১০
ঘটনাটা সম্ভবত ২০১০ সালের বইমেলার। এরপর ২০১১ এবং ২০১২ সালের বইমেলা পার হয়ে যাওয়ায় আমি সালটা সঠিকভাবে মনে করতে পারছি না। তবে যতদূর মনে পড়ে সময়টা ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসই হবে। ঐ বছর বইমেলার যে দিনটির কথা আমি বলতে চাচ্ছি সেই দিনটি কি বার ছিল আমার সঠিকভাবে মনে নেই। সম্ভবত শুক্র কিংবা শনিবার। কারণ ঐ দিন আমি সিভিলে ছিলাম (ইউনিফর্ম পরা ছিলাম না)। সঠিক সময়টাও আমার খেয়াল নেই, দুপরের আগে কিংবা ঠিক পরে হবে। ২০১০ সালের শুরু থেকে আমি ওয়ারি ডিভিশনের এডিসির দায়িত্বে ছিলাম। তখন ব্যস্ততার কারণে বইমেলায় আসার সময় বের করা কঠিন হয়ে পড়ত। এজন্য সুযোগ পেলেই চলে আসতাম। ঐ সময় মেলার অধিকাংশ পুলিশ সদস্য আমাকে চিনত। এর কারণ ২০০৯ সালে আমি রমনা ডিভিশনের এডিসির পদে দায়িত্বরত ছিলাম। এজন্য মেলায় গেলে পরিচিত কারো না কারো সাথে দেখা হয়ে যেত এবং সে আমার সাথে হাঁটতে শুরু করত। অনেককে নিষেধ করলেও শুনত না। ব্যাপারটা আমার পছন্দ হতো না বিধায় আমি মেলার মধ্যে অধিকাংশ সময় ইউনিফর্ম পরিহিত পুলিশ সদস্যদের এড়িয়ে চলতাম এবং অফিসিয়াল ডিউটি ছাড়া ইউনিফর্ম পরে যেতাম না।
ঐ দিন আমি বইমেলায় হাঁটছিলাম আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলাম। বইমেলায় প্রবেশ করলে আমি প্রথম কিছুক্ষণ হাঁটি, তারপর কোথাও গিয়ে বসি। বইমেলায় একা একা হাঁটতে আমার খুব ভালো লাগে। সবাই বই দেখে আর আমি দেখি বই কেনা মানুষগুলোকে। বিশেষ করে ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের। বই কিনে তারা কত আনন্দিত। আর যারা জাফর ইকবাল স্যারের বই কিনে তাদের আনন্দ আরও বেশি। জাফর ইকবাল স্যার যখন অটোগ্রাফ দেন তখন আমি প্রায়ই তার পাশে শিশু কিশোরদের ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকি। স্যারের একটা অটোগ্রাফ একটা শিশুকে কতটা খুঁশি করে তা না দেখলে বোঝা যাবে না।
আমি হাঁটতে হাঁটতে উত্তর দিকের মূল গলিতে ঢুকে গেলাম। এই গলির শেষ মাথায় অন্য। প্রকাশের স্টল। গত কয়েক বছর ধরে হুমায়ূন আহমেদের প্রায় সব বই অন্য প্রকাশ থেকেই প্রকাশিত হচ্ছে। অন্য প্রকাশের সামনে সবসময় ভীড় থাকে। ঐ দিন আমার কাছে মনে হচ্ছিল ভীড় একটু যেন বেশিই। আমি আরও কাছে যেতে বুঝলাম ভীড় না, লম্বা লাইন। তবে লাইনটা একপাশে, সম্পূর্ণ স্টলের সামনে না। কেন এমন লাইন আমার খুব জানতে ইচ্ছে হলো। কাছে গিয়ে লাইনের পিছনের লোককে জিজ্ঞেস করতে সে জানাল, ভিতরে হুমায়ূন আহমেদ আছেন। তিনি সবাইকে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন।
কথাটা শোনমাত্র আমার বুকটা ধক করে উঠল। মনে পড়ল হুমায়ূন আহমেদকে দেখার জন্য কত চেষ্টাই না করেছি। খুলনার সার্কিট হাউস মাঠে গিয়েছি, হুমায়ূন আহমেদের কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে গিয়েছি, মোকাররম ভবনে গিয়েছি, একটা অটোগ্রাফের জন্য মেলার মধ্যে সারাদিন হেঁটে বেড়িয়েছি। অথচ কখনোই আমি হুমায়ূন আহমেদের সাথে দেখা করতে পারিনি। সেই হুমায়ূন আহমেদ কিনা এখন ঠিক আমার সামনে! মাত্র বিশ পঁচিশ গজ দূরে! ভাবতেই আমার শরীরে ভালোলাগার শিহরণ বয়ে গেল।
ঐ মুহূর্তে আমি যে কি করব ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সামনে স্টলের দিকে তাকালাম। যেখানে হুমায়ূন আহমেদ বসে আছেন সেখানে খুব ভীড়। এত দূর থেকে তাকে দেখা যাচ্ছে না। মানুষের ভীড় ঠোকানো এবং লাইন ঠিক করে দেয়ার জন্য দুপাশে পুলিশও আছে। পুলিশ দেখে আমি কিছুটা দমে গেলাম, আমাকে আবার চিনে না ফেলে।
ঠিক করলাম, যাই হোক না কেন আমি আজ হুমায়ূন আহমেদের একটা বই কিনে সেটাতে অটোগ্রাফ নেব। এজন্য লাইনে দাঁড়ালাম। আমার অবস্থান সবার পিছনে। লাইন এক ইঞ্চি ইঞ্চি করে সামনের দিকে এগোচ্ছে। সম্ভবত হুমায়ূন আহমেদ অটোগ্রাফ দিচ্ছেন এবং পাঠকদের সাথে কথা বলছেন। সকল লেখকই এটা করে থাকেন। এতে পাঠক যেমন খুশি হন, লেখকও আনন্দ পান।
হুমায়ূন আহমেদের সামনে গিয়ে আমি যে বইটা পাব সেটাই কিনব ঠিক করলাম। তবে লক্ষ্য করলাম যারা লাইনে দাঁড়িয়েছে সবার হাতেই হুমায়ূন আহমেদের বই। অর্থাৎ সবাই বই কিনে ফেলেছে। বই কিনে লাইনে দাঁড়াতে হয়। আমি ঐ বছরের হুমায়ূন আহমেদের সকল বই আগেই কিনে ফেলেছিলাম। আবার বই কিনতে যেতেও ইচ্ছে করছিল না। কারণ তাহলে আমাকে। নতুনভাবে লাইনে দাঁড়াতে হবে, এতে অনেক সময় লাগবে। তাই লাইনেই দাঁড়িয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। যদি প্রয়োজন হয় নিজের পরিচয় দিয়ে হলেও হুমায়ূন আহমেদের অটোগ্রাফ নেব– এটাই মনে মনে ঠিক করলাম। হুমায়ূন আহমেদ পুলিশ অফিসারদের প্রতি কিছুটা নমনীয় ভাব প্রকাশ করেন বলে জেনেছিলাম। কারণ তার বাবা ছিলেন পুলিশ অফিসার এবং ১৯৭১ সালে পিরোজপুরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন। হুমায়ূন আহমেদ যে পুলিশ অফিসারদের পছন্দ করেন তার একটা ঘটনা আমি রমনা ডিভিশনের ডিসি আতিক স্যারের কাছ থেকে শুনেছিলাম। আতিক স্যার রমনা ডিভিশনে বদলী হওয়ার আগে গাজীপুরের পুলিশ সুপার বা এসপি পদে দায়িত্বরত ছিলেন। ঐ সময় হুমায়ূন আহমেদ নুহাশ পল্লীতে বাইরের কোনো মানুষকে ভিতরে যাওয়ার খুব একটা অনুমতি দিতেন না। একদিন আতিক স্যার হুমায়ূন আহমেদের সাথে দেখা। করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে হুমায়ূন আহমেদ আতিক স্যারের সম্পূর্ণ পরিবারকেই দাওয়াত করেন। আতিক স্যার, ভাবী আর তার দুই মেয়েসহ নুহাশ পল্লীতে গেলে হুমায়ূন আহমেদ নিজে তাদের আপ্যায়ন করেছিলেন। কথা প্রসঙ্গে তিনি তাঁর বাবার স্মৃতিচারণ করে আতিক স্যারকে ‘জোছনা ও জননী’ বইটি অটোগ্রাফসহ উপহার দিয়েছিলেন। আমি রমনা ডিভিশিনের এডিসি থাকার সময় আতিক স্যার নিজে আমাকে ঘটনাটি বলেছিলেন। আতিক স্যারের ঐ ঘটনাটি আমাকে আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে।
আমি যখন পাঁচ সাত গজ এগিয়েছে তখন হঠাই চার পাঁচজন উচ্ছঙ্খল ছেলে লাইন ভেঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করল। সাথে সাথে শুরু হলো ধাক্কাধাক্কি আর চিৎকার চেঁচামেচি। তখন দায়িত্বরত পুলিশ ছেলেদের ধাক্কা দিয়ে সরাতে চেষ্টা করতে ছেলেগুলো দ্রুত সামনে থেকে কেটে পড়ল। আর তাতে সামনে যে ফাঁকা জায়গার সৃষ্টি হলো তাতে মাত্র এক ঝলক আমি হুমায়ূন আহমেদকে দেখতে পেলাম। মুহূর্তের জন্য যে হুমায়ূন আহমেদকে আমি দেখেছিলাম। তার অবয়বটা খুব সাধারণ ছিল। তিনি অবাক চোখে সামনে তাকিয়ে আছেন, তার হাতে একটা কলম। তারপর আবার তিনি হারিয়ে গেলেন ভিড়ের আড়ালে। হুমায়ূন আহমেদকে ঐ এক ঝলক দেখে আমি সত্যি অভিভূত হয়েছিলাম। হুমায়ূন আহমেদকে ঐ এক ঝলক দেখার আনন্দ আমি কোনোদিনও কাউকে বোঝাতে পারব না। ঐ মুহূর্তটা ছিল আমার জীবনের এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। জানি না বাংলা ভাষায় এ ধরণের মুহূর্তকে ব্যক্ত করার জন্য কোনো শব্দ আছে কিনা। থাকলে সেটাই আমি ব্যবহার করতাম। ইংরেজিতে এরকম মুহূর্তকে ব্যক্ত করার জন্য কেউ কেউ Magic Moment শব্দটা ব্যবহার করেন। হয়তো ঐ মুহূর্তটা সত্যি আমার জীবনের Magic Moment ছিল।
এরপর আবার লাইন ঠিক করা হলো। আবার আমরা অটোগ্রাফের জন্য লাইনে দাঁড়ালাম। এর মাঝে গন্ডগোলের কথা শুনে অনেক পুলিশ চলে এসেছে। এই পুলিশদের মধ্যে একজন সাব ইন্সপেক্টর আমাকে চিনে ফেলল। সে আমাকে স্যালুট করে বলল, স্যার আপনি এখানে এই লাইনে কেন?
আমি খুব বিব্রত হলাম। নিচু গলায় বললাম, আমি অটোগ্রাফের জন্য এসেছি। আপনি এখন যান।
আপনি হুমায়ূন স্যারের অটোগ্রাফ নিবেন! আমরা থাকতে লাইনে দাঁড়াবেন কেন? আসুন স্যার আসুন। আমি আপনাকে অটোগ্রাফ নেয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
আশে পাশের সবাই তখন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। খুবই অস্বস্তিকর অবস্থা। তাড়াতাড়ি বললাম, আপনি এখন আপনার কাজ করুন। আমি লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেই অটোগ্রাফ নেব।
সাব-ইন্সপেক্টর আরও জোর দিয়ে বলল, না স্যার, তা হয় না। আপনি আমাদের এই এলাকার এডিসি ছিলেন। আমরা থাকতে আপনি দাঁড়িয়ে অটোগ্রাফ নেবেন, তা কখনও হতে পারে না।
আমার তখন সত্যি রাগে গা জ্বলছিল। অনেক কষ্টে নিজের রাগটা নিয়ন্ত্রণ করলাম। সাব ইন্সপেক্টর বেচারা যা করছে তা আমাকে ভালোবেসেই করছে। এসময় তাকে কড়া কথা শোনান। মানে তাকে অপমান করা। বুঝতে পারলাম লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার অবস্থা আর নেই। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলে শুধু আশেপাশের মানুষই না, আশেপাশের সকল পুলিশও আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে।
তাই আমি লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লাইন থেকে বের হয়ে এলাম। শেষবার হুমায়ূন আহমেদকে দেখার জন্য একবার স্টলের দিকে তাকালাম। না, ভক্তের ভীড়ের কারনে হুমায়ূন আহমেদকে আর দেখা গেল না। আমি উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করলাম। সাব-ইন্সপেক্টর বুঝতে পেরেছিল আমি রাগ করেছি। অনেক কষ্টে তাকে বুঝলাম আমি রাগ করিনি। আরও বললাম পরে যখন অটোগ্রাফ নিতে আসব, অবশ্যই আগে তাকে জানিয়ে আসব।
মেলার বাইরে আসতে নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিলাম যে, এক ঝলকের জন্য হলেও আমি হুমায়ূন আহমেদকে দেখতে পেয়েছি। আজকের জন্য এই প্রাপ্তিটাও কম কিসের? আমি তো আশাই করিনি যে হুমায়ূন আহমেদকে আমি আজ দেখতে পাব। এই এক ঝলক হুমায়ূন আহমেদকে দেখা, জীবনে না দেখা হুমায়ূন আহমেদের থেকে নিশ্চয় অনেক…অনেক…অনেক বড় প্রাপ্তি!
১১
২০১২ সালের ১৮ জুলাই। আমি তখন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ইন্টেলিজেন্স এন্ড এনালাইসিস ডিভিশনের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার পদে কর্মরত। ঐ সময় আমি সত্যি খুব ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলাম। কারণ দুই সপ্তাহের মধ্যে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণের জন্য সুদানের দাফুরে যেতে হবে। এজন্য অফিসের অসমাপ্ত কাজগুলো খুব দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু নানা ব্যস্ততার জন্য কাজগুলো শেষ হচ্ছিল না। দিন যত যাচ্ছিল ব্যস্ততা যেন তত বাড়ছিল। এজন্য সত্যি বেশ হাঁপিয়ে উঠছিলাম।
ঐ দিন দুপুর আনুমানিক দুইটার দিকে অপারেশনস্ অফিসার সার্জেন্ট সাজ্জাদ শর্ট এডভান্স রিপোর্টটা (SAR) আমার টেবিলে উপস্থাপন করল। ইন্টেলিজেন্স বিভাগের একটা বিশেষ দায়িত্ব হলো আগামীকাল কি ঘটবে বা ঘটতে পারে সে সম্পর্কে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনারকে শর্ট এডভান্স রিপোর্টের মাধ্যমে অবহিত করা। এই রিপোর্টের নিচে আগামী সাত দিনে কি ঘটবে সে সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো উল্লেখ করা থাকে। এরকমই একটা তথ্যের উপর আমার চোখ আটকে গেল। সেখানে লেখা, বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অবস্থা সংকটাপন্ন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বেলভিউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। লেখাটার পাশে কোনো মন্তব্য নেই।
হুমায়ূন আহমেদ যে অপারেশনের পর অসুস্থ হয়ে পূনরায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তা
আমি জানতাম। তবে রিপোর্টটা কখনও শর্ট এডভান্স রিপোর্টটে আগে অন্তর্ভূক্ত হয়নি। সংবাদটা দেখে আমি সার্জেন্ট সাজ্জাদকে বললাম, হুমায়ূন আহমেদের অসুস্থতার সংবাদটা এখানে অন্তর্ভূক্ত করেছেন যে?
সার্জেন্ট সাজ্জাদ বলল, স্যার সার্বিক বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হচ্ছে যে এবার হুমায়ূন আহমেদের শারীরিক অবস্থা সত্যি খুব খারাপ।
তাই নাকি?
জি স্যার। আমি খুব ভয়ে আছি।
কেন?
সত্যি যদি কিছু ঘটে যায়!
আমি সার্জেন্ট সাজ্জাদের চোখে তাকিয়ে বললাম, আশা করি কিছু ঘটবে না।
স্যার আপনি কীভাবে বলছেন?
হুমায়ূন আহমেদ অনেক উঁচু মানসিক শক্তির অধিকারী। যেহেতু তার অপারেশন হয়ে গিয়েছে, বলতে পারেন বড় ধকলটা কেটে গেছে। ছোট-খাট অসুখ তাকে কাবু করতে পারবে না। আমি নিশ্চিত তিনি আরও অনেকদিন বাঁচবেন। তার এই বেঁচে থাকাটা আমাদের সবার জন্য খুব প্রয়োজন।
কিন্তু স্যার..
কোনো কিন্তু নয়। আমি এই প্রতিবেদনে হুমায়ূন আহমেদের জীবন সম্পর্কে কোনো মন্তব্য। করতে চাই না।
আমি কি তাহলে সংবাদটা বাদ দিয়ে দেব?
হ্যাঁ বাদ দিয়ে দিন। তবে আমাকে আপডেট জানাবেন।
কথাটা বলে আমি নিজেই লাল কালি দিয়ে সংবাদটা শর্ট এডভান্স রিপোর্ট থেকে কেটে দিলাম। কারণ কেন যেন আমি খুব আত্মবিশ্বাসী ছিলাম যে হুমায়ূন আহমেদ সত্যি সুস্থ হয়ে আবার দেশে ফিরে আসবেন।
সার্জেন্ট সাজ্জাদ আমার রুম থেকে চলে যাওয়ার পর নালন্দা প্রকাশনীর স্বত্ত্বাধিকারী জুয়েল ভাইয়ের ফোন পেলাম। কি একটা কাজে জুয়েল ভাই সেদিন ফোন করেছিলেন। কথার ফাঁকে জুয়েল ভাই বললেন, আমি জানতে পারলাম হুমায়ূন আহমেদের শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ। এই সংবাদ পেয়ে জাফর ইকবাল স্যার বাংলাদেশ থেকে আমেরিকা গিয়েছেন।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
জানলেন কীভাবে?
বাংলাবাজারের সবাই বলাবলি করছে। এখন নাকি তাঁর অবস্থা সত্যি সংকটাপন্ন।
আমার মন বলছে তিনি এবারও সুস্থ হয়ে উঠবেন।
তাহলে জাফর ইকবাল স্যারকে খবর দিয়ে নিয়ে যাবে কেন?
হয়তো কোনো কারণ আছে।
আমার সন্দেহ হচ্ছে।
আমরা এতকিছু চিন্তা করে এখান থেকে কিছু করতে পারব না। যা পারব তা হলো দোয়া করা। সবাই চলুন আমরা তার জন্য দোয়া করি যেন তিনি সুস্থ হয়ে দ্রুত দেশে ফিরে আসেন।
হ্যাঁ সেটাই ঠিক হবে।
এরপর জুয়েল ভাইয়ের সাথে আমার আর তেমন কোনো কথা হয়নি। অফিসের কাজে আবার মনোনিবেশ করতে চেষ্টা করি। কিন্তু কেন যেন পারছিলাম না। কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিল। শেষে না পেরে রুমের মধ্যে হাঁটতে শুরু করলাম। হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আমার মনের মধ্যে একটা স্বপ্ন ছিল যেটা আমি পূরণ করতে পারিনি। আর তা হলো তার সাথে একবার দেখা করে কিছুক্ষণ কথা বলা। যদিও আমি সবাইকে বলছিলাম হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে যাবেন কিন্তু মনের মধ্যে একটা শংকা থেকেই যাচ্ছিল। সত্যি যদি অনাকাঙ্খিত কিছু ঘটে যায় তাহলে বাংলা সাহিত্য যেমন তার সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রকে হারাবে তেমনি আমার মনের মধ্যেকার স্বপ্নটা আর পূরণ হবে না। সেক্ষেত্রে সেটা হবে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় এক অপূর্ণতা, অনেক বড় এক আফসোস –যার কষ্ট আমি কখনোই ভুলতে পারব না।
কিছুক্ষণ পর আবিদ ভাইয়ের ফোন পেলাম। আবিদ ভাই তখন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ডেপুটি কমিশনার ট্রেনিং পদে কর্মরত ছিলেন। আবিদ ভাইয়ের উপর দায়িত্ব ছিল আমাদের মিশনে যাওয়ার টিকিটের দিন তারিখ ঠিক করা এবং টিকিট কেটে ফেলা।
ফোন ধরতে আবিদ ভাই বললেন, মিশনে যাওয়ার টিকিটের তারিখ ঠিক হয়ে গেছে।
কবে?
পঁচিশে জুলাই।
আমি ভেবেছিলাম হয়তো জুলাই মাসের শেষে কিংবা আগস্ট মাসের প্রথমে হবে। তাই বললাম, এত তাড়াতাড়ি?
আমরা এর মধ্যে তিন মাস দেরি করে ফেলেছি। আর দেরি করা যাবে না। আর এ বিষয়ে তো তোমার সাথে দুদিন আগে কথা হয়েছে।
হ্যাঁ, ভেবেছিলাম অন্তত দুই সপ্তাহ সময় পাব।
আর সম্ভব না। টিকিট কনফার্ম হয়ে গেছে। পাঁচিশে জুলাই সকালে ফ্লাইট, এমিরেটস্ এয়ারলাইনস্। দুবাই তিন ঘণ্টা ট্রানজিট শেষে সরাসরি খার্তুম। যা কিছু আছে গুছিয়ে ফেলো। দেখবে সময় খুব দ্রুত চলে গেছে।
আবিদ ভাইয়ের সাথে কথা শেষে আমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো কি সেগুলোর একটা তালিকা করে ফেললাম। লম্বা তালিকায় একটা কাজ ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর সেটা হলো নিখোঁজ মোস্তফা কামালকে খুঁজে বের করা। মোস্তফা কামাল আমার কেউ না, তাকে আমি চিনিও না। পূর্ব পরিচিত এক তরন ব্যবসায়ী আসিফ সাহেবের মাধ্যমে সংবাদটা আমার কাছে আসে। সপ্তাহখানেক আগে আসিফ সাহেব আমাকে ফোন করে বলেন, ভাই, আপনি অনুমতি দিলে আপনার কাছে একটা বিষয় নিয়ে আসতাম। আমি তাকে আসতে বললে তিনি আমার কাছে এসে প্রথমেই বলেন, আমাকে
একজন অপহৃত মানুষ উদ্ধার করে দিতে হবে।
আমি বললাম, ঘটনাটা বুলুন।
আসিফ সাহেব বললেন, যে অপহৃত হয়েছে তার নাম মোস্তফা কামাল। বাড়ি কুমিল্লায়। আগে লিবিয়ায় কাজ করত। কিন্তু লিবিয়ায় গাদ্দাফির পতনের পর অবস্থা খারাপ হওয়ায় সে দেশে চলে আসতে বাধ্য হয়। তখন সে বাড়ি থেকে ঢাকা শহরে চাকুরির জন্য আসে। তারপর থেকে সে নিখোঁজ।
আমি আগ্রহ নিয়ে বললাম, তারপর?
তার সাথে তার বাড়ির লোকজনের শেষ কথা হয় গত হয় জুন মাসের আঠার তারিখে। সে তখন বলেছিল সে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে রয়েছে। এরপর তার মোবাইল বন্ধ হয়ে যায়। আর তার কোনো খোঁজ খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। উনিশে জুন তারিখে তার স্ত্রীর কাছে মালয়েশিয়া থেকে একটা ফোন আসে এবং জনৈক ব্যক্তি জানায় মোস্তফা কামাল জীবিত আছে এবং পাঁচ লক্ষ টাকা মুক্তিপন দেয়া হলে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে। মোস্তফা কামালের পারিবারিক অবস্থা খুব খারাপ। এমনিতেই গরীব মানুষ, তার উপর লিবিয়া গিয়ে অনেক টাকা লোকসান দিয়েছে। ঋণে জর্জরিত। এই পরিস্থিতিতে তাদের টাকা দেয়া সত্যি দুঃসাধ্য ব্যাপার ছিল। তারপরও স্বামীর কথা চিন্তা করে মোস্তাফা কামালের স্ত্রী আসামীর ফোনে আলোচনাপূর্বক নিজের বাবার বাড়ি এবং ভাসুরের কাছ থেকে টাকা ধার করে জুলাই মাসের এক তারিখে যাত্রাবাড়ির শনির আখড়া এলাকায় জাকির নামের এক ব্যক্তির নিকট এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা প্রদান করে। ঐ টাকা প্রাপ্তির পর অপহরণকারীদের মোস্তফা কামালকে ছেড়ে দেয়ার কথা থাকলেও তারা দেয়নি। তারা এখন আরও এক লক্ষ টাকা দাবী করছে। এই টাকা দেয়ার মতো অবস্থা তাদের পরিবারের নেই। এখন সবার মরণাপন্ন অবস্থা।
আমার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি এই ধরনের কেসগুলো বেশ জটিল হয় এবং খুব সাবধানে এগোতে হয়। একটু ভুল হলেই আসামীরা ভিকটিমকে মেরে ফেলে। অনেকসময় মেরে ফেলার পরও মুক্তি চাইতে থাকে। তাই নিশ্চিত হতে বললাম, মোস্তফা কামাল যে বেঁচে আছে তার প্রমাণ কি?
তার স্ত্রীর সাথে এই মাসের এক তারিখের পরও কথা হয়েছে।
কি কথা হয়েছে?
আমি বিস্তারিত জানি না। তবে বলেছে তাকে যেন তারা বাঁচানোর চেষ্টা করে। যারা তাকে অপহরণ করেছে তারা খুব ভয়ংকর। পুলিশকে কিছু জানালে তাকে হত্যা করবে।
আসিফ সাহেবের তথ্যগুলো পরিপূর্ণ না থাকায় আমাদের একজন অফিসারকে সম্পূর্ণ তথ্য। মোস্তফা কামালের বাড়ি থেকে সংগ্রহ করতে বলি। অতঃপর ঘটনাটা যাত্রাবড়ি থানাকে জানানো হয়। সম্পূর্ণ ব্যাপারটা খুবই গোপনীয়তার সাথে করা হয়। আসামীদের সাথে কথা বলার পাশাপাশি বিভিন্নভাবে মোস্তফা কামালের অবস্থানও জানার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। মূল সমস্যা ছিল আসামী পক্ষের লোকজন কথা বলছিল মালয়েশিয়া থেকে। বোঝা যাচ্ছিল আসামীরা খুব পেশাদার এবং ভয়ংকর। তা না হলে তারা কখনোই মালয়েশিয়া থেকে ফোন করত না। ব্যাপারটা এরকম ছিল যে বাংলাদেশের অপহরণকারী যে মোস্তফা কামালকে অপহরণ করেছে সে প্রথমে মালয়েশিয়ায় তার পার্টনারের সাথে কথা বলত। ঐ পার্টনার মালয়েশিয়া থেকে মোস্তফা কামালের স্ত্রীকে ফোন করত। যে কথা হতো তা আবার মালয়েশিয়া থেকে সে বাংলাদেশের অপহরণকারীকে জানিয়ে দিত। এ ধরনের টেকনিক একেবারে নতুন হওয়ায় আমরা সত্যি খুব সতর্ক ছিলাম। শেষে অন্য কোনো উপায় না দেখে চৌদ্দ জুলাই তারিখে এক লক্ষ টাকা মুক্তিপন প্রদানের জন্য দিন ধার্য করা হয়। পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে যাত্রাবাড়ী থানার বেশ কয়েকজন পুলিশকে বিভিন্ন ছদ্মবেশে আশেপাশে রাখা হয়। টাকা নিতে আসে জাকির নামের আগের সেই যুবক। তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং থানায় মামলা করা হয়। জিজ্ঞাসবাদে জাকির জানায় আমীর মিজি নামের একজনসহ আরও কয়েকজন মিলে তারা মোস্তফা কামালকে অপহরণ করেছে। মোস্তফা কামালকে ভালো কাজ দেয়ার কথা বলে গাড়ির মধ্যে পানের সাথে ঘুমের ওষুধ খাওয়ান। হয়। তারপর আমীর মিজি আর তার সহযোগিরা তাকে নিয়ে গেছে, কোথায় নিয়ে গেছে সে জানে না। আগের টাকা কি করেছে বলে জানায় আমির মিজিকে দিয়েছে এবং সে সেখান থেকে ভাগ পেয়েছে। তবে আমির মিজি কিংবা মোস্তফা কামাল কোথায় আছে সে জানে না।
জাকির গ্রেফতার হওয়ার পর মালয়েশিয়া থেকে ফোন আসা বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে মোস্তাফা কামাল বেঁচে আছে কিনা সেটাও বোঝার উপায় ছিল না। এভাবেই চলতে থাকে। বিষয়টা ডিবিকেও অবহিত করা হয়। কিন্তু কিছুতেই মোস্তফা কামালের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না। এতে ব্যবসায়ী আসিফ সাহেব এবং মোস্তফা কামালের পরিবার আরও ভয় পেয়ে যায়। তারা একসময় হতাশ হয়ে বলতে থাকে পুলিশকে সবকিছু না জানিয়ে অপহরণকারীদের অতিরিক্ত এক লাখ টাকা দিয়ে দিলে মোস্তফা কামালকে ফিরে পাওয়া সম্ভব হতো। আমি তখন তাদের কোনোভাবেই বোঝাতে পারছিলাম না, অতিরিক্ত এক লাখ টাকা দিলে অপহরণকারীরা আবার টাকা চাইত।
মামলাটির আপডেট জানতে আমি ঐ দিন অর্থাৎ আঠার জুলাই তারিখে যাত্রাবাড়ি থানায় ফোন। করি। থানা থেকে জানান হয়, কোনো অগ্রগতি নেই, মোস্তফা কামালের হদিস পাওয়া যায়নি।
মোস্তফা কামালের সন্ধান না পাওয়ার ঘটনাটা সত্যি তখন আমাকে খুব অস্থির করে তোলে। আর ঐ অস্থিরতার কারণেই হয়তো আমি সেদিন হুমায়ূন আহমেদের চরম অসুস্থতার কথাটি ভুলে গিয়েছিলাম।
১২
উনিশে জুলাই তারিখটা ছিল বৃহস্পতিবার। খুব ব্যস্ত সময় কাটছিল অফিসে। কাজের পর কাজ। হাতে সময় খুব কম। মাত্র সাত দিন পর জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যাওয়ার ফ্লাইট। এই সময় আমার ছুটিতে থাকার কথা। সাধারণত মিশনে যাওয়ার আগে শেষ সাতদিন সবাই পরিবারের সাথে সময় কাটায়। আর আমি কিনা করছি অফিস! এজন্য নিজের মধ্যে তাড়াহুড়া ছিল। টার্গেট ছিল যেভাবেই হোক শনিবারের মধ্যে সব কাজ শেষ করব। এজন্য সবাইকে ডেকে সব কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম। কিন্তু একটা সমস্যার কারণে এগোতে পারছিলাম না। তা হলো আমি চলে যাওয়ার পর কে দায়িত্বে থাকাবেন তা নিশ্চিত না হওয়া। আমার ডেপুটি এডিসি সুনন্দা তখন স্টাফ কলেজে ট্রেনিংএ। এজন্য জটিলতা আরও বেশি ছিল। কিছু অতি গোপনীয় কাজ ছিল যেগুলো যে কাউকে বুঝিয়ে দেয়া সম্ভব ছিল না। আমি কমিশনার বেনজীর আহমেদ স্যারের সাথে দেখা করে কথা বলার পর স্যার জানালেন কাকে দায়িত্ব দেয়া হবে তা তিনি দ্রুত জানাবেন।
অফিসে আসার পর পরবর্তী দিনগুলোর কাজগুলো ঠিক করে ফেললাম। শুক্রবার মিশনে যাওয়ার জন্য কেনাকাটা শেষ করা, শনিবার অফিসের সব কাজ শেষ করা, অফিসের কোনো কাজ বাকি। থাকলে তা রবিবার শেষ করা এবং অফিস থেকে বিদেয় নেয়া, সোম ও মঙ্গলবার পরিবারকে সময় দেয়া। বুধবার পঁচিশ তারিখ সকালে মিশনের উদ্দেশে যাত্রা। এর ফাঁকে যে কোনো একদিন নিজের লাগেজ গুছিয়ে সেটি ডিএইচএলের মাধ্যমে দাফুরের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা। আমি ঠিক করলাম লাগেজের কাজগুলো রবিবারের মধ্যে শেষ করব।
বৃহস্পতিবার ছিল ভয়াবহ ব্যস্ততার দিন। বিকেল পাঁচটায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে ফিটনেস সেন্টার এবং ক্যান্টিনের উদ্বোধন। উদ্বোধন শেষে সবাইকে যেতে হবে। রাজারবাগ টেলিকম ভবনে। সেখানে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সাথে মত বিনিময় সভা। সভা শুরু হতে আমি আর সেখানে থাকলাম না। রওনা দিলাম ধ্বনিচিত্রের উদ্দেশে। সেখানে একটি ডকুমেন্টারির এডিটিং করতে হবে। গাড়িতে আমার খুব মাথাব্যথা শুরু হলো। ব্যথার জন্য আমি সিটের উপর শুয়ে পড়লাম। ভাবছিলাম এডিটিংএ যেতে পারব না। কিন্তু সময় নেই, যেতেই হবে। পথের মাঝ থেকে প্যারাসিটামল আর ভারগন কিনে খেলাম। কিন্তু তাতে কাজ হলো না। জোর করে এডিটিং প্যানেলে বসলাম। সাউন্ড এডিটিং এর কাজ হওয়ায় মোবাইল সাইলেন্ট মুডে রাখতে বাধ্য হয়েছিলাম। মাথা ব্যথার কারণে আধঘণ্টা পর আর থাকতে পারলাম না। বাসায় ফিরে আসতে বাধ্য হলাম। বাসায় ফেরার পর মাথা ব্যথা আরও বাড়ল। শেষে মাথায় পানি দিতে হলো। এক সময় অতিরিক্ত দুর্বলতায় কারণে ঝিমুতে লাগলাম। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়লাম না।
রাত এগারোটার দিকে পলিন অপ্রত্যাশিত সংবাদটি দিল। সে ফিস্ ফিস্ করে বলল, হুমায়ূন আহমেদ মারা গেছেন। টিভিতে স্ক্রল দিচ্ছে।
সংবাদটা শোনার পর প্রথমে আমার প্রতিক্রিয়া ছিল খুব স্বাভাবিক। আমি আমার চশমাটা চোখে দিয়ে টিভির স্ক্রিনে তাকাতে দেখলাম সেখানে লেখা উঠছে,
দেশ বরেণ্য কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ যুক্তরাষ্ট্রের বেলভিউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন।
আমি মোবাইল ফোন হাতে নিতে দেখি অনেক মেসেজ এসেছে। আর এসেছে মিস্কল। মেসেজগুলোর সবগুলোই হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু সংক্রান্ত। মোবাইলের রিং টন এবং ভাইব্রেশন ধবনিচিত্রে বসে বন্ধ করেছিলাম, এজন্য টের পায়নি। আমি এক মনে অনেকক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকলাম। আমার সামনে টেলিভিশনের পাশে তখন হুমায়ূন আহমেদের মধ্যাহ্ন বইটি ছিল। আমি খুব আবেগভরে বইটি হাতে তুলে নিয়েছিলাম। তারপর বিড় বিড় করে বলেছিলাম, ‘হে মহান। লেখক, খুব ইচ্ছে ছিল তোমাকে কাছ থেকে দেখার, দুটো কথা বলার, কিন্তু তা আর হলো না।
বৃহস্পতিবার আমার টার্গেটের অনেক কাজ শেষ না হওয়ায় শুক্রবার আমি আমার প্ল্যান পরিবর্তন করে অফিসে আসার পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর অফিসে আসা হয়নি। দুটি কারণ ছিল। প্রথম কারণ হলো মাথা ব্যথা তখনও ছিল আর দ্বিতীয় কারণ, বিভিন্ন চ্যানেলে হুমায়ূন আহমেদ স্মরণে প্রচারিত অনুষ্ঠানগুলো দেখছিলাম। হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে অনেক অনেক অজানা তথ্য তখন জেনেছি।
টিভিতে হুমায়ূন আহমেদের স্মরণে অনুষ্ঠানগুলো দেখে বার বার নিজেকে প্রশ্ন করছিলাম, আমার কিছু করার আছে কিনা? বুঝতে পারছিলাম কিছু করার আছে, কিন্তু কি করার আছে সেটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। জুম্মার নামাজের পর নালন্দা প্রকাশনীর স্বত্ত্বাধিকারী জুয়েল ভাইয়ের ফোন পেলাম। ফোন ধরতে জুয়েল ভাই বললেন, মোশতাক ভাই, আপনি কোথায়?
বাসায়।
চ্যানেল আইতে হুমায়ূন আহমেদের স্মরণে স্মারক বই খুলেছে। আপনি কি সেখানে কিছু লিখার জন্য যাবেন?
এতক্ষণ যেন আমি এরকম কিছুই খুঁজছিলাম। তাই জোর দিয়ে বললাম, অবশ্যই যাব।
আমাকে তাহলে আজিজ সুপার মার্কেট থেকে তুলে নিয়েন।
ঠিক আছে।
আমি বিকেল সাড়ে চারটার দিকে আজিজ সুপার মার্কেটে গেলাম। জুয়েল ভাইয়ের তখনও আসতে কিছুটা সময় লাগবে। সময় কাটাতে ঢুকলাম প্রথমা স্টলে। প্রথমার ম্যানেজার জয়ন্ত দা বললেন, আজ শুধু হুমায়ূন আহমেদের বই বিক্রি হচ্ছে। এত বেশি যে কল্পনা করা যাচ্ছে না।
আমি বললাম, হবেই তো। তাঁর বই বিক্রি না হলে কার বই বিক্রি হবে?
জয়ন্ত দা আবার বললেন, ধানমন্ডি থেকে এক ভদ্রলোক ফোন করেছিলেন। তিনি জানতে চেয়েছেন আমার কাছে হুমায়ূন আহমেদের কতগুলো বই আছে। তিনি নাকি সব বই কিনে মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেবেন।
আমি কিছুক্ষণ প্রথমায় ছিলাম। যে বইগুলো বিক্রি হতে দেখলাম সবগুলো হুমায়ূন আহমেদের। এরপর প্রথম থেকে বের হয়ে এলাম পাশের সিডির দোকানে। মিশনে শোনার জন্য বেহালার কিছু। করন সুর কেনার ইচ্ছে ছিল। দোকানগুলোতে এসে দেখি দোকানের সামনে শুধু হুমায়ূন আহমেদের নাটক আর সিনেমার সিডি রাখা হয়েছে। বিক্রিও হচ্ছে দেদারছে। এমন দিনে হুমায়ূন আহমেদের সিডি ছাড়া অন্য সিডি কেনা ঠিক হবে না ভেবে বেহালার করুন সুরের সিডি আর কিনলাম না।
জুয়েল ভাইকে নিয়ে চ্যানেল আইতে এলাম বিকেল পাঁচটার দিকে। সেখানে এসে দেখি ভবনের নিচ তলায় হুমায়ূন আহমেদের বড় একটা ছবি টাঙানো হয়েছে। সেই ছবির নিচে সারি সারি ফুলের তোড়া আর মালা। হুমায়ূন আহমেদকে শ্রদ্ধা জানাতে গত রাত থেকে তার ভক্তরা এখানে ফুল রেখে যাচ্ছে, মালা রেখে যাচ্ছে, তারপর স্মারক বহিতে লিখে যাচ্ছে শ্রদ্ধাভরা প্রিয় কিছু কথা।
দেশের মন্ত্রী থেকে শুরু করে লেখক, অভিনেতা, অভিনেত্রী, মিডিয়া কর্মী, সাধার মানুষ, সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী, ছাত্র শিক্ষক অনেকে এর মধ্যে স্বাক্ষর করে গেছেন। যারা বাকি আছেন এবং আসছেন তারা অপেক্ষা করছেন। আমার পালা আসতে আধঘণ্টা সময় লাগল। আমি সেখানে। লিখলাম,
হে কিংবদন্তী
তুমি ছিলে, আছে, থাকবে; থাকবে আমাদের হৃদয়ে, হৃদয়ের অনেক অনেক গভীরে, যেখানে হিমু, মিসির আলীসহ তোমার শত সাহিত্যকর্ম আমরা সযত্নে লালন করে রাখব। তোমাকে সশ্রদ্ধ ভালোবাসা।
মোশতাক আহমেদ
চ্যানেল আই থেকে আবার আজিজ সুপার মার্কেটে এলাম। আর্জিজ সুপার মার্কেটের দোতলায় ‘অন্তরে’ নামের একটা হোটেল আছে। সেখানকার লুচি আর ভাজি খেতে আমার সবচেয়ে ভালো লাগে। তবে ঐ দিন লুচি আর ভাজি খেতে যাইনি। গিয়েছিলাম কিছুটা সময় হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে। চ্যানেল আই থেকে আমাদের সাথে শুভ নামের আর একজন এনজিও কর্মী এসেছিলেন। তিনি হোটেলের ভিতর বসে হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ শহীদ মিনারে আনা হবে, কত মানুষ হবে বলে আপনি অনুমান করছেন?
প্রশ্নটা আমাকে করার পিছনে তার অবশ্যই যুক্তি ছিল। কারণ তখন আমি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ইন্টেলিজেন্স বিষয়গুলো দেখি এবং এটা আমার দায়িত্ব ছিল। কিন্তু ঐ মুহূর্তে আমার পক্ষে উত্তর দেয়া সবচেয়ে কঠিন ছিল। শুধু আমি কেন, আসলে কেউই অনুমান করতে পারছিল না শহীদ মিনারে কত মানুষ হবে। তাই উত্তরটা তখন দিতে পারিনি।
এরমধ্যে জানতে পেরেছি হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ রবিবার ঢাকায় আনা হবে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে কখন নেয়া হবে তা তখন জানতে পারিনি। শহীদ মিনারে যে মানুষের ঢল নামবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেক্ষেত্রে নিরাপত্তা একটা বড় ইস্যু হবে। এজন্য প্রস্তুতিটা এখন থেকেই নেয়া দরকার। এরকম একটা চিন্তা থেকে ভাবলাম, এখনই কমিশনার স্যারের সাথে কথা বলে বিষয়টা তাকে জানাই। কিন্তু শেষ মুহূর্তে অবশ্য স্যারকে জানালাম না। কারণ আমার মনে হচ্ছিল স্যারকে জানানোর সাথে সাথে সম্পূর্ণ নিরাপত্তা ব্যবস্থার সমন্বয়ের দায়িত্বটা আমার উপর এসে পড়বে। তখন মিশনে যাওয়ার আগের এই কয়েকটা দিনে এক মুহূর্তও সময় পাব না।
মিশনের জন্য কিছু কেনাকাটা করে বাসায় ফিরতে রাত হয়ে গেল। সময়টা এখনও আমার মনে আছে। রাত এগারোটা তেইশ মিনিটে কমিশনার স্যার নিজেই ফোন করলেন। তারপর জানতে চাইলেন হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ কখন আসবে, কোথায় রাখা হবে এবং কোথায় সমাধি হবে। আমি যতটুকু পারলাম স্যারকে জানালাম। স্যার আরও বিস্তারিত জানতে চাইলেন এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে বললেন। স্যারের কথাতে আমি তখন বুঝতে পারলাম, চাইলেও আমি হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ সত্ত্বার সংক্রান্ত সকল বিষয়াদি সম্পাদনের প্রক্রিয়া থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারব না।
আগেই বলেছি হুমায়ূন আহমেদের সাথে আমার কখনও পরিচয় হয়নি, কথাও হয়নি। তবে জাফর ইকবাল স্যারের সাথে আমার খুব ভালো পরিচয় আছে। স্যারের সাথে মাঝে মাঝে ফোনে কথা হয়, দেখাও হয়েছে কয়েকবার। স্যার তখন আমেরিকায়, হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ দেশে আনার সামগ্রিক কর্মকান্ড সমাধানে ব্যস্ত। ঐ রকম পরিস্থিতিতে তাকে ফোন করা যুক্তিসংগত মনে হলো না আমার কাছে। হুমায়ূন আহমেদের ছোট ভাই আহসান হাবীব ভাইকে চিনি, কিন্তু তার সাথে আমার পরিচয় হয়নি। হুমায়ূন আহমেদের দেশে আসা সম্পর্কে চারদিক থেকে যে সংবাদগুলো পাচ্ছিলাম তা নিশ্চিত মনে হচ্ছিল না। যে যার মতো বলছিল। অথচ আমার সঠিক এবং যথাযথ তথ্য দরকার ছিল। শেষে সিদ্ধান্ত নিলাম সকালে আহসান হাবিব ভাইয়ের বাসায় যাব। সায়েন্স ফিকশন লেখক হাসান খুরশীদ রুমী ভাইকে ফোন করে আহসান হাবীব ভাইয়ের বাসার ঠিকানা নিলাম। তারপর আমার অফিসের সার্জেন্ট সুশান্তকে ফোন করে জানালাম, সকাল দশটায় আহসান হাবীব ভাইয়ের বাসায় যাব, সে যেন তার টিমের লোক দিয়ে বাসাটা খুঁজে রাখে।
পরের দিন অর্থাৎ শনিবার থেকে রোজা। শেষ রাতে সেহরি খাওয়ার পর আর ঘুম আসছিল না। পলিনের সাথে হুমায়ূন আহমেদের কিছু স্মৃতিচারণ করতে শুরু করলাম। আমরা দুজনে বিয়ের আগে বলাকা সিনেমা হলে হুমায়ূন আহমেদের ‘দুই দুয়ারী’ ছবিটি দেখতে গিয়েছিলাম। সেটা ছিল জীবনের এক মধুর স্মৃতি। তখন বসুন্ধরা সিনেপ্লক্স ছিল না। বলাকা সিনেমা হল ছিল প্রেমিক। প্রেমিকাদের ছবি দেখার হল। বলাকা সিনেমা হলে ঐ একটি ছবিই আমরা দেখেছিলাম।
দুই দুয়ারী সিনেমার কথা মনে হতে পলিন বলল, হুমায়ূন আহমেদ ছিল বলেই ছবিটা আমরা দেখতে পেরেছিলাম এবং জীবনে কিছু সুন্দর সময় উপভোগ করেছিলাম।
আমি আফসোস করে বললাম, অথচ সেই হুমায়ূন আহমেদকেই আমার কাছ থেকে দেখা হলো না, তার সাথে কথা হলো না।
পলিন খুব অবাক হয়ে বলল, তোমার সাথে হুমায়ূন আহমেদের কখনও কথা হয় নি!
না হয় নি। একবার শুধু কাছ থেকে এক মুহূর্তের জন্য দেখেছিলাম। আর দেখিনি।
এটা কীভাবে সম্ভব?
আমি নিজে ভেবেও অবাক হই। হুমায়ূন আহমেদকে দেখা আমার জন্য কঠিন কিছু ছিল না। তার। জন্মদিনে যখন পাবলিক লাইব্রেরিতে মেলা হয় সেখানে গেলই হতো, নতুবা তিনি যে অনুষ্ঠানগুলোতে মাঝে মধ্যে যান সেখানে গেলেও হতো। আর কিছু না হলে অন্তত একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে গিয়ে দেখা করলেও পারতাম। সত্যি অবাক ব্যাপার, তাই না?
হ্যাঁ অবাক ব্যাপারই তো। তুমি লেখালেখি করো, অথচ হুমায়ূন আহমেদের সাথে দেখা হয়নি, কথা হয় নি, ব্যাপারটা কেমন না?
এইজন্য আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
কি সিদ্ধান্ত?
আমি হুমায়ূন আহমেদকে কাছ থেকে দেখব, একেবারে কাছ থেকে।
কিন্তু উনি তো আর নেই, মারা গেছেন।
আমি মৃত হুমায়ূন আহমেদেকেই কাছ থেকে দেখব, খুব কাছ থেকে। এতে হুমায়ূন আহমেদকে না দেখার যে অপূর্ণতা আমার মধ্যে আছে সেটা কিছুটা হলেও লাঘব হবে।
পলিন অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল।
আর আমি মনে মনে ঠিক করলাম যেভাবেই হোক আমি হুমায়ূন আহমেদকে আর একবারের জন্য দেখব এবং তা খুব কাছ থেকে।
১৩
একুশে জুলাই, শনিবার সকাল সাড়ে দশটার দিকে মীরপুরে আহসান হাবিব ভাইয়ের বাসায় উপস্থিত হলাম। তার কাছ থেকে যতটুকু জানতে পারলাম, হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ পরের দিন অর্থাৎ বাইশ তারিখ, রবিবার সকালে ঢাকায় এসে পৌঁছাবে। তারপর জাফর ইকবাল স্যার এবং পরিবারের সবার সাথে কথা বলে তারা সিদ্ধান্ত নেবেন কোথায় কোথায় মরদেহ নেয়া হবে এবং কোথায় তার দাফন হবে। তবে তিনি নিশ্চিত করলেন মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেয়া হবে। ঐ মুহূর্তে আমি বুঝতে পারছিলাম আমার আরও সুনির্দিষ্ট তথ্য দরকার। তা না হলে নিরাপত্তা নিয়ে ঝামেলা হতে পারে। কারণ পুলিশের আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। আমি তখন সরাসরি জাফর ইকবাল স্যারকে ফোন করলাম। কিন্তু ফোন বন্ধ পেলাম। পরে ফোন করলাম সময় প্রকাশনীর ফরিদ ভাইকে। ফরিদ ভাই আহসান হাবীব ভাইয়ের মতো একই কথা বললেন।
অফিসে ফিরে আসার সময় আমি ভাবতে শুরু করলাম কীভাবে আমি আর একবার হুমায়ূন আহমেদকে দেখতে পারি। ভেবে দেখলাম তাকে শেষবার দেখার অনেক উপায় আছে। এয়ারপোর্টে মরদেহের কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের সময় কফিন উম্মুক্ত করা হতে পারে –সেটা একটা সুযোগ। তাকে যখন তার বাড়িতে আনা হবে এবং পরিবারের সদস্যরা শেষ বারের মতো তার মুখ দেখবেন তখন দেখার একটা সুযোগ পাওয়া যাবে। শহীদ মিনারে অবশ্যই সুযোগ পাওয়া যাবে। তা না হলে জানাজার মাঠে সকলকে যখন মুখ দেখানো হবে তখন সুযোগ থাকবে। সব শেষে দাফনের সময় দেখার সুযোগ থাকবে। এই স্থানগুলোর একটাতেও যেতে আমার কোনো অসুবিধা হবে না। কাজেই হুমায়ূন আহমেদের সাথে শেষ সাক্ষাৎ আমার হবেই– এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম।
বিকেলে সার্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে নাসির উদ্দিন ইউসুফ ভাইয়ের (গেরিলা ছবির পরিচালক) অফিসে একটা সভা বসল। সেখানে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সহ-সভাপতি গোলাম কুদ্ছ ভাইও ছিলেন। ছিলেন হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনের বাবা এবং আরও কয়েকজন। সেখানে জানা গেল প্লেনে কোনো জটিলতার কারণে হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ রবিবার দেশে আসবে না, আসবে সোমবার সকালে। মরদেহ এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি ধানমন্ডি হুমায়ূন আহমেদের ফ্ল্যাট দখিনা হাওয়ায় নেয়া হবে এবং সেখান থেকে আনা হবে শহীদ মিনারে। অতঃপর পারিবারিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাকে মাটি দেয়া হবে।
সম্পূর্ণ ব্যাপারটি আমি অফিসে এসে কমিশনার স্যারকে জানালাম। স্যারের রুম থেকে বাইরে বের হয়ে আসতে বুঝলাম শরীর ভালো লাগছে না। আমার নিজের শরীরের উপর আমার নিয়ন্ত্রণ খুব বেশি। কিন্তু ঐ সময় আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম শরীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না যে আগের দিনের মাথা ব্যথাটা স্বাভাবিক কোনো ব্যথা ছিল না, ঐ মাথা ব্যথাটা বড় ধরনের অসুখের লক্ষণ প্রকাশ করছিল। যেহেতু পাচিশ তারিখে আমার ফ্লাইট সেজন্য আগেভাগেই সতর্ক হতে হবে ভাবলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম প্রোফাইলেকটিক (রোগ প্রতিরোধের জন্য পূর্ব সতর্কতামূলক ডোজ) ওষুধ খাব। কিন্তু রমজান মাস হওয়ায় আর ডাক্তারের কাছে যাওয়া হলো না, ওষুধও খাওয়া হলো না।
রাত আনুমানিক সাড়ে নয়টার দিকে ডিসি হেডকোয়ার্টার্স হাবিবুর রহমান স্যার ফোন করলেন। ফোন করে প্রথমেই জানতে চেয়ে বললেন, মোশতাক, হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ দেশে আসবে। কবে?
আগামী সোমবার, তেইশে জুলাই সকালে।
স্যার একটু সময় নিলেন। তারপর বললেন, হুমায়ূন আহমেদের জন্য আমাদের কিছু দরকার। এত বড় একজন লেখক, তার উপর পুলিশ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। কি বলো তুমি?
আমি সায় দিয়ে বললাম, জি স্যার, করা দরকার।
কি করা যায় বলো তো? যেখানে সারাদেশের মানুষ সবকিছু করবে সেখানে আমাদের এমন কি করার আছে?
আমি একটু সময় নিলাম। তারপর বললাম, স্যার নিরাপত্তা তো দেয়া হচ্ছেই। নিরাপত্তা দেয়ার পাশাপাশি যদি ভালো কিছু করতে হয় তাহলে বাংলাদেশ পুলিশের সালামী দল দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ বহন করা যায়। আমার ধারণা হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ বহনের সময় এত মানুষ হবে যে খুব ধাক্কাধাক্কি হবে। সেই ধাক্কাধাক্কিতে যেন কোনো অনাকাঙ্খিত ঘটনা না ঘটে সেজন্য আমাদের সালামী দলকে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। যেহেতু আমাদের সালামী দল প্রশিক্ষিত তারা দায়িত্বটা খুব সুন্দরভাবে পালন করতে পারবে।
স্যার সাথে সাথে রাজি হয়ে বললেন, আমি এখনই কমিশনার স্যারের সাথে কথা বলছি। আর হুমায়ূন আহমেদের পরিবারের দিকের কার সাথে এ বিষয়ে কথা বলতে বে?
সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট।
এ কথা বলে আমি স্যারকে নাসির উদ্দিন ইউসুফ এবং গোলাম কুদ্ছ ভাইয়ের নম্বর দিলাম। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের হাসান আরিফ ভাইয়ের সাথেও কথা বলতে বললাম। কারণ হাসাফ আরিফ ভাইও সার্বিক প্রক্রিয়ার সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত ছিলেন।
দশ মিনিট পর ডিসি হেডকোয়ার্টার্স স্যার আমাকে আবার ফোন করলেন। তারপর বললেল, আইজি স্যার এবং কমিশনার স্যারের অনুমতি নেয় হয়েছে, বাচ্চু ভাইয়ের সাথেও কথা হয়েছে। আমরাই হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ বহন করব, একেবারে বিমান থেকে নামানো শুরু করে কবর পর্যন্ত।
স্যারের কথাটা শোনার সাথে সাথে নিজের মধ্যে ভিন্ন এক শিহরণ অনুভব করলাম। হুমায়ূন আহমেদের মতো দেশ বরেণ্য একজন লেখকের মরদেহ বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা বহন করবে– ঐ মুহূর্তে বাংলাদেশ পুলিশের জন্য সেটার থেকে গৌরব আর সম্মানের সংবাদ আর কি হতে পারত!
রবিবার সকালে আমরা জাতীয় শহীদ মিনারে গ্রাউন্ড মিটিং করলাম। জতীয় শহীদ মিনারে শবদেহেরে প্রতি এ ধরনের শ্রদ্ধাঞ্জলির অনুষ্ঠান প্রায়ই হয়ে থাকে। রমনা ডিভিশনের স্টান্ডার্ড অপেরেটিং সিস্টেম অনুসারে সেই অনুষ্ঠানগুলো হয়। কিন্তু হুমায়ূন আমেদের ক্ষেত্রে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়া হলো। কারণ নিরাপত্তার ব্যাপারে এখানে অনেক বিষয় বিবেচনার ছিল।
সভা শেষে আমি সবকিছু কমিশনার স্যারকে অবহিত করার জন্য তার রুমে প্রবেশ করলে স্যার সবকিছু মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। তারপর প্রথম যে প্রশ্নটি করলেন সেটি ছিল, কত মানুষ হবে?
আমি একটু সময় নিলাম। তারপর বললাম, স্যার সঠিকভাবে অনুমান করা কঠিন। তবে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয় এক লাখের কম হবে না।
স্যার অবাক হয়ে বললেন, এক লাখ!
জি স্যার।
মরদেহ শহীদ মিনারে কতক্ষণ থাকবে?
সকাল নয়টা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত, মোট পাঁচ ঘণ্টা।
স্যার ক্যালকুলেটরে হিসেব করে বললেন, পাঁচ ঘন্টা মানে প্রতি ঘণ্টায় আমাদের কফিনের সামনে দিয়ে বিশ হাজার মানুষকে পাস করিয়ে দিতে হবে। তার মানে প্রতি মিনিটে তিনশ তেত্রিশজন এবং প্রতি সেকেন্ডে পাঁচ জন। এটা কীভাবে সম্ভব! তাহলে তো বিশাল লাইন হয়ে যাবে।
আমার সেরকমই মনে হচ্ছে স্যার। অর্থাৎ আমাদের আরও সতর্ক থাকতে হবে। জি স্যার। আমাদের আশঙ্কা কোনো কোনো ভক্ত অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হয়ে অনাকাঙ্খিত কোনো ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারে।
অন্য কোনো আশঙ্কা?
বেদি থেকে কাফিন জাতীয় ঈদগায়ে নেয়ার সময় কিছুটা ঝুঁকি থাকবে। কেউ কেউ কফিনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করতে পারে।
আর?
আমি আরও কিছু অবজারভেশন স্যারকে দিলাম (বিষয়গুলো অতিগোপনীয় হওয়ায় এখানে উল্লেখ করা হলো না)। আমি যখন স্যারের রুম থেকে বের হয়ে আসি স্যারকে তখন ডিসি রমনা নুরুল ভাইকে ফোন করে নিরাপত্তা আরও জোরদার করার নির্দেশনা দিতে শুনেছিলাম।
কমিশনার স্যারের রুম থেকে বের হয়ে বুঝতে পারলাম শরীরের অবস্থা খুব খারাপ। সম্ভবত যে কোনো একটা অসুখের জীবানু জোটবদ্ধ হয়ে শরীর আক্রমণ করছে। তা না হলে কখনোই এতটা খারাপ লাগাত না। ওষুধ যে খাব সেই উপায়ও নেই। রোজার সময়।
সন্ধ্যায় ইফতারের পর আর থাকতে পারলাম না। ৫০০ মিলিগ্রামের একটা এজিথ্রোসিন ট্যাবলেট খেয়ে ফেললাম। এজিথ্রোসিন হলো এজিথ্রোমাইসিন, নতুন জেনারেশনের একটা এন্টিবায়োটিকস। বেক্সিমকো ব্রান্ডের এই ওষুধের ট্রেড নেইম এজিথ্রোসিন। ওষুধটা প্রতি আমার বিশেষ দুর্বলতা আছে। কারণ ২০০১ সালের প্রথম দিকে যখন বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসে চাকরি করতাম তখন এজিথ্রোসিন ৫০০ ওষুধটি বাজারে ছাড়ার দায়িত্ব ছিল আমার। আমি ছিলাম ওটার প্রডাক্ট অফিসার। এজিথ্রোমাইসিন ৫০০ মিলিগ্রামের সবচেয়ে বড় সুবিধা এর তিন দিনে তিনটি ডোজ। অন্য এন্টিবায়োটিকস্ এর মতো দিনে কয়েকবার খাওয়ার ঝামেলা নেই। আবার ওষুধের কার্যকারিতাও সন্তোষজনক। বিশেষ করে আমার শরীরে খুব ভালো কাজ করে। আগেও কয়েকবার খেয়েছি। প্রত্যেকবার ভালো ফল পেয়েছি। ওষুধটি কখনোই আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। শরীর আক্রমণকারী বহিশত্রু জীবানুকে একেবারে শেষ করে দিয়েছে। কিন্তু এবার প্রথম ওষুধটি আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল। রাত এগারোটার দিকে আমার প্রচন্ড জ্বর এলো। এত জ্বর যে আমি শুয়ে পড়তে বাধ্য হলাম। জ্বর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকলে একসময় জ্বরের ঘোরের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুমানোর আগ মুহূর্তে কেউ একজন টেলিফোনে আমাকে নিশ্চিত করেছিল হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ দখিনা হাওয়ায় নেয়া হবে না, এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি জাতীয় শহীদ মিনারে আনা হবে। হুমায়ূন আহমেদের আম্মা সেখানেই তার বড় ছেলেকে শেষবারের মতো দেখবেন।
১৪
তেইশে জুন, সোমবার।
সকাল সাতটা থেকে বাসার নিচে গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছিল। আমার এয়ারপোর্টে যাওয়ার কথা। আমি ঘুম থেকে উঠেছিলাম ঠিকই, কিন্তু বিছানা থেকে নামতে পারছিলাম না। গতকাল শুধু জ্বর ছিল, আজ যোগ হয়েছে দুর্বলতা। বেশ কয়েকবারের চেষ্টায় যখন সত্যি বসতে পারলাম না, তখন নিশ্চিত হলাম আমি এয়ারপোর্টে যেতে পারব না। এয়ারপোর্টে হুমায়ূন আহমেদকে দেখার প্রাথমিক সুযোগটা আমি হারালাম।
ঘণ্টাখানেক পরে উঠে বসলাম। বুঝতে পারলাম কিছুটা ভালো লাগছে। এই সুযোগে একেবারে শহীদ মিনারে চলে এলাম। আমার পোশাক ছিল সিভিল, কারণ আমরা ইন্টেলিজেন্সের সবাই সাদা পোশাকে দায়িত্বরত থাকি। ওয়াকিটকি সেটে শোনা যাচ্ছিল হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ এয়ারপোর্ট থেকে শহীদ মিনারের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে।
শহীদ মিনারে গিয়ে দেখি বেদির সামনে সকল টিভি চ্যানেলের ক্যামেরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে আছে। কয়েকটি চ্যানেল শ্রদ্ধা নিবেদনের সম্পূর্ণ পর্ব সরাসরি সম্প্রচার শুরু করে দিয়েছে। পূর্ব দিকে মানুষের বিশাল লম্বা লাইন। শেষ মাথা আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না। সময় যত গড়াচ্ছিল মানুষের ভীড় তত বাড়ছিল।
আমি বুঝতে পারছিলাম আমার শরীর আবার খারাপ হতে শুরু করেছে। আমি রোদ থেকে ছায়ায় গিয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু সেখানে স্থির থাকার উপায় ছিল না। যদিও গ্রাউন্ড নিরাপত্তার দায়িত্বের সাথে আমি সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলাম না তারপরও অনেক জুনিয়র পুলিশ সদস্য সিদ্ধান্তের জন্য আমার কাছে আসছিল। পাশাপাশি অনেক সাংবাদিক পরিচিত হওয়ায় তারা বার বার জানতে চাচ্ছিল হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ কতদূর। কারণ আমরা ওয়াকটকি সেটে হুমায়ূন আহমেদের মরদেহের অবস্থান জানতে পারছিলাম।
ঐ দিন মোস্তাফা কামালের ঘটনা আমাকে বেশ উদ্বিগ্ন করে রেখেছিল। কারণ সে তখনও উদ্ধার হয়নি। তার পরিবারের অবস্থা খুব খারাপ। আমি বুঝতে পারছিলাম পরিস্থিতি ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। কিন্তু ঐ মুহূর্তে আমি কি করতে পারি কিছু ভেবে পাচ্ছিলাম না। আর কিছু ভেবে না পাওয়া বা না করতে পারার ব্যর্থতাটা আমাকে তীব্র কষ্ট দিচ্ছিল।
অসুস্থতার কারণে যখন আমার দাঁড়িয়ে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছিল তখন এক সময় আমি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম, আমি কেন চলে যাচ্ছি না? আমি চলে গেলে কেউ কিছু বলবে না। কারণ সবাই জানে পরশুদিন আমার ফ্লাইট। তাছাড়া এখানে এই ভেন্যুতে ইন্টেলিজেন্স এবং নিরাপত্তা সমন্বয়ের জন্য আমার ডিপার্টমেন্ট থেকে অন্য অফিসারকে দায়িত্ব দেয়া আছে। তাহলে আমি এখানে কেন? উত্তর একটাই পেয়েছিলাম, আর তা হলো হুমায়ূন আহমেদকে শেষ বারের মতো দেখার জন্য। এই দেখাটা না দেখলে আমি নিজে কখনও শান্তি পাব না। তাই যত কষ্টই হোক আমি একবারের জন্য হুমায়ূন আহমেদকে দেখব –এটাই ছিল আমার প্রতিজ্ঞা।
দখিনা হাওয়ায় হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ না নেয়ার কারণে নির্ধারিত সময়ের কিছু আগে মরদেহ শহীদ মিনারে চলে এলো। সময়টা আমার সঠিকভাবে খেয়াল নেই। সম্ভবত দশটা হবে। চিলিং ভ্যান (মরদেহের গাড়ি) থেকে মরদেহ নামানোর সময় খুব ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে গেল। কে কার আগে কফিন ধরবে। আমি সত্যি খুব আতংকিত হয়ে পড়েছিলাম। তবে পুলিশের সালামী দল আগে থেকে প্রশিক্ষিত এবং প্রস্তুত থাকায় কোনো সমস্যা হলো না। তারা খুব দক্ষতার সাথে কফিনসহ মরদেহ কাঁধে বহন করছিল। এয়ারপোর্টে এই দলটিই মরদেহ বহনের দায়িত্বে ছিল। তারা মরদেহের সাথে এসেছে। এজন্য তাদের সবকিছু জানা ছিল কীভাবে কি করতে হবে।
মরদেহ বেদি পর্যন্ত আনার সময় আমি নিজেও কফিনটা হাতে ধরেছিলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ পারিনি। অন্যদের ধাক্কায় সরে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম। তবে বেদিতে মরদেহ রাখার পর আমি আর সেখান থেকে সরলাম না। কারণ আমার বিশ্বাস ছিল সেখানে কফিনের উপরের ঢাকনাটা একবার খোলা হবে এবং আমি হুমায়ূন আহমেদকে একবার দেখতে পাব। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য উপরের ঢাকনাটা খোলা হলো না। এর মধ্যে শ্রদ্ধানিবেদন শুরু হয়ে গেল। সবার প্রথমে মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তাদের প্রতিনিধি পুস্পস্তবক অর্পন করে শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন। এরপর ধীরে ধীরে বিভিন্ন মন্ত্রী এবং সরকারী সংস্থার প্রতিনিধি আসতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরাও এলো। সামনে ছিলেন কমিশনার স্যার। স্যারের সাথে সাথে আমরাও দেশবরণ্যে কথাসহিত্যিক এবং নাট্যকর হুমায়ূন আহমেদের কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পন করে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করলাম।
শ্রদ্ধা জ্ঞাপন শেষে আমি কফিন থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমার তখন দাঁড়িয়ে। থাকতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু আমি চলে যেতে পারছিলাম না। কারণ কখন হুমায়ূন আহমেদের আম্মা আসবেন এবং কফিন খোলার পর আমি হুমায়ূন আহমেদকে দেখব– সেই ইচ্ছেটা আমাকে যেতে দিচ্ছিল না।
এনেক্স ভবন আর ঢাকা মেডেকেল কলেজের সামনে তখন মানুষ আর মানুষ। কিন্তু লাইনের গতি খুব কম। কারণ যিনি কফিনের সামনে যাচ্ছেন তিনি আর সরছেন না। যেখানে আমাদের হিসেবে প্রতি সেকেন্ডে পাঁচজন মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের কথা, সেখানে প্রতি দশ সেকেন্ডেও একজন হচ্ছে না। কাউকে কাউকে দেখলাম কফিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই, বলার পরও সরছে না। কফিনের উপর তখন ফুলের স্তূপ জমে গেছে। এত ফুল যে ওপাশে হুমায়ূন আহমেদের পরিবারের সদস্যদের ঠিকমতো দেখা যাচ্ছিল না। তখন উপায় না দেখে, দায়িত্বরত ভলেন্টিয়াররা ফুলগুলো। সরিয়ে বেদির পিছনে রাখতে শুরু করল।
আমি ষোল সতের বছরের একটি মেয়েকে অনেকগুলো কদম ফুল হাতে এগিয়ে আসতে দেখলাম। যারা শ্রদ্ধা জানাতে আসছেন তাদের কারো হাতে কদম ফুল দেখিনি। এই প্রথম কাউকে কদম ফুল হাতে দেখলাম। কদম ফুলকে কখনও আমার ধনীদের ফুল মনে হয় না। গরীবদের ফুল। বলে মনে হয়। কারণ সাধারণত যত্ন করে কেউ কদম ফুল বাড়িতে লাগায় না। কদম ফুল গ্রামের পথে ঘাটে যেখানে সেখানে হয় এবং নিজের মতো করে বড় হয়। গরীব ছেলে মেয়েরা এই ফুলগুলো নিয়ে নানারকম খেলা খেলে। এজন্য আমার মনে হয় কদম ফুল গরীবের ফুল। অথচ আমার সামনে যে মেয়েটি কদমফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছে তাকে ধনীর মেয়েই মনে হচ্ছে। সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মেয়েটির সাথে হঠাৎ আমার চোখাচোখি হলো। আমি উৎসুক হয়ে বললাম, আপনি কদম ফুল এনেছেন কেন?
মেয়েটি উজ্জ্বল মুখে বলল, হুমায়ূন আহমেদ কদম ফুল খুব পছন্দ করেন, তাই।
কীভাবে জেনেছেন?
তার বই পড়ে।
পেলেন কোথায় কদম ফুল?
আমাদের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইল থেকে আনিয়েছি।
এরপর মেয়েটি সামনের দিকে চলে গেল। আমি খুব বিস্মিত হলাম মানুষের ভালোবাসার গভীরতা দেখে। একজন লেখক একজন ভক্তের কত প্রিয় হলে সেই ভক্ত শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সুদূর গ্রামের বাড়ি থেকে কদম ফুল এনে এই তপ্ত রোদে শহীদ মিনারে আসতে পারে। আমি জানি না বাংলাদেশের আনাচে কানাচে হুমায়ূন আহমেদের এরকম কত ভক্ত আছেন যারা বাদল দিনের কদম ফুল হাতে হুমায়ূন আহমেদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছেন। হয়তো দূরত্বের কারণে তারা ঢাকার এই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আসতে পারেননি, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি তাদের কদম ফুলে সুভাসিত বুক ভরা শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা ঠিকই পৌঁছে যাচ্ছে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে রহস্যময় আর বিস্ময়কর লেখক হুমায়ূন আহমেদের কাছে।
এক পর্যায়ে আমি বুঝতে পারলাম আমার যে অবস্থা তাতে আর আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না। তাই বেদির পিছনে পুলিশের যে কন্ট্রোল রুম ছিল সেখানে গিয়ে বসলাম। আমি অনুধাবন করলাম, আমার চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে, মুখ একেবারে শুকিয়ে আসছে। অ্যান্টিবায়োটিকস্ এর সাইড ইফেক্ট কিনা বুঝতে পারলাম না। রোযার কারণে এমন হতে পারে ভাবলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ পর যখন চোখের সামনে সবকিছু মুহূর্তের জন্য অন্ধকার হয়ে গেল বুঝলাম সমস্যা অন্য কোথাও। এখানে আর থাকার মতো অবস্থা নেই। বডিগার্ডকে বললাম, গাড়ি নিয়ে সোজা পুলিশ হাসপাতালে যাবে।
হুমায়ূন আহমেদকে দেখার চিন্তা তখনও মাথা থেকে যায়নি। হুমায়ূন আহমেদকে শহীদ মিনার থেকে জানাজার জন্য জাতীয় ঈদগায়ে নেয়া হবে। তখন তাকে আমি দেখবই– এরকমই ছিল শেষ পিরিকল্পনাটা।
হাসপাতলে গিয়ে দেখা গেল আমার জ্বর একশ দুই ডিগ্রী। ডাক্তার সরাসরি বললেন, রোযা ভেঙ্গে বিশ্রামে চলে যান।
আমি যখন বললাম পরশুদিন আমার ফ্লাইট তখন তিনি বড় বড় চোখে বললেন, এরকম জ্বর থাকলে যাবেন কীভাবে?
আমি অ্যান্টিবায়োটিকস্ শুরু করে দিয়েছি। তাহলে বিশ্রাম নিন। আপনার বিশ্রাম প্রয়োজন। মনে হচ্ছে যে কোনো কারণে আপনি মানসিক চাপের মধ্যে আছেন।
মোস্তফা কামালের বিষয়টা নিয়ে আমি সত্যি মানসিক চাপের মধ্যে ছিলাম। কি করব ভেবে না। পেয়ে ডিসি ডিবি সাউথ মনির স্যারকে ফোন করলাম। স্যার কেসটার উপর কাজ করছিলেন। আমি কেসটার বিষয়ে স্যারকে অনুরোধ করলে স্যার জানালেন, অপহরণকারীরা খুব চালাক।
আমি জোর দিয়ে বললাম, স্যার যেভাবেই হোক মোস্তফা কামালকে জীবিত উদ্ধার করতে হবে।
আমার বিশ্বাস আমরা পারব।
কীভাবে বলছেন স্যার?
আমরা মালয়েশিয়ায় যোগাযোগ করেছি। মালয়েশিয়ায় যে নম্বরটা থেকে ফোন করা হচ্ছে ওটার ব্যবহারকারীকে সনাক্ত করা যাবে। ঐ চ্যানেলে কাজ করছি। আশা করছি অল্প সময়ে ভালো অগ্রগতি হবে।
আমি স্যারকে ধন্যবাদ দিয়ে ফোন রেখে দিলাম।
মনির স্যারের সাথে কথা বলার পর আমার নিজেকে খুব হালকা মনে হতে লাগল। কেন যেন। মনে হচ্ছিল কেসটা দ্রুত ডিটেকড় হয়ে যাবে। সব আসামী ধরতে হবে, মোস্তফা কামালকে সুস্থভাবে পুলিশ তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারবে। এরকম মনে হতে নিজেকে অনেকটা সুস্থ মনে হলো আমার।
আরও কিছুক্ষণ বিশ্রামের প্রয়োজন বুঝতে পেরে আমি হাসপাতালেই অবস্থান করলাম। হাসপাতালের টিভিতে সবগুলো চ্যানেলে তখন শহীদ মিনারে হুমায়ূন আহমেদের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের দৃশ্যগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম। সেখানে দেখলাম তার আম্মাও চলে এসেছেন। আমি তখন বুঝতে পারলাম হুমায়ূন আহমেদকে দেখার আর মাত্র দুটি সুযোগ আছে আমার। প্রথমটি জাতীয় ঈদগায়ে এবং দ্বিতীয়টি নুহাশ পল্লীতে তাকে দাফন করার সময়। কিন্তু সময়ের যে স্বল্পতা তাতে নুহাশ পল্লীতে আমার পক্ষে আমার যাওয়া সম্ভব না। কাজেই সুযোগ দুটি এবং তা জাতীয় ঈদগায়ে।
আমি আর দেরি করলাম না। গাড়িতে উঠলাম, গন্তব্য জাতীয় ঈদগাঁও। কিন্তু খুব একটা বেশিদূর এগোতে পারলাম না। তীব্র মাথার যন্ত্রণা আমাকে অস্থির করে তুলল। সাথে জ্বরও বাড়তে লাগল। সাথে নতুন আর এক উপসর্গ দেখা দিল। সেটা হলো বমির ভাব হওয়া। আমার মনে হচ্ছিল আমি যে কোনো সময় বমি করে দিতে পারি।
ওসি শাহবাগকে ফোন করে জানলাম জানাজা শুরু হবে আরও ঘণ্টা দেড়েক পরে। কিন্তু আমি জানতাম দেড় ঘণ্টা পর জানাজা শুরু হবে না। আরও সময় লাগবে। কারণ ওয়াকিটকিতে তখন পুলিশ অফিসারদের বলতে শুনতে পাচ্ছিলাম, ‘দোয়েল চত্বর থেকে শহীদ মিনার পর্যন্ত শুধু মানুষ আর মানুষ, মানুষকে লাইনে দাঁড় করানো যাচ্ছে না, সামনে তাড়াতাড়ি করুন, দ্রুত সবাইকে পাস্ কর…দ্রত..।
আমি বুঝলাম হাতে কিছুটা সময় পাওয়া যাবে। সরাসরি বাসায় চলে এলাম। বাসায় মোবাইল ফোন, ওয়াকিটকি বন্ধ করে নিরিবলি বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। তখন আমি বুঝতে পারছিলাম, সত্যি আমার কিছুক্ষণ বিশ্রাম প্রয়োজন, তা না হলে কোনো কাজই করতে পারব না।
অতিরিক্ত দুর্বলতার কারণে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি পৌনে তিনটা বাজে। বুঝতে পারলাম অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছি। শরীর খুব দুর্বল লাগছিল। আবার ওসি শাহবাগকে ফোন করলাম। জানতে পারলাম জানাজা সম্পন্ন হয়েছে এবং মরদেহ নিয়ে সবাই রওনা করেছে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। মরদেহ এখন নুহাশ পল্লীতে যাবে, সেখানেই হুমায়ূন আহমেদেকে দাফন করা হবে। হুমায়ূন আহমেদকে দেখার আমার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ আমার এই অবস্থায় আমার পক্ষে নুহাশ পল্লীতে যাওয়া সম্ভব না।
এমন সময় ইন্টেলিজেন্স অপস্ থেকে আমাকে ফোন করে জানানো হলো, স্যার, হুমায়ূন। আহমেদের মরদেহ বারডেমে পৌঁছে গেছে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, বারডেমে কেন?
স্যার এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি হুমায়ূন আহমেদেকে কোথায় দাফন করা হবে। মরদেহ আজ বারডেমের হিমঘরে রাখা হবে। আগামীকাল দাফন করা হবে।
আমি সকালে এ ধরনের একটা আভাস পেয়েছিলাম এবং সেরকমই হচ্ছে। আমি বারডেমে হুমায়ূন আহমেদকে দেখার আর একবার সুযোগ পাব ভেবে কিছুটা আশ্বস্ত হলাম।
আমি লক্ষ করলাম বিকেল থেকে আমার জ্বর ছেড়ে যেতে শুরু করেছে। একইসাথে মাথার ব্যথাও কমে আসছে। বমি বমি ভাবটা নেই। বুঝলাম আমার বিশ্বস্ত এজিথ্রোসিন ৫০০ কাজ করতে শুরু করেছে।
সন্ধ্যায় ইফতারের পর যখন এক কাপ চা খেলাম তখন একেবারে সুস্থ হয়ে গেলাম। এই সুযোগে জাতিসংঘ মিশনের জন্য লাগেজগুলো তাড়াতাড়ি গুছিয়ে ফেললাম। সেই সাথে ডকুমেন্টারির যে কাজগুলো বাকি ছিল সেগুলো শেষ করার জন্য ধনিচিত্রে গেলাম। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত দশটা বেজে গেল। বাসায় সবাই আমার উপর তখন কিছুটা হলেও মনক্ষুণ্ণ। কারণ আমি তাদের মোটেও সময় দিচ্ছি না।
রাত সাড়ে দশটা থেকে শুরু হলো ফোন। প্রথম ফোন করল এসিসেট্যান্ট কমিশনার অপারেশন। হুমায়ূন আহমেদকে কোথায় দাফন করা হবে তা জানা তার খুব দরকার। কারণ যদি মীরপুর বুদ্ধিজীবি কবরস্থানে দাফন হয় তাহলে ডেপুটি কমিশনার মীরপুরকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। আর যদি নুহাশ পল্লীতে হয় তাহলে গাজীপুর জানিয়ে দিতে হবে। এরপর শুরু হলো সংবাদিকদের ফোন। অনেক সাংবাদিক জানেন, কিছু কিছু খবর আমি সবার আগে জানতে পারি। তাই একটার পর একটা ফোন আসতে লাগল। আমি একেবারে অস্থির হয়ে। গেলাম। কয়েকজন প্রকাশক ফোন করেও সর্বশেষ অবস্থাটা জানতে চাইলেন। আবার বেশ কয়েকজন লেখকও ফোন করলেন। শেষে ফোন শুরু হলো আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধু-বান্ধবের।
পুলিশের উধর্বতন কর্মকর্তা, পুলিশ কন্ট্রোল রুম আর ইন্টেলিজেন্স অপস এর ফোন তো আছেই।
রাত দেড়টা কি দুইটার দিকে নিশ্চিত সিদ্ধান্ত পাওয়া গেল, হুমায়ূন আহমেদের দাফন হবে নুহাশ পল্লীতে। সেখানেই চির নিদ্রায় শায়িত হবেন বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ।
Leave a Reply