1 of 2

উইলিয়াম উইলসন

উইলিয়াম উইলসন

উইলিয়াম উইলসন!

হ্যাঁ, এখনকার মতো মনে করা যাক, উইলিয়াম উইলসন আমার নাম।

এ মুহূর্তে আমার সামনে যে সাদা পাতাটা রয়েছে সেটার গায়ে আমার প্রকৃত নামটাকে লিখে কলঙ্কিত করার কিছুমাত্র আগ্রহও আমার নেই। আর সে নামটা তো আমার পরিবারের সদস্যদের চোখে অনেক অবজ্ঞা, অনেক বিতৃষ্ণা আর অনেক ভীতি সৃষ্টি করেছে। ক্রুদ্ধ বাতাস কি এসব অতুলনীয় অখ্যাতিকে পৃথিবীর প্রত্যন্ত কোণ পর্যন্ত পৌঁছে দেয়নি।

হায় কী যে মারাত্মক, অবর্ণনীয় জাতিচ্যুৎ। সবার দ্বারা আমাকে পরিত্যক্ত হতে হয়েছে। পৃথিবীর আপামর জনগণের চোখে কি আজ তোমার পরিচয় মৃত জন নয়? তুমি কি মৃত বলে পরিচিত নও? পৃথিবীর মান সম্মান, রঙ-বেরঙের ফুলের মেলা আর রঙিন মুখ-স্বপ্ন থেকে কি তুমি নির্মমভাবে নির্বাসিত নও? ঘন কালো এক টুকরো জমাট-বাঁধা মেঘ কি তোমার বাসনা আর স্বর্গের মধ্যে ব্যবধানের প্রাচীর সৃষ্টি করে না? হায়! আজ তুমি সবকিছু থেকে নির্মমভাবে বঞ্চিত।

আজ যদি আমার পক্ষে সম্ভব হত তবে আমার জীবনের শেষ অবর্ণনীয় দুঃখ যন্ত্রণা আর অক্ষমতা-অযোগ্যতার অপরাধের কাহিনী লেখনির মাধ্যমে আজই এখানে। তুলে ধরতে উৎসাহি হতাম না।

আমার জীবনের এ পর্যায়টা শেষের দিককার বছরগুলো মতো খুব বেশি রকম চাঙা করে দিয়েছিল।

এ মুহূর্তে আমার লক্ষ্য একটাই, আমার নীতিচ্যুত হওয়ার প্রথম দিকের ঘটনাগুলোকে সবার সামনে তুলে ধরা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, মানুষ সাধারণত তিলে তিলে ধাপে ধাপে নিচে নামতে আরম্ভ করে, খুবই ধীরগতিতে অবনতির পথে এগিয়ে যায়, তাই না? আমার ক্ষেত্রে কিন্তু অবনতির ব্যাপারটা ছিল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। আমার মধ্য থেকে সৎগুণাবলী একেবারে হঠাই বিচ্যুত হয়ে যায়।

খুবই নগণ্য একটা দুষ্টুমি থেকে আমি যেন দৈত্যের মতো ইয়া লম্বা একটা লাফ দিয়ে আকাশে পৌঁছাতে পারি।

হঠাৎ একেবারে হঠাই কিভাবে একটামাত্র ঘটনার মাধ্যমে চরমতম পাপ কর্মে ব্রতী হলাম–পরিণত হয়ে গেলাম জঘন্যতম পাপীতে, তা আমার বক্তব্য থেকেই

অবগত হওয়া যাবে।

মৃত্যু! নির্মম ও নিষ্ঠুর। মৃত্যু আমার শিয়রে দাঁড়িয়ে। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তের ছায়া আমার ওপর প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছে। একেবারেই অন্তিম মুহূর্ত।

নিতান্তই অজানা-অচেনা এ পথে পা-বাড়াবার পূর্বে আমি স্বাভাবিকভাবেই বন্ধু বান্ধবদের সহানুভূতির প্রত্যাশী হয়ে পড়লাম। তাদের কৃপার প্রত্যাশী বলতেও আমি কিছুমাত্রও কুণ্ঠিত নই।

সে মুহূর্তে আমার একটাই ইচ্ছা, আত্মজনরা জানুক এবং বিশ্বাস করুক, মানুষের পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, এরকম একটা ঘটনার জালে জড়িয়ে আমি নিছকই অসহায় হয়ে পড়েছিলাম। আমার একান্ত আগ্রহ, যে কাহিনী আমি রচনা করে চলেছি সেটা পড়ে সবাই জানুক, মর্মে মর্মে উপলদ্ধি করুক, মানুষ যতই বড় প্রলোভনের ফাঁদে পা দিক না কেন, ইতিপর্বে কেউই এমন অসহায়ভাবে প্রলোভনের খপ্পরে পড়েনি। জীবনে এমন অভাবনীয় পতন ঘটেনি। তাই যদি হয়, তবে এজন্যই আমার মতো আর কোনো মানুষ, কোনোদিনই আমার মতো এমন দুঃসহ যন্ত্রণার শিকার হয়ে তিলে তিলে দগ্ধে মরেনি?

সত্যি কি আমি এক স্বপ্নের ঘোরে প্রতিটা মুহূর্ত কাটাইনি? পার্থিব জগতের উন্মাদনা সঞ্চারকারী দৃশ্য দেখার ভয় ভীতি আর রহস্যের ফাঁদে পড়েই আমার মৃত্যু আসন্ন হয়ে ওঠেনি?

আমি যে বংশে জন্মগ্রহণ করেছি, অর্থাৎ আমার পূর্বপুরুষদের অনেকেই কল্পনার মাধ্যমে স্বপ্নরাজ্যে বিচরণ করতে এবং উত্তেজনার শিকার হয়ে হঠাৎ-হঠাৎ কাজ করে বসতেই উৎসাহি ছিলেন। আমি কিন্তু বাল্যকালেই পূর্বসূরীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অনেক নজির সৃষ্টি করেছি।

আমার বয়স আর গায়ে গতরে বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যেসব প্রবণতাও উত্তরোত্তর বেড়েই গেছে। আর সে প্রবণতা বিভিন্নভাবে আমার বন্ধুবান্ধব আর সে সঙ্গে আমার নিজের অনিষ্টই ডেকে এনেছে।

উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া গুণাবলী আমাকে ক্রমেই খুব বেশি রকম স্বেচ্ছাচারী, পরপীড়ক আর অসংযত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ করে তুলল।

আমার মতোই শারীরিক অক্ষমতা আর দুর্বল মানসিকতার জন্যই আমার বাবা-মা। চারিত্রিক বিয়গুলোকে সামলে রাখতে সক্ষম হননি। সে রকম কোনো কাজে তারা যখনই উৎসাহি হয়ে প্রবৃত্ত হয়েছেন তখনই তারা নির্মমভাবে পরাজয় স্বীকার করেছেন। তবে আমি কিন্তু পরাজিত তো হইনি বরং সর্বতোভাবে জয়ী হয়েছি।

আমার পরিবারের সবার ওপর উত্তরোত্তর সাফল্য আমার কর্তৃত্ব এনে দিয়েছে। আর এরই ফলে আমার প্রবর্তিত বিধানই পরিবারের কাছে আইন বলে গণ্য হয়েছে, অর্থাৎ এক বাক্যে আমার কর্তৃত্ব সবাই মেনে নিয়েছে। ব্যস, আর কথা নয়, সে-বয়স থেকেই আমি হয়ে উঠলাম আমার সর্বময় কর্তা, নিজেই নিজের ভাগ্য-নিয়ন্তা।

এলিজাবেথের যুগের একটা পুরনো বাড়ির ছবি আমার বিদ্যালয় জীবনের প্রথম স্মৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। সেটা ইংল্যান্ডের কুয়াশার চাদরে মোড়া এক গ্রাম্য পরিবেশে অবস্থিত। স্বীকার না করে পারছি না। পুরনো সে শহরটা আমার যথার্থই এক স্বপ্নরাজ্য, একটা শান্তি-সুখের আধার হিসেবে গণ্য হত।

সে বাড়িটা যে গ্রাম্য পরিবেশের নিছকই সাদামাটা একটা বাড়ি তা তো আগেই বলেছি। আরও কিছু বলতে গেলে সেটা ছিল একেবারেই অপরিকল্পিত ও রীতিমত অগোছালো। বাড়িটায় যতগুলো ঘর ছিল তার মধ্যে পড়াশুনার ঘরটাই সবচেয়ে বড় ছিল। সেটাই ছিল আমাদের পাঠশালা আর বাড়ি।

সে পুরনো জরাজীর্ণ বাড়িটার একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটা ঘরয় ছিল অধ্যক্ষ রেভারেন্ড ড. ব্র্যানসবিরের থাকার ব্যবস্থা। এ ছাড়া ছাত্র জীবনের স্মৃতি আর কিই বা থাকতে পারে? সেই কাকডাকা ভোরে বিছানা ছেড়ে ওঠা, চেঁচিয়ে পড়া মুখস্ত করা রাতে ঘণ্টার শব্দ হলে ঘুমিয়ে পড়া, সাময়িক অধছুটি ভোগ করা, মানে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানো আর খেলতে গিয়ে মাঠে ঠেলাঠেলি, গুঁতোগুতি আর পরস্পরের মধ্যে বাকবিতণ্ডা, মন কষাকষি আর প্রতিদ্বন্দ্বীতা–ব্যস। কিন্তু সে ঘটনার স্মৃতি করেই আমার মধ্যে ধুয়ে মুছে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

তবুও একটা ব্যাপার আমার স্মৃতিতে আজও ছবির মতো স্পষ্ট আঁকা হয়ে রয়েছে। আমার প্রভুত্ব, আবেগ-উচ্ছ্বাস আর অত্যুৎসাহী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য আমি সহজেই স্কুলের বন্ধু, বিশেষ করে সহপাঠিদের নজর কেড়ে নিলাম। আর এরই জন্য অচিরেই সমবয়ী বন্ধুদের নেতা বনে গেলাম। তবে একজন বাদে। কে সে? সে ছাত্রটা আমার আত্মীয় ছিল না। অথচ তার নাম আর পদবী আর আমার নাম আর পদবী একই ছিল। তাই অন্য উপায় না থাকাতে আমি এ কাহিনীতে নিজের নাম ব্যবহার করেছি উইলিয়াম উইলসন। আর পদবীটা কল্পনা প্রসূত হলেও আমার আসল পদবীর কাছাকাছিই ছিল।

স্কুলের ব্যবহৃত ভাষায় যাকে ‘দল অর্থাৎ আমাদের দল’ আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে তাদের মধ্যে কেবলমাত্র সে ছাত্রটাই, নামের ব্যাপারে যাকে আমার মিতা বলা যেতে পারে, পড়াশুনার ক্ষেত্রে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল, খেলার মাঠেও অবশ্যই প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। সে আমার সব আদেশ অবলীলাক্রমে মেনেনিত না, আমার ইচ্ছার কাছেও নতি স্বীকার করত না।

প্রকৃতপক্ষে আমার নামের নামধারী ছাত্রটা সবক্ষেত্রে আমার জোর জুলুমের প্রতিবাদ করত, প্রবল বিরোধিতা করত। মাঝে মধ্যে কিশোর ছাত্রদের সর্দারি করতে গিয়ে আমি চরম ও নিঃশর্ত স্বেচ্ছাচার চালাতাম।

আমার স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে সহপাঠী উইলসনের বিরোধিতাই আমার কাছে সবচেয়ে অস্বস্তিকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। অসহ্য! একেবারেই বরদাস্ত করতে পারতাম না।

একটা কথা অস্বীকার করতে পারব না, আমি বাইরে যত হম্বিতম্বি করি না কেন ভেতরে ভেতরে কিন্তু তাকে ভয়ই পেতাম। আর এও সত্য যে, আমি তাকে সমকক্ষ বলেই ভাবতাম, হয়তো বা আমার চেয়ে বড়ও মনে করতাম। তবে এও খুবই সত্য যে, এই যে ‘সমকক্ষ বা আমার চেয়ে ‘বড়’ এ-কথাটাকে একমাত্র আমি নিজে ছাড়া দলের দ্বিতীয় কেউই কিছুতেই মেনে নিত না। তবে এও খুবই সত্য যে, উইলসন নিজের কিন্তু বড় একটা উচ্চাভিলাষী বা আগ্রহি যে ছিল তা বলা যায় না।

সে অন্য দশজনের কাছে মুখে যা-ই বলুক বা যা-ই করুক না কেন, অন্তরের অন্তঃস্থলে কিন্তু আমার প্রতি অব্যক্ত একটা আকর্ষণ অনুভব করত।

আমার সহধ্যায়ী উইলসনের এ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, উভয়ের একই নামকরণ আর একই দিনে উভয়েরই স্কুলে ভর্তি হবার ঘটনা প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে একটা বিশ্বাসের দানা বেঁধেছিল যে আমরা দুই সহোদর। এ-বিশ্বাসটা আদৌ সত্যি নয়। কিন্তু আমরা যদি সত্যি সহোদর হতাম তবে অবশ্যই যমজ ভাইই হতাম।

‘যমজ ভাই’ কথাটা কেন বললাম? এর পিছনে যুক্তি অবশ্যই আছে। কারণ, অধ্যক্ষ রেভারেন্ড ড. ব্রাসরির স্কুলের পাঠ শেষ করে সবাই ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার পর ঘটনাচক্রে আমি জানতে পেরেছিলাম, আমার নামের নামধারী সহপাঠী বন্ধুটা জন্মেছিল ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের ১৯ জানুয়ারি। আর ঠিক একই বছরে, একই তারিখে আমিও প্রথম পৃথিবীর আলো দেখেছিলাম।

একটা কথা আমাকে স্বীকার করতেই হবে, উইলসনের নিরবচ্ছিন্ন রেষারেষি আর প্রতিবাদের ফলে আমাকে বড়ই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে দিয়ে প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্ত কাটাতে হত সত্য বটে। তা সত্ত্বেও তাকে সম্পূর্ণরূপে ঘৃণা করা। অর্থাৎ মনে প্রবল। বিদ্বেষ পোষণ করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কথাটা অবাক হবার মতো মনে হলেও এটাই ছিল প্রকৃত ব্যাপার।

কেন? কেন এমন কথা বলছি? কারণ, প্রায় রোজই তার সঙ্গে কোনো-না-কোনো ব্যাপারে আমার ঝগড়া বাঁধতই বাধত। তা সত্ত্বেও আমাদের মধ্যে কিন্তু বাক্যালাপ বন্ধ হত না। সমানে সমানেই লড়াই চলত। তবে একটা ব্যাপারে সে অন্তরের গভীরে দুর্বলতা পোষণ করত।

কোনো দীর্ঘরোগ ভোগের দরুণ হয়তো তার কণ্ঠনালিটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল যার ফলে সে তার কণ্ঠস্বর কিছুতেই করতে পারত না। কথা বললে কেবলমাত্র ফিসফিস শব্দসহ স্বর উচ্চারিত হত। তবে তার বক্তব্য বুঝতে অসুবিধা হত না, ব্যস এটুকুই। আমি তার এ দৈহিক দুর্বলতার সুযোগটা নিতে ছাড়তাম না। এ ব্যাপারে সে ছিল সত্যি অসহায়। সত্যি বলছি, আসলে আমি তার অসহায়ত্বটাকেই কাজে লাগাতাম।

আমার ওপর বদলা নেবার জন্য উইলসন চিন্তা-ভাবনা করে মাথা থেকে হরেক রকম উপায় বের করত। আর সেগুলোকে বাস্তবে প্রয়োগ করে আমাকে ঘায়েল করার জন্য উঠে পড়ে লেগে যেত। তবে সেগুলোর মধ্যে একটা রসিকতা সে প্রায়ই ব্যবহার করে আমাকে যারপর নাই ব্যতিব্যস্ত করে তুলত। সত্যি, আমি তাতে বড়ই বিব্রত হয়ে পড়তাম। আমি যে অতি নগণ্য, তুচ্ছাতিতুচ্ছ একটা কারণে এমন বেশিমাত্রায় বিব্রত হব, রেগে মেগে একেবারে আগুন হয়ে যাব, এটা সে যে কি করে মাথা খাঁটিয়ে বের করেছে, তা আজও আমার পক্ষে আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি।

স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আমার পৈত্রিক নামটার প্রতি আমার প্রথম থেকে, মনে জ্ঞান হওয়া অবধি একটা বিতৃষ্ণা অন্তরে পোষণ করে আসছিলাম। নামটার চেয়ে অনেক, অনেক বেশিমাত্রায় বিতৃষ্ণা ছিল আমার নামের আগে ব্যবহৃত পদবীটার প্রতি। সে শব্দগুলো ব্যবহার করে আমাকে সম্বোধন করল, ক্রমশ আমার সামনে যে কোনো প্রসঙ্গ উত্থাপন করা মাত্র মনে হত কানে বুঝি বিষ ঢেলে দিল। মুহূর্তের মধ্যে আমার মধ্যে ক্রোধের সঞ্চার ঘটত। আমি ক্রোধে রীতিমত ফুঁসতে লাগলাম। সে কারণেই, আমি যেদিন ভর্তি হওয়ার জন্য প্রথম স্কুলে পা দিলাম সেদিন, সে মুহূর্তে দ্বিতীয় এক উইলিয়াম উইলসনও সেখানে উপস্থিত ছিল। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই আমার ভেতরে অবর্ণনীয় ক্রোধের সঞ্চার ঘটল। অব্যক্ত ক্রোধে আমি ভেতরে ভেতরে ঘোৎ ঘোৎ করতে লাগলাম।

আমি কেন সেদিন এমন ক্রুদ্ধ হয়েছিলাম? আমার ক্রোধের কারণ তো অবশ্যই ছিল। নামটার প্রতি গোড়া থেকেই যে আমার বিরক্তি ছিল, তা-তো আগেই বলেছি। তাই বিরক্তিকর নামটার অধিকারী আমি স্কুলে পা দিয়েই যখন সেখানে অন্য আর এক উইলিয়াম উইলসনের উপস্থিতি উপলব্ধি করলাম তখন স্বাভাবিকভাবেই আমার মাথায় একটা ব্যাপার ঘুরপাক খেতে লাগল–‘নাম বিভ্রাট’-এর জন্যই একজনের সুনাম বদনামের বোঝা অন্য একজনের ঘাড়ে এসে পড়বে।

তখনও অর্থাৎ স্কুল-জীবনের প্রথম দিন আমার মাথায় আসেনি, আসবেই বা কি করে যে, আমরা উভয়েই সমান বয়স্ক, একই দৈহিক উচ্চতাবিশিষ্ট, আর চোখ, মুখ আর নাকের দিক থেকেও আমাদের মধ্যে যারপরনাই সাদৃশ্য বর্তমান। আর দৈহিক গঠন বৈশিষ্টের দিক থেকেও আমরা উভয়ে অবিকল একই রকম।

তখন কিন্তু আমি ঘুণাক্ষরেও ব্যাপারটা ভাবতে পারিনি। আর প্রথম দর্শনেই এমন একটা ভাবনা তো কারো মাথায় আসারও কথা নয়। কি সে ব্যাপার, তাই না? ঠিক আছে খোলসা করেই বলছি–আমাদের উভয়ের নাম পদবী আর দৈহিক সাদৃশ্যের ব্যাপারটাকে সে যে ভবিষ্যতে আমাকে ঘায়েল মানে বিরক্ত ও অতিষ্ট করে তোলার জন্য মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে এরকম তিলমাত্র আশঙ্কাও আমার মনে জাগেনি।

সে ‘মোক্ষম অস্ত্রটা কি ছিল? অবিকল একটা ‘দ্বিতীয় আমি তার নাম-পদবী থেকে শুরু করেনিখুঁত দৈহিক বৈচিত্র্য পর্যন্ত সবকিছুর মধ্যেই বিরাজ করছিলাম। হ্যাঁ, এটাকেই সে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হিসেবে নির্বাচন করে নিয়েছিল। কেবল পদবী আর দৈহিক গঠন বৈচিত্র্যের কথাই বা বলি কেন? এমনকি কথা বলার ধরণ-ধারণ তার কাজকর্ম করার পদ্ধতির দিক থেকেও আমাদের মধ্যে কম-বেশি মিল থাকলেও সেনিষ্ঠার সঙ্গে অনুশীলন চালিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই বাকিটুকু রপ্ত করে যেটুকু ঘাটতি ছিল পূরণ করেনিল।

আর পোশাক আশাকের ব্যাপারটা? হুবহু একই রকম পোশাক ব্যবহার করা তো খুবই মামুলি ব্যাপার। অল্পায়াসেই সে সমস্যার সমাধান করে নেওয়া তো কোনো সমস্যাই নয়।

আর চলাফেরার যৎকিঞ্চিৎ বৈসাদৃশ্য যেটুকু ছিল অনুশীলনের মাধ্যমে দুদিনেই আয়ত্ব করেনিল। এবার সবশেষে সে নজর দিল কণ্ঠস্বরের ব্যাপারটার দিকে। কণ্ঠস্বরকে অনুকরণ করতে এতটুকুও চেষ্টার ত্রুটি করেনি। তবে প্রশ্ন উঠতেই পারে, সে নিজের ফ্যাসাসে কণ্ঠস্বরকে অনুশীলনের মাধ্যমে কি করে আমার মতো ভরাট কণ্ঠস্বরে পরিণত করল? হ্যাঁ, এরকম জিজ্ঞাসা জাগা স্বাভাবিক। ব্যাপারটা হচ্ছে, সে কিন্তু তার ভরাট গলার কণ্ঠস্বরকে আমার মতো উচ্চস্বরে তোলার জন্য তিলমাত্র চেষ্টাও করল না। যা করতে চেয়েছিল তা কিন্তু ঠিকই সেরে ফেলল। তার বিশেষ। কণ্ঠস্বর–নিচু স্বরের ফ্যাসফ্যাসে শব্দটা যেন অবিকল আমার কণ্ঠস্বরকেই প্রতিধ্বনিতে পরিণত করে ফেলল। তার এ অত্যাশ্চর্য-অদ্ভুত ক্ষমতাকে অস্বীকার করার ক্ষমতা। আমার অন্তত নেই।

উইলিয়াম উইলসন আমাকে সব দিক থেকে হুবহু নকল করে, অভিনয়ের মাধ্যমে আমাকেনিখুঁতভাবে নকল করার কাজটাকে এমন অভাবনীয়ভাবে সম্পন্ন করত, যা দেখে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত রাগে জ্বলে উঠত। সে মুহূর্তে অন্তত আমি কিছুতেই তাকে বরদাস্ত করতে পারতাম না। অস্বীকার করব না, তখন আমার মনে হত দৌড়ে গিয়ে তাকে চিবিয়ে খেলেও বুঝি তার ওপরে আমি সন্তুষ্ট হতে পারব না।

এতকিছু সত্ত্বেও আমার একটা সান্ত্বনা অবশ্যই ছিল। সেটা কি? তার এ অদ্ভুত অভিনয়টা কেবলমাত্র আমি ছাড়া আর কেউই হৃদয়ঙ্গম করে মজা লুটতে পারত না।

আরও আছে। নিজে সফল অভিনয়ের ফলে তার ঠোঁটে–চোখে-মুখে ব্যঙ্গের হাসি প্রকট হয়ে উঠত, একমাত্র আমিই সেটা বুঝতে পারতাম। দাঁত কিড়মিড় করে নীরবে হজম করে নিতাম। তবে স্কুলে অন্য কোনো ছাত্রই তার বিন্দু বিসর্গও বুঝতে পারত না। আর সেই কারণেই তার সঙ্গে যোগ দিয়ে কেউ আমাকে নিয়ে বিদ্রুপে মেতে উঠত না।

বহুদিন ধরে বহু চেষ্টা করেও এ অসহনীয় রহস্যটা ভেদ করা আমার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হয়নি। ফলে নিতান্ত অসহায়ভাবে এ-কুটিল ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ আমাকে মুখ বুজে হজম করতেই হয়েছে।

দীর্ঘ ভাবনা-চিন্তার পর আজ আমার যতদূর মনে পড়ছে, তখন তার সঙ্গে আমার জোর বাকযুদ্ধ–কথা কাটাকাটি হয়েছিল। আমি এমনই ক্ষেপে গিয়েছিলাম যে, গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠে তাকে ঘা-কতক বসিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম।

আমি গায়ে হাত দেওয়ায় সে ক্রোধে একেবারে ফেটে পড়ার যোগাড় হল। এমন একটা ব্যাপার তার কাছে বাস্তবিকই অপ্রত্যাশিত ছিল। ক্রোধ সম্বরণ করতে না পেরে সে রীতিমত অগ্নিশর্মা হয়ে গিয়ে আমাকে লক্ষ্য করে এমনকিছু কটুক্তি করল আর এমনকিছু কথা–গালমন্দ করল যা নিতান্তই তার স্বভাববিরুদ্ধ। তার আচরণে আমি যতটা বিস্মিত হয়েছিলাম তার চেয়ে অনেক বেশি সে মর্মাহত ও লজ্জিত হয়েছিলাম। সে এ ব্যাপারে মুখে কিছু না বললেও তার আচার ব্যবহারের মাধ্যমে আমি ঠিকই এটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম।

তবে একটাই সান্ত্বনা যে, ঘটনাটা আর বেশিদূর গড়ায়নি, এমনকি দীর্ঘস্থায়ী প্রতিক্রিয়াও লক্ষিত হয়নি।

হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম, আমার বিশ্বাস পুরনো বাড়িটায় ছোট-বড় অনেকগুলো ঘর ছিল, তাদেরই একটা ছিল খুবই বড়-সড়, যাকে আমরা হলঘর বলতাম। হলটার লাগোয়া কতকগুলো ছোট ছোট ঘরটায় পড়ুয়াদের থাকার ব্যবস্থা ছিল। কিছুসংখ্যক ছাত্র ওই ঘরগুলোতেই থাকত।

আর অধ্যক্ষ রেভারেন্ড ডাঃ ব্র্যানসোবির থাকার ঘরটার কথা তো আগেই বলেছি–বাড়িটার এক্কেবারে শেষ প্রান্তের পায়রার খোপের মতো একটা ছোট্ট ঘরে তার থাকার ব্যবস্থা ছিল। আবার বড় হলো ঘরটাতেই অধিকাংশ থাকত। আর উইলিয়াম উইলসনের থাকার ব্যবস্থা ছিল হলঘরটার লাগোয়া ছোট ছোট ঘরগুলোর একটাতে।

একটু আগে যে উইলিয়াম উইলসনের গায়ে হাত দেবার ঘটনার উল্লেখ করেছি, সে ঘটনার ঠিক পর পরই, আমার স্কুলে ভর্তির ঠিক পাঁচ বছরের শেষার্ধের এক রাতের কথা বলছি। আমি তক্কে তক্কে ছিলাম, বাড়ির অন্য সব ছাত্ররা ঘুমিয়ে পড়ার পর আমি খুবই সন্তর্পণে, যাকে বলে একেবারে পা টিপে টিপে নিজের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম।

আগের মতোই সন্তর্পণে বারান্দাটা পেরিয়ে উইলিয়াম উইলসনের শোবার ঘরের দরজায় গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। উত্তর্ণ হয়ে লক্ষ্য করলাম, সে ঘুমিয়ে পড়েছে, নাকি জেগে আছ? মোটামুটি নিঃসন্দেহ হলাম, ঘুমিয়েই পড়েছে। এবার দরজায় মৃদু আঘাত করলাম। না, ভেতর থেকে কোনো শব্দই ভেসে এলো না। সে যে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে এ ব্যাপারে আমার মনে আর সামান্যতম সন্দেহই রইল না।

ব্যস, আর মুহূর্তমাত্রও দেরি না করে আমি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেলাম।

সত্যি কথা বলতে কি, একটা কূটবুদ্ধির খেলায় তাকে ঘায়েল করে তৃপ্তি লাভের প্রত্যাশা বুকে নিয়ে উপযুক্ত সুযোগের প্রত্যাশায় তক্কে তক্কে ছিলাম। দীর্ঘ প্রতীক্ষার। পর এবার বাঞ্ছিত সে মওকাটা হাতের মুঠোয় পেয়ে গেলাম।

আমি খুবই সন্তর্পণে, যাকে বলে অবিকল বিড়ালের মতো পা টিপে টিপে এগিয়ে গিয়ে তাকের ওপরে রক্ষিত জ্বলন্ত বাতিটাকে চাপা দিয়ে আবার একই রকম সন্তর্পণে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। ঢাকা দেওয়া বাতিটাকে বাইরে রেখে দিয়ে আবার ঘরের ভেতরে ঢুকে গেলাম।

দুপা এগিয়ে আমি একেবারে তার চৌকিটা ঘেঁষে দাঁড়ালাম। সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে একটু উৎকর্ণ হয়ে তার নিশ্বাসের শব্দ লক্ষ্য করলাম।

সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ হলাম, সে সত্যি সত্যি গভীর ঘুমে ডুবে রয়েছে।

ঘর থেকে আবার বেরিয়ে বাতিটা হাতে করে আবার ঘরের ভেতরে গেলাম। মশারি টাঙিয়ে সে শুয়েছিল। সেটা ফেলাই রয়েছে।

মশারিটা সামান্য ফাঁক করে বাতিটা ভেতরে ঢুকিয়ে নিতেই উজ্জ্বল আলোকচ্ছটা তার ঘুমন্ত মুখের ওপর পড়ল। আমি অপলক চোখে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি নিরবচ্ছিন্নভাবে তার মুখের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধই রাখলাম।

মুহূর্তের একটা অভাবনীয় অসাড়তা, বরফের মতো ঠাণ্ডা ভাব যেন আমাকে গ্রাস করে ফেলল। সত্যিকারের অভাবনীয় একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হলাম আমি।

কেবলমাত্র আমার বুকের ভেতরে যে ধুকপুকানিই শুরু হয়ে গেছে তা-ই নয়, হাঁপরের মতো বুকটা বার বার ওঠানামা করতে লাগল। আর হাঁটু দুটোও থর থর করে। কাঁপতে আরম্ভ করে দিল। কী যে অত্যাশ্চর্য রীতিমত অকল্পনীয় পরিস্থিতির মুখোমুখি আমি হলাম তা ভাষায় প্রকাশ করা মোটেই সম্ভব নয়। অহেতুক একটা আতঙ্ক আমাকে যেন পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলল।

আমি আরও অনেক, অনেক বেশি মাত্রায় হাঁপাতে আরম্ভ করলাম। হাঁপাতে হাঁপাতেই আমি মোহমুগ্ধের মতো জ্বলন্ত আলোটাকে তার আরও কাছে নামিয়ে নিলাম।

আমি একেবারে হঠাৎই সচকিত হয়ে খাড়াভাবে দাঁড়িয়ে পড়লাম। শরীরের সব কয়টা স্নায়ু যেন একই সঙ্গে ঝনঝনিয়ে উঠল। বুকের ঢিবঢিবানিটা আরও অনেকাংশে বেড়ে গেল।

কে? কে এটা? উইলিয়াম উইলসন? এটা কি উইলিয়াম উইলসনেরই মুখ? আমার চোখের সামনে কে শুয়ে রয়েছে।

হ্যাঁ, আমি ঠিক তাই দেখলাম। সত্যি সত্যি উইলিয়ামই বটে। কেন আমার মন এমন বিপরীত ভাবনার শিকার হয়ে গেল–কিভাবে? কেনই বা অসহ্য আতঙ্কে ভরে উঠল? অব্যক্ত তীব্র যন্ত্রণায় আমি যেন কেমন কুঁকড়ে যেতে লাগলাম।

কেন? কেন? কেন আমার মন এমন অকল্পনীয় আতঙ্কে ভরে উঠল? এমনকি রয়েছে তার মুখে যা আমাকে এতটা বিচলিত আতঙ্কিত করে তুলল?

ভাবলাম, হয়তো বা চোখ আর মনের ভুলের জন্যই আমি এমন একটা অভাবনীয় পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে পড়েছি। আবারও তার মুখের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। মাথাটা ঝিম ঝিম করতে লাগল। কিছুটা সময় এলোমেলো হরেক রকমের চিন্তা আমার মাথায় আশ্রয় নিয়েছে। মাথাটা বার বারই চক্কর মেরে উঠতে লাগল। আর কানের ভেতরে শুরু হলো দদপানি।

হায় ঈশ্বর! এ কী দেখছি! এ আমি কাকে দেখছি! কিন্তু জাগ্রত আমার উইলিয়াম উইলসন তো এমনটা দেখতে নয়, কিছুতেই নয়। তবে? তবে চোখের সামনে এ আমি কাকে দেখছি! একই নাম-পদবী! একই দৈহিক গঠন! তারপর দীর্ঘ অনুশীলনের মাধ্যমে আমার চালচলন অনুকরণ। নিরবচ্ছিন্ন প্রয়োগের মাধ্যমে আমার আচরণ আর স্বভাব নিখুঁতভাবে নকল করা–এ কী রক্ত-মাংসে গড়া কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব? এই মাত্র চোখের সামনে যা চাক্ষুষ করলাম, তা কি তবে এ ব্যাঙ্গাত্মক অনুকরণের, নিরবচ্ছিন্ন অনুকরণের ফল ছাড়া কিছু নয়?

আতঙ্কে বার বার শিউরে উঠে ফুঁ দিয়ে হাতের বাতিটাকেনিভিয়ে দিলাম।

অসহ্য! রীতিমত অসহনীয় পরিস্থিতির শিকার হওয়ায় আমার মধ্যে অসহনীয় অস্থিরতা ভর করল। আর এক মুহূর্তও পুরনো পাঠশালা-বাড়িটায় থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হলো না।

আমি আগের চেয়েও সন্তর্পণে নিঃশব্দে তার ঘরটা থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একেবারে সদর দরজার বাইরে চলে এলাম।

আর কোনোদিন, একটা মুহূর্তের জন্যও আমি সে বাড়িটার ভেতরে ঢুকিনি। আমাকে জোর করেও কেউ আর সেখানে পাঠাতে পারেনি। অলসতা, শুধুমাত্র অলসভাবে শুয়ে বসে আরও মাসকয়েক আমি বাড়িতেই কাটিয়ে দিলাম।

তারপর ইনটন-এর স্কুলের খাতায় নাম লেখালাম। সেখানে নতুন করে পাঠাভ্যাস চালাতে লাগলাম।

এই অল্প সময়ের মধ্যেই আমার মন থেকে অধ্যক্ষ রেভারেন্ড ডাঃ ব্র্যানসবির পাঠশালার অবাঞ্ছিত ঘটনার স্মৃতি অনেকাংশে ম্লান হয়ে গেল। ভয়ঙ্কর সে নাটকের সে দৃশ্যটার চিহ্নমাত্রও আমার মনে আর অবশিষ্ট থাকল না। পুরো ব্যাপারটাকেই আমি সাময়িক চোখ ও মনের ভুল বলেই ধরে নিলাম। তাই তার লেশমাত্রও আর মনের গভীরে টিকে থাকার কথাও নয়।

তারপর শোচনীয় স্বেচ্ছাচার আমার জীবনের সর্বক্ষণের সঙ্গি করে নিলাম। স্কুলের প্রচলিত নিয়ম কানুন, কড়াদৃষ্টিকে কিছুমাত্রও আমল না দিয়ে চলতে লাগলাম। আমার তখনকার আচরণের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়ার চেষ্টা আর করলাম না। আর সে বিবরণ দিতে গেলে রীতিমত একটা পুস্তিকা তৈরি হয়ে যাবে। অতএব ব্যাপারটা চেপে যাওয়াই সব দিক থেকে মঙ্গল।

সত্যি কথা বলতে কি, তিন-তিনটা বছরের বোকামির ফলে ফায়দা কিছুই হলো না। যা পেলাম তা হলো কেবলমাত্র কিছু পাপ কর্মের পাকাপাকি অভ্যাস।

একটা সপ্তাহ ধরে দৈহিক ভ্রষ্টাচারের মধ্য দিয়ে কাটিয়ে একদিন আমি একদল চরম বখাটে ছাত্রকে আমার ঘরে ডেকে নিয়ে এলাম। উদ্দেশ্য, তাদের নিয়ে গোপনে কিছু আনন্দ-ফুর্তি করে মনটাকে একটু চাঙা করে নেয়া।

তারা আমার ঘরে একটু বেশি রাতেই হাজির হল। আলোচনার মাধ্যমে আগেই পরিকল্পনা করে নিয়েছিলাম, ভোর পর্যন্ত সবাই হৈ-হুঁল্লোড়ে মেতে থাকব।

আমরা অফুরন্ত উন্মাদনায় মত্ত হয়ে একের পর এক মদের বোতল খুলে গলায় ঢালতে লাগলাম। কেবলমাত্র যে গলা পর্যন্ত মদ গিলেই আমরা সেদিন ক্ষান্ত দিয়েছিলাম তাই নয়। সে আরও বহুরকম মারাত্মক বিপজ্জনক প্রলোভন তো ছিলই। ফলে ভোরের আলো যখন একটু একটু করে ফুটতে শুরু করল তখন আমাদের আনন্দ-ফুর্তি চরম রূপ ধারণ করল।

তখন মদ আর তাসের নেশায় একেবারে বদ্ধ উন্মাদ বনে গেছি। আর কারণে অকারণে একে ওকে অনবরত অকথ্য গালিগালাজ করে চলেছি। আমাদের, বিশেষ করে আমার মুখে যেন খই ফোঁটার মতো খিস্তি বেরোতে আরম্ভ করল।

আচমকা ঘরের দরজার পাল্লা দুটো সামান্য ফাঁক হল। পরিচারকের কথা শুনতে পেলাম। চৌকাঠের বাইরে দাঁড়িয়েই সে বলল, কে একজন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। জরুরি দরকার। হলঘরে অপেক্ষা করছে।

মদের নেশায় আমার মধ্যে তখন উন্মত্ততা জাগিয়ে তুলেছে। ফলে হঠাৎ মজা লোটার বাধা পড়ায় অবাক না হয়ে আমি বরং আনন্দিতই হলাম।

চাকরের তলব পেয়েই আমি মদের ঘোরে টলমল শরীরটাকে কোনোরকমে টানতে টানতে হলঘরের দিকে হাঁটতে লাগলাম।

সামান্য এগিয়েই বাড়ির বারান্দার লাগোয়া ঘরটার দরজায় হাজির হলাম। ঘরটা ছোট্ট। ফলে জানালা দিয়ে সবে ভোরের আলো ফুটে ওঠা হালকা আলো ছাড়া ঘরে আর কোনো বাতির আলো ছিল না। তাই ঘরটা প্রায় অন্ধকারই ছিল।

আমি টলতে টলতে এগিয়ে গিয়ে দরজার চৌকাঠের গায়ে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তেই চোখে পড়ল আমার মতোই লম্বাটে এক কিশোরের মূর্তি ঘরটার ভেতরে অবস্থান করছে। তার পরনে একটা সাদা ফ্র। তখন আমার পরনে যেমন জামা ছিল, ঠিক সেরকমই একটা ফ্রক আগুন্তুক কিশোরটা ব্যবহার করেছে। ভোরের হালকা আলোয় এটুকু কোনোরকমে দেখতে-বুঝতে পারলাম। কিন্তু ক্ষীণ আলোয় তার মুখটা ভালো দেখতে পেলাম না। আমি চৌকাঠ ডিঙিয়ে ঘরের ভেতরে পা দিতেই সে ব্যস্ত-পায়ে এগিয়ে এসে খুবই অস্থিরভাবে আমার হাতটা জড়িয়ে ধরল।

আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই আগন্তুক কিশোরের মূর্তিটা একেবারে যন্ত্রচালিতের মতো নিজের মুখটাকে আমার কানের কাছে নিয়ে এসে অনুচ্চকণ্ঠে, একেবারই ফিসফিসানির স্বরে বলে উঠল–‘উইলিয়াম উইলিয়াম!

আকস্মিক চাবুক খেয়ে আমি যেন মুহূর্তের মধ্যেই সম্বিৎ ফিরে পেলাম। সচকিত হয়ে ঝট করে একেবারে খাড়াভাবে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

অপরিচিত আগন্তুকের চালচলন দেখে আর যেভাবে সে আমার চোখ দুটো আর আলোর মধ্যবর্তী স্থানে তর্জনি তুলে বার বার নাড়াতে লাগল তা লক্ষ্য করে আমি যারপরনাই অবাক হয়ে গেলাম। আমি যেন মুহূর্তে বাশক্তি হারিয়ে ফেললাম। কাঠের পুতুলের মতো নিশ্চল-নিথরভাবে দাঁড়িয়ে তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই যেন করার ক্ষমতা আমার মধ্যে ছিল না।

খুবই সত্য যে, কেবলমাত্র এটাই কিন্তু আমাকে এমন অভাবনীয় বিচলিত করে তোলেনি। তবে? তার সে অত্যাশ্চর্য রকমের হিস্ হিস্ করে বলা শব্দ দুটোর মধ্যে যেন এক গোপন তাৎপর্যপূর্ণ ভর্ৎসনার সুর বাজছিল। সবার ওপরে ওই দুটো সহজ সরল শব্দ, সুপরিচিত অথচ অনুচ্চ-অস্পষ্ট স্বরে বলা কথার বৈশিষ্ট্য আর বক্তব্য আমার ভেতরে অতীতের বহু, বহু স্মৃতিকে মুহর্তে মনের গভীরে জাগিয়ে তুলল। আমার অন্তরাত্মায় তীব্র খোঁচা মেরে সচকিত করে তুলল।

আমি যখন সম্বিৎ ফিরে পেলাম। চোখ আর কানকে নতুন করে পুরোপুরি সজাগ করতে পারলাম তখন দেখলাম, কামরার মধ্যে সে অনুপস্থিত–উধাও হয়ে গেছে। চোখের ভুল ভেবে সাধ্যমত অনুসন্ধিৎসু চোখে ঘরটার সর্বত্র তাকিয়ে দেখলাম, সত্যি সে যেন কর্পূরের মতোই উবে গেছে। স্তম্ভিত হলাম।

ব্যাপারটা নিয়ে সপ্তাহ কয়েক গভীর ভাবনায় ডুবে রইলাম। অদ্ভুত অদ্ভুত সব কল্পনা আমার মাথার ভেতরে জট পাকাতে লাগল।

আমার ভাবনা ওই আকস্মিক আর্বিভূত লোকটা আমার কাজে প্রতিবন্ধকতা করল, বিঘ্ন ঘটাল, অভিযোগের সুরে উপযাচক হয়ে আমাকে পরামর্শ দিয়ে গেল, তাকে যে আমি চিনতে পারিনি তা তো সত্য নয়।

মনের গোপন করে তা সত্ত্বেও জিজ্ঞাসা থেকেই গেল, কে ওই আগন্তুক কিশোর? কে-ই বা ওই উইলিয়াম উইলসন? কোথায় তার ঘর, এসেছেই বা কোত্থেকে? আর কোন দরকারেই বা এখানে এসেছিল, আমার সঙ্গে দেখা করেছিল? এরকম হাজারো প্রশ্ন আমার মাথার ভেতরে অস্থির পোকার মতো অনবরত কামড়াতে লাগল।

কিন্তু হায়! দীর্ঘসময় ধরে নিরলস প্রয়াস চালিয়েও ওইসব প্রশ্নের কোনোটারই উত্তর খুঁজে পেলাম না। মানসিক স্বস্তি কিছুতেই ফিরে তো পেলামই না, বরং অস্থিরতা হাজার গুণ বেড়ে গেল।

তবে চেষ্টা-চরিত্রের মাধ্যমে, কেবলমাত্র যেটুকু জানতে পারলাম, আমি যেদিন অধ্যক্ষ রেভারেন্ড ডা, ব্র্যান্সরির স্কুল ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলাম সেদিন বিকালেই তার পরিবারে একেবারে হঠাৎই একটা দুর্ঘটনা ঘটে যায়। আর এরই ফলে তাকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নেওয়া হয়। এছাড়া উপায়ও কিছু ছিল না।

আমি সে স্কুল ছেড়ে আসার পরই অক্সফোর্ডে যাওয়ার ব্যবস্থাদি করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পরি। অন্য কোনো দিকে মনোযোগ দেওয়ার অবসর ও মানসিকতা কোনোটাই সে মুহূর্তে আমার বিন্দুমাত্র ছিল না। তাই জোর তৎপরতার সঙ্গে উদ্যোগ-আয়োজন সেরে আমি দিন কয়েকের মধ্যেই অক্সফোর্ডে পারি জমালাম। আর সেখানে পা দিয়েই। আমি বাবা-মায়ের টাকাকড়ির জোরে বিলাসে মেতে গেলাম। যাকে বলে একেবারে লাগামহীন বিলাসে গা ভাসিয়ে দিলাম।

অক্সফোর্ডে পাঠাভ্যাস শুরু করতে না করতেই আমি এমন সব ঘৃণ্য, একেবারে জঘন্যতম কাজকর্মে মেতে উঠলাম, যে, জুয়াড়ির কাজকর্মের কৌশল রপ্ত করতেও আমি দ্বিধা করলাম না। এতটুকুও রুচিতেও বাঁধল না।

কয়দিনের মধ্যেই আমি একজন পয়লা নম্বরের জুয়াড়ি হয়ে গেলাম। জুয়ার দিকেই আমার দিনের একটা বড় অংশ কাটতে লাগল। সে কাজে আমার দক্ষতা উত্তরোত্তর বেড়েই যেতে লাগল।

সর্বজনবিদিত ও ঘৃনিত জুয়াখেলার জঘন্য কাজটায় আমি অতিমাত্রায় দক্ষতা অর্জন করে আমি কলেজের জনাকয়েক বোকা হাঁদার পকেট দেখতে দেখতে ফাঁকা করে দিলাম। আমার কলা-কৌশলে আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। দিনের পর দিন জুয়া খেলায় জিতে আমি অচিরেই একজন টাকার কুমির বনে গেলাম আর অন্যরা হয়ে গেল পথের ভিখারী ।

আমি এভাবে রীতিমত দাপটের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের দুটো বছর কাটিয়ে দিলাম।

তারপর, হ্যাঁ তারপরই ‘গ্লোণ্ডিনিং’ নামধারী এক যুবকের আকস্মিক আবির্ভাব ঘটল। সত্যি কথা বলতে কি তার পরিচয়, এক ধনী যুবক। এর ওর মুখে শুনলাম, সে নাকি হেববাডেস এটিকাসের মতোই বিত্তশালী। যাকে বলে একজন ধনকুবের। আর যে ধন-সম্পদের পাহাড় আমার মতোই নির্ভেজাল সৎ পথেই অর্জিত। কিন্তু তার সে সৎ পথটা যে কি তার খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা সে মুহূর্তে অন্তত করিনি।

আর কথাবার্তা ও কাজকর্মের মাধ্যমে এও বুঝতে পারলাম, তার মাথায় ক্ষার পদার্থ বলতে যা বোঝায় তা তিলমাত্রও নেই। পুরোটাই গোবর ভর্তি।

ব্যস, আমি মতলব এঁটে ফেললাম। কূট-কৌশলে আমি অচিরেই তাকে সাথে ভিরাবার জন্য তৎপর হয়ে পড়লাম। কাজ হাসিল করতে কিন্তু আমার মোটেই বেশি সময় তো লাগলই না। বরং অচিরেই আমার পবিত্র জুয়াখেলায় ভিড়িয়ে নিলাম।

কেউ নতুন খেলতে নামলে, খেলা শুরু করলে বিচক্ষণ ও চতুর জুয়াড়িরা গোড়ার দিকে তাকে জিতিয়ে দিয়ে তার লোভ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করে আকাশ-ছোঁয়া করে তোলে। আমিও একই বুদ্ধি-কৌশলকে কাজে লাগিয়ে নবাগত যুবক গ্লোণ্ডিনিংকে জিতিয়ে দিয়ে তার আকর্ষণকে ক্রমেই বাড়িয়ে তুলতে লাগলাম।

হ্যাঁ, আমার মতলবটা পুরোপুরি কাজে লেগেছে। যুবক গ্লোণ্ডিনিং অচিরেই আমার ফাঁদে মাথা গলিয়ে দিল। তাকে কজা করে ফেলতে পারায় আমার মনে যে কী অব্যক্ত খুশির জোয়ার বয়ে গেল তা কাউকে বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়।

একদিন মওকা বুঝে উভয়েই সহাধ্যায়ী মি. প্লেন্টনের ঘরে আট-দশজনের বেশ জোরদার এক জুয়ার আড্ডা গড়ে তুললাম। সবাই আমার কলেজের বন্ধু, সহায়ধ্যায়ী।

আগেই বলে রাখা দরকার, আমার মাথায় যে কূট একটা মতলব কাজ করছিল তার তিলমাত্রও উইলিয়াম উইলসন জানত না। আমার আচরণের মাধ্যমেও বদ পরিকল্পনাটার বিন্দুবিসর্গও টের পায়নি।

সে যা-ই হোক, অনেক রাতে প্রায় গভীর রাতে জুয়াখেলা শুরু হয়। মদের নেশায় ধনকুবের ছাত্রটা একেবারে কুঁদ হয়ে আসরের মধ্যমণি হয়ে বসে। কয়েক মুহূর্ত চোখ দুটো আধ-বোজা অবস্থায় বসে মদের জাঁকিয়ে বসা নেশাটাকে উপভোগ করল। এবার শুরু করল জুয়ার দান চালা।

ব্যস, আর যাবে কোথায়। সে যতইবারই দান চালল, ততবারই গো-হারা হেরে গেল। রাশি-রাশি কাড়িকাড়ি নোট সে পকেট থেকে বের করতে লাগল। আর প্রতিবারই নোটগুলো আশ্রয় নিতে লাগল আমার পকেটে। ফলে তার পকেট ক্রমে হালকা হয়ে আমার পকেটগুলো ফুলে ফেঁপে রীতিমত ঢোল হয়ে উঠতে লাগল।

এদিকে কার্যত দেখা গেল, গ্লোন্ডিনিং যত হারে তার জেদও ততই উৰ্দ্ধমুখি হতে লাগল। মোদ্দা কথা, সে যেন রীতিমত ক্ষেপে গেল। এখন তার পকেট একেবারেই শূন্য। একটা কানাকড়িও তার কাছে আর অবশিষ্ট নেই। কিন্তু নিজেকে সংযত রাখা এখন তার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু উপায়? জেদ বজায় রাখতে হলে উপায় তো একটা

একটা বের করতেই হবে।

মদের নেশায় জড়িয়ে-আসা গলায় গ্লোন্ডিনিং বলে উঠল–কোনো সমস্য নেই দোস্ত! খেলা চলবেই।

আমি ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপের হাসি ফুটিয়ে তুলে বললাম–সে না হয় বুঝলাম, খেলা চলবে। কিন্তু বন্ধু তোমার পকেটে যে একটা কানাকড়িও নেই। তবে খেলাটা চলবে কি করে দয়া করে বলবে কী?

‘তুমি আমাকে কিছু মালকড়ি ধার দাও। সময়মত শুধরে দেব, কথা দিচ্ছি।’

‘হ্যাঁ, এটা অবশ্য সম্ভব হতে পারে। কথা বলতে বলতে তার পকেট থেকে আমার চলে আসা একটা নোটের গোছা তার দিকে ছুঁড়ে দিলাম।

জুয়ার আসর আবার জমজমাট হয়ে উঠল। আমার দাম্ভিক মদমত্ত বন্ধুবর এবারও একের পর এক দারুণভাবে হারতে লাগল। মিনিট কয়েকের মধ্যেই সে আমার কাছে মোটা অর্থ ঋণী হয়ে গেল।

বন্ধুবর গ্লোণ্ডিনিং এবার কয়েক মুহূর্ত গুম হয়ে বসে রইল। আপন মনে কি যে ভাবল, সে জানে। তারপর একটা ভরা মদের বোতল বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে হাতে তুলে নিল। ছিপিটার সঙ্গে দাঁত আটকিয়ে এক হ্যাঁচকা টানে বোতলের মুখটা খুলে ফেলল। তারপর ঢ ঢক্‌ করে পুরো বোতলটা গলায় ঢেলে দিল। আমি সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় ঠিক যেমনটা প্রত্যাশা করছিলাম–সে একেবারে হঠাই রেগে অগ্নিমূর্তি! কোনো সমস্যা নেই, দানের অঙ্কটা এবার দ্বিগুণ করা হোক, রাজি?

আমি কয়েকবার আমতা আমতা করতে লাগলাম। আসলে আমি অভিনয়ে লিপ্ত হলাম। এভাবে কয়েকবার অনিচ্ছার অভিনয় করে আমি তার আকস্মিক প্রস্তাবটায় সম্মত হয়ে গেলাম। আর এরই ফলে তার ধারের পরিমাণ এবার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে বাড়তে মিনিট কয়েকের মধ্যেই দ্বিগুণ হয়ে উঠল। আর এক ঘণ্টার তা চারগুণ হয়ে দাঁড়াল।

একটা ব্যাপারের প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল। গোড়ার দিকে ভাবলাম, আমার চোখ ও মনের ভুল, তারপর অনুসন্ধিৎসু চোখে ব্যাপারটাকে লক্ষ্য কওে নিঃসন্দেহ হতে পারলাম। হ্যাঁ, ঠিকই তো বটে, তার মুখের রক্তের ছোপটা ক্রমেই ফিকে হয়ে আসছিল। চকের মতো বিবর্ণ হয়ে পড়েছে।

আমি প্রথম দর্শনের পরই বিশ্বস্তসূত্রের মাধ্যমে খোঁজ লাগিয়ে জানতে পেরেছিলাম নতুন বন্ধুবর গ্লোণ্ডিনিং একজন সত্যিকারের ধনকুবের। তার মতো একজন ধনকুবের এতক্ষণ ধরে জুয়া খেলে যে পরিমাণ টাকাকড়ি হারিয়েছে তার জন্য তো এমন হতাশা আর হাহাকারে জর্জরিত হয়ে পড়ার কথা নয়।

আমি নিঃসন্দেহ হলাম, মাত্রাতিরিক্ত মদ গেলার ফলেই তার মধ্যে এমন আকস্মিক পরিবর্তন ঘটে চলেছে। চোখ-মুখ অস্বাভাবিক বিবর্ণ হয়ে পড়েছে। তাই উপস্থিত সবার কাছে ভালো মানুষ সাজার জন্য আমি কণ্ঠস্বর বেশ চড়িয়েই খেলা বন্ধ করার প্রস্তাব দিলাম।

হ্যাঁ, আমার মতলবটায় কাজ অবশ্যই হয়েছে। খেলা বন্ধ করে দেবার প্রস্তাব দিতেই উপস্থিত সবাই তারস্বরে চেঁচিয়ে প্রতিবাদ জানাতে লাগল। আর মাতাল গ্লোণ্ডিনিং সচকিত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে গুঙিয়ে উঠল–‘না! কখনো না! খেলা বন্ধ করা চলবে না, কিছুতেই না।’

আমি নিজে এরকম একটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে পড়লে কি যে করতাম তা বলা মুশকিল। সত্যি বলছি, নবাগত বন্ধু গ্লোন্ডিনিং-এর মর্মান্তিক দশা দেখে উপস্থিত সবার মন দারুণ বিষিয়ে উঠল। মিনিট কয়েকের জন্য ঘরটায় গভীর নীরবতা নেমে এলো। সবাই নির্বাক-নিস্তব্ধ। পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চলভাবে বসে রইল।

আমি লক্ষ্য করলাম, দলের সবার না হলেও অনেকেই আমার ওপর ক্ষুব্ধ। তারা ঘৃণাভরে বার বার আমার দিকে যে তাকাতে আরম্ভ করেছে তা-ও আমার নজর এড়াল না। তবে এক আকস্মিক ও অত্যাশ্চর্য ঘটনায় জগদ্দল পাথরের মতো চেপে-বসা দুঃসহ ভারটা বেশি না হোক, কিছুক্ষণের জন্য হলেও নেমে গেল। নিজেকে অনেকাংশে হালকা বোধ করতে লাগলাম। স্বস্তি পেলাম।

হঠাৎ হ্যাঁ, একেবারে হঠাই ঘরটার ভারী বড় সড় জানালাগুলো দুম্ করে পুরোপুরি খুলে গেল। পর মুহূর্তেই আরও বিস্ময়কর ভোজবাজির খেলা শুরু হয়ে গেল। যন্ত্রচালিতের মতোই সবগুলো মোমবাতি একই সঙ্গে নিভে গেল। ব্যস, মুহূর্তের মধ্যেই ঘরের ভেতরের নিচ্ছিদ্র অন্ধকার নেমে এলো। আর সেই সঙ্গে শ্মশানেরনিস্তব্ধতা তো রয়েছেই।

বাইরে থেকে আসা চাঁদের হালকা আলোয় আমি শুধুমাত্র এটুকুই উপলব্ধি করতে পারলাম, আপাদমস্তক আলখাল্লায় ঢাকা অবিকল আমার মতোই লম্বাটে একজন। বিদ্যুৎগতিতে ভেতরে ঢুকে এলো। কেবলমাত্র দরজা দিয়ে ঢোকার সময় তাকে এক ঝলক দেখতে পেলাম। ভেতরে ঢোকার পরই মূর্তিটা অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেল।

আমি আগন্তুককে দেখতে না পেলেও এটুকু অবশ্যই উপলব্ধি করতে পারলাম, আমাদের মাঝখানে সে নীরবে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

ঘরটার ভেতরে আমরা, যতগুলো প্রাণী অবস্থান করছি, সবাই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়লাম। কারো মুখে রা-সরছে না।

কয়েকমুহূর্ত পর সবার বিস্ময়ের ঘোর কেটে যাবার আগেই সে আগন্তুক, অনধিকার প্রবেশকারীর কণ্ঠস্বর কানে এলো।

আমি রীতিমত চমকে উঠলাম। শরীরের শিরা-উপশিরাগুলো যেন শিথিল হয়ে আসতে লাগল। রক্তের গতি হয়ে পড়ল দ্রুততর। আর বুকের ভেতরে কোনো অদৃশ্য হাত যেন অনবরত হাতুড়ি পিটে চলেছে।

হ্যাঁ, সে কণ্ঠস্বরটা আমি অন্তত স্পষ্ট শুনতে পেলাম। অনুমান অভ্রান্ত বলেই মনে হল। তার কণ্ঠস্বরই বটে। হুবহু সেই চাপা ফ্যাসাসে কণ্ঠস্বরে উচ্চারিত কথাগুলো যেন আমার শরীরের হাড়গুলো ভেদ করে মজ্জায় গিয়ে আঘাত হানতে আরম্ভ করল, রীতিমত কাঁপুনি ধরিয়ে দিল। কোনোদিনই সে কণ্ঠস্বর আমি স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে পারব না। কিছুতেই না।

ফ্যাসফ্যাসে স্বরে সে বলতে আরম্ভ করল–উপস্থিত ভদ্র মহোদয়গণ, আমার এ আচরণের জন্য আমি অবশ্যই দুঃখিত নই। অতএব মার্জনা ভিক্ষা করার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ? কারণ একটাই, আজ আমি কেবলমাত্র কর্তব্য পালন করছি। ব্যস, এর। বেশি কিছু অবশ্যই নয়।

এরকম কথা আমি কেন বলছি আপনাদের জানতে ইচ্ছে করছে, তাই না? বলব, সবই বলব। ধৈর্য ধরে শুনুন, সবই খোলসা করে বলছি–যে লোকটা আজ রাতে জুয়া খেলায় হারিয়ে দিয়ে লর্ড গ্লোন্ডিনিং-এর কাছ থেকে প্রচুর অর্থ জিতে নিয়েছে তার চরিত্র, মানে আসল পরিচয় আপনাদের জানা নেই। আর জানার কথাও নয়।

আমি এখন আপনাদের কাছে জানতে চাই, তার আসল পরিচয় জানার জন্য আপনাদের মনে কৌতূহল জাগছে না? আমি তো মনে করছি, তা জানার জন্য আপনারা অবশ্যই অত্যুৎসাহি। শুনুন তবে, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটা জানার পথ আমি আপনাদের বলে দিচ্ছি। এখন কি বলছি, সবই মন দিয়ে শুনুন–‘অনুগ্রহ করে সময় সুযোগ মতো তার জামার বাঁ-হাতের আস্তিনের ভেতরের দিকটা আর তার নকসা-করা চাদরটার ভেতর দিককার বড় বড় পকেটগুলো তন্ন তন্ন করে পরীক্ষা করবেন, বুঝলেন?

সবাই নির্বাক। ঘরের ভেতরে গভীর নিস্তব্ধতা বিরাজ করতে লাগল।

এদিকে কথাগুলো বলেই আগন্তুক মূর্তিটা যেমন দ্রুতগতিতে ঘরটায় ঢুকেছিল, ঠিক তেমনি দ্রুত চৌকাঠ ডিঙিয়ে বাইরে চলে গেল। মুহূর্তে কর্পূরের মতো মিলিয়ে গেল।

আমার তখনকার মানসিক অবস্থার বর্ণনা কীই বা দেব? দেওয়া সম্ভব হবে কি? আমার কি না বললেই নয় যে, অভিশপ্ত এক জীবনের নিরবচ্ছিন্ন হাহাকার আর হা হুতাশে আমার বুকটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল?

না, কোনোকিছু ভাববার মতো অবসর আমর নেই, মোটেই নেই। অনেকগুলো হাত একই সঙ্গে এগিয়ে এলো। সেখানেই আমাকে সাঁড়াশির মতো আঁকড়ে ধরল।

ঘরের ভেতরে আবার মোমবাতি জ্বলে উঠল। আগের মতোই আলোয় ঝলমলিয়ে উঠল। মুহূর্তমাত্রও দেরি না করে জোর তল্লাসি শুরু করে দেওয়া হল।

ছায়ামূর্তিটার কথাগুলো উপস্থিত সবার মনেই দাগ কেটে দিয়ে গেছে। তার পরামর্শমাফিক সবাই আমার জামার আস্তিন আর গায়ে নকশা-করা চাদরটার ভেতরের দিকটা পরীক্ষা করার কাজে মেতে গেল। আস্তিনের লাইনিংটা ঘাটাঘাটি করতেই তার ভেতর থেকে, চাদরের ভেতরের পকেটগুলো থেকে জুয়াখেলার জাল জুয়াচুরির সব কটা নকল তাস নানারকম মার্কা-দেওয়া তাস দমাদম মেঝেতে পড়তে আরম্ভ করল। আমার ধাপ্পাবাজির কারসাজি সবই ফাঁস হয়ে গেল।

তারপরই ঘরটার মালিক বন্ধুটা মেঝে থেকে, পায়ের তলা থেকে একটা দুপ্রাপ্য ও বহুমূল্য পশমের আলখাল্লা তুলে নিয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল–‘মি. উইলসন, এটা আপনার নিন, ধরুন।

আমি হাত বাড়িয়ে সেটা নিয়ে দেখলাম, আমার আলখাল্লাটাই বটে। নিজের ঘর ছেড়ে আসার সময় চাদরের ওপর সেটাকে চাপিয়ে এসেছিলাম। শীত খুব আঁকিয়ে পড়েছিল। তাই সেটাকে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম। এখানে এসে সেটাকে খুলে জানালার সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখেছিলাম।

ঘরের মালিক-বন্ধুটা আবার সরব হল- মি. উইলসন, নিঃসন্দেহ হচ্ছি, জুয়াখেলার হাত সাফাইয়ের আরও প্রমাণ খুঁজে সময় নষ্ট করার দরকার নেই। আমাদের প্রয়োজনীয় সে প্রমাণ তো অনেকেই ইতিমধ্যেই আমরা হাতে পেয়ে গেছি। আমি কি বলব ভেবে না পেয়ে অন্যমনষ্কভাবে আলখাল্লাটার ধুলো ঝাড়াঝাড়ি করে নিজেকে ব্যস্ত রাখলাম।

ঘরের মালিক-বন্ধুটা এবার একটু বেশ কড়া মেজাজেই বলল–‘আমি আশা করছি, আপনি আজই অক্সফোর্ড থেকে বিদায় নেবেন। আর এও আশা করছি, কথাটা আর দ্বিতীয়বার বলতে হবে না।

আমি নিতান্ত অপরাধীর দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

সে এবার বলল–আরও আছে, এ মুহূর্তেই আমার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে বাধিত হব।’

তখন আমি কী লজ্জায় পড়লাম, অপদস্থ হলাম তা আর বলার নয়। সে মুহূর্তে আমি এমনই ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম যে, নিজেকে সামলে-সুমলে না রাখতে পারলে হয়তো বা তার পিঠে কয়েক-ঘা বসিয়েই দিতাম। আর ঠিক সে মুহূর্তে আর একটা বিস্ময়কর ঘটনাও ঘটে গিয়েছিল, যার ফলে আমার মনোযোগ সেদিকেই অস্পষ্ট হয়ে পড়েছিল। ঘরের মালিক-বন্ধুর আজ্ঞা পাওয়ার এটাও একটা বড় কারণ বটে।

বিস্ময়কর ঘটনাটা হচ্ছে, ঘরের মালিক মি. প্রেস্টন যখন মেঝে থেকে আলখাল্লাটা আমার হাতে তুলে দিল তখন আমি খেয়ালই করিনি যে, আমার নিজের আলখাল্লাটা আমারই অন্য হাতে ধরা রয়েছে। আর যে আলখাল্লাটা সে আমার হাতে তুলে দিল সেটা অবিকল আমার আলখাল্লাটারই মতো।

এবার ব্যাপারটা আমার মনে পড়ে গেল, যে বিশেষ লোকটা অকস্মাৎ উপস্থিত হয়ে আমার নিষ্ঠুরভাবে জারিজুরি ফাঁস করে, মুখোশটা মুহূর্তের মধ্যে খুলে দিয়ে উল্কার বেগে চম্পট দিল, তার গায়েও একটা আলখাল্লা দেখেছিলাম। সে আর আমি ছাড়া তৃতীয় কোনো ব্যক্তির গায়েই আলখাল্লা ছিল না।

যাক, যে কথা বলতে যাচ্ছি, ঘরটার মালিক-বন্ধু মি. প্রেস্টনের দেওয়া আলখাল্লাটা আমার নিজের আলখাল্লাটার ওপর চাপিয়ে নিয়ে বীরদর্পে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। চরম নির্দেশ পাওয়ার পর আর সেখানে থাকাও তো সম্ভব ছিল না।

আমার প্রতি পরবর্তী নির্দেশ, আমাকে অক্সফোর্ড ছেড়ে চলে আসতে হবে। অনন্যোপায় হয়েই পরদিন কাকডাকা ভোরে, দিনের আলো ফোঁটার আগেই ভয় ও লজ্জায় অক্সফোর্ড ছেড়ে মহাদেশের উদ্দেশে পা-বাড়াতেই হল।

অক্সফোর্ড ছেড়ে পালিয়ে এসে ভাবলাম, বুঝি অব্যাহতি পেয়ে গেলাম। কিন্তু কার্যত দেখা গেল, বৃথাই পালিয়ে এসেছি।

আমার অশুভ ভাগ্য বুঝি অধিকতর উল্লাসে আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতে ব্যস্ত। একটা কথাই বুঝি আমাকে বিশেষ করে বুঝিয়ে দিতে চাইছে, এখানেই শেষ নয়, বরং আমার পালিয়ে পালিয়ে বেড়ানো সবে তো শুরু হয়েছে।

অক্সফোর্ড ছেড়ে এসে আমি এবার প্যারিস নগরীতে মাথা গুঁজলাম।

প্যারিসে হাজির হওয়া মাত্রই আমার সম্বন্ধে উইলিয়াম উইলসনের মধ্যে যে অবাঞ্ছিত আগ্রহ ভর করেছে তার প্রমাণ হাতে-নাতে পেয়ে গেলাম। একের পর এক বছর পেরিয়ে গেল তবু কিন্তু আমার দুঃখ-যন্ত্রণা ঘুচল না।

হতচ্ছাড়া শয়তান! আমি রোমে অবস্থানকালে কত অসময়ে, কী এক ভৌতিক পরিবেশে সে যে কতবার আবার আমার উচ্চাকাঙ্খর মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে আমাকে বিপর্যস্ত করেছে, যারপরনাই হেনস্তা করেছে, সে-সব কথা ভাবতে গেলে আজও আমার। গায়ে রীতিমত কাঁটা দিয়ে ওঠে, শরীর শিথিল হয়ে আসতে থাকে।

কেবলমাত্র রোমের কথাই বা বলি কেন? ভিয়েনাতেও সে আমাকে কম উত্যক্ত করেনি। তারপর বার্লিন আর মস্কোতেও শয়তানটা আমার পিছন ছাড়েনি। যাকে বলে, সে আমার সঙ্গে যেন আঠালির মতো লেগেছিল। এক জায়গার কথা বলা যাবে না, যেখান থেকে আমার অন্তরের বিতৃষ্ণা নিঙড়ে তাকে অভিসম্পাত দেবার মতো যথেষ্ট কারণ ছিল না।

অতিষ্ট! আমি তার দুর্বোধ্য অত্যাচারে রীতিমত অতিষ্ট হয়ে পড়েছিলাম। উপায়ান্তর না দেখে আমি তার জঘন্য অত্যাচারের হাত থেকে অব্যাহতি পাবার জন্য যন্ত্রণাদগ্ধ মানুষ যেভাবে মহামারীর কবল থেকে আত্মরক্ষার জন্য উন্মাদের মতো পালায়, আমিও ঠিক তেমনই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পৃথিবীর শেষপ্রান্তে পালিয়ে যাই। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। পালিয়ে গেলাম বটে, কিন্তু ফায়দা কিছুই হলো না! শয়তানটা একটা দিনের জন্যও আমার সংস্রব থেকে দূরে থাকেনি। অতএব দুর্বিষহ যন্ত্রণা আমার সর্বক্ষণের সঙ্গি হয়ে দাঁড়াল।

দিনের পর দিন, বছরের পর বছর দুর্বেধ্য অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে আমি বার বার নিজের মনকেই প্রশ্ন করেছি–কে? সে কে? কোথা থেকেই বা আমাকে উত্যক্ত করতে ছুটে আসে? তার উদ্দেশ্য কি? কোন্ প্রত্যাশায়ই বা আমাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে চলেছে? আ িদিনের পর দিন নিজেকে এমন সব প্রশ্ন করেছি। কিন্তু হায়! কোনো জবাবই পাইনি। তবে এও সত্য যে, একটা ব্যাপার আমি লক্ষ্য করেছি, শয়তানটা যেখানে, যতবারই আমার সামনে আবির্ভূত হয়েছে, আমার ইচ্ছায় যখনই সে নাক গলিয়েছে, নানাভাবে বাধা দিয়েছে–কোনো বারই আমার পক্ষে তার মুখটা দেখা সম্ভব হয়নি, কিছুতেই না।

উইলিয়াম উইলসন নামধারী লোকটা যেই হোক, যেখান থেকেই এসে আমার সামনে হাজির হোক না কেন, সে কি একটা মুহূর্তের জন্যও মনে স্থান দিয়েছে, ইটন শহরে যে আমাকে বিশ্রিভাবে তিরস্কারের মাধ্যমে উত্যক্ত করেছিল, আমি অক্সফোর্ডে অবস্থানকালে সে আমার অপমানের চূড়ান্ত করে সম্মানকে ধুলিসাৎ করে দিয়েছিল, রোমে সে প্রতিবন্ধকতার মাধ্যমে আমার উচ্চাকাঙ্খকে নস্যাৎ করে দিয়েছিল, প্যারিসে আমার প্রতিহিংসাকে ব্যর্থ করে দিয়েছিল আর আমার অত্যুগ্র ভালোবাসাকে ব্যর্থ করে দিয়ে মন-প্রাণ হতাশা আর হাহাকারে ভরিয়ে তুলেছিল– যে লোকটা আমার সবচেয়ে বড় চিরশত্রু, আমার অশুভ অদৃষ্ট, আমি কিন্তু তার মধ্যে আমার স্কুলের সহপাঠী, আমার নামের সঙ্গে যার হুবহু মিল ছিল, সে জঘন্য ঘৃণিত ভয়াবহ প্রতিদ্বন্দ্বীকে দেখতে পাইনি, অবশ্যই নয়।

অসম্ভব! একেবারেই অসম্ভব! এ শয়তানটা কিছুতেই অধ্যক্ষ রেভারেন্ড ড. ব্রানসবির স্কুলে আমার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী উইলিয়াম উইলসন হতে পারে না।

যাক আর নয়, অকল্পনীয় সে ব্যাপারটা নিয়ে অনেক কথাই তো বলেছি। সত্যি কথা বলতে কি, শয়তানটার ন্যাক্কারজনক কাজের পুরো ফিরিস্তি দেওয়া সম্ভব নয়। তাই এ নাটকের শেষ ঘটনাবহুল দৃশ্যের অবতারণা করাই শ্রেয়।

আঠারো খ্রিস্টাব্দের কথা।

আমি তখন রোমে বাস করছি। সে বছরের উৎসবে আমি উপস্থিত ছিলাম। নেপলসের ডিউক ডি ব্ৰগলিওর পালাজ্জোতে এক মনোজ্ঞ মুখোশ-নৃত্যের অনুষ্ঠান হয়েছিল। সে নৃত্যানুষ্ঠানে আমি দর্শকের আসনে ছিলাম।

আমি ইয়ার দোস্তদের সঙ্গে মদের টেবিলে বসে মদ গিলতে গিলতে মুখোশ নৃত্যের অনুষ্ঠান দেখছিলাম। আর খুব বেশি রকম হৈ-হুঁল্লোড়ে মেতে গিয়েছিলাম, অস্বীকার করা যাবে না।

ঘরটায় তখন গাদাগাদি ভিড়। দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। আর সে সঙ্গে অসহ্য গরমও ছিল। আবহাওয়া নিতান্তই দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। আমি আর এক মুহূর্তও টিকতে না পেরে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লাম। এবার অত্যুগ্র আগ্রহের সঙ্গে জবুথুবু হয়ে পড়া বুড়ো ডি ব্ৰগলিওর রূপসি যুবতি স্ত্রীর খোঁজে ভিড়ের ভেতরে দাপাদাপি শুরু করে দিলাম।

সে রূপসি যুবতি তার পোশাকের গোপন কথাটা আমাকে আগে থেকেই বলে দিয়েছিল। অতএব আমার মধ্যে তাকে খুঁজে বের করার আগ্রহটা যে আরও অনেক গুণ বেড়ে গিয়েছিল, অস্বীকার করব না।

আমি ভিড়ের মধ্যে তাকে হন্যে হয়ে খোঁজা শুরু করে দিলাম। শেষপর্যন্ত ভিড়ের মধ্যে এক মুহূর্তের জন্য তাকে দেখতে পেলাম। ব্যস, আমি উদ্রান্তের মতো একে ওকে ধাক্কা দিয়ে দ্রুত তার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম।

ঠিক সে মুহূর্তে ভিড়ের মধ্যে থেকে কে যেন আচমকা আমার কাঁধে হাত রাখল। ঘাড় ফিরিয়ে হাতের মালিককে খুঁজে বের করার চেষ্টা করার আগেই আমার কানে এলো সে চিরস্মরণীয়, ফ্যাসফ্যাসে, ক্ষীণ অভিশপ্ত কণ্ঠস্বরটা।

আমি মুহূর্তে যেন রেগে একেবারে আগুন হয়ে গেলাম। ক্রোধে আমার সর্বাঙ্গ থর থরিয়ে কাঁপতে লাগল আর মাথায় রক্ত উঠে যাওয়ার যোগাড় হলো। আমি গর্জে উঠলাম–‘শয়তান। হতচ্ছাড়া! নচ্ছাড় কাহাকার। না, কিছুতেই না। এভাবে মৃত্যু পর্যন্ত তোমাকে আমি আঠার মতো আমার সঙ্গে সেঁটে থাকতে দিচ্ছি না, কিছুতেই না।’

সেনির্বাক। টু-শব্দটিও করল না।

আমি আগের মতোই তর্জন গর্জন করতে লাগলাম–‘শয়তান, আমার সঙ্গে এসো। আসতেই হবে তোমাকে। তা যদি না কর তবে যেখানে দাঁড়িয়ে আছ সেখানেই ছুরির ফলাটা তোমার বুকে আমুল গেঁথে দেব, বলে দিচ্ছি!’

আমার মেজাজ মর্জি তখন এমনিতেই খুবই বিগড়ে ছিল। আমার বাঞ্ছিতা রূপসি যুবতিকে কাছে পাবার জন্য ব্যর্থ হয়ে পড়েছিলাম। ফলে আমার কাঁধে তার হাতটা পড়ামাত্র দুম্ করে সেটাকে চেপে ধরে ফেলেছিলাম।

হ্যাঁ, আমার অনুমান অভ্রান্তই বটে। অবিকল আমার মতোই পোশাক সে গায়ে চাপিয়েছিল। একটা স্পেনি আলখাল্লা। প্রায় পায়ের পাতা পর্যন্ত ঝুলে পড়েছিল। নীল ভেলভেটের তৈরি। লাল বেল্টের সঙ্গে সুতীক্ষ তরবারিটা ঝুলছিল। আর কালো রেশমি মুখোশ দিয়ে মুখটাকে ঢেকে রাখা ছিল। ফলে তার মুখের সামান্যতম অংশও নজরে পড়ছিল না। তবে শয়তানটাকে চিনতে আমার অসুবিধা হয়নি।

আমি আবার গর্জে উঠলাম–‘এসো আমার সঙ্গে।

আবারও বলছি কোনোরকম ধান্ধাবাজির চেষ্টা করলে চোখের পলকে তোমার বুকে ছুরির ফলাটা গেঁথে দেব, শুনে রাখ!’

আমি কথা বলতে বলতে তার কলারটা শক্ত করে চেপে ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে তাকে নাচের আসর থেকে পাশের ছোট ঘরটায় নিয়ে গেলাম। আশ্চর্য ব্যাপার! সে কিন্তু বাধা দেওয়ার চেস্টা করা তো দূরের ব্যাপার কোনোরকম আপত্তি পর্যন্ত করল না। বরং নিতান্ত অনুগতের মতোই আমার সঙ্গে সে ঘরটায় ঢুকল।

আমি তাকে নিয়ে ঘরে ঢুকেই সজোরে একটা ধাক্কা দিলাম। সেনিজেকে সামলাতে না পেরে টলতে টলতে সামনের দেওয়ালটায় দুম করে আছড়ে পড়ল।

আমি ব্যস্ত হাতে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। প্রায় গর্জে উঠেই বললাম–‘খাপ থেকে আমার তরবারিটা বের কর।’

মুহূর্তের জন্য ইতস্তত করে সে চাপা নিশ্বাস ফেলল। তারপর নীরবে খাপ থেকে তরবারিটা বের করে হাতে নিল।

আমি হুঙ্কার ছাড়তেই সে আত্মরক্ষার জন্য তরবারিটা শক্ত করে ধরে তৈরি হয়ে নিল।

আমাদের উভয়ের মধ্যে লড়াই হলো। তবে খুবই অল্পসময়ের লড়াই। মনে করা যেতে পারে, লড়াই ভালোভাবে শুরু হতে না হতেই শেষ হয়ে গেল।

আমার মধ্যে তখন চরম উত্তেজনা ভর করেছে। উত্তেজনায় প্রায় উন্মদদশা প্রাপ্ত হয়েছি। আমার একটা হাতে যেন হাজার হাতের শক্তি এসে ভর করেছে। অসুরের শক্তি অনুভব করলাম।

লড়াই শুরু হবার মাত্র সেকেন্ড কয়েকের মধ্যেই একমাত্র দৈহিক শক্তির ওপর নির্ভর করে দেওয়ালের কাঠের আবরণটার সঙ্গে সজোরে চেপে ধরলাম। তার নড়াচড়া করার মতো সামান্যতম শক্তিও রইল না। আমার মধ্যে তখন নেকড়েরনিংস্রতা ভর করেছে। আমার চরমতম শত্রুটাকে পেয়ে নেকড়ের মতো হিংস্রতায় আমার হাতে ঝকঝকে চকচকে তীক্ষ্ম তরবারির ফলাটাকে বার বার তার বুকে গেঁথে দিতে লাগলাম।

ঠিক সে মুহূর্তেই মনে হলো কে যেন দরজায় অনবরত ধাক্কা মারছে, খোলার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

দরজাটা খুলে কেউ যদি ঘরে ঢুকে আসে, ব্যাপারটা জানা জানি হয়ে যায়, তাই দৌড়ে গিয়ে সিটকিনিটাকে ভালোভাবে আটকে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে আবার এক লাফে আমার চরমতম শত্রুর কাছে ফিরে গেলাম।

কিন্তু হায়! যে অভাবনীয় দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল, তার ফলে আমার মধ্যে যে বিস্ময়ের সঞ্চার হলো, যে আতঙ্ক আমার বুকে চেপে বসল, আমাকে পুরোপুরি আচ্ছন্ন করে ফেলল তাকে আমি কোন ভাষায় ব্যাখ্যা করব। সে যে নিছকই বর্ণনাতীত ব্যাপার।

মুহূর্তের জন্য আমি চোখ ফিরিয়ে ছিলাম, সেটুকু সময়ের মধ্যেই ঘরের সব ব্যবস্থা রীতিমত বদলে গেছে। যাকে বলে ঘরের সবকিছুরই আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। কয়েক মুহূর্ত আগে যেখানে কিছুই আমার নজরে পড়েনি এখন সেখানে আমার দৃষ্টি গেল। অন্তত সে মুহূর্তে আমার এরকমই মনে হয়েছিল। দেখলাম বিশাল একটা আয়না।

আমি চরম আতঙ্ক বুকে নিয়ে দুপা এগিয়ে গিয়ে যখন আয়নাটার মুখোমুখি দাঁড়ালাম, তখন একেবারেই অবিশ্বাস্য এক ব্যাপার প্রত্যক্ষ করলাম। মনে হলো আমার নিজের মূর্তিই আঁকাবাঁকা গতিতে আমার মুখোমুখি হবার জন্য এগিয়ে এসেছে। তবে সে মূর্তি তখন চকের মতো ফ্যাকাশে, বিবর্ণ আর রক্তাপ্লুত। ভয়ঙ্কর একটা মূর্তি যেন একেবারে আমার মুখোমুখি স্থবিরের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে।

এরকম দেখলাম, বলছি ঠিকই, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আদৌ তা নয়। মৃত্যুযন্ত্রণা আর হতাশা হাহাকারে জর্জরিত হয়ে যে আমার মুখোমুখি দাঁড়াল, সে উইলসনই বটে। নিজের গায়ের আলখাল্লা আর মুখোশটাকে সে খুলে যে মেঝেতে ফেলে দিয়েছিল সে দুটো তেমনি সেখানেই পড়ে থাকতে দেখলাম।

অবাক না হয়ে পারলাম না, তার মুখের কোথাও এমন কোনো একটা রেখা নেই যা আমার মুখে অনুপস্থিত। অর্থাৎ হুবহু আমারই মুখের মতো। আমারই মুখটা যেন তার কাঁধের ওপর বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুটো মুখই যেন একই ছাঁচে গড়া।

কেবলমাত্র মুখের কথাই বা বলি কেন? তার পোষাক-আশাকে এমন একটা সূতোও নেই যা আমার পোশাকে নেই। আর পোশাক তৈরির কায়দা-কৌশলও অবিকল একই রকম। যেন একই কাপড় আর একই দর্জি দিয়ে উভয়ের পোশাকই তৈরি করানো হয়েছে।

হ্যাঁ, স্বীকার না করে উপায় নেই। সত্যি বলছি, সে অন্য কেউ নয়, অন্য কিছুই নয়, উইলসনই বটে।

কিন্তু তা সত্ত্বেও সে কিন্তু অনুচ্চ কণ্ঠে, ফাঁসাসে কণ্ঠস্বরে কথা বলল না। তার কণ্ঠস্বর শুনে আমি অনায়াসেই ধরেনিতে পারতাম যে, কথাগুলো সে নয়, আমিই বলে চলেছি।

সে বলে চলল, হেরে গেছি, আমি হেরে গেছি, আমি হেরে গেছি। তুমিই জয়ী হয়েছ। তবু আজ, এ-মুহূর্ত থেকে তুমিও মৃত–পৃথিবীবাসীর কাছে, পরম পিতার কাছে, আর আমার কাছে তুমিও মৃত।

তুমি এতকাল আমারই মধ্যে বেঁচেছিলে। আর আজ, এ-মুহূর্তে আমার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এ-মূর্তি যা তোমার মতো নয়–তোমারই মূর্তি তার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেই আমার কথার সত্যতা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারবে, চূড়ান্তভাবে আমাকে নয়, তুমি নিজেকেই হত্যা করেছ। হত্যা! আত্মহত্যা করেছ তুমি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *