1 of 2

দ্য অ্যাঞ্জেল অব দ্য অড

দ্য অ্যাঞ্জেল অব দ্য অড

নভেম্বরের এক বিকেল।

নভেম্বরের শীতের এক বিকেল।

এইমাত্র আহার সেরে উঠেছি। খাদ্যবস্তুর মধ্যে প্রধানতম ছিল ক্ৰফে নামক ছত্রাকের একটা তরকারি। পেটের রোগীদের উপযুক্ত খাদ্য।

আহার সেরে আমি একাই খাবার ঘরের চুল্লির ঢাকনার ওপর পা দুটো রেখে আয়েশ করে সময় কাটাতে লাগলাম। হাতের নাগালের মধ্যেই ছোট টেবিলটার ওপর হরেক রকম মদের বোতল সাজানো রয়েছে।

সকাল থেকে একে একে টাকারম্যান লিখিত সিসিল, গ্রিসওল্ড লিখিত পুরাকীর্তিকথা, গ্লোভার লিখিত লিওনিডাম আর উইল্কির, এপিগোনিয়াড প্রভৃতি বই পড়ে কাটিয়েছি। তাই নির্দিধায় মেনে নিচ্ছি নিজেকে এখন যেন কেমন বোকা হাদা মনে হচ্চে। একটু পওে পরে লাফিও দিয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিয়েছি, মনে-প্রাণ সতেজও করে নিয়েছি বটে।

না, লাফিও থেকে কোনো ফল পেলাম না। তাই হতাশ হয়ে হাত বাড়িয়ে একটা সংবাদপত্র টেনে নিলাম।

একের পর এক পাতা উলটে কুকুর বেপাত্তা, বাড়ি ভাড়া, শিক্ষানবীশ ও পত্নীদের বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ প্রভৃতি ব্যাপার-স্যাপারে চোখ বুলিয়ে সম্পাদকীয় পাতাটা খুললাম। আগোগোড়া পড়ার পর একটা বর্ণও বুঝতে না পেরে ভাবলাম, চীনা ভাষা। আবার গোড়া থেকে শেষ অবধি পড়েও তেমন ফল হলো না।

শেষপর্যন্ত আমার মধ্যে বিরক্তি জাগল। বিরক্তিবশত হাতের কাগজ ছুঁড়ে ফেলে দিতে গিয়ে থমকে গেলাম। আসলে নিচের লেখাটুকুর দিকে চোখ পড়তেই সেটাকে ফেলে দেওয়া সম্ভব হলো না।

মৃত্যুর উপায় অদ্ভুত এবং অগণিত। লন্ডন থেকে প্রকাশিত একটা খবরের কাগজে একটা বিচিত্র মৃত্যুর কথা ছাপা হয়েছে। লোকটা ফু-র সাহায্যে তীর ছোঁড়ার খেলায় মেতেছিল। খেলার পদ্ধতিটা হচ্ছে বেশ লম্বা একটা সুঁচের ছিদ্রে পশমের সূতো পরিয়ে সজোরে ফুঁ দিয়ে টিনের একটা নলের ভেতর দিয়ে বের করে লক্ষ্যভেদ করতে হবে।

খেলাটা বাস্তবিকই অত্যক্তৃত, তাই না? যা-ই হোক, খেলা শুরু হল, লোকটা ভুল করে বিপরীত দিকে সঁচটাকে রাখল। এবার সঁচটার গতি যাতে তীক্ষ্ণতর হয় সে জন্য ফুসফুস ভরে শ্বাস নিতে গিয়েই প্রমাদটা ঘটল। সূঁচ দ্রুত তার গলার ভেতরে ঢুকে গেল। মুহূর্তের মধ্যে সেটা গলার ভেতর দিয়ে সরাসরি ফুসফুসে হাজির হয়। ব্যস, মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই তাকে দুনিয়ার খেলা শেষ করে পরলোকে চলে যেতে হয়।

লেখাটা পড়া শেষ করেই আমি বিষণ্ণমুখে খবরের কাগজটাকে চোখের সামনে থেকে সরিয়ে ফেললাম। আসলে কাহিনীটা পড়ার পরই আমি রাগে ভেতরে ভেতরে দারুণ ফুঁসতে লাগলাম।

কেন যে আমার মধ্যে এমন আকস্মিক ক্রোধের সঞ্চার ঘটল তা আমারই জানা নেই, অন্য কাউকে বলার তো প্রশ্নই ওঠে না।

আমি হাতের কাগজটাকে সজোরে টেবিলে ছুঁড়ে মেরেই গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠলাম–মিথ্যা কথা! নির্ভেজাল মিথ্যো কথা! লোককে বোকা হদা বানাবার ফন্দি ছাড়া আর কিছুই নয়। অন্য যে নিরেট বোকা পাঠকদের মনে চমক লাগিয়ে দিতে পারলেও আমার মতো বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ পাঠককে এমন একটা মনগড়া অদ্ভুত কাহিনী দাঁড় করিয়ে ধাপ্পা দেওয়া এত সহজ নয়।

মনে পুঞ্জিভূত ক্রোধটুকু অব্যাহত রেখে আমি আবার ক্রোধে স্বগতোক্তি করতে লাগলাম। এবার থেকে বিচিত্র বা অদ্ভুত শিরোনাম দেওয়া কোনো কাহিনীর দিকে আমি কোনোদিন ভুলেও ফিরে তাকাব না। কোনো সাংবাদিক এমন কোনো কাহিনী কানের কাছে ফিসফিস করে বললেও বিশ্বাস করব না, কোনোদিনই না।

হায় ঈশ্বর। হায় পোড়া কপাল, তুমি তবে কী বোকার মতো কথাটাই না বলে ফেললে।–কথা গোপন অন্তরাল থেকে এমন মিষ্টি মধুর কণ্ঠে উচ্চারিত হলো যা এর আগে কোনোদিনই শুনিনি। কথাটা শোনামাত্র আমার মনে কেমন খটকা লাগল, গোড়ার দিকে আমার মনে হল, আমার শোনারই ভুল, নুতবা কানে কোনো ভোঁ ভোঁ শব্দ করছে বলেই এমনটা বোধ হচ্ছে।

পরক্ষণেই নিজের মনের সঙ্গে দীর্ঘসময় ধরে বোঝাপড়া করার পর আবার ভাবলাম, তা-ই যদি হয় তবে এমন অর্থপূর্ণ কথাই বা কি করে সম্ভব। তাই ঘরে কে ঢুকেছে তা দেখার জন্য ঘাড় ঘুরিয়ে বার বার ঘরটার চারদিকে অনুসন্ধিৎসু নজরে তাকিয়ে নিলাম। ঘরে কেউ ঢুকেছে কি না তার আড়চোখে দেখে নেওয়াই আমার উদ্দেশ্য। না, কারও নজরে পড়ল না। নিঃসন্দেহ হলাম, কেউ নেই, আমার কাজের সাক্ষী কেউ নেই।

উফ! একটু আগে শোনা সে কণ্ঠস্বর।

সেই অবিশ্বাস, একেবারেই বিচিত্র যে কণ্ঠস্বরেই কে যেন এবার চঞ্চল–তুমি দেখছি মদের নেশায় শুয়োরের মতো একেবারে কুঁদ হয়ে রয়েছে হে! আমি তোমার পাশে, ধরতে গেলে প্রায় গা-ঘেঁষেই বসে তবু আমার অস্তিত্বই অনুভব করতে পারছ না? এ কী অবাক কাণ্ড হে?

তার কথাটা শেষ হতে না হতেই আমি চোখ তুলে সরাসরি তার মুখের দিকে তাকালাম। সম্পূর্ণ সত্য যে, আমার মুখোমুখি লোকটা অবস্থান করছে সেও দেখতে অদ্ভুত, বাউণ্ডুলে প্রকৃতির হলেও কিম্ভুতকিমাকার, ভাষায় বর্ণনা করা একেবারেই অসম্ভব নয়।

তার শরীরটার বিবরণ দিতে গিয়ে বলা যেতে পারে যে একটা মদের গ্লাস, একটা মদের নল, নইলে ওরকমই কিছু একটা, আরও যথাযথভাবে বলতে গেলে লোকটার চেহারার তুলনা একমাত্র ফলস্টাফের সঙ্গেই চলতে পারে। নিচের দিকে দুটো খিল… লাগিয়ে নেওয়া হয়েছে, যা দিয়ে পায়ের অভাব পূরণ করা যেতে পারে।

আর হাত? শরীরের কাঠামোর ওপর থেকে দুটো লম্বা, বোতল দুপাশে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর তার মাথা? দেহখাঁচার ওপরে একটা মদের পেয়ালার ওপর পুরু করে বস্তা জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আর নস্যির বড় কৌটোর মতো দুটো ছিদ্র মুখের দুপাশে করে দেওয়া আছে। আর সে ছিদ্র দুটো আমার দিকেই অবস্থান করছে। যা কিছু শব্দ উচ্চারিত হয়ে আমার শ্রুতিগোচর হচ্ছে সবই কিন্তু ওই ছিদ্র দুটো দিয়েই বেরিয়ে আসছে। আর সে শব্দ দুটো দিয়ে যেসব কথা বেরিয়ে আসে সবই সহজবোধ্য বলেই তার বিশ্বাস।

অবিশ্বাস্য বিচিত্র মূর্তিটা একই দুর্বোধ্য, অবোধ্যও বলা চলে। এবার বলল আমি তো তোমার ব্যাপার স্যাপার দেখে বড়ই অবাক হচ্ছি হে!

আমি মুখ তুলে তার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম।

সে আগের মতো চোখে মুখে বিস্ময়ের ছাপ একে বলতে লাগল–ধ্যুৎ! তুমি দেখছি, হাঁসের মতোই বোকা হাঁদা হে!

আমি তার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধই রাখলাম।

সে আগের কথার জের টেনে বলল–শোন, তুমি যদি নিছকই একটা বোকা না হতে তবে কী খবরের কাগজের পাতায় যে বক্তব্য ছাপা হয়েছে তাতে অবিশ্বাস করতে। আমার কথা শোন, ওসব সত্যি, সবই শতকরা একশো ভাগই সত্যি।

তার কথায় আমি কিছুটা হকচকিয়ে গেলেও কণ্ঠস্বরে গাম্ভীর্য এনেই বললাম–তুমি কে হে? কি তোমার পরিচয়?

সে কিছু বলল না। আসলে আমি তাকে কিছু বলার জন্য উপযুক্ত সময় না দিয়ে আমিই আবার বলতে লাগলাম আর তুমি এখানে ঢুকলেই বা কি করে তা-ও তো আমার মাথায় আসছে না। আর তুমি কি যে বলতে চাচ্ছ মথামু কিছু বুঝছি না। তুমি এখানে ঢুকলে কি করে এ মুহূর্তে এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।

আমার কথা শেষ হতেই মূর্তিটা আগের মতোই দুর্বোধ্য শব্দ ব্যবহার করে কি যেন বরে আমার কথার উত্তর দিল–শোন হে, আমি এখানে কিভাবে ঢুকেছি তা নিয়ে। তো হেতামার মাথাব্যথা হওয়ার কথা নয়। আর এটাও শুনে রাখ, আমি কি বলব আর বলবনা তা-ও তোমার ব্যাপার নয়। পুরোপুরি আমার, নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।

আমি তার চাছালোলা কথাগুলো শুনে সবিস্ময়ে তার মুখের দিকে নীরবে তাকিয়ে রইলাম।

সে আমাকে একই রকম অবাক করল–আমার সাফ কথা তুমি শুনে রাখ, আমার মন যা চায় তা-ই আমি বলতে পারি। আর বলবও ঠিক তা-ই। আর আমার পরিচয়, মানে আমি কে, তাই তো তুমি জানতে চাইছ, ঠিক কি না?

আমি নীরবে মাথা ঝাঁকালাম।

সে বলেই চলল–আমার পরিচয় মুখ ফুটে নাই বললাম। একটু পরেই আমার পরিচয় তুমি স্বচক্ষেই চাক্ষুষ করতে পারবে। আর সে জন্যই আমি এখানে হাজির হয়েছি, বুঝলে?

আমি নির্দিধায় বললাম–তুমি একটা আস্ত মাতাল। একজন পয়লা নম্বরের ছন্নছাড়া বাউণ্ডুলে। আমি এখনই ঘণ্টা বাজিয়ে আমার পরিচারককে ডাকব। তাকে বলব, যেন লাথি মেরে তোমাকে সদর দরজার বাইরে, একেবারে রাস্তায় পৌঁছে দিয়ে আসে।

হতচ্ছাড়া আগন্তুকটা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হো-হো করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতেই বলল–আমি ভালোই জানি এ তোমার কর্ম নয়। তুমি পারবে না, কিছুতেই না।

আমি ভ্রূ কুঁচকে বললাম–কী বললে, পারব না!

অবশ্যই না। বললামই তো তুমি ও কাজ কিছুতেই করতে পারবে না।

কী পারব না? আমি কি করতে পারব না? তুমি কী বলতে চাইছ? সাক্ষাৎ শয়তানের মতো ফিকফিক করে হেসে সে এবার বলল–ওই কাজ, মানে ঘণ্টাটা বাজাতে পারবে না?

তার কথাটা শুনেই আমি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করলাম।

কিন্তু হতচ্ছাড়াটা আমাকে কিছুতেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দিল না। আমি চেয়ারের আশ্রয় ছেড়ে ওঠার চেষ্টা করা মাত্র সে তার শক্ত বোতলের হাত দিয়ে আমার কপালে আচমকা এমন সজোরে একটা আঘাত হানলো যার ফলে আমি আবার ধপাস করে চেয়ারটার ওপর বসে পড়লাম।

তার কাণ্ড দেখে আমি কপালের ব্যথা-বেদনার কথা ভাবার অবকাশই পেলাম না। এতই অবাক হলাম যে, হঠাৎ করে বুঝে উঠতে পালাম না এ মুহূর্তে আমার কর্তব্য কি?

আমি মুখ খোলার আগেই লোকটা বিশি স্বরে হেসে বলল কি হে, ব্যাপারটা তো নিজের চোখেই দেখলে। এখন যা বলছি, লক্ষ্মী ছেলের মতো শোন, এখানে চুপটি করে বসে থাক। এবারই জানতে পারবে, আমি কে–কি আমার পরিচয় কী?

আমি তার দিকে নীরব চাহনি মেলে তাকিয়ে রইলাম। সে বলেই চলল–আমার পরিচয় জানতে চাইছ, তাই না? ভালো কথা, আমার দিকে তাকাও। হ্যাঁ, তাকাও দেখ! আমিই কদাকার অদ্ভুত দেবদূত।

আমি বুকে সাহস সঞ্চয় করে বলে উঠলাম–হ্যাঁ, রীতিমত বটে! তুমি নিজেকে দেবদূত বলে পরিচয় দিচ্ছ? দেবদূতের একজোড়া পাখা থাকে বলেই তো আমি জানতাম।

পাখা! ডানা! রেগে একেবারে আগুন হয়ে গিয়ে সে এবার খেঁকিয়ে উঠল– আমার ডানার কি দরকার হে! হায় ঈশ্বর! হায় আমার কপাল! তুমি কী ভেবেছ, আমি একটা মুরগির ছানা? আমার সম্বন্ধে তোমার ধারণাটা কী খোলসা করে বলতো?

আমি ভয়ে মুখ কাচুমাচু করে আমতা আমতা করতে লাগলাম–আরে না, না, তুমি অবশ্যই মুরগির ছানা নও। তোমার সম্বন্ধে আমি ভুল ধারণা করেছি।

বহুৎ আচ্ছ। তাই যদি হয় তবে চেয়ারটায় চুপটি করে বসে থাক। আর কথা বলার সময় আগপাছ চিন্তা করে তবেই কথা বলবে, বুঝলে বাছাধন। আর যদি হম্বিতম্বি করার চেষ্টা কর তবে আবার এমন এক ঘা বসিয়ে দেব যে, একেবারে দফা রফা হয়ে যাবে।

আর কিছু বলার মতো সাহস আমার হলো না। বাধ্য হয়েই মুখে কুলুপ এঁটেই বসে রইলাম।

সে আগের মতো ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল–শোন আহাম্মক, পেঁচার ডানা লাগে, মুরগির ডানা লাগে আর ডানা দরকার হয় ক্ষুদে শয়তানের, ঠিক কিনা? দেবদূতের ডানা অবশ্যই থাকে না, আর আমি যে কিম্ভুতকিমাকার দেবদূত হে।

আমি ভয়ে ভয়ে হাত কচলে বললাম। বেশ তো, কিন্তু তুমি এখানে, আমার এখানে হানা দিয়েছ কেন? কোন দরকারে।

আমার মুখের কথা কেড়েনিয়ৈ আগন্তুক বলল–দরকার, কি কাজ? কি দরকারে? তুমি যে কী নিচ কূলের লোক তা ভেবে আমি অবাক হচ্ছি যে, একজন বিশিষ্ট ভদ্রলোককে অর্থাৎ এক দেবদূতকে জিজ্ঞেস করছ, এখানে কোন্ কাজে এসেছে। তুমি কেমন নিচ বংশোদ্ভুত এবং এক আহম্মক হে!

সত্যি বলছি, আগন্তুক দেবদূত হলেও তার কথাগুলোকে আমি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারলাম না, বরং আসহ্যই মনে হলো। ক্রোধ সম্বরণ করতে না পেরে হাতের কাছে লবনের পাত্রটা পেয়ে সেটাকে যন্ত্রচালিতের মতো তুলে নিয়ে তার কপাল বরাবর ছুঁড়ে মারলাম। এমনও হতে পারে, আমার লক্ষ্য ঠিক ছিল না, নতুবা সে তড়াক করে একদিকে সরে গিয়েছিল। তাই লবনের পাত্রটা ছুটে গিয়ে দুম করে ম্যান্টেল পিসের ওপর রাখা ঘড়িটার গায়ে আঘাত হানলো যার ফলে মুহূর্তে তার ডায়ালটা ভেঙে গেল।

আগন্তুক দেবদূতের বদলা নিতে ছাড়ল না। সে আমার কপালে বোতল হাত দিয়ে দমাদম কয়েক ঘা হেঁকে দিল।

আঘাতের চোটে আমি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে গেলাম। বরং বাধ্য হলাম বলাই উচিত। স্বীকার করতে লজ্জায় মরে যাচ্ছি, বিরক্তিবশতই হোক, আর যন্ত্রণাতেই হোক, আমার চোখে দুটোর কোণে পানি ভিড় করল, কয়েক ফোঁটা পানি গলা দুটো বেয়ে মাটিতেও পড়ল।

আমার বেহাল পরিস্থিতি দেখে কদাকার দেবদূত সহানুভূতির স্বরে অনুচ্চকণ্ঠে বলল–হায় ঈশ্বর! লোকটা হয় অনেক দুঃখ-যন্ত্রণায় ভূগেছে, নতুবা গলা অবধি মদ গিলে একেবারে বে-হেড হয়ে গেছে।

মুহূর্তের জন্য থেমে আমাকে লক্ষ্য করে সহানুভূতির স্বরে এবার বলল শোন হে, এত কড়া মদ কেন যে গিলতে যাও, ভেবে পাই না। একটু পানি ঢেলে হালকা করে নিলেই তো পার। এই নাও, ভালো ছেলের মতো এটা খেয়ে ফেল। কান্না থামাও। এটা খেয়ে নাও।

কথা বলতে বলতে কদাকার অদ্ভুতদর্শন দেবদূত তার বোতল-হাত থেকে কিছুটা বর্ণহীন তরল পদার্থ আমার মদের গ্লাসে ঢেলে দিল।

সে বোতলটা সামান্য কাৎ করতেই তার গায়ে সাটা একটা লেবেল আমার নজর এড়াল না। তাতে বড়-বড় হরফে লেখা রয়েছে–কার্যওয়াসার কথাটা।

আগন্তুক বিচিত্র দেবদূতের মমত্ববোধ আমাকে মুগ্ধ করল। ফলে আমার ক্রোধ অনেকাংশে লাঘব হয়ে গেল। আর আমার মদের গ্লাসে একাধিকবার পানি মিশিয়ে দিয়েও সে মন জয় করে নিল। ফলে আমার মন মেজাজ স্বাভাবিক হয়ে এলো। এবার সে যে অসাধারণ একটা ভাষণ দিল তা-ও আমি মন দিয়ে শুনলাম। সে যে কি বলল, তা পুরোপুরি বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে যেটুকু হৃদয়ঙ্গম করতে পারলাম তা হচ্ছে, সে হচ্ছে একজন অশুভ শক্তির সাক্ষাৎ-নিয়ন্তা। আর সে এসব বিচিত্র দুর্ঘটনায় লিপ্ত থাকে যা নাস্তিকদের মনে বিস্ময় জাগিয়ে তোলে, অস্থির করে ফেলে।

আমি তার কথা অবিশ্বাস করায়, তার কাজে বাধা সৃষ্টি করায় সে চটে এমন রুদ্রমূর্তি ধারণ করল যাতে শেষপর্যন্ত আমি ঘাবড়ে গিয়ে সামলেসুমলে নিতে বাধ্য হলাম। আর সে-ও মওকা পেয়ে এক নাগাড়ের বকবকানি শুরু করে দিল। রীতিমত কথার ফুলঝুরি।

তার ভাষণ চলতেই লাগল। আমি কোনোরকম বাধা না দিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে পরমানন্দে এলাচি চিবুতে ব্যস্ত রইলাম।

কিন্তু আমার এ আচরণটা দেবদূতের পছন্দ হলো না। সে হঠাত্র রেগে একেবারে অগ্নিমূর্তি ধারণ করল। রাগ সামলাতে না পেরে সে দুহাতে নিজের চোখ দুটো ঢেকে মোক্ষম একটা অভিশাপ আমাকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিল। আর রাগে কাঁপতে কাঁপতে এমন ভাষায় আমাকে শাসাল, ভয় দেখাল যে তার অর্থ একটা বর্ণও আমি বুঝতে পারলাম না।

শেষপর্যন্ত অদ্ভুতদর্শন দেবদূত নতজানু হয়ে আমাকে অভিবাদন জানিয়ে আর্চবীশপ জিল-ব্লাসের ভাষায় আমার মঙ্গল কামনা করল। আমার কাছ থেকে হাসিমুখে বিদায় নিয়ে পথে নামল।

আমি কিন্তু এতে তেমন খুশি হতে পারলাম না। বরং সে চলে যাওয়ায় আমি কেমন একটা অবর্ণনীয় অস্বস্তিই বোধ করতে লাগলাম।

পর পর কয়েক গ্লাস মদ উদরস্থ করায় শরীরে ঝিমুনি অনুভব করলাম। ঘুমে চোখের পাতা দুটো জড়িয়ে আসতে লাগল। ফলে ঘুমিয়ে পড়লাম।

মিনিট পনের-বিশ ঘুমিয়ে নিলাম।

ছয়টায় এক জায়গায় আমার যাবার কথা। খুবই জরুরি দরকার। যত অসুবিধাই থাক না কেন যেতে আমাকে হবেই। আমার বসতবাড়ির বীমার পলিসির মেয়াদ গতকাল শেষ হয়ে গেছে। এ নিয়ে কিছু গোলযোগের সূত্রপাত হয়েছে। তাই কথা বলে স্থির করেছি ঠিক ছয়টায় কোম্পানির বোর্ড অব ডিরেক্টরদের সঙ্গে দেখা করে আমি বীমার পলিসি নবীকরণ করিয়ে নেব।

ঘাড় ঘুরিয়ে ম্যান্টেলপিসের ওপরে রক্ষিত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বুঝে নিলাম, এখনও পঁচিশ মিনিট সময় হাতে আছে।

এখন পাঁচটা ত্রিশ মিনিট। হেঁটে মাত্র পাঁচ মিনিটে বীমা কোম্পানির দপ্তরে পৌঁছে যেতে পারব। আর আমার দিবান্দ্রিা কোনোদিনই পঁচিশ মিনিটের বেশি স্থায়ী হয় না। তাই খুবই নিশ্চিতে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। উদ্দেশ্য ঘুম থেকে উঠেই বীমা কোম্পানির দপ্তরের উদ্দেশ্যে হাঁটা জুড়ব।

হঠাৎ আমার ঘুম চটে গেল। হুড়মুড় করে উঠে বিছানায় উঠে পড়লাম। ঘড়িটার দিকে চোখ পড়তেই অবাক হয়ে গেলাম। দেখলাম মাত্র তিন মিনিট আমি ঘুমিয়েছি। কারণ আমার হাতে এখনও সাতাশ মিনিট সময় রয়ে গেছে। অবাক হবার মতো ব্যাপারই বটে, মনে হলো বেশ কিছু সময় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলাম। কিন্তু কার্যত দেখা যাচ্ছে, মাত্র তিন মিনিট আমি ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। আবার বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলাম। অচিরেই ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম।

দ্বিতীয় বার যখন ঘুম ভাঙল তখন ঘড়ির দিকে চোখ ফিরিয়েই সচকিত হয়ে বিছানায় সোজা হয়ে বসে পড়লাম। দেখলাম সাড়ে সাতটা বাজে।

ঘড়িটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই স্বগতোক্তি করলাম–সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। এখন না গিয়ে কাল সকালে বীমা কোম্পানির দপ্তরে গিয়ে বিলম্বের জন্য

মার্জনা ভিক্ষা করেনিলেই ল্যাঠা চুকে যাবে। কিন্তু ব্যাপারটা কেমন হলো। ঘড়িটা কোনো-না-কোনোভাবে বিকল হয়ে যায়নি তো? খাট থেকে নেমে ম্যান্টেলপিসের ওপর থেকে ঘড়িটাকে নামিয়ে আনলাম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে সহজেই নজরে পড়ল, মেওয়া খাওয়ার সময় তার খোসাগুলো ঘরের মেঝেতে ফেলেছিলাম। তাদেরই একটা কণা বাতাসে উড়ে গিয়ে কাঁচের ফাঁক দিয়ে ডায়ালে ঢুকে গিয়ে মিনিটের কাঁটাটার গতি রোধ করে দিয়েছে। ফলে সেটা সে মুহূর্ত থেকেই একই জায়গায় থমকে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

আপন মনেই বলে উঠলাম–ধ্যুৎ! এ ব্যাপার। একে নিছকই একটা অঘটন বলা যায়। এরকম ব্যাপার তো যে কোনো মুহূর্তেই ঘটতে পারে।

ঘড়ির ব্যাপারটাকে সামান্যতম আমল না দিয়ে আমি আবার বিছনায় কাৎ হয়ে পড়লাম।

হাত বাড়িয়ে শিয়য়ের কাছে ছোট পড়ার টেবিলটায় একটা মোমবাতি জ্বালালাম। এবার ঈশ্বর সর্বভূতে বিরাজমান বইটা টেনে নিলাম। বইটাকে খুলে চোখের সামনে ধরলাম। কিন্তু বেশিদূর অগ্রসর-হওয়া সম্ভব হলো না। আমি বিশ সেকেন্ডের মধ্যেই ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম। মোমবাতিটা জ্বলেই চলল।

কখন যে আমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম বলতে পারব না। তবে এটুকু অন্তত বলতে পারি, ঘুমিয়ে পড়ার অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই যে বিচিত্র দেবদূত বার বার আমার সামনে হাজির হতে লাগল।

সত্যি বলছি, আমার যেন পরিষ্কার মনে হলো সে যেন কোচের নিচে দাঁড়িয়ে থেকে হাত-বাড়িয়ে আমার মশারিটা সামান্য ফাঁক করল। মদের বোতল খালি আর আমি যে তার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতে গিয়ে চোখ-মুখ বিকৃত করে বিরক্তিকর শব্দ করেছিলাম, সে এখন তারই বদলানিচ্ছে।

আমি তার উদ্দেশ্য বুঝতে না বুঝতেই সে ঝট করে আমার মাথার ছড়ানো টুপিটাকে খুলে ফেলে দিল। আমি তো ব্যাপার দেখে ভিরমি খাওয়ার জোগাড় হলাম।

আমি আরও অবাক হলাম যখন দেখলাম, আমার গলার ভেতর দিয়ে একটা নল গলিয়ে দিয়ে তার বগলের নিচে ঝুলিয়ে রাখা বোতল থেকে কার্থওয়াসার বের করে আমার পাকস্থলিটাকে কানায় কানায় ভরে দিল। আমি সে বিশেষ পানীয়টার স্রোতে ভেসে যাওয়ার উপক্রম হলাম।

আমি যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলাম। আমার যন্ত্রণা যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল, তখন আচমকা আমার স্বপ্ন ভেঙে গেল। ঘুম ভেঙে যাওয়ায় আমিনিদারুণ

অস্থিরতার শিকার হয়ে যন্ত্রচালিতের মতো দ্রুত বিছানার ওপর বসে পড়লাম।

জ্বলন্ত মোমবাতিটার দিকে চোখ পড়তেই আমি যারপরনাই অবাক হয়ে পড়লাম। দেখলাম, একটা ইঁদুর জ্বলন্ত মোমবাতিটাকে দাঁত কামড়ে ধরে পালাতে গিয়ে অঘটনটা ঘটিয়েছে।

মুহূর্তের মধ্যেই দম বন্ধকরা একটা উৎকট গন্ধ আমার নাকের ভেতর দিয়ে সোজা ফুসফুসে ঢুকে গেল। খুবই অস্বস্তির মধ্যে পড়লাম।

অস্থিরভাবে খাট থেমে নেমে খোলা জানালা দিয়ে বার কয়েক এদিক-ওদিক চোখ ঘোরাতেই বুঝতে পারলাম, বাড়িতে আগুন লেগে গেছে। মিনিট কয়েকের মধ্যে বাড়ির সর্বত্র দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে লাগল। সম্পূর্ণ বাড়িটাই জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে।

আমি উন্মাদের মতো চারদিকে তাকিয়ে পরিস্থিতিটা সম্বন্ধে আঁচ করে নিতে গিয়ে নিঃসন্দেহ হলাম, জানালা ছাড়া অন্য কোনো পথেই আমার পক্ষে ঘরটা থেকে বেরনো সম্ভব নয়।

তবে পরমুহূর্তেই দেখতে পেলাম, পল্লীবাসীরা লম্বা একটা মই জোগাড় করে এনে আমার জানলায় রাখল।

মইটা জানালায় লাগতে না লাগতেই আমি উম্রান্তের মতো মইটার দিকে ছুটে গেলাম। মুহূর্তমাত্র সময় নষ্ট না করে সেটা বেয়ে তর তর করে নিচে নেমে যেতে লাগলাম।

মইটা বেয়ে আমি কিছুটা নেমে যেতেই হঠাৎ একটা নাদুসনুদুস শুয়োরকে দেখে থমকে গেলাম। তার ইয়া মোটা পেট আর দৈহিক গঠন দেখেই প্রথমেই যার কথা আমার মনে পড়ল–সে আর কেউ না ওই অদ্ভুত দেখতে দেবদূত।

বিশালদেহী শুয়োরটা পানি-কাদার মধ্য থেকে উঠে ঘোৎ ঘোৎ করতে করতে এসে আমার মইটার গায়ে পরম আনন্দে গা ঘষতে আরম্ভ করল। ব্যাপার দেখেই তো আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে পড়ার জোগাড় হলো। মিনিট খানেকের মধ্যেই প্রমাণ হয়ে গেল, আমার ভীতিটা অমূলক নয়। বরং যা আশঙ্কা করেছিলাম, কার্যত ঘটলও ঠিক তাই। মইটার সঙ্গে আমিও হুড়মুড় করে পথে আছাড় খেয়ে পড়ে গেলাম। ব্যস, যা ঘটার ঘটে গেল। আমার একটা হাত ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।

এবার আমি বাস্তবিকই মহাফাপড়ে পড়ে গেলাম। বীমার জন্য ক্ষতি, মাথার সব চুল পুড়ে ছাই হয়ে যাবার জন্য ক্ষতি–বাস্তবিকই দুর্ঘটনাটা আমাকে দুর্ভাবনার সাগরে ছুঁড়ে দিল। আর আমি বে-সামাল পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে রীতিমত খাবি খেতে লাগলাম।

কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হয়ে হাপিত্যেশ করতে করতে আমি মনস্থির করে ফেললাম, এবার একটা সহধর্মিনী গ্রহণ না করলে আর চলছে না।

আমার পরিচিত গণ্ডির মধ্যেই এক বিধবা অপরূপ সুন্দরি–অকালে স্বামী রত্নটাকে খুইয়ে বড়ই মর্মপীড়ার মধ্যে দিনাতিপাত করছেন। এক নজর তাকে দেখলেই শরীর ও মন রোমাঞ্চে ভরে ওঠে।

আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, যাকে প্রতিজ্ঞাও বলা চলে–সে রূপসি যুবতি বিধবাটার ক্ষতস্থানে যেন শান্তির প্রলেপ দিয়ে দিল।

আমি সদ্য স্বামীহারা সে বিধবা যুবতির কাছে আমার অভিলাষের কথা ব্যক্ত করতেই সে বার কয়েক আমতা আমতা করে হলেও শেষমেশ আমার টোপটা গিলল। আমার প্রস্তাবে পুরোপুরি মতো দিয়ে দিল।

আমার আকাঙ্ক্ষিতার সম্মতি পাওয়ায় আমি যেন আকাশের চাঁদকে হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়ে গেলাম। মহাবিস্ময় ও পুলকানন্দে স্তবস্তুতি করতে করতে আমি সটান তার পায়ের কাছে পড়ে গেলাম।

আমার অবস্থা দেখে তিনি লজ্জায় মিইয়ে গিয়ে নিজের কালো চুলের গোছাটা দিয়ে আমার মাথার ধার করা পরচুলোকে ঢেকে দিল।

ব্যাপারটা যে কিভাবে ঘটেছিল তা আমার পক্ষে বলা বাস্তবিকই কঠিন। আমি যখন উঠে সোজাভাবে দাঁড়ালাম তখন দেখলাম অত্যাশ্চর্য, একেবারেই অবিশ্বাস্য এক কাণ্ড! আমার মাথার পরচুলা যেন ভোজবাজির মতো কোথায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আর সে জায়গায় রয়েছে কুচকুচে কালো চুল।

আর সে বিধবা যুবতি? তিনি মাথার অর্ধেকটা অন্যের চুলে ঢাকা রয়েছে। আর তা দেখেই তিনি সক্রোধে রীতিমত হম্বিতম্বি শুরু করে দিলেন। রাগে, ঘৃণায় আর অপমানে তার সর্বাঙ্গ থরথরিয়ে কাঁপছে।

ব্যস, বিধবা যুবতিটাকে সহধর্মিনী হিসেবে পাওয়ার আকাঙ্খটা এভাবেই এমন একটা অঘটনের মাধ্যমে চিরদিনের মতো নিঃশেষ হয়ে গেল। যাকে একেবারেই অভাবনীয় ছাড়া কিছুই ভাবা সম্ভব নয়।

তবে এও সত্য যে, স্বাভাবিক কার্য-কারণের ব্যাপারটা ঘটেছিল।

আমি কিন্তু এতেই হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিলাম না, বরং তার চেয়ে কম নির্মম, নিষ্ঠুর কোনো এক নারীকে পটিয়ে আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন্য আদাজল খেয়ে লেগে গেলাম।

এবারও গোড়ার দিকে আমার ভাগ্য খুলে গেল বলেই মনে হলো। ধরেই নিলাম এবার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবেই হবে। কিন্তু অচিরেই খুবই সাধারণ একটা ঘটনা প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াল।

আমার বাঞ্ছিতা, আমার বাগদত্তাকে শহরের গণ্যমান্য লোকের মেলায় হঠাৎ দেখতে পেয়েই আমি তাকে অভিবাদন জানাবার জন্য ব্যস্তপায়ে ছুটে গেলাম। উভ্রান্তের মতো একে ঠেলে, ওকে ধাক্কা মেরে তার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ানো মাত্র আচমকা কি যেন একটা বস্তু, উড়ে এসে আমার চোখে পড়ল। ব্যস, মুহূর্তের মধ্যেই আমি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে একেবারে অন্ধ হয়ে গেলাম।

আমি অস্থিরভাবে চোখ ডলাডলি করে দৃষ্টিশিক্ত ফিরে পাওয়ার অনেক আগেই আমার মনের মানুষটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল।

আমার আকস্মিক ও ক্ষণিকের দৃষ্টিহীনতাকে পূর্বপরিকল্পিত চক্রান্ত জ্ঞান করে আমি বড়ই মর্মাহত, ক্ষুব্ধও কম হইনি।

আমি আকস্মিক অভাবনীয় ব্যাপারটায় এমনই স্তম্ভিত হয়ে পড়লাম যে, আমার জ্ঞানবুদ্ধি যেন নিঃশেষে আমার মধ্য থেকে উবে গেছে।

আমার অন্ধত্ব কিন্তু তখনও নিমূর্ল হয়নি, কিছুই স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি না। ঠিক তখনই সে অদ্ভুতদর্শন দেবদূত যেন আমার চোখের সামনে এসে হাজির হলো।

আমি তখনও চোখের সমস্যা নিয়ে নাজেহাল হচ্ছি। কিন্তু সে দেবদূত আমার সামনে উপস্থিত হয়েও এমন বিনয়ের সঙ্গে আমাকে সাহায্য করতে আগ্রহ প্রকাশ করল, যা আমার কাছে নিতান্তই অপ্রত্যাশিত ছিল।

সে এগিয়ে এসে আমার একেবারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ল। মুহূর্তের মধ্যে আমার চোখের পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ সেরে ফেলল। এবার খুবই সতর্কতার সঙ্গে তার কাছে থেকে কী যেন একটা বস্তু বের করে আনল। তার সহানুভূতি আমাকে বাস্তবিকই অবর্ণনীয় স্বস্তি দান করল।

না, খুব হয়েছে ভাবলাম, ভাগ্য যখন এতই মন্দ তখন আর ধরে প্রাণটাকে মিছে জিইয়ে রেখে ফায়দাই বা কি? এর চেয়ে বরং মরে যাওয়াই অনেক, অনেক ভালো।

আমি আত্মহত্যাকেই একমাত্র শান্তির পথ হিসেবে বেছে নিলাম। কিন্তু সেটা কিভাবে? নিজের মনের সঙ্গে দীর্ঘ বোঝাপড়ার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম, নদীর

জলে প্রাণ বিসর্জন দেওয়াই সহজতম উপায়। শেষপর্যন্ত নদীর পানিকেই শান্তির পথ। হিসেবে চূড়ান্তভাবে বেছে নিলাম।

এবার পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি গুটিগুটি অদূরবর্তী নদীটার দিকে হাঁটতে লাগলাম।

কিছুক্ষণের মধ্যেই নদীর পাড়ে পৌঁছে গেলাম। স্থানটা বড়ই নির্জন নিরালা। ধারে-কাছে তো নয়ই, এমনকি দূরেও কোনো মানুষজনের চিহ্নও দেখা যাচ্ছে না। ব্যস, মুহূর্তমাত্র সময় নষ্ট না করেই আমি ব্যস্ত-হাতে পোশাক-পরিচ্ছদ খুলে নদীর পাড়ে রেখে দিয়ে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র অবস্থায় আচমকা নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।

আগেই বলেছি, মানুষ জনের নামগন্ধও ধারে কাছে ছিল না। তাই গাছের ডালে বসে থাকা একটা কাক আমার এ-কাজের একমাত্র প্রাণবন্ত সাক্ষী রইল। হতচ্ছাড়াটা মদে ভেজানো শাকে উদর পূর্তি করে নেশার ঘোরে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

হায়! এ কী সর্বনাশা কাণ্ড রে বাবা? আমি পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ামাত্রই হতচ্ছাড়া পাখিটা আমার পোশাক-পরিচ্ছদের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় অংশটা ঠোঁটে কামড়ে ধরে উড়ে গেল। কেন যে সেটা এমন একটা কাজে উৎসাহি হয়ে পড়ল, তা আমি কিছুই বলতে পারব না।

তাই নিতান্ত নিরুপায় হয়েই আমাকে আত্মহত্যার ইচ্ছাটাকে তখনকার মতো শিকেয় তুলে রাখতে হলো। ব্যস্ত হয়ে পানি থেকে উঠে এসে শরীরেরনিম্নাংশকে কোটের মধ্যে ঢুকিয়ে কোনোরকমে লজ্জানিবারণ করে নচ্ছার শয়তান পাখিটার খোঁজে ছুটতে আরম্ভ করলাম।

কিন্তু অদৃষ্টের বিড়ম্বনাও আমাকে অনুসরণ করে চলল। আমি কাকটাকে আকাশের দিকে নিবদ্ধ রেখে উদ্ধশ্বাসে পোশাক-চোর ওই শয়তান পাখিটার পিছন পিছন ধেয়ে চললাম। এক সময় হঠাৎ আমার খেয়াল হলো মাটির সঙ্গে আমার পা দুটোর কোনো সম্পর্কই নেই, পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

আসল ব্যাপারটা হচ্ছে, উদ্রান্তের মতো ছুটতে ছুটতে আমি কখন যে পাহাড়ের ওপরে উঠে গিয়েছিলাম, বুঝতেই পারিনি। এর অনেক আগেই আমি আছড়ে পড়ে থেঁতলে যেতাম। অবশ্য ভাগ্যগুণে বাতাসের কাঁধে ভর করে ভাসমান একটা বেলুনের গা থেকে ঝুলন্ত দড়ি ধরে যদি ঝুলে পড়তে না পারতাম তবে আমার অবস্থা যে কি হতো তা ভাবলেই আমার অন্তরাত্মা শুকিয়ে আসতে লাগল।

ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই আমি গলা ছেড়ে চিৎকার করে মাথার ওপরের বেলুনটার চালককে লক্ষ্য করে আমার চরমতম দুর্গতির কথা জানোনোর জন্য প্রাণপণে চেষ্টা চালাতে লাগলাম। দীর্ঘসময় ধরে আমি বুককাঁপা চিৎকার করলাম। কিন্তু কোনো ফলই হলো না। এর দুটো কারণ হতে পারে। বোকাহাদাটা হয়তো আমার চিল্লাচিল্লি শুনতেই পায়নি। আবার এমনও হতে পারে, শয়তানটা সবকিছু শুনে বুঝেও আমার দিকে নজর দিতে উৎসাহি হলো না।

ইতিমধ্যে দৈত্যাকৃতি যন্ত্রটা খুবই তাড়াতাড়ি ওপরে উঠে যেতে লাগল। আর আমার শক্তি-সামর্থ্যও সে অনুপাতে কমে যেতে আরম্ভ করল। আমি উঠছি তো উঠছিই।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি হয়তো অদৃষ্টের কাছে আত্মসমর্পণ করে সমুদ্রের বুকে আছাড় খেয়ে পড়ে নিঃশব্দে ডুবেই যেতাম। ঠিক সে মুহূর্তে অকস্মাৎ আমার মাথার ওপর থেকে এর গম্ভীর ফাঁকা এক আওয়াজ বাতাসে ভেসে কানে এলো। আওয়াজটা কানে আসার পরই আমার মনোবল যেন হঠাৎ বেড়ে গেল। আচমকা ওপরের দিকে চোখ ফেরাতেই বিচিত্র সেই দেবদূত আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল।

দেখলাম, সে সুবিশাল আকাশযানটার ওপর থেকে ঝুঁকে, অদ্ভুতভাবে হাত দুটো ভাঁজ করে বসে রয়েছে। তার দুটো ঠোঁটের ফাঁকে একটা পাইপ আটকে রয়েছে। আর সেটা থেকে থেকে ধোয়া ছাড়ছে। মৌজ করে তামাকের সদ্ব্যবহার করে চলে।

তার ভাবগতিক দেখে মনে হল, এ পৃথিবীতে সে পরমানন্দেই দিন গুজরান। করছে।

আমি তখন কথা বলার শক্তিটুকুও হারিয়ে বসেছিলাম। তাই নিতান্ত অনন্যোপায় হয়েই চোখে-মুখে মিনতির সুস্পষ্ট ছাপ এঁকে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে মুহূর্তে তার করুণাই আমার একমাত্র ভরসা।

সে আমাকে জিজ্ঞাসা করল–তোমার কি নাম হে? আর তুমি কোন সাহসে এভাবে চলাফেরা করছ? কেনই বা তুমি এ অবস্থায় এখানে এসেছ, বলবে কী?

লোকটার নির্মম নিষ্ঠুর আচরণ আর বাহানার জবাবে আমার মাথায় একটা মাত্রই কথা বেরিয়ে এলো রক্ষা কর, বাঁচাও আমাকে।

আমার কথাটা শেষ হওয়ামাত্র সে যন্ত্রটার ভেতর থেকে কার্থওয়াসর-এর বড়সড়ও ভারি একটা বোতল ছুঁড়ে দিল। সেটা এসে দুম করে আমার মাথায় পড়ল। উফ! কী নিষ্ঠুর লোকটা। আর একটু হলেই আমার মাথাটাই ফেটে যেত। তার আচরণে বীতশ্রদ্ধ হয়ে আমি ধরে-থাকা দড়িটাই ছেড়ে দিতে চাইলাম।

আমার মনোভাব বুঝতে পেরে কে যেন চেঁচিয়ে বলল–আরে, করছ কী! করছ। কী! ভুলেও এমন কাজ করো না! দড়িটা শক্ত করে ধরে থাক, মাথা গরম করে এরকম চরম ভুল করতে যেয়ো না।

আমি তার কথার কি জবাব দেব ভেবে না পেয়ে কপালের চামড়ায় পর পর কয়েকটা ভাজ এঁকে নীরবে তাকিয়ে রইলাম।

সে বলে চলল–শোন, তোমার যদি আরও কাথওয়াসর-এর বোতল দরকার হয়ে থাকে বল, দিচ্ছি। কিন্তু দড়িটা যেন ভুলেও ছেড়ে দিও না। নাকি, একটাতেই তোমার কাজ মিটে গেছে? বিবেক বিচার-বিবেচনা বোধ ফিরে পেয়েছ? নাকি–

আমি মুখে কিছু না বলে ব্যস্তভাবে দুবার মাথা নাড়লাম। প্রথমবার মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিতে চাইলাম, এ মুহূর্তেরই আমার আর বোতল দরকার নেই। আর দ্বিতীয় বার হ্যাঁ সূচক, অর্থাৎ আমি বিবেক-চৈতনা ফিরে পেয়েছি। এবার দেবদূতের রাগ অনেককাংশে কমে গেছে বলেই মনে হলো।

দেবদূত আবার মুখ খুলল। সে এবার বেশ নরম গলায় আরও বেশি সহানুভূতি প্রকাশ করে বলল–তবে তুমি শেষপর্যন্ত মেনে নিচ্ছ যে, অদ্ভুত কাণ্ডও দুনিয়ায় ঘটে থাকে, কী বল?

আমি আবার মাথা নেড়ে তার কথার সম্মতি জানালাম। এবারও মুখে টু-শব্দটিও করলাম না।

এবার সে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল–তুমি তবে আমাকে না, মানে বিচিত্র দেবদূতকে বিশ্বাস করছ, তাই না?

আমি এবারও মুখে কিছু না বলে মাথা নেড়ে তার কথার জবাব দিলাম।

সে এবার বলল–তুমি যে আমাকে বিশ্বাস করছ, সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করছ, তার প্রমাণ কী? আমি উপযুক্ত প্রমাণ চাই। আমার কাছে আত্মসমর্পণের প্রমাণস্বরূপ তোমার ডান হাতটাকে বাঁদিকের জ্যাকেটের পকেটে ঢুকিয়ে আমার কাছে আত্মসমর্পণের প্রমাণ দাও।

না, তার নির্দেশ পালন করা স্বাভাবিকভাবেই আমার পক্ষে সম্ভব হলো না। কারন, আমি তো অনে আগেই মই থেকে পড়ে গিয়ে ডান হাতটাকে খুইয়েছি। আর অন্য হাতটা যদি ছেড়ে দেই তবে তো আমি সঙ্গে সঙ্গেই অক্কা পাব। আর জ্যাকেট? হায় আমার কপাল! সেই সদাশয় কাকটার দেখা না পেলে আমি জ্যাকেট পাবই বা কোথায় যে পকেটে হাত ঢোকাব? তাই নিতান্ত অনন্যোপায় হয়েই আমি এমন ভাবে মাথা নাড়লাম যাতে সে বোঝে তার নির্দেশ পালন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

কিন্তু আমি এ-কাজটা করে কী ভুল, বোকামিই যে করেছিলাম, তা আর শোধরাবার নয়।

আমি মাথা নাড়ানো থামাতে-না-থামাতেই বিচিত্র দেবদূত রেগে গর্জে উঠল– ঠিক আছে, তুমি তবে জাহান্নামেই যাও।

কথাটা বলতে বলতেই যে একটা চকচকে ঝকঝকে ছুরি দিয়ে ব্যস্ত-হাতে আমার ধরে-থাকা দড়িটাকে ঘ্যাঁচ করে কেটে দিল।

ভাগ্য ভালো যে আমি তখন আমার নিজের বাড়িতে পৌঁছে গেছি। আর আমার অবর্তমানে মিস্ত্রিরা ঝটপট বাড়িটাকে মেরামত করে প্রায় নতুনের মতো করে ফেলেছে। তাই দড়িটা কাটার ফলে আমি ছাদের চিমনিটার মধ্যে ঢুকে গেলাম। তারপর সেটা দিয়ে গলে একেবারে ঘরের মেঝেতে আছড়ে পড়লাম।

মেঝেতে পড়ার ফলে আমি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেললাম। কতক্ষণ যে আমি অচৈতন্য অবস্থায় মেঝেতে পড়েছিলাম, তা বলতে পারব না।

সংজ্ঞা ফিরে পাবার পর বুঝতে পারলাম, ভোর হতে চলেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, চারটা বাজে।

দড়িটা কেটে দেওয়ার ফলে আমি ঘরের মেঝের যেখানে পড়েছিলাম, সেখানেই অলসভাবেই পড়ে রইলাম। মাথায় হাত দিয়ে দেখি, নিভে থাকা চিমনির ছাই কালি মাখামাখি হয়ে রয়েছে। আর উলটে থাকা ভাঙা টেবিলটার ওপর আমার পা দুটো উঠে রয়েছে।

ঘরের বাকি অংশের অবস্থাও একই রকম। ঘরময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে গ্লাস আর বোতলের ছোট-বড় টুকরো, খাবারদাবারের টুকরো, একটা ছেঁড়া-ফাটা খবরের কাগজ, সিডাম কৰ্থওয়াস-এর একটা অলি পাত্র এবং আরও কত কি সে চোখে পড়ল সব বলা সম্ভব নয়।

বিচিত্র দেবদূত আমার কাজের মাধ্যমে ক্ষুব্ধ হয়ে এভাবেই বদলা নিয়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *