১০. লটারি কমিটির রিপোর্ট

কলকাতার ক্রমবিকাশ

লটারি কমিটির রিপোর্ট

কলকাতা শহরের আধুনিক আঙ্গিক বিন্যাসের কাজ, অর্থাৎ পথঘাট ট্যাঙ্ক স্কোয়ার ইত্যাদি তৈরি, মোটামুটি একটি পরিকল্পনা অনুযায়ী আরম্ভ হয় উনিশ শতকের গোড়া থেকে। তার আগে কলকাতার গ্রাম্য রূপই প্রায় অক্ষুণ্ণ ছিল বলা চলে। উত্তর-মধ্য দক্ষিণ কলকাতা ছিল কয়েকটি গ্রামের সমষ্টি মাত্র এবং সেই গ্রামের রূপ বাংলার যে-কোনো সাধারণ গ্রামের মতোই ছিল। মাটি-খড়ের ঘর বা পর্ণ কুটির, সাহেবরা যাকে ‘native hut’ বলেছেন, মেঠো পথ, এঁদো পুকুর, পচা ডোবা, খাল, নালা, বাঁশবন জঙ্গল ইত্যাদিতে ভর্তি ছিল গ্রামগুলি। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে, বর্গির (মারাঠা) হাঙ্গামার সময়, কলকাতার পূর্বদিকে দীর্ঘ টানা একটি খাল কাটা হয়েছিল (‘মারাঠা ডিচ’) আত্মরক্ষার জন্য। অষ্টাদশ শতকের শেষে এই খালটিকে বুজিয়ে ফেলা হয় এবং বর্তমান সার্কুলার রোড, আপার ও লোয়ার, এই বুজনো খালের উপরে গড়ে ওঠে। এছাড়া উনিশ শতকের আগে কলকাতা শহরের আর বিশেষ কোনো আঙ্গিক উন্নতি হয়নি। অবশ্য সেকালের গোবিন্দপুর গ্রামে নতুন কেল্লা (Fort) নির্মাণের পর তার সমানে বিস্তৃত ‘এসপ্লানেড’ অঞ্চলটি ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল (Esplanade কথার অর্থ হল ‘open stretch of land’ বা ‘level area before a fortress’)।

কলকাতা শহরের বহিরঙ্গের বিন্যাস আরম্ভ হয় উনিশ শতকের গোড়া থেকে এবং ওয়েলেসলি তার সূত্রপাত করেন। বেভারলে (H. Beverley) তাঁর কলকাতা শহরের সেনসাস রিপোর্টে (১৮৭৬) লিখেছেন : Few Governor-Generals have done as much for Calcutta as Lord Wellesley effected during his tenure of office from 1798 to 1805 কলকাতার নাগরিক উন্নয়নের অবশ্যকতা সম্বন্ধে ওয়েলেসলি তাঁর প্রস্তাবে (১৬ জুন ১৮০৩) বলেন :

The increasing extent and population of Calcutta, the capital of the British Empire in India, and the seat of the Supreme authority, require the serious attention of Government. It has now become absolutely necessary to provide permanent means of promoting the health, the comfort, and convenience of the numerous inhabitants of this great town…

It is a primary duty of the Government to provide for the health, safety and convenience of the inhabitants of this great town by establishing a comprehensive system for the improvement of the roads, streets, paths, drains and water-courses, and by fixing permanent rules for the construction and distribution of the houses and public, edifices, and for the regulation of nuisances of every description.

এই প্রস্তাব অনুযায়ী ওয়েলেসলি তিরিশ জন সদস্য নিয়ে একটি উন্নয়ন কমিটি গঠন করেন এবং নগর-উন্নয়নের একটি পরিকল্পনাও রচনা করা হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা বিশেষ কার্যকর হয়নি। সম্ভবত ১৮১৪ সালে এই কমিটি লোপ পেয়ে যায়, যদিও সঠিক সনতারিখের উল্লেখ কোনো নথিপত্রে পাওয়া যায় না, এবং ১৮১৭ সালে গবর্ণমেণ্ট একটি নতুন লটারি কমিটি নিয়োগ করেন। কিছু কিছু উন্নয়নের কাজ ওয়েলেসলি গঠিত উন্নয়ন-কমিটি করেছিলেন, বিশেষ করে ট্যাঙ্ক খননের কাজ, নতুন লটারি কমিটির হিসেবপত্র থেকে তা বোঝা যায়। ২৪ নভেম্বর, ১৮১৭ তারিখের লটারি কমিটির কার্যবিবরণ দেখা যায়, আগেকার কমিশনারদের কাছ থেকে নগর-উন্নয়নের দায়িত্ব নতুন কমিটি গ্রহণ করেছেন, এবং লটারির টাকা কীভাবে ব্যয় করা হবে সে সম্বন্ধে তাঁরা বলেছেন :

Lottery funds be applicable to excavating tanks, filling up old ones, opening new streets or roads, constructing aquiducts, bridges ghauts and other works for the health, convenience and comfort…but not for repairing streets, drains which are to be left to the assessment department.

লটারির টাকা নতুন ট্যাঙ্ক খনন, পুরাতন ট্যাঙ্ক বোজানো, নতুন পথ নির্মাণ, জল সরবরাহের ব্যবস্থা, সেতু ঘাট ইত্যাদি তৈরির কাজে ব্যয় করা হবে, কিন্তু পথঘাট ড্রেন ইত্যাদির সংস্কারের জন্য ব্যয় করা হবে না। সংস্কারের কাজ ‘অ্যাসেসমেণ্ট’ বিভাগে করবে। কমিটি তাঁদের আর্থিক তহবিলের হিসেবও দিয়েছেন (৪ ডিসেম্বর, ১৮১৭) :

২৭ নভেম্বর তহবিলে জমা টাকা : ৪৬৭২৮০-৮-১১

সপ্তদশ লটারির জন্য ব্যাঙ্কের কাছে প্রাপ্য টাকা : ৭২,০০০ টাকা

১৮১২-১৩ সালে চৌরঙ্গিতে ট্যাঙ্ক খননের খাতে : ৩৫০০ টাকা

১৮১৩-১৪ সালে ধর্মতলায় একটি ট্যাঙ্ক গভীর করার খাতে ৯৭২ টাকা

১৮১৩-১৪ সালে বড় জেলখানার উত্তরে নতুন ট্যাঙ্ক খনন বাবদ : ১৫২৬ টাকা

এই হিসেব থেকে বোঝা যায়, ১৮১৭ সালে নতুন লটারি কমিটি নগর উন্নয়নের কাজ আরম্ভ করার আগে, পূর্বেকার কমিটি ট্যাঙ্ক খননাদি ব্যাপারে কিছু কাজ করেছিলেন, পথঘাট নির্মাণে বিশেষ মনোযোগ দিতে পারেননি। কলকাতার ‘টাউন হল’ (Town Hall), বেলেঘাটা খাল নির্মাণ অবশ্য এই কমিটির অন্যতম কীর্তি। পথঘাট জলাশয় সেতু জলাধার ইত্যাদি নির্মণের কাজ প্রধানত করেছিলেন ১৮১৭ সালে গঠিত নতুন লটারি কমিটি।

নতুন লটারি কমিটির উদযোগে কলকাতা শহরের মধ্যভাগ, উত্তরাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলে উন্নয়নের কাজ হয় বেশি, দক্ষিণ দিকে চৌরঙ্গি অঞ্চলের খানিকটা উন্নতি হলেও তার বাইরে বেশি দূর পর্যন্ত তেমন কিছু করা হয়নি। ১৮১৭ থেকে ১৮২১ সাল পর্যন্ত লটারি কমিটির যে কার্যবিবরণ পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায় যে এই সময়ের মধ্যে ওয়েলিংটন স্ট্রীট ও স্কোয়ার, হেস্টিংস ও হেয়ার স্ট্রীট, ম্যাংগো লেন ও কসাইতলা (বেণ্টিক স্ট্রীট), ক্রিক রো, ফ্রি স্কুল স্ট্রীট, কিড স্ট্রীট, উত্তর দিকে কলেজস্কোয়ার, দক্ষিণে পার্ক স্ট্রীট, চৌরঙ্গি প্রভৃতি নতুন করে তৈরি করা হয়। লটারি কমিটির তিন খণ্ড রিপোর্ট পাণ্ডুলিপি আকারে এখনও পাওয়া যায় এবং ১৯৫৭-৫৮ সালে এই রিপোর্ট লেখকের দেখার সুযোগ হয়। বেভারলে কলকাতার সেনসাস রিপোর্ট (১৮৭৬) লিখেছেন :  “A full account of the works effected by the Lottery Committee would form one the most interesting chapters in the history of the Town.” আজ পর্যন্ত এই রিপোর্টের কোনো বিবরণ কোথাও প্রকাশিত হয়নি। এখনে রিপোর্টের কিছু কিছু অংশ বাংলায় প্রকাশ করা হল। কলকাতার প্রাচীন ইতিহাস সম্বন্ধে অনুসন্ধানী ও অনুসন্ধিৎসু যাঁরা তাঁরা এই বিবরণ থেকে এমন অনেক উপাদান পাবেন যা চমকপ্রদ। বিষয়গুলি পড়লে তাঁদের নিঃসন্দেহে মনে হবে, এগুলি কলকাতা শহরের ক্রমবিকাশের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় অবশ্যপাঠ্য অধ্যায়।

কলকাতা ১৭০৭

মোগল বাদশাহ ঔরঙ্গজীবের মৃত্যু হয় ১৭০৭ সালে। এই সময় কলকাতার (অর্থাৎ, গোবিন্দপুর, টাউন কলকাতা, বাজার কলকাতা ও সুতানুটি নিয়ে যে কলকাতা) বাইরের রূপ কেমন ছিল তা Bengal Consultations, 12 June 1707-এর একটি বিবরণ থেকে বোঝা যায়। বর্তমান ফোর্ট উইলিয়াম অঞ্চল জুড়ে ছিল গোবিন্দপুর গ্রাম, তার উত্তরে বউবাজার প্রায় বিস্তৃত ছিল ‘টাউন কলকাতা’ অঞ্চল, তার উত্তরে প্রায় বড়বাজার পর্যন্ত অঞ্চল ছিল ‘বাজার কলকাতা’ এবং পরবর্তী উত্তরাংশ শোভাবাজার-শ্যামবাজার পর্যন্ত ছিল ‘সূতানুটি’ গ্রাম।

গোবিন্দপুর (Govenpore)

গোবিন্দপুর

মোট ১১৭৭ বিঘা ৭ কাঠা জমির মধ্যে গোবিন্দপুরে ধানক্ষেত ছিল প্রায় অর্ধেক, বাকি অধিকাংশই ছিল বনজঙ্গল, পতিত জমি, বাঁশবন, কলাবাগান ইত্যাদি। লোকের বসতি ছিল মাত্র ৫৭ বিঘার মতো।

টাউন কলকাতা

টাউন কলকাতা

‘টাউন কলকাতা’ ছিল তখন সবচেয়ে বর্ধিষ্ণু অঞ্চল। এই অঞ্চলের মোট ১৭১৭ বিঘা ১৪ কাঠা জমির মধ্যে এখানেও প্রায় তিনভাগের দু’ভাগ জমিতে ছিল ‘ধানক্ষেত কলাবাগান ও জঙ্গল’। বসতি-এলাকা ছিল গোবিন্দুপুরের প্রায় চারগুণ।

বাজার কলকাতা

বাজার কলকাতা

‘বাজার কলকাতার’ মোট ৪৮৮ বিঘা ১২ কাঠা জমির মধ্যে বসতি-এলাকাই ৪০০ বিঘার বেশি। বসতি অবশ্য শুধু বাসগৃহ নয়, দোকানপাঠ বাজারও আছে। লক্ষণীয় হল, এখানে ধানক্ষেত নেই, জঙ্গলও নেই, পতিত জমি মাত্র একবিঘার মতো, কিন্তু বাগান আর কলাবাগান মিলিয়ে প্রায় ৩৩ বিঘা, ব্রহ্মোত্তর ২৬ বিঘা এবং ফুলবাগান ৬ কাঠার মতো। বাজার কলকাতার প্রতিপত্তিশালী অধিবাসীদের মধ্যে তখন প্রধন ছিলেন বাঙালি তন্তুবণিক শেঠ-বসাকরা এবং মল্লিক প্রভৃতি সুবর্ণবণিকরা। এঁদের প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহ ও দেবালয়ের জন্যই যে ব্রহ্মোত্তর, বাগান ফুলবাগান তা বোঝা যায়।

সূতানুটি (Sootaloota)

সূতানুটি

সুতানুটির গ্রাম্য রূপ গোবিন্দপুরের মতোই সুপরিস্ফুট। মোট ১৬৯২ বিঘা ১৬ কাঠা জমির মধ্যে কমবেশি একহাজার বিঘা ধানক্ষেত আর জঙ্গল। বাগান, কলাবাগান ফুলবাগান মিলিয়ে দুশো বিঘার বেশি। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য হল বাঙালি তন্তুবণিক শেঠদের এই অঞ্চলে খুব বড় একটি বাগান ছিল। তন্তুবণিক শেঠ-বসাকদের প্রসঙ্গে আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, টাউন কলকাতা ও সূতানুটিতে তখন প্রায় ৩৫ বিঘার মতো জমিতে তুলার চাষ হত।

অষ্টাদশ শতকের শেষপর্যন্ত প্রায় কলকাতার এই গ্রাম্যরূপের বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। উনিশ শতকে লটারি কমিটির উদযোগে কলকাতার নাগরিক উন্নয়নের কাজ আরম্ভ হয়। এই উন্নয়নকর্মের কয়েকটি দৃষ্টান্ত এখানে দেওয়া হল।

ওয়েলিংটন অঞ্চল

(কমিটির চিঠি, চীফ সেক্রেটারিকে লিখিত, ২ সেপ্টেম্বর ১৮১৭)

ব্যাপারীটোলায় একটি ট্যাঙ্ক ও স্কোয়ার নির্মাণের খরচ পড়বে ১০৪৩৪৮ টাকা ৬ আনা ১০ গোণ্ডা, এবং রাস্তা তৈরির জন্য ১৭৫৯২ টাকা, মোট ১২১৯৪০ টাকা ৬ আনা ১০ গোণ্ডা। পুরনো বাড়িঘরের ভাঙাচোরা জিনিস বিক্রি থেকে ১৭৮৪৪ টাকা ৯ আনা ৫ গোণ্ডা পাওয়া যাবে। অতএব এই টাকা বাদ দিয়ে গবর্ণমেণ্টের মোট খরচ হবে প্রায় ১০৪০৯৫ টাকা ১৩ আনা ৫ গোণ্ডা।

ট্যাঙ্ক, স্কোয়ার ইত্যাদি তৈরি হয়ে গেলে এই অঞ্চলের যে উন্নতি হবে তার ফলে জমির মূল্য ৩০০ টাকা কাঠা হতে পারে। এই মূল্য ন্যায্য মানে হয়, বেশি নয়।

[কার্যবিবরণ, ১২ ফেব্রুয়ারি ১৮১৮]

ব্যাপারীটোলার ট্যাঙ্ক, স্কোয়ার ইত্যাদির জন্য অনেক জায়গাজমি কেনা হয়েছে। জমির মালিকদের আজ পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে ৫৪,৭৪২ টাকা। পাকা বাড়ি যা কেনা হয়েছে তা অবিলম্বে ভেঙ্গে ফেলা দরকার। কয়েকজন জমির মালিকের ওজর আপত্তির জন্য কাজে বাধা পড়ছে। উন্নয়নের জন্য যে জমি কমিটিকে দখল করতে হবে তার মধ্যে ইমাম বকস নামে একজনের ৬ বিঘা ১৭ কাঠা জমি আছে। এই জমির মোট মূল্য ২৭৫০০ টাকা ধরা হয়েছে, কাঠাপ্রতি ২০০ টাকা করে। এই মূল্য ন্যায্য বলে আমরা মনে করি, কারণ অনেক মালিক এই মূল্য গ্রহণ করতে আপত্তি করেননি। ইমাম বকস এই মূল্য গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক, তিনি আরও দু’চারজন ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা জমির মূল্য নির্ধারণের জন্য অনুরোধ করেছেন।

নিচে উল্লেখিত দু’জনের বাড়ি আমরা এই মূল্যে কেনার জন্য প্রস্তাব করেছি, এবং মূল্য বেশি করেই (over-rated) ধরা হয়েছে :

মিস্টার ব্ল্যাক। একতলা বাড়ি। এক বিঘা জমি। ১১৫০০ টাকা

মিঞা জান। দোতলা বাড়ি। ৪ কাঠা ২ ছটাক জমি। ৩০৩২ টাকা

[সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার এডওয়ার্ড হাইড ইস্টের কাছে সেখ মিঞা জানের আবেদন]

আবেদনকারী ৩০ নং ধর্মতলার (‘Dhurum Tulla, No 30’) একটি বাড়ির মালিক। লটারি কমিটি ও কালেক্টর সাহেব বাড়িটি অন্যায়ভাবে অত্যাচার করে (‘in an unlawful and in a most tyrannical manner’) দখল করতে চান, এই অঞ্চলে একটি ট্যাঙ্ক খোঁড়ার জন্য। এই বাড়ির ভাড়াটের কাছ থেকে আমি যে মাসিক ভাড়া পাই, তাও এই ভদ্রলোকরা ভাড়াটেকে দিতে নিষেধ করেছেন।

প্রথমে কলেক্টর সাহেব বাড়িটির ৮০০০ টাকা মূল্য দিতে স্বীকার করে একটি চুক্তিপত্র অবেদনকারীকে দিয়ে সই করিয়ে নেন, কিন্তু এখন বলছেন যে ৩০৩২ টাকার বেশি মূল্য দেবেন না। তাঁরা আমাকে শাসাচ্ছেন যে যদি এই মূল্য আমি গ্রহণ না করি তাহলে কয়েদীদের কাজে লাগিয়ে বাড়ি তাঁরা জোর করে ভেঙে দেবেন।

আবেদনকারীর বাড়িটি ইংরেজি ফ্যাশনে তৈরি (‘is built after the English fashion’) এবং বাড়ির ভাড়াটেও একজন ইংরেজ ভদ্রলোক (‘an English Gentleman’)। ৬০ টাকা করে মাসিক ভাড়ার হারে আবেদনকারী ট্যাক্স দিয়ে থাকেন।

হুজুরের কাছে আবেদনকারী ন্যায়সঙ্গত বিচারপ্রার্থী।

[কার্যবিবরণ, ২১ জুন ১৮২০]

৩ ফেব্রুয়ারি ১৮২০ একটি সাব-কমিটি গঠন করা হয় ডিঙ্গাভাঙ্গা খাল ভরাট করার ব্যবস্থাদির জন্য (for carrying into execution the necessary arrangements for filling up the Dinga bhanga Khal’)। উক্ত তারিখ সেকসপীয়ার সাহেব লটারি কমিটিকে বলেন যে ব্যাপারীটোল অঞ্চলের উন্নয়নের কাজ অনেক ভাল হবে যদি ডিঙ্গাভাঙ্গা খালটি ভরাট করে পরে সার্কুলার রোড ও ময়রা স্কোয়ারের সংযোগ পর্যন্ত একটি রাস্তা তৈরি করা হয়।

[কার্যবিবরণ, ১৫ জুন ১৮২০]

ময়রা স্কোয়ার সাব-কমিটির রিপোর্ট, লটারি কমিটির সেক্রেটারির কাছে লিখিত, ১৩ জুন ১৮২০।

তিলকরাম পাকড়াশীর বাড়িঘর জমিজমার বর্তমান মালিক ও উত্তরাধিকারী আনন্দচন্দ্র মুখর্জিকে তাঁর গোটা বাড়িটা বিক্রি করে দেবার জন্য অনুরোধ করা হয়, যাতে ময়রা স্কোয়ার থেকে বউবাজার পর্যন্ত সোজা একটি রাস্তা তৈরি করা যায়। অনুরোধ ব্যর্থ হয়। আনন্দচন্দ্রের আপত্তির একটি কারণ হল, তাঁর শিবঠাকুরের মন্দিরটিও ভাঙা হবে। অনেক আলোচনার পর আনন্দচন্দ্র ১৪,৩০০ টাকায় তাঁর যে সম্পত্তি উন্নয়ন-কমিটিকে দিতে সম্মত হয়েছেন, তার বিবরণ এই :

প্রায় একবিঘা জমিতে প্রজাদের বসতি উচ্ছেদের জন্য

ক্ষতিপূরণ : ৮৪০০ টাকা

ক্ষতিপূরণ

ময়রা স্কোয়ার অঞ্চলের উন্নয়নের কাজ শেষ হলে ব্যাপারীটোলা সাব-কমিটি জানাচ্ছেন যে এখানকার প্রায় ৪ বিঘার মতো জমি ৪০০ টাকা মূল্যে বিক্রি করা সম্ভব হবে।

ডিঙ্গাভাঙ্গা খাল ভরাটের জন্য ২০০ কুলি লাগবে, মাসে তাদের মজুরি ৭৫০ টাকা, চার মাসের জন্য ৩০০০ টাকা। চারমাসেই কাজ শেষ হয়ে যাবে।

[কার্যবিবরণ, ৯ নভেম্বর ১৮২০]

লটারি কমিটির সেক্রেটারি ব্যাপারীটোলা সাব কমিটিকে জানাচ্ছেন : …in compliance with the proposition of His Excellency…you will be pleased to designate the new square in the Dhurrumtollah under the name of Wellington Square.’

ধর্মতলার নতুন স্কোয়ারের নাম রাখা হয় ওয়েলিংটন স্কোয়ার, ১৮২০ সালের নভেম্বর মাসে। এই অঞ্চলের প্রাচীন নাম ছিল ব্যাপারীটোলা এবং ১৮১৭ থেকে ১৮২০ সালের মধ্যে এখানকার প্রাথমিক উন্নয়নের কাজ শেষ হয়। কমিটির কার্যবিবরণ থেকে বোঝা যায়, এই অঞ্চলে উনিশ শতকের গোড়ার দিকে অনেক মুসলমানের বসতি ছিল, এবং তাঁদের মধ্যে ইমাম বকস, মিঞা জানের মতো কয়েকজন, অনেক জমিজমা ও ঘরবাড়ির মালিক ছিলেন। ইংরেজদের ভাড়া দেবার জন্যই মিঞা জান ‘ইংলিশ ফ্যাশানের’ বাড়ি তৈরি করেছিলেন ৩০ নং ধর্মতলায়। বাড়ি ও জমির মূল্যের কথাও আজকের দিনে রূপকথার মতো শোনায়।

চৌরঙ্গি অঞ্চল

ওয়াল্টার হ্যামিল্টন তাঁর East India Gazetteer-এ (১৮১৫) লিখেছেন : What are now called the Esplanade, the site of Fort William and Chowringhee, were so late as 1756 a complete jungle interpersed with a few huts and small pieces of grazing and arable land.

পলাশির যুদ্ধের আগের বছর নবাব সিরাজউদ্দৌলা যখন কলকাতা আক্রমণ করেন ইংরেজদের উচ্ছেদ করার জন্য, তখন চৌরঙ্গি অঞ্চল ছিল জঙ্গলাকীর্ণ, মধ্যে মধ্যে ছিল খানাডোবা পুকুর র্কুড়েঘর নিয়ে ছোট ছোট গ্রাম। ইংরেজদের বসতি প্রথম দিকে স্বাভাবিক কারণে পুরাতন কেল্লার কাছাকাছি (Old Fort) অঞ্চলে (ডালহৌসি স্কয়ার) গড়ে ওঠে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিক থেকে ধনিক সাহেবরা শিয়ালদহ এণ্টালির দিকে (সার্কুলার রোড) অনেকটা জায়গা জুড়ে বাগানবাড়ি করে বাস করতে থাকেন। অনেকে খিদিরপুর গার্ডেনরিচের দিকে বাগানবাড়ি করেন। ১৭৯২ সালে প্রকাশিত বেইলির মানচিত্রে (Baillie’s Map. 1792) দেখা যায়, জানবাজার ও পার্ক স্ট্রীটের মধ্যে প্রায় ৪০টি ইংরেজদের বাড়ি ছিল এবং তার দক্ষিণে (পার্ক স্ট্রীট থেকে দক্ষিণে সার্কুলার রোড পর্যন্ত অঞ্চলে) প্রায় একই সংখ্যক বাড়ি ছিল ইংরেজদের। বাকি সব গ্রাম। এই অঞ্চলের প্রাচীন নাম ছিল বামুনবস্তি, কলকাতার অভিজাত ইংরেজপল্লি এখানেই পরে গড়ে ওঠে (ক্যামাক স্ট্রীট, হাঙ্গারফোর্ড স্ট্রীট, উড স্ট্রীট অঞ্চলে)। তার দক্ষিণে ছিল, বিরজিতলা ও ডিহি বিরজি নামে গ্রামাঞ্চল (এলগিন রোড, চক্রবেড়িয়া অঞ্চল)। পার্ক স্ট্রীটের দক্ষিণে বামুনবস্তির অধিকাংশ জমির মালিক ছিলেন ক্যামাক (Camac) সাহেব, যাঁর নামে ক্যামাক ষ্ট্রীট, এবং শর্ট (Short) সাহেব, যাঁর নামে শটর্স স্ট্রীট ও বাজার। প্রসঙ্গত চৌরঙ্গি সম্বন্ধে, উনিশ শতকের গোড়ায় (১৮০৩), লর্ড ভ্যালনশিয়ার (Lord Valentia) উক্তি মনে হয় : ‘Chowringhee is an entire village of Palaces’-অর্থাৎ চৌরঙ্গি তখনও প্রধানত গ্রামাঞ্চল ছিল, এবং তার মধ্যে ইংরেজদের বাগানবাড়িগুলো প্রাসাদের মতো দেখাত। প্রধানত এই অঞ্চলের উন্নয়নের ভার নেন লটারি কমিটি। লটারি কমিটির উন্নয়নের পর থেকে, অর্থাৎ উনিশ শতকের প্রায় মাঝামাঝি থেকে, চৌরঙ্গির আভিজাত্য, ইংরেজপ্রধান বসতি (White town) বলে, ক্রমে বৃদ্ধি পেতে থাকে। পরবর্তীকালে কলকাতা শহরের আর কোনো অঞ্চল, শ্বেতাঙ্গদের বসতি হিসেবে, অনুরূপ আভিজাত্য অর্জন করতে পারেনি। বর্তমানে সেকালের নেটিভদের বংশধরদের বসতিকেন্দ্র চৌরঙ্গি হলেও তার আভিজাত্য অক্ষুণ্ণ রয়েছে।

‘East of the Theatre’ (দক্ষিণ চৌরঙ্গি অঞ্চল) সাব-কমিটি-চৌরঙ্গির উন্নয়ন সম্পর্কে একটি রিপোর্ট লটারি কমিটির কাছে পেশ করেন (২০ এপ্রিল ১৮২০)। সমগ্র অঞ্চলটিকে তাঁরা কয়েকটি প্লটে ভাগ করেন এবং জমির মালিক ও তার মূল্য ইত্যাদির কথা উল্লেখ করেন রিপোর্টে। এই দীর্ঘ রিপোর্ট থেকে কয়েকটি অনুচ্ছেদের (paragraph) অংশ বিশেষের বিবরণ এখানে দেওয়া হল :

প্যারা ১১। ২ নং প্লট, বামুনবস্তির অন্তর্ভুক্ত, রামশঙ্কর চ্যাটার্জির সম্পত্তি।

প্যারা ১২। ৩ নং প্লট ক্যামাক সাহেবের সম্পত্তি, তত্ত্বাবধানের ভার মেসার্স পামার অ্যাণ্ড কোম্পানির উপর। ৩ নং ও ২ নং প্লটের মধ্যে একটি বড় নালা (ditch) আছে এবং নালাটি কোনো কোনো জায়গায় প্রায় ৪৬ ফুট পর্যন্ত চওড়া।

প্যারা ১৮। প্লট নং ৩, ৪, ৫, ৬ সবই ক্যামাক সাহেবের সম্পত্তি। মেসার্স পামার অ্যাণ্ড কোম্পানি তত্ত্বাবধান করেন, অর্থাৎ ক্যামাক সাহেবের সম্পত্তির ম্যানেজার। ম্যানেজারের অধিকার আছে সম্পত্তি বিক্রি করার, কিন্তু তার কোনো অংশ তাঁরা খরচ করতে পারেন না।

প্যারা ১৯। ম্যানেজার তাঁদের একটি চিঠিতে আমাদের জানিয়েছেন যে ৫০ টাকা কাঠা মুল্যে তাঁরা ক্যামাক সাহেবের ভূসম্পত্তি বিক্রি করতে পারেন। অভাবনীয় প্রস্তাব। কমিটির কাছে আমাদের অনুরোধ, তাঁরা পামার অ্যাণ্ড কোম্পানির এই প্রস্তাব যেন অবিলম্বে গ্রহণ করেন।

প্যারা ২০। কলকাতা শহরে ইয়োরোপীয়দের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। কাজেই এই অঞ্চলের উন্নয়নের কাজ যদি শেষ করা যায়, তাহলে যে মুল্যে ইয়োরোপীয়দের ঘরবাড়ি তৈরির জন্য জমিজমা বিক্রি করা সম্ভব হবে, তাতে খুব সহজেই গবর্ণমেণ্টের উন্নয়নের খরচ-খরচা উঠে আসবে।

Adverting to the increasing European population of this Town, we cannot doubt but that the greatest part would be purchased in its improved state for the erection of Dwelling House at rates which would more than repay the previous expenditure.

রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা হল কমিটিতে। আলোচনার পর এই মর্মে প্রস্তাব গৃহীত হয় যে লটারি কমিটির সেক্রেটারি যেন গবর্ণমেণ্টের চীফ সেক্রেটারিকে ২৮ এপ্রিল ১৮২০ তারিখে লেখেন-

কমিটি ক্যামাক সাহেবের যাবতীয় সম্পত্তি উক্ত ৫০ টাকা কাঠা মূল্যে কিনে নিতে ইচ্ছুক।

ক্যামাক সাহেবের মোট সম্পত্তি এই অঞ্চলে প্রায় ২৫০ বিঘার মতো এবং ১০০০ টাকা প্রতি বিঘা মূল্যে এই সম্পত্তির মোট মূল্য হবে ২,৫০,০০০ টাকা।

(কার্যবিবরণ, ১৮ মে ১৮২০)

।। লটারি কমিটির কাছে চীফ সেক্রেটারীর চিঠি, ৫ মে ১৮২০।।

চৌরঙ্গি অঞ্চলে ক্যামাক সাহেবের ভূসম্পত্তি কেনার জন্য লটারি কমিটি তিন লক্ষ টাকার মধ্যে প্রয়োজনীয় টাকা পাবলিক ট্রেজারি থেকে তুলে নিতে পারেন। তার জন্য বছরে শতকরা ৬ টাকা হারে সুদ দিতে হবে।

(কার্যবিবরণ, ৫ অক্টোবর ১৮২০)

।। উইলিয়াম ক্যামাকের ভূসম্পত্তির কবালাপত্র।।

মোট ২৫০ বিঘা ১৮ কাঠা

১। একখণ্ড জমি, ২০ বিঘা। চৌহদ্দি : উত্তরে কবরখানা রাস্তা (Burying Ground Road), দক্ষিণে শর্টস বাজার লেন, পশ্চিমে ইংরেজদের কবরখানা এবং পূবে জন অ্যাথানসের বাড়িঘর।

২। একখণ্ড জমি, ৪৯ বিঘা ২ কাঠা। চৌহদ্দি : উত্তরে রামমোহন দত্ত ও বিবি টমসনের কয়েকটি বাড়ি এবং খানিকটা শটশ বাজার লেন, দক্ষিণে চৌরঙ্গি থিয়েটারমুখী একটি রাস্তা, পশ্চিমে শটর্স বাজার রোড এবং পূবে মেসার্স পামার অ্যাণ্ড কোম্পানির অধীন কয়েকটি বাড়ি।

৩। একখণ্ড জমি, ৪৭ বিঘা ৮ কাঠা ১২ ছটাক। চৌহদ্দি : উত্তরে শটস বাজার লেন, ইংরেজদের কবরখানা আর রামনারায়ণ ঘোষের কয়েকটি বাড়ি, দক্ষিণে চৌরঙ্গি থিয়েটারমুখী রাস্তা, পশ্চিমে উক্ত কবরখানা ও সার্কুলার রোড, এবং পূবে শটর্স বাজার রোড।

৪। একখণ্ড জমি, ৫১ বিঘা ৯ কাঠা। চৌহদ্দি : উত্তরে চৌরঙ্গি থিয়েটারমুখী রাস্তা, দক্ষিণে সার্কুলার রোড, পশ্চিমে শর্টস বাজার রোড এবং পূবে রামশঙ্কর চ্যাটার্জির কয়েকটি বাড়ি।

৫। আর একখণ্ড জমি, ৯৫ বিঘা ১৮ কাঠা ৪ ছটাক। চৌহদ্দি : উত্তরে চৌরঙ্গি থিয়েটারমুখী রাস্তা, দক্ষিণে ও পশ্চিমে সার্কুলার রোড, পূবে শর্টস বাজার রোড।

উপরে বর্ণিত সমগ্র জমি মোট ২৬৩৯০০ সিক্কা টাকায় বিক্রি করা হল।

 কবলাপত্রের তারিখ

 ২২ সেপ্টেম্বর ১৮২০

 স্বাক্ষর

আই, পামার (Palmer)

আই. এস. ব্রাউনরিগ (Brownrigg)

এইচ. ডব্লু. হবহাউস (Hobhouse)

এক. আই. হল (Hall)

উইলিয়াম প্রিনসেপ (Prinsep)

গোলদীঘি মির্জাপুর অঞ্চল

(কার্যবিবরণ, ৮ মার্চ ১৮২১)

ধর্মতলা-ওয়েলিংটন অঞ্চলের উন্নয়নের কাজ শেষ হল। বাকি হইল, সান্ত্রীর পাহারাঘর (Sentry box) ও মালিক ঘর তৈরি করা। নতুন ট্যাঙ্ক ও স্কয়ারের নাম হল ওয়েলিংটন স্কয়ার, এবং ধর্মতলা থেকে বউবাজার পর্যন্ত যে নতুন রাস্তা হল তার নাম ওয়েলিংটন স্ট্রীট। স্কয়ারের পূর্বদিক থেকে যে রাস্তা সার্কুলার রোড পর্যন্ত তৈরি হল, তার নাম ডিঙ্গাভাঙ্গা স্ট্রীট।

কমিটির পরবর্তী উন্নয়নের পরিকল্পনা ১৮১৫ সালেই পেশ করা হয়েছিল। পূবে সার্কুলার রোড এবং পশ্চিমে চৌরঙ্গি থেকে কসাইতলা ও চিৎপুর রোডের মধ্যবর্তী অঞ্চলের উন্নয়নের কাজ আরম্ভ করা প্রয়োজন। উত্তর থেকে দক্ষিণে একটি বড় রাস্তা তৈরি করতে হবে। এই অঞ্চলে ছোট ছোট ডোবা অনেক আছে, কিন্তু ভাল পুকুর বিশেষ নেই, যার জল স্থানীয় লোকরা নিরাপদে পানাদির জন্য ব্যবহার করতে পারে। অধিকাংশ লোকই এখানে মাটির কুড়ে ঘরে বাস করে এবং এত ঘিনজি বসতি যে আগুন লাগলে সব পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, অনেক লোকও মারা যাবে।

সেইজন্য আমরা প্রস্তাব করছি, বউবাজার থেকে সিমলাস্ট্রীট পর্যন্ত উন্নয়নের প্রয়োজন। ধর্মতলা থেকে বউবাজার পর্যন্ত যে নতুন রাস্তা তৈরি হয়েছে, তার সঙ্গে উত্তর বরাবর আর একটি রাস্তা সোজা তৈরি করতে হবে, দৈর্ঘ্যে অন্তত ৪৪২০ ফুট। এই নতুন রাস্তা ওয়েলিংটনস্ট্রীটের মতোই চওড়া হবে, ৬০ ফুট। ট্যাঙ্ক ও স্কয়ার নির্মাণের কাজে ২৭ বিঘার মতো একটি জায়গাও পাওয়া যাবে এর মধ্যে, মোটামুটি ন্যায্য মূল্যে (‘at a price which seems to us to be moderate’)। এই নতুন ট্যাঙ্ক স্কয়ার আর ওয়েলিংটন ট্যাঙ্ক স্কয়ারের মধ্যে দূরত্ব হবে ১২৫০ গজের মতো।

(কার্যবিবরণ, ১৮ এপ্রিল ১৮২১)

।। কমিটির কাছে চীফ সেক্রেটারির চিঠি।।

পূর্বোক্ত উন্নয়ন পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য কমিটি তিন লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা ব্যয় করতে পারবেন। এই টাকায়, কমিটির প্রস্তাবিত নতুন রাস্তা তৈরি হবে বউবাজার থেকে সিমলাস্ট্রীট পর্যন্ত, পটলডাঙ্গার কাছে নতুন ট্যাঙ্ক ও স্কয়ার হবে এবং পাশাপাশি অঞ্চলেও উন্নয়নের কাজ হবে।

(কার্যবিবরণ, ২১ জুন ১৮২১)

।। লটারি কমিটির সার্ভেয়ার এ.ই. এইচ ব্লেশিনডেন প্রেরিত।।

রিপোর্ট (৯ জুন ১৮২১) পটলডাঙ্গা-মির্জাপুর অঞ্চল সম্বন্ধে।।

পূর্বদিকে পটলডাঙ্গায় জমি আছে ১৫ বিঘা ৯ কাঠা ১০ ছটাক। জমির উত্তরে রামনারায়ণ গাঙ্গুলি ও লক্ষ্মণ দত্তের (Ramnarain Gangoolly and Lucken Dutt) বাড়ি, পূর্বে কালীনাথ ও রামতনু দত্তের (Collynaut and Ramtanoo Dutt) বাড়ি, দক্ষিণে পটলডাঙ্গা লেন (‘called also Puttollah Land’) এবং পশ্চিমে পটলডাঙ্গা ষ্ট্রীট (‘commonly called Tantoniah Steet’)।

পশ্চিমদিকে জমি আছে ৭ বিঘা ৮ কাঠা ৪ ছটাক। জমির উত্তরে কুঞ্জ সরকারের (Coonjoo Sircar) বাড়ি ও জমি, পূর্বে পটলডাঙ্গাস্ট্রীট, দক্ষিণে দুর্গারাম কর ও সেখ বকসুর (Durgaram Kurr and Shaike Buxoo Sur) বাড়ি, এবং পশ্চিমে একখণ্ড জমি, যার মালিক রামমোহন পালিত (Rammohan Paulit)।

মির্জাপুরে জমি আছে ৪ বিঘা 81/2 ছটাক। জমির উত্তরে মনোহর বিশ্বাসের বাড়ি, পূর্বে বড় একখণ্ড জমি আছে, মালিক সীতারাম ঘোষ। লোকে এই জায়গাটাকে ‘গয়ারাম ঘেষের ডাঙ্গা’ বলে (“a large piece of ground belonging to Sitaram Ghose, commonly called Goyaram Ghose’s Dangah”)। জমির দক্ষিণে মির্জাপুর লেন এবং পশ্চিমে সীতারাম ঘোষের লেন ও মনোহর বিশ্বাসের বাড়ির অংশ বিশেষ। মির্জাপুরে জমির মূল্য ১৫০ টাকা কাঠা।

গঙ্গাজল ও গোরু

(কার্যবিবরণ, ২৩ এপ্রিল ১৮২৮)

গঙ্গাজল হিন্দুদের কাছে পবিত্র এবং সেই কারণে পানীয়ও বটে। শহরের যাবতীয় ময়লা নোংরা আবর্জনা মেথররা গঙ্গায় নিয়ে এসে ফেলে দেয়। তার ফলে গঙ্গার জল শুধু যে কলুষিত হয় তা নয়, জলপান করার ফলে শহরবাসীর মধ্যে অসুখবিসুখ ছড়িয়ে পড়ে।

গঙ্গাজলের মতো হিন্দুদের কাছে গরুও দেবতুল্য পূজ্য। সেই গরু ও তার বাছুর হিন্দু গোয়ালারা ভিন্ন জাতের লোকের কাছে বেচে দেয় জবাইয়েরই জন্য। এর প্রতিকার প্রয়োজন।

এই মর্মে গোপীমোহন ঠাকুর, গোপীমোহন দেব, রামদুলাল দে, রাধামাধব ব্যানার্জি ও হরিমোহন ঠাকুর স্বাক্ষরিত একটি আবেদনপত্র, লটারি কমিটির সেক্রেটারি ট্রটারকে লিখিত, কমিটির কার্যবিবরণের মধ্যে পাওয়া যায়। পত্রাংশ উদ্ধৃত হল :

To

A Trotter, Secretary to the Lottery Committee

 (Signed by) Gopee Mohun Tagore

 Gopee Mohun Deb

 Ram Dololl Day

 Radamadub Banerjee

 Hurry Mohun Tagore,

The Petition of the Principal Inhabitants of the town of Calcutta :

“It is notorious that all Hindoos bathe in and drink of the waters of the Ganges. Yet on the shores of the Sacred Stream are daily thrown by mathers, and other people of that description, many thousand baskets of Ordure and filth of all kinds which, when the tide reaches, are borne away, and cover a large portion of the surface of the River. Of the water thus polluted your Petitioners are obliged to drink, and they are fully warranted by experience in attributing much of the sickness which has prevailed among them…

“There are many Hindoos, Sellers of Cow’s milk, who disregardful of the purity and duties of their caste, do not confine themselves to the vending of milk, but also sell the cows to persons of other castes which, by Hindu Institution, they are expressly forbidden to do ; and what is still more opposed to these Institutions, when the cows bring for calves. they sell the latter to the Butchers…

“….the poor animals, deprived of their calves, roar about the neighbourhood for many days, and thus vex all the hearts of good Hindoos, knowing the cause by their cries and lamentations.”

ডেভিড হেয়ারের বাড়ি ও সম্পত্তি

ব্যাঙ্কশাল, হেস্টিংশ স্ট্রীট, চার্চ লেন অঞ্চলের উন্নয়নকালে (১৮২০-২১) ডেভিড হেয়ার তাঁর পরিকল্পিত গৃহের (হেয়ার স্ট্রীটে) শোভাবর্ধনের জন্য, লটারি কমিটির কাছ থেকে কিছু জমি কিনেছিলেন। মহানুভব হেয়ার সাহেব নিজের গৃহ-ভূসম্পত্তি সম্বন্ধে যে কতদূর সজাগ ছিলেন তা লটারি কমিটির কার্যবিবরণে তাঁর সম্পত্তির লেনদেনের বর্ণনা থেকে বোঝা যায়। কমিটির কার্যবিবরণ থেকে প্রাসঙ্গিক অংশগুলি উদ্ধৃত হল।

(কার্যবিবরণ, ২৩ নভেম্বর ১৮২০)

।। লটারি কমিটির সেক্রেটারিকে লিখিত গবর্ণমেণ্টের চীফ সেক্রেটারির চিঠি।।

“The G. G. in Council is not aware of any objection to the transfer to Mr. Hare of the narrow slip of grounds lying between the great tunnel that runs through the Bankshall premises and the ground which has been already pruchased by Mr. Hare on the north side of the new road, including the space indicated by the Committee on which some of Commodore Hayes’ outoffices at present stand.”

“It is understood that in consideration of the thansfer of this portion of ground to Mr. Hare, that gentleman will pay the amount of the compensation proposed to be granted to Commodore Hayes and will defray, the expense of re-building the outoffices alluded to by the Committee and that the transfer in question will further admit of such an arrangement of the building to be constructed by Mr. Mare on his own ground, as will be more ornamental to the new street than would otherwise be the case.”

ডেভিড হেয়ার জমির জন্য লটারি কমিটিকে মোট ৩৮৯৩৭ টাকা ১১ আনা ২ পাই দিয়েছিলেন। কমোডোর হেইসকে তাঁর অডিট-অফিসের জন্য কত টাকা হেয়ার সাহেব ক্ষতিপূরণ দিয়েছিলেন তার উল্লেখ কমিটির কার্যবিবরণে নেই, থাকার কথা নয়।

(কার্যবিবরণ, ২৭ সেপ্টেম্বর১৮২১)

।। সাব-ট্রেজারের কাছে কমিটির সেক্রেটারির চিঠি।।

“I am directed by the Lottery Committee to transmit to you the accompanying sum of sicca rupees thirty-eight thousand nine hundred and thirty-seven, eleven annas and two pies, received from Mr. David Hare, in payment of ground sold to him in the vicinity of the Bankshall and to request that you will carry the sum to the credit of the Lottery Committee in their account with the General Treasury.”

ভাঙ্গা খোয়া। পাকা রাস্তা

(কার্যবিবরণ, ৭ সেপ্টেম্বর ১৮২০)

উনিশ শতকের কলকাতা শহরে পাকা রাস্তা বলতে ইটভাঙা খোয়ার রাস্তাই বোঝাত। তখন ইট বা পাথর ভাঙ্গার কোনো যন্ত্র ছিল না। দরিদ্র মজুররা হাতের হাতল দিয়ে ইট ভেঙে খোয়া করত। সেই খোয়া দিয়ে পাকা রাস্তা তৈরি হত। ১৮১৪-১৬ সালের রাস্তা মেরামতের (for repairs of roads) রিপোর্টে দেখা যায় যে প্রত্যেক বছরে ১২০ লক্ষ ইট প্রয়োজন হত মেরামতের জন্য, তার মধ্যে ৮০ লক্ষ ইট ভেঙে খোয়া তৈরি করা হত। যারা ইট ভেঙে খোয়া তৈরি করত তারা কত মজুরি পেত? তার হিসেব লটারি কমিটির কার্যবিবরণে আছে (৭ সেপ্টেম্বর ১৮২০) :

২ টাকা ১০০ ফেরার (Ferrah) জন্য

১ ফে = ৩৬ খানা ১১ ইঞ্চি ইট, অর্থাৎ

২ টাকা ৩৬ × ১০০ = ৩৬০০ ভাঙার জন্য

মজুর লাগিয়ে এইভাবে ইট ভাঙানো দুরূহ কাজ। এই কারণে লটারি কমিটির ইঞ্জিনিয়ার একটি স্মারকপত্রে (২ মে, ১৮২০) এবিষয়ে কয়েকটি প্রস্তাব পেশ করেন :

খোয়াভাঙা যন্ত্র যদি কেউ তৈরি করতে পারেন, তাহলে তাঁকে ১০০০ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।

খোয়া যে ইট ভেঙে তৈরি হয় সেই ইট ছাঁচ থেকে ইংরেজি ফ্যাশানে হয়। ইংরেজি কায়দায় তৈরি ইট খুব ভারি হয় বলে তা থেকে খোয়া করা খুব কঠিন। তার চেয়ে এখানকার দেশীয় প্রথায় যে ইট হয় তা অনেক পাতলা ও হালকা, সহজে পোড়ানো যায় এবং অনেক বেশি মজবুত হয়। ইংরেজ ইঞ্জিনিয়ারের উক্তি :

“The Koah is made from Bricks formed in moulds after the English fashion, which also addes to the expense it .would be equally well, if the better, made from brick used by the natives, which for their thinness are more easily burnt, and consequently more durable than those made in the English mode.”

১ ধর্মতলা-ওয়েলিংটন সংযোগস্থলের একাংশের প্রাচীন নাম।
১ বর্তমান ‘ক্রিক রো’ রাস্তা বরাবর খালের নাম।
১ স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে কমিটি কিনেছিলেন ১৫০ টাকা কাঠা মূল্যে।
১ প্রত্যেক কুলির মাসিক মজুরি ৩ টাকা ৮ আনা।
১। বর্তমান ক্রীক রো
২। পরিষ্কার বোঝা যায়, এই নতুন ট্যাঙ্ক স্কয়ারটি কলেজ স্কয়ার বা গোলদীঘি।
১। অর্থাৎ পটুয়াটোলা লেন।
২। ঠনঠনিয়া স্ট্রীট।
৩। ‘সীতারাম ঘোষ স্ট্রীট’ নামে রাস্তা আছে। গয়ারাম হয়ত সীতারামের ডাকনাম অথবা তাঁর পূর্বপুরুষের নাম হতে পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *