1 of 2

এ টেল অব দ্য র‍্যাগড মাউন্টেইনস

এ টেল অব দ্য র‍্যাগড মাউন্টেইনস

১৮০৭ সাল।

সে বছরের প্রথমের দিকে আমি ভার্জিনিয়ার চার্লোটিস ভিলাতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতাম। এক সকালে একেবারেই অভাবনীয়ভাবে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার আলাপ পরিচয় হয়। তাঁর নাম অগ্যাস্টাস বেড়লো।

মি. বেডলো ছিলেন বয়সে যুবক। আর সত্যিকারের ভদ্রলোক বলতে যা বুঝায় তিনি ছিলেন ঠিক সেই রকমই সজ্জন। তাঁর আচরণ ছিল অমায়িক, কথাবার্তায়ও সাধ্যমত শিষ্টতা বজায় রাখতে সাধ্যমত চেষ্টা করতেন। তার সঙ্গে মেলামেশার মাধ্যমে যারপরনাই সৌহার্দ্যপূর্ণ সৌজন্যবোধের পরিচয় পেয়ে আমি মুগ্ধ হয়ে পড়ি। আর এ কারণেই আমি তার সম্বন্ধে আরও কিছু জানা ও বোঝার জন্য নিরবচ্ছিন্ন কৌতূহলের শিকার হয়ে পড়ি।

মি. বেডলোর সম্বন্ধে বিশেষভাবে জানার আগ্রহ আমার যত গভীরই হোক না কেন, নীতিগত বা দেহগত সম্পর্কের দিক থেকেও তাকে যথাযথভাবে জানা ও চেনা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সাধ্যমত সতর্কতার সঙ্গে নিজেকে সংযত রেখে খোঁজখবর নিয়েও তার পরিবার সম্বন্ধে সন্তুষ্ট হওয়ার মতো নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য সংগ্রহ করা আমার পক্ষে সম্ভব হলো না। তিনি কোন অঞ্চলের লোক, কোথা থেকে যে এসেছেন, বহু চেষ্টা করেও করে এ-তথ্যটুকুও সঠিকভাবে জানতে পারলাম না। আর আমি তাকে যুবক বলে মনে করলেও তার বয়সের ব্যাপারেও আমি পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হতে পারলাম। কারণ, তার মধ্যে আমি এমনকিছু লক্ষ্য করেছি যা আমাকে তার বয়সের ব্যাপারে পাকাপাকি কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে না পারার জন্যই আমাকে বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়েছে। এ-ই যদি সত্য হয় তবে আমি তাকে যুবক বলে বর্ণনা দিলাম কেন, তাই না? প্রশ্নটা খুবই সঙ্গত, অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে আমার বক্তব্যের যুক্তিও আছে যথেষ্টই। আসলে প্রথম দর্শনেই ভদ্রলোককে আমার যুবক বলেই মনে হয়েছিল। আবার তিনি কথা প্রসঙ্গে প্রায়ই যৌবনের কথা বলতেন। তবুও মাঝে মধ্যে তিনি এমন সব কথাও বলতেন যার ফলে তাঁকে যুবক মনে করা তো দূরের ব্যাপার একশো বছরের এক বৃদ্ধ মনে করতেও এতটুকুও দ্বিধা আমার মধ্যে সঞ্চারিত হত না। তাই তো না বলে পারছি না, অন্য সবকিছুকে ছাপিয়ে তার চেহারার বৈশিষ্ট্যটুকুই প্রাধান্য পেত। মোদ্দা কথা, তার চেহারার বৈশিষ্ট্যটুকুই আমাকে বিভ্রান্তির মুখে সবচেয়ে বেশি করে ঠেলে দেয়। এবার দু-চার কথায় তার চেহারার বিবরণ দেওয়ার চেষ্টা করা যাক। মি. বেডলোর শরীরটা ছিল রোগাটে, একেবারেই লিকলিকে। আর তিনি লম্বাও কম ছিলেন না। সংক্ষেপে বললে, তিনি ছিলেন ইয়া লম্বা এক রোগাটে চেহারার মানুষ। আর পথ চলার সময় সামনের দিকে একটু বেশি রকমই ঝুঁকে চলতেন। অস্বাভাবিক লম্বা আর পাটকাঠির মতো লিকলিকে। হাড়ের ওপর মাংসের লেশমাত্রও ছিল বলে মনে হত না। আর কপালটা ছিল একটু বেশি রকমই চওড়া ওনিচু। তাঁর মুখটা ছিল চওড়া আর দুপাশে হাড় বের করা। আর নমনীয়ও ছিল বটে। মুখের দিকে অনুসন্ধিৎসু নজরে তাকালে সেখানে ছিটেফোঁটা রক্ত ছিল বলেও মনে হত না। তাঁর মুখের আর যে একটা বিশেষত্ব খুব বেশি করে নজরে পড়ত তা হচ্ছে, অসমান দাঁতের পাটি। এমন এলোমেলো এবড়ো খেবড়ো দাঁতের পাটি ইতিপূর্বে অন্য । কারো মুখে আমার অন্তত চোখে পড়েনি।

মি. বেডলো কথা বলার সময় থেকে থেকে অভাবনীয়ভাবে হেসে উঠতেন। এ হাসিটুকু তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য মনে করা যেতে পারে। তার সে হাসিটুকু বৈচিত্র্যে ভরপুর হলেও কিন্তু মোটেই আমার বিরক্তির সঞ্চার করত না। আর তার সে হাসিতে কেমন যেন এক অবর্ণনীয় বিষণ্ণতার প্রলেপ মাখানো থাকত। গভীর বিষণ্ণতা। তাঁর চোখ দুটো ছিল বিড়ালের চোখের মতো গোলাকার আর বড়ও ছিল অস্বাভাবিক। কেবলমাত্র আকৃতির দিক থেকেই নয়, বৈশিষ্ট্যের দিক থেকেও বিড়ালের চোখের সঙ্গে তার চোখ দুটোর সাদৃশ্য খুব বেশি করে লক্ষিত হত তা হচ্ছে–বিড়াল ও বিড়ালের মতো অন্যান্য প্রাণীর মতো আলো কমা-বাড়ার সঙ্গে চোখ দুটো ছোট-বড় হয়ে যেত। আর যদি তার মধ্যে উত্তেজনা ভর করত তবে মুহূর্তের মধ্যেই চোখের মণি দুটো অস্বাভাবিক উজ্জ্বল হয়ে উঠত। রীতিমত জ্বল জ্বল করত আর সে দুটো থেকে যে আলোকরশ্মি বিচ্ছুরিত হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ত তা অবশ্য প্রতিফলিত আলো নয়। তবে? সূর্যরশ্মি বা মোমবাতির আলোর মতো মৌলিক আলো। আরও আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, সাধারণ পরিস্থিতিতে তার চোখের উভয় গোলকই একেবারেই নিষ্প্রভ-নিস্তেজ, ঝাপসা আর অস্পষ্ট। সে দুটোর দিকে চোখ পড়তেই দীর্ঘদিন ধরে কবরস্থ থাকা মৃত ব্যক্তির চোখের কথা মনের কোণে উঁকি মেরে উঠত। সত্যি তার চোখ দুটোর দিকে তাকালেই সর্বাঙ্গে যেন কেমন একটা অব্যক্ত কম্পন অনুভব করতাম। আর আতঙ্কে বুকের মধ্যে ঢিবঢিবানি শুরু হয়ে যেত।

আমার সঙ্গে দেখা হলে ভদ্রলোক কথা প্রসঙ্গে বহুবারই নিজের চেহারার এসব বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করে আফশোস করেছেন। ক্ষোভপ্রকাশও কম করেননি। তারপর দীর্ঘসময় ধরে ঠাণ্ডা মাথায় আমাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলার জন্য প্রাণান্ত প্রয়াস চালিয়েছেন। আমি তার কথা কতখানি হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছি আর কতখানিই বা আমার জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে পুরোপুরি যাচাই করে উঠতে পারিনি, তার ধারণা নিতেও চেষ্টার ত্রুটি করতেন না।

সে ভদ্রলোকের সব কথা ধৈর্য্যের সঙ্গে শুনে ও বিচার বিশ্লেষণ করে আমি এ সিদ্ধান্তইনিতাম যে, তিনি দীর্ঘ পরিশ্রমের মাধ্যমে আমার মধ্যে যে ধারণা সঞ্চার করতে চাইতেন তা সংক্ষেপে অর্থাৎ সারমর্ম বললে এরকম দাঁড়ায়–আজ আমি তার চেহারা যেমন দেখছি, তিনি কিন্তু চিরদিন হুবহু এমনটা ছিলেন না। তার আগেকার চেহারা ছবির সঙ্গে আজকের চেহারার সাদৃশ্যের চেয়ে বৈসাদৃশ্যই বেশি। আর কারণস্বরূপ তিনি যা আমার কাছে ব্যক্ত করেছেন তা হচ্ছে–একের পর এক বহু স্নায়ুবিক রোগের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ক্রম পরিবর্তনের মাধ্যমে আজ তার এ হাল হয়েছে। তবে এও সত্য যে, তিনি কিন্তু রোগব্যাধি সম্বন্ধে কোনোদিনই উদাসীন ছিলেন না। তিনি অতীতের দীর্ঘদিন টেম্পলটন নামক কোনো এক চিকিৎসকের চিকিৎসাধীন ছিলেন। এক নাগাড়ে দীর্ঘদিন ধরে হরেকরকম রোগের চিকিৎসা তিনি করেছেন।

ডা. টেম্পলটনের সঙ্গে তার প্রথম পরিচয় হয় সবরাটোগেতে। তার বয়স তখন সত্তর বছর। প্রথম পরিচয়ের মুহূর্তেই তিনি ডাক্তারের কাছে নিজের দৈহিক সমস্যার কথা খোলাখুলি বলতে অনুরোধ করেন, তিনি সুচিন্তিত চিকিৎসার মাধ্যমে তাঁর রোগমুক্তি ঘটলে যারপরনাই বাধিত হবেন। তাঁর অমায়িক সহজ সরল ব্যবহার ও মধুর কথাবার্তায় মুগ্ধ হয়ে ডা. টেম্পলটন তার চিকিৎসা করতে সম্মত হন।

ডা. টেম্পলটন এবার প্রভূত বিত্ত সম্পদের অধিকারী বেডলোর চিকিৎসায় হাত দিলেন। দিন কয়েক চিকিৎসা করার ফলে তিনি আশাতীত ফল পান।

এবার ডা. টেম্পলটন টাকার কুমির বেডলোর সঙ্গে একটা পাকাপাকি চুক্তি করার প্রয়োজন বোধ করলেন। সে চুক্তির বিষয়বস্তু ছিল, কি পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে তিনি তার চিকিৎসা চালিয়ে যাবেন। উভয়ের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে তারা স্থির সদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারলেন। চুক্তির শর্ত হল–বার্ষিক মোটা অর্থের বিনিময়ে তিনি একমাত্র এ পঙ্গু লোকটার চিকিৎসায় নিজেকে লিপ্ত রাখবেন। নিঃস্বার্থভাবে বা অর্থের বনিময়ে কোনো পরিস্থিতিতেই তিনি অন্য কারো চিকিৎসাই করতে পারবেন না।

ডা. টেম্পলটন যৌবনে একজন পর্যটক ছিলেন। দেশভ্রমণ করা নেশা ছিল তার, রক্ত মাংস মজ্জার সঙ্গে মিশেছিল। আর এক সময় তিনি যখন প্যারিসে বাস করতেন তখন মেসমারের দলের সঙ্গে মিশে যান। তাদের সঙ্গে বেশ কিছুদিন এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ান।

বর্তমানে ডা. টেম্পলটন তীব্র ব্যথা বেদনার উপশম ঘটানোর জন্য চুম্বকঘটিত ওষুধই ব্যবহার করেন।

ধনকুবের বেড়লো ডা. টেম্পলটনকে দিয়ে চিকিৎসা করানো সুবাদে কথা প্রসঙ্গে তাঁর চিকিৎসা-পদ্ধতির গুপ্তকথা জানতে পারলেন। আর মৈসুরিক গবেষণা, ভাবনা চিন্তা থেকে ওষুধগুলো তৈরি করা সম্ভব হয়েছে, সেগুলোর প্রতি তাঁর আস্থা অনেকাংশে বেড়ে গেল। তবে এও সত্য যে, তিনি তার নতুন ছাত্রটার মধ্যে নিজের ভাবনা চিন্তা সঞ্চারিত করতে, পুরোপুরি বিশ্বাস স্থাপন করতে দিনের পর দিন প্রাণান্ত প্রয়াস চালিয়ে যেতে থাকেন। তারপর শেষপর্যন্ত দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগীকে সম্মত করতে পারলেন। বেডলো এবার ডা. টেম্পলটনের ওপর পুরোপুরি আস্থাবান হয়ে উঠলেন।

তারপর থেকে রোগ নিরাময়ের বিভিন্ন কাণ্ডকারখানার মধ্য দিয়ে ডা. টেম্পলটন এবং বেডলোর মধ্যে একটা পরিষ্কার বোঝাপড়া হয়ে যায়। আর এভাবেই উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়ে ওঠে। আমি কিন্তু এমন কথাও বলছি না যে, উভয়ের বোঝাপড়া সহজ-সরল ঘুম-পাড়ানি ক্ষমতার সীমা ছাড়িয়ে বাইরেও বিস্তার, লাভ করেছিল। তবে এও খুবই সত্য যে, সে-শক্তিটাই খুব বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল।

কিন্তু সৈস্নব-বিদ্যার শরবারীর চৌম্বকন্দ্রিালু সৃষ্টির প্রথম প্রয়াস পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে গেল। তিনি কিন্তু এত সহজেই দমলেন না। একের পর এক প্রয়াস চালিয়েই যেতে লাগলেন–চার-চারবার তার প্রয়াস ব্যর্থ হলেও তিনি হাল ছেড়ে দিলেন না। শেষপর্যন্ত তিনি পঞ্চম বারের প্রয়াসে আংশিক সাফল্য লাভ করলেন। তারপরের বার অর্থাৎ ষষ্ঠবারের প্রয়াসেও তিনি কিছুটা সফল হলেন। অবশ্য প্রতিবারেই তিনি কঠোর পরিশ্রম, নিরবচ্ছিন্ননিষ্ঠা ও অধ্যাবসায়ের সঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন।

কিন্তু আংশিক সাফল্যে তার মন তো ভরার নয়। তাঁকে পুরোপুরি সাফল্য লাভ করতেই হবে। অতএব অধিকতর ধৈৰ্য্য ওনিষ্ঠার সঙ্গে তাঁকে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় মগ্ন হতে হবে। তিনি করলেনও তাই। আবারও গবেষণায় লিপ্ত হলেন–একের পর এক ব্যর্থতা আর আংশিক সাফল্যের পর শেষপর্যন্ত দ্বাদশ প্রয়াসে সৈসব-বিদ্যার চিকিৎসক সম্পূর্ণ সাফল্য লাভ করতে সক্ষম হলেন।

পরীক্ষার সম্পূর্ণ সাফল্যলাভের পর থেকেই রোগীর ইচ্ছাশক্তি খুবই দ্রুত চিকিৎসকের ইচ্ছাশক্তির কাছে নিজেকে সঁপে না দিয়ে পারল না। এবার থেকে উভয়ের ইচ্ছাশক্তির একই মিলিত ধারায় প্রবাহিত হতে লাগল।

আর এ কারণেই রোগী ও চিকিৎসক উভয়ের সঙ্গে যখন আমার পরিচয় ঘটল তখন কেবলমাত্র চিকিৎসকের ইচ্ছাশক্তির কাছে পরাভূত হয়ে, রোগীর ইচ্ছাশক্তি ক্রমে স্তিমিত হতে হতে এক সময় ম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করে, ঘুমিয়ে পড়ে। অচিরেই ঘুমে একেবারে অচৈতন্য হয়ে পড়ে। এমনকি পঙ্গু রোগীর যদি চিকিৎসকের উপস্থিতির কথা জানা না-ও থাকত, তবু এ রকম কাণ্ড ঘটত। ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য।

বর্তমানকালে অর্থাৎ ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে এমন একটা অদ্ভুত অবিশ্বাস্য অযৌক্তিক ঘটনা হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন চোখের সামনে দেখছে। আজকের মানুষ আর এরকম ঘটনার মুখোমুখি হয়ে কিছুমাত্রও অবাক হচ্ছে না। কিন্তু যে সময়ের কথা আমি এখানে ব্যক্ত করছি তখনকার মানুষ এরকম ঘটনা প্রত্যক্ষ করলেই ভয়ঙ্কর কিছু একটা মনে করে রীতিমত স্তম্ভিত হয়ে যেত।

একটা কথা এ প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার, বেডলোর কথাবার্তা খুবই মিটমিটে, সহজেই রেগে যান। তবে তার মধ্যে আগ্রহের বিন্দুমাত্রও অভাব কোনোদিনই লক্ষিত হত না। তার কল্পনাশক্তি ছিল বিশেষ রকমের শক্তিশালী, সৃজনশীলও বটে। অবশ্য এ রকমটা ছিল নিয়মিত আফিমের গুলি উদরস্থ করার জন্যই। আর আফিমের পরিমাণ একটু বেশি মাত্রায়ই গ্রহণ করতেন। এও সত্য যে, প্রতিদিন যথেষ্ট পরিমাণে আফিম না গিলে তার পক্ষে বেঁচে থাকাই ছিল কঠিন সমস্যা। সমস্যা বললে ঠিক বলা হবে না, বরং আফিম না গিলে তাঁর পক্ষে বেঁচে থাকা একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার ছিল। তার কল্পনাশক্তি আরও অনেক বেশি তীব্র হয়ে ওঠে।

প্রতিদিন সকালে কিছু আহারাদির পর, এক কাপ কফি পানের পরই বেশ কিছু পরিমাণে আফিম খাওয়া ছিল তার অভ্যাস। এ অভ্যাসের এতটুকুও হেরফের হবার জো ছিল না।

আফিম সেবনের পর তিনি মেজাজ চাঙা করে নিয়ে বেড়িয়ে পড়তেন হাঁটাহাঁটি করতে। কখনও একা, আবার কখনও বা পোষা-প্রিয় কুকুরটাকে সঙ্গে নিয়ে চার্লোটেস্–ভিলের দক্ষিণ-পশ্চিমের অরণ্যে ছায়া মনোরম প্রাকৃতিক শোভামণ্ডিত পর্বতশ্রেণির গা ঘেঁষে এগিয়ে যাওয়া আঁকাবাঁকা পথ ধরে দীর্ঘ সময় ধরে তিনি যখন নিজের আস্তানায় ফিরে আসতেন, তখন সূর্যদেব পাহাড়ের মাথায় না উঠলেও পাহাড়ের গা-বেয়ে অনেকটা ওপরে উঠে আসত। সেখানকার অধিবাসীরা ওই পর্বতশ্রেণিকে বন্ধুর পর্বতমালা বলে সম্বোধন করে সম্মান প্রদর্শন করত।

নভেম্বরের শেষের দিকে একদিন। সেদিন সকাল থেকেই ভ্যাপসা গরম চলছিল। ঘন কুয়াশা প্রকৃতিকে ছেয়ে রেখেছিল। আর কুয়াশার দাপটে সূর্যের আলো একেবারেই ম্লান হয়ে পড়েছিল। এমনই কুয়াশাচ্ছন্ন দিনে মি. বেড়লো প্রতিদিনের অভ্যাসমত বেড়াতে বেরোলেন। পাহাড়ের প্রায় গা ঘেঁষে এঁকে বেঁকে এগিয়ে-যাওয়া পথ ধরে তিনি হাঁটতে লাগলেন। হাঁটতে হাঁটতে তিনি কোথায়, কতদূর চলে গেলেন তা তিনি ছাড়া আর কেউ-ই জানতে পারল না। সকাল গিয়ে দুপুর এলো, তারপর এলো দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা, আর সবশেষে রাতও ঘনিয়ে এলো। কিন্তু হায়! তিনি ফিরলেন না।

রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে এলে আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম। রাত আটটা বেজে গেলেও তিনি ফিরে না আসায় আমরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে, তাকে খোঁজ করতে লাগলাম। ঠিক তখনই একেবারে অভাবনীয়ভাবে তিনি দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে এলেন। তাঁকে দেখে আমরা যেন দেহে প্রাণ ফিরে পেলাম।

আমি অত্যুগ্র আগ্রহের সঙ্গে মি. বেডলোর আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে নিসন্দেহ হলাম, তার শরীরের অবস্থা যেমন থাকার কথা ঠিক তেমনই আছে। তার মধ্যে অসুস্থতার চিহ্নমাত্রও নজরে পড়ল না। একটা ব্যাপার দেখে আমি সবচেয়ে বেশি বিস্মিত হলাম। কেবল তাঁর চোখ-মুখে ক্লান্তির ছাপই অনুপস্থিত নয়, উপরন্তু চোখের তারায় অবর্ণনীয় হাসির ঝিলিক। তার মেজাজটা বেশি মাত্রায় চাঙা বলেই মনে হল। অর্থাৎ মেজাজ মর্জি খুশিতে ভরপুর।

আমাদের জিজ্ঞাসা দূর করতে গিয়ে মি. বেডলো তার অস্বাভাবিক বিলম্বের কারণ সম্বন্ধে যা-কিছু ব্যক্ত করলেন তা কেবলমাত্র অসাধারণ নয়, যারপনরাই অবিশ্বাস্যও বটে।

মি. বেডলো ঘরে ঢুকে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে তাতে শরীর এলিয়ে দিলেন। আমরাও তার মুখোমুখি চেয়ার দখল করলাম। আমরা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

মি. বেডলো এক সময় সোজা হয়ে বসলেন। আমাদের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে তিনি বাড়ি ফিরতে বিলম্বের কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে বললেন–আশা করি আপনাদের অবশ্যই মনে আছে, সকাল নয়টার কাছাকাছি আমি চার্লোটেসৃভিল ছেড়ে বেড়াতে বেরোই। সদর দরজা থেকে বেরিয়েই সোজা হাঁটার পর দশটা নাগাদ একটা গিরিখাতের কাছে হাজির হই। আমার কাছে সে জায়গাটা একেবারেই নতুন, অপরিচিত। আমি মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে থেকে গুটিগুটি পায়ে তার ভেতর ঢুকে গেলাম। সত্যি কথা বলতে কি, আমি খুবই উৎসাহের সঙ্গে এঁকে বেঁকে হেলে দুলে এগিয়ে যাওয়া গিরিখাতটা ধরে কিছু সময় হাঁটলাম। সেখানের চারদিকের দৃশ্যাবলী এমনকিছু মনলোভা না হলেও তাতে এমন এক ভয়ঙ্কও নির্জনতা বিরাজ করছিল যা আমাকে অভিভূত করছিল। তাই আমি অকৃত্রিম আগ্রহের সঙ্গেই পথ পাড়ি দিচ্ছিলাম, অস্বীকার করতে পারব না।

হাঁটতে হাঁটতে একটা কথাই বার বার আমার মনে হচ্ছিল, আমি যে ধূসর পাহাড়–সবুজ ঘাস আর লতা-গুল্মের ওপর দিয়ে হাঁটছি এখানে ইতিপূর্বে কোনো মানুষের পায়ের ছাপ দেখা যায়নি। অর্থাৎ আমিই প্রথম মানুষ যে প্রথম এই গিরিখাত ধরে পথ পাড়ি দিচ্ছি। গিরিখাতের প্রবেশ পথটা খুবই নির্জন ছিল। আশপাশ থেকে সামান্যতম শব্দও ভেসে আসছিল না, তার ওপর পথটা খুবই দুর্গম ছিল। অতএব আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি, আমিই সে- যে গিরিখাতটার প্রথম অভিযাত্রী। ব্যাপারটা কিছুমাত্রও অসম্ভব নয়, আর সম্পূর্ণ সত্যও বটে।

ঘন কুয়াশার একটা চাদর, ধোয়াও হতে পারে, সবকিছুকে মুড়ে রেখেছে। সবই অস্পষ্ট, একেবারেই ঝাপসা, আর এজন্যই পরিবেশটা সম্পর্কে আমার ধারণাটা ক্রমে গভীর থেকে গভীরতর হয়ে পড়তে লাগল।

অসম্ভব! আমি সামনে-পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পরিস্থিতিটা সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা নেবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু একেবারেই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। কি করেই বা সম্ভব হবে? কুয়াশার আস্তরণটা এতই গাঢ় ছিল যে, আমার সামনের পথটার বারো গজ দূরের কোনোকিছুকেও দেখতে পাচ্ছিলাম না, সবই সম্পূর্ণ অস্পষ্ট, ঝাপসা, আর পথটা ছিল খুবই দুর্গম। সত্যি কথা বলতে কি, এমন পথে হাঁটাচলা করা নিতান্তই সমস্যার-ব্যাপার।

কুয়াশায় চারদিক এমনভাবে ছেয়ে রেখেছে যে, সূর্যের অস্তিত্বও বুঝা যাচ্ছে না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই অল্প সময়ের মধ্যেই দিক হারিয়ে ফেললাম। কোন্ দিকে যে চলেছি কিছুই ঠাহর করতে পারছিলাম না।

দিকভ্রম হলেও আমি কিন্তু চলা অব্যাহত রাখি। এরই মধ্যে আমার ভেতরে আফিমের কাজও শুরু হয়ে যায়। ব্যাপারটা আমি কিছুটা অনুমানও করতে পারছিলাম। আর এরই ফলে সমস্ত বৰ্হিজগষ্টা সম্বন্ধে আমার মনে আগ্রহ-উৎসাহ অনেকাংশে বেড়ে গেছে। সবকিছু জানার, বুঝার আগ্রহের কথা বলতে চাচ্ছি।

আমার মধ্যে অদ্ভুত একটা ভাবনার উদয় হল। বিশ্বব্যাপী এক ইঙ্গিতের কথা বলতে চাইছি, এলোমলো ভাবনা-চিন্তার এক আনন্দমধুর ধারা। একটা পাতা তির তির করে কেঁপে ওঠার মাধ্যমে, ঘাসের ডগার ঘন সবুজ রঙে, একটা ত্রিপটের আকৃতির মধ্যে একটা মৌমাছির গুণ গুণ ধ্বনিতে, ঘাসের ওপর জমে-থাকা একটা শিশির বিন্দুর ঝকমকিতে হালকা বাতাসের একটা নিশ্বাসের মধ্য দিয়ে আর বনের ভেতর থেকে ভেসে-আসা অজানা অচেনা অস্পষ্ট গন্ধের মধ্য দিয়ে আমি বিশ্বব্যাপী একটা ইঙ্গিত খুঁজে পাই। আর সব মিলে আমার মধ্যে জেগে ওঠে এলোমেলো চিন্তার অদ্ভুত একটা ধারা। সত্যি, সে কী বিচিত্র এক ধারা তা সত্যি আমি বুঝিয়ে বলতে পারব না–আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার।

এমন বহু কথা ভাবতে ভাবতে আমি পথ পাড়ি দিতে লাগলাম। আমি ঘন কুয়াশার আস্তরণ অগ্রাহ্য করে হাঁটছি তো হাঁটছিই। একটু একটু করে এগোতে এগোতে কয়েক ঘণ্টায় অনেকখানি পথ পাড়ি দিয়ে ফেললাম। কিন্তু কয় ঘণ্টা ধরে হাঁটলাম, আর পথই বা কতখানি পাড়ি দিয়েছি, কিছুই সঠিক করে বলতে পারব না।

ইতিমধ্যে কুয়াশার চাদরটা ক্রমে গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে হতে এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছাল যে, পথ চলাই আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে দেখা দিল। কিন্তু তবুও আমার গতি স্তব্ধ করে দিতে পারল না। কোন্ মোহের বশবর্তী হয়ে, কোন্ আকর্ষণে যে আমি এগিয়ে চলার দুর্নিবার আকর্ষণ ভেতর থেকে অনুভব করতে লাগলাম তার কিছুই আমি বুঝে উঠতে পারলাম না। আসলে আমি যেন তখন বাধা বন্ধনহীন এক আজন্ম পথিক। পথ যেন আমাকে অনবরত হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকছে। আর সে ডাকে সাড়া না দিয়ে আমার যেন দ্বিতীয় কোনো উপায়ই ছিল না।

কুয়াশা! কুয়াশা! আর কুয়াশা! কোনো অদৃশ্য হাত যেন ঘন কুয়াশার পাহাড়, পার্বত্য উপত্যকা আর অদূরবর্তী পার্বত্য বনানীর ওপর ছড়িয়ে দিয়েছে। আর এরই জন্য আমার অতি কাছের একেবারে হাতের নাগালের মধ্যের জিনিসগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম না। এখন উপায়। এ পরিস্থিতিতে পথ পাড়ি দেওয়া যে বাস্তবিকই মহাসমস্যার ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল।

না, এত সহজে হার মানার পাত্র আমি নই। আমাকে এগিয়ে যেতেই হবে, দেখতে হবে এ পথের শেষ কোথায়।

আমি পথ হাতড়ে হাতড়ে কোনোরকমে ধীর-পায়ে পথ পাড়ি দিতে লাগলাম। ঠিক তখনই আমি একটা অভাবনীয়, একেবারেই অবর্ণনীয় অস্বস্তির শিকার হয়ে পড়লাম। কোন্ অসতর্ক মুহূর্তে যে আমার পা দুটো থেমে গেছে বলতে পারব না।

অস্বস্তি! হ্যাঁ, অবর্ণনীয় অস্বস্তিই বটে। এক অভাবনীয় স্নায়ুবিক দ্বিধা আমার মধ্যে ভর করল। এক অভাবনীয় কম্পনও অনুভব করতে লাগলাম। একেই বুঝি বলে, অনিশ্চিত বিপাশঙ্কায় কুঁকড়ে যাওয়া।

.

হায়! এ কী মহাসঙ্কটে পড়ে গেলাম। আতঙ্কে বুকের ভেতরে রীতিমত ঢিবঢিবানি শুরু হয়ে গেল। পা ফেলতেও ভরসা হচ্ছে না, ভয় হচ্ছে, পা ফসকে যদি কোনো গভীর ফাঁদে পড়ে যাই তবে মৃত্যুর নিশ্চিত শিকার হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না।

কুয়াশার চাদর গায়ে চাপিয়ে, ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে পথের মাঝে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কর্তব্য নির্ধারণে মগ্ন হলাম। সে অবস্থানকালে কতসব অদ্ভুত গল্প-কথা যে মনের কোণে উঁকি দিতে লাগল তা বলে শেষ করা যাবে না। এখানকার পাহাড়ের গুহা আর বনজঙ্গলে নাকি বিচিত্র আর খুবই হিংস্র প্রকৃতির মানুষ বাস করে। তারা সুযোগের সন্ধানে এখানে ওখানে ওৎ পেতে বসে থাকে। মওকা বুঝে অতর্কিতে পথচারীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ব্যস, তারপরের কথা না-ই বা বললাম।

একের পর এক, হাজার হাজার অদ্ভুত কল্পনা আমার মধ্যে ভর করল। আমার মন-প্রাণ সে সব কাল্পনিক বিপদাশঙ্কায় অবশ হয়ে পড়তে লাগল। তবে এও স্বীকার না করে উপায় নেই, আবছা বলেই সেগুলো আমার মধ্যে আরও বেশি করে প্রভাব। বিস্তার করেছে, আরও–বেশি আতঙ্ক সঞ্চার করেছে।

আমি যখন কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশে, অন্ধকার পথের মাঝে দাঁড়িয়ে কর্তব্য স্থির করতে ব্যস্ত ঠিক তখনই মাদলের বাদ্য বাতাস বাহিত হয়ে আমার কানে এসে লাগল। আওয়াজটা খুব জোরোলোই শোনাল। মনে হল, কাছেই কে বা কারা জোরে জোরে। মাদল বাজাচ্ছে।

আমি উকর্ণ হয়ে সে আওয়াজটা শুনলাম। নিঃসন্দেহ হলাম, মাদলই বটে।

ব্যস, মুহূর্তে আমার বিস্ময় তুঙ্গে উঠে গেল। মুহূর্তের জন্য হলেও আমার সর্বাঙ্গ থরথরিয়ে কেঁপে উঠল। বিস্ময় বিমূঢ় অবস্থায় আমি ভাবতে লাগলাম, এখানকার পর্বত আর পার্বত্য বনাঞ্চলের মানুষ তো কোনোদিন মাদল দেখেছে বলে মনে হচ্ছে না। তবে? এখানে কে বা কারা মাদল বাজাচ্ছে। এ কী অদ্ভুত কাণ্ডরে বাবা!

।মাদলের বাদ্য না শুনে আমি যদি শ্রেষ্ঠ দেবদূতের বাঁশির সুর শুনতে পেতাম তবুও হয়তো বা বিস্ময়ে এমন হতবাক হয়ে পড়তাম না। আমি যখন মাদলের বাদ্যের রহস্য ভেদ করতে ব্যস্ত ঠিক সে মুহূর্তেই আমার বিস্ময়, আগ্রহ, বিহ্বলতার মধ্যে আরও অদ্ভুত, একেরারেই অবিশ্বাস্য একটা কারণ আমার সামনে দেখা দিল। আচমকা একটা শব্দ আমার কানে এলো। মনে হল, আমার কাছে, একেবারে হাতের নাগালের মধ্যে অবস্থানরত কেউ একজন একটা চাবির গোছা হাতে নিয়ে ঘন ঘন নাচিয়ে চরেছে। আগের বারের মতোই উকর্ণ হয়ে ব্যাপারটা লক্ষ্য করলাম। হ্যাঁ, চাবির ‘গাছার শব্দ ছাড়া অন্য কিছুই হতে পারে না।

আরে বাবা। আমি সচকিত হয়ে মুহূর্তের মধ্যে এক লাফে দুপা পিছিয়ে গেলাম। বুকের মধ্যে ধড়ফড়ানি শুরু হয়ে গেল। নাড়ির গতি হয়ে পড়ল দ্রুততর।

পরমুহূর্তেই এক দীর্ঘাকৃতি কালো অর্ধনগ্ন মানুষ বিকট স্বরে আর্তনাদ করতে করতে আমার পাশ দিয়ে ধরতে গেলে প্রায় গা-ঘেঁষে উদ্ধশ্বাসে ছুটতে ছুটতে চলে গেল। সে আমার এত কাছ দিয়ে দৌড়ে গেল যে আমার মুখে তার গরম নিশ্বাস পর্যন্ত স্পষ্ট অনুভব করলাম। অজানা-অচেনা জায়গায়, জমাটবাধা অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে এমন অভাবনীয় একটা দৃশ্যের মুখোমুখি হলে এমন কোন্ বীরপুরুষ আছে যে নিজেকে স্থির রাখতে পারে? সত্য গোপন না করলে, বলতেই হয় সে মুহূর্তে আকস্মিক আতঙ্কে আমি রীতিমত মুষড়ে পড়েছিলাম। পরিস্থিতি খারাপ অনুমান করে আমি যন্ত্রচালিতের মতো দ্রুততার সঙ্গে সাধ্যমত পথের একধারে সরে গেলাম। আমার হাঁটু দুটো অজানা বিপদাশঙ্কায় থর থর করে কাঁপতে লাগল।

ভয়ালদর্শন লোকটার হাতে নোঙরেরর মতো ইস্পাতের একটা যন্ত্র অনেকগুলো ইস্পাতের আংটা একত্রিত করে যন্ত্রটা তৈরি করা হয়েছে।

লোকটা আমাকে অতিক্রম করে যেতে না যেতেই প্রকাণ্ড একটা জন্তুকে তার দিকে ধেয়ে যেতে দেখলাম।

অনুসন্ধিৎসু নজরে ভয়ঙ্কর সে জন্তুটার দিকে তাকিয়ে খুবই আবছা আলোয় মনে হলো সেটা অতিকায় একটা হায়না। প্রচণ্ড আক্রোশে সেটা অনবরত তীব্র গর্জন করে চলেছে। গর্জন করার ফাঁকে ফাঁকে ইয়া বড় হাঁ করছে। চোখ দুটো জ্বল জ্বল করছে।

এবার ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। লোকটা কেন তার হাতের ইস্পাতের আংটার মতো যন্ত্রটাকে বার বার এদিক-ওদিক দোলাতে দোলাতে ছুটে চলেছে। হায়না। ক্ষুধার্ত হায়না।

ক্ষুধার্ত রাক্ষসটাকে দেখার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত আতঙ্কে, অনিশ্চিত বিপদামঙ্কায় আমার বুকের ভেতরে ধড়ফড়ানি শুরু হয়ে গিয়েছিল। অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু অতিকায় হিংস্র জন্তুটাকে দেখামাত্র আমার আতঙ্ক বেড়ে না গিয়ে বরং দ্রুত কমে গিয়ে স্বাভাবিকতা ফিরে পেতে লাগলাম।

আমার মধ্যে এমন অভাবনীয় আকস্মিক পরিবর্তনের কারণ কি? কারণ খুবই স্বাভাবিক। আমি যে এতক্ষণ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলাম, ঘুমের ঘোরে স্বপ্নরাজ্যে বিচরণ করছিলাম সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হয়ে এবার আমি জাগ্রত চেতনায় ফিরে আসার জন্য চেষ্টা করতে লাগলাম।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আমি নিজেকে সামলে সুমলে বুকে সাহস সঞ্চয় করে নিলাম। এবার সাহসে ভর করে ধীরপায়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম।

সামনের দিকে দু-তিন পা এগোতে না এগোতেই আমার গলা দিয়ে বুক ফাটা আর্তস্বর বেরিয়ে এলো। আমার বিকট আর্তনাদে চারদিক কেঁপে ওঠার জোগাড় হল। হাত দুটো পিঠ দিয়ে চোখ দুটোকে কচলে নিলাম আবার! আবার আগেকার মতো

বুকের ধুককুড়ানি শুরু হয়ে গেল। নখ দিয়ে নিজের শরীরেই সাধ্যমত বল প্রয়োগ করে। চিমটি কাটলাম। কাঁপা কাঁপা পায়ে কোনোরকমে আরও কয়েক পা এগিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কুল কুল শব্দ কানে ভেসে আসতে লাগল। নিচু হয়ে, বার বার এদিক-ওদিক হেলে নিঃসন্দেহ হলাম, কুল কুল ধ্বনিটার উৎস আর কিছু নয়, পর্বতের গা-বেয়ে নেমে-আসা একটা ঝর্ণা।

আমি গুটি গুটি হেঁটে ঝর্ণাটার একেবারে গা-ঘেঁষে গিয়ে দাঁড়ালাম, কোমর বাঁকিয়ে ঝর্ণাটার ওপর ঝুঁকে, প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে হাত ভরে ঠাণ্ডা পানি তুলে তুলে চোখ-মুখে, কানে ও কপালে দিতে লাগলাম।

ঠাণ্ডা পানির ছোঁয়া পেয়ে আমার শরীর কিছুটা স্বাভাবিকতা ফিরে পেল। মনের ঘোরও ক্রমে কেটে যেতে লাগল। অচিরেই আমার দেহ-মনের অস্বস্তি কেটে যাওয়ায় আমি একজন সম্পূর্ণ সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ বনে গেলাম। আমি উঠে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। না, আমার মধ্যে আর তিলমাত্র দ্বিধাও অবশিষ্ট নেই। আমি যেন সম্পূর্ণ নতুন এক মানুষ।

এবার আমার আবার নতুন করে হাঁটা শুরু করার পালা। অজানা অচেনা পথে, ধীর-স্থির-শান্ত পদক্ষেপে আমি আবার চলতে শুরু করলাম। আমি হাঁটছি তো হাঁটছিই। এ হাঁটার যেন আর বিরাম নেই, শেষ নেই।

আমি ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। পা দুটো যেন বিশ্বাসঘাতকতা করতে চাইছে। নিতান্ত অনন্যোপায় হয়েই আমি পথের ধারের একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসে পড়লাম।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই গাছের পাতার ছায়া পড়ল সবুজ ঘাসের ওপরে। আমি অপলক চোখে টুকরো টুকরো ছায়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ছায়ার আকৃতি আমার মধ্যে বিস্ময়ের সঞ্চার করল। মনের দ্বিধা কাটাতে গিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে ওপরের দিকে তাকালাম। হ্যাঁ, যা অনুমান করেছিলাম ঠিক তা-ই। আমি একটা তালগাছের তলায় বসে।

আমি যন্ত্রচালিতের মতো দ্রুতগতিতে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বসে আরাম আয়েশ করে নষ্ট করার মতো যতেষ্ট সময় আমার হাতে নেই। স্বপ্ন দেখার মতো সময় তো অবশ্যই নেই। আমি লক্ষ্য করলাম, দেখলাম, বুঝতেও পারলাম স্পষ্টই। আমার ইন্দ্রিয়গুলো এখনও আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়নি, বরং বশেই আছে। আর সেগুলোই আমার সামনে, অন্তরের অন্তঃস্থলের সম্পূর্ণ নতুন একটা অনুভূতির জগতের দরজা খুলে দিল।

অনেকক্ষণ পর নিজের সম্বন্ধে ভাববার মতো অবকাশ ও মানসিক অবস্থা ফিরে পেলাম। একেবারে মুহূর্তের মধ্যেই যেন গরমটা অসহ্য বোধ হতে লাগল। এতক্ষণ গরম বা ঠাণ্ডা কোনো কিছুই অনুভব করিনি।

মন চাঙা-করা সুগন্ধ বাতাস বাহিত হয়ে আমার নাকে এসে লাগতে লাগল। আর বর্ষার ভরা নদীর শান্ত স্রোতের মতো চাপা একটা কুল কুল ধ্বনি স্পষ্ট শুনতে পেলাম। আর তার সঙ্গে সুর মিলিয়েছে অগণিত মানুষের গুণগুণানি। এ যেন এক সম্পূর্ণ নতুনতর অনুভূতি।

আমি যখন বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে সে গুণগুনানি শুনছি ঠিক সে সময়েই সেখান থেকে দমকা একটা বাতাসের যাদুকাঠি ছুটে এসে যেন ঘন কুয়াশার আস্তরণটাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল। চারিদিক একেবারে স্বচ্ছ। কুয়াশা বা অন্ধকারের লেশমাত্রও নেই।

আমি যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থা কাটিয়ে মুহূর্তে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। অনুসন্ধিৎসু নজরে চারদিক তাকিয়ে বুঝতে পারলাম, আমি যেন সুউচ্চ পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে সামনের বিস্তীর্ণ প্রান্তরের ওপর চোখের মণি দুটো বুলিয়ে চলেছি। আর প্রান্তরটার বুক চিড়ে আকাবাঁকা পথে হেলে দুলে বয়ে চলেছে বিশাল একটা নদী। আর নদীটার গা-ঘেঁষে অবস্থান করছে প্রাচ্য ধরনের একটা নগর। আমার আরব্য উপন্যাসের পাতায় যেরকম নগরের বিবরণ দেখতে পাই, ঠিক সে-রকম কোনো নগর অবশ্যই নয়, বরং সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধরনের।

আমি তখন শহরটা থেকে বেশ দূরে এবং অনেকটা উঁচুতে অবস্থান করছিলাম। তাই শহরটার বাড়ি-ঘর, রাস্তাঘাট ও বাগান প্রভৃতি সবকিছুকে পটে আঁকা ছবির মতোই আমার মনে হতে লাগল।

শহরটার অসংখ্য রাস্তাগুলো বেশ চওড়া। তবে সদর রাস্তার তুলনায় ছোট-বড় ও আঁকাবাঁকা গলির সংখ্যাই বেশি।

আর পথে পথে মানুষ যেন একেবারে গিজগিজ করছে, অনবরত মানুষের মিছিল চলেছে।

পথের ধারে সারিবদ্ধভাবে একের পর এক বাড়ি মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর তাদের বারান্দা, গাড়ি-বারান্দা, আকাশচুম্বি মিনার আর মনলোভা কারুকার্যমণ্ডিত জানালাগুলো যে কোনো সৌন্দর্যপ্রিয় মানুষের বিস্ময় উৎপাদন করতে বাধ্য।

শহরটার এখানে-ওখানে বাজার তো রয়েছেই, আর সুসজ্জিত দোকানপটেরও অভাব নেই। দোকানগুলোতে কতরকম জিনিসপত্র যে সাজিয়ে রাখা হয়েছে তার । ইয়ত্তা নেই। দোকানে দোকানে দেখা যাচ্ছে কাঁচের আলমারিতে পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে পান্না, হীরা, মণি, মুক্তার অলঙ্কারাদি। কোনোটিতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বহুমূল্য মসলিন আর রেশমিবস্তু আবার কোনোটিতে বা শোভা পাচ্ছে চকচকে ঝকঝকে ছুরি-কাঁচি ও অন্যান্য ও অত্যাবশ্যক অস্ত্রপাতি। আরও কত কী যে দোকানগুলোতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে তা বলে শেষ করা যাবে না।

আর সদর রাস্তায় দেখা যাচ্ছে, অবগুণ্ঠনে ঢাকা পাল্কি, মহিলা বহনকারী শিবিকা। আর বহুমূল্য মসলিন ও জরি প্রভৃতি দিয়ে সাজানো হাতি মনিবকে পিঠে, নিয়ে দুলকি চালে পথ পাড়ি দেওয়ার দৃশ্যটাও কম দৃষ্টিনন্দন নয়।

পথচারীদের কতাবার্তা চিৎকার চ্যাঁচামেচি আর হৈ চৈ আর ভিড়ের মধ্যে ঝলমলে রাজপোশাকে সজ্জিত হয়ে, মাথায় বাহারি পাগড়ি চাপিয়ে বুক পর্যন্ত নেমে-আসা লম্বা দাড়িওয়ালা লক্ষ লক্ষ কুচকুচে কালো ও হলদেটে মানুষের ভিড়ে অগণিত পবিত্র ষাঁড় নির্ভয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

আকাশচুম্বি মিনার, মসজিদের কার্নির্স আর উঁচু উঁচু বাড়িগুলোর পবিত্র জানালায়র গায়ে ময়লা জড়ানো হাজার হাজার হনুমান বিচিত্র ভঙ্গিতে ঝুলে রয়েছে। এ যেন সত্যি বড় অদ্ভুত এক দৃশ্য।

নদীর তীর ঘেঁষে জনবহুল সদর রাস্তা এগিয়ে গেছে। সেটা থেকে নদীর পানি পর্যন্ত বহু ঘাট নেমে গেছে। এগুলো শহরবাসীদের স্নানের ঘাট।

আর নদীর হালকা ঢেউয়ের ওপর দিয়ে মাল বোঝাই বড় বড় জাহাজ এগিয়ে চলেছে। পালতোলা নৌকার সংখ্যাও কম নয়।

শহরের সীমানার বাইরে থেকে সারি সারি তাল ও অন্যান্য আকাশছোঁয়া গাছ উঁকি দিচ্ছে। ছোট-বড় বহু ফল বাগিচার সংখ্যা নেহাৎ কম নয়। আর এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে চাষের ক্ষেত। কোনো কোনোটাতে ফসলও ফলেছে। তারই ফাঁকে ফাঁকে ছোট-বড় মাটির দেওয়াল আর খড়ের ছাউনি দেওয়া ঘর। সুবিশাল একটা জলাশয় আর নির্জন পরিবেশে দাঁড়িয়ে আছে জীর্ণ অথচ বেশ বড় সড় একটা মন্দির। পথের ধারে, মাঠের গায়ে বেদেদের তাঁবুও দেখা যাচ্ছে। মাথায় কলসি নিয়ে এক মেয়েমানুষ সিঁড়ি বেয়ে নদীর ঘাটে নামতে দেখা যাচ্ছে। আমি স্বপ্নে বিভোর ছিলাম বলেই এমন কথা শোনাচ্ছি, আপনারা হয়তো বলবেন। আসলে কিন্তু মোটেই তা নয়। আমি যা-কিছু চাক্ষুষ করেছি, যা-কিছু শুনেছি, অন্তর দিয়ে যা-কিছু উপলব্ধি করেছি আর ভেবেছি–তার মধ্যে স্বপ্ন দেখার কোনো ব্যাপার-স্যাপার তো দূরের ব্যাপার সামান্যতম খামখেয়ালির স্থানও ছিল না। আরও পরিষ্কার করে বললে সবকিছুর মধ্যেই সামঞ্জস্যের ছোঁয়া ছিল পুরোদস্তুর।

তবে স্বীকার করছি, গোড়ার দিকে আমি সন্দেহের দোলায় দুলছিলাম। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে বার বার সন্দেহ উঁকি দিচ্ছিল। আমি ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে আছি, নাকি পুরোপুরি জেগে আছি। ব্যাপারটা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও কম করিনি। আর তার পরই আমি বুঝতে পারলাম। নিঃসন্দেহ হলাম, আমি সত্যি সত্যি জেগেই আছি। তাই তো এসব দৃশ্যকে আমি সম্পূর্ণ বাস্তব, শতকরা একশো ভাগই সত্য ঘটনা বলেই মনে। করছি, অতএব,

আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই ডাক্তার টেম্পলটন আগ বাড়িয়ে বলে উঠলেন–‘দেখুন ভাই, আমি অবশ্য ব্যাপারটা, নিয়ে বড় একটা ভাবিত নই, তবে বলছি, আপনি নির্দিধায় চালিয়ে যান, আমি শুনছি।

মুহূর্তের জন্য নীরব থেকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মি. বেডলোর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন–‘আপনি গাছতলা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে শহরের দিকে এগোতে লাগলেন, তাই তো বললেন, ঠিক কি না?

‘হ্যাঁ, আমি শহরের দিকে হাঁটতে লাগলাম।

‘তারপর? তারপর কী হল?

চোখের তারায় বিস্ময়ের ছাপ এঁকে মি. বেডলো ডাক্তারের মুখের দিকে তাকালেন। মুহূর্তের মধ্যেই বিস্ময়ের ঘোরটুকু কাটিয়ে নিয়ে আবার মুখ খুললেন–হ্যাঁ, বলেছেন ঠিকই। আমি গাছের তলার ঘাসের বিছানার আশ্রয় ছেড়ে উঠে পায়ে পায়ে শহরের দিকে এগোতে লাগলাম।

ডাক্তার টেম্পলটন চশমার ফাঁক দিয়ে মি. বেডলোর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে তার কথাগুলো গিলতে লাগলেন।

মি. বেডলো বলে চললেন–‘শহরের দিকে এগোবার সময় পথে বহু লোকজনের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হল। দেখলাম, সবাই ভিড় করে ব্যস্ত পায়ে একই দিকে চলেছে। আর এও লক্ষ্য করলাম, সবার মুখেই উত্তেজনার ছাপ সুস্পষ্ট। ব্যাপারটা আমাকে যে কেন এত ভাবিয়ে তুলল বুঝতে পারলাম না। সত্য গোপন না করলে বলতেই হয়, ব্যাপারটা সম্পর্কে আমি যারপরনাই কৌতূহলের শিকার হয়ে পড়লাম। আর এও। স্বীকার করে নিচ্ছি, ভীড় করে এগিয়ে চলা লোকজনের ওপর আমার মনে তীব্র একটা শত্রুতার ভাব মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।

আমি পর মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে যন্ত্রচালিতের মতো সেখান থেকে সরে পড়লাম। সাধ্যমত দ্রুততার সঙ্গে পা চালিয়ে ঘুর পথে শহরে হাজির হয়ে গেলাম।

আমি শহরে পা দিয়েই দেখি, শহর জুড়ে হৈ হট্টগোল চলছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গোলমাল তুঙ্গে উঠে গেল। ব্যস, দেখতে দেখতে বেঁধে গেল তুমুল লড়াই। দল দুইটির মধ্যে একদল আধা বৃটিশ ইউনিফর্ম পরিহিত পদস্থ অফিসারগণ আর আধা বৃটিশ ও আধা ভারতীয় পোষাক পরিহিত মানুষের ছোট একটা দল। আর বিপক্ষে লড়াই করছে, বিভিন্ন গলিপথ থেকে বেরিয়ে আসা দুষ্ট প্রকৃতির একদল লোক।

হ্যাঁ, তুমুল গণ্ডগোল চলতে লাগল। আমি অদূরবর্তী পথের ধারে দাঁড়িয়ে কর্তব্য সম্বন্ধে ভাবতে লাগলাম। মুহূর্তে মনস্থির করে ফেললাম, লড়াইয়ে ভিড়ে যাওয়াই সঙ্গত মনে করলাম। আমি এক লাফে এগিয়ে গিয়ে কোনো এক মৃত অফিসারের হাত থেকে ছিটকে পড়া অস্ত্রপাতি কুড়িয়ে নিয়ে দুর্বলতর দলটার হয়ে লড়াইয়ে মেতে গেলাম।

কাদের মধ্যে লড়াই হচ্ছে, কেনই বা লড়াইয়ের সূত্রপাত কোনোকিছু বিচার বিবেচনা না করেই আমি এলোপাথাড়ি অস্ত্র চালাতে লাগলাম। সে যে কী লড়াই ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

আমাদের দলটা হেরে গেল। একমাত্র সংখ্যাধিক্যের চাপে পড়ে আমাদের পরাজয় স্বীকার করতেই হল। কোনো উপায় না দেখে আমরা রণক্ষেত্র ছেড়ে চম্পট দিলাম। উর্ধশ্বাসে ছুটতে ছুটতে গিয়ে আশ্রয় নিলাম ছাদহীন একটা ঘরে। মুহূর্তের মধ্যেই সেখানে চারদিকে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে তখনকার মতো কিছুটা অন্তত নিরাপদ এবং নিশ্চিন্ত হলাম।

ছাউনিটার মাথার দিকের একটা বড়সড় ছিদ্রপথে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে দেখতে পেলাম, উত্তেজিত জনতার বিরাট একটা দল নদীর একেবারে তীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাসাদোপম সুবিশাল একটা বাড়ির ওপর চড়াও হয়েছে, তীব্র আক্রমণ চালাচ্ছে।

বাড়িটার দিকে অনুসন্ধিৎসু নজরে দীর্ঘসময় ধরে তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ অদ্ভুত একটা দৃশ্য দেখতে পেলাম। উপরের দিককার খোলা-জানালা ভেতর থেকে যেন ইয়া মোটা একটা দড়ি নিচে নেমে এসেছে। পাগড়ির কাপড় দিয়ে তৈরি দড়ি। আর সে দড়িটা বেয়ে মেয়ে মানুষের মতো দেখতে একটা লোক তরতর করে নিচে নেমে যাচ্ছে।

নদীর পাড়ে একটা নৌকা আগে থেকেই মোটা একটা গাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল। মেয়েলি চেহারার লেকটা দড়ি বেয়ে নিচে নেমেই ব্যস্ত পায়ে নৌকাটায় চেপে বসল। বাঁধন খুলতেই সেই নৌকাটা স্রোতের টানে এগিয়ে চলল। লোকটা নদীর বিপরীত তীরে গিয়ে উঠল। পালিয়ে গেল নির্বিবাদে, তার গায়ে কাঁটার আঁচড়টিও কেউ দিতে পারল না।

আমার মাথায় এবার একটা নতুন পরিকল্পনা খেলল। মতলবটা একেবারেই নতুন। বন্ধুদের কাছে খুব সংক্ষেপে সেটা ব্যক্ত করলাম। আমার পরিকল্পনাটা শোনামাত্র তারা আমার প্রস্তাবে সম্মত হয়ে গেল।

ব্যস, আর মুহূর্তমাত্র দেরি না করে চালা ঘরটা থেকে দৌড়ে বেরিয়ে পড়লাম।

শত্রুপক্ষ আমাদের হঠাৎ এবং জোরদার আক্রমণের চাপ বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারল না। বে-কায়দা বুঝে, হঠাৎ করে কর্তব্য স্থির করতে না পেরে তারা পড়ি কি মরি করে যে যেদিকে পারল ছুটে পালাল, সবাই গলিতে-গলিতে গিয়ে গা-ঢাকা দিল।

তারা কিন্তু হাত-পা গুটিয়েনিশ্চেষ্ট হয়ে বসে রইল না। দুদিকের গলিগুলো থেকেই তীর আর বর্শা নিয়ে আমাদের ওপরে আক্রমণ চালাতে লাগল। উভয়দিক থেকে ঘন ঘন বৃষ্টির মতো তীর আর বর্শা ছুটে আসতে লাগল।

তীরের ফলাগুলো কী যে মারাত্মক তা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। যাকে বলে যথার্থ মারণাস্ত্র। একমাত্র মালয় দেশের অস্ত্র বাঁকা কিরিচের সঙ্গেই সেগুলোর তুলনা চলতে পারে। তীরের ফলার মাথায় যে কেবলমাত্র বিষ মাখানো তা-ই নয়, সেগুলো। সর্পাকৃতি। আর লম্বাটে ও কুচকুচে কালো। সেগুলো এক নজরে দেখলেই আতঙ্কে বুকের মধ্যে ঢিবঢিবানি শুরু হয়ে যায়।

আতঙ্ক! আতঙ্কের পর আতঙ্ক। আচমকা একটা তীর ছুটে এসে সোজা আমার কপালে গেঁথে গেল। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথায় ঝিমঝিমানি শুরু হয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যেই মাথাটা চক্কর মেরে উঠল। আমি হুমড়ি খেয়ে পথে পড়ে গেলাম। তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলাম। অসুস্থ হয়ে পড়লাম। তবু আমি হাত থেকে অস্ত্রটা ফেললাম না। দাঁতে দাঁত চেপে তীব্র যন্ত্রণার মধ্যেও অনেকক্ষণ লড়ে গেলাম। এবার বিষ-জ্বালা সহ্যাতীত হয়ে পড়ল। হাঁপও ধরে গেল। আর টিকে থাকতে পারলাম না, মরে গেলাম। শেষ। আমার সব শেষ হয়ে গেল।

মুহূর্তের জন্য নীরব থেকে আমি আবার মুখ খুললাম–‘ডাক্তার টেম্পলটন, আশা করি এতকিছু শোনার পর আর আগের মতো বলবেন না যে, আপনার গোটা

অভিযানটাকে একটা স্বপ্ন ছাড়া অন্য কিছুই ভাবতে উৎসাহ পাচ্ছি না।’

ডাক্তার টেম্পলটন ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে চশমার ফাঁক দিয়ে আমার মুখের দিকে তাকালেন।

আমি এবার বললাম–‘ডাক্তার টেম্পলটন, আশা করি আপনি অবশ্যই বলতে উৎসাহি হবেন না যে, আপনি মৃত, কী বলেন?

ডাক্তার টেম্পলটন এবার নীরবে মুচকি হাসলেন।

আমি মি. বেডলোর মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। তাকেও নীরব দেখে আমি অবাকই হলাম। আমি নিঃসন্দেহ ছিলাম, তার কাছ থেকে মোক্ষম একটা মন্তব্য শুনতে পাব। কি আশ্চর্য ব্যাপার। লক্ষ্য করলাম, ইতস্তত করছে। তার সর্বাঙ্গ কাঁপছে, থর থরিয়ে কাঁপছে। মুখটা ফ্যাকাশে, রক্ত শূন্য। ছাইয়ের মতো বিবর্ণ সাদাটে হয়ে গেছে। তিনি নীরব, মুখে কলুপ এঁটে বসে রইলেন। টু-শব্দটিও করলেন না।

আমি ঘাড় ঘুড়িয়ে আবার ডাক্তার টেম্পলটনের মুখের দিকে তাকালাম। তার অবস্থা দেখে আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়ার জোগাড় হলাম। দেখলাম, তিনি চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে কাঠের মতো সোজা ও শক্ত হয়ে চেয়ার আঁকড়ে বসে। ঘন ঘন দাঁতে দাঁত লাগার রীতিমত ঠক ঠক আওয়াজ হচ্ছে। আর চোখ দুটো ইয়া বড় বড়। নিশ্চল-নিথর। কোটর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

পর মুহূর্তেই নিজেকে একটু সামলে নিয়ে, বুকে শক্তি ও সাহস সঞ্চার করে কোনোরকমে উচ্চারণ করলেন–‘মি. বেডলো থামলেন কেন? বলে যান। তারপর কি হলো, বলুন?

বেডলো নিজের চেয়ারে একটু নড়েচড়ে আয়েশ করে বসলেন। তারপর আবার মুখ খুললেন ‘হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম–দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আমার একমাত্র অনুভূতি কি ছিল জানেন ডাক্তার টেম্পলটন?

ডাক্তার টেম্পলটন ভাঙা ভাঙা গলায় কোনোরকমে উচ্চারণ করলেন–কী? কীসের কথা বলছেন?

‘বলতে চাইছি, অনেকক্ষণ পর্যন্ত আমার একমাত্র অনুভূতি ছিল, জমাটবাধা অন্ধকারের আর অস্তিত্বহীনতার।

‘অস্তিত্বহীনতার।

‘হ্যাঁ, ঠিক তা-ই। আর সঙ্গে ছিল মৃত্যুচেতনা। আর শেষ পর্যন্ত আমার বোধ হলো অকস্মাৎ একটা বিদ্যুৎপ্রবাহ যেন আমার বুকের ভেতর তোলপাড় করতে লাগল। সে যে কী অবস্থা তা বুঝিয়ে বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আসলে যে সেটা একটা অনুভূতি মাত্র, চোখে দেখা বা স্পর্শ করে উপস্থিতি অনুভব করার ব্যাপার নয়।

আমি যেন যন্ত্রচালিতের মতো মুহূর্তে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

খুবই সত্য যে, চোখে দেখা, কানে শোনা বা শারীরিক দিক থেকে তখনকার মতো গ্রাহ্য করার মতো কোনোরকম উপস্থিতিই আমার মধ্যে ছিল না।

এক সময় জনতার উত্তেজনা থেমে গেল। এক এক করে সবাই চলে গেল। পথঘাট ধরতে গেলে জনমানবশূন্য হয়ে পড়ল। গোলমালের চিহ্নমাত্রও আর রইল না। শহরের পরিবেশ শান্ত-স্বাভাবিক হয়ে এলো।

আমার শবদেহটা আমারই পায়ের তলায় অবস্থান করছে। তীরটা কপালে গেঁথে রয়েছে। আর মাথাটা ফুলতে ফুলতে ইয়া বড়, খুবই বিকট আকার ধারণ করেছে। বুঝার উপায় নেই, সেটা আমার, কোনো মানুষের মাথা হতে পারে। তবে যা-কিছু বলছি সবই আমার ধারণা–অনুভূতির মাধ্যমে উপলব্ধি করা, কোনোটাই বাস্তব চোখের সামনে দেখা ব্যাপার অবশ্যই নয়। আবারও বলছি, কোনো ব্যাপারেই আমার আগ্রহ উৎসাহের লেশমাত্রও ছিল না। এখনও বলছি, এমনকি আমার শবদেহটার। ব্যাপারেও আমার মধ্যে কোনোরকম আগ্রহ ছিল না। বরং এ ব্যাপারে আমি একেবারেই উদাসীন, সম্পূর্ণ নিস্পৃহ।

আমার মধ্যে আগ্রহ না থাকলেও কেবলই যেন মনে হতে লাগল, কে যেন গোপন অন্তরাল থেকে আমাকে সেখান থেকে কেটে পড়ার জন্য বার বার উস্কানি দিতে লাগল।

আমি শেষপর্যন্ত সেখান থেকে সরে পড়ার সিদ্ধান্ত না নিয়ে পারলাম না। তাই যে ঘুরপথে আমি শহরে ঢুকেছিলাম সে পথ অনুসরণ করে আমি ব্যস্ত-পায়ে শহর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম।

উৰ্দ্ধশ্বাসে হাঁটতে হাঁটতে আমি যেখানে হায়নাটাকে চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পেরেছিলাম ঠিক সে জাগায়টাতেই আবার এসে হাজির হলাম। সে জায়গাটাকে চিনতে পারামাত্র আমি যেন আচমকা বিদ্যুৎপিষ্ট হয়ে গেলাম। ভার, আগেকার সেই ইচ্ছাশক্তি আর অস্তিত্ববোধ আমার মধ্যে ফিরে আসতে লাগল।

একসময় আপন অস্তিত্ব আমার মধ্যে পুরোপুরি জেগে উঠল।

হ্যাঁ, আমি আবার আপন সত্ত্বা ফিরে পেলাম। সম্বিৎ যে আমি সম্পূর্ণরূপে ফিরে পেয়েছি তা উপলব্ধি করতে আমার দেরি হলো না।

এবার আমি অত্যুগ্র আগ্রহের সঙ্গে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলাম। তখন আমার একটা মাত্রই ভাবনা, কত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যেতে পারব।

কিন্তু অতীতকার বাস্তবতাকে অবশ্যই বিস্মৃত হলো না। এর মধ্যে অবাস্তব ব্যাপার-স্যাপার কী-ই বা আছে তা তো আমি ভেবে উঠতে পারলাম না। সম্পূর্ণ বাস্তব যা-কিছু তাদের স্বপ্ন বলে উড়িয়ে দেওয়া কি করে সম্ভব, বলুন? ডাক্তার টেম্পলটন নির্দিধায় বললেন–সেটা স্বপ্ন ছিল না এ-সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ কিছুমাত্রও নেই। কিন্তু সেটাকে যে কোন নামে অভিহিত করা যায় তা-ও তো ভাববার ব্যাপারই বটে।

মি. বেডলো তাঁর দিকে নীরব চাহনি মেলে তাকিয়ে কথাগুলো শুনতে লাগলেন।

ডাক্তার টেম্পলটন তাঁর বক্তব্য অব্যাহত রাখলেন–‘দেখুন, আমরা শুধুমাত্র এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে, বর্তমান যুগের মানুষের মন, মানুষের চিন্তাধারা বিরাট একটা আবিষ্কার করতে চলেছে।

‘আবিষ্কার?

‘হ্যাঁ, আবিষ্কার। একেবারেই অভিনব এক আবিষ্কার। তবে এও সত্য যে, এ পর্যন্ত জেনেই আমাদের তুষ্ট থাকতে হবে, আত্মতৃপ্তি লাভ করতে হবে। আর বাকিটার সামান্যতম ব্যাখ্যা আমি করছি।

মুহূর্তের জন্য নীরব থেকে ডাক্তার টেম্পলটন একটা ছবির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন–এই যে ছবিটা দেখছেন, ভালোভাবে লক্ষ্য করুন। অবশ্য আমার উচিত ছিল আগেই আপনাকে এটা দেখিয়ে রাখা।

মি. বেড়লো কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। আসলে ডাক্তার টেম্পলটন তাকে সে সুযোগ না দিয়ে নিজেই আবার বলতে শুরু করলেন–হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, ছবিটা কেন আমি আগেই দেখাইনি, ঠিক কি না? এর উত্তরে আমি বলব, বর্ণনাতীত একটা আতঙ্কের জন্যই এতদিন ছবিটা দেখানো সম্ভব হয়নি।

তাঁর অঙ্গুলি-নির্দেশিত পথে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে আমরা ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি দীর্ঘসময় ধরে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে ছবিটার দিকে তাকিয়ে, ভালোভাবে লক্ষ্য করেও ছবিটার মধ্যে এমনকিছু পেলাম না যা আমার কাছে অসাধারণ বা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মনে হবে।

ছবিটার মধ্যে আমি অসাধারণ কিছু খুঁজে না পেলেও মি. বেডলোর কাছে তার বিশেষ প্রতিক্রিয়া হল।

আমি লক্ষ্য করলাম, ছবিটা দেখা মাত্র মি. বেডলোর চোখ মুখ মুহূর্তের মধ্যে কেমন যেন বদলে গেল। তিনি প্রায় সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলার উপক্রম হলেন।

আসলে ছবিটা তো মি. বেডলোরই ছোট একটা প্রতিকৃতি ছাড়া অন্য কিছুই নয়। তবে প্রতিকৃতিটা তো তাঁর নিজেরই অবয়বের এক অদ্ভুত ধরনের অবিকল প্রতিরূপ। আর যা-ই হোক না কেন, ছবিটা দেখে আমার কাছে এ ছাড়া অন্য কিছুই মনে হয়নি। তবে? তবে তার মধ্যে এরকম আকস্মিক পরিবর্তনের কারণ কি? আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি ও ভাবনা চিন্তা দিয়ে ব্যাপারটার কিনারা করতে পারলাম না।

আমার অসহায় অবস্থাটা ডাক্তার টেম্পলটনের নজর এড়াল না। তিনি আমার বিস্ময় মাখানো মুখের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই মুচকি হেসে বললেন–ভালোভাবে লক্ষ্য করুন, দেখতে পাবেন, প্রতিকৃতিটার এক কোণে অস্পষ্ট হলেও লেখাটা বোঝা যাচ্ছে, সময়টা উল্লেখ করা হয়েছে ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দ।

আমি তার কথা মতো প্রতিকৃতিটার বিশেষ কোণটার ওপর চোখ বুলাতে লাগলাম।

ডাক্তার টেম্পলটন বলে চলল–‘হ্যাঁ, প্রতিকৃতিটা সে বছরই আঁকা হয়েছিল। আমার এক পরলোকগত বন্ধুর প্রতিকৃতি।

‘আপনার মৃত বন্ধুর প্রতিকৃতি?

‘হ্যাঁ, ঠিক তাই। মি. ওন্ডের নামে এক বন্ধু।

‘মি. ওন্ডের?’

‘হ্যাঁ। তাঁর সঙ্গে আমার হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল কলকাতায়। তখন ওয়ারেন হেস্টিংস ছিলেন সেখানকার শাসক। আমি তখন যুবক। বয়স মাত্র ত্রিশ বছর।

‘সে বহুদিনের কথা ভাই।

‘সে তো নিশ্চয়ই। হ্যাঁ, যে কথা বলতে চাইছি–মি. বেডলো; আপনার সঙ্গে তো আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল সারাটোগাতে, তাই না?

‘হ্যাঁ। আপনাকে প্রথমবার দেখেই প্রতিকৃতিটা আর আপনার সঙ্গে অলৌকিক সাদৃশ্য লক্ষ্য করেই আমি আপনার ব্যাপারে উৎসাহি হয়ে পড়ি। আমিই এগিয়ে গিয়ে গায়ে পড়ে আপনার সঙ্গে পরিচয় করেছিলাম, মনে পড়ছে?

‘অবশ্যই। অবশ্যই।

প্রথম আলাপ পরিচয়ের মুহূর্তেই আপনার সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনের প্রস্তাব দেই।

মি. বেডলো নীরবে মুচকি হাসলেন।

ডা. টেম্পলটন বলে চললেন–‘আমি তখন এমন সব ব্যবস্থা করলাম যাতে আমি আপনার সর্বক্ষণের সঙ্গি হয়ে উঠতে পারি–অভিন্ন হৃদয় বন্ধু যাকে বলে। কিন্তু কেন আমি আপনার ব্যাপারে এতখানি উৎসাহি হয়ে পড়ি, হয়তো আপনি মনে মনে ভেবেও ছিলেন, ঠিক কি না?

মি. বেডলোর দিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে ডাক্তার টেম্পলটনই আবার মুখ খুললেন, ব্যাপারটা আরও খোলসা করে দেবার জন্য বলতে শুরু করলেন–‘দেখুন মি. বেডলো, আমার এ কাজটার পিছনে দুটো উদ্দেশ্য, মানে কারণ ছিল–প্রথমত মৃত ব্যক্তির অনুশোচনাবিহীন স্মৃতি, আর দ্বিতীয়ত আপনার সম্পর্কে অস্বস্তিকর ও অল্প বিস্তর ভীতিপ্রদ কৌতূহলের শিকার হয়ে পড়া।

আপনি পর্বতের ভিতরে প্রবেশ করে শহরের যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন, যা-কিছু চাক্ষুষ করেছিলেন তার বিস্তারিত বিবরণ আমাদের কাছে ব্যক্ত করেছেন। আপনার বর্ণনায় যে পবিত্র নদীর উল্লেখ করেছেন, তা ভারতীয় নদী গঙ্গা ছাড়া কিছুই নয়। আর নদী তীরবর্তী যে শহরের উল্লেখ করেছেন তা নদী তীরবর্তী বেনারস শহরেরই অবিকল বর্ণনা, কার্বন কপি মনে করা যেতে পারে।

আপনি যে দাঙ্গা হাঙ্গামার উল্লেখ করেছেন সেই দাঙ্গা, সেই লড়াই আর সেই হত্যালীলা সত্যি সত্যি সংঘটিত হয়েছিল চৈৎসিংহের বিদ্রোহের সময়–১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে। যখন ওয়ারেন হেস্টিংসের প্রাণ পর্যন্ত বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। তখনকার ঘটনা।

আপনি বর্ণনার মধ্যে পাগড়ির দড়ি বেয়ে একজনের নেমে যাওয়ার কথা উল্লেখ করেছিলেন, ঠিক কি না? যিনি এভাবে পালিয়ে গিয়ে ছিলেন তিনি আসলে কে, বলুন তো? তিনি চৈৎসিং নিজে।

আর চালাঘরে যাদের আশ্রয় নেবার কথা বলেছিলেন, তারা আসলে হেস্টিংসের অধীনস্ত একদল সিপাহী আর এক ইংরেজ অফিসার। আমি নিজের যে দলে ছিলাম, তাদের হয়ে লড়াই করেছিলাম। আর বিষমাখা তীরটার কথা বলেছিলেন না? সে কোনো এক বাঙালি নিক্ষেপ করেছিল। তার আঘাতে সে অফিসারটি মারা গিয়েছিল তাকে ওই ভয়ঙ্কর অভিযান থেকে বিরত করার জন্য আমি চেষ্টার ত্রুটি করিনি। কিন্তু ফয়দা কিছুই হলো না। সে অফিসারটি ছিলেন আর কেউ নয়, আমার এক অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। ওন্ডেব তার নাম।

ডাক্তার টেম্পলটন কথা বলতে বলতে একটা নোটবই আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। তার কয়েকটি পৃষ্ঠা সদ্য লেখা হয়েছে বলেই মনে হল। নোটবইটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে তিনি এবার বললেন–এ পাণ্ডুলিপিটা পড়ে দেখুন, তবেই বুঝতে অসুবিধা হবে না–পাহাড়ের ভেতর থেকে আপনি কল্পনার মাধ্যমে যে সময়ের এসব দৃশ্য দেখতে পেয়েছিলেন, ঠিক সে সময়ে আমি আমার নিজের বাড়ির পড়ার ঘরে বসে সে বিবরণটা লিখতে ব্যস্ত ছিলাম। কেবল ব্যস্ত বললে ঠিক বলা হবে না, লেখার মধ্যে পুরোপুরি ডুবে গিয়েছিলাম।

এ আলোচনার প্রায় সপ্তাহখানেক বাদে নিচে বর্ণিত বিবরণটা চালোটিসভিল পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। বিবরণটি হুবহু নিচে উল্লেখ করলাম।

বড়ই দুঃখের সঙ্গে আমরা মি. অগাস্টাস বেডলোর মৃত্যু সংবাদ প্রকাশ করছি। খোলামেলা মনের মানুষটি মিষ্টি মধুর ব্যবহার এবং বহুরকম গুণের জন্য বহুদিন পর্যন্ত চার্লোটেসংভিল অঞ্চলের অধিবাসীদের কাছে বড়ই প্রয়োজন হিসেবে গণ্য ছিলেন। সত্যি কথা বলতে কি, নাগরিকদের কাছে তিনি ছিলেন চোখের মণি।

মি. বি গত বছর কয়েক ধরে স্নায়রোগে ভুগছিলেন। কষ্টও পাচ্ছিলেন খুবই। আর প্রায়ই আশঙ্কা হত সে এ রোগেই তাঁর ভবলীলা সাঙ্গ হবে। ক্রমে এ ধারণাটা তাঁর কাছে প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে পড়তে লাগল। তবে একটা তার মৃত্যুর পরোক্ষ কারণ হলেও প্রত্যক্ষ কারণটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

দিন কয়েক আগে। বন্ধুর পর্বতশ্রেণিতে অভিযান চালাতে গিয়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। সর্দি-জ্বরের কবলে পড়ে যান। পরিস্থিতি ক্রমে সঙ্গীণ হয়ে পড়ে। আর এ কারণেই তার মস্তিষ্কে প্রচুর পরিমাণে রক্ত-সঞ্চালিত হয়ে পড়ে।

তিনি ডাক্তার টেম্পলটনের শরণাপন্ন হন। তিনি প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সে উপসর্গটা হ্রাস করার জন্য সাধ্যমত চেষ্টা চালাতে লাগলেন। এ কাজে তিনি সংরক্ষণ পদ্ধতি অনুসরণ করলেন। তার কপালে জোঁক বসিয়ে দেওয়া হল। খুবই কম সময়ের মধ্যেই তিনি মারা গেলেন। পরবর্তীকালে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখা গেল, জোঁকগুলোকে যে পাত্রটার মধ্যে রাখা হয়েছিল ভুলবশত তাতে এমনকিছু সংখ্যক বিষাক্ত জলজকীট ছিল যা কাছাকাছি পুকুরগুলোতে প্রায়ই চোখে পড়ে। এ জলজ প্রাণীটা তার কপালের দক্ষিণ দিকের এক ধমণীকে কামড়ে ঝুলেছিল। বিষাক্ত কীটটি দেখতে চিকিৎসা কাজে ব্যবহৃত জেঁকের মতো দেখতে বলেই এরকম একটা ভুল হয়ে যায়। তারপর খুবই দেরিতে সেটা বুঝা গেল। এত বেশি দেরি হয়ে গিয়েছিল যে, তখন আর কিছুই করার সুযোগ ছিল না। আগে, সময়মত ব্যাপারটা ধরা পড়লে হয়তো কিছু করার সুযোগ পাওয়া যেত।

বিশেষ লক্ষ্যণীয়, চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত চার্লোটেসভিল নামক এ বিষাক্ত জলজ কীটটা যে জোঁক নয় তা একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলে সহজেই বুঝা যায়। একে চিনতে পারা এমনকিছু কঠিন সমস্যা নয়। এর গায়ের রং কালো। আর এটি সাপের মতো এঁকে বেঁকে চলাফেরা করে। চলার কৌশল দেখে একে জেক থেকে আলাদা। করা যেতে পারে।

আমি ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনার জন্য পত্রিকার সম্পাদক সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম। কথা প্রসঙ্গে আমি তাঁর কাছে প্রশ্ন রাখলাম–একটা কথা জিজ্ঞেস করছি, নিহত লোকটার নাম ‘Bedlo’ লেখার কারণটা কি, জানতে পারি কী?

সম্পাদক সাহেব আমার প্রশ্নের কি জবাব দেবেন হঠাৎ করে ভাবতে না পেরে আমতা আমতা করতে লাগলেন।

আমি এবার বললাম আপনারা যেমন Bedlo’ লিখেছেন, ঠিক এ পদ্ধতিতে নামের বানান লেখার বিশেষ কোনো যুক্তি, মানে যুক্তিপূর্ণ পদ্ধতি নিশ্চয়ই আপনারা অনুসরণ করেন, কী বলেন?

যুক্তি? যুক্তিপূর্ণ পদ্ধতি? আরে ভাই, এটা কোনো পদ্ধতির ব্যাপার নয়, নিছকই ছাপার ভুল। পৃথিবীর সবাইই জানে, Bedlo’ নামের বানান লেখাটার সময় শেষে একটা ‘e’ অবশ্যই বসানো চাই। এর অন্য কোনো বানান হয় বলে আমার অন্তত শোনা নেই। অবশ্য ছাপার ভুলের জন্যই এরকম প্রমাদ ঘটেছে।

সম্পাদকের দপ্তর থেকে বেরিয়ে আসার সময় আমি আপন মনেই বলতে লাগলাম–ব্যাপারটা তাহলে আর কিছুই না হোক অন্তত একটা ব্যাপাওে প্রকৃত উপন্যাসের চেয়েও অবাক হবার মতোই বটে। কারণ Bedlo’ নামটার শেষে ‘e ব্যবহার না করে লেখার মানে দাঁড়াচ্ছে, oldeb’ নামটাকেই ছাপার সময় ভুল করে হরফগুলোকে উলটেপাল্টা সাজানো হয়েছে। এ ছাড়া অন্য কিছু তো ভাবা যায় না। আর সম্পাদক সাহেবও তো বলেন ছাপার ভুলের জন্যই এ রকমটা ঘটেছে। কথাটা যুক্তিগ্রাহ্য, সন্দেহ নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *