দ্বিতীয় খণ্ড – সপ্তম পুস্তক

দ্বিতীয় খণ্ড – সপ্তম পুস্তক

হ্যাঁ, আগে যা বলেছি তারপর পুরো নিস্তব্ধতা এবং সহিষ্ণুতার মধ্য দিয়ে পার করেছি। সন তারিখ এখন চলছে ১৭৪১।

.

আবার আমি কলম ধরেছি। প্রিয় পাঠক, আমার এমন আচরণের কারণের বিষয়ে আপনার বিচার আপাতত স্থগিত রাখুন। এই ধরাধামে আমার আগমন ঘটেছে ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে। সেই হিসেবে এখন ৬৬ বছরে পা দিয়েছি। কম ভাগ্য নয়। জন্মাবধি আমার পরিপার্শ্বকে বিচার করার ক্ষমতা কিছুটা আমার হয়েছে। আমাকেও আপনারা কিছুটা দেখতে পেয়েছেন। এবার আমার একটু বয়স হয়েছে একথা আমি বলতে পারি। এবার আমার একটু বিচার বুদ্ধি হয়েছে, একথাও আমি বলতে পারি। আপনারা আমাকে দেখেছেন। আমার যৌবন কেটেছে–তেমন কোনও হতাশাও যেমন ইতোমধ্যে ঘটেনি, তেমনি বিরাট কোনও ধন-সম্পদের মালিকেও আমি পরিণত হইনি। আর ভাগ্যের এ মাথায় এবং ও মাথায় চূড়ান্ত কিছু না ঘটার কারণ হিসেবে বলতে পারি, একদিকে রয়েছে আমার আবেগপ্রবণতা, আর অপরদিকে রয়েছে আমার ব্যবস্থাপনা। ফলে একদিকে যেমন আমি কোনও ধর্মের কাজ করিনি, তেমনি সাংঘাতিক কোনও অধর্মেও আমি পতিত হইনি।

কিন্তু আমি জানতাম না অচিরেই আমার কী দুর্ভাগ্য ঘটবে। প্রথম ত্রিশ বছর আমি যেভাবে কাটিয়েছি পরবর্তী ত্রিশ বছর যে কী দুর্ভাগ্য আমার ঘটেছে তা আমার বর্ণনারও অতীত।

আমার আত্মাক্তির প্রথম ভাগ আমি রচনা করেছি আমার স্মৃতি থেকে। আর তাতে আমার ভুলভ্রান্তির অন্ত থাকেনি। আর এই যে দ্বিতীয় ভাগে পা দিয়েছি সে ভাগেরও ভ্রান্তির অন্ত থাকবে না। আমার জীবনের সর্বোত্তম অংশ কেটেছে সুখে এবং আনন্দে। আমার জীবনের বাকি অংশেও আমার সুখ আর আনন্দের অভাব ঘটেনি। আমার স্মৃতিতে তার সবই আজ আমার মনে ভেসে উঠছে। পাঠক কিছুকালের মধ্যেই আপনারা দেখতে পাবেন কী বিপরীত ভাগ্য বা ঘটনার মধ্য দিয়ে আমার জীবন অতিবাহিত হয়েছে। আর সে স্মৃতিতে বিষাদময় হয়ে ওঠে আমার জীবন। অবশ্য একটা ক্রেডিটও আমি নিজেকে না দিয়ে পারিনে। দুঃখ আর বিষাদ যতই হোক আমি দুহাতে তাকে দু’পাশে সরিয়ে দিতেও পারি। বস্তুত তেমন স্মৃতিকে আমি যথার্থই বিস্মৃত হয়ে যাই : এমন বিস্মৃতি যে যদি দরকার তার কিছু স্মরণ করার তখন তার কিছুকে আদৌ আমি স্মরণ করতে পারিনে। সহজে এমন করে স্মৃতিকে বিস্মৃত হওয়ার ক্ষমতা আমার মনে একটা গর্বের ভাবই তৈরি করে। আমার স্মরণ করার যেমন ক্ষমতা, বিস্মৃত হওয়ার তেমনি ক্ষমতা। এতেই আমার মুক্তি। এতেই আমার সুখ আর আনন্দ।

আমার বিস্মরণের শূন্যতাকে পূরণ করার যে ব্যবস্থাই আমি করি না কেন তার সব আবার বিস্মরণের অতলেই তলিয়ে যায়। অবশ্য আমার একটা অনুগত শিষ্য আছে যার উপর আমি নির্ভর করতে পারি যে আমাকে উদ্ধার করে দেয় : স্মৃতির শেকল যেখানে ভেঙে যায় আমার এই অনুগত শিষ্য তাকে বিস্ময়করভাবে আবার জোড়া লাগিয়ে দেয়।

আমার দুর্ভাগ্যকে ভুলতে আমার কষ্ট হয় না। কিন্তু আমার বিচ্যুতিকে ভুলতে আমার কষ্ট হয়।…

আমার এই যে আত্মকথা তার আসল উদ্দেশ্য আমার অস্তিত্বের মূলকে বের করে আনা। কত যে আমার পতন ঘটেছে, তার কোনওটাকে আমি ভুলতে পারিনে। আমি স্থির করেছি আমার আত্মার অন্তরকে আমি একেবারে টেনে বের করে আনব। সেজন্য আমাকে আর অপর আর কোনও স্মৃতিকথার আশ্রয় নিতে হবে না।

আমি মনে করি না যে আত্মকথা বলার প্রতিশ্রুতি আমি আমার পাঠকদের দিয়েছি, তারা তা বিস্মৃত হবেন না। তারা যেন মনে না করেন যে আমি এর মাধ্যমে কোনও জবাবদিহি করছি : কোনও কিছুর জন্য আমি অনুতপ্ত বোধ করছি। আর পাঠক যেন এটাও মনে না করেন যে, সত্যকে আমি মিথ্যার আবরণে আবৃত করে দেব। সত্যের ব্যাপারেও আমি নিঃশব্দ থাকব না। যে সত্য আমার পক্ষে আসবে সে সত্যকে আমি অস্বীকার করব কেন?

আমার প্রথম ভাগের সঙ্গে এই ভাগের এই মিলটার কথা আমাকে বলতে হবে। এই ব্যতিক্রম ব্যতীত আর কিছুতে আমার এই ভাগ অপর ভাগ থেকে হীন হবে না। আমার স্মৃতির প্রথম ভাগটা যখন আমি লিখি তখন আমার আনন্দের সীমা ছিল না। তখন যত স্মৃতিকে আমি স্মরণ করতে চেয়েছি তার সবই আমাকে আনন্দে ভরে তুলেছে। আর তাই তার প্রত্যেকটিতে প্রত্যাবর্তনে আমার আনন্দের আর সীমা থাকেনি। আমি বারবার এর প্রত্যেকটি ঘটনাকে আনন্দের সঙ্গে স্মৃতিরপটে তুলে ধরেছি।

এখন যা আমি শুরু করেছি, তা আমি করতে বাধ্য বলেই করছি। আমার দুঃখ, এখন আর আমার সেই পূর্বের স্মৃতিশক্তি নেই। তাই বলছিলাম, বর্তমানে আমি যা করছি তা একটা বাধ্যতাবশেই আমি করছি। আমার হৃদয় এখন বিষাদে ভরা। এখনকার স্মৃতিতে আমার দুঃখ ছাড়া কোনও সুখ নেই। এই জগতে যা কিছু দেয়ার আছে তা সবই আমি দিতে সক্ষম হব কেবল যদি সময়ের অন্ধকারে তার সবকিছু যদি আমি আবৃত করতে পারি। আমি যতই ব্যথিত বোধ করিনে কেন যা আমাকে বলতে হবে, তা আমি প্রকাশ করব। আমি জানি, আমার চারদিকে যে বাধার প্রাচীর দাঁড় করানো হয়েছে : মিথ্যাচার, বিশ্বাসঘাতকতা, বিষাদময়তা এবং বিশ্বাসহীনতার প্রাচীর; তার থেকে আমার পরিত্রাণ নেই। যে ছাদের নিচে আমি আজ স্থাপিত তা থেকে বেরুবার কোনও পথ নেই। এই মুহূর্তে মাত্র কয়েকটা ছত্র আমি লিখতে পারছি। এর কোনওটাকে পরিবর্তন করার আমার কোনও ক্ষমতা নেই। আমার এই আত্মকথাকে কেমন করে আজ আলোর মধ্যে তুলে ধরব? আমি জানি যে প্রয়াসে আমি আজ নিবদ্ধ হয়েছি, এখান থেকে উদ্ধারের আমার কোনও উপায় নেই।

.

[রুশো কিছু সময়ের জন্য লিয়নসে অবস্থান করেছিল। এখানে রোজিক নামে এক বন্ধুকেও সে লাভ করেছিল।]

.

আমি প্যারিসে এসে পৌঁছেছিলাম শরঙ্কালে, ১৭৪১ সালে। আমার পকেটে তখন মাত্র ১৫টি ফরাসি মুদ্রা। কাজেই এ দিয়ে কিছু জোগাড় করার মতো আমার হাতে তখন সময় আদৌ ছিল না। আমি তাই যথাশীঘ্র সম্ভব আমার যা কিছু পরিচয়পত্র ছিল তা কাজে লাগাবার চেষ্টা করলাম। আর পরিচয়পত্র বলতে আমার ছিল একখানা চেহারা। আর একটি সুন্দর চেহারা নিয়ে একটি তরুণ যদি প্যারিসে আসে এবং তার সে চেহারাকে পুঁজি করার চেষ্টা করে তবে তার সুন্দর পিয়াসীদের কাছ থেকে সংবর্ধনা পেতে কোনও অসুবিধা হয় না। আমার বেলাও তাই হলো। এতে আমার মনে বেশ আনন্দেরও সৃষ্টি হলো। কিন্তু আমার সুন্দর চেহারার পুঁজি খুব যে কাজে এল এমন নয়।

.

[তবে রুশোর সঙ্গে রুমার নামে এক ভদ্রলোকের পরিচয় ঘটে গেল। সে ভদ্রলোক একটি ব্যবস্থা করল যাতে রুশোর পক্ষে প্যারিসের বিজ্ঞান একাডেমিতে তার একটি প্রবন্ধ পাঠ সম্ভব হলো। এটা ১৭৪১-এর কথা। একাডেমির তরফ থেকে তার প্রবন্ধ পরীক্ষার জন্য তিনজন অভিজ্ঞকে নিযুক্ত করা হয়েছিল। তারা রুশোর প্রবন্ধের মূল্য কিছু বুঝতে না পেরে তার সম্পর্কে সাধারণ কিছু মন্তব্য পেশ করে ছেড়ে দিল।]

.

আমার এই ব্যর্থ পরিশ্রমের ক্লান্তিতে আমার কিছু বিশ্রামেরও প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। আমি তাই নিজেকে হতাশার হাতে ছেড়ে না দিয়ে আমার স্বভাবগত প্রয়োজনীয় বিশ্রামের হাতে নিজেকে অর্পণ করে দিলাম। আর অপেক্ষা করতে লাগলাম দেখি ভাগ্য আমাকে কী দেয়। তেমন কিছু পরোয়া না করে লুইস মুদ্রার যে ক’টি তখনও বাকি ছিল সে ক’টিকে খরচ করতে কোনও কার্পণ্য করলাম না। আমার আমোদফুর্তি যে একেবারে ছেড়ে দিলাম, তা নয় তবে একটু সতর্ক হওয়ার চেষ্টা করলাম।

কাফেতে রোজ না গিয়ে একদিন বাদে পরের দিন যাওয়ার চেষ্টা করলাম। আর থিয়েটারের বেলাতেও সপ্তাহে দু’দিনের বেশি নয়। আর মেয়ে মানুষের ওপর টাকা খরচের ব্যাপারে আমার চিন্তার কোনও কারণ কখনও হতো না। কেবল একটা দিনে কিছু খরচ করতে হয়েছিল। সে সম্পর্কে একটু বলতে হবে। যেরূপ ঠাণ্ডা মাথায় এবং আনন্দে এই ব্যাপারটিতে আমি রত হলাম, সেটি আমার কাছেও বিস্ময়কর বলে বোধ হলো। এমন ফুর্তিতে মাতার মতো আমার হাতে তিন মাসের টাকাও ছিল না। আর সেজন্যই বলছি আমার চরিত্রের এটা ছিল একটা বেপরোয়া বৈশিষ্ট্য। যে সহানুভূতির আমি আকাক্ষী ছিলাম সেটাই আমাকে উপযুক্ত ব্যক্তিবর্গের সন্নিকটে আমার যাওয়াকে অসম্ভব করে তুলল। ফলে আমি একাডেমির উপযুক্ত ব্যক্তিদের কাছে আমার যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। অথচ একাডেমির ব্যক্তিদের সঙ্গে আমি ইতোমধ্যে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছিলাম। কিছু সাহিত্যিকদের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেছিল। যাদের সাহচর্য আমি ছাড়লাম না তার মধ্যে কেবল ছিলেন : মারিভ-ম্যাবলির যাজক এবং ফন্টে ফন্তেনেলী মাত্র। নারসিসাস শিরোনামের নাটকটিকে আমি মারিভ’কে দেখালাম। দেখলাম নাটকটিকে তিনি পছন্দ করলেন এবং তাকে একটু সংশোধন করে উন্নত করারও চেষ্টা করলেন। দিদেরতের সঙ্গও আমি পরিত্যাগ করিনি। দিদেরত তখনও খুব বৃদ্ধ হয়ে পড়েননি। তিনি তখনও আমার বয়সী। সঙ্গীতে তিনি আসক্ত ছিলেন। সঙ্গীতের কলা-কৌশল তিনি ভালই জ্ঞাত ছিলেন। আমরা উভয়ই সঙ্গীত নিয়ে পরিকল্পনাদির কথা আমাকে বলতেন। এর ফলে আমাদের দুজনের মধ্যে প্রগাঢ় অন্তরঙ্গতার সৃষ্টি হয়েছিল। আমাদের এই অন্তরঙ্গতা অন্তত দীর্ঘ পনের বছর যাবৎ স্থায়ী হয়েছিল। আমাদের এই অন্তরঙ্গতা আরও অধিককাল স্থায়ী হতে পারত। এর জন্য তথা এই বিচ্ছেদের জন্য আমরা উভয়ই দায়ী ছিলাম যেমন আমি তেমনি তিনি।

.

[এই সময়ে দেখা যায় যে, রুশো লুকাজমবার্গে ভারজিল অধ্যয়ন করতে শুরু করেছেন। দাবারও তিনি ভক্ত হয়ে দাঁড়ান। এই সময়ে তাকে কেউ মাদাম দা বুজেনভাল এর সঙ্গে পরিচিত করে দেন। বুজেনভালের একটি মিয়ে ছিল, তার সঙ্গেও রুশো অন্তরঙ্গ হয়ে উঠল। মেয়েটির নাম ছিল মাদাম দা বখি।]

.

তখন প্রায় রাত ১টা। আমি বললাম, মাদাম, এবার আমি যাই। মাদাম বুজেনভাল বললেন, তোমার বাসা তো এখান থেকে অনেক দূর। তুমি বরং আমার এখানে থেকে যাও এবং এখানেই রাতের আহার কর। এমন প্রস্তাবের জন্য তাকে আর দ্বিতীয়বার বলতে হলো না। মিনিট পনের পরে আমি বুঝলাম যে ঘরে তিনি আমাকে ডিনারের আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন সেটি তার চাকরানির ঘর।

যদিও মাদাম দা বুজেনভাল নিঃসন্দেহে একজন উত্তম মহিলা ছিলেন, তবু একথাও ঠিক যে তার বুদ্ধি-বিবেচনা কিছু কম ছিল। আমার ব্যাপারেও তিনি যতনা আমার আচরণে আমাকে বিচার করেছেন, ততটা আমার পোশাক-আশাকের প্রতি দৃষ্টি দেননি। আমার পোশাকে দারিদ্র ছিল ঠিকই তবু। তবু সে পোশাকের একটা সম্মানের ভাবও ছিল। আর সেই পোশাকে এমন কিছু ছিল না যাতে তিনি আমাকে চাকরানির টেবিলে ভোজের জন্য আহবান জানাতে পারেন। তার সেই বাসস্থানে তো আমি কম দিন থাকিনি। যা হোক আমার মনের বিরক্তি প্রকাশ না করে আমি মাদাম বুজেনভালকে বললাম, আমার ভুল হয়ে গেছে। একটা কাজে আমার চলে যেতে হবে। এই বলে আমি আবার চলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। মাদাম দা ব্ৰগলি উপরে তার মার কাছে চলে গেল এবং তার কানে ফিসফিস করে কী যেন বলল। আর তাতে ফলও ফলল। মাদাম দা বুজেনভাল নিজের আসন থেকে উঠে আমার কাছে এসে আমাকে তাদের কাছেই রাত্রি যাপন করতে বললেন। তিনি বললেন, তুমি আমাদের কাছে থাকলে আমরা সত্যই সম্মানিত বোধ করব। এবার আর আমি আপত্তি করলাম না। ভাবলাম তেমন করাটা আমার পক্ষে বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তাছাড়া মাদাম দা ব্ৰগলির সহৃদয়তা আমাকে যথার্থই অভিভূত করেছিল। তাছাড়া এবার তাকে আমার কাছে সুন্দর বলেই বোধ হলো। আমি তাদের সঙ্গে আনন্দের সঙ্গেই আহার করলাম। আমি ভাবলাম আমার সঙ্গে আর একটু অন্তরঙ্গ হলে সে আমাকে পছন্দ না করে পারবে না। লাযোগণন-এর প্রেসিডেন্টও আমাদের সঙ্গে আহার করলেন। তাকেও দেখলাম এই পরিবারের একজন বিশিষ্ট বন্ধু। মাদাম দা ব্ৰগলির মতো তিনিও প্যারির বস্তির ভাষার সঙ্গে বেশ পরিচিত ছিলেন। আমি আবার কথাবার্তায় অধিক কোনও জালিয়াতির ভাব দেখাতাম না। আজ আমার এই আফসোস যে, সেদিনের মতো যদি সবসময় আবার বুদ্ধির পরিচয় দিতাম তাহলে যে দুরবস্থায় আজ আমি পড়েছি তেমন দুরবস্থায় আমাকে পড়তে হতো না।

আমার নিজের বোকামিতে আমার নিজেরই দুঃখের অন্ত ছিল না। বিশেষ করে আমার দুঃখ হচ্ছিল যে মাদাম দা ব্ৰগলি আমার জন্য যা করেছেন তার জন্য আমার কৃতজ্ঞতার কথা আমি বুঝিয়ে বলতে পারছিলাম না। আহারাদির পর আমি আবার আমার স্বভাবে ফিরে এলাম। আমার পকেটে ছিল কাব্যে রচিত একটি পদ্য। এটি আমি রচনা করেছিলাম আমার লিয়নসে অবস্থানকালে পারিসটের জন্য। আমার এই পদটিতে আমার অগ্নিক্ষরা আবেদনের কোনও অভাব ছিল না। আমার আবৃত্তির ধারায় আমার শ্রোতা তিনজনকেই অশ্রুসিক্ত আবেগে আপ্লুত করে তুলেছিলাম। আমি জানি না এ কথা আমার অহঙ্কার হবে না যথার্থ যে আমি মাদাম দা ব্ৰগলির অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম যেন তিনি বলছেন, মা এই লোকটি তোমার সঙ্গে আহার করার যথার্থই উপযুক্ত ব্যক্তি। তোমার জন্য যে মহিলারা অপেক্ষায় রত তাদের চাইতে এই লোকটি অবশ্যই অধিক উত্তম। মাদাম ব্ৰগলি আবার তার মাকে বললেন, একথা আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম। ঠিক কী-না? মাদাম ব্ৰগলির এই কথা শোনার আগ পর্যন্ত আমার মনটা ভারী হয়েছিল। কিন্তু তার এই প্রশান্তি শোনার পরে আমার মন আবার প্রফুল্ল হয়ে উঠল। অবশ্য মাদাম দা ব্ৰগলি আমার সম্পর্কে প্রশংসা একটু অধিক পরিমাণেই করে ফেলেছিলেন। যেন তিনি বিশ্বাস করলেন যে প্যারিসে আমি যথার্থই একটা হৈ চৈ ফেলে দেব এবং মেয়েরা আমাকে নিয়ে দস্তুরমতো লোফালুফি শুরু করে দেবে। আমার অনভিজ্ঞতাকে পূরণ করতে তিনি আমাকে কতেদা…র আহোক্তিখানা আমাকে উপহার দিলেন আর বললেন, বাছা, যে জগতে তুমি যাচ্ছ সেখানে এই বইখানা তোমার উপকারে আসবে। তুমি বইটিকে মাঝে মাঝে কাজে লাগিয়ে। তার উপদেশটি যথার্থ ছিল। মাদাম ব্ৰগলির এই পুস্তকখানা এর পর থেকে প্রায় বিশ বছর আমার বুকের কাছে রক্ষা করেছিলাম। এটি আমি করেছিলাম মাদাম ব্ৰগলির প্রতি তার সৌজন্যের জন্য কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে। যদিও তিনি মেয়েদের নিয়ে আমার কর্মক্ষমতার যে প্রশংসার কথা তিনি করেছিলেন তার স্মৃতিতে আমার হাসিই পায়। বইখানা পাঠ করার পরে মাদাম ব্ৰগলির প্রতি আমার আকর্ষণ যথার্থই বৃদ্ধি পায়। এবং একথা যথার্থ যে আমার বান্ধবীদের মধ্যে সত্যিকার বান্ধবী যদি কেউ থেকে থাকেন সে একমাত্র মাদাম ব্ৰগলি।

.

[তার এই নতুন বন্ধুদের মাধ্যমে রুশো সঙ্গীত শিক্ষকের দায়িত্ব লাভ করেন। এভাবে তার মাদাম দা দুপিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। রুশো অনতিবিলম্বে তার সঙ্গীত শিক্ষার্থীর প্রেমে পতিত হন। কিন্তু তার প্রেমের প্রতিদানে হিমশীতল আচরণই মাত্র লাভ করেন। তাহলেও উচ্চস্তরের লোকজনের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। মাদাম দুপিনের সৎপুত্রের সঙ্গে সে রসায়ন শাস্ত্র অধ্যয়ন করে। রুশো একটা ‘অপেরা’ রচনারও চেষ্টা করে। কিন্তু এ কাজে অধিক দূর অগ্রসর হতে পারার পূর্বেই মাদাম দা ব্ৰগলি তার জন্য ভেনিসের রাষ্ট্রদূতের সেক্রেটারির পদে নিয়োগটি সগ্রহ করে দেন। এটা ১৭৪৩ সালের কথা। রুশো তার পদে যোগদানের জন্য যাত্রা শুরু করার পথেই তাকে জেনোয়ায় কোয়ারেন্টাইন করা হয়। সে যা হোক তার নিয়োগে সে দক্ষতা অর্জন করলেন তার রাষ্ট্রদূতের কাছ থেকে নানা প্রকার দুর্ব্যবহার লাভ করতে থাকেন। রাষ্ট্রদূতের ঘনিষ্ট লোকজন তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে শুরু  করে। রুশোকে তারা নানাভাবে অপদস্থ করতে শুরু করে। ফলে রুশো তার নিজের পদ থেকে পদত্যাগ করে।
এরপরে সে যথার্থই সঙ্গীত শাস্ত্রে দক্ষতা লাভ করে এবং নানা প্রকার সঙ্গীতে পারদর্শী হয়ে ওঠে।]

.

আমার ভাললাগার যে বোধ তাতে সঙ্গীত হচ্ছে অপেরার সব চাইতে শ্রেষ্ঠ শিল্প। আর এর তুলনা, ইটালি বা অপর কোথাও পাওয়া যায় না। একে আমি বলি Scuole (স্কুলি)। এই স্কুলি এক ধরনের দাঁতব্য প্রতিষ্ঠান। এর প্রতিষ্ঠা ঘটে সঙ্গতিহীন তরুণীদের শিক্ষা দানের জন্য। পরবর্তীকালে এদের সরকারের তরফ থেকেই বিভিন্ন স্থানে তাদের বিবাহ সম্পন্ন করার জন্য প্রেরণ করা হয় অথবা একটা বিশেষ ধরনের আচ্ছাদিত উঠানে সময় কাটাবার জন্য। এদের চর্চার মধ্যে সঙ্গীতই প্রধান। এই স্কুলিতে প্রত্যেক রোববার মঠের মধ্যে দক্ষ শিক্ষকরা এদের সঙ্গীতে দক্ষ করে তোলে। এদের গীত এই সঙ্গীতের চাইতে উত্তেজক আর কোনও সঙ্গীতের কথা আমি চিন্তা করতে পারিনে। ক্যারিয়া আর ভেসপারায় এই সঙ্গীতের আসরে যেতে পারলে কখনও সে সুযোগকে হাত ছাড়া করতাম না। চার্চ প্রায় সব সময়েই এই মেয়েদের দ্বারা ভরা থাকত। একবার আমি যখন এ বিষয়ে মশিয়ে লা ব্রন্ডকে বলছিলাম, তখন তিনি বললেন এদের সম্পর্কে তোমার যদি এত উৎসাহ, আমি তোমাকে সহজেই ওদের কাছে তোমাকে নিয়ে যেতে পারি। এই প্রতিষ্ঠানের আমি একজন পরিচালকও বটে।…

একথা শুনে তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করা পর্যন্ত তাকে শান্তিতে থাকতে দিলাম না। শেষপর্যন্ত তিনি যখন আমাকে এই সুন্দরীদের মেলায় যথার্থই নিয়ে গেলেন তখন বোধ করিনি। ম. লা ব্রভ এই সুন্দরীদের একটিকে আর একটির পরে আমার সামনে উপস্থিত করতে লাগলেন। কিন্তু সবগুলোকে যে আমার পছন্দ হয়েছিল তেমন না।…

মেয়েদের ব্যাপারে ভেনিস-এর মতো জায়গা মেয়েদের বর্জন করা যে কারোর পক্ষেই অসম্ভব। আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করতে পারে এদের সম্পর্কে তোমার আর কী বলার আছে। জবাবে বলব, হ্যাঁ, আমার নিশ্চয়ই কিছু বলার আছে। আর যা বলার আছে তা আমি নিঃসঙ্কোচেই বলব।

সাধারণ দেহ ব্যবসায়ীদের আমার মোটেই পছন্দ হয় না। অথচ ভেনিসে এরা ছাড়া আমার সাধ্যের মধ্যে আর কিছুই ছিল না। যারা একটু বনেদি তাদের কাছে যাওয়ার মতো আমার কোনও অর্থ ছিল না। ম, লা ব্লন্ডের মেয়েরা খুবই ভদ্র ছিল। কিন্তু খুবই গম্ভীর প্রকৃতির। তাদের মা এবং বাবার প্রতি আমার অপরিসীম শ্রদ্ধা ছিল। আমি তাদের এমন সুন্দর মেয়েদের সম্পর্কে আমি অন্য কোনও কুচিন্তা করতেই পারতাম না। অবশ্য আর একটি মেয়ে ছিল। তার নাম ছিল মাদামসেল দা কাতানিও। তাকে আমার পছন্দ হতো। কিন্তু তার প্রতি কারিওর ভালবাসা ছিল। এমন কি দুয়ের মধ্যে পরিণয়ের কথা হচ্ছিল। আর তাছাড়া কারিও ছিল বেশ সম্পদবান। আর আমার কোনও সম্পদই ছিল না। কারিওর মাসিক বেতন ছিল মাসে একশ’ লুই, আর আমার ছিল মাত্র একশ’ পিসততালি। তাছাড়া কোরিও আমার বন্ধুও ছিল। একজন বন্ধুর মালের ওপর নজর দেয়ার আমার কোনও ইচ্ছা ছিল না। আমি জানতাম প্রেমের ব্যাপারে একের প্রেমের ওপর অন্যের হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। বিশেষ করে ভেনিসে বসে। তাছাড়া আমার নিজের কামনাকে নিবৃত্ত না করার কুঅভ্যাস আমি তখনও পরিত্যাগ করিনি। ভেনিসের আবহাওয়ার প্রতি আমার আকর্ষণ ছিল তীব্র। আমি প্রায় এক বছর ভেনিসে কাটালাম যথার্থই পবিত্রতার সাথে, যেমন কাটিয়েছিলাম প্যারিসে। শেষপর্যন্ত আঠার মাস পর্যন্ত আমি মেয়েদের সঙ্গে কোনও কারবার না করে আমি ভেনিস ছেড়ে চলে এলাম। এর ব্যতিক্রম মাত্র দু’বার ঘটেছিল। একটা বিশেষ সুবিধা পাওয়ার কারণে। সে ঘটনার কথা আমি বলব।

এর প্রথম ঘটনাটা ঘটাল সম্মানিত ভিটালি। ইতোমধ্যে আমি তাকে তার অভিমতের জন্য আমার কাছে তাকে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেছিলাম। আলাপ আলোচনা চলছিল ভেনিসের বিনোদিনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে। টেবিলে যারা ছিল তারা আমাকে ভর্ৎসনা করল এই বলে যে আমি ভেনিসের আসল মালই দেখিনি। এই কথা বলে ভেনিসের মেয়েদের মোহনীয় আচরণের বিষয়ে আমি কিছুই জানি না, আর কিছুই বুঝি না। ভেনিসের এই মেয়েদের তুলনা পৃথিবীর আর কোথাও নাকি নেই। সে বলল, আমি নাকি ভেনিসের আসল মেয়েকেই দেখিনি। সে প্রতিশ্রুতি দিল সে আমাকে সেই মাল দেখাবে এবং তাকে দেখে আমি মুগ্ধ না হয়ে পারব না। তার এই কথা শুনে আমি তার এমন দয়ায় হাসতে শুরু করলাম। এমন হাসিতে বৃদ্ধ কাউন্ট পিকি আমাকে অপ্রত্যাশিত দিলখোলা ভাবে বললেন, বাছা, প্রস্তাবটা ছেড়ো না দিয়েছেই যখন লুফে নাও। গিয়ে দেখো না! শেষপর্যন্ত আমি তার প্রস্তাবমতো যথার্থই সেই মালের কাছে গেলাম। দি প্যাডোনা বা যার বাড়িতে আমি গেলাম দেখতে সে ভালই ছিল। বলা চলে সুন্দরী ছিলেন। কিন্তু তার সৌন্দর্যতে আমি ভুলতে পারলাম না। ডোমেনিকো যে আমাকে তার কাছে নিয়ে গিয়েছিল সে তার কাছে আমাকে রেখে চলে গেল। যাওয়ার সময়ে মেয়েটিকে আমাকে গান শুনতে বলল। তার গান শুনতে আধাঘণ্টা কেটে যাবার পর আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং একটি ডুবাট তথা স্বর্ণমুদ্রা তার টেবিলে রেখে চলে আসার উদ্যোগ করলাম। কিন্তু মেয়েটার একটা গুণ ছিল। সে তার করণীয় না করে আমার দেয়া সোনার মুদ্রাটি নিতে অস্বীকার করল। আর আমিও সে যা আমাকে করতে বলল, আমি তা করতে দ্বিরুক্তি করলাম না। এমন কর্ম থেকে ফিরে এসে আমার নিশ্চয়ই পকস বা বসন্ত হয়েছে। সেই ভয়ে আমি ডাক্তারের জন্য লোক পাঠালাম। ডাক্তার এলে আমার অবস্থার কথা বলে আমি তার কাছে ওষুধ চাইলাম। তারপর প্রায় তিন সপ্তাহ আমি মনমরা হয়ে রইলাম। অথচ আমার বসন্ত হয়নি। কিন্তু আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না যে মেয়েটার সঙ্গে আমার মিলনে কোনও রোগ হয়নি। তবু ডাক্তার বুঝাতে লাগলেন যে আমার কিছু হয়নি। আমি তখনই যে বিশ্বাস করলাম, তা নয়। তবু এ পর্যন্ত আমার শরীরে কোনও রোগের লক্ষণ দেখা দেয়নি তাতে আমার বিশ্বাস হলো হয়তো যথার্থই আমার কোনও রোগ ওই মেয়েটার সঙ্গে মিলনের মধ্য দিয়ে ঘটেনি। তবুও বলব যদিও আমার তেমন কোনও রোগ হয়নি, তবু আমি ওই কাজে কখনও ব্রত হইনি– সে কথাও আমি বলতে পারিনে।

আমার অন্য কর্মকাণ্ডের মধ্যে আর একটি মেয়ের সঙ্গে কারবারটিও উল্লেখযোগ্য। এ মেয়েটার ধরন ছিল আলাদা; যেমন তার মূলের দিকে তেমনি তার কারবারের শেষ আচরণেরও। আমি যখন ভ্রমণের জাহাজের আরোহণ করলাম তখন স্পেনের দূতাবাসের মেয়ে সেক্রেটারিটিকেও সঙ্গে নিলাম। আমি মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে যখন জাহাজে উঠলাম তখন ভেবেছিলাম জাহাজের ক্যাপ্টেন আমাকে সংবর্ধনা জানাবে। কিন্তু আমার সে আশা সে পূরণ করল না। তার এমন আচরণে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমি এজন্য আমার বিরক্তি গোপন করতে পারলাম না। ফলে আহারাদির আয়োজন উত্তম থাকলেও আমি তা আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করতে পারলাম না। ফলে আমি আহারও যেমন যথেষ্ট পরিমাণ করতে পারলাম না, এবং খাবারের টেবিলে তেমন আত্মপ্রকাশ করাও আমার পক্ষে সম্ভব হলো না।

আহার শেষে কোনও বাহবাও জুটল না। ব্যাটা ক্যারিও আমার এই বিপর্যয়কে খুবই উপভোগ করতে লাগল। আমাকে বুড়ো খোেকা মনে করে আমাকে নিয়ে খুব ঠাট্টা তামাশা করতে লাগল। আহারের অর্ধাধি সময়ে দেখলাম একটি গন্ডোলা এগিয়ে আসছে। তা দেখে আমাদের ক্যাপ্টেন চিৎকার করে উঠল : তোমরা সাবধান হও ভয়ানক একটা গন্ডোলা কিন্তু এগিয়ে আসছে। আমি যখন তার এমন ভয়ার্ত চিৎকারের অর্থ জিজ্ঞেস করলাম তখন সে আমার দৃষ্টি একটি অপূর্ব সুন্দরী মেয়েলোকের দিকে আকৃষ্ট করল। আমি দেখলাম সুন্দরীটি দেখতে না দেখতে লম্ফ দিয়ে আমি একটু সরে বসার আগেই আমার গা ঘেঁষে বসে পড়ল। সুন্দরীটির বয়স বিশের মতো ছিল। সে ইটালিয়ান ভাষায় কথা বলতে পারত। তার কথার যে উচ্চারণ ছিল তাতেই আমার মাথা ঘুরে যেতে পারত। খেতে খেতে সে যখন কথা বলছিল তখন তার দৃষ্টি আমার ওপরই কেবল নির্দিষ্ট ছিল। তারপর সে হঠাৎ বলেও উঠল : আহা আমার সুন্দর, কতদিন পরেই না তোমার সাথে আজ আমার সাক্ষাৎ ঘটল! সে মুহূর্তের মধ্যে আমার মধ্যে ঢুকে পড়ল এবং তার পা দিয়ে আমার পা আটকে ধরল। তার বড় বড় কালো চোখ যেন আমার মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে তুলল। আমি প্রথমে আশ্চর্য হয়ে গেলেও মেয়েটা আমাকে কখন একেবারে গিলে খেল। অবশ্য তার কাম স্পৃহা চূড়ান্ত হওয়ার পরে সে আমাকে তার বাহুবন্ধন থেকে মুক্তি দিল। অবশ্য সে আমাকে শেষ করার পরে বলল, বাছা, তোমাকে দেখতে আমার ঠিক সেই মশিয়ে দা ড্রেমন্ডের মতো মনে হয়েছিল। টাসকান কাস্টম হাউজের সে ছিল একজন পরিচালক। সে বলতে লাগল তাকে আমি এখনও ভালবাসি। কিন্তু কী করব, লোকটা আসলে ছিল বোকা আর তাই আমি যে কী, তা সে বুঝতেই পারেনি। তার মতো তুমি দেখতে বলেই আমি তোমার কাছে এসেছি। সে বলল, আমার সেই লোকের মতো তুমি আমাকে ভালবাসবে, যতক্ষণ আমি চাইব, ততক্ষণ আমি তোমাকে ছাড়ব না। আসলে তাই হলো। সে আমাকে যা করতে বলল, আমি তাই করলাম। আমার মাথায় তার টুপি পরিয়ে দিল। হাতের গ্লোভ আমার হাতে দি। ইতোমধ্যে দেখলাম, হঠাৎ সে আমাকে ছেড়ে আর একটা লোকের কাছে চুপিসারে বহুক্ষণ যাবৎ কী যেন আলাপ করল এবং তারপর আবার। আমার কাছে ফিরে এসে বলল : দেখ বাপু, আমি ফরাসি কায়দার ভালবাসা পছন্দ করি না। কারণ ফরাসি কায়দার ভালবাসায় আমার কোনও লাভ হয় না। আমাকে যখন তুমি শেষ করতে পারবে তখন তুমি চলে যেয়ো, তাতে আমার কোনও দুঃখ হবে না। তবে একটা সাবধান বাণী তোমাকে শুনাচ্ছি। যা করবে শেষপর্যন্ত করবে। মাঝখানে ছাড়বে না। সে বেপরোয়াভাবে তার টাকা পয়সা ওড়াতে লাগল তাতে মনে হলো যেন টাকা পয়সার জন্য সে কোনও চিন্তাই করে না। সে যখন আমার কাছ থেকে তাকে ব্যবহারের জন্য টাকা চাইল তখন তার ভাবটিও ছিল এমন যে আমি যা দেব তাতেই সে খুশি। সে খুশি আমার টাকার জন্য নয়, আমাকে সে যে ইচ্ছামতো ব্যবহার করতে পেরেছে তার জন্য। অপর সবার ক্ষেত্রেও তার ভালবাসার আচরণ এমনিই…

আমার জীবনে এমন যদি কিছু থাকে যা আমার চরিত্রকে উত্তমরূপে প্রকাশ করে তবে সেটি হবে সেই বৈশিষ্ট্যটি যা আমি এখন বিবৃত করব। আমার এই বই লেখার উদ্দেশ্যকে আমি এই মুহূর্তে যেমন গভীরভাবে স্মরণ করছি, তাতে আমার বর্তমান বর্ণনা কোনও সংকোচ বা বাধাকেই গ্রাহ্য করবে না। পাঠক আপনি যেই হোন না কেন, আপনি যদি একটা লোকের অন্তরাত্মাকে যথার্থভাবে জানতে চান তবে সামনের গোটা দুই পৃষ্ঠা পাঠ করার সাহস যেন আপনি ইতোমধ্যে সংগ্রহ করে থাকেন।

মেয়েটার ঘরে আমি ঢুকে পড়লাম- যেন মেয়েটার মধ্যে আমি ভালবাসার স্বর্গ আবিষ্কার করে ফেলব, এমন বিশ্বাস আমার ছিল। মেয়েটাকে আমি দেখলাম : আমি কল্পনা করলাম মেয়েটার দেহে সুন্দরের স্বর্গ আছে এবং যদি আমি কিছু হারাই সেই ভয়ে তাই আমি বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করে তার দেহের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আমি ভাবছিলাম এই মেয়েটা সুন্দর এবং সৌন্দর্যের সেরা। সে যেমন উদার তেমনি সুন্দর। পৃথিবীর সুন্দরতম পুরুষ তার দাস বৈ আর কিছু হবে না। অথচ মেয়েটা ছিল কী অসীম করুণার পাত্রী। রাস্তার মেয়ে। যে কোনও পুরুষের কাছে বিক্রিত হওয়ার জন্য সে আকুল। একটু আগে সে ছিল কোনও একটা ব্যবসায়ীর অঙ্কে। আমার ওপরও সে ঝাঁপ দিল। যদিও সে জানত আমি ধন-ঐশ্বর্যের মালিক ছিলাম না। আমার মান মর্যাদা সম্পর্কে সে কিছুই জানত না, তবু কোনও কিছুর চিন্তা না করে সে আমার বাহু বন্ধনে ধরা দিল। তার নির্বাধ আচরণটাই আমাকে বিস্মিত করল। এমন কেন হলো। হয় আমার আত্মা মেয়েটার ব্যাপারে আমাকে একটা মুখে পরিণত করে ফেলেছে, নয় আমার সকল সৌন্দর্যবোধকে বিনষ্ট করে ফেলেছে, কিংবা কোনও অজানা মন্ত্র আমার আত্মার মধ্যে ঢুকে একটা ঘৃণ্য মেয়ের বন্ধনে আমাকে আবদ্ধ করে ফেলেছে। আমার আত্মার দুর্বলতাকে আমি অন্বেষণ করতে লাগলাম। কিন্তু তাতে কোনও ফল হলো না। এই মেয়েটার সঙ্গে সহগামীতে যে আমি রোগাক্রান্ত হয়ে পড়তে পারি তাও আমি ভুলে গেলাম। আমারই বরং চিন্তা জাগল আমি মেয়েটার উপযুক্ত হব তো? আসলে আমি যে মেয়েটার জন্য অনুপযুক্ত এমন চিন্তা আমার মনে আদৌ ঢুকল না। মেয়েটার জন্য আমার এমন কল্যাণ চিন্তা বরং মেয়েটার দুর্দশার চিন্তায় আমার চোখে পানি এনে দিল। আমার আচরণে, জুলিয়েটাও (মেয়েটার এই নামই ছিল) যেন অভিভূত হয়ে পড়ল। ঘরের আরশিতে সে নিজেকে ভাল করে দেখল এটা বোঝার জন্য, আমার এমন আচরণের কারণ কী। সে কি তার সৌন্দর্যের কোনও ঘাটতির জন্য? তার সামনের আরশিতে তার সৌন্দর্যের অভাব আমার এমন অদ্ভুত আচরণের কারণ নয়। আমি মেয়েটাকে আমার কোলে তুলে নিলাম। যেন সে অসুন্দর নয়, যেন সে একটি দেবী। আমি নিজের মধ্যে কোনও ত্রুটি খুঁজে পেলাম না। অথচ মেয়েটা দেখতে যথার্থই একটা ডাইনিবৎ ছিল। তবু মেয়েটাকে আমার বাহুর মধ্যে ধরে রাখলাম। ওকে ডাইনি বলে সম্বোধনও করলাম। মেয়েটা তাতে রাগ না করে খুশি হলো। হাসতে লাগল এবং খুশিতে নাচতে লাগল। তার নাচুনি সত্ত্বেও আমার ভালবাসার কোনও ঘাটতি হলো না। তবু একথাও ঠিক আমার আচরণের অস্বাভাবিকতা মেয়েটা যেন ধরতে পারল। শেষপর্যন্ত দেখলাম মেয়েটা তার পরনের কাপড় পারিপাটি করার চেষ্টা করল এবং বিছানা ছেড়ে উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এবার আমিও মেয়েটার পাশে গিয়ে একটু দাঁড়ালাম। ওর পাশে বসার চেষ্টা করলাম। মেয়েটাকে দেখলাম মেয়েটা আমার পাশ থেকে একটু সরে বসল। দেখলাম মেয়েটা একটা কোচে বসল। আবার বসা থেকে সে উঠে দাঁড়াল, নিজেকে পাখা দিয়ে হাওয়া করল এবং আমার কাছে ঘেঁষে বলল : বাপু, তুমি মাইয়া মানুষ ছাড়। মাইয়া লোকের বদলে নিজের অঙ্ক পাঠে মন দাও। আমি তাকে ছেড়ে আসার পূর্বে মেয়েটাকে বললাম, কাল একবার আসি, সে তার মুখে একটা ব্যঙ্গের হাসি ফুটিয়ে বলল, কাল না, পরশু এসো। আগামীকাল একটু বিশ্রাম কর। তার কথা মতো পরের দিনটা আমি বাদই দিলাম। পরের দিনটা আমাকে ছটফট করে কাটাত হলো। আমার মনে মেয়েটার সৌন্দর্যের চেয়ে মেয়েটার নম্রতা ভেসে উঠতে লাগল। মেয়েটার আচরণে কোনও অসৌজন্যতা ছিল না। কোনও খারাপ আচরণ ছিল না। তাই আমি মেয়েটাকে আদৌ খারাপ ভাবতে পারলাম না। আমি নিজের আচরণের দিকে চেয়ে নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগলাম। মেয়েটার কাছে যাওয়ার যে ভাগ্য পেয়েছিলাম, সেই ভাগ্যকে আমার এমন আচরণে নষ্ট করলাম। নিজেকে ধিক্কার দিলাম : আমি এমন খারাপ কেমন করে হলাম? আমি কেবল ভাবতে লাগলাম আমার কৃত এমন অপরাধের পরিশোধ আমি কেমন করে করি? আসলে মেয়েটা তো আমার জীবনে সবচাইতে মমতাময় একটি সুন্দর মুহূর্তকে সম্ভব করেছিল। অথচ আমি কীভাবে সময়টাকে ব্যবহার করলাম। আমি কেবল ভাবতে লাগলাম, কেমন করে আমার দুর্ব্যবহারের প্রায়শ্চিত্ত করি। ও আমাকে একদিন পরে যেতে বলেছিল। আমি কোনওরকমে দিনটা কাটালাম। তারপরই প্রায় ছুটে গিয়ে ওর ঘরে উপস্থিত হলাম। আমি জানি না আমাকে ফিরে পেয়ে সে কতখানি খুশি হয়েছিল। আমি নিজের মনে কেবল ভাবতে লাগলাম কেমন করে ওর প্রতি আগের সত্যকার আত্মাকে প্রকাশ করব।

কিন্তু আমার কোনও কিছুই প্রকাশ করা লাগল না। যে লোকটিকে আমি আগেভাগে যাব বলে খবর পাঠিয়েছিলাম, সে ফিরে এসে বলল : মেয়েটা আগের রাতেই বাসা ছেড়ে ফ্লোরেন্সের দিকে চলে গেছে। এখন আমার দৃষ্টি দিয়ে বুঝলাম যথার্থই আমি ওকে কী ভালই না বেসেছিলাম। একেই বলে মূখের ভালবাসা। মূখের ভাল এমন মূর্খের মতোই হয়? মুখের কাছে বিনয় আর মমতার কী মূল্য? এই ঘটনার দুঃখ আমার জীবনে আর বিস্মৃত হতে পারিনি। যদি মেয়েটাকে আবার পেতাম তাহলে আমি বিশ্বাস করি ওর মন থেকে আমার আচরণের গ্লানি আমি দূর করে দিতে পারতাম। আমি আবার সেদিনের আচরণের জন্য দুঃখবোধ করি। ও আমার আচরণে যে দুঃখবোধ নিয়ে গেল তার পরিশোধের কোনও সুযোগ আমি পেলাম না। এটাই আমার দুঃখ। আমি ওকে আমার আচরণ দিয়ে বুঝতে পারলাম না, আমি ওকে ঘৃণা করিনি। আমি ওকে যথার্থই ভাল বেসেছিলাম।

আমি যখন মেয়েটাকে আমার বুকের মধ্যে পেয়েছিলাম, তখন যদি ওকে যথার্থই ভালবাসতে না পেরে থাকি এখন মেয়েটা যখন আমার আয়ত্তের বাইরে হারিয়ে গেল তখন তাকে ভালবাসার জন্য আমার মনে হাহাকার জেগে উঠল। আমার এই মূর্খ দুঃখের বোধ আর আমি এ জীবনে বিস্মৃত হতে পারলাম না। আহা, কী বিনয়ী ছিল মেয়েটা। এমন দৃষ্টিতে যখন আমি ওকে দেখেছিলাম, তখন এই বোধটা আমার থাকলে আমি ওর প্রতি এমন আচরণ করতাম না। আমি সত্যকার ভাবে ওকে ভালবেসে বুঝতে পারতাম আমি আসলে খারাপ লোক নই। কিন্তু এখনতো আর কোনও প্রতিশোধের উপায় নেই। আমার প্রতি যে ঘৃণাপূর্ণ মন নিয়ে মেয়েটা আমার কাছ থেকে আমার এমন আচরণের কারণে হারিয়ে গেল এখন কোনওভাবেই তো আমার এই অপরাধের কোনও প্রতিশোধ আমি করতে পারব না।

আমার এই জীবনের এই দু’টি কাহিনীর কথা আমার পাঠকদের শোনালাম। যে আঠারটা মাস আমি ভেনিসে ছিলাম সে সময়টাকে এর অধিক আর কিছু আমার বলার নেই।

হ্যাঁ, ভালবাসার চেষ্টা যে আমি না করেছি তা নয়। ক্যারিওর কথা বলতে পারি। তারও মেয়েলোকের ওপর লোভের সীমা ছিল না, তারও লোভ থাকত অন্যের হাতের মেয়েলোকের ওপর : অপরের কোনও একটাকে সে নিজের মালিকানাতে রাখতে চাইত। সে আমাকে একবার বলেছিল, এস আমরা দুজনে একটা ভাগ করে লই। কিন্তু বহু খুঁজেও এমন একটাকে পেলাম না যেটাকে দু’জনে ভাগ করে ভোগ করতে পারি।

একবার একটা এগার কিংবা বার বছরের মেয়ে যোগাড় করেছিল। মেয়েটার নির্মম মা মেয়েটাকে কারোর কাছে বিক্রি করে দিতে চাচ্ছিল। আমরা দুজনেই মেয়েটাকে দেখতে গেলাম। সে দেখতে বেশ সুন্দরী ছিল। একটি অল্প বয়সের মেষ শাবকের মতো মেয়েটা নরম ছিল। কিন্তু তাকে কেউ ইটালির মেয়ে বলে বোধ করতে চাইত না। ভেনিসের খাই খরচ তেমন বেশি ছিল না। আমরা মেয়েটার জন্য ওর মাকে কিছু টাকা দিলাম। মেয়েটার থাকার জন্য একটা জায়গারও ব্যবস্থা করলাম। মেয়েটার গানের গলা বেশ ভাল ছিল এবং মেয়েটাকে গান শেখাবার জন্য একজন মাস্টারও যোগাড় করলাম। এসবের জন্য আমাদের মাসে ফরাসি দুই সিকুইনস-এর অধিক লাগত না। অন্য খরচ কমিয়ে আমরা হাতে কিছু টাকাও জমিয়ে ফেললাম। কিন্তু মেয়েটাকে ভোগ করার জন্য আরও সময়ের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হলো। মেয়েটাকে দেখে আমার ভাল লেগেছিল। যেমন সুন্দর তেমনি একটি মেষ শাবকের মতো নরম। যাই হোক দেরি হলেও আমরা রাজি হলাম। মেয়েটা একেবারেই বাচ্চা বাচ্চাটার সাথে আমরা খেলা করতাম। কিন্তু মেয়েটাকে ভোগ করতে অধিকতর সময় আমাদের ব্যয় করতে হবে তাতে আমরাও অশান্ত হয়ে উঠছিলাম। আসলে আমরা যখন কোনও একটা মেয়েতে আসক্ত হয়ে পড়ি সেটা যতটা না যৌন আচরণের জন্য, তার অধিক মেয়েদের সঙ্গে একটা নৈকট্য লাভের অনুভূতির জন্য। মেয়েটার নাম ছিল অ্যানজোলেটা। কিন্তু মেয়েটার সাথে আমার আচরণে যতটা না যৌন তৃষ্ণা প্রকাশ পেত তার প্রতি আমার পিতৃস্নেহ অধিক প্রকাশিত হতো। আমি মেয়েটাকে আমার মেয়ের মতো ভালবাসতে লাগলাম। ফলে মেয়েটা যত বড় হতে লাগল, যৌন আকর্ষণে এবং যৌন আচরণের চাইতে তার প্রতি আমার পিতৃস্নেহসুলভ আচরণই প্রকাশ পেত। আমার সঙ্গীর অজান্তেই মেয়েটার সঙ্গে তার ব্যবহার আমার মতো হতে লাগল। আমরা দুজনেই মেয়েটার সঙ্গে যৌন মিলনের কামনার চাইতে ছোট্ট একটি মেয়ের সঙ্গে খেলা করার ভাব দেখাতাম।

কাম এবং ভোগের বস্তু হিসেবে নয়। একটি ছোট মেয়ের সঙ্গে খেলাধূলার আকর্ষণ এবং আনন্দই আমাদের বেশি ছিল। তাই তার কোনও ক্ষতি করার চাইতে, কোনও ক্ষতি থেকে তাকে রক্ষা করার বোধটিই আমাদের মধ্যে প্রবল হতে লাগল।

সমাজের এই অবস্থা আমার মনে ঘৃণার জন্ম দিল। চলতি সমাজ ব্যবস্থা আসলে সত্যিকার ব্যবস্থাকে বিনষ্ট করে দেয়। চলতি সমাজ ব্যবস্থার আসল উদ্দেশ্য হলো অপবাধকে ন্যায্য বলে তুলে ধরা। তার ফলে সমাজ ব্যবস্থা মূলেই ধসে পড়ে।

এবার আমরা যেখানে এলাম সেখানে একজন নতুন মালিকের দেখা পেলাম। এ মহিলা তার নিজের কাজের সুবিধার জন্য গ্রাম থেকে একটি মেয়েকে জোগার করে এনেছিল। এর বয়স ২২ কি ২৩-এর মতো ছিল। এই মেয়েটি বাড়ির মালিকের মতো আমাদের সঙ্গেই খাওয়া-দাওয়া করত। এই মেয়েটির নাম ছিল থেরেসি লাভাসিউর। একটি সম্মানজনক পরিবার থেকে এসেছিল। তার বাবা একটা অফিসে কাজ করত, তার মা একটি ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ওদের পরিবারের আকারটি বৃহৎই ছিল। কিন্তু বাবার অফিসটি বন্ধ হয়ে যাওয়াতে তাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ল। ফলে তারা তিনজনেই জীবন ধারনের উপায় বার করার জন্য প্যারিস শহরে এসে উঠল। মেয়েটি, তার মা এবং বাবা এই তিনজনে কোনওক্রমে সংসার চালাত।

এই পরিবারের মেয়েটির সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে প্রথমে ওদের খাওয়ার টেবিলে। আমার প্রথম দর্শনেই মেয়েটিকে আমার ভাল লেগেছিল। এ যেমন সুন্দর তেমনি সে কথায় এবং আচরণও বেশ সুন্দর ছিল। মেয়েটিকে সবদিক দিয়ে আমার কাছে তুলনাহীন বলে বোধ হলো। এই সঙ্গটির মধ্যে কেবল আমিই ফরাসি বলতে পারতাম। আমি দেখলাম মেয়েটার ওপর দলের অন্য লোকেরও দৃষ্টি পড়েছিল। আমাদের এই দলের গিন্নীর আচার-আচরণও তেমন ভাল ছিল না। সৎ ব্যবহারের দিক দিয়ে আমিই বোধহয় একমাত্র ভদ্র কিসিমের ছিলাম। বাকি সকলে মেয়েটাকে নানাভাবে উত্ত্যক্ত করত। মেয়েটির প্রতি ওদের আচরণ দেখে আমি যেই মেয়েটির পক্ষ নিলাম, অমনি ওরা আমার বিরুদ্ধে লাগল। আমি মেয়েদের প্রতি আচরণে সব সময়ই ভদ্র ছিলাম। কাজেই এই মেয়েটিকে অপরে হয়ত মিশ্রভাব হতে দেখে আমি মেয়েটাকে ওদের আচরণ থেকে রক্ষা করার ভূমিকা গ্রহণ করলাম। আমি দেখলাম আমার এমন সহানুভূতিপূর্ণ আচরণে মেয়েটা আমার প্রতি খুশি হলো। আমি দেখলাম আমার প্রতি সে তার মনের ভাব প্রকাশ করার সাহস পাচ্ছে না। তাতে মেয়েটিকে আমার আরও ভাল লাগল।

আমার দিকে চাইতে ওর চোখ মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠত। আমারও নিশ্চয়ই তেমনি হতো। আমাদের উভয়ের এই ব্যবহারে কোনও গোপনতা ছিল না। বাড়ির গিন্নীর চোখে আমাদের এই ব্যাপারটা এড়াল না। ফলে গিন্নী আমার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। গিন্নীর এমন রূঢ় ব্যবহারে আমার প্রতি মেয়েটির আকর্ষণ যেন বৃদ্ধি পেল। মেয়েটাকে সঙ্গ দেয়ার আর কেউ ছিল না। ফলে মেয়েটা চাইত না যে আমি ওকে ছেড়ে বাইরে যাই। কিংবা গেলেও আমি যেন তাড়াতাড়ি ওর কাছে আবার ফিরে আসি। এই ছিল ওর আচরণের ভাবটি। ফলে মেয়েটা যেন আমার মধ্যে তার একমাত্র একজন রক্ষককে আবিষ্কার করতে পারল। আমি একবার প্রকাশ্যে ওর কাছে বলে ফেললাম, আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। তার প্রকট ভয় ছিল এরূপ যে সে আমার কাছ থেকে যা আশা করে আমি তাকে দিতে পারছিনে। তার এই ভয়ের জন্য আমার মনেই বেদনা জাগতো বেশি। আমার সঙ্গে মিলনের পূর্বে তার আচরণে সে তার নিজের মনের বেদনার কথা প্রকাশ করতে চাইত। ওর এমন আচরণের কারণ আমি অনুধাবন করতে না পেরে মনে করতাম হয়ত মেয়েটার মনে আমার চাইতে অপর কারোর প্রতি অধিকতর ভালবাসা আছে। অথচ ওর সম্পর্কে ওর ওপর এমন বিচারের অধিক অন্যায় বিচার আর কিছুই হতে পারে না। এই মনোভাব থেকে ওর জন্য আমার মনের বেদনা আরও বৃদ্ধি পেত। আসলে আমাদের কেউ অপরকে বুঝতে পারতাম না। তার মনে হতো যে আমি আসলেই পুরো একটা পাগল এবং আমাকে ওর কী ভাবে দেখতে হবে এটা ও বুঝতে পারত না। পরে আমরা পরস্পরকে বুঝতে পারলাম। একদিন ও চোখের পানিতে বলল: আমার ছোটকালে একটা বদলোক আমাকে বলাৎকার করেছিল। আমি যখন ওর অবস্থা বুঝতে পারলাম তখন আমি আনন্দে আপ্লুত হয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম : তুমি আমার লক্ষ্মী মেয়ে! আমি বললাম, তুমি দুঃখ করো না। প্যারিস জায়গাটা খারাপ নয়। তোমার বিশ বছর বয়সে তোমার জন্য একজনের ভাল লাগতে পারে। তাতে অন্যায় কিছু নেই। তুমি আমার প্রিয় থেকো। আমি তোমাকে পেয়ে আমার জীবনের ভালবাসাকে পেয়েছি। এমন ভালবাসার কথা আমি জীবনে চিন্তা করতে পারিনি।

আমার এই জীবনের গোড়াতে একটি মেয়েকে মনে করতাম একটা খেলার পুতুল বলে। এই ঘটনার পরে আমি দেখলাম, একটা মেয়েকে আমি আগে যদি একটা ভোগের দ্রব্য বলে মনে করতাম, আমার কী ভাগ্য যে, আমি এখন যথার্থ একটি সঙ্গীনিকে লাভ করেছি। এই মহৎ মেয়েটির সঙ্গে যে অন্তরঙ্গতা আমি লাভ করলাম, তখন ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করে আমি দেখলাম যে, এই মেয়েটি আমাকে যথার্থ সুখের সন্ধান দিয়েছে। আমি এতদিন মেয়েদের নিয়ে যে কামনা পোষণ করতাম তার জায়গাতে আমি যে যথার্থ ভালবাসার আবিষ্কারে সক্ষম হলাম। শুধু মেয়ে লোক নয়, আমি উপলব্ধি করলাম আমার প্রয়োজন একজন যথার্থ সঙ্গী। এক কথায় যে আমাকে নিয়ে এতদিন আমি অভিভূত ছিলাম, তার স্থানে আমার প্রয়োজন একজন বিশ্বস্ত সঙ্গী। যার মধ্যে যেমন আমি আনুগত্য লাভ করতে পারব, তেমনি লাভ করতে পারব মমতা। আমার নিজেকে পর্যবেক্ষণ করলাম। আমি যখন একাকী থাকতাম এবং চিন্তা করতাম তখন মনে হতো আমার ভেতরে যেন একটা শূন্যতা বিরাজ করছে। আমার মনে হতো আমার এই রকম অন্তর যেন আমি আর এক জনের মধ্যে লাভ করতে পারি। তাহলেই আমরা দুজনে এক অনুভূতির হব : আমরা দুজনে একজন হয়ে যাব। আমার ভাগ্যই আমারে আমার আকাঙ্ক্ষিত দ্বিতীয় সত্ত্বা থেকে পৃথক করে ফেলেছে। সেই বিচ্ছেদের বেদনাই আমার মধ্যে জাগে। এক দ্বৈতসত্তার বোধ আমাকে কাঁদায়, থেরেসি মেয়েটার মধ্যে যেন আমি আমার আকাঙ্ক্ষাকে লাভ করেছিলাম। থেরেসিকে আজও আমি ধন্যবাদ জানাই। বাস্তব পরিস্থিতিতে যতটুকু সম্ভব থেরেসি আমার সে অভাব পূরণ করে দিত। ওর সঙ্গে আমি যতদিন ছিলাম আমি যথার্থই সুখী ছিলাম। আমি ওর মানসিক বোধের ক্ষমতা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করলাম। ও গুণতে জানত না আমি তার চেষ্টা করলাম। ও অক্ষর চিনত না, ওকে আমি অক্ষর চেনাবার চেষ্টা করলাম। হয়ত আমি তাতে সফল হতাম না। তবু ওকে উন্নত করার চেষ্টা আমার একটা কাজ হয়ে দাঁড়াল। আমি যখন বাড়ি বদল করে আর একটাতে গেলাম তখন দেখলাম আমার এই নতুন বাড়ির জানালায় বিপরীত দিকে একটা দেয়াল ঘড়ি আছে। সে ঘড়ি দিয়ে ওকে সময় গণনা না করার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। কিন্তু তেমন ব্যর্থতাতে আবার সুখ ছাড়া দুঃখ হতো না। আমি বুঝতাম যে ক্ষমতা ওর নাই তা আমি কেমন করে সৃষ্টি করব। ওকে টাকা পয়সা গণনার কায়দাটাও আমি শেখাতে পারলাম না। বারের নাম শেখাবার চেষ্টা করলাম। তাতেও আমি সক্ষম হলাম না। ও যে শব্দ করতে পারত না, তা নয়। কিন্তু আমি দেখতাম ও যা বুঝতে চায় ও তার বিপরীত শব্দ ব্যবহার করে। যা ওকে বুঝতে আমাকে সাহায্য করত না। থেরেসি যে সব শব্দ উচ্চারণ করত, আমি একবার তার একটা অভিধান বানালাম। আমি দেখলাম, তার বোধবুদ্ধি যাই থাকুক বা না থাকুক, সে আমার বিপদে-আপদে যে পরামর্শ দেয়ার চেষ্টা করত তার সেই চেষ্টাই ছিল আমার বুদ্ধির অধিক যথার্থ। আর তাই আমি বলি ওকে যতো মূর্খই আমি মনে করতাম না কেন ওর আত্মার গভীরে এমন একটা নির্বাস চেতনা ছিল যে চেতনা দিয়ে সে আমার মঙ্গল কামনা করত এবং যথার্থ সুপরামর্শ দিতে সক্ষম হতো। যাকে আমরা খ্রিস্টীয় নৈতিকতা বলে অভিহিত করি তার যদি অস্তিত্ব নাও থাকত তবু আমি মনে করি আমার এই সরল মেয়েটি যার নাম থেরেসি, সে খ্রিস্টীয় নৈতিকতার সবটাই সে পালন করত। সে তার আচরণে আচরণে অজানিতভাবে খ্রিস্টীয় নীতির প্রত্যেকটিই পালন করত।

কাজের মধ্যে যেগুলো গুরুত্বপূর্ণ নয় সেগুলোর ব্যাপারে তার কোনও অমান্যতা ছিল না।…তবে তার সব নৈতিকতার লক্ষ্য ছিল, মলিয়ে দ্য অ্যাভেলকে খুশি করা। সে একই দিনে ২০টা পুরুষের শয্যা সঙ্গিনী হতে পারত, তাতে তার বিবেকের কোনও দংশন ঘটত না। আমি এমন সব ধর্মীয়পুরুষকে জানি যারা এ বিষয়ে এর চাইতে অধিক কোনও বিবেকবোধে বিদ্ধ হয় না। থেরেসির ব্যাপারটা ছিল…

আমরা যখন আমাদের ভালবাসার পাত্রের সঙ্গে মিলিত হই, তখন আমাদের অনুভূতি কেবল যে আমাদের মনকেই নিয়ন্ত্রণ করে তা নয়, আমাদের অনুভূতি আমাদের হৃদয়কেও স্পর্শ করে। থেরেসির সঙ্গে আমার ভালবাসার সম্পর্ক আমার কলপনারও অধিক বলে আমি মনে করতাম। মানুষের মধ্যে ওকে আমি অতিমানুষ বা জিনিয়াস বলে গণ্য করতাম। আমার সারা জীবনটাই আমি ওর সঙ্গে কাটাতে পারতাম। এক বিকেলে আমি ঘরে ঢুকে একটি পত্র দেখতে পেলাম।…

আমি এর আগে কিছু বই কেনার কথা বলেছিলাম। এর মধ্যে কিছু বই আমি পড়েও ছিলাম। অবশ্য তাতে আনন্দের চাইতে আমি পরিশ্রম বোধ করেছি বেশি। পৃথিবী সম্পর্কে আমার ভুল ধারণার ফলে আমি মনে করলাম যে, আমার সংগৃহীত বই এর কোনও একটিকে যথার্থভাবে বুঝতে হলে আমাকে বুঝতে হলে, যে-বই আমি পাঠ করেছি সেই বই-এর লেখক বিশ্ব সম্পর্কে কোন্ ধারণার ভিত্তিতে এমন তিনি রচনা করেছেন। কাজেই এর কোনও একটি বইকে বুঝতে হলে সে বই-এর মূল ভিত্তিকে আমার বুঝতে হবে। যে বইটি আমি পড়ছি তার লেখক নিজেও যে তার বইতে উল্লিখিত সত্যসমূহ সম্পর্কে অজ্ঞ এমন কথা আমি ভেবেছি, তেমন হয়ত নয়। তবু তাকেও যে নানা বই থেকে তার বিশ্বাসকে সংগ্রহ করতে হয়েছে, এ বিশ্বাসে আমার পৌঁছা ছাড়া উপায় থাকেনি। এটা আমার মূর্খতা হতে পারে। তবু একখানার মূল উদ্ধার করতে কেবল দশখানা নয় আমাকে দশ দশটা তথা ১০০টা গ্রন্থাগার আমাকে তছনছ করতে হয়েছে। এই পাঠ পদ্ধতির ফলে আমাকে কেবল যে সময় নষ্ট করতে হয়েছে তাই নয়। এমন পরিশ্রমে দশ পৃষ্ঠা শেষ করার আগেই আমার মাথা ঘুরতে আরম্ভ করেছে। আমার এমন পদ্ধতি ছিল দস্তুর মতো মূর্খতা বিশেষ। ফলে বই-এর রাজ্যে আমাকে এক বই থেকে অপর আর এক বইতে ছুটতে হয়েছে। তবু পাঠের এমন পদ্ধতি আমি পরিত্যাগ করতে পারিনি। এমন মুখতার ফলে আমি কোনও কিছুর জ্ঞানই অর্জন করতে পারছিলাম না। ভাগ্য ভাল এক সময় আমি এমন মূর্খতার নিষ্ফলতাকে বুঝতে পেরে ওই পদ্ধতি আমি পরিত্যাগ করতে সক্ষম হলাম।

আসলে পরিশেষে আমি বুঝতে পারলাম যে, কেউ যদি কিছু শিখতে চায়, তাহলে তাকে প্রথমে এটা বুঝতে হবে যে, জ্ঞানের ক্ষেত্রে একটি অপরটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এই সংশ্লিষ্টতাই তাকে একটি থেকে আর একটিতে আকৃষ্ট করে। একটি জ্ঞান আর একটির জ্ঞান অর্জনে সাহায্য করে; মোটকথা তাকে এটা বুঝতে হবে জ্ঞানের রাজ্যে কোনও একটি জ্ঞান অপর একটি জ্ঞান থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। অবশ্য একথা ঠিক যে, কারোর পক্ষে সমগ্র বিষয়ের জ্ঞানকে আয়ত্ত করে সম্ভব নয়। তাকে কোনও একটি নিয়েই শুরু করতে হয়। কিন্তু অন্যান্য বিষয়ে যদি তার সংশ্লিষ্টতার বিশ্বাস না থাকে তবে দেখা যাবে যে পাঠক যা নিয়ে শুরু করেছে সে বিষয়টির ব্যাপারেও সে একেবারে অন্ধকারে ডুবে আছে। আমি বুঝতে পারলাম আমার লক্ষ্য বা ইচ্ছাটা খারাপ নয়, কিন্তু আমার শিক্ষার পদ্ধতিটি আমাকে পরিবর্তন করতে হবে।

এবার যথার্থই আমি আমার পদ্ধতি পাল্টালাম। এবার শুরুতে আমি এনসাইক্লোপিডিয়া বা বিশ্বকোষ ধরে শুরু করলাম। আমি অনুভব করলাম, সব এক সাথে শুরু না করে বিষয় হিসেবে আমাকে জ্ঞানের রাজ্যকে বিভক্ত করা উচিত নয়। এবার আমি তাই এক একটি বিষয় ধরলাম। আমি বুঝলাম, আমি যে বিষয়টি ধরেছি, তার শেষ না দেখা পর্যন্ত আমার কোনও বিষয়ান্তরে যাওয়া উচিত নয়। এভাবে আমি বিষয়ের সঙ্গে বিষয়ের সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারটি কিছুটা ধরতে পারলাম। এবার জ্ঞানের জায়গাতে আমার অবস্থান হলো ধ্যানের ক্ষেত্রে। আমার এই চিন্তাটা আমাকে বেশ পরিমাণে সাহায্য করল। এবার আমি বুঝলাম আমি বাঁচি কিংবা মরি, সময় নষ্ট করার কোনও সময় আমার নেই। না, আমি দমিত হলাম না। এ কথা আমি বুঝলাম ২৫ বছর বয়সেও আমি যথার্থই কিছু জানিনে। তবু আমাকে জানতে হবে, সবকিছুকে জানারই আমার ইচ্ছা থাকতে হবে। তার পরিণতি তাতে আমার জন্য যাই হোক না কেন।

এই পদ্ধতির অনুসরণে আমি যথার্থই লাভবান হলাম। এবার আমি আমার সময়ের বৃথা ব্যয় না করে, আমি এবার আমার সময়ের সদ্ব্যবহার করতে শিখলাম।…

এবার আমি দেখলাম, কোনও একটাতে অনির্দিষ্টকাল আছে থাকার পরিবর্তে বিষয়ের পরিবর্তন আমাকে কোনও একটাতে আবদ্ধ থাকার একঘেয়েমি থেকে যেন মুক্তির পথ নির্দিষ্ট করে দিল।

এতদিন যখন আমি কোনও একজন লেখকে আবদ্ধ থাকতাম তখন একটু পরেই আমি ক্লান্ত হয়ে পড়তাম।

এবার দেখলাম বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করার আমার এ এক লাভ হলো যে, কোনও একটা বিশেষ বিষয়ে আবদ্ধ থাকার ক্লান্তি থেকে যেন আমি মুক্তি পেলাম। আমার পাঠের পদ্ধতির এই পরিবর্তন আমাকে উৎসাহিত করল। এবার বাড়ির বা বাগানের কাজকর্মকে যেন আমার পাঠের অংশ হয়ে দাঁড়াল। আবার আমার পাঠের আগ্রহ যত বৃদ্ধি পেল, আমি পড়াশোনার জন্য অধিকতর সময় ব্যয় করার কৌশলও আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়ে উঠতে লাগলাম।

আমার পাঠের এই যে খুঁটিনাটি আমি আমার পাঠকদের সামনে তুলে ধরছি। আমি জানি আমার পাঠকবৃন্দ এতে বিরক্ত না হয়ে পারেন না। আর সব যে খুলে বলছি, তাও নয়। কিছুটা রাখঢাক আমাকে করতেও হচ্ছে। আর যা আমি বলছিনে তার যদি একটু উল্লেখ আমি না করি তাহলে আমার পাঠকরা আদৌ বুঝবেন না যে আমার গোপন করারও কিছু আছে। এখানে একটা কথা বলা আবশ্যক যে, আমি যখন কোনও কারণে আমার পুস্তকাদি পাঠ একেবারে বন্ধ করে দিতাম সেই সময়টায় যে যন্ত্রণা আমি বোধ করতাম, এমন যন্ত্রণার তুলনা আমার জীবনে আর আমি খুঁজে পেতাম না। আমার জীবনের এই পর্যায় যেভাবে আমার সময়কে ভাগ করে ব্যয় করতাম, আমার সেই কৌশলকে আজ স্মরণ করতে আমার মনে অপার আনন্দের সঞ্চার হচ্ছে। আমার মনে কোনও কারণে আমার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেলে আমার মনে এমন অলসতা আর আবদ্ধতা এবং একঘেয়েমির একই বোধ সৃষ্টি হত যার তুলনাও আমার জীবনে খুব কমই খুঁজে পেতাম। এমন পর্যায়েই আমার শরীর ভেঙে পড়ত সবচেয়ে বেশি। আমার জীবনের নিজস্ব ধারাকে অনুধাবন করার চেষ্টায় মাঝে মাঝেই দুই মাস এমন কি তিনমাসও নষ্ট হয়ে যেত। আমার উল্টা-পাল্টা জীবন যাপনে আমি যে কেবল কষ্টই পেতাম, তাও না। এমন ধারায় আমি যেন জীবনের অজানা আর একটা দিককে ভোগ করে আনন্দও লাভ করতাম। কাজেই কেবল কষ্ট নয়, একটা বিশেষ আনন্দময় সামাজিকতাবোধও যেন আমি আমার এমন উল্টাপাল্টা জীবন-যাপন থেকে লাভ করতাম। আমি মনে করতাম আসলে জীবনটা যথার্থই এত খারাপ নয়, যতটা খারাপ আমি মনে করি। আর তাই বলি শেখার কষ্টকর চেষ্টাও আমার বিত্রস্ত জীবনকে আনন্দে পূর্ণ করে তুলত।

আমার এই সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা এবার বরং বাদ দিই। এদের বাদ দেয়া ছাড়া আমার উপায়ও নেই। কারণ এগুলো প্রকৃতিগতভাবেই অবর্ণনীয় রূপে সরল ছিল। আসলে জীবনের যথার্থ আনন্দ একেবারেই অবর্ণনীয়। এটা কেবল যার জীবন সেইই উপলব্ধি করতে পারে। অপর কেউ নয়। আর এই উপলব্ধির প্রকৃতি যত শক্তিশালী হয়, তাকে বর্ণনা করার ক্ষমতা আমার পক্ষে বটেই, ভুক্তভোগী অপর যে কারোর পক্ষেই বর্ণনার অতীত এবং আর কিছু নয়। আমি নিজে এমন অনুভূতিকে যেমন বিস্মৃত হতে পারিনে তেমনি যতবার ইচ্ছা ততবার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে মনের মধ্যে তুলেও আনতে পারিনে। শেষপর্যন্ত যখন দেখলাম আমার পরিবর্তনশীল এমন বোধ ক্রমান্বয় একটা নির্দিষ্ট আকার যেন লাভ করছে, তখন আমার জীবনের সময়ের বিভাগটাকে আমি নিম্নোক্তভাবে বর্ণনা করতে পারি। প্রত্যেক দিন সকালে সূর্য ওঠার আগে আমি শয্যা ছেড়ে উঠতাম এবং কাছের একটা বাগানের আঙ্গুর বাগানের মধ্য দিয়ে চেম্বারি বলে অভিহিত পার্বত্য জায়গাটিতে উঠতাম। সেখানে উঠে আমি আমার প্রার্থনার কাজ সম্পন্ন করতাম। আমার সে প্রার্থনা কেবল আমার ওষ্ঠদ্বয়ের সঞ্চারণে সীমাবদ্ধ থাকত না। আমার প্রার্থনা নিবেদিত হতো স্রষ্টা আমার চোখের চারপাশে সৌন্দর্যের যে আকর তৈরি করে রেখেছেন আমার প্রার্থনা নিবেদিত হতো তারই উদ্দেশে। আমি কোনও ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠের মধ্যে আমার প্রার্থনা সম্পন্ন করতাম না। তেমন হলে চারপাশের ক্ষুদ্র মানুষের ক্ষুদ্র সৃষ্টিসমূহ যেন আমার অস্তিত্ব এবং ঈশ্বর এই দু-এর মধ্যখানে এক ব্যবধানের সৃষ্টি করত। আমার ঈশ্বর বলে যদি কিছু থাকে তবে আমি তাকে তার সৃষ্টির মধ্যেই কল্পনা করতে ভালবাসি। তখন আমার আত্মা আমার সেই ঈশ্বরের প্রতি উদ্বাহু হয়ে যেন উত্থিত হয়। আমি তোক যাই হই না কেন এ কথা বলতে আমার সঙ্কোচ নেই যে, স্রষ্টার প্রতি আমার প্রার্থনায় কোনও কৃত্রিমতা থাকতো না। আর সে কারণে আমি যে কাউকে বলতে পারি আমার প্রার্থনার উচ্চারণকে আবার শ্রবণ করতে হবে। আমার নিজের কথা বললে যেন, আমার জন্য তেমনি আমার ভালবাসার পাত্রীর জন্য আমার প্রার্থনা থাকত একটি পবিত্র জীবনেরই কামনা করতাম। একটি পবিত্র এবং প্রশান্ত জীবন। একটি বিশুদ্ধ জীবন সর্বপ্রকার দুঃখ কষ্ট, দুষ্টতা, অভাবের আর্তিহীন এক জীবন। আমার প্রার্থনা হতো যেন আমি এবং আমার ভালো পাত্রী দুজনেই ন্যায়ের জীবনের অন্তিমে পরকাল বলে যদি কিছু থাকে তবে সেখানে গমক করতে পারি। এছাড়া আমার প্রার্থনার মধ্যে তুচ্ছাতিতুচ্ছ কোনও পার্থিব বস্তু থাকত না। কারণ আমার এই বিশ্বাস ছিল যে, আমার সকলের জন্য যিনি তার দেয়কে দিয়ে থাকেন তা তিনি আমাদের নয়, তা আমরা লাভ করি আমরা তার উপযুক্ত বলে তিনি মনে করেন বলে বাইরের এই প্রার্থনা এবং প্রত্যাবর্তন ঘটত আমার নানা পথে। ফিরে আসার সেই পথেও আমি প্রকৃতি সৌন্দর্যবোধে আমার কোনও শেষ থাকত না। একটু দূর থেকে আমার চোখের অম্বেষণের প্রশ্ন থাকত, আমার মাতৃবৎ আআর মামার দরজাটি খোলা কী-না এবং যদি আমি দেখতাম তার দ্বার উন্মুক্ত তাহলে আর আমার অবধি থাকত না। আমি তাকে লক্ষ্য করে ছুটে যেতাম।ত তার দরজা যদি ভোলা না থাকত তবে পেছনের বাগানের মধ্য দিয়ে দেখতে চাইতাম। মামার দরজা তখনও মুক্ত হয়েছে কিনা। তার দরজা না উন্মুক্ত হওয়া পর্যন্ত আমি সতৃষ্ণ নয়নে তার দরজার দিকে তাকিয়ে থাকতাম।

তার দরজা যখন খুলে যেত আমি তখন ছুটে গিয়ে লুটিয়ে পড়তাম? হয়ত তখনও তিনি শয্যায় শায়িত থাকতেন-তবু তার অর্ধমুক্ত চোখ দুটোকে আমার ভালবাসার চুম্বনে ভরে দিতাম। আমার সে চুম্বন ছিল যে কোনও প্রকৃতির ঊর্ধ্বে শ্রদ্ধায় পূর্ণ। আমরা সাধারণত সাদা কফি দিয়ে প্রাতরাশ সমাপ্ত করতাম। তখন আমাদের হাতে অন্য সময়ের চেয়ে অধিকতর সময় মিলত। আমরা সকলে মিলে গালগল্পে মেতে উঠতাম। এই সময় থেকেই প্রাতরাশের প্রতি আমার একটা আকর্ষণ সৃষ্টি হলো। তুলনা করলে আমাদের এমন প্রাতরাশ-এর চাইতে ইংল্যান্ড এবং সুইজারল্যান্ডে প্রচলিত প্রাতরাশ উত্তম ছিল। ইংল্যান্ড এবং সুইজারল্যান্ডে সকালের ব্রেকফাস্ট দস্তুর মতো একটা ভোজনের মতো ছিল। এমন খাবার টেবিলে গৃহের সবাই এসে উপস্থিত হতো। এটা আবার ফরাসিদের কায়দার চাইতে একেবারে ভিন্ন হতো। ফরাসিরা সকালের নাশতা যার যার ঘরে বসে একা একা সম্পন্ন করত। অনেক সময়ে ফরাসিদের মধ্যে প্রাতরাশের কোনও প্রথারই প্রচলন দেখা যেত না।

প্রাতরাশের আড্ডার গাল-গল্প শেষ করে আমি আমার পড়ার ঘরে চলে যেতাম এবং সেখানে মধ্যাহ্ন ভোজ পর্যন্ত আমার সময় কাটাতাম। এই পর্যায়ে আমি আমার পাঠ শুরু করতাম দর্শন দিয়ে। এর মধ্যে থাকত পোর্ট রয়াল-এর লজিক, জনলকের ‘এসে’ বা নিবন্ধে, লাইবলিজ অথবা দেকার্ত। এদের নাড়াচাড়া করতে করতে আমি দেখলাম, এরা কেউ কারোর সঙ্গে মেলে না : এদের প্রত্যেকে যেন অপর সকলের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে। তাদের এমন পারস্পরিক ভিন্নতা দেখে আমি ভাবতাম, আমি দেখি না এদের সবাইকে আমি ঐক্যবদ্ধ করতে পারি কী-না। আমার এমন চিন্তা আসলে অবান্তরই ছিল আর এমন চেষ্টায় যেমন নিষ্ফলভাবে আমার পরিশ্রম ব্যয় হতো তেমনি আমার সময় নষ্ট হতো। তাছাড়া এর ফলে আমার মাথা ঘুরতে থাকত আর আমি আমার এমন কাজে বিন্দুমাত্র অগ্রসর হতে পারতাম না। শেষপর্যন্ত আমি আমার এমন চেষ্টা করা ছেড়েই দিলাম। এরপরে বরং আমি একটা ভাল পদ্ধতির সন্ধান পেলাম। এর ফলে আমার তেমন বিদ্যা-বুদ্ধি না থাকলেও আমি নিষ্ফল হলাম না। এ কথা অবশ্য বলার অপেক্ষা রাখে না যে পড়াশোনায় আমার তেমন দক্ষতা কখনই ছিল না। এবার আমার পদ্ধতি হলো সকলকেই আদ্যোপান্ত পাঠ করা এবং কারোর সঙ্গে তর্কাতর্কি বা ঝগড়া-বিবাদ না করা। আমি বরং তাদের প্রত্যেককে আপন আপন বিশ্বাসে বিশ্বাসী থাকতেই উৎসাহিত করতাম, সকল প্রকার বিতর্ক পরিত্যাগ করে। আমার পদ্ধতিটা ছিল এরূপ যেন আমার পুঞ্জিভূত সকল পন্ডিতকে একত্র করে তাদের প্রত্যেককে বলা; হ্যাঁ, আপনারা যে যা বলছেন, সবই ঠিক বলছেন। আসুন আমরা ঝগড়া ছেড়ে দিই এবং প্রত্যেকে প্রত্যেককে স্বীকার করি। আমি তাদের সবাইকে লক্ষ্য করে বলতাম, এতে আমার কী ক্ষতি। আমার এমন পদ্ধতি বা কৌশলের যে সীমাবদ্ধতা বা ত্রুটি-বিচ্যুতি বা কৌশলের যে সীমাবদ্ধতা বা ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল না তা নয়। এ কথা আমি বুঝি। তবু এর লাভেরও একটা দিক তো ছিল। আমার পাঠের একটা গতি সৃষ্টি হতো। কোথাও তো আমি নোঙর গেড়ে বসে থাকতাম না। এর আগে তো কতো পন্ডিতকে আমি পাঠ করেছি, আমি সবাইকেই অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি : অবশ্য তাদের কারোর সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক না করে, যুক্তির ক্ষেত্র বিচার না করে।

আমি দেখলাম, আমার আত্মশিক্ষার এই কৌশল বিফল হয়নি। আমার প্রাণের ভাণ্ডার যে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাও আমি বুঝলাম। এমন ক্ষেত্রে অগ্রসর হতে আমার আর অপর কোনও পন্ডিতের সাহায্যের প্রয়োজন পড়ল না। তারপরে আমার স্বোপার্জিত জ্ঞান ভাণ্ডারকে যুক্তির পাল্লায় পরিমাপ করার চেষ্টা করলাম এবং এদের মধ্যে এবার আমি পছন্দ-অপছন্দতেও দক্ষ হয়ে উঠলাম। কাউকে ভাল বললাম, কাউকে যুক্তির পাল্লা থেকে শ্রেফ ছুঁড়ে ফেললাম। আমি এই পদ্ধতিতে হিসাব করে দেখলাম, এতে আমার কোনও লোকসান হয়নি। আমার বিশ্লেষণের দক্ষতার কোনও হাস ঘটেনি। আসলে আমার নিজস্ব এই পদ্ধতিটি অনেক আগেই গ্রহণ করা দরকার ছিল। হ্যাঁ, আরম্ভটা দেরিতে হয়েছে। কিন্তু তাতে ক্ষতিটা কী ঘটেছে? এবং আমার এই জ্ঞান ভাণ্ডার যখন প্রকাশ করলাম তখন যে যাই বলুক না কেন, কেউ এমন কথা বলতে পারল না যে অপর কারো চিন্তাকে আমি নকল করেছি বা চিন্তার ক্ষেত্রে কারোর দাসতৃপনা করেছি। আমি পিথাগোরাস হইনি যিনি তার গুরু তথা শিক্ষক থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি। তার গুরু যা বলেছেন তিনিও অবিকল তাই-ই বলেছেন।

.

তথ্য সূত্র

১. এমিলি : রুশোর আর একটি বিখ্যাত গ্রন্থ। এমিলির মূল বিষয় হচ্ছে শিক্ষার ব্যাপারে রুশোর

২. ইনকুইজিশন : মধ্যযুগের ধর্মীয় বিচার; যার পরিণামে অভিযুক্তকে খুঁটিতে বেঁধে পুড়িয়ে মারা হতো।

৩. SA Angustine (A. D. 354-430) খ্রিস্ট ধর্মের সন্তু বা ঋষি।

৪. St. Svegory: খ্রিস্ট সন্তু বা ঋষি : pope (৫৪০-৬০)।

৫. এমিলি : শিক্ষার ওপর রচিত রুশোর অপর একখানি বিখ্যাত গ্রন্থ।

৬. Alphens and Arethusa.

৭. Horace 65-08Bc: খ্রিস্টপূর্বাব্দের সমাপ্তিকালে রোমান সাহিত্যের সবচেয়ে বিখ্যাত, অনূদিত এবং বিশেষভাবে উদ্ধৃত কবি।

৮. রুশো তার এবং মাদামের এই বনবাসের সময়ের উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন : ১৭৩৬। রুশোর জন্ম হয়েছিল জেনেভায় ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে। তাই কাহিনীর উল্লিখিত সময়ে রুশোর বয়স ছিল ১৭১২-১৭৩৬।

৯. পিথাগোরাস (৫৮০-৫০০ খ্রি: পূ:) পাইথাগোরাস বা পিথাগোরাস : একজন প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক। অঙ্ক এবং জ্যোতিষ শাস্ত্রের বিকাশে পিথাগোরাসের অনুসারীদের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পিথাগোরাসের মতে, বিশ্ব অস্তিত্বের মূল হচ্ছে সংখ্যা।

১০. জ্যাকোবাইট : ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় জেমস-এর সমর্থক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *