1 of 2

মেনাস্ক্রিপ্ট সাউন্ড ইন এ বটল

মেনাস্ক্রিপ্ট সাউন্ড ইন এ বটল

আমার দেশ আর আমার পরিবারের কথা বলার মতো কিছুই নেই। নিতান্তই মামুলি ব্যাপার মনে করতে পারেন। বদনাম আর দীর্ঘ বেশ কয়েক বছরের ব্যবধানের ফলে আমাকে একটা থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছে আর অন্যটা থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। এসব কথা আর দশজনের কাছে ফলাও করে বলারই বা কি থাকতে পারে?

উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া টাকাকড়ি আমাকে যে শিক্ষা দিয়েছে তাকে নিতান্ত সাধারণ ব্যাপার বলে মনে করা যাবে না। আর জীবনের গোড়ার দিকে খুবই পরিশ্রমের মাধ্যমে যে বিদ্যা আমি রপ্ত করেছিলাম, তাকে যথোপযুক্ত পথে চালিত করেছে চিন্তা-ভাবনা আর আমার মন। এ সবের চেয়ে আমাকে ঢের, ঢের বেশি মনের খোরাক জুগিয়েছে জার্মান নীতিবিদদের সুচিন্তিত বক্তব্যসমৃদ্ধ গ্রন্থাবলী। হ্যাঁ, অকপটে স্বীকার করে নিচ্ছি সে সব গ্রন্থ আমার মন-প্রাণকে খুশিতে কাণায় কাণায় ভরে দিয়েছে।

তবে এও সত্য যে, জার্মান নীতিবিদদের লিখিত গ্রন্থাবলী থেকে যে আমি অপার আনন্দ পেয়েছি তার কারণ, তাদের বল্গাহীন উন্মত্ততার অহেতুক আকর্ষণ যতটা নয় তার চেয়ে অনেক বেশি তাদের ভাবনা চিন্তাকে বোধগম্য করে তোলার মতো আমার কঠোর ধীশক্তি ও চিন্তা করার সহজাত প্রবৃত্তি আর অনুশীলন।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমার প্রতিভার রসহীন কাঠিন্যবশত আমি নিশ্চিত হয়ে পড়েছি, আমার চরিত্রের সীমিত কল্পনাশক্তি অপরাধ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।

সত্যি কথা বলতে কি, আমি যে সব মতামত প্রকাশ করেছি, তাতে নাস্তিকতাই প্রকাশ পেয়েছে। আর এরই জন্য আমি কুখ্যাত হয়ে পড়েছি।

আসলে, আমার বিশ্বাস, পদার্থ-বিষয়ক দর্শনশাস্ত্রের প্রতি আমার অত্যাধিক আকর্ষণই আমার এ পরিণতির জন্য দায়ী। আর তাই আমাকে এ আমলের মামুলি ভ্রান্তিতে জড়িয়ে ফেলেছে। ব্যাপারটা আসলে কি তাই না? আমি বলতে চাইছি, ব্যাপারটা হচ্ছে, খুবই সামান্য, একেবারেই নগণ্য ব্যাপারকেও সে বিষয়ক বিজ্ঞানের মৌলিক নীতি প্রয়োগ করে বিচার-বিবেচনা করার অভ্যাস।

মোদ্দা কথা হচ্ছে, কুসংস্কারে অন্ধ হয়ে বাস্তবতা, সত্যের কঠিনতা থেকে সরে যাবার অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে যতখানি প্রযোজ্য, ঠিক ততখানি অন্য করো বিরুদ্ধে নয়। সত্য কথা বলতে কি, সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোণ থেকে আমার বক্তব্যকে বিচার করা হয়েছে।

আগেভাগেই এমন একটা বক্তব্যের অবতারণা করছি কেন, তাই না? হ্যাঁ, এর পিছনে সঙ্গত কারণ তো অবশ্যই আছে। কি সে কারণ? কারণটা হচ্ছে, এ যদি না করতাম তবে আমি এখন যে অবিশ্বাস্য কাহিনীটা আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চলেছি, তাকে নিছক অলীক কল্পনার আবেগে উচ্ছ্বাস বলে গণ্য করতে পারেন।

দীর্ঘদিন পরদেশে ঘুরে ঘুরে আঠারো সালে খুন্দা দ্বীপপুঞ্জে যাওয়ার ইচ্ছা হলো।

রীতিমত সমৃদ্ধ দ্বীপ জাভা।

জাভার বাটাভিয়া বন্দরটাও কম সমৃদ্ধ নয়। এটা জনবহুল জাভা দ্বীপের কর্মচঞ্চল বন্দর। প্রতিদিন কাজের তাগিদে জনসমাগমও এখানে কম ঘটে না। বন্দরের বুকে উদয়াস্ত কর্মব্যস্ততা যেন লেগেই থাকে।

আমি কর্মব্যস্ত বাটাভিয়া বন্দর থেকে একদিন জাহাজে চেপে বসলাম।

তখন স্নায়ুবিক উত্তেজনা আমাকে প্রতিমুহূর্তে এখান-ওখানে ছুটিয়ে নিয়েছে। আর সে তাড়নার শিকার হয়েই আমি সে-জাহাজটার যাত্রী হয়েছিলাম।

বন্দর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ধীর-মন্থর গতিতে জাহাজটা গভীর সমুদ্রের দিকে এগিয়ে চলল। বন্দর আর জাহাজটার মধ্যে ব্যবধান ক্রমেই বেড়ে চলল।

জাহাজটা অতিকায়। প্রায় চারশো-টনের সুদৃশ্য একটা জাহাজ। আর সেটাকে তামার পাত দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মালাবার সেগুন কাঠ দিয়ে বোম্বাইয়ের কারখানায় তৈরি।

লাক্ষাদ্বীপ থেকে সংগৃহীত তেল আর তুলা দিয়ে অতিকায় জাহাজটাকে বোঝাই করা হয়েছে। আর যা-কিছু জাহাজে তোলা হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে, ইয়া মোটামোটা কাছি, নারকেল, তাল-গুড়, ঘি আর আফিমের পেটি কয়েকটা।

মালপত্র সাজিয়ে-গুছিয়ে না রেখে এলোমেলো রাখার জন্য জাহাজটা বার বার এদিক-ওদিক টলতে লাগল।

বাতাসের চাপেই যাত্রী আর মালপত্র বোঝাই জাহাজটা হেলেদুলে এগিয়ে যেতে লাগল। জাভার পূর্ব উপকূল পথেই আমাদের অনেকগুলো দিন কেটে গেল। খুন্দা দ্বীপপুঞ্জ থেকে আসা কয়েকটা ছোট ছোট জাহাজের সঙ্গে মাঝে-মধ্যে আমাদের দেখা হতে লাগল বটে। তবে আমাদের চলার পথে এরকম ঘটনা ছাড়া আর কোন ঘটনাই ঘটল না যাতে আমরা একঘেয়েমি কাটিয়ে নতুনক্ষের স্বাদ পেতে পারি।

আমাদের অতিকায় জাহাজটা উত্তাল উদ্দাম সমুদ্রের বুকে ভাসছে তো ভাসছেই। এ ভাসার, এ চলার যেন আর শেষ নেই। আমাদের চারদিকে কেবল পানি আর পানি। আর অফুরন্ত ঢেউয়ের খেলা।

জাহাজটা হেলে দুলে এগিয়ে চলেছে। এক সন্ধ্যায় আমি জাহাজের পিছন দিকের রেলিঙে ভর দিয়ে অন্যমনস্কভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমার চোখের মণি দুটো একবার নিচের সফেন জলরাশির পর মুহূর্তেই আবার মাথার ওপরের সুবিশাল আকাশটার গায়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল।

এক সময় উত্তর-পশ্চিম আকাশের গায়ে আমার চোখের মণি দুটো থমকে গেল। অদ্ভুত এক টুকরো মেঘ আমার নজরে পড়ল, অপলক চোখে আমি মেঘের টুকরোটাকে দেখতে লাগলাম। বাটাভিয়া থেকে পানি আসার পর এই প্রথম মেঘ চোখে পড়ল। আরও আছে। জমাটবাধা ওই মেঘের টুকরোটার রঙটাও বাস্তবিকই খুব অদ্ভুত।

সারাদিনের কর্মক্লান্ত সূর্যটা পশ্চিম আকাশের গায়ে আত্মগোপন করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত আমি ওই বিচিত্র মেঘের টুকরোটার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলাম।

জমাটবাধা নিশ্চল-নিথর মেঘের টুকরোটা আকাশের পূর্ব-পশ্চিম অংশে ছড়িয়ে পড়ল। আকাশের একটা বড় ভগ্নাংশই মেঘে ঢাকা পড়ে গেল।

তারপর? তারপর মুহূর্তের মধ্যে এক টুকরো কুয়াশা মেঘটাকে এমনভাবে ছেয়ে ফেলল যে, সেটাকে নিচু উপকূলের লম্বা একটা রেখা বলেই মনে হতে লাগল। অত্যল্প সময়ের মধ্যেই চাঁদের গোধূলি রাঙা রূপ আর সমুদ্রের একটা বিচিত্র চরিত্রের দিকে আমার নজর গেল, দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়ে পড়ল।

লক্ষ্য করলাম, সমুদ্রের রূপ খুব তাড়াতাড়ি বদলে যাচ্ছে। আর উত্তাল সমুদ্রের জলরাশি ক্রমেই অস্বাভাবিক স্বচ্ছ হয়ে আসছে।

পানিবাহিত বাতাসও অসহ্য গরম বোধ হতে লাগল। উত্তপ্ত লোহার গা-বেয়ে বয়ে-আসা বাতাসের মতোই গরম বোধ হতে লাগল। ঠিক যেন আগুনের হল্কা এসে আমার গায়ে লাগছে। অবাক না হয়ে পারলাম না। প্রকৃতির এ কী অভাবনীয় খেলা!

ক্রমে সমুদ্রের বুকে, রাতের অন্ধকার নেমে আসতে লাগল। কোনো অদৃশ্য হাত যেন দিগন্ত জোড়া সমুদ্রের ওপর কালো চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। চারদিকের, এমনকি খুব কাছের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না।

বাতাস কমতে কমতে একেবারেই সরে গেল। কেমন যেন অভাবনীয় একটা গুমোট ভাব অনুভব করতে লাগলাম। শুধু কি এই? চারদিক এত বেশি থমথমে হয়ে গেল যা কল্পনাও করা যায় না।

ঘাড় ঘুরিয়ে বাতি-দানের জ্বলন্ত মোমবাতিটার দিকে তাকালাম। অবাক না হয়ে পারলাম না। মোমবাতির শিখাটা এতটুকুও কাঁপছে না, একেবারেই স্থির, অচঞ্চল। বুড়ো আঙুল আর অন্য আর একটা আঙুলের সঙ্গে একটা চুল ঝুলিয়ে রেখে অনুসন্ধিৎসু নজরে লক্ষ্য করতে লাগলাম–না, সেটা এতটুকুও নড়ছে না, কাঁপছেও না।

আমি যখন হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে অত্যাশ্চর্যজনক ব্যাপারটা নিয়ে ভাবনা চিন্তায় মগ্ন, তখন ক্যাপ্টেন এসে জানালেন, বিপদের কোনো আশঙ্কা নেই।

তারপর আমরা যখন উপকূল ঘেঁষে সোজা এগিয়ে চলেছি, তখন কপ্তেনই নির্দেশ দিলেন, নোঙর তুলে পাল উড়িয়ে দেওয়া হোক।

যাত্রীদের অধিকাংশই মালয়বাসী। ক্যাপ্টেনের নির্দেশ কানে যাওয়া মাত্র তারা ডেকের ওপর সটান শুয়ে পড়ল।

আমি আতঙ্কিত মন নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলাম। সত্যি কথা বলতে কি, আসন্ন একটা ঝড়ের আশঙ্কা সবকিছুর মধ্যেই প্রকটভাবে লক্ষিত হতে লাগল।

আমি পায়ে পায়ে ক্যাপ্টেনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ফ্যাকাশে বিবর্ণ মুখে তার দিকে তাকালাম, বার-কয়েক ঢোক গিলে আমার ভয়ের কথা তার কাছে ব্যক্ত করলাম।

ক্যাপ্টেন আমার কথা ধৈর্য ধরে সবকিছু শুনলেন বটে। আমার মুখের কথা শেষ হতেই তিনি ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে তুললেন। অবাক না হয়ে পারলাম না। তিনি আমার কথা ফুঙ্কারে উড়িয়ে দিলেন। এতটুকুও আমল দিলেন না।

ক্যাপ্টেনের আচরণে আমি আরও বেশি অবাক হলাম, আমার কথার ভালো-মন্দ কোনো জবাব দেবার প্রয়োজনই বোধ করলেন না।

অস্থিরতা আমার মধ্যে ভর করল। বিছানায় শুয়ে আমি বার বার অস্থিরভাবে এপাশ-ওপাশ করতে লাগলাম। সত্যিকথা বলতে কি পুরোপুরি মানসিক অস্থিরতার শিকার হয়ে পড়লাম। ঘুমানো তো দূরের কথা দুচোখের পাতা পর্যন্ত এক করতে পারলাম না। সে যে কী নিদারুণ যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতি একমাত্র ভুক্তভোগি ছাড়া অন্য কারো পক্ষে অনুভব করা সম্ভব নয়। আর ভাষার মাধ্যমে কাউকে বুঝিয়েও বলা যাবে না।

মাঝরাত পর্যন্ত নির্ঘুম অবস্থায় কাটিয়ে নিরবচ্ছিন্ন অস্থিরতার হাত থেকে অব্যাহতি পাবার জন্য আমি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। ক্যাবিন থেকে বেরিয়ে এক পা-দুপা করে এগোতে এগোতে সিঁড়ির কাছে গেলাম। কিছু সময় সেখানে থমকে দাঁড়িয়ে থাকলাম।

এক সময় অন্যমনস্কভাবে সিঁড়ির ওপরের ধাপটায় পা ঠেকাতেই আচমকা একটা গুঞ্জনধ্বনি আমার কানে এলো। যন্ত্রচালিতের মতো থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। গুঞ্জনধ্বনিটা রীতিমত জোরালো।

দুরু দুরু বুকে উৎকর্ণ হয়ে সে গুঞ্জনধ্বনিটার উৎস ও প্রকৃতি সম্বন্ধে ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করলাম। কলকারখানার চাকা খুব জোরে ঘুরলে এরকম শব্দের সৃষ্টি হয়।

আমি ব্যাপারটা নিয়ে গভীরভাবে ভাবনা চিন্তা করে তার কারণ সম্বন্ধে ধারণা করার আগেই পুরো জাহাজটা দুলতে লাগল। মুহূর্তে সেটা এমনভাবে দুলতে লাগল একেবারে বেসামাল হয়ে পড়ার উপক্রম হলাম।

এদিক-ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে না তাকাতেই চোখের পলকে প্রবল ফেনায়িত জলোচ্ছ্বাস আমাকে, কেবলমাত্র আমাকেই বলি কেন, আমাদের এক আছাড় মেরে একেবারে দূরে নিয়ে গিয়ে ফেলল। আর জলরাশি আমাদের ওপর দিয়ে বয়ে গিয়ে পুরো ডেকটাকেই ভাসিয়ে দিল। মনে হলো সমুদ্রের সবটুকু পানি বুঝি জাহাজটার ওপর উঠে এসেছে।

তবে ওটা অবশ্যই সত্য যে, ঝড়ের এ দাপটের জন্যই জাহাজটা অনেকাংশে রক্ষা পেয়েছে। জাহাজটা পুরোপুরি ডুবে যাওয়া সত্ত্বেও মিনিটখানেকের মধ্যেই সেটা আবার সমুদ্রের ভেতর থেকে উঁকি দিল। আর ঝড়ের দাপটে বার বার টলতে টলতে এক সময় খাড়াভাবে দাঁড়িয়ে পড়ল।

আমি নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে জানে বেঁচে গেলাম কিন্তু কোনো অলৌকিক কারণে যে আমি সমূহ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেলাম তা কিছুতেই বলতে পারব না।

পানির সে প্রচণ্ড ধাক্কাটা সামাল দিয়ে উঠেই আমি বুঝতে পারলাম, জাহাজের পিছন দিককার মাস্তুল আর হালের মাঝখানে আমি বন্দি হয়ে পড়েছি। সে দুটো যেন আমাকে দুদিক থেকে সাঁড়াশির মতো আঁকড়ে ধরে রেখেছে।

অনেক কসরৎ করে তবে মাস্তুল আর হালের কাঠগড়া থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারলাম। হাতের ওপর ভর দিয়ে কোনোরকমে উঠে দাঁড়ালাম।

এদিক-ওদিক দৃষ্টি ফিরিয়ে আমাদের তখনকার অবস্থা সম্বন্ধে ধারণা করে নিতে চেষ্টা করলাম। দৃষ্টি ঝাপসা। ঝাপসা দৃষ্টিতে চারদিকটা অনুসন্ধিৎসু নজরে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম, আমারা ঢেউয়ের মধ্যে অবস্থান করছি। আকাশ ছোঁয়া সফেন। ঢেউয়ের যে ঘূর্ণিপাকে আমরা আটকে পড়েছি, তার ভয়ঙ্করতা কল্পনায় আনা যায় না।

আমি ভয়াবহ সে পরিস্থিতি থেকে আত্মরক্ষার উপায় ভাবতে লাগলাম। কিছুক্ষণ বাদে কার যেন কণ্ঠস্বর আমার কানে এলো। উকর্ণ হয়ে কণ্ঠস্বরটা সম্বন্ধে ধারণা করে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। হ্যাঁ, আমি নিঃসন্দেহ হলাম, এক সুইডেনবাসীর কণ্ঠস্বরই বটে।

হ্যাঁ, আমরা দুটো প্রাণী ছাড়া জাহাজটার এতগুলো মানুষের মধ্যে আর কেউই জীবিত নেই।

জাহাজের গাঁট্টাগোট্টা জোয়ান মরদ ক্যাপ্টেন আর মেটরা তো ঘুমন্ত অবস্থাতেই পরপারে পৌঁছে গেছে। ব্যাপারটা সম্বন্ধে তো এতটুকুও দ্বিধা থাকার কথাও নয়। কারণ, তাদের কেবিনগুলোকে চোখের সামনেই সমুদ্রের বুকে, ঢেউয়ের তালে তালে নাচানাচি করতে দেখছি।

একটু-আধটু সাহায্য ছাড়া জাহাজটার নিরাপত্তার ব্যাপারে আমাদের নেই বলতে–কিছুই করার নেই। শত চেষ্টা করলেও কিছু করা সম্ভব নয়।

সত্যি কথা বলতে লজ্জা নেই, গোড়ার দিকে পানিতে ডুবে মরার আশঙ্কায় আমাদের মধ্য থেকে যেন যাবতীয় ক্ষমতা নিঃশেষে উবে গিয়েছিল। কি করব, কি-ই বা করা উচিত কিছুই মাথায় এলো না। উত্তাল উদ্দাম সমুদ্রের বুকে প্রচণ্ড দোলায় আমরা অসহায়ভাবে এমন দোলা খেতে লাগলাম যা একেবারেই বর্ণনাতীত। একের পর এক পর্বত প্রমাণ ঢেউ এসে আমাদের ওপর সবেগে আছড়ে পড়তে লাগল। একটা ঢেউয়ের আক্রমণ কোনোরকমে মোকাবেলা করতে না করতেই প্রচণ্ড আক্রোশে আর একটা ঢেউ এসে আমাদের ওপর আছড়ে পড়তে লাগল।

পিছনের গলুইটার অবস্থা খুবই শোচনীয় হয়ে গেল, লক্ষ্য করলাম। ভেঙেচুড়ে একেবারে ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে।

আর আমরা? আমরাও নানাভাবে আহত হয়ে পড়লাম। বরং বলা চলে, কোনোরকমে পিতৃদত্ত জীবনটা রক্ষা পেয়ে গেছে, এই যা। সত্যি ভাগ্যের ব্যাপারই বটে। ভাগ্যের জোরে পাম্পগুলোর মুখ আটকে যায়নি। যদি তাই হতো তবে এতক্ষণে কেলেঙ্কারির চূড়ান্ত ঘটে যেত। আর? আর জাহাজ বোঝাই ইট-পাথরের টুকরোগুলো এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়েনি।

প্রাণে একটু পানি এলো বটে। ঝড়ের বেগ ক্রমে কমতে কমতে অনেক কমে। গেছে। আগের সে দাপট আর অবশ্যই নেই। তবে বাতাসের বেগ এখনও আছে। তবে এ বাতাস থেকে বিপদের আশঙ্কা নেই। আমাদের বুকের জমাট-বাঁধা ভয়ও অনেকাংশে লাঘব হয়ে গেছে। বিপদের আশঙ্কা আর তেমন কিছু আছে বলে মনে হলো না। আমাদের প্রাণে কিছুটা পানি এলো বটে। তবে বিপদের আশঙ্কা একেবারে নির্মূল হয়ে গেছে এরকম ধারণা করতে পারলাম না, পরিস্থিতি তেমন ছিলও না।

বাতাস একেবারে কমে না যাওয়া পর্যন্ত আমাদের স্বস্তি নেই। অনন্যোপায় হয়ে আমরা বাতাস কমে গিয়ে সমুদ্র একেবারে শান্ত না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে লাগলাম।

না, আমাদের সে আশা বাস্তবায়িত হলো না। বরং বলা চলে, একেবাওে নিষ্ফল প্রত্যাশা। আমাদের হতাশ হতেই হলো।

এক-দুই-তিন করে পাঁচ পাঁচটা দিন ও রাত কেটে গেল।

আমাদের একমাত্র খাদ্যবস্তু কিছু পরিমাণ তালের গুড় কোনোরকমে রক্ষা করা গেল। আমাদের দোমড়ানো-মোচড়ানো–ভাঙাচোরা জাহাজটা সমুদ্রের ঢেউয়ের কাঁধে ভর দিয়ে কোনোরকমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হলেও এগিয়ে যেতে লাগল। তবে তার গতি একেবারে মন্থর হয়ে গেছে, এরকম কথা বলা যাবে না, বরং বলতেই হয় জাহাজের ভাঙা অংশটা দ্রুতগতিতেই এগিয়ে যেতে লাগল।

ঝড়ের তাণ্ডব অনেকাংশেহাস পেয়েছে, স্বীকার না করে উপায় নেই, খুবই সত্য বটে। তবে এখন ঝড়ের যে দাপট আর তর্জন গর্জন কানে আসছে তা-ও নেহাৎ কম নয়। আর এখন যে পরিস্থিতি চলছে এরকম প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখিও আমাকে এর আগে কোনোদিন হতে হয়নি।

তবে এও সত্য, গোড়ার দিকের চারদিন আমাদের গতি ছিল খুবই এলোমেলো। মোদ্দা কথা, কর্তব্য স্থির করতে না-পেরে মানুষ অসহায় পরিস্থিতিতে যেমন দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে যা করে থাকে, আমরাও তাই করেছি। কখনও দক্ষিণ পূর্বে, আবার কখনও বা সোজা দক্ষিণে। তবে গোড়ার দিকের চারদিনই আমরা ওরকম করেছি, ব্যস। অতএব ইতিমধ্যে আমাদের দু-দুবার যাওয়ার কথা।

পঞ্চম দিন। সেদিন ঠাণ্ডাটা খুব বেশি রকমই পড়ল। হাত-পা কেমন যেন অবশ হয়ে আসতে লাগল। এমনভাব ঠাণ্ডা যে ভাবা যায় না।

পূব-আকাশের গায়ে হলুদ আভা ছড়িয়ে দিয়ে সূর্যটা নিজের উপস্থিতি জানান দিতে লাগল। দিগন্ত রেখা থেকে সামান্য কয়েক ডিগ্রি ওপরে সকালের তাজা সূর্যটা জ্বলজ্বল করতে লাগল।

আকাশ পরিষ্কার নির্মেঘ। আকাশের গায়ে মেঘের চিহ্নমাত্রও দেখা যাচ্ছে না। তবে বাতাসের বেগ ক্রমেই বাড়তে বাড়তে একটু পরেই লক্ষ্য করলাম, বাতাস কখনও বাড়ছে, পরমুহূর্তেই বাতাস যেন কমতে কমতে একেবারেই কমে যাচ্ছে।

এক সময় লক্ষ্য করলাম, সূর্যটা যেন কেমন বিবর্ণ হতে হতে কোথায় তলিয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, ইতিমধ্যে কখন যে আকাশের গায়ে টুকরো টুকরো মেঘের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে লক্ষ্যই করিনি।

দুপুরের দিকে আবার আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল। সূর্যটা আবার স্পষ্ট হয়ে চোখের সামনে দেখা দিল। তবে আগের মতো আলো বিকিরণ করল না। কেমন যেন বিষণ্ণ–যাকে বলে ম্যাড়ম্যাড়ে আলো।

বিকেল হলো। সারাদিনের কর্মক্লান্ত সূর্যটা সমুদ্রের বুকে গা-ঢাকা দেবার আগে হঠাৎ যেন একেবারেইনিষ্প্রভ হয়ে গেল। মনে হলো কোনো অদৃশ্য দুটো হাত গোপন অন্তরাল থেকে সূর্যটাকেনিভিয়ে দিল, সমুদ্রের বুকে ডুবিয়ে দিল।

আমাদের জাহাজের ভাঙা-অংশটা উল্কার বেগে ছুটে চলেছে। সূর্যটা সমুদ্রগর্ভে ডুব দিল। অতল সমুদ্রের বুকে পুরোপুরি ডুবে যাওয়ার আগে একটা রূপার অস্পষ্ট বলয়ের মতো দেখা গেল। খুবই অস্পষ্ট, যেন একেবারেই ঝাপসা একটা বলয়।

পঞ্চম দিনের সন্ধ্যা। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এলো উত্তাল-উদ্দাম অতল সমুদ্রের বুকে। ষষ্ঠদিন যে আসবেই, এরকম আশা করা যায় না। সত্যি সে আশা করা অর্থহীন। যা ভেবেছিলাম, কার্যত তাই হলো। না, আমার কাছে যে ষষ্ঠ দিনটা আর এলো না। কেবলমাত্র আমার কাছেই নয়, আমার একমাত্র সহযাত্রী সুইডেনবাসীর কাছেও আর কোনোদিনই সে দিনটা এলো না।

ব্যস, আমরা নিদ্রি অন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে গেলাম। অন্ধকার এক ঘেরাটোপের মধ্যেই আমাদের প্রতিটা মুহূর্ত, প্রতিটা দিন কাটতে লাগল।

তবে আমাদের এগিয়ে চলা কিন্তু অব্যাহতই রইল। জমাটবাধা অন্ধকার আমাদের চারদিক থেকে ঘিরে রাখল। আমরা যেন অন্ধকার যক্ষপুরীতে অবস্থান করতে লাগলাম। তবে অবশ্যই নিশ্চল-নিথরভাবে নয়, বরং দারুণভাবে সচল। দুর্বার আমাদের গতি।

আশ্চর্য ব্যপার! অমাবস্যার রাতও বুঝি এত অন্ধকার হয় না।

এবার থেকে অন্তহীন নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে যক্ষপুরি বাসিন্দার মতো আমাদের দিন কাটতে লাগল। দিন-রাতের পার্থক্য বোঝার মতো ক্ষমতা, না ক্ষমতার কথা বলব না, আসলে সামান্যতম সুযোগই আমাদের দিল না। জাহাজ থেকে দশ পা দূরের কোনো জিনিসই আমাদের নজরে আসছে না। অন্তহীন রাত আমাদের চারদিক থেকে ঘিরে রইল।

গ্রীষ্মমণ্ডলে সমুদ্রের পানিতে যে থেকে থেকে ফসফরাস ঘটিত আলো আমাদের চোখে পড়ে, তা-ও একেবারেই অনুপস্থিত। অন্ধকার সমুদ্রের পানির গায়ে ফসফরাসঘটিত যে আলোর ঝকঝকানি দেখে আমরা অভ্যস্থ, সে আলোর কথা বলছি। তার নাম গন্ধও আমাদের চোখে পড়ছে না। অবাক হবার মতো ব্যাপারই বটে।

ঝড়ের তাণ্ডব আগের মতোই অব্যাহত রইল। ঝড় থামা তো দূরের ব্যাপার তার তীব্রতা এতটুকুও হ্রাস পেল না। আবার এও লক্ষ্য করলাম, সাগরের বুকে বা তীরে ফেণার এতটুকু লেশমাত্রও নেই।

না, আমাদের চরম বিপদ থেকে অব্যাহতি পাবার সামান্যতম আশাও মনে অবশিষ্ট রইল না। হতাশা, হাহাকার আর নিরবচ্ছিন্ন আতঙ্ক আমাদের চারদিক থেকে ঘিরে রাখল। না, এক বর্ণও বানিয়ে বলছি না, নিরবচ্ছিন্ন বিষণ্ণতা, আতঙ্ক আর পোড়া আবলুস কাঠের মরুভূমি ছাড়া আশাব্যঞ্জক কোনো ভাবনা-চিন্তাই আমাদের মনে জাগতে পারল না।

গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো নতুন একটা ভাবনা, সুইডেনবাসী বুড়োটার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উঁকি মারতে লাগল। সর্বনাশা এক আতঙ্ক কুসংস্কারজাত আতঙ্ক। না, কেবলমাত্র তার কথা বললে সত্য গোপন করাই হবে। নীরব বিস্ময়। আমার অন্তরেও ছড়িয়ে পড়তে লাগল। আরও সহজ-সরল ভাষায় বললে, আমিও বিস্ময়-আতঙ্কের শিকার হয়ে পড়লাম।

জাহাজটার পরিস্থিতি সম্বন্ধে ভাবনা চিন্তা করা, জোড়াতালি দিয়ে জাহাজটাকে টিকিয়ে রাখার মতো সামান্যতম আগ্রহও আমাদের মধ্যে রইল না। পিছন দিকের মাস্তুলটার গোড়ায় একেবারে ওটার গা ঘেঁষে আমরা দুটো প্রাণী নীরবে সমুদ্রের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে পাশাপাশি বসে রইলাম। এ স্থানটাকেই সবচেয়ে নিরাপদ ভেবে আশ্রয় নিলাম।

সময় আমাদের অজ্ঞাত। সময় বুঝবার কোনো উপায়ই নেই। ঘণ্টা মিনিট তো দূরের ব্যাপার, সকাল, দুপুর নাকি বিকেল তাও বুঝা সম্ভব নয়। আর কোথায়ই বা আমরা অবস্থান করছি, সেটাও বুঝতে পারছি না। কী সমস্যায়ই না পড়া গেল!

হ্যাঁ, আমরা এগিয়ে চলেছি। চলেছি তো চলেছিই বটে। তবে একটা ব্যাপার আমাদের কাছে পরিষ্কার, নিঃসন্দেহই বলা যেতে পারে, আমরা দ্রুত সুদূর দক্ষিণের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। আর দক্ষিণের যে অঞ্চল দিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি এর আগে কোনো নাবিকের পক্ষে এখানে আসা সম্ভব হয়নি। অথচ অবাক না হয়ে পারলাম না, সেখানকার বরফ আমাদের চলার পথে কোনোরকম প্রতিবন্ধকতা এখনও সৃষ্টি করেনি, আমাদের পথ আগলায়নি।

আমরা দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা যে অনবরত চলেছি তো চলেছিই প্রতিটি মুহূর্তই মনে হচ্ছে আমাদের জীবনের শেষ মুহূর্ত–চরম শত্রু, চরম আতঙ্কের মতো পর্বত প্রমাণ ঢেউয়ের আঘাতের সম্মুখীন হয়ে মনে হচ্ছে, এই আমাদের জীবনের অন্তিম লগ্ন। চরমতম আতঙ্কের মতো প্রতিটা ঢেউ আমাদের ওপর আছড়ে পড়ছে। ঢেউয়ের প্রতিটা আঘাত এমনই প্রচণ্ড, এমনই ভয়ঙ্কর যে, ইতিপূর্বে কোনোদিন কল্পনাও করতে পারিনি।

তবে একটা ব্যাপার আমাদের আরও বেশি করে অবাক করছে যে, এমন পর্বত প্রমাণ উত্তাল উদ্দাম ঢেউ আমাদের এখনও টিকিয়ে রেখেছে, সলিল সমাধি দিয়ে দেয়নি। হ্যাঁ, ব্যাপারটা কেবল অভাবনীয়ই নয়, অলৌকিক বললেও অত্যুক্তি হবে না।

হ্যাঁ, আমরা অবিশ্বাস্যভাবে বেঁচে আছি, পিতৃদত্ত জীবনটার অস্তিত্ব এখনও পুরো দস্তুরই আছে। আমার মুখ থেকে এরকম উক্তি শুনে আমার সঙ্গি সুইডেনবাসী বুড়োটা আশ্বাস দিয়ে বলল–আমাদের জীবনের আশঙ্কা তেমন নেই বলেই মনে হচ্ছে।

আমি আচমকা ঘাড় তুলে তার মুখের দিকে বিস্ময় মাখানো দৃষ্টিতে তাকালাম।

আমি কিছু বলার আগেই সে আবার মুখ খুলল–হ্যাঁ, আমার ধারণাটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও অমূলক নয় বলেই মনে করতে পারেন।

আমি চোখ-মুখের বিস্ময়ের ছাপটুকু অব্যাহত রেখেই বললাম–আপনি কি করে যে এতটা নিশ্চিন্ত হতে পারছেন, কোন্ আশা বা লক্ষণ দেখে এতটা দৃঢ়তার সঙ্গে কথাটা বললেন, কিছুই বুঝতে পারছি না।

ফ্যাকাশে বিবর্ণ মুখায়বে জোর করে ম্লান হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বুড়োটা এবার বলল–দেখুন, আমার আশ্বস্থ হবার কারণ, ভেঙেচুড়ে আমাদের জাহাজটা এখন খুবই হালকা হয়ে গেছে।

হ্যাঁ, আপনার এ যুক্তিটা অবশ্য সমর্থনযোগ্য বটে।

আরও আছে–

তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই আমি বলে উঠলাম–আরও আছে? জাহাজটা টিকে থাকা, আমাদের জীবনের অস্থিত্ব রক্ষা পাওয়ার ব্যাপারে আপনার আর কি যুক্তি, জানতে পারি কী?

আমি বলতে চাইছি, জাহাজটার যন্ত্রপাতি আর গঠন পদ্ধতিও খুবই ভালো। আর এ কারণেই সমুদ্র আর ঝড়ের এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও জাহাজটা নিজে যেমন টিকে আছে, আমাদেরও বাঁচিয়ে রেখেছে।

সুইডেনবাসীর মুখে যুক্তিসঙ্গত আশা ভরসার কথা শুনেও আমি কিন্তু তার মতো নিশ্চিন্ত হতে পারলাম না। আমার হতাশা আর হাহাকার জর্জরিত মনের নৈরাশ্য কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারলাম না। মৃত্যু অবধারিত।

আমি প্রাণের আশা ছেড়ে দিয়ে আসন্ন মৃত্যুর জন্য নিজেকে তৈরি করতে লাগলাম। কারণ, আমি যে নিঃসন্দেহ, এমন কোনো শক্তি নেই যে আমাকে মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা করতে পারে। আর আমি এও এমন মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম যে, মৃত্যু আসতে আর আধ ঘণ্টাও দেরি হবে না।

আমাদের জাহাজটা আগের মতোই দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে। কোথায়, কোনদিকে চলেছি না জানলেও আমরা যে এগিয়ে চলেছি, এটা তো আর মিথ্যা নয়। জাহাজটা অনবরত দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলার প্রতিটা নট-এর সঙ্গে উত্তাল উদ্দাম সমুদ্রের প্রতিটা আকাশছোঁয়া ঢেউ আরও অনেক, অনেক বেশি প্রলয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। কখনও এক-একটা ঢেউ আচমকা আমাদের ভাঙাচোরা মনটাকে এতই ওপরে তুলে। নিয়ে যেতে লাগল, মাথার ওপরে ইতস্তত উড়ে বেড়ানো অ্যালট্রেস পাখিগুলোকেও ছাড়িয়ে উঠে যেতে লাগল। প্রতিবারই ভাবি দম বন্ধ হয়ে যাবার জোগার হয়, ভাবি এবারই বুঝি ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে গেল। আবার পর মুহূর্তেই যখন আকাশছোঁয়া ঢেউটার মাথাটা সেঁটে গিয়ে জাহাজটসমেত আমাদের দম্ করে নিচে ছুঁড়ে দেয় তখন আমার অবস্থা আরও অনেক বেশি খারাপ হয়ে পড়তে লাগল। অন্তরাত্মা শুকিয়ে, প্রাণপাখি খাঁচাছাড়া হবার জোগার হয়ে উঠতে লাগল। মনে হলো নরকের দক্ষিণ দরজার দিকে এত দ্রুত নেমে যাচ্ছি যা ভাবা যায় না। মাথার ভেতরে ঝিমঝিমানী শুরু হয়ে যায়। উফ্! সে যে কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তা কাউকে বলে বুঝানো সম্ভব নয়।

একবার সেভাবে সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে যাওয়ামাত্র আমার সহযাত্রীর ভয়ঙ্কর আর্তস্বর বাতাসবাহিত হয়ে রাতের জমাট বাঁধা অন্ধকার ভেদ করে বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল।

সে তার মুখটাকে সাধ্যমত আমার কানের কাছে এগিয়ে নিয়ে এসে তীব্রস্বরে আর্তনাদ করে উঠল–শোন! শোন! পরমেশ্বর সর্ব শক্তিমান। শোন! দেখ! দেখ!

আমি উৎকর্ণ হয়ে, অত্যুগ্র আগ্রহান্বিত হয়ে তার কথাগুলো শুনতে লাগলাম।

সে আবারও বলল–দেখ! ওই দেখ!

আমি তার অঙ্গুলি-নির্দেশিত পথে অনুসন্ধিৎস নজরে তাকালাম। আমার নজরে পড়ল, আমরা যেখানে অবস্থান করছি ঠিক সে জায়গাটাতেই সমুদ্রটা দ্বিধা বিভক্ত হয়ে গেছে।

আর এও লক্ষ করলাম যে নিস্পলক চোখে একই দিকে সবিস্ময়ে তাকিয়ে রয়েছে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে আবার তার অঙ্গুলি-নির্দেশিত পথে দৃষ্টি ফেরালাম। লক্ষ্য করলাম–হ্যাঁ, যা ভেবেছি ঠিক তাই। সমুদ্রটা দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। আর লাল আলোর একটা অদ্ভুত রেখা তার ফাঁক দিয়ে এগিয়ে আমাদের জাহাজের ডেকের ওপর পড়েছে।

ব্যাপারটা লক্ষ্য করে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না, পরমুহূর্তেই ঘাড় ঘুরিয়ে ওপরের দিকে দৃষ্টিপাত করামাত্র যে অভাবনীয়, একেবারেই অপ্রত্যাশিত দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল, তা যে কেবলমাত্র আমাকে অবাকই করল তাই নয়, শরীরের সবটুকু রক্ত হিম হয়ে, জমাটবেঁধে যাবার পক্ষে যথেষ্ট।

আমার বিস্ময়ের ঘোরটুকু কাটতে না কাটতেই দেখতে পেলাম, আমাদের ঠিক মাথার ওপরে, সমুদ্রের উপরিতলে কম হলেও হাজার চারেক টনের অতিকায় একটা জাহাজ ইতস্তত চক্কর মারছে। দৃষ্টি ফেরানো তো দূরের কথা, চোখের পলক পর্যন্ত খোলা আমার পক্ষে সম্ভব হলো না। আপন মনে প্রায় অস্ফুটস্বরে বলে উঠলাম– আরে বাবা!

সমুদ্রের উপরিতলে বললে যথার্থ বলা হবে না। বরং বলা যেতে পারে, সমুদ্র কক্ষ থেকে একশো গুণেরও বেশি উপরে অবস্থান করছে বিশালায়তন জাহাজটা। আবার কেবলমাত্র বিশালায়তন বললেও জাহাজটার আয়তন সম্বন্ধে কারো মধ্যে ধারণা সঞ্চার করা সম্ভব নয়। তবে? বহু উঁচুতে, আকাশচুম্বী ঢেউয়ের মাথায় অবস্থান করলেও জাহাজটার আকার-আয়তন এ পথে যাতায়াতকারী বা প্রচলিত ইস্ট ইন্ডিয়ান-এর যে কোনো জাহাজের চেয়ে অনেকাংশে বড়।

জাহাজটার অতিকায় দেহটার গায়ে গাঢ় কালো রঙের প্রলেপ দেওয়া। আর অন্যান্য সাধারণ জাহাজের মতো এটা কারুকার্যবিশিষ্টও নয়। যাকে বলে একেবারে সাদামাটা তার গড়ন। জাহাজটার গায়ের খোলা ছিদ্রপথগুলো দিয়ে কয়েকটা কামানের ধাতব নল উঁকি দিচ্ছে। শিকল দিয়ে অগণিত মশাল জাহাজটার এখান-ওখান থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর তাদেরই আলো জাহাজের মসৃণ গায়ে প্রতিফলিত হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। এসব তো হচ্ছে মামুলি ব্যাপার। কিন্তু যে ব্যাপারটা প্রত্যক্ষ করার পর আমার চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে যাবার জোগার হলো সে কথা তো এখনও বলাই শুরু করিনি। আর কিভাবেই সে অবিশ্বাস্য, অভাবনীয় ঘটনাটার যথার্থ বর্ণনা দেব, তা-ও আমার পক্ষে কম সমস্যা নয়। তবু বলতে যখন শুরু করেছি তখন যে করেই হোক ব্যাপারটা ব্যক্ত তো করতেই হবে। যে ব্যাপারটা আমাকে যারপরনাই অবাক করল, আতঙ্কে প্রায় কুঁকড়ে দিল, সেটা হচ্ছে–এই উত্তাল উদ্দাম উন্মাদপ্রায়। সমুদ্র আর নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত ভয়ঙ্কর ঝড়ের তাণ্ডবের মধ্যেও একমাত্র পালের ওপর ভর করে জাহাজটা অক্ষত অবস্থায় দিব্যি চলাচল অব্যাহত রেখেছে। এমন একটা আতঙ্ক মিশ্রিত বিস্ময়কর ব্যাপার দেখে অভিভূত না হয়ে পারা যায়?

আমি নিস্পলক চোখে আবছা সে ফাঁকটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সেটা যখন আমার নজরে পড়ল, তখন লক্ষ্য করলাম, ভয়ঙ্কর সে-ফাঁকটা দিয়ে ক্রমে একটা গলুই ভেসে উঠছে। হ্যাঁ, কেবলমাত্র গলুইটাকেই আমি দেখতে পেলাম।

আকাশছোঁয়া ঢেউয়ের মাথায় অবস্থানরত জাহাজটা মুমূর্ষ রোগীর মতো কাঁপতে কাঁপতে এক সময় আচমকা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। ব্যস, আর দেরি নয়, দ্রুতবেগে সেটা নিচে নেমে এলো। নিচে, একেবারে সমুদ্রের অশান্ত বুকে।

আমি কিন্তু ভেঙে পড়লাম না। বরং সে চরম মুহূর্তে আমার মধ্যে কী যে অভাবনীয় আত্মসংযম জেগে উঠল তা আমি নিজেই জানি না। আমার তখনকার মানসিক দৃঢ়তা দেখে আমিই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম।

আমি মুহূর্তের মধ্যে যন্ত্রচালিতের মতো ঝট করে কয়েক পা একধারে সরে গিয়ে নির্ভয়ে আসন্ন ধ্বংসের প্রতীক্ষায় নিশ্চলনিথরভাবে অপেক্ষা করতে লাগলাম। সে চরম মুহূর্তে নিশ্চেষ্টভাবে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আমার তো করার কিছু নেই।

আমাদের জাহাজটার সব চেষ্টার অবসান হলো। এবার সেটার চরম ধ্বংসের পালা। শেষপর্যন্ত এক সময় ধীর মন্থর গতিতে হলেও ক্রমে সমুদ্রের অতল গহ্বরের দিকে যাত্রা করল, একটু একটু করে তলিয়ে যেতে লাগল।

আমাদের জাহাজটা তলিয়ে যেতে যেতে এক সময় আমাদের ওপরে অবস্থানরত এবং আগেই তলিয়ে যাওয়া জাহাজটার গায়ে ধাক্কা মারল। ধাক্কাটা বেশ জোরেই লাগে। আর তার অনিবার্য পরিণতি হলো আমি সবেগে ছিটকে গিয়ে পড়লাম হাত কয়েক দূরে। আগেই তলিয়ে যাওয়া জাহাজটার দড়ির গাদার ওপর আমি আছাড় খেয়ে পড়লাম।

আশ্চর্য ব্যাপার! সত্যি বলছি, আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। দড়িদড়ার ওপর আমি হুমড়ি খেয়ে পড়তে না পড়তেই আমাকে অবাক করে দিয়ে জাহাজটা বার কয়েক দুলে উঠে আবার তির তির করে চলতে আরম্ভ করল। জাহাজের মাঝিমাল্লারা আনন্দে লাফালাফি শুরু করে দিল। সে কী উল্লাস তাদের! আমি তাদের হৈ হট্টগোলে সুযোগ নিলাম। হৈহুল্লোড়রত মাঝিমাল্লাদের নজর এড়িয়ে দড়িদড়ার সে স্তূপটা থেকে উঠে গুটিগুটি সেখান থেকে সরে পড়লাম।

জাহাজের সবাই কাজে ব্যস্ত, সবারই লক্ষ্য জাহাজটা যাতে আবার নিরাপদে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। আমি শিকারি বিড়ালের মতো পা টিপে টিপে, খুবই সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে সবার নজরের আড়ালে আধ-বোজা দরজাটা দিয়ে সোজা ভেতরে ঢুকে গেলাম।

আমি থামলাম না। চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে এগিয়েই চললাম। সে মুহূর্তে আমার একমাত্র লক্ষ্য জাহাজটার কোনো এক স্থানে আশ্রয় নেওয়া যাতে আমার খোঁজ কেউ না পায়।

আমি এক-পা দু-পা করে এগোতে এগোতে একটা সিঁড়ির কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমার বুঝতে দেরি হলো না, সিঁড়িটা জাহাজের খোলে নামার কাজে ব্যবহার করা হয়। ব্যস, মুহূর্তমাত্র সময় নষ্ট না করে আমি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে শুরু করলাম। অচিরেই আমি জাহাজের খোলে, নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে। গেলাম। অন্ধকারে খোলের ভেতরে আমি ঘাপটি মেরে বসে রইলাম।

কিন্তু কেন যে আমি সবার অলক্ষ্যে জাহাজটার অন্ধকার খোলের মধ্যে আশ্রয় নিলাম তা আমার পক্ষে বলা শক্ত। তবে এটা হতে পারে বটে, প্রথম দর্শনে জাহাজের মাঝিমাল্লাদের ভয়ে আমি অনিশ্চিত বিপদাশঙ্কায় মুষড়ে পড়ি। আর সে ভয়বশতই আমি তড়িঘড়ি আত্মগোপনের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হই। আর করিও তাই। আর প্রথম দর্শনেই আমি যে অজানা অচেনা যে নতুনত্বের সম্মুখীন হই তাতেই আমার মধ্যে সন্দেহ ও আতঙ্ক মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আর তখন তাদের চেহারা ছবি আর আচরণে যেসব লক্ষণ আমার নব জরে পড়ে তা থেকেই আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে ভয় হঠাৎই জমাট বেঁধে যায়। আর এরই ফলে হয়তো বা আমার পক্ষে তাদের ওপর আস্থা রাখা, ভরসা করা সম্ভব হয়নি। তাই ঝট করে আত্মগোপন করার সিদ্ধান্তকে আমি গ্রহণ না করে পারিনি। শেষপর্যন্ত করলামও তাই। আর জাহাজের অন্ধকার খোলটা ছাড়া আত্মগোপন করার মতো ভালো জায়গা কোথায় বা আছে।

হ্যাঁ, জাহাজটার খোলের ভেতরেই আমি আশ্রয় নিলাম। সেখানে বোর্ডের একটা ছোট টুকরো ধীরে ধীরে সরিয়ে ফেলতেই কয়েকটা বড়সড় কাঠের টুকরো পেয়ে গেলাম। তাদের মাঝখানে লুকিয়ে-থাকার মতো চমৎকার একটা জায়গা নজরে পড়ল। বুঝলাম, জায়গাটা আশ্রয় নেবার উপযুক্তই বটে। ব্যস, চোখের পলকে সে ফাঁকটার মধ্যে নিজেকে সিধিয়ে দিয়ে ঘাপটি মেরে বসে রইলাম।

তখন সবে কাজটা সেরেছি। ঠিক সে মুহূর্তেই কার যেন কাটামারা বুটের খট খট শব্দ কানে এলো। চোখের পলকে আবার কাঠের বোর্ডটাকে বসিয়ে দিলাম। ব্যস, নিরাপদ। বলা তো যায় না, কোন হাঙ্গামায় জড়িয়ে পড়ে নাস্তানাবুদ হতে হয়, জীবন সংশয় হওয়াও কিছুমাত্র বিচিত্র নয়।

মিনিট খানেকের মধ্যেই একটা অস্থির দুর্বল পদধ্বনি আমার দিকে এগিয়ে এসে আবার দূরে সরে যেতে লাগল। অল্পক্ষণের মধ্যেই সেটা দূরে সরে যেতে যেতে এক সময় একেবারে মিলিয়ে গেল।

আমি সে লোকটার মুখটা দেখতে পাইনি সত্য, কিন্তু তার চেহারাটা ঠিকই আমার নজরে পড়ল। এবার বুঝতে পারলাম, কেন তার পদধ্বনি অস্থির হলেও এমন দুর্বল মনে হচ্ছিল। লোকটা বৃদ্ধ, একেবারেই জরাগ্রস্ত। বয়সের ভারে পা দুটো তার দেহটাকে যথাযথভাবে বইতে পারছে না। তাই দুর্বল পা দুটো কোনোরকমে টেনে টেনে তার দেহটাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। হাঁটু অনবরত কেঁপেই চলেছে আর নুয়ে পড়া দেহটা এদিক-ওদিক টলছে। আর একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম, বুড়োটা অবোধ্য ভাষায় আপন মনে বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। যাকে বলে আপন মনে বকবক করা। আমি উৎকর্ণ হয়ে লক্ষ্য করলেও তার কথার একটা বর্ণও বুঝতে পারলাম না।

বুড়োটা ধীরপায়ে থপ থপ করতে করতে আরও খানিকটা এগিয়ে জাহাজটার খোলের একেবারে কোণে চলে গেল। আমি কাঠের বোর্ডটার ফাঁক দিয়ে তার গতিবিধির ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখতে লাগলাম।

অচিরেই আমার নজরে পড়ল, বুড়োটা সে কোণটায় পড়ে-থাকা বিচিত্র যন্ত্রপাতি, ভাঙাচোরা লোহা লক্কর আর জাহাজ চালানোর জীর্ণ মানচিত্রের পাঁজার মধ্যে কি যেন হণ্যে হয়ে খোঁজাখুঁজি করছে। কি যে সে খুঁজছে জানার কথা নয়, আর সে মুহূর্তে আমার জানার আগ্রহও তেমন ছিল না। তবে সবচেয়ে বেশি করে যা আমার নজরে পড়ল তা হচ্ছে, তার আচরণে শৈশবের দুরন্তপনার দিনগুলোর খিটখিটে মেজাজ প্রকাশ পাচ্ছে। আর এও লক্ষ্য করলাম, শিশুসূলভ খিটখিটে মেজাজের সঙ্গে দেবতাদের গাম্ভীর্য ও শান্ত-সৌম্য প্রকৃতি ও মর্যাদাবোধের অদ্ভুত সংমিশ্রণ ঘটেছে।

বুড়োটা এতক্ষণ হণ্যে হয়ে খোঁজাখুঁজি করল, সে বাঞ্ছিত বস্তুটা পেল কি না বুঝতে পারলাম না। তবে একটু পরেই লক্ষ্য করলাম, সে আগের মতোই ধীর-মন্থর গতিতে থপ থপ করতে করতে চলে গেল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সে আমার নজরের বাইরে চলে গেল। ব্যস, তাকে আর দেখা গেল না। আবার আমি প্রায়ান্ধকার ডেকের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন উৎকণ্ঠার মধ্যে প্রতিটা মুহূর্ত কাটাতে লাগলাম।

আমি অজানা এক অনুভূতির শিকার হয়ে পড়লাম। সে অনুভূতিটা যে কি তার কথা কাউকে বুঝিয়ে বলা তো দূরের ব্যাপার, কারো মধ্যে সামান্যতম ধারণা সঞ্চার করাও সম্ভব নয়। অতীতের শিক্ষাদীক্ষা বা অভিজ্ঞতা সে ক্ষেত্রে একেবারেই অকেজো, সম্পূর্ণ অর্থহীন। আমার কাছে ব্যাপারটা এমন মনে হলো যে, অনাগত ভবিষ্যতেও সে বিশেষ রহস্যটা ভেদ করার জন্য কোনো চাবিকাঠি আমার হাতে তুলে দেবে না। অর্থাৎ রহস্যটা হয়তো চিরদিনই পর্দার আড়ালেই রয়ে যাবে। আর আমার মানসিকতা

যেভাবে তৈরি হয়েছে তাতে শেষ সম্ভাবনার ব্যাপারটাকে মনের কোণে স্থান দেওয়াই রীতিমত পাপের বোঝা মাথায় নেওয়া ছাড়া কিছু নয়। হ্যাঁ, নির্দিধায় স্বীকার করে নিচ্ছি, আমার মনোভাবের ব্যাপারে আমি কোন দিনই সন্তুষ্ট হব না, এক মুহূর্তের জন্যও না। আমি নিশ্চিত কোনোদিনই সন্তুষ্ট হব না। আবার সে ধারণাগুলো যে নিশ্চিত নয়, তাতেও অবাক হবার কিছু নয়। অবাক হবার সামান্যতম কারণই থাকতে পারে না। কেন? কারণ তাদের উৎস যেখানেনিহিত সেগুলোও একেবারেই অভূতপূর্ব, সম্পূর্ণ অভাবনীয়ও বটে। সম্পূর্ণ নতুন একটা ইন্দ্রিয় যেন আমার আত্মার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। যুক্ত হয়েছে নতুন একটা সত্ত্বা। সত্যি আমার সে অনুভূতিটা ব্যাখ্যার অতীতই বটে।

দুই-একদিন বা দুই-এক বছরের কথা নয়, বহু দিন আগের কথা, যেদিন এ। ভয়ঙ্কর জাহাজটায় আমি প্রথম পা দিয়েছিলাম। আমার ভাগ্যরেখা ক্রমে স্লান হতে। হতে একটা বিন্দুতে এসে মিরিত হয়েছে। মানুষগুলোর হাবভাব কিছুই বুঝার উপায় নেই। একেবারেই দুর্বোধ্য। কী যে গভীর ভাবনায় হাবুডুবু খেতে খেতে সবাই আমার ধার দিয়ে চলে যেতে লাগল, তার মাথামুণ্ড কিছু আমি অনুমানও করতে পারলাম না। কাঠের বোর্ডটার ফাঁক দিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে আমি তাদের চলাফেরার ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখতে লাগলাম। কিন্তু এ-পর্যন্তই। তাদের সম্বন্ধে এক তিলও ধারণা করতে পারলাম না। আমি তাদের গতিবিধির ওপর সাধ্যমত নজর রাখতে পারলেও তারা কেউই কিন্তু আমাকে দেখতে পায় না।

এবার আমি বুঝতে পারলাম, ডেকের মধ্যে, কাঠের স্কুপের অন্ধকার গহ্বরে এভাবে ঘাপটি মেরে বসে থাকাটা বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। হ্যাঁ, বোকামি তো অবশ্যই। কারণ, আমি এখানে এভাবে থাকলে এরা তো আমার দিকে ফিরেও তাকাবে না। এই তো সবেই গেট পেরিয়ে সবার চোখের সামনে দিয়েই ডেকে নেমে এসেছি। তা ছাড়া বেশিক্ষণ আগে নয়, এই তো আমি মনকে শক্ত করে বেঁধে, বুকে সাহস সঞ্চয় করে গুটি গুটি ক্যাপ্টেনের নিজস্ব কেবিনে ঢুকি, আর তার টেবিল থেকে লেখার জন্য কাগজ-কলম প্রভৃতি নিয়ে ফিরে আসি।

আমি দিনপঞ্জি লিখতে আরম্ভ করলাম। মনস্থ করলাম, মাঝে মাঝে একটু ফুরসৎ পেলেই এ দিনপঞ্জি লেখার কাজ চালিয়ে যাব, তবে আমি এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ যে, আমার এ লখা অন্ধকার ডেকের বাইরে জগতে কারো কাছে পাঠাবার সুযোগ কোনোদিনই পাব না। তা সত্ত্বেও আমি মনস্থির করে ফেললাম, দিনপঞ্জি লেখার কাজ আমি বন্ধ করব না, চালিয়েই যাব। তবে কেনই বা এ পণ্ডশ্রম তাই না? শেষমেশ আমার দিনপঞ্জির পাণ্ডুলিপিটাকে একটা বোতলের মধ্যে ভরে, ভালোভাবে ছিপি এঁটে সমুদ্রের বুকে ভাসিয়ে দেব। সমুদ্রের বুকে ভাসতে ভাসতে সেটা কোনো-না কোনোদিন, কারো না কারো হাতে তো পড়বেই। যাকগে, সে চিন্তা করে আজ ফয়দাই বা কি? পাণ্ডুলিপিটার গতি যা হয় হবে।

একদিন আমার মনে একটা নতুনতর ভাবনার উদয় হলো। আসলে নতুন একটা ঘটনা ঘটার ফলেই আমার মনে ভাবনাটা জাগল। তবে কি এসবই অনিয়ন্ত্রিত আকস্মিকতার ফল, আকস্মিকতার পরিণতি?

সেদিন মনে জোর করে সাহস সঞ্চয় করে সে প্রায়ান্ধকার গহ্বর থেকে বেরিয়ে গুটি গুটি ডেকের ওপরে উঠে যাই। পা টিপে টিপে এগিয়ে সবার চোখের আড়ালে ডিঙির তলদেশে জমিয়ে রাখা পুরনো ছেঁড়াফাটা পাল আর মইয়ের দড়ির ভ্রুপের ওপর নেমে দাঁড়ালাম।

পাল আর দড়িদড়ার ওপরে দাঁড়িয়ে নিজের অদৃষ্ট বিড়ম্বনার কথা ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্কভাবে পাশের একটা পিপের গায়ে হাত বুলতে লাগলাম। তারপর অন্যমনষ্কভাবেই পিপেটার ওপরে রাখা ছোট পালটার গায়ে আলকাতরার বুরুশটা টানতে লাগলাম। পালটা জাহাজের ওপর কাৎ হয়ে অবস্থান করছে। ফলে অন্যমনষ্ক ও উদ্দেশ্যহীনভাবে চালানো বুরুশটার ঘষায় সেটার মুখে একটা শব্দ স্পষ্ট হয়ে উঠল। কি সে বিশেষ শব্দটা? আবিষ্কার। শব্দটা আমি স্পষ্ট পড়তে পারলাম।

আবিষ্কার শব্দটা আমার মনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করল। আমি এবার ঘাড় ঘুরিয়ে, দৃষ্টি ফিরিয়ে জাহাজটার গঠন প্রকৃতি দেখার দিকে মন দিলাম।

আমি অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে দীর্ঘসময় ধরে দেখে লক্ষ্য করলাম, জাহাজটা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। তবে আরও ভালোভাবে লক্ষ্য করে মনে হলো অস্ত্রশস্ত্র সাজানো থাকলেও এটা যুদ্ধজাহাজ নয়। কারণ, তার দড়িদাঁড়া, গঠন প্রকৃতি আর সাধারণ ব্যবস্থাদি দেখে সেটাকে যুদ্ধজাহাজ মনে করতে উৎসাহ পাওয়া গেল না। আর এটা যে কি নয়। তা অচিরেই বুঝে নিলাম। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা যে কি–ও বলা সম্ভব নয়। আসলে জাহাজটা সম্বন্ধে নিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল।

জাহাজটা, এটা যে আসলে কি তা আমার জানা নেই। দীর্ঘসময় ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেও সেটা সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলাম না। আসলে এর মডেলটাই অদ্ভুত। আর মাস্তুল? এর গঠন প্রকৃতিও খুবই বিচিত্র। আমাদের জাহাটারই কেবল নয়, অন্য কোনো জাহাজের মাস্তুলের গড়নও এরকম অদ্ভুত নয়। আর গলুইও সাদামাটা, পিছন দিকটাও একেবারেই সাধারণ আগেকার। দিনে জাহাজের পিছন দিকটা যে আকৃতি বিশিষ্ট করা হতো ঠিক সে রকম করেই তৈরি।

আমি আবারও অনুসন্ধিৎসু নজরে জাহাজটার পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজে মেতে গেলাম। সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। নতুন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে একেবারে হঠাৎই আমার মনের কোণে পূর্ব পরিচয়ের একটা অনুভূতি উঁকি দিল। আর সে অত্যাশ্চর্য অভাবনীয় অস্পষ্ট স্মৃতির সর্বদা প্রতিটা মুহূর্তই মিশে রয়েছে বিদেশের প্রাচীন ইতিকথা, বহুদিন আগেকার বর্ণনাহীন, ব্যাখ্যার অতীত স্মৃতি। আগেই তো বলে রেখেছি, সে স্মৃতি খুবই অস্পষ্ট, ঝাপসা, ঠিক যেন কুয়াশার মোড়কে আটকাপড়া।

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে জাহাজটার কাঠের দিকে তাকালাম। সাধ্যমত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম কোন্ কাঠ দিয়ে জাহাজটাকে তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও তা আবিষ্কার করা নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলাম না। আসলে এ কাঠ আমার একেবারেই অপরিচিত। এ ধরনের কাঠ আগে কোনোদিন দেখেছি বলেও মনে হলো না। কাঠটাকে দীর্ঘসময় ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তার এমন একটা বৈশিষ্ট্য আমার চোখে ধরা পড়ল যে, সেটা জাহাজে ব্যবহারের একেবারেই অনুপযুক্ত। কেন? এমন দৃঢ়তার সঙ্গে কথাটা কেন বলছি, তাই না? সমুদ্রের লোণা পানির সংস্পর্শে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর থাকায় কীটের দ্বারা আক্রান্ত হওয়া, বয়সের ভারে সহজেই জীর্ণ হয়ে পড়া ছাড়াও কাঠটার গায়ে অগণিত ছিদ্রের সৃষ্টি হওয়ার কথাই আমি বলতে চাচ্ছি। আবার এমন প্রশ্নও কারো না কারো মনে জাগতেই পারে। এ ব্যাপারটা নিয়ে আমার মধ্যে এমন কৌতূহলের উদ্রেক হলো কেন? তবে আমি স্বীকার করে নিচ্ছি, আমার কাজ ও কথার মধ্যে কৌতূহলের গন্ধ আছে ঠিকই। তবে জাহাজটায় ব্যবহৃত কাঠের মধ্যে স্পেনীয় ওক কাঠের যা-কিছু বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার সবই বর্তমান। স্পেনীয় ওক কাঠকে যদি অস্বাভাবিক, একেবারেই অভাবনীয় উপায়ে সম্প্রসারিত করা যায়, তবে আমার আর কিছুই বলার নেই। বক্তব্যটা যদি যুক্তিগ্রাহ হয় তবে মেনে না নিয়ে উপায়ই বা কি?

এ বক্তব্যটুকু পড়তে পড়তে আমার স্মৃতির পটে ভেসে উঠছে এমন এক বুড়ো ওলন্দাজ নাবিকের কথা–যে জীবনে বহুবার ঝড় ঝঞ্ঝার মোকাবেলা করেছে। হ্যাঁ, তার বক্তব্যটা বার বারই আমার মনে পড়তে লাগল।

বুড়ো ওলন্দাজ নাবিকটার কথায় তিলমাত্র সন্দেহ প্রকাশ করলেই সে মুখ না। খুলে পারত না। সে সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য করত–দেখ হে, সমুদ্রের বুকে জাহাজে চেপে ভাসমান কোনো নাবিকের দেহটা যেমন ক্রমে বেড়েই চলে, ঠিক একই রকমভাবে জাহাজটার দেহটাও ক্রমাগত বেড়েই চলে। তার পরই সে আবার বলে উঠত তেমন একটা সমুদ্রের অস্তিত্বও যে সত্যি সত্যি রয়েছে টা যেমন সত্যি আমার বক্তব্যটাও ঠিক তেমনি সম্পূর্ণ নিশ্চিত। কথাটা রীতিমত দৃঢ়তার সঙ্গেই বুড়ো ওলন্দাজ নাবিকটা বলত।

আমি ঘণ্টা খানেক আগে সেখান থেকে উঠে এসেছি। ওপারে, এক ধারে দাঁড়িয়ে তাকিতুকি করতে লাগলাম। আসলে আমি সুযোগের প্রতীক্ষায় রয়েছি, কিভাবে নাবিকদের সঙ্গে ভিড়ে যাওয়া যায়। শেষপর্যন্ত করলামও তাই। সুযোগ বুঝে একদল নাবিকের দলে ভিড়ে গেলাম। এমন আচরণ করতে লাগলাম, আমি যেন তাদেরই একজন। আর তারাও যেন আমার উপস্থিতির কথা বুঝেও বুঝল না।

আমি সুযোগ বুঝে নাবিকদের দলের একেবারে মাঝে চলে গেলাম। তাদের দলের মাঝে অবস্থান করেও আমার যেন মনে হলো আমার উপস্থিতি সম্বন্ধে তারা পুরোপুরি উদাসিন। আমার দিকে কারো তিলমাত্র লক্ষ্যও নেই।

আমি জাহাজটার খোলের মধ্যে অবস্থানকালে যে বুড়োটাকে থপ থপ করে ধীর মন্থর গতিতে হাঁটাচলা করতে দেখেছিলাম, আমার চারদিকের মানুষগুলোও যেন তারই মতো অতিবৃদ্ধ, জরার ভারে জীর্ণ। বার্ধক্য তাদের হাঁটুর জোর গ্রাস করে ফেলেছে, খুবই দুর্বল। আর এরই ফলে তাদের হাঁটু তিরতির করে অনবরত কেঁপেই চলেছে। আর জরার ভারে তাদের সবার কাঁধই সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। গায়ের ঢিলে হয়ে-পড়া শুকনো চামড়া দমকা বাতাসে কাঁপছে, কণ্ঠস্বর। কাঁপা কাঁপা কথাগুলো এমনই দুর্বোধ্য যে, তাদের একটা বর্ণও বোঝার উপায় নেই। আর এরই ফলে বুড়ো নাবিকগুলো নিজেদের মধ্যে যে সব কথা বলাবলি করছে, তার কিছুই আমার বোধগম্য হলো না। আর এও আমার নজরে পড়ল তাদের চোখের কোণগুলিতে বার্ধক্যজনিত পিচুটি ভিড় করে রয়েছে। আর এরই ফলে তারা পিটপিট করে তাকাচ্ছে আর চোখ দুটো চকচক করছে। আর তাদের মাথায় শনটাপের মতো সাদা পাকা চুলের গোছা। বাতাসে সেগুলো অনবরত উড়ছে। হঠাৎ করে দেখলে মনে হয় তাদের মাথায় যেন পাকা চুলের ঢেউ বয়ে চলেছে।

বুড়ো নাবিকগুলোর চারদিকে, ডেকের এখানে ওখানে–সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে গণিতশাস্ত্রে ব্যবহৃত অদ্ভুত আকৃতিবিশিষ্ট অপ্রচলিত বহু যন্ত্রপাতি। তাদের আকৃতি প্রকৃতি যে কী অদ্ভুত প্রকৃতির তা বলে শেষ করা যাবে না।

একটু আগেই তো এক বাঁকা-পাল অর্থাৎ বেঁকে-থাকা পালের কথা বলেছি, তাই না? সেই তখন থেকেই ভেঙে যাওয়া জাহাজটা একপাশে হেলেপড়ে প্রায় বাতাসের মতো তীব্র বেগে দক্ষিণ দিকে ধেয়ে চলেছে–অনবরত ছুটেছে তো ছুটেছেই। পা ঠিকঠাক রেখে দাঁড়িয়ে থাকাই সমস্যা হয়ে পড়েছে। কোনোরকম নিজেকে সামলে সুমলে জাহাজটার ডেকে পৌঁছতে পেরেছি। তবে এও ঠিক আমি জাহাজটার নাবিকদের কোনোরকম সমস্যায় ফেলেছি বলে মনে হলো না। সে মুহূর্তে একটা কথা আমার বারবার মনে হতে লাগল; আমরা এতগুলো প্রাণী যে উত্তাল উদ্দাম সমুদ্রের অতল গহ্বরে চিরদিনের মতো তলিয়ে যাইনি, এটাই তো একটা একেবারেই অলৌকিক ব্যাপার। অলৌকিক ব্যাপার ছাড়া একে আর কী-ই বা আখ্যা দেওয়া যেতে পারে? অতএব আমরা তো পুরোপুরি নিঃসন্দেহ যে, সমুদ্রের অতলে চিরদিনের মতো সলিলসমাধির পরিবর্তে অনাদি অনন্তকাল ধরে সফেন সমুদ্রের বুকে ঢেউয়ের তালে তালে চক্কর মেরে বেড়ানোই আমাদের বরাতে আছে।

জীবনের একটা বড় ভগ্নাংশই আমার কেটেছে উত্তাল সমুদ্রের বুকে। আর জীবনে যত ঢেউয়ের মুখোমুখি হয়েছি তার চেয়ে অনেক, অনেকগুণ প্রচণ্ড ঢেউয়ের তাণ্ডবের মোকাবিলা করতে করতে আমরা এগিয়ে চলেছি, বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উড়ে বেড়ানো সমুদ্র-পরীক্ষা, তীব্র অথচ স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে, তীব্র গতিতে এগিয়ে চলছি।

আকাশচুম্বী অতিকায় ঢেউগুলো আমাদের মাথা ডিঙিয়ে পাতালপুরীর দৈত্যদের মতো বার বার সদম্ভে মাথা তুলছে। পরমুহূর্তেই আবার নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে প্রায় স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। এমনি করে প্রতি মুহূর্তে ওঠা-নামার খেলা চলতে লাগল। তবে একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত যে, তারা আমার মধ্যে আতঙ্কের সঞ্চার করতে পারে সত্য বটে। কিন্তু ধ্বংস করে দেওয়ার ক্ষমতা নেই।

কিন্তু অভাবনীয়, একেবারেই অপ্রত্যাশিত উপায়ে যে আমরা বার বার জীবন রক্ষা করতে পারছি তার একটামাত্র প্রাকৃতিক কারণ আমার পক্ষে অনুমান করা সম্ভব হচ্ছে না। কি সে প্রাকৃতিক কারণ, তাই না? তবে খোলসা করেই বলছি, আমাদের বিকল হয়ে-যাওয়া ভাঙাচোরা জাহাজটা হয়তো বা কোনো প্রবল স্রোতের মধ্যে পড়ে তার টানে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করে এমন সুতীব্র গতিতে ছুটে চলছে। আর যদি তা নাই হয় তবে কোনো চোরা-স্রোতের টানে পড়ে ছুটছে তো ছুটছেই। না, এ ছাড়া অন্য কোনো কারণ আমার মাথায় আসছে না।

আমি অনুসন্ধিৎসু চোখে বার-কয়েক এদিক-ওদিক দৃষ্টি ফেরাতেই দেখলাম, ক্যাপ্টেন তাঁর নিজের কেবিনে দাঁড়িয়ে। আমার মুখোমুখি তিনি অবস্থান করছেন। কিন্তু আমি যা অনুমান করেছিলাম, তাঁর দৃষ্টি যেন কেমন অস্বাভাবিক, উদাস ব্যাকুল। ব্যাপারটা আমার মাথায় এলো না। আবার তাকে দেখে মানুষ ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেও আমি মনের দিক থেকে সাড়া পেলাম না। তবু তাঁর দিকে চোখ পড়তেই অন্তরের অন্তঃস্থলে জেগে উঠল বিস্ময়মিশ্রিত শ্রদ্ধা ও আতঙ্কের অনুভূতি। অস্বীকার করতে বিস্ময়ের চেয়ে আতঙ্কই আমাকে বেশি করে দুর্বল করে তুলল।

ক্যাপ্টেনের আপাদমস্তক চোখের মণি দুটোকে বুলিয়ে নিয়ে আমি অনুমান করতে পারলাম, তার দৈহিক উচ্চতা প্রায় আমারই সমান, পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি। সুঠাম দেহী বলিষ্ঠ বা বিশেষ করে বলার মতো কিছু নয়। বরং সব মিলিয়ে বলা যায়, ক্যাপ্টেন একজন দীঘাকৃতি, সুঠামদেহী সাদামাটা হেচারার মানুষ। তা সত্ত্বেও তার মুখের হাবভাবে এমন একটা বিশেষ ছাপ আমার নজরে পড়ল, যাতে বার্ধক্যের অতি অদ্ভুত আর রোমহর্ষক ভাব বলেই তার ব্যাখ্যা করা চলে। আর এক ঝলক দেখেই আমার মধ্যে একেবারেই অভাবনীয় ও অবর্ণনীয় অনুভূতির সঞ্চার হলো। সত্যি সে অনুভূতির কথা কিছুতেই আমার পক্ষে খোলসা করে বর্ণনা করা, কারো মধ্যে ধারণা সঞ্চার করা একেবারেই অসম্ভব। বার্ধক্যের প্রভাবে তার কপালের চামড়ায় পর পর বেশ কয়েকটি ভাজ পড়ে গেছে। আর সে কুঞ্চিত কপালের চামড়ার গায়ে যেন অনন্তকালের ছাপ অঙ্কিত হয়ে রয়েছে। তার মাথায়, কাকের বাসার মতো উসকো খুসকো পাকা চুলের ফাঁকে ফাঁকে লেখা রয়েছে ইতিহাস–অতীত কাহিনী। আর তার চোখের মণি দুটোর গায়ে লেখা আছে অকথিত ভবিতব্যের কথা।

কেবিনের মেঝেটা একেবারেই অপরিচ্ছন্ন। মেঝের এখানে ওখানে–সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে লোহার মোটা তার দিয়ে গাঁথা অদ্ভুত অদ্ভুত সব কাগজপত্র, বৈজ্ঞানিক কাজকর্ম আর পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভাঙাচোরা যন্ত্রপাতি আর সুদীর্ঘকাল অব্যবহৃত ও অপ্রচলিত তালিকা।

কয়েকমুহূর্ত পর আবার হঠাৎ তার দিকে চোখ পড়তেই লক্ষ্য করলাম, সে বুড়ো বিচিত্র এক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হাত দুটোর ওপর অদ্ভুতভাবে হাত দুটো রেখে অবর্ণনীয় এক ভঙ্গিতে, চোখের তারায়ও অদ্ভুত ছাপ এঁকে একটা কাগজের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রয়েছে।

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে কাগজটার দিকে তাকালাম। অনুসন্ধিৎসু চোখে সেটাকে দেখে নিয়ে আমি অনুমান করলাম, সেটা মোটেই একটা সাধারণ কাগজ নয়, একটা নিয়োগপত্র। আর তার গায়ে রাজার স্বাক্ষরটাও আমার নজর এড়াল না।

আমি আরও লক্ষ্য করলাম, খোলের মধ্যে যে বিচিত্র আর অদ্ভুত চরিত্রের বুড়োটাকে অনবরত বক বক করতে দেখেছিলাম, এ বুড়োটারও সর্বক্ষণ ঠোঁট নেড়েই চলেছে। অনুচ্চ কণ্ঠে, একেবারেই অস্ফুট স্বরে কি যেন বলছে। কেবলমাত্র অবোধ্য বিদেশি ভাষায়ই নয়, বড়ই বিরক্তির সঙ্গে নে কথাগুলো বলছে। আরও আশ্চর্য হলাম, যখন আমার মধ্যে ভাবনার উদয় হলো, বুড়ো নাবিকটা আমার কাছাকাছি আর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলছে আর আমার মনে হচ্ছে, যেন এক মাইল দূর থেকে বাতাসবাহিত হয়ে আমার কানে পৌঁছাচ্ছে। এমন একটা অভাবনীয় ব্যাপার নজরে পড়লে কার মধ্যে না বিস্ময়ের সঞ্চার ঘটে। আমি অপলক চোখে তাকিয়ে তার কাণ্ডকারখানা দেখতে লাগলাম।

ভালোভাবে লক্ষ্য করে নিঃসন্দেহ হলাম, জাহাজটার নির্মাণ পদ্ধতি তো বটেই এমন জাহাজের ভেতরে যেসব জিনিসপত্র ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, সবকিছুর গায়েই প্রাচীনত্বের ছাপ সুস্পষ্ট। আর নাবিকদের কথা নাই বললাম। আমার চারদিকে যারা অপেক্ষা করছে, এদিক-ওদিকে চক্কর মেরে চলেছে, তারা প্রত্যেকেই যেন বহু শতাব্দীর প্রেতাত্মা–প্রেত-ছায়ার মতো। আর তাদের চোখে-মুখে প্রকাশ পাচ্ছে সাগ্রহ আর অস্বস্তি। মশালের জোড়ালো আলোকচ্ছটায় তারা যখন আমার সামনে পথ আগলে পাশাপাশি দাঁড়ায়, সে মুহূর্তে আমার ভেতরে যে ভাবের সঞ্চার ঘটে, আমি

ইতিপূর্বে তেমন কোনো ভাবের শিকার অবশ্যই হইনি। সে যে কী এক অবর্ণনীয় ভাব, তার বর্ণনা করা আমার কাছে বাস্তবিকই কঠিন সমস্যার ব্যাপার।

সত্যি কথা বলতে কি, আমি জীবনভর প্রত্নতাত্বিক বস্তুসামগ্রি ঘাঁটাঘাঁটি করেই কাটিয়েছি। অর্থাৎ আমার অতীত কেটেছে মৃতের স্তূপ ঘাটাঘাটি করে। প্রত্নবস্তু কেনাবেচা করাই আমার একমাত্র পেশা। তাই বলতেই হয়, বর্তমানকে নিয়ে কোনোদিনই আমার মাথা ব্যথা ছিল না, অতীতই ছিল আমার সম্বল। আমার আত্মা ধ্বংসস্তূপে পরিণত না হওয়া অবধি আমি পৃথিবীর বহু দেশে চক্কর মেরে বেড়িয়েছি। আমি হরদম ঘুরে বেড়িয়েছি টার্ডমোর, বলবেক আর পার্সিপোলিসের প্রভৃতি ধ্বংসস্তূপে। আমার ঘুরে বেড়ানো ছিলনিত্যকার ব্যাপার।

ইদানিং মাঝে মধ্যেই নিজের অতীত আচরণের জন্য লজ্জাবোধ করি। তখন আমার মধ্যে যে ভয়ের সঞ্চার ঘটত, মন-প্রাণ ভয়ে আঁতকে উঠত আর যে অবর্ণনীয় ভয়ে থেকে থেকে কুঁকড়ে যেতাম আজ সে সব কথা স্মৃতির পটে ভেসে উঠলে খুবই লজ্জাবোধ করি, নিজেকে কম ছোট মনে হয় না।

একটা কথা, আমার অতীত জীবনে সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে যে ঝড়ের তাণ্ডবের শিকার হয়েছে, আতঙ্কে শিউরে উঠে, বাতাস আর সমুদ্রের সে তাণ্ডবকে সাইমুন ও টর্ণেডো বলে বর্ণনা করলেও তাকে ছোট করেই ব্যক্ত করা হবে। আর এরকম ভয়ঙ্কর একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে আমি কি আতঙ্কিত না হয়ে পারি? হ্যাঁ, সে পরিস্থিতিতে কেবলমাত্র আমি নই, যে কোনো বীরপুরুষই আতঙ্কে মুষড়ে পড়তে বাধ্য।

ভাঙাচোরা জাহাজটা গর্জনরত সমুদ্রের জলরাশির ওপর দিয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে তো চলেছেই। শুধুই কি সমুদ্রের উদ্দামতা? আমাদের জাহাজটাকে ঘিরে রেখে অন্তহীন জমাটবাধা অন্ধকার। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, অন্ধকার যক্ষপুরীর মধ্য দিয়ে আমাদের জাহাজটা যেন বাতাসের বেগে ধেয়ে চলেছে। আর ফেণাহীন পানির তোলপাড়ানি তো আছেই। প্রবল জলোচ্ছাস। আর থেকে থেকে অন্ধকার ভেদ করে প্রায় এক লীগ দূরত্ব জুড়ে অস্পষ্টভাবে বরফের প্রাচীর। বরফের প্রাচীর তুলে যেন দূর্গকে সুরক্ষিত করা হয়েছে। আর সে প্রাচীর যেন আকাশছোঁয়া। হঠাৎ করে দেখলে মনে হয় পৃথিবীর প্রাচীর যেন অন্ধকার আকাশেরনির্জনতা ভঙ্গ করে সদম্ভে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে নিজের অস্তিত্বের কথা ঘোষণা করছে।

আমার আশঙ্কা অমূলক নয়। বরং আমি যে আশঙ্কা করেছিলাম বাস্তবেও তাই ঘটে চলেছে। আমাদের ভাঙাচোরা জাহাজটা সত্যি সত্যি স্রোতের কবলে পড়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে। তবে জোয়ারের ফলে সে উদ্দাম স্রোতটা সাদা বরফের গায়ে আছড়ে পড়ার পর প্রচণ্ড গতিতে জলপ্রপাতের সুতীব্র বেগ দক্ষিণ দিকে ধেয়ে চলেছে। তাকে যদি ওই নামকরণ করা উচিত মনে হয়। স্রোতের দুরন্ত টানে আমাদের জাহাজটা কে জানে, কোন হারা উদ্দেশে ধেয়ে চলেছে তো চলেছেই।

আমার বিশ্বাস, আমার তখনকার আতঙ্কের অনুভূতিকে উপলব্ধি করা তিলমাত্রও সম্ভব নয়। সবকিছু নিশ্চিতভাবে জেনে-বুঝেও আমাকে সে অঞ্চলের জমাটবাধা রহস্য ভেদ করার অত্যুগ্র কৌতূহল, অভাবনীয় আগ্রহের কাছে আমি পরাজয় স্বীকার না করে পারলাম না। আমি অগ্র-পশ্চাৎ আর ভালো-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা নিঃশেষে হারিয়ে ফেললাম, তাই তো রহস্য ভেদের অদম্য কৌতূহল নিয়ে আমি মৃত্যুর সে ভয়ঙ্কর মূর্তির মুখোমুখি হওয়ার জন্য এগিয়ে না গিয়ে পারলাম না। আর এও সম্পূর্ণ সত্য যে, কোনো উত্তেজনাপূর্ণ জ্ঞানের দিকে আমরা দ্রুত, অতি দ্রুত ধেয়ে চলেছি–এমন এক জমাটবাধা অন্তহীন রহস্যের দিকে অগ্রসর হয়ে যাকে পাওয়ার অর্থই হচ্ছে নিশ্চিত ধ্বংস-মৃত্যু।

আমরা কোথায় চলেছি, কোথায় গিয়ে যে আমাদের এ যাত্রা ভয়ঙ্কর, এ পরিস্থিতির সমাপ্তি ঘটবে, কিছুই জানা নেই। এমনও হতে পারে, এ দুর্বার জলস্রোত আমাদের একেবারে দক্ষিণ মেরুতে নিয়ে হাজির করবে। আর আমরা হয়তো বা ভয়ঙ্কর সে অন্তিম পরিণতির দিকে যাব।

জাহাজের নাবিকরা কিন্তু চুপচাপ দাঁড়িয়ে নেই। তারা অস্থির আর কাঁপা কাঁপা পায়ে ডেকের ওপর হাঁটাহাঁটি করছে।

আমি আবারও অনুসন্ধিৎসু নজরে নাবিকদের এর-ওর মুখের দিকে বার বার তাকাতে লাগলাম। তাদের মুখে এখন যেন কেমন একটা নতুন ছাপ দেখতে পেলাম। তাদের চোখ মুখে হতাশার ও বিরক্তির ছাপটুকু যেন অনেকাংশে ম্লান হয়ে গেছে, আর সে জায়গা দখল করেছে গভীর আশা। মুখের হালকা হাসির প্রলেপটুকু আমাকে এ কথাটা ভাবতেই উৎসাহিত করছে।

কখন যে বাতাসের গতিবেগ মন্থর হয়ে গেছে, আর কখন যে বাতাসের গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে গেছে, আমি কিছুই টের পাইনি। এখন বাতাস পিছন দিকে আমাদের মাথার ওপর দিয়ে তিরতির করে বইতে শুরু করেছে।

অত্যাশ্চর্য একটা ব্যাপার আমাকে ভাবিয়ে তুলল। আমরা যখন পালের গদাটাকে কোনোরকমে বয়ে নিয়ে অগ্রসর হতে আরম্ভ করেছি, ঠিক সে মুহূর্তেই জাহাজটা সমুদ্রের ওপরে মাঝে মাঝে ভেসে উঠতে লাগল। হায়! এ কী মহাচক্করে পড়া গেল রে বাবা! এ কী নতুনতর আতঙ্কের শিকার হয়ে পড়লাম। একের পর এক আতঙ্ক আমার মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতে লাগল।

এক সময়ে আচমকা লক্ষ্য করলাম, আমাদের সামনের সমুদ্রটা যেন দু-দুটো ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। আর বাঁ দিকেও। সুবিশাল একটা রঙমঞ্চকে কেন্দ্র করে আমরা ভেঁ-ভোঁ করে অনবরত চক্কর মারতে শুরু করলাম। আর উভয়দিকে জমাটবাঁধা ঘুটঘুঁটে অন্ধকার বিরাজ করছে। সে গাঢ় অন্ধকারে রঙ্গমঞ্চটার প্রাচীরের শীর্ষদেশগুলো দূরের অন্ধকারে চাপা পড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

আমার পরিণতি যে কি হবে সে কথাটা ভাববার মতো সামান্যতম ফুরসত বা মন। কোনোটাই আমার নেই।

আমাদের জাহাজটা দ্রুত গতিতে অনবরত চক্কর মেরেই চলেছে। এবার লক্ষ্য করলাম, বৃত্তগুলো যেন ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। আর আমরা দ্রুত সমুদ্রের অতল গহ্বরের দিকে ধেয়ে চলেছি–তলিয়ে যাচ্ছি ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে।

নিরবচ্ছিন্ন আর্তচিৎকার, অনবরত গোঁ-গোঁ রবে আর্তনাদ হতে লাগল। আর সে সঙ্গে সমুদ্র আর ঢেউয়ের বজ্র-গম্ভীর বুক-কাঁপানো গর্জন তো রয়েছেই। এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে জাহাজটা যেন মোচার খোলার মতো বার বার এদিক-ওদিক অস্বাভাবিক দুলতে লাগল। হায়! হায় ঈশ্বর! জাহাজ ক্রমে তলিয়ে যাচ্ছে! সমুদ্রের অতলগহ্বরে আশ্রয় নেবার জন্য আমাদের জাহাজটা যেন অস্থির হয়ে পড়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *