০১. ট্যাভার্ন ও কফিহাউস

টাউন কলকাতার কড়চা

ট্যাভার্ন ও কফিহাউস

জনসনের যুগে লণ্ডনের শহুরে জীবনের অন্যতম আকর্ষণ ছিল কফিহাউস ও ট্যাভার্ন। অষ্টাদশ শতাব্দীর কলকাতা শহরেও জনসনের যুগের লণ্ডনের বেশ একটু ছোঁয়া লেগেছিল বলে মনে হয়। ১৭৮০ সালে জনৈক প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন : ‘আমাকে একদিন কলকাতার একটি ট্যাভার্নে নিয়ে যাওয়া হল, তার নাম লণ্ডন হোটেল। একটি করে সোনার মোহর দিলে সেখানে প্রবেশাধিকার পাওয়া যেত এবং তার আমোদপ্রমোদও উপভোগ করার সুযোগ মিলত। সুরাপান ও ভোজনের দক্ষিণা ছিল আলাদা। কফিহাউস দেখেছি, এককাপ কফি খেতে একটাকা দক্ষিণা দিতে হত। অবশ্য এই একটি টাকা দিলে এককাপ কফি ছাড়াও, ইংরেজি পত্রিকাগুলি বিনা পয়সায় পড়তে পাওয়া যেত। লণ্ডনের ট্যাভার্নের মতন কলকাতার ট্যাভার্নেও সংবাদপত্র সাজানো থাকত। ক্যালকাটা অ্যাডভাটাইজর, ক্যালকাটা ক্রনিকেল প্রভৃতি পত্রিকা আমি ট্যাভার্নে নিয়মিত পাঠ করেছি।’

এই বিবরণ থেকে বোঝা যায়, জনসনের যুগের লণ্ডনের হাওয়া কলকাতা শহরেও মৃদুগতিতে বইতে আরম্ভ করেছিল। তবে লণ্ডনের ট্যাভার্ন জনসনের যুগে যেমন তখনকার ইংরেজ সমাজ-জীবনের একটা বড় কেন্দ্র ছিল, কলকাতার ট্যাভার্ন বা পাঞ্চহাউস বাঙালির জীবনের সে-রকম কেন্দ্র ছিল না। অন্তত আঠার শতকে বা উনিশ শতকের গোড়ার দিকে একেবারেই ছিল না। বাংলার সমাজ-জীবন থেকে কলকাতার পাঞ্চহাউস ও ট্যাভার্নগুলি একেবারে বিচ্ছিন্ন ছিল বলা চলে। জনসনের যুগের ইংরেজ প্রতিনিধিরা নিজেদের দেশের মডেলে এই সব আড্ডাখানা কলকাতায় গড়ে তুলেছিলেন। বড় বড় সাহেবদের সঙ্গে এদেশের অভিজাত ধনীদের যথেষ্ট হৃদ্যতা থাকলেও, তাঁরা নাবিক সৈনিক বা ‘লোফার’ সাহেবদের সঙ্গে সাধারণত মেলামেশা করতেন না। বাঙালি নব্য অভিজাতদের বাড়িতে সাহেবসুবোদের নিয়ে ভোজসভার ও নাচসভার আয়োজন হত যথেষ্ট, কিন্তু ট্যাভার্ন বা পঞ্চহাউসে গিয়ে তাঁরা কখনও গোরাদের বারোয়ারি নাচ-গান হল্লায় যোগদান করতেন না। তা না করলেও ট্যাভার্ন ও পাঞ্চহাউস যে এদেশের নতুন শহুরে জীবনকে একেবারে প্রভাবিত করেনি তা নয়। পাশ্চাত্ত্য জীবনের অনেক পঙ্কিল আবর্জনার স্রোত কলকাতার এইসব পাঞ্চহাউসের ভিতর দিয়ে আমাদের নাগরিক সমাজের নানা স্তরে তখন বয়ে আসতে আরম্ভ করেছিল।

ট্যাঙ্কস্কয়ার (ডালহৌসি), লালবাজার, কসাইতলা (বেণ্টিক স্ট্রীট) ও বৌবাজার অঞ্চল ছিল তখন কলকাতার প্রাণকেন্দ্র। এই অঞ্চলেই কলকাতার আদিযুগের ট্যাভার্ন ও পাঞ্চহাউসগুলি গজিয়ে উঠেছিল। উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই অঞ্চলে পাঞ্চহাউসের হৈ-হল্লা অপ্রতিহত গতিতে চলেছিল বোঝা যায়। ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৮৪২ Bengal Hurkaru পত্রিকা ‘Lol Bazaar Revelries’ নাম দিয়ে স্থানীয় নাগরিকদের একটি আবেদনপত্রের সংবাদ পরিবেশন করেছেন। এই সংবাদ প্রসঙ্গে তাঁরা লিখেছেন :

The application was for the interference of the Magistrates to check the constant din and uproar, at almost all hours of the night and day, in that vicinity, caused by sea-men and others, riotous characters, who frequent the numerous public houses with which Loll Bazaar and Bow Bazaar abound……the tranquility and repose of the inhabitants being disturbed, owing to the uproarious revelry and noisy fiddling and drumming kept up every night, to a very late hour, in the many surrounding Punch Houses.

উনিশ শতকের মাঝামাঝির পর লালবাজার-বৌবাজার অঞ্চলে পাঞ্চহাউসের এই সুরামত্ততা ও হৈ-হল্লা যে কমে গিয়েছিল তা নয়। ক্রমে আরও বেড়েছিল, এমনও হতে পারে। ২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৭৮১ ‘ইণ্ডিয়া গেজেট’ পত্রিকায় একজন বৃদ্ধ ক্যাপটেন লেখেন : ‘১৭৩৬ সালে আমি কলকাতায় এসেছি। তখন দেখেছি, কৌন্সিলের অনরেবল মেম্বাররা Banyan Shirt, Long Drawer, ও Conjee Cap পরে বেড়াতেন। লঙ ড্রয়ার তাঁদের পরতে হত মশার কামড় থেকে আত্মরক্ষার জন্য। তার সঙ্গে থাকত ‘a case bottle of good old Arrack’ এবং ‘a Gouglet of Water,’ যা সেক্রেটারিরা ঘন ঘন মিশিয়ে ‘পাঞ্চ’ তৈরি করতেন। পাঞ্চহাউসেও এই শ্রেণির নানা রকমের পাঞ্চ তৈরি হত। সব ট্যাভার্ন ও পাঞ্চহাউসই যে নাবিক, সৈনিক ও অজ্ঞাতকুলশীল হল্লাবাজদের জন্য গড়ে উঠেছিল তা নয়। রবার্ট উইলসন অ্যাপলো ট্যাভার্নের ঠিকানা দিয়ে, ১২ ডিসেম্বর, ১৭৪৮ ফোর্ট উইলিয়মের প্রেসিডেণ্ট ও গবর্নর উইলিয়ম বারওয়েলকে একখানি পত্র লেখেন। পাদ্রি লঙ তাঁর অপ্রকাশিত দলিলপত্রের সংকলনে তা উল্লেখ করেছেন। ট্যাভার্ন যদি কেবল অমান্যদের মিলনকেন্দ্র হত, এবং তার সঙ্গে মানীদের একেবারেই কোনো সম্পর্ক না থাকত, তা হলে নিশ্চয়ই উইলসন সাহেব ‘dated Apollo at Calcutta’ বলে গবর্নরকে চিঠি লিখতেন না।

অ্যাপেলো ট্যাভার্নের যে একটা সামাজিক মর্যাদা ছিল তা পরিষ্কার বোঝা যায়। এ রকম আরও দু’চারটে ট্যাভার্ন যে ছিল না তা নয়। ১৭৫৮ সালে ট্রেশাম সাহেব (J. Tresham) মেরিডিথ লেনে (বেণ্টিক ষ্ট্রীট সংলগ্ন গলি) একটি ট্যাভার্ন প্রতিষ্ঠা করেন। এই ট্যাভার্নে তিনি ‘Settlement-এর’ (অর্থাৎ কলকাতা শহরের) ‘Ladies and Gentlemen’-এর জন্য নানারকমের খাদ্যদ্রব্য ও পানীয় (‘Cold Collations’) তৈরি করতেন। বিখ্যাত হারমনিক ট্যাভার্নের পাশে ফ্রাঁসিস গ্যালে (ফরাসী?) একটি ট্যাভার্ন খুলেছিলেন। সেখানে রিচার্ড বারওয়েল ১৭৭৫ সালে ‘every fortnight’ তাঁর বন্ধুবান্ধবদের একত্রে মিলিত হবার জন্য অনুরোধ করতেন। মহারাজা নন্দকুমারের ঐতিহাসিক বিচারের সময় ফ্রাঁসিস তাঁর ট্যাভার্ন থেকে উকিল অ্যাডভোকেটদের খাদ্য সরবরাহ করতেন এবং ১৬ জন লোকের ৮টি ডিনার ও ৯টি সাপারের জন্য তিনি ৬২০ টাকা বিল করেছিলেন। ফ্রাঁসিস গ্যালে ‘His Lordship’-এর বড় বড় ভোজসভাতেও খাদ্য যোগান দিতেন। অ্যাপলো বা গ্যালের ট্যাভার্ন অনেকটা একালের বড় হোটেলের মতন ছিল। ট্যাভার্ন ঠিক পাঞ্চহাউসের মতন ছিল না। পাঞ্চহাউসগুলি সাধারণ লোকের আড্ডার স্থান ছিল, ট্যাভার্ন ছিল সম্ভ্রান্তদের বিরামকেন্দ্র। খাদ্যদ্রব্য ও পানীয়েরও তফাৎ ছিল দুই স্থানে। পাঞ্চে যে পাঁচজনের আড্ডা জমত, তাদের কোনো সামাজিক পরিচয় বলে কিছু থাকত না। সেইজন্য সেখানকার উচ্ছৃঙ্খলতাও প্রায় সীমা ছড়িয়ে যেত। ট্যাভার্নে তা হত না।

হারমনিক ট্যাভার্ন

১৭৮০ সালে লালবাজারের হারমনিক ট্যাভার্ন কলকাতার উচ্চসমাজের সেরা মজলিসমহলে পরিণত হয়েছিল। আজকালকার বড় বড় হোটেলের চেয়েও হারমনিকের মর্যাদা তখনকার কলকাতায় অনেক বেশি ছিল। মিসেস ওয়ারেন হেষ্টিংস হারমনিকের একজন পেট্রন ছিলেন। নিয়মিত সেখানে তাঁর চা-কফির মজলিস বসত। মিসেস ফে তাঁর চিঠিপত্রের মধ্যে (Letters from India, 1818) লিখেছেন* : ‘কিছুদিন আগে হারমনিক ট্যাভার্নের একখানি টিকিট পেয়ে আমি সত্যিই খুব পুলকিত হয়েছিলাম। শহরের বাছা-বাছা বড়লোকেরা হারমনিকের পৃষ্টপোষক। তাঁরা নামের বর্ণানুক্রমে প্রত্যেকে প্রায় একপক্ষকাল অন্তর বলনাচ ও সান্ধ্যভোজের ব্যবস্থা করে থাকেন। শীতকালেই সাধারণত এই সব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আমি যে সান্ধ্য অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম, মিঃ টেইরল তার পেট্রন ছিলেন। চমৎকার নাচগান হল সেই রাতে, যা সহজে ভুলব না।’ (জানুয়ারি ১৭৮১)

হারমনিক ট্যাভার্নের খানাপিনা ও আমোদপ্রমোদের ব্যাপার নিয়ে হিকি সাহেব তাঁর ‘বেঙ্গল গেজেটে’ নির্মম ভাষায় ঠাট্টা বিদ্রূপ করতেন। একবার হারমনিকের খাদ্যদ্রব্যের মূল্য নিয়েও গেজেটে তীব্র সমালোচনা করা হয়, এবং ট্যাভার্নের পৃষ্ঠপোষকদের সভা ডেকে তার মীমাংসা করারও চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাতে কোনো ফল হয় না। ডিসেম্বর ১৭৮১, ‘বেঙ্গল গেজেট’ পত্রিকায় ‘Sarcasm’ নাম দিয়ে জৈনিক রসিক ব্যক্তি এই বিষয়ে একটি কবিতা লেখেন। কবিতাটি এই :

At the Harmonic Tavern in Loll Bazar Steet,

Where the hearty supporters of the STEWARDS meet;

Where still to protect their bless’d Constitution,

They are come to the following wise resolution;

RESOLV’D – That those Reptiles, who dar’d to express

In a libellous vile and malicious, address

An aversion to our belov’d spokesman (and thus

So apparent meant to reflect upon US)

Are too low for the notice of the SAWNEYS who meet,

At the Calcutta Tavern in Loll Bazar Street.

And after the most mature deliberation,

Much debate and much serious consideration;

Since We cannot their insult severely resent,

We’re determined to treat them with proper contempt;

And, therefore, no means of revenge being known,

Be it farther RESOLV’D-that we let them alone,

হারমনিক ট্যাভার্ন তার পূর্ণ মর্যাদা নিয়ে কলকাতার সমাজে দীর্ঘকাল জাঁকিয়ে বসেছিল। ১৭৮৫, জানুয়ারি মাসে হারমনিক ট্যাভার্নে ওয়ারেন হেস্টিংসকে তাঁর বিদায়কালীন ‘address of thanks’ দেবার জন্য মহানগরের মহামানীদের একটি সভা হয়। ১৭৯০-৯১ সালের দিকে হারমনিক ধীরে ধীরে একটি ‘অ্যাকাডেমি’ও হয়ে উঠে। জনৈক M. Soubie বিজ্ঞাপন দিয়ে জানান যে, ‘He keeps his school at the Harmonic where he attends Tuesdays, Thursdays and Saturdays, from seven in the morning till half past Ten O’Clock’. ট্যাভার্নে যখন সুবি সাহেব তাঁর স্কুলের ক্লাস নেবেন মনস্থ করেছিলেন, তখন তার পরিবেশ ঠিক যে ট্যাভার্ন-তুল্য ছিল তা বলা যায় না। অন্তত হারমনিকের মতন ট্যাভার্নের তা ছিল না।

ক্যালকাটা এক্সচেঞ্জ কফিহাউস

১ জুলাই ১৭৯৮ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে এই কফিহাউসের দ্বার উদ্ঘাটন করা হয়। বিজ্ঞাপনে জানানো হয় : এক্সচেঞ্জ কফিহাউস ভদ্রলোক, বণিক ও ব্যবসায়ীদের জন্য ১ জুলাই থেকে খোলা হবে। তিনটি বড় বড় ঘর থাকবে কফিহাউসে, এবং কাউন্সিল হাউস ষ্ট্রীট ও ট্যাঙ্ক স্কয়ার দুদিক থেকেই তাতে ঢোকার পথ থাকবে। কলকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বাই শহরে যত পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়, কফিহাউসের পরিচালকরা তার সবগুলিরই গ্রাহক হবেন, তাঁদের সহৃদয় পেট্রনদের সুবিধার জন্য। শুধু তাই নয়, ‘two of the most approved London Papers’ও তাঁরা নিয়মিত কফিহাউসে রাখবার ব্যবস্থা করবেন, এবং তার সঙ্গে ‘Some of the most curious and interesting political pamphlets’ও তাঁরা বিদেশ থেকে আমদানি করবেন। উৎসাহী পেট্রনরা কফিপানের সঙ্গে তাঁদের নানারকমের কৌতূহলও (জ্ঞানের) যাতে চরিতার্থ করতে পারেন, সেদিকে পরিচালকরা বিশেষ নজর রাখবেন।

১৭৯৯ সালেই এক্সচেঞ্জ কফিহাউস বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। এ-হেন কফিহাউস কেন যে একবছরের মধ্যেই অচল হয়ে গিয়েছিল বলা যায় না। হয়ত মালিক যিনি তিনি ট্যাভার্ন বা কফিহাউসের ব্যবসায়ে বিশেষ এক্সপার্ট ছিলেন না, অথবা তাঁর পেট্রন-তোষণের ব্যবস্থা এত বেহিসেবি হয়ে গিয়েছিল, যে শেষপর্যন্ত তিনি আর তাল সামলাতে পারেননি। ১০০ টাকা করে ১৬০০ টিকিট বিক্রির এক লটারির ব্যবস্থা করে তিনি কফিহাউসটি বেচে দিয়েছিলেন। মাত্র ১০০ টাকায় এই ধরনের একটি কফিহাউসের মালিকানা পাওয়া কম ভাগ্যের কথা নয়। সুতরাং টিকিট বিক্রি হয়েছিল, এবং কফিহাউসের মালিক ১০০ টাকা নয়, ১ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা পেয়েছিলেন।

স্টার্নডেল সাহেব তাঁর কলকাতা কলেক্টরেটের ইতিহাসে বলেছেন যে ১৮০০ সালে কলকাতায় নানারকমের ৮টি হোটেল ১১টি পাঞ্চহাউস এবং আরও কতকগুলি ইয়োরোপীয়ানদের বোর্ডিং-লজিং হাউস ছিল। অধিকাংশই তখন ট্যাডার্ন বা পাঞ্চহাউস নামে পরিচিত ছিল, ‘হোটেল’ নাম খুব বেশি ছিল না। অনেক ইয়োরোপীয় ব্যবসায়ী তখন ‘কফিহাউস’ নামটিও খুব পছন্দ করতেন। জনৈক William Doughty ১৮০৫ সাল থেকে কলকাতা শহরে হোটেলের ব্যবসা করতে আরম্ভ করেন। ১৮০৭ সালে তিনি ‘ক্যালকাটা গেজেট’ পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপনে জানান যে, ‘he has taken that well situated and most extensive House, belonging to the Estate of General Martine, opposite to the college and the South-West corner of Tank Square, where he has spared no expense, in fitting it up for the reception of Families and Gentlemen arriving from Europe…’ এই বিজ্ঞপ্তির পর তিনি ‘বিশেষ দ্রষ্টব্য’ (N.B) বলে উল্লেখ করেছেন ‘W.D. begs leave to observe that his house in future will be conducted under the title of the Crown and Anchor Hotel and British Coffee House.’ হোটেল নামের সার্থকতা বোঝা যায়, কিন্তু ডব্লু ডির ‘ব্রিটিশ কফিহাউস’ নামের প্রতি অনুরাগের কারণ কি, বিশেষ করে কলকাতা শহরে, তা বোঝা যায় না। শুধু এইটুকু বোঝা যায় যে জনসনযুগের লণ্ডনের অনেক সামাজিক বৈশিষ্ট্য ইংরেজরা তখন বেশ সচেতনভাবেই বাংলাদেশে বয়ে নিয়ে এসেছিলেন। এই বৈশিষ্ট্যের মধ্যে কলকাতার ট্যাভার্ন ও কফিহাউস অন্যতম।

কেবল কলকাতা শহরে নয়, কলকাতার বাইরে ইয়োরোপীয়দের অন্যান্য বাণিজ্য-বসতিকেন্দ্রে ও বন্দরে ট্যাভার্ন ও পাঞ্চহাউস আঠার শতক থেকেই গড়ে উঠেছিল। কলকাতার পঁচিশ মাইল দক্ষিণে ফলতা তখন ব্যবসা-বাণিজ্যের বড় ঘাঁটি ও বন্দর ছিল। নদীপথে কলকাতায় যাতায়াতের সময় সহেবরা প্রায়ই ফলতাতে হল্ট করতেন। সেখানে তাঁদের আপ্যায়ন-অভ্যর্থনার জন্য বেশ ভাল দু’ একটি ট্যাভার্ন গড়ে উঠেছিল। ১৮০২ সালে ফলতার একটি ট্যাভার্ন বিজ্ঞাপনে জানিয়েছিল যে তার অবস্থা, ‘by no means disgraceful to the most improved style of architecture. A number of captains, travellers of consequence land here, taking their departure to their various destinations in India,’ ১৮০৫ সালে এক ব্রিটিশ ভদ্রমহিলা ফলতার ট্যাভার্ন দেখে খুশি হয়ে লেখেন, ‘It was decent respectable place.’ ১৮১৩ সালে ফলতার ট্যাভার্ন সম্বন্ধে আর একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি লেখেন যে ‘মেসার্স হিগিনসন অ্যাণ্ড বল্ডুইন’ হলেন ট্যাভার্নের মালিক, এবং যাত্রীরা সেখানে স্বচ্ছন্দে বিশ্রাম করে যাতে ক্লান্তি দূর করতে পারেন, তার বেশ সুব্যবস্থাই মালিকরা করেছেন। ১৮১৭ সালে আর একজন পর্যটন লেখেন যে ফলতার ট্যাভার্নের মালিক হলেন একজন ডাচম্যান, ‘who consoled us by a most sumptuous breakfast, for which we paid two rupees each.’ ব্রেকফাস্টের দক্ষিণা আজকালকার অভিজাত হোটেলের তুলনায় নেহাৎ কম ছিল না।

ফলতার মতন শ্রীরামপুর চানক (বারাকপুর) প্রভৃতি স্থানেও ভাল ভাল ট্যাভার্ন ছিল। শ্রীরামপুর ট্যাভার্নের একটি প্রাচীন বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, মালিক চার্লন মেটন তাঁর পেট্রনদের প্রলুব্ধ করার জন্য জানাচ্ছেন :

Sirampore Tavern

Charles Maton having taken the house near the Water side lately occupied by Mojor Briton, and fitted up the same as a Tavern and Hotel, Respectfully acquaints the Gentlemen of Calcutta, that they may depend on every possible accomodation, good provisions and the best of liquors. Beds also may be had and Boarding, on Reasonable Terms.

N.B. – A very good Billiard Table and Skittle Ground, Mrs. Maton makes up all sorts of Millinery in the neatest manner. 9th December, 1780.

ট্যাভার্ন-পাঞ্চহাউসের ব্যবসা প্রধানত ইউরোপীয়দেরই একচেটিয়া ছিল। পরে লাভবান ব্যবসা বলে বাঙালি ব্যবসায়ীরাও এর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কলকাতার নানাস্থানে, বিশেষ করে ‘নেটিব’ ব্যবসাকেন্দ্র ধর্মতলা, চীনাবাজার প্রভৃতি অঞ্চলে, এদেশী ব্যবসায়ীরা পাঞ্চহাউসের ও ট্যাভার্নের ব্যবসা ফেঁদে বসেছিলেন। এরকম একজন চীনাবাজারের বাঙালি পাঞ্চহাউস-কিপারের কথা ‘গ্রিফিন’ তাঁর Sketches of Calcutta (Glasgow, 1843) পুস্তকে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। বাঙালি ব্যবসায়ীর নাম শ্রীকৃষ্ণ দত্ত। শ্রীকৃষ্ণের পাঞ্চহাউসের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় ছিল। কাঠের আসবাবপত্তর বলতে বিশেষ কিছুই ছিল না, এমনকি ভাঙাচোরা টেবল-বেঞ্চও না। তার মধ্যে নানাদেশীয় লোকের সমাগম হত এদেশীয় পচাই-মদের আকর্ষণে। ডাচ, পর্তুগিজ, ফরাসি, ইংরেজ, ট্যাঁস-ফিরিঙ্গি, বাঙালি, বিহারি, ওড়িয়া সকল জাতের লোকের পায়ের ধুলোয় শ্রীকৃষ্ণের পাঞ্চহাউস আন্তর্জাতিক তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছিল। অর্থাৎ দত্ত মহাশয়ের পাঞ্চহাউসকে আন্তর্জাতিক পচাইখানা বলা যেত। মধ্যে মধ্যে বিভিন্ন ভাষাভাষি খদ্দেরদের মধ্যে ভাব-বিনিময়ের সংকট দেখা দিত। সংকটের সমাধান করা হত আদিম সাংকেতিক ভাষায়। ‘গ্রিফিন’ চমৎকার ভাষায় ভাবের এই সাংকেতিক আদান-প্রদানের বিবরণ দিয়েছেন :

Jack is altogether ignorant of Bengalee, and the native spirit dealer is ignorant of English, but the former wants liquor and the latter wants money, and therefore the language of signs is very expressive.

জ্যাক একবর্ণও বাংলা জানে না, পচাইখানার মালিকও একবর্ণও ইংরেজি জানে না। কিন্তু প্রথম ব্যক্তি চায় পচাই, এবং দ্বিতীয় ব্যক্তি চায় টাকা। অতএব দুজনের ভাবপ্রকাশের পক্ষে ইঙ্গিতের ভাষাই যথেষ্ট। এই সব পাঞ্চহাউস ও ট্যাভার্নের কথা মনে করে ‘গ্রিফিন’ কলকাতা শহরের ‘pleasures of liberty and brandy’ অফুরন্ত ও অতুলনীয় বলে উল্লেখ করেছেন। শ্রীকৃষ্ণ দত্তের মতন নিশ্চয় আরও অনেক বাঙালি ব্যবসায়ী ট্যাভার্ন ও কফি-পাঞ্চহাউসের ব্যবসা করতেন, এবং সেগুলি প্রাচ্যপাশ্চাত্ত্য সংস্কৃতির লেনদেনের একটা কেন্দ্রও ছিল বলা চলে। অবশ্য লেনদেনটা হত সাংস্কৃতিক তলানির।

স্পেন্সেস হোটেল

আধুনিক যুগে ‘হোটেল’ বলতে যা বোঝায়, সেই ধরনের বাসস্থান আঠার শতকের মধ্যে কলকাতা শহরে গড়ে উঠেছিল বলে মনে হয় না। তার কারণ কলকাতা শহরে তখন যাঁরা যাতায়াত করতেন, তাঁদের ঠিক হোটেলের মতন কোনো জায়গায় থাকার বিশেষ প্রয়োজন হত না। ব্যবসায়ের দিক থেকে হোটেল তখন লাভের ব্যবসাও ছিল না। দু-চার দিনের জন্য শহরে যাঁদের মাথা গোঁজার দরকার হত, তাঁরা তা কোনোরকমে ট্যাভার্নের ঘরেই মিটিয়ে নিতেন। হোটেলের আরাম-বিরাম, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য তাঁদের প্রয়োজন হত না। আঠার শতক পর্যন্ত তাই ইংলণ্ডের শহরের মতন কলকাতা শহরেও ট্যাভার্ন ও কফিহাউসের প্রাচুর্য ছিল। জনসনযুগের লণ্ডন শহরের সঙ্গে কলকাতার এইদিক দিয়ে সাদৃশ্য ছিল তখন।

উনিশ শতকের গোড়ার দিক থেকেই মনে হয় কলকাতা শহরে হোটেল গড়ে উঠতে থাকে। কলকাতার আকার-গড়ন, বসতিবিন্যাস, লোকসংখ্যা, ব্যবসাবাণিজ্য, বিদ্যাচর্চা ইত্যাদি সবই তখন থেকে দ্রুত বাড়তে আরম্ভ করে। নানাস্থানের লোকজনের আনাগোনাও বাড়ে শহরে। ব্যবসায়ীরা হোটেল স্থাপনের আবশ্যকতা বোধ করেন। এই সময় যেসব হোটেল গড়ে ওঠে, তার মধ্যে ‘স্পেন্সেস হোটেল’ খুব প্রাচীন। নানাদিক থেকে স্পেন্সেসের একটা ঐতিহাসিক খ্যাতিও আছে। উনিশ শতকের প্রথমভগে কলকাতায় হোটেল বলতে স্পেন্সেস এবং স্পেন্সেস বলতে হোটেল বোঝাত। এরকম প্রতিষ্ঠা ও সুনাম তখনকার দিনে আর কোনো হোটেলের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব হয়নি। মনে হয়, ১৮৩০ সালে স্পেন্সেস হোটেল স্থাপিত হয়েছিল। কলকাতার সুপ্রিমকোর্টের অ্যাডভোকেট জর্জ জনসন ১৮৩০-এর গোড়ার দিকে কলকাতায় আসেন। তিনি লিখেছেন : ‘কলকাতাগামী জাহাজ ‘কেডিগ্রি’ (খেজুরী) পর্যন্ত পৌঁছলে, বিদেশি যাত্রীদের উচিত একটি চিঠি ডাকহরকরার নৌকায় কলকাতার কোনো বন্ধুর কাছে, অথবা মিঃ স্পেন্স বা মিঃ উইলসন যে-কোনো একজনের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে আগমন-সংবাদ জানানো।’ মিঃ স্পেন্স হলেন স্পেন্সেস হোটেলের মালিক, উইলসন হলেন অকল্যাণ্ড হোটেলের মালিক। শহরাভিমুখী যাত্রীরা কলকাতায় পৌঁছবার আগে খেজুরী বন্দর থেকেই স্পেন্সেস বা অকল্যাণ্ড হোটেলের কামরা রিজার্ভ করার জন্য আগে খবর পাঠাতেন। অকল্যাণ্ডের চেয়ে স্পেন্সেসের কাছেই অবশ্য বেশি খবর পৌঁছত।

জন স্পেন্স ঠিক কোন সময় থেকে এই হোটেলের ব্যবসা আরম্ভ করেছিলেন তা জানা যায়নি। ১৮৩২ সালের Bengal Registerএ ‘সেটেলমেণ্টের’ (কলকাতার) ইউরোপীয় অধিবাসীদের মধ্যে জন স্পেন্সের নাম পাওয়া যায়, কিন্তু তাঁর কাজকর্মের কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না। ১৮৩৪ সালের Calcutta Directory-তে John Spence, Calcutta Hotal, Waterloo Street, also at Becher’s place’-এই সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে জন স্পেন্সের হোটেল ব্যবসায়ের হদিশ মেলে। বর্তমান ওয়েলেসলি প্লেস ও ফ্যান্সি লেনই স্পেন্সেস হোটেলের আদিনিবাস।

১৮৩০-৪০ এর মধ্যে স্পেন্সেস হোটেলের খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কেবল খেজুরী বন্দরে পৌঁছেই যে কলকাতার নবাগতরা স্পেন্সেস হোটেলে খবর দিতেন তা নয়, গ্রিফিন লিখেছেন যে ডিঙি বা নৌকায় করে কলকাতার চাঁদপাল ঘাটে পৌঁছালেই পাল্কি-বেয়ারারা ঘিরে ধরত এবং শহরের কোনো জায়গায় নিয়ে যেতে বললেই সোজা স্পেন্সেস হোটেলে নিয়ে গিয়ে হাজির করত। ‘The bearers soon ask where to carry? Sahib would say-Burra Potch Khanna-great dinner house. In a few minutes they would take to Spence’s Hotel.’ (A Griffin : Sketches of Calcutta, ৩১-৩৫)।

স্পেন্সেস হোটেলের খরচের হিসেব দেখে মনে হয়, স্বল্পবিত্ত সাধারণ লোকের পক্ষে সেখানে থাকা সম্ভব হত না। জন স্পেন্স সম্বন্ধে ‘গ্রিফিন’ বলেছেন, ‘He may be said to have originated hotels in Bengal’। হোটেলের ‘রেট’ সম্বন্ধে তিনি বলেছেন : ‘একজনের একখানি থাকার ঘর, ব্রেকফাস্ট, টিফিন, ডিনার ও চা নিয়ে একমাসের জন্য ১০০ টাকা; তিন সপ্তাহের জন্য ৫০ টাকা; দু’সপ্তাহের জন্য ৭০ টাকা; এক সপ্তাহের জন্য ৪০ টাকা, এবং একদিনের জন্য ৬ টাকা। সুরাপানের খরচ এর অন্তর্ভুক্ত নয়। এক বোতল ক্ল্যারেট, শেরি, পোর্ট ও মদিরার জন্য ৩ টাকা, এক বোতল ব্র্যাণ্ডি, জিন ও হুইস্কির জন্য ২।।০ টাকা, এবং এক বোতল শ্যাম্পেনের জন্য ৬ টাকা দিতে হয়।’ অ্যাডভোকেট জনসন যে ‘রেটের’ কথা বলেছেন তা আরও একটু বেশি মনে হয়। তিনি লিখেছেন : ‘হোটেলের একতলায় শোয়া-বসার আলাদা ঘরের দু’কামরার ‘সুট’ নিয়ে থাকতে হলে, খাওয়া সমেত মাসে ২৫০ টাকা খরচ লাগত। দোতলার ও তেতলায় তিন কামরার ‘সুট’ ছিল, এবং সেখানে থাকার খরচ লাগত মাসে ৩৫০ টাকা (G. W. Johnson : The Stranger in India Vol. I, ৩৪-৩৫) ১৮৪১ সালের ‘গেজেটিয়ারে’ স্পেন্সেস হোটেলে থাকা-খাওয়ার যে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় তা এই :

প্রতিমাসের খরচ, একজনের

কামরা ১ ২ ৩ ৪ ৫
টাকা ১০০ ২৫০০ ৩৫০ ৪৫০ ৫৫০ } প্রতি কামরার জন্য ১০০ টাকা

তিন সপ্তাহের খরচ
৯০ ২২৫ ৩১৫ ৪০৫ ৪৯৫

দু’সপ্তাহের খরচ
৭০ ১৭৫ ২৪৫ ৩১৫ ৪৭৫

এক সপ্তাহের খরচ
৪০ ১০০ ১৪০ ১৮০ ২২০

একদিনের খরচ
৬ ১৫ ২৪ ২৭

অতিরিক্ত খরচ : প্রতিদিন ৫ টাকা

শহরে অন্যান্য আরও হোটেল যে ছিল না তা নয়। গেজেটিয়ারে আরও তিনটি হোটেলের নাম আছে :

উইলসন্স হোটেল-গভর্নমেণ্ট প্লেস ইস্ট

বেনিটো হোটেল-গভর্নমেণ্ট প্লেস নর্থ

বেণ্টন্স হোটেল-রানীমুদি গলি (ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান ষ্ট্রীট)

কিন্তু এসব হোটেল থাকলেও, ‘গ্রিফিন’ বলেছেন যে স্পেন্সের সঙ্গে কারও তুলনা হয় না : ‘There are two others, but Benton’s Cannot be compared to Spence’s and Bodry’s has not the smallest claim to similarity.’ জন স্পেন্স হোটেল ও কফিহাউস দুয়েরই ব্যবসা একসঙ্গে করতেন। কিন্তু দুই জায়গায় দুটি প্রতিষ্ঠিত ছিল। সেইজন্য পুরনো রেজিস্টারে ও গেজেটিয়ারে দুটি পৃথক ঠিকানা দেখা যায়। পরে একটি বাড়িতেই কফিহাউস ও হোটেল প্রতিষ্ঠিত হয়। স্পেন্সের কফি হাউস তখনকার দিনে সবচেয়ে অভিজাত মজলিসকেন্দ্র ছিল। কেবল ইয়োরোপীয়রা নন, এদেশীয় সম্ভ্রান্ত ধনিকেরাও স্পেন্সের কফিহাউসে মধ্যে মধ্যে সান্ধ্য মসলিশে মিলিত হতেন। কলকাতার ‘মজলিশী-কালচারকে’ কফিখানা হোটেলের ভিতর দিয়ে জন স্পেন্স একটা শোভন, সুন্দর ও সংযত রূপ দেবার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর এ চেষ্টা কলকাতার কালচার-স্নবদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকার মতন।

স্পেন্সেস হোটেলের একটি ঐতিহাসিক স্মৃতির কথাও এখানে উল্লেখ করা উচিত। ১৮৬৭ সালের ফ্রেব্রুয়ারি মাসে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ইউরোপ থেকে কলকাতায় ফিরে এসে স্পেন্সেস হোটেলে ওঠেন। তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আগে থেকে সুকিয়া স্ট্রীটে রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে তাঁর জন্য কয়েকখানি ঘর বিলেতি কায়দায় আসবাবপত্তর দিয়ে সাজিয়ে-গুছিয়ে রেখেছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল, মধুসূদন সেইখানেই এসে বাস করবেন। কিন্তু তা তিনি করেননি। কলকাতার শ্রেষ্ঠ অভিজাত হোটেল স্পেন্সেসেই তিনি উঠেছিলেন। তাঁর আগমনবার্তা শহরময় রাষ্ট্র হবার পর বন্ধুবান্ধবরা সকলে স্পেন্সেস হোটেলেই তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে আসেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ও তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য হোটেলে আসেন, এবং মধুসূদন তাঁকে দেখে দৌড়ে এসে তাঁর গলা জড়িয়ে ধরেন। কি করবেন ভেবে না পেয়ে, আনন্দে আত্মহারা হয়ে মধুসূদন দুহাতে বিদ্যাসাগরের গলা জড়িয়ে ধরে ঘন-ঘন তাঁকে চুম্বন করে নৃত্য করতে থাকেন। বিদ্যাসাগর ও মধুসূদন, বাংলার দুটি শ্রেষ্ঠ যুগপ্রতিভার এই ঐতিহাসিক মিলনদৃশ্য স্পেন্সেস হোটেলের ঘরেই অভিনীত হয়েছিল। মধুসূদন প্রায় আড়াই বছর স্পেন্সেস হোটেলে ছিলেন। এই সময় কলকাতা শহরের শ্রেষ্ঠ বাঙালিরা স্পেন্সেসে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। নবযুগের বাংলার প্রতিভাবান পুরুষদের কাছে অন্তত আড়াই বছরের জন্য যে স্পেন্সেস হোটেল তীর্থস্থানে পরিণত হতে পেয়েছিল, সেজন্য তার প্রতিষ্ঠাতা স্পেন্স সাহেব যথেষ্ট গর্ব বোধ করতে পারেন।

উইলসন-অকল্যাণ্ড-গ্রেট ইস্টার্ন

স্পেন্সেস ছাড়াও আরও দুতিনটি হোটেল যে তখন কলকাতায় গড়ে উঠেছিল, সেকথা আগে বলেছি! তার মধ্যে উইলসন্স বা অকল্যাণ্ড হোটেলের নাম স্পেন্সের পরেই উল্লেখযোগ্য। ডেভিড উইলসন এই হোটেল ১৮৩৫ সালে স্থাপন করেন। কলকাতা শহরে হোটেলের ব্যবসায়ে জন স্পেন্সের মতন উইলসনও একজন উৎসাহী ব্যক্তি ছিলেন। ইতিহাসের দিক থেকে স্পেন্সেসের পরেই তাঁর হোটেলের নাম করা উচিত। ডেভিড উইলসন শহরের লোকের কাছে ‘ডেইণ্টি ডেভি’ (Dainty Davie) নামে পরিচিত ছিলেন। কলকাতার গাড়োয়ান ও পাল্কি-বেয়ারারা তাঁর হোটেলকে উইলসন সাহেবের হোটেল বলত, যদিও তার নাম ছিল ‘অকল্যাণ্ড হোটেল’। পরে এই অকল্যাণ্ডই ‘গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল’ নাম ধারণ করে! ‘গ্রেট ইস্টার্ন’ নামে ব্যবসা আরম্ভ করার সময় সাময়িক পত্রিকায় তার যে পূর্বের ইতিহাস প্রকাশিত হয়, তার মর্ম এই :

মেসার্স ডি. উইলসন অ্যাণ্ড কোং সম্প্রতি ‘The Great Eastern Hotel Company Ld’ নামে হোটেলের ব্যবসা করতে আরম্ভ করেছেন। ব্যবসায়ের মূলধন ১৫ লক্ষ টাকা, ৬ হাজারের শেয়ারে ২৫০ টাকা করে বিভক্ত। হোটেলটি প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৩৫ সালে। মিস্টার ডি.উইলসন ‘ডেইণ্টি ডেভি’ নামে পরিচিত এবং এই কোম্পানির ১৫০০ শেয়ারের মালিক। ডেভিড উইলসন অনেক আগে ১৮৫১ সালে ওল্ডকোর্ট হাউস স্ট্রীট ও রানী মুদি গলিতে (ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান স্ট্রীট) জায়গা কিনে কতকগুলি দোকান খুলেছিলেন, এবং হোটেলের ব্যবসাও আরম্ভ করেছিলেন! তখন তাঁর হোটেলের নাম ছিল ‘Auckland Hotel and Hall of All Nations.’ এর চোদ্দ বছর পরে, ১০ সেপ্টেম্বর ১৮৬৫, তিনি ‘গ্রেট ইস্টার্ন’ নামে নতুন কোম্পানি করে ব্যবসাটিকে আরও বাড়াবার চেষ্টা করেন। ‘Great Eastern Hotel, a Wine and General Purveying Company Limited’ -এই ছিল কোম্পানির পুরো নাম। (The Calcutta Monthly Magazine, June 16, 1862).

অকল্যাণ্ডের বদলে ‘গ্রেট ইস্টার্ন’ নামকরণ সম্বন্ধে পত্রিকায় লেখা হয় : By a curious mistake the Company was described in the conveyance as the Great Eastern Hotel Company Ltd., instead of by its original title of the ‘Auckland Hotel and Hall of all Nations.’ আমাদেরও তাই মনে হয়। অকল্যাণ্ড হোটেলের নামটি, আমাদের মতে, অনেক বেশি সুন্দর ছিল, তার শেষের ‘Hall of all Nations’. আমাদেরও তাই মনে হয়। অকল্যাণ্ড হোটেলের নামটি, আমাদের মতে, অনেক বেশি সুন্দর ছিল, তার শেষের ‘Hall of all Nations’. এই অতিরিক্ত পদটির জন্য। আজকের দিনে হঠাৎ শুনলে মনে হয়, U.N.O বা রাষ্ট্রসংঘের কোনো শাখা-প্রতিষ্ঠান হতে পারে। উইলসন সাহেব অবশ্য একশো বছর আগে প্রখর আন্তর্জাতিকতাবোধের দিক থেকে যে তাঁর হোটেলের নামের শেষে ‘Hall of All Nations’ পদটি যোগ করেছিলেন তা মনে হয় না। কিন্তু তা হলেও তাঁর নামকরণের মধ্যে নতুনত্ব ও কৃতিত্ব দুইই ছিল। এদিক দিয়ে স্পেন্স সাহেবকে, ব্যবসায়ের দিক থেকে না হলেও নাম-নির্বাচনের দিক থেকে, উইলসন সাহেব যে হার মানিয়ে ছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হোটেলের ব্যবসায়ে তিনি স্পেন্সের অনুগামী হলেও, হোটেলের আধুনিক ‘ডেফিনিশন’ নির্ধারণে তিনি এক্ষেত্রে অন্যান্য সকল ব্যবসায়ীদের মধ্যে অগ্রগণ্য। আজ থেকে প্রায় ১২৫ বছর আগে, যখন হোটেল সম্বন্ধে মানুষের কোনো সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না, তখন হোটেলের এরকম একটি আভিধানিক সংজ্ঞা নির্দেশ করা সহজ ব্যাপার নয়। আজকের দিনেও যদি কেউ জিজ্ঞাসা করেন, ‘হোটেল’ কাকে বলে এবং যদি কেউ তার উত্তরে বলেন, ‘হোটেল’ হল ‘The Hall of All Nations’,  তাহলে কোনো ভুল হয়নি? বিংশ শতাব্দীর হোটেল-ব্যবসায়ীরাও স্বচ্ছন্দে উইলসনের এই ‘ডেফিনিশনটি’ হোটেলের মডার্ন বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করতে পারেন।

আগের বিবরণ থেকে বোঝা যায়, আঠার শতকের শেষভাগ থেকে উনিশ শতকের প্রথমভাগ পর্যন্ত কলকাতা শহরে ট্যাভার্ন ও কফিহাউসের হঠাৎ যেন একটা জোয়ার এসেছিল। জোয়ারের বেগ তারপর থেকে কমতে থাকে এবং ধীরে ধীরে একেবারে লোপ পেয়ে যায়। তার বদলে নানারকমের হোটেল ও চায়ের দোকান বা রেস্টুরেণ্ট গড়ে উঠে থাকে। কফিহাউস ও ট্যাভার্নগুলি প্রায় একশ বছর কলকাতায় নতুন শহুরে সমাজে প্রতিষ্ঠিত ছিল। প্রশ্ন হল, এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে এখানকার শহুরে সমাজে ও সাংস্কৃতিক জীবনে তারা কোনো প্রভাব বিস্তার করেছিল কিনা, এবং করে থাকলে কোনদিক থেকে কতখানি করেছিল? এ প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়, আঠার-উনিশ শতকে বাংলাদেশে যে নতুন সমাজ ও সংস্কৃতির বিকাশ হচ্ছিল কলকাতা শহর কেন্দ্র করে, তার উপর বিশেষ কোনো প্রভাব ট্যাভার্ন-কফিহাউসের পড়েনি! যেটুকু পড়েছিল তা হয়ত সমাজের তলার দিকে, চীনাবাজারের শ্রীকৃষ্ণের পাঞ্চহাউসের মতন আড্ডাখানার ভিতর দিয়ে চুঁইয়ে এসেছিল। সেটা পাশ্চাত্ত্য সংস্কৃতির একটা পাঁচমেশালি তলানি ছাড়া কিছু নয়, এবং তার খানিকটা আমাদের এদেশের সমাজের নর্দমা দিয়ে ভেসে চলে গেছে, আর কিছুটা তলানি সমাজের আনাচেকানাচে জমেছে।

আঠার শতকের ইংলণ্ডের শহুরে সমাজ-জীবনের একটা নিদর্শনরূপে ট্যাভার্ন-কফিহাউস আমাদের সমাজের শহরে শহরে আমদানি হয়েছিল। কেবল কলকাতায় নয়, বোম্বাই ও মাদ্রাজ শহরেও ট্যাভার্ন-কফিহাউস যথেষ্ট গড়ে উঠেছিল। ইংলণ্ডের শহরে কফিহাউস গড়ে ওঠার কারণ কী? কফি ও চা দুয়েরই আস্বাদ ইংরেজরা পেয়েছিলেন ‘ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি’র দৌলতে। ঐতিহাসিক ট্রেভেলিয়ান লিখেছেন :

…. in Charles II’s reign thousands of well-to-do Londoners frequented the ‘coffee-houses’, to enjoy the fashionable new drinks brought over by the East India Company. But early in the reign of George III all classes in town and country were drinking tea in their own homes. In his Farmer’s Letters for 1767 Arthur Young complained that ‘as much superfluous money is expended on tea and sugar as would maintain four millions more subjects on bread.’ Tea drinking had become a nantional habit, a rival to the consumption of spirits and beer; ‘the cups that cheer but not inebriate’ were already as well knwon and as highly valued in the labourer’s cottage as in the poet Cowper’s parlour.

(G. M. Trevelyan : English Social History, ৩৮৬-৮৭)।

দ্বিতীয় চালর্সের রাজত্বকালেই হাজার হাজার অবস্থাপন্ন লণ্ডনাররা কফিহাউসে যেতে আরম্ভ করেছিলেন, ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির আমদানি নতুন কফি-পান করার জন্য। কিন্তু তৃতীয় জর্জের রাজত্বকালের গোড়ার দিকেই শহরে ও গ্রামে ইংলণ্ডের লোকেরা ঘরে বসেই চা-পান করতে অভ্যস্ত হয়েছিলেন। ১৭৬৭ সালে আর্থার ইয়ং লেখেন যে ইংলণ্ডের লোক এত টাকা চা-চিনিতে খরচ করতেন যে তাতে অন্তত ৪০ লক্ষ লোকের রুটির খরচ যোগানো যেত। চা-পান ক্রমে ইংলণ্ডে একটা জাতীয় অভ্যাসে পরিণত হল, এবং বিয়ার ও সুরাপানের রীতিমত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াল। চা হল এমন এককাপ পানীয় যা মাতায়, কিন্তু মাতাল করে না, তাই মজুরের ঘর থেকে কবি কুপারের ‘পার্লার’ পর্যন্ত চায়ের আদর বেড়ে যেতে লাগল।

ট্রেভেলিয়ানের এই বিবরণ থেকে বোঝা যায়, কফি ও চা দুইই ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির আমল থেকে পূর্বাঞ্চল থেকে পশ্চিমে ও ইংলণ্ডে প্রচলিত হয়েছিল, এবং চায়ের আগে কফি-পান শুরু হয়েছিল শহরে। তাই চাখানার বদলে লণ্ডন শহরে আঠার শতকে কফিহাউসের অত প্রাচুর্য দেখা যায়। কফির দাম বেশি বলে শহরের অবস্থাপন্ন উচ্চমধ্যবিত্ত সমাজের বাইরে কফি-পান তেমন জনপ্রিয় হয়নি। কিন্তু তা না হলেও কফিহাউসগুলি ইংলণ্ডের সাংস্কৃতিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। জনসনের যুগের ইংলণ্ডের এতটাই ছিল বড় বৈশিষ্ট্য। এক-একটি কফিহাউস এক-একশ্রেণির বৃত্তিজীবীর মিলনকেন্দ্র ছিল। বণিক-ব্যবসায়ীরা ‘রয়াল এক্সচেঞ্জ’, গ্যারাওয়ে’, ‘জোনাথান’, ‘টমাস ও লয়েডস’ কফিহাউসে নিয়মিত মিলিত হতেন। পুস্তক-প্রকাশকদের মেলামেশার স্থান ছিল ‘চ্যাপ্টার কফিহাউস’, এবং ডাক্তারদের জন্য ছিল ‘ব্যাটসন্স’। ‘টেম্পলবার’ ও ‘কোভেণ্ট গার্ডেন’ কফিহাউসে ইংলণ্ডের বিখ্যাত সাহিত্যিক ও রসিকদের মজলিস বসত। সাহিত্যিকদের এই মজলিসে লণ্ডনের শৌখিন অভিজাতরাও মধ্যে মধ্যে এসে যোগ দিতেন। কিন্তু অভিজাতদের জন্য ছিল সেণ্ট জেমস ষ্ট্রীট ও পলমলের বিখ্যাত ‘কফি-চকোলেট-হাউস’। কোভেণ্ট গার্ডেনে সাহিত্যিকদের আড্ডা বসত বটে, কিন্তু ‘বেডফোর্ড’ কফিহাউস ছিল সাহিত্যিক-শিল্পীদের হেড-কোয়ার্টার। সেখানে ফিল্ডিং, হগার্থ, মার্ফি, কলম্যান প্রমুখ খ্যাতনামা সাহিত্যিকরা মিলিত হতেন। ড্রাইডেন, অ্যাডিসন, ষ্ট্রীল, এঁরা মিলিত হতেন ব্যাটন্স ও উইলস কফিহাউসে। প্রত্যেক কফিহাউস এইভাবে বিভিন্ন শ্রেণির ও গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাবান ব্যক্তির জীবনের সঙ্গে জড়িত ছিল। শিল্পী, সাহিত্যিক, রাজনীতিক, ডাক্তার, নানাশ্রেণির ব্যবসায়ী সকলেই নিজেদের এক-একটি গোষ্ঠী তৈরি করে স্বতন্ত্র কফিহাউসে মেলামেশা করতেন। তখনকার ইংলণ্ডের সম্ভ্রান্ত সমাজের যে-কোনো গোষ্ঠীর লোকের সঙ্গে পরিচিত হতে গেলে তাঁদের বাড়িতে না গিয়ে নির্দিষ্ট কফিহাউসে গেলেই চলত। তাতে আরও সুবিধা হত এই যে একজন সাহিত্যিক বা ব্যবসায়ীর সঙ্গে পরিচয় না হয়ে, আরও বহু সাহিত্যিক ও ব্যবসায়ীর সঙ্গে পরিচয় হত। অর্থাৎ লণ্ডনের বণিকসমাজ, বিদ্বৎসমাজ, শিল্পীসমাজ ইত্যাদির সঙ্গে পরিচিত হতে হলে তাঁদের নির্ধারিত কফিহাউসের প্রবেশপত্র না পেলে চলত না। জনসনের যুগের কফিহাউসগুলিকে এইদিক দিয়ে নিঃসন্দেহে সংস্কৃতিচক্র বলা যায়। জনসন নিজে অবশ্য কফিহাউসের চেয়ে ট্যাভার্নের পরিবেশই বেশি ভালবাসতেন, এবং তাঁর বিচিত্র ঐতিহাসিক জীবন ট্যাভার্নের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। ট্যাভার্নের চেয়ারটিকে জনসন ‘the throne of human felicity’ মনে করতেন। কফিহাউসে একশ্রেণির মানুষের একঘেয়ে সমাবেশ তাঁর ভাল লাগত না, তার চেয়ে ট্যাভার্নের মানব-বৈচিত্র্য তাঁকে অনেক বেশি প্রেরণা দিত। (Johnson’s England, an Account of the Life and Manners of his Age Edited by A.S. Turberville, Oxford 1933, Vol. I. ১৭-৮০)।

কফিহাউসের আরও সঠিক ইতিবৃত্ত রচনা করতে হলে বলতে হয়, এর উৎপত্তিস্থল অদূর-প্রাচ্য (Near East)। সেখান থেকে কনস্টানটিনোপল, ভিয়েনা ও হামবুর্গ-মার্সাইয়ের মতন বন্দর-শহরের ভিতর দিয়ে ক্রমে কফিহাউস পৌঁছেছিল লণ্ডনে। লণ্ডনে প্রথম কফিহাউস স্থাপিত হয় ১৬৫২ সালে, প্যারিসে হয় স্টক এক্সচেঞ্জের কাছে ১৬৭১ সালে। ইংলণ্ডে তখন গণতন্ত্রের উষাকাল। সমাজ তার আভাস পাচ্ছে জীবনে। এই সদ্যোজাত গণতান্ত্রিক সমাজের প্রথম অস্ফুট কলকাকলি শোনা যায় কফিহাউসে-‘the coffee-houses become the first centres of opinion in a partially democratised society’ (Mannheim) তখনও দৈনিক সংবাদপত্রের যুগ আসেনি, সংবাদপত্রের মতন দেখতে বৃহদাকারের নানারকম সব পত্রিকা প্রকাশিত হত, কিন্তু সেগুলি শাসকরা ‘সেন্সর’ করতেন, এবং তা নিয়মিত পড়ার অভ্যাসও লোকের হয়নি। সুতরাং ‘the Coffee-houses presented a place for free expression, where pamphlets were read and speeches given’ (Mannheim). আমাদের কলকাতার কফিহাউসেরও দু’একজন স্বত্বাধিকারী তাঁদের পেট্রনদের জন্য প্যামফলেট রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। ‘ক্যালকাটা এক্সচেঞ্জ কফিহাউস’-এর মালিক ১৭৯৮ সালে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়েছিলেন যে তিনি ‘some of the most curious and interesting political pamphlets’ বিদেশ থেকে আমদানি করার ব্যবস্থা করবেন। এদিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যায়, আঠার শতকে কফিখানার রাজনৈতিক গুরুত্ব কম ছিল না। ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস থেকেও তার প্রমাণ পাওয়া যায়। (Karl Mannheim : Essays on The Sociology of Culture, ১৩৮-৩৯)।

আধুনিক ক্লাবের (Club) বিকাশ হয়েছিল কফিহাউসের পরে। কপি হাউস যখন ধীরে ধীরে লোপ পেয়ে গেল, তখন ইংলণ্ডের শহর-নগর ক্লাবে ক্লাবে ছেয়ে গেল। সমাজতত্ত্ববিদ ম্যানহাইম বলেছেন : ‘The clubs retained much of the character of the coffee-houses. First of all, they mostly centred around shared opinions. ‘ কফিহাউসের বৃত্তিকেন্দ্রিক গোষ্ঠীবদ্ধতার বৈশিষ্ট্য নিয়ে আধুনিক ক্লাব গড়ে উঠেছে, এবং পরবর্তী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে ক্লাবের প্রভাব বেড়েছে সর্বক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি।

ইংলণ্ডের সমাজে ট্যাভার্ন-কফিহাউসের যে প্রবল প্রভাব ছিল, বাংলার সমাজে কলকাতার ট্যাভার্ন ও কফিহাউসের প্রভাব তার শতাংশের একাংশও ছিল না। বিদেশি ব্যবসায়ীরা এখানে ঠিক ইংলণ্ডের শহরের অনুকরণে এই সব ট্যাভার্ন ও কফিখানা গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সে চেষ্টা তাঁদের ব্যর্থ হয়েছিল। এদেশের সম্ভ্রান্ত ইংরেজরাও এগুলিকে আপনার করে নিতে পারেন নি। বেডফোর্ড, কোভেল্ট গার্ডেন বা জনসনের ট্যাভার্নের মতন একটিও কফিহাউস বা ট্যাভার্ন কলকাতা শহরে গড়ে উঠতে পারেনি। তার কারণ, আমাদের বাংলার সমাজ ইংরেজদের প্রভাবেও লণ্ডন-সমাজের মতন বাইরের জীবনের অনুরাগী হয়ে ওঠেনি। তাই উনিশ শতকের কোনো শ্রদ্ধেয় বাঙালি সমাজনেতা বা সাহিত্যিক কলকাতার কফিহাউস বা ট্যাভার্নের মজলিসে যোগ দিয়েছেন বলে শোনা যায় না। রামমোহন রায় থেকে দেশের সাধারণ লোকের জীবনে পর্যন্ত ঘর বৈঠকখানার প্রভাবই তখন সর্বাধিক ছিল ট্যাভার্ন-কফিহাউস। এমন কি বাইরের সভা-সমিতি পর্যন্ত, দীর্ঘকাল এদেশের ঘরোয়া-বৈঠকখানার বিকল্প মজলিসকেন্দ্র হতে পারেনি। নবযুগের বাংলার বুদ্ধিজীবীরা, এমনকি চরম-প্রগতিপন্থী ডিরোজিয়ান বা ইয়ংবেঙ্গল দলও যে কফিহাউসে মিলিত হতেন, তার কোনো সংবাদ পাওয়া যায় না। অথচ ইয়ংবেঙ্গলের ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’-এর বৈঠক ডিরোজিওর বৈঠকখানায় বা শ্রীকৃষ্ণ সিংহের বাগানবাড়িতে না বসে, উনিশ শতকের দ্বিতীয় তৃতীয় দশকে কলকাতার কোনো ভাল কফিহাউসে বা ট্যাভার্নে বসতে পারত। কিন্তু তা বসত না। ফরাসি বিপ্লব, আমেরিকান বিপ্লব, ইংলণ্ডের রিফর্ম ইত্যাদি বিষয়ে বিদেশি রাজনৈতিক পুস্তক-পুস্তিকা পড়বার আগ্রহ ইয়ংবেঙ্গলের যথেষ্ট ছিল, এবং সেজন্য তাঁরা জাহাজের পথ চেয়ে থাকতেন। ‘ক্যালকাটা এক্সচেঞ্জ কফিহাউস’-এর মতন কোনো জায়গায় তাঁদের যাতায়াত থাকলে তাঁরা হয়ত এই ধরনের অনেক পুস্তক-পুস্তিকার খবর পেতেন। কিন্তু সেরকম কোনো কফিহাউসের সঙ্গে তাঁদের ঘনিষ্ঠ সংস্রব ছিল বলে মনে হয় না। হয়ত তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ দুএকবার কফিহাউসে ‘হানা’ দিয়েছেন বিদেশি রাজনৈতিক পুস্তিকাদির সন্ধানে, কিন্তু লণ্ডনের মতন কলকাতার কোনো ট্যাভার্ন বা কফিহাউস তাঁদের গোষ্ঠীবদ্ধ পোষকতায় ধন্য হয়ে ওঠেনি। এদেশের কফিহাউসে তাই বিদেশি পরগাছার মতন গজিয়ে উঠে মাটির রসের অভাবে আপনা থেকেই শুকিয়ে গেছে। গণতন্ত্রের উষাকালে স্বাধীন লণ্ডন শহরে ট্যাভার্ন-কফিহাউস যেমন ‘partially democratised’ সমাজের ‘centres of opinion’ হয়েছিল, পরাধীন কলকাতা শহরে বিদেশি শাসকের অধীনে তা যে হতে পারেনি তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। তা না হতে পারাই স্বাভাবিক। অনেক পরে, বিংশ শতাব্দীর প্রায় দ্বিতীয় দশক থেকে, আমাদের দেশে কলকাতা শহরের চা খানাগুলি অষ্টাদশ শতাব্দীর লণ্ডনের কফিহাউসের ভূমিকা গ্রহণ করতে আরম্ভ করেছে। এবং তারও অনেক পরে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে বলা চলে, কলকাতা শহরে কফিহাউসের বিকাশ হয়েছে জনসনযুগের লণ্ডনের মতন।

* সুতানুটি সমাচার : এলিজা ফে’র চিঠিপত্র, দ্রষ্টব্য

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *