১.৩ শিরবেদের কাল চলে গেল

কতজন শিরবেদের কাল চলে গেল, সে জানেন কালপুরুষ। সে কি, মনে রাখার সাধ্য মানুষের? তবে মূল শিরবেদে ছিল বিশ্বম্ভর। তার নামটাই মনে আছে বেদেদের, বলেআদিপুরুষ বিশ্বম্ভর। বেদেকুলে জন্ম নিয়েছিলেন স্বয়ং শিব।

নিজে বিষ খেয়ে বিশ্বম্ভর পৃথিবীকে দেন অমৃত। ঢুলুঢুলু করে তাঁর চোখ। শিরবেদে বিশ্বম্ভরের সঙ্গে তাঁর মিল অবিকল। এই বিশ্বম্ভরই জাতি কুল ঘর দুয়ার নিয়ে সাঁতালী গাঁয়ের পত্তন করেছিল। মায়ের অজ্ঞাতে আবার বিয়ে করেছিল বুড়া বয়সে। সন্তান হল, কালো মেঘে ঢাকা চাঁদের মত সন্তান। কিন্তু কই? কালনাগিনী যে বলেছিল, সে আসবে বেদেকুলে কন্যে হয়ে—সে এল কই? কন্যে না হয়ে এ যে হল পুত্তুসন্তান! শিরবেদে বিশ্বম্ভর দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে; কিন্তু বেদেদের বিধাতা হাসলেন। বিশ্বম্ভরের ছেলে, বার বছর বয়স তখন, দেখে মনে হয় ষোল বছরের জোয়ান ছেলে। সাপ ধরে মাছের মত। গাছের উপর চড়ে তেড়ে ধরে বাঁদর। তেমনি তার ভেলকিবাজিতে হাত-সাফাই। তাকে পাশে নিয়ে শিরবেদ একদিন বসে ওই কথাই ভাবছে, এমন সময় এল কালো পাতলা এক তিন বছরের মেয়ে গামছা পরে ঘোমটা দিয়ে বউ সেজেছে; এসে দাঁড়াল সামনে, বিশ্বম্ভর হেসে বললে—কে গো? তুমি কাদের বউ? মেয়েটি পড়শীর মেয়ে, নাম দধিমুখী, সে ঘোমটা খুলে বিশ্বম্ভরের ছেলেকে দেখিয়ে বললে—উর বউ আমি। উকে বিয়ে করব; বিশ্বম্ভরের ভাবনা ভেসে গেল আনন্দের ঢেউয়ে। বললে—সেই ভাল। তুই হবি আমার বেটার বউ। বিশ্বম্ভরের যে কথা, সেই কাজ। ধুমধাম করে বিয়ে দিলে ছেলের। কিন্তু সাত দিন যেতে না যেতে নাগদংশনে মরল সে ছেলে। বিশ্বম্ভর চমকে উঠল। বেটার জন্যে কদল না, চোখ রাখলে দধিমুখীর উপর। ষোল বছর যখন ওই বিধবা কন্যটির বয়স হল, কন্যেটির মা-বাপে আবার বিয়ে দেবার উদ্যোগ করছে, তখন একদিন, এমনি বিষহরির পূজার দিনে শিরবেদে চিৎকার করে উঠল—জয় বিষহরি!

তার ঢুলুঢ়ুল চোখের দৃষ্টিতে দেখতে পেয়েছে ওই কন্যের কপালে নাগচক্র। তার মুখখানাকে দু হাতে ধরে একদৃষ্টে দেখে বলল। হঁ। হঁ। হঁ।

—কি?

–না-গ-চ-ক্ক।

–কই?

–কন্যের ললাটে।

বারবার ঘাড় নেড়ে বলে উঠেছিল—এইজন্যে এইজন্যে এই একে দিবে বলেই মা মোর বলি নিয়েছে কালাচাঁদকে।

তারপর চেঁচিয়ে উঠল—বাজা বাজা বাঁশি বাজা, বিষম-ঢাকি বাজা, চিমটে বাজা। ধূপ আর ধুনা আন, পিদিম আনু, দুধ আনু, কলা আন্, মা-বিষহরির বারি তো আটনে। আল্ছে আছে, যে বাক্ দিয়েছিল, সে আছে।

পাড়ায় তখন তিন ঘর বেদে। সে সেই প্রথম সাঁতালী পত্তনের কালের কথা।

তারপর কত শিরবেদের আমল গেল, সে ওদের মনে নাই। বলে—সে জানেন এক কালপুরুষ।

মনে আছে তিনজন শিরবেদের কথা।

* * *

শিবরাম কবিরাজ বলেন—মহাদেব শিরবেদেকে প্রথম দেখেছিলাম গুরু ধূর্জটি কবিরাজের সঙ্গে সাঁতালীতে গিয়ে। তারপর ওরা এল গুরুর আয়ুর্বেদভবনে। ওখানে ওরা আসত আশ্বিনের প্রথমে। গঙ্গার ঘাটে বেদেদের নৌকা এসে লাগত। ওদের রুখু কালো চুল, চিকন কালো দেহবর্ণ, গলায় মাদুলি—তার সঙ্গে পাথর জড়িবুটি, ওদের মেয়েদের বিচিত্র রূপ, ওদের গায়ের গন্ধ বলে দিত ওরা বিষবেদে। ওদের নৌকার গড়ন, নৌকায় বোঝাই সাপের ঝাঁপির থাক্‌, এক পাশে বাধা ছাগল, মইয়ের মাথায় খুঁটিতে বাঁধা বাঁদর–-এসব দেখলেই গঙ্গার তীরভূমির পথিকেরা থমকে দাঁড়াত। বলত–বেদে। বিষবেদের নৌকা।

ধূর্জটি কবিরাজ মহাশয়ের আয়ুর্বেদভবনে গম্ভীর গলায় জয় বিষহরি হাঁক দিয়ে এসে দাঁড়াত বেদেরা। সকলের আগে থাকত মহাদেব।

জয় বিষহরি হাঁক দিয়েই আবার হক দিতজয় বাবা ধন্বন্তরি। তারপরই হাতের বিষম ঢাকিতে টোকা মেরে শব্দ তুলত—ধুন-ধুন! তুমড়ি—বাঁশিতে ফুঁ দিত–পুঁ-উঁ-উঁ! পুঁ-উঁ-উঁ-উঁ! চিমটের কড়া বেজে উঠত ঝনাৎ-ঝন!

সৌম্যমূৰ্তি আচার্য বেরিয়ে এসে দাঁড়াতেন প্রসন্ন মুখে; স্মিতহাসি ফুটে উঠত অধরে, সমাদর করেই তিনি বলতেন—এসেছ!

হাত জোড় করে মহাদেব বলত–যজমানের ঘর, অন্নদাতার আঙুনে, প্রভু ধন্বন্তরি বাবার আটন, এখানে না এস্যা যাব কোথা? অন্ন দিবে কে? বাবা ধন্বন্তরি, আপনার পাথরের খল ছাড়া এ গরলই বা ফেলাব কোথা? একে সুধা করবে কে শোধন করে? জলে ফেলি তো জীবনাশ, মাটিতে ফেলি তো নরলোকের সব্বনাশ। আপুনি ছাড়া গতি কোথা, বলেন!

* * *

মহাদেব শিরবেদে যেন এক ঘন অরণ্যের ভিতরের অটুট একটা পাথরের দেউল। কোন্ পুরাকালে কোন সাধক তার ইষ্টদেবতার মন্দির গড়েছিল,–বড় বড় পাথরের চাইয়ে গড়া মন্দির, কারুকার্য নাই, পলস্তারা নাই, এবড়োখেবড়ো গড়ন–যুগযুগান্তরের বর্ষায় গায়ে। শ্যাওলা ধরেছে, তার উপর গাছের ফাঁকে ফাঁকে রোদ পড়ে শ্যাওলার সবুজে সাদা খড়ির দাগ পড়েছে, আরও পড়েছে গাছের পল্লব থেকে শুকনো পাতার গুঁড়ো—শুকনো ফুলের রেণু। বাতাসে বনের তলার ধুলো উড়িয়েও তাকে ধূলিধূসর করে তুলেছে। গলায় হাতে জড়িবুটি মালা দেখে মনে হয় যেন দেউলের গায়ে উঠেছে বুনো লতার জাল। মাথায় অ্যাঁকড়া চুল দেখে মনে হয়, দেউলটার মাথায় বর্ষায় যে ঘাস গজিয়েছিল–সেগুলো এখন শুকিয়ে শক্ত সাদা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

শিবরাম ওকে প্রথম দেখেছিলেন–হিজল বিলের ধারে সাঁতালী গাঁয়ে গিয়ে। গুরুর সঙ্গে নৌকা করে গিয়েছিলেন বিষ কিনতে। দেখে এসেছিলেন ওদের গ্রাম, ওদের ঘর, মা-বিষহরির আটন, হিজলের বিল, ওদের নাগিনীকন্যা শবলাকে। শুনে এসেছিলেন ওদের ভাসান-গান, ওদের বাজনা। নাগিনী কন্যের দুলে দুলে পাক দিয়ে নাচন, বারি মাথায় করে ভরণ–দেখে এসেছিলেন। আর দেখে এসেছিলেন কত রকমের সাপ। কত চিত্ৰবিচিত্র দেহ, কত রকমের বর্ণ, কত রকমের মুখ! তুলতে পারেন নাই। বিশেষ করে ওই কালো কন্যে আর ওই খাড়া সোজা পাথরের দেউলের মত বৃদ্ধকে।

আবার হঠাৎ আশ্বিনের শেষে একদিন দেখলেন।

শিবরাম কিবরাজই এই কাহিনীর বক্তা। প্রাচীন সৌম্যদর্শন মানুষটি বলে যান এই কাহিনী। বিষবৈদ্যদের এ কাহিনী অমৃত-সমান নয়, বিষ-বেদনায় সকরুণ।

আশ্বিনের শেষ। শরতের শুভ্র রৌদ্র হেমন্ত-সমাগমে ঈষৎ পীতাভ হয়েছে। শিবরাম কবিরাজ বলে যান।

 

শহরে গুরুর ঔষধালয়ে রোগীর ভিড় জমেছে, বসে আছে সব! রাস্তার উপর গরুর গাড়ি, ড়ুলি-পালকির ভিড়, দূর-দূরান্তর থেকে রোগী এসেছে। ঘরের মধ্যে বসে গুরু চোখ বুজে একে একে নাড়ি পরীক্ষা করছেন, উপসর্গের কথা শুনছেন, ব্যবস্থা দিচ্ছেন, আমি পাশে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ বাইরে ঝনাৎ-ঝন ঝনাৎ-ঝন শব্দ উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ভারী গলায় কেউ বললে জয় মা-বিষহরি! পেন্নাম বাবা ধন্বন্তরি। তার কথা শেষ হতে না-হতে বেজে উঠল বিষম-ঢাকি ধুমধুম-ধুমধুম! তারই সঙ্গে বেজে উঠল একঘেয়ে সরু সুরে তুমড়ি-বাঁশি-পুঁ-উঁ-উঁ–উঁ-উঁ-উঁ!

গুরু বারেকের জন্যে চোখ খুলে বললে—মহাদেবের দল এসেছে, অপেক্ষা করতে বল।

বেরিয়ে এলাম। দেখলাম, কাঁধে সাপের ঝাঁপির ভার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাঁতালী গাঁয়ের বেদের দল। তাদের সবার সামনে দাঁড়িয়ে আছে খাড়া সোজা শক্ত পেশিবাধা-দেহ বুড়ো মহাদেব শিরবেদে। আর তার পাশে সেই আশ্চর্য কালো বেদের মেয়ে—শবলা। নাগিনী কন্যে। আশ্বিন মাসের সকালবেলার রোদ, বার মাসের মধ্যে উজ্জ্বল রোদ, দু-মাস বর্ষার ধারায় স্নান করে কিরণের অঙ্গে তখন যেন জ্যোতি ফোটে, সেই রোদের ছটা ওই কালো মেয়ের অঙ্গে পড়েছে—তার অঙ্গ থেকেও কালো ছটা ঝিলিক মারছে। শুধু মাথার চুল রুখু—সকালবেলার বাতাসে এলোমেলো হয়ে গোছা গোছা উড়ছে। পরনে তার টকটকে রাঙা শাড়ি, গাছকোমর বেঁধে পরা।

বললাম—বস নোমরা, কবিরাজ মশায় আসছেন।

মহাদেব বললে তুমারে চিনি-চিনি লাগছে যেন বাবা? কুথা দেখলম গ তুমাকে?

শবলা হেসে বললে—লজর তুর খাটো হছে বুড়া। মানুষ চিনতে দেরি লাগছে। উটি সেই বাবার সাথে আমাদের গাঁয়ে গেছিল, বাবার সাকরে বটে, কচি-ধন্বন্তরি।

শিবরাম বলেন—বেদের মেয়ের বাক্যে যত বিষ তত মধু, শবলা আমার নাম দিয়েছিল কচি-ধন্বন্তরি।

খিলখিল করে হেসে শবলা বলেছিল মহাদেবকে নামটি কেমন দিলম রে বুড়া? অ্যাঁ? মহাদেব রূঢ় হয়ে উঠল, বললে—হুঁ!

* * *

ভদ্রের শেষে শেষ নাগপঞ্চমীতে মা-বিষহরির পুজো শেষ করে ওদের সফর শুরু হয়। সাঁওতালেরা যেমন বসন্তকালে শালগাছে কচি পাতা বের হলে শিকারে বের হয়, সেকালে শরৎকালে বিজয়া দশমী দশেরা সেরে যেমন রাজারা দিগ্বিজয়ে বের হতেন, বণিকেরা যেমন বের হতেন ডিঙার বহর ভাসিয়ে বাণিজ্যে, আজও যেমন গাড়িবোঝাই করে ছোট দোকানিরা মেলা ফিরতে বের হয়, তেমনি বিষবেদেরাও বের হয়–তাদের কুল-ব্যবসায়ে। হাঙরমুখী, কুমিরখালা, হাঁসখালি বেয়ে সারি সারি বিষবেদেদের নৌকা এসে পড়ে মা-গঙ্গার জলে। নৌকাতে সাপের কাঁপি, রান্নার হাড়ি, খেলা-দেখাবার বদর-ছাগল আর মানুষ। শুধু বিষবেদেরাই নয়—অন্য অন্য যারা জাতবেদে তারাও বের হয়। কতক নৌকায়, কতক হাঁটাপথের কাঁধে। এই সফর ওদের কুলপ্রথা, জাতিধর্ম। বর্ষা গিয়েছে, কত পাহাড় বন ভাসিয়ে কত জল বয়ে গিয়ে পড়েছে সাগরে, কত দেশ ভেসেছে, কত দেশের কত সাপ, কত গাছ, কত গাছের বীজ, কত জন্তু, কত মানুষ ভেসেছে তার সঙ্গে, তার কতক বলি নিয়েছেন মহাসাগর, কতক ভেসে কূল নিয়েছে—ডাঙায় উঠেছে। গাছের বীজ আগামী বারের বর্ষার অপেক্ষা করে আছে, সেই বর্ষায় ফেটে অঙ্কুর হয়ে মাথা তুলবে। সাপ গর্তে বাসা নিয়েছে, সে অপেক্ষা করে আছে কবে কোন সাপিনীর অঙ্গের কাঁঠালীচাপার সুবাস পাবে। সাপিনী অপেক্ষা করে আছে—তার অঙ্গে বাস কবে বের হবে, সে সুবাসের আকর্ষণে আসবে কোন্ সাপ! সেই সব সাপ-সাপিনী মাঠে মাঠে বা নদী-নালার কূলের গর্তে গর্তে সন্ধান করে ধরতে বের হয়। দেশ-দেশান্তর ঘোরে, বাধা কবিরাজ মোয়দের ঘর আছে, সেইখানে গিয়ে তাদের চোখের সামনে কালনাগিনীর বিষ গেলে বিক্রি করে; গ্রামে গ্রামে গৃহস্থদের ঘরে ঘরে খেলা দেখায় সাপের নাচন, ছাগল-বদরের খেলা। দেখিয়ে দেখিয়ে চলে এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রাম, এক জেলা থেকে আর এক জেলা-মাসের পর মাস কেটে যায়, তারপর একদিন আবার ঘরের দিকে ফেরে। বিষবেদেরা চলে নৌকায়—জলে জলে, গঙ্গা থেকে ঢেকে অন্য নদীতে, চলে আসে। কলকাতা শহর পর্যন্ত, সেখানে সাহেবান লোকের নতুন শহর গড়ে উঠেছে, বড় বড় আমীর বাস। করে, অনেক কবিরাজও আছেন। সেখানেও বিষ বিক্রি করে, তারপর শীত বেশ গাঢ় হয়ে পড়তেই ফেরে। গাঙের জল কমে আসছে, হিজল বিলের ধারে জল শুকিয়ে পাক জেগেছে। চারিপাশে এর পর কুমিরখালায় হাঙরমুখীতে জল মরে শুকিয়ে আসবে, তখন আর নৌকা নিয়ে সাঁতালী গাঁয়ের ঘাটে গিয়ে ওঠা যাবে না। তার ওপর শীতে নাগ-নাগিনী কাতর হয়েছে, জর-জর হয়েছে হিমেল দেহখানি, চোখ হয়েছে ঘোলা, মাথা তোলার শক্তি নাই, আর শিস মেরে মাথা তুলে নাচতে পারে না। খোঁচা দিলে অল্প ফোঁস শব্দ করে একটু পাক খেয়ে নিথর হয়ে যায়। বিষবেদের মন কাতর হয়—মা-বিষহরির সন্তান, তাদের মেরে ফেলতে ওরা চায়। না, ওরা তাদের ছেড়ে দেয় নদীর নির্জন কূলে, অথবা পতিত প্রান্তরে, বনে কিংবা জঙ্গলে। বলে দেয়—স্বস্থানে যা। মা তোকে রক্ষে করুন। সাপদের মুক্তি দিয়ে খালি ঝাঁপি নিয়ে শহরে বাজারে কিনে-কেটে ফেরে সাঁতালীতে। শুধু তো খালে-বিলে জলই শুকায় নাই, গাঙের চরে, বিলের চারিপাশে কাশবনে ঘাস পেকেছে। সেই ঘাস কাটতে হবে, শুকুতে হবে, ঘরগুলি ছাইতে হবে কাশ দিয়ে। তা ছাড়া, হিজলের চারিপাশে এতদিনে চাষীরা এসে গিয়েছে। লাঙল দিয়ে চষে বুনে দিয়েছে গম যব ছোলা মসুর মটর সরষে। সবুজ হয়ে উঠেছে চারিধার। হিজলের চারিপাশে বার মাসই সবুজ, কিন্তু এ সুবজ যেন আলাদা সবুজ। এ সবুজে শুধু রঙ নাই, রঙে রসে একাকার। ফসল তোলার সময় ফসল কুড়িয়ে ওরা ঘরে তুলবে। তা ছাড়া, মাঘ মাস থেকে পড়বে সব সাদি-সাঙার হিড়িক। সাঁতালীতে ছ মাস জল, ছ মাস স্থল। স্থল না জাগলে সাদিসাঙা হয় কি করে? তা ছাড়া, ঝাঁকে ঝাঁকে এসেছে হাজার হাঁস। তারা আকাশে উড়ছে আর ডাকছে–প্যাঁক-প্যাক-কাও-ক্যাও—কিচ কিচক-কল্‌-কল্‌-কল্।

তারা ওদের ডাক পাঠায়।

শীতের শুরুতে নায়ের মাথায় বুনো হাঁস পাক খেয়ে ডাক মেরে গেলেই শিরবেদের হুকুম হয়—ঘুরায়ে দে লায়ের মুখ। চল্ সাঁতালী। সাঁতালী!

নাগপঞ্চমীতে সাঁতালী থেকে বেরিয়ে ঘুরতে ঘুরতে মহাদেবের দল এসে লা বেঁধেছে। শহরে। প্রথমেই ধন্বন্তরি বাবার বাড়িতে বিষ না দিয়ে ওরা আর কোনোখানে বিষ বেচে না। ধূর্জটি কবিরাজের খ্যাতি তার প্রধান কারণ তো বটেই, কিন্তু আরও কারণ আছে। বাবার মত আদর ওদের কেউ করে না। বাবার মত সাপ চিনতে ওস্তাদ ওদের চোখে পড়ে নাই।

লা—অর্থাৎ নৌকাগুলি বেঁধেছে শহরের প্রান্তে। গঙ্গার কূলে বেশ একটি পরিষ্কার পতিত জায়গা, তার উপর গুটি তিনেক বড় বড় গাছ। সেই গাছগুলির শিকড় কূলের ভাঙনের মধ্যে আঁকাবাঁকা হয়ে বেরিয়ে আছে, তাতেই বেঁধেছে নৌকার দড়ি। বটগাছের তলাগুলি যথাসাধ্য পরিষ্কার করে নিয়ে পেতেছে গৃহস্থালি। ডালে ঝুলিয়েছে শিকে-তাতে রয়েছে রান্নার হাড়ি। তার পাশেই শিকেতে ঝুলছে সাপের কাঁপি; তলায় পেতেছে উনান, তার পাশে খেজুরের চাটাই বিছিয়ে দিয়েছে, ঘাসের উপর শুকাচ্ছে ভিজে কাপড়, শিকড়ে বেঁধেছে ছাগল আর বাঁদর। বাচ্চারা ধুলোয় হামা দিয়ে বেড়াচ্ছে নগ্নদেহে, নাকে পেঁটা গড়িয়ে এসেছে—মুঠোবন্দি মাটি নিয়ে খাচ্ছে, মুখে মাখছে। অপেক্ষাকৃত বড়রা গায়ে ধুলো মেখে ছুটে বেড়াচ্ছে; তার চেয়ে বড়রা শুকনো কাঠ-কুটা কুড়িয়ে ঘুরছে—কেউবা গাছের ডালে উঠে দোল খাচ্ছে। সবল বেদেরা বেরিয়েছে তাদের পসরা নিয়ে। সঙ্গে তাদের যুবতী বেদিনীর দল।

ধূর্জটি কবিরাজ এসে দাঁড়ালেন। হাস্যপ্রসন্ন মুখে স্নেহস্মিতকণ্ঠে সমাদর জানিয়ে বললেন এসেছ মহাদেব!

হাত জোড় করে মহাদেব বললে—এলম বাবা। যজমানের ঘর, অন্নদাতার আঙন, ধন্বন্তরির আটন, হেথাকে না এস্যা যাব কুথাকে বাবা? বিষবেদের সম্বল বাবা, লাগের বিষ মানুষের রক্তে এক ফোটা লাগলে মিত্যু; হলাহল—গরল, এ বস্তু এক শিব ধারণ করেছেন গলায়, আর ধারণ করতে পারে বাবা ধন্বন্তরির পাথরের খল। আপনকার খল ছাড়া এ ফেলব কুথা গো? জলে ফেললেজলের জীব মরে, থলে ফেললে নরলোকের হয় সৰ্ব্বনাশ! এক আপুনিই তো পারেন এরে শোধন করে সুধা করতে।

এগুলি পুরুষানুক্রমিক বাধা বুলি ওদের।

কবিরাজের উদ্দেশে সকলেই মাথা মাটিতে ঠেকিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করেপেনাম বাবা।

কবিরাজ হেসে সকলেরই কুশল জিজ্ঞাসা করেন।

তারপর প্রশ্ন করেন–মায়ী শবলা, তুই এত চুপচাপ কেন রে বেটি?

দাঁত বের করে তিক্তস্বরে মহাদেব কুটিল হয়ে উঠল একমুহূর্তে, বললে—তাই শুধান বাবা, তাই শুধান। আমারে কয় কি জানেন? কয়—বুড়া হছিস, তুর লজর গেছে। কানে খাটো হছি, চেঁচায়ে গোল না করলে চুপচাপ ভাবিস; ভাবান্তর দেখিস। লাগিনী জরেছে বাবা, খোলস ছাড়বে।

কালনাগিনী চকিতের জন্য যেমন ফণা তোলে তেমনিভাবেই শবলাও একবার সোজা হয়ে উঠল। মনে হল, ছোবল মারার, মত বুড়াকে আক্রমণ করে কিছু বলবে; কিন্তু পরক্ষণেই একটু হেসে শান্ত হয়ে মাথা নামালে, বললে—বাবা গো, লাগিনী যখন শিশু থাকে, তখন কিলবিল কর্যা ঘুরে বেড়ায়; ঘাসের বনে বাতাস বইলে পর, তা শুনেও হিস কর্যা ফণা তুলে দাঁড়ায়। বয়স বাড়ে বাবা, পিথিমীর সব বুঝতে পারে, সাবধান হয়। মানুষ দেখলি, জন্তু দেখলি সি তখন ফোঁস করা মাথা তুলে না বাবা চুপিসাড়ে পলায়ে যেতে চায়। নেহাত দায়ে পড়লি পর তবে ফণা তুলে বাবা। তখন আক্কেল হয় যি, মানুষ সামানি লয়। মানুষকে কামড়ালি পরে লাগের বিষে মানুষ মরে, কিন্তু মানুষ তারে ছাড়ে না, লাঠির ঘায়ে মারে; মারতে না পারলি বেদে ডাকে। বেদে তারে বন্দি করে, বিষৰ্দাত ভাঙেনাচায়। সে মরণের বাড়া। তার উপর বেদের হাতের জ্বালা বড় জ্বালা বাবা! তাই বোধ হছে বাবাবেদের ঝাঁপির লাগিনী, অঙ্গের জ্বালায় জরেছি; ওই হল মরণ-জরা।

শবলা হাসলে। কথাগুলির মধ্যে প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ ছিল যেমন, তেমনি ছিল আরও কিছু। বুঝতে ঠিক পারলাম না, শুধু অ্যাঁচ পেলাম।—শিবরাম বললেন। গুরু রোগী দেখেন যেমন করে তেমনি করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন শবলার মুখের দিকে। তারপর বললেন—শবলা বেটি আমার সাক্ষাৎ নাগিনী কন্যা।

মহাদেব বলে উঠল–হঁ বাবা। গর্তের মধ্যি থাকে, খোঁচা খেলে ফেঁসায় না, পথের পাশে লুকায়ে থাকে, মানুষ তো মানুষ, বেদের বাপের সাধ্য নাই যে ঠাওর করে। ফাঁক খোঁজে কখন দংশাবে, রাগ চেপে রোষ চেপে পড়ে পড়ে ফাঁক খোঁজে।

তার পাকা দাড়ি-গোঁফের মধ্যে থেকে আবার বের হল দুপাটি বড় বড় দাত; হাসলে মহাদেবকে ভয়ঙ্কর দেখায়;—বয়সের জন্য বড় বড় দাঁতগুলি মাড়ি থেকে ঠেলে উঠে আরও বড়। দেখায়, লাল-কালো ছোপ-ধরা বড় বড় দাত; তার মধ্যে দু-তিনটে না থাকার জন্য ভয়ঙ্কর দেখায় বেশি।

–হঁ রে বুড়া ঘঁ। সব অপরাধ লাগিনীর। সে তো জনমদোষিনী রে! মানুষের আয়ু ফুরায়ে। যায়, নেয়তের লিখন থাকে, যম লাগিনীরে কয়—তুর বিষে মরণ দিলাম মিশায়ে, যা তু উরে ডংশায় আয়; লাগিনী যমের কেনাদাসী; আজ্ঞে লঙ্ন করতে পারে, ডংশায়, মানুষটা মরে, অপরাধ হয় লাগিনীর। পথে ঘাটে বনে বাদাড়ে হতভাগিনীরা ঘুরে বেড়ায়, মানুষ মাথায় দেয়। পা, পুচ্ছে দেয় পা, লাগিনী কখনও রাগের বশে, কখনও পরানের দায়ে, কখনও পরানের ডরে তারে ডংশায়। অপরাধ হয় লাগিনীর!

হাসলে শবলা, সেই বিচিত্ৰ হাসি, যে হাসি সে এর আগেও একবার হেসেছিল। তারপরে বললে—লে লে বুড়া, কথার প্যাচ গুয়ে বাবারে সাপগুলান দেখা। বাবার অনেক কাজ। তুর আমার খেল, এ আর উনি কি দেখবেন? তু আমারে খোঁচা দিলে আমি তুরে ছোবল মারব, দাঁত ভাঙবি, ফের গজাবে সে দাঁত। কুনোদিন যদি তুর অঙ্গে বিধে, আর নিয়ত যদি লিখে থাকে যি—ওই বিষেই তুর মরণ হবে, তবে তু মরবি। লয় তো মুই মরব তুর হাতের পিরশের জ্বালায়, তুর লাঠির খোঁচায়, তুর জড়িবুটির গন্ধে। লে, এখন সাপগুলান দেখা, বিষ গেলে দে, দিয়া চল্ ফিরে চন্।

ধূর্জটি কবিরাজ বললেন—সেই ভাল। তুমি শিরবেদে, তুমি বাপ শবলা নাগিনী কন্যে, তোমার বেটি, বাপ-বেটির ঝগড়া তোমাদের মিটিয়ে নিয়ো।

 

সাপের বিষ গেলে নেওয়া দেখেছ?

আজকাল বিজ্ঞানের যুগে নানা কৌশল হয়েছে। কাচের নলের মধ্যে বিষ গেলে জমা করা। হয়, চমৎকার সে কৌশল। কিন্তু বেদেদের সেই আদি কাল থেকে এক কৌশল। তার আর অদলবদল হয় না। বদলের কথা বললে হাসে।

তালের পাতা আর ঝিনুকের খোলা। যে ঝিনুক পুকুরে মেলে সেই ঝিনুক। তালের পাতা ধনুকের ছিলার মত ঝিনুকের গায়ে টান করে বেঁধে ধরে একজন, আর একজন সাপের চোয়াল টিপে হাঁ করিয়ে ধরে। ঝিনুকটা দেয় মুখের মধ্যে পুরে, বিষদাঁত দুটি বিঁধে যায় ওই তালপাতার বাঁধনে। তালপ তার ধারালো করকরে প্রান্তভাগের চাপ পড়ে বিষের থলিতে, ওদিকে বিষদাঁত বিঁধে থাকার স্বাভাবিক ক্রিয়ায় পাঁতের নালী বেয়ে বিষ টপটপ করে পড়ে ওই ঝিনুকের খোলায়। এমনই কৌশল ওদের যে বিষের শেষ বিন্দুটি পর্যন্ত ঝরে পড়বে। তারপর সাপটা যায় ঝাপিতে, ঝিনুকের বিষ যায় সরষের তেলে ভরা কবিরাজের পাত্রে। জলের উপর তেলের মত, তেলের উপর বিষ ছড়িয়ে পড়ে ভাসে। না হলে বাতাসের সংস্পর্শে জমে যায় বাবা।

শিবরাম গল্প বলে যান—আমার সম্মুখেই আমাদের বিষ নেওয়ার পাত্র। বেদের দলের সামনে বসে মহাদেব, তার পাশে বাঁ-দিকে শবলা—শিরবেদে আর নাগিনী কন্যা, পিছনে বেদেরা। বেদেরা হাঁড়ি এগিয়ে দেয়—মহাদেব হাঁড়ির মুখের সরা খুলে সাপ বের করে। জেলেরা যেমন মাছ ধরে, সে ধরা তেমনিভাবে ধরা বাবা। এক হাতে মাথা, এক হাতে লেজ ধরে প্রথমটা গুরুকে দেখাচ্ছিল, গুরু লক্ষণ দেখে সাপ চিনে নিচ্ছিলেন। কালো রঙ হলেই হয়। না, কালো সাপের মধ্যেই কত জাত। কালো সাপের গায়ের দিকে চাইলে দেখতে পাবে, তার। মধ্যে সুচের ডগায় আঁকা বিন্দুর মত সাদা ফুটকি। ফণার নিচে গলায় কারও বা একটি, কারও বা দুটি, কারও বা তিনটি মালার মত সাদা-কালো বেড়। কারও বা মধ্যের দাগটি চাপা ফুলের। রঙ। ফণায় চক্ৰচিহ্ন, তাও কত রকমের। কারও চক্র শঙ্খের মত, কারও বা পদ্মের কুঁড়ির মত, কারও বা মাথায় ঠিক একটি চরণচিহ্ন। কারও কালো রঙ একটু ফিকে, কারও রঙের উপর রোদের ছটা পড়লে অন্য একটা রঙ ঝিলিক দেয়।

গুরু বলেছিলেন-কালনাগিনী হবে শুধু কালো। সুকেশী মেয়ের তৈলাক্ত বেণির মত কালো মাথায় থাকবে নিখুঁত চরণ-চিহ্নটি। বাকি যা দেখ বাবাও সব হল বর্ণ সঙ্কর। কালনাগিনীর নাগ নাই, শঙ্খনাগ সন্ততি দিয়েছে, তার মাথায় শঙ্খচিহ্ন; পদ্মনাগ দিয়েছে পদ্মকলি চিহ্ন আপন আপন কুলের ছাপ রেখে গেছে বাবা। ওই ছাপ যেখানে দেখবে সেখানে বুঝবে, ওর স্বভাবে ওর বিষেসবেই আছে পিতৃকুলের ধারা। সাবধান হবে বাবা। এদের বিয়ে ঠিক কাজ হয় না।

থাক, ওসব কথা থাক। ওসব আমাদের জাতিবিদ্যার কথা।

এক টিপ নস্য নিয়ে নাক মুখে শিবরাম বলেন—মহাদেবের ধূর্জটি কবিরাজকে না-জানা। নয়, তবু ওর জাতি-স্বভাবগত বোলচাল দিতে ছাড়লে না। এক-একটি সাপ ধরে তাঁর সামনে দেখাতে লাগল।

এই দেখেন বাবা! গড়নটা দেখেন আর বরনটা দেখেন। চিকচিকে কালো। এই দেখেন চক্কটি দেখেন। লেজটি দেখেন।

উঁহুঁ। ওটা চলবে না মহাদেব। ওটা রাখ।

–কেনে বাবা? ই তো খাঁটি জাত।

–না ওটা রাখ তুমি।

শবলা বলছিলরা বুড়া রাখ। ইখানে তু জাতিস্বভাবটা ছাড়। কারে কি বুলছিস?

মহাদেব রাখলে সে সাপ, কিন্তু অগ্নিদৃষ্টি হেনে শবলাকে বললে—তু থাম্।

শবলা হাসলে।

ধূর্জটি কবিরাজ দেখেশুনে বেছে দিলেন পাঁচটি কালো সাপ; মহাদেব এবার বসলসে সাপের মুখ ধরবে, আর তালপাতার বেড় দেওয়া ঝিনুক মুখে পরিয়ে ধরবে নাগিনী কন্যা শবলা।

 

ঈষৎ বাঁকা সাদা দাঁত দুটির দিকে তাকিয়ে শিবরাম যেন মোহাবিষ্ট হয়ে গিয়েছিলেন। ওই বাঁকা ওই এতটুকু একটি কাটার মত দাঁত, ওর প্রান্তভাগে ওই ক্ষুদ্র এক তরল বিন্দু, ওর কোথায়। রয়েছে মৃত্যু? কিন্তু আছে, ওরই মধ্যে সে আছে, এতে সন্দেহ নাই। সাপের চোখে পলক নাই, পলকহীন দৃষ্টিতে তার সম্মোহনী আছে; সাপের চোখে চোখ রেখে মানুষ তাকিয়ে থাকতে থাকতে পঙ্গু হয়ে যাওয়ার কথা শিবরাম শুনেছেন, কিন্তু ওই বিষবিন্দুঝরা দাঁতের দিকে চেয়ে পঙ্গু হয়ে যাওয়ার কথা তিনি শুনেন নাই। তবু তিনি যেন পঙ্গু হয়েই গেলেন।

ধূর্জটি কবিরাজ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন—সেবার তোমাদের গ্রামে যখন গিয়েছিলাম, তখন শবলা মায়ী যে সাপটি দিয়েছিল মহাদেব, সে জাত কিন্তু আর পেলাম না।

মহাদেব হাসলে। তিক্ত এবং কঠিন সে হাসি। নাকের ডগাটা ফুলে উঠল; হাসিতে ঠোঁট দুটি বিস্কুরিত হল না, ধনুকের মত বেঁকে গেল। তারপর বললে—ধন্বন্তরি বাবার তো অজানা কিছুই নাই গ! কি বলব বলেন?

তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সে শবলার দিকে মুহূর্তের জন্য ফিরে তাকালে। তাকিয়ে বললেই জাতটার নেকনের ফল, রীতিচরিতের দোষ। এই এর মতি দেখেন কেনে! সে আঙুল দিয়ে দেখালে শবলাকে।

সঙ্গে সঙ্গে গুরুর শঙ্কিত সতর্ক কণ্ঠস্বরে শিবরাম চমকে উঠলেন, সাপের দাঁত দেখে মোহে পঙ্গু হয়ে পড়েছিলেন, সে মোহ তার ছুটে গেল।

ধূর্জটি কবিরাজ শঙ্কিত সতর্ক কণ্ঠস্বরে ঘেঁকে উঠলেন-হাঁ শবলা!

শবলা হাসলে, হেসে উত্তর দিলে—দেখছি বাবা। হাত মুই সরায়ে নিইছি ঠিক সময়ে।

ধূর্জটি কবিরাজ বললেন সাবধান হও বাবা মহাদেব। কি হত বল তো?

সত্যই কি হত ভাবতে গিয়ে শিউরে উঠলেন শিবরাম। সর্বনাশ হয়ে যেত। মহাদেব দুই আঙুলে টিপে ধরেছিল সাপটার চোয়াল, ঝিনুক ধরেছিল শবলা। উত্তেজিত হয়ে মহাদেব শবলার দিকে চোখ ফিরিয়ে মুক্ত হাতটির আঙুল দিয়ে শবলাকে যে মুহূর্তে দেখাতে গিয়েছে, সেই মুহূর্তে তার সাপ-ধরা হাতটি ঈষৎ বেঁকে গিয়েছে, সাপটার মাথা হেলে পড়েছে, তালপাতায় বেঁধা একটা পাত তালপাতা থেকে খুলে গিয়েছে। শবলা যদি মহাদেবের কথায় বা আঙুল দিয়ে দেখানোর প্রতিক্রিয়ায় মুহূর্তের জন্য চঞ্চল হয়ে চকিতের জন্যও চোখ তুলত, তাকাত মহাদেবের দিকে, তবে ঐ বক্র তীক্ষ্ণ দাতটি সেই মুহূর্তেই বসে যেত শবলার আঙুলে।

ধূর্জটি কবিরাজ তিরস্কারের সুরেই বললেন–সাবধানে বাবা মহাদেব। কি হত বল তো?

অবজ্ঞার হাসি হাসলে মহাদেব।–কি আর হত বাবা?

সুরে সুর মিলিয়ে শবলা বললে–তা বৈকি বাবা! কি আর হত বলেন। নিজের বিষেই জরে মরত নাগিনী। নরদেহের যন্ত্রণা থেকে খালাস পেত।

খিলখিল করে হেসে উঠল বিচিত্র বেদের মেয়ে। সে হাসিতে ব্যঙ্গ যেন শতধারে ঝরে পড়ল।

মহাদেবের মুখখানা থমথমে হয়ে উঠল। এর পর নীরবে অতি সতর্কতার সঙ্গে চলতে লাগল। বিষ-গালার কাজ।

বিষ-গালা শেষ হল। শবলা বললে—বাবাঠাকুরের ছামুতে তু মিটায়ে দে যার যা পাওনা। বাবা, আপুনি দেন গ হিসাব করে।

মহাদেব কঠিন দৃষ্টিতে তাকালে শবলার দিকে।—কেনে?

—কেনে আবার কি? বাবা হিসাব করে দেবেন এক কলমে, মুখে মুখে হিসাব করতে তুদের সারাদিন কেটে যাবে। কি গ, বল না কেনে তুরা? মুখে যে সব মাটি লেপে দিলি! অ্যাঁ?

একজন বেদে বললে–হ্যাঁ, তা, হ্যাঁ সেই তো ভাল। না, কি গ? সকলের মুখের দিকে চাইলে সে।

হ্যাঁ। হ্যাঁ।—সকলেই বললে। কেউ বা মুখ ফুটে বললে, কেউ সম্মতি জানালে ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ হ্যাঁ।

* * * *

শিবরাম চমকে উঠলেন, একটি সুরেলা মিষ্টি গলার বিচিত্র মধুর ডাক শুনেকচি-ধন্বন্তরি! জানালার দিকে তাকিয়ে দেখলেন শিবরাম, এ সেই বেদের মেয়েটি। বেলা তখন তৃতীয় প্রহরে শেষ পাদ। ছাত্রদের প্রায় তৃতীয় প্রহর পর্যন্ত যায় বৈদ্যভবনের কাজে; তারপর খানিকটা বিশ্রাম। রোগীরা চলে যায়, বৈদ্যভবনের দুয়ারগুলি বন্ধ হয়, ছাত্রেরা আহার করে, স্নানের নিয়ম প্রাতঃস্নান-ওটা হয়ে থাকে, গুরুর বিশ্রাম তখনও হয় না, তাকে বের হতে হয় সম্পন্ন ব্যক্তিদের বাড়ি রোগী দেখতে অনেক ক্ষেত্রে যে সব রোগীকে নাড়াচাড়া করা চলে না সে সব বাড়িতেও যেতে হয়—এমনি সময় তখন। আঙিনাটা জনশূন্য, গুরু বেরিয়েছেন, তখনও ফেরেন নি; সঙ্গে গিয়েছে অন্য শিষ্য, শিবরামের সেদিন বিশ্রাম। এক দিকের কোণের একটা ছোট ঘরে শুয়ে আছেন, পাশে খোলা পড়ে আছে একখানা বিষশাস্ত্রের পুঁথি। বেদেরা যাওয়ার পর ওই পুঁথিখানাই। বের করে খুলে বসেছিলেন। কিন্তু সে পড়তে ভাল লাগছিল না। ঘরের ছাদের দিকে চেয়ে ভাবছিলেন বোধহয় ওই বেদেদের কথাই, ওই আশ্চর্য কৌশল, ওই অদ্ভুত সাহস, ওদের বিচিত্ৰ দ্ৰব্যগুণবিদ্যা আর সর্বাপেক্ষা রহস্যময় মন্ত্রবিদ্যা শিখবার একটা আগ্রহ নেশার মত আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল।

* * * *

বিষের দাম মিটিয়ে যখন নেয় বেদেরা তখন শিবরাম মহাদেবের সঙ্গে কথা বলছিলেন। যার যা প্রাপ্য হিসেব করে নিচ্ছিল বেদেরা, মহাদেব নিশৃহের মত বসে ছিল একদিকে। শিবরাম তাকে ডেকে বলেছিলেন—আমায় শেখাবে? কিছু বিদ্যা দেবে? আমি দক্ষিণা দোব।

মহাদেব বলেছিল–দক্ষিণা দিবে তো বুঝলাম। কিন্তুক বিদ্যা কি একদিন দুদিনে শিখা যায়? বলেন না আপুনি?

—তা যায় না। তবে কতকগুলো জিনিস তো শেখা যায় দু-একবার দেখে। তা ছাড়া, তোমরা বলবে আমি লিখে নেব। আমি তো সাপ ধরা শিখতে চাই না, আমি সাপ চিনতে চাই। লক্ষণ পড়েছি আমাদের শাস্ত্রে, সেই লক্ষণ মিলিয়ে সাপ দেখিয়ে চিনিয়ে দেবে। জড়ি শিকড় চিনিয়ে দেবে, নাম বলে দেবে। আমি লিখে নেব।

—কি দিবা বল দক্ষিণা?

–কি চাও বল?

–পাঁচ কুড়ি টাকা দিবা। আর ষোল আনা মা-বিষহরির প্রণামী।

অর্থাৎ এক শো এক টাকা।

এক শো এক টাকা কোথায় পাবেন ছাত্র শিবরাম? গুরুগৃহে বাস, গুরুর অন্নে দিনযাপন। প্রায় পুরাকালের শিক্ষাব্যবস্থার ধারা।

শেষে বলেছিলেন–পাঁচটি টাকা আমি দেব, বিদ্যা শেখাতে হবে না, সাপ চিনিয়ে দিয়ে।

রাজি হয়েছিল মহাদেব। বলেছিল—শহরের হুই দক্ষিণে এক্কেরে সিধা চলি যাবা গাঙের কূলে কূলে। আধকোশ-টাক গিয়া পাবা আমবাগান, আর গাঙের কূলে তিনটা বটগাছ। দেখবা, বেদেদের লা বাধা রইছে; সেই পাড়ের উপর আমাদের আস্তানা।

* * * *

শিবরাম সেই কথাগুলিই ভাবছিলেন।

হঠাৎ কানে এল এই সুরেলা উচ্চারণে মিহি গলার ডাক–কচি-ধন্বন্তরি!

জানালার ওপাশে সেই বিচিত্র বেদের মেয়ের মুখ।

ঠোঁটে একমুখ হাসি, চোখে চঞ্চল তারায় সস্মিত আহ্বান—সে তাকেই ডাকছে।

শিবরাম বললেন—আমাকে বলছ?

–হাঁ গ। তুমাকে ছাড়া আর কাকে? তুমি ধন্বন্তরিও বট, কচিও বট। তাই তো কইলাম কচি-ধন্বন্তরি! শুন।

—কি?

–বাইরে এস গ। আমি বাইরে রইলাম দাঁড়ায়ে–তুমি ঘর থেক্যা কইছ–কি? কেমন তুমি?

অপ্রতিভ হয়ে বাইরে এলেন শিবরাম।

–ধন্বন্তরি বাবা কই? এবার তার চোখে তীব্ৰ দীপ্তি ফুটে উঠল।

–গুরু তো ডাকে বেরিয়েছেন।

–ঘরে নাই?

–না।

মেয়েটা গুম হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। তার পর উঠে পড়ল, বললে–চললাম। চলে গেল। কিছুক্ষণ পরই ফিরল ধূর্জটি কবিরাজের পালকি। পালকির সঙ্গে ফিরল শবলা। পথে দেখা হয়েছে।

কবিরাজ পালকি থেকে নেমে বললেনকি? মহাদেবের সঙ্গে বনছে না? সেই মীমাংসা করতে হবে?

—না বাবা। যা দেবতার অসাধ্য, তার লেগে মুই বাবার কাছে আসি নাই।

–তবে?

চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল শবলা। কোনো কথা বললে না। কোনো একটা কথা বলতে যেন সে পারছে না।

—বল, আমার এখনও আহার হয়নি বেটি।

শবলা বলে উঠল—হেই মা গ! তবে এখুন না। সে এখুন থাক্। আপুনি গিয়া সেবা করেন। বাবা। হেই মা গ!

বলে প্রায় ছুটেই চলে গেল।

–শবলা! শোন। বলে যা।

–না না। তার কণ্ঠস্বর ভেসে এল। সে ছুটে পালাচ্ছে।

বিচিত্র মেয়ে। কেনই বা এসেছিল, কেনই বা এমন করে ছুটে চলে গেল শিবরাম বুঝতে পারলেন না। ধূর্জটি কবিরাজ একটু হাসলেন। বিষণ্ণ সস্নেহ হাসি। তারপর চলে গেলেন। ভিতরে। এই তৃতীয় প্রহরে আবার তিনি স্নান করবেন, তারপর আহার।

 

পরের দিন কিন্তু ধন্বন্তরি ধূর্জটি কবিরাজের কাছে শবলা আর এল না। না এলেও শিবরামের সঙ্গে তার দেখা হয়ে গেল।

গুরু তাকে পাঠিয়েছিলেন এক রোগীর বাড়ি। ধনাঢ্য ব্যক্তির বাড়ির রোগী। তরুণ গৃহস্বামীর দুর্ভাগিনী পিতামহীর অসুখ। দুর্ভাগিনী বৃদ্ধা স্বামীপুত্র হারিয়ে পৌত্রের আমলে সম্পূর্ণরূপে অবহেলিত। বড় ঘরে, বড় খাটে পড়ে আছেন, চাকরে টানাপাখাও টানে, কিন্তু এক কন্যা ছাড়া কেউ দেখে না। মৃত্যুরোগ নয়, যন্ত্রণাদায়ক ব্যাধি, তারই ওষুধ দিয়ে পাঠালেন শিবরামকে, ওষুধগুলি অন্তঃপুরে গিয়ে বৃদ্ধার কন্যার হাতে দিয়ে সেবন-বিধি বুঝিয়ে দিয়ে আসতে। নইলে ওষুধ হয়ত বাইরেই পড়ে থাকবে। অথবা এ চাকর দেবে তার হাতে, সে দেবে। এক ঝিয়ের হাতে, ঝি কখন একসময় গিয়ে কোন কুলুঙ্গিতে রেখে চলে আসবে। বলেও আসবে না যে, ওষুধ রইল। সমস্ত বুঝেই কবিরাজ অনুপানগুলি পর্যন্ত সংগ্রহ করে শিবরামকে পাঠালেন।

এই বাড়ির অন্তঃপুরের উঠানে সেদিন শিবরাম দেখলেন শবলাকে।

শবলা! কিন্তু এ কি সেই শবলা? এ যেন আর একজন। হাতে তার দড়িতে বাধা দুটো বাঁদর আর একটা ছাগল। কাঁধে ঝুলিতে সাপের ঝাপি। চোখে চকিত চপল দৃষ্টি। অঙ্গের হিল্লোলে, কথার সুরে, কৌতুক-রসিকতা যেন ঢেউ খেলে চলেছে।

এটা ওদের আর একটা ব্যবসা।

নদীর কূলে নৌকা বেঁধে পাড়ের উপর আস্তানা ফেলে মেয়েরা বেরিয়ে পড়ে। সাপ বদর ছাগল ড়ুগড়ুগি বিষম-ঢাকি নিয়ে অন্দরের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে ডাক দেয়—বেদেনীর খেলা দ্যাখেন গ মা বাড়ির গিনি, রাজার রানী, স্বামী-সোহাগী, সোনা-কপালী চাঁদের মা। কালনাগিনীর দোলন নাচন হীরেমনের খেল—

বিচিত্র সুর, খাজে খাজে সুরেলা টানে ওঠে-নামে। বাড়ির মেয়েরা এ সুর চেনে, ছুটে এসে দরজায় দাঁড়ায়। বেদের মেয়ে এসেছে। আশ্চর্য কালো মেয়ে। আশ্চর্য ভাষা। আশ্চর্য ভূষা!

—বেদেনী এসেছিস! ওরে, সব আয় রে! বেদেনী—বেদেনী এসেছে।

–হ্যাঁ গ মা-লক্ষ্মী, বেদেনী আছে। অর্থাৎ এসেছে। বেদেনী আছে মা, পোড়ারমুখী আছে তুমাদের দুয়ারের কাঙালিনী আছে, সব্বনাশী-মায়াবিনী আছে খেল্ দেখাতে, ভিখ মাঙতে, দুয়ারে এস্যা হাত পেতে দাঁড়াছে।

মেয়েরা হাতের কাজ ফেলে ছুটে আসে। না এসে পারে না। এই কালো মেয়েগুলি রহস্যময়ী মেয়ে, ওরা সত্যিই বোধহয় জাদু জানে। কথায় জাদু আছে, খেলায় জাদু আছে, হাসিতে জাদু আছে। কোনো কোনো গিন্নি বলেন-ঢের হয়েছে, আজ যা এখন। সব্বনাশীরা কাজ পণ্ড করার যাশু; হাতের কাজ পড়ে আছে আমাদের। পালা বলছি।

ওরা খিলখিল করে হাসে। বলে—তা মাজনুনী, সোনামুখী, তুমি বলেছ ঠিক। বেদেনী দুয়ারে এস্যা হাঁক দিলি পর হাতের কাজ মাটি। বেদেনী মায়াবিনী গ—আমাদের মন্তর রইছে। যে ঠাকরুণ! এখুন বিদায় কর আপদেরে, জয় জয় দিতি দিতি মুই পথ ধরি; তোমাদের ঘেঁড়া কাজ আবার জোড়া লাগুক; ভাণ্ডার ভরা উঠুক; মা-বিষহরি কল্যেণ করেন, নীলকণ্ঠের আশীর্বাদে তুমার ঘরের সকল বিষ হর্যা যাক। জয় মা-বিষহরি, জয় বাবা নীলকণ্ঠ, জয় আমার গিন্নিমা, এই ঝুলি পাতলাম, দাও ভিখ দাও, বিদায় কর।

দাবি ওদের কিন্তু সামান্য নয়। দাবি অনেক।

বড় একটা বিষধরকে গলায় জড়িয়ে তার মুখটা হাতে ধরে মুখের সামনে এনে বলে শিগগিরি বেনারসী শাড়ি আনেন ঠাকরণ-বরের সাথে বেদেনীর শুভদৃষ্টি হবে। আনেন ঠাকরণ, আনেন, মাথার পরে ঢেকা দ্যান, ত্বরিৎ করেন, বর মোর গলায় পাক দিচ্ছে। কাপড় না পেলে বেদেনী সাপের পাকে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়ে যাবার ভান করে। এ ভানের কথা লোকে জানে; কিন্তু এত ভয়ঙ্কর এ ভান যে, ভান বুঝেও চোখে দেখতে পারে না।

কখনও পোশ বদরটাকে বলে হীরেমন, ধৰ্ব মা-গিনির চরণে ধর। বল, ওই পরনের শাড়িখানা ছেড়া দ্যান, লইলি পর চরণ ছাড়ব নাই।

বাঁদরটা এমন কথা বুঝতে পারে যে, ঠিক এসে গিন্নির পা দুখানি দু িহাত দিয়ে জড়িয়ে বসে পড়ে। গিনি শিউরে ওঠেন ছাড় ছাড়। বেদেনী হাসে, বলে কিছু করবে নাই মা, কিছু করবে নাই। তবে কাপড়খানি না পেলে ও ছাড়বে না। মুই কি করব বলেন? ই আজ্ঞে ওস্তাদের আজ্ঞে।

দর্শক পুরুষ হলে তো কথাই নাই।

বাঁদর নাচাতে নাচাতে, সাপ নাচাতে নাচাতে গানের সঙ্গেই তার অফুরন্ত দাবি জানিয়ে যায়–

যেমন বাবুর চাঁদো মুখ
তেমনি বিদায় পাব গ।
বেনারসীর শাড়ি পর‍্যা
লেচে লেচে যাব গ!
প্রভু রাঙা হাত ঝাড়িলে
আমার পাহাড় হয় গ!
মাথায় নিয়া সোনার পাহাড়
দিব প্রভুর জয় গ!

মেয়েদের মজলিসে বেদের মেয়ের শুধু বাক্যের মোহ সম্বল; পুরুষদের মহলে বাক্যের। মোহের সঙ্গে তার দৃষ্টি এবং হিল্লোলিত দেহও মোহ বিস্তার করে। সাপের নাচ বাঁদরের খেলা দেখিয়ে সব শেষে সে বলে—এই বারে প্রভু বেদেনীর লাচন দেখেন। লাগিনী লেচেছে হেলে দুলে, এই বারে লাচবে দেখেন বেদের কন্যে। বলতে বলতেই কথা হয়ে ওঠে সুরেলা, টানা সুরে ছড়ার মতই বলে যায়—লা-লা লো মায়াবিনী, লাচ দিকিনি, হেলে দুলে পাকে পাকে; বেউলা সতীর যে লাচ দেখে ভুলেছিল বুড়া শিবের মন। আবার সুরেলা ছড়া কাটা বন্ধ করে বলে যায়—শিবের আজ্ঞায় বিষহরি ফির্যায়ে দিছিল সতীর মরা পতিকে, সেই আচ লাচবি। বাবুদের রাঙা মন ভুলায়ে ভিক্ষার ঝুলিতে ভরে লিবি, গরবিনী সাজবি। বাবুর হাতের আংটি লিবি, নয়তো লিবি সোনার মোহর—তবে ফির্যা দিবি সেই রাঙা মন।

কথা শেষ করেই গান ধরে, নাচ শুরু করে। এক হাত থাকে মাথার উপর, এক হাত রাখে কঁকালে, পা দুটি জোড় করে সাপের পাকের মত পাকে পাকে দুলিয়ে নাচে, সে পাক পা থেকে। ঠিক যেন সাপের পাকের মতই দেহের উপর দিয়ে উঠে যায়।

উরর হায় হায়, লাজে মরি,
আমার মরণ ক্যানে হয় না হরি!
আমার পতির মরণ সাপের বিষে
আমার মরণ কিসে গ!
মদন-পোড়া চিতের ছাইয়ের
কে দেবে হায় দিশে গ!
অঙ্গে মেখে সেই পোড়া ছাই।
ধৈর্য মুই ধরি গ ধৈর্য মুই ধরি—উর্‌র্‌, হায় গ!

বেহুলা-পালার গান এটি। ওদের নিজস্ব পালাওদের কোনো পদকর্তা অর্থাৎ বিষবেদে কবি রচনা করেছে। ওরাই গায়। এ গান গাইবার সময় বেহুলার মত চোখ থেকে জলের ধারা নেমে আসার কথা; বেহুলা যখন দেবসভায় মৃত লখিন্দরকে স্মরণ করে নেচেছিল, তখন চোখের জলে তার বুক ভেসেছিল। কিন্তু মায়াবিনী বেদের কন্যে যখন গান গেয়ে নাচে, তখন তার চোখ থেকে জলের ধারা নামে না, ওদের সরু অথচ লম্বা চোখ ও ভুরু দুটি কটাক্ষভঙ্গির টানে বেঁকে। হয়ে ওঠে গুণ-টানা ধনুকের মত। লাস্যের তূণীর খালি করে সম্মোহন বাণের পর বাণ নিক্ষেপ করে স্থানটার আকাশবাতাস যেন আচ্ছন্ন করে দেয়। দর্শকেরা সত্যই সম্মোহনে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।

বুড়ো শিব বেহুলা সতীর নৃত্য দেখে মোহিত হয়ে কন্যা বিষহরিকে আজ্ঞা দিয়েছিলেন লখিন্দরের প্রাণ ফিরিয়ে দিতে; বেদের কন্যে বাবুদের মোহিত করে বিদায় চায়, টাকা চায়, টাকা চায় দু হাত ভরে।

ধনীর বাড়িতে বারান্দায় বসে ছিলেন তরুণ গৃহস্বামী আর তার সঙ্গীরা। সামনে বাগানে নাচছিল শবলা। অন্দর থেকে ফিরে শিবরাম থমকে দাঁড়ালেন।

গৃহস্বামী তাকে দেখেও দেখলেন না। দেখবার তখন অবকাশ ছিল না তার। বেদের মেয়েও তার দিকে ফিরে তাকাল না। তারই বা অবকাশ কোথায়? দেবসভায় অপ্সরাত্যের কথা শিবরামের মনে পড়ে গেল। দেবতারাও মোহগ্ৰস্ত, নৃত্যপরা অন্সরা নৃত্যলাস্যে মোহবিস্তার করতে গিয়ে নিজেও হয়েছে মোহগ্রস্ত। শবলার চোখেও নেশার ছটা লেগেছে। সে রূপবান তরুণ গৃহস্বামীর কাছে হাত পেতেছে, বলছে—মুই বেদের কন্যে, কালনাগিনীর পারা কালো অ্যাঁধার, রাঙা। হাত মুই কোথাকে পাব? কিন্তুক লাজ নাই বেদেনীর, লাজের মাথা খেয়ে তবে তো দেখাতে পেরেছি। লাচন। তাই বাবু মোর সোনার লখিন্দর, বাবুর ছামনে পাতলাম কালো অ্যাঁধার হাত।

হেসে বাবু বললেন—কি চাই ব?

–দাও, রাঙাবরন শাড়ি দাও; দেখ, কি কাপড় পরে রইছি দেখ!

সঙ্গে সঙ্গে হুকুম হয়ে গেল। নতুন লালরঙের শাড়ি এখুনি এনে দাও দোকান থেকে। জলদি।

লোক ছুটল সঙ্গে সঙ্গে।

—আর একটা টাকা দাও একে।

বেদেনী বলে উঠল—উই উই, টাকা কি লিব? টাকা লিব না মুই। সোনা লিব-তুমার সোনার বরন অঙ্গে কত সোনা রইছে, দুই হাতে অতগুলান অঙ্গুরি, গলায় হার, হাতে তাগা–ওরই এক টুকরা লিবে কালামুখী কালোবরনী কালনাগিনী বেদের কন্যে!

দুটো চোখ থেমে মুহুর্মুহুঃ কটাক্ষ হানছিল সে।

তরুণ গৃহস্বামী তৎক্ষণাৎ হাত থেকে একটি আংটি খুলে বললেন–নে।

এবার বেদেনী খিলখিল করে হেসে উঠে খানিকটা পিছিয়ে গেল।–ইরে বাবা রে!

–কি? কি হল?

শবলা হেসে বলে–ই বাবা গ! সব্বনাশ সব্বনাশ! উ লিলি পর আমার পরান যাবে, আপনার মান্যি যাবে। বেদে বুড়া দেখলি পর টুঁটি টিপে ধরবে, লয় তো বুকে বিন্ধে দিবে লোহার শলা। আর গিন্নিমা দেখলি পর মোর মাথায় মারবেন ঝাঁটা। আপনার খালি আঙ্গুল দেখ্যা গোসা করা ঘরে গিয়া খিল দিবেন, কি চলা যাবেন বাপের ঘর।

হেসে তরুণ গৃহস্বামী আংটিটা আবার আঙুলে পরলেন, বললেন—তবে চাইলি কেন?

—দেখলাম আমার সোনার লখিন্দরের কালনাগিনীর পরে ভালবাসাটা টি, না মেকি!

–কি দেখলি?

-খাঁটি, খাঁটি। হঠাৎ মুখে কাপড় দিয়ে হেসে উঠল, বললেখাঁটিই হয় গো সোনার লখিন্দর। তাতেই তো লাগের বিষে মরে না লখিন্দর লাগিনীর বিষে মরে।

ঠিক এই সময়েই বাজার থেকে লোক ফিরে এল লালরঙের চন্দ্রকোণা শাড়ি নিয়ে। টকটকে লালঙের শাড়ি, তারও চেয়ে গাঢ় লালরঙের পাড়। চকচক করে উঠল বেদেনীর চোখ।

কাপড়খানা গায়ে জড়িয়ে নতুন কাপড়ের গন্ধ নাকে শুকে সে বললে—আঃ!

–পছন্দ হয়েছে?

–হবে না? চাঁদের পারা বদন তুমার, তুমার দেওয়া জিনিস কি অপছন্দ হয়? এখন–বিদায় কর।

—আর কি চাই বল? আংটি চাইলি, দিতে গেলাম, নিলি নে।

—দাও। যখুন দিবার তরে মন উঠেছে, পোড়াকপালী বেদের বেটির কপাল ফিরেছে, তখুন দাও, আংটির দাম পাঁচটা টাকা দিবার হুকুম কর। তুমি হাত ঝাড়লে আমাদের তাই পব্বত। দিয়া দাও পাঁচটি টাকা।

তাও হুকুম হল দিতে।

পাওনা নিয়েই ছুটতে শুরু করলে সে। বেদের মেয়েটার চলন কি দ্রুত! মাঠের মধ্যে সাপের পিছনে তাড়া করে সাপের নাগাল নেয়,বেদের মেয়েদের চলনই খর, বলনও খর, চাওনিও খর। শবলা আবার তাদের মধ্যে অদ্বিতীয়া, বিচিত্র মেয়েদের মধ্যে ও আবার আরও বিচিত্র।

বাবু হাঁকলেন—দাঁড়া দাঁড়া। এই বেদেনী, এই!

দাঁড়াল শবলা। এরই মধ্যে সে অনেকটা চলে গেছে। ফিরে পাঁড়িয়ে অতি মধুর এবং অতি চতুর হাসি হাসলে সে। বললে—আজ আর লয় সোনার লখিন্দর, উই তাকায়ে দ্যাখেন পছিম আকাশ বাগে—বেলা হিলে গেছে, সুয্যি দেবতার লালি ধরেছে; সঁঝ আসছে নেমে। যাব সেই কত পথ। শিয়াল ডাকবার আগে ঘরকে যেতে না পারলি ঘরে লিবে না, জাতে ঠেলবে। বলেই হেসে সুর করে বলে—

শিয়াল ডাকিলি পরে, বেদেরা না লিবে ঘরে
অভাগিনীর যাবে জাতিকুল।

তারপর ছড়া ছেড়ে সহজ করে বললে—বেশ চুপিচুপি বলার ভঙ্গিতে–তুমি জান না সোনার লখিন্দর, তুমি বেদের কন্যেরে জান না। বেদের কন্যের লাজ নাই শরম নাই, বেদের কন্যের ধরম নাই, বেদের কন্যের ঘরের মায়া নাই; বেদের কন্যে বেদিনী অবিশ্বাসিনী। রীতচরিত তার আগের কন্যে লাগিনীর মতন। রাত লাগলি, অ্যাঁধার নামলি চোখে নেশা লাগে, বুকের ভিতরটা তোলপাড় করে, লাগিনীর মতন সনসনিয়ে চলে, ফণা তুলে লাচে। সে লাচন যে দেখে সে সংসার ভুলে যায়।

চোখ দুটো তার ঝকঝক করে উঠল একবার।

বললে–সে পাঁচন তুমাকে দেখাবার উপায় নাই সোনার লখিন্দর।

তারপর সে আবার ছুটল। সত্য সত্যই সে ছুটতে শুরু করল। ওদিকে সূর্য প্রায় দিগন্তের কোলে নেমেছে, রঙ তার লাল হয়ে উঠেছে। সন্ধ্যা হতে খুব দেরি নাই। শবলা মিথ্যে বলে নাই, শিবরাম জানেন, শুনেছেন, ওই যেবার গিয়েছিলেন হিজল বিলের ধারে সাতালী গায়ে, সেবারই শুনে এসেছিলেন, সন্ধ্যার শিবারবের পর যে বেদের মেয়ে গাঁয়ের বা আস্তানার বাইরে রইল, তার আর ঘরে প্রবেশাধিকার রইল না। অন্তত সে রাত্রির মত রইল না। পরের দিন সকালে তাকে সাক্ষীসাবুদ নিয়ে শিরবেদের সম্মুখে এসে দাঁড়াতে হবে, প্রমাণ করতে হবে–সে সন্ধের সময় পর্যন্ত কোনোমতেই ঘর পর্যন্ত পথ অতিক্রম করতে পারে নাই এবং সন্ধের সময়েই সে আশ্রয় নিয়েছিল কোনো সৎগৃহস্থের ঘরে, কোনো অপরাধে সে অপরাধিনী নয়। তবে সে পায় ঘরে ঢুকতে। প্রমাণে এতটুকু খুঁত বের হলে দিতে হয় জরিমানা। এর উপর খেতে হয়। বেদের প্রহার।

শবলা নাগিনী কন্যা, পাঁচ বছর আগে নিজের স্বামীকে খেয়ে প্রায় চিরকুমারী, কিন্তু আস্তানায় বা ঘরে তার প্রতীক্ষায় বসে থাকে স্বয়ং শিরবেদে। নাগিনী কন্যাকে যদি স্পর্শ করে ব্যভিচারের অপরাধ, তবে গোটা বেদে-সমাজের মুখে কালি পড়বে, মা-বিষহরি তার হাতে পূজা নেবেন না। পরকালে পিতৃ-পুরুষদের অধোগতি হবে। সন্ধ্যার শিবাধ্বনি কানে ঢুকবামাত্র। শিরবেদে উঠে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে মা-বিষহরির নাম নিয়ে প্রণাম করবে।জয় মাবিষহরি, জয় মা-মনসা!

কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করেই হাঁকবে–কন্যে!

হাঁ গ, সন্ঝার প্রদীপ জ্বালছি গ।–উত্তর দিতে হবে নাগিনী কন্যাকে।

ছুটে চলল শবলা।

গঙ্গার ঘাটের দিকে চলল, তারপর সেখান থেকে গঙ্গার কুলের পথ ধরে তাকে হাঁটতে হবে। অনেকটা। তার আকর্ষণে ছাগলটা এবং বদর দুটোও ছুটছে।

দর্শকদের সঙ্গে শিবরামও দাঁড়িয়ে রইলেন তার দিকে চেয়ে। মেয়েটার ছুটে চলাও বিচিত্র, সজাগ হয়েই ছুটে চলেছে বোধহয় মেয়েটা। দর্শকেরা যে তার পিছনে তারই দিকে চেয়ে রয়েছে, একথা সে মুহূর্তের জন্যও ভুলছে না। ছুটে চলার মধ্যেও তার তন্বী দেহের হিল্লোল অটুট। রেখে ছুটে চলেছে। নাচতে নাচতেই যেন ছুটেছে মেয়েটা।

শিবরামের মনে হল মেয়েটার মুখে হাসির রেশ ফুটে রয়েছে। সে নিশ্চয় করে জানে যে, দর্শকেরা মোহগ্ৰস্তের মত এখনও তারই দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

দেখতে দেখতে গঙ্গার কূলের জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে গেল বেদের মেয়ে।

* * * *

পরের দিন সকালেই মহাদেব এসে দাঁড়াল ধূর্জটি কবিরাজের উঠানে। চোখে বিভ্রান্ত দৃষ্টি, কাঁধে সাপের বাঁক নাই, হাতে ডমরুর মত আকারের বাদ্যযন্ত্রটা নাই, তুমড়ি বাঁশিও নাই; হাতে শুধু লোহার ডাণ্ডাটাই আছে।

-বাবা!

তখনও প্রায় ভোরবেলা। ধূর্জটি কবিরাজ চিরটাকাল রাত্রির শেষ প্রহরে শয্যাত্যাগ করে প্ৰাতঃকৃত্য সেরে স্নান করতেন ঠিক উদয়-মুহূর্তে। সূর্যোদয় না হলে দিবাগণনা হয় না বলেই অপেক্ষা করে থাকতেন—স্তবপাঠ ইত্যাদি করতেন। দিনের দেবতার উদয় হলেই গঙ্গাস্নান করে ফিরে পূজায় বসতেন। কবিরাজ সবে স্নান সেরে বাড়ি ঢুকছেন, ওদিক থেকে ব্যস্ত হয়ে এসে উপস্থিত হল মহাদেব।

—কি মহাদেব? এই ভোরে?

তার আপাদমস্তক তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চেয়ে দেখে বললেন—এই ভাবে? কি ব্যাপার?

শহরে এসে মধ্যে মধ্যে ওরা মহামারীতে আক্রান্ত হয়। নগদ পয়সা হাতে পেয়ে শহরের খাদ্য-অখাদ্য খায় আকণ্ঠ পুরে। দিনে দুপুরে সারাদিন ঘুরে বেড়ায়। তৃষ্ণা পায়, সে তৃষ্ণা মেটাতে যে-কোনো স্থানের জল গ্রহণে ওদের দ্বিধা নাই, সুতরাং মহামারী আর আশ্চর্য কি?

মহাদেব বললে—বিপদ হল বাবা, ছুটে এলম! হেতা তুমি ছাড়া আমাদের আর কে রয়েছে। কও?

—কি হল?

–একটা ছোঁড়া মরিছে কাল রাতে!

–মরেছে? কি হয়েছিল?

–কি হবে বাবা? বেদের মিত্যু লাগের মুখে। সপ্যাঘাত হইছে।

–সর্পাঘাত?

–হাঁ বাবা। সাক্ষাৎ কাল। এক আকামা রাজগোখুরা। কি করে ঝাঁপি খুলল, কে জানে? ঝাঁপি থেকে বেরিয়ে পেলে ছোঁড়াকে ছামুতে, ছোঁড়া পিছা ফিরা বসে ছিল—পিঠের উপর মাথা ঠুকে দিলেক ছোবল। এক্কেরে এক খামচ মাস তুলে নিলে। কিছুতে কিছু হয় নাই—দণ্ড দুইয়ের ভিতর শ্যাষ হয়ে গেল। এখুন বাবা ইটা হল শহর বাজার ঠাঁই, অপঘাত মিত্যুর নাকি তদন্ত হবে থানাতে। আপনি একটা চিরকুট লিখে দাও বাবা দারোগাকে।

—বস।

হাত জোড় করে মহাদেব বললে—অভয় পাই তো একটি কথা বলি বাবা ধন্বন্তরি।

—বল।

–চিরকুট লিখ্য এই বাবাঠাকুরের হাত দিয়া ইয়ারে মোর সাথে দাও। দারোগার সাথে কথা কি বলতি কি বুলব বাবা–

সুরে ভঙ্গিমায় অসমাপ্ত থেকে গেল মহাদেবের কথা বলতে পারলে না-হয়ত জানে না বাক্যের রীতি, অথবা সাহস করলে না অনুরোধ পুনরাবৃত্তি করতে।

আচার্য ভাবছিলেন। ভাবছিলেন আয়ুর্বেদ-ভবনের সুবিধা-অসুবিধার কথা, শিষ্যের অসুবিধার কথাও মনে হচ্ছিল।

হাত জোড় করে মহাদেব বললে—বাবা, কাল নিয়ে খেলা করি, মরি বাঁচি ডর করি না, কিন্তুক থানা-পুলিশ যমের বাড়া, উরা বাবা সাক্ষাৎ বাঘ। দেখলি পরেই পরানটা চাছাড়া হয়্যা যায় গ।

এবার হেসে ফেললেন ধূর্জটি কবিরাজ। শিবরামের দিকে তাকিয়ে বললেন—তোমার হয়ত একটু কষ্ট হবে শিবরাম, তবে এদের জন্য কষ্ট করলে পুণ্য আছে, তুমি যাও একবার। দারোগাকে আমার নাম করে বোলো—অযথা কোনো কষ্ট যেন না দেন! তুমি না গেলে হয়ত হয়রানির ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের চেষ্টা করবে। বুঝেছ?

শিবরাম উঠলেন। বললেন–আমি যাচ্ছি।

জোয়ান বেদের ছেলে। মৃতদেহটা দেখে মনে হচ্ছিল, কালো কষ্টিপাথরে গড়া একটা মূৰ্তি, সুন্দর সবল চেহারা। শুইয়ে রেখেছিল বেদেদের আস্তানার ঠিক মাঝখানে। মাথার শিয়রে কাঁদছিল তার মা। চারিদিকে আপন আপন আস্তানায় বেদেরা যেন অসাড় হয়ে বসে আছে। ছোট ছোট ছেলেগুলো শুধু দল বেঁধে চঞ্চল হবার চেষ্টা করছে; কিন্তু তাও ঠিক পেরে উঠছে না চঞ্চল হতে, বড় মানুষদের স্তম্ভিত ভাবের প্রভাব তাদেরও যেন আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।

শবলা দাঁড়িয়ে আছে একটা গাছের ডাল ধরে; যেন ডালটা অবলম্বন করে তবে দাঁড়াতে পেরেছে। অদ্ভূত চেহারা হয়েছে চঞ্চলা চপলা মেয়েটার। স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে ওই মরা মানুষটার দিকে; কিন্তু তাকে সে দেখছে না, মনের ভিতরটা যেন বাইরে এসে ওই মরা মানুষটার উপরে শবাসনে বসে আছে। চোখের উপরে ভ্র দুটির মাঝখানে দুটি রেখা স্পষ্ট দাঁড়িয়ে উঠেছে।

দারোগা-পুলিশের তদন্ত অল্পেই মিটে গেল।

কি-ই বা আছে তদন্তের! সাপের ওঝার মৃত্যু সাধারণত সাপের বিষেই হয়ে থাকে। কাল নিয়ে খেলা করতে গেলে দশ দিন খেলোয়াড়ের, একদিন কালের। তার উপর বিখ্যাত ধূর্জটি কবিরাজের অনুরোধ নিয়ে তাঁর শিষ্য শিবরাম উপস্থিত। নইলে এমন ক্ষেত্রে অল্পস্বল্পও কিছু আদায় করে পুলিশ। দারোগা শব-সৎকারের অনুমতি দিয়ে চলে গেলেন।

মহাদেব দেখালে সমস্ত। সাপটা দেখালে। প্ৰকাণ্ড একটা দুধে-গোখুরো। সাদা রঙের গোখুরো খুব বিরল। কদাচিৎ পাওয়া যায়। বেদেরা বলে-রাজার ভিটে ছাড়া দুধে-গোখুরো বাস করে না। রাজবংশের ভাগ্যপ্রতিষ্ঠা যখন হয়, বংশের লক্ষ্মী যখন রাজলক্ষ্মীর মর্যাদা পান, তখনই হয় ওর আবির্ভাব। লক্ষ্মীর মাথার উপর ছত্র ধরে সে-ই তাকে দেয় ওই গৌরব। তারপর রাজবংশের ভাগ্য ভাঙে, বংশ শেষ হয়ে যায়, রাজপুরী ভেঙে পড়ে, লক্ষ্মী অন্তৰ্হিতা হন, চলে যান স্বস্থানে—একেই রেখে যান ভাঙা পুরী পাহারা দেবার জন্যে। ভাঙা পুরীর খিলানে খিলানে, ফাটলে ফাটলে ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুরে বেড়ায়। অনধিকারী মন্দ অভিপ্ৰায়ে এই ভাঙা পুরীতে প্রবেশ করতে চেষ্টা করলে দণ্ড ধরে অর্থাৎ ফণা তুলে দাঁড়ায়। মন্দ অভিপ্ৰায় না থাকলে তুমি যাও, ও সাড়া দেবে না; তুমি ঘুরেফিরে দেখবেও তোমাকে দেখবে, নিজের অস্তিত্ব জানতে দেবে না, পাছে তুমি ভয় পাও। তুমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে হয়ত বড়জোর ও-ও নিশ্বাস ফেলবে। হঠাৎ যদি তোমার প্রবেশমুখে ও বাইরেই থাকে, চোখে পড়ে তোমার, তবে তৎক্ষণাৎ ও দ্রুতবেগে চলে যাবে কোন অন্ধকারে, লুকিয়ে পড়বে। মুখে ওর ভাষা নাই, ভাষা থাকলে শুনতে পেতে ও বলছে—ভয় নাইভয় নাই। এস, দেখ।

–মালদহে দেখেছিলাম বাবা। মহাদেব বললে তখন মুই ভর্তি জোয়ান। মোর বাপ শঙ্কর শিরবেদে বেঁচ্যা। অরণ্যে-ভরা ভাঙা ভগ্ন পুরী, ঘুরা ঘুর্যা দেখছি। আর বিধাতারে বুলছি—হায় বিধেতা, হায় রে! এ কি তোর খেলা! এই গড়াই বা ক্যানে—আর গড়লি তবে ভাঙাই বা ক্যানে! ঘুরতে ঘুরতে মনে হল, এই এত বড় রাজবাড়ি, কুথা আছে ইয়ার তোষাখানা? সিখানে কি সোনা-দানা-হীরে-মানিকের কিছুই নাই পড়ে? কি বুলব বাবা, মাথার উপর উঠল। গর্জন—ফেঁ-ফো-ফেঁ। শুন্যা পরানটা উড়ে গেল। এক্কেরে মাথার উপরে যে, ফিরে তাকাবার সময় নাই। শিরে হৈলে সপ্যাঘাত, তাগা বাঁধব কুথা! তবে বেদের বেটা-ভয় তো করি না। বুদ্ধি করে সঙ্গে সঙ্গে বসে পড়লাম ঝপ করে। তা বাদে মাথা তুলে উপর বাগে তাকালাম। দেখি, খিলানের ফাটল থেক্য এই হাত খানেক দেহখানা বার করে দণ্ড ধরে গরজাইছে। এই কুলার মতন ফণা, এই সোনার বরন চক্ক, দুধের মতন দেহের রঙ। মরি মরি মরি! কি বলব বাবা, মন মোহিত হয়ে গেল। বেদের কুলে জন্ম নিছি, হিজল বিলের ধারে সাতালী গাঁয়ে বাস পাতালে লাগলোকে যত লাগ, সাঁতালীর ঘাসবনে গাছের কোটরেও তত লাগ। কিন্তু এমনটি তো দেখি নাই। মনটা নেচ্যা উঠল বাবা। ভাবলাম, ইয়ারে যদি ধরতে না পারি তো কিসের বেদে মুই? খানিক পিছিয়ে এলম, দাঁড়ালম বাবা খুঁট লিয়ে। আয়, তু আয়। মনে মনে ডাকলাম মা-বিষহরিকে, ডাকলাম কালনাগিনী বেটিকে। হাকতে লাগলাম মন্তর। সেও থির, মুইও থির। কে জেতে, কে হারে! ভাবলাম, ফস বানায়ে মারব ছুঁড়ে শেষ পর্যন্ত। পিছন থেকে মোর বাপ হাঁক দিলেক খবরদার! মুখ ফিরাবার জো নাই বাবা, আমি ফিরাব চোখ তো উ মারবে ছোবল, উ নামাবে মাথা তো মুই দেব ছো। মুখ না ফিরায়ে মুই বাপকে কইলাম—এস তুমি আগায়ে এস; মুই ঠিক আছি। ধর তুমি। বাপ কইলনা, পিছায়ে আয় পায়ে পায়ে। উনি হলেন রাজগোখুর, এ পুরীর আগলদার সাক্ষাৎ কাল। ওরে ধরে কেউ বাঁচে না। পিছায়ে আয়। বাপের হুকুম শিরবেদের আদেশ বাবা, দুপা পিছায়ে গেলম। সেও খানিক দেহ গুটায়ে ঢুকায়ে নিলে, ফণাটা খানিক ছোট হল। বাবা কইলে—সব্বনাশ করেছিলি। ওরে ধরতে নাই। বেদের বেটা, ধরতে হয়ত পারবি, কিন্তুক মুখে রক্ত উঠ্যা মরে যাবিনয়ত যেতে হবে ওই ওর বিষে। তা উনি এমুন দণ্ড ধরে দাঁড়ালেন ক্যানে? ওরে তেড়েছিলি? না, মনে মনে পাপ ভাবনা ভেবেছিলি? গুপ্তধন খুঁজতে গিয়েছিলি? বললম—কি করে জানলা গ? বাবা কইল বৃত্তান্ত। কইল-পাপ বাসনা মুছে ফেল্ ভুলে যা। দেবতারে পেনাম করা আস্তানায় চ। নইলে নিস্তার পাবি নাই। মনের বাসনা মনে ড়ুবালম, মুছে দিলম। বুললম–দেবতা, তুমি ক্ষমা কর। বাস্। বাবা, নিমিখ। ফেলতে দেখি, আর নাই তিনি। ঢুকে গেছেন। ফিরে এলম। তার পরে গিয়েছি বাবা সেই ভিটেতে, মনে মনে বলেছি–ক্ষমা কর দেবতা, কোনো বাসনা নিয়ে আসি নাই, এসেছি দেখতে, নয়ন সাথক করতে। আর কোনোদিন দেখা পাই নাই।

নিজের গল্প শেষ করে মহাদেব বললে কাল, বাবা, দেখি, ই ছোঁড়া ধরে এনেছে সেই এক রাজগোক্ষুর, সাক্ষাৎ কাল। বাবা শিবের বরন হল দুধের মতন, তার অঙ্গের পরশ ছাড়া ই বরন উ পাবে কুথা? বেদের ছেলে, ই কথা না-জানা লয়, মুই কতবার ই কাহিনী বুলেছি। জানে। ভালমতে। কিন্তু ওর নেয়ত। ওর রীতচরিতটা খারাপ ছিল—এমুনি হবে মুই জানতম। জোয়ান বয়স কার না হয় বাবা! ই ঘোড়ার জোয়ান বয়স হল—যেন সাপের পাঁচ পা দেখলে। রক্তের তেজে ধরাখানা হল সরা। যত কিছু মানা আছে বেদের কুলে—তাই করতে ছিল উয়ার ঝোঁক। লইলে বাবা

হঠাৎ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল মহাদেবের মুখ, কণ্ঠস্বরে বেজে উঠল যেন বিষম-ঢাকির সুর, সে প্রায় গর্জন করে উঠল, ফেটে পড়ল, সে বললে লইলে বাবা, লাগিনী কন্যে বেদের কুলের কন্যেলক্ষ্মী, তার দিকে দিষ্টি পড়ে বাবা?

–এই উয়ার নিয়ত। এই উয়ার নিয়ত। মাথা ঝুঁকি দিয়ে উঠল মহাদেব, কাঁকড়া চুল দুলে উঠল। পাপ কথা উচ্চারণ করে সম্ভাবত প্ৰায়শ্চিত্তের জন্য দেবতার নাম স্মরণ করলে সে—জয় বাবা মহাদেব, জয় মা-বিষহরি, জয়-চণ্ডী, ক্ষমা কর মা, ক্ষমা কর।

সমস্ত স্থানটা থমথম করছিল। গঙ্গার ওপারের তটভূমিতে তখনও শোনা যাচ্ছিল মহাদেবের কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি। আর উঠছিল গঙ্গার স্রোতের কুলকুল শব্দ এবং উত্তর বাতাসে অশ্বত্থ ও বটগাছের পাতায় মৃদু সরসর ধ্বনি, মধ্যে মধ্যে দুটো-একটা পাতা ঝরে ঘুরতে ঘুরতে মাটির উপর এসে পড়ছিল। বেদেদের সকলে স্তব্ধ, ছেলেগুলো পর্যন্ত ভয় পেয়ে চুপ করে গিয়েছে, সভয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মহাদেবের ক্রুদ্ধ মুখের দিকে। শবলা শুধু একবার ফিরে তাকালে মহাদেবের দিকে, তারপর আবার যেমন স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তেমনিভাবেই দাঁড়িয়ে রইল।

মহাদেব মনের আবেগে বলেই যাচ্ছিল, বলে কথা যেন শেষ করতে পারছে না। সে আবার বললে—আমি জানতম। আমি জানতম। এমন হবে আমি জানতম। কন্যে চান করে বিলের ঘাটে, ছোটা লুকায়ে দেখে। আমি সাবধান করে দিছি, ফুলের মুঠা ধরে মারছি, তবু উয়ার লালস মিটল না। আর ওই কন্যেটা! ওই যে লাগিনীর জাত, উ একদিন, বাবা, কন্যের রূপ ধরে চলেছিল গোটা বেদের জাতটারে। জনমে জনমে উ ছলনা করে বাবা। ঘোড়ার নেয়ত! ছোঁড়া কাল গেছিল হুই মা-গঙ্গার হুই পাড়েভাঙা লালবাড়ির জঙ্গলের দিকে। সেখানে ছিলেন এই দেবতা। এসে বুললে শবলারে। শবলা বুললে—বেদের বেটা লাগ দেখ্যা ছেড়া দিয়া এলিকি রকম বেদের বেটা তু? যা, ধ্যা নিয়ে আয়। জোয়ান বেদের বেটা, তার উপর শবলা বুলেছে, আর রক্ষা আছে বাবা! নিয়া এল ধরে, আমি দেখলম, দেখ্যা শিউরে উঠলম। বললম—ছেড়া। দে, লইলে মরবি। কিছুতে রাজি হয় না; শ্যাষ কেড়ে নিলম বাবা। সঁঝ হয়ে গেছিল, কাঁপিতে ভর্যা রেখে দিলম, ভাবলমকাল সকালে ছেড়া দিয়া আসব স্বস্থানে। কিন্তুক ওর নেয়ত, আমি কি করব, বলেন? রাতের বেলা ঝাঁপি ঠেল্যা বেরিয়েছে সাক্ষাৎ কাল; ইদিকে ছোঁড়া গাঙের ধারে গিয়া বস্যা কি করছিল কে জানে? পিছা থেকে সাপটা গিয়া এক্কেরে পিঠের মেরুদণ্ডের পরে দিছে ছোবল। ছোঁড়া ঘুরা দেখে কাল। বেদের বেটা, হাতে ছিল লোহার ডাণ্ডা, সেও দিলেক পিটায়ে। দুটাতেই মরল।

প্রকাণ্ড দুধে-গোখুরাটার নির্জীব দেহটা খানিকটা দূরে একটা ঝুড়ির নিচে ঢাকা ছিল। পাছে কাক চিল বা অন্য কোনো মৃতমাংসলোভী পাখি ওটাকে নিয়ে টানাটানি শুরু করে, সেই ভয়েই ঝুড়ি দিয়ে ঢেকে রেখেছে। ঝুড়িটা তুলে মহাদেব বললে—দেখেন, নিজের পাপে নিজে মরেছে ছেড়া, আবার মরণের কালে ই কি পাপ করে গেল, দেখেনঃ কি দেবতার মতন দেহ দেখেন। কি সোনার ছাতার মত চক্ক দেখেন! ই পাপ অৰ্ণাবে বেদে-গুষ্টির উপর।

এতক্ষণে কথা বললে শবলা, শবদেহটার উপর থেকে দৃষ্টি তার ফিরে আবদ্ধ হয়েছিল মহাদেবের উপর। কখন যে ফিরেছিল কেউ লক্ষ্য করে নাই। উত্তেজিত মহাদেবের কথা শুনে লোকে তার দিকেই তাকিয়ে ছিল, তারপর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে ছিল সাপটার উপর! সত্যই সাপটার দেহবৰ্ণ অপরূপ, এমন দুধের মত সাদা গোখুরা সাপ দেখা যায় না। এরই মধ্যে শবলা কখন দৃষ্টি ফিরিয়ে তাকিয়েছিল মহাদেবের দিকে। সে বলে উঠল-ই পাপ অৰ্ণাবে তুকে। বেদে-গুষ্টির পাপ ইতে নাই। পাপ তুর।

চমকে উঠল মহাদেব।

তিক্ত কুটিল হাসিতে শবলার ঠোঁট দুটি বেঁকে গিয়েছে, নাকের ডগাটা ফুলে ফুলে উঠছে। চোখের দৃষ্টিতে আক্রোশ যেন বিচ্ছুরিত হচ্ছে। কোনো অগ্নিকুণ্ডের ছাইয়ের আবরণ যেন অকস্মাৎ একটা দমকা বাতাসে উড়ে গিয়ে বাতাসের স্পর্শে মুহূর্তে মুহূর্তে দীপ্যমান হয়ে উঠছে। মহাদেবের কোন্ কথা যে দমকা বাতাসের কাজ করলে, শবলার চোখের দৃষ্টি থেকে উদাসীনতার স্তিমিত ভাবের ছাইয়ের আবরণ উড়িয়ে দিলে, সে কথা জানে ওই শবলাই।

মহাদেব তার কথা শুনে চমকে উঠেছিল, তার দিকে তাকিয়ে যেন থমকে গেল।

শবলার মুখের তিক্ত হাসি আরও একটু স্পষ্ট হয়ে উঠল, আরও একটু বেশি টান পড়ল তার দুই ঠোঁটের কোণে। মহাদেবের চমক দেখে এবং তাকে থকে যেতে দেখে সে যেন খুশি হয়ে উঠেছে; মহাদেবের স্তম্ভিত ভাবের অবসরে সে নিজের কথাটা আরও দৃঢ় করে বলে উঠল—শুধু ওই রাজলাগের মরণের পাপই লয় বুড়ো, ওই বেদের ছাওয়াল মরল, তার পাপও বটে। দুই পাপই তুর।

রোষ এবং বিস্ময় মিশিয়ে একটা অদ্ভুত ভাব ফুটে উঠছিল মহাদেবের মুখে, কিন্তু সে যেন নিজেকে ঠিক প্রকাশ করতে পারছিল না,শুকনো বারুদ ঠিকই আছে, কিন্তু আগুনের স্পর্শ পাচ্ছিল না। সে শুধু বললে—আমার পাপ?

–হাঁ। তুর। তুর। বুড়া, তুর। বল্ ক্যানে। উপরে রইছেন মাথার পরে দিনের ঠাকুর দিনমণি, পায়ের তলায় তুর মা-বসুমতী, তাকে মাথায় ধরে রইছেন মা-বিষহরির সহোদর বাসুকী। তুর ছামুতে রইছে মায়ের বারি—তু বব বুড়া, পাপ কার?

এবার ফেটে পড়ল মহাদেব। চিৎকার করে উঠল—শবলা!

সে হক যেন মানুষের হাঁক নয়—সে যেন আত্মা চিৎকার করে উঠল। সে আওয়াজে বেদেরা যে বেদেরা, যারা মহাদেবের সঙ্গে আজীবন বাস করে আসছে, তারাও চমকে উঠল। শিবরাম চমকে উঠলেন। বেদেদের আস্তানায় গাছের ডালে বাধা বদরগুলি চিকচিক করে এডাল থেকে ওডালে লাফিয়ে পড়ল, ছাগলগুলি শুয়ে ছিল, সভয় শব্দ করে উঠে দাঁড়াল, গাছের মাথায় পাখি যারা বসে ছিল, উড়ে পালাল; শব্দটা গঙ্গার বুকের জল ঘেঁষে দু দিকে ছুটে চলে অ্যাঁকেবাকে ধাক্কা মেরে প্রতিধ্বনি তুললে—

শবলা!

শবলা!

শবলা!

ক্রমশ দূরে-দূরান্তরে গিয়ে শব্দটা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে মিলিয়ে গেল। তখনও সকলে স্তম্ভিত হয়ে রয়েছে। শুধু শবলা গাছের ডালটা ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর অতি মৃদু কণ্ঠে অল্প একটু হেসে বলল—তুই বিচার কর্যা দেখ। পাঁচজন রইছে, পঞ্চজনেও বিচার করুক। এই রইছেন ধন্বন্তরি বাবার শিষ্য, ওরেও শুধা। বল্ রে বুড়া, তু যে লাগকে দেখে চিনলি রাজলাগ বলে, তু জানলি যে ইয়ারে ধরলে মিত্যু থেকে নিস্তার নাই। মুকে তু বললি সি কথা, ঘোড়াটার কাছ থেকে কেড়েও লিলি। কিন্তু ছেড়ে দিলি নাই ক্যানে? গাঙ পার কর্যা দেবগকে ছেড়া দিয়া যদি মেগে লিতিস তার মাৰ্জ্জনা, তবে বল্ রে বুড়া, মরত ওই বেদের ছাওয়াল, না মরত ওই দেবলগ? ইবার বিচার করে দেখ—পাঁচজনতে দেখুক কার পাপ?

মহাদেব কথার উত্তর খুঁজে পেলে না।

শবলা শিবরামের দিকে তাকিয়ে বললে—কই, বল তো তুমি ধন্বন্তরি-বাবার শিষ্য কচিধন্বন্তরি। বিচার কর তো তুমি।

শিবরামকে বলতে হলহ্যাঁ, সাপটা তুমি সন্ধেতেই যদি ছেড়ে দিয়ে আসতে, মহাদেব। ভুল তোমার হয়েছে।

মহাদেব একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে, বললে,-হ্যাঁ, তা বুলতে পার গ। তবে? ভুল তো এক রকমের লয়, ভুল দু রকমের; এক ভুল মানুষ করে নিজের বুদ্ধির দোষে, আর এক ভুল-সে ভুল লয় বাবা ভের-নেয়ত—অদেষ্ট মানুষকে ভেরস্ করায়। এ সেই আদেষ্টের খেলা, নেয়ত ভেরস্ করিয়ে দিলে।

আবার মহাদেব হঠাৎ উগ্র হয়ে উঠল—বললে—একবার বাবা, শিরবেদে বিশ্বম্ভরকে ছলেছিল অদেষ্ট। নিয়তি কন্যেমূর্তি ধরে এসে কালনাগিনীকে বুকে ধরিয়েছিলভেরমে ফেলে বুঝিয়েছিল, সে-ই তার মরা কন্যে। এও তাই বাবা। ওই পাপিনী লাগিনী কন্যের ছলনা। ওই কন্যেটার পাপ ঢুকেছে বাবা-মহাপাপ। মা-বিষহরির সেবায় মন নাই, মন টলেছে কন্যের। লাগিনীর মন মেতেছে বয়সের নেশায়। ওই ছেড়াটারে উ ভুলায়েছিল। কাঁচা বয়স ছাওয়ালটার, তার উপর মরদ হয়্যা উঠেছিল ভারি জবর। আধারের মধ্যে যমকে দেখলে, তার পিছা-পিছা ছুটে যেত। ছোঁড়া সেই গরমে এতবড় ধরাকে দেখলে সরাখানা! লাগিনীর কালো বরনের চিকচিকি আর চোখের ঝিঝিকিতে মেতে গেল। বেদের ছাওয়াল, মানলে না বেদেদের কুলশাসন, বুঝলে না নাগিনী হল বেদেকুলের কন্যে, ও কন্যে মায়াবিনী, মায়াতে ভুলায়ে আপন বাসনা মিটায়ে লিয়ে ওই ওরে ডংশন করবে। ততটা দূর ঘটনাটা এগোয় নাই বাবা, যদি ততদূর যেত তবে ওই লাগিনীই ওরে ডংশন করত। বেদের সহায় মা-বিষহরি, বেদেদের সে পাপ থেক্যা রক্ষা করেছেন। তিনিই রাজগোখুরারে পাঠায়ে দিছেন, ওরে মোহিত করেছেন। ওই সব্বনাশী

শবলাকে দেখিয়ে মহাদেব বললে—সব্বনাশী মায়ের ছলনা বুঝে নাই বাবা, বুঝলে ঘোড়াটারে বারণ করত। কুলতনা, ধরিস না, উ সাক্ষাৎ কাল, মা তুকে-আমাকে ছলতে পাঠায়েছেন ওই কালকে।

হাসলে মহাদেবদেব-ছলনা বুঝা যায় না বাবা। মায়াবিনীই ছোঁড়ারে বুলেছিল—নিয়ে আয় ধরে। হোক দুধবরন সাপ। মায়াবিনী রাজগোখুরা চিনত নাই, চোখে দেখে নাই। ওরই কথাতে আনল ছোঁড়া ধর্যা। দেবতার ইচ্ছা, বুঝতে পারি বাবা, লইলে রাজগোখুরার শুধু তো ছোঁড়াটারে খাবার কথা লয়, পাপী-পাপিনী দুজনারে খাবার কথা, তা হল নাই, শুধু ঘোড়াটাই গেল।

তারপর শবলার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেওই কন্যেটার কপালে অনেক দুঃখ আছে বাবা। অনেক দুঃখ পেয়ে মরবে।

****

পরের দিন শিবরাম আবার গিয়েছিলেন বেদেদের আস্তানায়।

যার জন্য মহাদেব একদিন পাঁচ কুড়ি এক টাকা অর্থাৎ একশো এক টাকা চেয়েছিল, তাই সে দিতে চেয়েছে বিনা দক্ষিণায়। ওই দিনের পুলিশ-তদন্তের সময় শিবরাম উপস্থিত ছিল–সেই কৃতজ্ঞতায় মহাদেব বলেছিল—আপনি যা করলে বাবা, তা কেউ করে না। বাবা ধন্বন্তরির দয়া আমাদের পরে আছে। এই শহরে এই মানুষটিই আমাদের আপনজন, তার কথাতেই আপনি এসেছ তা ঠিক; কিন্তুক বাবা, এসেছ তো তুমি! আপনজনের মতন কথা তো বুলেছ! আপনকার চরণে কাটা বিধলি পর পাঁতে কন্যা তুলে দিব আমি। কি দিব তুমাকে কবা, এই দুটি টাকা পেনামী–

শিবরাম বলেছিলেন না না না। টাকা দিতে হবে না মহাদেব। টাকা আমি নেব না। যদি দেবেই কিছু তবে আমাকে সাপ চিনিয়ে দিয়ে। আমি তোমাকে বলেছিলাম, মনে আছে?

–হঁ হঁ, আছে। দিব, তাই দিব। কাল আসিও আপনি। টাকা লাগবে না, কিছু লাগবে না। দিব, চিনায়ে দিব।

কিন্তু আশ্চর্য!

পরের দিন মহাদেব আর এক মহাদেব।

বসে ছিল সে আচ্ছন্নের মত। নেশা করেছে। গাঁজার সঙ্গে সাপের বিষ মিশিয়ে খেয়েছে। তার সঙ্গে খেয়েছে মদ। নেশায় ঘোরালো চোখ দুটো মেলে সে শিবরামের দিকে চেয়ে রইল। তারপর বললে—কি? কি বটে? কি চাই?

শিবরাম আশ্চর্য হয়ে গেলেন। তিনি কোনো কথা বলবার পূর্বেই মহাদেব বলে উঠল–বেদের মেয়ের লোভে আসছ? আ! বলে দুপাটি বড় বড় অপরিচ্ছন্ন দাঁত বের করলে হিংস্ৰ। জানোয়ারের মত।

শিবরাম শিউরে উঠলেন। পা থেকে মাথা পর্যন্ত যেন রক্তস্রোত শনশন করে বয়ে গেল। আত্মসংবরণ করতে পারলেন না তিনি। বলে উঠলেন—কি বলছ তুমি?

ঠিক বুলছি। মহাদেবের চোখ আবার তখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কণ্ঠস্বর মাদকের জড়তায় জড়িয়ে এসেছে।

না। কাল তুমি নিজে আসতে বলেছিলে তাই এসেছি। টাকা দিতে এসেছিলে; আমি নিই নি, বলেছিলাম

–অ। আবার চোখ দুটো বিস্ফারিত করে মহাদেব তার দিকে তাকিয়ে বললে—অ। কবিরাজ ঠাকুর! অ। আমি তুমারে চিনতে লেরেছি বাবা। নেশা করেছি, নেশা। তা—

আবার ঢুলতে লাগল সে। বিড়বিড় করে বললে—এখুন লারব বাবা। এখন হবে না। উঁহুঁ। উঁহুঁ। সে ধুলোর উপরেই শুয়ে পড়ল।

আর একজন বেদে এসে বললে—আপনি এখুন ফিরে যাও বাবা। বুড়ার এখুন হুঁশ নাই।

শিবরাম ক্ষুণ্ণ মনেই ফিরলেন। কিন্তু দোষ দেবেন কাকে? ওদের জীবনের এই ধারা। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন।

পরের দিন ঠিক দুপুরবেলা—এল শবলা।

আরও একদিন সে যে-সময়ে এসেছিল-ধূর্জটি কবিরাজ ছিলেন না, ঠিক তেমনি সময়ে। এসে সেই জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ডাকলে—কচি-ধন্বন্তরি! ছোট কবিরাজ গ!

বেরিয়ে এলেন শিবরাম।

—কি? কবিরাজ মশাই তো এ সময়ে বাড়িতে থাকেন না। সেদিন তো বলেছি তোমাকে। শবলা হেসে বললে–সে জেনেই তো আসছি গ। কাজ তো মোর তুমার সাথে।

—আমার সঙ্গে? বিস্মিত হলেন শিবরাম। মেয়েটার লাস্যময়ী রূপ তিনি সেদিন জমিদার বাড়িতে দেখেছেন। কালো ক্ষীণাঙ্গী বেদের মেয়ে লাস্যময়ী রূপ যখন ধরে তখন তাকে যেন আসব-সরোবরে সদ্যস্নাতার মত মনে হয়। সর্বাঙ্গ দিয়ে যেন মদিরার ধারা বেয়ে নামে। মানুষ আত্মহারা হয়। ওই নির্জন দ্বিপ্রহরে ধূর্জটি কবিরাজ অনুপস্থিত জেনে মোহময়ী নাগিনী কন্যা কোন ছলনায় তাকে ছলতে এল! বুকের মধ্যে হৃদপিণ্ড তাঁর সঘন স্পন্দনে স্পন্দিত হতে শুরু করেছে তখন; মুখের সরসতা শুকিয়ে আসছে। চোখ দুটিতে বোধহয় শঙ্কা এবং মোহ দুই-ই একসঙ্গে ফুটতে শুরু করেছে। শুকণ্ঠে তিনি বললেন কেন, আমার সঙ্গে কি কাজ?

শবলা বললে ভয় নাই গ ছোট কবিরাজ। তুমার সাথে দুপুরবেলা রঙ্গ করতে আসি নাই। বদন তুমার প্রসন্ন কর।

খিলখিল করে হেসে উঠল সে।

সাপের ঝাঁপি নামিয়ে চেপে বসল শবলা। বললে—কাল তুমি গেছিলা বুড়ার কাছে। কত টাকা দিছ বুড়ারে?

–টাকা?

–হ্যাঁ। টাকা। পরশু–

–অ। হ্যাঁ। পরশু যখন পুলিশে চলে গেল তখন বুড়ো আমাকে টাকা দিতে চেয়েছিল। আমি তো টাকা নিই নাই।

–হুঁ। কিছুক্ষণ চুপ করে রইল শবলা। তারপরে বললে—ঘুষ দিবারে চেয়েছিল, লাও নাই, ধরমদেব তুমারে রক্ষা করেছেন গ। লিলে তুমারে নরহত্যের পাপের ভাগী হতে হত। বুড়া জোয়ান বেদেটারে খুন করেছে।

চমকে উঠলেন শিবরাম।—খুন? খুন করেছে?

—হাঁ গ। খুন। বুড়া রাজ-গোখুরাটারে কেড়ে লিলে, রাখলে ঝাঁপিতে ভর্যা। মনে মনে মতলব করাই ভরা রেখেছিল। লইলে তো তখুনি যদি ছেড়ে দিত গাঙের ধারে—তবে তো ই বিপদ ঘটত না। মতলব করেছিল, রাতের বেলা ওই জোয়ানটা যখন আড ছেড়া চুপিসাড়ে বেরিয়ে যাবে আমার সন্ধানে, তখুনি পিছা পিছা গিয়া সাপটারে খোঁচা দিয়া দিবে পিছন থেকে ছেড়া। রাজগোখুরা তারে আমারে দুজনারেই খাবে। ঘোড়াটারে আমি বুলেছিলম গ। বারে বারে বুলেছিলম। কিন্তুক–

দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে শবলা। কাপড়ের খুঁট দিয়ে চোখ মুছলে। বললে—আমি লাগিনী কন্যে। আমার দিকে পুরুষকে তাকাতে নাই। বেদের পুরুষের তো নাই-ই। তার মোরে ভাল লেগেছিল—সে মোর পিছা পিছা ঘুরছে বছর কালেরও বেশি! বুলেছিল, যা থাকে মোর ললাটে তাই হবে, তবু তুর কামনা আমি ছাড়তে লারবলারব, আরব, লারব। আমি তারে কত বুঝ বুঝাইছি, তবু সে মানে নাই, নিতুই রাতে গায়ের ধারে, নয়তো গাঙের ধারে গিয়া বসে থাকত। আমি যেতম না, তবু সে বসে থাকত। বলত আসতে তুকে হবেই একদিন। যতদিন না আসবি, ততদিন বসে থাকব। বুড়া হব, সে দিন পর্যন্ত বসে থাকব; বুড়া জানত। বুড়াও তাই চেয়েছিল। আমার সাথে বুড়ার আর বনছে না। এই শহরে এসে মোর দেহেও কি হল কবরেজ! আমিও আর থাকতে পারলাম। আজ তিন দিন গাঙের ধারে তার সাথে দেখা আমিও করছিলম। মা-বিষহরির নাম নিয়া বুলছি কবরেজ, পাপ করি নাই, ধরম ছাড়ি নাই। শুধু গাঙের ধারে বস্যা বস্যা মা-বিষহরিরে ডেকেছি আর কেঁদেছি। কেঁদেছি আর বুলেছি–মা গ, দয়া কর, আমার জীবনটা লাও, আমারে তুমি মুক্তি দাও। জোয়ানটাও পাপ করে নাই কবিরাজ, মোর অঙ্গে হাত দেয় নাই, শুধু বুলেছে—শবলা, ই সব মিছা কথা রে, সব মিছা কথা, মানুষ লাগিনী হয় না। চল, আমরা দুজনাতে পালাই; পালাই চল্ হুই দেশান্তরে। দেশান্তরে গিয়া দুজনাতে ঘর বাঁধি। খাঁটি, খাই, ঘরকন্না করি। আমি শুম আর ভাবতম। ভাবতম আর কখুনও বা হাসতম, কখনও বা কাদতম। কখুনও মনে হত—সে যা বুলেছে সেই সত্যি, যাই তার সাথেই চলে যাই, বিদেশে গিয়ে ঘর বাঁধি, সুখে থাকি। কখনও বা মা-বিষহরির ভয়ে শিউরে উঠতম, বুকটা কেঁপ্যা উঠত, কদম আর বুলতমনা রে, না। নাওরে না না না। সাথে সাথে ডাকতম মা-বিষহরিক, বুলতম ক্ষমা কর গ মা, দয়া কর গ মা, দয়া কর। দণ্ড যদি দিবা মা, তবে আমারে দাও। আমার জীবনটা তুমি লাও, বিষের জ্বালায় জর-জর করা আমার জীবনটা লাও। জোয়ান ছেলে, মরদ মানুষ তারে কিছু বুলো না, তারে তুমি মাৰ্জ্জনা কর, দয়া কর, ক্ষমা কর।

বলতে বলতে চুপ করে গেল শবলা, অকস্মাৎ উদাস হয়ে গেল-কথা বন্ধ করে চেয়ে রইল আকাশের দিকে। কার্তিকের মধ্যাহ্নের আকাশ। শরতের নীলের গাঢ়তা তখনও আকাশে ঝলমল করছে। কয়েক টুকরো সাদা মেঘও ভেসে যাচ্ছিল। বাতাসে শীতের স্পর্শ জেগেছে; গঙ্গার ওপারের মাঠে আউস ন কাটা হয়ে গেছে, হৈমন্তী ধানের মাঠেলঘু ধানে হলুদ রঙ ধরে আসছে, মোটা ধানের ক্ষেত সবুজ, শিষগুলি নুয়ে পড়েছে। রাস্তায় লোকজন নেই। মধ্যে মধ্যে গঙ্গার স্রোত বেয়ে দু-একখানা নৌকা চলেছে ভেসে।

সে দিনের স্মৃতি শিবরামের মনে এমন ছাপ রেখে গেছে যে, সে কখনো পুরনো হল না। কালো মেয়ে শবলা, কালের ছোপের মধ্যে সে মিলিয়ে যাবার নয়; সে কোনো দিনই যাবে না; কিন্তু সে দিনের আকাশ, মাঠ, গঙ্গা, দুপুরের রোদ-সব যেন তার বৃদ্ধ বয়সের জরাচ্ছন্ন চোখের সামনেও সদ্য আঁকা ছবির মত টকটক করছে।

 

অনেকক্ষণ পর শবলা দীৰ্ঘনিশ্বাস ফেলে কথা বলেছিল—তা মা ক্ষমা করলে না। মায়ের ইচ্ছে ছাড়া তো কাজ হয় না কবরাজ; তাই বুলছি এ কথা। নইলে।

ঝকমক করে উঠল শবলার চোখ। সাদা দাতগুলি ঝিকমিক করে উঠল—নিক কালো নরম দুটি পাতলা ঠোঁটের ঘেরের মধ্যে। কণ্ঠস্বরের উদাসীনতা কেটে গেল, জ্বালা ধরে গেল কণ্ঠস্বরে, বললে—ওই–ওই বুড়ো রাক্ষস উয়াকে খুন করেছে। অন্ধকারে চুপিচুপি গিয়া ছেড়ে দিলে রাজ-গোখুরাকে। ঝাঁপিটাকে ঝাঁকি দিলে, লাগটারে রাগায়ে দিয়া ঝটিপার দড়ি টেনে ঢাকনাটা দিলে খুলে। সাপের আক্কোশ জান না কবরাজ-বড় আক্কোশ। সে ছামুতে পেলে ছেলেটাকে। বুড়া ভেবেছিল, আমি সমেত আছি—খাবে, আমারে উয়ারে দুজনারেই শ্যাষ করবে লাগ। তা—

নিজের কপালে হাত দিয়ে শবলা বললে তা আমার ললাটে এখুনও দুঙ্কু আছে, ভোগান্তি আছে, আমার জীবন যাবে ক্যানে!

ম্লান হাসি ফুটে উঠল তার মুখে, তারই মধ্যে ঢেকে গেল তার চোখের ঝকমকানির উগ্রতা। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে এল।

শিবরাম স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।

মেয়েটার চোখের কয় ফোঁটা জলে যেন সব ভিজিয়ে দিয়েছিল। কার্তিকের দুপুরটা যেন মেঘলা হয়ে গিয়েছে মনের মধ্যে। মানুষের গভীর দুঃখ যখন স্বচ্ছন্দ প্রকাশের পথ পায় না, বুকের মধ্যে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘোরে, তখন তার সংস্পর্শে এলে এমনিই হয়। কি বলবেন শিবরাম! চোরের মা যখন ছেলের জন্য ঘরের কোণে কি নির্জনে লুকিয়ে মৃদুগুঞ্জনে কঁদে তখন যে শোনে তার অন্তর শুধু বেদনায় বোবা হয়ে যায়, সান্ত্বনাও দিতে পারা যায় না, অবজ্ঞা করে তিরস্কারও করা যায় না। হতভাগিনী মেয়েটা ওদের সমাজধৰ্ম কুলধৰ্ম পালন করতে গিয়ে যে দুঃখ পাচ্ছে সে দুঃখকে অস্বীকার তো করা যায় না। আবার ওই কুলধৰ্ম অন্যায় মিথ্যে এ কথাই বা বলবেন কি করে শিবরাম? ওই যে ছেলেটা, তার ওই যৌবনধর্মের আবেগে ওই নাগিনী কন্যাটির প্রতি আসক্ত হয়েছিল, তাই বা কি করে সমর্থন করবেন? কিন্তু ছেলেটার মৃতদেহ মনে পড়ে এ কথাও মনে উঁকি মারতে ছাড়ছিল না যে, ওই কষ্টিপাথরকেটে-গড়া মূর্তির মত ওই ছেলেটার পাশে এই নিকষকালো মেয়েটাকে মানাত বড় ভাল।

আচার্য ধূর্জটি কবিরাজকে লোকে বলে সাক্ষাৎ ধূর্জটি; পবিত্রচিত্ত কবিরাজ শিবের মতই কোমল; পরের দুঃখে বিগলিত হন এক মুহূর্তে; আবার অন্যায় অধর্মের বিরুদ্ধে তিনি সাক্ষাৎ রুদ্র। তারই শিষ্য শিবরাম। শবলাকে তিনি সান্ত্বনাও দিতে পারলেন না, তার দুঃখবেদনাকে অস্বীকার করতে পারলেন না। রোগযন্ত্রণায় অসহায় রুগৃণের দিকে যে বিচিত্র দৃষ্টিতে বিজ্ঞ চিকিৎসক তাকিয়ে থাকেন, সেই দৃষ্টিতে তিনি শবলার মুখের দিকে তাকিলে রইলেন।

শবলা কিন্তু অতি বিচিত্র। অকস্মাৎ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সব যেন ঝেড়ে ফেলে দিলে এক মুহূর্তে। বললে—দেখ, নিজের কথাই পাঁচ কাহন করে বুলছি। যার লেগে এলম, সে ভুলেই গেলাম। এখন পড়ার কাছে কাল আবার কেন গেছিলা বল দেখি?

–সাপ চিনবার জন্যে। বুড়া বলেছিল সাপ চিনিয়ে দেবে।

–কত টাকা দিলা? বুড়া তুমাকে কত টাকা ঠকায়ে নিলে?

–টাকা?

–হাঁ গ। কত টাকা দিছ উয়াকে?

–টাকা কিসের? কি বলছ তুমি?

হেসে উঠল বেদের মেয়ে। ঠকে ঠকেছ—সে কথা জানাজানি করতে শরমে বাঁধছে কচিধন্বন্তরি? আঃ, হায় হায় কচি-ধন্বন্তরি, ঠকলে, ঠকলে, বুড়ার কাছে ঠকলে গ? আমার মতুন কালো সুন্দরীর হাতে ঠকলে যি দুস্কু থাকত না।

শঙ্কিত হয়ে উঠলেন শিবরাম। আবার মনে পড়ে গেল বেদের মেয়ের সেই জমিদার বাড়িতে লাস্যময়ী রূপ। বললেনো না। কি যা-তা বলছ তুমি?

বিদ্যে শেখার জন্যে টাকা দাও নাই তুমি? বুড়া তোমার কাছে পাঁচ কুড়ি টাকা চায় নাই? মিছা বলছ আমার কাছে? দাও নাই?

হঠাৎ মেয়েটার চেহারা একেবারে পালটে গেল। লাস্য না, হাস্য না, কঠিন ঋজু হয়ে দাঁড়াল কালো মেয়ে, চোখের দৃষ্টি স্থির, সর্ব অবয়বে ফণা-ধরে দাঁড়ানো সাপিনীর দৃপ্ত ভঙ্গি। শিবরাম শুনেছিল, নিয়তির আদেশ মাথায় নিয়ে দণ্ড ধরে সাপেরা দাঁড়ায় দণ্ডিত মানুষের শিয়রে, প্রতীক্ষা। করে, কখন দণ্ডিত মানুষটির আয়ুর শেষক্ষণটি আসবে, সঙ্গে সঙ্গে সে মারবে ছোবল। মনে মনে এরই একটি কল্পনার ছবি তাঁর আঁকা ছিল। তারই সঙ্গে যেন মিলে গেল। স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে ধীরে মৃদুস্বরে শবলা বললে রাজার পাপে রাজ্য নাশ, কত্তার পাপে গেরস্তের দুগগতি, বাপের পাপে ছাওয়াল করে দণ্ডভোগ। বুড়ার পাপে গোটা বেদেগুষ্টির ললাটে দুঃখভোগ হবে, বুড়ার পাপের ভাগ নিতে হবে, দুর্নামের ভাগী হতে হবে। তাই আমি ছুটে এলম আজ তুমার কাছে। তুমি কবরাজ; বেদেদের বিষের ঠাঁই তুমাদের পাথরের খলে। আমাদের যজমান তুমরা। তুমার কাছে টাকা লিলে, লিয়ে তুমার বিদ্যে দিলে না। অধৰ্ম্ম হল না? ই পাপ মা-বিষহরি সইবেন। ক্যানে গ? বিদ্যের তরে টাকা লিয়া বিদ্যে না দিলে বিদ্যে যে অফলা হয়ে যাবে। বুড়া করলে পাপ, আমি লাগিনী কন্যে, আমি এলম ছুটে—পেরামিত্তি করতে। যতদিন লাগিনী কন্যা রইছি তত দিন করতে হবে আমাকে বুড়ার পাপের পেরাচিত্তি।

হাঁপাতে লাগল শবলা। চোখ দুটোতে সেই স্থির দৃষ্টি। সে যেন সত্যি সত্যিই নাগিনী কন্যা হয়ে উঠেছে, শিবরাম সে নাগিনীকে শবলার মধ্যে দেখতে পাচ্ছেন।

বেদেনীর বিচিত্র ধর্মজ্ঞান এবং দায়িত্ববোধ দেখে শিবরাম অবাক হয়ে গেলেন। তিনি বললেন কিন্তু আমার কাছে তো টাকা নেয় নি মহাদেব।

–সত্যি বুলছ?

–সত্যি বলছি। কেন আমি মিথ্যে বলব তোমার কাছে?

–তুমাকে বিনি টাকাতে বিদ্যে দিবে বলেছিল?

শিবরাম বললেন পরশু যখন পুলিশের সঙ্গে গিয়েছিলাম, তখন তো ছিলে তুমি শবলা! মনে নেই, পুলিশ চলে গেলে মহাদেবের সঙ্গে আমার কি কথা হয়েছিল?

ঘাড় নেড়ে বললে শবলা—না। শেষ বেলাটা আমার শ ছিল না কবরাজ। পুলিশ চলে গেল। বুঝলাম জোয়ানটার দেহ এইবার গাঙের জলে ভাসায়ে দিবে। ভেসে যাবে ঢেউয়ে ঢেউয়ে, কোথা চলে যাবে কোন দেশে দেশে। মনটাও যেন আমার ভেসে গেল। কানে কিছু শুনলম না আর, চোখে কিছু দেখলম না।

শিবরাম বললেন–পুলিশ চলে গেলে মহাদেব আমাকে দু টাকা প্রণামী দিতে এসেছিল, আমি তা নিই নি। বলেছিলাম, টাকা আমি নেব না। সত্যিই যদি কিছু দিতে চাও, তবে আমাকে সাপ চিনিয়ে দিয়ে। বলেছিল—দেব। তাই গিয়েছিলাম। তুমি তো দেখেছ, একেবারে নেশায় অজ্ঞান হয়ে রয়েছে। কি করব! ফিরে এলাম।

–মিছা, মিছা, সব মিছা কচি-ধন্বন্তরি সব মিছা। নেশা উ করেছে। কিন্তু বেদের মরদের। নেশা হয় কবরাজ? সাপের বিষ গিলে ফেলবার ঠাঁই না পেলে গাঁজার সাথে খাবার তরে রেখে দেয়। এমন বেদেও আছে ধন্বন্তরি, মুখের দাঁতের গোড়ায় ঘা না থাকলে বিষ চেটেই খেয়ে ফেলায়। উ তুমাকে বুলেছিল—বিদ্যে দিব, বিনা পয়সায় দিব। কিন্তুক বলে আফসোস হল, বিনা টাকায় বিদ্যে দিতে মন চাইল না, তাথেই অমুনি ভান করলে গ! জান, তুমি চলে এলে খানিক পরেই বুড়া উঠে দাঁড়াল, তারপরে সে কি হা-হা হাসি! তোমারে ঠকায়েছে কিনা তাথেই খুশি, তাথেই আলাদ। দেহটা মোর যেন আগুনের হেঁকায় শিউরে উঠল ধন্বন্তরি; মনে মনে মাবিষহরিকে ডাকলম। বললম মা, তুমি রক্ষে কর অধৰ্ম্ম থেকে। বেদেকুলের যেন অকল্যেণ না হয়। তাথেই এলম তুমার কাছে। বুলি, বুড়ো করলে পাপ, আমি তার খণ্ডন কর্যা আসি। কবরাজকে বিদ্যা দিয়া আসি।

শিবরাম বললেন—কি নেবে তুমি বল?

—কি নিব? বেদে বুড়া তুমাকে বাক্ দিছে, আমি সেই বাক্ রাখতে এসেছি। টাকা তো মুই চাই নাই কবরাজ। লাও, বস। লাগ চিনায়ে দিই তুমাকে।

বেদেদের পুরুষ-পুরুষানুক্রমিক রহস্যময় সর্পবিদ্যা। ওই আশ্চর্য কালো মেয়েটির সব যেন জন্মগুণে আয়ত্ত। রক্তের সঙ্গে মিশে গিয়েছে বোধ হয়।

নাগ দেখালে, নাগিনী দেখালে। নপুংসক সাপ দেখালে। আকার-প্রকারের পার্থক্য দেখিয়ে দিলে। ফণার গড়নে চোখের দৃষ্টিতে প্রভেদ দেখালে।–এই দেখ কচি-ধন্বন্তরি, দেখছ–ইটাতে ইটাতে তফাত?

শিবরাম দেখতে ঠিক পাচ্ছিলেন না। যমজ সন্তানের মায়ের চোখে ধরা পড়ে যে পার্থক্য, যে প্রভেদ, সে কি অন্য কারুর চোখে ধরা পড়ে? তিনি ধরতে ঠিক পারছিলেন না, শুধু অবাক হয়ে শুনে যাচ্ছিলেন। সে কি অপরূপ বর্ণনা! মেয়েটা কিন্তু প্রভেদগুলি স্পষ্ট, অত্যন্ত স্পষ্টরূপে চোখে দেখছে, আর বলে যাচ্ছে নাগ-নাগিনীর দেহবৈশিষ্ট্যের কথা। আচার্য ধূর্জটি কবিরাজ যেমন ধ্যানময় আনন্দের সঙ্গে অসংকোচে নর-নারীর দেহগঠনতত্ত্ব বর্ণনা করে যান, ছবি এঁকে বুঝিয়ে দেন, ঠিক তেমনিভাবে শবলাও সাপকে উলটেপালটে তার প্রতিটি অঙ্গ দেখিয়ে তাকে বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করলে।

বললে–কবরাজ, আমি যদি মাথায় পাগড়ি বেঁধে মরদ সাজি, তবু কি তুমি আমাকে দেখ্যা কন্যে বলে চিনবে না! ঠিক চিনবে। আমার মুখের মিঠা মিঠা ভাব দেখ্যাই চিনবে। সন্দেহ হলি পর বুকের পানে চাইলিই ধরা পড়বে। বুকের কাপড় যত শক্ত করাই বাঁধি, মেয়ের বুক তো লুকানো যায় না। তেমনি কবরাজ, নাগিনীর নরম নরম গড়ন, বরনের চিকচিকে শোভা দেখলেই ধরা পড়বেক।

শিবরাম বললে–হ্যাঁ।

তিনি যেন মোহাবিষ্ট হয়ে গিয়েছেন।

শবলা বললেবল, আর কি দেখবা।

—কি দেখব আর কোনো প্রশ্ন আর শিবরাম খুঁজে পেলেন না।

শবলা খিলখিল করে হেসে উঠল। রহস্যময়ী কালো মেয়েটা মুহূর্তে লাস্যময়ী হয়ে উঠল আবার, কটাক্ষ হেনে বলল—তবে ইবার আমাকে দেখ খানিক। সাপের চোখে ভাল লাগে। সাপিনী, তুমারও ভাল লাগবে বেদেদের লাগিনী কন্যে। লাগবে না?

শিবরামের বুকের ভিতরটায় যেন ঝড়ো হাওয়া বয়ে গেল। ধাক্কা দিয়ে সব যেন ভেঙেচুরে দিতে চাইলে, চোখ দুটির দৃষ্টিতে বুঝতে পারা গেল সে কথা। চোখের দৃষ্টি যেন ঝড়ের তাড়নায় জানলার মত কাঁপছে।

মেয়েটা আবার উঠল হেসে বললে—কবরাজ মনের ঘরে খিল আঁটো গ, খিল আঁটো।

শিবরাম মুহূর্তে সচেতন হয়ে উঠলেন। নিজেকে সংযত করেও হেসেই বললেন–খিল আঁটলেও তো রক্ষে হয় না শবলা; লোহার বাসরঘরে সোনার লখিন্দর সাতটা কুলুপ এঁটে শুয়েও রক্ষে পায় নি, নাগিনীর নিশ্বাসে সরষেপ্রমাণ ছিদ্র বড় হয়ে নাগিনীকে পথ দিয়েছিল। আমি খিল আঁটব না। তোমার সঙ্গে মনসা-কথার বেনেবেটি আর মহানাগের মত সম্বন্ধ পাতাব। জান তো সে কথা?

—জানি না? নাগলোকে থাকে নাগেরা, নরলোকে থাকে নরেরা, বিধেতার বিধান নরে নাগে বাস হয় না। কি করা হবে? নাগের মুখে মিত্যুবিষ, মানুষের হাতে অস্তর। এরে দেখলে ও ভাবেআমার মিত্যুদূত, ওরে দেখলে এ ভাবে আমার মিত্যুদূত। কখনও মরে মানুষ, কখনও মরে নাগ। বিধির বিধান–নরে নাগে বাস হয় না।

হাসল শবলা, বললে—মত্তে থাকে বণিক বুড়া, যত ধনী তত কৃপণ। বাড়িতে আছে গিনি, বেটা আর বেটার বউ। আর আছে সিন্দুকে ধন, খামারে ধান, ক্ষেতে ফসল, পুকুরে মাছ, গোয়ালে গাই। শ্যামলী ধবলী বুধি মঙ্গলার পাল। সেই পাল চরায় পাড়ার বাউরিছেলে বণিক বুড়োর রাখাল ছোঁড়া। কৃপণ বণিক বুডোর ঘরে রাধুনি নাই, বেটার বউকে ভাত রান্না করতে হয়। যেমন সুন্দরী তেমনি লক্ষ্মী, কিন্তু শিশুকালে মা বাপ হারিয়েছে, বাপকুলে কেউ নাই। নাই বলেই বণিক-বুডোর চাপ বউয়ের উপর বেশি। তাকে দিয়েই করায় রাধুনির কাজ, ঝিয়ের কাজ। বউ ব্রাঁধেন, শ্বশুরকে স্বামীকে খাওয়ান, নিজে খান, রাখাল ছোঁড়ার ভাত নিয়ে বসে থাকেন।

রাখাল ছোঁড়া গরুর পাল নিয়ে যায় মাঠে, গরুগুলি চরে বেড়ায়, সে কখনও গাছতলায়। বসে বাঁশি বাজায়, কখনও বা গাছের ডালে দোল খায়, কখনও ঘুমায়, কখনও আম জাম কুল পেড়ে আঁচল ভর্তি করে নিয়ে আসে। একদিন গাছের তলায় দেখে দুটি ডিম। ভারি সুন্দর ডিম। রাখালের সাধ হল, ডিম দুটি পুড়িয়ে খাবে। ডিম দুটি খুঁটে বেঁধে নিয়ে এল, বণিক-বউকে দিলে-বউ গ বউঠাকরণ, ডিম দুটি আমাকে পুড়ায়ে দিয়ে।

বউঠাকরুণ ডিম দুটি হাতে নিয়ে পোড়াতে গিয়েও পোড়াতে পারলে না। ভারি ভাল লাগল। আহা, কোন্ জীবের ডিম, এর মধ্যে আছে তাদের সন্তান, আহা! ডিম দুটি সে এক কোণে একটি টুকুই ঢাকা দিয়ে রেখে দিলে। তার বদলে দুটি কাঠাল বিচি পুড়িয়ে রাখালকে দিলেন—লে, খা।

রাখাল ছোঁড়া কাঠালবিচি-পোড়া খেয়েই খুব খুশি।

বউও খুব খুশি, কেষ্টর জীব দুটি বাঁচব।

দিন যায়, মাস যায়। রাখাল ঘেঁড়া গরু-চরায়। বউঠাকরুণ ভাত রাধে, বাসন মাজে, ঘরসংসারের কাজ করে। ডিম দুটি টুকুই চাপা পড়েই থাকে। বউঠাকরুণ ভুলেই যান, মনেই থাকে না। হঠাৎ একদিন দেখেন, টুকুইটি নড়ছে। বউয়ের মনে পড়ে গেল, হরপরশ হয়ে টুকুই তুলতেই দেখেন, দুটি নাগের বাচ্চা। লিকলিক করছে, ফণা তুলে দুলছে, মাথার চক্র দুটিতে পদ্মপুষ্পের মত শোভা।

বউয়ের প্রথমটা ভয় হল। তার পরে মায়া হল। আহা, তার যতনেই ডিম দুটি বেঁচেছে, ডিম ফুটে ওরা বেরিয়েছে। ওদের কি করে মারবেন? ভগবানকে স্মরণ করলেন, নাগের বাচ্চা দুটিকে বললেন—তোদের ধম্ম তোদের ঠাঁই, আমার ধৰ্ম্ম আমার কাছে, সে ধম্মকে আমি লঘন করব না।

বলে ছোট একটি মাটির সরাতে দুধ এনে নামিয়ে দিলেন। নাগ দুটি মুখ ড়ুবিয়ে চুচুক করে খেলে। আবার টুকুই ঢাকা দিলেন।

রোজ দুধ দেন, তারা খায় আর বাড়ে।

বণিক-বউয়ের মায়া বাড়ে।

ঘরে আম আসে, আমের রস করে তাদের দেন। কাঁঠাল এলে কাঁঠালের কোয়া চটকে তাও দেন। নাগ দুটি দিনে দিনে বাড়ে লাউ-কুমড়ার লতার ডগার মত। বেশ খানিকটা বড় হল–তখন আর তারা থাকবে কেন টুকুই-চাপা বেরিয়ে পড়ল; ঘুরতে লাগল ঘরের ভিতর, তারপরে বাইরে, ওই বণিক-বউয়ের পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল।

বণিক-বুড়ো বণিক-বুড়ি দুজনে ভয়ে শিউরে ওঠেন। ও মা-এ কি! এ কি কাণ্ড! এ কি। বেদের কন্যে, না, নাগিনী? এ কে? মার, মার, নাগের বাচ্চা দুটোকে মার।

বাচ্চা দুটিকে কপকপ করে কুড়িয়ে অ্যাঁচলে ভরে বেনে-বউ পালিয়ে গেলেন বাড়ির পদাড়ে। নাগ দুটিকে ছেড়ে দিয়ে বললেন—ভাই রে তোমরা তোমাদের স্বস্থানে যাও, আমি শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে ঘর করি, তাতেই গঞ্জনা সইতে পারি না। তোমাদের জন্যে মনে দুঃখু আমার হবে ডিম থেকে এত বড়টি করলাম। কিন্তু কি করব? উপায় নাই।

নাগ দুটি স্বস্থানে গিয়ে মা-বিষহরিকে বললেমা, ভাগ্যে বণিক-বেটি ছিল তাই বেঁচেছি, নইলে বাতাম না। সে আমাদের ভাই বলেছে, আমরা, তাকে দিদি বলেছি। সে তোমার কন্যে মা। তাকে একবার আনতে হবে আমাদের এই নাগলোকে। মা বললেন–বাবা, না। তা হয় না। নরে-নাগে বাস হয় না। বিধাতার নিষেধ। আমি বরং তাকে বর দেব এইখান থেকে, ধনে-ধানে সুখে স্বচ্ছন্দে স্বামী-পুত্রে তার ঘর ভরে উঠুক।

নাগেরা বললে–না মা, তা হবে না। তা হলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে নাগেদের বলবে নেমকহারাম।

মা বললেন—তবে আন।

নাগেরা নরের রূপ ধরলেন, বণিক-বউয়ের যমজ মাসতুতো ভাই সাজলেন, সেজে এসে দোরে দাঁড়ালেন মাউই গো, তাউই গো, ঘরে আছ? সঙ্গে ভার-ভারোটায় নানান দ্রব্য।

—কে? কে তোমরা?

—তোমাদের বেটার বাউয়ের মাসতুতো ভাই। দূর দেশে থাকতাম। দেশে এসে খোঁজ নিয়ে দিদিকে একবার নিতে এলাম।

–ও মাগো! বাপকুলে পিসি নাই মা-কুলে মাসি নাই শুনেছিলাম, হঠাৎ মাসতুতো ভাই এল কোথা থেকে?

–বললাম তো, দূর দেশে বাণিজ্য করতাম, ছেলেবয়স থেকে দেশ ছাড়া, তাই জান না।

বলে নামিয়ে দিলেন ভার-ভারোটায় হাজারো দ্রব্য। কাপড়চোপড় আভরণ গন্ধ–নানান দ্রব্য। মণিমুক্তার হার পর্যন্ত।

এবার চুপ করলে বুড়োবুড়ি। কেউ যদি না হবে তবে এত দ্রব্য দেবে কেন? জিনিস তো সামান্য নয়! এ যে অনেক! আর তাও যেমন-তেমন জিনিস নয়—এ যে মণি মুক্তো সোনা রুপো।

নাগেরা বললেন—আমরা কিন্তু দিদিকে একবার নিয়ে যাব।

–নিয়ে যাবে? না বাবু, তা হবে না।

–হতেই হবে। ওদিকে বণিক-বধূ কাঁদতে লাগলেন–আমি যাবই।

শেষে বুড়োবুড়িকে রাজি হতে হল। নগেরা বেহারা ভাড়া করলে, পাকি ভাড়া করলে, বণিক-বউকে পালকিতে চাপিয়ে নিয়ে চলল। কিছু দূরে এসে বেহারাদের বললে—এই কাছে আমাদের গ্রাম, ওই আমাদের বাড়ি। আর আমাদের নিয়ম হল–কন্যা হোক বউ হোক, এইখান থেকে পায়ে হেঁটে বাড়ি ঢুকতে হবে।

ভাল করে বিয়ে করলেন। দেখিয়ে দিলেন কাছের গ্রামের রাজবাড়ি। বেহারারা খুশি হয়ে চলে গেল।

তখন নগেরা বললেন–দিদি, আমরা তোমার মাসতুতো ভাইও নই, মানুষও নই। আমরা হলাম সেই দুটি নাগ, যাদের তুমি বাঁচিয়েছিলে। বড় করেছিলে। মা-বিষহরি তোমার বৃত্তান্ত শুনে খুশি হয়েছেন। তোমাকে নাগলোকে নিয়ে যেতে বলেছেন, আমরা তোমাকে সেইখানে নিয়ে যাব। মায়ের বরে তুমি বঁটুলের মত ছোটটি হবে, তুলোর মতন হালকা হবে, আমাদের ফণার উপর ভর করবে, আমরা তোমাকে আকাশ-পথে নিয়ে যাব নাগলোকে। তুমি চোখ বোজ।

মনে হল আকাশ-পথে উড়ছেন। তারপর মনে হল, কোথাও যেন নামলেন। নাগরা বললে—এইবার চোখ খোল।

চোখ খুললেন। সামনে দেখলেন, মা-বিষহরি পদ্মফুলের দলের মধ্যে শতদলের মত বসে। আছেন। অঙ্গে পদ্মগন্ধ, পদ্মের বরন। মুখে তেমনি দয়া।

মা বললেন মা, নাগলোকে এলে, থাক, দুধ নাড় দুধ চাড়, সহস্ৰ নাগের সেবা কর। সব দিক পানে চেয়ো মা, শুধু দক্ষিণ দিক পানে চেয়ো না।

 

নির্জনে দ্বিপ্রহরে গল্প বলতে বলতে বেদের মেয়েটার মনে ও চোখে যেন স্বপ্নের ছায়া নেমে এসেছিল। ওই ব্ৰতকথা গল্পের ওই স্বজনহীনা কন্যাটির বিষধরকে আপনজন জ্ঞানে অ্যাঁকড়ে ধরার মত এই মেয়েটিও যেন শিবরামকে অ্যাঁকড়ে ধরার কল্পনায় বিভোর হয়ে উঠেছে।

শিবরামের মনেও সে স্বপ্নের ছোঁয়া লাগল। তিনি বললেন হ্যাঁ, শবলা। ওই বেনেবেটি আর নাগেরা যেমন ভাই-বোন হয়েছিল, আমরাও তেমনি ভাই-বোন হলাম।

শুনে শবলা হাসলে। এ হাসি শবলার মুখে কল্পনা করা যায় না। মনে হল শবলা বুঝি কাদবে এইবার।

সে কিন্তু কদল না, কাদলেন শিবরাম, গোপনে চোখের জল মুছে বললেন—তা হলে কিন্তু তোমাকে আমি যা দেব নিতে হবে।

–কি?

শিবরাম বের করলেন দুটি টাকা। বললেন—বেশি দেবার তো সাধ্য আমার নাই। দুটি টাকা তুমি নাও! তুমি আমাকে বিদ্যাদান করলে, এ হল দক্ষিণা। গুরুদক্ষিণা দিতে হয়।

গুরু-দক্ষিণা কথাটা শুনে চপলা মেয়েটার সরস কৌতুকে হেসে গড়িয়ে পড়ার কথা। শিবরাম তাই প্রত্যাশা করেছিলেন। প্রত্যাশা করেছিলেন হেসে গড়িয়ে পড়ে শবলা বলবেও মা গ! মুই তুমার গুরু হলাম। দাও—তবে দাও। দক্ষিণে দাও।

শিবরামের অনুমান কিন্তু পূর্ণ হল না। এ কথা শুনেও সেয়েটা হাসলে না। স্থিরদৃষ্টিতে একবার তাকালে শিবরামের দিকে, তারপর তাকালে টাকা দুটির দিকে। শিবরামের মনে হল, চোখের দৃষ্টিতে রুপোর টাকা দুটোর ছটা বেড়েছে, সেই ছটায় দৃষ্টি ঝকমক করছে। তবু সে স্থির হয়ে রইল। নিজেকে সংবরণ করে নিয়ে বললে–না। লিতে লারব ধরমভাই। লিলে বেদেকুলের ধরম যাবে। তুমাকে ভাই বুলেছি, ভাই বলা মিছা হবে। উ লিতে লারব। টাকা তুমি রাখ।

শিবরাম বললেন-আমি তোমাকে খুশি হয়ে দিচ্ছি। তা ছাড়া, ভাই কি বোনকে টাকা দেয় না?

–দেয়! ইয়ার বাদে যখুন দেখা হবে দিয়ো তুমি। মুই লিব। সকল জনাকে গরব করা দেখিয়ে বেড়াব, বুলব—দে গো দেখু, মোর ধরমভাই দিছে দে।

তারপর বললে—বেদের কন্যে কালনাগিনী বইন তুমার আমি। আমি তুমারে ভুলতে লারব, কিন্তুক ধন্বন্তরি, তুমি তো ভুল্যা যাবা। দাম দিয়া জিনিস লিয়া দোকানিরে কে মনে রাখে কও? জিনিসটা থাকে, দোকানিটারে ভুল্যা যায় লোকে। আমি তোমারে বিনা দক্ষিণায় বিদ্যা দিলম, এই বিদ্যার সাথে মুইও থাকলম তুমার মনে। দাঁড়াও তুমাকে মুই আর একটি দব্য দিব।

মেয়েটা অকস্মাৎ ভাবোচ্ছ্বাসে উথলে উঠেছে বর্ষাকালের হিজল বিলের নদীনালার মত। অ্যাঁটসট করে বাধা তার বুকের কাপড়ের তলা থেকে টেনে বের করলে তার গলার লাল সুতোর জড়ি-পাথর-মাদুলির বোঝা। তার থেকে এক টুকরো শিকড় খুলে শিবরামকে বললে—ধর। হাত পাত ভাই। পাত হাত।

শিবরাম হাত পাতলেন। শিকড়ের টুকরাটা তার হাতে দিয়ে বেদের মেয়ে বললে ইয়ার থেকে বড় ওষুদ বেদের কুলের আর নাই ধন্বন্তরি। লাগের বিষের অম্রোে, মা-বিষহরির দান।

—কি এ জড়ি? কিসের মূল?

বেদের মেয়ে হাসলে একবার। বললে—সি কইতে তো বারণ আছে ধরমভাই। বেদেকুলের গুপ্ত বিদ্যা-এ তো পেকাশ করতে নিষেধ আছে।

মেয়েটা একটু চুপ করে থেকে বললে—যদি বিশ্বাস কর ধরমভাই, তবে বুলি শোন। এ যে কি গাছ তার নাম আমরাও জানি না। বেদেরা বলে—সেই যখন সাঁতালী পাহাড় থেকে বেদেরা ভাসল নৌকাতে, তখুন ওই কালনাগিনী কন্যে যে আভরণ অঙ্গে পর্যা নেচেছিল, তাথেই এক টুকরা মূল ছিল লেগে। সাঁতালী ছাড়ল বেদেরা, সঙ্গে সঙ্গে ধন্বন্তরির বিদ্যা চাঁদো বেনের শাপে হল বিস্মরণ। লতুন বিদ্যা দিলেন মা-বিষহরি। এখুন ধন্বন্তরির বিদ্যার ওই মূলটুকুই কন্যের আভরণে লেগে সঙ্গে এল, তাই পুঁতলে শিরবেদে নতুন সাঁতালী গাঁয়ে হিজল বিলের কূলে। গাছ আছে, শিকড় নিয়া ওষুদ করি। কিন্তু নাম তো জানি না ধরমভাই। আর ই গাছ সাঁতালী ছাড়াও তো আর কুথাও নাই পিথিমীতে। তা হলে তুমাকে নাম বলব, কি গাছ চিনায়ে দিব কি করা কও? এইটি তুমি রাখ, লাগ যদি ডংশন করে আর সি ডংশনের পিছাতে যদি দেবরোষ কি ব্ৰহ্মরোষ না থাকে ধন্বন্তরি—তবে ইয়ার এক রতি জলে বেট্যা গোলমরিচের সাথে খাওয়াই দিবা, পরানা যদি তিল-পরিমাণও থাকে, তবে সে পরানকে ফিরতে হবে, এক পহরের মধ্যে মড়ার মত মনিষ্যি চোখ মেলে চাইবে।

আর একটি শিকড়ও সে দিয়েছিল শিবরামকে। তীব্র তার গন্ধ।

 

এতকাল পরেও বৃদ্ধ শিবরাম বলেন-বাবা, সে গন্ধে নাক জ্বালা করে, নিশ্বাসের সঙ্গে বুকের মধ্যে গিয়ে সে যেন আত্মার শ্বাসরোধ করে।

 

শবলা সেদিন এই শিকড় তার হাতে দিয়ে বলেছিল—এই ওষুদ হাতে নিয়া তুমি রাজগোখুরার ছামনে গিয়া দাঁড়াইবা, তাকে মাথা নিচু কর্যা পথ থেকে সর্যা দাঁড়াতে হবে। দাঁড়াও দাঁড়াও, তুমাকে দেখায়ে দিই পরখ কর্যা।

খুলে দিলে সে একটা সাপের কাঁপি। কালো কেউটে একটা মুহূর্তে ফণা তুলে উঠে দাঁড়াল। সদ্য-ধরা সাপ বোধ হয়। শিবরাম পিছিয়ে এলেন।

হেসে বেদেনী বললে ভয় নাই, বিষদাঁত ভেঙে দিছি, বিষ গেলে নিছি। এসো এসো, তুমি জড়িটা হাতে নিয়া আগায়ে এসো।

বিষদাঁত ভাঙা, বিষও গেলে নেওয়া হয়েছে সবই সত্যি; কিন্তু শিবরাম কি করে কোন সাহসে এগিয়ে যাবেন! দাঁতের গোড়ায় যদি থাকে একটা ভাঙা কণা? যদি থলিতে থাকে সুচের ডগাটিকে সিক্ত করতে লাগে যতটুকু বিষ ততটুকু? কিংবা বিষ গেলে নেওয়ার পর এরই মধ্যে যদি আবার সঞ্চিত হয়ে থাকে? সে আর কতটুকু? ওই দাঁতের ভাঙা কণার মুখটুকু ভিজিয়ে দিতে কতটুকু তরল পদার্থের দরকার হবেপুরো এক বিন্দুরও প্রয়োজন হবে না। এক বিন্দুর ভগ্নাংশ।

বেদের মেয়ে শিবরামের মুখের দিকে চেয়ে হেসে বললে—ডর লাগছে? দাও, জড়িটা আমাকে দাও। জড়িটা নিয়ে সে হাতখানা এগিয়ে নিয়ে গেল।

আশ্চর্য! সাপটার ফণা সংকুচিত হয়ে গেল, দেখতে দেখতে সাপটা যেন শিথিলদেহ হয়ে। ঝাঁপির ভিতর নেতিয়ে পড়ে গেল। মানুষ যেমন অজ্ঞান হয়ে যায় তেমনি, ঠিক তেমনিভাবে।

–ধর, ইবার তুমি ধর।

শিবরামের হাতে শিকড়টা দিয়ে এবার শবলা যা করলে শিবরাম তা কল্পনাও করতে পারেন। নি। আর একটা ঝাঁপি খুলে এক উদ্যতফণা সাপ ধরে হঠাৎ শিবরামের হাতের উপর চাপিয়ে দিলে।

সাপের শীতল স্পর্শ। স্পর্শটা শুধু ঠাণ্ডাই নয়, ওর সঙ্গে আরও কিছু আছে। সাপের ত্বকের মসৃণতার একটা ক্রিয়া আছে। শিবরাম নিজেও যেন সাপটার মত শিথিলদেহ হয়ে যাচ্ছিলেন। তবু প্রাণপণে আত্মসংবরণ করলেন। শবলা ছেড়ে দিলে সাপটাকে; সেটা ঝুলতে লাগল। শিবরামের হাতের উপর নিপ্ৰাণ ফুলের মালার মত।

আশ্চর্য!

শিবরাম বলেন—সে এক বিস্ময়কর ভেষজ বাবা। সমস্ত জীবনটা এই ওষুধ কত খুঁজেছি, পাই নি। বেদেদের জিজ্ঞাসা করেছি—তারা বলে নি। তারা বলে—কোথা পাবেন বাবা এমন ওষুধ? আপনাকে কে মিথ্যে কথা বলেছে। শিবরাম শবলার নাম বলতে পারেন নি। বারণ করেছিল শবলা।

বলেছিল–ই ওষুদ তুমি কখুনও বেদেকুলের ছামনে বার করিও না। তারা জানলি পর আমার জীবনটা যাবে। পঞ্চায়েত বসবে, বিচার করে বুলবে—বেটিটা বিশ্বাস ভেঙেছে, বেদেদের লক্ষ্মীর ঝাঁপি খুলে পরকে দিয়েছে। এই জড়ি যদি অন্যে পায় তবে আর বেদের রইল কি? বেদের ছামনে সাপ মাথা নামায়, তিল পরিমাণ পরান থাকলে বেদের ওষুদে ফিরে, সেই জন্যেই মান্যি বেদের। নইলে আর কিসের মানি! কুলের লক্ষ্মীকে যে বিয়ে দেয়, মরণ হল তার সাজা। মেরে ফেলাবে আমাকে।

শিবরাম কোনো বেদের কাছে আজও নাম করেন নি শবলার। কখনও দেখান নি সেই জড়ি।

ওদিকে বেলা পড়ে আসছিল; গঙ্গার পশ্চিম কূলে ঘন জঙ্গলের মাথার মধ্যে সূর্য হেলে পড়েছে। দ্বিপ্রহর শেষ ঘোষণা করে দ্বিপ্রহরের স্তব্ধ পাখিরা কলকল করে ডেকে উঠল; গাছের ঘনপল্লবের ভিতর থেকে কাকগুলো রাস্তায় নামছে। শিবরাম চঞ্চল হয়ে উঠলেন। আচার্য ফিরবেন এইবার।

—তুমি এমন করছ ক্যানে? এমন চঞ্চল হল্যা ক্যানে গ?

—তুমি এবার যাও শবলা, কবিরাজ মশাই এবার ফিরবেন। কবিরাজ বারণ করে দিয়েছেন। শিষ্যদের সাবধান বাবা, বেদেদের মেয়েদের সম্পর্কে তোমরা সাবধান। ওরা সাক্ষাৎ মায়াবিনী।

শবলা ঝাঁপি গুটিয়ে নিয়ে উঠল। চলে গেল বেরিয়ে। কিন্তু আবার ফিরে এল।

—কি শবলা?

–একটি জিনিস দিবা ভাই?

–কি বল?

শবলা ইতস্তত করে মৃদুস্বরে প্রার্থিত দ্রব্যের নাম করলে।

চমকে উঠলেন শিবরাম। সর্বনাশ! ঐ সর্বনাশী বলে কি?

শিবরাম শিউরে বলে উঠলেন নানা-না। সে পারব না। সে পারব না। সে আমি—

মিথ্যে কথাটা মুখ দিয়ে বের হল না তাঁর। বলতে গেলেন—সে আমি জানি না। কিন্তু জানি না কথাটা উচ্চারণ করতে পারলেন না।

শবলা তাঁর কাছে নরহত্যার বিষ চেয়েছে ওষুধের নামে। মাতৃকুক্ষিতে সদ্যসমাগত সন্তান-হত্যার ভেষজ চেয়েছে সে। যে চোখে স্বপ্ন দেখা মানা, সে চোখে অবাধ্য স্বপ্ন এসে যদি নামে, সে স্বপ্নকে মুছে দেবার অস্ত্র চায় সে। সে ওষুধ সে অস্ত্র তাদেরও আছে; কিন্তু তাতে তো শুধু স্বপ্নই নষ্ট হয় না, যে-চোখে স্বপ্ন নামে সে চোখও যায়। তাই সে ধন্বন্তরির কাছে এমন ওষুধ চায়, এমন সূক্ষ্মধার শাণিত অস্ত্ৰ চায়, যাতে ওই চোখে-নামা স্বপ্নটাকেই বোটা-খসা ফুলের মত ঝরিয়ে দেওয়া যায়। যেন চোখ জানতে না পারে, স্বপ্ন ছিন্ন হয়ে মাটিতে পড়ে মিশে গেল।

শিবরাম জানেন বেদের মেয়েদের অনেক গোপন ব্যবসার কথা। এটাও কি তারই মধ্যে একটা? বশীকরণ করে তারা। কত হতভাগিনী গৃহস্থবধূ স্বামীবশ করবার আকুলতায় এদের ওষুধ। ব্যবহার করে স্বামীঘাতিনী হয়েছে, সে শিবরামের অজানা নয়।

কি চতুরা মায়াবিনী এই বেদের মেয়েটা! শিবরামের টাকা না নেওয়ার সততার ভান করে, তার সঙ্গে ভাই সম্বন্ধ পাতিয়ে, তাকে কেমন করে বেঁধেছে পাকে পাকে! ঠিক নাগিনীর বন্ধন।

বেদের মেয়ে মায়াবিনী, বেদের মেয়ে ছলনাময়ী, বেদের মেয়ে সর্বনাশী, বেদের মেয়ে পোড়ারমুখী! পোড়ামুখ নিয়ে ওরা হাসে, নির্লজ্জা, পাপিনী।

শবলা শিবরামের মুখের দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শিবরামের মুখ দেখে, তার আর্ত কণ্ঠস্বর শুনে সে যেন মাটির পুতুল হয়ে গিয়েছিল কয়েকটা মুহূর্তের জন্য। কয়েক মুহূর্ত পরেই তার ঘোর কাটল। মাটির পুতুল যেন জীবন ফিরে পেলে। সে জীবন-সঞ্চারের প্রথম লক্ষণ একটি দীর্ঘশ্বাস। তারপর ঠোঁটে দেখা দিল ক্ষীণরেখায় এক টুকরা হাসি।

অতি ক্ষীণ বিষণ্ণ হাসি হেসে সে বললে—যদি দিবারে পারতে ধরমভাই, তবে বইনটা তুমার বাঁচত।

শিবরাম বুঝতে পারলেন না শবলার কথা। কি বলছে সে?

শবলা সঙ্গে সঙ্গেই আবার বললে—সি ওষুদ যদি না জান ধরমভাই, যদি দিতে না পার, তুমার ধরমে লাগে–তবে অঙ্গের জ্বালা জুড়ানোর কোনো ওষুদ দিতে পার? অঙ্গটা মোর জ্বল্যা যেছে গ, জ্বলা যেছে। মনে হছে হিজল বিলে, কি, মা-গঙ্গার বুকের পরে অঙ্গটা এলায়ে দিয়া ঘুমায়ে পড়ি। কিংবা লাগগুলাকে বিছায়ে তারই শয্যে পেতে তারই পরে শুয়ে ঘুমায়ে যাই। কিন্তু তাতেও তো যায় না মোর ভিতরের জ্বালা। সেই ভিতরের জ্বালা জুড়াবার কিছু ওষুদ দিতে পার?

ওদিকে রাস্তায় উঠল বেহারার হক। আচার্য ধূর্জটি কবিরাজের পালকি আসছে।

শিবরাম স্তব্ধ হয়েই দাঁড়িয়ে রইলেন। গুরুর পালকির বেহারাদের হাঁকেও তার চেতনা ফিরল না। বেদের মেয়ে কিন্তু আশ্চর্য! মানুষের সাড়া পেয়ে সাপিনী যেমন চকিতে সচেতন হয়ে উঠে মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে যায়, তেমনিভাবেই ক্ষিপ্ৰ লঘু পদক্ষেপে আচার্যের বাড়ির পাশের একটি গলিপথ ধরে বেরিয়ে চলে গেল।

আচার্যের পালকি এসে ঢুকল উঠানে। আচার্য নামলেন। শিবরামের তবু মনের অসাড়তা কাটল না। হাতের মুঠোয় জড়ি দুটি চেপে ধরে তিনি দাঁড়িয়েই রইলেন।

কয়েক মুহূর্ত পরেই শিবরামের কানে এল—কোন দূর থেকে চপল মিষ্টি কণ্ঠের সুরেলা কথা।

–জয় হোক গ রানীমা, সোনাকপালী, চাদবদনী, স্বামীসোহাগী, রাজার রানী, রাজজনী, রাজার মা! ভিখারিনী পোড়াকপালী কাঙালিনী বেদের কন্যে তুমার দুয়ারে এসে হাত পেতে দাঁড়াছে। লাগলাগিনীর লাচন দেখ। কালামুখী বেদেনীর লাচন দেখ। মা–গ!

সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠল হাতের ডম্বরুর বাদ্যযন্ত্রটি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *