০৫. কেউই বাগানবাড়িতে এল না

পাঁচ

পরদিন প্রভাসের দলের কেউই বাগানবাড়িতে এল না৷ শরৎ সন্ধ্যার দিকে বাগানে আপনমনে খানিকটা বেড়িয়ে বাবাকে ডেকে বললে, বাবা খাবে নাকি?

কেদার বললেন, আজ এরা কেউ এল না কেন রে শরৎ?

—তা কি জানি বাবা! বোধ হয় কোনো কাজ পড়েছে—

—তা তো বুঝলাম, কিন্তু যা দেখবার দেখে নিতে পারলে হত ভালো৷ আবার বাড়ি ফিরতে হবে সংক্রান্তির আগেই—

কেদারের আর তেমন ভালো লাগছিল না বটে, কিন্তু তিনি বুঝেছিলেন মেয়ের এত তাড়াতাড়ি দেশে ফিরবার ইচ্ছে নেই—তার এখন দেখবার বয়স, কখনো কিছু দেখে নি, আছে আজীবন গড়শিবপুরের জঙ্গলে পড়ে৷ দেখতে চায় দেখুক—তিনি বাধা দিতে চান না৷

শরৎ বললে, পেঁপে খাবে বাবা? বাগানের গাছ থেকে পেড়েছি, চমৎকার গাছ-পাকা! নিয়ে আসি দাঁড়াও—

কেদার বললেন, আশপাশের বাগানবাড়িতে লোক থাকে কিনা জানিস কিছু মা?

—চলো না, তুমি পেঁপে খেয়ে নাও—দেখে আসি৷

মিনিট পনেরো পরে দুজনে পাশের একটা অন্ধকার বাগানবাড়ির ফটকের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই একজন খোট্টা দারোয়ান ফটকের পাশের ছোট্ট একটা গুমটি ঘর থেকে বার হয়ে বললে, কেয়া মাংতা বাবুজি?

কেদার হিন্দী বলতে পারেন না৷ উত্তর দিলেন, এ বাগানে কি আছে দারোয়ানজি?

—বাবুলোক হ্যায়—মাইজি ভি হ্যায়—যাইয়ে গা?

—হ্যাঁ, আমার এই মেয়েটি একবার বাগান দেখতে এসেছে—

—যাইয়ে—

বেশ বাগান৷ প্রভাসদের বাগানের চেয়ে বড় না হলেও নিতান্ত ছোট নয়৷ অনেক রকম ফুলের গাছ, ফুল ফুটেও আছে অনেক গাছে—সানবাঁধানো পুকুরের ঘাট, খানিকটা জায়গা তার দিয়ে ঘেরা, তার মধ্যে হাঁস এবং মুরগি আটকানো৷ খুব খানিকটা এদিক-ওদিক লিচুতলা ও আমতলায় অন্ধকারে বেড়ানোর পরে ওরা একেবারে বাগানবাড়ির সামনের সুরকি বিছানো পথে গিয়ে উঠল৷ বাড়ির বারান্দা থেকে কে একজন প্রৌঢ়কণ্ঠে হাঁক দিয়ে বললেন, কে ওখানে?

কেদার বললেন, এই আমরা৷ বাগান দেখতে এসেছিলাম—

একটি পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছরের বৃদ্ধ ভদ্রলোক ধপধপে সাদা কোঁচানো কাপড় পরে খালিগায়ে রোয়াকে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, আসুন আসুন—সঙ্গে মা রয়েছেন, তা উনি বাড়ির মধ্যে যান না? আমার স্ত্রী আছেন—

শরৎ পাশের পাঁচিলের সরু দরজা দিয়ে অন্দরে ঢুকল৷ কেদার রোয়াকে উঠতেই ভদ্রলোক তাঁকে নিয়ে উপরে চেয়ারে বসালেন৷ বললেন, কোন বাগানে আছেন আপনারা?

—এই দুখানা বাগানের পাশে৷ প্রভাসকে চেনেন কি বাবু?

—না, আমি নতুন এ বাগান কিনেছি, কারুর সঙ্গে চেনা হয় নি এখনও৷ তামাক খান কি?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, তা খাই—তবে আমার আবার হ্যাঙ্গামা আছে—ব্রাহ্মণের হুঁকো না থাকলে—

—আপনি ব্রাহ্মণ বুঝি? ও, বেশ বেশ৷ আমিও তাই, আমার নাম শশিভূষণ চাটুজ্জে—‘এঁড়েদার’ চাটুজ্জে আমরা৷ ওরে ও নন্দে, তামাক নিয়ে আয়—

দুজনে কিছুক্ষণ তামাক খাওয়ার পরে চাটুজ্জে মশাই বললেন, আচ্ছা মশাই—এখানে টেক্স এত বেশি কেন বলতে পারেন—আমার এই বাগানে কোয়ার্টারে আট টাকা টেক্স৷ আপনি কত দেন বলুন তো? না হয় আমি একবার লেখালেখি করে দেখি—কলকাতায় আপনারা থাকেন কোথায়?

কেদার অপ্রতিভ মুখে বললেন, আমার বাগান নয়—আমাদের বাড়ি তো কলকাতায় নয়৷ বেড়াতে এসেছি দু-দিনের জন্যে—কলকাতায় থাকি নে—

—ও, আপনাদের দেশ কোথায়? গড়শিবপুর? সে কোন জেলা? ও, বেশ বেশ৷

—বাবু কি এখানেই বাস করেন?

—না, আমার স্ত্রীর শরীর ভালো না, ডাক্তারে বলেছে কলকাতার বাইরে কিছুদিন থাকতে৷ তাই এলাম—যদি ভালো লাগে আর যদি শরীর সারে, তবে থাকব দু-তিন মাস! বেশ হল মশায়ের সঙ্গে আলাপ হয়ে৷ আপনার গানটান আসে?

কেদার সলজ্জ বিনয়ের সুরে বললেন, ওই অল্প অল্প৷

—তবে ভালোই হল—দুজনে মিলে বেশ একটু গান-বাজনা করা যাবে৷ কাল এখানে এসে বিকেলে চা খাবেন৷ বলা রইল কিন্তু…বাজাতে পারেন?

—আজ্ঞে, সামান্য৷

—সামান্য-টামান্য না৷ গুণী লোক আপনি দেখেই বুঝেছি৷ এখন খালিগলায় একখানা শুনিয়ে দিন না দয়া করে? তার পর কাল থেকে আমি সব যোগাড়যন্ত্র করে রাখব এখন৷

কেদার একখানা শ্যামা বিষয় গান ধরলেন, কিন্তু অপরিচিত জায়গায় তেমন সুবিধে করতে পারলেন না, কেমন যেন বাধ-বাধ ঠেকতে লাগল—সতীশ কলুর দোকানে বসে গাইলে যেমনটি হয় তেমনটি কোনোখানেই হয় না৷ চাটুজ্জে মশাই কিন্তু তাই শুনেই খুব খুশি হয়ে উঠে বললেন, বাঃ বাঃ, বেশ চমৎকার গলাটি আপনার! এসব গান আজকাল বড় একটা শোনাই যায় না৷—সব থিয়েটারি গান শুনে শুনে কান পচে গেল মশাই৷ বসুন, একটু চায়ের ব্যবস্থা করে আসি—

কেদার ভদ্রলোককে নিরস্ত করে বললেন, চা খেয়ে বেরিয়েছি, আমি দুবার চা খাইনে সন্দের পর, রাতে ঘুম হয় না, বয়েস হয়েছে তো—এবার আপনি বরং একটা—

চাটুজ্জে মশায়ও দেখা গেল বিনয়ের অবতার৷ তিনি গান গাইলেন না, কারণ তিনি বললেন, একে তিনি গান গান না, কারণ গানের গলা নেই তাঁর—যাও বা একটু-আধটু হুঁ হুঁ করতেন, কেদারের মতো গুণী লোকের সামনে তাঁর গলা দিয়ে কিছুই বেরুবে না৷ অবশেষে অনেক অনুরোধের পর চাটুজ্জে মশায় একটা রামপ্রসাদী গেয়ে শোনালেন—কেদারের মনে হল তাঁদের গ্রামের যাত্রাদলের তিনকড়ি কামার এর চেয়ে অনেক ভালো গায়৷

এ সময় শরৎ বাড়ির মধ্য থেকে বেরিয়ে এসে বললে, চলো বাবা, রাত হয়ে গেল৷

চাটুজ্জে মশায় বললেন, এটি কে? মেয়ে বুঝি? তা মা যে আমার জগদ্ধাত্রীর মতো, ঘর আলো করা মা দেখছি৷ বিয়ে দেন নি এখনও?

—বিয়ে দিয়েছিলাম চাটুজ্জে মশাই—কিন্তু বরাত ভালো নয়, বিয়ের দু-বছর পরেই হাতের শাঁখা ঘুচে গেল৷ চলো মা, উঠি আজ চাটুজ্জে মশাই, নমস্কার৷ বড় আনন্দ হল—মাঝে মাঝে আসব কিন্তু৷

—আসবেন বৈকি, রোজ আসবেন আর এখানে চা খাবেন৷ মাকেও নিয়ে আসবেন৷ মায়ের কথা শুনে মনে বড় দুঃখ হল—উনি আমার এখানে একটু মিষ্টিমুখ করবেন একদিন৷ নমস্কার৷

পথে আসতে আসতে শরৎ বললে, গিন্নি বেশ লোক বাবা৷ আমায় কত আদর করলে, জল খাওয়ানোর জন্যে কত পীড়াপীড়ি—আমি খেলাম না, পরের বাড়ি খেতে লজ্জা করে—চিনি নে শুনি নে৷ আমায় আবার যেতে বলেছে৷

—আমারও ভালো হল, কর্তা গান-বাজনা ভালোবাসে, শখ আছে—এখানে সন্দেটা কাটানো যাবে—

ওরা নিজেদের বাগানবাড়িতে ঢুকেই দেখলে বাড়ির সামনে প্রভাসের মোটর দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ তার পর বাড়ি পৌঁছেই প্রভাসের সঙ্গে দেখা হল৷ সে বাড়ির সামনে গোল বারান্দায় বসে ছিল, বোধ হয় এদের প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায়৷ কাছে এসে বললে, কোথায় গিয়েছিলেন কাকাবাবু? আমি অনেকক্ষণ এসে বসে আছি৷ কিন্তু আজ যে বড্ড দেরি করে ফেললেন—সিনেমা যাবার সময় চলে গেল৷ সাড়ে ন’টার সময় যাবেন? প্রায় বারোটায় ভাঙবে৷

শরৎ বললে, না প্রভাসদা, অত রাত্রে ফিরলে বাবার শরীর খারাপ হবে৷ থাক না আজ, আর একদিন হবে এখন—

কেদার বললেন, তাই হবে এখন প্রভাস, আজ বড্ড দেরি হয়ে যাবে৷ তুমি তো আজ ও-বেলা এলে না—এ-বেলাও আমরা সন্দে পর্যন্ত দেখে তবে বেরিয়েছি৷ কাল বরং যাওয়া যাবে এখন৷ বসো চা খাও৷

—না কাকাবাবু, আজ আর বসব না৷ কাল তৈরি থাকবেন, আসব বেলা পাঁচটার মধ্যে৷ কোনো অসুবিধে হচ্ছে না?

—না না, অসুবিধে কিসের? তুমি সেজন্য কিছু ভেব না৷

.

পরদিন একেবারে দুপুরের পরই প্রভাস মোটর নিয়ে এল৷ শরৎ চা করে খাওয়ালে প্রভাসকে—তারপর সবাই মিলে মোটরে গিয়ে উঠল৷ অনেক বড় বড় রাস্তা ও গাড়ি মোটরের ভিড় পেরিয়ে ওদের গাড়ি এসে একটা বড় বাড়ির সামনে দাঁড়াল৷ প্রভাস বললে, এই হল সিনেমা ঘর—আপনারা গাড়িতে বসুন, আমি টিকিট করে আনি—

শরৎ বাড়িটার মধ্যে ঢুকে চারিদিকে চেয়ে আশ্চর্য হয়ে গেল৷ কত উঁচু ছাদ, ছাদের গায়ে বড় বড় আলোর ডুম, গদি-আঁটা চেয়ার বেঞ্চি ঝকঝক তকতক করছে, কত সাহেব মেম বাঙালির ভিড়!

কেদার বললে, এ জায়গাটার নাম কি হে প্রভাস?

—আজ্ঞে এ হল এলফিনস্টোন পিকচার প্যালেস—একটা পার্শি কোম্পানির৷

—বেশ বেশ৷ চমৎকার বাড়িটা—না মা শরৎ? থাকি জঙ্গলে পড়ে, এমন ধারাটি কখনো দেখি নি—আর দেখবই বা কোথায়? ইচ্ছে হয় সতীশ কলু, ছিবাস এদের নিয়ে এসে দেখাই৷ কিছুই দেখলে না ওরা, শুধু তেল মেপে আর দাঁড়ি-পাল্লা ধরেই জীবনটা কাটালে৷

সারা ঘর অন্ধকার হয়ে গেল৷ কেদার বলে উঠলেন—ও প্রভাস, এ কি হল? ওদের আলো খারাপ হয়ে গেল বুঝি?

প্রভাস নিম্নসুরে বললে, চুপ করুন কাকাবাবু, এবার ছবি আরম্ভ হবে৷

সামনে সাদা কাপড়ের পর্দাটার ওপরে যেন জাদুকরের মন্ত্রবলে মায়াপুরীর সৃষ্টি হয়ে গেল, দিব্যি বাড়িঘর, লোকজন কথা বলছে, রেলগাড়ি ছুটছে, সাহেব-মেমের ছেলেমেয়েরা হাসি-খেলা করছে, কাপড়ের পর্দার ওপরে যেন আর একটা কলকাতা শহর৷

কিন্তু ছবিতে কি করে কথা বলে? কেদার অনেকবার ঠাউরে দেখবার চেষ্টা করেও কিছু মীমাংসা করতে পারলেন না৷ অবিশ্যি এর মধ্যে ফাঁকি আছে নিশ্চয়ই, মানুষে পেছন থেকে কথা বলছে কৌশল করে, মনে হচ্ছে যেন ছবির মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছে—কিন্তু কেদার সেটা ধরে ফেলবার অনেক চেষ্টা করেও কৃতকার্য হতে পারলেন না৷ একবার একটা মোটরগাড়ির আওয়াজ শুনে কেদার দস্তুরমতো অবাক হয়ে গেলেন৷ মানুষে কি মোটরগাড়ির আওয়াজ বের করে মুখ দিয়ে? বোধ হয় কোনো কলের সাহায্যে ওই আওয়াজ করা হচ্ছে৷ কলে কি না হয়?

হঠাৎ সব আলো একসঙ্গে আবার জ্বলে উঠল৷ কেদার বললেন, শেষ হয়ে গেল বুঝি?

প্রভাস বললে, না কাকাবাবু, এখন কিছুক্ষণ বন্ধ থাকবে—তারপর আবার আরম্ভ হবে৷ চা খাবেন কি? বাইরে আসুন তবে?

শরৎ বললে, প্রভাসদা, দোকানের চা আর ওঁকে খাওয়ানোর দরকার নেই—সত্যিক জাতের এঁটো পেয়ালায় চুমুক দিতে হবে—থাকগে৷ ওমা, ওই যে অরুণবাবু—উনি এলেন কোথা থেকে?

অরুণ কেদারকে প্রণাম করে বললে, কেমন লাগছে আপনার, ওঁর লাগছে কেমন? চলুন আজ সিনেমা ভাঙলে দমদমা পর্যন্ত আপনাদের পৌঁছে দিয়ে আসব—

কেদার বললেন, বেশ, তা হলে আমাদের ওখানেই আজ খেয়ে আসবে দুজনে—

—না, আজ আর না, আর একদিন হবে এখন বরং৷

এই সময় গিরীন বলে সেই লোকটিও ওদের কাছে এসে দাঁড়াল৷ প্রভাসকে সে কি একটা কথা বললে ইংরিজিতে৷

প্রভাস বললে, কাকাবাবু, শরৎ দিদিকে আমার এই বন্ধু ওঁর বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্যে বলছেন৷

কেদার বললেন, বেশ তো৷ আজই?

—হ্যাঁ আজ, বায়োস্কোপের পরে৷

ছবি ভাঙবার পরে সবাই মোটরে উঠল৷ গিরীন ও প্রভাস বসেছে সামনে, কেদার, অরুণ আর শরৎ পেছনের সিটে৷ একটা গলির মধ্যে ঢুকে একটা ছোট বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াল৷ গিরীন নেমে ডাক দিলে—ও রবি, রবি?

একটি ছেলে এসে দোর খুলে দিলে৷ গিরীন বললে, তোমার এই পিসিমাকে বাড়ির মধ্যে নিয়ে যাও—আসুন কেদারবাবু, বাইরের ঘরে আলো দিয়ে গিয়েছে৷

সে বাড়িতে বেশিক্ষণ দেরি হল না৷ বাড়ির মধ্যে থেকে সেই ছেলেটাই সকলকে চা ও খাবার দিয়ে গেল বাইরের ঘরে৷ একটু পরে শরৎ এসে বললে, চলো বাবা৷

.

আবার দমদমার বাগানবাড়ি৷ রাত তখন খুব বেশি হয় নি—সুতরাং কেদার ওদের সকলকেই থেকে খেয়ে যেতে বললেন৷ হাজার হোক, রাজবংশের ছেলে তিনি৷ নজরটা তাঁর কোনো কালেই ছোট নয়৷ কিন্তু ওরা কেউ থাকতে রাজি হল না৷—তবে এক পেয়ালা করে চা খেয়ে যেতে কেউ বিশেষ আপত্তি করলে না৷

কেদার জিজ্ঞেস করলেন রাত্রে খেতে বসে—ওই ছেলেটির বাড়িতে তোকে কিছু খেতে দেয় নি?

—দিয়েছিল, আমি খাই নি৷ তুমি?

—আমায় দিয়েছিল, আমি খেয়েওছিলাম৷

—তা আর খাবে না কেন? তোমার কি জাতজম্মো কিছু আছে? বাচবিচের বলে জিনিস নেই তোমার শরীরে৷

—কেন?

—কেন? ওরা জাতে কি তার ঠিক নেই৷ বামুন নয়, কায়েতও নয়—আমি পরের বাড়ি গিয়ে কি করে তোমাকে বারণ করে পাঠাই?

—কি করে জানলে?

—ও মা, সে যেন কেমন৷ দু-তিনটি বৌ বাড়িতে৷ সবাই সেজেগুজে পান মুখে দিয়ে বসে আছে৷ যে ছেলেটা দোর খুলে দিলে, তাকে ও-বাড়ির চাকর বলে মনে হল৷ কেমন যেন—ভালো জাত নয় বাবা৷ একটি বৌ আমায় বেশ আদর-যত্ন করেছে৷ বেশ মিষ্টি কথা বলে৷ আবার যেতে বললে৷ আমার ইচ্ছে হয় মাথা খুঁড়ে মরি বাবা, তুমি কেন ওদের বাড়ি জল খেলে? আমায় পান সেজে দিতে এসেছিল, আমি বললাম, পান খাই নে৷

—তাতে আর কি হয়েছে?

—তোমার তো কিছু হয় না—কিন্তু আমার যে গা-কেমন করে৷ আচ্ছা গিরীনবাবুর বাড়ি নাকি ওটা?

—হ্যাঁ, তাই তো বললে৷

—অনেক জিনিসপত্র আছে বাড়িতে৷ ওরা বড়লোক বলে মনে হল৷ হারমোনিয়ম, কলের গান, বাজনার জিনিস—বেশ বিছানা-পাতা চৌকি, বালিশ, তাকিয়া—দেওয়ালে সব ছবি৷ সেদিক থেকে খুব সাজানো-গোজানো৷

—তা হবে না কেন মা, কলকাতার বড়লোক সব৷ এ কি আর আমাদের গাঁয়ের জঙ্গল পেয়েছ?

—তুমি আমাদের গাঁয়ের নিন্দে করো না অমন করে৷

কেদার বললেন, তোদের গাঁ বুঝি আমাদের গাঁ নয় পাগলি? আচ্ছা, বল তো তোর এখানে থাকতে আর ভালো লাগছে, না গ্রামে ফিরতে ইচ্ছে হচ্ছে?

—এখন দুদিন এখানে থেকে দেখতে ইচ্ছে হয় বৈকি বাবা৷ আমার কথা যদি বলো—আমার ইচ্ছে এখানে এখন কিছুদিন থেকে সব দেখি শুনি—গাঁ তো আছেই, সে আর কে নিচ্ছে বলো৷

.

পরদিন সকালে চাটুজ্জে মশায় কেদারকে ডেকে পাঠালেন৷ সেখানে গানের মজলিশ হবে সন্ধ্যায়৷ কেদারকে আসবার জন্যে যথেষ্ট অনুরোধ করলেন তিনি৷ মজলিশে শুধু শ্রোতা হিসাবে উপস্থিত থাকলে চলবে না, কেদারকে গান গাইতে হবে৷

কেদার বললেন, আজ্ঞে, আমি বাজাতে পারি কিছু কিছু বটে—কিন্তু মজলিশে গাইতে সাহস করি নে৷

—খুব ভালো কথা৷ কি বাজান বলুন?

—বেহালা যোগাড় করতে পারেন বাবু?

—বেহালা ওবেলা পাবেন৷ আনিয়ে রাখব৷ সেদিন তো বলেন নি আপনি বেহালা বাজাতে পারেন! আপনি দেখছি সত্যিই গুণী লোক৷ ওবেলা এখানে আহার করতে হবে কিন্তু৷ বাড়িতে মাকে বলে আসবেন৷

—আমার মেয়ে যেখানে সেখানে আমায় খেতে দেয় না, তবে আপনার বাড়িতে সে নিশ্চয়ই কোনো আপত্তি করবে না৷ তাই হবে৷

—আপত্তি ওঠালেও শুনব না তো কেদারবাবু? মার সঙ্গে নিজে গিয়ে ঝগড়া করে আসব৷ আচ্ছা তাঁকে—

—সে কোথাও খায় না৷ তাকে আর বলার দরকার নেই৷

—বিকেলে চাও এখানে খাবেন—

বৈকালে কেদার সবে চাটুজ্জে মশায়ের বাগানবাড়িতে যাবার জন্যে বার হয়েছেন, এমন সময় প্রভাসের গাড়ি এসে ঢুকল ফটকে৷ প্রভাস গাড়ি থেকে নেমে বললে, কাকাবাবু কোথায় যাচ্ছেন?

কেদারের উত্তর শুনে প্রভাস হতাশার সুরে বললে, তাই তো, তা হলে আর দেখছি হল না—

—কি হল না হে?

—শরৎ দিদিকে আজ একবার অরুণের বাড়ি আর আমার বাড়ি নিয়ে যাবার জন্যে এসেছিলাম, ওখান থেকে একেবারে নিউমার্কেট দেখিয়ে—

—চলো একটু কিছু মুখে দিয়ে যাবে—এসো—

শরৎ ছুটে বাইরে এসে বললে, প্রভাসদা! আসুন, আসুন—অরুণবাবু এসেছেন নাকি? বসুন প্রভাসদা, চা খাবেন৷

কেদার বললেন, বড় মুশকিল হয়েছে মা, প্রভাস নিতে এসেছিল, এদিকে আমি যাচ্ছি চাটুজ্জেবাবুদের গানের আসরে৷ না গেলে ভদ্রতা থাকে না—ওবেলা বার বার বলে দিয়েছেন—

প্রভাসও দুঃখ প্রকাশ করলে৷ শরৎ দিদিকে সে নিজের বাড়ি ও অরুণের বাড়ি নিয়ে যাবার জন্যে এসেছিল—কিন্তু কাকাবাবু বেরিয়ে যাচ্ছেন—

শরৎ বললে, বাবা আমি যাই নে কেন প্রভাসদার সঙ্গে? যাব বাবা?

কেদার খুশির স্বরে বললে, তা বরং ভালো বাবা৷ তাই যাও প্রভাস—তুমি শরৎকে নিয়ে যাও—তবে একটু সকাল সকাল পৌঁছে দিয়ে যেয়ো—

প্রভাস বললে, আজ্ঞে, তবে তাই৷ আমি খুব শীগগির দিয়ে যাব৷ সে বিষয়ে ভাববেন না৷

প্রভাসের গাড়ি একটা বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াল৷ প্রভাস নেমে দোর খুলে বললে, আসুন শরৎদি, ভেতরে আসুন৷

শরৎ বললে, এটা কাদের বাড়ি প্রভাসদা?

—এটা? এটা অরুণদেরই বাড়ি ধরুন—তবে অরুণ এখন বোধ হয় বাড়ি নেই—এল বলে৷ শরৎকে নিয়ে গিয়ে প্রভাস একটা সুসজ্জিত ঘরে বসিয়ে ডাক দিলে—ও বৌদি, বৌদি, কে এসেছে দ্যাখো—

শরৎ চেয়ে দেখলে ঘরটার মেজেতে ফরাস বিছানা পাতা, দেওয়ালে বেশির ভাগ বিলিতি মেম-সাহেবের ছবি, একদিকে একটা ছোট তক্তপোশের ওপর একটা গদিপাতা বিছানা—তাতে বালিশ নেই, গোটা দুই ডুগি-তবলা এবং একটা বেলো-খোলা বড় হারমোনিয়াম বিছানার ওপর বসানো৷ একটা খোল-মোড়া তানপুরা, দেয়ালের কোণের খাঁজে হেলান দেওয়ানো৷ খুব বড় একটা কাঁসার পিকদানি তক্তপোশের পায়াটার কাছে৷ একদিকে বড় একটা কাঁচের আলমারি—তার মধ্যে টুকিটাকি শৌখিন কাঁচের ও মাটির জিনিস, গোটাকতক ছোট মতো বোতল, আরও কি কি৷ একটা বড় দেওয়াল-ঘড়ি৷

শরৎ ভাবলে—এদের বাড়িতে গান-বাজনার চর্চা খুব আছে দেখছি৷ বাবাকে এখানে এনে ছেড়ে দিলে বাবার পোয়া বারো—

একটি সুবেশা মেয়ে এই সময় ঘরে ঢুকে হাসিমুখে বললে, এই যে এসো ভাই—তোমার কথা কত শুনেছি প্রভাসবাবু ও অরুণবাবুর কাছে৷ এসো এই খাটের ওপর ভালো হয়ে বোসো ভাই—

মেয়েটিকে দেখে বয়স আন্দাজ করা কিছু কঠিন হল শরতের৷ ত্রিশও হতে পারে, পঁয়ত্রিশও হতে পারে—কম হবে না, বরং বেশিই হবে৷ কিন্তু কি সাজগোজ! মাগো, এই বয়সে অত সাজগোজ কি গিন্নিবান্নি মেয়েমানুষের মানায়? আর অত পান খাওয়ার ঘটা!

পেটো-পাড়া চুলে ফিরিঙ্গি খোঁপা, গায়ে গহনাও মন্দ নেই—বাড়িতে রয়েছে বসে, এদিকে পায়ে আবার চটিজুতো—মখমলের উপর জরির কাজ করা৷ কলকাতার লোকের কাণ্ডকারখানাই আলাদা৷

শরৎ গিয়ে খাটের ওপর বসল বটে ভদ্রতা রক্ষার জন্যে—কিন্তু তার কেমন গা ঘিনঘিন করছিল৷ পরের বিছানায় সে পারতপক্ষে কখনো বসে না—বিছানার কাপড় না ছাড়লে সংসারের কোনো জিনিসে সে হাত দিতে পারবে না—জলটুকু পর্যন্ত মুখে দিতে পারবে না৷ কথায় কথায় বিছানায় বসা আবার কি, কলকাতার লোকের আচার-বিচার বলে কিছু নেই৷

বৌটি তেমনি হাসিমুখে বললে, পান সাজব ভাই? পানে দোক্তা খাও নাকি?

শরৎ মৃদু হেসে জানালে যে সে পান খায় না৷

—পান খাও না—ওমা তাই তো—আচ্ছা দাঁড়াও, ভাজা মশলা আনি—

—না, আপনি ব্যস্ত হবেন না৷ আমার ওসব কিছু লাগবে না৷

প্রভাস বললে, শরৎদি, বৌদি খুব ভালো গান করেন, শুনবেন একখানা?

শরৎ উৎফুল্ল কণ্ঠে বললে, শুনব বৈকি, ভালো গান শোনাই তো হয় না—উনি যদি গান দয়া করে—

বাবার গান ও বাজনা শরৎ শুনছে বাল্যকাল থেকেই, কিন্তু লণ্ঠনের তলাতেই অন্ধকার, বাবার গান-বাজনা তার তেমন ভালো লাগে না৷ এমন কি বাবা ভালো গাইতে পারেন বলেও মনে হয় না শরতের৷ অপরে শুনে বাবার গানের বা বাজনার কেন অত প্রশংসা করে শরৎ তা বুঝতে পারে না৷

মাঝে মাঝে কেদার বলতেন গড়শিবপুরের বাড়িতে—শরৎ শোনো মা এই মালকোষখানা— বেহালার সুরের মূর্ছনায় রাগিণী পর্দায় পর্দায় মূর্তি পরিগ্রহ করত—বাবার ছড় ঘুরানোর কত কায়দা, ঘাড় দুলুনির কত তন্ময় ভঙ্গি—কিন্তু শরৎ মনে মনে ভাবত বাবার এসব কিছুই হয় না৷ এ ভালোই লাগে না, বাবা হয়তো বোঝেন না, লোকে শুনে হাসে…

প্রভাস ওর বৌদিদির দিকে চেয়ে হেসে বললে, শুনিয়ে দাও একটা—

মেয়েটি মৃদু হেসে হারমোনিয়মের কাছে গিয়ে বসল—তার পরে নিজে বাজিয়ে সুকণ্ঠে গান ধরল—

‘‘পাখি এই যে গাহিলি গাছে,

 চুপ দিলি কেন ঝোপে ডুবে গেলি যেমন এসেছি কাছে৷’’

শরৎ মুগ্ধ হয়ে শুনলে, এমন কণ্ঠ এমন সুর জীবনে সে কখনও শোনে নি৷ গড়শিবপুরের জঙ্গলে এমন গান কে কবে গেয়েছে? আহা, রাজলক্ষ্মীটি যদি আজ এখানে থাকত৷ রাজলক্ষ্মী কত দুঃখদিনের সঙ্গিনী, তাকে না শোনাতে পারলে যেন শরতের অর্ধেক আমোদ বৃথা হয়ে যায়৷ সুখের দিনে তার কথা এত করে মনে পড়ে৷

গান থেমে গেলে শরতের মুখ দিয়ে আপনা-আপনি বেরিয়ে গেল—কি চমৎকার!

মেয়েটি ওর দিকে চেয়ে হেসে হেসে কি একটা বলতে যাবে—এমন সময় একটি উনিশ-কুড়ি বছরের মেয়ে দোরের কাছে এসে বললে, আজ এত গানের আসর বসল এত সকালে, কে এসেছে গো তোমাদের বাড়ি? আমি বলি তুমি—

শরতের দিকে চোখ পড়াতে মেয়েটি হঠাৎ থেমে গেল৷ তার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল৷ ঘরে না ঢুকে সে দোরের কাছে রইল দাঁড়িয়ে৷

মেয়েটির পরনে লালরঙের জরিপাড় শাড়ি, খোঁপায় জরির ফিতে জড়ানো, নিঁখুত সাজগোজ, মুখে পাউডার৷ শরৎ ভাবলে, মেয়েটি হয়তো কোথাও নিমন্ত্রণ খেতে যাবে কুটুমবাড়ি, তাই এমন সাজগোজ করেছে৷

প্রভাসের বৌদি বললে, এই যে গানের আসল লোক এসে গিয়েছে৷ কমলা, এঁকে তোমার গান শুনিয়ে দাও তো ভালো—

কমলা বিষণ্ণমুখে বললে, তাই তো, আমার ঘরে যে এদিকে হরিবাবু এসে বসে আছে—আজ আবার দিন বুঝে সকাল সকাল—

প্রভাস ওকে চোখ টিপলে মেয়েটি চুপ করে গেল৷

প্রভাসও বললে, না, তোমার একখানা গান না শুনে আমরা ছাড়ছি নে—এদিকে এসো কমলা—

কমলাও হারমোনিয়ম বাজিয়ে গান ধরলে৷ থিয়েটারি গান ও হালকা সুর—কলকাতার লোক বোধ হয় এইসব গান পছন্দ করে৷ অন্য ধরনের গান তারা তেমন জানে না, কিন্তু গড়শিবপুরে ঠাকুরদেবতা, ইহকাল পরকাল, ভবনদী পার হওয়া, গৌরাঙ্গ ও নদীয়া ইত্যাদি সংক্রান্ত গানের প্রাদুর্ভাব বেশি৷ বাল্যকাল থেকে শরৎ বাবার মুখে, কৃষ্ণযাত্রার আসরে, ফকির-বোষ্টমের মুখে এই সব গান এত শুনে আসছে যে কলকাতায় প্রচলিত এই সব নূতন সুরের নূতন ধরনের গান তার ভারি সুন্দর লাগল৷ জীবনটা যে শুধু শ্মশান নয়, সেখানে আশা আছে, প্রাণ আছে, আনন্দ আছে—এদের গান যেন সেই বাণী বহন করে আনে মনে৷ শুধুই হতাশার সুর বাজে না তাদের মধ্যে৷

শরৎ বললে, বড় চমৎকার গলা আপনার, আর একটা গাইবেন?

বিনা প্রতিবাদে মেয়েটি আর একটা গান ধরলে, গান ধরবার সময় ঘরের মেজেতে বসানো এক জোড়া বাঁয়াতবলার দিকে চেয়ে প্রভাসকে কি বলতে যাচ্ছিল, প্রভাস আবার চোখ টিপে বারণ করলে৷ আগের চেয়েও এবার চড়া সুর, দু-একটা ছোটখাটো তান ওঠালে গলায় মেয়েটি, দ্রুত তালের গান, শিরায় শিরায় যেন রক্ত নেচে ওঠে সুর ও তালের মিলিত আবেদনে৷

গান শেষ হলে প্রভাস বললে, কেমন লাগল শরৎদি?

—ভারি চমৎকার প্রভাসদা, এমন কখনও শুনি নি—

কমলা এতক্ষণ পরে প্রভাসের বৌদিদির দিকে চেয়ে বললে, ইনি কে গা?

প্রভাসের বৌদিদি বললে, ইনি? প্রভাসবাবুদের দেশের—

শরৎ এ কথায় একটু আশ্চর্য হয়ে ভাবলে, প্রভাসদার বৌদিদি তাকে ‘প্রভাসবাবু’ বলছেন কেন, বা যেখানে ‘আমার শ্বশুরবাড়ির দেশের’ বলা উচিত সেখানে ‘প্রভাসবাবুদের দেশের’ই বা বলছেন কেন? বোধ হয় আপন বৌদিদি নন উনি!

কমলা বললে, বেশ, আপনার নাম কি ভাই?

শরৎ সলজ্জ সুরে বললে, শরৎসুন্দরী—

—বেশ নামটি তো৷

প্রভাস বললে, উনি এসেছেন কলকাতা শহর দেখতে৷ এর আগে কখনও আসেন নি—

কমলা আশ্চর্য হয়ে বললে, সত্যি? এর আগে আসেন নি কখনও?

শরৎ হেসে বললে, না৷

—আপনাদের দেশ কেমন?

—বেশ চমৎকার৷ চলুন না একবার আমাদের দেশে—

—যেতে খুব ইচ্ছে করে—নিয়ে চলুন না—

—বেশ তো, আপনি আসুন, উনি আসুন—

মেয়েটি আর একটি গান ধরলে৷ এই মেয়েটির গলার সুরে শরৎ সত্যিই মুগ্ধ হয়ে গেল—সে এমন সুকণ্ঠী গায়িকার গান জীবনে কখনও শোনে নি—প্রভাসের বৌদিদির বয়স হয়েছে, যদিয়ো তাঁর গলা ভালো তবুও এই অল্পবয়সী মেয়েটির নবীন, সুকুমার, কণ্ঠস্বরের তুলনায় অনেক খারাপ৷ শরতের ইচ্ছে হল, কমলার সঙ্গে ভালো করে আলাপ করে৷

গান শেষ করে কমলা বললে, আসুন না ভাই, আমাদের ঘরে যাবেন?

—চলুন না দেখে আসি—

প্রভাস তাড়াতাড়ি বলে উঠল—না, উনি এখনই চলে যাবেন, বেশিক্ষণ থাকবেন না—এখন থাকগে—

কিন্তু শরৎ তবুও বললে, আসি না দেখে প্রভাসদা? এখুনি আসছি—

প্রভাস বিব্রত হয়ে পড়ল যেন৷ সে জোর করে কিছু বলতেও পারে না অথচ কমলার সঙ্গে শরৎ যায় এ যেন তার ইচ্ছে নয়৷ এই সময় হঠাৎ একটা লোক ঘরে ঢুকে অস্পষ্ট ও জড়িত স্বরে বলে উঠল—আরে এই যে, কমল বিবি এখানে বসে, আমি সব ঘর ঢুঁড়ে বেড়াচ্ছি বাবা—বলি প্রভাসবাবুও যে আজ এত সকালে—

প্রভাস হঠাৎ বিবর্ণ হয়ে উঠে তাকে কি একটা বলে তাড়াতাড়ি বাইরে নিয়ে গেল৷ লোকটার ভাবভঙ্গি দেখে শরৎ আশ্চর্য হয়ে ভাবলে—লোকটা পাগল নাকি? অমন কেন?

সে প্রভাসের বৌদিদিকে বললে, উনি কে?

—উনি—এই হল গে—আমাদের বাড়ির—বাইরের ঘরে থাকেন—

—কমলার সম্পর্কে কে?

—সম্পর্কে—এই ঠাকুরপো—

কমলার ঠাকুরপো কি রকম শরৎ ভালো বুঝল না৷ লোকটির বয়স চল্লিশের কম নয়—তা হলে কমলার দোজবরে কি তেজবরে স্বামীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছে নাকি? না হলে অত বড় ঠাকুরপো হয় কি করে? কমলার ওপর কেমন একটু করুণা হল শরতের৷ আহা, এমন মেয়েটি! কমলাও একটু অবাক হয়ে প্রভাসের বৌদিদির দিকে চাইলে৷ সে যেন অনেক কিছুই বুঝতে পারছে না৷

শরৎ জিজ্ঞেস করলে, আপনি প্রভাসদার কে হন?

কমলা কিছু বলবার আগে প্রভাসের বৌদিদি উত্তর দিলে, ও আমার পিসতুতো বোন হয়৷ এখানে থেকে পড়ে৷

হঠাৎ শরৎ কমলার সিঁথির দিকে চাইলে৷ সত্যই তো, ওর এখনও বিয়ে হয় নি৷ এতক্ষণ সে লক্ষ করে নি৷ তবে আবার ওর ঠাকুরপো কি রকম হল! শরতের বড় ইচ্ছে হচ্ছিল এসব গোলমেলে সম্পর্কের একটা মীমাংসা সে করে ফেলে—এদের প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে৷ কিন্তু দরকার কি পরের বাড়ির খুঁটিনাটি কথা জিজ্ঞেস করে?

একটু পরে প্রভাস বাইরে থেকে ডাকলে, কমলা, তোমায় ডাকছেন—শুনে যাও—

কমলা চলে যাবার আগে হাত তুলে ছোট্ট একটা নমস্কার করে শরৎকে বললে, আচ্ছা, আসি ভাই—

—কেন, আপনি আর আসবেন না?

—কি জানি, যদি কোনো কাজ পড়ে—

—কাজ সেরে আসবেন—যাবার আগে দেখা করেই যাবেন—

—আপনি কতক্ষণ আছেন আর?

প্রভাসের বৌদি বললেন, উনি এখনও ঘণ্টাখানেক থাকবেন—

কমলা বললে, যদি পারি আসব তার মধ্যে—

ও চলে গেলে শরৎ প্রভাসের বৌদিদির দিকে চেয়ে বললে, বেশ মেয়েটি—

—কমলা তো? হ্যাঁ, ওকে সবাই পছন্দ করে—

—বড় চমৎকার গলা—

—গানের মাস্টার এসে গান শিখিয়ে যায় যে! এখন বোধ হয় সেই জন্যেই উঠে গেল৷ আপনি বসুন চায়ের দেখি কি হল—

শরৎ ব্যস্ত হয়ে বললে, না না, আপনি যাবেন না৷ আমি চা খেয়ে বেরিয়েছি—

—বেরুলেন বা! তা কখনও হয়? একটু মিষ্টিমুখ—

—না না—আমি এসময় কিছুই খাই নে—

—বসুন, আমি আসছি৷

—বসছি কিন্তু খাওয়ার যোগাড় কিছু করবেন না যেন৷ আমি সত্যিই কিছু খাব না৷

প্রভাস বললে, থাক বরং বৌদি, উনি এসময় কিছু খান না৷ ব্যস্ত হতে হবে না৷

এই সময় অরুণ ও গিরীন বলে সেই লোকটা ঘরে ঢুকল৷ শরৎ হাসিমুখে বললে, এই যে অরুণবাবু আসুন—

—দেখুন মাথায় টনক আছে আমার৷ কি করে জানলুম বলুন আপনি এখানে এসেছেন—

গিরীন প্রভাসকে বাইরে ডেকে নিয়ে বললে, কি ব্যাপার?

প্রভাস বিরক্ত মুখে বললে, আরে, ওই হরি সা না কি ওর নাম, সব মাটি করে দিয়েছিল আর একটু হলে—এমন বেফাঁস কথা হঠাৎ বলে ফেললে—আমি বাইরে নিয়ে গিয়ে ধমকে দিলাম আচ্ছা করে৷ ভাগ্যিস পাড়াগাঁয়ের মেয়ে, কিছু বোঝে না তাই বাঁচোয়া৷ কমলা বিবি আবার ঘর দেখাতে নিয়ে যাচ্ছিল ওর, কত কষ্টে থামাই৷ দেখলেই সব বুঝে না ফেলুক, সন্দেহ করত৷

—তার পর?

—তার পর তোমরা তো এসেছ, এখন পথ বাৎলাও—

—লেমনেড খাওয়াতে পারবে না?

—চা পর্যন্ত খেতে চাইছে না—তা লেমনেড!

—ও এখানে থাকুক—চলো আমরা সব এখান থেকে সরে পড়ি৷

—মতলবটা বুঝলাম না৷

—এখানে দু-দিন লুকিয়ে রাখ৷ তার পর ওর বাবা ওকে আর নেবে না—ওর গ্রামে রটিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে দাও যে কোথায় ওকে পাওয়া গিয়েছে৷ পাড়াগাঁয়ের লোক, সমাজের ভয়ে ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না৷

—তাই করো—কিন্তু মেয়েটিকে তুমি জানো না৷ যত পাড়াগেঁয়ে ভীতু মেয়ে ভাবছ, অতটা নয় ও৷ বেশ তেজি আর একগুঁয়ে মেয়ে৷ তোমার যা মতলব, ও কতদূর গড়াবে আমি বুঝতে পারছি নে৷ চেষ্টা করে দেখতে পার৷

—তুমি আমার হাতে ছেড়ে দাও, দেখ আমি কি করি—টাকা কম খরচ করা হয় নি এজন্যে—মনে নেই?

—হেনাকে ডাকো একবার বাইরে৷ হেনার সঙ্গে পরামর্শ করো৷ তাকে সব বলা আছে, সে একটা পথ খুঁজে বার করবেই৷ কমলাকেও বোলো৷

ওর বৌদিদি শরৎকে পাশের ঘরের সাজসজ্জা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল ইতিমধ্যে৷ একটা খুব বড় ড্রেসিং টেবিল দেখে শরৎ খুশি হয়ে বললে, বেশ জিনিসটা তো? আয়নাখানা বড় চমৎকার, এর দাম কত ভাই?

—একশো পঁচিশ টাকা—

—আর এই খাটখানা?

—ও বোধ হয় পড়েছিল সত্তর টাকা—আমার ধীরেনবাবু—মানে আমার গিয়ে বাপের বাড়ির সম্পর্কে ভাই—সেই দিয়েছিল৷

—বিয়ের সময় দিয়েছিলেন বুঝি? এ সবই তা হলে আপনার বিয়ের সময় বরের যৌতুক হিসেবে—

—হ্যাঁ তাই তো৷

—আপনার স্বামী এখনো বাড়ি আসেন নি, আফিসে কাজ করেন বুঝি?

—হ্যাঁ৷

—আপনার শাশুড়ি বা আর সব—ওঁদের সঙ্গে আলাপ হল না৷

—এ বাড়িতে আর কেউ থাকেন না৷ এ শুধু মানে আমাদের—উনি আর আমি—

—আলাদা বাসা করেছেন বুঝি? তা বেশ৷

—হ্যাঁ, আলাদা বাসা৷ আফিস কাছে হয় কিনা৷ এ অনেক সুবিধে৷

—তা তো বটেই৷

—আপনি এইবার কিছু মুখে না দিলেই সত্যিই ভয়ানক দুঃখিত হব ভাই৷

বারবার খাওয়ার কথা বলাতে শরৎ মনে মনে বিরক্ত হল৷ সে যখন বলছে খাবে না, তখন তাকে পীড়াপীড়ি করার দরকার কি এদের? সে যে বিধবা মানুষ, তা এরা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে, বিধবা মানুষ সব জায়গায় সব সময় খায় না—বিশেষ করে সে পল্লীগ্রামের ব্রাহ্মণের ঘরের বিধবা, তার অনেক কিছু বাছবিচার থাকতে পারে, সে জ্ঞান দেখা যাচ্ছে কলকাতার লোকের একেবারেই নেই৷

শরৎ এবার একটু দৃঢ়স্বরে বললে, না, আমি এখন কিছু খাব না, কিছু মনে করবেন না আপনি৷

প্রভাসের বৌদিদি আর কিছু বললে না এ বিষয়ে৷ শরৎ ভাবলে, এদের সঙ্গে ব্যবহারে হয়তো সে ভদ্রতা বজায় রেখে চলতে পারবে না, কিন্তু কি করবে সে, কেন এ নিয়ে পীড়াপীড়ি করা? খাবে না বলেছে, ব্যস মিটে গেল—ওদের বোঝা উচিত ছিল৷

—আরও দু-পাঁচ মিনিট শরৎকে এ ছবি, ও আলমারি দেখানোর পরে প্রভাসের বৌদিদি ওর দিকে চেয়ে বললে, ভালো, একটা অনুরোধ রাখো না কেন—আজ এখানে থেকে যাও রাতটা৷

শরৎ আশ্চর্য হয়ে বললে, এখানে? কি করে থাকব?

—কেন, এই আলাদা ঘর রয়েছে৷ উনি বোধ হয় আজ আর আসবেন না৷ এক-একদিন রাত্রে কাজ পড়ে কিনা৷ সারারাত আসতে পারেন না৷ একলা থাকতে হবে, তার চেয়ে তুমি থাকো ভাই, দুজনে বেশ গল্পে-গুজবে রাত কাটিয়ে দেব, তোমাকে আমার বড় ভালো লেগেছে৷

কথা শেষ করে প্রভাসের বৌদিদি শরতের হাত ধরে আবদারের সুরে বললে, কথা রাখো ভাই, কেমন তো? তা হলে প্রভাসবাবুকে—ইয়ে ঠাকুরপোকে বলে দিই আজ গাড়ি নিয়ে চলে যাক—তাই করি, বলি ঠাকুরপোকে?

শরৎ বিষণ্ণ মনে বলে উঠল—না না, তা কি করে হবে? আমি থাকতে পারব না৷ বাবার পাশের বাড়িতে চাটুজ্জে মহাশয়ের ওখানে আজ রাত্রে নেমন্তন্ন আছে, তাই রান্না নেই, এতক্ষণ আছি সেই জন্যে৷ নইলে কি এখনও থাকতে পারতাম! বাবা একলাটি থাকবেন, তা কখনো হয়? তা ছাড়া তিনি ব্যস্ত হয়ে উঠবেন যে! আমি তো আর বলে আসি নি যে কারো বাড়ি থাকব, ফিরব না৷ আর সে এমনিই হয় না৷ আপনার স্বামী যদি এসেই পড়েন হঠাৎ—

প্রভাসের বৌদিদি বললে, এসে পড়লে কিছুই নয়৷ তিনটে ঘর রয়েছে এখানে, তোমাকে ভাই এই ঘরে আলাদা বিছানা করে দেব, কোনো অসুবিধে হবে না—থাকো ভাই, প্রভাসকে বলি গাড়ি নিয়ে চলে যাবার জন্যে৷ বোসো তুমি এখানে—

—না, সে হয় না! বাবাকে কিছু বলা হয় নি, তিনি ভীষণ ভাববেন—

—প্রভাস কেন গাড়িতে করে গিয়ে বাবার কাছে খবর দিয়ে আসুক না যে তুমি আমাদের এখানে থাকবে—তা হলেই তো সব চেয়ে ভালো হয়—তাই বলি—এই বেশ সব দিক দিয়ে সুবিধা হল—তোমার পায়ে পড়ি ভাই, এতে অমত করো না৷

শরৎ পড়ে গেল বিপদে৷ একদিকে তার অনুপস্থিতিতে তার বাবার সুবিধে অসুবিধের ব্যাপার, অন্যদিকে প্রভাসের বৌদিদির এই সনির্বন্ধ অনুরোধ—কোন দিকে সে যায়? অবিশ্যি একটা রাত এখানে কাটানো আর তেমন কি, সম্ভবতঃ ওর স্বামী আজ আফিসের কাজের চাপে বাড়ি ফিরতে পারবেন না বলেই ওকে সঙ্গে রাখবার জন্যে ব্যস্ত হয়েছে—শোয়ারও অসুবিধে কিছু নেই, থাকলেই হল—কিন্তু একটা বড় কথা এই যে, সে বাড়ি না ফিরলে বাবা কি ভাবনাতেই পড়ে যাবেন! তবে বাবাকে যদি প্রভাসদা এখুনি খবর দিয়ে দেন—সে আলাদা কথা৷

সে সাতপাঁচ ভেবে কি একটা বলতে যাচ্ছিল, এমন সময়ে কমলা এসে ঘরে ঢুকে বললে, বা রে, এখানে সব যে, আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি—

প্রভাসের বৌদিদি উৎফুল্ল হয়ে উঠে বললে, বেশ সময়ে এসে পড়েছ কমলা—আমি ওকে বোঝাচ্ছি ভাই যে আজ রাতটা এখানে থেকে যেতে৷ উনি আজ আফিস থেকে আসবেন না, জানোই তো—দুজনে বেশ একসঙ্গে গল্পগুজবে—কি বলো?

প্রভাস এবং তার দলবল একটু আগে বাইরে কমলার সঙ্গে কি কথা বলেছে৷ এই জন্যই তার এখানে আসা, যতদূর মনে হয়৷

সে বললে, আমিও তাই বলি ভাই, বেশ সবাই মিলেমিশে একটা রাত আপনাকে নিয়ে আমোদ করা গেল—

প্রভাসের বৌদিদি বললে, আর বড্ড ভালো লেগেছে তোমাকে তাই বলছি৷ কি বলো কমলা?

—তা আর বলতে! আমি তো ভাবছি একটা কিছু সম্বন্ধ পাতাব—

এই মেয়েটিকে সত্যিই শরতের খুব ভালো লেগেছিল—বয়সে এ তার সঙ্গিনী রাজলক্ষ্মীর চেয়ে কিছু বড় হবে, দেখতে শুনতে রূপসী মেয়ে বটে৷ সকলের ওপরে ওর গান গাইবার গলা…অনেক জায়গায় গান শুনেছে শরৎ—কিন্তু এমন গলার স্বর—

শরৎ আগ্রহের সঙ্গে বলে উঠল, বেশ, সম্বন্ধ পাতাও না ভাই—আমি ভারি সুখী হব—

—কি সম্বন্ধ পাতাবেন বলুন?

—আপনি বলুন—

প্রভাসের বৌদিদি বললে, গঙ্গাজল! পছন্দ হয়?

কমলা উৎসাহের সুরে ঘাড় নেড়ে বললে, বেশ পছন্দ হয়৷ আপনারও হয়েছে তো?…তবে তাই—কিন্তু আজ রাত্রে—

শরৎ আপনমনেই বলে গেল—তোমাকে ভাই আমাদের দেশে নিয়ে যাব, যাবে তো? তোমার বয়সী একটি মেয়ে আছে রাজলক্ষ্মী, বেশ মেয়ে৷ আলাপ করিয়ে দেব৷ আমাদের বাড়ি গিয়ে থাকবে৷ তবে হয়তো অত অজ-পাড়াগাঁ তোমার ভালো লাগবে না—

—কেন লাগবে না, খুব লাগবে—আপনাদের বাড়ি থাকব—

—জানো না তাই বলছ৷ আমাদের বাড়ি তো গাঁয়ের মধ্যে নয়—গাঁয়ের বাইরে জঙ্গলের মধ্যে—

কমলা আগ্রহের সুরে বললে, কেন, জঙ্গলের মধ্যে কেন?

—আগে বড় বাড়ি ছিল, এখন ভেঙে-চুরে জঙ্গল হয়ে পড়েছে, যেমনটি হয়—

—বাঘ আছে সেখানে?

শরৎ হেসে বললে, সব আছে, বাঘ আছে, সাপ আছে, ভূতও আছে—

কমলা ও প্রভাসের বৌদিদি একসঙ্গে বলে উঠল—ভূত! আপনি দেখেছেন?

—না, কখনো দেখি নি, ওসব মিথ্যে কথা৷ কিংবা চলো তোমরা একদিন, ভূত দেখতে পাবে৷

প্রভাসের বৌদিদি বললে, আচ্ছা, সে জঙ্গলে না থেকে কলকাতায় এসে থাকো না কেন ভাই! এখানে কত আমোদ-আহ্লাদ—তুমি এখানে থাকলে কত মজা করব আমরা—তোমাকে নিয়ে মাসে মাসে আমরা থিয়েটারে যাব, বায়োস্কোপে যাব—খাব দাব—কত আমোদ ফুর্তি করা যাবে! গঙ্গার ইস্টিমারে বেড়াতে যাব, যাও নি কখনো বোধ হয়? চমৎকার বাগান আছে ওই শিবপুরের দিকে, সেখানে কত গাছপালা—

শরতের হাসি পেল৷ গাছপালা দেখতে ইস্টিমারে চেপে গঙ্গা বেয়ে কোথায় যেন যেতে হবে কতদূর কলকাতায় এসে—তবে সে গাছপালা দেখতে পাবে! হায় রে গড়শিবপুরের জঙ্গল—এরা তোমাকে দেখে নি কখনো তাই এমন বলছে৷ সেখানে গাছ দেখতে রেলেও যেতে হয় না, ইস্টিমারেও যেতে হয় না—ঘুম ভেঙে উঠে চোখ মুছে জানালা দিয়ে চাইলেই দেখতে পাবে জঙ্গলের ঠ্যালা৷

কমলাও বললে, তাই করুন—কলকাতায় চলে আসুন, কেমন থাকা যাবে—

প্রভাসের বৌদিদি বললে, এই আমাদের বাড়িতেই থাকবে ভাই! মানে—আমাদের বাড়ির কাছেও বাসা করে দেওয়া যাবে এখন৷ এমনি সাজিয়েগুছিয়ে বেশ চমৎকার করে দেওয়া যাবে৷ কি ভাই সেখানে পড়ে আছ জঙ্গলে, কলকাতায় এসে বাস করে দেখো ভাই, আমোদ ফুর্তি কাকে বলে বুঝতে পারবে৷ আমাদের সঙ্গে থাকবে, একসঙ্গে বেড়াব, দেখব শুনব, সে কি রকম মজা হবে বলো দিকি ভাই? তোমার মতো মানুষ পেলে তো—

কমলাও উৎসাহের সুরে বললে, আপনাকে পেয়ে আর ছাড়তে ইচ্ছে করছে না বলেই তো—

শরতের খুব ভালো লাগছিল ওদের সঙ্গ৷ এমন মন-খোলা, আমুদে, তরুণী মেয়েদের সঙ্গ পাড়াগাঁয়ে মেলে না, এক আছে রাজলক্ষ্মী, কিন্তু সেও এদের মতো নয়—এদের যেমন সুশ্রী চেহারা, তেমনি গলার সুর, এদের সঙ্গে একত্রে বাস করা একটা ভাগ্যের কথা৷ কিন্তু ওরা যে বলছে, তা সম্ভব হবে কি করে? এরা আসল ব্যাপারটা বোঝে না কেন?

সে বললে, ভালো তো আমারও লেগেছে আপনাদের৷ কিন্তু বুঝছেন না, কলকাতায় বাবা থাকবেন কি করে? তেমন অবস্থা নয় তো তাঁর? এই হল আসল কথা৷

প্রভাসের বৌদিদি হেসে বললে, এই! এজন্যে কোনো ভাবনা নেই তোমার ভাই৷ এখন দিনকতক আমাদের বাসাতে থাকো না—তার পর বাসা একটা দেখেশুনে নিলেই হবে এখন৷ আর তোমার বাবা? উনি যে অফিসে কাজ করেন, সেখানে একটা কাজটাজ—

 —সে কাজ বাবা করতে পারেন না৷ ইংরিজি জানেন না—উনি জানেন গান-বাজনা৷ বেশ ভালো বেহালা বাজাতে পারেন—

প্রভাসের বৌদিদি কথাটা যেন লুফে নিয়ে বলল, বেশ, বেশ—তবে তো আরও ভালো৷ নরেশবাবু থিয়েটারেই তো কাজ করেন—তিনি ইচ্ছে করলে—’

শরৎ বললে, নরেশবাবু কে?

—নরেশবাবু!—এই গিয়ে—ওঁর একজন বন্ধু, আমাদের বাসায় প্রায়ই আসেন-টাসেন কিনা৷

শরৎ একটুখানি কি ভেবে বললে, কিন্তু বাবা কি গাঁ ছেড়ে থাকতে পারবেন? আমার শহর দেখা শেষ হয় নি বলে তিনি এখনও বাড়ি যাবার পেড়াপীড়ি করছেন না—নইলে এতদিন উদ্ব্যস্ত করে তুলতেন না আমাকে! নিতান্ত চক্ষুলজ্জায় পড়ে কিছু বলতে পারছেন না, তিনি টিকবেন শহরে, তবেই হয়েছে!

প্রভাসের বৌদিদি বললে, আচ্ছা, এক কাজ করো না কেন?

—কি?

—তুমিই কেন থাকো না এখন দিনকতক? এই আমাদের সঙ্গেই থাকো৷ তোমার বাবা ফিরে যান দেশে, এর পরে এসে তোমাকে নিয়ে যাবেন৷ আমাদের বাড়িতে আমাদের বন্ধু হয়ে থাকবে, টাকাকড়ির কোনো ব্যাপার নেই এর মধ্যে—তোমায় মাথায় করে রেখে দেব ভাই৷ বড্ড ভালো লেগেছে তোমাকে, তাই বলছি৷ কি বলিস কমলা? তুই কথা বলছিস নে যে—বল না তোর গঙ্গাজলকে!

কমলা বললে, হ্যাঁ, সে তো বলছিই—

প্রভাসের বৌদিদি বললে, সে-সব গেল ভবিষ্যতের কথা৷ আপাততঃ আজ রাত্রে তুমি এখানে থাকো৷ প্রভাস গিয়ে খবর দিয়ে আসুক তোমার বাবাকে৷ রাজি?

শরৎ দ্বিধার সঙ্গে বললে, আজ?—তা—না ভাই আজ বরং আমায় ছেড়ে দাও—কাল বাবাকে বলে—

—তাতে কি ভাই! প্রভাস ঠাকুরপো গিয়ে এখুনি বলে আসছে৷ যাবে আর আসবে—ডাকি প্রভাসবাবুকে—তুমি আর অমত কোরো না৷ বসো আমি আসছি—তুমি থাকলে কমলাকে দিয়ে সারারাত গান গাওয়াব৷

শরৎ এমন বিপদে কখনো পড়ে নি৷

কি সে করে এখন? এদের অনুরোধ এড়িয়ে চলে যাওয়াও অভদ্রতা—যখন এতটাই পীড়াপীড়ি করছে তার থাকার জন্যে, থাকলে মজাও হয় বেশ—কমলার গান শুনতে পাওয়া যায়৷

কিন্তু অন্যদিকে বাবাকে বলে আসা হয় নি, বাবা কি মনে করতে পারেন৷ তবে প্রভাসদা যদি মোটরে করে গিয়ে বলে আসে, তবে অবিশ্যি বাবার ভাববার কারণ ঘটবে না৷ তবুও কি তার নিজের মন তাতে শান্তি পাবে? কোথায় বাগানের মধ্যে নির্জন বাড়ি, সেখানে একলাটি পড়ে থাকবেন বাবা, রাত্রে যদি কিছু দরকার পড়ে তখন কাকে ডাকবেন, কে তাঁকে দেখে?

সে ইতস্তত করে বললে, না ভাই, আমার থাকবার জো নেই—আজ ছেড়ে দাও, বাবাকে বলে কাল আসব৷

হঠাৎ প্রভাসের বৌদিদি উঠে হাত বাড়িয়ে দরজা আগলে দাঁড়িয়ে বললে, যাও দিকি কেমন করে যাবে ভাই! কক্ষণও যেতে দেব না—কই, যাও তো কেমন করে যাবে? এমন আমোদটা আমাদের মাটি করে দিয়ে গেলেই হল!

শরৎ তার কাণ্ড দেখে হেসে ফেললে৷

এমন সময় বাইরে থেকে প্রভাসের গলা শুনতে পাওয়া গেল—ও বৌদিদি—

প্রভাসের বৌদিদি বললে, দাঁড়াও ভাই আসছি—ঠাকুরপো ডাকছে—বোধ হয় চা চান, বন্ধু-বান্ধব এসেছে কিনা? ঘন ঘন চা—

সে বাইরে যেতেই প্রভাস তাকে বারান্দার ও-প্রান্তে নিয়ে গিয়ে বললে, কি হল?

তার সঙ্গে অরুণ ও গিরীনও ছিল৷ গিরীন ব্যস্তভাবে বললে, কতদূর কি করলে হেনা?

—বাবাঃ—সোজা একগুঁয়ে মেয়ে! কেবল বাবা আর বাবা! এত বোঝাচ্ছি, এত কাণ্ড করছি এখনও মাথা হেলায় নি—কমলা আবার ঢোঁক মেরে চুপ করে রয়েছে৷ আমি একা বকে বকে মুখে বোধ হয় ফেনা তুলে ফেললাম৷ ধন্যি মেয়ে যা হোক৷ যদি পারি, আমায় একশো কিন্তু পুরিয়ে দিতে হবে! কমলা কিছুই করছে না—ওর টাকা—

গিরীন বিরক্তির সুরে বললে, আরে দূর, টাকা আর টাকা! কাজ উদ্ধার করো আগে—একটা পাড়াগেঁয়ে মেয়েকে সন্দে থেকে ভুলোতে পারলে না—তোমরা আবার বুদ্ধিমান, তোমরা আবার শহুরে—

প্রভাসের বৌদিদি মুখনাড়া দিয়ে বলে উঠল—বেশ, তুমি তো বুদ্ধিমান, যাও না, ভজাও গে না, কত মুরোদ! তেমন মেয়ে নয় ও—আমি ওকে চিনেছি৷ মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেছি, আমরা চিনি মেয়েমানুষ কে কি রকম! ও একেবারে বনবিছুটি—তবে পাড়াগাঁ থেকে এসেছে, আর কখনো কিছু দেখে নি—তাই এখনও কিছু সন্দেহ করে নি, নইলে ওকে কি যেমন তেমন মেয়ে পেয়েছ?

প্রভাস বিরক্ত হয়ে বললে, যাক, আর এক কথা বার বার বলে কি হবে? সোজা কাজ হলে তোমাকেই বা আমরা টাকা দিতে যাব কেন হেনা বিবি, সেটাও তো ভাবতে হয়—

হেনা বললে, এবার যেন একটু নিমরাজি গোছের হয়েছে—দেখি—

হেনা ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল এবং মিনিট পাঁচেক পরেই হাসিমুখে বার হয়ে এসে বললে, কই ফেল তো দেখি টাকা!

ওরা সবাই ব্যস্ত ও উৎসুক ভাবে বলে উঠল—কি হল? রাজি হয়েছে?

হেনা হাসিমুখে ঘাড় দুলিয়ে বাহাদুরির সুরে বললে, এ কি যার-তার কাজ? এই হেনা বিবি ছিল তাই হল৷ দেখি টাকা? আমি যাকে বলে—সেই যাই পাতায় পাতায় বেড়াই—তাই—

গিরীন বিরক্তির সুরে বললে, আঃ, কি হল তাই বলো না? গেলে আর এলে তো?

—আমি গিয়েই বললাম, ভাই, প্রভাস ঠাকুরপোকে বলে এলাম তোমার বাবাকে খবর দিতে৷ সে গাড়ি নিয়ে এখুনি যাচ্ছে বললে৷ আমি জোর করে কথাটা বলতেই আর কোনো কথা বলতে পারলে না৷ কেবল বললে, প্রভাসদা যাবার আগে আমার সঙ্গে যেন দেখা করে যায়—বাবাকে কি বলতে হবে বলে দেব—কমলা কিন্তু কিছু করছে না, মুখ বুজে গিন্নি-শকুনির মতো বসে আছে!

গিরীন বললে, না প্রভাস, তুমি এখান থেকে সরে পড়ো, হেনা গিয়ে বলুক তুমি চলে গিয়েছ—তুমি এসময় সামনে গেলে একথাও বলতে পারে যে আমিও ওই গাড়িতে বাবার কাছে গিয়ে নিজেই বলে আসি৷ তা ছাড়া তোমার চোখমুখ দেখে সন্দেহ করতে পারে—হেনার মতো তুমি পারবে না—ও হল অ্যাকট্রেস, ও যা পারবে, তা তুমি আমি পারতে—

হেনা বললে, বঙ্গরস থিয়াটারে আজ পাঁচটি বছর কেটে গেল কি মিথ্যে মিথ্যে? ম্যানেজার সেদিন বলেছে, হেনা বিবি, তোমাকে এবার ভাবছি সীতার পার্ট দেব—সেদিন আমার রানীর পার্ট দেখে—ও কি ওই কমলির কাজ? অনেক তোড়জোড় চাই—

গিরীন বললে, যাক ও সব কথা, কে কোথা দিয়ে শুনে ফেলবে! এত পরিশ্রম সব মাটি হবে! খসে পড়ো প্রভাস—তোমাকে আর না দেখতে পায়—মন আবার ঘুরে যেতে কতক্ষণ, যদি বলে বসে—না, আমি প্রভাসদার মোটরে বাবার কাছে যাব! আর কে যাচ্ছে এখন এত রাত্রে সেই পাগলা বুড়োটার কাছে?

প্রভাস ইতস্তত করে বললে, তবে আমি যাই?

—যাও—তোমায় আর না দেখতে পায়—পায়ের বেশি শব্দ করো না৷

—তোমরা? তোমাদেরও এখানে থাকা উচিত হবে না, তা বুঝছ?

—আমরা যাচ্ছি৷ তুমি আগে যাও—কারণ তুমি চলে গেলে ওর হাতের তীর ছাড়া হয়ে যাবে, আর তো ও মত বদলাতে পারবে না?

হেনা বললে, আজ রাত্তিরটা কোনো রকম বেতাল না দেখে ও৷ তোমরা ওই হরি সা লোকটাকে আগলে রাখো—

অরুণ বললে, কোথায় সে?

প্রভাস বললে, আমি তাকে কমলির ঘরে বসিয়ে রেখে এসেছি৷ কিন্তু এখন যা আছে, আর দু-ঘণ্টা পরে তো থাকবে না৷ ওকে চেনো তো? চীনেবাজারের অত বড় দোকানটা ফেল করেছে এই করে৷ বোকা তাই রক্ষে! ওকে সরিয়ে দাও বাবা, আজ রাত্তিরের মতো—

গিরীন বললে, যাও না তুমি? কেন দাঁড়িয়ে বকবক করছ?

প্রভাস চলে যেতে উদ্যত হলে গিরীন তাকে বললে, কোথায় থাকবে?

—আজ বাড়ি চলে যাই—বাবা সন্দেহ করবেন, বেশি রাত্তিরে বাড়ি ফিরলে—

—ভালো কথা, তোমার বাবার সঙ্গে তো ওর বাবার খুব আলাপ, সেখানে গিয়ে সন্ধান নেবে না তো বুড়ো?

প্রভাস হেসে বুড়ো আঙুল নেড়ে বললে—হুঁ হুঁ বাবা—সে গুড়ে বালি! অত কাঁচা ছেলে আমি নই৷ বাবা তো বাবা, বাড়ির কেউই ঘুণাক্ষরেও কিছু জানে না৷ বাবাও কেদারকে ভুলে গিয়েছেন, দুজনের দেখাশুনো নেই কতকাল৷ দেখলে কেউ হঠাৎ হয়তো চিনতে পারবে না৷ তার ওপর আমাদের বাড়ি কেদার বুড়ো জানবে কি করে? ঠিকানা জানে না, নম্বর জানে না—কোনোদিন শোনেও নি৷ আর এ কলকাতা শহর, বুড়ো না চেনে বাড়ি না চেনে রাস্তাঘাট৷ সেদিকে ঠিক আছে৷

প্রভাস সিঁড়ি দিয়ে নেমে নিচে গেল৷

অরুণ একটু দ্বিধার সুরে বললে, কাজটা তো এক রকম যা হয় এগুলো—শেষে পুলিসের কোনো হাঙ্গামায় পড়বো না তো?

—কিসের পুলিসের হাঙ্গামা? নাবালিকা তো নয়, ছাব্বিশ-সাতাশ বছরের ধাড়ি—আমরা প্রমাণ করব ও নিজের ইচ্ছেয় এসেছে৷ ওকে এ জায়গায় কেন পাওয়া গেল—এ কথার কি জবাব দেবে ও? আমি বুঝি নি বললে কেউ বিশ্বাস করবে? নেকু!

—তা ধরো ও পাড়াগাঁয়ের মেয়ে, সত্যিই ওর বয়েস হয়েছে বটে, কিন্তু এসব কিছু জানে না, বোঝে না৷ দেখতেই তো পেলে—একটু সন্দেহ জাগলে ওকে রাখতে পারত হেনা? তা জাগে নি৷ এমন জায়গাও কখনো দেখে নি, জানে না৷ যদি এই সব কথা প্রমাণ হয় আদালতে?

গিরীন আত্মম্ভরিতার সুরে বললে, শুধু দেখে যাও আমি কি করি! কুণ্ডুকে তোমরা সোজা লোক ঠাউরো না—

অরুণ বললে, আর একটা কথা, সে না হয় বুঝলাম—কিন্তু ওসব ঘরের মেয়ে, যখন সব বুঝে ফেলবে, তখন আত্মহত্যা করে বসে যদি? ওরা তা পারে৷

গিরীন তাচ্ছিল্যের সুরে বললে, হ্যাঁ—রেখে দাও ওসব! মরে সবাই—দেখা যাবে পরে—

—আজ চলো আমরা এখান থেকে যাই—

—এখন?

—আমার মনে হয় তাই উচিত৷ কোনো সন্দেহ না জাগে মনে—এটা যেন মনে থাকে৷

হেনাকে সন্তর্পণে বাইরে আনিয়ে গিরীন বললে, আমরা চলে যাচ্ছি হেনা বিবি৷ রেখে গেলাম কিন্তু—

হেনা বললে, আমি বাবু পুলিসের হ্যাঙ্গামে যেতে পারব না, তা বলে দিচ্ছি৷ কাল দুপুর পর্যন্ত ওকে এখানে রাখা চলবে৷ তারপর তোমরা কোথায় নিয়ে যাবে যেয়ো—আমার টাকা চুকিয়ে দিয়ে৷

গিরীন বললে, কেন, আবার নতুন কথা বলছ কেন? কি শিখিয়ে দিয়েছিলাম?

—সে বাপু হবে না৷ ও বেজায় একগুঁয়ে মেয়ে৷ আগে যা ভেবেছিলাম তা নয়—ও শুধু বুঝতে পারে নি তাই এখানে রয়ে গেল৷ নইলে রসাতল বাধাত এতক্ষণ৷ আর একটা কথা কি, কিছুতেই খাচ্ছে না, এত করে বলছি, নানারকম ছুঁতো করছে, পাড়াগাঁয়ের বিধবা মানুষ, ছুঁচিবাই গো, ছুঁচিবাই৷ কেন খাচ্ছে না আমি আর ওসব বুঝি নে? আমি মানুষ চরিয়ে খাই—

অরুণ বললে, মানুষ চরাও নি কখনো হেনা বিবি, ভেড়া চরিয়েছ৷ এবার মানুষ পেয়েছ, চরাও না দেখি৷ বুঝলে?

ওরা দুজনে নীচে নেমে গেল৷

.

চাটুজ্জে মশায়ের বাড়ির গানের আসর ভাঙল রাত এগারোটায়৷ তার পরে খাওয়ার জায়গা হল, প্রায় ত্রিশজন লোক নিমন্ত্রিত, আহারের ব্যবস্থাও চমৎকার৷ যেমন আয়োজন, তেমনি রান্না৷ কেদার একসময়ে খেতে পারতেন ভালোই, আজকাল বয়স হয়ে আসছে, তেমন আর পারেন না—তবুও এখনও যা খান, তা একজন ওই বয়সের কলকাতার ভদ্রলোকের বিস্ময় ও ঈর্ষার বিষয়৷

বাড়ির কর্তা চাটুজ্জে মশায় কেদারের পাতের কাছে দাঁড়িয়ে তদারক করে তাঁকে খাওয়ালেন৷ আহারাদির পরে বিদায় চাইলে বললেন, অবার আসবেন কেদারবাবু, পাশেই আছি—আমরা তো প্রতিবেশী৷ আপনার বাজনার হাত ভারি মিঠে, আমার স্ত্রী বলছিলেন উনি কে? আমি বললাম, আমাদের পাশের বাগানেই থাকেন—এসেছেন বেড়াতে৷ আহা, আজ যদি আপনার মেয়েটিকে আনতেন—বড় ভালো হত, আমার স্ত্রী বলছিলেন—

—আজ্ঞে হ্যাঁ—তা তো বটেই৷ তার এক দাদা এসে তাকে নিয়ে গেল বেড়াতে কিনা? মানে গ্রাম-সম্পর্কের দাদা হলেও খুব আপনা-আপনি মতো৷ কলকাতায় তাদের বাড়ি আছে—সেখানেই নিয়ে গেল৷ মোটর গাড়ি নিয়ে এসেছিল, তা আর একদিন নিয়ে আসব—

—আনবেন বৈকি, মাকে আনবেন বৈকি,—বলা রইল, নিশ্চয় আনবেন—আচ্ছা নমস্কার কেদারবাবু—

কেদারের সঙ্গে চাটুজ্জে মশায় একজন লোক দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কেদার তা নিতে চান নি৷ তিনি গানের আসরের শেষ দিকে একটু ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন, মেয়ে এসে একা থাকবে বাগানবাড়িতে৷ গাঁয়ে গড়বাড়ির বনের মধ্যে মেয়েকে ফেলে রেখে যেতেন প্রায় প্রতি রাত্রেই, সে কথা ভেবে এখন তাঁর কষ্ট হল৷ তবুও সে নিজের গ্রাম, পূর্বপুরুষের ভিটে, সেখানকার কথা স্বতন্ত্র৷

গেট দিয়ে ঢোকবার সময় কেদার দেখলেন, কোনো ঘরে আলো জ্বলছে না৷ শরৎ তা হলে হয়তো সারাদিন ঘুরেফিরে এসে ক্লান্ত অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়েছে! আহা, কত আর ওর বয়স, কাল তো এতটুকু দেখলেন ওকে—দেখুক শুনুক, আমোদ করুক না৷

বাড়ির রোয়াকে উঠে ডাকলেন, ও শরৎ—মা শরৎ উঠে দোরটা খোলো, আলোটা জ্বালো—

সাড়া পাওয়া গেল না৷

কেদার ভাবলেন—বেশ ঘুমিয়ে পড়েছে দেখছি—বড্ড ঘুম-কাতুরে, গড়শিবপুরে এক-একদিন এমন ঘুমিয়ে পড়তো—ছেলেমানুষ তো হাজার হোক—হুঁ—

পুনরায় ডাক দিলেন—ও মা শরৎ, ওঠো, আলো জ্বালো—

ডাকাডাকিতে ঝি উঠে আলো জ্বেলে রান্নাঘরের বারান্দা থেকে এসে বললে, কে—বাবু? কই দিদিমণি তো আসেন নি এখনও—

কেদার বিস্ময়ের সুরে বললেন, আসে নি? বাড়ি আসে নি? তুই ঘুমিয়ে পড়েছিলি, জানিস নে হয়তো—দ্যাখ—সে হয়তো আর ডাকে নি—চল ঘরে, আলো জ্বাল—

ঝি বললে, চাবি দেওয়া রয়েছে যে বাবু, এই আমার কাছে চাবি৷ দোর খুলবে, আমার কাছ থেকে চাবি নেবে, তবে তো ঢুকবে ঘরে! কি যে বলো বাবু!

তাই তো, কেদার সে কথাটা ভেবে দেখেন নি৷ চাবি রয়েছে যখন ঝিয়ের কাছে, তখন শরৎ দোর খুলবে কি করে!

ঝি বললে, আমি সন্দে থেকে বসে ছিনু এই রোয়াকে, এই আসে এই আসে—বলি মেয়েমানুষ একা থাকবে? এসব জায়গা আবার ভালো না৷ বাগানবাড়ি, লোকজনের গতাগম্যি নেই—রাত্তির কাল! আমি শুয়ে থাকবখন দিদিমণির ঘরে—রান্নাঘরে আটা এনে রেখেছি, ঘি এনে রেখেছি, যদি এসে খাবার করে খায়—

কেদার অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন—ঝিয়ের দীর্ঘ উক্তির খুব সামান্য অংশই তাঁর কর্ণগোচর হল৷ ঝিয়ের কথার শেষের দিকে প্রশ্ন করলেন—কে খাবার করে খেয়েছে বললে?

—খায় নি গো খায় নি, যদি খায় তাই এনে রাখনু সব গুছিয়ে৷ আটা ঘি—

কেদার বললেন, তাই তো ঝি, এখনও এল না কেন বল দেখি? বারোটা বাজে—কি তার বেশিও হয়েছে—

—তা কি করে বলি বাবু!

—হ্যাঁ ঝি, থিয়েটার দেখতে যায় নি তো? তা হলে কিন্তু অনেক রাত হবে৷ না?

—তা জানি নে বাবু৷

রাত একটা বেজে গেল—দুটো৷ কেদারের ঘুম নেই, বিছানায় শুয়ে উৎকর্ণ হয়ে আছেন৷ বাগানবাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে অত রাতেও দু-একখানা মোটর বা মাল-লরীর যাতায়াতের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে; কেদার অমনি বিছানার ওপর উঠে বসেন৷ এই এতক্ষণে এল প্রভাসের গাড়ি! কিছুই না!

আবার শুয়ে পড়েন৷

নয়তো উঠে তামাক সাজেন বসে বসে, তবুও একটু সময় কাটে৷

হলের ঘড়িটায় টং টং করে তিনটে বাজল৷

কত রাত্রে কলকাতার থিয়েটার ভাঙে! কারণ এতক্ষণে তিনি ঠিক করেই নিয়েছেন যে প্রভাস ওকে থিয়েটার দেখাতে নিয়ে গিয়েছে, প্রভাস এবং অরুণের বাড়ির সবাই গিয়েছে, মানে মেয়েরা৷ তাদের সঙ্গেই—তা তো সব বুঝলেন তিনি, কিন্তু থিয়েটার ভাঙে কত রাত্রে? কাকে জিজ্ঞেস করেন এত রাত্রে কথাটা! আবার শুয়ে পড়লেন৷ একবার ভাবলেন, গেটের কাছে দাঁড়িয়ে কি দেখবেন? শেষ রাত্রে কখন ঘুম এসে গিয়েছিল চোখে তাঁর অজ্ঞাতসারে, যখন কেদার ধড়মড় করে বিছানা ছেড়ে উঠলেন, উঃ, এ যে দেখছি রোদ উঠে বেশ বেলা হয়ে গিয়েছে!

ডাকলেন—ও ঝি—ঝি—

ঝি এসে বললে, আমি বাজারে চননু বাবু, এর পর মাছ মিলবে না, ওই মুখপোড়া ইটের কলের বাবুগুণো হন্নে শেয়ালের মতো—

—হ্যাঁরে, শরৎ আসে নি?

—না বাবু, কই? এলে তো তখুনি উঠে দরজা খুলে দিতাম বাবু৷ আমার ঘুম বড্ড সজাগ ঘুম৷

 ঝি বাজারে চলে গেল৷ কেদারের মনে এখন আর ততটা উদ্বেগ নেই৷ তিনি এইবার ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন৷ অনেক রাত্রে থিয়েটার ভেঙে গেলে প্রভাসের বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে শরৎ তাদের বাড়িতে গিয়ে শুয়েছে—এ তো সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ব্যাপার৷ রাত্রের অন্ধকার মানুষের মনে ভয় ও উদ্বেগ আনে, দিনের আলোয় তাঁর মনের দুশ্চিন্তা কেটে গিয়েছে৷ মিছিমিছি ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই এর মধ্যে৷ কলকাতার জীবনযাত্রা-প্রণালী গড়শিবপুরের সঙ্গে এক নয়—এ তাঁর আগেই বোঝা উচিত ছিল৷

কেদার নিজেই জল ফুটিয়ে চা করে খেলেন, ঝি দোকান থেকে খাবার নিয়ে এল—আটটা ন’টা দশটা বাজল, কেদার ঝিকে বলে দিয়েছিলেন কি কি আনতে হবে, মেয়ে এসে মাছ রাঁধবে বলে ভালো মাছও আনতে দিয়েছেন—ঝি বাজার থেকে ফিরে এল, অথচ এখনও শরতের সঙ্গে দেখা নেই৷ বাজার পড়ে রইল, ঝি জিজ্ঞেস করল—দিদিমণি তো এখনও এলো না, মাছ কি কুটে রাখবো?

—রেখে দে৷ হয়তো গঙ্গাচ্চান করে আসবে৷

যখন বারোটা বেজে গেল, তখন ঝি এসে বললে, বাবু, রান্নাটা আপনিই চড়িয়ে দিন না কেন? আমার বোধ হয় দিদিমণি এবেলা আর এলেন না৷ না খেয়ে কতক্ষণ বসে থাকবেন৷

কিন্তু কেদার বড় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন৷

আজ একটা ব্যাপার তাঁর কাছে আশ্চর্য ঠেকেছিল, সেটা এই, শরৎ যত আমোদের মধ্যেই থাকুক কেন না, বাবাকে ভুলে—তাঁর জন্যে রান্নার কথা ভুলে—সে কোথাও থাকবে না৷ জীবনে সে কখনও তা করে নি৷ যতই কালীঘাটেই যাক আর গঙ্গাস্নানই করুক, বাবার খাওয়া হবে না দুপুরে, এ চিন্তা তাকে বৈকুণ্ঠের দোর থেকেও ফিরিয়ে আনবে৷

অথচ এ কি রকম হল!

মহা মুশকিলে পড়ে গেলেন কেদার৷

প্রভাসের বাড়ির ঠিকানা জানেন না তিনি যে খোঁজ নেবেন৷ এমন তো হতে পারে কোনো অসুখ করেছে শরতের! কিন্তু প্রভাসও খবর দিতে এল না একবার, এই বা কেমন কথা!

ঝি এসে দাঁড়াল, আবার ভাত চড়াবার কথাটা বলতে৷

একটু ইতস্তত করে বলল, বাবু, একটা কথা বলব কিছু মনে কোরো নি, দিদিমণি যেনার সঙ্গে গিয়েছেন, তিনি কি রকম দাদা!

ঝিয়ের কথার সুর ও বলবার ধরণ কেদারের মনের মধ্যে হঠাৎ যেন একটা ধারালো অস্ত্রের বিষম ও নিষ্ঠুর খোঁচা দিয়ে তাঁর সরল মনকে জাগিয়ে তুলবার চেষ্টা করলে৷

তিনি পাংশুমুখে ঝিয়ের দিকে চেয়ে বললেন, কেন মেয়ে? কেন বলো তো?

—না বাবু, তাই বলছি৷ বলি, যেনার সঙ্গে তিনি গিয়েছেন, তিনি নোক ভালো তো? শহর-বাজার জায়গা, এখানে মানুষ সব বদমাইশ কিনা, দিদিমণি সোমত্ত মেয়ে, তাই বলছি, তবে আপনি বলছিলে দাদার সঙ্গে গিয়েছে, তবে আর ভয় কি! তা বাবু, ভাতটা চড়িয়ে—

কেদার রান্না চড়াবেন কি, ঝির কথা শুনে তাঁর কেমন একটা ভয়ে সমস্ত শরীর ঝিমঝিম করে উঠল, হাতে পায়ে যেন বল নেই৷ এসব কথা তাঁর মনেও আসে নি৷ ঝি নিতান্ত অন্যায় কথা তো বলে নি৷ প্রভাসকে তিনি কতটুকু জানেন? তাঁর সঙ্গে মেয়েকে যেতে দেওয়া হয়তো তাঁর উচিত হয় নি৷

হঠাৎ মনে পড়ল, পাশের বাগানে গিয়ে চাটুজ্জে মশাইকে সব জানিয়ে এ বিপদে তাঁর পরামর্শ নেওয়া দরকার—বিশাল কলকাতা শহরের মধ্যে তিনি আর কাউকে জানেন না, চেনেন না৷ ঝিকে বসিয়ে রেখে বাড়িতে তিনি চাটুজ্জে মশায়ের বাগানবাড়িতে গেলেন৷ চাটুজ্জে মশায়কে সামনের চাতালেই চাকরে তেল মাখাচ্ছিল, কেদারকে এমন অসময়ে আসতে দেখে তিনি একটু বিস্মিত হয়ে কাপড় গুছিয়ে পরে উঠে বসলেন৷ হাত তুলে নমস্কার করে বললেন, আসুন কেদারবাবু, ওরে বাবুকে টুলটা এগিয়ে দে—

কেদার বললেন, বড় বিপদে পড়ে এসেছি চাটুজ্জে মশায়—আপনি ছাড়া আমি তো আর কাউকে জানি নে চিনিও নে—কার কাছেই বা যাব—

চাটুজ্জে মশায় সোজা হয়ে বসে বিস্ময়ের সুরে বললেন, কি বলুন দিকি? কি হয়েছে?

কেদার ব্যাপার সব খুলে বললেন৷

চাটুজ্জে মশাই শুনে একটু চুপ করে ভাবলেন৷ তার পর বললেন, আপনি ঠিকানা জানেন না?

—আজ্ঞে না—

—প্রভাস কি?

—দাস—ওরা কর্মকার৷

—আহা দাঁড়ান, টেলিফোন গাইডটা দেখি৷ কিন্তু আপনি তো বলছেন ঠিকানা জানেন না, তবে তাতে কি হবে? ওই নামে পঞ্চাশ জন মানুষ বেরুবে—আচ্ছা, আপনি দয়া করে একটু অপেক্ষা করুন, আমি স্নানটা সেরে নি চট করে, বেলা হয়েছে৷ আপনাকে নিয়ে একবার থানায় যাব কি না ভেবে দেখি৷ পুলিসের সঙ্গে একবার পরামর্শ করা দরকার৷

পুলিসের নাম শুনে নির্বিরোধী কেদার ভয় পেয়ে গেলেন৷ পুলিসে যেতে হবে, ব্যাপারটা গুরুতর দাঁড়াবে কি? নাঃ, হয়তো মন্দির-টন্দির দেখতে বেরিয়েছে মেয়ে, ফিরে আসতে একটু বেলা হচ্ছে৷ একেবারে পুলিসে যাওয়াটা ঠিক হবে না৷

কেদার বললেন, আচ্ছা, আপনি স্নানাহার সেরে নিন—আমি ততক্ষণ একবার দেখে আসি এল কিনা৷ আপনি খেয়ে একটু বিশ্রাম করুন৷ আমি আসছি—

বাগানবাড়িতে ফিরে কেদার এঘর ওঘর খুঁজলেন, ঝিকে ডাকলেন, শরৎ আসে নি৷ ঘড়িতে বেলা দুটো৷ কিছুক্ষণ চুপ করে বিছানায় শুয়ে মন শান্ত করার চেষ্টা করলেন—পুলিসে খবর দেবার আগে বরং একটু দেরি করা ভালো৷ ঘড়িতে আড়াইটে বাজল৷

এমন সময়ে ফটকের কাছে মোটরের হর্ন শোনা গেল৷ কেদার উৎকর্ণ হয়ে রইলেন—সকাল থেকে একশো মোটর গাড়ির বাঁশি শুনেছেন তিনি৷ কিন্তু মনে হল—না, এই তো, গাড়ির শব্দ একেবারে বাগানের লাল কাঁকরের পথে৷ বাবাঃ, বাঁচা গেল৷ সমস্ত শরীর দিয়ে যেন ঝাল বেরিয়ে গেল কেদারের৷

ঝি ছুটে এসে বললে, বাবু মোটর ঢুকছে ফটক দিয়ে—দিদিমণি এসেছে—

কেদার প্রায় ছুটেই বাইরে গেলেন৷ মোটর সামনে এসে দাঁড়াল—তা থেকে নামল প্রভাস ও গিরীন৷ শরৎ তো গাড়িতে নেই!

ওরা এগিয়ে এল৷

কেদার ব্যস্ত ভাবে বললে, এসো বাবা প্রভাস—শরৎ আসে নি? এত দেরি করলে, তাকে কি বাড়িতে—

প্রভাস ও গিরীনের মুখ গম্ভীর৷ পাশেই ঝিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গিরীন বললে, শুনুন, আপনার সঙ্গে একটা কথা আছে৷ ওদিকে চলুন—

ঝি হঠাৎ বলে উঠল, হ্যাঁগা বাবু, দিদিমণি ভালো আছে তো?

গিরীন নামতা মুখস্ত বলার মতো বললে, হ্যাঁ, আছে আছে—আসুন, চলুন ওই ওদিকে৷ তুই যা না কেন, হাঁ ক’রে এখানে দাঁড়িয়ে কি—

ওদের রকম-সকম দেখে কেদার উদ্বিগ্ন মুখে প্রশ্ন করলেন, কি—কি হয়েছে? শরৎ ভালো আছে তো?

প্রভাস বললে, হ্যাঁ, ভালো আছে৷ সেজন্য কিছু নয়, তবে একটা ব্যাপার হয়েছে, তাই আপনার কাছে—

কেদার জিনিসটা ভালো বুঝতে না পেরে বললেন, তা শরৎকে সঙ্গে নিয়ে এলেই হত বাবাজি—তাকে আর কেন বাড়িতে রেখে এলে?

গিরীন বললে, আজ্ঞে না, তাঁকে নিয়েই তো ব্যাপার—সেই বলতেই তো—

কেদারের প্রাণ উড়ে গেল—শরতের নিশ্চয় অসুখ-বিসুখ হয়েছে, এরা গোপন করছে—তা ছাড়া আর কি হওয়া সম্ভব? তিনি অধীর ভাবে কি একটা বলতে যাচ্ছিলেন, গিরীন এগিয়ে এসে গম্ভীর মুখে বললে, আপনাকে বলতেই তো আমাদের আসা৷ কিন্তু কি করে যে বলি, তাই বুঝতে পারছি নে৷ আসল কথাটা কি জানেন, আপনার মেয়েকে কাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না—মানে এখন পাওয়া গিয়েছে তবে—

এদের কথাবার্তার গতি কেদার বুঝতে পারলেন না, একবার বলে মেয়েকে পাওয়া যাচ্ছে না, আবার বলে পাওয়া গিয়েছে—গিয়ে যদি থাকে, তবে কি তাকে সাংঘাতিক আহত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে? নইলে এরা তার পরে আবার ‘কিন্তু’ বলে কেন? মুহূর্তের মধ্যে কেদারের মনে এই কথাগুলো খেলে গেল—কিন্তু তাঁর হতবুদ্ধি ওষ্ঠাধর বাক্যে এর রূপ দেওয়ার পূর্বেই গিরীন আবার বললে—হয়েছিল কি জানেন, আপনার মেয়ে—বল না হে প্রভাস!

প্রভাস বললে, বলব কি, আমারও হাত-পা আসছে না আপনার সামনে একথা বলতে, অরুণের সঙ্গে কাল শরৎ-দি কোথায় চলে গিয়েছিল—কাল রাত্রে তারা সারারাত আসে নি৷ আজ সকালে—মানে—

গিরীন ওর কাছ থেকে কথা লুফে নিয়ে বললে, মানে আমরা কাল সারারাত খোঁজাখুঁজি করেছি—পাই নি৷ আপনার কাছেই বা কি বলি, কার কাছেই বা কি বলি—তার পর আজ সকালে একটা কুশ্রেণীর মেয়ের বাড়িতে এদের দুজনকে পাওয়া গিয়েছে৷ এসব কথা বলতে আমাদের মাথা কাটা যাচ্ছে লজ্জায়৷ প্রভাস তো বলছিল, আমি কাকাবাবুর কাছে গিয়ে এসব বলতে পারব না৷ আমি বললাম—না চলো, বলতেই যখন হবে আমিই বলব এখন৷ তিনিও তো ভাববেন৷ তাই ও এল, নইলে ও আসতে চাইছিল না৷

কেদার নির্বোধের মতো ওদের মুখের দিকে চেয়ে সব কথা শুনছিলেন—কিন্তু কথাগুলোর অর্থ তাঁর তেমন বোধগম্য হয় নি বোধ হয়—কারণ কিছুমাত্র না ভেবেই তিনি প্রশ্ন করলেন, তাকে তোমরা আনলে না কেন? তার অসুখ-বিসুখ হয় নি তো?

গিরীন হাত নেড়ে একটা হতাশাসূচক ভঙ্গি করে বললে, সে চেষ্টা করতে কি আর আমরা বাকি রেখেছিলাম? আসতে চাইলেন না৷

কেদার বিস্ময়ের সুরে বললেন, আসতে চাইলে না?

—তবে আর বলছি কি ছাই আপনাকে! আমি আর প্রভাস গিয়ে আজ সকাল থেকে কত খোশামোদ, তা বললেন, আমি যাব না৷ এখানে বেশ আছি৷ কুশ্রেণীর দুটো মেয়ে আছে সে বাড়িতে, দিব্যি দেখলুম সাজিয়েছে৷ আমায় বললেন, দেশে আর সে জঙ্গলে ফেরবার আমার ইচ্ছে নেই৷ এই বেশ আছি৷ অরুণ তাঁকে সুখে রাখবে বলেছে৷ কলকাতা শহর ফেলে তিনি আর জঙ্গলে ফিরতে চান না, এই গেল আসল কথা৷ বললেন, আমি সাবালিকা, আমার বয়স হয়েছে, আমি এখন যা খুশি করতে পারি৷ আমি যাব না৷ এখন যেমন ব্যাপার বুঝিছি অরুণের সঙ্গে ওর—মানে মনের মিল হয়ে গিয়েছে—বয়েসও তো এখনও—বুঝলাম যতদূর তাতে—

কেদার অধীর ভাবে বললেন, আমার কথা বলেছিলে?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, এই জিজ্ঞেস করুন না প্রভাসকে৷ সকাল থেকে ঝুলোঝুলি করেছি আমরা৷ কিছু কি আর বাদ রেখেছি—কাল থেকে কলকাতা শহর তোলপাড় করে বেড়িয়েছি৷ ওদিকে অরুণের সঙ্গে ওখানে গিয়ে উঠেছেন তা কি করে জানব? তা আপনার কথা বলতে বললেন, বাবাকে দেশে ফিরে যেতে বলুন৷ আমার এখন সেখানে যাবার ইচ্ছে নেই—এই জিজ্ঞেস করুন না প্রভাসকে?

প্রভাস বিষণ্ণ মুখে বললে, সে-সব কথা আর কি বলি? কত রকম করে বোঝালুম, তা ওই এক বুলি মুখে! আমি আর ফিরব না দেশে, বাবাকে গিয়ে বলো গে যাও৷ আমি এখানে বেশ আছি৷ এসব কথা কি আপনার কাছে বলবার কথা, লজ্জায় মাথা কাটা যায়—কি করি বাধ্য হয়ে বলতে হচ্ছে৷ আমি কি চেষ্টার ত্রুটি করেছি কাকাবাবু? এখন এক উপায় আছে পুলিসে খবর দেওয়া৷ আপনার সঙ্গে সেই পরামর্শ করতেই আসা৷ আপনিও চলুন আমাদের সঙ্গে, জোড়াসাঁকো থানায় গিয়ে পুলিসের কাছে এজাহার করে দেওয়া যাক—

গিরীন চিন্তিত মুখে বললে, তাতেই বা কি হবে, সেই ভাবছি৷ ছেলেমানুষ নয়, বয়েস হয়েছে ছাব্বিশ-সাতাশ, বিধবা—সে মেয়ে যা খুশি করতে পারে৷ পুলিস হস্তক্ষেপ করতে চাইবে না৷ তার ওপরে ওঁদের মানী বংশ, পুলিসে কেস করতে গেলেই এ নিয়ে খবরের কাগজে একটা লেখালেখি হবে, ওঁদের ছবি বেরুবে, একটা কেলেঙ্কারির কথা—ভালো কথা তো নয়? চারিদিকে ছি ছি পড়ে যাবে৷ এ সবই ভাবছি কিনা! তা উনি যে-রকম বলেন সে-রকম করতে হবে৷ চলুন না হয় এখুনি তবে পুলিসে যাই—পুলিসে খবর দিলেই এখুনি প্রথম তো ওঁর মেয়েকে বেঁধে চালান দেবে—যদি অবিশ্যি পুলিসে এ কেস নেয়৷ তাঁকেই আসামী করবে—

গিরীন ধীরে ধীরে যে চিত্রপট কেদারের সামনে খুলে ধরলে, নিরীহ কেদার তাতে শিউরে উঠলেন৷ তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, না না—পুলিসে যাওয়ার দরকার নেই৷

গিরীন বললে, না কেন? আমার মনে হয় পুলিসে একবার যাওয়া উচিত৷ আমাদের মোটরে আসুন জোড়াসাঁকো থানায়৷ আপনি গিয়ে এজাহার করুন৷ আদালতে আপনাকে সব খুলে বলতে হবে এর পর৷ হয় কেস হোক৷ আপনার মেয়ে যখন এ পথে গিয়ে পড়েছেন, তখন তাঁরও একটু শিক্ষা হয়ে যাক না! তিনটি বছর জেল ঠুকে দেবে এখন৷ ও অরুণকেও ছাড়বে না—আপনার মেয়েকেও ছাড়বে না৷ যা হয় হবে, আপনি আসুন আমাদের সঙ্গে জোড়াসাঁকো থানায়৷ চলুন—কি বলো প্রভাস?

প্রভাস বললে, হ্যাঁ, তা যেতে হবে বৈকি৷ যা থাকে কপালে৷ শরৎ-দিকে আসামী হয়ে ডকে দাঁড়াতে হবে বলে আর কি করা, চলুন আপনি৷ আমার গ্রামের লোক আপনি৷ আমি এর একটা বিহিত না করে—

গিরীন বললে, না, বিহিত করাই উচিত৷ খারাপ পথে যখন পা দিয়েছে, তখন ওদের শাস্তি হয়ে যাওয়াই উচিত৷ জেল হলেই বা আপনি করবেন কি? আসুন, উঠুন গাড়িতে, আপনার আহারাদি হয়েছে?

কেদার যেন অকূলে কূল পেয়ে বললেন, না, এখনও হয় নি৷ ভাত চড়াতে যাচ্ছিলাম—

—কি সর্বনাশ! খাওয়া হয় নি এখনও? আপনি রান্নাখাওয়া করে নিন—আমরা ততক্ষণ একটু অন্য কাজ সেরে আসি৷

কেদার ব্যস্তভাবে বললেন, তোমরা যেন আমায় না বলে থানায় যেয়ো না বাবাজি৷

গিরীন বললে, আপনি না থাকলে তো পুলিসে এজাহার করাই হবে না৷ আমরা কে—আপনিই তো ফরিয়াদি—আপনার মেয়ে, আমরা বাইরের লোক—আমাদের কথা নেবেই না পুলিস৷ আপনাকে না নিয়ে গেলে তো কাজই হবে না৷ আপনি খাওয়া-দাওয়া করুন, আমরা বেলা চারটের মধ্যে আসব৷

প্রভাস ও গিরীন মোটর নিয়ে চলে গেলে কেদার খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি ভাবলেন৷ ঠিকমতো ভাববার শক্তিও তখন তাঁর নেই—মাথার মধ্যে কেমন যেন সব গোলমাল হয়ে গিয়েছে৷ জীবনে কখনো এ-ধরনের ভাবনা ভাবেন নি তিনি—নির্বিরোধী নিরীহ মানুষ কেদার—শখের যাত্রাদলে গানের তালিম দিয়ে আর গ্রাম্য মুদির দোকানে বসে হাসিগল্প করেই চিরদিন কাটিয়ে এসেছেন৷ এমন জটিল ঘটনাজালের মধ্যে কখনো পড়েন নি, এমন ধরনের চিন্তায় তাঁর মস্তিষ্ক অভ্যস্ত নয়৷

একটা কথাই শুধু বার বার তাঁর মাথায় খেলতে লাগল—পুলিসে গেলে তাঁকে মেয়ের বিরুদ্ধে এজাহার করতে হবে, তাতে তাঁর মেয়ের জেল হয়ে যেতে পারে!

শরতের জেল হয়ে যেতে পারে!

আর এ মোকদ্দমার তিনিই হবেন ফরিয়াদি! আদালতে দাঁড়িয়ে মেয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে হবে তাঁকে৷

ঝি এসে বললে, বাবু ওনারা চলে গেল৷ দিদিমণির কথা কি বলে গেল বাবু? কখন আসবেন তিনি?

কেদারের চমক ভাঙলো ঝিয়ের কথায়৷ বললেন, হ্যাঁ—এই—কি বললে? ও, শরৎ—না, তার এখন আসবার দেরি আছে৷

—তা আপনি আজ ভাত চড়াবেন না বাবু? দিদিমণির খবর তো পাওয়া গেল—এখন দুটো ভাতে ভাত যা হয় চড়িয়ে—

—না, মেয়ে, এখন অবেলায় আর ভাত—দুটো চিঁড়ে এনে দেবে?

—ওমা, চিঁড়ে খেয়ে থাকবেন আপনি? তা দেন, পয়সা দেন—নিয়ে আসি৷

.

বাগানের পথে দিব্যি বাতাবিলেবু গাছের ছায়া পড়েছে, প্রায় বিকেল হতে চলল৷

ঘণ্টা দুই পরে প্রভাস ও গিরীন মোটর নিয়ে ফিরে এসে দেখলে ঝি গাড়িবারান্দার সামনের রোয়াকে বসে৷ তাকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল কেদার কোথায় চলে গিয়েছেন, বাজার থেকে চিঁড়ে কিনে নিয়ে এসে সে আর তাঁকে দেখতে পায় নি৷ কেদারের কাপড় চোপড়ের পুঁটুলিটাও সেই সঙ্গে দেখা গেল নেই৷

গিরীন বাগানের বাইরে এসে হো হো করে হেসে গড়িয়ে পড়ে আর কি!

—কেমন বাবাঃ, বললাম যে সব আমার হাতে ছেড়ে দাও—গিরীন কুণ্ডুর মাথার দাম লাখ টাকা বাবা! ও পাড়াগেঁয়ে বুড়োর কানে এমন মন্তর ঝেড়েছি যে, এ-পথে আর কোনো দিন হাঁটবে না, বলি নি তোমায়?

—আচ্ছা বুড়োটা গেল কোথায়?

—কোথায় আর যাবে? গিয়ে দেখ গে যাও তোমাদের সেই কি পুর বলে, তার জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে কাল সকাল নাগাদ ঠেলে উঠেছে৷ লজ্জায় এ-কথা কারো কাছে এমনিই বলতে পারত না—তার ওপর যে পুলিসের ভয় দিইছি ঢুকিয়ে বুড়োর মাথায়—দেখবে যে রা কাটবে না কারো কাছে৷ এক ঢিলে দুই পাখি সাবাড়৷

.

দমদমার বাগানবাড়ি থেকে বার হয়ে কেদার পুঁটুলি হাতে হনহন করে পথে চলতে লাগলেন৷ হাতে পয়সার সচ্ছলতা নেই—খরচের দরুন যা কিছু ছিল, তা নিতান্তই সামান্য৷ তা ছাড়া কেদার এখনও কোথায় যাবেন না যাবেন ঠিক করে উঠতে পারেন নি—এখন তাঁর প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য, তাঁর ও কলকাতা শহরের মধ্যে অতি দ্রুত ও অতি বিস্তৃত একটি ব্যবধান সৃষ্টি করা৷ এই ব্যবধান যত বড় হবে, যত দূরে গিয়ে তিনি পড়তে পারবেন—তাঁর মেয়ে তত নিরাপদ৷

সুতরাং পিছন ফিরে না চেয়ে এখন শুধু হেঁটেই যেতে হবে…হেঁটেই যেতে হবে৷ মেয়ের বিপদ না ঘটে…শুধু হাঁটতেই হবে৷ কিসের বিপদ মেয়ের, তা কেদারের ভাবার সময় বা অবসর নেই৷ মেয়ে যে খুব নিরাপদ আছে কি নেই—সে-সব ভাবনারও সময় নেই এখন৷ শুধু হাঁটতে হবে, কলকাতা থেকে দূরে গিয়ে পড়তে হবে৷ প্রভাস ও গিরীন যেমন রেগে গিয়েছে, ওরা শোধ তুলে হয়তো ছাড়বে অরুণের ওপর৷ মোটরে করে এসে তাঁকে রাস্তা থেকে জোর করে নিয়ে না যায়!

ক্ষুধা নেই, তৃষ্ণা নেই, ক্লান্তি নেই, পরিশ্রম নেই, শুধু পথ বেয়ে চলা—যতদূর যাওয়া যায়৷

সন্ধ্যার সময় দমদমা থেকে সাত মাইল দূর যশোর রোডের ধারে গাছতলায় বসে একটি বৃদ্ধ ব্রাহ্মণকে হাউ হাউ করে কাঁদতে দেখে দু-চারজন পথিকের ভিড় জমে গেল৷

একজন বললে, কি হয়েছে মশায়?

আর একজন বললে, বাড়ি কোথায় আপনার? কি হয়েছে?

লোকজনের মধ্যে বেশির ভাগ চাষী লোক, দুজন দমদমায় এইচ-এম-ভি গ্রামোফোন কোম্পানির কারখানায় কাজ করে, ছুটির পর সাইকেলে গ্রামে ফিরছিল৷ তাদের একজন এগিয়ে এসে বললে—কি হয়েছে মশাই? আমিও ব্রাহ্মণ, আসুন আমার বাড়ি—এই কাঁচা রাস্তা দিয়ে নেমে গিয়ে গরানহাটি কেশবপুরে আমার বাড়ি—

কেদার বললেন, না, ও কিছু না—আমি এখন হেঁটে যাব—

—কাঁদছেন কেন, কি হয়েছে আপনার বলতেই হবে—আসুন আপনি দয়া করে৷ এ অন্ধকার রাত্রে একা যাবেন কোথায়?

কেদার কাকুতি মিনতির সুরে বললেন, না বাবু, আমি যাব না৷ আমার কিছুই হয় নি—এই গিয়ে মাঝে মাঝে পেটে ফিকব্যথা ধরে কিনা৷ ও কিছু নয়, এক্ষুনি সেরে যাবে—সেরে গিয়েছে অনেকটা৷

কেদার পুঁটুলি নিয়ে অন্ধকারের মধ্যে উঠে বারাসাতের দিকে রওনা দিলেন পথ ধরে৷

সকলে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলে৷

ওদের মধ্যে একজন মুচকি হেসে বললে, পাগল—পাগল ও, দেখেই চেনা যায়৷ পাগল—

সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে পথে রাত এল৷ অন্ধকার রাত৷ কেদারের দৃকপাত নেই—কোথায় যাচ্ছেন তা তিনি এখনও জানেন না৷ মাঝে মাঝে মোটরের হর্ন বাজে পেছন থেকে, মালবোঝাই লরি যশোর রোড বেয়ে বারাসাত কি বনগাঁয়ে মাল নিয়ে চলেছে—কেদার হর্ন শুনলেই পথের ধারের গাছের গুঁড়ির আড়ালে লুকিয়ে পড়েন, প্রভাসদের মোটর তাঁর সন্ধানে পুলিস নিয়ে বেরিয়েছে কিনা কে জানে! সারাদিন পেটে কিছু যায় নি, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় কেদার এখন আহারের কোনো প্রয়োজন পর্যন্ত অনুভব করছেন না৷ শরীর এবং মন যেন তাদের সমস্ত অনুভূতি হারিয়ে একটিমাত্র অনুভূতিতে পর্যবসিত হয়েছে, সেটা সময় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ তীক্ষ্ণ ও স্পষ্ট হয়ে উঠছে৷ অন্য কিছু নয়—কন্যার উপর তাঁর গভীর স্নেহ ও একটি অদ্ভুত করুণা৷ শরৎ যেন ছাব্বিশ বছরের যুবতী নেই, তাঁর মনোরাজ্যে সে কখন শিশু মেয়েটি হয়ে ফিরে এসেছে, যে গড়শিবপুরের বাড়িতে জঙ্গলের ধারে কুচফল তুলে খেলা করত—তার খেলাঘরে ধুলোর ভাত ও পাথরকুচি পাতা মাছ খেতে হয়েছে বসে বসে৷ তার এখনও কি বুদ্ধিই বা হয়েছিল, চিরকাল পাড়াগাঁয়ে কাটানোর ফলে শহরের ব্যাপারে কি বা সে বোঝে!

একবার ভাবলেন, কলকাতায় ফিরে গিয়ে পাশের বাগানের চাটুজ্জে মশায়ের কাছে সব কথা ভেঙে বলে তাঁর সাহায্য চাইলে কেমন হয়? কিন্তু পুলিসের আইন বড় কড়া৷ সেখানে চাটুজ্জে মশায় কতটুকু সাহায্য করতে পারবেন? বিশেষ করে এমন একটা কথা তিনি চাটুজ্জে মশায়কে খুলে বলতে পারবেন? তবে কথা গোপন থাকবে না৷ ওই ঝিটা এতক্ষণ কথাটা পাড়াময় রাষ্ট্র করেছে—ঝি কি আর এতক্ষণ এ কথা না জেনেছে! ওই প্রভাস ও গিরীনই তাকে সব কথা প্রকাশ করে বলেছে এতক্ষণ৷ না, সেখানে আর ফিরবার উপায় নেই—এখন তো নয়ই, এর পর—কত পরে তা তিনি এখনও জানেন না—যা হয় একটা কিছু করবেন তিনি৷

বারাসাতের বাজারে পৌঁছে কেদারের ইচ্ছে হল এখানে চা কিনে খান দোকান বেছে—রাস্তার ধারেই অনেকগুলো চায়ের দোকান৷ আজ শরৎ নেই সঙ্গে যে তাঁকে দোকানের চা খেতে বাধা দেবে, যে তাঁকে ইহকালের অনাচার থেকে সন্তর্পণে বাঁচিয়ে রেখে তাঁর পরকালের মুক্তির পথ খোলসা করবার জন্যে সচেষ্ট ছিল চিরদিন—আজ সে নির্মমভাবে সমস্ত অনাচারের স্বাধীনতা দিয়ে তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছে—সুতরাং অনাচার তিনি করবেনই৷ যা হয় হবে, পরকাল তিনি মানেন না৷ আরও জোর করে, ইচ্ছে করে তিনি যা খুশি অনাচার করবেন কে দেখবার আছে তাঁর?

রাস্তার ধারের দোকান থেকে এক পেয়ালা চা খেয়ে কেদার আবার হনহন করে রাস্তা হাঁটতে লাগলেন—সারারাত ধরে পথ চলে সকালের দিকে দত্তপুকুর থেকে কিছু দূরে একটা গ্রামে এসে পথের ধারেই বসে পড়লেন৷ আর তিনি ক্ষুধা ও পথশ্রম-ক্লান্ত দেহটাকে টেনে নিয়ে যেতে পারছেন না৷

জনৈক গ্রাম্য লোক সকালে গাড়ু হাতে মাঠ থেকে ফিরে আসছিল, তাঁকে এ অবস্থায় দেখে বললে—কোথা থেকে আসা হচ্ছে?

—আজ্ঞে বারাসাত থেকে৷

কেদার একটু মিথ্যে কথার আমদানি করলেন, লোককে সন্ধান দেওয়ার দরকার কি, তিনি কোথা থেকে আসছেন?

লোকটি আবার বললে, তা এখানে বসে এমন ভাবে?

—একটু বসে আছি, এইবার উঠি৷

—আপনারা?

—ব্রাহ্মণ৷

—আজ্ঞে প্রাতঃপ্রণাম৷ আমার নাম হরিহর ঘোষ, কায়স্থ—আপনি যদি কিছু না মনে করেন, একটা কথা বলি! আমার বাড়ি এবেলা দয়া করে পায়ের ধুলো দিয়ে দুটি সেবা করে যান৷ আমরাও প্রসাদ পাব এখন৷ চলুন উঠুন৷

কেদার কিছুতেই প্রথমটা রাজি হন নি—কিন্তু তাঁর চেহারা দেখে লোকটার কেমন দয়া ও সহানুভূতির উদ্রেক হয়েছিল, সে পীড়াপীড়ি করে তাঁকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেল৷ কেদার দেখলেন লোকটি সম্পন্ন অবস্থার গ্রাম্য গৃহস্থ, বাইরে বড় চণ্ডীমণ্ডপ, অনেকগুলো ধানের মরাই, বাড়ির সামনে একটা পানাভরা ডোবা৷ সেই ছোট পানাভরা ডোবার আবার একটা ঘাট বাঁধানো দেখে দুঃখের মধ্যেও কেদার ভাবলেন—এদের দেশে এর নাম পুকুর, এর আবার বাঁধা ঘাট! এদের নিয়ে গিয়ে গড়ের কালো পায়রার দিঘিটা একবার দেখিয়ে দিতে হয়—

ভালো লাগল জায়গাটা তবুও৷ কেদার সারাদিন রইলেন, সন্ধ্যার সময় বিদায় নিতে চাইলে গৃহস্বামী আপত্তি করে বললে—তা হবে না ঠাকুরমশায়৷ সামনে অন্ধকার রাত, আপনাকে কি ছেড়ে দিতে পারি এখন? থাকুন না এখানে দুদিন৷

ইতিমধ্যে কেদার নিজের একটা মিথ্যা পরিচয় দিয়েছিলেন৷ তিনি গরিব ব্রাহ্মণ৷ গোবরডাঙার জমিদারবাড়িতে কিছু সাহায্য প্রার্থনা করতে চলেছেন৷

লোকটা তাই বললে, দুদিন থাকুন, দেখি যদি আমাদের এখান থেকে আপনাকে কিছু সাহায্য করতে পারি৷ আমি দুপুরবেলা দু-একজনকে আপনার কথা বলেছি—সকলেই কিছু কিছু দিতে রাজি হয়েছে৷

কেদার বিপদে পড়লেন৷ তিনি গড়শিবপুরের রাজবংশের লোক, কারো কাছে হাত পেতে কখনো কিছু নিতে পারবেন না ওভাবে—যতই অভাব থাকুক৷ নিজেকে গরিব ব্রাহ্মণ বলে তিনি যে মহা মুশকিলে পড়ে গেলেন৷

রাত্রিটা অগত্যা থেকে যেতে হল৷ পরদিন সকালে তিনি যখন আবার বিদায় চাইলেন, গৃহস্বামী তিনটি টাকা তাঁর হাতে দিতে গেল৷ বললে—এই উঠেছে ঠাকুরমশায়, মিত্তির মশায় দিয়েছেন এক টাকা আর আমি সামান্য কিছু—এই নিয়ে যান—

কেদার বিনীত ভাবে বললেন, আমি ও নিতে পারব না—

ঘোষ মশায় আশ্চর্য হয়ে বললে, নেবেন না? কেন?

—আজ্ঞে—ইয়ে—ও আমার দরকার নেই৷

ঘোষ মশায় তাঁর মুখের দিকে চেয়ে বললে, এর চেয়ে বেশি উঠল না যে ঠাকুরমশায়! না হয় আমি আর একটা টাকা—

কেদার বললেন, না—না—আপনি অতি মহৎ লোক, যা করেছেন তা কেউ করে না৷ কিন্তু আমি—আমি নিতে পারব না৷ আমি আপনাকে এমনিই আশীর্বাদ করছি—আপনি ধনেপুত্রে লক্ষ্মীশ্বর হোন—ভগবান আপনাদের সুখে রাখুন—

কেদারের চোখে জল দেখে গৃহস্বামী বিস্মিত হয়ে তাঁর দিকে চেয়ে রইল, তার পরে উঠে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে বললে—আচ্ছা, আপনি ঠিকমতো পরিচয় দেন নি বোধ হয়৷ এ বাজারে চার টাকা ছেড়ে দেয় এমন লোক আমি দেখি নি—বলুন আপনি কে—কি হয়েছে আপনার—

কেদার উদগত অশ্রু কোনোমতে চেপে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তায় উঠতে উঠতে বললেন—কিছু হয় নি, কিছু হয় নি৷ আমি আসি, আমার বিশেষ দরকার আছে—কিছু মনে করবেন না—

গৃহস্বামী টাকাটা হাতে করে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল৷

সেদিন সারাদিন অনবরত পায়ে হেঁটে সন্ধ্যার পর কেদার গড়শিবপুর থেকে ছয় ক্রোশ দূরে হলুদপুরের বাজারে পৌঁছলেন৷ এখানে কেউ তাঁকে চিনতো না—চার ক্রোশ দূরের এ বাজারে তাঁর যাতায়াত বিশেষ ছিল না৷ না চেনে সে খুব ভালো৷ একটা পুকুরের বাঁধা ঘাটের চাতালে এসে বসলেন, এতদূর পর্যন্ত চলে এসেছেন কিসের ঝোঁকে, কিছু বিবেচনা না করেই, এইবার তাঁর মনে প্রশ্ন জাগল—কোথায় যাবেন তিনি? গাঁয়ে ফেরা কি উচিত হবে? মেয়ের কথা লোকে জিজ্ঞেস করলে কি উত্তর দেবেন তিনি? কেদারের উদভ্রান্ত মন এ দু-দিন এসব কথা ভাববার অবকাশ পায় নি৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *