০১৫. সৌভধ্বংস-শাল্ববধবৃত্তান্ত

১৫শ অধ্যায়

সৌভধ্বংস-শাল্ববধবৃত্তান্ত

যুধিষ্ঠির কহিলেন, হে মহাবাহো! সৌভবধের সংক্ষেপবৃত্তান্ত শ্রবণে আমার মন একান্ত অপরিতৃপ্ত হইয়াছে, অতএব সবিস্তরে কীর্ত্তন কর।”

শ্ৰীকৃষ্ণ কহিলেন, “হে ভরতবংশাবতংস! দুরাত্মা শাল্ব, আমি শ্রুতিশ্রবার তনয়কে বিনাশ করিয়াছি শ্রবণ করিয়া, দ্বারাবতীনগরে আগমন করিল। দুরাত্মা দানব সেই আকাশগামী সৌভপুরীতে ব্যূহসংস্থাপনপূর্ব্বক স্বয়ং তন্মধ্যে থাকিয়া দ্বারকার চতুর্দ্দিক অবরোধ করিয়া বলপূর্ব্বক ঘোরতর সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইল। আমাদের দ্বারকাপুরী চতুর্দ্দিকে পতাকা, তোরণ, উপশল্য, রথ্যা, অট্টালিকা ও গোপুর প্রভৃতি নগর-শোভাসম্পাদক মনোহর দ্রব্যজাতে সুশোভিত; চক্ৰ, লগুড়, তোমর, অঙ্কুশ, শতয়ী, লাঙ্গল, ভুমুখী, অশ্নগুড়ক, খড়গ, চর্ম্ম ও পরশু প্রভৃতি অস্ত্ৰ-শস্ত্ৰে সুসজ্জিত এবং ভেরী, পণব, ঢাক্কা প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রে সমাকীর্ণ ও শাস্ত্রদৃষ্ট বিধি অনুসারে সর্ব্বতোভাবে সংরক্ষিত হইল। গদ, শাম্ব, উদ্ধব প্রভৃতি অরিনিবারণসমর্থ বিখ্যাতকুলপ্রসূত ও প্রদর্শিতবিক্রম বীরপুরুষগণ বহুবিধ রথ, পতাকা, অশ্ব ও সৈন্য লইয়া সর্ব্বদা ঐ পুরী রক্ষা করিতে লাগিলেন। কামচারী সৌভপুরের সমাগম হওয়াতে, প্ৰমত্ত থাকিলে নরাধিপ শাল্ব নিশ্চয়ই পরাভব করিবে, ইহা বিবেচনা করিয়া উগ্রসেন, উদ্ধব প্রভৃতি বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশীয় সমস্ত প্রাসাদরক্ষক বীরপুরুষগণ সুরাপান নিষেধ করিয়া দিলেন এবং অহোরাত্র অপ্ৰমত্ত ও সর্ব্বদা সাবধান হইয়া রহিলেন। দ্বারকাস্থ সমস্ত নট এবং নর্ত্তক ও গায়কগণকে তাহাদের চিরসঞ্চিত ধনের সহিত অতি যত্নপূর্ব্বক নগর হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিয়া সমুদয় সংক্রম [সেতু—পোল, সাঁকো প্রভৃতি] ভগ্ন, নৌকায় গমনাগমন প্রতিষিদ্ধ ও সমুদয় পরিখা উত্তমরূপে বজ্রসম কীলায়িত [অর্গল [হুড়কো]-যুক্ত— কপাটদ্বারা রুদ্ধ] হইল। চতুর্দ্দিকে অতি গভীর কূপ ও ক্রোশব্যাপী নানাবিধ নিবিড় মহীরুহ দ্বারা সেই স্থান দুরধিগম্য ও অনাক্রমণীয় হইয়া উঠিল। আমাদের দুর্গ সহজেই দুৰ্গম, সুরক্ষিত ও অস্ত্ৰ-শস্ত্ৰে পরিপূর্ণ, তাহাতে আবার তৎকালে বিশেষরূপে সজ্জিত ও বীরগণকর্ত্তৃক সংরক্ষিত হওয়াতে ইন্দ্রভবনের ন্যায় শোভমান হইতে লাগিল। তৎকালে কেহই সঙ্কেত-মুদ্রা [গমনাগমনের অনুজ্ঞাসূচক লিপি—ছাড়পত্র] প্রদর্শন না করিয়া নগরে প্রবিষ্ট বা তথা হইতে বহির্গত হইতে পারিত না। সমুদয় রথ্যা, অনুরথ্যা ও চত্বরে প্রভূত হস্ত্যশ্বসম্পন্ন দৃষ্টপরাক্রম সৈন্যসমূহ সমবহিত হইয়া সমুপস্থিত রহিল। সৈন্যগণকে যথানিয়মে বেতন, অস্ত্ৰ-শস্ত্র ও পরিচ্ছদ প্ৰদান করিয়া অতি যত্নপূর্ব্বক প্রণয়সহকারে নিযুক্ত করা হইয়াছিল। সুবর্ণ বা রৌপ্য ভিন্ন কাহারও বেতন ছিল না। অনুগ্রহ করিয়া বা বেতন না লইয়া কেহ কর্ম্ম করিত না ও সকলেরই পরাক্রম দর্শন করিয়া নিযুক্ত করা গিয়াছিল। হে মহারাজ! নরপতি আহুক এইরূপে অবিখ্যাত সমৃদ্ধিশালী দ্বারকানগর তৎকালে রক্ষা করিয়াছিলেন।”