০০৭. ধৃতরাষ্ট্রসমীপে বিদুরাগমনে দুর্য্যোধনের দুশ্চিন্তা

৭ম অধ্যায়

ধৃতরাষ্ট্রসমীপে বিদুরাগমনে দুর্য্যোধনের দুশ্চিন্তা

বৈশম্পায়ন কহিলেন, এ দিকে দুর্ম্মতি দুৰ্য্যোধন পুনরায় বিদুর আসিয়াছেন এবং ধৃতরাষ্ট্র তাঁহাকে সান্ত্বনা করিয়াছেন শুনিয়া যৎপরোনাস্তি পরিতপ্ত হইল। মহামোহে অভিভূত দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন শকুনি, কর্ণ ও দুঃশাসনকে আনয়ন করিয়া কহিতে লাগিল, “ঐ দেখ, ধৃতরাষ্ট্ৰ-মন্ত্রি বিদ্বান বিদুর আসিয়াছেন। উনি পাণ্ডুপুত্ৰগণের পরম সুহৃৎ ও একান্ত হিতৈষী, উনি যে পৰ্য্যন্ত পিতাকে পাণ্ডবানয়নে কৃতনিশ্চয় না করেন, তাবৎ আমার হিতমন্ত্রণা কর। হে সুহৃদগণ! যদি আমি পাণ্ডবগণকে পুনরায় এখানে আগত দেখি, তাহা হইলে নিতান্ত সন্তপ্ত ও একান্ত মূর্চ্ছিত হইব সন্দেহ নাই। অধিক কি বলিব, বরং উদ্বন্ধন, বিষ, শস্ত্র বা অগ্নি দ্বারা প্ৰাণ পরিত্যাগ করিব, তথাপি তাহাদিগকে সম্পত্তিশালী দেখিতে পারিব না।”

তখন শকুনি দুৰ্য্যোধনকে কহিলেন, “হে রাজন! তুমি কি নিমিত্ত নিতান্ত মূঢ়ের ন্যায় এইরূপ অনিষ্টচিন্তা করিতেছ? পাণ্ডবগণ সকলেই সত্যপরায়ণ, তাহারা যখন প্রতিশ্রূত হইয়া গিয়াছে, তখন কদাচ তোমার পিতার অনুরোধে এখানে আসিবে না। তবে যদিও তাহারা মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের বচনানুরোধে স্বীয় প্ৰতিজ্ঞা ভঙ্গ করিয়া এখানে আইসে, তাহা হইলে আমরা সকলে একমত হইয়া মহারাজের অভিপ্ৰায়ানুসারে গোপনে কেবল পাণ্ডবগণের ছিদ্রান্বেষণে তৎপর হইব।”

তখন দুঃশাসন শকুনিকে সম্বোধন করিয়া কহিল, “হে মহাপ্রাজ্ঞ মাতুল! আপনি যাহা যখন কহেন, তাহা আমার নিতান্ত উপযুক্ত ও বুদ্ধিবৃত্তির একমাত্ৰ কাৰ্য্য বলিয়া বোধ হয়।”

কৰ্ণ কহিলেন, “হে রাজন! আমরা সকলেই ঐকমত্য ধু অবলম্বনপূর্ব্বক তোমার অভীষ্ট চিন্তা করিতেছি। তাহারা আপনাদিগের প্রতিজ্ঞা পূর্ণ না করিয়া কদাচ আসিবে না, যদিও মোহপ্রযুক্ত হইয়া আইসে, তাহা হইলে পুনরায় তাহাদিগকে কপটদ্যূতে পরাজয় করা যাইবে।”

পাণ্ডবনিধনে কৌরবগণের উদ্‌যোগ

রাজা দুৰ্য্যোধন কর্ণের এই বাক্য শ্রবণ করিয়া অনতিহৃষ্টমনে পরাঙ্মুখ হইলেন। তখন কৰ্ণ দুৰ্য্যোধনের অভিপ্রেত বুঝিতে পারিয়া ক্ৰোধবিস্মফারিতলোচনে দুঃশাসন, শকুনি ও দুৰ্য্যোধনকে কহিলেন, “হে ভূপতিগণ! তোমরা আমার পূর্বোক্ত বাক্যে অসম্মত হইয়াছ, এক্ষণে আমার আর এক মত শ্রবণ করা। আমরা কিঙ্করের ন্যায় মহারাজের প্রিয়কাৰ্য্য সম্পাদন করিব, উহার অধীন না হইলে কখনই প্রিয় হইতে পারিব না। এক্ষণে চল, সকলে একত্ৰ হইয়া বর্ম্মধারণ ও অস্ত্ৰ-শস্ত্র গ্রহণপূর্ব্বক রথারোহণ করিয়া কাননস্থ পাণ্ডবগণকে নিধন করিতে গমন করি। পাণ্ডবগণ শমনভবনে গমন করিলে উভয় কুলের মধ্যে আর কোন বিবাদ থাকিবে না। যে পৰ্য্যন্ত পাণ্ডবগণ ব্যথিত, শোকযুক্ত ও মিত্ৰবিহীন থাকে, তাবৎ আমার এই মতানুসারে কর্ম্ম করিতে পরিবে।” দুৰ্য্যোধন, শকুনি ও দুঃশাসন কর্ণের এই বাক্য-শ্রবণে যৎপরোনাস্তি সন্তুষ্টচিত্তে বারংবার ঐ বাক্যের প্রশংসা করিয়া তাহাতে অনুমোদন করিল এবং ক্রোধাভরে পৃথক পৃথক রথে আরোহণপূর্ব্বক পাণ্ডবগণকে বিনাশ করিতে চলিল।

তাহারা প্রস্থান কিরলে মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন দিব্যচক্ষুদ্বারা বৃত্তান্ত অবগত হইয়া তাহাদিগের নিকট আগমনপূর্ব্বক নিবারণ করিলেন। পরিশেষে প্রজ্ঞাচক্ষু ধৃতরাষ্ট্রের সমীপে উপস্থিত হইয়া কহিতে লাগিলেন।