১০৭. সগরসন্তানগণের জন্মবৃত্তান্ত

১০৭তম অধ্যায়

সগরসন্তানগণের জন্মবৃত্তান্ত

লোমশ কহিলেন, “হে রাজসত্তম! মহারাজ সগর এইরূপ দৈববাণীশ্রবণানন্তর সাতিশয় শ্রদ্ধান্বিত হইয়া সেই অলাবুমধ্যস্থ বীজ ষষ্টিসহস্ৰ ভাগে বিভক্ত করিয়া পৃথক পৃথক ঘৃতকুম্ভমধ্যে সংস্থাপনপূর্ব্বক পুত্ররক্ষার্থ এক এক জন ধাত্রী নিযুক্ত করিলেন। এইরূপে বহুকাল অতীত হইলে মহাদেবের প্রসাদে সেই সমস্ত কুম্ভমধ্যে অমিততেজাঃ সগররাজের ষষ্টি-সহস্ৰ পুত্র সমুৎপন্ন হইল। তাহারা ক্রমে ক্রমে দারুণ ক্রুরকর্ম্মা ও গগনগামী হইয়া উঠিল, তাহারা একত্ৰ মিলিত হইয়া সকল লোককেই অপমান করিতে লাগিল; অধিক কি, দেব, গন্ধর্ব্ব ও রাক্ষস প্রভৃতি অমানুষ প্রাণীগণের সহিতও বিবাদ করিতে আরম্ভ করিল।

“তখন সমুদয় লোক মন্দবুদ্ধি সগর-সন্তানগণের দৌরাত্মে নিতান্ত বিরক্ত হইয়া দেববৃন্দসমভিব্যাহারে ব্রহ্মার নিকট গমনপূর্ব্বক তাহার শরণাপন্ন হইল। সর্ব্বলোকপিতামহ মহাভাগ ব্ৰহ্মা তাহাদিগকে সমাগত দেখিয়া কহিতে লাগিলেন, “হে দেবগণ! তোমরা এই সমুদয় সমুপস্থিত লোকসমভিব্যাহারে স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান কর; সগরসন্তানগণ অতি অল্পদিনমধ্যেই স্বকীয় কর্ম্মদোষে বিনষ্ট হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। দেবগণ ও অন্যান্য জনগণ ব্ৰহ্মার এইরূপ বাক্যশ্রবণানন্তর তাঁহার অনুজ্ঞা গ্রহণপূর্ব্বক স্ব স্ব নিকেতনে গমন করিলেন।

কপিল কর্ত্তৃক সগরসন্তানগণের ভস্মীকরণ

“বহুদিন অতীত হইলে সগর-রাজ অশ্বমেধ যজ্ঞে দীক্ষিত হইলেন। অনন্তর যজ্ঞের অশ্ব তদীয় সন্তানগণকর্ত্তৃক পরিরক্ষিত হইয়া ইতস্ততঃ বিচরণ করিতে করিতে ভীমদৰ্শন জলশূন্য জলনিধির অভ্যন্তরে প্রবেশ করিল। সগরসন্তানগণ সমুদ্রমধ্যে সাতিশয় প্ৰযত্নসহকারে রক্ষা করিলেও সেই অশ্ব দেখিতে দেখিতে অন্তর্হিত হইল। সগরতনয়েরা যজ্ঞের অশ্ব অপহৃত হইয়াছে মনে করিয়া পিতার নিকট আগমনপূর্ব্বক সমুদয় বৃত্তান্ত নিবেদন করিল। তখন ভূপতি স্বীয় সন্তানগণকে কহিলেন, “তোমরা সকলে সর্ব্বত্র অশ্বান্বেষণে গমন কর। সগরতনয়েরা স্বীয় পিতার আদেশানুসারে সমস্ত মেদিনীমণ্ডলে অশ্ব অন্বেষণ করিল, কিন্তু অশ্বাপহর্ত্তার [ঘোটক-চোরের] কিছুমাত্র অনুসন্ধান করিতে সমর্থ হইল না। তখন তাহারা সকলে একত্ৰ হইয়া পিতার সমীপে আগমনপূর্ব্বক কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করিল, “হে তাত! আমরা আপনার আদেশানুসারে সমুদ্র, দ্বীপ, বন, নদ, নদী, পর্ব্বত ও কন্দরসমবেত সমুদয় মেদিনীমণ্ডল পরিভ্রমণপূর্ব্বক আশ্বান্বেষণ করিয়াছি; কিন্তু কোথাও তুরগ বা তুরগাপহর্ত্তার অনুসন্ধান করিতে পারি নাই। দৈবনির্ব্বন্ধের কি অনুল্লঙ্ঘনীয় প্রভাব! সগর-মহীপতি স্বীয় পুত্ৰগণের বাক্য-শ্রবণে এককালে ক্ৰোধে অন্ধ হইয়া তাহাদিগকে কহিলেন, ‘তোমরা চিরকালের মতো বিদায় হইয়া পুনরায় অশ্বান্বেষণ কর; অশ্ব না লইয়া কদাপি প্রত্যাগমন করিবে না। সগরতনয়েরা পিতার অনুমতিক্রমে পুনরায় অশ্বান্বেষণ করিবার নিমিত্ত সমস্ত মেদিনীমণ্ডল ভ্ৰমণ করিতে লাগিল।

“অনন্তর তাহারা একদা শুষ্ক সমুদ্রমধ্যে এক গর্ত্ত নিরীক্ষণ কিরয়া কুদ্দাল প্রভৃতি অস্ত্রদ্বারা খনন করিতে আরম্ভ করিল। রত্নাকর সগরসন্তানগণের খননে চতুর্দ্দিকে বিদারিত হইয়া যৎপরোনাস্তি ব্যথিত হইল। অসুর, উরগ, রাক্ষস এবং অনেক প্রাণীগণ সগরসন্তানদিগের অস্ত্রাঘাতে একান্ত জর্জ্জরিত হইয়া আর্ত্তনাদপূর্ব্বক প্রাণত্যাগ করিতে লাগিল। শত-সহস্ৰ জন্তুগণের মধ্যে কাহার বা ছিন্ন মস্তক, কাহার বা বিদীর্ণ কলেবর, কাহার বা ভিন্ন ত্বক, কাহার বা ভগ্ন অস্থি অবলোকিত হইতে লাগিল। এইরূপে বহুকাল অতীত হইলেও তুরঙ্গমের কিছুমাত্রও অনুসন্ধান হইল না।

“তখন সগরপুত্রেরা সাতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া সমুদ্রের পূর্বোত্তরদেশ পাতাল পৰ্য্যন্ত খনন করিয়া দেখিল, ঐ স্থানে সেই অশ্ব বিচরণ করিতেছে ও অসামান্য তেজঃসম্পন্ন মহাত্মা কপিল তথায় উপস্থিত আছেন। যেমন পাবক স্বীয় শিখাদ্বারা প্রজ্বলিত হইতে থাকে, তদ্রূপ মহাত্মা কপিল স্বীয় তেজোরাশিদ্বারা প্ৰদীপ্ত হইয়া রহিয়াছেন। কালপ্রেরিত সগরসন্তানগণ তুরঙ্গম-সন্দর্শনে সাতিশয় পুলকিত ও লোমাঞ্চিতকলেবর হইয়া ক্ৰোধাভরে মহাত্মা কপিলকে অনাদর করিয়া অশ্ব গ্রহণ করিতে ধাবমান হইল। তখন সাক্ষাৎ বাসুদেবস্বরূপ প্রভাবশালী মুনিসত্তম কপিল কোপকম্পিত-কলেবরে নয়ন বিকৃত করিয়া সেই মন্দবুদ্ধি সগরসন্তানগণকে তেজোদ্বারা ভস্মীভূত করিলেন।

সগরের স্বতনয় অসমঞ্জার পরিত্যাগ

“মহাতপাঃ নারদ তাহাদিগকে ভস্মীভূত দেখিয়া সগরের নিকট গমনপূর্ব্বক সমুদয় বৃত্তান্ত বর্ণনা করিলেন। মহারাজ সগর মহর্ষি নারদমুখে সেই মর্ম্মচ্ছেদী বৃত্তান্ত শ্রবণানন্তর ক্ষণকাল বিমনার ন্যায় হইয়া মহাদেবের বাক্য চিন্তা করিলেন এবং পরিশেষে নিজ তনয় অসমঞ্জার পুত্র অংশুমানকে আহ্বান করিয়া কহিতে লাগিলেন, “বৎস! সেই ষষ্টিসহস্ৰ তনয় আমার নিমিত্তই কপিলের কোপানলে দগ্ধ হইয়াছে; আমি আপনার ধর্ম্মরক্ষা ও পৌরগণের হিতকামনায় তোমার পিতা অসমঞ্জাকে পরিত্যাগ করিয়াছি।’ ”

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে তপোধন! নৃপতিশ্রেষ্ঠ সগর কি নিমিত্ত নিতান্ত দুস্ত্যোজ্য স্বীয় আত্মজকে পরিত্যাগ করিলেন, আপনি তাহা সবিশেষ বর্ণন করুন।”

লোমশ কহিলেন, “হে রাজন! শৈব্যার গর্ভে অসমঞ্জা নামে মহারাজা সগরের এক পুত্র জন্মিয়াছিল। অসমঞ্জা পুরবাসীদিগের রোরুদ্যমান দুর্ব্বল বালকগণের গলদেশ ধারণ করিয়া নদীনীরে নিক্ষেপ করিত। তাহাতে পৌরগণ ভয়ে ভীত ও শোকে একান্ত অভিভূত হইয়া মহারাজা সগরের সমীপে গমনপূর্ব্বক কৃতাঞ্জলিপুটে কহিল, “হে মহারাজ! আপনি আমাদিগকে সমুদয় ভয় হইতে পরিত্রাণ করিয়া থাকেন। এক্ষণে আমরা ভবদীয় পুত্ৰ অসমঞ্জার ভয়ে নিতান্ত ভীত হইয়াছি, আপনি আমাদিগকে পরিত্রাণ করুন।’ নৃপতিসত্তম সগর পৌরবর্গের সেই দারুণবাক্য শ্রবণানন্তর ক্ষণকাল বিমনার ন্যায় চিন্তা করিয়া স্বীয় মন্ত্রিগণকে কহিলেন, “হে সচিবগণ! যদি তোমরা আমার প্রিয়ানুষ্ঠান করিতে বাঞ্ছা কর, তবে ত্বরায় অসমঞ্জাকে নগর হইতে নির্ব্বাসিত কর।” সচিবগণ মহারাজের আদেশানুসারে তৎক্ষণাৎ অসমঞ্জাকে নগর হইতে বহির্গত করিলেন। হে ধর্ম্মরাজ! পৌরগণহিতৈষী মহাত্মা সগর যে নিমিত্ত আপনার পুত্ৰকে পরিত্যাগ করিয়াছিলেন, তাহা কহিলাম; এক্ষণে তিনি মহাবল পরাক্রান্ত অংশুমানকে যাহা কহিয়াছিলেন, শ্রবণ করুন।

“সাগর-মহীপতি কহিলেন, “হে বৎস! আমি তোমার পিতার পরিত্যাগ, অপর ষষ্টিসহস্র পুত্রের নিধন ও যজ্ঞার্থের অলাভনিবন্ধন মনস্তাপে নিতান্ত পরিতপ্ত ও যজ্ঞবিঘ্ন নিমিত্ত মোহিতপ্রায় হইয়াছি; অতএব তুমি অশ্বানয়নপূর্ব্বক আমাকে নরক হইতে বিমুক্ত কর।”

অংশুমানের কপিলাসমীপে গমন-যজ্ঞশ্বলাভ

“অংশুমান মহাত্মা সগরের বাক্য-শ্রবণে যৎপরোনাস্তি ব্যথিত হইয়া সগরসন্তানকর্ত্তৃক নিখাত প্রদেশে গমনপূর্ব্বক পূর্ব্বপ্রকাশিত পথদ্বারা সাগরতলে প্রবেশপূর্ব্বক অবলোকন করিলেন, পুরাণ ঋষিসত্তম মহাত্মা কপিল তথায় উপবিষ্ট আছেন; যজ্ঞশ্ব তাঁহার নিকটে রহিয়াছে। তখন তিনি ভক্তিভাবে মহর্ষির চরণে প্ৰণিপাতপূর্ব্বক তাঁহাকে আপনার আগমন-প্রয়োজন নিবেদন করিলেন। মহর্ষি কপিল অংশুমানের প্রতি পরম পরিতুষ্ট হইয়া তাঁহাকে কহিলেন, “হে ভারতবংশাবতংস! আমি তোমাকে বরপ্রদান করিতেছি, গ্রহণ কর।” তখন অংশুমান প্রথমে সেই যজ্ঞীয় তুরঙ্গম, তৎপরে পিতৃলোকদিগের উদ্ধার এই দুই বর প্রার্থনা করিলেন। মহাতেজাঃ মুনিপুঙ্গব কপিল কহিলেন, “হে অনঘ! তুমি যে দুইটি বর প্রার্থনা করিলে, আমি তোমাকে তাহা অবশ্য প্ৰদান করিব। তুমি অসাধারণ ভাগ্যশালী মানব; ক্ষমা, ধর্ম্ম ও সত্য তোমাতেই প্রতিষ্ঠিত আছে। সগর-রাজ তোমা হইতে কৃতাৰ্থ ও তোমার পিতা তোমাকে লাভ করিয়াই যথার্থ পুত্রবান হইয়াছেন; তোমার প্রভাবেই সগরসন্ততিসকল স্বৰ্গলাভ করিবে। তোমার পৌত্র সগরসন্তানগণের পরিত্ৰাণ নিমিত্ত দেবাদিদেব মহাদেবকে পরিতুষ্ট করিয়া স্বৰ্গ হইতে সুরধুনীকে মর্ত্যলোকে আনয়ন করিবে। হে নরপুরুষ! তোমার মঙ্গল হউক, এক্ষণে এই যজ্ঞশ্ব গ্রহণপূর্ব্বক স্বচ্ছন্দে সাগরসমীপে উপস্থিত হইয়া যজ্ঞ সমাপন কর।’

“অংশুমান মহাত্মা কপিলের বাক্য-শ্রবণানন্তর অশ্ব গ্রহণপূর্ব্বক যজ্ঞাঙ্গনে আগমন করিয়া সগরের চরণবিন্দন করিলেন। মহাত্মা সগর তাঁহার মস্তকাঘ্রাণ করিলে তিনি তখন সাগরসমীপে তদীয় সন্তানগণের বিনাশবৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত সমস্ত যথাবৎ বর্ণন করিয়া কহিলেন, “মহারাজ! যজ্ঞভূমিতে যজ্ঞশ্ব আনীত হইয়াছে।”

“মহারাজ সগর তৎসমুদয় শ্রবণপূর্ব্বক পুত্ৰশোক বিস্মৃত হইয়া অংশুমানকে পরমসমাদরপূর্ব্বক নির্ব্বিঘ্নে যজ্ঞ সমাপন করিলেন। অনন্তর তিনি সমুদয় দেবগণকর্ত্তৃক সম্মানিত হইয়া সমুদ্রকে স্বীয় পুত্রত্বে কল্পনা করিলেন। এইরূপে বহুকাল রাজ্যপালন করিয়া পরিশেষে স্বীয় পৌত্র অংশুমানের হস্তে সমুদয় রাজ্যভার ন্যস্ত করিয়া স্বর্গে গমন করিলেন। ধর্ম্মাত্মা অংশুমানও স্বীয় পিতামহের পদবী অনুসরণ করিয়া সসাগরা ধরা শাসন করিতে লাগিলেন। এইরূপে কিছুদিন অতীত হইলে দিলীপনামে তাঁহার এক পুত্ৰ জন্মিল, পরে তিনি পুত্ৰহস্তে রাজ্যভার সমর্পণ করিয়া পরলোকে যাত্ৰা করিলেন।

“দিলীপ-ভূপতি পূর্ব্বপুরুষদিগের সেই নিদারুণ নিধনবার্ত্তাশ্রবণে সাতিশয় সন্তপ্ত হইয়া তাঁহাদের সদগতিলাভের নিমিত্ত ভূতলে ভাগীরথীকে আনয়ন করিতে বহুবিধ প্ৰযত্নসহকারে সাধ্যানুসারে চেষ্টা করিলেন; কিন্তু কোনক্রমেই কৃতকাৰ্য্য হইতে পারিলেন না। কালক্রমে ভগীরথনামে দিলীপের এক পুত্ৰ জন্মিলেন। ঐ পুত্ৰ সাতিশয়, শ্ৰীমান, ধর্ম্মপরায়ণ, সত্যবাক ও অসূয়াশূন্য ছিলেন। দিলীপ তাঁহাকে রাজ্যে অভিষিক্ত করিয়া অরণ্যে প্রস্থান করিলেন এবং তথায় কালক্রমে তপঃসিদ্ধি লাভ করিয়া পরিশেষে সুরপুরে গমন করিলেন।