৫
রিবিট ফ্ল্যাটবাড়ির সামনের গেটে এসে দাঁড়াল। গেট ভিতর থেকে তালা দেয়া। ভিতরে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। গেটের পাশে কলিংবেল দেখে সে কলিংবেলে চাপ দিল। দুবার চাপ দিতেই ভিতরে দারোয়ানের ঘর থেকে কেউ একজন সাড়া দিল : কে?
রিবিট কোনো কথা বলল না। সে আবার কলিংবেল চাপল।
এবার ভিতর থেকে মাঝবয়সী এক লোক বেরিয়ে এলো। পোশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে দারোয়ানই হবে। বেচারা বোধহয় বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাই চোখ ডলতে ডলতে বাইরে বেরিয়ে আসছে।
গেট থেকে তিন-চার হাত দূরে এসে দারোয়ান থমকে দাঁড়াল। রিবিটকে দেখে ঢোঁক গিলে বলল : আ..আ….পনে কে?
আমি রিবিট। গেট খুলুন।
রি…রি…রিবিট!
আমি রিবিট, একটি উচ্চবুদ্ধি মাত্রার রোবট। গেট খুলন।
রো..ব..ট। রোবট কী?
রিবিট বুঝল এই দারোয়ানকে তার পরিচয় বোঝানো সম্ভব হবে না। তাই খানিকটা গম্ভীর গলায় বলল : আপনি গেট খুলুন, আমি ভিতরে যাব।
দারোয়ান বেচারা অবিশ্বাস নিয়ে রিবিটের দিকে তাকিয়ে আছে। রিবিট আবারো বলল : কই গেট খুলুন, আমি ভিতরে যাব।
গেট খুলব কেন? আপনে তো মানুষ না। আপনে কে? কার কাছে যাবেন? কোন ফ্ল্যাটে যাবেন?
আমি তো বলেছি আমি মানুষ না। আমি একটি রোবট। আমার কোলে এই যে বাচ্চাদুটো দেখছেন ওরা খুব ক্ষুধার্ত। ওদের জন্য আমাকে খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য এই বাড়ির যে-কোনো একটা ফ্ল্যাটে যেতে চাই। এ ব্যাপারে আমাকে আপনার সাহায্য করতে হবে।
দারোয়ান বেচারা ততক্ষণে বুকে ফুঁ দিতে শুরু করেছে। ভয়ে তার চোখদুটো বড় হয়ে গেছে। বলল : আ..আ..মি গেট খুলব না। নিষেধ আছে।
সেটা আমিও জানি। কিন্তু এই দেখুন দুটো বাচ্চা। ওদের জন্যই আমি গেট খুলতে বলছি।
দারোয়ান এবার কিছুটা এগিয়ে এল। সে অবশ্য বাচ্চাদুটোর পরিবর্তে রিবিটকেই দেখছে বেশি। বলল : আপনেরে আমি সাহায্য করবার পারব না।
কেন পারবেন না? দুটো বাচ্চা ক্ষুধায় ছটফট করছে, ছেলেবাচ্চাটি চিৎকার করে কাঁদছে। আর আপনি ওদেরকে সাহায্য করবেন না! ওরা তো আপনাদেরই বাচ্চা। আপনাদের বাচ্চাকে আপনারা সাহায্য করবেন না? খেতে দেবেন না? ওদের যত্ন নেবেন না?
দারোয়ান এবার আরো কাছে এসে বাচ্চাদুটোকে ভালোমতো দেখার চেষ্টা করল। তারপর বলল : ওরা তো এই ফ্ল্যাটের বাচ্চা না।
তাতে কী? আপনাদের মতোই কারো বাচ্চা। আপনারাই তো ওদেরকে জন্ম দিয়েছেন, এই পৃথিবীতে এনেছেন। আর এখন ওদেরকে সাহায্য করতে চাচ্ছেন না।
আমি পারব না। আমার অনুমতি নাই।
আপনি অনুমতি নিন।
এত রাইতে কেউ আমারে অনুমতি দিবে না। আপনে মানুষ হন আর না হন, আপনে চইলা যান। আমারে বিরক্ত কইরেন না।
আমি বিরক্ত করছি মানে! আমি মানুষকে সাহায্য করার চেষ্টা করছি।
আপনে অন্যহানে দেহেন। আমি আপনের কোনো উপকার করতে পারব না।
ঠিক আছে এই বাড়ির যে ফ্ল্যাটে কোনো ছোট বাচ্চা আছে সেই ফ্ল্যাটে ফোন করে আমার কথা বুঝিয়ে বলুন। নিশ্চয় তারা বাচ্চাদুটোকে সাহায্য করতে রাজি হবে।
এই ফ্ল্যাটে এত ছোট কোনো বাইচ্চা নাই। কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল দারোয়ান।
কী বলছেন আপনি! এতগুলো ফ্ল্যাট, অথচ বলছেন কোনো ফ্ল্যাটে একটি ছোট বাচ্চাও নেই। তা কীভাবে সম্ভব! অবাক হয় বলল রিবিট।
আপনে যান তো। এত রাইতে জ্বালাইয়েন না। যান, আপনে যান। কিছুটা ধমকে উঠে বলল দারোয়ান।
আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন? এবার কিছুটা উঁচুস্বরে বলল রিবিট।
রাইত দুপুরে মানুষরে জ্বালাবার আইছেন, আপনের সাথে কি মিষ্টি, মিষ্টি কইরা কথা কব? যান এইহানতে।
রিবিট বুঝতে পারল এভাবে কাজ হবে না, তাকে ভিন্নপথ অবলম্বন করতে হবে।
এতক্ষণ দারোয়ান কথা বলতে বলতে একেবারে গেটের কাছে চলে এসেছে। তাই এ সুযোগটাকেই কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করল সে। আচমকাই গেটের লোহার গারদের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দারোয়ানের কলার চেপে ধরল। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলল। আমি বলছি আপনি গেট খুলবেন।
দারোয়ান নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে রিবিট কলার ধরে দারোয়ানকে আরো কাছে টেনে এনে বলল : খবরদার, ফালাফালি করবেন না। গেট খুলুন।
যদি গেট না খুলি! তারপরও সাহস করে বলল দারোয়ান।
যদি না খোলেন তাহলে আপনাকে এই লোহার ফাঁক দিয়ে টেনে এপাশে নিয়ে আসব। বলুন তো তাহলে আপনার অবস্থা কী হবে?
আলু ভত্তা। চোখ বড় বড় করে বলল দারোয়ান।
আলু ভর্তা না, আপনার ভর্তা। আর কোনো কথা নয়, আমি এক থেকে তিন পর্যন্ত গুনব। এর মধ্যে আপনি গেট খুলবেন।
রিবিটকে এক থেকে তিন পর্যন্ত গুনতে হলো না। তার আগেই দারোয়ান গেট খুলে দিল।
রিবিট ভিতরে প্রবেশের সময় দারোয়ানের কলার ছেড়ে দিতে বাধ্য হল। আর এই সুযোগটাই গ্রহণ করল দারোয়ান। সে একদৌড়ে তার ঘরে ঢুকে পাঁচফুট দৈর্ঘ্যের মোটা একটা লোহার পাইপ হাতে নিয়ে বেরিয়ে এল। ততক্ষণে রিবিট গেটের ভিতরে প্রবেশ করেছে।
দারোয়ান রিবিটের সামনে এসে বলল : খবরদার, তুই যদি আর এক পা সামনে আইছস, তাইলে আমি তোর হাড় সব গুড়া কইরা ফেলাব।
রিবিটকে ‘তুই’ করে বলায় রিবিট সত্যি কষ্ট পেল। তবে সে তার কষ্টকে প্রকাশ না করে বলল : দেখুন দারোয়ান ভাই, আমি আপনার কোনো ক্ষতি করছি না। আমি শুধু এই বাচ্চাদুটোকে বাঁচানোর জন্য এখানে এসেছি।
রাখ তোর বাইচ্চা! তুই এক্ষুনি বাইরায় যা, নইলে আমি তোর ভত্তা বানাব।
রিবিট কোনো কথা বলল না। সে আরো দুপা এগিয়ে গেল। আর তখনই দারোয়ান ঝাঁপিয়ে পড়ল রিবিটের উপর। রিটি আগেই বুঝতে পেরেছিল দারোয়ান যেভাবে লাঠি দিয়ে আঘাত করতে আসছে তাতে বাচ্চাদুটো আঘাত পেতে পারে। তাই সে সরে এসে পিঠ পেতে দিল। দারোয়ানের প্রচণ্ড আঘাতটা তার পিঠে এসে লাগল।
পিঠে আঘাত লাগার সাথে সাথে ইপি বলে উঠল : রিবিট, সিস্টেম ও-কে, সিস্টেম ও-কে। প্রাইমারি ডিফেন্স সিস্টেম অ্যাকটিভ। তুমি আত্মরক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারো।
রিবিট বলল : ধন্যবাদ ইপি। আমি দেখছি।
এদিকে দারোয়ান বেচারা হতভম্ব হয়ে গেছে। সে এত জোরে আঘাত করেছে অথচ রিবিটের কিছুই হয়নি। এ তো তার কাছে অবিশ্বাস্য! সে কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। তাছাড়া মেয়েলি কণ্ঠে কথা বলল কে সেটাও বুঝতে পারল না। তাই সে চারপাশটা একবার দেখে নিল। তারপর হঠাৎই লোহার পাইপ হাতে আবারো তেড়ে এল রিবিটের দিকে।
রিবিট এবার প্রস্তুতই ছিল। দারোয়ান পাইপ দিয়ে আঘাত করা মাত্র সে একহাতে বাচ্চাদুটোকে আঁকড়ে রেখে অন্যহাতে পাইপটা ধরে ফেলল। তারপর জোরে টান দিয়ে পাইপটা নিজের হাতে নিয়ে এল। কৌশলে দু-হাতে পাইপের দু-মাথা ধরে প্রচণ্ড শক্তিতে পাইপটাকে বাঁকিয়ে মাঝখান থেকে ভেঙে ফেলল।
দারোয়ান বেচারা বোধহয় এমন ঘটনা তার জীবনেও দেখেনি। কেউ একজন যে এভাবে এত মোটা একটা লোহার পাইপকে ভেঙে ফেলতে পারবে তা ছিল তার কল্পনাতীত। ভয়ে সে যেন নড়তেও ভুলে গেছে।
রিবিট ভাঙা পাইপটিকে পাশের দেয়ালে ছুঁড়ে মেরে দারোয়ানের সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর হঠাৎই দারোয়ানের কলার চেপে ধরে তাকে মাটি থেকে এক ফুট উপরে তুলে ফেলল।
দারোয়ান বেচারার আধমরা হওয়ার অবস্থা। সে কাঁপতে কাঁপতে বলল : স্যার আপনে যা কবেন আমি তাই শুনব। তবুও আমারে জানে মাইরেন না।
রিবিট গম্ভীর গলায় বলল : আপনি ভিতরে প্রবেশের গেট খুলে দিন। জি স্যার দিতেছি। দয়া করে আমার কলার ছাইড়া দেন।
না, আপনার কলার ছাড়া যাবে না। আপনার মধ্যে মানুষকে সাহায্য করার কোনো প্রবণতা নেই। আপনাকে এই অবস্থায়ই থাকতে হবে। মাটি থেকে আপনার পা এক ফুট উপরে থাকবে। আমি আপনাকে ভিতরের গেটের কাছে নিয়ে যাচ্ছি। আপনি ভিতরের গেট খুলে দেবেন।
জি স্যার, আপনে যা কবেন আমি তাই করব। তবু আমারে জানে মাইরেন না।
না, আমি আপনাকে মারব না। আমার কথা শুনলে আপনার কোনো ক্ষতি হবে না।
শুনব স্যার শুনব। হাজারবার শুনব, একশো বার শুনব। সারাজীবন আপনার গোলাম হইয়া থাকব।
আর কথা না, এখন গেট খুলুন। আমি ভিতরে যাব। দারোয়ান শূন্যে ঝুলন্ত অবস্থায়ই গেট খুলে দিল। রিবিট গেটের ভিতর প্রবেশ করে বলল : এখন বলুন এরকম ছোট্ট বাচ্চা কোন্ ফ্ল্যাটে আছে? খবরদার মিথ্যা বলবেন না। মিথ্যা বললে আপনাকে আরো এক ফুট উপরে তুলব।
দারোয়ান তোতলাতে তোতলাতে বলল : না স্যার, আমারে আর উপরে তুইলেন না। আমি আপনেরে সবই বলব, আর মিথ্যা বলব না। তিনতলায় সি-টু ফ্ল্যাটে ছোট বাচ্চা আছে।
আমি তাহলে সি-টু ফ্ল্যাটে যাব। আপনি আমাকে ফ্ল্যাটের অধিবাসীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবেন। ঠিক আছে?
ঠিক আছে স্যার।
রিবিট লিফটে তিনতলায় এসে পৌঁছাল। তারপর দারোয়ানকে ইশারা করতে সে ফ্ল্যাটের কলিংবেলে চাপ দিল। চারবার কলিংবেলে চাপ দেয়ার পর ভিতর থেকে মেয়েলি কণ্ঠে কেউ একজন কথা বলল : কে?
আমি দারোয়ান।
এত রাইতে কী দারোয়ান ভাই?
দরজা খোলো, জরুরি ব্যাপার আছে।
এত রাইতে কিসের জরুরি?
তোমাগো মেহমান আইছে। সাথে কইরা নিয়া আইছে। দেখলে খুশি হবা।
তখনো দরজা খুলছে না দেখে দারোয়ান ফিসফিস করে বলল : স্যার কাজের মেয়ে, এইজন্য দরজা খুলবার ভয় পায়।
রিবিট কিছু বলল না। একহাতে কলার ধরে দারোয়ানকে দরজার সামনে উঁচু করে রেখে সে পাশে দাঁড়িয়ে রইল। অন্যহাতে বাচ্চাদুটোকে বুকের সাথে আঁকড়ে ধরে রেখেছে।
কাজের মেয়ে দরজা খুলে দারোয়ানের অবস্থা দেখে হা হয়ে গেল। মেঝে থেকে কেউ যে এভাবে এক ফুট উপরে থাকতে পারে তা তার কল্পনার বাইরে। দারোয়ান বলল : ভয় পাইও না, স্যার খুব ভালো মানুষ, তোমারে কিছু কবে না। খালি স্যারের কথা শুনবা।
কাজের মেয়ে এবার উঁকি দিয় রিবিটকে দেখল। তাকে দেখামাত্র সে চিৎকার করে উঠে বলল; ওরে ভাইজানরে, ওরে ভাবীজানরে…আমি এইডা কী দেখলাম। তারপরই ধপাস করে নিচে পড়ে গেল।
দারোয়ান তোতলাতে তোতলাতে বলল : স্যার ভয় পাইছে। মনে হয় অজ্ঞান হইয়া গেছে।
রিবিট সরাসরি ড্রইং রুমে ঢুকল। তারপর বলল : এই ফ্ল্যাটে যারা বসবাস করে তাদের নাম কি?
এই ফ্ল্যাটের মালিক শওকত সাহেব।
আপনি শওকত সাহেবকে ডাকুন।
দারোয়ানকে আর ডাকতে হল না। তার আগেই শওকত সাহেব ঘুম জড়ানো চোখে ড্রইংরুমে প্রবেশ করলেন। তিনি রিবিট আর দারোয়নকে দেখে একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। চোখ কুঁচকে বুঝতে চেষ্টা করলেন তিনি যা দেখছেন তা আদৌ সত্য, নাকি স্বপ্ন। কোনোমতে তোতলাতে তোতলাতে বললেন, দারোয়ান…তুমি..আর সাথে…ও..
এবার রিবিটই বলল : দেখুন শওকত সাহেব। আপনি আমাকে ভয় পাবেন না। আমি আপনার কাছে সাহায্যের জন্য এসেছি। আমার কোলে দুটো যমজ শিশু দেখতে পাচ্ছেন। ওরা খুব অসহায়, একে অন্যের সাথে পায়ে আর মাথায় সংযুক্ত। তার থেকে বড় কথা ওরা ক্ষুধার্ত। একটা বাচ্চা অনেকক্ষণ ধরে ক্ষুধায় চিৎকার করছে। আমি আপনার কাছে এসেছি সাহায্যের জন্য। আপনি দয়া করে ওদের খাবারের ব্যবস্থা করুন।
আ…আমি কী…ভাবে খাবারের ব্যবস্থা করব? অস্পষ্ট উচ্চারণে বললেন শওকত সাহেব।
ওদের জন্য দুধের ব্যবস্থা করুন।
আমি দুধ পাব কোথায়? তাছাড়া আপনি কে?
আমি কে এ-মুহূর্তে তা জানা খুব একটা জরুরি নয়। আমি সবকিছুই আপনাকে খুলে বলব। তার আগে ওদের জন্য দুধের ব্যবস্থা করুন।
আমার বাসায় কোনো দুধ নেই। আপনি দয়া করে চলে গেলে খুশি হব। তাছাড়া আপনি দারোয়ানকে ওভাবে শূন্যে তুলে রেখেছেন কেন? কিছুটা সাহসী ভঙ্গিতে বললেন শওকত সাহেব।
রিবিট এবার দৃঢ় এবং কঠিন কণ্ঠে বলল : দেখুন শওকত সাহেব, আমি জানি আপনার এখানে ছোট বাচ্চা আছে এবং তার জন্য দুধের ব্যবস্থাও রয়েছ। দারোয়ানই আমাকে বলেছে। সে প্রথমে আমাকে সহযোগিতা করতে চায়নি বলেই এখন তার এই অবস্থা। আপনিও যদি এই বাচ্চাদুটোর প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে না দেন আপনারও এই অবস্থা হবে।
রিবিটের কথা শোনামাত্র ভয়ে শওকত সাহেবের আত্মা শুকিয়ে গেল। তাকে অবশ্য কিছু বলতে হল না। তার স্ত্রী মিসেস শওকত ড্রইংরুমে এসে কম্পিত গলায় বললেন : আ..আ..আমি দেখছি। আমি ওদের জন্য দুধের ব্যবস্থা করছি।
পর্দার আড়াল থেকে মিসেস শওকত সবই শুনেছেন। তাই তিনি আর কোনো ঝুঁকি নিলেন না। দাবোয়ান আর তার স্বামীর অবস্থা নিজ চোখে দেখতে পাচ্ছেন। শুধু আড়চোখে একবার রিবিটের দিকে তাকালেন। তারপর শওকত সাহেবকে উদ্দেশ করে বললেন : সালমা কোথায়? সালমা?
দারোয়ান সাথে সাথে উত্তর দিল : সালমা দরজার কাছে অজ্ঞান হইয়া গেছে।
মিসেস শওকত আবার বললেন, এই তুমি যাও তো, সালমাকে ভিতরে নিয়ে এসো। ওর মুখে পানির ছিটা দাও। আমি পানি গরম করছি। দেখি বাচ্চাদুটোকে দেখি।
মিসেস শওকত এগিয়ে আসতে রিবিট আবার বলল; আমাকে ভয় পাবেন না। আমি আপনাদের কোনো ক্ষতি করব না। বাচ্চাদের খাওয়া শেষ হলেই চলে যাব। ওরা খুব ক্ষুধার্ত।
মিসেস শওকত এবার ভয়ে ভয়ে বললেন : আমি ব্যবস্থা করছি। আমারও দুটো বাচ্চা আছে। বড়টির বয়স আট বছর, নাম অমি। আর ছোটটি তিন মাস। আপনি অপেক্ষা করুন, আমি ওদের খাওয়ার ব্যবস্থা করছি। এই বলে সে বাচ্চাদুটোকে কোলে তুলে নিল। সাথে সাথে ছেলেবাচ্চাটির কান্নাও থেমে গেলে।
রিবিট খুব অবাক হল। এতক্ষণ তার কোলে বাচ্চাটি কেঁদেই যাচ্ছিল। অথচ এখন শওকত সাহেবের স্ত্রী মিসেস শওকত কোলে নিতেই বাচ্চাটির কান্না থেমে গেল। এই রহস্যের কারণ সে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না।
এদিকে শওকত সাহেব সালমার মুখে পানির ছিটা দিতে সালমার জ্ঞান ফিরে এল। শওকত সাহেব কিছুটা ধমকে উঠে বললেন : ওঠ, ভিতরে চল।
সালমা কিছু বলল না। ভয়ে এখনো সে কাঁপছে। সে শওকত সাহেবের পিছন পিছন ভিতরে আসতে লাগল। ড্রইংরুমের মধ্যে রিবিটকে দেখামাত্র আবার চিৎকার করে উঠে বলল : ওরে ভাইজানরে, এইডা কী…! সালমা আর কথা বলতে পারল না। আবারো জ্ঞান হারাল।
রিবিট লক্ষ্য করল কেউ একজন পর্দার আড়াল থেকে তাকে উঁকি দিয়ে দেখছে। আরো ভালোমতো লক্ষ্য করতে বুঝল ছোট্ট একটি ছেলে। সে ইশারায় ছেলেটিকে কাছে ডাকতে ছেলেটি ধীরে ধীরে ভিতরে এল। রিবিট খুব অবাক হল যখন দেখল ছেলেটির চোখে যতটা না ভয় তার থেকে বেশি কৌতূহল আর আগ্রহ।
ছেলেটির ভয় কাটাতে রিবিট আবারো ইশারায় কাছে ডেকে বলল : তোমার নাম নিশ্চয় অমি?
রিবিটকে বিস্মিত করে দিয়ে অমি বলল : তুমি রিবিট।
তুমি আমাকে চিনলে কীভাবে! বিস্মিত কণ্ঠে বলল রিবিট।
কাল রাতে টিভিতে আমি তোমাকে দেখেছি।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ।
তুমি কি আমাকে খুব ভয় পাচ্ছ অমি?
একটু আগে পাচ্ছিলাম। এখন পাচ্ছি না। আমি জানি তুমি খুব ভালো। তুমি দুটো বাচ্চাকে বাঁচানোর জন্য আমাদের কাছে নিয়ে এসেছ। এই বলে আমি রিবিটের আরো কাছে এল।
অমি, তুমি তো খুব সাহসী। কিন্তু তোমাদের বাসার সবাই তো খুব ভয় পাচ্ছে।
কারণ তারা তো কাল রাতে তোমাকে টেলিভিশনে দেখেনি। আমি দেখেছি। তুমি আমার মতো অনেক ছেলেমেয়েকে আদর করেছ, ওদেরকে কোলে নিয়েছ। আমার খুব ভালো লেগেছে। আমি তোমাকে পছন্দ করি রিবিট, আমি তোমাকে ভালোবাসি।
তুমি খুব ভালো অমি। খুব সাহসী এবং বুদ্ধিমান। আমি তোমার সাহস এবং বুদ্ধির প্রশংসা করছি। তুমি কি আমার কোলে আসবে?
হ্যাঁ আসব। কিন্তু তুমি কীভাবে আমাকে কোলে নেবে? দারোয়ান চাচাকে তুমি তো উঁচু করে রেখেছ।
ঠিক আছে আমি ওনাকে ছেড়ে দিচ্ছি। এই বলে রিবিট দারোয়ানকে নিচে নামিয়ে দিল। তারপর বলল : খবরদার আমার অনুমতি ছাড়া যেন এক পাও নড়তে না দেখি।
না না স্যার, এক পা-তো দূরের কথা, এক চুলও নড়ব না। হাতজোড় করে বলল দারোয়ান।
রিবিট এবার অমিকে কোলে তুলে নিল। অমি কোলে উঠে বলল : আমি খুব খুশি হয়েছি তুমি আমাদের বাসায় এসেছ। আগামী দুদিন আমার ছুটি। তা না। হলে আগামীকাল স্কুলে যেয়ে তোমার গল্প বলতাম।
এমন সময় শওকত সাহেব ড্রইংরুমে এলেন। অমিকে রিবিটের কোলে দেখে তার চোখ কপালে ওঠার অবস্থা। কোনোমতে তোতলাতে তোতলাতে বললেন : অ..অমি, তু..তুমি এখানে? ‘
হ্যাঁ বাবা। আমি রিবিটকে ভালোবাসি।
রি..বি..ট!
হ্যাঁ বাবা। এই হল রিবিট, খুব ভালো। তুমি তো টিভিতে রিবিটকে দ্যাখোনি।
শওকত সাহেব এবার রিবিটের দিকে তাকিয়ে বললেন : আপনি রিবিট, মানে…আপ…
হ্যাঁ শওকত সাহেব। আমার নাম রিবিট, অতি উচ্চবুদ্ধি মাত্রার রোবট। আপনি রো..ব..ট! শওকত সাহেব এখন যেন আর কথা বলতে পারছেন না।
হ্যাঁ বাবা, রিবিট রোবট। বলল অমি। কিন্তু রিবিট রোবট হলে কী হবে, মানুষের জন্য, শিশুদের জন্য রিবিটের অনেক ভালোবাসা। মানুষের থেকেও বেশি। এই দেখছ না, আমাদের কাছে বাঁচানোর জন্য দুটো বাচ্চা নিয়ে এসেছে।
শওকত সাহেব এখনো যেন ভিন্ন কোনো জগতে রয়েছেন। তিনি কোনোমতে সোফা দেখিয়ে বললেন : রিবিট সাহেব আপনি বসুন। আপনি কী খাবেন? চা, কফি, না কি অন্য কিছু…?
অমি আবার হেসে দিয়ে বলল : বাবা তুমি তো দেখছি বোকা, কিছু জানো না। রিবিট তো কিছু খায় না, চকোলেটও না। রিবিট শুধু মানুষকে ভালোবাসে, আমাকেও ভালোবাসে। তাই না রিবিট?
রিবিট উপরে নিচে মাথা দোলাল।
এমন সময় মিসেস শওকত ভিতরে এলেন। এক হাতে তিনি বাচ্চাদুটোকে কোলে নিয়েছেন। অন্যহাতে দুটো দুধের ফিডার। সোফার উপর বসে তিনি চমকে উঠে বললেন : অমি তুমি, ওনার কোলে কেন?
শওকত সাহেব তার স্ত্রীকে আশ্বস্ত করলেন। বললেন : রিবিট সাহেব খুব ভালোমানুষ, তুমি ভয় পেও না। তাড়াতাড়ি ওদেরকে দুধ খাওয়াও।
মাঝখান থেকে দারোয়ান বলল : খালি ভালোমানুষ না ভাইজান, একেবারে ফেরেশতা।
রিবিট সাথে সাথে বলল : রোবট কখনো মানুষ বা ফেরেশতা হতে পারে না, আপনি ভুল বলছেন।
দারোয়ান সাথে সাথে বলল : হ ভাইজান, আমার ভুল হইছে। আমারে মাফ কইরা দেন।
এদিকে মিসেস শওকত বললেন : আমি ওদেরকে দুধ খাওয়াতে চেষ্টা করছি। কিন্তু পারছি না। ছেলেটি দুধ খেলেও মেয়েটি খাচ্ছে না। ফিডার মুখে দিলেই মুখ
সরিয়ে নিচ্ছে, ফিডার টানছে না।
তাহলে বোধহয় ক্ষুধা নেই। বললেন শওকত সাহেব। ঠিক বুঝতে পারছি না, মেয়েটি খুব বেশি নড়াচড়াও করছে না। শুধু পিটপিট করে তাকাচ্ছে, আবার চোখ বন্ধ করছে।
এবার কথা বলল রিবিট : তাহলে মেয়েবাচ্চাটিকে কি খাওয়ানো সম্ভব হবে?
আমার মনে হচ্ছে অন্য কোনো সমস্যা রয়েছে।
কী সমস্যা?
মনে হচ্ছে মেয়েটি অসুস্থ। তবে নাও হতে পারে।
তাহলে আমি কী করব?
আপনি ওদেরকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান।
এত রাতে ডাক্তার পাব কোথায়? চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল রিবিট।
যে-কোনো ক্লিনিক বা হাসপাতালে নিতে পারেন। সেখানে সবসময়ই ডাক্তার থাকে। আর আমাদের পাশে গ্রিনরোডে বেশ কয়েকটি ক্লিনিক রয়েছে। আপনি ইচ্ছে করলে এগুলোর যে-কোনো একটায় নিতে পারেন।
রিবিট চিন্তিত হয়ে পড়ল। এ মুহূর্তে সে কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। সে কি আদৌ বাচ্চাদুটোকে ক্লিনিকে নিয়ে যাবে নাকি সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবে ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। তাছাড়া বাচ্চাদুটোর বাবা-মা কোথায় সেটাও বের করা দরকার। বাচ্চাদুটো কীভাবে ডাস্টবিনের পাশে এল সেটাও চিন্ত রি বিষয়। সবকিছু মিলে ঘটনাটা ধীরে ধীরে জটিল আকার ধারণ করছে বুঝতে পারছে সে। এ-বিষয়ে শওকত সাহেব এবং তার স্ত্রীর কাছে সাহায্য চাইবে কিনা কিছুক্ষণ ভাবল। কিন্তু শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারল না। তাই অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্কে ইপির সাথে পরামর্শ শুরু করল : ইপি, আমি কী সমস্যায় পড়েছি তুমি কি বুঝতে পারছ?
হ্যাঁ রিবিট, বুঝতে পারছি। তোমার সমস্যাটা গুরুতর।
আমি এখন কী করব? বচ্চাদুটোকে কি আমার সাথে নিয়ে যাব?
তোমার তো সেরকমই করা উচিত।
কিন্তু ওদেরকে আমি আমার কাছে রাখব কীভাবে? বাচ্চাদের খাবার তৈরি করা, ওদের জন্য দুধ বানানো, ওদের কান্না থামানো, ওদেরকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো, চিকিৎসা করানো, এগুলো তো বেশ ঝামেলার কজ।
ঝামেলার তো বটেই। কিন্তু কোনো বিকল্প উপায় তো নেই।
আমি কি ওদেরকে শওকত সাহেব এবং তার স্ত্রীর কাছে রেখে যেতে পারি না? তাদের তো ছোট বাচ্চা আছে। সম্ভবত ভিতরে ঘুমাচ্ছে। ওদের সাথেই এ বাচ্চাদুটো থাকবে, খেলবে, বড় হবে।
না ইপি, তুমি তা পারো না। তাহলে বাচ্চাদুটোর প্রতি তোমার অবহেলা করা হবে।
কেন? ওরা তো মানুষের কাছেই থাকছে।
তা থাকছে। কিন্তু মানুষ তার নিজের সন্তানকে যেভাবে ভালোবাসে অন্যের সন্তানকে সেভাবে ভালোবাসে না। এটি মানুষের চরিত্রের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। অবশ্য শুধু মানুষ না, প্রায় সকল প্রাণীই নিজের সন্তানের প্রতি অধিক দায়িত্বশীল এবং আবেগপ্রবণ। যাইহোক, বাচ্চাদুটোকে তোমার সাথেই নিতে হবে এবং ওদেরকে কোনো ক্লিনিকে চিকিৎসা করাতে হবে। দেরি হলে অন্য কোনো বিপদ হতে পারে।
ঠিক আছে ইপি, আমি বাচ্চাদুটোকে কোনো ক্লিনিকে নিয়ে যাব।
সেটাই সঠিক সিদ্ধান্ত হবে। তোমার কাজ হবে যেভাবেই হোক ওদেরকে বাঁচিয়ে তোলা। তুমি যদি বাচ্চাদুটোকে বাঁচিয়ে রাখার সকল ব্যবস্থা করতে পারো, ওদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারো, তাহলেই তুমি মানুষের জন্য কিছু করতে পেরেছ বলে ভাবতে পারবে।
তোমাকে ধন্যবাদ ইপি, দেখি আমি কী করতে পারি। রিবিট ইপির সাথে অভ্যন্তরের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কথা বলায় কেউ তা শুনতে পায়নি।
এদিকে মিসেস শওকত কোনোভাবেই মেয়েবাচ্চাটিকে খাওয়াতে পারলেন না। অবশেষে বললেন : মনে হচ্ছে বাচ্চাটিকে খাওয়ানো যাবে না। আমি দুধসহ একটা ফিডার দিয়ে দিচ্ছি, পরে পারলে ওকে খাওয়াবেন।
আপনাকে ধন্যবাদ। বলল রিবিট।
আর সম্ভব হলে ওদেরকে দ্রুত কোনো ডাক্তার দেখানোর চেষ্টা করুন। আমার মনে হচ্ছে মেয়েটি সত্যিই অসুস্থ।
আমি ওদেরকে ডাক্তার দেখাতে চেষ্টা করব।
কথা বলতে বলতে রিবিট কোল থেকে অমিকে নামিয়ে দিল। তারপর মিসেস শওকতের কোল থেকে বাচ্চাদুটোকে নিজের কোলে নিল। মিসেস শওকত অবশ্য নতুন একটা চাদর দিয়ে বাচ্চাদুটোকে জড়িয়ে দিয়েছেন। রিবিট ঘুরে দাঁড়াতে দেখল, দারোয়ানকে সে যেখানে নামিয়ে দিয়েছিল ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। আগের মতোই একহাতে বাচ্চাদুটোকে কোলে নিয়ে অন্যহাতে দারোয়ানের কলার চেপে ধরে তাকে এক ফুট উপরে তুলে ফেলল। তারপর এগিয়ে গেল দরজার দিকে।
দরজার কাছে আসতে অমি পিছন থেকে বলল : রিবিট, তুমি আবার কখন আসবে?
রিবিট ঘুরে দাঁড়াল। তারপর বলল : প্রয়োজন হলেই আসব।
তুমি যখন খুশি তখন আমাদের বাসায় আসবে। আমি তোমার সাথে ভিডিও গেম খেলব। আমি নতুন একটা ভিডিও গেম কেনার জন্য টাকা জমাচ্ছি।
এবার কথা বললেন শওকত সাহেব : হ্যাঁ রিবিট সাহেব, আপনার ইচ্ছে হলেই আমাদের বাসায় চলে আসবেন।
আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ আমি আপনাদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। বাচ্চাদুটোর জন্য আপনারা অনেক কিছু করেছেন। আর ওদের জন্য দোয়া করবেন।
আপনাকেও ধন্যবাদ। বিড়বিড় করে বললেন মিসেস শওকত। নিচে এসে রিবিট দারোয়ানের দিকে তাকাল। সে দারোয়ানকে এখনো একফুট শূন্যে তুলে রেখেছে। ভয়ে বেচারার চোখমুখ শুকিয়ে গেছে। বাইরে একেবারে গেটের কাছে এসে সে দারোয়ানকে নিচে নামিয়ে দিয়ে বলল : এখন। থেকে মানুষের উপকার করতে চেষ্টা করবেন।
হ্যাঁ করব।
আমি জানি এত রাতে আপনার পক্ষে গেট খুলে আমার মতো অপরিচিত কাউকে ভিতরে প্রবেশ করতে দেয়া আপনার স্বাভাবিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু তারপরও আপনাকে অনুরোধ করছি আপনি বাস্তবতা বুঝতে চেষ্টা করবেন, মানুষের সুবিধা-অসুবিধা বুঝতে চেষ্টা করবেন।
জ্বি..জি স্যার, করব। দারোয়ান এখনো ভয়ের মধ্যে আছে।
রিবিট একটু হেঁটে যেয়ে ভাঙা পাইপের টুকরো দুটো তুলে নিয়ে এলো। তারপর টুকরো দুটো দারোয়ানের হাতে দিয়ে বলল : আপনার পাইপটি ভেঙে ফেলার জন্য আমি দুঃখিত। আমার কোনো উপায় ছিল না, তা না হলে হয়তো বাচ্চাদুটোর শরীরে আঘাত লাগত।
না, ঠিক আছে।
আমাকে সাহায্য করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
রিবিট আর কোনো কথা বলল না। গেট দিয়ে বাইরে রাস্তায় বেরিয়ে এল। দারোয়ান অবশ্য তার আগের জায়গায়ই দাঁড়িয়ে আছে। সে এখনো বুঝতে পারছে না যা-কিছু ঘটে গেল তা কি আদৌ সত্য, নাকি তার স্বপ্ন।
৬
রিবিট কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থেকে সিদ্ধান্ত নিল। তাকে এখন নিকটবর্তী ক্লিনিকে যেতে হবে, নিশ্চিত হতে হবে মেয়েবাচ্চাটি আদৌ অসুস্থ কিনা। সে ঢাকার ম্যাপটি পরীক্ষা করে বুঝল খুব কাছেই গ্রিনরোডে একটি নামকরা ক্লিনিক রয়েছে। এখান থেকে হেঁটে যেতে সর্বোচ্চ সাত থেকে আট মিনিট সময় লাগবে। সে সিদ্ধান্ত নিল এই ক্লিনিকেই যাবে। তাই ক্লিনিকের দিকে হাঁটতে শুরু করল।
বাচ্চাদুটো এখনো জেগে আছে। তবে ছেলেবাচ্চাটির চোখ ঘুমে ঢুলুঢুলু। মেয়েবাচ্চাটি এখন একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে, চোখ পিটপিট করছে না। মেয়েটির দৃষ্টিতে অদ্ভুত এক অভিব্যক্তি, যেন কিছু বলতে চায়। রিবিটের কেমন যেন মায়া হল। সে আলতোভাবে তার হাত মেয়েটির মুখের উপর রাখল। মেয়েটি চোখ বন্ধ করে আবার তার দিকে তাকাল।
বাচ্চাদুটোর কথা ভেবে রিবিট সত্যিই অবাক হচ্ছে। দুটোবাচ্চা তাদের মাথা আর পায়ের মাধ্যমে একে অপরের সাথে সংযুক্ত। ইচ্ছে করলেই তারা স্বাধীনভাবে নড়াচড়া করতে পারছে না। আপন ভাই-বোন পাশাপাশি রয়েছে, অথচ কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। ব্যাপারটি সত্যি বিস্মিত করার মতো। এরা যদি এভাবে বেঁচে থাকে তাহলে একমাত্র আয়নার মাধ্যমেই একে অপরকে দেখতে পাবে। অন্য কোনোভাবে নয়। এদের পরবর্তী জীবন কেমন হবে ভাবতেই শিউরে উঠল সে। জীবনের এতগুলো বছর এরা কীভাবে একসাথে। কাটাবে তা তার মাথায় ঢুকল না।
হাঁটতে হাঁটতে রিবিট ডেকে উঠল : ইপি!
হা রিবিট। আমি বুঝতে পারছি তুমি আমাকে কী জিজ্ঞেস করবে। ক্লিনিকে কী-ধরনের জটিলতা হতে পারে এই তো?
ইপি তুমি ঠিকই ধরেছ।
আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। তবে আশা করছি ক্লিনিকের সবাই তোমাকে সাহায্য করবে। কিন্তু মূল সমস্যা হচ্ছে…
আমার কাছে তেমন কোনো টাকাপয়সা নেই, মাত্র তিনশো তেত্রিশ টাকা আছে। এত অল্প টাকায় কিছুই হবে না।
তোমার অনুমান সত্য রিবিট।
ঠিক আছে আগে তো যাই, তারপর দেখা যাবে।
এত রাতে অবশ্য কোনো ভালো ডাক্তারও পাওয়া যাবে না।
তা হয়তো পাওয়া যাবে না। কিন্তু বাচ্চাদুটোকে তো কোনো ডাক্তারকে দেখাতে পারব। অন্তত বুঝতে পারব আদৌ ওরা অসুস্থ কিনা। তারপর হয়তো চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে।
তোমার সিদ্ধান্ত ঠিকই আছে। তবে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাকি থেকে যাচ্ছে।
কী কাজ? প্রশ্ন করল রিবিট।
বাচ্চাদের মা-বাবাকে খুঁজে বের করা।
কিন্তু এ-মুহূর্তে তা কীভাবে সম্ভব? আমরা কাউকে চিনি না, জানিও না। তাছাড়া কোথায় কীভাবে খুঁজব?
রিবিট তুমি ঠিকই বলেছ। আপাতত ডাক্তারকেই দেখাও। পরের সিদ্ধান্ত পরে নেয়া যাবে। প্রথমে নিশ্চিত হও আদৌ বাচ্চাদুটো সুস্থ কিনা। তারপর নাহয় অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।
মেয়েবাচ্চাটিকে নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে, ও বোধহয় সত্যিই অসুস্থ। নড়াচড়াও করছে না, কিছু খাচ্ছেও না।
অন্য কোনো কারণও হতে পারে। বলল ইপি।
কী কারণ?
আমি ঠিক জানি না। বাচ্চাদের সাইকোলজি সম্পূর্ণ ভিন্ন। ওরা অনেককিছুই করে যা মানুষের আচরণে স্বাভাবিক মনে হয় না। কিন্তু ওদের কাছে স্বাভাবিক। মেয়েবাচ্চাটি সুস্থ কিনা তা তুমি নিজেই পরীক্ষা করার চেষ্টা করতে পারো।
কীভাবে?
তোমার অভ্যন্তরে যে-সকল সুর রেকর্ড করা আছে তার কয়েকটি বাজিয়ে দেখতে পারো। বাচ্চারা যে-কোনো শব্দ বা সুর শুনলে বিভিন্নভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। মেয়েটি যদি অসুস্থ হয় তাহলে এই সুর বা শব্দ তার মধ্যে তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না। খুব বেশি হলে বিরক্তির সৃষ্টি করতে পারে।
ইপির কথামতো রিবিট তার অভ্যন্তরে সংরক্ষিত কয়েকটি সুর বাজাল। সুরগুলো খুবই সুন্দর, শুনলে যে-কারো ভালো লাগবে। কিন্তু মেয়েটির মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। তাই রিবিট অনেকটা হতাশ গলায় বলল : না ইপি, বাচ্চাটি আগের মতোই আছে।
এমনও তো হতে পারে বাচ্চাটি বধির, কিছু শুনতে পায় না।
কী বলছ তুমি! চমকে উঠে বলল রিবিট।
হ্যাঁ রিবিট হতে পারে। ছেলেবাচ্চাটি কী করছে?
ঘুমিয়ে পড়েছে।
হ্যাঁ তাই তো দেখছি। তুমি এক কাজ করে। মেয়েবাচ্চাটির ডানপাশে হাত দিয়ে অদ্ভুত কোনো শব্দ করো। যদি দ্যাখো বাচ্চাটি ঘুরে দেখার কোনো চেষ্টা করছে তাহলে বুঝতে পারবে বাচ্চাটি বধির না। এভাবেই ডাক্তাররা বাচ্চাদের পরীক্ষা করে। এ পরীক্ষায় তুমি হয়তো নিশ্চিত হতে পারবে না, তবে অনুমান করতে পারবে।
আমি দেখছি ইপি। বাচ্চাদুটোর ডানে রিবিট হাতের আঙুলের সাহায্যে বেশ জোরে অদ্ভুত একটা শব্দ করল।
সাথে সাথে ছেলেবাচ্চাটি চোখ মেলে তাকাল। তারপর হালকা নড়েচড়ে উঠল। শব্দের সাথে সাথে মেয়েবাচ্চাটিও চোখ বন্ধ করে আবার তাকাল। রিবিট নিশ্চিত হতে একই রকম শব্দ আবারো করল। আগের মতোই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল বাচ্চাদুটো।
রিবিট এবার আনন্দের সাথে বলল : ইপি, আমি নিশ্চিত হয়েছি দুটো বাচ্চার কেউই বধির না।
তারপরও তোমাকে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। ডাক্তারের অভিমত না-পাওয়া পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যাবে না।
কথা বলতে বলতে রিবিট ক্লিনিকের সামনে এসে পৌঁছাল। ক্লিনিকের অভ্যন্তরে রিসেপশনে এসে সে চারদিকটা ভালোমতো দেখে নিল। রিসেপশন ডেস্কে অল্পবয়সী এক মেয়ে বসে-বসে ঝিমুচ্ছে। পাশেই অনেকগুলো চেয়ার থাকলেও দুটো বাদে সবগুলোই ফাঁকা। একটাতে মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। অন্যটাতে বয়স্ক এক ভদ্রলোক তার দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে। রিবিট বুঝতে পারল বয়স্ক ভদ্রলোক তাকে দেখে খুব ভয় পেয়েছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে বয়স্ক ভদ্রলোক ধীরে ধীরে পিছনে সরে যাচ্ছে।
রিবিট সরাসরি রিসেপশন ডেস্কের সামনে এসে দাঁড়াল। মেয়েটি তখনো ঝিমুনির মধ্যে রয়েছে। রিবিট সামনে কাঁচের উপর মৃদু টোকা দিতে মেয়েটি চোখ মেলে তাকাল। রিবিটকে সামনে দেখে প্রথমেই সে হাঁ হয়ে গেল। তারপর মাথা ঝাঁকি দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করল আদৌ সে যা দেখছে তা সত্যি কিনা। আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য দুহাতে চোখ কচলে নিল। তারপর বলল : আ.আ..
রিবিট খুব শান্তভাবে বলল : আমি রিবিট, অতি উচ্চবুদ্ধিমাত্রার রোবট। আমার আপনার সাহায্যের প্রয়োজন।
আমার..আ…সা…। মেয়েটির গলা দিয়ে কোনো কথা বেরোচ্ছে না।
হ্যাঁ, আমাকে আপনার সাহায্য করতে হবে। আমার কাছে দুটো বাচ্চা আছে। সম্ভবত ওরা অসুস্থ। আপনি কি দয়া করে ওদেরকে পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করবেন?
মেয়েটি একবার বাচ্চাদুটোকে দেখে আবার রিবিটের দিকে তাকাল। তারপর বলল : আ…আপনি রি..রি, বিট, রোবট।
হ্যাঁ আমি রিবিট এবং রোবট। তার থেকে বড় কথা এ বাচ্চাদুটোর জন্য আপনার সাহায্য প্রয়োজন এবং তা জরুরি।
আপনি অপেক্ষা করুন। আমি ডাক্তার স্যারদের খবর দিচ্ছি।
মেয়েটি রিসেপশন ডেস্ক থেকে ফোন করলেই পারত। কিন্তু কেন যেন সে ফোন না করে ডেস্ক ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এল। ক্লিনিকের ভিতরে যাওয়ার আগে সে শুধু বলল : রা…রাতে আ..আমি আপনাকে টিভিতে দেখেছি।
মেয়েটি চলে যেতে রিবিট পিছনে ফিরে তাকাল। দেখল মাঝবয়সী ভদ্রলোক অঘোরে ঘুমোচ্ছে। আর বয়স্ক ভদ্রলোক চেয়ারের পিছনে লুকিয়ে আছে। তবে মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে তাকে দেখছে। রিবিট সরাসরি ভদ্রলোকের চোখে তাকাতে ভদ্রলোক চেয়ারের পিছনে সেই যে লুকাল আর মাথা তুলে তাকাল না। তবে লুকানোর সময় চেয়ারে ধাক্কা লাগায় ধপ করে একটা শব্দ হল। আর তাতেই জেগে উঠল মাঝবয়সী ভদ্রলোক। ভদ্রলোক খুব বিরক্তি নিয়ে রিবিটের দিকে তাকাল যেন ভাবখানা এমন রিবিটই তার ঘুম ভেঙেছে। তিন সেকেন্ডের মাথায় ভদ্রলোকের চোখে বিরক্তির পরিবর্তে স্পষ্ট ভয়ের চিহ্ন ফুটে উঠল। রিসেপশনে বসা মেয়েটির মতো সেও দুহাতে চোখ ডলে বুঝতে চেষ্টা করল আদৌ সে যা দেখছে তা সত্যি কিনা। বিষয়টি সম্পর্কে আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য চারপাশে তাকাল। যখন দেখল আশেপাশে কেউ নেই তখন ভয়ে নিজের বুকে বেশ কয়েকবার ফুঁ দিল। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে ধীরে ধীরে পিছনে সরে যেতে লাগল। ভদ্রলোক লক্ষ্য করল না তার শরীরের ধাক্কায় পাশেই দুটো চেয়ার পড়ে গেল। এদিকে আগে থেকেই চেয়ারের পিছনে লুকিয়ে থাকা ভদ্রলোককে থরথর করে কাঁপতে দেখল রিবিট। বয়স্ক ভদ্রলোক চেয়ার আছড়ে পড়ার শব্দ শুনে ভেবেছে হয়তো রিবিটই তাকে ধরতে এসেছে।
রিবিট বুঝতে পারল মারাত্মক ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। তাই সে নিজেই ভদ্রলোক দুজনের ভয় দূর করার সিদ্ধান্ত নিল। আর এ-কারণেই সে ভদ্রলোক দুজনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকল। তার এগিয়ে আসার কারণে উল্টো ফল হল। মাঝবয়সী ভদ্রলোক আর ডানে-বামে তাকাল না। ‘ওরে আল্লা…রে, গেলাম…রে’ বলে চিৎকার করে দৌড়ে ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে গেল। তার দেখাদেখি বয়স্ক ভদ্রলোকও উঠে দাঁড়াল। সে উঠে দাঁড়িয়ে দেখে রিবিট তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে তার চোখদুটো যেন ফুটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। রিবিট তাড়াতাড়ি বলল : আমাকে ভয় পাবেন না, আমি আপনাদের বন্ধু, আপনাদের..
বয়স্ক ভদ্রলোক রিবিটকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আগের জনের মতোই চিৎকার করতে করতে ছুট দিল : ওরে আল্লারে, কোনে আইলাম!…এই কি হাসপাতাল… না…ওরে বাপরে…ওরে মা…রে…আ…মি …মরছি, কোনে আইলাম!… কোনে আইলাম…!!!
রিবিট খুব কষ্ট পেল। সে কাউকে ভীত বা আতঙ্কিত করতে চায় না অথচ সবাই তাকে দেখলে ভয় পায় বা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তাই সে মনের দুঃখে ইপিকে বলল : ইপি, কেন আমাকে সবাই এরকম ভয় পাচ্ছে?
রিবিট, এরকম হতেই পারে। কারণ এনাদের কেউই তোমাকে আগে কখনো দেখেনি। তাছাড়া তুমি দেখতে অবিকল মানুষের মতো নও। তোমার শরীর ধাতুর তৈরি, তোমার শরীরে রক্তের প্রবাহের পরিবর্তে রয়েছে ইলেকট্রনের প্রবাহ, মস্তিষ্কের পরিবর্তে তুমি নিয়ন্ত্রিত হও প্রোগ্রাম দ্বারা, তোমার…
ইপি আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু সবকিছুর পরে এটা তো সত্য যে আমি মানুষের উপকার করতে চেষ্টা করছি।
হ্যাঁ সত্য। কিন্তু মানুষ তা বুঝতে পারছে না। এমনকি তুমি বললেও সকলে তা বিশ্বাস করবে না। কারণ মানুষের বিশ্বাস অর্জন করা খুব কঠিন, তবে বিশ্বাস ভাঙা খুব সহজ। এ-কারণে বিশ্বাস অর্জনের জন্য তোমাকে দীর্ঘ সময় কাজ করতে হবে। পাশাপাশি বিশ্বাস রক্ষা করার জন্য সবসময় খুব সতর্ক থাকতে হবে। তোমার সামান্য ত্রুটির জন্য মানুষ তোমাকে ভুল বুঝতে পারে।
কিন্তু এই যে দুজন মানুষ আমাকে দেখে ভয়ে পালাল, আমি তো তাদের বিশ্বাসভঙ্গের মতো কোনো আচরণ করিনি। এমনকি রিসেপশনে যে-মেয়েটি ছিল সে আমাকে চিনতে পেরেও ভয়ে পালাল।
রিবিট, মানুষের মন বড় রহস্যময়। সে কারণে মানুষের আচরণও রহস্যময়। এই তুমি রিবিট একদিন দেখবে মানুষ তোমাকে কত ভালোবাসবে, কত সম্মান করবে। তোমাকে দেখলে কত মানুষ তোমার সাথে একটু কথা বলার জন্য ছুটে আসবে, হাত মিলানোর জন্য ছুটে আসবে। আজ যারা তোমাকে দেখে ভয়ে পালাচ্ছে হয়তো তারাও আসবে। তোমাকে শুধু বিশ্বাস অর্জন করতে হবে রিবিট, শুধুই বিশ্বাস। এ দেশে বিশ্বস্ত মানুষের খুব অভাব। তুমি মানুষ নও, একটি উচ্চ বুদ্ধিমাত্রার রোবট। রোবট হয়ে তুমি যদি মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে পার দেখবে মানুষ তোমাকে কত ভালোবাসে। রিবিট, তুমি কল্পনা করতে পারবে না এদেশের মানুষের মনে কত ভালোবাসা। কিন্তু তাদের দুঃখ, তারা তাদের এই বুকত্র ভালোবাসা উপহার দেয়ার মতো কাউকে খুঁজে পায় না। তারা অধিকাংশই মিথ্যা ভালোবাসা উপহার দেয়ার ভান করে ঘুরে বেড়ায়। এই মিথ্যা ভালোবাসা প্রদানে কিংবা শ্রদ্ধা জ্ঞাপনে কোনো আনন্দ নেই, কোনো সুখ নেই। রিবিট, তোমার স্রষ্টা প্রফেসর হক চান তুমি সত্যিকারের ভালোবাসা অর্জন করো, তুমি সত্যিকারের শ্রদ্ধা অর্জন করা। তাহলেই তার স্বপ্ন সার্থক হবে। তুমি একটি বোবট হয়ে যদি লক্ষ লক্ষ গরিব-দুঃখী মানুষের ভালোবাসা অর্জন করতে পার, পথে-ঘাটে ঘুরে-বেড়ানো হাজার হাজার শিশুর শ্রদ্ধা ভালোবাসা অর্জন করতে পারো, তোমার থেকে সুখী আর কেউ হবে না। তুমি তোমার কোলের ছোট্ট শিশুদুটোর কথা চিন্তা করে দ্যাখো। ওদের বুকের মধ্যে কত নিষ্পাপ ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা জমে আছে। অথচ ওরা যে এই ভালোবাসা, শ্রদ্ধা কাউকে দেবে সেরকম কেউ নেই। রিবিট, তুমিই আজ ওদের সব, ওদের বাবা-মা, ওদের জীবন-মরণ। রিবিট, তুমি যদি এই ছোট্ট শিশুদুটোর জীবন রক্ষা করে ওদেরকে সুন্দর জীবনের নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারো তাহলে তুমিই ওদের বুকভরা ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার অধিকারী হবে। আমি জানি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার জন্য তোমার কোনো আকাক্ষা নেই, কিন্তু তুমি দেখবে সামান্য ভালো কাজের জন্য কীভাবে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা তোমার কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তুমি না-চাইলেও মানুষ তোমাকে ভালোবাসবে, তুমি না-চাইলেও মানুষ তোমাকে শ্রদ্ধা করবে। তাই বলছি, আজকের ঘটনার জন্য তুমি মন খারাপ কোরো না। তোমার কোনো দোষ নেই। যারা ভয়ে পালিয়েছে তারা তাদের নিজের মানসিক দুর্বলতার জন্যই পালিয়েছে। তুমি আমি ছেলেটির কথা চিন্তা করে দ্যাখো। সে তোমার প্রতি কতটা ভালোবাসা প্রকাশ করেছে। সে ছোট হলেও তোমাকে দেখে একটুও ভয় পায়নি। বরং তোমার কাছে এসে তোমার প্রতি তার সুন্দর সুন্দর অনুভূতিগুলো প্রকাশ করেছে। তুমি সবসময় এই সুন্দর অনুভূতিগুলোর প্রতি যত্নশীল থাকবে। লক্ষ্য রাখবে কখনো যেন এই অনুভূতিগুলো আহত না হয়।
ইপি, আমি তোমার কথায় সত্যি মুগ্ধ। আমি দারুণ উৎসাহবোধ করছি। বুঝতে পারছি পরোপকারেই পরম শান্তি। আমি চেষ্টা করব, অবশ্যই চেষ্টা করব।
ধন্যবাদ রিবিট।
ইপি চুপ হয়ে গেলে রিবিট পিছনে পায়ের শব্দ শুনতে পেল। ঘুরে দাঁড়াতে দেখে ভয় আর আতঙ্কমিশ্রিত চোখে মধ্যবয়সী একজন ডাক্তার এগিয়ে আসছেন। তার পিছনে রিসেপশনের সেই মেয়েটি। ডাক্তার কিছুদূর এগিয়ে এসে হঠাই থেমে গেলেন। বোঝা যাচ্ছে খুব ভয় পেয়েছেন তিনি।
রিবিট নিজেই সামনে এগিয়ে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল : আমি রিবিট, একটি উচ্চ বুদ্ধিমাত্রার রোবট।
ডাক্তার সাহেব কিছুটা ইতস্তত ভঙ্গিতে বললেন : জি, আ..আমি আপনার কথা শুনেছি। আমি ডাক্তার মিলন।
ডাক্তার মিলন কথা বললেও রিবিটের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন না। কিছুতেই তিনি তার ভয় কাটাতে পারছেন না।
রিবিট তার হাত টেনে এনে বলল : দয়া করে আমাকে ভয় পাবেন না। আ, আপনাদের কোনো ক্ষতি করতে আসিনি। আমি আপনাদের কাছে সাহায্যের; এসেছি। আমার কোলে এই যে দুটোবাচা দেখতে পাচ্ছেন ওরা একজনের সাথে অন্যজন সংযুক্ত। সম্ভবত মেয়েবাচ্চাটি অসুস্থ। আপনি কি একটু পরীক্ষা করে দেখবেন?
এমন সময় একজন নার্স উপস্থিত হল। ডাক্তার মিলন ইশারা করতে নার্স ভয়ে-ভয়ে রিবিটের কোল থেকে বাচ্চাদুটোকে নিয়ে ভিতরে গেল। ডাক্তার মিলন বললেন : আপনি অপেক্ষা করুন, আমি দেখছি। কথা শেষ করেই তিনি ভিতরে চলে গেলেন।
ডাক্তার মিলনের হাবভাবে মনে হল তিনি যেন এখান থেকে চলে যেতে পারলেই বাঁচেন।
ডাক্তার মিলন আর নার্স চলে গেলেও রিসেপশনের মেয়েটি দাঁড়িয়ে থাকল। রিবিট বুঝতে পারল মেয়েটি ভয় পাচ্ছে। রিবিট মেয়েটির ভয় কাটাতে বলল : আপনি আমাকে ভয় পাবেন না।
জি, ভয় পাব না।
তারপরও রিবিট মেয়েটিকে ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে দেখল। সে বুঝতে পারল এত সহজে সে মেয়েটির ভয় কাটাতে পারবে না। তাই হাল ছেড়ে দিয়ে ভিন্ন প্রসঙ্গে এল, এখানে ডাক্তারদের ফি কত?
মেয়েটি আমতা-আমতা করে বলল : জি ফি, মানে ইয়ে..আউটডোরের ফি একশো টাকা।
রিবিট একটি একশো টাকার নোট মেয়েটির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল : এই নিন ফি।
মেয়েটি বিস্মিত চোখে বলল : ফি মানে…কেউ তো আপনার কাছে ফি চায়নি..!
আপনি রাখুন। আপনাদের নিশ্চয় ফি রাখার নিয়ম রয়েছে।
মেয়েটি কাঁপা হাতে নিবিটের কাছ থেকে একশো টাকার নোটটি নিল। তারপর রিসেপশন ডেস্ক থেকে রশিদ লিখে এনে রিবিটের হাতে দিল। তবে এবার আর মেয়েটির হাত কাঁপল না। রিবিটের মনে হল এবার বোধহয় মেয়েটির ভয় কিছুটা হলেও কমেছে। মেয়েটিকে বলল : ডাক্তার মিলন ছাড়া কি আজ রাতে অন্য কোনো ডাক্তার নেই?
জি আছেন। সবাই উনার থেকে কম অভিজ্ঞ। এখন শেষরাত তো, তাই সবাই বিশ্রামে আছে।
ও আচ্ছা। একটু থেমে রিবিট আবার বলল : ডাক্তার মিলন কি শিশু বিশেষজ্ঞ?
না, উনি মেডিসিনের ডাক্তার। তবে আমি আশা করছি উনি বাচ্চাদুটোর সমস্যা বুঝতে পারবেন।
তাহলে তো ভালো।
রিবিট লক্ষ্য করল ভিতরে প্রবেশের দরজা দিয়ে বেশ কয়েকজন নার্স উঁকিঝুঁকি মেরে তাকে দেখছে। তবে কেউই সামনে আসছে না। সবার মধ্যে যে একরকম অজানা ভয় কাজ করছে সে তা বুঝতে পারল।
এমন সময় ডাক্তার মিলন আর আগের সেই নার্স ফিরে এল। বাচ্চাদুটো নার্সের কোলে। রিবিট কিছু বলার আগেই ডাক্তার মিলন বললেন : ছেলেটি ভালো আছে, তবে মেয়েটির পালস বা নাড়ির স্পন্দন বেশ কম, ব্লাডপ্রেশারও কম। আমি ঠিক নিশ্চিত নই মেয়েটি কতটা অসুস্থ।
আপনারা তাহলে আপনাদের ক্লিনিকে ওদের দুজনকে ভর্তি করে নিন।
বাচ্চাদুটোকে আপনি কোথায় পেয়েছেন? বেশ সন্দেহ নিয়ে প্রশ্ন করলেন ডাক্তার।
ডাস্টবিনের পাশে।
ওদের বাবা-মা কোথায়?
আমি জানি না। সঠিক বলতে পারব না।
ওদের নাম কী?
আমার জানা নেই।
আপনি কি দুধের ফিডারটি সাথেই পেয়েছিলেন?
না। ওদেরকে যেখানে পেয়েছি তার পাশের একটি বাসা থেকে দিয়েছে। ডাক্তার মিলন এবার খানিকটা গম্ভীর হয়ে বললেন, আমি দুঃখিত রিবিট সাহেব, এরকম নাম পরিচয়হীন দুটো শিশুকে আমরা ভর্তি করতে পারব না।
কেন পারবেন না?
বাচ্চাদুটো সংযুক্ত যমজ, জটিলতা অনেক। যদি কোনোকিছু ঘটে যায় তাহলে বেশ ঝামেলা হবে। নামপরিচয়হীন দুটো শিশুকে হাসপাতালে রাখার দায়ে যথেষ্ট পুলিশি ঝামেলা পোহাতে হবে।
কেন? আমি তো রয়েছি। আমি পুলিশকে সবকিছু খুলে বলব।
পুলিশ আপনার কথা বিশ্বাস করবে না।
আমি যদি এখনই পুলিশকে সবকিছু খুলে বলি।
আপনি চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তাতে কোনো কাজ হবে না।
কেন হবে না?
আমি দুঃখিত রিবিট সাহেব। আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি আপনি একটি রোবট মাত্র, আপনার কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। কাজেই যত ঝামেলা আমাদেরকেই পোহাতে হবে।
ডাক্তার মিলনের কথায় রিবিট খুব দুঃখ পেল। তারপরও বলল : তাই বলে অসুস্থ দুটো শিশুকে আপনারা ক্লিনিকে ভর্তি করবেন না? রাস্তায় গাড়ি দুর্ঘটনায় পতিত মুমূর্ষ মানুষ তো তার নিজের নাম-ঠিকানা বলতে পারে না। আপনারা কি তাদেরকে ভর্তি করেন না?
হ্যাঁ করি। কারণ ওই ঘটনার পারিপার্শ্বিক প্রমাণ থাকে। তাছাড়া এ-ধরনের বাচ্চার চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এই ব্যয় বহন করবে কে?
আমি করব। হঠাৎই উত্তর দিল রিবিট।
আপনার কাছে কি এত টাকা রয়েছে?
রিবিট খানিকটা সময় নিয়ে বলল : এ মুহূর্তে আমার কাছে দুইশো তেত্রিশ টাকা আছে। আপনি আপাতত ওদের ভর্তি করে নিন। আমি টাকার ব্যবস্থা করছি।
আমি দুঃখিত রিবিট সাহেব। আমরা বাচ্চাদুটোকে ভর্তি করতে পারব না।
ডাক্তার মিলন আর কোনো কথা বললেন না। সরাসরি ভিতরে চলে গেলেন।
ডাক্তার মিলনের সাথের নার্স বাচ্চাদুটোকে রিবিটের কোলে দিয়ে সেও ভিতরে চলে গেল। রিবিট বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল। সে ভেবে পেল না কেন এরকম
অসহায় দুটো বাচ্চার চিকিৎসা ডাক্তার মিলন করতে চাচ্ছেন না।
সবাই চলে গেলে রিবিট লক্ষ্য করল রিসেপশনিস্ট মেয়েটি তখনো আছে। রিবিট তাকে বলল : আমি এখন কী করতে পারি?
মেয়েটি অসহায়ভাবে বলল : আমি জানি না। সম্ভব হলে আমি আপনাকে সাহায্য করতাম। কিন্তু আমার ক্ষমতা খুবই নগণ্য।
আমি কি অন্য কোনো ক্লিনিকে চেষ্টা করব?
কোনো লাভ হবে না। নামপরিচয়হীন এ-ধরনের শিশুদের কেউ ভর্তি করবে না।
রিবিট বাচ্চাদুটোকে দেখল। ছেলেটির চোখে ঘুম। মেয়েটি সেই আগের মতোই তাকিয়ে আছে। মাঝে মাঝে চোখ পিটপিট করছে। মেয়েবাচ্চাটির জন্য তার খুব কষ্ট হচ্ছে। ডাক্তার যেভাবে বলেছে তাতে বাচ্চাটি আদৌ সুস্থ না অসুস্থ বিষয়টা তার কাছে পরিষ্কার হয়নি। যে-কোনো কারণেই পাস আর ব্লাডপ্রেশার কম হতে পারে।
রিবিট বাচ্চাদুটোকে বুকে চেপে ধরে রিসেপশনিস্ট মেয়েটিকে স্নান গলায়। বলল : আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি বাচ্চাদুটোর জন্য সহমর্মিতা দেখিয়েছেন।
কেন যেন মেয়েটির গলা জড়িয়ে এল। সে আর কিছু বলতে পারল না।
৭
রিবিট বাচ্চাদুটোকে নিয়ে ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে এল। এ মুহূর্তে সে কী করতে পারে? অন্য কোনো ক্লিনিকে যেতে পারে, কিন্তু তাতে কোনো লাভ হবে না। সরকারি হাসপাতালে যেতে পারে, সেখানেও একই ঝামেলা পোহাতে হবে। তারাও ভর্তি করবে না। পুলিশের কাছে যেতে পারে, কিন্তু সেখানে তো চিকিৎসা হবে না। অনেক ভেবেচিন্তে সে সিদ্ধান্ত নিল পুলিশের কাছেই সাহায্যের জন্য যাবে। পুলিশ যদি বাচ্চাদুটোর দায়িত্ব নেয় তাহলে অন্তত হাসপাতালে ভর্তি করা সম্ভব হবে, হয়তো পুলিশ নিজ উদ্যোগেই কাজটা করবে। এই ভেবে সে থানায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
রিবিট ঢাকার ম্যাপ পরীক্ষা করে নিউমার্কেট থানাকে কাছেই দেখতে পেল। গ্রিনরোডে সে যেখানে রয়েছে সেখান থেকে দ্রুত হেঁটে গেলে সর্বোচ্চ পনেরো থেকে বিশ মিনিটের মতো সময় লাগবে। অবশ্য কোনো গাড়ি পেলে ভালো হত। কিন্তু এত রাতে তার পক্ষে গাড়ি পাওয়া খুব কঠিন। তাছাড়া কে তাকে গাড়ি দেবে?
রিবিট যখন এসব ভাবছে ঠিক তখনই একটা ট্যাক্সিক্যাবকে আসতে দেখল। হাত উঁচু করে ইশারা করতে গাড়িটির গতি কমে এল। রিবিট ভেবেছিল গাড়ির চালক তাকে দেখে ভয় পাবে এবং দ্রুত চলে যাবে। সে খুব অবাক হল যখন দেখল গাড়িটি তার সামনে এসে খুব স্বাভাবিকভাবে থামল। আরো অবাক হল যখন গাড়ি থেকে যুবক বয়সী ছোটখাটো ড্রাইভার দ্রুত বেরিয়ে এসে বলল : আরে! রিবিট ভাইজান না? রোবট মানুষ? হ তাইতো, আমি আপনেরে ঠিকই চিনবার পারছি।
রিবিট বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে উঠে বলল : আ… আমাকে আপনি চিনলেন কীভাবে?
হেইডা মেলা কথা। মনে হয় আপনে সমস্যায় পড়ছেন। তয় কোন্হানে যাবেন? চলেন নামায় দিয়া আসি।
আসলে আমি..
আরে আপনে যহন হাত উচা করছেন নিশ্চয় কোনো ভালো কামে যাবেন। আসেন আসেন, সময় নষ্ট কইরেন না।
রিবিট গাড়িতে উঠে বসতে ড্রাইভার বলল : ভাইজান আপনের তো মেলা ওজন!
হ্যাঁ ধাতব শরীর তো, ওজন তিনজন মানুষের সমান।
তাইলে অসুবিধা নাই।
আপনি বললে আমি আমার ওজন কিছুটা কমাতে পারি।
তার আগে কন কোন্হানে যাবেন?
নিউমার্কেট থানা।
তাইলে তো কাছেই। ভাবছিলাম মেলাক্ষণ আপনের সেবা করার সুযোগ পাব, এহন দেহি পাঁচ মিনিটও না। তয় আইচ্ছা, আমি গাড়ি টান দিলাম। আর ই, আপনের ওজন কমানোর কথা কইছিলেন, দরকার নাই। আমি জানি আপনের মইধ্যে মেলা কলকজা আছে। আপনি মেলা কিছু করবার পারেন। আকাশে উড়বার পারেন, পানিতে নামবার পারেন। এক ঘুষিতে দালান, ঘর-বাড়ি ভাইঙ্গ ফেলাবার পারেন। দুই-চাইরড়া মানুষরে আঙ্গুলের খুচায় মাইরা ফেলাবার পারেন, এক ঘুষিতে আমার এই গাড়ির মতো পাঁচ-ছয়ড়া গাড়িরে মাটির নিচে পাঠায় দিবার পারেন, আরো কত কী! আল্লায় দিছে আপনেরে, মাশাল্লা!
আপনি এসব অবাস্তব কথা কোথায় শুনলেন? রিবিটের বিস্ময় যেন আরো বেড়েছে।
আরে কন কী? আপনের কেরামতির কথা কে না জানে? কাইল রাইতে প্রেসক্লাবে আপনে যহন আকাশ থাইকা উইড়া আইসা পড়লেন তহন ঐহানে আমার এক দোস্ত আছিল। আমার মতো হে-ও ট্যাক্সি-ড্রাইভার। হে-ই আপনের গল্প আমারে কইছে। আপনে বলে কয়েক হাজার মানুষের সামনে এক আছাড়ে এক গাড়ি ভাইঙা ফেলাইছেন। ওই হালার কথা শুইনা আমি প্রথমে বিশ্বাস করি নাই। পরে যহন অন্য ড্রাইভাররাও কইল তহন বিশ্বাস না-কইরা পারলাম না। আর এহন তো আমি নিজের চোখে দেখতাছি। আমার কী সৌভাগ্য! আইজ রাইতেই আপনের সাথে আমার দেহা হইয়া গেল।
কিন্তু এই কথাগুলো তো সত্য নয়।
না না সত্য। আপনার সুনাম সব জায়গায় ছড়ায় গেছে।
রিবিট বুঝল এই মানুষটাকে কিছুই বোঝানো যাবে না। তাই সে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলল : ভাই আপনার নাম কী?
আরে কী মুছিবত! আমারে আপনে আপনে করতাছেন কেন, তুই কইরা কন। আমি আপনের চেয়ে বয়সে ছোড। কেবল বিশ বছর অইছে। গত বছরই তো ড্রাইভিং লাইসেন্স পাইলাম। আর হ, আপনে যদি আমারে ‘আপনে কইরা কন, তাইলে কিন্তু আমি আপনের কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিব না।
আচ্ছা আচ্ছা আমি আপনাকে তুমি করে বলব। তবে আপনিও আমাকে তুমি করে বলবেন।
এহন তো দেহি আমার বন্ধু ঠিকই কইছে। আপনার মনড়া বলে দিলদরিয়া। ভাইজান, আপনে যদি আমারে মাইরাও ফেলান, আমারে পায়ের তলায় পিষাও ফেলান, আমি আপনেরে ‘আপনে’ ছাড়া অন্যকিছু কইয়া অসম্মান করবার পারব না। এইডাই আমার ফাইনাল কথা। হ যা জিজ্ঞেস করছিলেন, আমার নাম সালাম। লোকজন আমারে ড্রাইভার সালাম বইলা চেনে। তয় আপনে আমারে ‘সালাম’ ডাকবেন।
আচ্ছা ঠিক আছে, আমি তোমাকে ‘সালাম’ বলেই ডাকব।
আর আমার সম্পর্কে বলবার কিছুই নাই। এই গাড়িডাই আমার জীবন। মেলা কষ্ট কইরা টাকা জমায় কিনছি। গাড়ির বডি পুরান হইলেও ইঞ্জিন ভালো। দিন রাইত সবসময় গাড়িতেই থাকি। খাওয়া দাওয়া এই গাড়িতেই। গাড়িডাই আমার ঘর-বাড়ি, সংসার সবকিছু। খালি টয়লেট নাই। অসুবিধা হয় না। দুই টাকা দিলে সিটি করপোরশনের টয়লেটে বাথরুম আর গোসল হইয়া যায়। তাই কোনো চিন্তা নাই। একেবারে সুখী মানুষ। হাঃ হাঃ….।
কিন্তু তোমার মা-বাবা, ভাই-বোন, পরিবার কোথায়? অবাক হয়ে বলল রিবিট।
কেউ নাই। আমি রাস্তায় রাস্তায় বড় হইছি। তাই মা-বাপ, ভাই-বোন কেউই নাই। আছে খালি এই গাড়ি। গাড়িডাই আমার মা-বাপ, ভাই-বোন। গাড়ির কিছু হইলে আমি পাগল হইয়া যাব ভাইজান।
রিবিট কিছু বলল না। সালামের ব্যাপারটা তার কাছে খুব বিস্ময়কর মনে হল।
রিবিটকে কিছু বলতে না দেখে সালাম বলল : ভাইজান, আপনে খুব অবাক হইছেন। সবাই আপনের মতোই অবাক হয়। আমার কথা বাদ দেন। এই যে আইসা গেছি, আপনের নিউমার্কেট থানা।
রিবিট গাড়ি থেকে নেমে সালামের দিকে একশো টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিয়ে বলল : সালাম তোমার ভাড়া রাখো।
ভাইজান আপনে এইডা কী কইলেন! আপনে কি আমারে বেইজ্জত করবার চান? আপনের কাছ থাইকা ভাড়া নিয়া আমি কি জাহান্নামে যাব নাকি? আমারে মাফ করবেন ভাইজান।
তুমি আমার কাছ থেকে ভাড়া নেবে না?
মইরা গেলেও না। আমার জীবনডা আইজ আপনে ধন্য করছেন। আপনেরে গাড়িতে পাইয়া আমি বড় শান্তি পাইছি ভাইজান। আমি এই শান্তি নষ্ট করবার চাই না। আপনের যহন প্রয়োজন তহন আমারে ডাকবেন। আমার মোবাইল নম্বর রাহেন।
নিজের নম্বরটা বলেই সালাম আবার বলল : আপনের তো লেইখা নেয়ার কোনো ঝামেলা নাই। একবারেই মুখস্থ। আল্লায় আপনের ব্রেইন দিছে। ভাইজান আমি যাই। তয় একখান কথা
কী কথা?
ভাইজান, যদি পারেন দুই-চাইর চান্দাবাজ আর ছিনতাইকারী ধইরেন। ধরার পরে আল্লার কসম আমারে একবার খবর দিবেন। আমার খুব ইচ্ছা এইগুলারে নিজ হাতে বানাব।
বানাবেন মানে?
হালাগো এমন ধোলাই দিব যে ওগো চৌদ্দগুষ্ঠি দৌড়ায় পালাব। সব কয়ডার আজীবনের জন্য পাতলা পায়খানা হইয়া যাব। সারাজীবনে খালি টয়লেটে দৌড়ান লাগব।
সালাম, তুমি দেখি অশ্লীল কথা বলছ?
কী বলেন ভাইজান? এইডা কি অশ্লীল কথা হইল? এইডা তো ভালো কথা, সুন্দর কথা। আপনি যদি অশ্লীল কথা শুনবার চান তাইলে কয়ডা শুনাই।
না না থাক্। তোমাকে আর অশ্লীল কথা শোনাতে হবে না।
তাইলে ভাইজান যাই। প্রয়োজন হইলে ডাইকেন। আপনের ডাক পাইলে ঝড়ের আগে ছুঁইডা আসব। তয় ভাইজান, ঐ একখান কথা। চান্দাবাজ আর ছিনতাইকারী ধরলে আমারে খবর দিবার ভুলবেন না কিন্তু। হালাগো ধোলাই দিয়া আমি সাধ মিটাব। আসি ভাইজান।
সালাম গাড়ি নিয়ে চলে যেতে রিবিট কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থাকল। সালামের ব্যবহারে সে খুব অবাক হয়েছে। সে বুঝতে পারল সালামকে তার অসাধারণ ভালো লেগেছে। আর এ ভালোলাগার কারণেই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক সে সালামের নম্বরটা তার মেমোরিতে সংরক্ষণ করে রাখল।
থানায় প্রবেশ করার জন্য ঘুরে দাঁড়াতে ইপি বলল : রিবিট, তুমি খুব সাবধানে এগোবে।
কেন ইপি?
থানার সেন্টি তোমাকে ভিতরে প্রবেশ করতে নাও দিতে পারে। এমনিতেই রাত, তারপর তুমি তার পরিচিত নও। কাজেই তোমাকে সন্দেহ করাটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া সেন্ট্রির কাছে অস্ত্র রয়েছে। কোনো কারণে তোমাদের দুজনের ভুল-বোঝাবুঝি হলে মারাত্মক কিছু ঘটে যেতে পারে।
ধন্যবাদ ইপি, আমি সতর্ক থাকব।
রিবিট আট-দশ কদম এগোতেই ইপির সতর্কবাণী সত্য প্রমাণিত হল। অল্পবয়সী এক কনস্টেবল যে কিনা সেন্ট্রির দায়িত্বে ছিল, একটা থ্রি নট থ্রি। রাইফেল সরাসরি তার বুক বরাবর তাক করে চিৎকার করে বলল : হল্ট।
রিবিট সাথে সাথে জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল।
কন্সটেবল জোরগলায় বলল : আপনি কে? কাকে চান?
আমি রিবিট, অতি উচ্চবুদ্ধি মাত্রার একটি রোবট। আমি থানার অফিসারের সাথে দেখা করতে এসেছি।
কেন?
আমার সাহায্যের প্রয়োজন।
আপনি দেখতে তো মানুষের মতো না। আপনার শরীর অন্যরকম।
আমি তো বলেছি আমি একটি রোবট।
ঠিক আছে আপনি দাঁড়ান। আমি না, আসা পর্যন্ত একচুলও নড়বেন না।
কনস্টেবল রাইফেল তাক করে রেখেই ভিতরে উঁকি দিল। তারপর উঁচুগলায় বলল : স্যার, রিবিট নামের এক ভদ্রলোক আপনার সাথে দেখা করতে চায়।
হ্যাঁ পাঠিয়ে দাও। ভিতর থেকে বলল কেউ একজন।
স্যার, ভদ্রলোক দেখতে যেন কেমন!
কী নাম বললে?
রিবিট।
ঠিক আছে পাঠিয়ে দাও।
কনস্টেবল বেচারার সন্দেহ কাটল না। তাই সে রাইফেল আগের অবস্থায় রেখে বলল : আপনি ভিতরে আসুন। ডিউটি অফিসার আছে, তার সাথে কথা বলুন।
রিবিট ভিতরে প্রবেশের সময় দেখতে পেল ডিউটি অফিসার একজন সাব ইন্সপেক্টর, টেবিলের উপর গভীর মনোযোগর সাথে কিছু লিখছিল। সে ভিতরে প্রবেশ করতে সাব-ইন্সপেক্টর উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল : হ্যাঁ রিটি, আপনি এই চেয়ারটায় বসুন।
রিবিট সাব-ইন্সপেক্টরে সাথে হাত মিলিয়ে বলল : আপনি কি আমাকে…
হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি আপনার কথা শুনেছি। গতরাতে আপনি যখন প্রেসক্লাবে ছিলেন তখনই আমাদের ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আমরা খবর পেয়ে যাই। কমিশনার অফিস থেকেও আপনার সম্পর্কে আমাদের জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে একটি জিডিও রয়েছে।
বলেন কী! আমার নামে জিডিও আছে! অবাক হয়ে বলল রিবিট।
না, জিডি খারাপ কিছু না। জিডি হল জেনারেল ডায়েরি। অর্থাৎ সাধারণ বা। অসাধারণ কোনো ঘটনার বর্ণনা। কমিশনার অফিস থেকে আমরা যে নির্দেশ পেয়েছি তা হল আপনার কর্মকাণ্ড যদি মানুষের জন্য ক্ষতিকর কিছু না হয় তাহলে আপনাকে যেন সহায়তা করা হয়। নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, আপনার প্রতি আমাদের অর্থাৎ পুলিশের প্রাথমিক ধারণা বা মনোভাব ভালো।
হারুন সাহেব আপনাকে ধন্যবাদ। রিটি ইউনিফর্মের উপরে নেমপ্লেট থেকে ডিউটি সাব-ইন্সপেক্টরের নামটা পড়ে নিয়েছে।
আপনি খুব ভালো সময়ে এসেছেন। কিছুক্ষণ আগে একটা কেসের চার্জশিট লেখা শেষ করলাম, আগামীকাল জমা দিতে হবে। খুব ঝামেলার কাজ। নিজেকে এখন হালকা হালকা লাগছে। এখন বলুন, আপনার জন্য কী করতে পারি? আর মনে হচ্ছে আপনার কোলে কোনো বাচ্চা বা শিশু?
হ্যাঁ, আপনি ঠিকই ধরেছেন। এই বাচ্চাদুটোর জন্যই আমি আপনার কাছে এসেছি। ওদেরকে আমি একটি ডাস্টবিনের পাশে কুড়িয়ে পেয়েছি, ওরা সংযুক্ত যমজ। একজন ছেলে, অন্যজন মেয়ে। মেয়েটি অসুস্থ, কিছুই খাচ্ছে না। আমি ক্লিনিকে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে জানতে পারলাম মেয়েটির হার্টবিট এবং ব্লাডপ্রেশার কম, অর্থাৎ ও অসুস্থ। আমি অনেক অনুরোধ করার পরও ওরা ওকে ভর্তি করল না।
কেন?
কারণ বাচ্চাদের নাম-পরিচয় নেই। ওদের বাবা-মাকে আমি চিনি না। পরবর্তীতে কোনো অঘটন ঘটলে পুলিশি ঝামেলা হবে এই ভয়ে তারা ভর্তি করতে চায়নি।
এখন আমরা কী করতে পারি বলুন?
রিবিট একটু সময় নিয়ে বলল : আপনারা ওদেরকে ভর্তি করতে সাহায্য করুন অথবা ওদেরকে অন্য কোনোভাবে সাহায্য করুন।
ডিউটি সাব-ইন্সপেক্টর হারুন একটু সময় নিয়ে বলল : দেখুন রিবিট, ভর্তির ব্যাপারে আমরা যেটুকু করতে পারব তা হল জিডি। আমরা যদি একটি জিডি করে দেই তাহলে হয়তো পরবর্তী ঝামেলাগুলো এড়ানো সম্ভব হবে। অবশ্য অন্য সবার কাছে যে-বিষয়গুলো ঝামেলার সেগুলো আমাদের কাছে দায়িত্ব। কারণ হাসপাতালে যে-কোনো মৃত্যু হলে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে সে-সম্পর্কে একটি প্রাথমিক তদন্ত সম্পন্ন করা। কারণ এরকম অনেক বাচ্চার নানাভাবে অপমৃত্যু ঘটে থাকে। যাইহোক সে-সকল বিষয়ে আমি বিস্তারিত আলোচনা করতে চাচ্ছি না। আর বাচ্চাদুটোকে যদি আপনি আমাদের হাতে তুলে দেন তাহলে তাতে জটিলতা আরো বাড়বে। কারণ বাচ্চাদুটো কোনো অপরাধী নয়, ওরা দুজন নিষ্পাপ অবোধ শিশু। কাজেই ওদেরকে আমাদের কোর্টের মাধ্যমে নিরাপদ হেফাজতে দিতে হবে। বিষয়টি বেশ জটিল। আর হ্যাঁ, আমরা ওদের দুজনকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারি, কোনো ক্লিনিকে নয়। কারণ সরকারি কর্মকর্তা হিসাবে আমরা যদি ওদেরকে সরকারি হাসপাতালের অনুমতি ব্যতীত কোনো ক্লিনিকে নিয়ে যাই তাহলে পরবর্তীতে আমাদেরকে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। তাছাড়া সরকার সম্ভবত ক্লিনিকের ব্যয়ভার বহন করবে না। কাজেই একটি মাত্র উপায় রয়েছে, তা হল সরকারি হাসপাতাল। ঢাকা মেডিকেল কিংবা শিশু হাসপাতাল। সেখানে আমরা নিয়ে যাওয়া যে-কথা, আপনি নিয়ে গেলেও একই কথা। আমাদের অভিভাবকত্বে হাসপাতালে ভর্তি হলে বাচ্চাদুটো যে বিশেষ কোনো সুবিধা পাবে তেমন কিন্তু নয়। কারণ আমরা সারাদিন নানা কাজে ব্যস্ত থাকি, হয়তো ঠিকমতো খেয়ালও রাখতে পারব না। আর যদি আপনার অভিভাবকত্বে ভর্তি হয় তাহলে অন্তত আপনি সবসময় ওদের উপর নজর রাখতে পারবেন, ওদেরকে সাহায্য করতে পারবেন। সবকিছু বিবেচনা করে আমার পরামর্শ হবে আপনি বাচ্চাদেরকে সরাসরি ঢাকা মেডিকেল কিংবা শিশু হাসপাতালে ভর্তি করে দিন।
অর্থাৎ আপনারা বাচ্চাদুটোর জন্য কিছুই করবেন না?
আমি বলিনি কিছু করব না। কিন্তু আপনাকে বিভিন্ন সমস্যাগুলো বোঝাতে চেষ্টা করছি। আমাদের মূল কাজ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখা, হাসপাতালে কাউকে চিকিৎসা করান নয়। আমরা যে-কারণে কাউকে হাসপাতালে নিয়ে যাই তা হয় মানবিকতা নতুবা দায়িত্ববোধের অংশ হিসাবেই। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের প্রতি লক্ষ্য রাখা বা তাদের সেবা করার মতো প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সাপোর্ট এবং সময় আমাদের থাকে না। তাছাড়া বাচ্চাদুটোর ক্ষেত্রে আমি বিভিন্ন পরিস্থিতির কথা ব্যাখ্যা করেছি। আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন আমাদের হেফাজতে আমরা বাচ্চাদুটোর জন্য যা কিছু করতে পারব, আপনি তার থেকে অনেক দ্রুত অনেক বেশিকিছু করতে পারবেন। আপনি চাইলে আমি সম্পূর্ণ বিষয়টি জিডি করতে পারি।
জিডি কেন?
আপনার নিরাপত্তার জন্য।
আমার কোনো নিরাপত্তার প্রয়োজন নেই।
তাহলে আমি গাড়ির কথা বলছি। আপনাকে ঢাকা মেডিকেলে পৌঁছে দেবে।
হারুন সাহেব। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমাকে আরো কিছুক্ষণ ভাবতে হবে। প্রয়োজনে আমি আপনার সাহায্য চাইব।
ঠিক আছে, যে-কোনো প্রয়োজনে আমাকে জানাবেন।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
৮
থানা থেকে বেরিয়ে রিবিট নীলক্ষেতের মোড়ে এসে দাঁড়াল। তারপর রাস্তা পার হয়ে পাশেই ফুটপাতে বসে পড়ল। তার মন খুব খারাপ। সে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না। ঢাকা মেডিকেলে যাবে নাকি শিশু হাসপাতালে যাবে, নাকি অন্য কিছু করবে? বাচ্চা দুটোর জন্য তার কষ্ট যেন আগের চেয়ে আরো বেড়েছে। ছেলেটি ঘুমালেও মেয়েটি সেই আগের মতোই জেগে আছে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
কী মনে করে রিবিট ফিডারটি মেয়েটির মুখের ভিতর ধরল। রিবিটকে অবাক করে দিয়ে সাথে সাথে মেয়েটি ফিডারের দুধ টানতে লাগল। রিবিট সত্যিই বিস্মিত হল। সে উৎফুল্ল গলায় বলল : ই. ইপি!
আমি দেখতে পেয়েছি রিবিট, মেয়েটি দুধ খাচ্ছে।
আমার খুব আনন্দ হচ্ছে ইপি।
আমি বুঝতে পারছি।
তুমি বুঝতে পারছ?
হ্যাঁ রিবিট, আমি বুঝতে পারছি কিন্তু উপলব্ধি বা অনুভব করতে পারছি না।
তোমার এই বুঝতে পারা আর উপলব্ধি করার মধ্যে পার্থক্য কী?
রিবিট, পার্থক্য খুব সূক্ষ্ম। আমার অভ্যন্তরের প্রোগ্রামের কাছে ব্যাখ্যাটি এরকম যে, আমার বুঝতে পারা হচ্ছে কোনো ঘটনা সম্পর্কে আমার জানতে পারা, দেখতে পারা বা শুনতে পারা, কিন্তু প্রভাবিত হওয়া নয়। কারণ আমার মধ্যে কোনো অনুভূতি বা আবেগ না-থাকায় আমি কখনো প্রভাবিত হই না। ফলে আমি সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না সবকিছুই দেখি, শুনি কিংবা বুঝি কিন্তু কখনোই উপলব্ধি বা অনুভব করতে পারি না।
ইপি, তুমি যদি এই মুহূর্তে আমার আনন্দ উপলব্ধি করতে পারতে তাহলে বুঝতে আনন্দ কতটা স্বর্গীয়!
হয়তো তাই। কিন্তু আনন্দ উপলব্ধি করার কোনো ক্ষমতা আমার নেই।
আমি দুঃখিত ইপি, আমি বোধহয় তোমাকে কষ্ট দিয়েছি।
না রিবিট, তুমি মনখারাপ কোরো না। কারণ কষ্ট উপলব্ধি করার ক্ষমতাও আমার নেই। কাজেই আমি কোনো ঘটনায় কখনো যেমন আনন্দ পাই না তেমনি কষ্টও পাই না।
রিবিট আর কথা বলল না। বাচ্চাটির দিকে মনোযোগ দিল। আর তখনই চমকে উঠে বলল : ইপি, বাচ্চাটি তো এখন আর দুধ খাচ্ছে না!
কী হল?
বুঝতে পারছি না। আমি ফিডারটি বেশ কয়েকবার ওর মুখে দিয়ে দিলাম কিন্তু প্রত্যেকবারই ও ফিডারটি মুখ থেকে বের করে দিচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে?
বাচ্চারা কেন দুধ খায় না সে-বিষয়ে আমি এইমাত্র ইন্টারনেটের গুগল এ সার্চ। করেছি এবং সতেরোটি বই পড়েছি। এতে আমি সর্বমোট একচল্লিশটি কারণ পেয়েছি। যেমন ধরো- বাচ্চার ক্ষুধা না-থাকা, বাচ্চার মা-বাবা বা সঠিক অভিভাবক না-থাকা, বাচ্চা অসুস্থ থাকা, বাচ্চা মনে কষ্ট পাওয়া, আশেপাশের পরিবেশ অনুকূল না-থাকা, বাচ্চার খাবার তার পছন্দমতো না-হওয়া, খাওয়ানোর সময় বাচ্চার সাথে হাসি তামাশা না-করা…
হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি, কিন্তু এই সমস্যার অধিকাংশই আমি বুঝতে পারব না বা সমাধান করতে পারব না। ইপিকে কথা শেষ করতে না দিয়েই বলল রিবিট।
তাহলে যেগুলোর সমাধান করা সম্ভব সেগুলোর মাধ্যমে চেষ্টা করতে পারো।
যেমন?
বাচ্চাটি যে ক্ষুধার্ত এ-বিষয়ে তুমি নিশ্চিত। সত্যিকারের অভিভাবক, অসুস্থতা, মনে কষ্ট পাওয়া, এ–বষয়গুলো সম্পর্কে তুমি কিছু করতে পারব না। কাজেই তোমাকে বাচ্চাটির সাথে কথা বলে, বাচ্চাটিকে দোল দিয়ে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে ওকে খাওয়ার জন্য উৎসাহিত করতে হবে।
কিন্তু আমি তো বাচ্চাদের সাথে কথা বলতে পারি না, বাচ্চাদেরকে দোল দিতে পারি না। আমার প্রোগ্রামে এ-ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেই।
আমার প্রোগ্রামেও নেই, বলল ইপি। তবে ইন্টারনেটে আছে। তুমি কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করো। আমি দেখি কিছু পাই কিনা।
মাত্র ছয় সেকেন্ড পরেই ইপি বলল : হ্যাঁ রিবিট, পেয়েছি। বাচ্চাদের যত্ন নেয়া সম্পর্কে ইন্টারনেটে আমি ছয় সেকেন্ডে এগারোটি ছবি এবং চারটি ডকুমেন্টারি দেখেছি। এর মধ্যে থেকে একটি ছবির কিছু অংশ আমি তোমাকে দেখাচ্ছি। তুমি তোমার অভ্যন্তরের ভিডিও মনিটরে দেখতে পাবে কীভাবে বাচ্চাদের দোল দিয়ে আদর করে খাওয়াতে হয়।
রিবিট বলল : ইপি, এইমাত্র আমি দেখলাম। কিন্তু দোল দেয়ার ব্যাপারটা খুব কঠিন। তাছাড়া ছেলেবাচ্চাটির ঘুম ভেঙে যেতে পারে।
তুমি যতটা কঠিন মনে করছ ততটা না। তোমার সামনে ফাঁকা রাস্তা। তুমি খুব ধীরে ধীরে দুলে দুলে হাঁটবে আর মুখে বলবে : ও..ও.. খাও..খাও… উ..উ.. খাও..খাও..1 দেখবে বাচ্চাটি খেতে শুরু করবে। আর একটু সতর্ক থাকবে যেন বেশি জোরে দোল না লাগে। তাহলে শুধু ছেলেটির ঘুমই ভাঙবে না, উপরন্তু দু’জনের জন্যই ব্যাপারটা ক্ষতিকর হতে পারে। কারণ কিছুক্ষণ আগে ছেলে বাচ্চাটি দুধ খেয়েছে, ওর পেটে এখনো দুধ রয়েছে। অতিরিক্ত দোলায় সেই দুধ মুখ দিয়ে বের হয়ে আসতে পারে।
ঠিক আছে ইপি, আমি সতর্কভাবে চেষ্টা করছি।
ইপির কথামতো রিবিট বাচচাদুটোকে কোলে নিয়ে মুখ দিয়ে ও..ও.. খাও..খাও… উ..উ.. খাও..খাও.. আদরসূচক শব্দ করে ফাঁকা রাস্তায় খুব ধীরে ধীরে দোল দিতে লাগল। তাতে কিছুক্ষণের মধ্যেই কাজ হল। মেয়েবাচ্চাটির মুখে ম্লান হাসি ফুটে উঠল। রিবিট খুশিতে টগবগ করে উঠে বলল : ইপি, মেয়েটি হাসছে।
হ্যাঁ, তাই তো দেখছি।
হাসিটা কী অপূর্ব!
বাচ্চাদের হাসি সবসময়ই অপূর্ব হয়। তুমি ওকে খাওয়াতে চেষ্টা করো।
আমি চেষ্টা করছি। কিন্তু খাচ্ছে নাতো।
তাহলে বেশি চেষ্টা কোরো না। কারণ বাচ্চাদের খাওয়ানোর জন্য অতিরিক্ত চেষ্টা করা উচিত নয়, এতে বরং ক্ষতিই হয় বেশি।
রিবিট অনেকটা হতাশ ভঙ্গিতে বলল : এখন আমরা কী করতে পারি?
আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
তুমি বলেছিলে বাচ্চাদের খাবার পছন্দ না হলে বাচ্চারা খায় না। আমার মনে হচ্ছে দুধ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, এজন্য খেতে চাচ্ছে না।
হতে পারে। তাহলে তো তোমাকে দুধ গরম করতে হবে।
কিন্তু কোথায় করব? কেউ তো সাহায্য করতে চায় না। তুমি তো থানার পুলিশদের আচরণ লক্ষ্য করেছ?
হ্যাঁ করেছি। কিন্তু তারা যে-ধরনের কথা বলেছে তা একেবারে অযৌক্তিক নয়। তারা সম্পূর্ণ বিষয়টিকে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করেছে। একই ভাবে ক্লিনিকের ডাক্তারও তাদের নিজস্ব বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। তাদেরকে সম্পূর্ণ দোষ দেয়া তোমার ঠিক হবে না।
আমি দোষ দিচ্ছি না। তবে অবশ্যই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বাচ্চাদুটোর বিষয় তারা বিবেচনা করতে পারত।
হয়তো পারত, কিন্তু করেনি। যাইহোক এখন মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। বাচ্চাটির জন্য দুধ গরম করার কথা বলছিলে। তোমার কি মনে হয় আশেপাশের কোনো বাসার সাহায্য আমরা নিতে পারি?
না ইপি, আমি আর কোনো বাসায় যেতে চাচ্ছি না। আমি সরাসরি প্রফেসরের বাসায় যেতে চাচ্ছি। তার বাসা তত বুয়েটের পাশেই। সেখানে গেলে বাচ্চাদুটোর জন্য সকল ব্যবস্থার আয়োজন করা যাবে। তাছাড়া প্রফেসর তো আছেনই। উনি আমাদেরকে অবশ্যই সাহায্য করবেন এবং আমরা একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারব।
আমি তোমার প্রস্তাবকে সমর্থন করছি রিবিট।
তাহলে প্রফেসরের বাসায়ই যাচ্ছি।
হ্যাঁ।
রিবিট বাচ্চাদুটোকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে প্রফেসরের বাসার উদ্দেশে হাঁটা শুরু করল।
৯
প্রফেসর হকের বাড়িটি অদ্ভুত। এ এলাকায় এত পুরোনো বাড়ি আর একটিও নেই। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে এখানে বুঝি কেউ থাকে না। বাড়ির বাইরের দেয়ালে কোনো প্লাস্টার নেই। কোনোকালে ছিল বলেও কেউ বিশ্বাস করবে না। দেয়ালের এখানে-ওখানে অনেক আগাছা-পরগাছাও জন্মেছে। কয়েকটা বটগাছ চোখে পড়ার মতো বড় হয়েছে। বাইরের গেটটি এত পুরোনো যে, যে-কোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। একতলা মূলভবন আর সীমানার দেয়ালের মাঝে বড় বড় গাছগুলো বাড়িটিকে যেন ভূতুড়ে বাড়িতে পরিণত করেছে। এলাকার অনেকেই জানে না আদৌ এ-বাড়িতে কেউ থাকে কিনা। কারণ প্রফেসর হক সপ্তাহে একদিন রাত নটার পর এক থেকে দু-ঘন্টার জন্য বাজার করতে বের হন আর মাঝে মাঝে বুয়েটে দু-একটা ক্লাস নেন, এছাড়া তিনি বের হন না। তিনি কাছের বাজার থেকে কোনোকিছু কেনাকাটাও করেন না। নিউমার্কেটের একটি নির্দিষ্ট দোকান থেকে কিছু নির্দিষ্ট জিনিস কিনবেন, তারপর সরাসরি ফিরে আসবেন। আর বুয়েটে যদি কোনো ক্লাস থাকে তাহলে সপ্তাহের কোনো নির্দিষ্ট দিনে সবগুলো ক্লাস নেবেন। ফলে বাইরের কেউ তাকে সহজে দেখতে পায় না।
প্রফেসর হকের মূলভবন বা বাসার অবস্থা আরো করুণ। বাইরে কোনো প্রাস্টার তো নেই-ই বরং কোনো জানালাররা দরজাও ঠিক নেই। পনেরো বছর আগে প্রফেসর হক নিজহাতে সবগুলো করে জানালা ইটের দেয়াল দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছেন। শুধুমাত্র তার নিজের আর রিবিটের কক্ষে একটি করে জানালা রয়েছে। তবে মূলভবনটি অনেক বড়। বিশেষভাবে রক্ষিত এগারোটি কক্ষের প্রত্যেকটিই অসংখ্য ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতিতে ভরা। এগুলোর সাহায্যেই প্রফেসর হক রিবিটকে তৈরি করেছেন। অবশ্য বাইরে থেকেও তাকে নানা বিষয়ে সাহায্য গ্রহণ করতে হয়েছে। কিন্তু রিবিট-সংক্রান্ত মূলকাজগুলো তিনি এখানেই করেছেন, যেন কেউ রিবিট সম্পর্কে কোনো তথ্য জানতে না পারে।
প্রফেসর হকের বাড়ি দেখে কারো বোঝার উপায় নেই এই বাড়ির মধ্যে কী কী রয়েছে। তার নিজের কক্ষে একটি অতি পুরাতন খাট আর একটি ইজিচেয়ার ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো আসবাবপত্র নেই। দেয়ালে একটি ফাটা কাঁচের আয়না থাকলেও তা প্রফেসর সাহেব কখনোই ব্যবহার করেন না। প্রফেসর হক খাটের পরিবর্তে ইজিচেয়ারে বসেই সময় কাটাতে বেশি পছন্দ করেন। এজন্য রিবিট অধিকাংশ সময় তাকে ইজিচেয়ারেই বসে থাকতে দেখে।
রান্নাঘরের অবস্থা আরো করুণ। সবকিছু এত এলোমেলো আর অগোছালো যে কোনোকিছু খুঁজে পাওয়া দায়। প্রফেসর হক হয়তো চা খাওয়ার জন্য রান্নাঘরে গেলেন এবং তিনি নিশ্চিত রান্নাঘরে চা-পাতা রয়েছে, অথচ দেখা যাবে তিনি চা পাতা খুঁজে পাচ্ছেন না। শেষপর্যন্ত হয়তো তার আর চা খাওয়া হবে না।
তবে রিবিটের কক্ষটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। যে-কেউ রিবিটের কক্ষ দেখলে সত্যি অবাক হয়ে যাবে। বিশেষভাবে তৈরি বড় আকৃতির শীততাপনিয়ন্ত্রিত এই কক্ষটিতে রিবিটের জন্য প্রয়োজনীয় সকল যন্ত্রপাতিই রয়েছে। রিবিট যে-কোনো সময় এখানে এসে তার প্রোগ্রামের কার্যক্ষমতা, অভ্যন্তরীণ ইলেকট্রনপ্রবাহের গতিপ্রকৃতি, সেন্ট্রাল মেমোরি বা কেন্দ্রীয় স্মৃতির অবস্থা, ভাইরাস প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, নিজের শরীরের যে কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যক্ষমতা এবং অন্যান্য যে-কোনো বিষয়ে সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারবে। নিজের সিস্টেম ঠিক রয়েছে কিনা সেজন্য রিবিটের প্রতিমাসে একবার এখানে এসে সবকিছু পরীক্ষা করার নিয়ম রয়েছে। তবে তা রিবিটের প্রয়োজনীয়তার ওপর নির্ভর করবে এবং যদি সে এখানে আসে তাহলে প্রফেসর হকের সাথে সাক্ষাতের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এই বাড়িতে প্রবেশের ক্ষেত্রে প্রফেসর হক রিবিটকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছেন। রিবিট যে-কোনো সময় যে-কোনো প্রয়োজনে এই বাড়িতে আসতে পারবে এবং যে-কোনো জিনিস ব্যবহার করতে পারবে।
বাইরের গেটে এসে রিবিট গেটের উপর দিয়ে হাত ঢুকিয়ে গেট খুলে ফেলল। ভিতরের গেটের একটি চাবি সসময়ই তার কাছে থাকে। তাই ভিতরে প্রবেশ করতে কোনো অসুবিধা হল না। প্রফেসর হকের কক্ষের দরজা খোলাই ছিল। রিবিট ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখে ইজিচেয়ারে বসে প্রফেসর হক তার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হতে প্রফেসর হক কিছুটা স্নান গলায় বললেন : রিবিট, তুমি!
হ্যাঁ প্রফেসর। বিশেষ সমস্যায় পড়ে এসেছি। আপনি এখনো জেগে আছেন যে?
হ্যাঁ জেগে আছি। আমি জানতাম তুমি আজ রাতে যে-কোনো সময় এখানে আসবে। যাইহোক তোমার সমস্যা কী?
এই বাচ্চাদুটো। একটি ছেলে একটি মেয়ে, সংযুক্ত যমজ। ওদের জন্য দুধ গরম করতে হবে।
আমি বুঝতে পেরেছি। তুমি নিশ্চয় বাচ্চাদুটোকে কোথাও কুড়িয়ে পেয়েছ। কিন্তু বাসায় তো দুধ নেই। আমি দুধ খাচ্ছি না প্রায় পনেরো বছর হল।
এই ফিডারে আছে।
ঠিক আছে তুমি বাচ্চাদের দুধ গরম করো।
প্রফেসর, আপনার শরীর কেমন এখন?
ভালো। প্রফেসর সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে ইজিচেয়ারে হেলান দিলেন।
রিবিট জানে প্রফেসরের শরীর ভালো নেই। ইদানীং তার শরীর খুব কমই ভালো থাকে। তিনি বার্ধক্যজনিত অসুখে ভুগছেন। তাছাড়া গত ত্রিশবছরের একটানা গবেষণায় ক্লান্ত তিনি। তাই এখন তাঁর নিরবিচ্ছিন্ন বিশ্রামের প্রয়োজন। প্রফেসর সেই আশাই ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু রিবিট জানে প্রফেসর চাইলেও বিশ্রাম নিতে পারবেন না। তার মাথায় নতুন নতুন পরিকল্পনা ঘুরপাক খাচ্ছে, সবই মানবসেবার পরিকল্পনা। তাই এ-ধরনের মানুষ কখনো বিশ্রাম নিতে পারে না। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তারা নিজেদের মানবসেবার কাজে ব্যস্ত রাখেন।
দুধ গরম করে রিবিট তার নিজের ঘরে এল। বাচ্চাদুটোকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে সে দুধ খাওয়াতে চেষ্টা করল। কিন্তু কোনো লাভ হল না। মেয়েবাচ্চাটি দুধ
খেল না। রিবিট ইপিকে ডেকে বলল : ইপি, বাচ্চাটি এখনো দুধ খাচ্ছে না।
ইপি বলল : এ মুহূর্তে বাচ্চাটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তাছাড়া আমরা একটি ভুলও করেছি।
কী ভুল?
ফিডারের দুধ কখনো গরম করে খাওয়াতে হয় না। এতে বাচ্চাদের ক্ষতি হতে পারে।
আশা করছি কিছু হবে না। কারণ বাচ্চাটি এখনো একটু দুধও খায়নি। যেটুকু খেয়েছে তা বেশ আগে।
তাহলে হাসপাতালে ভর্তি ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
কিন্তু ভর্তি করতে যেয়ে তো ঐ একই ঝামেলা। বাচ্চাদুটোর নাম-পরিচয় নেই। কেউ তো ভর্তি করতে চাইবে না।
আমার মনে হয় প্রফেসর সাহায্য করতে পারবেন। আমাদের উচিত তার সাথে কথা বলা।
ইপির কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রফেসর ভিতরে প্রবেশ করলেন। তিনি ঠিকমতো হাঁটতে পারছেন না। তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। রিবিট উঠে এসে প্রফেসরকে ধরতে গেলে প্রফেসর হাত উঁচু করে তাকে থামিয়ে দিলেন। তারপর বললেন : রিবিট, তুমি যেখানে আছ সেখানেই বসে থাকো। আমি ভালো আছি। তুমি তো জান এ রকম জ্বর আমার মাঝে মাঝেই হয়। আজ মাঝরাতের পর থেকে জ্বরটা বেড়েছে। আশা করছি সকালের আগেই কমে যাবে। বাচ্চাদুটোর কী অবস্থা?
ছেলেটি ভালো আছে, কিন্তু মেয়েটি কিছু খাচ্ছে না।
প্রফেসর হক খাটের উপর এসে বসলেন। তারপর বাচ্চাদুটোর দিকে তাকিয়ে বললেন : আমার মনে হচ্ছে মেয়েটি অসুস্থ। প্রথমত মেয়েটি কিছু খায়নি, আর দ্বিতীয়ত এখনো জেগে আছে। ও কি সারারাতই জেগে ছিল?
হ্যাঁ প্রফেসর, একটুও ঘুমায়নি। মুখ দিয়ে টু-টা শব্দও করেনি।
আমি নিশ্চিত ও অসুস্থ।
আমি একটা ক্লিনিকে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেখানের ডাক্তার ঐ একই কথা। বলেছিল।
ভর্তি করলে না কেন?
তারা নাম-পরিচয়বিহীন শিশুকে ভর্তি করতে চাচ্ছে না।
আমি বুঝতে পারছি। এ-ধরনের যমজ শিশুর অনেক জটিলতা থাকে। ক্লিনিক ক্লিনিক কিছু করতে পারবে না। তুমি সরাসরি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাও।
কিন্তু ঢাকা মেডিকেল যদি একই সমস্যা করে?
সম্ভবত করবে না। কারণ ঢাকা মেডিকেল সরকারি হাসপাতাল। আর যদি এ ধরনের ঝামেলা করে তাহলে তোমাকেই তার সমাধান করতে হবে। তোমাকে এমন অনেক ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে যার মাধ্যমে তুমি অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারবে। তোমার উদ্দেশ্য হবে কারো কোনো ক্ষতি না করে তোমার সকল ক্ষমতা ব্যবহারের মাধ্যমে এই বাচ্চাদুটোর উপকার করা। যদি তুমি করতে পারো তাহলেই তুমি সফল হবে, আমার গবেষণাও সার্থক হবে। তুমি কি বুঝতে পারছ আমি কী বলছি?
হ্যাঁ আমি বুঝতে পারছি। তবে…
তবে কী?
বাচ্চাদুটোর চিকিৎসার জন্য অনেক অর্থের প্রয়োজন হতে পারে।
তুমি ঠিকই বলেছ। ছোটখাটো চিকিৎসার খরচ হাসপাতাল নিজেই বহন করে। তবে অপারেশন কিংবা যদি এ-ধরনের অন্য কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হয় তাহলে অনেক অর্থের প্রয়োজন হবে। সেক্ষেত্রে আমি তোমাকে খুব একটা সাহায্য করতে পারব না। কারণ আমার কাছে এমন কোনো অর্থ নেই যার সাহায্যে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারব। আমার ব্যাংকে নয় হাজার একশো আঠারো টাকা আছে। আমি তোমাকে নয় হাজার টাকার একটা চেক দিচ্ছি। সকালে ব্যাংক খুললে তুমি ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে পারবে। এই টাকার সাহায্যে তুমি বাচ্চাদুটোকে বাঁচাতে চেষ্টা করবে।
আমি চেষ্টা করব। বলল রিবিট।
শুধু চেষ্টা নয়, তোমাকে পারতেই হবে রিবিট। আমি আমার জীবনের সকল অর্থ তোমার পিছনে ব্যয় করে তোমাকে তৈরি করেছি। তোমার সৃষ্টি শুধু মানুষের উপকারের জন্য। তবে মনে রেখো এটা আমার কাছে তোমার কোনো দায়বদ্ধতা নয়। সবকিছুই তোমার ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। তুমি যদি মানুষকে সাহায্য করো তাহলে আমি মনে শান্তি পাব। তোমার কাছে আমার শর্তসাপেক্ষ কোনো দাবি নেই। আমার সকল দাবি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে। একজন মানুষ হিসাবে তোমার মতো উচ্চ বুদ্ধিমাত্রার রোবটের কাছে আমার দাবি থাকবে তুমি মানুষের উপকার করবে। তুমি আজ এই বাচ্চাদুটো নিয়ে যাদের কাছেই যাবে তাদের অধিকাংশই তোমাকে সাহায্য করবে না। কারণ মানুষের মধ্যে মানবিকতা থাকলেও এদেশে ক্রমাগত অভাব-অনটন, দুঃখ-কষ্ট, দুর্নীতি আর অপরাধের জন্য মানুষ এখন সংকীর্ণ আর ভীত হয়ে পড়েছে। ইচ্ছে থাকলেও তারা এখন নিজেদের মানবিকতাকে প্রকাশ করতে, উন্মোচিত করতে সাহস পায় না। তোমার দায়িত্ব হবে এই মানবিকতাকে জাগিয়ে ভোলা।
প্রফেসর হকের কথার উত্তরে রিবিট বলল : প্রফেসর, আজ রাতে আমি আপনার কথার সত্যতার প্রমাণ পেয়েছি। তবে ভালোমানুষও রয়েছে। আমি সাইফের মতো উদ্যমী আর কর্মঠ সাংবাদিক, অমির মতো ছোট নির্ভীক বাচ্চা ছেলে, হাসপাতালে রিসেপশনিস্টের মতো উদারমনের মেয়ে, ড্রাইভার সালামের মতো ভালোমনের মানুষের সাক্ষাৎও পেয়েছি।
রিবিট, আমি খুব আনন্দিত যে তুমি ভালোমানুষকে খুঁজে পাচ্ছ। সমাজের আনাচে-কানাচে এরকম হাজারো ভালোমানুষ রয়েছে। তোমার দায়িত্ব হবে তাদের সবার মনের উদারতাকে জাগ্রত করা। যদি মনে করো বাচ্চাদুটোর চিকিৎসার জন্য আরো অর্থের প্রয়োজন, তুমি এই মানুষগুলোর সাহায্য কামনা করবে। দেখবে তারা কীভাবে তোমার পাশে এসে দাঁড়ায়।
প্রয়োজনে আমি অবশ্যই তাদের সাহায্য গ্রহণ করব।
রিবিট, আমি খুব খুশি হয়েছি তুমি তোমার প্রথমদিনে এমন একটা সমস্যার সমাধাণ করতে চেষ্টা করছ যা অত্যন্ত জটিল কিন্তু খুব হৃদয়স্পর্শী। মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে এটি একটি অতি মহান কাজ। মানবশিশুর উপকার করার থেকে বড় উপকার আর কী হতে পারে? ওরা কথা বলতে পারে না, নিজেদের অনুভূতিকে বোঝাতে পারে না, নিজেদের কষ্টকে প্রকাশ করতে পারে না, অথচ ওরা মানবসন্তান, সবচেয়ে নিষ্পাপ আর অসহায় মানুষ। তুমি ওদের উপকার করতে চেষ্টা করছ। এটি যে কতবড় মহান কাজ তা তুমি বুঝবে না।
প্রফেসর, আপনি বাচ্চাদুটোর জন্য প্রার্থনা করবেন।
হ্যাঁ, আমি করছি এবং করব। রিবিট, আমি বোধহয় তোমাকে আর তেমন কোনো সাহায্য করতে পারব না। ঢাকা মেডিকেল কলেজে আমার পরিচিত কেউ নেই। যদি থাকত তাহলে আমি অবশ্যই ফোন করে দিতাম। তোমার কাজ সহজ হত।
তার দরকার হবে না প্রফেসর, আমি পারব।
আমার শরীরটা ভালো নেই। ভালো থাকলে তোমাকে গাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসতাম। তোমাকে সাহায্য করতাম। কিন্তু আমি নিজে ঠিকমতো হাঁটতে পারছি না।
প্রফেসর, আমি জানি আপনি কতটা মহান। আপনার শরীরের তাপমাত্রা একশো তিন ডিগ্রির উপরে। আপনার নিজেরই সাহায্যের দরকার।
আমাকে নিয়ে কখনো চিন্তা করবে না। তুমি এক কাজ করো, আমার গাড়ি নিয়ে যাও, যদিও গাড়ি স্টার্ট নেবে কিনা আমার সন্দেহ রয়েছে।
তার দরকার হবে না। ঢাকা মেডিকেল এখান থেকে দশ মিনিটের রাস্তা। আমি হেঁটেই চলে যেতে পারব।
সাবধানে যেও। আর হ্যাঁ, তুমি আমার ঘরে এসো। আমি তোমাকে চেক দিয়ে দিচ্ছি।
রিবিট বাচ্চাদুটোকে কোলে নিতে যেয়ে চমকে উঠে বলল : প্রফেসর বাচ্চামেয়েটি এমন করছে কেন?
প্রফেসর লক্ষ্য করলেন বাচ্চামেয়েটির চেহারা হঠাৎই নীল হয়ে গেছে। তিনি বললেন : সম্ভবত বাচ্চাটির অসুস্থতা আরো বেড়েছে। রিবিট, তোমার আর দেরি করা ঠিক হবে না। তুমি…
প্রফেসর কথা শেষ করার আগেই বাচ্চাটি বমি করে দিল।
প্রফেসর আঁতকে উঠে বললেন : রিবিট, তুমি আর দেরি কোরো না, যাও।
রিবিট তাড়াতাড়ি বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে এল।
প্রফেসর হক দ্রুত তার চেকবই নিয়ে এসে দুটো পাতায় স্বাক্ষর করে বললেন : আমি আর অন্য কিছু লিখে সময় নষ্ট করলাম না। তোমাকে ব্লাংক চেক দিয়ে দিলাম। তুমি টাকার অঙ্ক বসিয়ে নিও।
আমি আসি প্রফেসর।
যদি পাবো একটা ট্যাক্সিক্যাব নিয়ে নিও।
হ্যাঁ নেব।
রিবিটের নিষেধ সত্ত্বেও প্রফেসর বাইরের গেট পর্যন্ত এলেন। রিবিট বিদায় নিয়ে গলির ভিতর থেকে বাইরে বড় রাস্তায় এসে দাঁড়াল। কিন্তু সে কোথাও
কোনো ট্যাক্সি বা অন্য কোনো যানবাহন দেখল না।
রিবিট ডেকে উঠল; ইপি!
বলো রিবিট।
তুমি আমার শরীরে অ্যান্টি-জার্কিং সিস্টেম চালু করে দাও যেন আমি দৌড়ালে শুধু আমার শরীরের নিচের অংশ কম্পিত হয়, উপরের অংশ নয়। ফলে বাচ্চাদুটোর শরীরে কোনো ঝাঁকি লাগবে না।
রিবিট, আমি চালু করে দিয়েছি।
এখান থেকে ঢাকা মেডিকেলে দৌড়ে যেতে কতক্ষণ সময় লাগবে?
তুমি যদি তোমার সর্বোচ্চ গতিতে দৌড়াও তাহলে তিন মিনিট তেরো সেকেন্ড।
ইপি, আমি দৌড় শুরু করছি।
রিবিট কথা শেষ হতেই দৌড় শুরু করল। তার শরীরের নিচের অংশ কম্পিত হলেও উপরের অংশ এ্যান্টি-জার্কিং এবং অ্যান্টি-মোশন সিস্টেমের কারণে কম্পিত হল না। ফলে রিবিটের কোলের দুই মানবশিশু বুঝতেই পারল না যে তারা দৌড়রত এক অতি উচ্চবুদ্ধিমাত্রার রোবটের কোলে রয়েছে।
Leave a Reply