1 of 2

দ্য ফল অব দ্য হাউস অব আশার

দ্য ফল অব দ্য হাউস অব আশার

হেমন্তকাল!

সে বছরের হেমন্তের এক বিকাল।

হেমন্তের বিকাশে মেঘরাশি যখন আকাশ ছেড়ে অস্বাভাবিক নিচে নেমে শূন্যে ঝুলে পড়েছে ঠিক এমনই এক ঘেয়ে মেঘলা, নিঃঝুমনিস্তব্ধ দিনে আমি একা, একদম একা ঘোড়ায় চেপে নিরানন্দময় গ্রাম্য পথে কিছুটা সময় অতিবাহিত করেছিলাম।

এক সময় সারাদিনের কর্মক্লান্ত সূর্যটা একটু একটু করে পশ্চিম-আকাশের গায়ে হেলে পড়তে আরম্ভ করল। তারই চারদিকে আঁকা হয়ে গেল বিদায়ী সূর্যের শেষ রক্তিম ছোপটুকু। শেষপর্যন্ত এক সময় একটু একটু করে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসতে লাগল গ্রাম্য পরিবেশটার গায়ে।

চারদিকে আবছা অন্ধকারে চাপা পড়তেই আমার চোখের সামনে ফুটে উঠল বিন্ন এক বাড়ি। তার সামনে বড় বড় হরফে লেখা ‘আশার আলয়’ কথাটা আমার চোখে পড়ল।

কেনআর কিভাবেই বা হয়েছিল আমি বলতে পারব না। তবে এটুকু অন্তত জোর দিয়েই বলতে পারি, বাড়িটাকে দেখার প্রথম মুহূর্ত থেকেই নিতান্তই অসহনীয় একটা বিষণ্ণতা আমার বুকের মধ্যে চেপে বসেছিল। অসহনীয় বলার কারণ এই যে কোনো ভীষণতা বা নির্জনতার কোনো সুকঠোর মূর্তির সামনে–একেবারে সামনা সামনি দাঁড়িয়ে পড়তে হলেও সে অর্ধসুখদায়ক ছন্দময় কাব্যিক ভাব আমাদের মনকে। প্রভাবিত করে এতে তা-ও তিলমাত্র ছিল না।

সামনের প্রাকৃতিক দৃশ্যের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলাম। বাড়িটার চারদিকে দৃশ্যাবলীর ওপর নজর বুলাতে লাগলাম। বাড়িটার নিকট ও দূরবর্তী অতি সাধারণ গ্রাম্য-দৃশ্য প্রাচীন, জীর্ণও বিষণ্ণ প্রাচীর, উন্মুক্ত বাহ্নায়ণ, তৃষ্ণাচ্ছাদিত জলজভূমি আর মরা গাছের কয়েকটা কাত্রে ওপর আগ্রহী চোখের মণি দুটোকে বুলোতে বুলোতে এমন এক বিষণ্ণতা আমার মন-প্রাণকে ভারাক্রান্তি করে তুলল যার একমাত্র তুলনা চলতে পারে আফিমের নেশাগ্রস্থের স্বপ্নালু ভাব কেটে যাবার পর তার মানসিক পরিস্থিতির সঙ্গে, আর রঙীন স্বপ্ন ভঙ্গের পর জীবনের বাস্তবতার তিক্ততায় ফিরে যাওয়ার সঙ্গে।

তখন আমার মন-প্রাণকে ঘিরে ধরল এক বরফের মতো শীতলতা, পানিতে ডুবে যাওয়ার অসহায়, ব্যামোগ্রস্তের দুঃসহ যন্ত্রণা চিন্তার এমন এক প্রতিকারহীন ভয়ঙ্করতা যাকে কল্পনার মাধ্যমেও মহৎ অনুভূতির জগতে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব নয়।

কিছুটা সময় স্থবিরের মতো দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম, এমন কোন শক্তিতে শক্তিমান যা ‘আশার আলয়’-এর ভাবতে গিয়েই আমার মধ্যে এমন অসহনীয় অসহায়তার মধ্যে ডুবিয়ে দিল?

না, এ রহস্য ভেদ করা সাধ্যাতীত। আর সে ভাবনার জট ছাড়াতে গিয়ে আমি যে সব ঝাপসা কল্পনার জালে জড়িয়ে পড়লাম তাকেও আমি ঠিক ঠিক ভাবে বুঝে উঠতে পারলাম, না।

শেষমেশ নিতান্ত অনন্যোপায় হয়েই আমাকে এ ভালো না লাগা সিদ্ধান্তকেই স্বীকার করে নিতে হল, যদিও খুবই সহজ-সরল স্বাভাবিক ঘটনাবলি বহুক্ষেত্রেই আমাদের মনকে এমন বিধ্বস্ত করে তুলতে পারে তবু সে ক্ষমতাকে বিচার-বিশ্লেষণ করার শক্তি আমাদের মধ্যে অনুপস্থিত।

আরও মনে হলো ঘটনার বিস্তারিত বিবরণকে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে হয়তো আমাদের মন-প্রাণের ওপর তার দুঃখ-যন্ত্রণার প্রভাব অনেকটা কমে যেত, নতুবা একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। এরকম ধারণা বুকে নিয়েই ‘আশার আলয়’-এর লাগোয়া হ্রদটার একেবারে তীরে পৌঁছে লাগাম টেনে ধরে ঘোড়াটাকে দাঁড় করালাম। তার ধূসর স্থির পানির দিকে দৃষ্টি ফেরালাম। কিন্তু পানির দিকে চোখ পড়তেই আমার বুকের ভেতরে হঠাৎ ধড়াস্ করে উঠল। সর্বাঙ্গ থরথরিয়ে কাঁপতে লাগল।

আরও আছে, হ্রদটার তীরবর্তী ধূসর তৃন্দ্রাচ্ছাদিত ভূমি, ভূতুড়ে গাছের কান্ডের সারি আর চোখের পাতা খোলা জানালাগুলো–এসব কিছুর ওল্টানো বিকৃত ছবি হ্রদের পানিতে ভাসতে দেখা গেল। আমি ঘোড়ার পিঠে বসেই বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে সবকিছু দেখতে লাগলাম।

এ সত্ত্বেও এবার বিষণ্ণ এ আশার আলোতে দিন কয়েক কাটিয়ে দেব বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম।

রোডিবক আশার আমার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। তার সঙ্গে দীর্ঘ দিনের হৃদতার সম্পর্ক। আমাদের মধ্যে শেষবার দেখা হওয়ার পর বেশ কয়েকটা বছর পেরিয়ে গেছে। ইদানিং দেশের একেবারে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বসবাসের সময় হঠাৎ তার। একটা চিঠি হাতে পাই। তাতে এমন এক জোরালো বক্তব্য ছিল যার ফলে তার চিঠিটার উত্তর না দিয়ে পারাই গেল না।

তার হস্তাক্ষরে স্নায়বিক উত্তেজনা খুবই স্পষ্ট ছিল। চিঠিটার বন্ধুবর নিজেই বলেছে, সে কঠিন ব্যামোগ্রস্ত, মানসিক ভারসাম্যের অভাবের ব্যথা-বেদনা, তার সবচেয়ে অন্তরঙ্গ ও প্রিয় আর একমাত্র বন্ধুও ঘনিষ্ঠতার তাগিদে আমাকে একবারটি চোখের দেখা দেখে শান্তি লাভের কথা। আর সে শেষ চেষ্টা করে দেখতে অত্যুগ্র আগ্রহী সে আমার সক্ষম লাভের ফলে তার কঠিন ব্যামো কিছুটা কমে কিনা। এসব কথার মাধ্যমে সে যেভাবে আকুল আর্তি জানিয়েছে, আরও অনেক কথা বলে আমাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়েছে যে আমার পক্ষে তা উপেক্ষা করার সামান্যতম সুযোগও ছিল না। তাই তো চিঠিটা হাতে পাওয়া মাত্র তার সনির্বন্ধ অনুরোধ রক্ষা করতে এখানে ছুটে আসতে বাধ্য হয়েছি।

আমার বাল্যকালের অন্তরঙ্গ বন্ধু, ঘনিষ্ঠজন হওয়া সত্ত্বেও তার সম্বন্ধে তেমন কিছু জানা নেই। স্বভাব বসত যে নিজেকে পর্দার আড়ালে রাখতেই বেশি উৎসাহি ছিল। সত্যি কথা বলতে কি এ ব্যাপারে সে যা-কিছু করত তাকে মাত্রাতিরিক্তই বলা চলে। তবে আমার এটুকু জানা ছিল সে স্মরণাতীত কাল থেকেই তার পরিবারের বিশেষ মেজাজ মর্জির জন্য চারদিকে যথেষ্ট নামডাক ছিল। দীর্ঘদিন যাবৎ তার প্রকাশ ঘটেছিল শিল্পকলার অগণিত কারুকার্যের মাধ্যমে। আর ইদানিং কালে বিভিন্ন দরাজ হাতের কাজকর্ম আর জটিলতর সংগীতের প্রতি অত্যন্ত প্রীতি ও চর্চার মাধ্যমেও তারা কম খ্যাতি অর্জন করেনি।

আরও একটা বিশেষ উল্লেখযোগ্য তথ্য বিশেষভাবে আমার পক্ষে জানা সম্ভব হয়েছিল–সবার শ্রদ্ধাভাজন এ আশার বংশের প্রধান কাণ্ডটা থেকে কোনোদিনই স্থায়ী কোনো ডালপালা সৃষ্টি হয়নি। কথাটাকে অন্যভাবে, আরও সহজ করে বললে, পুরো। পরিবারটা আজ অবধি মোটামুটি একটা মাত্র বংশকেই ধরেই বয়ে চলেছে। আর একারণেই একের পর এক শতক ধরে বংশ পরম্পরায় একটা পারিবারিক ধারাই প্রবাহিত হচ্ছে বিশালায়তন এ আশার আলয়টাকে কেন্দ্র করে। তাই তো বাড়িটার পরিচয় যা-ই থাক না কেন, নিকটবর্তী পল্লীবাসীদের কাছে বাড়িটা ‘আশার আলয়’ নামটাই বেশি পরিচিত। আর এ নামটার মাধ্যমেই তাদের বংশের এবং বাড়িটার পরিচয় প্রকাশ পাচ্ছে।

এসব কথা ভাবতে ভাবতে আমি আবার চোখ ফিরিয়ে বাড়িটার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম।

বাড়িটার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য অতি প্রাচীনত্ব। কালের প্রভাবে বাড়িটা আর জীর্ণ আর বিবর্ণ হয়ে পড়েছে।

