১৪. পাণ্ডুলিপির রোমান্স

পাণ্ডুলিপির রোমান্স

প্রথম স্তবক

.

যে দেশে ছাপার কর্ম চলিত না হইয়াছে সে দেশকে প্রকৃত সভ্য বলা যায় না। এই দেশে পূর্বকালে কতক লোকের ঘরে পুস্তক ছিল এবং অল্প লোক বিদ্যাভ্যাস করিত অন্য সকল লোক অন্ধকারে থাকিত এখন এই দেশে ক্রমে ছাপার পুস্তকে প্রায় ছোট বড় ঘর সকল ব্যাপ্ত হইয়াছে যে ব্যক্তি এক পুস্তক লইয়াছে তাহার অন্য পুস্তকের লওনের চেষ্টা জন্মে এইরূপে এদেশে বিদ্যা প্রচলিত হইয়াছে।

সমাচার দর্পণ, ২০ ফেব্রুয়ারি, ১৮১৯

ডাকবিভাগ ও ডাকপিয়ন না থাকলে যেমন দেশের লোকের মানসিক বৃত্তির স্বাভাবিক বিকাশ হত না, নানা রকমের ভাবাবেগ পত্রপক্ষ বিস্তারের অভাবে মনের চৌকাঠে মাথা খুঁড়ে মরে যেত—এতমনি যদি ছাপাখানা ও ছাপা বই না থাকত তাহলে জ্ঞানবিদ্যার আলো দেশের লোকসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হত না, মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা অসম্ভব হত, আমরা যে তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরেই থাকতাম। সুতরাং ছাপা বইয়ের জন্য যে ‘এদেশে বিদ্যা প্রচলিত হইতেছে’ এবং ‘যে ব্যক্তি এক পুস্তক লইয়াছে তাহার অন্য পুস্তক লওনের চেষ্টা’ জন্মাচ্ছে—’সমাচার দর্পণ’ পত্রিকার এ কথা খুব সত্য কথা। কিন্তু তবু যখন প্রেসের কল্যাণে একালের পাণ্ডুলিপির চরম দুরবস্থা দেখতে পাই, কম্পোজিটারের ডেস্ক থেকে কালিঝুলি মেখে ক্ষতবিক্ষত হয়ে লেখকের হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি প্রুফরিডারের নির্মম নির্যাতনচিহ্ন বুকে করে অবশেষে সম্পাদকের বা প্রকাশকের ওয়েস্টপেপার বাস্কেটের আবর্জনাস্তূপে নিদারুণ অবজ্ঞায় নিক্ষিপ্ত হয়—তখন, একমাত্র তখনই মনে হয় সেই পাণ্ডুলিপির রোমান্সের কথা। মনে হয়, অনর্থক অসহায় পাণ্ডুলিপির উপর ছাপাখানার এই অমানুষিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে লেখকদের দৃঢ়কণ্ঠে প্রতিবাদ করা উচিত। অবশ্য লেখকদের ক্ষীণকণ্ঠের আওয়াজ ছাপাখানার ট্রেডল—ফ্ল্যাট বা রোটারি মেশিনের গর্জনের মধ্যে ডুবে তলিয়ে যাবে। তবু প্রতিবাদের প্রয়োজন আছে, পাণ্ডুলিপি যে পবিত্র জিনিস, অন্তত সেই কথাটা জানাবার জন্য। ছাপাখানার প্রসার হোক ক্ষতি নেই, কিন্তু তার জন্য লেখকের পাণ্ডুলিপির সমস্ত মর্যাদা যে বিসর্জন দিতে হবে, তার কোনো মানে নেই। ‘লেখার কপি রেখে পাঠাবেন’—’অমনোনীত রচনা ফেরত দেওয়া হয় না’—ইত্যাদি সম্পাদকীয় বিজ্ঞপ্তির মধ্যেই পাণ্ডুলিপির বর্তমান দুরবস্থার পরিচয় পাওয়া যায়। সম্পাদকরা অবশ্য নিরুপায়, কারণ পাণ্ডুলিপির সংরক্ষণের মতন ‘গোডাউন’ তৈরি করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। স্ট্র্যান্ড রোডে গঙ্গার ধারের মালগুদামঘরের মতন পত্রিকা অফিসের পাশে পাণ্ডুলিপির গুদামঘর তৈরি করতে হয় তাহলে। কিন্তু লেখকদের অবস্থা কী?

আজকালকার অধিকাংশ লেখকদের দেখেছি পাণ্ডুলিপির প্রতি তাঁদের কোনো মমতা, কোনো শ্রদ্ধা বা যত্ন নেই। মনের মধ্যে ভাবের আবেগ এল, কতকটা যেন ‘নসিয়া’ বা বমি—বমি ভাবের মতন, অমনি তাঁরা সামনে যা পেলেন, দোকানের পুরনো মেমোর বা অফিসের ফর্মের পিছনদিক, এমনকি ঠোঙার কাগজ পর্যন্ত, তাতেই সমস্ত ইমোশনটাকে উগরে দিলেন, অত্যন্ত কুৎসিতভাবে কলমের আঁচড় টেনে। কোনো কোনো লব্ধপ্রতিষ্ঠ লেখকেরও পাণ্ডুলিপির প্রতি এই অশ্রদ্ধার ভাব দেখেছি। এটা কি যন্ত্রযুগের প্রভাব? ছাপাখানার মাহাত্ম্য? তাহলেও কম্পোজিটার ও রিডারদের কথা একটু ভাবা উচিত। পাণ্ডুলিপির যদি রীতিমতো পাঠোদ্ধার করতে হয়, প্রতিটি শব্দ তার ডিসাইফার করতে হয়, তাহলে ছাপাখানার কর্মীদের অবস্থাটা কী হয় সে সম্বন্ধেও রীতিমতো জ্ঞান থাকা দরকার। ছাপাখানার যুগেও পাণ্ডুলিপির মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকতে পারে এবং থাকাও উচিত। কিন্তু অনেক লেখকেরই সে সম্বন্ধে কোনো চেতনা নেই। পাণ্ডুলিপি আজ স্বয়ং লেখকের কাছেই অনাদৃত ও অবজ্ঞাত। তা কেন হবে? লেখা ছাপা হোক বা না হোক, প্রথম যখন নিজ হাতে লেখক তা লেখেন, তখন যদি তার প্রতি মমতা ও দরদ না থাকে, তাকে সুন্দর কাগজে সুশোভন অক্ষরে সুদৃশ্য করে প্রকাশ করবার ইচ্ছা তাঁর না হয়, তাহলে বুঝতে হবে যে, লেখাকে তিনি আন্তরিক ভালবাসেন না এবং লেখাটা তাঁর পেশামাত্র, প্যাশন নয়। আমার তো মনে হয়, পাণ্ডুলিপিটা একটা অত্যন্ত শখের শৌখিন জিনিস। দেখেছি, লেখা যাঁদের জীবনের প্যাশন, লেখা যাঁরা ভালবাসেন, তাঁদের পাণ্ডুলিপি ঠিক যেন অরিজিনাল পেইন্টিং—এর মতন। যেমন, রবীন্দ্রনাথের পাণ্ডুলিপি। কাটাকাটির পাকচক্রের মধ্যেও অত্যন্ত সজাগ শিল্পীমনের চক্রমণের যে পরিচয় রবীন্দ্রনাথের পাণ্ডুলিপিতে পাওয়া যায়, তেমনটি আর কোথাও পাওয়া যায় না। আর দেখেছি, রাজশেখর বসুর পাণ্ডুলিপি, দেখবার মতন, শিল্পী ও বিজ্ঞানী এখানে যেন একাত্মা হয়ে গেছেন। শব্দ গুনে, লাইন গুনে এক—একটি পৃষ্ঠা অত্যন্ত সযত্নে লেখা, অক্ষরের দৈর্ঘ্য পর্যন্ত সমান—কাটা শব্দের উপর মেপেজুখে সাদা কাগজ এঁটে তার উপর সংশোধিত শব্দটি লেখা। আশ্চর্য পাণ্ডুলিপি, দেখিনি কখনও। পাণ্ডুলিপি যে একরকম হতে পারে তা ‘পরশুরামের’ পাণ্ডুলিপি দেখার আগে কল্পনাও করিনি। আমি তাঁর একটি ব্যঙ্গকবিতার পাণ্ডুলিপি সযত্নে বাঁধিয়ে রেখেছি ঘরে, দেখলেও লেখার প্রেরণা পাওয়া যায়, মনে হয় লেখাই জীবনের জপতপধ্যান, লেখাই ব্রত, লেখাই সাধনা। লেখাটা তাসপাশা খেলার মতন বা শনিবারের ঘোড়দৌড় খেলার মতন অবসরবিনোদন নয়, হঠাৎ কোনো চিত্তচাঞ্চল্য যেনতেন প্রকারেণ কাগজে—কলমে খালাস করার ব্যাপারও নয়। শিল্পীর প্যাশন ও বিজ্ঞানীর প্রিসিশিন, শিল্পীর সাধনা ও বিজ্ঞানীর সংযম—লেখার জন্য দুইই থাকা চাই। হাতে লেখা পাণ্ডুলিপির মধ্যে যদি লেখকের চরিত্র ও মনের পরিচয় পাওয়া যায়, তাহলে এই দুইয়ের বিচিত্র প্রকাশ রবীন্দ্রনাথ ও রাজশেখর বসুর পাণ্ডুলিপির মধ্যে রয়েছে বলা চলে। রবীন্দ্রনাথের পাণ্ডুলিপি বিচিত্রগতি প্যাশনের প্রতিমূর্তি—ভাব—অনুভাব, খুশিখেয়াল ও কল্পনার অসংখ্য উচ্ছ্বসিত তরঙ্গায়িত স্রোতধারার চিহ্ন তার মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। রাজশেখর বসুর পাণ্ডুলিপি একাগ্রচিত্ত কঠোর জ্ঞানতপস্বীর পাণ্ডুলিপি, বিজ্ঞানীর সংযমনিষ্ঠা ও স্থিরতার প্রতিমূর্তি। তার ভেতর দিয়েই তাঁর সুরসিক শিল্পীমনের পরিচয়টিও পরিষ্কার ধরা পড়ে। ছাপা বইয়ের মধ্যে এত কথা জানা যায় না, এত কিছু ভাবাও যায় না। ছাপা বই তো সবই সমান, পাইকা বা স্মলপাইকাতে ছাপা হোক, আর লাইনোতেই ছাপা হোক। তা দেখে লেখকের মন বোঝা যায় না, মনের বিচিত্র গতির কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না। হয়তো বলবেন, লেখাই তো ছাপা রয়েছে, সুতরাং সমালোচকের দৃষ্টিতে লেখককে বিচার করা যাবে না কেন? কিন্তু সে হল সমালোচনা, লেখকের লেখার মূল্য বিচার, দূর থেকে লেখক ও লেখাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা। পাণ্ডুলিপির মধ্যে শিল্পীর সঙ্গে যে প্রত্যক্ষ ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়, তার সঙ্গে ছাপা বইয়ের কোনো তুলনাই হয় না। ব্যক্তিগত হাতে লেখা চিঠি আর ছাপানো বুকপোস্টে পাঠানো চিঠি কি এক? বই পড়ে দেশ দেখা, ফোটোগ্রাফে ও সিনেমায় স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও শিল্পকলার নিদর্শন দেখা, আর দেশ ভ্রমণ করে সোজা সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখ দিয়ে সব দেখার মধ্যে একটা বিরাট পার্থক্য নেই কি? নিশ্চয় আছে, পাণ্ডুলিপি ও ছাপা বইয়ের মধ্যেও পার্থক্য ঠিক ততখানি।

কল্পনা করুন, কোনো ‘শিল্পী’ তাঁর পাণ্ডুলিপি লিখছেন। নিভৃতে বসে একমনে তিনি লিখছেন, চিন্তাধারার সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে কলম চলছে কাগজের উপর। মনটা যেন তিনি উপুড় করে দিচ্ছেন পাণ্ডুলিপির মধ্যে। চিন্তার স্রোত যখন ঝর্ণা—ধারার মতন কুলকুল করে বয়ে চলেছে তখন কলমও চলেছে অবাধ গতিতে, পাণ্ডুলিপির অক্ষর ও শব্দবিন্যাসের ঝকঝকে—তরতরে চেহারা দেখলেই তা বোঝা যায়। ভাব যেখানে লেখ্যভাষার গণ্ডিকে ছাড়িয়ে দুরন্তবেগে ছুটতে চাইছে, কলম যেখানে মনের দুর্বার গতির সঙ্গে তাল রাখতে পারছে না, হয়রান হয়ে যাচ্ছে, সেখানে ভাবের সঙ্গে পাশাপশি কাঁধ মিলিয়ে ভাষার প্রাণপণ দৌড়বার চেষ্টা অতিদ্রুত লেখার অক্ষর ও শব্দগুলির ব্যস্তবাগীশ মূর্তির মধ্যে ধরা পড়ে যায় পাণ্ডুলিপিতে। চিন্তা ও ভাবধারা যেখানে সংযত, লেখাও সেখানে স্থির ধীর স্পষ্ট ও মন্থরগতি। বিরোধী ভাবধারার সংঘাত যেখানে আবর্তের সৃষ্টি করেছে, সেখানে অক্ষর ও শব্দগুলিও যেন বিক্ষুব্ধ ও প্রতিহত হয়ে পাণ্ডুলিপির উপর ঘন ঘন কাটাকাটি, আছড়া—আছড়ি করছে। পাণ্ডুলিপির মধ্যেকার কাটা শব্দ এবং সেই কাটা শব্দের দেহ ও পরিপার্শ্ব জুড়ে কলমের হিজিবিজি আঁচড়ের আবর্তন দেখলেই তা বোঝা যায়। রবীন্দ্রনাথের পাণ্ডুলিপিতে কেন এর প্রতিপত্তি তা বুঝতে একটুও কষ্ট হয় না। কবিমনের উদ্বেল ভাবতরঙ্গোচ্ছ্বাস রবীন্দ্র—পাণ্ডুলিপির মধ্যে চিহ্নিত ও রূপায়িত হয়ে থাকে। সেইজন্যই রবীন্দ্রনাথের পাণ্ডুলিপির মধ্যে তাঁর যেরকম প্রত্যক্ষ পরিচয় পাওয়া যায়, রবীন্দ্রনাথের ছাপা বইয়ের মধ্যে তা কখনোই পাওয়া সম্ভব নয়। তেমনি ছোটবড় সব লেখকের ক্ষেত্রেও এ কথা সত্য। পাণ্ডুলিপির মধ্যে আমরা লেখকের জীবন্ত সত্তাকে খুঁজে পাই, তাঁর মন ও চরিত্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয় হয় তার মধ্যে। প্রত্যেক রচনা সৃষ্টির পিছনে যে গভীর বেদনা থাকে, সেই বেদনা প্রকাশ করার ব্যাকুলতা যেভাবে লেখক অনুভব করেন, প্রকাশের পথে যে দ্বন্দ্ব—সংঘাতের মধ্য দিয়ে তাঁকে যেতে হয়, এমনকি যে স্নায়বিক শিহরন পর্যন্ত তিনি অনুভব করেন—তার প্রত্যেকটি সুস্পষ্ট ছাপ থাকে একমাত্র লেখকের নিজস্ব পাণ্ডুলিপির মধ্যে। ছাপা বইয়ের মধ্যে এছাপা থাকে না, থাকতে পারে না। শুধু লেখাটার বাইরের ইতিহাসটুকু নয়, সেই লেখা সৃষ্টির সমস্ত আভ্যন্তরিক, একান্ত গোপন ইতিহাসের ধারাও পাণ্ডুলিপির মধ্যে রূপায়িত হয়ে ওঠে। পাণ্ডুলিপির রোমান্স এইখানে, ছাপা বইয়ের মধ্যে কোনো রোমান্স নেই। ছাপাখানার একমাপের অক্ষরে সব বইয়ের মূল্য (বিষয়গত মূল্য নয়) সমান হয়ে যায়, ফ্ল্যাট মেশিনের চাপে সব লেখকের ব্যক্তিগত সত্তা ফ্ল্যাট হয়ে একাকার হয়ে যায়। কিন্তু পাণ্ডুলিপিতে তা হবার উপায় নেই। স্বাতন্ত্র্য তার থাকবেই থাকবে। সাজানো পাণ্ডুলিপির গ্যালারিতে বা প্রদর্শনীতে ঢুকে তাই মনে হয়, লেখকেরা যেন নিজেরাই দাঁড়িয়ে আছেন এবং তাঁদের সঙ্গে একেবারে মুখোমুখি পরিচয় হচ্ছে। আমাদের দেশের বড় বড় জাতীয় গ্রন্থাগারের পাণ্ডুলিপি—বিভাগের সামনে দাঁড়িয়ে অনেকদিন এই কথা আমার মনে হয়েছে, লেখকদের ব্যক্তিগত সত্তাকে মনে মনে অনুভব করেছি, রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছে দেহ—মন, কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম থেকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয়ের অভিজ্ঞতা লাভ করে। বইয়ের দোকানে দোকানে দিনরাত ঘুরে বেড়িয়েও এই অভিজ্ঞতা কোনোদিন হয়নি। আনন্দ হয়েছে, আগ্রহ বেড়েছে, কিন্তু রোমাঞ্চ হয়নি। বইয়ের দোকানে আইনস্টাইন ও আলিমুদ্দিন এক, রবীন্দ্রনাথে ও যাদবেন্দ্রনাথে কোনো তফাত নেই। কিন্তু পাণ্ডুলিপি দেখুন, সঙ্গে সঙ্গে আপনি অনুভব করবেন এই আইনস্টাইন, ওই আলিমুদ্দিন, এই রবীন্দ্রনাথ, ওই যাদবেন্দ্রনাথ। বলে দিতে হবে না, বুঝিতে দিতে হবে না, ছাপার হরফে নাম দেখেও চিনতে হবে না। দেখলেই বুঝতে পারবেন, রক্তমাংসের জীবন্ত রবীন্দ্রনাথ রয়েছেন তাঁর পাণ্ডুলিপির মধ্যে। পাণ্ডুলিপির এই যে রোমান্স, এ কি ভবিষ্যতে আর থাকবে না, আর কেউ অনুভব করবে না কোনোদিন? ছাপাখানা ও ছাপা বইয়ের জন্য পাণ্ডুলিপির নিজস্ব যে রোমান্টিক জগৎ তা কি একেবারে ধ্বংস হয়ে যাবে? শুধু ছাপাখানা নয়, মনে হচ্ছে টাইপরাইটারও যেন স্টিমরোলারের মতন পাণ্ডুলিপির এই রোমান্স ও রোমান্টিক জগৎকে ধূলিসাৎ করে দিচ্ছে। তা যদি দেয়, তাহলে আপশোসের আর সীমা থাকবে না।

পাণ্ডুলিপির রোমান্স

দ্বিতীয় স্তবক

তিল ত্রিফলা শিমুলছালা

ছাগদুগ্ধে করি মেলা

লৌহপাত্রে লোহায় ঘষি

ছিঁড়ে পত্র না ছাড়ে মসি।

.

ছড়া বা কবিতা নয়, কালি তৈরির ফর্মুলা যেকালি দিয়ে পাণ্ডুলিপি লেখা হত। আজকালকার ফাউন্টেন—পেনের কালি নয় বা কারখানায় তৈরি ছাপার কালি নয়। পাণ্ডুলিপি হাতে লেখার জন্য কালি তিল ত্রিফলা শিমুলছাল লৌহপাত্রে লোহায় ঘষে তৈরি কালি। এমন কালি যে, কলমের টানে পত্র ছিঁড়ে যেতে পারে, তবু কালি ছাড়বে না। কিন্তু পত্র ছিঁড়ে যাবার কোনো সম্ভাবনা ছিল কি? কলমের টান দিয়ে যাঁরা পাণ্ডুলিপি নকল করতেন তাঁদের কি বিদ্যাবুদ্ধি কিছুই ছিল না? মোটেই তা নয়। জবরদস্ত পণ্ডিত না হলেও, তাঁরা বেশ সুশিক্ষিত ছিলেন এবং লিখন—পঠনেও তাঁদের অসাধারণ দক্ষতা ছিল। তাঁরা অবশ্য ব্যবসাদার ছিলেন, অর্থাৎ পেশাদার নকলনবিশ। বেশ বোঝা যায়, সমাজের উচ্চস্তরের বা সাধারণ নিম্নস্তরের লোক পেশা হিসেবে এটা গ্রহণ করতেন না। মধ্যস্তরের স্বল্পবিত্ত লোকেরা পেশা হিসেবে পাণ্ডুলিপি নকল করার কাজ করতেন। পাণ্ডুলিপি নকল করেই তাঁরা জীবিকা অর্জন করতেন। এইভাবে ছাপাখানার আগের যুগে একটা পেশাদার নকলনবিশ—শ্রেণি গড়ে উঠেছিল দেখা যায়, অনেকটা এ যুগের কেরানি, প্রাইভেট সেক্রেটারি ও স্টেনো—টাইপিস্টদের মতন। তাঁদের লেখা ছিল অত্যন্ত সুন্দর, ছাপার হরফকেও হার মানাত। পাণ্ডুলিপির হস্তাক্ষর এতে সুন্দর ও নিখুঁত ছিল যে, ছাপাখানার প্রথম যুগে এই হস্তাক্ষর অনুকরণ করেই বাংলা ছাপার হরফ তৈরি হয়েছিল। হওয়াই স্বাভাবিক। লেখকরা বড় বড় রামায়ণ, মহাভারত, চৈতন্যচরিতামৃত, ভাগবত ইত্যাদি পুঁথি দিনের পর দিন বসে এমন সযত্নে সুন্দরভাবে নকল করতেন যে, তার মধ্যেও কোথাও কাটাকুটি থাকত না। লেখাগুলি—’সমানি সম শীর্ষাণি ঘনানি বিরলানি চ’।

আবার সেই লেখার কালিই বা কত সুন্দর ছিল তা ওই ‘ছিঁড়ে পত্র না ছাড়ে মসি’র আর্জা থেকেই বোঝা যায়। গৃহস্থের বৈঠকখানায় বা চণ্ডীমণ্ডপে বসে পুঁথির অনুলিপি তৈরি করতে হত। দু’চার দিনে যে কাজ শেষ হত না, তিন—চার—ছ’মাস ধরে ক্রমাগত পরিশ্রম করে এক—একটা পুঁথি নকল করা শেষ হত। তারপর গৃহস্বামী হয়তো লেখককে নগদ দু’টি টাকা ও একজোড়া কাপড় প্রণামি দিয়ে বিদায় দিতেন। নগদ দক্ষিণার কথা ভেবে বিস্মিত হবার কিছুই নেই, কারণ তখন মাসিক চার—পাঁচ টাকা বেতনে যিনি চাকরি করতেন তিনি দোল—দুর্গোৎসবে, অষ্টপ্রহর নবরাত্রে, বারোমাসে তেরোপার্বণে লোককে ভূরিভোজনে তৃপ্ত করতেন। অর্থাৎ নগদ ক্যাশ টাকার যুগই সেটা ছিল না, পণ্যবিনিময়েই কাজ চলে যেত। নগদ দশ—পনেরো টাকাতে তখন গৃহস্থের ঘরে শুভবিবাহ সম্পন্ন হত। সুতরাং নকলনবিশরা যা পেতেন তা একালের স্টেনোদের তুলনায় কম নয়। পুঁথি অনুলিখনের খরচও একালের ছাপার খরচের তুলনায় কম ছিল না। একখানি মাত্র পাণ্ডুলিপি একজনে একেবারে কপি করতে পারেন এবং খরচ ও মেহনত দুইদিক দিয়েই তার মূল্য ছাপা বইয়ের চেয়ে অনেক বেশি। ছাপা বই হারিয়ে গেলে সহজেই কিনে ফেলা যায়, কিন্তু পাণ্ডুলিপি ও পুঁথির বেলায় তা যায় না। সেইজন্য পাণ্ডুলিপির মধ্যে চুরি করা বা নষ্ট করা সম্বন্ধে কঠোর দিব্যি দেওয়া থাকত—এমনকি রীতিমতো অকথ্য কটু ভাষা প্রয়োগ করতেও লেখকরা কুণ্ঠাবোধ করতেন না। তার কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি :

যত্নেন লিখিতং চেদং যশ্চোরয়তি পুস্তকম্।

শূকরী তস্য মাতা চ পিতা তস্য চ গর্দভঃ।।

(সোসাইটির পুঁথিসংখ্যা ৫২০৪)

পুস্তকং হরতে যস্তু কাণো দুঃখী ভবেন্নরঃ।

মৃতঃ স্বর্গং ন গচ্ছেত্তু পিতরং নয়েৎ।।

(সংস্কৃত কলেজের পুঁথিবিবরণ, ৫।৭৬)

অর্জিতং ভুরিকষ্টেন পুস্তকং যচ্চ মেহনঘ।

হর্তুমিচ্ছ ত সঃ পাপী তস্য বংশক্ষয়ো ভয়েৎ।।

(সোসাইটি পুঁথি ৮।৬০৬২)

পুঁথি ও পাণ্ডুলিপি অনুলিখনের কাজ শুধু যে পুরুষরাই করতেন তা নয়, মহিলারাও করতেন। অনেকে হয়তো অবাক হয়ে প্রশ্ন করবেন, কী করে করতেন? পেশা হিসেবে বাইরের কোনো কাজ, অথবা জীবিকা অর্জনের জন্য কোনো কাজ করার কোনো স্বাধীনতা তখন মেয়েদের ছিল না। সুতরাং মেয়েরা পুঁথি নকল করার কাজ করবেন কী করে? এমনও তো হতে পারে যে পিতা ও স্বামীরা বাইরে থেকে কাজটা ঠিক করে আনতেন এবং ঘরে বসে তাঁদের কন্যা ও স্ত্রী—রা সেটা সযত্নে করে দিতেন। একালের অনেক গোঁড়া পরিবারের মেয়েরা অভাবের তাড়নায় ঘরে বসে নানা রকমের কাজ করে থাকেন। সুতরাং সেকালে মহিলা নকলনবিশ থাকা কিছুই আশ্চর্য নয়। তা ছাড়া একালে সামান্য লেখাপড়া জেনে যেমন মেয়েদের মধ্যে অনেকে টাইপরাইটিং শেখেন, তেমনি হয়তো সেকালে চলনসই সংস্কৃত বাংলা শিখে মেয়েরা ঘরে বসে হাতের লেখা মকশো করতেন এবং একজন পাকা লিখিয়ে হবার চেষ্টা করতেন। হাতের লেখাটা ভাল করে রপ্ত করতে পারলেই গৃহস্থ ঘরের মেয়েদের ঘরে বসে কিছু রোজগারের একটা পথ খোলা থাকত—পুঁথি ও পাণ্ডুলিপি নকল করে। দরিদ্র ঘরের মেয়েরা, অসহায় বিধবারা হয়তো অনেকে এইভাবে জীবিকা অর্জন করতেন। মেয়েদের মধ্যে লিখন—পঠনক্ষম শিক্ষিতের সংখ্যা খুব অল্প থাকলেও, একেবারেই যে ছিল না তা নয়। তখনকার বৈষ্ণব—ঘরের মেয়েদের মধ্যে শিক্ষিতের সংখ্যা নাকি নেহাত অল্প ছিল না। এমনিতেই তো বোঝা যায়, যাঁরা ভেক নিতেন তাঁরা অন্যান্যদের তুলনায় অনেক স্বাধীনচেতা ছিলেন। বিশেষ করে ভেকধারী বৈষ্ণবদের কথা বলছি। লেখাপড়াতেও এই ভেকধারিণীরা কিছুটা দুরন্ত ছিলেন। সামাজিক ব্যাপারেও তাঁরা সবচেয়ে আধুনিকা ও ‘ফরওয়ার্ড’ ছিলেন বলে মনে হয়। আজকাল ‘স্মার্ট’ বলতে যা বোঝায়, তা—ও তাঁরা কম ছিলেন না। সুললিত কণ্ঠে যাঁরা বাবাজিদের আখড়ায় শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত ও ভাগবত পাঠ করতেন, তাঁরা যে লীলায়িত ছন্দে কলমের আঁচড় টেনে তার পুঁথিও নকল করতে পারতেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কলকাতা শহরবাসিনী এক বৈষ্ণবী বিধবার উল্লেখ করেছেন লং সাহেব। বাংলা লেখাপড়া তিনি ভালই জানতেন, সংস্কৃতেও জ্ঞান ছিল। জীবিকা হিসেবে এই বৈষ্ণবীর নাকি প্রধান পেশা ছিল বাংলা ও সংস্কৃত পুঁথি নকল করা। লোকের বাড়ি—বাড়ি গিয়ে নিশ্চয়ই তিনি এই কাজ করতেন অথবা কাজ নিয়ে এসে ঘরে বসে করতেন। কতকটা একালের লেডি সেক্রেটারি ও পার্সোনাল স্টেনোর কাজ এই বৈষ্ণব মহিলারা করতেন। তখনকার সমাজে তাঁরাই প্রগতিশীল ছিলেন এবং রক্ষণশীলরা তাঁদের এই জাতীয় স্বাধীন কাজকর্ম নিশ্চয় সুনজরে দেখতেন না। সাহিত্যিক ও কবিরা এইসব বৈষ্ণব মহিলা অনুলেখিকাদের পুঁথি কপি করবার জন্য বিশেষভাবে নিয়োগ করতেন কি না সঠিক জানা যায় না, তবে করাটা অসম্ভব নয়। তা যদি সম্ভব হয়, তাহলে পাণ্ডুলিপির যুগ আরও অনেক বেশি রোমান্টিক হয়ে ওঠে। লেখকের নিজস্ব পাণ্ডুলিপির একটা রোমান্স তো আছেই, ছাপা বইয়ে যে রোমান্সের কোনো আভাসও নেই। কিন্তু আসল লেখকরা ছাড়াও, অনুলেখক—অনুলেখিকাদের নিয়ে পাণ্ডুলিপি ঘিরে এমন একটা রোমান্টিক পরিবেশের সৃষ্টি হত সেকালে যা একালে কোনো ছাপাখানায় হতে পারে না, অথবা লেডি স্টেনোরাও সৃষ্টি করতে পারেন না।

পদকর্তা পদাবলি রচনা করছেন, চরিতকার চরিতামৃত, রসিক কবি বিদ্যাসুন্দর। ভাবোন্মত্ত অবস্থায় হয়তো মুখে মুখে তিনি কাব্য রচনা করে চলেছেন, আর তাঁর সামনে বসে অনুলেখিকা (বৈষ্ণব বা শাক্ত মহিলা) লিখছেন একাগ্রচিত্তে, ঘাড় হেঁট করে। কবির ভাবতরঙ্গে তিনিও ওঠানামা করছেন এবং করতে করতে দিশাহারা হয়ে কলম ছেড়ে দিয়ে ভাবসমুদ্রের কিনারা খুঁজছেন। ঠিক এরকম অবস্থা, একেবারে কবি ডিকটেশন দিচ্ছেন এবং অনুলেখিকা লিখছেন, এ যদি কল্পনা করতে কষ্ট হয়, তাহলে করবার দরকার নেই। ভিন্ন অবস্থা কল্পনা করুন। কবি নিজে লিখছেন এবং অনুলেখিকা তাঁরই একটা পুঁথি পাশে বসে নকল করছেন। অথবা তা—ও যদি না হয়, তাহলে কোনো বিশেষ একজন অনুলেখিকাকে দিয়ে সকলেই লেখাতে চান। (হয়তো নির্ভুল ও সুন্দর করে লিখতে পারার জন্য এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।) মোট কথা, যত রকমের অবস্থাই কল্পনা করা যাক—না কেন, প্রত্যেকটার মধ্যে কিছু—না—কিছু রোমান্স আছে, একটা থ্রিল আছে। ছাপাখানায় তার কোনো চিহ্ন নেই। ছাপাখানায় যাঁরা কাজ করিয়েছেন ও করা দেখেছেন দিনের পর দিন, পাণ্ডুলিপির মর্মান্তিক করুণ পরিণতির কথা তাঁরা নিশ্চয় জানেন। মসিলিপ্ত, জীর্ণ (দ্রুত কম্পোজের জন্য) পাণ্ডুলিপির চেহারা দেখলে কান্না আসে। বই, তা সে যত সুন্দর ছাপা ও বাঁধা হোক না কেন, লেখকের নিজস্ব পাণ্ডুলিপির মধ্যে বা অনুলিখিত পাণ্ডুলিপির মধ্যেও যে প্রত্যক্ষ প্রাণের স্পর্শ পাওয়া যায়, বইয়ের মধ্যে তা পাওয়া যায় না। যন্ত্রযুগের যান্ত্রিক কম্পোজিটারের পাশে সেকালের কোনো ভেকধারী বৈষ্ণবী অনুলেখিকার কথা স্মরণ করলেই, বইয়ের সঙ্গে পাণ্ডুলিপির রোমান্টিক জগতের পার্থক্য যে কতখানি তা পরিষ্কার বোঝা যায়।

কলকাতাবাসিনী বৈষ্ণবী অনুলেখিকা পুঁথি পাণ্ডুলিপি নকল করে কীরকম রোজগার করতেন, জানি না। তবে খুব বেশি হলে মাসে নগদ চার—পাঁচ টাকা এবং বছরে হয়তো দু’একজোড়া শাড়ি বা কাপড়। পাণ্ডুলিপি কপি করার কী ‘রেট’ ছিল তা সঠিক না—জানা গেলেও, অনেকটা আন্দাজ করা যায়। কলকাতা শহরে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়াতে যে রেট চালু ছিল, সে সম্বন্ধে ওয়ার্ড সাহেব মোটামুটি একটা হদিশ দিয়েছেন। হাতে লেখা ‘মুগ্ধবোধ’ তিন টাকায় বিক্রি হত, তা—ও খুব সুন্দর লেখা কপি হলে। খারাপ লেখা কপি দেড় টাকাতেও পাওয়া যেত। হাতে লেখা ‘অমরকোষ’ও তিন টাকাতে বিক্রি হত। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়াতে বিদ্যাসাগরমশায় কয়েকটি পাণ্ডুলিপি এই দামে কিনেছেন :

কাব্যদর্শ : পাঁচ সিকা

মাঘটীকা : পাঁচ টাকা

রসমঞ্জরী প্রকাশ : আট আনা

কিরাতটীকা : আড়াই টাকা

এছাড়া আরও অনেক পুঁথি নকল করার দক্ষিণার কথা জানা যায় ‘সাহিত্য পরিষদ’ ও ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’ পাণ্ডুলিপি সংগ্রহের ক্যাটালগ থেকে। যেমন—কৃষ্ণরাম দাসের ‘কালিকামঙ্গল’ ১৭৫২ সালে কপি করানো হয়েছিল অনুলেখককে নগদ দুটি টাকা ও একজোড়া কাপড় দিয়ে। ‘রামায়ণ’ (চার কাণ্ড) ১৭১৪ সালে কপি করানো হয়েছিল নগদ সাত টাকা, কিছু কাপড় ও মিষ্টি দিয়ে। ১৭০৭ সালে ‘মহাভারত’ (বিরাটপর্ব) কপি করানো হয়েছিল নগদ একটি টাকা দিয়ে। ১৮৪৬ সালে মহাভারতের ‘শান্তিপর্ব’ মাত্র তেরো আনায় কপি করানো হয়। ওয়ার্ড সাহেব লিখেছেন, গত শতাব্দীর গোড়ার দিকে কপি করার রেট ছিল বারো আনায় বত্রিশ হাজার অক্ষর। একেও উচ্চহার বলা হয়েছে, কারণ এইভাবে বড় বড় পুঁথি কপি করাতে নাকি অনেক টাকা ব্যয় হত। রাজেন্দ্রলাল মিত্র বলেছেন যে, গত শতাব্দীর মাঝামাঝিতে এক হাজার শ্লোক কপি করার রেট ছিল চার টাকা, অর্থাৎ এক টাকায় আড়াইশো শ্লোক। খুব প্রাচীন পাণ্ডুলিপিতে আরও উচ্চহার ও যাবজ্জীবন ভরণপোষণের কথাও জানা যায়। মনে হয়, ধনী লোকেরা হয়তো পণ্ডিত ও বয়স্যের মতন কপিস্ট বা অনুলেখকও বেতন দিয়ে প্রতিপালন করতেন এবং তাঁর নিজস্ব ‘ভাণ্ডার’ বা পাঠাগারের জন্য তাঁকে দিয়ে পুঁথি নকল করাতেন। যা—ই হোক—না কেন, সেকালে পেশাদার কপিস্ট বা অনুলেখকদেরও একটা স্বতন্ত্র শ্রেণি গড়ে উঠেছিল এবং সমাজের চোখে তাঁদের পেশাটা খুব প্রশংসনীয় ছিল না। এমনিতেই যে পুঁথিপত্র খুব বেশি নকল করানো হত তা নয়, কারণ সাধারণ লোকসমাজে জ্ঞান বিতরণ করাটাই তখন মহাপাপ বলে মনে করা হত। ধর্মকর্মে, উৎসব—পার্বণে পণ্ডিত ও পুরোহিতদের পাণ্ডুলিপি দান করা অথবা নেহাত খেয়াল ও শখ চরিতার্থের জন্য নিজের ঘরে এক—আধখানা ধর্মগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি রাখা—প্রধানত এইজন্যই পুঁথি নকল করানো হত। পেশাদার কপিস্টদের কোনোদিক দিয়েই সামাজিক সম্মান ছিল না। লিপিকররা চাটুকারে পরিণত হয়েছিল, সভাকবিদের মতন। সভাকবিদের চাইতেও তাঁদের অবস্থা আরও শোচনীয় ছিল। দর্পনারায়ণ দাস নামক জনৈক লিপিকারের উক্তি এখানে উদ্ধৃত করছি। এই উক্তি থেকে লিপিকারদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক দুরবস্থার কথা পরিষ্কার বোঝা যায়। চার কাণ্ড রামায়ণ লিখে দর্পনারায়ণ কীভাবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন, তা তিনি লঙ্কাকাণ্ডের পুঁথির শেষে লিখে গেছেন। দর্পনারায়ণ লিখেছেন :

সেইমত আনন্দেতে রাখ গুরুচরণ দাসে।

কোন প্রকারে পুস্তক লইলে আমার পাশে।।

দাসবাবু আমাকে দিলেন সাত টাকা।

সেইমত দাসের পাপ খণ্ডাহ প্রভুর একা।।

পুস্তক লেখাইয়া আমার কৈলেন উপগার।

অনেক জঞ্জালে ত্রাণ করিলে বাবু কর্মকার।

কর্মকার বাবুরে রাম তুমি কর দয়া।

পুস্তক সাঙ্গেতে বাবু দিবেন বস্ত্র মোয়া।।

আমাকে গামছা দিবেন বহুবাদ ঘুষি।

অতএব রাম দয়া কর সগোষ্ঠী পরিবারে আসি।।

বালিট্যা গ্রামবাসী আমি জাতি যে কায়স্থ।

চারিকাণ্ড রামায়ণ লিখিলাম সমস্ত।।

(সাহিত্য পরিষদ, চিত্তরঞ্জন সংগ্রহ, পুঁথি ৩০৩)

একালের ছাপাখানার কম্পোজিটারদের যা অবস্থা, সেকালের পেশাদার কপিস্টদেরও ঠিক সেই অবস্থা ছিল। কপিস্টদের কথা মনে হলে পাণ্ডুলিপির সমস্ত রোমান্স উবে যায়, এমনকী কলকাতাবাসিনী বৈষ্ণবী অনুলেখিকার কথা মনে হলেও। বাস্তবিকই পাণ্ডুলিপির যুগের কোনো রোমান্স নেই, কিন্তু পাণ্ডুলিপির নিশ্চয় রোমান্স আছে। লেখকের নিজস্ব পাণ্ডুলিপির, হতভাগ্য পেশাদার কপিস্টদের অনুলিখিত পাণ্ডুলিপি নয়। ছাপাখানা তার সমস্ত যান্ত্রিক মালিন্য নিয়েও জ্ঞানের অগ্রদূত, আর পাণ্ডুলিপি অজ্ঞানের প্রতীক। কিন্তু আমি যে পাণ্ডুলিপির রোমান্সের কথা বলেছি, সে হল লেখকের নিজস্ব পাণ্ডুলিপির। অনুলিখিত পাণ্ডুলিপির নয়, পাণ্ডুলিপি যুগেরও নয়। ছাপাখানার যুগে এবং ছাপা বইয়ের যুগে পাণ্ডুলিপির যে নিজস্ব রোমান্স তা আমরা যেন একেবারে হারিয়ে ফেলেছি। কিছুদিন পরে টাইপরাইটার হয়তো একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেবে হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি। হাতে লেখা পাণ্ডুলিপির এই পরিপূর্ণ যান্ত্রিক রূপান্তরের বিরোধী আমি, কারণ তার ফলে পাণ্ডুলিপির মধ্যে তার স্রষ্টাদের ব্যক্তিসত্তার জীবন্ত স্পর্শ আমরা চিরদিনের মতো হারিয়ে ফেলেছি। ভবিষ্যৎ বংশধরদের কাছে তার জন্য কৈফিয়ত দিতে হবে। টাইপ—করা কপি বা ছাপা বই দেখে তারা খুশি হবে না। জীবন্ত মানুষের পরিচয় খুঁজবে তারা হাতে লেখা পাণ্ডুলিপির মধ্যে, লেডি টাইপিস্টদের নিখুঁত কপি বা লাইনোতে ছাপা ঝকঝকে বই দেখিয়ে তাদের কৌতূহল মেটানো যাবে না। পাণ্ডুলিপির অন্ধকার যুগ পার হয়ে এসে ছাপাখানার আলোর রাজ্যে প্রবেশ করলেও, পাণ্ডুলিপির এই নিজস্ব রোমান্স নষ্ট করার কোনো অধিকার আমাদের নেই। লেডি টাইপিস্ট বা বৈষ্ণবী অনুলেখিকাদের নিয়ে যত রোমান্টিক পরিবেশই সৃষ্টি করি—না কেন, তাঁদের অনুলিখিত পাণ্ডুলিপির কোনো রোমান্স নেই। লেখকের নিজস্ব পাণ্ডুলিপির রোমান্স চিরকাল ছিল, এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে, কারণ তার মধ্যে তাঁর সমস্ত সত্তার জীবন্ত ছাপ থেকে যায়—কপিস্টের লেখায় বা কম্পোজিটারের টাইপ সেটিঙে সে ছাপ থাকে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *