৮. কলকাতা কালচার

কলকাতা কালচার

প্রথম প্রস্তাব

কলকাতা কালচার বা ক্যালকাটা কালচার বলে একটা স্বতন্ত্র বস্তু আছে যেটা ঠিক বাঙালি কালচারও নয়, সাহেবি কালচারও নয়। একদিকে বাঙালিয়ানা, অন্যদিকে সাহেবিয়ানা, এই দুইয়ের জ্যোতিষিক টানাটানির ফলে ‘কলকাতা কালচার’—এর উৎপত্তি। ‘কলকাতা কালচার’—এর এই বৈশিষ্ট্য আজও অক্ষুণ্ণ রয়েছে এবং সম্প্রতি ইংরেজি শিক্ষার ব্যাপারে ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে। আমরা ছেলেমেয়েদের আজও ফিরিঙ্গি বা পাদরিদের স্কুলে পড়াবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠি। বিদ্যার প্রতি চিরদিন যাঁদের বিপিতাসুলভ মনোভাব, কোনোদিন যাঁরা লেখাপড়া করেননি, তাঁরাও ছেলেমেয়েদের ফিরিঙ্গি মাস্টারের কাছে ইংরেজি—শিক্ষা দেবার জন্য উদগ্রীব। তাঁরা বলেন ‘এডুকেশন দিতে হলে ফিরিঙ্গিদের কাছে।’ তাঁদের মতে, বাঙালি শিক্ষকরা নাকি ‘মেথড’ জানেন না। বাতিকটা কিন্তু নতুন নয়, বহু পুরাতন সেই কলকাতা কালচারেরই একটা বিকৃত ধারা আজও প্রবল রয়েছে একশ্রেণির বাঙালির মধ্যে। পুরনো ইংরেজি—শিক্ষার ও সাহেবিয়ানার সেই বাতিকের কথা কিছু বলা তাই এখানে প্রয়োজন।

বাঙালি সাহেবের যে জ্যোতিষিক টানাটানির কথা বলেছি তার অর্থ হল এই যে, সাহেবরা শুধু যে বাঙালিদের টেনেছেন তা নয়, বাঙালিরাও সাহেবদের টেনেছেন। ‘টানে প্রায় যায় রে ভেসে’র মতন বাঙালিদের প্রাণ যেমন সাহেবদের দিকে ভেসে গেছে, সাহেবদের প্রাণও ঠিক তেমনি বাঙালিদের দিকে ভেসে এসেছে। শ্রীমতী গণেশসুন্দরীর যেমন মিসেস ভন হবার ইচ্ছা হয়েছে, মিস গিবার্টেরও তেমনি ইচ্ছা হয়েছে শ্রীমতী আনন্দময়ী হতে। দুই পক্ষের ইচ্ছার ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া নিউটনের তৃতীয় সূত্রানুসারে ইকুয়াল ও অপোজিট হবার কথা, এবং ঠিক তা—ই হয়েছিলও। তারই ‘নিট’ ফলাফলরূপে দেখা দিয়েছিল ‘কলকাতার কালচার’। এইটাই হল ‘কলকাতা কালচার—এর’ গোড়ার কথা। বাঙালির সাহেবিয়ানা ও ইংরেজিশিক্ষা এবং সাহেব বাঙালিয়ানা ও বাংলা—শিক্ষা—এই নিয়ে ‘কলকাতা কালচার’। প্রথমে বাঙালিদের কথা বলছি।

শ্রীমতী গণেশসুন্দরীর কথাটা কিন্তু মিথ্যা নয়। একসময় কলকাতা শহর এই গণেশসুন্দরীকে নিয়ে কেঁপে উঠেছিল। এমন কোনো খবরের কাগজ ছিল না যে গণেশসুন্দরীর আন্দোলনে যোগ দেয়নি। যে গোলদিঘি বা কলেজ স্কোয়্যার অঞ্চলে এখনও প্রায়ই কিছু—না—একটা নিয়ে হইচই হয়, সেই কলেজ স্কোয়্যারেই একদিন গণেশসুন্দরীকে নিয়ে তুমুল কাণ্ড ঘটেছিল। একালের কোনো সুন্দরীকে নিয়ে এমন চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়নি, এমনকি ‘মিস ক্যালকাটা’কে নিয়েও না। কাণ্ডটা কী বলছি। গণেশসুন্দরী কলকাতার কোনো বাঙালী পরিবারের বিধবা কন্যা। তখনকার দিনে, বাঙালিদের যখন সাহেব হবার ইচ্ছা প্রবল হয়ে উঠেছিল তখন, পাদরি মহিলারা বাঙালিদের বাড়িতে গিয়ে মেয়েদের লেখাপড়া শেখাতেন, অর্থাৎ ইংরেজি শেখাতেন। এখানকার মেমসাহেব গবর্নেসদের মতন তাঁদের বেতন খুব বেশি দিতে হত না। সেকালের পাদরি মেমরা অল্প টাকাতেই বাড়িতে গিয়ে পড়াতে রাজি হতেন, কারণ তখন ইংরেজি শেখানোটাই ছিল তাঁদের ‘মিশন’। এইজন্যই গোড়ার দিকে বাঙালি সাহেবরা সহজেই তাঁদের বাড়িতে ডেকে মেয়েদের পড়াতে বলতেন। শ্রীমতী গণেশসুন্দরীও এইরকম একজন পাদরি মেমসাহেবের কাছে পড়তেন। এই পাদরি মেম নাকি পড়াতে পড়াতে তাঁকে প্রায়ই বলতেন যে, বিধবা হয়ে গণেশসুন্দরী অনন্ত নরকের ধারে দাঁড়িয়ে আছেন। নরকের বর্ণনাও তিনি দিতেন, কতকটা কবি মিলটনের মতন করে। শুনতে শুনতে গণেশসুন্দরীর ভয় হত এবং একদিন নরকের ভয়ে ভড়কে গিয়ে একজন পাদরি সাহেবের সঙ্গে কাউকে না বলে—কয়ে তিনি গৃহত্যাগী হন। গণেশসুন্দরীরও পাদরি মেম হবার ইচ্ছা হয়। মেমসাহেবিয়ানার টানে গণেশসুন্দরীর গৃহত্যাগ নিয়ে কলকাতা শহরে হুলুস্থূল পড়ে যায়, হাইকোর্টে মকদ্দমা হয়, খবরের কাগজে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। যে পাদরি সাহেবের কাছে গণেশসুন্দরী আশ্রয় নিয়েছিলেন সেই ভন সাহেব একদিন বিকেলে কলেজ স্কোয়্যারের এক কোণে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করছিলেন। এমন সময় গণেশসুন্দরীর এক ভাই কোথা থেকে চেলাচামুণ্ডা জুটিয়ে নিয়ে এসে পাদরির উপর চড়াও হলেন। কিল—চড়—ঘুসির সঙ্গে (তখন পটকা—পাইপগান ছিল না) ইঁটপাটকেলও চলল। পাদরি সাহেব দৌড়ে পালিয়ে গিয়ে সংস্কৃত কলেজের সামনে শ্যামাচরণ দে বিশ্বাস মশায়ের (যার নাম শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট হয়েছে) বাড়িতে আশ্রয় নেন। ছেলেপিলেরা সেই বাড়ি চড়াও করবার পর বেশ খানিকটা হাতাহাতি হয়, তারপর যে যার কেটে পড়ে। পরে গণেশসুন্দরী অনুতপ্ত হয়ে অবশ্য ফিরে আসেন এবং শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁকে আশ্রয় দেন। তখন তাঁর গণেশসুন্দরী নাম বদলে মনোমোহিনী নাম রাখা হয়। এইভাবে অনেক শ্রীমান গণেশ ও শ্রীমতী গণেশসুন্দরী সাহেবিয়ানার টানে ভেসে গেছেন এবং তাঁদের মধ্যে অনেকেই ফিরে আসেননি। সুন্দরীরাই যদি এত দূর পর্যন্ত এগিয়ে থাকেন, তাহলে গণেশরা যে কী করেছেন, তা না বলাই ভাল। গণেশবাবুদের সাহেবিয়ানার কথা সকলেই জানেন, সেটা আর বললাম না।

ইংরেজি—শিক্ষার কথা বলি। বাঙালি ছেলেরা প্রথমে গুরুমশায়ের কাছে বাংলা শিখত, তারপর মুনশির কাছে শিখত ফার্সি এবং সবার শেষে সাহেবের কাছে ইংরেজি শিখে বিদ্যাশিক্ষা শেষ করত। এই শিক্ষা সম্বন্ধে ভবানীচরণ বলেছেন: ‘সাহেবদের মেজের সজ্জা এবং খানা ও টিফিন খাওয়া দেখিয়া বাবুদিগেরা প্রায় তদনুরূপে ব্যবহার হইল, আর সাহেবের সহিত সর্বদা কথোপকথন দ্বারা গাডামী রাসকেল, বেরিগুড, হুট, নানসেন্স, গোটে হেল এইরূপ কতকগুলিন কথা অভ্যাস করিয়া বাঙ্গালা কথায় মিশাইয়া করিতে লাগিলেন..।’ রাজনারায়ণ বসু, শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ সেকালের বাঙালিদের রচনায় ও আত্মচরিতের এই ইংরেজি—শিক্ষার ভারী চমৎকার সব গল্প আছে। তার কিছু কিছু এখানে বলছি। বাঙালি বাপ—মা যারা প্রাণ—যায়—তাও—স্বীকার পণ করে আজও ফিরিঙ্গি ও পাদরিদের স্কুলে ছেলেমেয়েদের ইংরেজি শেখাচ্ছেন, তাঁরা বিশেষ মনোযোগ দিয়ে গল্পগুলো পড়বেন।

সেদিন এক ভদ্রলোক বলছেন (তাঁর পুত্র ফিরিঙ্গি স্কুলে পড়ছে) : ‘আমার ছেলের স্কুলে মশায়, সিস্টাররা পিয়ানো বাজিয়ে নাচে, আর তারই সুরে তালে তালে ইংরেজি কবিতা ছেলেদের পড়ায়। আশ্চর্য মেথড মশায়, কোনো বাঙালি স্কুলে পারবে করতে কোনোকালে?’ জানি না পারবে কি না পারবে, তবে সেকালের গুরুমশায়রা যে নামতা ও ছড়া পড়াতেন সুর করে, তা বিলেতি পিয়ানো বা দেশি ঢোল সংযোগ না হলেও, ওই একই পদ্ধতি কতকটা নয় কি? তা ছাড়া, ফিরিঙ্গি স্কুলে ইংরেজি শেখানোর ব্যাপারটাও এইভাবে অনেককাল ধরে চলে আসছে কলকাতায়। শুধু ফিরিঙ্গি স্কুলে নয়, সব স্কুলেই এই পদ্ধতিতে ইংরেজি শেখানো হত। স্কুল পরিদর্শন করতে গেলে মাস্টারমশায়রা জিজ্ঞাসা করতেন যে ছাত্রেদের কী ঘোষাবেন? তেমন তাঁরা বলতেন: ‘গার্ডেন ঘোষাব, না স্পাইস ঘোষাব? অর্থাৎ বাগানের বিভিন্ন সবজির ইংরেজি নাম মুখস্থ বলাব, না মশলার নাম? হয়তো বললেন: গার্ডেন ঘোষান। মাস্টারমশায় অমনি ছাত্রদের বলতেন: গার্ডেন ঘোষাও। ছাত্ররা বলত—

পমকিন লাউকুমড়ো, কোকাম্বর শসা।

ব্রিঞ্জেল বার্তাকু, প্লোমেন চাষা।।

কখনও কখনও হয়তো—বা খাম্বাজ রাগিণীতে, ঠুংরি তালে ইংরেজি শব্দের বাংলা অর্থ গান করে বলা হত। যেমন—

নাই (Nigh) কাছে,

নিয়ার (Near) কাছে,

নিয়ারেস্ট (Nearest) আরও কাছে,

কাট (Cut) কাট

কট (Cot) খাট

ফলোয়িং (Following) পাছে।

এ ছাড়া হয়তো আরেবিয়ান নাইটের গল্প বা ইশপের গল্প তবলা—ঢোলক—মন্দিরা সহকারে ইংরেজি পয়ারে লিখে বাড়ি—বাড়ি গান গেয়ে শুনিয়ে বেড়ানো হত। সুতরাং আমার সেই পরিচিত ভদ্রলোক ইংরেজি শেখানোর যে মেথডের কথা বলছিলেন সেটা হালের নয়, অনেককালের। কিন্তু এই পদ্ধতিতে বেশির ভাগ বাঙালি ছেলেরা ইংরেজি শিখল কেমন? ফিরিঙ্গি স্কুলে ইংরেজি—শেখা এক বঙ্গনন্দনকে একবার সাহেব আমাদের রথযাত্রার রথ জিনিসটা কী জিজ্ঞাসা করেছিলেন। তাতে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন : ‘উডেন চর্চ স্যার।’ অর্থাৎ রথটা অনেকটা গির্জার মতন দেখতে বলে এই কথা বলা হয়েছিল, কিন্তু সাহেব কিছু বুঝতে পারেননি। তাই তাঁকে আরও ব্যাখ্যা করে ইংরেজি—শিক্ষিত বঙ্গনন্দন বললেন :

থ্রি স্টারিস হাই (তিনতলার মতন উঁচু)

গাড আলমাইটি সিট আপন (উপরে জগন্নাথদেব বসে থাকেন)

লাং লাং রোপ (লম্বা দড়ি সামনে),

থৌজন্ত ম্যান ক্যাচ (হাজার লোক ধরে),

পুল পুল পুল (খুব জোরে টানে),

রানাওয়ে রানাওয়ে,

হরি হরি বোল, হরি বোল!

আর—এক বাঙালি ভদ্রলোক এক সাহেবের ফার্মে কাজ করতেন, কিন্তু তার স্টোর থেকে প্রায় মাল সরিয়ে ফেলতেন। একদিন সাহেব তাঁকে ডেকে বললেন: তুমি ডিজঅনেস্ট কেন? মাল চুরি করো কেন? তিনি বললেন :

ডে অ্যান্ড নাইট টুয়েন্টি টুয়েন্টি ফট্টি লিভস ফল (অর্থাৎ দু’বেলা বিশটা করে চল্লিশজনের পাত পড়ে), লিটন মনি (অল্প টাকা বেতন), হাউ ম্যানেজ? দেয়ারফোর ডিজঅনেস্ট, কী করে চালাব? তাই চুরি করি!

সাহেব প্রথম ‘টুয়েন্টি টুয়েন্টি ফট্টি লিভস ফল—এর’ ব্যাপারটা বুঝতে পারেননি, পরে বুঝতে পেরে বেতন বাড়িয়ে দেন। এই ইংরেজি—শিক্ষিত বাঙালিদের কথাবার্তার নমুনা হল :

আমার father yesterday কিছু unwell হওয়াতে doctor—কে call করা গেল, তিনি একটা physic দিলেন। Physic বেশ operate করেছিল, four five times motion হল, আজ কিছু better বোধ করছেন।

এঁদের দেখাদেখি তখনকার কবিওয়ালারাও ইংরেজি—বাংলা মিলিয়ে ছড়া বাঁধতে আরম্ভ করলেন। যেমন—

শ্যাম গোইং মথুরায়

গোপীগণ পশ্চাৎ ধায়,

বলে ইওর অক্রুর আনকেল

ইজ এ গ্রেট রাসকেল।

তবু তো যেকালের কথা বলছি সেকালের জীবনের মন্ত্র ছিল—

হেয়ার কল্বিন পামরশ্চ কেরি মার্শামেনস্তথা।

পঞ্চ গোরাঃ স্মরেন্নিত্যং মহাপাতকনাশনং।।

কলকাতা শহরে একসময় একটি সভা স্থাপিত হয়েছিল, প্রাথমিক ইংরেজি গ্রন্থাদি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করার জন্য। সভার নামকরণ করা হয়েছিল Indigenous Literary Society সভার ইংরেজি—শিক্ষিত উদযোগীদের জিজ্ঞাসা করা হয় সভার উদ্দেশ্য কী? ‘ইন্ডিজেনাস’ কথার অর্থ কী? তার উত্তরে একজন বলেন, ‘ইন্ডিজেনাস’ কথাটির অর্থ হল—‘Literature connected with the genius of India’ ইংরেজি—শিক্ষা ও মাতৃভাষার শিক্ষা নিয়ে যখন কলকাতার বিদ্বৎসমাজে তুমুল তর্ক হচ্ছিল (১৮৩০—৩৫ সালে), তখন ‘টি’ নাম দিয়ে এক ভদ্রলোক ‘ইন্ডিয়া গেজেট’ পত্রিকায় কতকগুলি চিঠি লেখেন। চিঠিগুলি ১৮৩৪ সালে গ্রন্থাকারে ছাপা হয়। তার মধ্যে এই ঘটনাটির উল্লেখ করে লেখক বলেছেন যে—এ দেশি ডাক্তাররা যদি চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইংরেজি শব্দের এইরকম ব্যুৎপত্তিগত অর্থ করেন, তাহলে—‘all we can say is, God help their patients.’

একালে হেয়ার, কল্বিন, পামর, কেরি বা মার্শম্যান সাহেবরা আর নেই। আছে অজ্ঞাতকুলশীল ফিরিঙ্গিরা। তাদের কাছে ইংরেজি শিখতে আরম্ভ করলে শেষ পর্যন্ত তার ফল যে কী দাঁড়াবে তা বলা কঠিন। ছেলেরা বাইবেলের গল্প জানে, মহাভারতের গল্প জানে না; ড্যাম হেল বলতে পারে, কিন্তু দশ বছরেও এক লাইন শুদ্ধ ইংরেজি লিখতে পারে না; হয়তো শেক্সপিয়রের নাম শেখে, কিন্তু মাইকেল মধুসূদন কে জিজ্ঞাসা করলে বলে ফিল্ম অ্যাকটর; এক লাইন ইংরেজি হয়তো কোনোরকমে ‘টুয়েন্টি লিভস ফল’—এর মতন লিখতে পারে, কিন্তু এক লাইন বাংলা লিখতে গেলে ‘ও সিস্টার, হয়ার দাউ আর্ট’ বলে কেঁদে ফেলে। এ শিক্ষার শেষ কোথায়? এ কালচারের পরিণতি কী? ফিরিঙ্গি স্কুলে দু’ঘণ্টা ইংরেজি গান শুনে বাড়িতে ফিরে এসে যদি বাকি বাইশ ঘণ্টা ‘লারে লাপপা’ শোনে তাহলে ছেলের যে কী শিক্ষা হতে পারে জানি না।

.

দ্বিতীয় প্রস্তাব

বাঙালি সাহেব ও সাহেব—বাঙালিরাই ক্যালকাটা কালচারের আদিস্রষ্টা, এ কথা আগে বলেছি। কলকাতা কালচারের গোড়াপত্তনের যুগে এই ইঙ্গ—বঙ্গ ও বঙ্গ—ইঙ্গদের দান অবিস্মরণীয়। সম্প্রতি বাঙালির সাহেবিয়ানা ও সাহেবের বাঙালিয়ানার বেশ কিছুটা ‘হিন্দুস্থানি’ উপাদান মিশে ক্যালকাটা কালচারের ভোল পাল্টে যাচ্ছে। সে কথা পরে আলোচ্য। বাঙালি সাহেবিয়ানার কথা বলেছি। কিন্তু ক্যালকাটা কালচারে প্রথম পর্বে সাহেবের বাঙালীয়ানাটাও কম উল্লেখযোগ্য নয়। সেই কথা এখানে বলব। তা না হলে দেবে আর নেবে, মিলাবে মিলিবে’র গভীর তাৎপর্য আমাদের কালচারের ক্ষেত্রে উপলব্ধি করা সম্ভব হবে না।

বাঙালিরাই যে ইংরেজদের জামাই হয়েছে তা নয়, ইংরেজরা বাঙালিদের ঘরজামাই হয়েছে। জোব চার্নক সাহেবকে যদি সত্যই কলকাতা শহরের প্রতিষ্ঠাতা বলে স্বীকার করে নেওয়া যায়, তাহলে স্বয়ং কলকাতার প্রতিষ্ঠাতাই যে বাঙালির ঘরজামাই ছিলেন সে কথাও অস্বীকার করার উপায় থাকে না। একদিক দিয়ে বিচার করলে, এ দেশের প্রথম বড়লাট বাহাদুর ওয়ারেন হেস্টিংসকেও আমাদের ঘরের জামাই বলতে হয়। কালচারের ক্ষেত্রেও ইংরেজদের সঙ্গে বাঙালির এই জাতীয় শ্বশুর—জামাইসুলভ ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার ফলে বিচিত্র এক হিংটিং—ছট ‘কলকাতা কালচার’—এর সৃষ্টি হয়েছে। সেই আজব কালচারই ইংরেজোত্তর হিন্দুস্থানি যুগে বর্তমানে এক কিম্ভূতকিমাকার ইঙ্গ—বঙ্গ—বিহারী কালচারে পরিণত হচ্ছে, অথবা হয়েছে।

কলকাতা শহরকে লর্ড ক্লাইভ বলেছিলেন—‘One of the most wicked places in the Universe.’ অনেক দুঃখে ভূতের মুখ দিয়ে ভৌতিক রাজ্যের এই বর্ণনা বেরিয়েছিল। মিসেস শেহউডও ‘the splendid sloth and languid debauchery of European society in those days’ সম্বন্ধে লিখে গেছেন। তা ছাড়া হিকির গেজেটে, ফর্বিসের ‘ওরিয়েন্টাল মেময়ের্স’, হেবারের জার্নালে, হেস্টিংসের ও ক্লাইভের জীবনচরিত, সেকালের কলকাতা ও কলকাতার ইংরেজ—নবাবদের জীবনযাত্রা সম্বন্ধে চমৎকার সব বর্ণনা আছে, যা পড়তে পড়তে ক্যালকাটা কালচারের উদযোগপর্বের রূপটা চোখের সামনে ছবির মতন ভেসে ওঠে। মনে হয়, আধুনিক কলকাতায় না জন্মে যদি সেকালের কলকাতায় জন্মাতাম। তাহলে কি দেখতাম? দেখতাম, একালে যারা ঝুনঝুনওয়ালা ও দুন্দুভিপ্রসাদের অনুরক্ত নোকর, তাঁদের পূর্বপুরুষরাই সেকালের ইংরেজ নবাবদের দেওয়ান, সরকার মুনশি, এমনকি হুঁকোবরদার পর্যন্ত। একালের ক্যালকাটা কালচারের যেসব ইংরেজ হবুচন্দ্ররা নায়ক, সেকালের ক্যালকাটা কালচারের প্রতিষ্ঠাতা তাঁদেরই পূর্বপুরুষরা। রাজনারায়ণ বসু লিখেছেন :

সেকালে সাহেবরা অর্ধেক হিন্দু ছিলেন। পূর্বে মুসলমানেরা এ ভারতবর্ষকে আপনাদের গৃহস্বরূপ জ্ঞান করিতেন। তাঁহাদের অনুরাগ এইখানেই বদ্ধ থাকিত। ইংরেজের আমলের প্রথম সাহেবরা অনেক পরিমাণে ওইরূপ ছিলেন।

এই সাহেবদের কথাই আমি বলছি, ইংরেজ আমলের প্রথম সাহেবরা ক্যালকাটা কালচারের বনিয়াদ তৈরি করে গেছেন, অষ্টাদশ শতাব্দীর থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক পর্যন্ত। আজকাল সাহেবরা যেমন ঘন ঘন বিলেত যান ও আসেন, তখনকার দিনে কালেভদ্রে যাতায়াতের সুযোগ ঘটত কি না সন্দেহ। যাঁরা যেতেন তাঁরা লুঠপাটের পালা যত দূর সম্ভব করেই একেবারে যেতেন, এবং যাঁরা আসতেন তাঁরাও এক ধনরত্নের স্বর্গে এলেন মনে করে ফেরবার কথা প্রায়ই ভাবতেন না। বাধ্য হয়ে তাঁদের এ দেশের লোকের সঙ্গে আত্মীয়তা করতে হত। আর্যরাও তা—ই করেছিলেন, মুসলমানদেরও তা—ই করতে হয়েছিল এবং ইংরেজদেরও তা না করে উপায় ছিল না। কারও পক্ষেই দলে দলে পরিবার—স্ত্রী—পুত্র নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি, এ দেশের বাসিন্দাদের সঙ্গেই সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়েছে। তার ফলে যা হয়েছে তা হল এই :

আর্য + প্রাক—আর্য = হিন্দু

মুসলমান + প্রাক—মুসলমান = মুসলমান বা হিন্দু

ইংরেজ + প্রাক—ইংরেজ বা হিন্দু—মুসলমান = অ্যাংলো বা ফিরিঙ্গি

হিন্দু ও মুসলিম কালচারের কেন্দ্র ইন্দ্রপ্রস্থ বা দিল্লি এবং লখনউ; অর্থাৎ উত্তর ভারত এবং অ্যাংলো কালচারের অন্যতম আদি কেন্দ্র (বোম্বাই ও মাদ্রাজ ছাড়া অবশ্য) পূর্ব ভারত তথা কলকাতা। ক্যালকাটা কালচারের সঙ্গে অ্যাংলো কালচারের তাই এত নিকট আত্মীয়তা ও বিচিত্র সাদৃশ্য।

প্রথম যুগের সাহেবরা মেমসাহেব ঘাড়ে করে তো আসতেনই না, বিশেষ কোনো লটবহর নিয়েও আসতেন না। বিলেত থেকে কোনো জাহাজ এসে পৌঁছলে কলকাতার সাহেবমহলে তখন সাড়া পড়ে যেত, বিশেষ করে যদি কোনো নতুন লেডি বা ‘মিস’ আসতেন তাহলে চাঞ্চল্যের সীমা থাকত না। নবাগত সাহেব—মেমদের সঙ্গে এখানকার সাহেবসমাজের আলাপ হত রবিবার সকালে খ্রিস্টভজনের সময়। তখন ভজনের জন্য কোনো গির্জা ছিল না, কাস্টমস অফিসের নিচের হলঘরে সকলে জমা হতেন রবিবার সকালে, সেখানে নবাগতরাও আসতেন। নতুন মেমসাহেব এলে সাহেবদের মধ্যে আলাপ—পরিচয় করা নিয়ে অনেক সময় হাতাহাতি ডুয়েল হয়ে যেত। এই যখন সাহেবসমাজের অবস্থা তখন এ দেশি লোকের সঙ্গে না মিশে উপায় কী? শুধু পুরুষ নয়, এ দেশের নারীদের সাহচর্য ছাড়াও তাই সাহেবদের চলত না। মেমসাহেবরা যেমন অনেক বাঙালিকে আধা—সাহেব করেছেন, তেমনি বাঙালি মেয়েরা অনেক সাহেবকে আধা—বাঙালি করেছেন। সাহেবি কালচার ও বাঙালি কালচারকে বৈবাহিক বন্ধনে বাঁধবার জন্য বিলেতের মেমসাহেব ও বাংলা দেশের মেয়েরাই করেছেন ঘটকগিরি। সুতরাং ক্যালকাটা কালচারের ক্যাটালিটিক এজেন্ট তাঁদেরই বলা উচিত। এটা অবশ্য নতুন কোনো ব্যাপার নয়। ইতিহাসে দেখা যায়, দু’টি বিভিন্ন কালচারের সংঘর্ষ যখনই হয়েছে তখন সমন্বয়ের কাজ শুরু করেছেন মেয়েরা। ইংরেজদের আমলে এ দেশে তার ব্যতিক্রম হবার কথা নয়। সাহেবরা, প্রধানত এ দেশি মেয়েদের পাল্লাতে পড়েই, পান খাওয়া শিখেছেন, আলবোলা—গড়গড়া—হুঁকো ফুঁকেছেন, উৎসব—পার্বণে যোগ দিয়েছেন, হোলি খেলেছেন, মল্লযুদ্ধ করেছেন, পাল্কিতে চড়েছেন। কালীঘাটে কালীপুজো তো অনেকে করতেনই, কোনো কোনো সাহেব বাড়িতে শালগ্রাম শিলা পর্যন্ত রাখতেন এবং ব্রাহ্মণ দিয়ে তার পুজোও করাতেন। বাঙালি দেওয়ান মুনশি—আমলাদের বাড়িতে সাহেবরা মধ্যে মধ্যে কুশল খোঁজখবর করতে যেতেন এবং তাঁদের ছেলেমেয়েদের হাঁটুর উপর বসিয়ে আদর করতেন। বাঙালি গিন্নিরা চন্দ্রপুলি, নারকেলের নাড়ু দিয়ে সাহেবদের জলযোগ করাতেন, পাখার বাতাস করতেন, পান সেজে দিতেন। শেষে একটু তামাক টেনে সাহেবরা বাড়ি ফিরতেন। এইভাবেই প্রথমে সাহেবদের বাঙালিকরণের পর্ব হয়েছিল।

চূড়াকরণ, নামকরণের মতন সাহেবিকরণ ও বাঙালিকরণও রীতিমতো কষ্টকর প্রথা। ভিনদেশি কালচারের প্রত্যেকটি উপাদান নিজের কাছে খাপ খাইয়ে নেওয়া সহজ নয়। সুতরাং বাঙালিদের মতন সাহেবদেরও আধা—বাঙালি পর্যন্ত হতে বেশ কষ্ট করতে হয়েছিল। যেমন, পান খেতে গিয়ে সাহেবরা এমন বিষম খেতেন যে তার ধকল সামলাতে তাঁদের প্রায় হিক্কা উঠে যেত। তারপর থেকে পান দেখলেই ঘাম ছুটত শরীরে। পাল্কি—চড়া অভ্যাস করতেও তা—ই হয়েছিল। জনৈক ক্লিভল্যান্ড সাহেব কলকাতায় প্রথম এসে নৌকা করে নেমেই পাল্কিতে চড়েছিলেন। পাল্কি বেয়ারারা যখন তাঁকে কাঁধে করে ছুটে চলেছে তখন তাদের চলার শব্দ হচ্ছে—হুন্ হুন্ না, হুন্ হুন্ না, ঘাট পেরিয়ে হুন্ হুন্ না—জোর সে চলো, হুন্ হুন্ না—হেঁই আর এ হেঁই আর এ—ইত্যাদি। সাহেব এই ধরনের অদ্ভুত শব্দ শুনে ভয় পেয়ে পাল্কি থেকে লাফ দিয়ে পড়লেন—ভাবলেন বেয়ারাগুলো বোধহয় ধুঁকছে ও গোঙাচ্ছে, এখনই পড়ে মরে যাবে। তাঁর সঙ্গী এক কর্নেল সাহেব ছিলেন, তিনি বুঝিয়ে বললেন যে, এটাই পাল্কি বেয়ারাদের পথ চলার গানের ধরন, যা তারা সামনে দেখে তা—ই বলতে বলতে যায়। ক্লিভল্যান্ড সাহেব সহজে বুঝতে চান না। পরে বেয়ারারা যখন তাঁকে বুঝিয়ে দিল হাত—পা নেড়ে, তখন তিনি ধাতস্থ হয়ে পাল্কি চড়লেন। এইভাবে প্রত্যেক সাহেবকেই পাল্কি—চড়া ধাতস্থ করতে হয়েছে, কখনও লাফিয়ে পড়ে হাত—পা ভেঙে, কখনও—বা ভয়ে চেঁচিয়ে উঠে। তামাক টানা শিখতে অবশ্য বেশি সময় লাগেনি, যদিও মৌজ করে ওয়ারেন হেস্টিংসের মতন আলবোলায় তামাক টানতে খুব কম সাহেবই পারতেন। এ দেশি রাজা—মহারাজাদের মতন ইংরেজ নবাবদের আভিজাত্যের প্রধান লক্ষণ ছিল সোনা—বাঁধানো রুপোর গড়গড়া ও আলবোলা এবং তার সঙ্গে দশগজি এক নল ও অন্তত প্রত্যেকের চারজন করে হুঁকোবরদার। হুঁকোবরদাররা যে বাড়িতেই থাকত তা নয়, সাহেবদের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত তামাকের সরঞ্জাম নিয়ে তাদের বাইরেও যেতে হত। তখনকার দিনে গবর্নমেন্ট হাউসে যে ডিনার পার্টি হত সেখানে পর্যন্ত নিমন্ত্রিত সাহেবদের সঙ্গে হুঁকোবরদাররা যেত। ভোজনান্তে লেডিরা অন্য ঘরে চলে গেলে প্রত্যেকের হুঁকোবরদার আলবোলা ও নল হাতে করে এসে সারবন্দি হয়ে দাঁড়াত হলঘরে এবং একে—একে প্রভুদের কাছে গিয়ে নল হাতে দিয়ে যেত। হুঁকোর নল খুব সাবধানে সরিয়ে রাখা হত, কারণ একজনের হুঁকোর নল অন্য কেউ ডিঙিয়ে বা মাড়িয়ে গেলে সেটা ইনসাল্টিং মনে করা হত। এই নিয়ে তখনকার সাহেবদের মধ্যে অনেক ‘hookah-bowl’ হুঁকো নিয়ে হাতাহাতি’ হয়ে গেছে। আলবোলা ও নলের লম্বাকৃতি চেহারা দেখে প্রথমটা মেমসাহেবরা ভড়কে যেতেন, ইচ্ছে হলেও টান দিতে সাহস করতেন না। কিন্তু প্রাইস সাহেব তাঁর ‘ট্রাক্টস’—এর মধ্যে লিখে গেছেন যে, ক্রমে লেডিরাও নানা রকমের সুগন্ধি তামাকের লোভ সামলাতে পারলেন না এবং সাহেবদের সঙ্গে মেমরাও হুঁকো ফুঁকতে শুরু করলেন। প্রাইস লিখেছেন:

The maxiture of sweet-scented Persian tobacco, sweet herbs, coarse sugar, spice etc. which they inhale, comes through clean water and is so very pleasant that many ladies take the tube and draw a little of the smoke into their mouth.

মেমরাও হুঁকো খান, এটা অনেক সাহেব পছন্দ করতেন না। তামাক খাওয়ার জন্য নয়, বোধহয় আলবোলার চেহারার জন্য! কিন্তু মেমসাহেবরা লোভ না সামলাতে পেরে, সাহেবরা টেনে খাওয়ার পরে লুকিয়ে নল মুখে দিয়ে টানতেন। ছেলেবেলায় বাপের হুঁকোয় লুকিয়ে তামাক টেনে আমাদের দেশে অনেককে যেমন নাজেহাল হতে হয়েছে, তেমনি অনেক মেমসাহেবকেও সাহেবের কাছে ধাতানি খেতে হয়েছে তামাক টানার জন্য। শেষ পর্যন্ত লেডিরাই জয়ী হয়েছেন এবং সভাসমিতিতে ক্রিটান নাগিনিদেবীর মতন আলবোলার নল কোমরে জড়িয়ে বসে তাঁরা ফুঁকেছেন, সাহেবদের নল বাড়িয়ে অফার করেছেন।

এইভাবে বাঙালি কালচারের প্রত্যেকটি উপকরণ নয় শুধু, বাঙালি জীবনধারাটাকেও সাহেবদের ধাতস্থ করতে হয়েছে। সেটা অবশ্য আমাদের দেশের রাজা—মহারাজা আমির—ওমরাহদের জীবনধারাই। সেইজন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলের বণিক সাহেবদের ইংরেজ ‘নবাব’ বলা হত। হিকির মতন একজন অ্যাটর্নি সাহেবেরও (যাঁর স্মৃতিকথা পূর্বে ‘সুতানুটি সমাচার—এ’ বর্ণিত হয়েছে) তেষট্টিজন চাকর ছিল। অবস্থাপন্ন সাহেব বণিকদের অনেকের একশোজনেরও বেশি চাকর থাকত। সকালবেলা সাহেবের ঘুম ভাঙাতে চাকরে এবং ঘুম ভাঙাবার পর নাপিত এসে দাড়ি কামিয়ে, নখ কেটে, কান খুঁটে দিন। তারপর ব্রেকফাস্টে চা—টোস্ট খেয়ে সাহেব টেবিলের সামনে বসতেন চুল ঠিক করতে। হেয়ারড্রেসাররা চুল ঠিক করে দিত। সাহেব অফিসে যেতেন, সঙ্গে চাপরাশি, হরকরা, পিওন, হুঁকোবরদার নিয়ে প্রায় জন কুড়ি নোকর যেত। গ্রীষ্মকালে অফিস চলত বেলা ন’টা থেকে বারোটা, শীতকালে দশটা থেকে দেড়টা পর্যন্ত। তারপর দ্বিপ্রহরে খাওয়া এবং সে খাওয়া ছিল রাক্ষুসে খাওয়া। সেই খাওয়া দেখে ‘কুইজ’ ছদ্মনামে কোনো ইংরেজ কবি লিখে গেছেন—

Their masticators they employ,

On curry, rice and beef and goat.

Voraciously they cram each throat.

মধ্যাহ্নভোজের পর লম্বা ঘুম। সন্ধ্যার আগে সাহেব ও মেমদের ঘুম ভাঙত। ড্রেসাররা এসে সাহেবদের পরচুলা ও মেমদের চুড়াকার খোঁপা বেঁধে দিত। তারপর বিকেলের টিফিন খেয়ে সাহেব—মেমরা নৈশবিহারে বেরুতেন, কেউ পাল্কিতে, কেউ ফিটনে চড়ে। বড় বড় কোম্পানির সাহেবরা জুয়াখেলাতেও জমে যেতেন, প্রধানত তাসের জুয়া এবং অনেকের দেশি রাজারাজড়াদের বাড়িতে নৈশভোজের ও বাইনাচের নিমন্ত্রণ থাকত। এই নৈশভোজ ও নাচের সভাটাই ‘কলকাতা কালচার’—এর একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য, যা কোম্পানির আমল থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় একই ধারায় চলে আসছে বলা যায়।

.

তৃতীয় প্রস্তাব

ইংরেজ হঠাৎ নবাবরাও যে এ দেশি নবাবদের মতন শতাধিক চাকর রাখতেন, সে কথা আগে বলেছি। বিখ্যাত ফ্রান্সিস সাহেবের শ্যালক মাকরাবি লিখে গেছেন :

‘One hundred and ten servants to wait upon a family of four people, and yet we are economists.’

অর্থাৎ ‘আমাদের চারজনের পরিবারে একশো দশজন চাকর চাই, তবু আমরা নাকি ইকনমিস্ট। চাকরদের অবস্থা অনেকটা ক্রীতদাস—দাসীর মতন ছিল। প্রভুদের অত্যাচারে মধ্যে মধ্যে তারা পালিয়ে যেত এবং ধরা পড়লে আদালত থেকে হুকুম জারি করা হত, দশ ঘা কি বিশ ঘা চাবুক মেরে তাদের মাস্টারদের কাছে ফিরিয়ে দেবার জন্য। চাকররা চুরিচামারি করলে সাহেব মাস্টাররা ব্রাহ্মণ পুরোহিত ডেকে তাদের চালপড়া খাওয়াতেন এবং পুরুত চালপড়ার পরীক্ষায় যাকে চোর বলে সাব্যস্ত করতেন তাকে ধরে সাহেব উত্তম—মধ্যম চাবুক মারতেন। এ সম্বন্ধে ফ্যানি পার্কস নামে এক ইংরেজ মহিলা চমৎকার একটি কাহিনি বর্ণনা করে গেছেন। ফ্যানি কিছুদিন কলকাতায় ছিলেন (ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে) এবং তাঁর বহু চাকরবাকর ছিল। একবার তাঁর বাড়িহতে চুরি হওয়াতে তিনি চালপড়া খাইয়ে চোর ধরবার চেষ্টা করেন। এ—সম্বন্ধে তিনি নিজের ভাষাতে যা লিখেছেন, তা—ই উদ্ধৃত করাই ভাল। ফ্যানি লিখেছেন :

Trial by rice… Every man chewed rice, and spat it out like so much milk and water, with the exception of three persons, from whose mouths it came forth as dry… The Moonshee said, ‘those are the guilty men, one of them will probably inform against the others,’ and he carried them off to the police… So much for the ordeal by rice, in which I have firm faith.

পঁয়ত্রিশজন চাকরকে চালপড়ার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। শ্রীমতী ফ্যানি যদি কেবল চালপড়ার ‘অডিয়াল’—এর বর্ণনা দিয়ে ক্ষান্ত হতেন, তাহলে আমাদের বলবার কিছু থাকত না। কিন্তু তা তিনি করেননি। তিনি পরিষ্কার বলেছেন যে, চালপড়ার মাহাত্ম্যে তাঁর অগাধ আস্থা আছে।

এই ব্যাপারটা থেকে বোঝা যায় যে, সাহেবরা আমাদের দেশি কালচার কত দূর পর্যন্ত গ্রহণ করেছিলেন। শুধু যে সাহেবরা কালী মন্দিরে মানত করতে যেতেন বা শালগ্রাম শিলা রেখে পুজো করতেন তা নয়, চালপড়া, ঘটিচালা, নলচালা, কবচধারণ, বশীকরণ পর্যন্ত তাঁরা বেশ রপ্ত করে ফেলেছিলেন। কালচারের ক্ষেত্রে দেবে—আর—নেবের মহিমা বোঝা সত্যিই মুশকিল।

কলকাতার প্রথম যুগের সাহেবদের দৈনন্দিন জীবন ও দিবানিদ্রার কথা বলেছি। দিবানিদ্রাটি নবাবি আমলের কালচারট্রেট, ইংরেজ আমলের সাহেব—নবাবরা স্বচ্ছন্দে আত্মসাৎ করে ফেলেছিলেন। ১৭৮৯ সালে জনৈক ইংরেজ কাহিনিকার লিখছেন :

The custom of reposing if not sleep after dinner is so general that the streets of Calcutta, in the afternoon, are as empty of Europeans as if it were midnight.

‘মধ্যাহ্নভোজনের পর দিবানিদ্রাটি সাহেবসমাজে এতটা প্রচলিত ছিল যে অপরাহ্ণে কলকাতার রাস্তায় সাহেবের টুপি পর্যন্ত দেখা যেত না—মধ্যরাত্রির মতন কলকাতা শহর নিস্তব্ধ হয়ে থাকত।’ সন্ধ্যার দিকে শহর আবার সরগরম হয়ে উঠত ফিটন বগির ঘোড়ার খুরের টপ—টপ শব্দে। অভিজাত সাহেবরা ফিটনে করে বেরুতেন, স্বল্পবিত্তরা শেয়ারে পাল্কি ভাড়া করে শহরে চক্কর দিতেন। লর্ড ও লেডিরা নিজেরাই ফিটন হাঁকিয়ে যেতেন, কচুয়ান বেয়ারারা পিছনে থাকত। যার যত ভাল ফিটন বগি হবে এবং যে যত কায়দা করে ঘোড়ার রাশ টেনে গাড়ি হাঁকিয়ে যেতে পারবে, প্রেমের বাজারে তার দর বাড়বে তত বেশি। একালের বুইক হাম্বারের মতন ভাল ভাল ফিটন বগিই ছিল সেকালের আভিজাত্যের লক্ষণ। একালে যাঁরা ট্রামে—বাসে—রিকশায় চড়ে বেড়ান তাঁদের প্রেমে যেমন কোনো মেয়েই সহজে পড়তে চান না, সেকালেও তেমনি লেডিরা ভাল ফিটনের মালিক না হলে কারও সঙ্গে বাক্যালাপই করতে চাইতেন না। সাহেবসমাজেই এটা বিশেষ করে দেখা যেত। তখন বিলেত থেকে অনেক লেডি কলকাতা শহরে আসতেন শুধু ভাল ব্যবসায়ী সাহেব পাকড়াবার জন্য। কলকাতার রাস্তায় ফিটন—চালক লর্ড ও ফিটন—চালিকা লেডিদের সঙ্গে মোলাকাত হত, টিমটিমে কেরোসিন তেলের আলোয় ঘোড়ার রশি ধরে প্রেমালাপ চলত। জনৈক সাহেব কাহিনিকার লিখেছেন :

‘No gentleman could hope to win a young lady’s favour unless he had a smart carriage.’

সুতরাং যেসব সাহেব শেয়ারে পাল্কি চড়ে সন্ধ্যাভ্রমণে বেরুতেন তাঁদের পাল্কির ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে ফিটনের মাথায়—চড়া লর্ড—লেডিজদের প্রেম দেখে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলা ছাড়া উপায় ছিল না। অর্থাৎ তখন তলার পাল্কি থেকে উপরদিকে চেয়ে ফিটনের মাথায় লর্ড—লেডিদের প্রেম দেখতে হত, এখন দেখতে হয় উপরে ডবল ডেকার বাস থেকে নিচের দিকে চেয়ে স্ট্রিমলাইন্ড বুইকের ভেতর লর্ড—লেডিদের প্রেম। কালের যাত্রায় দৃষ্টির পরিবর্তন যে হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

সান্ধ্য কলকাতার ফৈটনিক প্রেমই যে একমাত্র দ্রষ্টব্য বিষয় ছিল তা নয়। লর্ড—লেডিরা বন্ধুবান্ধবদের গৃহে চায়ের আসরে যেতেন, জুয়া খেলতেন, হোটেলে নাচ—গান—হল্লাও করতেন। এ দেশি রাজা—মহারাজা, নবাব ও জমিদারদের বাড়িতেও নৈশভোজ ও বাইনাচের নিমন্ত্রণ থাকত সাহেবদের। এই নাচের ব্যাপারটা সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং। বিলেতে নাচা আর কলকাতায় নাচা এক ব্যাপার নয়। কলকাতা শহরের প্রচণ্ড গরমে সাহেব—মেমদের নাচার অসুবিধা হত খুব। সামান্য একটু নাচলে—কুঁদলেই সমস্ত গা দিয়ে ঘাম ঝরে পড়ত, কালা ক্রীতদাসের হাতপাখার বা টানা—পাখার হাওয়ায় সে ঘাম সহজে শুকোত না। অনেক সাহেব প্রথম যুগের এই নাচের কথা তাই দুঃখ করে লিখে গেছেন। ১৭৮৮ সালের ৯ অক্টোবর, ‘ক্যালকাটা গেজেট’ পত্রিকায় ‘গাইডস টু হেলথ’ নির্দেশের মধ্যে সাহেবদের তাই জানানো হয় :

The Gentlemen are particularly entreated not to eat above four pounds of solids at a meal, of drink above six bottles of claret. Dancing will be extremely fatal to the ladies, if taken more than three times a week, and they are positively forbid to wear full dresses of either satin or velvet untinl the 1st November.

চার পাউন্ড সলিড বস্তু ও ‘ছ’বোতল মদ খেতে বলা হলেও নাচ—সম্বন্ধে বলা হচ্ছে যে সপ্তাহে তিন দিনের বেশি নাচলে লেডিদের প্রাণ নিয়ে টানাটানি হতে পারে, এবং নাচের সময় ভেলভেট বা শার্টিনের পোশাক পরা একেবারে নিষেধ, অন্তত পহেলা নভেম্বর শীতের আমেজ না—আসা পর্যন্ত। সব ছাঁটাকাঁটা প্রায় নগ্ন নাচের পোশাকের প্রচলন এরপর থেকে শুরু হয়। তার আগে আমাদের দেশের বাইজিদের পোশাক ইংরেজ লেডিরা নকল করবার চেষ্টা করতেন এবং তার ফলে গলদঘর্ম হয়ে নাচের ঘরে প্রায় দাঁত লেগে অজ্ঞান হয়ে পড়তেন।

নাচের ভেতর দিয়ে এইভাবে পূর্ব—পশ্চিমের কালচারের লেনদেন চলতে থাকে। দেশি রাজা—মহারাজা ও নবাবরা যাঁরা সাহেবদের ভোজে নিমন্ত্রণ করতেন, তাঁরা লখনউ—বারাণসীর বিখ্যাত বাইজিদের নিয়ে এসে নাচ দেখাতেন। সাহেবরা তখন এ দেশি বাইজিনাচের রীতিমতো ভক্ত ছিলেন। অবশ্য ভক্ত না হয়ে তখন উপায়ও ছিল না। কারণ, বিলেতি নাচওয়ালি তখন কলকাতা শহরে খুব বেশি আমদানি হয়নি। দেশীয় রাজাদের ভোজসভায় বাইজিদের নাচ দেখে জনৈক ফিরিঙ্গি কবি বর্ণনা করেছেন :

 Then suddenly sounded a loudclanging gong

And there burst on the eyes of the

wondering throng

A bevy of girls

Dressed in bangles and pearls

And other rich gems,

With fat podgy limbs…

And sang a wild air

Which affected your hair—

অর্থাৎ বাইজিদের নাচ দেখে সাহেবদের মাথার চুল পর্যন্ত খাড়া হয়ে উঠত। সেই নাচ ইংরেজ লেডিরা নকল করতে গিয়ে ঘেমে অজ্ঞান হয়ে যেতেন। আর বাইজিরা কী করতেন? ভোজসভা থেকে যখন সাহেব—মেমরা ফিটনে করে বাড়ি ফিরে যেতেন, তখন হলঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে বাইজিরা কৌতুক করে রাজা—মহারাজাদের বিলেতি নাচ নকল করে নেচে দেখাতেন। তা—ই নিয়ে হাসাহাসি—ঠাট্টাবিদ্রুপও চলত। ক্রমে যত দিন যেতে লাগল তত বাইজিরা বিলেতি নাচ ব্যঙ্গ করে নাচতে লাগলেন এবং ইংরেজ লেডিরা বাইজি—নাচ নকল করে ঘামতে আরম্ভ করলেন। উভয় পক্ষের নাচের অনুকরণ থেকে, বিলেতি ও দেশি নাচের ভঙ্গিমার লেনদেন থেকে, এক বিচিত্র ইঙ্গ—বঙ্গ বা ইঙ্গ—ভারতীয় নাচের উৎপত্তি হল। এই অ্যাংলো—ইন্ডিয়ান নাচই হল ‘কলকাতা কালচার—এর’ অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মধ্যরাত্রে কলকাতার হোটেলে আজও এই নাচ দেখা যায়।

‘কলকাতা কালচার’—এর উদ্যোগপর্বের এই হল বৈশিষ্ট্য। নকলনবিশি ও উচ্ছৃঙ্খল বিলাসিতা ছাড়া তার মধ্যে আর বিশেষ কিছু ছিল না। এই উচ্ছৃঙ্খল হালকা ধারার পাশাপাশি আর—একটি স্বতন্ত্র ধারা ছিল, কালচারের লেনদেনের ব্যাপারে যার গুরুত্ব বেশি। ফ্রান্সিস ও হিকি সাহেব যে সমাজে মেলামেশা করতেন সেখানে নাচ—গান—হল্লা, মদ্যপান, জুয়াখেলা, ঘুসখাওয়া, ফিটন—চড়া, নৌকাবিহার ইত্যাদি ছাড়া আর বিশেষ কিছু ছিল না। হেস্টিংস ও তাঁর বন্ধুবান্ধবরা কবিতা লিখতেন, সংস্কৃত—ফরাসি শিখতেন, মহাভারত—রামায়ণ পড়তেন। বাংলা দেশের ধানখেতের উপর দিয়ে পাল্কি চড়ে যেতে যেতে হেস্টিংস অনেক কবিতা লিখেছেন, যুধিষ্ঠিরের স্বর্গারোহণের কথা পড়তে পড়তে কেঁদে ফেলেছেন। দৈনন্দিন জীবনযাত্রাও তাঁর খুব সাদাসিধে ছিল। তাহলেও, খুব সংকীর্ণ একটা গোষ্ঠীর বাইরে হেস্টিংস বিশেষ প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। দেশি—বিদেশি খুদে নবাবদের আয়ত্তে আনতে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। এ দেশি লোকদের সঙ্গে তিনি যথেষ্ট মেলামেশা করতেন, এবং তাঁর আমলে ইংরেজদের সঙ্গে আমাদের একটা প্রীতির সম্পর্ক ছিল। সম্পর্কটা অবশ্য লুটের মালের ভাগবাঁটোয়ারার ভেতর দিয়েই স্থাপিত হয়েছিল। ওয়েলেসলির আমলে এই সম্পর্কে ভাঙন ধরতে থাকে, রাজা—প্রজা, প্রভু—ভৃত্যের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কর্নওয়ালিসের আমলে উচ্ছৃঙ্খলতার বন্যায় ভাটা পড়ে, নবাবি আমলের অস্তগামী সূর্য একেবারে ডুবে যায়। কলকাতা কালচারের এক নতুন পর্ব শুরু হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে।

১৮০৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর ‘ক্যালকাটা গেজেট’ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপা হয় :

To be sold by public auction by Tullon & Company on Monday, the 25th January, 1808 at his house adjoining the Supreme Court, the truly elegant property of William Hickey, Esq. returning to Europe.

হিকি সাহেব তাঁর জিনিসপত্তর নিলেমে বেচে ১৮,৩০০ টাকা পেয়েছিলেন, তা—ও নাকি আসল দামের তুলনায় অনেক কম। এ হিকি হলেন অ্যাটর্নি হিকি, সাংবাদিক হিকি নন। হিকির কলকাতা ত্যাগের পর ‘ক্যালকাটা কালচার—র’ একটা যুগ শেষ হয়ে গেল বলা যায়। সেটা বনেদি দেশি নবাব ও ইংরেজ হঠাৎ—নবাবদের পারস্পরিক লেনদেন ও উচ্ছৃঙ্খলতার প্রাথমিক যুগ। ১৮০৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি হিকির জাহাজ কলকাতার বন্দর ছাড়ল। এ দেশি পুরাতন ভৃত্য মন্নু, হিকির সঙ্গে বিলাতযাত্রা জাহাজে করল। পশ্চিমের সঙ্গে পুবের, বিলেতের সঙ্গে বাংলার তথা ভারতের মিলন হল এইভাবে। বিলেতে পৌঁছে হিকি সাহেব মন্নুকে খিস্টধর্মে দীক্ষা দিয়ে নাম দিলেন ‘উইলিয়াম মান্নিউ’। বিলেতে পাম গাছের তলায় বসে হিকি সাহেব বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে সন্ধ্যার সময় মজলিশি গল্প জমাতেন ‘ক্যালকাটা কালচার’ সম্বন্ধে। উইলিয়াম মান্নিউ ওরফে মন্নুও তাঁতে যোগ দিত। ‘কলকাতা কালচার—এর’ প্রথম পর্বটা এইভাবে শেষ হল।

.

চতুর্থ প্রস্তাব

হিকি সাহেবের বিলেতযাত্রার পর থেকেই কলকাতা কালচারের যে পর্ব শেষ হয়ে গেল, সেটা কলকাতার ইংরেজ হঠাৎ—নবাবদের কালচার, ব্রিটিশ মুচি, নাপিত ও অকালকুষ্মাণ্ডরা—যারা কোম্পানির আমলে ‘ফ্যাক্টর’ ও ‘রাইটার’ হয়ে এ দেশে আসত—তাদের কালচার। সে কালচার হিকির মেময়ের্স বা হেজেসের ভ্রমণকাহিনির মতন বিবরণলিপিরই খোরাক জোগাতে পারে। সেকালের একজন মাদ্রাজের গবর্নর জনৈক ব্রিটিশ জুতো—পালিশওয়ালা রামবোল্ড সাহেব, যখন এ দেশ থেকে বিলেতে ফিরে যান, তখন তাঁর নবাবি চালচলন দেখে বিলেতি পত্রিকায় একটি ব্যঙ্গকবিতা লেখা হয় :

When Mackreth served in Arthur’s crew,

He said Rumbold, “Black my shoe.”

He humbly answered, ‘Yea Bob.”

But when returned from India’s land,

And grown too proud to brook command,

His stern reply was “Na-bob.”

বাংলা দেশের একজন ‘ফ্যাক্টর’ (বাণিজ্যকুঠির ছোট অফিসারদের ‘ফ্যাক্টর’ বলা হত, আর কেরানিদের ‘রাইটার’) সার ফ্রান্সিস সাইক্স যখন প্রচুর ধনসম্পত্তি নিয়ে বিলেতে ফিরে যান, তখন তাঁকেও নবাব নাপিতনন্দন বলে বিদ্রুপ করা হয় সংবাদপত্রে :

Worth offspring of a barber,

Squeez’d twixt powder-puffs and lather.

হেস্টিংস, ক্লাইভ সকলেই ‘রাইটার’ বা কেরানি হয়ে বাংলা দেশে এসেছেন, লর্ড বা নবাব হয়ে স্বদেশে ফিরে গেছেন। প্রথম যুগের কলকাতা কালচার ছিল প্রধানত এইসব ইংরেজ ফ্যাক্টর ও রাইটারদের কালচার, অর্থাৎ সাধারণ তৃতীয় শ্রেণির ইংরেজদের কালচার। কিন্তু এ হল বাংলা দেশের ইংরেজদের কালচারের কথা। তখনকার নতুন বাঙালি কালচার কী রূপ ধারণ করেছিল? অষ্টাদশ শতাব্দীর অর্থাৎ ইংরেজ যুগের প্রথম পর্বের কলকাতা কালচারের বাঙালি রূপের প্রতিভূ ছিলেন শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুর।

হিকি সাহেবের পুরাতন ভৃত্য মন্নুর মতন যাঁরা উইলিয়াম মান্নিউ হয়ে খোলস পাল্টাচ্ছিলেন, তাঁদের সংখ্যা অষ্টাদশ শতাব্দীতে খুব বেশি ছিল না। ১৭৬৩ সাল পর্যন্ত যেসব বিবরণী পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায় যে কয়েকজন মাত্র বাঙালি তখন পর্যন্ত খ্রিস্টান হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ফ্রান্সিস রামচরণ, জনসন রামকৃষ্ণ, জনাথন গঙ্গাগোবিন্দ, হুইলার জনার্দন, ম্যাথিউ মুল্লুকচাঁদ, টমকিন কাশীনাথ, ফিলিপ গঙ্গারাম, টমাস ঘনশ্যাম প্রভৃতির নাম করা যেতে পারে। সুতরাং নবকৃষ্ণের আমলে (১৭৩২—১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে) বাঙালি খ্রিস্টানরা বা বাঙালি সাহেবরা খুব বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। এই সময় ইংরেজ হঠাৎ নবাবদের মতন বাঙালি হঠাৎ—রাজাদের প্রাধান্যই কালচারের ক্ষেত্রে বজায় ছিল এবং কালচারের ভারকেন্দ্র মুর্শিদাবাদ, শান্তিপুর, নবদ্বীপ, কৃষ্ণনগর, ত্রিবেণী, সপ্তগ্রাম থেকে কলকাতা শহরে স্থানান্তরিত হচ্ছিল। বাঙালিদের মধ্যে যাঁরা ইংরেজ যুগের প্রথম পর্বে নতুন কলকাতা কালচারের গোড়াপত্তন করেছিলেন কলকাতা শহরে, শোভাবাজারের মহারাজা নবকৃষ্ণ তাঁদের অন্যতম ও প্রতিনিধিস্থানীয়।

শোভাবাজারের রাজবাড়ি শহরের লোক সকলেই জানেন। মহারাজা নবকৃষ্ণ তাঁর স্বনামখ্যাত রাস্তা ‘রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিট’ নিজেই খরচ করে তৈরি করেছিলেন। চিৎপুর রোড থেকে আপার সার্কুলার রোড পর্যন্ত এই রাস্তা একসময় বিস্তৃত ছিল। কর্নওয়ালিস স্ট্রিট হবার পর এর পূর্বাংশের নাম হয় হাতিবাগান স্ট্রিট এবং পরে আরও কিছু অংশ গ্রে স্ট্রিটের অন্তর্ভুক্ত হয়। সুতরাং এখনকার ‘রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিট’ আদি রাজপথের অর্ধেকেরও কম। হেস্টিংস যখন কোম্পানির কেরানি ছিলেন, তখন নবকৃষ্ণ ছিলেন তাঁর মুনশি বা ফারসি ভাষার প্রাইভেট টিউটর। পরে হেস্টিংস যখন গবর্নর—জেনারেল হন তখন নবকৃষ্ণ হন সুতানুটির (সমস্ত উত্তর কলকাতা) তালুকদার। প্রাইভেট টিউটরের এরকম সম্মান ও পদোন্নতির কথা নিশ্চয়ই আজকাল কেউ ভাবতে পারেন না। কিন্তু তখন মাস্টারদের পোয়াবারোর যুগ ছিল। নবকৃষ্ণের দত্তকপুত্র গোপীমোহনের পুত্র রাধাকান্ত দেবের যিনি ইংরেজির প্রাইভেট টিউটর ছিলেন, তিনি জরির জুতো আর মোতির মালা পরে পড়াতে আসতেন। আজকাল যদি এরকম পোশাক পরে কেউ ছাত্রদের এলিয়টের কবিতা পড়াতে আসেন, তাহলে কী অবস্থা হয়। তখন এরকম হত না। বাঙালি মাস্টার যাঁরা রামমোহন—রাধাকান্তের যুগে ইংরেজি শেখাতেন, তাঁরা জরির জুতো পরে মোতির মালা গলায় দিয়ে বুক ফুলিয়ে পড়তে যেতেন। কারণ নিজেদের তাঁরা সমাজের মধ্যে অমূল্য রত্নস্বরূপ মনে করতেন। রাধাকান্তের ঠাকুরদা নবকৃষ্ণের আমলে ইংরেজির চেয়ে ফার্সির সম্মান ছিল বেশি, ফার্সি না শিখলে ভাল সরকারি চাকরি কারও হত না, শিক্ষিত বলে কেউ গণ্য হতেন না। নবকৃষ্ণ ভাল ফার্সি পড়াতেন, তবে কী পোশাক পরে পড়াতে যেতেন জানি না। জরির জুতো ও মোতির মালা নিশ্চয়ই নয়, পণ্ডিত, মুনশির মতন সাদাসিধে পোশাকই হবে। পরে কোম্পানির মুনশি তেজাউদ্দীন খাঁ—র বদলে ড্রেক সাহেব নবকৃষ্ণকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মুনশির পদে নিযুক্ত করেন। তখন থেকেই তিনি ‘নব মুনশি’ নামে পরিচিত। ইংরেজদের পক্ষে যা কিছু লেখালেখি, আবেদন—নিবেদন, সন্ধি—ষড়যন্ত্রের কাজ সবই মুনশিদের করতে হত নবাবদের সঙ্গে এবং নবকৃষ্ণ ইংরেজদের পক্ষে সেই কাজ করতেন। সুতরাং পলাশির যুদ্ধের পর ইংরেজদের যখন ভাগ্য ফিরে গেল, তখন নবকৃষ্ণেরও ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়। ক্লাইভ দিল্লীশ্বরের কাছ থেকে নবকৃষ্ণকে প্রথমে ‘রাজা বাহাদুর’, পরে ‘মহারাজা বাহাদুর’ উপাধির সনন্দ আনিয়ে দিলেন। নবকৃষ্ণকে এই উপাধি ও খেলাত দান উপলক্ষে ক্লাইভ কলকাতার যে দরবার করেন, তাতে শহরের কোনো ইংরেজ অনুপস্থিত ছিলেন না। দরবার শেষ হবার পর নবকৃষ্ণকে একটা সুসজ্জিত হাতির পিঠে রুপোর হাওদায় চড়িয়ে দিয়ে মহাসমারোহে অশ্বারোহী, গজারোহী, পদাতিক প্রভৃতির শোভাযাত্রা সহকারে শোভাবাজারের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। প্রায় দু’শো বছর আগে কলকাতা শহরের বুকের উপর দিয়ে হাতির পিঠে চড়ে নবকৃষ্ণ এইভাবে শোভাযাত্রা করে ‘মহারাজা বাহাদুর’ উপাধি নিয়ে ঘরে ফিরে যান—অর্থাৎ শোভাবাজারে। তখন কর্নওয়ালিস স্ট্রিট বা চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের মতন কলকাতার রাস্তাঘাট বা ঘরবাড়ি কিছুই ছিল না। মেঠোপথ, চালাঘর, কিছু কিছু ইটের বাড়ি ছিল শ্যামবাজার—বাগবাজারের অনেক জায়গায়। সেকালের সুতানুটির নানা স্থানে চাষবাসও করত লোকে। খুব বেশি শহরের লোকসংখ্যা ছিল না, যারা ছিল তারা প্রায় সকলেই ভিড় করে নবকৃষ্ণের শোভাযাত্রা দেখতে এসেছিল। ইংরেজ যুগের প্রথম পর্বে যে কয়েকজন বাঙালি এইভাবে হঠাৎ রাজা হয়েছিলেন, মহারাজা নবকৃষ্ণ নিঃসন্দেহে তাঁদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। আন্দুল নিবাসী দেওয়ান রামচাঁদ রায়, ভূকৈলাসের দেওয়ান গোকুলচন্দ্র ঘোষাল, দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ, কাশিমবাজারের কান্তবাবু প্রমুখ সমসাময়িক প্রতিপত্তিশালী বাঙালিদের মধ্যে কেউই নবকৃষ্ণের মতন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতিক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। তার কারণ তিনি তাঁর শোভাবাজারের রাজবাড়িটাকে নতুন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল করে তুলেছিলেন। কলকাতা শহরের বাইরে থাকলে হয়তো এতটা প্রভাব বিস্তার করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হত না, কারণ নতুন বাঙালি কালচারের সূত্রপাত হচ্ছে তখন কলকাতায় এবং নতুন যুগের বাঙালি কালচার মানেই ‘কলকাতা কালচার’। প্রকৃতপক্ষে নবকৃষ্ণই (সুবর্ণবণিক ও শেঠ—বসাকদের বাদ দিলে) তখন অধিকাংশ কলকাতার মালিক ছিলেন। আগে বলেছি, হেস্টিংস এ দেশের শাসনকর্তা হয়ে নবকৃষ্ণকে সুতানুটির তালুকদারি দেন। তালুক সুতানুটির উত্তর সীমা ছিল বাগবাজারের খাল, পূর্ব সীমা সার্কুলার রোড, পশ্চিম সীমা ভাগীরথী, দক্ষিণ সীমা বড়বাজারের রতন সরকার গার্ডেন স্ট্রিট। সুতানুটি বাদ দিয়ে ‘কলকাতা’য় (ধর্মতলা পর্যন্ত মধ্য—কলকাতা) একদিকে সুবর্ণবণিক ও অন্যদিকে শেঠ—বসাকদের প্রতিপত্তি ছিল। তার দক্ষিণে ‘গোবিন্দপুরে’ ছিল নতুন ইংরেজদের আধিপত্য। আরও দক্ষিণে ভবানীপুরে ও কালীঘাটে ছিল ধনিক ও মধ্যবিত্ত হিন্দুদের প্রভাব। আধিপত্যটা ‘কালচার জোন’ হিসেবে বলা হচ্ছে। অর্থাৎ এই ছিল নবকৃষ্ণের আমলের কলকাতার ‘কালচার জোনস’ বা সাংস্কৃতিক অঞ্চল :

সুতানুটি (উত্তর কলকাতা) : নবকৃষ্ণ প্রবর্তিত তালুকদারি কালচার—অর্থাৎ নতুন যুগের বাঙালি রাজার সামন্তযুগীয় কালচার।

কলকাতা (মধ্য কলকাতা) : সুবর্ণবণিক ও শেঠ—বসাকদের বণিক—কালচার—সেকালের ও একালের বণিকের এক মিশ্রিত মার্কান্টাইল কালচার।

গোবিন্দপুর (নিম্ন—মধ্যকলকাতা) : নতুন যুগের ইংরেজি কালচার—তৃতীয় শ্রেণির ইংরেজ হঠাৎ—নবাবদের কালচার।

ভবানীপুর—কালীঘাট (দক্ষিণ কলকাতা) : হিন্দু ধনিক ও মধ্যবিত্তর কালচার, মিশ্র সামন্ততান্ত্রিক।

এইসব মিলিয়েই প্রথম যুগের ‘কলকাতা কালচার’। প্রত্যেক অঞ্চলের প্রভাব ছিল অন্য অঞ্চলের উপর, কিন্তু তার মধ্যে নবকৃষ্ণ প্রবর্তিত ইংরেজ যুগের উত্তর কলকাতার তালুকদারি কালচারের প্রভাব ছিল বোধহয় সবচেয়ে বেশি। নবকৃষ্ণের আমলের ক্যালকাটা কালচারের সেই তালুকদারি—তথা—ফিউডাল বৈশিষ্ট্য আজও অনেকটা বজায় আছে। পরাধীন ঔপনিবেশিক কালচারে তাই থাকবার কথা, কারণ নতুন যুগে এ দেশি বণিকরা বাণিজ্য—প্রসার বা পণ্য উৎপাদনের সুযোগ পাননি, ইংরেজরা তাতে বাধা দিয়েছিলেন। তাই আধা—মার্কান্টাইল, আধা—ক্যাপিটালিস্ট ও আধা—ফিউডাল উপাদান নিয়ে এক বিচিত্র ‘কলকাতা কালচার’—এর সৃষ্টি হয়েছে। এই বিচিত্র ‘কলকাতা কালচার’—এর ফিউডাল রূপের অন্যতম প্রবর্তক ছিলেন নবকৃষ্ণ।

তার সারাজীবন ইংরেজদের সাহচর্যে থেকেও এবং হেস্টিংস, ক্লাইভের সঙ্গী হয়েও মহারাজা নবকৃষ্ণ তাঁর বেহারা—কামানো মাথার ‘কেশ—শিখাটি’ শেষ পর্যন্ত কাটতে পারেনি। ধুতি পরে, কাঁধে গামছা নিয়ে তিনি রোজ গঙ্গাস্নান করতে যেতেন—কান্ত খানসামা মাথায় ছাতি ধরে যেত। যখন তিনি রাজকাজে যেতেন, তখন জোড় পরে, মাথায় খিড়কিদার পাগড়ি বেঁধে, লপেটা—পাদুকা পরে, ঝালরদার পাল্কি চড়ে যেতেন। ইংরেজ রাজার আদেশ ছাড়া কেউ তখন ঝালরদার পালকি চড়তে পারত না। ১৭৬৫ সালে ‘রাজা বাহাদুর’ উপাধি পাবার পর নবকৃষ্ণ এই পালকি চড়ার অধিকার পান। ইংরেজ নবাবদের মতন তিনি যে অশ্বশকটে চড়েননি, তা নয়। ১৭৭৫ সালে যখন স্টুয়ার্ট কোম্পানির কারখানা হয়, তখন সেখান থেকে তিনি একখানি শকট তৈরি করান। তিনিই নাকি বাঙালিদের মধ্যে প্রথম ঘোড়াগাড়িতে চড়েন এবং যেদিন প্রথম চড়েন, সেদিন উত্তর কলকাতার রাস্তায় তাঁকে দেখবার জন্য ভিড় নিশ্চয় জমে গিয়েছিল। একটি—দু’টি নয়, নবকৃষ্ণ সাতটি বিবাহ করেন। পলাশির যুদ্ধের পরে সেই বৎসরেই নতুন পূজার দালান তৈরি করে নবকৃষ্ণ সমারোহে দুর্গোৎসব করেন। তাঁর দুর্গোৎসব কতকটা কালচারাল উৎসবের মতন, হিন্দু—মুসলমান, ইংরেজ আমদানি ইহুদি, শহরের সকল সম্প্রদায়ের লোক তাতে যোগ দিত। জলের স্রোতের মতন টাকা খরচ হত। শ্রীশ্রীগোপীনাথ জিউ ও শ্রীশ্রীগোবিন্দ জিউ নামে দেববিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করতেও নবকৃষ্ণ লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করেছিলেন। দোলযাত্রা, জন্মাষ্টমী, চড়কের সময় তিনি মুক্তহস্তে খরচ করতেন। মাতৃশ্রাদ্ধের সময় তিনি নয় লক্ষ টাকা ব্যয়ের ফর্দ করেন, খরচ করেন তারও বেশি।

এসবই হল তালুকদারি—তথা—ফিউডাল কালচারের নমুনা, ইংরেজ যুগের বাঙালি কালচার তথা কলকাতা কালচারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। টমাস ঘনশ্যাম বা ফিলিপ গঙ্গারামের কালচার নয়, এ হল খাঁটি বাঙালি হিন্দুর কালচার। কিন্তু তবু হিন্দু বা মুসলমানের যুগের হিন্দু কালচার এটা নয়, এ হল ইংরেজ যুগের নতুন হিন্দু কালচার। নবকৃষ্ণের বিদ্যোৎসাহ ও কাব্যপ্রীতির মধ্যে তা আরও স্পষ্টাকারে ফুটে উঠেছিল। নবকৃষ্ণের আমল থেকেই কলকাতা শহরে পণ্ডিতদের সমাদর বাড়ল এবং আখড়াই ও কবিগানের ধুম পড়ে গেল। শান্তিপুর নবদ্বীপের কালচার কীভাবে ‘কলকাতা কালচার’—এ পরিণত হল, প্রধানত নবকৃষ্ণের উদযোগে, তা—ও জানা প্রয়োজন। কারণ মধ্যযুগের কালচারকে কীভাবে আধুনিক যুগের ‘কলকাতা কালচার’—এর সঙ্গে কচু—আলু ও আদার মতন মিশিয়ে ফেলা হল, তা না জানলে নবযুগের প্রথম পর্বের বাঙালি কালচারের বিবরণ অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

পঞ্চম প্রস্তাব

বাংলা দেশে যখন নতুন যুগের সূচনা হল তখন নবমুনশি হলেন মহারাজা নবকৃষ্ণ এবং কলকাতা শহরের শ্রেষ্ঠ জমিদার। অর্থাৎ এ যুগের বুর্জোয়া না হয়ে তিনি হলেন একজন সে যুগের ফিউডাল লর্ড। তাঁর হাতে তাই কলকাতা কালচার নতুন ফিউডাল রূপ ধারণ করল। নবকৃষ্ণ কলকাতা শহরে সেকেলে জমিদারি—তালুকদারি কালচারটাকেই আবার নতুন করে প্রবর্তন করলেন। শান্তিপুর—ভাটপাড়া নবদ্বীপের ভট্টাচার্য—গোঁসাই—বৈরাগীর কালচার কলকাতা শহরের গঙ্গাসাগরে মিলিত হল। এই মহামিলনের প্রধান ভগীরথ হলেন নবকৃষ্ণ। পণ্ডিতেরা সমাদৃত হয়ে এলেন ভাগীরথীর পূর্ব তীরে সুতানুটিতে এবং কবিগান, পাঁচালি ও হাফ আখড়াইয়ের অন্যতম কেন্দ্র হল সুতানুটি বা উত্তর কলকাতা। উত্তর থেকে দক্ষিণে ভবানীপুর—কালীঘাট পর্যন্ত এই নব্যতালুকদারি কালচারের স্রোত বয়ে গেল। প্রথম পর্বের এই তালুকদারি কালচারের সঙ্গে পরবর্তী পর্বের ‘বাবু কালচার’ ও ‘এজু কালচার’ (‘এজু’ শব্দ ইংরেজি ‘এজুকেটেড’ শব্দের তাৎকালিক অপভ্রংশ)—এর উদ্বাহবন্ধনে এক বিচিত্র ‘কলকাতা কালচার’—এর সৃষ্টি হল উনিশ শতকে।

শান্তিপুর—ভাটপাড়া—নবদ্বীপের পণ্ডিত—গোঁসাই—বৈরাগীর কালচার কলকাতা শহরে যে নবকলেবর ধারণ করল তা ঠিকমতন বুঝতে হলে তার আগেকার রূপটা জানা দরকার। ভটচাজ পণ্ডিতরা তখন শাস্ত্র আর পুঁথির মধ্যে আমস্তক নিমজ্জিত। দৃশ্যমান জগতের বদলে এক দার্শনিক ও নৈয়ায়িক জগতে তখন তাঁরা কাণ্ডজ্ঞানশূন্য অবস্থায় বিরাজ করছেন। তাঁদের এই তুরীয় অবস্থা সম্বন্ধে অনেক গল্প সে সময় লোকের মুখে মুখে রটেছিল। যেমন, এক ভটচাজ মশায়ের স্ত্রী ডাল রাঁধছিলেন। তিনি স্বামীকে রান্নাঘরে বসিয়ে পুকুরে জল আনতে গেলেন। তিনি তো গেলেন, কিন্তু ডাল এদিকে উথলে উঠল। ভটচাজ মশায় দেখলেন, বিষম বিপদ। উথলে—ওঠা ডাল কীভাবে সামলাবেন কিছুই ঠিক করতে না পেরে, তিনি হাতে পইতে জড়িয়ে সেই হাত ডালের উপরে শূন্যে স্থাপন করে জোরে জোরে চণ্ডীপাঠ করতে লাগলেন। কিন্তু উথলানো ডাল তাতে নিরুথল হল না। ক্রমেই তিনি আরও দ্রুত চণ্ডীপাঠ করতে লাগলেন। এমন সময় ভটচাজ গিন্নি পুকুর থেকে ফিরে এলেন এবং ব্যাপার দেখে বললেন: ‘এ কী? ডালে একটু তেল ফেলে দিতে পারোনি?’ এই বলে তিনি ডালে একটু তেল ফেলে দিলেন, উথলানো থেমে গেল।

ভটচাজ অবাক হয়ে ব্রাহ্মণীর দিকে অনেকক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন, তারপর গললগ্নীকৃতবাস হয়ে করজোড়ে বললেন: ‘তুমি কে বলো নারীরূপে আমার গৃহে অধিষ্ঠাতা নিশ্চয়ই তুমি মানবী নও, দেবী—তা না হলে চণ্ডীপাঠে যা হল না, ব্রাহ্মণ্যশক্তি যেখানে হার মেনে গেল, তুমি তা কী করে সামান্য এক ফোঁটা তেল দিয়ে জয় করলে বলো।’ বলা বাহুল্য, ব্রাহ্মণী ‘আ মরণ!’ বলে এক ঝামটা দিয়ে চলে গেলেন।

আর—এক ভটচাজের পুঁথি পড়তে পড়তে অনেক রাতে তামাক খাবার ইচ্ছা হল। তিনি পুঁথি ছেড়ে উঠে টিকে হাতে করে আগুনের খোঁজে বেরুলেন। মাইলখানেক হেঁটে গিয়ে দেখলেন, দূরে একটা পাঁজা পুড়ছে। সেখান থেকে টিকে ধরিয়ে ঘরে ফিরে দেখেন যে, তাঁর পুঁথির সামনে প্রদীপের বুক দাউদাউ করে জ্বলছে। তখন তাঁর খেয়াল হল, তা—ই তো, টিকে তো প্রদীপেই ধরানো যেত। এই হল ভটচাজ পণ্ডিতের অবস্থা—একেবারে চরম তুরীয় অবস্থা। কিন্তু তবু তাঁরা সত্যিকারের শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন। মহারাজা নবকৃষ্ণ এই ধরনের অনেক পণ্ডিতের পেট্রন ছিলেন। তাঁরই সাহায্যে অনেক পণ্ডিত ইংরেজ কোম্পানির জন্য শাস্ত্র অনুবাদের ও পণ্ডিতের কাজে নিযুক্ত হয়েছেন। কিন্তু পণ্ডিত হলেও তর্কবাগীশ—বিদ্যাবাগীশরা কলকাতা কালচারের উপর খুব বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি।

তাঁদের চেয়ে অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিল গোঁসাই ও বাবাজিদের আখড়া—কালচার। কলকাতা কালচারের উপর টুলো পণ্ডিতদের কালচারের চেয়ে বোষ্টম বাবাজিদের আখড়াই কালচারের প্রভাব অনেক বেশি। কলকাতার আশপাশে নদিয়া হাওড়া হুগলি বর্ধমানে তখন বাবাজিদের আখড়া ব্যাঙের ছাতার মতন গজিয়ে উঠেছিল। প্রেমানন্দ ভক্তানন্দ বাবাজিরা এবং ব্রজেশ্বরী রাইকিশোরী সেবাদাসীরা আখড়াগুলো সরগরম করে রেখেছিলেন। এইসব আখড়া থেকে প্রধানত কৃষ্ণলীলাকে কেন্দ্র করেই আখড়াই সঙ্গীত সংগ্রামের বিকাশ হয়। দুই দলের গানের লড়াই হত—একদল প্রশ্নকারী, আর—একদল উত্তরী। প্রথমে মঙ্গলগীতি, পরে সখীসংবাদ, তারপর মান ও শেষে মিলন গাওয়া হত। আখড়াই সঙ্গীতে চিতেন, পরচিতেন, ফুকা, ডবল ফুকা, মেলতা, মহড়া, সোয়ারী, মেলতা, মহড়া ও তেহারাণ দিয়ে ফিরে মেলতার পর মহড়া দিয়ে গান শেষ করা হত। এই হল গানের নমুনা :

চিঃ—আচম্বিতে একী প্রাণ

সই সই করি দরশন?

পঃ চিঃ—আমিও নারী চিন্তে নারি,

কে ও নারী, না জানি বিবরণ।

ফুকা—কীবা কামিনীর হাস্যানন

লাজে পূর্ণশশী মেঘে অদর্শন,

শতদল প্রায় দু’নয়ন।

ডবল ফুকা—কটিতে কেশরী মানে হার,

কীবা পীনাচ্চ কুচাকার।

রূপে রক্ষা নাই তায় অলঙ্কার,

এমন নারী বুঝি নাই আর?

—ইত্যাদি।

এই আখড়াই গানের প্রধান জন্মস্থান ছিল শান্তিপুর এবং রাজারাজড়া, জমিদাররা ছিলেন তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। শ্রীচৈতন্যের বৈষ্ণবধর্ম যখন বাবাজি ও সেবাদাসীদের আখড়া—কালচারে পরিণত হল, তখন আখড়াই সঙ্গীত হল তার অন্যতম প্রচারমাধ্যম। ধনীদের অবসর—বিনোদনে এই আখড়াই গান প্রধান সহায়ক হল। হিন্দুদের দেখাদেখি সাধারণ অশিক্ষিত মুসলমান স্বভাবকবিরা এর বিকৃত অনুকরণ করে ‘তর্জার লড়াই’ শুরু করল। শান্তিপুরের পর যখন সপ্তগ্রামের প্রাধান্য বাড়ল, তখন সপ্তগ্রাম হল আখড়াই সঙ্গীত, কবিগান ও তর্জার লড়াইয়ের প্রধান কেন্দ্র। পরে সপ্তগ্রাম থেকে আর্থিক ভারকেন্দ্র যখন হুগলি—চুঁচুড়ায় স্থানান্তরিত হল, তখন আখড়াই গানের আসরও জমে উঠল চুঁচুড়ায়। তারপর যখন কলকাতা শহর প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র ও রাজধানী হয়ে উঠল, তখন এইসব গানেরও প্রধান আখড়া হল কলকাতা। আখড়া কলকাতা শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে গজিয়ে উঠল এবং তার পৃষ্ঠপোষক হলেন শহরের নতুন বাঙালি বড়লোকেরা। এইসব আখড়ার মধ্যে শোভাবাজারের রাজবাড়ি তখন অন্যতম এবং কলকাতার নতুন তালুকদার মহারাজা নবকৃষ্ণ বোধহয় তার সর্বপ্রধান পৃষ্ঠপোষক। হরু ঠাকুরের দল, নিতাই বৈরাগীর দল, ভবানী বেনের দল, জোড়াসাঁকোর দল, পাথুরেঘাটার দল, বাগবাজারের দল, শোভাবাজারের দল, ভবানীপুরের দল প্রভৃতি আখড়াই গানের শখের ও পেশাদারি দল কলকাতা শহরে দেখা দিল। মহারাজা নবকৃষ্ণ হারু ঠাকুর, নিতাই বৈষ্ণব প্রভৃতি কবিয়ালদের যথেষ্ট সাহায্য করতেন ও প্রচুর উৎসাহ দিতেন। তাঁকেই কলকাতার আখড়াই ও কবি—কালচারের প্রধান প্রবর্তক বললে ভুল হয় না।

নবকৃষ্ণের এই পোষকতা সম্বন্ধে নিধুবাবুর (রামনিধি গুপ্ত) ‘গীতিরত্ন’ গ্রন্থের (১২৬৩ সনে ছাপা) সংকলক জয়গোপাল গুপ্ত লিখেছেন :

‘১২১০ সালের পূর্বে মৃত মহামতি মহারাজা নবকৃষ্ণ বাহাদুরের সময়ে বাঙালী মহাশয়দিগের মধ্যে ”আখড়াই” গাহনার অত্যন্তামোদ ছিল। তখন উক্ত মহারাজের নিকট কুলুই চন্দ্র সেন নামক একজন বৈদ্য আখড়াই বিষয়ে অতিশয় প্রতিপন্ন ছিলেন। ঐ মহাশয় সঙ্গীত শাস্ত্রে অদ্বিতীয় পারদর্শী ছিলেন, তাঁহাকে আখড়াই গাহনার একজন জন্মদাতা বলাই কর্তব্য হয়, তিনি ত্মরামনিধি গুপ্তের অতি নিকট সম্বন্ধীয় মাতুলপুত্র ছিলেন, কিন্তু নিধুবাবু তাঁহার পর আখড়াই বিষয়ে যে সকল নূতন প্রণালী করেন এমন আর কেহই করিতে পারেন নাই, ঞিহারকৃত প্রণালীই অদ্যাপি প্রচলিত রহিয়াছে।’

ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছেন : ‘ধনী লোক মাত্রেই কোন পর্বাহ উপলক্ষে কবিতা শুনিবার ইচ্ছা হইলে অগ্রেই নিতাই দাসকে বায়না দিতেন। ইঁহার সহিত ভবানী বেনের সঙ্গীতযুদ্ধ ভাল হইত। এক দিবস ও দুই দিবসের পথ হইতেও লোক সকল নিতেভবানের লড়াই শুনিতে আসিত। যাঁহার বাটীতে গাহনা হইত তাঁহার গৃহে লোকারণ্য হইত, ভিড়ের মধ্যভেদ করিয়া প্রবেশ করিতে হইলে প্রাণান্ত হইত। তৎকালে যদিও অন্যান্য দল ছিল, কিন্তু হরু ঠাকুর, নিতাই দাস এবং ভবানী বণিক এই তিনজনের দল সর্বাপেক্ষা প্রধানরূপে গণ্য ছিল।’ এই সব স্বভাবকবির কবিত্বশক্তির নেহাত উপেক্ষণীয় ছিল না। দু—একটি দৃষ্টান্ত দিলে বোঝা যাবে। যেমন ‘প্রেম’ সম্পর্কে হরু ঠাকুর বলেছেন :

নাম প্রেম তার সাকার নহে,

বস্তুটি সে নিরাকার,

জীবন যৌবন ধন কীবা মন,

প্রাণ বশীভূত তার।

অথবা—প্রেম কি যাচলে মিলে,

খুঁজলে মিলে?

সে আপনি উদয় হয়

শুভ যোগ পেলে।

.

রাম বসু বিরহী স্ত্রী—র বিরহযন্ত্রণা বর্ণনা করেছেন :

মনে রইল সই মনের বেদনা।

প্রবাসে যখন যাই গো সে, তারে বলি বলি,

আর বলা হলো না।

শরমে মরমে কথা কওয়া গেল না।

.

গোঁজলা গুঁইয়ের প্রেমের কবিতা আরও গরম ও চরম অবস্থায় উত্তীর্ণ হয়েছে। যেমন, প্রেমিক বলছে প্রেমিকাকে—

তোমাতে আমাতে একই অঙ্গ,

তুমি কমলিনী আমি সে ভৃঙ্গ,

অনুমানে বুঝি আমি সে ভুজঙ্গ,

তুমি আমার তায় রতনমণি।

তোমাতে আমাতে একই কায়া,

আমি দেহ, প্রাণ। তুমি লো ছায়া,

আমি মহাপ্রাণী, তুমি লো মায়া,

মনে মনে ভেবে দেখো আপনি।

.

কবিগানের প্রধান উপাদান হল, কৃষ্ণলীলা কেন্দ্র করে নরনারীরা প্রেমের ব্যাখ্যান। হরু ঠাকুর, নিতাই দাস, রাম বসু, ভোলা ময়রা, ভবানী বেনে, অ্যান্টনির ফিরিঙ্গি, গোঁজলা গুঁই প্রভৃতি স্বভাবকবিদের পাল্লায় পড়ে এই প্রেমের ব্যাখ্যান ও লীলামাধুর্য যে কোন স্তর পর্যন্ত গড়িয়েছিল তা সহজেই অনুমান করা যায়। তার উপর কলকাতার বাঙালি হঠাৎ রাজারা এইসব স্বভাবকবির আখড়াই ও কবিগানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁদের রুচি, শিক্ষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে প্রথম যুগের ইংরেজ হঠাৎ নবাবদের বিকৃত রুচির বিশেষ তারতম্য ছিল না। হতভাগ্য স্বভাবকবিরা এইসব বাঙালি হঠাৎ—রাজাদের বিকৃত রুচি চরিতার্থ করতে বাধ্য হত পেটের দায়ে, কবিগান গেয়ে। যে বৈষ্ণব—কালচার কালক্রমে বাবাজি—সেবাদাসীদের আখড়াই—কালচারে পরিণত হয়ে কৃষ্ণনগর, শান্তিপুর, সপ্তগ্রাম, হুগলি—চুঁচুড়ার বাঙালি ধনীদের চিত্তবিনোদন করত, সেই আখড়াই কালচারই হাফ—আখড়াই ও কবিগানের ভিতর দিয়ে কলকাতা শহরের নব্যযুগের বাঙালিবাবু, হঠাৎ—জমিদার ও দেওয়ানদের বিকৃত রুচির ইন্ধন জোগাত। ইংরেজ হঠাৎ—নবাবরা এবং বাঙালি হঠাৎ—রাজারা এইভাবে ‘কলকাতা কালচার’—এর গোড়াপত্তন করেছিলেন। ‘কলকাতা কালচার’—এর প্রথম পর্বের কাহিনি এইখানেই শেষ হল। কেবল নটেগাছটি মুড়োল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *