১৫
দুপুর একটা। প্রফেসর মালেক অপারেশন-সংক্রান্ত সভা শেষে তার কক্ষে রিবিটের সাথে কথা বলছেন। প্রফেসর মালেক চেয়ারে বসতে বসতে বললেন : রিবিট, তুমি কোনো চিন্তা করবে না।
চিন্তা কিছু হচ্ছে স্যার। তবে এখন আর আগের মতো না। বলল রিবিট।
তা অবশ্য হওয়ারই কথা। তবে এটা ঠিক, চমৎকারভাবে তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করেছ। আমি তোমার জন্য গর্ব অনুভব করছি।
ধন্যবাদ স্যার। আপনার সহায়তার জন্যই এই অপারেশন সম্ভব হচ্ছে।
না রিবিট। আজকের এই অপারেশনের জন্য তোমার সাফল্যই বেশি। অপারেশন সফল হলে হয়তো আমার অবদানের কথা আসতে পারে, কিন্তু আমি সবসময়ই বলব তুমিই বাচ্চাদুটোর জীবন ফিরিয়ে দেয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছ।
ধন্যবাদ স্যার। আপনারা কখন অপারেশন শুরু করবেন?
তিনটার সময়, অর্থাৎ আর মাত্র দু-ঘণ্টা পর। সবাই এখন বিশ্রামে রয়েছে, অপারেশনের পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করছে। আমাদের ভাগ্য ভালো যে আমি যাদেরকে অনুরোধ করেছিলাম তারা সবাই অপারেশনে অংশগ্রহণের জন্য রাজি হয়েছে। সর্বমোট নয়জন। আমাদের পক্ষ থেকে চেষ্টার কোনো ত্রুটি থাকবে না। এখন সবই ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। তবে আমি আশাবাদী। অবশ্য মেয়েটিকে নিয়ে সংশয় রয়েছে। ওর শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি হয়েছে। অপারেশনটা যদি দু-একদিন আগে করা যেত তাহলে এতটা অসুবিধায় পড়তে হত না।
আপনিই সঠিক বলতে পারবেন স্যার।
হ্যাঁ রিবিট, তুমি ঠিকই বলেছ। আমিই সঠিক বলতে পারব। কিন্তু সবকিছু তো আর আমার ওপর নির্ভর করছে না। যদি সবকিছুই আমার ওপর থাকত, তাহলে আমি নিশ্চিত বাচ্চাদুটোকে বাঁচিয়ে ভোলার জন্য যা যা করার সবকিছুই করতাম।
স্যার আপনার সাথে কি সাইফ নামের এক তরুণ সাংবাদিক দেখা করেছিল?
হা হা, কী যেন টিভি-অনুষ্ঠান তৈরি করবে। আমি অবশ্য ওকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। খুব উদ্যমী ছেলে। ও-ই তো তোমাকে সাহায্য করছে, তাই না?
হ্যাঁ স্যার। ওর জন্যই প্রাথমিকভাবে আমি আর্থিক সমস্যার সমাধান করতে পেরেছি।
রিবিট, আমিও চেষ্টা করছি তোমাকে সাহায্য করার জন্য। আমি সকল ডাক্তারকে অনুরোধ করেছি তারা যেন বিনা-পারিশ্রমিকে আজকের এই অপারেশন করে। যদিও আমি তাদের কাছ থেকে কোনো উত্তর পাইনি, তবে আমার বিশ্বাস তারা আমার প্রস্তাব উপেক্ষা করতে পারবে না।
তাহলে তো স্যার খুবই ভালো হয়। আমাদের খরচ আরো কমে যাবে।
হ্যাঁ সত্য। প্রফেসর মালেক একটু সময় নিয়ে আবার বললেন : আমি আজ একটা বিষয় বিশেষভাবে উপলব্ধি করলাম।
কী বিষয় স্যার?
ভালো কাজের শুরুটা কঠিন। কিন্তু একবার শুরু হয়ে গেলে তখন আর তা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মানুষের অভাব হয় না।
আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না স্যার।
আজকের ঘটনাটা বিশ্লেষণ করতে চেষ্টা করো। তুমি গতরাতে বাচ্চাদুটোকে পেয়েছ। প্রথমে তোমাকে কেউ সাহায্য করতে চায়নি। তুমি বাচ্চাটিকে নিয়ে এদিক-ওদিক অস্থিরভাবে ছুটে বেড়িয়েছ। এমনকি আমি নিজেও প্রথমে তোমার ডাকে সাড়া দিতে চাইনি। অথচ দ্যাখো, কীভাবে তুমি সবকিছুর ব্যবস্থা করে ফেললে। এখন পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে সবাই শুধু বাচ্চাদুটোকে সুস্থই দেখতে চায়, তারা অন্য কিছু ভাবতে পারছে না বা ভাবতে চাচ্ছে না। কাজ করছে মাত্র কয়েকজন মানুষ অথচ শুভকামনা করছে হাজার হাজার মানুষ। আমাকে আমার ওয়ার্ডবয় বলল : প্রতিটি টিভি-চ্যানেলে নাকি এখন এই বাচ্চাদুটোর খবরই প্রচারিত হচ্ছে, অন্য কিছু নয়। এই তুমি, সাংবাদিক সাইফ, ডাক্তার শফিক, নার্স সোমা, আর দু-একজন এই মহান কাজটি শুরু করেছ, আর এখন সবাই চাচ্ছে এই মহান কাজটি সুন্দরভাবে সম্পন্ন হোক। কীভাবে যেন তোমরা ভালোমনের মানুষেরা একজায়গায় জড়ো হয়ে যাও। তারপর সমাজের জন্য ভালো কাজ করতে চেষ্টা করো, আর সমাজ ঠিকই তার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়। এখন যদি তোমারা সবাই পিছিয়েও যাও, তাহলেও এই অপারেশন হবে, হয়তো বাচ্চাদুটো বেঁচেও থাকবে। অর্থাৎ শুধু দরকার ছিল ভালো কাজটি শুরু করে দেয়া, তারপর কাজটি নিজে থেকেই চলতে থাকে। রিবিট, আমার দুঃখ কোথায় জানো? আমরা আমাদের দেশে এই ভালো কাজগুলো সুন্দরভাবে শুরু করতে পারি না।
রিবিট লক্ষ্য করল প্রফেসর মালেক কথা বলার সময় বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছেন। তাই সে বলল : স্যার আমার এখানে থাকা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। এখন আপনার বিশ্রামের সময়। সেই সকাল থেকে আপনি ব্যস্ত রয়েছেন। আমার মনে হচ্ছে এখন কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলে তা আপনার জন্য ভালো হবে।
রিবিট তুমি ঠিকই বলেছ। আমার কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়া প্রয়োজন।
তাহলে আমি উঠি স্যার।
হ্যাঁ তুমি যাও, তুমি তোমার কাজ করো। অপারেশনের আগে আমার সাথে তোমার আর দেখা নাও হতে পারে।
তিনটার আগে আমি অপারেশন থিয়েটারের সামনে থাকব। আপনার সাথে আমার সেখানে দেখা হবে।
তার প্রয়োজন হবে না। তুমি বরং মিডিয়ার লোকজনকে ঠেকাতে চেষ্টা করো। আমাকে একেবারে পাগল করে ফেলল। একটু পর প্রফেসর আবার বললেন : তুমি ঠেকাবে কীভাবে? তোমার অবস্থা তো আমার থেকেও খারাপ। মিডিয়ার লোকজন তোমাকে পেলে তো আর ছাড়তে চাইবে না। ঠিক আছে তুমি যাও, আমি অন্য ব্যবস্থা করছি।
এই বলে প্রফেসর মালেক চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুঝলেন।
রিবিট প্রফেসর মালেকের কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসার সময় নিশ্চিত হল, প্রথমে সে প্রফেসর মালেককে যেমন ভেবেছিল আসলে তিনি সেরকম মানুষ নন। তিনি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল এবং পরোপকারী।
প্রফেসর মালেকের কক্ষ থেকে বের হতেই দেখা হল সাংবাদিক সাইফের সাথে। রিবিট কিছু বলার আগেই সাইফ বলল : কী অবস্থা রিবিট? সবকিছু ঠিক আছে? তোমার খবর কী?
ভালো। তোমার?
মোটামুটি সবকিছু ঠিকই আছে। তবে আমাদের ডকুমেন্টারিটি প্রচারের সময় একটা ত্রিশ মিনিট নির্ধারণ করা হয়েছে। ডকুমেন্টারির সময় কমিয়ে পনেরো মিনিট করা হয়েছে যেন প্রতি ঘণ্টায় এটি অন্তত একবার করে প্রচার করা সম্ভব হয়।
তার মানে তোমরা অনেকবারই ডকুমেন্টারিটি প্রচার করবে?
অবশ্যই। পারলে তো আমার পরিচালক ঘণ্টায় চারবার করত। অবশ্য বাকি সময় তোমার আর বাচ্চাদুটোর সংবাদই প্রচার হচ্ছে। অন্য কোনো অনুষ্ঠান প্রচারের উপায় নেই। দর্শক সবাই তোমাদের সংবাদ জানার জন্য অস্থির হয়ে আছে। অফিসে একটার-পর-একটা ফোন আসছে। জানি না আমাদের এই অনুষ্ঠান প্রচারের পর কী হবে? মিডিয়ার কোনো অফিসেই হয়তো ফোন রাখার সময় পাওয়া যাবে না।
সাইফ, আমার কাছে প্রচার খুব বেশি মনে হচ্ছে।
এটা তো তোমার আমার স্বার্থে করা হচ্ছে না। সত্যিকথা বলতে কী বাচ্চাদুটোর স্বার্থও প্রাধান্য পাচ্ছে না। যা-কিছু করা হচ্ছে বাণিজ্যিক বিষয়কে মাথায় রেখে, দর্শকদের চাহিদার কথা মনে রেখে।
বিষয়টি খুব দুঃখজনক।
হয়তো সত্য, হয়তো নয়। কিন্তু এসব দেখার সময় আমাদের নেই। আমরা সঠিক পথেই রয়েছি। কোনো অন্যায় করছি না। আমাদের মূল লক্ষ্য বাচ্চাদুটোকে বাঁচানো। আর আমরা সেটাই করতে যাচ্ছি এবং ন্যায়ের পথে থেকে।
কিন্তু তাই বলে মিডিয়ার এই প্রচারের উদ্দেশ্যের মধ্যে মানবতা বলে কিছু থাকবে না?
একেবারে যে নেই তা নয়। মানবতার জন্য মিডিয়া অনেক কিছুই করে। তবে বাণিজ্যিক বিষয়টাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মিডিয়াকে টিকে থাকার জন্য বাণিজ্যিক বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখতেই হবে।
সাইফ তুমি ঠিকই বলেছ।
যাইহোক, রিবিট এখন আমাদেরকে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
কী বিষয়ে?
তুমি তো জানো আমরা বাচ্চাদুটোর চিকিৎসার জন্য সাহায্য প্রদানের অনুরোধ জানাচ্ছি। যেহেতু আজ ছুটির দিন এবং ব্যাংক বন্ধ, অনেকে হাতে হাতে সাহায্য প্রদান করতে চাইবে এবং তা তোমার কাছে। আমাদেরকে সেই সাহায্য গ্রহণ করতে হবে। হাসপাতালে অবস্থান করে আমাদের পক্ষে সে সাহায্য গ্রহণ করা সম্ভব নয়। অন্য কোনো স্থান নির্ধারণ করতে হবে।
হাসপাতালে সম্ভব হবে না কেন?
রিবিট, তোমার কি মাথাখারাপ! এখন বাইরে যে-অবস্থা তাতে নিরাপত্তাব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে। লোকজন তোমার আর বাচ্চাদুটোর সংবাদ জানতে পাগল হয়ে গেছে। হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার পর এখন অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
তাই নাকি!
হ্যাঁ। জানি না বিকেলে কী হবে। বাইরে রোদ থাকায় খুব বেশি মানুষ এখনো বের হয়নি। তবে আমার বিশ্বাস, রোদ পড়ার সাথে সাথে মানুষের সমাগমও বৃদ্ধি পাবে। আর এ-কারণেই আমি চাচ্ছি আমরা এখানে সাহায্য গ্রহণ না করি।
তাহলে কোথায় করতে পারি?
সবচেয়ে ভালো হত কোনো সম্মেলনকক্ষে করতে পারলে। কিন্তু এই অল্পসময়ে তা সম্ভব নয়।
তাহলে?
আমরা শহীদ মিনার বা টিএসসিতে করতে পারি।
তোমার কাছে কোন স্থানটিকে বেশি উপযুক্ত মনে হয়?
টিএসসি। কারণ সেখানে এমনিতেই প্রচুর ছাত্রছাত্রী আসে। ভার্সিটি থেকে আমরা ভালো সহযোগিতা পাব। উপরন্তু বুয়েট, ঢাকা মেডিকেল কাছে হওয়ায় সহযোগিতা আরো বাড়বে। তাছাড়া টিএসসি সবার কাছে যেমন পরিচিত তেমনি অন্যান্য জায়গার সাথে এখানকার যোগাযোগব্যবস্থাও ভালো। ‘
ঠিক আছে, তাহলে আমরা টিএসসিতেই সাহায্য গ্রহণ করব।
বিকাল চারটার সময় এবং সেভাবেই টিভিতে ঘোষণা দেয়া হবে। বলল সাইফ।
আচ্ছা।
তাহলে তোমার সাথে আমার টিএসসিতেই দেখা হবে। এখন আমাকে অনুষ্ঠানের বাকি কাজটুকু দ্রুত শেষ করতে হবে। আমি তাহলে আসি।
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ সাইফ।
না রিবিট, ধন্যবাদ যদি কারো পেতে হয় তোমারই পাওয়া উচিত। যাইহোক, আমি আসছি, খুব তাড়াতাড়ি আমাদের আবার দেখা হবে।
কথা শেষ করেই সাইফ দ্রুতপায়ে করিডোর থেকে বেরিয়ে গেল। রিবিট কিছুক্ষণ স্থিরচোখে সাইফের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর অভ্যন্তরীণ
নেটওয়ার্কে ডেকে উঠল; ইপি!
বলো রিবিট। সাথে সাথে উত্তর দিল ইপি।
আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আমরা সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছি।
রিবিট, এ মুহূর্তে তুমি শুধু অর্থসংগ্রহের কথাই ভাবছ। হয়তো তুমি সেটা সংগ্রহ করতে পারবে। তারপরও অনেক কিন্তু থেকে যায়।
কী রকম?
ভাগ্য বলে একটা কথা আছে। যদি ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয় তাহলে তুমি দাবি করতে পারবে তুমি সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছ। যদি এমন হয় যে দুটোবাচ্চার মধ্যে একটি বাচ্চার মৃত্যু হল তাহলে নিশ্চয় তুমি পরিপূর্ণ শান্তি লাভ করতে পারবে না।
ইপি তুমি ঠিকই বলেছ। দুটো বাচ্চার জীবনরক্ষাই আমার মূল উদ্দেশ্য। আচ্ছা এমনকি কোনো উপায় নেই যে আমি ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি?
তা সম্ভব নয় রিবিট। মানুষ অনেক উপায়ে তার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে, যেমন প্রার্থনার মাধ্যমে, হাতে বিভিন্ন রঙের পাথর ব্যবহার করে, সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে কিছু উৎসর্গ করে ইত্যাদি। তবে কোনো উপায়েরই নিশ্চিত নির্ভরযোগ্যতা নেই। সৃষ্টিকর্তা যে কিসে সন্তুষ্ট হবেন তা কেউ জানে না।
রিবিট হতাশ ভঙ্গিতে বলল : হয়তো তাই।
তবে তোমার হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। যেহেতু ভাগ্যের ওপর কারো। হাত নেই সে-কারণে তোমার কিছু করার নেই।
একটা বিষয়ে আমার খুব আক্ষেপ হচ্ছে।
কী বিষয়?
প্রফেসর হক যদি আমাকে ভাগ্যনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা প্রদান করতেন তাহলে আমি দুটো বাচ্চাকেই বাঁচিয়ে দিতাম।
আমি তোমার উদ্দেশ্যকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। পাশাপাশি এটাও বলছি যে তুমি যা আশা করছ তা শুধু অবান্তরই নয়, অসম্ভবও বটে।
রিবিট কিছু বলল না, শুধু উপরে ছাদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।
১৬
চ্যানেল ফোকাস অনেক আগে থেকেই কিছুক্ষণ পর পর প্রচার করছিল যে তারা দুপুর একটা ত্রিশ মিনিট থেকে রিবিটের বক্তব্যসহ যমজ বাচ্চাদুটোর ওপর একটি ডকুমেন্টারি প্রচার করবে। এই ঘোষণা শোনার পর থেকে ডকুমেন্টারি দেখার জন্য সকল দর্শক টেলিভিশনের সামনে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের আগ্রহের যেন শেষ নেই। তারা যে যেভাবে পেরেছে তাদের বন্ধুবান্ধবদেরকে অনুষ্ঠান দেখার জন্য উৎসাহিত করেছে। রিবিট যেন তাদের কাছে এক মহাবিস্ময়! অবিশ্বাস্য কৌতূহল! মহাআনন্দ! পাশাপাশি মহিলাদের আগ্রহেও যেন কমতি নেই। রিবিটের পাশাপাশি বাচ্চাদুটো তাদের মধ্যে প্রচণ্ড উত্তেজনা আর আগ্রহের সৃষ্টি করেছে। প্রতি মুহূর্তে তারা বাচ্চাদুটোর অবস্থা জানার জন্য অস্থির হয়ে আছে।
ঠিক দুপুর একটা ত্রিশ মিনিটের সময় চ্যানেল ফোকাস বাচ্চাদুটোর ওপর ডকুমেন্টারি প্রচার করতে শুরু করল। লক্ষ লক্ষ দর্শক তখন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে টিভিসেটের দিকে। প্রথমেই দেখান হল বাচ্চা দুটোকে, ওদের অসহায়ত্ব আর কষ্টকে। বর্ণনা করা হল ওদের জীবনের অস্বাভাবিকতা আর চরম অনিশ্চয়তাকে। সম্পূর্ণ বিষয়টিকে সাইফ তার প্রাণবন্ত আর হৃদয়ছোঁয়া উপস্থাপনায় এমনভাবে উপস্থাপন করল যে দর্শকদের চোখে প্রায় পানি এসে গেল। শিশু-কিশোররা এতটাই আবেগপ্রবণ হয়ে উঠল যে তাদের কেউ কেউ বাচ্চাদুটোর মঙ্গলকামনায় অস্থির হয়ে উঠল।
টেলিভিশনের পর্দায় এরপর দেখা গেল রিবিটকে, যাকে একনজর দেখার জন্য, যার একটু কথা শোনার জন্য সকলে অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিল। টেলিভিশনের পর্দায় রিবিটকে দেখামাত্র সবাই নিজেদের মধ্যে কেমন যেন অজানা উত্তেজনা আর আবেগ অনুভব করল। সবাই নিশ্বাস নিতেও যেন ভুলে গেল। এক দৃষ্টিতে গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকল টিভিপর্দার দিকে।
রিবিট যা-কিছু দেখে, যা-কিছু করে, শোনে বা বলে, সবকিছুই তার অভ্যন্তরের মেমোরিতে সংরক্ষিত থাকে। রিবিট ডকুমেন্টারি প্রচারের আগেই গতকাল থেকে এ পর্যন্ত বাচ্চাদুটো সংক্রান্ত উল্লেখযোগ্য অংশের ভিডিও একটি সিডিতে রাইট করে তা সাইফকে দিয়েছিল। সেখান থেকেই বিভিন্ন অংশ এডিট করে রিবিটের বক্তব্যের সাথে সাথে সেটা প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফলে দর্শক গতরাতের সকল ঘটনা টেলিভিশনে দেখতে পাবে। তাদের মনে হবে সকল ঘটনা বুঝি তাদের চোখের সামনেই ঘটছে। তবে রিবিট সবসময়ই সতর্ক থেকেছে যেন এই ভিডিও প্রচারে কারো কোনো ক্ষতি না হয়, কেউ যেন অপমানিত না হয় অথবা কারো যেন মানহানি না ঘটে।
রিবিট যখন কথা বলতে শুরু করল তখন তার গলার স্বর খুব ধীর এবং কিছুটা দুঃখ-ভারাক্রান্ত। সে বলতে শুরু করল :
মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে ছোট্ট দুটো নিষ্পাপ শিশুর মঙ্গল কামনার মাধ্যমে, আমি রিবিট অতিউচ্চ বুদ্ধিমাত্রার রোবট, আপনাদের কাছে শিশুদুটোর জীবনরক্ষার্থে সাহায্যের আশা করছি। প্রিয় দর্শক, মানুষ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জীব, মানুষ মহাবিশ্বে সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী, মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব, সবচেয়ে হৃদয়বান প্রাণী। আমার গত কয়েকঘণ্টার অভিজ্ঞতায় আমি অনেকবার অনেকভাবে মানুষের এসকল অসাধারণ গুণের প্রমাণ পেয়েছি। তাই আমি নিজেকে মানুষের মধ্যে পেয়ে অত্যন্ত গর্বিত এবং আনন্দিত। তবে এ-মুহূর্তে আমার এই গর্ব এবং আনন্দ অনেকটা ম্লান হয়ে পড়েছে। কারণ নিম্ফাপ অসহায় দুটো মানবশিশু আজ জীবনসায়াহ্নে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। আমি আমার সর্বাত্মক চেষ্টা করে বুঝতে পেরেছি আমার মতো যন্ত্রের পক্ষে এই মানবশিশুকে বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব নয়, মানবশিশুকে একমাত্র মানুষই বাঁচিয়ে তুলতে পারে। মানুষের স্পর্শ ব্যতীত মানবশিশু বেঁচে থাকতে পারে না, মানবশিশু বিকশিত হতে পারে না, মানবশিশু মানুষ হিসাবে নিজেকে মর্যাদাবান করে গড়ে তুলতে পারে না। তাই এ-মুহূর্তে আপনাদের সহযোগিতা ছাড়া শিশুদুটোকে বাঁচিয়ে তোলা, তাদের নতুন জীবন দেয়া, তাদের মুখে হাসি ফোঁটানো সম্ভব নয়। তাই তো ওদেরকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য আপনাদের কাছে সাহায্যের জন্য আমার এই আকুল আবেদন।
প্রিয় দর্শক, আপনারা টেলিভিশনের পর্দায় দেখতে পাচ্ছেন গতকাল কোথায় এবং কীভাবে আমি সংযুক্ত যমজ বাচ্চাদুটোকে পেয়েছিলাম। একটি ডাস্টবিনের পাশ থেকে কুড়িয়ে পাওয়ার পর ওদেরকে পাশের একটি বাসায় নিয়ে যাই। উক্ত বাসার সকল সদস্য আমাদেরকে যথেষ্ট সাহায্য করে। তারা বাচ্চাদুটোর জন্য দুধের ব্যবস্থাও করে। ছেলেবাচ্চাটি দুধ খেলেও মেয়েবাচ্চাটি তখন থেকেই কিছু খাচ্ছিল না। তাই ওদের অসুস্থতার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য ওদেরকে নিয়ে পাশের একটি ক্লিনিকে যাই। সেখানে কর্তব্যরত ডাক্তার বাচ্চাদুটোর অসুস্থতার বিষয় নিশ্চিত করে। যেহেতু উক্ত ক্লিনিকে শিশুদের চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা ছিল তাই ওদেরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসি এবং সেখানে ওদেরকে ভর্তি করা হয়। এখানে প্রফেসর মালেকের তত্ত্বাবধানে এবং ডাক্তার শিপন, নার্স সোমা এবং অন্যান্যদের সহযোগিতায় অতিদ্রুত বাচ্চাদুটোর ডায়াগনোসিস সম্পন্ন করা হয়। অবশেষে জানা যায় যে বাচ্চাদুটোর জীবন সংকটাপন্ন। মেয়েবাচ্চাটির মস্তিষ্কে একটি টিউমার রয়েছে যা অতি অল্পসময়ে ছেলেবাচ্চাটির মাথায় বিস্তৃত হবে। আর এ কারণে মেয়ে বাচ্চাটির শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ এবং তা ছেলেটিকেও প্রভাবিত করছে। আর তাছাড়া কোনোভাবে যদি ওরা এ-যাত্রায় বেঁচেও যায় তাহলে ওদের ভবিষ্যৎ জীবন আরো দুর্বিষহ, যন্ত্রণাময় হয়ে উঠবে এবং ওরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে না। কারণ ওদের একজন ছেলে এবং অন্যজন মেয়ে। কাজেই অপারেশন ছাড়া এখন কোনো বিকল্প নেই। আর এই অপারেশনের জন্য তিন লক্ষ টাকার প্রয়োজন। ইতিমধ্যে যদিও এক লক্ষ টাকার ব্যবস্থা হয়েছে, বাকি দুই লক্ষ টাকা আগামী দু-একদিনের মধ্যে সংগ্রহ করতে হবে। তা না হলে বাচ্চাদুটোকে বাঁচান কঠিন হয়ে পড়বে।
প্রিয় দর্শক, মানবশিশু মহান সৃষ্টিকর্তার এক অপূর্ব এবং বিস্ময়কর সৃষ্টি। সর্বোচ্চ বুদ্ধির অধিকারী মানুষ, শিশু অবস্থায় যে কতটা অসহায় থাকে, এই মানবশিশু দুটো তার জ্বলন্ত প্রমাণ। ওরা কিছু বলতে পারে না, কিছু চাইতে পারে না, কিছু বোঝাতে পারে না, কিছু করতে পারে না। তবে ওরা অনেক কিছু উপলব্ধি করতে পারে, অনুধাবন করতে পারে। মস্তিষ্কের অভ্যন্তরের টিউমারের তীব্র যন্ত্রণা যে ওদের শরীরকে নিস্তেজ করে দিচ্ছে সেটা ওরা বুঝতে পারে। তাই তো শুধু অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বিবেকবান মানব জাতির দিকে, যদি কেউ একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসে, যদি কেউ ওদের প্রতি এতটুকু সহানুভূতি প্রকাশ করে, যদি কেউ ওদের কষ্টকে এতটুকু হলেও উপলব্ধি করে। প্রিয় দর্শক, আপনাদের বিন্দু পরিমাণ সাহায্য ওদের জীবন রক্ষার জন্য বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে। ওরা তো এই সমাজ তথা এই মানুষেরই সন্তান। পরিবেশ পরিস্থিতি এবং ভাগ্যের কারণেই আজ ওদের এই অবস্থা। যে সমাজ ওদেরকে জন্ম দিয়েছে, যে সমাজ ওদেরকে পৃথিবীতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে, যে সমাজ ওদেরকে এতদিন বাঁচিয়ে রেখেছে, সেই সমাজের কি উচিত হবে না ওদের জীবনকে রক্ষা করা? অবশ্যই হবে। তাই তো সবার প্রতি আমার অনুরোধ এই অসহায় শিশুদুটোর জীবনরক্ষার্থে আমরা সবাই এগিয়ে আসি। আমরা যারা ছোট্ট শিশু কিশোর রয়েছি তারা যেমন এই অসহায় শিশুদুটোকে স্কুলের একদিনের টিফিনের টাকা দিয়ে সাহায্য করতে পারি, তেমনি অন্যরা নিজ নিজ ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের একটি অংশ, তা যত সামান্যই হোক না কেন, প্রদানের মাধ্যমে বাচ্চাদুটোকে নতুন জীবন প্রদানের চেষ্টা করতে পারি। আমি বিশ্বাস করি এই সমাজ অবশ্যই এই ছোট্ট বাচ্চাদুটোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেবে। কারণ সমাজ তো মানুষেরই সৃষ্টি। যে মানুষ মহান, যে মানুষ দয়াবান, যে মানুষ মমতাময়ী, যে মানুষ হৃদয়বান, যে মানুষ সহানুভূতিশীল, সেই মানুষের সমাজ কখনো দুটো শিশুকে এতটা অসহায়ভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে না। আমরা সবাই ওদের মুখে হাসি দেখতে চাই, যে হাসিতে তারা বলবে : হে মহান মানুষ, হে সৃষ্টির সেরা জীব; তোমরা আমাদেরকে বাঁচিয়েছ, তোমরা তোমাদের সন্তানকে, তোমাদের ভাই এবং বোনকে বাঁচিয়েছে, তাদের অসহায়ত্বের সময় তোমরা পাশে এসে
দাঁড়িয়েছে; তোমরা সত্যিই মহান, ভালোবাসায় ভরা সত্যিই সৃষ্টির সেরা জীব; মনের গভীর থেকে আমরা তোমাদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, তোমাদেরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, তোমাদের মহত্ত্বকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।
রিবিট যখন শেষ কথাগুলো বলল তখন তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। শুধু রিবিটই নয়, টেলিভিশনের সামনে বসে থাকা অনেকে রিবিটের বাচনভঙ্গি, স্বরের ওঠানামা আর আবেগভরা আহ্বানে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ল। পারলে তারা অনেকেই এখনই সাহায্য প্রদানের জন্য ছুটে যায়।
রিবিটের পরই টেলিভিশনে অমিকে দেখা গেল। গতকাল রাতে রিবিট অমিদের বাসায়ই গিয়েছিল। সাইফ একথা শোনার পর সে এই অনুষ্ঠানে অমিকে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। অমির আহ্বানে ছোট্ট শিশু-কিশোররা সাড়া দেবে এটাই সাইফের উদ্দেশ্য।
টেলিভিশনের পর্দায় অমিকে দুঃখ-ভরাক্রান্ত মনে বলতে শোনা গেল : প্রিয় বন্ধুরা, আমি অমি। গতরাতে রিবিট বাচ্চাদুটোকে নিয়ে আমাদের বাসায়ই এসেছিল। কী অসহায় বাচ্চাদুটো! এমনকি ঠিকমতো খেতেও পারে না। অথচ ওদের চোখে বেঁচে থাকার আশা। ওদেরকে বাঁচিয়ে তোলার দায়িত্ব আমাদেরই। ওরা আমাদেরই ভাইবোন। প্রিয় বন্ধুরা, তোমরা যারা আমার মতো কিংবা আমার থেকে ছোট বা বড়, আমাদের সবাইকে এই দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। আমি টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে ভিডিও গেমস্ কেনার জন্য যে দুইশো একাত্তর টাকা জমিয়েছিলাম তা আমি আজ বাচ্চাদুটোর চিকিৎসার জন্য দিয়ে দিচ্ছি। আমি তোমাদের সকলকে অনুরোধ করব তোমরাও এগিয়ে আসো। তোমাদের সাহায্য যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, তা এই মহান কাজের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া আমাদের বন্ধু রিবিট যে-স্বপ্ন আর আশা নিয়ে বাচ্চাদুটোকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে আমাদের উচিত আমাদের বন্ধুর এই স্বপ্ন আর আশাকে বাস্তবায়নে সহায়তা করা। তাই আমাদের সকলের সাহায্য শুধু দুটো শিশুর জীবনই বাঁচাবে না, রিবিটের মতো ভালোবন্ধুর কাজকেও উৎসাহিত করবে। প্রিয় বন্ধুরা, এসো আমরা সবাই এক হয়ে একটি ভালো কাজ করি, বাচ্চাদুটোকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য আমরা যে যেভাবে পারি সাহায্য করি, আর সবাই প্রার্থনা করি ওরা যেন খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে আমাদের মতো সুন্দর জীবন লাভ করতে পারে।
অমির পর প্রফেসর মালেককে কথা বলতে দেখা গেল। প্রফেসর মালেক বললেন : প্রিয় দর্শক, মানুষ হিসাবে আমাদের কর্তব্য মানুষকে সহায়তা করা। আর সাহায্যপ্রার্থী মানুষটি যদি অসহায় শিশু বা কিশোর হয় তাহলে এই কর্তব্যের দায় আরো বেড়ে যায়। আজ আমাদের সময় এসেছে নিজেদের কর্তব্যকে পালন করার। ছোট্ট দুটো শিশু মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে লড়তে জীবনসায়াহ্নে এসে দাঁড়িয়েছে। আসুন আমরা চেষ্টা করে দেখি ওদেরকে বাঁচানো যায় কিনা? আপনার আমার সামান্য সাহায্য হয়তো ওদের জীবনকে আবারো সুন্দর আর উচ্ছল করে তুলবে। প্রিয় দর্শক, পাশাপাশি ওদের দুজনের জন্য অবশ্যই দোয়া করবেন। কারণ ওদের শরীরে জটিল অস্ত্রোপচার করতে হবে। আমি জানি এবং বিশ্বাস করি আপনারা আপনাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেন। কিন্তু সাহায্যের পাশাপাশি মহান সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছেটাও অনেক বড় ব্যাপার। তাই তার কাছে আমাদের প্রার্থনা থাকবে তিনি যেন শিশুদুটোকে পৃথিবীতে আবার নতুন এবং সুস্থ-সুখী জীবন দান করেন। আমাদের জন্যও আপনারা প্রার্থনা করবেন, যেন আমাদের টিমের সকল সদস্য যথাযথভাবে কোনোরকম প্রতিকূলতা ছাড়াই ওদের অপারেশন সম্পন্ন করতে পারে।
প্রফেসর মালেকের বক্তব্যের পর সাইফ বাচ্চাদুটোর বর্তমান শারীরিক অবস্থা এবং সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বর্ণনা করল। তারপর সকলের কাছে সে যে আহ্বান জানাল তার সারসংক্ষেপ এরকম :
প্রিয় দর্শক, আপনারা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন বাচ্চাদুটো কী জটিল পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। এ মুহূর্তে ওদের বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন আর্থিক সাহায্য। এই আর্থিক সাহায্য ব্যতীত বাচ্চাদুটোর জন্য ওষুধ পর্যন্ত কেনা সম্ভব হচ্ছে না। এরকম দুটো নিষ্পাপ শিশু চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করবে তা নিশ্চয় আমরা কেউ চাই না। তাই আসুন ওদেরকে সাহায্য করতে, ওদের মুখে হাসি ফোঁটাতে, ওদেরকে নতুন জীবন প্রদান করতে আমরা এগিয়ে আসি। আপনারা যারা সরাসরি রিবিটের নিকট সাহায্য প্রদান করতে চান তারা আজ বিকাল চারটার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে আসতে পারেন। আর যাদের পক্ষে আসা সম্ভব নয় তারা ‘লাইফ ব্যাংকে চ্যানেল ফোকাসের ‘মানবকল্যাণ’ হিসাব নম্বর টি-৯৩৭৫২১১-তে সরাসরি আর্থিক সাহায্য প্রেরণ করতে পারেন। আর এ-বিষয়ে রিবিটের সাথে যোগাযোগ করতে হলে রিবিটের ই-মেইল এ্যাকাউন্টে [email protected] মেইল করতে পারেন অথবা সরাসরি চ্যানেল ফোকাসের গ্রাহকসেবা নম্বরে ফোন করতে পারেন। সবশেষে আমরা আশা করব, আপনারা এই অসহায় শিশুদুটোকে বাঁচাতে এগিয়ে আসবেন। হয়তো আপনাদের আর্থিক সাহায্য আর আশীর্বাদের কারণেই ওরা আবার নতুন জীবন লাভ করবে।
এতক্ষণ রিবিট নিজেও অনুষ্ঠানটি দেখছিল। অনুষ্ঠান শেষ হতে সে ইপিকে বলল : ইপি আমার মনে হচ্ছে আমরা সঠিক পথেই অগ্রসর হচ্ছি।
রিবিট, আমার লজিক সেরকমই বলছে।
তাহলে আমাদেরকে বিকাল চারটায় টিএসসিতে যেতে হবে।
হ্যাঁ। তার আগে তুমি একবার প্রফেসর মালেকের সাথে দেখা করতে পারো। তিনি কিছুক্ষণের মধ্যেই অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করবেন।
তার কি আর প্রয়োজন আছে?
আপাতদৃষ্টিতে নেই। তবে শেষমুহূর্তে তিনি যদি কোনোকিছুর প্রয়োজন মনে করেন সেজন্যই বলছিলাম।
ধন্যবাদ ইপি। আমি যাচ্ছি।
রিবিট এইমাত্র আমি তোমার কাছে লেখা সাতবছরের একটি ছেলের ই-মেইল পেয়েছি। সে বাচ্চাদুটোর জন্য তার জমানো একুশ টাকা সাহায্য হিসাবে প্রদান করতে চায়।
চমৎকার। তুমি ওকে মেইল করে টিএসসিতে আসার বিষয়টি জানিয়ে দাও। তবে অবশ্যই যেন কোনো অভিভাবকের সাথে আসে।
হ্যাঁ জানাচ্ছি।
ধন্যবাদ দিতে ভুলো না কিন্তু।
না না, ভুলব না।
আর হ্যাঁ, তুমি এই ই-মেইলগুলোর উত্তর দিতে থাকো। খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু হলে আমাকে জানিও।
আমি সেরকমই করব। সম্ভবত ই-মেইলের সংখ্যা অনেক বেশি হবে। এরই মধ্যে আরো তিনটি ই-মেইল এসেছে। তাছাড়া চারজন তোমার সাথে চ্যাট করার জন্য অনলাইনে অপেক্ষা করছে। তিনজন তোমার সাথে ভয়েস মেইলে কথা বলতে চাচ্ছে। সম্ভবত এরা সবাই শিশু-কিশোর হবে। অধিকাংশই তাদের নাম, বয়স, স্কুলের ঠিকানা লিখে পাঠিয়েছে। তারা তাদের সাহায্য প্রদানের কথাও বলছে। রিবিট, তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ তোমার জনপ্রিয়তা কীভাবে বাড়ছে।
ইপি, তুমি ‘জনপ্রিয়তা’ না বলে ‘গ্রহণযোগ্যতা’ শব্দটি ব্যবহার করতে পারো। কারণ ‘জনপ্রিয়তা’ শব্দটি স্বার্থ বা রাজনীতিবিষয়ক মনে হয়। আর গ্রহণযোগ্যতা শব্দটির মধ্যে একরকম নিরপেক্ষভাব রয়েছে। যাইহোক, আমরা আর যাই করি এ-মুহূর্তে কোনো শিশু-কিশোরের সাথে অহেতুক চ্যাট করতে চাচ্ছি না। তাহলে ওদের পড়াশোনার মারাত্মক ক্ষতি হবে। ই-মেইলের মাধ্যমে শুধু ছোট ছোট উত্তর প্রদান করব।
রিবিট, তোমার সিদ্ধান্ত সঠিক। আমি সেভাবেই সবগুলো ই-মেইলের উত্তর দিয়ে দিচ্ছি।
কথা বলতে বলতে রিবিট অপারেশন-থিয়েটারের সামনে চলে এল। সেখানে আগে থেকেই নার্স সোমা দাঁড়িয়ে ছিল। সে ভিতরে প্রবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। রিবিট তাকে বলল : কী খবর সোমা?
এখন পর্যন্ত ভালো। বাচ্চাদুটোকে অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হয়েছে। মালেক স্যার ছাড়া সবাই ভিতরে আছে। স্যার এক্ষুনি ভিতরে ঢুকবেন।
সোমার কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রফেসর মালেক উপস্থিত হলেন। তিনি রিবিটকে দেখে একগাল হেসে বললেন : রিবিট তুমি এখানে এসেছ, ভালোই করেছ। সত্যিকথা বলতে কী তোমাকে দেখলে কেন যেন আমি প্রেরণা পাই।
এই প্রথম রিবিট প্রফেসর মালেককে এভাবে হাসতে দেখল। তার খুব ভালো লাগল। বলল : স্যার আপনাকে ধন্যবাদ। বাচ্চাদুটোর কী অবস্থা স্যার?
প্রফেসর মালেক এবার হো হো করে হেসে উঠে বলল : ভালো খুব ভালো। কোনো চিন্তা কোরো না। ইনশাল্লাহ কোনো অসুবিধা হবে না। তবে…
তবে কী স্যার?
বাচ্চাদুটোর নাম রাখা হল না। ওদের যে আসল নাম কী তাও জানা হল না।
ওদের নাম রাখার অধিকার তো আমাদের নেই স্যার। একমাত্র ওদের বাবা মাই ওদের নাম রাখার অধিকার রাখে। যেহেতু ওদের মা কিংবা বাবা কারোরই সন্ধান নেই, সেজন্য ওদের নামও জানা যাচ্ছে না।
আমার মনে হয় সন্ধান আছে রিবিট।
রিবিট অবাক হয়ে বলল : ওদের মা বাবা কোথায় আপনি জানেন স্যার?
না জানি না। তবে অনুমান করতে পারছি।
কী অনুমান?
আমার বিশ্বাস ওদের বাবা কিংবা মা, হয়তো মা-ই হবে, আশেপাশে কোথাও আছে। আমি নিশ্চিত কোনো মা মাঝরাতে তার সন্তানকে ডাস্টবিনে ফেলে রেখে চলে যেতে পারে না। হয় সে আশেপাশে থাকবে, তা না হলে আবার ফিরে আসবে। রিবিট তুমি জানো না মানুষের ভালোবাসা কত গভীর, কত শক্তিশালী..আর, মায়ের ভালোবাসা…এ গভীরতা, এ ভালোবাসার বন্ধন সকল শক্তির ঊর্ধ্বে। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী আর গভীর ভালোবাসা হলো মা সন্তানের ভালোবাসা। রিবিট, বাচ্চাদুটোর মাকে খুঁজে বের করাও তোমার গুরুত্বপূর্ণ কাজ। যে মা তার বাচ্চাকে এভাবে ডাস্টবিনে ফেলে রেখে যায়, সেই মা এ ঘটনার জন্য দায়ী কিংবা দোষী হতে পারে না। সেই দায় বা দোষ এই সমাজের, যে সমাজ মায়ের কোলেও সন্তানের জীবনের নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারে না। রিবিট, তুমি তোমার চোখ-কান খোলা রাখবে, দেখবে হয়তো… আশেপাশেই তুমি বাচ্চাদুটোর মা, কে পেয়ে গেছ।
প্রফেসর মালেক আর দাঁড়ালেন না। তিনি দ্রুতপায়ে অপারেশন থিয়েটারের ভিতরে চলে গেলেন। তার পিছন পিছন নার্স সোমাও গেল।
রিবিট লক্ষ্য করেছে শেষকথাগুলো বলার সময় প্রফেসর মালেকের গলা কেমন যেন আবেগময় আর দুঃখ-ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল। তিনি ঠিকমতো কথাও বলতে পারছিলেন না, কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছিল।
রিবিট ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না কেন প্রফেসর মালেক হঠাৎ এতটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। তবে প্রফেসরের কথাগুলো তার মনের মধ্যে বেশ প্রভাব ফেলেছে। সে বুঝতে পারছে কথাগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা শতভাগ। তাই সে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চারদিকে তাকাল। আশেপাশে অনেকেই আছে। কিন্তু কাউকেই তার বাচ্চাদুটোর মা কিংবা বাবা বলে মনে হল না।
১৭
ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে উপচে পড়া ভিড়। সবারই একই প্রশ্ন : বাচ্চাদুটোর কী হল? আদৌ ওরা বাঁচবে কিনা? ঠিকমতো চিকিৎসা হচ্ছে কিনা? ভিড় সামলাতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অতিরিক্তি দশ প্লাটুন পুলিশ নিয়োগে বাধ্য হয়েছে। এ মুহূর্তে রিবিটের চেয়ে বাচ্চাদুটোই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। এদিকে চ্যানেল ফোকাস মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সবকিছু বিবেচনা করে তাদের ডকুমেন্টারি বিনামূল্যে সবগুলো টিভি চ্যানেলকে প্রচারের অনুমতি দিয়েছে। ফলে প্রত্যেকটি টিভি-চ্যানেলেই এখন এই ডকুমেন্টারি প্রচার করা হচ্ছে। পাশাপাশি বাচ্চাদুটোর সার্বিক পরিস্থিতি নিয়েও ক্রমাগত অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে চ্যানেলগুলো। এক্ষেত্রে রেডিও পিছিয়ে নেই। একটু পর পর বিশেষ ঘোষণার মাধ্যমে তারাও বাচ্চাদুটো সম্পর্কে বিশেষ বুলেটিন প্রচার করছে এবং সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছে। ফলে একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত সংবাদ পৌঁছে যাচ্ছে। এ ছাড়া দুটি জাতীয় পত্রিকা ইতিমধ্যে রিবিট এবং বাচ্চাদুটোর ওপর বিশেষ কড়চা প্রকাশ করেছে। অন্যান্য পত্রিকাও বিশেষ কড়চা বের করার প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করে ফেলেছে। এসব কারণেই বাচ্চাদুটোর সংবাদ এখন সবার মুখে মুখে।
বিকাল চারটার সময় রিবিট এবং সাইফ যখন টিএসসিতে এসে পৌঁছাল তখন টিএসসিতে শুধু টিভি-ক্যামেরা আর টিভি-ক্যামেরা। অবশ্য সাংবাদিকদের পাশাপাশি পুলিশও রয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে দাঙ্গাপুলিশ পর্যন্ত মোতায়েন করা হয়েছে। ইতস্ততভাবে অনেকে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ালেও মানুষের ভিড় ততটা নেই। রিবিট খানিকটা আশঙ্কিত গলায় বলল : সাইফ, তোমার কি মনে হচ্ছে আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করতে পারব?
সাইফ অবাকচোখে বলল : রিবিট কী ঘটতে যাচ্ছে তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। মানুষ তোমাকে কীভাবে গ্রহণ করেছে তা তুমি ভাবতেও পারছ না।
কিন্তু সাহায্য প্রদানের জন্য আমি আশেপাশে কাউকে দেখছি নাতো।
রিবিট এখন চারটা বাজে। আমার বিশ্বাস সবাই এখন বাসাবাড়ি থেকে রওনা দিয়েছে। হয়তো আর আধঘণ্টা থেকে একঘণ্টার মধ্যে এখানে এসে পৌঁছাবে।
যদি না পৌঁছায়।
পৌঁছাবেই। মানুষ যখন বুঝতে পারে ভালো কাজের জন্য তাদের প্রদত্ত অর্থের কোনো অপচয় হবে না, অপব্যবহার হবে না, তখন তারা অর্থ প্রদানে কার্পণ্য করে না। আমি বিশ্বাস করছি কিছুক্ষণের মধ্যেই তুমি তার প্রমাণ পাবে। তাছাড়া আরো অনেক ভালো সংবাদ রয়েছে।
কী রকম?
প্রফেসর মালেক অপারেশন-থিয়েটারে প্রবেশের আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজের আবাসিক হলে যেয়ে আবাসিক ছাত্রছাত্রীদের সাহায্য প্রদানের জন্য দারুণভাবে উজ্জীবিত করেছেন। কাজেই ঢাকা মেডিকেল কলেজের সকল ছাত্রছাত্রী আমাদের সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসবে। বুয়েটেও ইতিমধ্যে দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। যেহেতু তোমাকে বুয়েটের প্রফেসর সৃষ্টি করেছে, বুয়েটের সকল ছাত্রছাত্রী ধরে নিচ্ছে তোমার অর্থ তাদেরই দায়িত্ব। ইতিমধ্যে প্রত্যেক হলেই বাচ্চাদুটোকে সাহায্য প্রদানের জন্য তহবিল গঠন করা হয়েছে। ওরা হয়তো সন্ধ্যার আগেই তোমার কাছে আসবে। আর ঢাকা ভার্সিটির কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশের সকল জাতীয় সমস্যার ক্ষেত্রে ঢাকা ভার্সিটির ছাত্রছাত্রীদের অবদান অবিস্মরণীয়। আর তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ জাতীয় সমস্যার তুলনায় তোমার আমার এই সমস্যার গুরুত্ব কতটুকু। শুধু ঢাকা ভার্সিটির ছাত্রছাত্রীরাই মুহূর্তের মধ্যে তোমার এই সমস্যার সমাধান করতে পারে। আমাদের শুধু দরকার ছিল তাদেরকে উজ্জীবিত করা, তাদেরকে সম্পূর্ণ বিষয়টি বোঝানো। আমরা সেটা করতে পেরেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর নিজেই এক লাখ টাকা সংগ্রহের উদ্যেগ নিয়েছেন।
কী বলছ তুমি!
হ্যাঁ, আমি যা বলছি সবই সত্য। রিবিট সত্যিকথা বলতে কী আমি নিজেও খুব উত্তেজিত, শিহরিত, প্রকম্পিত। তুমি যে-কাজ করছ নিজেকে তার সাথে সম্পৃক্ত করতে পেরে সত্যিই আমি অভিভূতি, মুগ্ধ, আনন্দিত।
আমি একা কোনো কাজ করছি না। আমরা সবাই মিলে করছি।
না না রিবিট। মানুষের ভালোবাসা, বিশ্বাস, শ্রদ্ধা পাওয়া এতটা সহজ নয় যেমন তুমি ভাবছ। অথচ তুমি সেই ভালোবাসা, বিশ্বাস আর শ্রদ্ধা অর্জন করতে যাচ্ছ।
রিবিট কিছু বলতে যাচ্ছিল। এমন সময় ইপি বলল : রিবিট, এইমাত্র আমি তিন হাজারতম ই-মেইলটির উত্তর প্রদান করলাম। এই তিন হাজার ই-মেইলের মধ্যে দুই হাজার চারশো তেত্রিশটা মেইল শিশু-কিশোরদের, চারশো বারোটি মেইল মহিলাদের এবং বাকি একশো পঞ্চান্নটি মেইল অন্যান্যদের। এ মুহূর্তে যে হারে তোমার কাছে মেইল আসছে তাতে তোমার নেটওয়ার্ক জ্যাম কিংবা স্লো হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশে যদি ঘরে ঘরে ই-মেইল থাকত তাহলে কী হত আমার লজিক তার ব্যাখ্যা প্রদান করতে পারছে না। অনেকে তো একের-পর-এক মেইল করেই চলছে।
ইপি, তুমি ওদেরকে নিষেধ করো যেন বারবার ই-মেইল না পাঠায়।
ওরা তো আমার কথা শুনছে না। বিশেষ করে ছোট ছোট শিশু-কিশোররা নাছোড়বান্দা। আমি যতই ওদেরকে মেইল পাঠাতে নিষেধ করছি ততই ওরা বেশি বেশি মেইল পাঠাচ্ছে। উপরন্তু বন্ধুবান্ধব যা আছে সবাইকে সংবাদ দিয়ে তোমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে মেইল করতে বলছে। তুমি চিন্তা করতে পারো এখন প্রায় এক হাজার সাতশো উনত্রিশ জন শিশু-কিশোর তোমার সাথে অনলাইনে কথা বলার জন্য কম্পিউটারের সামনে বসে আছে। অনেকে তোমার সাথে কথা বলতে না-পেরে তোমার সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। তারা অনুরোধ করেছে তারা না-আসা পর্যন্ত তুমি যেন এখানে থাকো।
ইপি, তোমার পরিসংখ্যানে আমি সত্যি বিস্মিত হচ্ছি।
আর এজন্যই বলছি সাইফের কথা মিথ্যা নয়। রিবিট তুমি যে মানুষ, বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের কাছ থেকে কী পরিমাণ ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা অর্জন করতে যাচ্ছ তা কল্পনাতীত।
ইপি তোমাকে ধন্যবাদ। কিন্তু তুমি নিশ্চয় জানো মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা অর্জন করার চেয়ে আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মানুষের কল্যাণ সাধন করা।
তুমি ঠিক বলেছ রিবিট। আর এজন্যই তোমাকে সবসময় মনে রাখতে হবে একজন মানুষের ভালোবাসা অর্জন করতে যেয়ে তুমি যেন অন্য কারো ক্ষতি না করো অথবা অন্য কারো কাছে অপ্রিয় হয়ে না যাও।
ইপি, আমি কি এমন কিছু করছি?
না রিবিট না। আমার লজিক বলছে তুমি সঠিক পথেই এগোচ্ছ, ন্যায়ের পথে রয়েছ এবং মানুষের কল্যাণের জন্যই কাজ করছ।
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ইপি।
এদিকে সাইফ টিএসসির ঢাকা ইউনিভার্সিটি স্ন্যাক্স বা ডাচের পিছনে ছোট্ট একটা টেবিল বসিয়েছে। সেই টেবিলের পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে তারা। বিষয়টি খুবই অনানুষ্ঠানিক হলেও সাংবাদিক এবং পুলিশের উপস্থিতিতে যেন মহা আনুষ্ঠানিকতার রূপ নিয়েছে। ডানপাশে মানুষের লাইনে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করেছে পুলিশ। সাহায্য প্রদানের জন্য সেখানে সাত-আটজন দাঁড়িয়েও আছে। সবার সামনে অল্পবয়সী একজন দরিদ্র মহিলা। তার পিছনে দশ-বারো বছরের দুই কিশোর। কথায় বোঝা যাচ্ছে ওরা দুজন একে অন্যের বন্ধু, সম্ভবত বেশ দূর থেকে এসেছে। দুজনেই রিবিটকে দেখে বেশ উত্তেজিত, নিজেদের মধ্যে রিবিটকে নিয়েই আলোচনা করছে। ওদের পিছনে দুই তরুণী, সম্ভবত ভার্সিটির ছাত্রী হবে।
তারপর চার-পাঁচ বছরের মেয়ে-কোলে এক ভদ্রলোক, তারপর আরো দুই। কিশোর। সবাই রিবিটের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখে একধরনের অজানা কৌতূহল আর উৎফুল্লতার আভাস।
রিবিট আর সাইফ যখন সম্পূর্ণ প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে তখন সামনে থেকে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করল : রিবিট আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে কি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে পারি?
না, আমি এই মুহূর্তে কোনো প্রশ্নের উত্তর দেব না। দয়া করে আমাকে কোনো প্রশ্ন করবেন না। খুব স্বাভাবিকভাবে বলল রিবিট।
আপনি কেন আমাদের প্রশ্নের উত্তর দেবেন না? এখানে যা-কিছুই ঘটছে সবই তো সরাসরি টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হচ্ছে। দর্শক আপনার প্রতিক্রিয়া জানতে চায়।
আমি এখানে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে আসিনি। আমি এসেছি দুটো শিশুকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে। কাজেই আমার অনুরোধ আমাকে আর কোনো প্রশ্ন করবেন না। আমাকে আমার কাজ করতে দিন। যারা অনেকদূর থেকে এখানে সাহায্য প্রদানের জন্য এসেছে তাদের সাথে কথা বলাকে আমি বেশি জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি।
এদিকে সাইফ ইশারা করতেই সামনের কমবয়সী দরিদ্র মহিলা সাহায্য প্রদানের জন্য এগিয়ে এল। সে রিবিটের সামনে এসে ছলছল চোখে রিবিটের দিকে তাকাল। তারপর হাতের মধ্যে গুঁজে রাখা দুই টাকার একটা নোট রিবিটের দিকে বড়িয়ে দিল। সাথে সাথে চারপাশের প্রায় একশত ক্যামেরা ফ্লাশসহ ক্লিক করে উঠল। তীব্র আলোর ঝলকানিতে মহিলা বোধহয় খুব অস্বস্তিবোধ করল। তাই সে দ্রুত টাকাটা রিবিটের হাতে দিয়ে অন্যপাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় শুধু অস্পষ্ট উচ্চারণে বলল : ভাইজান, কিয়ামত পর্যন্ত আল্লায় আপনেরে হায়াত দেউক।
দরিদ্র মহিলাটি চলে যেতে এগিয়ে এল দুই কিশোর। রিবিট তাদের সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল : কী নাম তোমাদের?
একজন বলল : আমার নাম সুমন, আর ও রিপন। আমরা দুই বন্ধু, মিরপুর থেকে এসেছি।
তোমরা তো অনেক দূর থেকে এসেছ।
হ্যাঁ। এই যে আমরা দুইজন আপনাকে বিশ টাকা দিলাম, আর এই যে আরো দুই টাকা।
তোমরা তো সব টাকাই দিয়ে দিলে, ফিরে যাবে কিভাবে?
এবার রিপন বলল : আমাদের কাছে আরো দশ টাকা আছে। শাহবাগ থেকে মীরপুর পর্যন্ত বাস ভাড়া হয়ে যাবে। আমরা যেতে পারব।
ঠিক আছে, তোমাদের অনেক ধন্যবাদ।
সুমন আর রিপন অবশ্য চলে গেল না। তারা এককোণায় যেয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।
এরপর দুই তরুণী প্রত্যেকে বিশ টাকা করে চল্লিশ টাকা দিল। তারপর এল চার-পাঁচ বছরের মেয়ে-কোলে ভদ্রলোক। ভদ্রলোক রিবিটের হাতে একটা একশো টাকার নোট দিয়ে বলল : রিবিট, আপনাকে দেখার জন্য আমার এই মেয়ে অস্থির হয়ে আছে। তাই আর না-এসে পারলাম না। আমি আমার সাধ্যমতো সাহায্যের চেষ্টা করলাম।
আপনি যে আমাদের সাথে আছেন এটাই আমদের জন্য সবচেয়ে বেশি আনন্দের। এই বলে রিবিট হাত দিয়ে মেয়েটির মুখ স্পর্শ করল। আর তাতে মেয়েটি ভয় পেয়ে দুহাতে তার বাবার গলা জড়িয়ে ধরল। ভদ্রলোক মৃদু হেসে বলল : তুমি ভয় পাচ্ছ কেন মা? এইতো রিবিট, তুমি না দেখতে চেয়েছিলে!
বাচ্চাটি কোনো কথা বলল না। বাবার গলা জড়িয়ে ধরে একদৃষ্টিতে রিবিটের দিকে তাকিয়ে থাকল।
এরপর আরো দুজন কিশোর এলো। দুজনে মিলে তারা দশ টাকা দিল।
ৱিবিট তাদের দুজনকে ধন্যবাদ দিতে তারা রিবিটের সাথে হ্যান্ডশেক করল। তারপর চলে না যেয়ে আগের দুজনের মতো এককোণায় দাঁড়িয়ে থেকে রিবিটকে লক্ষ্য করতে লাগল।
এভাবেই বাড়তে লাগল রিবিটের সংগ্রহ। এরই মধ্যে লাইনও ধীরে ধীরে লম্বা হতে শুরু করেছে। বোঝা যাচ্ছে মানুষ আসতে শুরু করেছে। কেউ গাড়িতে, কেউ রিকশায়, আবার কেউ পায়ে হেঁটে এসে লাইনে দাঁড়াচ্ছে। তারপর উঁকিঝুঁকি মেরে দেখতে চেষ্টা করছে রিবিটকে। লাইন ছাড়াও কেউ কেউ আশেপাশে দাঁড়িয়ে। রিবিটকে লক্ষ্য করছে। অবশেষে ভিড় এড়াতে পুলিশ সম্পূর্ণ এলাকাটা কর্ডন করে ঘিরে ফেলতে বাধ্য হল।
রিটি লক্ষ্য করেনি কখন অমি তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য এখন আর লক্ষ্য করার সময় সে পাচ্ছে না। শুধু হ্যান্ডশেক করে টাকাটা রেখে দিচ্ছে। কথাবলার সুযোগও পাচ্ছে না সে। অপেক্ষারত মানুষের লাইন খুব দ্রুত লম্বা হচ্ছে।
অমি তার বাবা শওকত সাহেবের সাথে এসেছে। সে তার জমানো দুইশো একাত্তর টাকা রিবিটকে দিয়ে বলল; রিবিট আমি কি তোমার সাথে থাকতে পারি?
আমার সাথে থেকে তুমি কী করবে? তোমার তত কষ্ট হবে।
না না কষ্ট হবে না। আমি তোমার সাথে থেকে তোমাকে সাহায্য করতে চাই।
ঠিক আছে, থাকো আমার সাথে।
অমি তার বাবাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। টেবিলের নিচ দিয়ে এসে রিবিট আর সাইফের মাঝে এসে দাঁড়াল। তারপর সাহায্য করতে লাগল রিবিটকে। অমি তার মতো ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে হাতের মধ্যে রাখতে লাগল। যখন হাতে টাকা আর ধরছে না তখন রিবিট কিংবা সাইফের হাতে তুলে দিচ্ছে।
এদিকে হঠাই ডানদিকে পুলিশের কর্ডনের মধ্যে হইচই শুনে রিবিট সেদিকে ফিরে তাকাল। দেখল একজন লোক লাইনে না-দাঁড়িয়েই ভিতরে প্রবেশের চেষ্টা করছে। পুলিশ বাধা দেয়ায় সে জোরে ‘ভাইজান ভাইজান’ বলে চিৎকার করছে। রিবিট ভালোমতো লক্ষ্য করতে বুঝল লোকটি আর কেউ নয়, ড্রাইভার সালাম।
রিবিট ইশারা করতে পুলিশ সালামকে ছেড়ে দিল। সালাম কটমট চোখে একবার পুলিশের দিকে তাকিয়ে তারপর ছুটে এল রিবিটের কাছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল : ভাইজান, আপনে এতবড় কাম করতেছেন আর আমারে জানাইলেন না? আমার কিনা জানতে হইল অন্য মানুষের কাছ থাইকা?
আসলে অনেক টাকার ব্যাপার তো! তুমি বুঝতেই পারছ। শুধু তোমাকে জানিয়ে কতটা লাভ হত?
আরে থামেন তো! মাত্র তো তিন লাখ টাকা! এইডা কোনো ব্যাপার হইল? আপনে হইলেন মহান, আপনার জন্য তিন লাখ টাকা কেন, তিন কোটি টাকা আমি জোগাড় কইরা দিব।
সে কি!
সে কী মানে! আমি ঢাকা শহরের সব ট্যাক্সিড্রাইভার, সিনজি ড্রাইভার, বাস ড্রাইভার, সবাইরে কইছি এইহানে আইসা একশো টাকা কইরা দেয়ার জন্য।
তুমি কীভাবে সবাইকে বললে?
এইডা আর কঠিন কি! আমি দশ জনরে কইছি। এই দশ জন প্রত্যেকে আবার দশ জনরে কবে। তাইলে কত হইল? একশো জন। এই একশো জন আবার দশ জনরে কবে, তাইলে হাজার জন। তারপর,
হ্যাঁ বুঝলাম। কিন্তু সবাই কি টাকা দেবে? দিবে না মানে। হালাগো ঘাড়ে দিবে। আমি তো কতগুলারে সাথে কইরা ধইরা নিয়া আইছি। এহনই দেখবার পাবেন। আপনের টাকা দরকার আর দিব না! না দিলে হালাগো…।
তুমি আবার অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করছ?
ভাইজান কী যে কন! হালা’ কোনো অশ্লীল শব্দ হইল? আপনি যদি শুনবার চান তাইলে কয়ডা অশ্লীল শব্দ আপনেরে শুনাই। এই যেমন ধরেন…
না না থাক। তোমাকে আর অশ্লীল শব্দ শোনাতে হবে না। তুমি এসেছ ভালোই হয়েছে। এই টাকাগুলো রাখা। এখন আর এগুলো হাতে রাখা যাচ্ছে না।
ভাইজান কোনো চিন্তা করবেন না। আমি যহন আইছি ব্যবস্থা হবেই। ইশ আপনে যদি আমারে খালি আগে জানাইতেন! তয় এহনও চিন্তা করবেন না। আমার গাড়িতে কয়দিন আগে এক প্যাসেঞ্জার মেলা কাপড়ের ব্যাগ ফেলায় গেছে। ফেরত দেয়ার জন্য হালারে মেলা খুঁজছি, কিন্তু পাই নাই। এহন ওইগুলারেই কামে লাগাব। আপনি কাম চালায় যান, আমি ব্যাগ নিয়া আসি।
ড্রাইভার সালাম তার গাড়িটা একেবারে কাছে নিয়ে এল। এখান থেকে গাড়িটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তারপর ভিতর থেকে একটা কাপড়ের ব্যাগের বান্ডিল বের করে এনে বলল : ভাইজান এই যে ব্যাংক নিয়া আইছি। এহন এইহানে টাকা রাহেন। এই বলে সে রিবিট, অমি আর সাইফের হাতে তিনটা ব্যাগ ধরিয়ে দিল। নিজেও একটা নিয়ে রিবিটের পাশে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ল।
একটু পর ড্রাইভার সালাম বলল : ভাইজান কোনো চিন্তা করবেন না। যদি টাকাপয়সার শর্ট পড়ে হেইডা পূরণ করার দায়িত্ব আমার। কারণ আপনে এক মহান কাম করতেছেন। মনে রাখবেন কেউ না-থাকলেও আমি আপনের পাশে আছি। ভালো কামে ড্রাইভার সালামের কোনো ক্লান্তি নাই।
তুমি কীভাবে ঘাটতি টাকা পূরণ করবে?
কী যে কন ভাইজান! আমার গাড়ি আছে না। প্রয়োজনে আমার গাড়ি বেইচা দিব। গাড়ির বডি ভাঙাচোরা হইলেও ইঞ্জিন ভালো। দাম একেবারে খারাপ পাব না।
কী বলছ তুমি! তুমি তোমার গাড়ি বিক্রি করে দিবে! তুমি না বলেছিলে গাড়িটাই তোমার জীবন।
হঁ ভাইজান কইছিলাম। তয় আপনের জন্য আমি সব করবার পারি। আর গাড়ি তো সামান্য ব্যাপার।
তাহলে থাকবে কোথায়? খাবে কী?
কেন? আপনের সাথে থাকব, আপনের সাথে ঘুরব, মানুষের উপকার করব। আর পারলে খাইলাম, না পারলে নাই।
রিবিট যে কী বলবে কিছু বুঝে উঠতে পারল না। সালামের মতো মানুষের মহত্তে সে সত্যি মুগ্ধ, বিস্মিত, অভিভূত। সে শুধু বলল : সালাম, আমি চাই না তুমি তোমার গাড়ি বিক্রি করো।
ভাইজান আপনে না চাইলে কী হবে? আমি তো চাই। আপনের জন্য আমি সবই চাই।
ড্রাইভার সালামের কথার মাঝেই যুবকবয়সী এক ড্রাইভার এসে হাজির হল। সে রিবিটের হাতে একশো টাকা তুলে দিতেই সালাম ধমকে উঠে বলল : এই হালা বাবুল, হারামজাদা, তুই একশো টাকা দেস কেন? দুইশো টাকা দে।
সাথে সাথে রিবিট বলল : সালাম, তুমি জোর করছ কেন? এখানে স্বেচ্ছায় যে যা সাহায্য করবে তাতেই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
ভাইজান আপনে থামেন তো। আমারে আমার কাম করবার দেন। এই হালার নাম সিনামা বাবুল। হালায় টাকা কামায় আর সিনামা দেইহা টাকা উড়ায়। এক সপ্তাহে একই সিনামা আটবার দেখছে।
আটবার না, আটবার না, নয়বার। সিনামা বাবুল নিজেই হাসতে হাসতে সংশোধন করে দিল।
শুনেন ভাইজান, শুনেন। নিজের কানে শুনেন, হালার কথা শুনেন। ওর কাছ থাইকা যদি টাকা না রাখি তাইলে কার কাছ থাইকা রাখব। দে আর একশো টাকা দে। ভালো কামে তো আর টাকা দিবি না, পচা কামে দিবি। তোগো কাছ থাইকা জোর কইরা টাকা রাখলে কোনো পাপ নাই।
ড্রাইভার বাবুল চলে যেতে মাঝবয়সী আর এক ড্রাইভার একশো টাকা হাতে এগিয়ে এল। সে টাকা এগিয়ে দিতে সালাম বলল : খবরদার ভাইজান, ওর টাকা নিয়েন না। ও এমনিতেই অভাবে আছে। তারপর মাঝবয়সী ড্রাইভার লোকটিকে বলল : কি আবুল ভাই, তোমার না মেয়ের অসুখ? তোমার টাকা দেওয়া লাগব না, যাও।
ড্রাইভার আবুল আমতা আমতা করে বলল : আমার মেয়ে ভালো হইছে। আমি মানত করছিলাম মেয়ে ভালো হইলে একশো টাকা ভালো কামে খরচ করব। তাই টাকা দিবার আইছি।
লাগব না, লাগব না। নিজের মেয়েরে ভালো-মন্দ খাওয়াও, এইডাও মেলা বড় আর ভালো কাম। যাও এহন যাও, বিরক্ত কইরো না। আমরা মেলা ব্যস্ত। আর হ, সবাইরে যাইয়া কও যেন তাড়াতাড়ি টাকা দিয়া যায়। এইডাও মেলা বড় কাম।
ড্রাইভার আবুল খানিকটা ইতস্তত করে ধীরপায়ে চলে গেল।
এরই মধ্যে সবার টাকা একসাথে করে ড্রাইভার সালাম একটা ব্যাগ ভরে ফেলেছে। সে বলল : ভাইজান এইভাবে তো টাকা রাখা যাব না। আমি গাড়িতে রাইখা আসি। গাড়ির দরজা তালা দেওয়া যায়। চুরি হওয়ার কোনো ভয় নাই।
রিবিট বলল : ঠিক আছে যাও।
ড্রাইভার সালাম গাড়িতে টাকার ব্যাগ রেখে দ্রুত ফিরে এল। তারপর অন্য সবার সাথে যোগ দিল টাকা-সংগ্রহে। অবশ্য একটু পরপরই সে গাড়ির দিকে ফিরে তাকাচ্ছে। টাকার নিরাপত্তা যেন বিঘ্নিত না হয় সে বিষয়ে সে-সচেষ্ট।
সন্ধ্যা ছয়টার দিকে মানুষের ভীড় প্রচণ্ড আকার ধারণ করল। পাঁচটা লাইন করেও ভিড় এড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। দুটো লাইন টিএসসি থেকে শাহবাগ পর্যন্ত, একটি দোয়েল চত্বর পর্যন্ত, একটি জগন্নাথ হল পর্যন্ত, আর একটি নীলক্ষেত পর্যন্ত লম্বা হয়ে গেছে। টিএসসির আশেপাশে মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। রিবিটের সাথে সাক্ষাতের পর কেউ আর টিএসসি থেকে চলে যাচ্ছে না। ফলে ভিড় আরো বাড়ছে। অধিকাংশই শিশু-কিশোর, তারা তাদের অভিভাবকের সাথে এসেছে। অনেক মহিলাও আছে। ঢাকা শহরে রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে কোটিপতি কেউ বাদ যাচ্ছে না। সবাই কমবেশি সাহায্য করছে। ঢাকার বাইরে থেকেও অনেকে এসেছে। রিবিট এখন আর টাকা গ্রহণ করতে পারছে না। সে শুধু হাত মিলাচ্ছে। সাইফ, অমি, ড্রাইভার সালামের পাশাপাশি সুমন, রিপনসহ আরো বেশ কয়েকজন কিশোর রিবিটের সাথে যোগ দিয়েছে। তারা সবাই রিবিটকে অর্থ সংগ্রহ করতে সাহায্য করছে।
সন্ধ্যা সাতটার সময় হঠাত্র একটা খবর শোনা গেল। দুটো শিশুই মারা গেছে। সাথে সাথে চারদিকে হৈ-হট্টগোল শুরু হয়ে গেল। সবাই খেপে উঠল। ডাক্তারের উপর। ভাবখানা এমন যেন তারা এক্ষুনি ডাক্তারদের চামড়া তুলে নেয়, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভাংচুর শুরু করে। রিবিট অবশ্য নিশ্চিত হয়েছে খবরটি মিথ্যা। কারণ অপারেশন এখনো শেষ হয়নি। কিন্তু কে শোনে কার কথা, যে-যার মতো চিৎকার-চেঁচামেচি করে সবকিছু পণ্ড করার অবস্থা। এ যাত্রায় অবশ্য বিশেষ সংবাদ পরিবেশন করে চ্যানেল ফোকাসই রক্ষা করল সবাইকে। রিবিটের সংবাদ প্রচারের জন্য চ্যানেল ফোকাস টিএসসিতে একটা বিশাল মোবাইল স্ক্রিন বা টেলিভিশন মনিটর বসিয়েছিল। সেখানে যখন ঘোষণা দেয়া হল। যে এখনো অপারেশন শেষ হয়নি, তখন শান্ত হল জনতা।
পরিস্থিতি শান্ত হলে ইপি বলল : রিবিট, তুমি কি ফোকাস টিভি চ্যানেলের সংবাদ শুনেছ?
না শুনিনি।
আমার লজিক বলছে বাচ্চাদুটোর জন্য তোমাকে আর চিন্তা করতে হবে না। ইতিমধ্যে অনেকে অনেকরকম প্রস্তাব দিয়েছে। একটি এনজিও বাচচাদুটোর চিকিৎসার সকল খরচ বহন করতে রাজি হয়েছে। একটি বেসরকারি ব্যাংক ফোকাস চ্যানেলের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ওদের চিকিৎসার জন্য ইতিমধ্যে এক লক্ষ টাকা প্রদান করেছে। এ ছাড়াও ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অনেক টাকা জমা হয়েছে। সবাই ইলেকট্রনিক ট্রান্সফারের মাধ্যমে টাকা প্রদান করছে। তবে সর্বমোট অর্থের পরিমাণ ঘোষণা করা হয়নি। একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান পরবর্তীতে বাচ্চাদুটোর শিক্ষার খরচ বহন করতে সম্মত হয়েছে। অপর একটি প্রতিষ্ঠান তোমাকে চাকুরি প্রদানের প্রস্তাব দিয়েছে। তাছাড়া..
রিবিট ইপিকে থামিয়ে দিয়ে বলল; আমার সত্যি মনে হচ্ছে বাচ্চাদুটোর জন্য আমরা কিছু করতে পারছি।
হ্যাঁ তাই। এখন ওরা বেঁচে থাকলে হয়। তুমি তো জান না, বিভিন্ন স্থানে বাচ্চাদুটোর জন্য দোয়া করা হচ্ছে। টিভি চ্যানেলগুলোতে দেখলাম নামাজের পর সবাই ওদের জন্য প্রার্থনা করছে। সমগ্র দেশ এখন উদগ্রীব হয়ে আছে ওদের খবর জানার জন্য। প্রত্যেকটি চ্যানেলে মানুষ যে-প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে তাতে বোঝা যাচ্ছে সবাই মনেপ্রাণে চাচ্ছে ওরা যেন বেচে থাকে এবং সুস্থ সুন্দর জীবন লাভ করে।
আমার বিশ্বাস এত লোকের প্রার্থনা বৃথা যাবে না।
হয়তো তাই। এখন শুধু অপেক্ষার পালা।
আমাদের হয়তো আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না। আমি শুনেছি ওদের পায়ের অপারেশন শেষ হয়েছে। এখন মাথার অপারেশন শেষ হলেই হয়।
কিন্তু মাথার অপারেশনটাই বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
এজন্যই আমি চিন্তার মধ্যে আছি। তাছাড়া হাসপাতালে কথা বলে জেনেছি মস্তিষ্কের অপারেশনে কিছু জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। যদি কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে তাহলে বিষয়টা সত্যি খুব দুঃখজনক এবং মর্মান্তিক হবে।
তুমি ঠিকই বলেছ রিবিট। বলল ইপি।
আমাদের আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। বিড়বিড় করে বলল রিবিট।
সবাইকে আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। রাত সাড়ে আটটার সময় সংবাদ এল অপারেশন সফল হয়েছে। দুটো বাচ্চাই সুস্থ আছে, এ মুহূর্তে ওদের তেমন কোনো জটিলতা নেই।
সংবাদটা শোনার পর রিবিট নিজের মধ্যে এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব করল। শেষপর্যন্ত বাচ্চাদুটোর জন্য সে কিছু করতে পেরেছে।
এদিকে অপারেশনের সফলতার সংবাদ শুনে আশেপাশে মানুষের মধ্যেও যেন আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। উফুল্লতার এক বিশেষ গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠল চারদিকটা। ভিড়ের মধ্যে মাঝে মাঝে কয়েক জায়গায় ছাত্রছাত্রীরা জড়ো হয়ে রিবিট আর বাচ্চাদুটোকে নিয়ে গান ধরেছে। সবাই তাদেরকে ঘিরে হাততালি দিচ্ছে। কয়েকজন নাচতেও শুরু করেছে। ব্যাপারটা রিবিটকে দারুণভাবে অভিভূত করল। সে কখনো ভাবতে পারেনি ভালো কাজে মানুষ এতটা উৎসাহী হতে পারে।
রাত দশটার পর ধীরে ধীরে ভিড় কমতে শুরু করল। কিন্তু লাইন এখনো অনেক লম্বা। লোকজন এখনো আসছে এবং লাইনে দাঁড়াচ্ছে। রিবিট কারো সাথে কথা বলার সময় পাচ্ছে না, আগের মতোই শুধু হাত মেলাতে পারছে মাত্র। তবে রিবিট কথা বলতে না-পারলেও যে-ই রিবিটের সামনে আসছে রিবিটকে ধন্যবাদ দিচ্ছে। কেউ কেউ অতি উচ্ছ্বাসে কথা পর্যন্ত বলতে পারছে না। গতকাল রাতের মতো অনেকে পাশ থেকে নানা ভঙ্গিতে ছবি তুলে নিচ্ছে। তবে সবই ঘটছে মহূর্তের মধ্যে।
রাত এগারোটা থেকে লাইন ছোট হতে শুরু করল। লাইনের সংখ্যাও কমে পাঁচটি থেকে তিনটি হল। এতক্ষণ যে-সকল কিশোর-কিশোরী আর শিশুরা রিবিটের সাথে ছিল তারাও চলে গেছে। রিবিট বুঝতে পারছে সাইফ আর ড্রাইভার সালাম দুজনেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। লাইন ঠিক রাখতে আর ভিড় সামলাতে চিৎকার করতে করতে সাইফের গলা বসে গেছে।
এদিকে টাকা গুনতে যেয়ে সালামের অবস্থাও খারাপ। অধিকাংশই দশ আর পাঁচ টাকার নোট হওয়ায় সালামকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে।
সাইফের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রিবিট যখন সালামের গাড়িতে উঠল তখন রাত বারোটা। গাড়ি চালু করেই সালাম বলল : কইছিলাম না ভাইজান, চিন্তার কোনো কারণ নাই। আপনে আছেন তো সব ঠিক। মানুষ আপনেরে জান পরান দিয়া ভালোবাসে। তা না হইলে মাত্র কয়ঘণ্টায় কি তিন লাখ আঠারো হাজার তিনশো ষোলো টাকা উঠত?
তুমি ঠিকই বলেছ সালাম। তবে আমাদের এই সাফল্য সকলের প্রচেষ্টার ফল।
আরে না ভাইজান। সবই আপনের কেরামতি। আপনের জায়গায় আমি হইলে কি কিছু হইত? হইত না। লোকজন আমারে প্রতারক, ভণ্ড, ধান্দাবাজ, চান্দাবাজ কইয়া, পারলে দুই-চাইরড়া চড়থাপ্পড় মাইরা কিংবা পাছায় দুইডা লাথি দিয়া হয় ভাগায় দিত, নয় পুলিশে দিত। যাইহোক বাদ দেন, এহন কী করবেন কন? ঢাকা মেডিকেলে যাইতে এক মিনিটও লাগব না।
আগে ওষুধের দোকানে যাব। একটা দোকানে রাতে চেক দিয়েছিলাম। চেকটা ফেরত আনতে হবে।
আপনে চেক দিছিলেন কেন? বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল সালাম।
আমার কাছে টাকা ছিল না।
আপনের কাছে টাকা আছিল না, তাই ঐ ব্যাটা আপনের কাছ থাইকা চেক রাখব? ওর এতবড় সাহস!
আহা, তুমি রেগে যাচ্ছ কেন?
রাগব না মানে! কী কন আপনে! আপনের অপমান তো আমার অপমান! দেহেন ভাইজান, আপনের মনডা বেশি নরম, এত নরম মন নিয়া এই কঠিন। দুনিয়ায় চলবার পারবেন না। আপনের উচিত আছিল ঐ হালারে ধইরা একটা আছাড় মারা যেন হাগা-মুতা বাইরায় যায়। তা না হইলে হালায় ঠিক হব না।
আহা সালাম! তুমি আবার অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করছ।
এইডা কোনো অশ্লীল ভাষা হইল? এইডা তো ভদ্রলোকেরই ভাষা।
ঠিক আছে ঠিক আছে। তুমি গাড়ি থামাও, আমরা চলে এসেছি।
রিবিট গাড়ি থেকে নেমে প্রথম ওষুধের দোকানে বাকিতে কেনা ওষুধের মূল্য। পরিশোধ করে দ্বিতীয় ওষুধের দোকানে ঢুকল। এই দোকানে গতকাল রাতের অল্পবয়সী দোকানদারই আছে। রিবিটকে দেখামাত্রই সে ভয়ে চেক বের করে রিবিটের দিকে এগিয়ে দিল। রিবিট অবশ্য কিছু বলতে পারল না। তার আগেই সালাম বলল : এই হালা, তুই ভাইজানরে চিনস্। তুই ভাইজানের কাছ থাইকা চেক রাখছস কেন? দিমু নাকি পেটটা গালাইয়া?
দোকানদার বেচারা কাঁদো-কঁদো গলায় বলল : আমি ওনারে চিনতে পারি নাই।
তা চিনবা কেন? প্যাদানি না দিলে তো চিনবা না। এমন প্যাদানি দিমু যে..
এবার কথা বলল রিবিট : আহা সালাম, থামো তো। তারপর দোকানদারের দিকে টাকা বাড়িয়ে দিয়ে বলল : এই নিন আপনার বাকি টাকা।
স্যার আমার টাকা লাগব না। আমি আপনের কাছ থেকে বেশি দাম রাখছিলাম।
দোকানদারের কথা শুনে সালাম এবার লাফ দিয়ে উঠে বলল : হারামজাদা কয় কি! ভাইজানের কাছ থাইকা বলে বেশি দাম রাখছে। তারপর হঠাই রিবিটের দিকে তাকিয়ে বলল : ভাইজান আপনে খালি আমারে একবার অনুমতি দেন, হালার দুই পাছায় এমন দুইডা লাথি মারব যে হালার পাছা দুইডা খুইলা পইড়া যাব।
সালাম তুমি আবার অশ্লীল কথা বলছ! হালকা ধমকের স্বরে বলল রিবিট।
ভাইজান অশ্লীল কথার আপনে দেখছেন কী? আমি এমন অশ্লীল কথা কব যে এই ইবলিসটা মাটির চল্লিশ হাত নিচে যাইয়াও মুক্তি পাব না। আমার কথা ওর শরীরে আগুন ধরায় দিব। ভাইজান আপনে খালি অনুমতি দেন।
রিবিট আর কোনো কথা বলল না, বাইরে বেরিয়ে এল। সালাম দোকানদারকে ছাড়ল না। খপ করে কলার চেপে ধরে হাতের আঙুলে মাথায় একটা গাট্টা বসিয়ে দিল। তারপর বিড়বিড় করে বলল : তোগো তো আর সবসময় মারবার পারব না, ভাইজান যেহেতু সাথে আছে, তার সম্মানে ছোট্ট একটা গাট্টা দিলাম। মনে রাখিস, এই ভাইজানের জন্যই আইজ বাইচা গেলি, নইলে…নইলে.. তোর প্যান্ট খুইলা নিতাম, ন্যাংটা হইয়া বাড়ি যাওয়া লাগত। বুঝছস?
সালাম বাইরে আসতে রিবিট বলল : সালাম, আজকের মতো আমাদের দায়িত্ব শেষ। তোমাকে একটু কষ্ট করতে হবে।
বলেন ভাইজান। আপনের জন্য আমি জাহান্নামেও যাবার পারি।
জাহান্নামে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এই টাকাগুলো তোমার হেফাজতে রাখবে। বাচ্চাদুটোর উপযুক্ত অভিভাবক পাওয়া গেলে তাদেরকে বুঝিয়ে দেব।
ভাইজান আপনে কোনো চিন্তা করবেন না। আমার কাছে আমার জানের থাইকা এই টাকার হেফাজতই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাইলে আইজ আসি ভাইজান।
হ্যাঁ যাও। তোমার মোবাইল নম্বর আমার কাছে আছে। আমি প্রয়োজনে তোমাকে ফোন করব। আর আমার ফোন নম্বরও রেখে দাও। প্রয়োজনে ফোন করো। আশা করছি আগামীকাল আমাদের দেখা হবে।
ঠিক আছে ভাইজান।
রিবিট এই প্রথম কাউকে তার ফোন নম্বর দিল।
১৮
ইনটেনসিভ কেয়ারে রিবিট যখন বাচ্চাদুটোকে দেখল তখনো ওদের জ্ঞান ফেরেনি। ডাক্তার বলেছে ওদের জ্ঞান ফিরতে আরো একঘণ্টা সময় লাগবে। দুজনেই সুস্থ। যদিও মেয়েটির শরীর দুর্বল কিন্তু ভয়ের কোনো কারণ নেই। রিবিট খুব অবাক হয়েছে সাইফকে হাসপাতালে দেখে। সে স্বীকার করতে বাধ্য হল ছেলেটি সত্যি কর্মঠ। বাচ্চাদুটোর জ্ঞান না-ফেরা পর্যন্ত সাইফ নাকি হাসপাতাল ছেড়ে যাবে না।
রিবিট এবারো সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্নের উত্তর দিল না। তার বিশেষ অনুরোধে সাংবাদিকরাও তাকে আর বিরক্ত করল না। সে যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বাইরে বেরিয়ে এল তখন চারদিকে একেবারে ফাঁকা।
রিবিট রাস্তায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর টিএসসির দিকে হাঁটতে শুরু করল। কিছুদূর যেয়ে সে ইপিকে বলল : ইপি আমার খুব ভালো লাগছে, বাচ্চাদুটো শেষপর্যন্ত বেঁচে আছে।
রিবিট। আমি তোমার ভালোলাগা বুঝতে পারছি।
এখন আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে মানুষ আমাকে ভালোভাবে গ্রহণ করেছে।
হ্যাঁ রিবিট, তোমার কথা সত্য। মানুষ তোমার আহ্বানে যেভাবে সাড়া দিয়েছে তা সত্যিই বিস্ময়কর। যদিও বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা আমার নেই, তবে মানুষের সহযোগিতার প্রবণতা বিশ্লেষণ করে আমি তা বুঝতে পারছি। তুমি তো গত কয়েক ঘণ্টা ব্যস্ত থাকায় কিছুই জানতে পারোনি। চ্যানেল ফোকাসের তহবিলে ইতিমধ্যে আট লক্ষ সতেরো হাজার দুইশত তেইশ টাকা জমা হয়েছে। তোমার কাছে প্রেরিত মেইল পড়ে এবং চ্যানেল ফোকাসের সংবাদ থেকে জানা গেছে, একুশটি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত এগারো লক্ষ আশি হাজার নব্বই টাক প্রদানের মৌখিক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ছুটির দিন শেষ হলেই তারা এই অর্থ প্রদান করবে। তিনটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বাচ্চাদুটোর চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে রাজি হয়েছে। একটি প্রতিষ্ঠান বাচ্চাদুটো স্বাবলম্বী না-হওয়া পর্যন্ত তাদের সকল ব্যয় বহন করার প্রস্তাব দিয়েছে। দুটো প্রতিষ্ঠান ওদের বিদেশে চিকিৎসার খরচ বহন করতে রাজি হয়েছে। এ ছাড়া ছয়টি প্রতিষ্ঠান তোমাকে চাকরির প্রস্তাব দিয়েছে যেখানে সম্মানী বিশ হাজার থেকে চার লক্ষ টাকা পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়েছে। চারটি প্রতিষ্ঠান তোমাকে ফ্রি গাড়ি প্রদানের প্রস্তাব দিয়েছে। এগুলোর মধ্যে অত্যাধুনিক রেসিং কারও রয়েছে যেগুলোর মডেল এখনো বাংলাদেশে এসে পৌঁছায়নি। চব্বিশটি প্রতিষ্ঠান তোমাকে কোনোরকম শর্ত ছাড়াই মাসিক কিছু অনুদান প্রদানের প্রস্তাব দিয়েছে যা তুমি মানবকল্যাণে ব্যয় করতে পারবে। সতেরোটি স্বেচ্ছাসেবক প্রতিষ্ঠান কোনোরকম শর্ত ছাড়াই তোমাকে তাদের প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ প্রদানের প্রস্তাব দিয়েছে। এক হাজার দুইশো বারোটি পরিবার কোনোরকম শর্ত ছাড়াই তোমাকে তাদের বাড়িতে আজীবনের জন্য থাকতে দিতে রাজি হয়েছে। দুই হাজার চারশো আঠারো জন শিশু-কিশোর আজীবনের জন্য তারা তাদের বেডরুমে তোমাকে থাকতে দিতে চেয়েছে। তিন হাজার তিনশো তিরানব্বই জন শিশু-কিশোর তোমার সাথে নিয়মিত মানবকল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণ করতে রাজি হয়েছে। পাঁচ হাজার আটশো তেরো জন বিভিন্ন বয়সী মানুষ তোমাকে তাদের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। দুই হাজার তিনশ একুশ জন….
ইপি তোমাকে আর বলতে হবে না। আমি সত্যি অভিভূত। আমি কখনো ভাবতে পারিনি মানুষ এভাবে আমার আহবানে সাড়া দেবে। মানুষ সত্যিই মহান।
রিবিট, তুমি নিশ্চয় জানো প্রত্যেক মানুষের মধ্যে মহত্ব রয়েছে। তুমি মানুষের সেই মহত্ত্বকে জাগিয়ে তুলতে পেরেছ। আর এ-কারণেই মানুষ এভাবে বাচ্চাদুটোর জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। অধিকাংশ টিভি চ্যানেলই বলছে এই সাহায্যের পরিমাণ এক কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। তোমাকে শুধু ছুটির দিন শেষ না-হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
এক কোটি টাকা!
যা রিবিট। কারণ ছুটির দিন থাকায় অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের সাহায্য পাওয়া যায়নি। প্রত্যেকটি টিভি-চ্যানেল, স্কুল-কলেজ, সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সবাইকে আহবান জানাচ্ছে সাহায্য প্রদান করার জন্য। ধারণা করা হচ্ছে এটাই বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত স্বল্পসময়ে প্রদত্ত সর্বোচ্চ সহযোগিতা।
ইপি, তাহলে বাচ্চাদুটোর ভবিষ্যত সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে।
হ্যাঁ তাই।
তবে সবচেয়ে ভালো হত যদি বাচ্চাদুটোর বাবা-মাকে খুঁজে পাওয়া যেত।
হ্যাঁ তাই। কিন্তু খুঁজে পাওয়ার উপায় কী?
প্রফেসর মালেক বলেছিলেন বাচ্চাদুটোর মা আমাদের আশেপাশেই কোথাও থাকবে এবং সে আমাদের আশেপাশেই আছে।
তুমি কি নিশ্চিত?
হ্যাঁ ইপি, এবং এখন আমি নিশ্চিত সে কে?
কী বলছ রিবিট! এতক্ষণ বলোনি কেন? তুমি বাচ্চাদুটোর মায়ের সাথে কথা বলোনি কেন?
আমি নিশ্চিত ছিলাম না। তবে এখন আমি নিশ্চিত হয়েছি।
কীভাবে?
প্রফেসর মালেক যে-মুহূর্ত থেকে আমাকে বলেছিলেন বাচ্চাদুটোর মা আশেপাশে থাকতে পারে, সেই মুহূর্ত থেকেই আমি আশেপাশে লক্ষ্য রাখতে শুরু করি। আশেপাশে যাকেই আমার সন্দেহ হয়েছে তার ছবিই আমি বিশেষ একটি ফাইলে সংরক্ষণ করেছি।
হ্যাঁ আমি লক্ষ্য করেছি। তুমি তোমার মেমোরিতে ‘মা’ নামক নতুন একটা ফাইল খুলেছ এবং তাতে অনেকের ছবি রয়েছে।
এই ফাইলে যে, মহিলার ছবি সবচেয়ে বেশি রয়েছে সে-ই বাচ্চাদুটোর মা। তুমি নিশ্চয় ছবিগুলো লক্ষ্য করেছ?
এ তো দেখছি সেই মহিলা যে কিনা টিএসসিতে সবার প্রথমে সাহায্য প্রদান করার জন্য দুই টাকা দিয়েছিল।
হ্যাঁ ইপি। তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিল। কারণ একজন হতদরিদ্র মহিলা নিশ্চয় দুই টাকা সাহায্য প্রদানের জন্য এমনি এমনি লাইনে সবার আগে এসে দাঁড়াবে না। এই মহিলাকে আমি হাসপাতালের পাশেও দুবার দেখেছি। তাছাড়া সে এখন আমার পিছন পিছন আসছে। সম্ভবত আমার সাথে কথা বলতে চায়। আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল হাসপাতালে আমি বাচ্চাদুটোর পাশে থাকি। কিন্তু যখন বুঝলাম আমার পরিবর্তে এই মহিলা অর্থাৎ বাচ্চাদুটোর মা যদি ওদের পাশে থাকে তাহলে সেটা হবে বেশি আনন্দদায়ক, তখন আমি বাইরে কিছুটা নির্জনে আসার সিদ্ধান্ত নেই যেন ঐ মহিলা আমার সাথে কথা বলতে পারে। কারণ আমি লক্ষ্য করেছি অনেক লোকের মধ্যে মহিলা সবসময় নিজেকে গুটিয়ে রাখছিল।
রিবিট তুমি সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছ।
রিবিট জাতীয় শহীদ মিনারের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। মহিলা তার থেকে প্রায় ত্রিশ গজ দূরে হাঁটছে। রিবিট ঘুরে দাঁড়াতে মহিলাও থমকে দাঁড়াল। রিবিট এবার তাকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকল। মহিলা প্রথমে ইতস্তত করলেও পরে ধীরে পায়ে রিবিটের দিকে এগিয়ে আসতে থাকল।
মহিলা রিবিটের থেকে দুই গজ দূরে এসে থামল। কেন যেন সে মাথা নিচু করে রেখেছে। রিবিট তাকে অভয় দিয়ে বলল : আমাকে ভয় পাবেন না। আমি লক্ষ্য করেছি আপনি আমাকে অনুসরণ করছিলেন। আমি কি জানতে পারি কেন?
মহিলা কিছু বলল না। মাথা নিচু করে আগের মতোই স্থির দাঁড়িয়ে থাকল।
আপনি কি আমাকে কিছু বলবেন?
এবার মহিলা ডুকরে কেঁদে উঠল।
রিবিট খুব অস্বস্তিতে পড়ল। মহিলা যে এভাবে কেঁদে উঠবে সে ভাবতে পারেনি। তাই বলল : আপনি কাঁদবেন না। কাঁদলে তো কোনো লাভ হবে না। আমাকে সবকিছু খুলে বলুন।
ইপি এবার অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্কে বলল : রিবিট তুমি দেরি করছ কেন? দেখতে পাচ্ছ না মহিলার কষ্ট হচ্ছে।
হ্যাঁ ইপি আমি দেখতে পাচ্ছি। যদিও আমি নিশ্চিত তারপরও আমি চাচ্ছি মহিলা নিজের মুখে বলুক সে বাচ্চাদুটোর মা। এতে আমি আরো নিশ্চিত হতে পারব। বাচ্চাদুটোর ভবিষ্যৎ এখন অনেক উজ্জ্বল। এ মুহূর্তে অনেকেই প্রতারণার মাধ্যমে বাচ্চাদুটোর জন্য যে-সাহায্যের অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে তা আত্মসাৎ করার চেষ্টা করতে পারে।
ঠিক আছে। তুমি তোমার মতো কাজ করে যাও।
এর মধ্যে মহিলা নিজেকে সামলে নিয়েছে। জীর্ণ শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে বলল : ভাইজান, আমার নাম মমতা। আপনে যে বাইচ্চা দুইডার জন্য জান দিয়া দিছেন আমি ওগো মা।
আপনি কি সত্য বলছেন?
হ ভাইজান। আপনের বিশ্বাস না হইলে আমাগো বাড়িতে খবর নিবার পারেন। আমাগো বাড়ি রাজবাড়ি। আমার স্বামী পঙ্গু। আমার আরো দুইডা মেয়ে আছে। তিনমাস আগে সদর হাসপাতালে সিজার কইরা আমার এই বাইচ্চা দুইডা হয়। ছেলের আশা করছিলাম। ছেলে হইছে, কিন্তু এমন কপাল যে আর একটা মেয়ের সাথে হইল, তাও আবার যমজ। ডাক্তার কইল ঢাকা আইনা মেডিকেলে অপারেশন করলে বাইচ্চা দুইডা বাইচা থাকব। সিজার করায় খুব অসুস্থ আছিলাম। তাই আগে ঢাকা আসবার পারি নাই। তিনদিন আগে দুইশো টাকা নিয়া একলাই ঢাকা আইছিলাম। মেডিকেলেও গেছিলাম। কিন্তু ডাক্তার কইল মেলা টাকা লাগব। কী করব ভাইজান? স্বামী পঙ্গু, নিজেরাই খাবার পাই না, আর এহন এত টাকা পাব কোনহানে? এইদিকে ঢাকা আইসা টাকাও শেষ। শেষে মানুষের কাছে হাত পাতলাম। কেউ বিশ্বাস করে না, কোনো সাহায্য দেয় না। কী করব কিছুই ভাইবা পাই না। বাইচ্চা দুইডারে দেশে নিলেও বাঁচান যাব না। মেয়েডা তো খাওয়া প্রায় ছাইড়াই দিছিল। শেষে উপায় না-পাইয়া বাইচ্চা দুইডারে ফেলায় যাবার সিদ্ধান্ত নেই। কষ্টে বুকটা ফাইটা যাবার চাইছিল। ফিরা আইসা দেহি আপনে বাইচ্চা দুইডারে কোলে নিছেন। সেই থেইকা আপনের পিছন পিছন আছি। তারপর কাইল রাইতে আপনে যহন গাড়িতে উঠেন তহন আপনেরে হারায় ফেলি। ভাবি আপনে মেডিকেলেই আসবেন। সকালে আপনেরে আবার মেডিকেলে খুইজা পাই। আমার কাছে কোনো টাকাপয়সা আছিল না। দুই টাকা আছিল। হেইডাই আপনেরে বিকালে দিছিলাম। এর চাইতে বেশিকিছু করার ক্ষমতা আমার আছিল না ভাইজান।
এই বলে মমতা হু হু করে কাঁদতে শুরু করল।
রিবিট বলল : আপনি কাঁদবেন না। আপনার ভয়ের কোনো কারণ নেই। আপনার বাচ্চারা সুস্থ আছে। আমি আপনাকে ওদের কাছে নিয়ে যাব। আর আপনাদের দুঃখ থাকবে না।
মমতা তখনো কাঁদছে।
রিবিট বলল : আমি আগেই অনুমান করেছিলাম আপনি ওদের মা। আমি নিশ্চিত হয়েছি। আপনি চিন্তা করবেন না। আগে চলুন আপনি খাওয়াদাওয়া করবেন। নিশ্চয় গত কয়েকদিন কিছু খাননি।
না ভাইজান, আমি কিছু খাব না। আমার কিছু খাবার ইচ্ছা করে না।
ঠিক আছে, আপনি আসুন আমার সাথে। আপনাকে আপনার বাচ্চাদের কাছে নিয়ে যাই। কিন্তু আর কখনো এভাবে নিজের বাচ্চাকে ফেলে যাবেন না।
ভাইজান, আমি আর কোনোদিনও এমন কাম করব না। আমার ভুল হইছে, আমারে মাফ কইরা দেন।
এতে ভুলের কিছু নেই, এটা অন্যায়। যে সন্তানকে আপনি জন্ম দেবেন, সে বিকলাঙ্গ হোক আর প্রতিবন্ধী হোক তাকে লালনপালন করার দায়িত্ব আপনার, আমার এবং এ সমাজের। সমাজ কোনো-না-কোনোভাবে তাদেরকে রক্ষা করে। তবে সেক্ষেত্রে যদি আমাদের সকলের সহযোগিতা থাকে তাহলে তা আরো সুন্দরভাবে সম্ভব হয়।
ভাইজান, আপনি মহান।
আমি মহান নই। মহান হল মানুষ, সৃষ্টিকর্তার এক বিস্ময়কর সৃষ্টি, সবচেয়ে বুদ্ধিমান আর হৃদয়বান জীব।
রিবিট মমতাকে নিয়ে হাসপাতালে ফিরে আসার সময় বুঝিয়ে দিল আগামীকাল কীভাবে সে মমতাকে সকল অর্থ বুঝিয়ে দেবে, তার দায়িত্ব কী হবে এবং হাসপাতাল থেকে চলে যাওয়ার পর কীভাবে তারা সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে পারবে।
হাসপাতালে ইনটেনসিভ কেয়ারের সামনে দায়িত্বরত নার্সের কাছ থেকে সে জানতে পারল দুটো বাচ্চারই জ্ঞান ফিরেছে। কথাটা শোনার পর মমতা যেভাবে ই হু করে কেঁদে উঠল তাতে রিবিট আবারো বিস্মিত হল। মানুষের ভালোবাসা আর আনন্দ যে এভাবে কান্নার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়, এ-ব্যাপারটা তাকে সবসময়ই বিস্মিত করে।
রিবিট মমতাকে শান্ত করতে বলল : আপনি কাঁদবেন না। যান আপনি আপনার বাচ্চাদেরকে দেখে আসুন। আমার বিশ্বাস ওরা আপনাকে দেখলে খুব খুশি হবে। প্রায় এক দিন হয়েছে ওরা আপনাকে দেখে না।
পাশাপাশি দুটি বেডে বাচ্চাদুটোকে রাখা হয়েছে। মমতা দুই বেডের উপর যেয়ে বাচ্চাদুটোকে উপুড় হয়ে দেখল। তার চোখ দিয়ে এখনো টপটপ করে পানি পড়ছে। শাড়ির আঁচল দিয়ে সে সেই পানি ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না। তার বাচ্চারা যে বেঁচে আছে এ ব্যাপারটা সে যেন এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না।
একটু পরেই মমতা ফিরে এসে বলল : ভাইজান ওরা আপনেরে দেখবার চায়।
রিবিট অবাক হয়ে বলল; আপনি কীভাবে বুঝলেন?
আমি বুঝি। আমি ওদের ইশারা বুঝবার পারি।
রিবিট ধীরে ধীরে মেয়েবাচ্চাটির বেডের পাশে এসে দাঁড়াল। দেখল, মেয়েটি তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টিতে শুধুই কৃতজ্ঞতা। রিবিট মেয়েটির উপর ঝুঁকে আসতে মেয়েটি অদ্ভুত একটা কাণ্ড করল। ছোট্ট ডান হাতটিকে সে উঁচু করে রিবিটের কপালে ছোঁয়াল। তারপর হাতটি ধীরে ধীরে মুখের নিচ পর্যন্ত নিয়ে এসে নামিয়ে নিল।
এত দুর্বল শরীরে মেয়েটি যে কীভাবে এমন করতে পারল তা রিবিটের মাথায় ঢুকল না। আনন্দে তার চোখ দিয়ে প্রায় পানি এসে গেল।
পাশ থেকে মমতা বলল : ভাইজান ও আপনেরে চিনবার পারছে।
রিবিট কোনো কথা বলল না। তার খুব কান্না পাচ্ছে এবং তার সত্যি সত্যি কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সে কাঁদল না। অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে ছেলেটির বেডের পাশে এসে দাঁড়াল।
রিবিট ছেলেটির উপর ঝুঁকে আসতে মেয়েটির মতো ছেলেটিও তার মুখে হাত বুলিয়ে একইভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল। রিবিট ভেবে পেল না কীভাবে ওরা দুজন একইভাবে তার মুখ ছুঁয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল। যমজ বলে ওরা কি কোনোভাবে একে অন্যের মনোভাব বুঝতে পেরেছে? নাকি আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল যদি ওরা বেঁচে থাকে তাহলে এভাবেই ওরা নিজেদের কৃতজ্ঞতা। প্রকাশ করবে?
রিবিট কোনো উত্তর খুঁজে পেল না। সে বুঝতে পারল মানুষ সত্যি রহস্যময়। তার মতো অতি উচ্চবুদ্ধি মাত্রার রোবটের পক্ষে মানুষের চরিত্রের এই বিচিত্র রহস্য কখনোই ভেদ করা সম্ভব নয়।
.
রিবিট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে চানখারপুলের রাস্তা ধরে পুরোনো ঢাকার দিকে এগোতে শুরু করল। খানিকটা এগোতে ইপি বলল : রিবিট, তোমার প্রতি মানুষের ভালোবাসার এক অদ্ভুত নমুনা তোমাকে দেখাব।
কী নমুনা?
টিভি চ্যানেলটি দেখো।
রিবিট টিভি চ্যানেলে মমতাকে দেখতে পেল। দেখল, প্রায় বিশ-পঁচিশ জন সাংবাদিক মমতাকে ঘিরে ধরেছে। মমতার ঠোঁট থরথর করে কাঁপছে। সম্ভবত সাংবাদিকরা তাকে কিছু-একটা জিজ্ঞেস করেছে। সে তার উত্তর দিতে চেষ্টা করছে।
এমন সময় তরুণ এক সাংবাদিক বলল : কই আপনি আপনার ছেলে আর মেয়ের নাম বলুন!
মমতা এবার কাঁপা কণ্ঠে বলল : ওগো কোনো নাম নাই, আমি ওগো কোনো নাম রাহি নাই। তয় আইজ আমি ওগো নাম রাখব।
কী নাম? আবারো প্রশ্ন করল তরুণ সাংবাদিক।
মমতা কম্পিত ঠোঁটে বলল : আমার ছেলের নাম হবে আমার ভাইজানের নামে। ওর নাম ‘রিবিট’। আর মেয়ের নাম..
মমতাকে আর কিছু বলতে হল না। তার আগেই সকল সাংবাদিক একসাথে চিৎকার করে উঠে বলল : ইপি, ইপি।
রিবিট সাথে সাথে বলল : ইপি, মানুষের ভালোবাসার কি কোনো সীমা আছে?
না রিবিট। মানুষের ভালোবাসার কোনো সীমা নেই।
মানুষের মহত্ত্বের কি কোনো সীমা আছে?
না রিবিট। মানুষের মহত্ত্বের কোনো সীমা নেই। মা
নুষের বুদ্ধির কি কোনো সীমা আছে?
না রিবিট নেই।
মানুষ সত্যি এক রহস্যময় জীব।
সত্যি রহস্যময়।
আমার খুব গর্ব হচ্ছে এই ভেবে যে ভালোবাসায় ভরা এরকম মহান, অতি বুদ্ধিমান এবং রহস্যময় জীব মানুষের সাথে আমি বসবাস করতে পারছি।
তুমি সত্যি সৌভাগ্যবান রিবিট।
এমন সময় রিবিটের ফোন এল। রিবিট ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে প্রফেসর হক বললেন : রিবিট, আমি সত্যি খুব খুশি হয়েছি। তুমি আমার গবেষণা, আমার সাধনাকে সার্থক করেছ। আমি তোমার জন্য সত্যি গর্বিত। আর হ্যাঁ, তোমার জন্য পত্রিকা অফিসে আমি একটা চাকুরি ঠিক করেছি। সপ্তাহে একদিন কাজ করতে হবে। এতে তোমার খরচ চলে যাবে। এ বিষয়ে পরবর্তীতে বিস্তারিত জানাব।
এই বলে প্রফেসর হক খুক খুক করে দুবার কাশি দিলেন। তারপর আবার বললেন : আমি ভালো আছি। আমাকে নিয়ে কোনো চিন্তা করবে না, আর অহেতুক বিরক্ত করবে না। মনে রেখো, তুমি মানুষের কল্যানণসাধন করতে পারলেই আমার কল্যাণ হবে।
প্রফেসর হক রিবিটকে কোনো কথা বলার সুযোগ না-দিয়েই লাইন কেটে দিলেন।
রিবিট খানিকটা স্লান গলায় বলল : প্রফেসর হক সত্যি মহান।
হ্যাঁ রিবিট, তিনি শুধু মহানই নন, রহস্যময়ও বটে। উত্তরে বলল ইপি।
ইপির সাথে কথা বলতে বলতে রিবিট ছোট্ট একটা মাঠের পাশে এসে দাঁড়াল। চারপাশটা একেবারেই নীরব। আশেপাশে কেউ নেই। হঠাৎই একটা অদ্ভুত শব্দে সতর্ক হয়ে উঠল সে। বলল : ইপি এটা কিসের শব্দ?
মনে হচ্ছে কিছু একটা নড়াচড়া করছে।
কী?
আমি বুঝতে পারছি না। তবে মনে হচ্ছে মাঠের অপর প্রান্ত থেকে শব্দটা আসছে।
আমি কি এগিয়ে যাব?
হ্যাঁ যাও। তবে সতর্ক থেকো।
রিবিটকে সতর্ক হতে হল না। দু-কদম এগোতেই সে ওয়া..ওয়া.. কান্নার শব্দ শুনতে পেল। সে নিশ্চিত শব্দটা মাঠের অন্যপাশ থেকে আসছে। অনেকটা অবাক হয়ে বলল : ইপি, মনে হচ্ছে মানুষেরই বাচ্চা!
আমার লজিক সেরকমই বলছে।
আবারো মানুষের বাচ্চা! এভাবে পড়ে আছে।
রিবিট, তুমি না বলেছিলে মানুষ খুব রহস্যময়। এটা হয়তো মানুষের চরিত্রেরই অন্য এক রহস্য। হয়তো এদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই রহস্যের মাত্রা কিছুটা বেশি।
তাহলে এখন আমি কী করব?
তোমাকে এগিয়ে যেতে হবে। এটাই তোমার কাজ। তুমি তো মানুষেরই জন্য, মানুষের মঙ্গলের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য।
রিবিট কোনো কথা বলল না। সে দ্রুতপায়ে শব্দের উৎস লক্ষ্য করে এগোতে লাগল। তাকে যে মানুষের অনেক অনেক কল্যাণ সাধন করতে হবে।
(০১.০৮.২০০৬– ০৭.০৯.০৬)
Leave a Reply