শ্যাওলার আস্তরণ জমেছে প্রাচীরের এখানে-ওখানে–সর্বত্র। তবে এমন কথা কিন্তু ভুলেও বলা যাবে না যে, বাড়িটা ধ্বংসের মুখে। চুন-বালির আস্তরণ ঘষে পড়েছে। এমন জায়গা ধরতে গেলে চোখেই পড়ে না। তবে কেবলমাত্র দু-চারটি পাথর খসে পড়তে চলেছে। ব্যস, এর বেশি কোনো লক্ষণ চোখে পড়ে না যাতে করে ভাবা যেতে পারে বাড়িটা ধ্বংসোনুখ।

তবে একটা কথা খুবই সত্য যে, রীতিমত অনুসন্ধিৎসু চোখে দেখলে নজরে পড়বে সামনের ছাদ থেকে একটা খুবই চিড়ধরার চিহ্ন দেওয়াল বেয়ে নেমে গিয়ে আরও এগোতে এগোতে হ্রদের স্বচ্ছ পানিতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ব্যস, এ পর্যন্তই।

চারদিকের দৃশ্যের ওপরে চোখ বুলাতে বুলাতে পাকা রাস্তাটা পেরিয়ে বাড়িটার সদর দরজায় হাজির হলাম।

চাকর দরজায়ই অপেক্ষা করছিল। আমাকে দেখেই ব্যস্ত-পায়ে এগিয়ে এসে ঘোড়ার লাগামটা হাতে ধরেনিল।

আমি সদর-দরজা দিয়ে বাড়িটার ভেতরে ঢুকে গথিক রীতিতে তৈরি মিলানের তলা দিয়ে হলঘরটায় হাজির হলাম।

ঠিক তখনই খানসামা নিঃশব্দে হলঘরে ঢুকে আমাকে নিয়ে এ ঘর-ও ঘরে ফাঁক দিয়ে অন্ধকার বারবার বাঁক নেওয়া পথ ধরে মালিকের স্টুডিওর দিকে হাঁটতে লাগল। আমি তাকে অনুসরণ করে স্টুডিওর দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

পথ চলতে চলতে বাড়িটায় যা-কিছু আমার চোখে পড়ল তাতে আমার আগেকার ধারণাই অনেকাংশে বেড়ে গেল। ঘর আর বাইরের দেওয়ালের কারুকার্য, দেওয়ালে ঝুলন্ত জীর্ণ পর্দাগুলো, আবলুশ কাঠের রঙের মতো মেঝের কুচকুচে কালো রঙ, আর বিচিত্র কর্মচর্মের বিজয় স্মারকনিদর্শন প্রভৃতির সঙ্গে সেই ছেলেবেলা থেকেই আমার পরিচয়, খুব ভালোই চেনা। তবুও পরিচিত সব বস্তু আমার কল্পনায় কেমন একটা একেবারেই অপরিচয়ের রহস্যের পর্দার আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে আমার চোখের সামনে হাজির হলো যা আমার মধ্যে অন্তহীন রহস্যের সঞ্চার ঘটাল।

একটা সিঁড়ির কাছে গিয়ে একজনের ওপর চোখ পড়তেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। পারিবারিক চিকিৎসক। তার চোখের তারায় ধূর্ততা আর বিমূতার মিশ্র অনুভূতির ছাপটুকু আমার নজর এড়াল না।

চিকিৎসক ভদ্রলোক আমাকে দেখেই ভয়ে ভয়ে অভিবাদন জ্ঞাপন করে লম্বা-লম্বা পায়ে সেখান থেকে কেটে পড়লেন। আমি সবিস্ময়ে তাঁর ফেলে-যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

আমার পথপ্রদর্শক খানসামাটা এবার আরও কয়েক পা এগিয়ে একেবারে মালিকের টেবিলের সামনে হাজির করল।

ঘণ্টা বেশ বড়সড়, ছাদও খুবই উঁচু। জালাগুলো লম্বা হলেও তুলনামূলকভাবে চওড়া কম।

ওক কাঠের ঘন কালো মেঝে থেকে জানালাগুলোর উচ্চতা এতই বেশি যে ভেতরের মেঝে থেকে সেখানে ওঠা কিছুতেই সম্ভব নয়।

জানালাগুলোর জাফরি কাটা কাঁচ ভেদ করে দিনের শেষের রক্তিম ঘরে ঢুকে এক মনোরম দৃশ্যের সঞ্চার করেছে।

আলোর ছোঁয়া পাওয়ার ঘরের ভেতরের সবকিছু দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও আমি ঘরটার কোনোগুলো আর খিলান দেখতে পেলাম না। ব্যাপারটা আমাকে যার পর নাই অবাক করল।

ঘরে আসবাবপত্রের সংখ্যা যথেষ্টই। তবে সবই সাবেকি আমলের। জীর্ণ দশা সবই প্রায় ভাঙাচোরা। তবে সেগুলো খুবই আরামদায়ক স্বীকার করতেই হবে। আর ঘরের এখানে-ওখানে বহু বইপত্র আর ছোট বড় ও হরেক আকৃতি বিশিষ্ট বাদ্যযন্ত্র ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে। যত্নের অভাবে সেগুলোর যে কী হাল হয়েছে ভাষার প্রকাশ করা অসাধ্য!

ঘরটার ভেতরের সবকিছুর ওপর চোখ বুলিয়ে নেওয়ার পর আমার স্পষ্ট মনে হল, আমি যেন এক বিষাদপূর্ণ পরিবেশে অবস্থান করছি। আর সে বিষণ্ণতা কঠিন আর রূঢ় বাস্তবে ভরপুর।

আমার বাল্যবন্ধু আশার কে একটা সোফার ওপর পা ছড়িয়ে আয়েস করে শুয়ে থাকতে দেখলাম।

আমাকে দরজায় দেখেই সে যন্ত্রচালিতের মতো দ্রুত সোফার আশ্রয় ছেড়ে উঠে বসে পড়ল। ঠিক একইরকম ব্যস্ততার সঙ্গে সোফা থেকে নেমে দরজায় এগিয়ে এসে আমাকে অভ্যর্থনা করে ভেতরে নিয়ে গেল। তার অভ্যর্থনা ও আপ্যায়নের মধ্যে আমি এত বেশি বাড়াবাড়ি লক্ষ্য করলাম যাতে পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে নিতান্ত অসঙ্গত মনে হল।

তবে মুখ তুলে তার চোখ মুখের দিকে দৃষ্টি পাত করতেই আমার বিস্ময়টুকু উঠে গেল। নিঃসন্দেহ হলাম, তার আচরণের মধ্যে কোনোরকম খাদ তো নেই-ই বরং আন্তরিকতায় ভরপুর।

আমরা এগিয়ে গিয়ে সোফার ওপারে উভয়ে পাশাপাশি বসলাম।

আমি আসন গ্রহণ করার পর কয়েক মুহূর্ত সে টু-শব্দটিও করল না। ভালো-মন্দ কোনো কথাই তার মুখ দিয়ে বের হলো না। তার নীরব মূর্তির দিকে চোখ পড়তেই অর্ধেক ঘৃণা আর অর্ধেক করুণায় আমার বুকটা কানায় কানায় ভরে উঠল।

রডেরিক আশারের আগে আর কেউ-ই কখন এমত অত্যল্পকালের মধ্যে এমন ভয়ঙ্করও অভাবনীয় পরিবর্তনের শিকার হয়ে মানসিক যন্ত্রণার শিকার হয়নি বলে জানা যায়।

আমি বহু চেষ্টা করে আমার মনের দ্বিধাটুকু দৃঢ় করে বোঝাতে পারলাম, আমার মুখোমুখি বসে থাকা লোকটা আমার বাল্যবন্ধু। এক সময় গভীর হৃদ্যসম্বন্ধ ছিল আমাদের উভয়ের মধ্যে।

তবে একটা কথা, তার মুখের আদল সেই ছেলেবেলা থেকেই খুবই উল্লেখযোগ্য। চোখ দুটো ছিল বেশ বড় বড় ও গোলাকার, চোখের তারা দুটো অত্যুজ্জ্বল, চকচকে, মুখটা ফ্যাকাশে বিবর্ণ। আর ঠোঁট দুটো যেন রক্তহীন, ফ্যাকাশে ও পাতলা। ঠোঁটের বাকাটা কিন্তু বড়ই দৃষ্টিনন্দন ছিল–একেবারেই অতুলনীয় নাকটার গড়ন হিব্রুদের মতোই সুন্দর। সুঢৌল থুতনিটা তার আর্থিক অভাব অনটনের লক্ষণ প্রকাশ করত। তার সে মুখটা যেন আজও আমার চোখের সামনে ভাসছে। আর তার আজকের মুখটা। সেদিনে সে আকর্ষণীয় মুখটার সঙ্গে তার আজকের মুখটার সামান্যতম সাদৃশ্যও নেই। আজ এতদিন পর তার মুখোমুখি বসে তার মুখটার ওপরে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে আমি ভাবছি, আমার সামনে এটা কার মুখ? আমি কার সঙ্গেই বা কথা বলছি।

তার চেহারার আর সবকিছু ছেড়ে দিয়েও তার গায়ের বর্তমান চামড়ার অস্বাভাবিক, ভৌতিক পাতা আর চোখের তারা দুটোত অলৌকিক উজ্জ্বলতা আমাকে যারপর নাই হকচকিয়ে দিল। শুধু কি এই? আমি ভয়ে মূচ্ছা যাবার উপক্রম হলাম।

আর তার মাথার রেশমের মতো মিহি আর মোলায়েম চুলগুলো দীর্ঘ অবহেলা অবজ্ঞায় ঘাঢ় ছড়িয়ে পিঠ পর্যন্ত ঝুলে পড়েছে। আর ছোট ছোট কিছু চুল বাতাসে এলোমেলোভাবে মুখের ওপর ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে অস্বাভাবিক দোল খাচ্ছে।

আমি অপলক চোখে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে অনেক চেষ্টা করেও তার মুখের আবরণ সুলভ কারুকার্যকে কিছুতেই একটা সহজ সরল প্রকৃতির মানুষের মুখের। সঙ্গে মেলাতে পারলাম না। বার বার চেষ্টা করেও আমাকে হতাশই হতে হল। শেষপর্যন্ত ব্যর্থ প্রয়াস থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে অন্যদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম।

আমি বন্ধুর সান্নিধ্যে আছি বটে, কিন্তু তার প্রতিমুহূর্তের চালচলন আর কথাবার্তায় কেমন যেন লক্ষ্য করার মতো অসংলগ্নতা, অস্বাভাবিক রকম অসামঞ্জস্য বিরাজ করতে দেখলাম।

আমি কৌতূহল মিশ্রিত আতঙ্কের সঙ্গে তার প্রতিটা মুহূর্ত লক্ষ্য করে বুঝতে পারলাম তার মধ্যে একটা অভ্যাসগত কাঁপুনি ক্রিয়া করে চলেছে। স্নাবিক একটা উত্তেজনাকে জয় করার ব্যর্থ প্রচেষ্টার ফলেই তার মধ্যে এমন কাণ্ডের প্রকাশ ঘটছে।

তবে এও সত্যি যে, তার চিঠি পাওয়ার পর এরকমই কোনো অদ্ভুত পরিস্থিতি মুখোমুখি হওয়ার জন্য আমি তৈরি হয়ে তবেই পা-বাড়িয়েছি আর আমি এও লক্ষ্য করলাম। তার যাবতীয় আচরণ আর কাজকর্ম ছিল ফুর্তিতে উজ্জ্বল, আবার পরমুহূর্তেই বিষণ্ণতায় ভরপুর-পাত্র। তার কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন ঘটেছে অস্বাভাবিক দ্রুত, আর অস্থিরতার জন্যই অভাবনীয় কাঁপা কাঁপা।

তার মধ্যে যখন তীব্র উত্তেজনা ভর করে তখন মনে হয় সে বুঝি নেশার ঘোরে রীতিমত ঝুঁদ হয়ে রয়েছে, আফিমখোররা মাত্রাতিরিক্ত আফিম সেবন করে বুঝি এমন বেসামাল হয়ে পড়ে।

আমি তার মুখোমুখি বসে পরিস্থিতিটা সম্বন্ধে কিছু ধারণা করে নেবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি ঠিক তখনই সে একই ভঙ্গিতে অনর্গল বলে যেতে লাগল, যে কেন পত্র মারফৎ আমাকে এখানে আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছে। সে নিজের উদ্দেশ্যের কথা আমার কাছে ব্যক্ত করতে গিয়ে বলল–‘বন্ধু, তোমাকে একবারটি চোখে দেখার জন্য বড়ই আগ্রহ–চিত্তচঞ্চল বোধ করছিলাম। কথাটা বলেই সে এক-এক করে বলে যেতে লাগল, আমার কাছ থেকে সে কতখানি সান্ত্বনা প্রত্যাশা করে।

মুহূর্তের জন্য নীরব থেকে আমার মুখের ছাপ কতটুকু বদলে যায়, তার বক্তব্যকে আমি কিভাবে নিচ্ছি বোঝার চেষ্টা করে নিয়ে তারপর নিজের ব্যাধির কথা খোলসভাবে আমার কাছে বলল।

আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে তার মুখের দিকে তাকালে সে আবার মুখ খুলল–‘শোন বন্ধু, এটা আমাদের পারিবারিক ব্যাধি। বংশ পরম্পরায় আমাদের এ ব্যাধির শিকার হতে হয়। মৃত্যুও হয় এ ব্যাধির কল্যাণে।

তিনি বিষণ্ণ কণ্ঠে, প্রায় অস্ফুট উচ্চারণ করল–‘তাই বুঝি?’

‘হ্যাঁ, ঠিক তাই। এ ব্যাধির কবল থেকে অব্যাহতি বা নিরাময়ের সামান্যতম আশাও নেই বন্ধু।

পর মুহূর্তেই আবার বলল–‘তোমাকে বলা হয়নি, রোগটা আসলে স্নায়ুবিক। শীঘ্রই সেরে উঠব।

তার কথায় বুঝলাম, ইন্দ্রিয়গুলোর মাত্রাতিরিক্ত তীক্ষ্ণতার জন্যই সে ভুগছে। সব খাবার তার শরীর বরদাস্ত করতে পারে না। কেবলমাত্র স্বাদহীন খাদ্যবস্তুই সে সহ্য করতে সক্ষম। আর পোশাক পরিচ্ছদের ব্যাপারেও বাধানিষেধ রয়েছে। কেবলমাত্র বিশেষ প্রকার হাতের তাঁতে বোনা কাপড়ের পোষাকই ব্যবহার করতে পারে। আরও আছে। যাবতীয় গন্ধদ্রব্য তাকে যারপর নাই কষ্ট দেয়। আলোক রশ্মি তার কাছে বড় পীড়াদায়ক। এমনকি মৃদু আলোও তার চোখ দুটো বরদাস্ত করতে পারে না। কিছু সংখ্যক বিশেষ ধরনের শব্দ এবং তার নিজের যন্ত্রর বাজনা ছাড়া অন্য যে কোনো শব্দ তাকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তোলে, আতঙ্কে সে কুঁকড়ে যায়।

আমি তার ব্যাপার স্যাপারের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রেখে এ সত্যই উপলব্ধি করতে পারলাম, সে যেন এক বিশেষ আতঙ্কের কবলে নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দিয়েছে।

আমি তার শারীরিক ও মানসিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে যাব, কিন্তু আমাকে সে সুযোগ না দিয়েই সে-ই আবার চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ এঁকে বলল–জান বন্ধু, আমি মরে যাব! মরেই যাব। এ শোচনীয় বোকামিই আমার অনিবার্য মৃত্যু ঘটাবে।

আমি তাকে প্রবোধ দিতে গিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করতেই সে-ই আবার বলল– ‘হ্যাঁ, আমি মরেই যাব। এ ভাবেই হ্যাঁ, ঠিক এভাবেই। অন্য কোনো ভাবে অবশ্যই নয়। তাদের ফলাফলকে নিয়ে আমার যত ভয়, যত আতঙ্ক। আমার মনের ও অসহনীয় ক্ষোভের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারার মতো কোনো ঘটনাই কেবল নয়, অতি সামান্য কোনো ঘটনার কথা আমার মনের ওপর উঁকি দেওয়ামাত্র আমি আতঙ্কে চমকে উঠি, একেবারে কুঁকড়ে যাই।

মুহূর্ত কাল নীরবতার মধ্য দিয়ে সে লক্ষ্য করল, তার কথাগুলোকে আমি কিভাবে নিচ্ছি। তা বোঝার চেষ্টা করে সে আবার মুখ খুলল–‘হ্যাঁ বন্ধু, যে কোনো ঘটনা, তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনা আমার মনের কোণে উঁকি দিতেই আমার অন্তরাত্মা যেন শুকিয়ে একেবারে কাঠ হয়ে যায়। একটা কথা কি জানো, সঙ্কটাপন্ন পরিস্থিতিতে আমি অবজ্ঞার চোখে দেখি না, একমাত্র ভয়কেই আমি দারুণ ঘৃণা করি।

আমার ভয়ঙ্কর স্নায়বিক পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে, আজ বা কাল যেদিনই হোক এক নির্মম অপচ্ছায়া যাকে লোকে আতঙ্ক আখ্যা দিয়ে থাকে, তার সঙ্গে লড়াই চালাতে চালাতেই জীবন আর যুক্তি-বুদ্ধির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যেতেই হবে। মোদ্দা কথা, আতঙ্কই আমাকে চরম পরিণতির মুখে ঠেলে দেবে, বুঝলে?

আমি তার কথার কি উত্তর দেব ভেবে না পেয়ে নীরব চাহনি মেলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম।

আমি তার প্রতিটা কথা, প্রতিটা মুহূর্তের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখতে লাগলাম। তার উক্ত কথাবার্তা ছাড়াও আমি তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে, টুকরো টুকরো আকার ইঙ্গিত থেকে তার মানসিক পরিস্থিতির আর একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে ধারণা করে নিতে পারলাম। সে যে বাড়িটায় বাস করছে দীর্ঘ দিনের মধ্যে সে বাড়ির বাইরে আসেনি সে পারিবারিক প্রাসাদোপম বাড়িটাই দিনের পর দিন বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন আকারে তার মনের ওপর নিজের অশুভ ছায়াপাত করেছে। এ জীর্ণ বাড়িটার ধূসর দেওয়ালগুলো, সারিবদ্ধ গম্বুজ আর ছায়া-ছায়া হ্রদটার স্থির জলে তাদের প্রতিচ্ছবি! এ সবই শেষপর্যন্ত তাকে বিপর্যস্ত, সম্পূর্ণরূপে বিপন্ন করে তুলেছে। আজ সে চরম পরিস্থিতির মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে।

তবে সহজে না হলেও, দীর্ঘ ইতস্ততের পরই সে এ-কথাটাও মেনে নিয়েছে, তার এ অদ্ভুত বিষণ্ণতার পিছনে আরও একটা স্বাভাবিক ও সহজবোধ্য কারণ রয়েছে।

আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকালাম। আমার জিজ্ঞাসা দূর করতে গিয়ে সে এবার যা বলল–‘কি সে কারণ, এটাই তোমার জিজ্ঞাস্য? সে কারণটা হচ্ছে, আমার বোন, বড় স্নেহের বোন, আমার বহু বছরের একমাত্র সাক্ষী। এ পৃথিবীতে আমার সর্বশেষ আর একমাত্র আত্মীয়ার বহুদিন ধরে কঠিন ব্যাধি, মৃত্যু, হ্যাঁ, মৃত্যুর মধ্য দিয়েই তার অনিবার্য অন্তিম পরিণতি।

যে বিষণ্ণতার কথাটা সে আমার দিকে ছুঁড়ে দিল তা কোনোদিনই আমার মন থেকে মুছে যাবে না।

সে এবার একই রকম তিক্ততার সঙ্গে বলল–‘তার বিচ্ছেদ, তার মৃত্যু সুপ্রাচীন আশার বংশের সর্বশেষ বংশধর করে আমাকে রেখে যাবে।

ম্যাডেলিন তার বোনের নাম। লেডি ম্যাডেলিন নামেই সে পরিচিত। আমার বন্ধুবর যখন আমার কাছে কথাগুলো বলতে লাগল তখন লেডি ম্যাডেলিন ঘরটার এক প্রান্তে গুটি গুটি পায়ে হাঁটতে লাগল। সে ঘরে আমার উপস্থিতি লক্ষ্য না করেই সে ধীরে-মন্থর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে দৃষ্টির একেবারে বাইরে চলে যায়।

তাকে দেখামাত্রই আমার ভেতরে দেখা দিল আতঙ্ক মিশ্রিত অসীম বিস্ময়। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, তার কোনো কারণই আমার মাথায় এলো না।

আর তার ক্রমে দূরে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া পা দুটোর দিকে চোখ পড়তেই আমার মন কেমন একটা অবর্ণনীয় ঘোর নেমে এলো। আমি যে কেমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলাম তা নিজেই বুঝে উঠতে পারলাম না। অন্যকে কি বুঝাব?

শেষপর্যন্ত কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ঘরের দরজাটা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেলেই আমার চোখ দুটো যন্ত্রচালিতের মতো তার ভাইয়ের মুখের ওপর গিয়ে পড়ল। কিন্তু ইতিমধ্যেই সে হাত দুটো দিয়েনিজর মুখটাকে ঢেকে ফেলেছে।

আমি তার মুখটা দেখতে পেলাম না। কেবলমাত্র এটুকুই লক্ষ্য করলাম, তার যারপরনাই ক্লান্ত, ফ্যাকাশে বিবর্ণ কাঁপা-কাঁপা শীর্ণ আঙুলগুলোর ফাঁক দিয়ে অনেক ব্যথা-বেদনার অশ্রু ফোঁটা ফোঁটা করে ঝরে পড়ে মেঝেটাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে।

অভিজ্ঞ চিকিৎসকরা লেডি ম্যাডেলিনের রোগের উপশম ও তার রোগমুক্তি ঘটাতে দীর্ঘদিন যাবৎ বৃথাই কঠিন কঠোর পরিশ্রম করেছেন।

সে ক্রমেই শীর্ণ থেকে শীর্ণতর হয়ে পড়তে লাগল আর সে সঙ্গে শক্তি সামর্থ্য হারিয়ে একেবারেই কাহিল হয়ে পড়ল। এতদিন ধরে সে যে রীতিমত দৃঢ়তার সঙ্গেই কঠিন ব্যাধির যাবতীয় বোঝা বহন করে বেরিয়েছে, প্রাণপনে লড়াই করেছে–ভুলেও কোনোদিন বিছানা আশ্রয় নেয়নি।

কিন্তু সে প্রাসাদোপম জীর্ণ বাড়িটায় আমার উপস্থিত হওয়ার প্রথম দিনই সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, অন্ধকারে সবকিছু তলিয়ে গেলে সে সবটুকু শক্তি নিয়োগ করে আত্মনিবেদন করে দিল। তার ভাই সে রাতেই অন্তহীন দুঃখের মধ্যে আমার কাছে কথাটা ব্যক্ত করেছিল। তার মুখ থেকে শোনা বিবরণটুকু ছাড়াও আমি জানতে পেরেছিলাম, সেদিন মুহূর্তের জন্য তাকে সে আমি দেখার সৌভাগ্য লাভ করেছিলাম, সেটাই তাকে আমার প্রথম দেখা, আর যা-ই হোক, অন্তত জীবিত অবস্থায় তাকে আর আমার পক্ষে দেখা সম্ভব হবে না, কোনোদিনই না।

সে ঘটনার পর এক-এক করে বেশ কয়েকটা দিন পার হয়ে গেল। আমার বন্ধুবর আশার বা আমি তার সম্বন্ধে আলোচনা করা তো দূরের ব্যাপার, তার নামটাও মুখে উচ্চারণ করলাম না।

আমি বন্ধু আশার-এর মন থেকে দুঃখের বোঝাটিকে লাঘব করতে না পারলেও কিছুটা অন্তত হালকা করার জন্য নিজেকে লিপ্ত রাখলাম।

আমার বন্ধুর মনকে একটু আধটু চাঙা করে রাখার উদ্দেশ্যে কখনও তাকে নিয়ে ছবি আঁকতে বসি, আবার কখনও বা পাশাপাশি বসে পুঁথিপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করি। আবার এমনও করি যে গিটারে মনগড়া সুরের মূৰ্ছনা তুলে আর আমি চোখ বুজে তন্ময় হয়ে শুনি।

এভাবে ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যের মধ্য দিয়ে আমাদের আন্তরিকতা ক্রমে ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হয়ে উঠতে লাগল। আর সে-ও আমার কাছেই একটু-একটু করে এমন সহজ হয়ে উঠতে লাগল যে তার মনের জানালাগুলো এক এক করে আমার কাছে খুলে দিতে লাগল। আমার কাছে কোনো কথা ব্যক্ত করতে তিলমাত্র দ্বিধাও সে করে না।

আর আমি তার বেদনাভরা মনের দীর্ঘশ্বাসের মধ্য দিয়ে ক্রমেই বেশি করে উপলব্ধি করতে লাগলাম যে, এমন প্রাণকে আনন্দ ফুর্তিতে ভরপুর করে তোলার যাবতীয় প্রয়াসই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য। এর কারণ, বুকের অন্ধকার কন্দর থেকে উৎসারিত অন্তহীন এক বিষণ্ণতার স্রোত তার দৈহিক ও দেহের বাইরের বিশাল জগৎকে চিরদিনের মতো হতাশার পর্দা দিয়ে আবৃত করে দিয়েছে। অন্ধকার, চরমতম নৈরাশ্যের সাগরেনিমজ্জিত হয়ে সে এখন হাবুডুবু খেয়ে চলেছে।

‘আশার আলয়’-এর মালিকের সঙ্গে এভাবে একা যে নিরানন্দময় মুহূর্তগুলো অতিবাহিত করছিলাম, সে গভীর স্মৃতি আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে চির জাগরুক রাখব। ইচ্ছা করলেও আমি অবশ্যই তাকে অন্তর থেকে মুছে ফেলতে পারব না।

কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, সে স্মৃতির যর্থাথ রূপটা কোনোদিনই আমি উদ্ধার করতে পারব না। ফলে কারো কাছেই প্রকাশ করা সম্ভব হবে না।

অথচ সত্যি কথা বলতে কি, আমার মধ্যে সম্পূর্ণ নিরাকার একটা ধারণা যেন সবকিছুর ওপর গন্ধকের আলোকশিখা ছড়িয়ে দিয়েছে। তার দীর্ঘ কাল্পনিক বিষণ্ণ নীতিগুলো চিরটাকাল ধরে আমার কর্ণকুহরে গুনগুন স্বরে বেজে বিষ-জ্বালায় জর্জরিত করবে।

অন্যান্য অনেক কিছুর সঙ্গে একান্ত দুঃখ-বিষাদেই অন্তরের গোপন করে তার ইচ্ছানুযায়ী রূপ দেওয়া ভন বেবার-এর দ্বৈত নৃত্যের বিকৃত আর বাড়িয়ে বাড়িয়ে রূপদান করা মাধুর্যকে সযত্নে পুষে রেখেছি।

আমি অত্যন্ত মনযোগের সঙ্গে লক্ষ্য করে উপলব্ধি করেছি, রঙ-তুলির মাধ্যমে ক্যানভাসের গায়ে মনোলোভা ছবি ফুটিয়ে তুলতে গিয়েই তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি উন্মাদনা-উদ্দামতা প্রকাশ পেত। তুলির সাহায্যে রঙের ওপর রঙের পোচ দিতে দিতে এক সময় তার ছবিটা কোনো এক অস্পষ্টতার জগতে উন্নীত হয়ে যায়। আর চোখের সামনে সেটাকে প্রত্যক্ষ করার ফলে উত্তেজনায় আমার মধ্যে অবর্ণনীয় কম্পনের উদ্ভব হত।

আমার বন্ধুবরের সহজ-সরল মানসিকতা আর খোলামেলা পরিকল্পনার ফলেই আমার মন অল্পতেই আকৃষ্ট হয়। কেউ যদি কোনোদিন তুলির টানে ভাবনার ছবি ফুটিয়ে তোলে তবে মনে করতে হবে সে অবশ্যই রডেরিক আশার ছাড়া কেউ নয়।

এবার আমি তার এ অদ্ভুত মানসিকতার ছোট দুটো নজির তুলে ধরছি। ছোট একটা ছবিতে একটা চৌকো মাটির তলায় ঘর দেখানো হয়েছে, সুড়ঙ্গের ভেতরের অংশটাও হতে পারে। তারনিচু-নিচু দেওয়ালগুলো খুবই তেলতেলে। রঙ সাদা আর কারুকার্যবিহীন। অনুসন্ধিৎসু নজরে দৃষ্টিপাত করলে এসব স্পষ্ট নজরে পড়ে। শুধু কি এ-ই! রঙ আর তুলির আঁচড়ে খুব চমৎকারভাবেই বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, পৃথিবীর সমতল ক্ষেত্র থেকে অনেক, অনেক গভীরে মনন কাৰ্যটা চালানো হয়েছে।

আলো-বাতাস ঢোকার উপযোগি কোথাও কোনো ফাঁক বা গর্ত করা নেই, আবার কোনো কৃত্রিম আলো, এমনকি মশালের ব্যবহারও নেই। তবুও একটা আলোকচ্ছটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে সম্পূর্ণ অঞ্চলটাকেই আলোকিত করে দিয়েছে। আরও স্পষ্ট করে বললে, একটা ভৌতিক আলো, একটা অনুপযোগি উজ্জ্বলতা যেন সবকিছুকেই তলিয়ে দিয়েছে।

তার এ কল্পনাশক্তিকে অসংযত ছাড়া অন্য কোনো আখ্যা দেওয়া যায় বলে জানা নেই। তার এরকম কল্পনাশক্তি প্রকাশের ব্যাপারেও কম প্রকটিত নয়, ভাবা যেতে পারে। তার ঠিক এমনই উদ্দাম ও অসংযত রচনার কথা আজও আমার স্মৃতির পাতায় গাঁথা রয়েছে।

কেন আজও আমি মনের গোপন কন্দর থেকে তার সে রচনাটা ধুয়ে মুছে ফেলতে পারিনি, তাই না? সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, তার রচিত কবিতা মাত্র একবার পাঠ করেই আমি অনুধাবন করে নিয়েছিলাম যে, তার মেধাশক্তি যে নিজের সিংহাসনের ওপরেই হুমড়ি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে–সে ব্যাপারে আমার বন্ধুবর আশারের পরিপূর্ণ চিন্তাধারা সেখানেই স্পষ্ট হয়ে উঠে, ধরা পড়ে। আর কবিতাটার শিরোনাম দেওয়া হয়েছিল ভুতুড়ে অট্টালিকা। আর তার বক্তব্য মোটামুটি এরকম–

পরীরা দল বেঁধে আমাদের সবুজ উপত্যকায় বাস করত। একদিন সেখানে গড়ে তোলা হলো আকাশচুম্বী সুদৃশ রাজপ্রাসাদ। তার অবস্থিতি হলো চিন্তা-মহারাজার রাজ্যে। এমন নির্মল মনোলোভা আকাশে কোনো দেবদূতই কোনোদিন মেলেনি।

প্রাসাদটার শীর্ষদেশে হলুদ, সোনালি আর অত্যুজ্জ্বল পতাকাগুলো বাতাসে অনবরত উড়ে বেড়াত। প্রাচীনকালের বহু যুগ পূর্বের এ কাহিনী। সে মনোরম দিনগুলোতে মৃদুমন্দ বাতাস যখন ধূসর সুউচ্চ প্রাচীরের গা বেয়ে প্রবাহিত হত তখন সুমিষ্ট একটা বাতাস যেন পাখায় ভর দিয়ে দূর থেকে দূরান্তের উদ্দেশে নেচে নেচে হেলে দুলে পাড়ি জমাত।

সে সুখদায়ক উপত্যকার পথ ধরে যেসব পথিক আসত, তারা আলোকিত দুটো খোলা জানালা দিয়ে পরীর দলকে দেখত, বাঁশির সুরের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে মনোরম ভঙ্গিতে নাচছে। আর তারা নাচছে পাথরের মূর্তির মতোই নিশ্চল-নিথরভাবে। সে রাজ্যের রাজা ঝলমলে পোশাক পরে সিংহাসন আগলে বসে রয়েছেন।

সুসজ্জিত ও সুদৃশ্য সে রাজপ্রাসাদের প্রতিটা দরজায় মণিমুক্ত সর্বদা দ্যুতি ছড়াত, ঝলমল করত।

আর যে রাজপথ দিয়ে সুসজ্জিত সৈন্যদের প্রতিধ্বনিতে আকাশ মুখরিত হয়ে উঠত। আর হবে না-ই বা কেন? গান গাওয়াই যে তাদের এক কাজ। কিন্তু তারা কি গায়, কোন গানে মাতোয়ারা হয়ে থাকে, দেশের রাজার অনন্য বুদ্ধিমত্তা আর অফুরন্ত জ্ঞানের কথা গানের কলির মাধ্যমে তারা তুলে ধরত।

কিন্তু সুদিনের হাসি-আনন্দ উঠে গিয়ে রাজ্য জুড়ে নেমে এলো দুঃসময়। দুঃখ দুর্দশার রূপ ধরে দুর্দিন এলো। রাজা মশাইয়ের রাজ্য আক্রান্ত হল। হায়! এসো আমরা এ অভাবনীয় দুঃসময়ের জন্য শোক প্রকাশ করি। কেন? কারণ তাঁর নিঃসঙ্গ জীবন আর কোনোদিনই নতুন প্রভাতের আলোকচ্ছটায় উদ্ভাসিত হবে না।

তার প্রাসাদটাকে ঘিরে যে গৌরবের ফুলগুলো ফুটে থাকত আজ তা নিছকই স্মৃতিতে পরিণত হয়েছে। আর আজ সেটা মহাকালের সমাধিতে সমাহিত হয়ে নজরের আড়ালে চলে গেছে।

যে সব পথিক সে উপত্যকায় এখন অবস্থান করছে তারা রঙিন খোলা-জানালা দিয়ে দেখছে, বিচিত্র বেসুরো বাজনার তালের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে অতিকায় সব মূর্তি নিরবচ্ছিন্নভাবে নেচে চলেছে। আর? হ্যাঁ, আরও আছে বিষণ্ণ খোলা-দরজা দিয়ে অধিকতর কদাকার একেবারেই বীভৎস সব মানুষ দল বেঁধে উত্তাল উদ্দাম আর দ্রুতগামী নদীর মতো ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে। তাদের মুখে সরব হাসি, অট্টহাসিতে তারা ফেঁটে পড়ার জোগার। তবে এও খুবই সত্য যে, তাদের মুখে আর কোনোদিন মিষ্টি মধুর হাসির রেখা দেখা যাবে না কোনোদিনই না।

বন্ধুবর আশার এক সন্ধ্যায় একেবারেই আচমকা আমাকে লেডি ম্যাডেলিনের মৃত্যু সংবাদ দিল। আর সে সঙ্গে আমার কাছে প্রস্তাব রাখল, তার মৃতদেহটা এক পক্ষ কালের জন্য তাদের প্রাসাদের প্রধান প্রাচীরটার ভেতরের অগণিত মাটির তলার কামরাগুলোর মধ্যে একটাতে সাময়িকভাবে রেখে দেওয়া হবে।

তার কথাটা আমার কাছে কেমন যেন অস্বাভাবিকই মনে হল। তবুও কি-ই বা। বলব ভেবে না পেয়ে বিষণ্ণ মুখে তার দিকে নীরবে তাকিয়ে থাকলাম।

সে-ই আবার বলতে লাগল। তবে গৃহীত এ বিশেষ ব্যবস্থাটার সমর্থনে সে যে পার্থিব যুক্তির অবতারণা করল, আমি ইচ্ছে করেই তার বিরুদ্ধে কিছু বলিনি, এতটুকুও প্রতিবাদ করিনি।

আপত্তি তো করিনি বরং বন্ধুর অনুরোধে লেডি ম্যাডেলিনের মৃতদেহের এ সাময়িক সমাধি-কাজে তাকে সাধ্যমত সাহায্য সহযোগিতাই করেছি।

মৃতদেহটাকে কফিনের ভেতরে রেখে আমরা উভয়ে মিলে ধরাধরি করে সমাধিস্থলে নিয়ে গেলাম। মাটির তলার যে কামরাটায় সেটাকে রাখা হলো সেটা খুবই ছোট। তারপর সেটা একেবারে সঁতসেঁতে ও আলো ঢোকার মতো কোনো পথই নেই।

প্রাসাদটার যে অংশে আমার শোবার জায়গা তারই ঠিক নিচে, অনেক তলায় সে কামরাটা। এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, বহুকাল আগে সামন্ততন্ত্রের আমলে এ কামরাটাকে বিপদের মুহূর্তে আশ্রয় নেবার কাজে ব্যবহার করা হত। একবার কোনোরকমে সেখানে আশ্রয় নিতে পারলে তার হদিস পাওয়া কিছুতেই সম্ভব ছিল না।

এর পরবর্তীকালে গোলা-বারুদ এবং অন্যান্য দাহ্য পদার্থের গুদামঘর হিসেবে এ কামরাটাকে ব্যবহার করা হত। আর এজন্যই কামরাটার অংশ বিশেষ আর সুড়ঙ্গ পথটার আগাগোড়া তামার পাত দিয়ে মুড়ে দেওয়া হয়েছে। আর দরজাটাকে তৈরি করা হয়েছে পেটা লোহার পাত দিয়ে, কামরাটাকে অধিকতর সুরক্ষিত করা হয়েছে।

পেটা লোহার দরজাটা এতই মজবুত আর ভারী যে, হাঁসকলের ওপর তার পাল্লাটাকে ঘুরিয়ে খোলা বা বন্ধ করার সময় বিশ্রি ধাতুর ক্যাচু ক্যাম্ আওয়াজ করে। আর টানাটানি করতে দম বেরিয়ে যাবার জোগাড় হত।

আমাদের শোক দুঃখের বোঝা কফিনটাকে সে ভয়-ভীতির রাজ্যে নামিয়ে রেখে তার-ঢাকনাটাকে সামান্য খুললাম। এবার মৃতার মুখের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম।

অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি মেলে তার মুখটাকে বার বার দেখে ভাই-বোনের মুখের আদলের অস্বাভাবিক মিল খুঁজে পেলাম। আর এদিকে এবারই প্রথম আমার নজর পড়ল। আর আমার তখনকার মানসিক পরিস্থিতিটার কথা ভেবেই হয়তো বন্ধু আশার আমার আসাকে লক্ষ্য করে এমনকিছু বক্তব্য রাখল, যা আমি ইতিপূর্বে শোনা তো দুরের ব্যাপার স্বপ্নেও ভাবিনি। সে বলল, মৃতার মুখে তার মুখের ছাপ খুঁজে পাওয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কারণ তারা দুজন ছিল যমজ ভাই-বোন। আর দুজনের একজনের প্রভাব অন্যের মধ্যেও পড়ত। এ দুর্বোধ্য প্রকৃতির প্রভাব শেষপর্যন্তই লক্ষিত হয়েছে।

তবে এও সত্য যে, মৃতার মুখের দিকে দীর্ঘ সময় দৃষ্টিকে আবদ্ধ রাখা আমাদের পক্ষে সম্ভব হলো না। সত্য গোপন না করলে বলতেই হয়, কেমন যেন একটা ভয় ভীতির অনুভূতি আমাদের মনকে ক্রমেই দুর্বল করে দিতে লাগল।

সে ভয়ঙ্কর ব্যাধি ভরা যৌবনকালেই হতভাগিনীকে নিষ্ঠুর সমাধিক্ষেত্রে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে। তার স্বাভাবিক ফলস্বরূপই তার মুখ ও বুকে রক্তিম এক আভা প্রকাশ পেয়েছে। আরও আছে, তার ঠোঁট দুটোতে এমন একটা ভয়ঙ্কর রহস্যময় হাসির প্রলেপ ছড়িয়ে পড়েছে যাতে মৃতার মুখর মুখটাকে অধিকতর ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। মুহূর্তের জন্য সে দিকে তাকালেই আতঙ্কে বুকের মধ্যে ধড়াস্ করে ওঠে, শরীরের রক্ত হিম হয়ে আসতে চায়।

আমরা ব্যস্ত-হাতে ঢাকনাটাকে কফিনের ওপর নামিয়ে রাখলাম। তারপর এক এক করে ভ্রু কটা লাগালাম। এবার টানাটানি করে লোহার দরজার পাল্লাটা বন্ধ করে দিলাম। এবার বহু পরিশ্রম করে বাড়ির ওপর তলায় উঠালাম। মৃতদেহসহ কফিনটা রইল আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে, অনেক নিচে।

আমরা উভয়ে অসহনীয় শোক-তাপের মধ্য দিয়ে দিন-কয়েক কাটিয়ে দিলাম।

এবার আমার বন্ধুবর আশার-এর মধ্যে মাথার দোষের কয়েকটা উল্লেখযোগ্য লক্ষণ প্রকাশ পেতে লাগল। সেগুলোর কোনোটাই আমার নজর এড়াল না। আর আমি এও লক্ষ্য করলাম, তার মধ্য থেকে স্বাভাবিক কথাবার্তা আর চালচলন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

আমি তাকে যতই দেখছি, ততই অবাক হতে লাগলাম। বন্ধুর স্বাভাবিক কাজকর্মের প্রতি দারুণভাবে অনীহা প্রকাশ পাওয়াটাও আমার নজর এড়াল না। আর ইদানিং তার সব কাজে সে কেমন ভুল করে বসছে। আরও আছে। সে লম্বা-লম্বা পায়ে, অসমানভাবে পা ফেলে ফেলে আর বিনা উদ্দেশ্যে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়।

কদিন যেতে না যেতেই তার বিবর্ণ মুখে পড়েছে আরও একটা রক্তিম আভার প্রলেপ। শুধু কি এ-ই? তার চোখের মণি দুটোর উজ্জ্বল ভাবটা উধাও হতে হতে আজ একেবারেই নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছে। আর তার কণ্ঠস্বরটাও যেন দারুণনিস্তেজ হয়ে গেছে। সে যা-ই বলে তাতেই একটা আতঙ্কের ছাপ সুস্পষ্ট। আতঙ্কে সে যেন একেবারে কুঁকড়ে যায়।

বন্ধুর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেই বারবার একই কথা আমার বুকের কন্দরে বার বার পাক খেতে থাকে, সে বুঝি কোনো একটা চাপা রহস্যকে প্রকাশ করে দেবার জন্য মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করছে। সে প্রতিনিয়ত অন্তর্জালায় পুড়ে মরছে।

আবার ব্যাপারটাকে এমনও মনে হত, আমার সব ধারণাই বুঝি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। তার চালচলন ইদানিং যা-কিছু আমার নজরে পড়ছে তা নিছকই পাগলামি, বদ্ধ পাগলের লক্ষণ। হ্যাঁ, পাগলের লক্ষণই বটে। মাঝে-মধ্যেই লক্ষ্য করেছি সে মন-প্রাণ সঁপে দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে উদাস দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু কোনো কাল্পনিক শব্দ শোনার অত্যুত্র আগ্রহেই সে যেন এমনটা করে। বন্ধুর অবস্থার ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে দেখে আমি দারুণ আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম। আমার মধ্যেও যেন কেমন অভাবনীয় একটা পরিবর্তন একটু একটু করে প্রকাশ পেতে লাগল, বুঝতে পারলাম। তবে, তবে কি তার অবস্থা আমার মধ্যেও সংক্রমিত হতে চলেছে? আমিও কি তার দলেই পৌঁছে গেছি?

আমার বন্ধুর একেবারেইনিজস্ব মনগড়া অথচ দৃঢ় লক্ষ্যণীয় কুসংস্কারগুলোর প্রভাব যেন এক-এক আমার মধ্যে প্রকাশ পেতে লাগল। আর তা নিশ্চিত হয়ে উঠতে লাগল। ব্যাপারটা এতই দৃঢ়ও নিশ্চিত যে নজরে পড়তে বাধ্য।

একটা রাতের ঘটনা বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য। মৃতা লেডি ম্যাডলিনকে ভূগর্ভস্থ আশ্রয় কক্ষে রেখে আসার পর সপ্তম-অষ্টম রাতের ঘটনার কথা বলছি। সে রাতে আহারাদি সেরে বিছানা আশ্রয় নেবার পরপরই আমার সে বিশেষ অনুভূতির পূর্ণ শক্তির অভিজ্ঞতা আমি লাভ করলাম।

ব্যাপারটা কি তাই না? বলব, সবই খোলসা করেই বলব, আর গোপনও রাখব না কিছুই। বিছানা শুয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে অনবরত পা দুটো নাচিয়েই চলেছি। কিছুতেই ঘুম আসতে চাইছে না। চোখ বন্ধ করেনিদারুণ অস্থিরতা আমার মধ্যে ভর করল। কতক্ষণ আর বিদ্রি অবস্থায় বিছানা আঁকড়ে পড়ে থাকা সম্ভব?

ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন অস্থিরতার মধ্য দিয়ে কাটিয়ে দিলাম।

আমার মধ্যে যে স্নায়বিক উত্তেজনা পাকাপাকিভাবে আশ্রয় নিয়েছে, নানা যুক্তি বুদ্ধির সাহায্যে তাকে দূরে ঠেলে দিয়ে নিজেকে হালকা করার চেষ্টা করলাম।

নানা যুক্তির অবতারণা করে নিজের মনকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, সম্পূর্ণরূপে না হলেও অন্তত আংশিক আমার এ আকস্মিক অনুভূতির কারণ এ-ঘরটার বিষণ্ণ দর্শন আসবাবপত্রের অস্বাভাবিকতার প্রভাব। চোখের পাতা মেলতে আমার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠল, বাইরে থেকে আসা ঝড়ো হাওয়ার ঝাঁপটায় দরজা-জানালার ভেঁড়া আর কালো পর্দাগুলো অবিশ্বাস্যভাবে দুলছে আর বিশ্রি রকম আওয়াজ সৃষ্টি করছে। বিছানার চারদিকের আওয়াজটা আরও বিশ্রি ও অস্বস্তিকর পৎ-পৎ ঘঘসে হয়ে উঠছে আমার বিছানাটার চারদিকে।

ক্রমেই একটা অস্বাভাবিক কাঁপুনি নিরবচ্ছিন্নভাবে আমার মধ্যে ভর করল। একেবারে অসহ্য! পরিস্থিতিটা আমাকে একেবারেই অস্থির করে তুলল। অস্থিরটা ক্রমেই বেড়ে চলল। এক সময় সেটা আমার বুকে জগদ্দল পাথরের মতো কঠিন বোঝা হয়ে চেপে বসল।

দীর্ঘ সময় ধরে নিজের মনের সঙ্গে লড়াই করে জোর করে অবাঞ্ছিত সে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিটাকে মন থেকে দূরে ঠেলে দিয়ে ঝট করে উঠে বসে পড়লাম।

বিছানায় বসে উৎকর্ণ হয়ে চার দেওয়ালে ঘেরা ঘুটঘুঁটে অন্ধকার পরিবেশটার দিকে নীরবে তাকিয়ে থাকার পর কেন বলতে পারব না–আমার ভেতর থেকে নির্দেশ পাওয়া তাগিদেই হয়–আরও বেশি মনঃসংযোগ করে উকর্ণ হয়ে লক্ষ্য করে ঝোড়ো। বাতাসটার সাময়িক বিরতির ফাঁকে ফাঁকে শুনতে পেলাম, কারো যেন নিঃশব্দে পদচারণা করার আওয়াজ। আর সেটা ধীরগতিসম্পন্ন হলেও নিরবচ্ছিন্নভাবে এগিয়ে আসছে। অস্পষ্ট সে আওয়াজটার উৎস কোথায় আমার জানা নেই।

আমি আরও কয়েক মুহূর্ত অসহ্য এবং দুর্বোধ্য আতঙ্কের তীব্র অনুভূতিতে বিপর্যস্ত হয়ে অন্ধকারে হাতড়েই আলনা থেকে পোষাক টেনে নিলাম। সাধ্যমত ব্যস্ততার সঙ্গে পোষাক বদলেই আমিনিদারুণ অস্থিরতার শিকার হয়ে ঘরময় পায়চারি করতে লাগলাম। এর উদ্দেশ্যে সে অসহ্য করুণ অবস্থাটা কাটিয়ে নিজেকে হালকা করতে পারি। অন্ধকার ঘরের মধ্যে আমি নিরবচ্ছিন্নভাবে পায়চারি করছি তো করছিই।

নিদারুণ আতঙ্ক আর নিরবচ্ছিন্ন অস্থিরতার মধ্য দিয়ে বার কয়েক পায়চারি করার পর মনে হল, সিঁড়ি থেকে যেন মৃদু পায়ের শব্দ ভেসে আসছে। মুহূর্তের জন্য উৎকর্ণ হয়ে লক্ষ্য করার পর বুঝতে পারলাম, পায়ের শব্দটা পরিচিত বন্ধু আশায় আসছে।

পর মুহূর্তেই আমার দরজায় বার কয়েক হালকা টোকা দিয়েই সে জ্বলন্ত মোমবাতি হাতে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।

আমি যন্ত্রচালিতের মতো ঘাড় ঘুরিয়ে তার মুখের দিকে তাকালাম। তার মুখটা খুবই ফ্যাকাশে বিবর্ণ দেখলাম। তবে তার দুচোখের তারায় উন্মাদ মানুষের বিশেষ ধরনের উচ্ছ্বাসটুকুও আমার নজর এড়াল না। আর এও লক্ষ্য করলাম, তার চোখ-মুখে সংযত মৃগী রোগের সুস্পষ্ট লক্ষণ। তার অভাবনীয় লক্ষণ দেখে আমার মধ্যে অবর্ণনীয় ভীতির সঞ্চার ঘটল। তবু সে অসহ্য নীরবতার মধ্যে এতক্ষণ কাটাতে হয়েছে, জোর করে সহ্য করেছি, সে তুলনায় অন্য সবকিছুই আমার কাছে বরণীয়ই মনে করলাম। আর যা-ই হোক না কেন, বন্ধুর উপস্থিতিতে আমি বড়ই স্বস্তি পেলাম। ঠিক এমনকিছুই যেন আমি প্রত্যাশা করছিলাম।

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই সে অস্থিরতার মধ্য দিয়ে ঘরটার সর্বত্র একটাবার চোখের মণি দুটোকে বুলিয়ে নিয়েই কাঁপা-কাঁপা ফাঁসফ্যাসে গলায় হঠাৎ প্রশ্ন করল– ‘তুমি, তুমি দেখনি?’

আমি হকচকিয়ে গিয়ে নীরব চাহনি মেলে ফ্যালফ্যাল করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

আমাকে নীরব দেখে সে-ই আবার মুখ খুলল–‘তুমি তবে দেখনি? কিছুই দেখনি? অপেক্ষা কর। নিশ্চয়ই দেখতে পাবে। অপেক্ষা কর।’

আশার কথা বলতে বলতে হাতের মোমবাতিটাকে আড়াল করে নিয়ে লম্বা-লম্বা পায়ে এগিয়ে গেল। ঝট করে একটা জানালা পুরোপুরি খুলে দিল। ঘরের বাইরে তখনও পুরদস্তুর ঝড়ের দাপাদাপি সমান তালেই চলেছে।

জানালাটা খুলে দিতেই প্রচণ্ড বেগে ঝড়ো হাওয়া ঘরের ভেতরে সবকিছু লণ্ডভণ্ড– আমাদের উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইল।

ঘরের বাইরে বিক্ষুব্ধ ঝড়ের দাপটে চললে রাতটা সুন্দরই বটে। ভয়ঙ্কর আতঙ্ক আর ঝড়ের উন্মাদনার অদ্ভুত বন্য বোঝাপড়া, সহাবস্থান।

পরিস্থিতিটা নিয়ে সামান্য ভাবতেই আমার মনে হল, অদূরবর্তী কোনো স্থানে ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রীভূত হয়েছে। এ রকম মনে করার কারণও রয়েছে যথেষ্টই। ঝড়ের গতি একটু পর পরই দিক পরিবর্তন করছে।

জমাটবাধা কালো মেঘ নামতে নামতে অনেকটা নিচে নেমে আসাতেও ঝড়ে সে জীবন্ত রূপ আমরা অনায়াসেই চাক্ষুষ করতে পারলাম। অথচ আকাশের গায়ে ঝুলে থাকা রূপালি চাঁদ বা অগণিত মিটমিটে তারা–কিছুই আমাদের চোখে পড়ল না। এমনকি ক্ষণিকের জন্য বিদ্যুৎও চমকায়নি যার ফলে মুহূর্তের জন্য হলেও পরিবেশটাকে আলোকিত করে তুলতে পারে। তা সত্ত্বেও কেমন যেন একটা অপ্রাকৃতিক আলোর খুবই স্লান একটা আভা প্রাসাদটার চারদিক জুড়ে রয়েছে। আশ্চর্য, ব্যাপারটা একেবারেই অবিশ্বাস্য।

আমি এগিয়ে আশারকে জানালার কাছ থেকে ধরতে গেলে জোর করেই টানতে টানতে ঘাটটার কাছে নিয়ে এলাম।

আমি তার পাশে, প্রায় গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে ভীত কাঁপা-কাঁপা গলায় বললাম–‘তুমি এসব দেখো না। আমি বলছি, এসব কিছুতেই দেখো না।’

সে ঝট করে আমার মুখের দিকে বিস্ময় মাখানো দৃষ্টি মেলে নীরবে তাকাল।

আমি বলেই চললাম–‘শোন, যে সব জিনিস দেখে তুমি জ্ঞানবুদ্ধি হারিয়ে হতভম্ব হয়ে পড়, সেটাকে নিছকই বৈদ্যুতিক ঘটনা ছাড়া অন্য কোনো আখ্যাই দেওয়া চলে না, আরে অবিশ্বাস্য হলেও এরকম ঘটনা মাঝে মধ্যেই চোখে পড়ে। তা নাহলে মনে করতে পার এ-সব হ্রদের পচা দূষিত পানিতে ভোজবাজি।’

তার চোখের আতঙ্কটুকু তখনও রয়ে গেছে লক্ষ্য করে আমি এবার বললাম– ‘জানালাটা দিয়ে কী কনকনে ঠাণ্ডা ঝড়ো বাতাস বইছে! এটা তোমার শরীর বরদাস্ত করবে না। মারাত্মক ক্ষতিকর।

মুহূর্তের জন্য তার মুখের দিকে তাকিয়ে নিয়ে এবার বললাম তোমার প্রিয় রোমান্সের বই এটা। এক কাজ করা যাক, আমি জোরে জোরে পড়ি, তুমি চুপটি করে শোন। আজকের এ ভয়ঙ্কর রাতটার বাকিটুকু এভাবেই কাটিয়ে দেওয়া যাক, কী বল?

আমি যে বইটা তাকে দেখিয়েছি সেটা স্যার ল্যান্সলট ক্যানিং-এর লেখা। প্রচ্ছদে বড় বড় হরফে বইয়ের নামটা লেখা–‘উন্মাদের হা-হুঁতাশ।

বইটাকে মুখে আমার মনের মতো বললেও আসলে আদৌ তা নয়। বইটার পাতায় পাতায় যে সব অবান্তর কথা বলা হয়েছে, তাকে প্রলাপ ছাড়া আর কিছুই ভাবা যায় না। আর আধ্যাত্মিক চেতনাসম্পন্ন মানুষ আমার বন্ধুর এসব প্যাচাল মনে ধরার কথা নয়। তবে এ বিশেষ মুহূর্তে হাতের কাছে এ-বইটাই পেয়ে গেলাম। আর এও ভাবলাম, আমার বন্ধুর এখন এ-মানসিক পরিস্থিতিতে এসব অবান্তর এলোমেলো কথা ভালো লাগা একেবারে অসম্ভব নয়।

বইটার একের পর এক পাতা পড়তে পড়তে যে পাতাটায় পৌঁছে গেলাম, সেখানে নায়ক এথেলরেড সন্ন্যাসীর আখড়ায় শান্তিপূর্ণ উপায়ে ঢোকার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। শেষপর্যন্ত ঢোকার জন্য তাকে বল প্রয়োগ করতে বাধ্য হচ্ছে। এ বর্ণনাটা যে এভাবেই দেওয়া হয়েছে, এ-কথা অনেকেরই মনে পড়ার কথা।

নায়ক এথেলরেড এমনিতে গায়ে গতরে প্রচুর শক্তি ধরে–তার ওপর কড়া মদ গিলে গায়ে প্রচুর শক্তি পেয়েছে। তাই সে বিদ্বেষ ভাবাপন্ন ও একরোখা সন্ন্যাসীর সঙ্গে কথা বলার তোয়াক্কা না করেই দরজা ভাঙার জন্য তৈরি হল। এদিকে অচিরেই ঝড়ের তাণ্ডব শুরু হয়ে যাবার আশঙ্কা ইতিমধ্যে দুচার ফোঁটা বৃষ্টিও গায়ে পড়ায় তার মধ্যে ব্যস্ততা সৃষ্টি করল। তাই সন্ন্যাসীকে আর ডাকাডাকি করে বৃথা সময় নষ্ট না করে হাতের মুগুরটা দিয়ে কাঠের দরজাটার গায়ে দমাদম আঘাত হানতে লাগল। গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে ঘা কতক মারতেই দরজাটার গায়ে লোহার দস্তানা দিয়ে হাতটাকে ভেতরে চালান করে দেবার মতো একটা ফোকড় তৈরি করে ফেলল। এবার এত বেশি শব্দ করে আঘাত আসতে শুরু করল যে, গোটা বনটাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। সে কী আওয়াজ!

অনুচ্ছেদটা পড়া শেষ করে আমি মুহূর্তের জন্য থেমে বইয়ের পাতা থেকে মুখ তুললাম। নীরবে উৎকর্ণ হয়ে যে শব্দটাকে শোনার চেষ্টা করলাম সেটা প্রাসাদটার সবচেয়ে দূরবর্তী কোনো কোণ থেকে ভেসে আসছে সেটা যেন ল্যান্সলট-এর বইয়ে বর্ণিত অমিত শক্তিধর নায়কের মুগুরের আঘাতের চেয়েও কোনো অংশে কম নয়। তবে এটাকে একটা আকস্মিক যোগাযোগ ছাড়া অবশ্যই অন্য কিছু ভাবা যাবে না। জানালায় দমকা বাতাস লাগায় শার্সিগুলো যে দুমদাম আওয়াজ করে চলেছে তাতে আমার বইটা পড়ার কোনোই বাধা সৃষ্টি করতে পারল না।

আমি আবার বইটার পাতায় চোখ রাখলাম। পড়তে লাগলাম–

আমি শক্তিধর সৎ-যোদ্ধা যুবক এথেলরেড দরজা ভেঙে আখড়ার ভেতরে ঢুকে বিদ্বেষ ভাবাপন্ন ও একরোখা সন্ন্যাসী বা তার চেলা চামুন্ড কাউকেই দেখতে না পাওয়ায় তার মধ্যে প্রচণ্ড ক্রোধের সঞ্চার হল। আবার সে বিস্মিতও কম হলো না।

ঘরের দরজায় পা দিয়েই সে থমকে গেল। দেখল, সন্ন্যাসীর পরিবর্তে একটা ড্রাগন ঘর আগলাচ্ছে। তার অতিকায় শরীরটা বড়-বড় আঁশে ঢাকা। আর জিভ দিয়ে লকলকে আগুন ঠিকরে বেরোচ্ছে।

সন্ন্যাসীর সোনার দেওয়াল আর রূপার মেঝের অট্টালিকাটার প্রহরায় সে নিযুক্ত।

চকচকে একটা পিতলের ফলক দেওয়ালে টাঙানো রয়েছে। তার গায়ে বড় বড় হরফে লেখা–যে এখানে প্রবেশ করতে পারবে বিজয়ীর সম্মান লাভ করবে। আর যে ড্রাগনটাকে মারতে পারবে, সে ফলক-বিজয়ীর সম্মানে সম্মানীত হবে।’

ফলকটার ওপর থেকে নজর তুলে নিয়ে এসেই বীরযোদ্ধা এথেলরেড হাতের মুগুরটা দিয়ে সজোরে ড্রাগনটার মাথায় আঘাত হানল। আঘাত লাগামাত্র ড্রাগনটা এমন বিকট চিৎকার করে উঠল যে এথেলরেডও হাত দিয়ে কান দুটো চেপে না ধরতে বাধ্য হল। এমন তীব্র চিৎকার এর আগে কেউ শোনেনি। ড্রাগনটা এবার তার পায়ের কাছে বার-কয়েক বুক-কাঁপানো চিৎকার করে পাগুলো ছড়িয়ে স্থির হয়ে গেল–শেষ নিশ্বাস ছাড়ল। ব্যস, সব শেষ।

এ পর্যন্ত পড়ে আমি আবার আচমকা বইটার পাতা থেকে মুখ তুললাম। আগ্রহের সঙ্গে কানখাড়া করতেই সত্যি সত্যি শুনতে পেলাম, নিচু অথচ কর্কশ কণ্ঠস্বর, অস্বাভাবিক আর্তস্বর বা কোনো ধাতব শব্দ দূর থেকে ভেসে আসছে। গল্পকার ন্যাসল্ট ড্রাগনটার যে অস্বাভাবিক আর্তনাদের কথা বলেছেন, যে আর্তনাদের কল্পনা আমি মনে মনে এই মাত্র করছিলাম, অবিকল সে রকমই আর্তনাদ আমার কানে এসে বাজতে লাগল।

ব্যাপারটা আমার মনকে খুবই দুর্বল করে দিল। একবার নয়, পরপর দুবার এমন অস্বাভাবিক যোগাযোগ কি করে যে সম্ভব হতে পাওে, তা ভেবে আমি আরও বিস্মিত হয়ে পড়লাম।

আমি আতঙ্কে, বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে পড়লেও অন্তত কিছুটা দৃঢ় মনোবল জোর করে বুকের মধ্যে ধরে রাখলাম, যার জন্য আমার মুখে এমন কোনো ভাব প্রকাশ করলাম না, বা এমন একটা শব্দও উচ্চারণ করলাম না যাতে আমার বন্ধুবর আশারের উত্তেজিত স্নায়ুগুলো আরও বেশি রকম উত্তেজিত হয়ে পড়ে।

আমি তার ফ্যাকাশে বিবর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃসন্দেহ হতে পারলাম না যে, আতঙ্ক সৃষ্টিকারী ওই শব্দটা তার কানেও এসেছে। তবে এও সত্য যে, শেষের দিকে মিনিট-কয়েক ধরে লক্ষ্য করেছি, তার হাবভাবে কেমন যেন একটা পরিবর্তন এসেছে। আমুল পরিবর্তনও বলা চলে।

সে আমার মুখোমুখি বসে রয়েছে। খাট থেকে নেমে কাঁপা কাঁপা হাতে কোনোরকমে একটা চেয়ার টেনে দরজার মুখোমুখি বসল। ফলে এমন তার মুখের একটা মাত্র অংশ আমার নজরে পড়ছে। তবে তার ঠোঁট দুটো যে তিরতির করে কাঁপছে এটা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। শ্রুতির আগোচরে যেন কিছুই নেই।

তার মাথাটা কাভাবে বুকের ওপর ঢলে পড়েছে। তবে পাশ থেকে হলেও যেটুকু দেখা যাচ্ছে, তাতেই বোঝা যাচ্ছে, সে ঘুমিয়ে পড়েনি। চোখ দুটো আধ-খোলা। তার শরীরটা স্থির হলেও মনে হচ্ছে থেকে থেকে বুঝি এদিক-ওদিক চলছে।

আমি বন্ধুর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে নিয়ে আবার ল্যান্সলটের বইয়ের পাতায় চোখ রাখলাম।

ভয়ঙ্কর ড্রাগনটার ক্রোধ থেকে অব্যাহতি পেয়ে পিতলের ফলকটার কথা ধরে যুবক এথেলরেডের মনে পড়ে গেল। নিজের ওপর থেকে শক্তিশালী মন্ত্রের প্রভাব কাটাবার কথাও তার মনে পড়ে গেল।

মৃত ড্রাগনটাকে টানাটানি করে সরিয়ে পথ পরিষ্কার করে নিয়ে সে দেওয়ালে টাঙানো ফলকটার দিকে এগিয়ে চলল।

কিন্তু সে ফলকাটার কাছে পৌঁছাবার আগেই সেটা অভাবিতভাবে আচমকা দুম করে রূপার মেঝের ওপর পড়ে টুকরো-টুকরো হয়ে গেল। একটা ধাতব ঠণ্ঠক্ শব্দ স্পষ্ট আমার কানে এলো।

আমি আচমকা সম্পূর্ণ বিপর্যস্তভাবে লাফিয়ে খাড়াভাবে দাঁড়িয়ে পড়লাম। এত কিছু সত্ত্বেও আমার বন্ধু আগের মতোই দোল খেতে লাগল। তার দুলুনির এতটুকু বাধা পড়ল না। তবে তার দৃষ্টি সামনের দিকে সম্পূর্ণ স্থির। মুখটা যেন পাথরের মতো কঠিন হয়ে গেছে।

আমি ধীর-পায়ে এগিয়ে গিয়ে তার কাঁধের ওপর একটা হাত রাখামাত্র সে হঠাৎ থরথর করে কাঁপতে লাগল। ঠোঁটের কোণে ম্লান হাসির রেখা ফুটে উঠলেও ঠোঁট দুটো অস্বাভাবিক রকম বেঁকে গেল।

তার দিকে সামান্য ঝুঁকে মুখের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই আমার স্পষ্ট মনে হলো যে, প্রায় অস্ফুট স্বরে কি যেন বলছে। আমি যে তার পাশে, একেবারে গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সে চেতনাটুকুও তার মধ্য থেকে নিঃশেষে উঠে গেছে।

তার মুখের একেবারে কাছাকাছি কানটাকে নিয়ে গিয়ে কোনোরকমে বক্তব্যটা উদ্ধার করতে পারলাম।

সে বিড়বিড় করে বলে চলল–‘কি হে, তুমি কিছু শুনতে পাচ্ছ না? আমি কিন্তু স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। হ্যাঁ, আমি শুনতে পেয়েছি। বহুকাল, বহুকাল, বহু মিনিট, বহু ঘণ্টা। বহুদিন আমি এ আহ্বান শুনেছি। তা সত্ত্বেও আমার সাহসে কুলোয়নি! উফ্! কৃপা কর, আমাকে কৃপা কর বড়ই অভাগা আমি–সত্যি আমার সাহসে কুলোয়নি। আমরা তাকে জীবন্ত সমাহিত করেছি। তোমার কাছে প্রকাশ করিনি আমার ইন্দ্রিয়গুলো বড় প্রখর হয়েছে? তোমার কাছে আজ প্রকাশ করছি, আমি প্রথম ফাঁকা কফিনের মধ্যে তার নড়াচড়ার খুবই অল্প আওয়াজ শুনেছি। বহু, বহুদিন আগেই আমি তার কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছি। তবু, তবু আমার সাহসে কুলোয়নি–কোনো কথা বলা সাহসে কুলোয়নি। আর এমন এ মুহূর্তে–আজ রাতে–এথেলরেড উফ! সন্ন্যাসীর কাঠের দরজা ভাঙল, ড্রাগনটার মরণ ডাক আর আছড়ে পড়ে ফলকটার খানখান হয়ে যাওয়ার আওয়াজ; তার চেয়ে বরং বল, তার কফিনটা খোলার আওয়াজ, তার কারাগারের লোহার হাঁসকলের ধাতব শব্দ, মাটির তলার ঘরের তামার পাতে ঢাকা সুড়ঙ্গের ভেতর তার লড়াই! উফ! আমি কোথায় পালিয়ে যাব? কোথায় গিয়ে গা ঢাকা দিয়ে থাকব? এ মুহূর্তে কি সে এখানে হাজির হবে না? ব্যস্ততার সঙ্গে কাজ সেরে ফেলার জন্য সে কি আমাকে তিরস্কার করছে না? আমার ওপর কি ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেনি? সিঁড়িতে তার পায়ের শব্দ কি আমার কানে পৌঁছায়নি? তার বুকের ধুকপুকানি কি আমার কানে ধরা পড়েনি? পাগল! বদ্ধ পাগল।’–এ পর্যন্ত বলে সে দুম্ করে একটা লাফ দিয়ে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। আত্মাটা যেন বেরিয়েই যাচ্ছে এমন আর্তস্বরে বলল– ‘উন্মাদ! বদ্ধ উন্মাদ কোথাকার! এখনও সে দরজাটার বাইরেই দাঁড়িয়ে! বদ্ধ উন্মাদ!’

তার কথাগুলোর মধ্যে মন্ত্রের প্রভূত শক্তি বুঝি লুকিয়ে ছিল। আর সে শক্তিকে অতিমানবিক শক্তি ছাড়া কীই বা বলা যেতে পারে? নইলে যে কথাটা বলতে না বলতেই অভাবিতভাবে বিশাল সাবেকি আমলের দরজাটার দিকে সে আঙুল উঠিয়ে ছিল, সেটা অল্প অল্প করে খুলে গেল। তীব্র ঝড়ো হাওয়ার চাপেই সেটা খুলেছে। তবে দরজার বাইরেই লেডি ম্যাডেলিনের সাদা কাপড়ে ঢাকা মূর্তি। আর সাদা কাপড়টার এখানে ওখানে রক্তের ছোপ, আর শরীরের সর্বত্র কঠিন লড়াইয়ের চিহ্ন অর্থাৎ ক্ষতচিহ্ন।

মাত্র অল্প কিছু সময়ের জন্য সে ঘরটার চৌকাঠের ওপর কাঁপতে কাঁপতে ঝড়ের কবলে পড়া গাছের মতো টলতে লাগল। ব্যস, পর মুহূর্তেই ভয়ঙ্কর আর্তনাদ করে ঘরের ভেতরে অবস্থানরত তার ভাইয়ের ওপর ঝাঁপ দিল। অসহনীয় মৃত্যু-যন্ত্রণার অস্বাভাবিক আবেগে ভাইকে জাপটে ধরেই ঘরের মেঝেতে ধপাস্ করে পড়ে গেল। তার ভাইও এমনই কিছু ঘটতে পারে সে আশঙ্কা করে আতঙ্কিত ছিল। আর এরই ফলে সে-ও মুহূর্তের মধ্যে প্রাণ হারাল।

সে কামরাটা থেকে, সে প্রাসাদটা থেকে আমি আতঙ্কের শিকার হয়ে পালিয়ে এলাম।

প্রাসাদের সদর-দরজা পেরিয়ে পুরনো পথটা যখন অতিক্রম করি, তুফানের উন্মাদনা তখনও একইভাবে চলছে, এতটুকুও স্তিমিত হয়েছে বলে মনে হলো না।

অকস্মাৎ সে পথটার একেবারে ওপরে সুদীর্ঘ একটা আলোর রেখা বিদ্যুতের ঝিলিকের মতো দ্রুত ছুটে এলো।

এমন অত্যুজ্জ্বল আলোকচ্ছটা কোথা থেকে এলো তা দেখার জন্য আমি ঘাড় ঘুরালাম। কারণ সে মুহূর্তে তো আমার পিছনে অবস্থান করছে কেবলমাত্র প্রাসাদটা আর তার ছায়াটুকু।

এবার ব্যাপারটা আমার কাছে খোলাসা হয়ে গেল, ওই অভাবনীয় আলোটার উৎস অস্তাচলগামী রক্তিম পূর্ণ চন্দ্র। তারই অত্যুজ্জ্বল প্রভা ছড়িয়ে পড়ছে পূর্ব বর্ণিত সে আঁকা বাঁকা ফাটলটার ভেতর দিয়ে যেটা বহু বাঁক নিয়ে প্রাসাদটার একেবারে ভিত অবধি নেমে এসেছে।

আঁকা-বাঁকা সামান্য সে ফাটলটা আমার চোখের সামনেই দ্রুত বেড়ে যেতে লাগল। আর তারই ভেতর দিয়ে তীব্র হিংস্র নিশ্বাস যেন ঘূর্ণিঝড় হয়ে ছুটে আসতে। লাগল। মুহূর্তের মধ্যে আমার চোখের সামনে উপগ্রহটার সম্পূর্ণ বৃত্তটাই ফেটে খান। খান হয়ে গেল। আর? সুবিশাল প্রাসাদটার অতিকায় দেওয়ালগুলো হুড়মুড় করে ধ্বসে পড়তে লাগল। প্রচণ্ড একটা আওয়াজ, হাজার হাজার জলপ্রপাত যেন একই সঙ্গে ধেয়ে আসছে–এমনই কানে তালা লেগে যাওয়ার মতো একটা ভয়ঙ্কর আওয়াজ। আর আমার পায়ের তলায় অবস্থিত কালো-পানির হ্রদটা এক অবর্ণনীয় নীরবতায় ধ্বংসপ্রাপ্ত ‘আশার আলয়’-এর প্রতিটা টুকরোকে ধীরে ধীরে চাপা দিয়ে দিল। ব্যস, শেষ–সব শেষ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *