ষষ্ঠ পুস্তক [১৭৩৮]

ষষ্ঠ পুস্তক [১৭৩৮]

এ পর্যন্ত যা বলেছি, তার পরে আর একটু বলি। যা আমি এ পর্যন্ত জীবনে পেয়েছি তার চেয়ে আর অধিক পাওয়ার কী ছিল। মাদাম ওয়ারেন্স-এর সম্পত্তিরও আমার প্রয়োজন ছিল না। যা পেয়েছি তার আনন্দেরই কোনও তুলনা নেই। একথা আমি আগেও বহুবার বলেছি এবং অনুভব করেছি যে, স্বামী-স্ত্রী : বা প্রেমিক-প্রেমিকা : এদের পারস্পরিক প্রাপ্তি অনুভূতি অভিন্ন নয়। ব্যক্তি হিসেবে এক ব্যক্তির নয়। অভিন্ন ব্যক্তির নয়। বিভিন্ন সত্তার।

এই পর্যায়ে আমার জীবনের স্বল্পস্থায়ী সুখের একটি পর্ব শুরু হলো : একথা আমি বলতে পারি। আমি বলতে পারি, হ্যাঁ, আমি জীবন ধারণ করেছি : এই পর্বটিতেই ঘটেছে আমার জীবনের যেমন মূল্যবান ঘটনা, তেমনি দুঃখজনক ঘটনা। জীবন যেন আমাকে বলল; যাও এবার ছোট। দেখি তুমি কতদূর যেতে পার। এগিয়ে তবে ধীরে, আস্তে। অস্থিরতার কী আছে। আমার স্মৃতি এই পর্যায়টি সত্যই যেন মধুময়। এ পর্বটির কথা যেমন আমি দ্রুত বলে শেষ করতে চাইনে, তেমনি ধীরলয়ে বলেও অশেষ করে তুলতে চাইনে। ব্যাপারটা আসলে তাই। বিষয়টা যদি কেবল কতগুলো ঘটনার হতো। কোনও কর্মকাণ্ড বা শব্দময় কাহিনী হতো তাহলে আমার বলতে কোনও অসুবিধা হতো না এবং তাকে আমার পাঠকদের কাছে অর্থময়ও করে তুলতে আমি সক্ষম হতাম। কিন্তু ব্যাপারটা যখন না ঘটনা, না শব্দের মাধ্যমে বলা কোনও কাহিনী, যার অস্তিত্ব আমার চিন্তার মধ্যেও ছিল না, ছিল কেবল আমার অনুভূতির মধ্যে, আমার আনন্দের মধ্যে, তাকে আমি কীভাবে প্রকাশ করি।

হ্যাঁ, সূর্য উদয়ের সঙ্গে আমি উঠেছি। সেও আমার এক আনন্দ ছিল। আমি বাগানে বেড়াতে গেছি : সেটাও আমার একটা আনন্দ ছিল। আমি মামাকে দেখতে গেছি। মামাকে দেখতে পেয়েছি, তাও এক অসীম আনন্দের বিষয়। আমি তাকে একটু দেখে চলে এলাম। সেটাও আমার একটা আনন্দ। বনের মধ্যে দিয়ে আমি দৌড়েছি, পাহাড়ের চূড়ায় উঠেছি, আমি বই পড়েছি, তাতেও আনন্দ পেয়েছি। বাগানে কাজ করেছি, তাতেও আনন্দ পেয়েছি। গাছ থেকে আমি ফল পেরেছি। ঘরের কাজে সাহায্য করেছি, তাতেও আনন্দ পেয়েছি। আমি যা কিছু করেছি বা না করেছি, সবই ছিল আমার আনন্দের উৎস। সবই ছিল আমার আনন্দ। সে আনন্দের কোনও বর্ণনা নাই। তাকে আমি কোনও সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করতে পারিনে। সে আনন্দের কোনও বাইরে অস্তিত্ব ছিল না। তার সবটাই ছিল আমার অন্তরের মধ্যে। আর তাই সেই পর্বটিতে আমার এমন কোনও মুহূর্ত ছিল না যখন আমি আনন্দময় ছিলাম না। যখন আমার অস্তিত্বটা আনন্দ ব্যতীত আর কিছু ছিল : না আর কিছু ছিল না। আনন্দের অস্তিত্ব। অস্তিত্বের আনন্দ। আনন্দহীন মুহূর্ত বলে তখন আমার কিছুই ছিল না।

সেই আনন্দময় সময়ে আমি যা কিছু করেছি, যা কিছু বলেছি : তার কোনও কিছুই আমার স্মৃতি থেকে তলিয়ে যায়নি। এর আগে এবং পরে যা কিছু ঘটেছে সবই আমার মনে উদিত হয়। সব যে তেমন স্পষ্ট তা নয়। তবু সমগ্র সময়টাকেই আমি স্মরণ করি। স্মরণ করার চাইতেও মনে হয় যেন আমি সেই স্মৃতির মধ্যেই বাস করছি। সেই স্মৃতিতেই আমার অস্তিত্ব, আমার কৈশোরে আমি ভবিষ্যতের পানে তাকিয়েছি। কিন্তু এখন আমি তাকাই কেবল আমার অতীতের দিকে। অতীতের এই স্মৃতি অতীতে আমি যা কিছু হারিয়েছি তার সব ঘাটতি যেন পূরণ করে দিচ্ছে। এখন আর আমি ভবিষ্যতের দিকে তাকাইনে। ভবিষ্যৎ আমাকে কী দেবে। তাৎক্ষণিকভাবে সে আমাকে কী দেয়। কিন্তু অতীতের দিকে তাকালে আমি সব দেখি, সব পাই। সব কিছুকেই আমি অন্তর দিয়ে স্পর্শ করতে পারি। বর্তমানে আমার দুর্ভাগ্য যাই-ই হোক না কেন, যে সময়ের কথা আমি বলছি, সে সময়ের দিকে তাকালে আমার আর সুখের অন্ত থাকে না।

এখানে আমি আমার স্মৃতির একটা ঘটনার কথা বলি। তা থেকে আমার মনের তখনকার অবস্থার কথা বেশ একটু স্পষ্টতার সঙ্গে বুঝতে পারা যাবে। প্রথম দিন যখন আমরা লা চারমেটাতে ঘুমাতে যাই সেদিন মামা একটা পালকিতে ছিলেন। মামার পালকি সামনে, আমি পেছনে। রাস্তাটা উঁচুর দিকে ছিল। মামার দেহের ভারে পালকির বাহকদের কষ্ট হবে এই ভেবে তিনি পালকি থেকে নেমে পড়লেন। তখনও আমরা অর্ধ পথে। মামা বললেন, বাকি পথ আমরা হেঁটে যাবো। মামা যখন হাঁটছিলেন তখন তিনি একটা ফুলের রঙের দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখো কী সুন্দর এর রঙ। আমি এমন রঙ আগে দেখিনি। আমি লম্বা ছিলাম না। তাই মাটি থেকে তা দেখতেও পাইনি। আমি ঘটনাটা ভুলে গিয়েছিলাম। তারপর কত দিন মাস পেরিয়ে গেছে। শুধু তাই নয়। প্রায় ত্রিশ বছর পরে একটা ফুলের রঙ দেখে আমি চমকে উঠলাম। আমি চীৎকার করে বললাম : এই যে প্রিউঙ্কিল। আমার সঙ্গী দুপেরুও দেখল। কিন্তু আমার এমন। উচ্ছ্বসিত আনন্দের কারণ তিনি তখন উপলব্ধি করতে পারেননি। আজ এই কাহিনী পাঠ করলে তিনি আমার উচ্ছ্বাসের কারণ বুঝতে পারবেন।

কিন্তু এ জায়গার আবহাওয়ায় আমার স্বাস্থ্যের অবস্থার কোনও উন্নতি ঘটল না। আমি যেমন নিস্তেজ ছিলাম, যেন তার চেয়েও বেশি নিস্তেজ হয়ে পড়তে লাগলাম। দুধও আমার সহ্য হলো না। ফলে দুগ্ধপান করাও আমি ছেড়ে দিলাম। সে কালে যে কোনও শারীরিক উপসর্গ নিরাময়ের জন্য জুল চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল। আমি সেই চিকিৎসাই জোরে সোরে শুরু করলাম আর তাতে আমার রোগের এমন শেষই হতে লাগল যেন আমার জীবনেরই শেষ হয়ে গেল। রোজ সকালে ফোয়ারার কাছে যাওয়ার সময়ে আমি বিরাটাকারের একটা জলের বাটি নিয়ে যেতাম। এবং হাঁটতে হাঁটতেই বাটির পরে বাটির জল পান করে ফেলতাম। আগে খাবারের সময়ে মদ্য পান করতাম। এই মদ্য পান আমি একেবারে ছেড়ে দিলাম। বরং মদের চেয়ে পাহাড়ি এই জল খাওয়া অধিক কষ্টকর হয়ে দাঁড়াল। ফলে দু’মাসের মধ্যে আমার পাকস্থলীকে আমি প্রায় শেষ করে ফেললাম। আর এর আগে আমার পাকস্থলীর অবস্থা বেশ ভাল ছিল। কিন্তু এখন আর কোনও খাবারই আমি হজম করতে পারলাম না। এবার আমি নিরাময়ের সব আশাই ছেড়ে দিলাম। এই সময়ে আমার শরীরে একটা ঘটনা ঘটল যার ফল যেমন অদ্ভুত ছিল, তেমনি আমার মৃত্যু পর্যন্ত যে তাকে আমার বহন করতে হবে তা বুঝতেও আমার অসুবিধা হলো না।

এক সকালে ছোট একটা টেবিলকে তার চার পায়ের ওপর দাঁড় করাবার চেষ্টা করতে গিয়ে আমার শরীরে আমি একটা অসম্ভব ব্যথা বোধ করলাম। আমি এটাকে শুধু এই বলে বুঝাতে পারি, আমার মনে হলো যেন আমার দেহের রক্তে যেন একটা বড় ঝড় বয়ে গেল এবং মুহূর্তে আমার সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেন তার তাণ্ডবে অস্থির হয়ে পড়ল। আমার রক্তের শিরাগুলো এমনভাবে কাঁপতে শুরু করল যে, আমি সেই কম্পন কেবল যে বোধ করতে লাগলাম, তাই নয়। সে কম্পনের শব্দ যেন আমি নিজের কানে শুনতে পেলাম। বিশেষ করে আমার ঘাড়ের ধমনীর এ অবস্থা হলো। এর সাথে আবার আমার কানের মধ্যেও তিন চার রকমের শব্দ হতে লাগল : একটা চাপা, অপর একটা ভারী। আর একটা হয়ত জলস্রোতের শব্দের মতো। ধমনীর ওঠা-পড়ার শব্দ সেগুলোকে হাত দিয়ে না ধরেও আমি শুনতে পেলাম। আমার নাড়ীর স্পন্দনের মতো, আমার শরীরে হাত না দিয়েই যেন শুনতে পেলাম। এটাকে যদি আমি আমার শরীরের ভেতরের শব্দ বলি তাহলে সে শব্দের ওজন এমন হলো যে তার জন্য আমার অপর কোনও কোমল শব্দ শোনা যেন অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। এক সময়ে সূক্ষ্ম শব্দ শোনার যে ক্ষমতা আমার ছিল, সে ক্ষমতা আমার আর রইল না। ফলে আমি একেবারে বধির না হলেও আমি কানে কম শুনতে লাগলাম। আজ পর্যন্ত আমার শোনার ক্ষমতার সেই হ্রাসপ্রাপ্তি দূর হয়নি। এখনো তা আমার একটা রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে : কানে খাটো। এতে আমার মনে যে বিস্ময় এবং ভীতির সৃষ্টি হলো তা কেবল আমি আন্দাজ করতে পারি। আমার মনে হলো আমি যেন মরে যাচ্ছি। আমি বিছানায় শুয়ে পড়লাম। আমার অবস্থায় চিন্তিত হয়ে কাছের লোকজন ডাক্তার ডাকল। আমি ডাক্তারকে আমার অবস্থা বলার চেষ্টা করলাম। আমার গলাতে কাঁপুনি দেখা দিল। আমার মনে হলো এ আমার মরণ রোগ দেখা দিয়েছে। এবার আমার নির্ঘাত মৃত্যু ঘটবে। আমার মনে হলো ডাক্তারও তাই ভাবছে। সে তার ডাক্তারি ব্যাখ্যায় তাই ভাবছে। সে তার ডাক্তারি ব্যাখ্যায় কার্পণ্য করল না। তার কথার কিছুই আমি বুঝতে পারলাম না। সে তার শাস্ত্রমত এবার আমার ওপর ‘এ্যাকিমা’ প্রয়োগ শুরু করল। তার দেয়া এই দাওয়াই আমার জন্য এত যন্ত্রণাদায়ক আর জঘন্য এবং নিষ্ফল হলো যে আমি এতে অল্প সময়ের মধ্যে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। এমনিভাবে কয়েক সপ্তাহ পার হলো : আমার রোগের কোনও হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটল না। আমি তাই শুয়ে থাকার বদলে উঠে বসলাম এবং দিনাদিনের স্বাভাবিক কাজ কর্ম করতে শুরু করলাম। আমার ধমনীর অস্বাভাবিক ওঠানামার কোনও উপশম হলো না। মাথার মধ্যেও একটা বাজনার মতো শব্দ হতে লাগল। আমার ধমনীর এমন কম্পনের আজ পর্যন্ত অন্তত গত ত্রিশ বছরে কোনও উপশম ঘটেনি। এক মিনিটের জন্যও নয়।

এর আগে আমার নিদ্রার কোনও ব্যাঘাত ছিল না। কিন্তু এখন ঘুম কাকে বলে তা আর আমি জানলাম না। এই সমস্ত উপসর্গের সঙ্গে এবার যুক্ত হলো পুরো নিদ্রাহীনতা। আজ পর্যন্ত আমি জানিনে ঘুম কাকে বলে। এবার আমি বুঝলাম, আমার জীবনের আর বেশি বাকি নেই। এই চিন্তা থেকে কোনও উপসর্গেরই কোনও নিরাময়ের চেষ্টা করলাম না। আমার বাঁচার আর সময় নেই, এই বোধ থেকে আমি স্থির করলাম, তাহলে আর কোনও চিকিৎসার কথা ভেবে লাভ কী? বরং জীবনের যে সময়টুকু বাকি আছে সেটুকু যতটুকু ভালভাবে পারি ততটুকু ভাল থাকার চেষ্টা কেন করিনে? এই পর্যায়ে আমার গায়ের ব্যথা যেন কিছুটা হ্রাস পেল এবং আমি সাধারণ কাজ কর্ম করতে সক্ষম হতে লাগলাম। একমাত্র মাথার মধ্যকার শব্দটার শেষ হলো না। তবে শব্দটাতে তেমন কোনও বেদনা বোধ হলো না। ব্যথা বোধ হলো না। কেবল নিদ্রাহীনতার কোনও উপশম হলো না। রাতে আর ঘুম হতো না। তার সাথে শ্বাসকষ্টও আবার স্থায়ীভাবে চলতে লাগল। পুরো ‘অ্যাজমা’ নয়। এটা শুরু হতো যখন একটু দৌড়াবার চেষ্টা করতাম কিংবা কোনও পরিশ্রমের কাজ করতে চাইতাম।

এটা দুর্ঘটনাই বটে। এর ফলে আমার মৃত্যু ঘটতে পারত। কিন্তু তা হলো না। বরং এর ফলে আমার ভেতরের সব কাম, উত্তেজনা একেবারে নিভে যেতে লাগল। এ জন্য এরপর থেকে রোজ আমার ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই তার এমন কৃপার জন্য। এই পর্যায়ে আমার মনে হলো যেন আমি সত্যিই মরে গেছি। আবার জন্ম না নেয়া পর্যন্ত আর আমার জীবন হবে না। এবার আমি একটা হিসাব করতে লাগলাম, যা গেছে তা গেছে। যিনি গেছে তার যেমন হিসাব দরকার, তেমনি সামনে উত্তম কাজ আমাকে কী কী করতে হবে তাও আমি স্থির করতে লাগলাম। আমাকে এখন সেই সব কাজই করতে হবে যে সব কাজ আমার এর পূর্বে করা প্রয়োজন ছিল অথচ আমি তার কোনওটা করিনি। ধর্মের ব্যাপারে, কিংবা বলা চলে ধর্ম নিয়ে আমি গুরুতর কোনও চিন্তা না করে কেবল বাঁচালতা করেছি। এর একটি ভাল ফল এই হলো যে অনেকের ক্ষেত্রে যেমন ধর্ম বিশ্বাস থেকে প্রয়োজনে অবিশ্বাসে প্রত্যাবর্তন করতে অসুবিধা ঘটে আমার তেমন কিছু ঘটল না। কিন্তু আবার এমন আছে যারা বিশ্বাসে প্রত্যাবর্তনে যেমন আনন্দ লাভ করে তেমনি একটা সান্তনাও। আমার মামার কাছে আমার এই এক কৃতজ্ঞতা যে, যে কাজ পৃথিবীর কোনও ধর্মবিশ্বাসী বা ধর্মীয় গুরু আমার জন্য করতে পারতেন না, মামা আমার জন্য তাই করলেন। সব কিছু বিচারের তার একটি ধারা ছিল। সব কিছুকেই যেন তিনি একটা নিয়ম বা শেকলে বাঁধতে পারতেন। ধর্মকেও তিনি এ চোখেই দেখতেন। অবশ্য তার এমন বিশ্লেষণে কোনও কিছুই বাদ পড়ত না। তার চিন্তায় সব কিছুরই জায়গা হতো। এর মধ্যে এমন কিছু থাকত যার মধ্যে যুক্তিতর্কের অভাব হতো না। তাৎপর্যের অভাব ঘটত না। আবার এমন অনেক বিষয়ও থাকত যারা ছিল মূর্খতার অশেষ। তার মুখে যেমন ছিল তার চরিত্রের একটা বৈশিষ্ট্যই তেমনি আবার এর অনেক কিছুর মূলে ছিল তার শিক্ষা প্রাপ্তির ব্যাপার, নানা কুসংস্কারের শিক্ষা।

সাধারণভাবে বিশ্বাসীরা তাদের বিশ্বাসের পাত্র বা পাত্রীকে নিজের প্রতিকৃতিতেই কল্পনা করে। যে উত্তম সে তার ঈশ্বরকে উত্তম আকারেই চিন্তা করে। যে অসৎ, যার চরিত্র অসৎ সে তার ঈশ্বরকে তেমন গুণেই গুণান্বিত মনে করে। যারা গোড়া একগুঁয়ে তারা তাদের ঈশ্বরকে তেমনি গোঁড়া আর খিটখিটে বৈ আর কিছু ভাবতে পারে না। তাদের চোখে কেবল নরকই ভেসে ওঠে, কারণ তারা সমস্ত পৃথিবীটাকেই ঘৃণ্য বলে গণ্য করে। অপরদিকে যে মানুষ শান্ত, ধীর স্থির, প্রেমময় তার পক্ষে ঈশ্বরকে অপর কিছু ভাবা আদৌ সম্ভব হয় না। টেলিমেকাসের মধ্যে উত্তম ফেনিলন কেমন করে খারাপ কিছু ভাবতে পারে তা আমি বিশ্বাস করে উঠতে পারিনি। অথচ ফেনিলনের প্রকাশে মনে হয় যেন সে এমন প্রকৃতিকে যে যথার্থই বিশ্বাস করে। আমার মনে হয় সে নিশ্চয়ই এ ক্ষেত্রে কোনও এক সময় মিথ্যার পরিচয় দিয়েছে। কারণ যে কোনও ধর্মযাজক হয় তাকে একবার না একবার মিথ্যা বলতেই হয়। অন্য সময়ে সে হতে পারে সত্যবাদী। কিন্তু ঐ এক সময় নিশ্চয়ই সে মিথ্যাবাদী। কিন্তু মামা আমার কাছে কখনো মিথ্যা বলেননি। নিজে পরিপূর্ণ মিথ্যামুক্ত হয়ে তিনি কখনো তার ঈশ্বরকে মিথ্যাবাদী এবং হিংসাত্মক বলে কল্পনা করতে পারতেন না।

একজন গোঁজা ধার্মিক যেখানে ন্যায় কিংবা দণ্ডই মাত্র দর্শন করেন, তিনি সেখানে দয়া এবং ক্ষমতার বাইরে আর কিছু কখনো দেখতে পেতেন না। অনেক সময় তিনি এমনও বলতেন যে ঈশ্বর যদি আমাদের প্রতি কেবল দয়াবানই হতেন তাহলে ঈশ্বর আমাদের প্রতি ন্যায়বান হতে পারতেন না। আর ঈশ্বর যেহেতু আমাদের কেবল উত্তমের চাইতে অধিক কিছুর জন্য সৃষ্টি করেছেন, সে কারণে ঈশ্বরের প্রতিও আমাদের তার প্রদত্ত দানের চাইতে অধিকতর কিছু প্রদান করতে হবে। এর কারণ অবশ্য এই ছিল যে, মামা নরকে বিশ্বাস না করলেও পারগেটরি’ বা পাপশোধনাগারে বিশ্বাস করতেন। তার এমন বিশ্বাসের কারণ এই যে, যাদের আত্মা দুষ্ট তাদের সেই আত্মার কী উপায় হবে তা তিনি বুঝতে পারতেন না। কারণ তিনি এমন আত্মাকে না পারতেন অভিশপ্ত বলতে, না পারতেন তারা উত্তম না হওয়া পর্যন্ত উত্তম বলতে। মামা মনে করতেন যারা দুষ্ট চরিত্রের তারা যেমন একালের জন্য একটা দুষ্টগ্রহ বিশেষ, তেমনি সেকালের জন্যও তারা দুষ্টগ্রহ।

আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিল তার। তার ব্যাখ্যাতে আদি পাপের যেমন কোনও স্থান ছিল না। তেমনি পাপ থেকে পরিত্রাণেরও কোনও উপায় ছিল না। ফলে তার ব্যাখ্যায় খ্রিস্টধর্মের ব্যাখ্যার মূল ভিত্তিটাই ধূলিসাত হয়ে যেত। তাতে ক্যাথলিকবাদকে আর আদৌ রক্ষা করা যেত না। তথাপি আমি বলব মামা একজন যথার্থ ক্যাথলিকই ছিলেন। অন্তত তিনি নিজেকে ক্যাথলিক বলে মনে করতেন। তার এমন অনুভূতিতে কোনও কৃত্রিমতা ছিল না। তিনি মনে করতেন ধর্মশাস্ত্রের ব্যাখ্যা তাদের ব্যাখ্যা নিতান্তই আক্ষরিক এবং নিষ্করুণ। ধর্মগ্রন্থে চির পাপ সম্পর্কে যা বিবৃত হয়েছে তা মানুষকে সতর্ক করার জন্যই লিখিত হয়েছে। একটা প্রতীক অর্থে তাকে অনুধাবন করতে হবে। যিশু খ্রিস্টের মৃত্যুকে তিনি ঈশ্বরের করুণার প্রকাশ বলে মনে করতেন। ঈশ্বরের উদ্দেশ্য মানুষ যেন ঈশ্বরকে ভালবাসতে শেখে, মানুষ যেন মানুষকে তথা পরস্পরকে ভালবাসতে শেখে। সংক্ষেপে আমি বলব, তিনি যে ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, তার প্রতি তিনি বিশ্বস্ত ছিলেন এবং তার ধর্মকে তিনি সামগ্রিকভাবেই গ্রহণ করেছিলেন কিন্তু তার বিভিন্ন ধারা বা উক্তির বিস্তারিত আলোচনার ক্ষেত্রে সমস্যার উদ্ভব হতো। তখন তার ব্যাখ্যা আর খ্রিস্টান ধর্ম অভিন্ন থাকত না। অবশ্য তিনি কখনো খ্রিস্টান ধর্মের ক্ষমতাকে অমান্য করেননি। এমন বৈপরীত্যের ক্ষেত্রে তার চারিত্রিক সারল্য স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হতো। তার এমন সরলতা ধর্মের সব কাঠিন্যকে অতিক্রম করে যেত। কিন্তু তিনি তার স্বীকৃতি গ্রহণকারী গুরুর কাছ থেকে কোনও কিছুই গোপন করতেন না। তিনি সরলভাবেই তাকে বলতেন : আমি একজন উত্তম ক্যাথলিক এবং আমি একজন উত্তম ক্যাথলিক হিসেবেই আমার জীবনকে যাপন করতে চাই। আমি আমাদের পবিত্র গীর্জার সকল সিদ্ধান্তকেই সর্বান্তকরণে মান্য করব। কিন্তু তথাপি আমি নিজেকে আমার বিশ্বাসের দাসী বলে গণ্য করিনে। আমি আমার নিজের ইচ্ছার অনুগত, অপর কিছুর নই। আমি সব কিছুকেই বিশ্বাস করি। আপনি আমার কাছ থেকে অধিক কি আশা করতে পারেন?

আমি মনে করি খ্রিস্টান ধর্মীয় নৈতিকতা বলে যদি কিছু না থাকত, তাহলেও মামার নৈতিকতা খ্রিস্টান নৈতিকতার সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে অভিন্ন হতো। মামা ধর্মে নির্ধারিত সব কিছুই পালন করতেন। কিন্তু নির্ধারিত না থাকলেও তার পালনের মধ্যে সে সবই আসত। গুরুত্বহীন ব্যাপারে তিনি আনুগত্য প্রকাশে ভালই বাসতেন। এমনকি উপবাসের দিনে যদি তাকে মাংস খেতে হতো, তাহলে তিনি আড়ালে উপবাসই করতেন। ঈশ্বরের আনন্দের জন্যই তিনি তা করতেন, কোনও যুক্তির ভিত্তিতে নয়। কিন্তু তার সকল নৈতিকতার ভিত্তি ছিল মশিয়ে দা তাভেল-এর নীতির অনুসারী। তিনি সে নীতির মধ্যে কোনও বৈপরীত্য দেখতে পেতেন না। তিনি রোজ বিশজন পুরুষের শয্যাগামিনী হতে পারতেন, তাতে তার বিবেকের কোনও দংশনের ব্যাপার ঘটত না। কামনার অতিরিক্ত তেমন কর্মে তার অপর ব্যাপার থাকত না। আমি জানি বহু ধার্মিক মানুষই এমন করে। তাদের সঙ্গে তার এই ছিল পার্থক্য যে তাদের ছিল কেবল কামনা। কিন্তু তার মধ্যে ছিল একটা যুক্তির ভাব। গভীর আবেগময় কথার মধ্যেও তিনি অনায়াসে, তার কণ্ঠস্বরের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন না করে আলোচ্য বিষয়ে পরিবর্তন ঘটাতে পারতেন। তাতে তার মনে কোনও বৈপরীত্য বোধের উদয় হতো না। প্রয়োজন হলে তিনি তেমন ক্রিয়ার মধ্যে আলাপ বন্ধ করেও দিতে পারতেন এবং পরমুহূর্তে পুনরায় তার কর্মে সমান গুরুত্বের সঙ্গে প্রত্যাবর্তন করতে পারতেন। তার নিজের বিশ্বাসের ভিত্তি এত দৃঢ় ছিল যে, সমগ্র ব্যাপারটাকেই তিনি অপর যে কোনও ব্যক্তির মতোই ব্যাপারটার ব্যাখ্যা দিতে পারতেন, তিনি তার ব্যাখ্যায় পরিবর্তন ঘটাতে পারতেন, এমনকি আগের ব্যাখ্যাকে নাকচ করে দিতে পারতেন। এ জন্য অপর কিছুর উল্লেখের প্রয়োজন পড়ত না বা তিনি তার ইশ্বরের নিকট কোনও অপরাধ করেছেন, এমন বোধও আসত না। এ ব্যাপারে আমি যে তার সঙ্গে একমত পোষণ করতাম, এমন নয়। আমি স্বীকার করি তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার সাহসও আমার ছিল না। অন্যের ব্যাপারে একটা যুক্তি যে আমি দেখাতে না পারতাম তা নয়। কিন্তু আমার বিশ্বাসকে পরিত্যাগ করে নয়। কিন্তু মামার নীতির যে দৃঢ়তা ছিল তাতে তার কোনও ব্যত্যয় ঘটত না। আমি বিশ্বাস করতাম, তিনি প্রতারিত হওয়ার মতো কোনও মহিলা ছিলেন না। তাই তার ক্ষেত্রে আমার নিজের জন্য কোনও ব্যতিক্রম কথা ভাবতে পারতাম না। আমি কথাটা বললাম কেবল তার আচরণের ব্যতিক্রমগুলোকে বুঝাবার জন্য। আমি বলেছি, আমি মামা সম্পর্কে কোনও মিথ্যাচারে লিপ্ত হব না। আমার সে কথার অন্যথা করব না। এবার আমি আবার আমার নিজের ব্যাপারে ফিরে আসব।

মৃত্যু সম্পর্কে ভয় কিংবা মৃত্যুর পরবর্তী কোনও আতঙ্ক বিষয়ে কোনও দুশ্চিন্তার কারণ আমি মামার চরিত্রে দেখিনি। এ আমার দৃঢ়বিশ্বাস। ফলে তার প্রতি আগের চাইতেও অধিকতর ভাবে আমি আকৃষ্ট বোধ করতে লাগলাম। আমি আনন্দের সঙ্গে আমার সমগ্র জীবনকে তার পদতলে অর্পণ করতে পারতাম। বরঞ্চ বলা চলে আমি যখন বোধ করতে লাগলাম, মৃত্যুর আর আমার অধিক বিলম্ব নাই, তখন তার প্রতি আমার আকর্ষণ যেন পূর্বের চাইতে গভীরতর ভাবে বোধ করতে লাগলাম। এই বোধ থেকে তার প্রতি আমার ইন্দ্রিয়গত আকর্ষণও যেন বৃদ্ধি পেল। আমার জীবনের যে ক’টা দিন বাকি আছে সে কটা দিন আমি মামার নৈকট্যে আনন্দের সঙ্গে অতিবাহিত করার একটা আবেগ আমি বোধ করতে লাগলাম। একটা ব্যাপারে আমি আনন্দ পেতে লাগলাম। মামা যে বিষয়ে আনন্দ পেতে পারেন, কোনও বহিভ্রমণ বা এমন কিছু আমার ইচ্ছা হলো তার জন্য সে ব্যবহার সম্ভব করে তোেলা। তার নিজের বাগানটাকে সুন্দর করে তুললে তিনি যদি আনন্দ বোধ করেন তবে আমি তারই চেষ্টা করতে লাগলাম। তার হাঁস, মুরগি, ফুলের বাগান- যাই-ই তিনি ভালবাসতেন, আমিও তাকে ভালবাসতে লাগলাম। এবং এ জন্য যা কিছু পরিশ্রম করতে হতো সে পরিশ্রম করতে আমার তখনকার রোগক্লিষ্ট শরীর কোনও ক্লেশ বোধ করত না। দুগ্ধপান কিংবা অপর কোনও ওষুধের চেয়ে মামার ভাললাগার জন্য এমন পরিশ্রমেই আমি আরাম বোধ করতাম। আমি বোধ করতাম যেন আমার স্বাস্থ্যের তাতে উন্নতি ঘটছে।

আঙ্গুর তোলার কাজটা সেবার আমাদের দুজনকেই বেশ আনন্দ দিয়েছিল। যে সব প্রতিবেশী দ্বারা আমরা পরিবেষ্টিত ছিলাম তাদের জন্য আমাদের প্রীতি এবং ভালবাসাও বৃদ্ধি পেতে লাগল। গ্রামের প্রতিও আমাদের আকর্ষণ বৃদ্ধি পেল। কিন্তু শীত আসন্ন দেখে আমাদের মনঃকষ্ট হলো। আমার ক্ষেত্রেই এটা বেশি হলো। কারণ আর একটা বসন্ত আমি দেখতে পাব, এমন আমি ভাবতে পারতাম না। আমার মনে হতো লাচারমিটেসে এই আমার শেষ। এর কোনও ঘাস কিংবা বৃক্ষকে চুম্বন না করে আমি স্থান ত্যাগ করতে পারতাম না। অনেক আগেই শহরের সঙ্গে কিংবা শহরের মেয়েদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক শেষ হয়েছিল। ফলে মামা এবং মশিয়ে সলোমন বাদে আর কারও সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক থাকল না। এই মশিয়ে সলোমনই এই সময়ে মামা এবং আমার চিকিৎসক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। ইনি যেমন ভদ্র, তেমন বুদ্ধিমান ছিলেন। তিনি একজন বড় রকমের দেকার্তবেত্তা ছিলেন, পৃথিবী সম্পর্কে তার আলোচনা বেশ স্বচ্ছ ছিল। বস্তুত অন্য কোনও ঔষধের চাইতে তার আলোচনা দ্বারাই আমি অধিক উপকৃত বোধ করতাম। সাধারণ আলোচনাকে আমি কখনো পছন্দ করতাম না। অপরদিকে কোনও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাতে আমি আকৃষ্ট এবং উপকৃত বোধ করতাম। আমি মশিয়ে সলোমনের বিশেষ ভক্ত হয়ে দাঁড়ালাম। তার সান্নিধ্যে আমি যেন সেই জ্ঞানের সম্পর্ক পেতাম যে জ্ঞানের জন্য আমার আত্মার আর্তি যেন জাগ্রত হচ্ছিল। মর্তের বন্ধন থেকে মুক্তি যেন জাগ্রত হচ্ছিল। মর্তের বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়ে আমি সেই ঊধ্ব জ্ঞানকে লাভ করতে পারব, এমনটাই আমার মনে হতো। আমি ক্রমান্বয়ে তার আলোচ্য বিষয়গুলোর প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগলাম। তার আলোচনা যেন আমি অধিকতর উত্তমরূপে অনুধাবন করতে পারি তার জন্য প্রয়োজনীয় গ্রন্থের অনুসন্ধান করতে লাগলাম। যা কিছুই আমাকে বিজ্ঞান এবং বোধের দিকে নিয়ে যেত তাই ই আমি ভালবাসতে লাগলাম। এরকম একটি বই পেয়ে গেলাম। বইটি ছিল ধর্মযাজক কাদার মীর রচিত : কনভারসেশন অন দি সাইন্সেস’ বা বিজ্ঞান বিষয়ে আলোচনা। এই গ্রন্থের আলোচনাগুলো বিজ্ঞানে আমার অনুপ্রবেশকে সহজ করে তুলল। এই গ্রন্থ আমি বারংবার পড়তে লাগলাম। বলা চলে এই বই আমি শতবার পড়েছি। এর ফলে আমি গ্রন্থপাঠে ক্রমান্বয়ে অধিকতর আকৃষ্ট বোধ করতে লাগলাম। যখন আমি ভাবতাম, আজকের দিনটাই আমার জীবনের শেষ দিন, সেদিনের পাঠে আমি এত নিবিষ্ট বোধ করতাম যেন আমার জীবনের কোনও শেষ ঘটবে না। অপরে বলত এতে আমার ক্ষতি হচ্ছে। আমি ভাবতাম এতে আমার উপকার হচ্ছে। কেবল যে আমার আত্মার উন্নতি ঘটত এমন পাঠে, তাই নয়। মনে হতো যেন আমার শরীরেরও উন্নতি ঘটছে। আসলে পাঠের প্রতি আমার আগ্রহ এত বৃদ্ধি পেতে লাগল, পাঠে আমি এত আনন্দ পেতে লাগলাম যে এর ফলে আমি আবার শারীরিক রোগের সম্পর্কে চিন্তা বা উদ্বেগ বোধ করতেই ভুলে গেলাম। তা সত্ত্বেও এটা সত্য যে রোগের কোনও উপশম ঘটত না। তবু শরীরে ব্যথার তীব্রতাটা যেন হ্রাস পেতে লাগল এবং সেটা গা সওয়া হয়ে দাঁড়াল। অনিদ্রাতে কোনও কষ্ট বোধ করতাম না, চিন্তায় আমি নিবিষ্ট থাকতাম। শেষ পর্যন্ত ভাবলাম : এটাই তো আমার স্বাস্থ্যের উন্নতি। এই রকম উন্নতি তথা আমার অস্তিত্বের হ্রাস প্রাপ্তিতে আমি একদিন শেষ হয়ে যাব। এটি খারাপ কী, সেই মৃত্যুতেই আমার মুক্তি ঘটবে।

আমার এই সব চিন্তার উপকারের একটা দিক এই ছিল যে, এর ফলে জীবনের সব উদ্বেগ যেন ভুলে যেতে লাগলাম এবং আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমার ওপর যে সব বিস্বাদজনক এবং ক্লান্তিকর উপশম প্রক্রিয়া প্রয়োগ করা হচ্ছিল তা থেকে যেন আমি মুক্তি পেলাম। আমার চিকিৎসক সলোমন এতদিনে স্থির বুঝেছিলেন যে তার ওষুধে আমার জীবন রক্ষা পাবে না। তাই তিনি তার মারাত্মক ওষুধ প্রদানের বদলে আমার জন্য মামার উদ্বেগকে প্রশমিত করার জন্য সেই সব সাধারণ ওষুধেরই ব্যবস্থাপত্র দিতে লাগলেন যাতে একদিকে রোগীর মনে বাঁচার আশা যেমন জন্মে তেমনি এতে চিকিৎসকের সুনামের কোনও হানি না ঘটে।

এবার আমি বেপরোয়া হয়ে উঠতে লাগলাম। আবার আমি মদ্যপান শুরু করলাম এবং আমার চলাচলে এমন ভাব দেখালাম যেন আদতে আমার কোনও অসুখই নেই। তবে এটা বলতে হবে আমি কোনও কিছুতেই বাড়াবাড়ি করতাম না। সব কিছুতেই একটা পরিমাপ বজায় রাখতাম। কিন্তু কোনও কিছুকে আমি পরিত্যাগ করলাম না।

এমনকি আমি এবার বাড়ির বাইরে যেতেও শুরু করলাম। আমার পরিচিত আচ্ছায় আমার পুনরায় আবির্ভাব ঘটতে শুরু করল। বিশেষ করে এই সময়ে মশিয়ে দা কনজি’র সঙ্গ আমার মনকে বিশেষ করে চাঙ্গা করে তুলত। ব্যাপারটা যথার্থই এমন হচ্ছিল। মৃত্যুর আসন্নতা আমার মনে সর্বরকম গ্রন্থপাঠের আগ্রহকে বৃদ্ধি করে দিতে লাগল। ভাবটা দাঁড়াল এমন যে, আছি তো মাত্র আর কটা দিন, একটা দিন জীবনটাকে ভোগ না করে ছাড়ছিনে। হাঁ মালমশলা কিছু তো পরকালের জন্য সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে হবে। ফলে মৃত্যুর আশা ৰা আশঙ্কা আমাকে দমিত না করে জ্ঞান সংগ্রহের আগ্রহকে আরো উদ্দীপিত করে তুলল। এ ছিল যথার্থই পরকালের জন্য জ্ঞান সংগ্রহের মনোভাব। আমার কেবল মনে হচ্ছিল, পরকালের জন্য কিছু সাথে করে নিয়ে না গেলে সেকালে আমি বাঁচবো কী খেয়ে! মশিয়ে বুচার্ডের একটা বই-এর দোকান ছিল। সে বই-এর দোকানে বিখ্যাত সব ব্যক্তিদের যাতায়াত ঘটত। সেবার যখন বসন্ত আসন্ন হয়ে এল তখন মশিয়ে বুচার্ডের দোকান থেকে বেশ কয়েকটা বই আমি সংগ্রহ করলাম। কারণ আমি জানতাম এই বসন্ত আমার জীবনে আর প্রত্যাবর্তন করবে না। আগামী বছরের বসন্তের সাক্ষাৎ আমি পাব, তেমন আমি আদৌ চিন্তা করে পারিনি। তবু ভাবলাম, আর একটা বসন্ত আমার জীবনে যদি বা আসে তাহলে সে বসন্তে আজকের গ্রন্থগুলো আমাকে আর কিছু না দিক তাদের সৎ সঙ্গ তো দিবে। সেটিই বা আমার জন্য কম কিসে।

আমার সেদিনের ভাগ্যের আর তুলনা হয় না। তখন আমার জীবনের কোনও আনন্দকেই আর পরিহার করলাম না। আহা! একটি ফুলগাছে ফুলের কলি এসেছে। এমন ঘটনা কি আর কখনো ঘটেছে? সেই ঘটনার আমি সাক্ষাৎ পেলাম? এমন ভাগ্য আর ক’জনার হয়!

হ্যাঁ, নতুন বসন্তেরও আমি সাক্ষাৎ পেলাম। আর এই বসন্তের সঙ্গে আমার পুনরায় সাক্ষাতের ঘটনা যেন স্বর্গে আমার পুনর্জন্মেরই একটা ব্যাপার বলে বোধ হলো। বরফ গলা শুরু হতেই আমরা আমাদের গুহা ছেড়ে বেরিয়ে এলাম এবং লা চারমিটিসকে লক্ষ্য করে ছুটতে লাগলাম যেন নাইটিঙ্গেল-এর প্রথম স্বরধ্বনিটি আমার শ্রবণের বাইরে থেকে না যায়।

সেই মুহূর্তটি থেকে আমার মন থেকে মৃত্যু চিন্তা অন্তর্হিত হয়ে গেল। আমি মরে যাচ্ছি বলে যে চিন্তা আমার আগে ছিল, সে চিন্তা আর রইল না। আর আমার নিজেরও ভাবতে অদ্ভুত লাগছে যে তারপর থেকে আর আমার সাংঘাতিক কোনও অসুখ আদৌ হয়নি। হ্যাঁ, আমার দেহে মাঝে মাঝে বেদনার সৃষ্টি হয়েছে। তবু আর আমি শয্যাশায়ী হয়ে পড়িনি। আমার বন্ধুদের আমি বহুবার বলেছি যখন শরীর আমার দুর্বল হয়ে পড়েছে, আমি তখন তাদের বলেছি, যখন তোমরা দেখবে যে আমি মারা যাচ্ছি, মৃত্যু আমার আসন্ন তখন তোমরা আমাকে একটি ওক গাছের ছায়ায় নিয়ে শুইয়ে দিও। তখন দেখবে যথার্থই আমি মরিনি, আমি আবার সুস্থ হয়ে উঠেছি।

তোমরা ঠিক জেনো : আমি আবার তখন সুস্থ হয়ে উঠেছি। আমি তখনো দুর্বল। তবু আমার গ্রাম্য জীবনের কাজকর্ম আবার আমি শুরু করলাম, আমার শক্তিতে যতটা কুলায়। কিন্তু বাগানটাকে পুরো ঠিক করতে পারছিনে দেখে আমি মর্মাহত হয়ে পড়লাম। কয়েক কোদাল মাটি ফেলতেই আমি ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। শ্বাস-প্রশ্বাসে আমার কষ্ট হতে লাগল। আমার শরীর দিয়ে ঘাম ঝরতে লাগল। হাঁটু গেড়ে বসতে গিয়েই দেখলাম আমার হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি পেয়ে যাচ্ছে। মাথায় আমার এত রক্তক্ষরণ হতে লাগল যে আমি আবার উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলাম। এই ঘটনার ফলে শক্ত পরিশ্রমের কাজ আমি বাদ দিলাম। আমি কেবল আমাদের পায়রার ঘরটার পরিচর্যায় নিযুক্ত থাকলাম। এবং এ কাজে আমার কোনও ক্লান্তি এল না। পায়রার ঘরের পরিচর্যার কাজকে আমি ভালবাসতে লাগলাম। ব্যাপারটা আমার জন্য এমন সুখকর হয়ে উঠল যে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা পায়রাগুলোর যত্নে মগ্ন হয়ে থাকতাম। এমন কাজে আমার কোনও একঘেয়েমী আসততা না। কিন্তু পায়রাগুলির চরিত্র এমন যে, ওরা যেমন লাজুক, তেমনি ওদের পোষ মানানো বড় কঠিন। তবু ওদের সঙ্গে আমার একটা সখ্য গড়ে উঠল। আমার পেছন পেছন ওরা হাঁটতো আর যখন যেটাকে ধরতে চাইতাম, তখন সে আমার হাতের মধ্যে ধরা দিত। ওদের কাছ থেকে যখন বেরিয়ে আসতাম তখন ওদের কেবল একটা নয়, বেশ কয়েকটা আমার কাঁধের ওপর এসে বসত। এমনকি আমার মাথার ওপরও। কিন্তু তবুও এদের শক্তির শেষ না থাকলেও আমি বেশিক্ষণ ওদের সহ্য করতে পারতাম না। এক সময়ে ওদের তাড়িয়ে দিতে বাধ্য হতাম।

আসলে পশুপাখি নিয়ে খেলতে আমার খুব ভাল লাগত। ওগুলোকে পোষ মানাতে, বিশেষ করে পায়রাগুলোকে পোষ মানাতে আমার ভয়ানক ভাল লাগত। ওদের উড়িয়ে দিতে, আমার সঙ্গে ওদের সম্পর্কের মধ্যে যেন কোনও ভয় না ঢোকে সেদিকে আমি সতর্ক থাকতাম। তাই ওরা আমাকে যথার্থই ভালবাসত। আমার সঙ্গ লাভে ওদের কোনও ভয় ছিল না।

এর আগে আমি বলেছি যে এই সময়ে আমি বেশকিছু বই সংগ্রহ করেছিলাম। আর এগুলোকে আমি ফেলে রাখতাম না। এগুলোকে আমি আমার ক্ষমতামত ব্যবহার করার চেষ্টা করতাম। তাদের বুঝার মতো ক্ষমতা তখনো হয়নি। আর তাই তাদের ব্যবহারে আমার গা যত ঘর্মাক্ত হতো, আমার মন তত বিজ্ঞ হতো না। জগৎ সম্পর্কে আমার যে বোধ তখন ছিল তাতে মনে হতো আমার সংগৃহীত অর্থ বুঝতে হলে এই সব গ্রন্থে যে আলোচনা আছে এবং যে সমস্ত গ্রন্থের ওপর ভিত্তি করে এদের রচনা করা হয়েছে, সেই সমস্ত গ্রন্থকে আমার আগে বুঝতে হবে। আসলে আমি তখনো বুঝিনি যে, এই সকল বই-এর রচনাকাররাও জানেন না তারা কী লিখেছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তার মূল অপর কোনও বই থেকে তার মমার্থ না বুঝে তার রচনার মধ্যে এ অংশ এবং ও অংশকে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। আমার এমন অবুঝ বুঝের ফলে কোনও গ্রন্থের কোনও বাক্য পাঠ করতে গেলে মুহূর্তে মুহূর্তে আমাকে থামতে হতো এবং প্রত্যেকটি প্রশ্নের জবাব খুঁজতে সংখ্যাহীন অপর গ্রন্থসমূহকে উল্টে দেখার ইচ্ছা হতো। আর তাতেই আমার বুঝের চাইতে প্রাপ্তি বেশি হতো। অনেক সময়ে এমন হয়েছে যে, একটা বই-এর দশপৃষ্ঠাও শেষ না করতেই এক একটা লাইব্রেরিতে আমাকে ছুটতে হতো, মূলকে উদ্ধারের চেষ্টায়। তবুও আমি আমার এই পাগলামি থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করতে পারতাম না। তার ফলে আমার জ্ঞান বৃদ্ধির চাইতে আমার সময়ই বেশি নষ্ট হতো। এর ফলে আমার মাথা ঘুরতে শুরু করত এবং তখন আমি আর কোনও কিছুই বুঝতে পারতাম না। ভাগ্য ভাল যে আমার এই পাগলামি দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়নি এবং একেবারে জ্ঞানপাগল হওয়ার আগেই আমি আমার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পেরেছিলাম।

আসলে কারোর যদি জ্ঞান অর্জনের ইচ্ছা জাগে, তবে তাকে একথাটা বুঝতে হবে যে জ্ঞানের কোনও অংশই অপর কোনও অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। জ্ঞানের বিভিন্ন অংশের মধ্যে যে আন্ত:সম্পর্ক বিদ্যমান সে সম্পর্কই যে কোনও শাখাকে বুঝতে আমাদের সাহায্য করে। অবশ্য একথা ঠিক যে মানুষের মনের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ : সমগ্র জ্ঞানকে কারোর পক্ষেই এক চোটে আয়ত্ত করা সম্ভব নয় এবং জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে আমাদের কোনও একটির ওপরই নজর নিবদ্ধ করতে হয়, তবু এই আন্ত:সম্পর্কের বিষয়টিকে আমাদের স্মরণ রাখা আবশ্যক। তাছাড়া অপর শাখাসমূহের কোনও কিছু সম্পর্কে সাধারণ ধারণাও না থাকলে, তার কোনও অংশ সম্পর্কেই বিচ্ছিন্নভাবে কোনও জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়। আমার এই ব্যর্থ প্রক্রিয়ায় আমি অন্তত: এটি বুঝলাম, যে পদ্ধতিতে আমি হাত দিয়েছিলাম সেটি যথার্থ নয়। সব কিছুকে এক চোটে পাওয়া সম্ভব নয়। তাই আমাকে বুঝতে হলে আমার জ্ঞানলাভের এতদিনকার পদ্ধতিকে পরিবর্তন করতে হবে। এক চোটে সব লাভ করার ইচ্ছাটা খারাপ না। তবে সব যে এক চোটে লাভ করা যায় না, এ বোধটিও মূল্যবান।

এই বুঝ থেকে আমি বিশ্বকোষ বা এনসাইক্লোপিডিয়ার ওপর এবার আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। একটা বিশ্বকোষ ধরে তার মধ্যকার বিভিন্ন বিষয়কে নির্দিষ্ট করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বুঝলাম। এ ব্যাপারটাও এত সহজ নয়। ভাগ করাই যথেষ্ট নয়। এবার আমি কোনও একটি বিষয় নির্দিষ্ট করে তার যতখানি সম্ভব আয়ত্ত করার চেষ্টা করতে লাগলাম। একটি বিষয়ে অগ্রসর হতে হতে যতক্ষণ না অপর একটি বিষয়ের সীমানার কাছে পৌঁছলাম, ততক্ষণ তাকে আমি পরিত্যাগ করলাম না। এমনি করে একটি যখন আর একটিতে পরিণত হলো এবং সব মিলিয়ে একটি জ্ঞান সত্তা তৈরি হলো ততক্ষণ আমি এতে নিমগ্ন থাকার চেষ্টা করলাম। এই প্রক্রিয়াতে একটি লাভ আমার এই হলো যে জ্ঞানের ক্ষেত্রে যেন একটি সমন্বিত বোধের একটা সাক্ষাৎ লাভ করলাম। এই জায়গাটাতে পৌঁছেই আমি বুঝতে পারলাম কী আমি চাচ্ছি, আর কেন তা পাচ্ছিনে। আমি বুঝতে পারলাম কেবল পাঠ নয়, পাঠের বিষয়কে অন্তরেও ধারণ করতে হবে : যাকে বলে তার ধ্যানেও আমাকে নিমগ্ন হতে হবে। এই অন্তরে গ্রহণ তথা ধ্যানই আমাকে এবার পথ দেখাতে লাগল। আমি বুঝলাম এই রাস্তায় আমি মরি কিংবা বাঁচি এর কোনও বিকল্প নেই আর হাতেও সময় নেই। তাই সময় নষ্ট করার সময় আমার হাতে নেই। প্রায় ২৫ বৎসর আমি অতিক্রম করেছি। অথচ দেখছি জগতের আমি কিছুই জানিনে এবং মৃত্যু যে কোনও মুহূর্তে এসে আমার সমস্ত প্রয়াসকে নস্যাৎ করে দিতে পারে। এই বোধ থেকে আমি স্থির সিদ্ধান্ত নিলাম : যা হয় হবে : সব কিছুই আমাকে জানতে হবে। কেবল আমার শক্তির সীমাকে জানার জন্য নয়। আমাকে জানতে হবে কোন্ জ্ঞান সর্বোত্তম জ্ঞান।

এই সিদ্ধান্তে আমার এমন একটি লাভ হলো যার কথা আমি আগে চিন্তা করিনি; এবার আর সময়ের ক্ষেপণ নয়, যে সময় আমার আছে তার সর্বাধিক ব্যবহার আমাকে করতে হবে। আমি তো আবার জন্মগ্রহণ করতে পারিনে যে, নতুন পদ্ধতিতে আমার জীবন আবার প্রথম থেকে শুরু করব। এবার আমার পদ্ধতিতেই আমাকে চলতে হবে : অপরের পদ্ধতিতে নয়। অপরের পদ্ধতিতে আমি আধা ঘন্টাও নিবিষ্ট থাকতে পারিনে। কিন্তু আমার নিজের পদ্ধতিতে যেমন অধিকতর সময় নিবিষ্ট থাকতে পারি এবং তা থেকে একটা সার্থকতা বোধও আমার জন্মে। অন্য কোনও লেখকের বই পড়তে গেলে তার কয়েক পৃষ্ঠার পাঠেই আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ি। তাকে জোর করে পড়তে গেলে আমি যেন নিঃশেষ হয়ে যাই। আমার মাথা ঘুরতে আরম্ভ করে। আমি নিজের চোখে যেন কিছু দেখতেই পাইনে। তার বদলে আমি যদি একই সঙ্গে একাধিক বইতে মন দেয়ার চেষ্টা করি তাতে বরঞ্চ আমার ক্লান্তি আসে না। এদের একজন যদি ক্লান্তি বোধ করে তবে সেখানে ছেড়ে পাশে আর একটা হাতে নিলে মনটা যেন হাল্কা হয়ে আসে। তখন আর বিরামের দরকার হয় না। আমার পাঠের একটা নিরবচ্ছিন্নতা যেন তৈরি হয়ে যায়। এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমি বই পাঠের একটা নতুন প্রান তৈরি করে ফেলেছি। আর এটি চালু করে দেখলাম আমার যেমন বই-এরও অভাব হয় না, তেমনি কোনও ক্লান্তিবোধও আমাকে অসহায় করে তোলে না। ফলে আমি সারাটা দিনই কাজে ব্যস্ত থাকি। অবশ্য বাগানের এবং ঘরের কাজ আমার ব্যস্ততার ক্ষেত্রেও একটা সাহায্যের ভূমিকা রাখে। তবু এর মধ্যেও আমি আমার পাঠের সময়ের ব্যাপারে কোনও অসুবিধা বোধ করিনে। কোনও না কোনওভাবে এই পড়ার সময় বের করে ফেলি। তার মানে এই কাজ এবং ও কাজ দুটোই যেন আমি করতে সক্ষম। তার কিন্তু এটা আমি খেয়াল করলাম না : একাজ ওকাজ দুটো একসঙ্গে করতে গেলে কোনও কাজই ভালভাবে সম্পন্ন করা যায় না।

এই যে খুটিনাটি বিষয় এত বিস্তারিতভাবে আমি বলছি, তাতে আমার আনন্দ হলেও, একথা আমি বুঝি যে, আমার এমন বর্ণনা আমার পাঠকদের মনে বিরক্তি সৃষ্টি করবে। অবশ্য আমি নিজেকে থামানোর চেষ্টা যে না করছি, তা নয়। সে কথা না বললে আমার পাঠকরা আমাকে সঠিকভাবে ধরতে পারবেন না। এখানে আমার স্মরণে আসছে কতভাবে যে আমি আমার সময়কে বিভক্ত করার চেষ্টা করেছি, আমার শ্রম যেন বিফলে না যায়। যে বই আমি পড়েছি তা থেকে যেন আমি সর্বোত্তম আনন্দকে লাভ করতে পারি। কিন্তু আমার এক বড় দুঃখ এই যে, যখন আমার অসুখ হয়েছিল তখন আমার জীবন ছিল বটে, কিন্তু আমার সময় নষ্ট হয়েছে। সে সময়ে আমি অসুখ ছাড়া কিছুই লাভ করতে পারিনি। এই অসুখের সময়টাতে যেমন আমি আমার অসহ্য বোধ হয়েছে। এভাবে প্রায় দু’তিন মাস আমি কাটিয়েছি আমার মনের ভাবটা বুঝার জন্য। কিন্তু তাতে দুঃখ পাইনি। এমন অলস কর্মহীন জীবনেরও তো একটা লাভ আছে। এমন জীবন কেমন জীবন তা আমি এমন জীবন ভোগ করা ছাড়া কেমন করে উপলব্ধি করতাম। কিন্তু এমন অবস্থায়ও কেবল যে জীবনকে আমি ভোগ করেছি, তাই নয়। আমি সমাজের মাধুর্যেরও আমি সাক্ষাৎ পেয়েছি। এটা ছিল আমার জন্য একটা বিরাট জ্ঞান লাভের ব্যাপার। এমন পর্যায়ের পরে আমার মনে হয়েছে, যেন আমি একটা নতুন সমাজের সাক্ষাৎ লাভ করেছি। একটা নতুন সমাজ আগে আমার কাছে এমন বোধ হয়নি, যেমন এখন বোধ হচ্ছে।

এই সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষার কথা বরং এখন বাদ দিই। এগুলো থেকে আমি অবশ্যই আনন্দ লাভ করেছি। কিন্তু সে আনন্দ যে কেমন আনন্দ তা ভাষায় প্রকাশ করে বলা যায় না। বুঝানো যায় না। এমন আনন্দ কেবল অনুভব করার ব্যাপার, প্রকাশ করার ব্যাপার নয়। আর তাই এর অনুভূতি যত অধিক তীব্র তাকে প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার তত কম হয় : তত প্রকাশ করার ক্ষমতা হ্রাস পায়। কারণ এমন আনন্দ কোনও ঘটনা সংঘটিত হওয়ার আনন্দ নয়। এটা হচ্ছে মানসিক ব্যাপার। মনের একটা অবস্থার ব্যাপার। আমি অনেক সময়ে চোখ বন্ধ এই অবস্থার দিকে তাকাই। আমার ইচ্ছা হয় আরো বেশি বেশি করে এবং বেশি করে যেন আমার অন্তরের মধ্যে প্রবেশ করে আরো গভীরভাবে সেই মুহূর্তগুলোকে আমার বোধের মধ্যে আনতে পারি। যাই হোক যখন শেষ পর্যন্ত আমার নিজেকে নিয়ে নিজের এই খেলা শেষ করতে সক্ষম হলাম তখন আমি আমার দিনের সময় ব্যয় করার একটা নিয়ম আমি দাঁড় করাতে সেই নিয়মের কথা বলতে গেলে বলব, প্রত্যেক দিন সূর্য ওঠার আগেই আমি উঠতাম এবং পাশের একটা বাগানের মধ্য দিয়ে, বাগানের উপরের দিকের একটা রাস্তায় গিয়ে পৌঁছতাম। এই রাস্তাটা শেষ হতে পায়ের পথেই চেম্বারীতে। সেখানে পৌঁছে আমি আমার প্রার্থনা উচ্চারণ করতাম। আমার প্রার্থনায় কোনও শব্দ উচ্চারিত হতো না। আমার প্রার্থনায় আমার আত্মা উন্মুখ হয়ে উঠত এই বিশ্বচরাচরের স্রষ্টার প্রতি। একটা ঘরে আবদ্ধ হয়ে কখনো আমি প্রার্থনায় রত হতে ভালবাসতাম না। তেমন হলে চারদিকের দেয়াল আর মানুষের তৈরি নানা দ্রব্যসামগ্রী স্রষ্টা এবং আমার মধ্যে একটা ব্যবধানে যেন সৃষ্টি করত। আমি স্রষ্টার সৃষ্টির মধ্যে আমার ভালবাসাকে প্রত্যক্ষ করতাম। তখন আমার আত্মা তার উদ্দেশ্যে উন্মুখ হয়ে উঠত। আমার বলতে দ্বিধা নাই, আমার এমন প্রার্থনায় কোনও কৃত্রিমতা থাকতো না। আমার প্রার্থনা ছিল পবিত্র এবং সে প্রার্থনা স্রষ্টার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হতে পারত না। যেমন আমার নিজের জন্য, তেমনি তাকে আমি ভালবাসতাম তার জন্য একটি শান্তিময় জীবন ব্যতীত আর কিছু আমি কামনা করতাম না। আমার এই প্রার্থনার মধ্যে কোনও অবাঞ্ছিত কিছু, কোনও দুঃখ বা অভাবের যাচনা থাকতো না। আমার কেবল প্রার্থনা হতো আমি এবং ভালবাসার পাত্রী একটি মহৎ মৃত্যুতে নিঃশেষিত হতে পারি এবং পরজন্মেও যেন আমরা এমন জীবন যাপন করতে পারি। এটাই ছিল আমার প্রার্থনা। এর বাইরে এই জগতের সব কিছুতে আমার বিস্ময়বোধ এবং আরাধনার অধিক আর কিছু থাকত না। কারণ আমার এমন একটা বোধ ছিল যে যিনি আমাকে দিবেন তিনি যা দিবেন তা আমার যোগ্যতার কারণেই আমাকে দান করবেন, আমার প্রার্থনার কারণে নয়। আমার এমন বোধ নিয়েই আমার চতুর্দিকের প্রকৃতির রাজ্যে ঘুরে বেড়াতাম। প্রতিটি আবর্তনে আমি যেন সূচনাতেই প্রত্যাবর্তন করতাম। কোনও দূরত্বকে অতিক্রম করা নয়। আর এমন পুনরাবর্তনে আমার কোনও ক্লান্তি আসত না। যদি দিন হতো তবে আমি মামার জানালার পানে তাকাতাম। যদি দেখতাম তার ঘরের জানালা উন্মুক্ত হয়েছে, তবে আমি সেই উন্মুক্ত জানালার উদ্দেশ্যে আমি ছুটে যেতাম। তখন আর আমার আনন্দের সীমা থাকত না। যদি দেখতাম তার জানালা তখন বন্ধ তবে আমি তার জানালার পার্শ্বে উন্মুখ হয়ে অপেক্ষারত থাকতাম যতক্ষণ না মাথা তার চিন্তা থেকে জাগরিত হয়। অপেক্ষার এই সময়টাতে আমি আমার বিগত দিনের পাঠের পুনরাবৃত্তি করতাম কিংবা তার বাগানের পরিচর্যায় নিজেকে নিযুক্ত করতাম। তার দরজা যখন খুলে যেত আমি তখন ছুটে গিয়ে তার হাত দুটিকে চুম্বন করতাম। হয়ত তিনি তখনো আধো নিদ্রায় নিদ্রিত থাকতেন। তবুও আমার চুম্বনের পবিত্রতা এবং তার নম্রতায় বিন্দুমাত্র ব্যত্যয় ঘটতো না। তখন আমার অনুভূতিতে পবিত্রতা ব্যতীত প্রবৃত্তির কোনও আনন্দের বোধ আমার মধ্যে অনুভূত হতো না। মামার আর আমার প্রাতঃরাশ সাদা কফিতেই সম্পন্ন হতো। সেই প্রাতঃরাশের পরে আবার আমরা বিশ্রামে নিমগ্ন হতাম। আমরা দুজনে নানা কথা আর গল্পে মেতে উঠতাম। আমাদের গল্পের যেন শেষ হতো না। খাওয়ার টেবিল ছেড়ে যেন উঠতেই পারতাম না। তখন থেকেই প্রাতঃরাশের প্রতি আমার আকর্ষণ বৃদ্ধি পেতে লাগল। প্রাতঃরাশের নানা দেশীয় বৈচিত্র্য আছে। ইংল্যান্ড আর সুইজারল্যান্ডের প্রাতঃরাশ যেন একটা পুরো আহার। খাওয়ার টেবিলে পরিবারের সকলে এসে সমবেত হয়। ফরাসিদের কায়দাটি হচ্ছে প্রত্যেকে একাকী তার নিজের ঘরে বসে আহার করবে। আবার অনেক সময় এমন হয় যে তারা প্রাতঃরাশ বলে কিছু খায়ই না।

আমি মামার সঙ্গে এক ঘণ্টা কিংবা দু’ঘণ্টা নিবিড় গল্প করে আমার পড়ার ঘরে চলে যেতাম এবং সেখানে ডিনারের সময় না আসা পর্যন্ত আমি পাঠের রাজ্যেই মগ্ন থাকতাম। পাঠের ক্ষেত্রে আমি শুরু করলাম প্রথমে দর্শনের গ্রন্থ নিয়ে। প্রথমে ধরলাম পোর্ট রায়লের লজিক, তার পরে লকের নিবন্ধ, মালেব্রাঙ্কে, লাইবনিজ কিং ডেকার্ডের যুক্তিশাস্ত্র। এদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার কিছুকালের মধ্যে আমি বুঝতে পারলাম এই জগতের যুগপুরুষরা যেন একের বিরুদ্ধে অপরকে খণ্ড-বিখণ্ড করার খেলাতেই অধিক আগ্রহ বোধ করেন। ফলে আমি বুঝলাম দ্বন্দ্বে রত এই বীরবৃন্দের মধ্যে কোনও সমঝোতা সৃষ্টির আমার যে আকুলতা, তা ভিত্তিহীন। তার পেছনে পরিশ্রম ব্যয় করে আমার কোনও লাভ হবে না। তাতে কেবল আমার সময়েরই অপচয় ঘটবে। আমার এমন চেষ্টায় আমার মাথা ঘুরতে লাগল। যা আমি চাচ্ছি সে পথে আমার ইঞ্চি পরিমাণ অগ্রগতির সাধন ঘটল না। শেষ পর্যন্ত এমন উদ্যোগ আমি ছেড়ে দিলাম। এপথ পরিত্যাগ করাতে আমার লাভই ঘটল। আমার পাণ্ডিত্য ছিল না। তবু যা আমি একটু কাজ করতে সক্ষম হয়েছি, তা কেবল পণ্ডিতজনদের মধ্যকার কলহ বন্ধ করার অপচেষ্টা পরিত্যাগের পরেই মাত্র। আমি জানি আমি কোনওদিন নিজেকে পণ্ডিত বলে দাবি করিনি।

আমি এই সমস্ত পণ্ডিতজনের গ্রন্থাদি পাঠ করে বুঝলাম : এদের কাউকে আমি তারা যা বলছেন, তার চাইতে সমৃদ্ধ করে তুলতে সক্ষম হব না।

অবশ্য আমার এমন পদ্ধতিতে ক্রটি যে ছিল না, তা নয়। তবু আমি নিজেকে বললাম : বাদ দাও ওসব কূটতর্ক। বরং এসো আমরা দুর্বোধ্য কূটতর্ক বাদ দিয়ে সরল চিন্তার কথা ভাবি। সরল চিন্তা যা বোধ্য। দুর্বোধ্য নয়। যে সরলকে আমি বুঝতে পারি তাদের শেষ করার পরেই মাত্র তাদের একটির সঙ্গে অপরটিকে তুলনা করে বিচার করতে আমি সক্ষম হব। এভাবে কয়েক বছর অতিক্রম করার পর আমি দেখলাম আমার এমন স্বশিক্ষার পদ্ধতিতে আমি বেশ লাভবান হয়ে উঠছি। এবার আমি পাঠের ক্ষেত্রে আত্মনির্ভর হওয়ার মূল্য অনুধাবন করতে সক্ষম হলাম। এর পরবর্তী সময়ে যখন কোনও পুস্তক পাঠেরই আমার সুযোগ ঘটল না, তখন আমার নিজের সংগৃহীত জ্ঞানকে পরিমাপ করার চেষ্টা করলাম। আমার যুক্তির কষ্টিপাথরে আমি তাদের মূল্যায়নের চেষ্টা করলাম। এখন আমি আমার পঠিত পথিকৃৎদের ওজন করার চেষ্টা করলাম। আমি দেখলাম আমার অপচয়িত বয়সে এভাবে আমার এভাবে শুরু করার কারণে আমার বিশ্লেষণী ক্ষমতার তেমন কোনও ক্ষতি ঘটেনি। পরবর্তী সময়ে আমার চিন্তাকে যখন আমি প্রকাশ করলাম তখন কেউ আমাকে অপরের অন্ধ অনুকারী বলে সমালোচনা করেননি। পিথাগোরাস১০ সম্পর্কে উচ্চারিত কথা স্মরণ করে আমি বলতে পারি পিথাগোরাসের মতো কোনও বৃহৎ ব্যক্তির মূর্তিকে সংরক্ষণের চেষ্টায় আমি নিজেকে অপচয়িত করিনি।

এই পর্যায়ে আমি প্রাথমিক জ্যামিতিতে মনোনিবেশ করি। অবশ্য এই প্রাথমিক স্তরকে আমি আর অতিক্রম করতে পারিনি। তবে আমি আমার পঠিত বিষয়াদিকে যেন বিস্মৃত না হই, সেজন্য যা আমি পাঠ করেছি তাকে বারংবার পাঠ করার অভ্যাসকে আমি কখনও পরিত্যাগ করিনি। আমি অবশ্য ইউক্লিডকে ছোট করতে পারিনি। আমার কাছে মনে হলো ইউক্লিডের চিন্তা যত না কোনও ধারণাকে স্থাপন করার ওপর তার অধিক চিন্তা হচ্ছে কোনও কিছু প্রমাণের শেকল সৃষ্টি করা। আমার কাছে ভাল লাগল যাজক ল্যামীর জ্যামিতি। এই যাজক ল্যামীকে তখন থেকে আমি ভালবাসতে লাগলাম এবং এখনও তাকে বারংবার পাঠ করতে আমার ভাল লাগে। আমি আর একটু অগ্রসর হতে যখন সক্ষম হলাম তখন আমি ধর্মযাজক রেমন্ডের হিসাববিজ্ঞানর প্রতি আকৃষ্ট হলাম এবং তার বিশ্লেষণ পদ্ধতিকেও আমার কাছে বোধগম্য মনে হলো। আসলে আমি তেমন ভালভাবে জ্যামিতির ওপর বীজ গণিতের প্রয়োগকে অনুধাবন করতে সক্ষম হইনি।…

এর পরে আমি শুরু করলাম ল্যাটিন।

.

ল্যাটিনে গিয়ে আমি দেখলাম : এ বড় কঠিন ব্যাপার। আমি ল্যাটিন পাঠ ছাড়লাম

বটে, তবু ল্যাটিনকে আমি তেমন কাবু কখনও করতে পারিনি, একথা আমাকে বলতে হবে। গোড়ার দিকে শুরু করেছিলাম, যাকে বলে ‘পোর্ট রয়্যাল পদ্ধতি’ তাই দিয়ে। কিন্তু তাতে তেমন কোনও ফল পেলাম না। মনে হলো যেন কোন বর্বর ভাষার পাল্লায় আমি পড়েছি। ল্যাটিন কবিতার কোনও ছত্রই আমি স্মরণ রাখতে পারতাম না। আসলে আমার কিছু মুখস্থ করা বা স্মরণ রাখার কোন ক্ষমতাই ছিল না। আর যার কোনও স্মরণশক্তি নেই তার পক্ষে কোনও ভাষার কোন শব্দমাত্র পাঠ করার আগ্রহ সৃষ্টি হতে পারে না। আর গোড়াতে আমার স্মরণশক্তি বাড়াবাড়ির জন্যই যেন জোর করে ল্যাটিন পাঠ করতে লাগলাম। কিন্তু তাতে ফল কিছু হলো না। ফলে শেষপর্যন্ত ল্যাটিন পাঠ আমি ছেড়েই দিলাম। অবশ্য যতখানি পাঠ করেছি, তা যে একেবারে নিষ্ফল হয়েছে, এমনও নয়। অভিধানের ডিগ্রিতে দু’একজন সহজপাঠ্য লেখকের লেখা আমি পাঠ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। এভাবে আরও কিছুদূর এগুলাম। আমি যে ল্যাটিন থেকে খাতায় কোনও কিছু অনুবাদ করেছি তা নয়। আমি মনে মনে অনুবাদ করতাম। এভাবে বেশ কিছু ল্যাটিন লেখকদের লেখা পাঠ করতে পেরেছি। কিন্তু তবুও ল্যাটিনে কথা বলা বা কিছু লেখার ক্ষমতা আমি আয়ত্ত করতে পারিনি। এর ফলে কোনও বৈঠকে আমাকে বেশ বিব্রত অবস্থায় পড়তে হয়েছে।…

দুপুরের আগে আমি বই পড়া শেষ করতাম। দুপুরের খাবার তৈরি না হলে আমি আমার প্রিয় পায়রার পরিবারে গিয়ে উপস্থিত হতাম। এছাড়া আমার আর একটি ছোট পরিবার ছিল : মৌমাছির পরিবার। বাগানের নিচের দিকে। আমি কোনওদিন তাদের না দেখে থাকতে পারতাম না। অনেক সময়ে মৌমাছিগুলোকে দেখার জন্য মামাও আমার সঙ্গে যেতেন। ওদের কাজ কারবার দেখতে আমার বেশ ভাল লাগত। ওরা যখন নানা ফুলের গাছ থেকে ওদের পাতায় মধু ভরে একেবারে ভারি পায়ে চাকে আসত তখন তা দেখে আমি খুব মজা পেতাম। গোড়ার দিকে মৌচাকে একেবারে কাছে গিয়ে আমি ওদের কাণ্ড দেখতে চাইতাম। আমার এমন কৌতূহলকে ওরা যে সবসময় পছন্দ করত তা নয়। গোড়াতে আমার হাতে, গায়ে হুল ফুটাতে ওরা কসুর করত না। কিন্তু ক্রমে ওদের সঙ্গে আমার পরিচয় গম্ভীর হতে হুল না ফুটিয়ে আমর হাতে, মুখে, গায়ে বসত। আসলে সকল প্রাণীই মানুষকে তাদের শত্রু মনে করে। ওদের এমন সন্দেহ যথার্থ। মানুষ আসলে প্রাণী মাত্রেরই শত্রু। তবে ওদেরও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আছে। যখন ওরা দেখে কোনও মানুষ ওদের জ্বালাতন করতে চায় না, জ্বালাতন করে না তখন ওরা মানুষের বন্ধু হয়ে ওঠে। যখন বুঝে মানুষ ওদের আঘাত করতে চায় না, তখন মানুষের প্রতি ওদেরও বিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। তখন কোনও মানুষের পক্ষেও ওদের বন্ধুত্বকে স্বীকার না করে উপায়ও থাকে না। কেবল বর্বর বাদে অপর কেউ মৌমাছির প্রতি তাদের বিশ্বাস ভঙ্গ করতে পারে না।

দুপুরের পরে আবার আমি আমার বই-এর জগতে ফিরে যেতাম। অবশ্য বিকেলের এই কাজকে বই পড়ার কাজ বলেও অভিহিত করা চলে না। এ সময়টাকে আমার মনে হতো আনন্দের সময়, উপভোগের সময়। কোনও কাজের সময় নয়। আহারের পরে আমার ঘরে কোনও কাজে আমার পক্ষে মন বসানো সম্ভব হতো না। সাধারণভাবে বললে গরমের মধ্যে আমার কোনও কাজ করতে ভাল লাগত না। গরমে আমি ভারি কষ্ট পেতাম। তবুও বই পড়াতে আমি ক্ষান্ত হতাম না। এমন পড়ায় যে কোনও শৃঙ্খলা বা নিয়ম ছিল, তা নয়। তবে স্মৃতি থেকে বলছি এমন পাঠের ক্ষেত্রে আমার ভাল লাগত ইতিহাস এবং ভূগোল পাঠ বেশি। আর যেহেতু ইতিহাস আর ভূগোল পাঠে তেমন পরিশ্রমও লাগত না, তাই আমার দুর্বল স্মৃতিশক্তি দিয়ে আমার পক্ষে এই সব গ্রন্থকে যত পাঠ করা সম্ভব, আমি তত তা পাঠ করার চেষ্টা করতাম।

.

[ধর্মীয় পুস্তকাদি পাঠ থেকে রুশোর মনে নরক আর স্বর্গ সম্পর্কে একটা ভীতির সঞ্চার হয়।]

.

ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠে ধর্ম সম্পর্কে আমার যে কোনও অবিশ্বাস জন্মেছিল, তা নয়। তবু আমি নিজেকে ধার্মিক বলে কখনও বিবেচনা করিনি। আমি মরলে পরে স্বর্গে যাব, না নরকে সেটা স্থির করার আমার একটি বিশেষ কৌতুকজনক কায়দা ছিল। আমি কোনও একটা গাছ নির্দিষ্ট করে ঢিল ছুঁডতাম। আমার ছোঁড়া ঢিলটা গাছের গায়ে আমার নির্ধারিত স্থানে গেলে আমি স্বর্গে কিংবা নরকে যাব তা স্থির করতাম। এই কায়দায় আমি আমার ইচ্ছামতো স্বর্গ বা নরক গমন স্থির করতে পারতাম। টিল ছোঁড়ার আগে নিজের মনকে বলতাম, যদি ঠিক জায়গায় লাগে তবে নিশ্চয় আমার স্বর্গবাস ঘটবে। আর যদি না লাগ তবে নরকবাস। এসবের স্মৃতিচারণে এখন আমার হাসি পাচ্ছে। তবু এটাও ঠিক, এমন কারবারে আমার সময় কেটে যেত। সময় আমার মনের ওপর ভারি হয়ে চেপে বসতে পারত না।

.

[১৭৩৭-১৭৪১ : এই সময়ে কিছুদিনের জন্য রুশো জেনেভা গিয়েছিল, বিশেষ করে উত্তরাধিকার সূত্রে কিছু সম্পত্তি পাওয়ার ব্যাপারে। সেখান থেকে সে তার মামার কাছে ফিরে আসে এবং জেনেভায় যা কিছু অর্থ সম্পদ সে লাভ করেছিল তার সবই মামার হাতে তুলে দেয়।]

.

কিন্তু এই সময়ের যেটা আসল স্মৃতি, তা হলো আমার শরীর ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়তে লাগল। আমি যেন ক্রমশ শুকিয়ে যেতে লাগলাম। আমার শরীর দেখতে হয়ে উঠল একটা মরা মানুষের কঙ্কালের মতো। আমার শরীরের শিরাগুলোর কম্পন ভয়ানক হয়ে দাঁড়াল। আমার হৃদযন্ত্রের কম্পনও আরও ঘন ঘন হতে লাগল, আমি অধিকতরভাবে শ্বাসকষ্টে ভুগতে লাগলাম। আমার দুর্বলতা এত বৃদ্ধি পেল যে, আমার পক্ষে হাঁটা প্রায় অসম্ভব হয়ে আসত। আমি মাথা নিচু করতে পারতাম না। নিচু হওয়ার চেষ্টা করলে আমার মাথা ঘুরতে শুরু করত। কোনও সামান্য ওজনের বস্তুও আমি তুলতে পারতাম না। আমি একেবারে নিষ্কর্ম হয়ে পড়লাম। তাতে আমার মতো অস্থির মানুষের মনে যন্ত্রণার আর শেষ রইল না। আমার সন্দেহ হলো আমি হিস্টেরিয়া বা মৃগী রোগের শিকারে পরিণত হয়েছি। আমি ভাবতাম এই রোগ হয় সুখী মানুষের। আমার মতো দুঃখী মানুষের জীবনে শেষপর্যন্ত এই রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটতে শুরু করল। আমার চোখে ক্রন্দনের কোনও কারণ ছাড়াই হঠাৎ পানি জমতে শুরু করত। গাছের একটি পাতার পতনে কিংবা একটি পাখির ডাকে, বলা চলে একেবারে সুখের অবস্থাতেও আমার মনে আবেগের সঞ্চার হতো, একে আমি মৃগী রোগের লক্ষণ বলেই মনে করতাম। আসলে এই জগতে আমার মতো মানুষের সামান্যতম সুখেরও ভাগ্য হয় না। ফলে কখনও যদি সামান্যতম সুখ বা দুঃখের কারণ ঘটে তাহলেই আমাদের মনে একটা অস্থিরতার ভাব জন্মে। সুখ আর দুঃখের আগমন যদি একই সঙ্গে না ঘটে, তাহলেও একটি আর একটিকে প্রভাবিত করে। ফলে আমার জীবনে যখন কোনও সুখ বা আনন্দের ঘটনা ঘটত তখনও তাতে ক্রন্দনের অবস্থার উদ্ভব অপর মানুষের কাছে একেবারেই দুর্বোধ্য বলে বোধ হতো। পরবর্তী সময়ে দেখা গেল, আমার বয়স বৃদ্ধিতে, আমার যখন বয়স হলো প্রায় ষাট, তখনও আমার শরীরের সুখ-দুঃখ বোধের শক্তি যেন বৃদ্ধি পেতে লাগল। আজ যখন প্রায় ষাট বছর বয়সে সুখ-দুঃখের এমন অবস্থার স্মৃতিচারণ করছি তখনও যেন আমার মনের মধ্যে একটা আবেগের সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে আমি বুঝলাম আনন্দ আর সুখকে ভোগ করার শক্তির চাইতে আমার মধ্যে যেন দুঃখ এবং কষ্টকে ভোগ করার শক্তিটাই অধিক ছিল।

.

[এই সময়ে একজন খ্যাতিমান চিকিৎসককে তার শরীরের অবস্থা সম্পর্কে পরামর্শের জন্য যখন ডাকা হচ্ছিল, তখন পথিমধ্যে গাড়িতে তার দু’জন চমৎকার মহিলার সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে।]

.

এ দু’জনের মধ্যে মাদাম দ্য লারেন্সের কথা মনে আছে। ইনি আমাকে দস্তুর মতো দখল করে ফেললেন। তখন থেকে আমার মধ্যে আর কোনও রোগের প্রকাশ ঘটল না! না জ্বর, না হিস্টোরিয়া, না পলিপট। ওর সঙ্গ যখন পেতাম তখন আমার মধ্যে হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি পাওয়া ব্যতীত কোনও রোগের উপসর্গই আমি দেখতে পেতাম না। তার সঙ্গ লাভ যথার্থই আমার হৃদযন্ত্রের স্পন্দনকে বৃদ্ধি করে দিত। তিনিও আমার এই রোগটিকে সারাবার কোন চেষ্টা করতেন না। আমিও তার সঙ্গে আমার হৃদস্পন্দনের বৃদ্ধিকে কামনা করতেই লাগলাম। অবশ্য আমার শারীরিক দুর্বলতার ব্যাপারটাই তাদের আলোচনার বিষয় ছিল। তারা বুঝলেন, আমি অবশ্যই অসুস্থ। আমি মন্টিমিলিয়ারের দিকে যাচ্ছিলাম। তাদের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতায় তারা একথা বুঝলেন যে আমি কোনও খারাপ লোক নই। আমি কোন প্রকার লাম্পট্যসম্পন্ন চরিত্র নই। আর আমি যে আমার লাম্পট্য সংশোধনের জন্য মন্টিমিলায় যাচ্ছিনে, তা তারা বিশ্বাস করলেন। আমি জানি কারও কোনও রোগ তাকে অন্য কারোর বিশেষ করে কোন মহিলার কাছে আকর্ষণীয় করে তোলে না। তবু একথা সত্য যে আমার রোগটাই যেন এই দু’জন ভদ্রমহিলার কাছে আমাকে আকর্ষণীয় করে তুলেছিল। সকাল হলেই আমি রাতে কেমন ছিলাম তা জানতে চেয়ে তারা লোক পাঠাতেন।

একবার এমন হলো যে, আমার স্বভাব অনুযায়ী কোনও চিন্তা না করে কথা বলার যে স্বভাব, সেই স্বভাব থেকে আমি বললাম : আমি জানিনে। আমার এমন জবাবে তারা মনে করলেন : আমি একটা পাগল। তারা দুজনেই আমাকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে দেখতে লাগলেন। তাদের এমন আচরণে আমি কিছু মনে করলাম না। আমি একবার শুনলাম মাদাম দু কলাম্বিয়ার তার এক বন্ধুকে আমার সম্পর্কে বলতে গিয়ে বললেন : লোকটার ব্যবহার ভাল নয়। তবু লোকটা খারাপ নয়। লোকটার একটা আকর্ষণ আছে। তাদের এই কথা শুনে আমি খুশিই হলাম এবং তার ফলে আমার আচারণে সাহসও বেশ কিছু বৃদ্ধি পেল।

আমাদের ঘনিষ্ঠতা যখন আরও বৃদ্ধি পেল তখন আর আমার নিজের সম্পর্কে কথা বলতে বাধল না। আমি কেন, কোত্থেকে এসেছি সবই আমি বললাম। আমার এমন আলাপে আমি যে কিছুটা বিব্রত হয়ে পড়িনি, তাও নয়। কারণ আমি বুঝলাম আমি ধর্মান্তরিত হয়েছি একথা বললে এই কেতাদুরস্ত মহিলাদের মধ্যে আমার অবস্থা যে কাহিল হয়ে পড়বে, তা আমার বোঝা উচিত ছিল। আমি জানি না কেন আমি আমার আলাপে নিজেকে একজন ইংরেজ বলে পরিচয় দিয়েছিলাম। আমি এমনও বললাম যে, আমি একজন জ্যাকোবাইট বা জ্যাকোবাইটপন্থী(১১)। আমি বললাম, আমি একজন ডাডিং। একথা শুনে তারা আমাকে মিস্টার ডাডিং বলতে শুরু করল। সমবেতদের মধ্যে একজন ছিল বিভ্রান্ত রকমের এক মারকুইস দা তোরিগনান। সে আমাদের দলেই ছিল এবং আমার মতোই এক অক্ষম। আমি জানি না কোন্ চিন্তা থেকে মিস্টার ভাডিং-এর সঙ্গে আলাপে উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন। সে রাজা জেমস্ সম্পর্কে আমার সঙ্গে আলাপ শুরু করল। রাজা জেমসকে বলা হতো মিথ্যাবাদী রাজা। অর্থাৎ রাজা হওয়ার তার কোনও দাবি ছিল না। সেন্ট জারমেইন সম্পর্কেও সে যেন কী বলল। আমি তার বিন্দু বিসর্গ বুঝলাম না। আমি আসলে তখনকার ইংল্যান্ডের রাজনীতি সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। কিছুই বুঝতাম না। ফলে আমি যেন একটা ফাঁদে আটকে গেলাম। ইংল্যান্ড সম্পর্কে যা আমি জানতাম সবটারই দৌড় ছিল ইংল্যান্ডের তখনকার সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশিত কিছু ঘটনা। কিন্তু তবু একথা বলতে হয় যে ইংল্যান্ড সম্পর্কে আমার এই যৎসামান্য জ্ঞানের আমি বেশ ভাল রকমই ব্যবহার করতে সক্ষম হলাম। আমার ভাগ্য ভাল এদের কেউ আমার ইংরেজি ভাষার জ্ঞান সম্পর্কে কোনও প্রশ্ন উঠাল না করলে আমার নাস্তানাবুদ হওয়া ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। কারণ ইংরেজি ভাষার একটা শব্দও আমার জানা ছিল না।

.

[এদের মধ্যে মাদাম দা লারনেজ নামের এক মহিলা বারংবার রুশোর প্রতি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছিল। রুশো তাকে তেমন পাত্তা দিল না। রুশোর মনে হচ্ছিল যেন সে রুশোকে নিয়ে কৌতুক করার চেষ্টা করছে।]

.

কিন্তু এই মাদাম দা’ লারনেজ তবু হাল ছাড়ছিল না। সে বারংবার আমার দিকে ভাবময় ভঙ্গিতে কেবল তাকাচ্ছিল এবং এমন নরমভাবে আমাকে সম্বোধন করছিল যে, আমার চাইতে কোনও বুদ্ধিমান ব্যক্তিই তার কথাকে আদৌ গুরুত্ব দিত না। কিন্তু সে আমাকে আদৌ ছাড়ছিল না। ফলে সে যত অদম্য হয়ে উঠছিল, আমি যেন তত তার ফাঁদে জড়িয়ে পড়তে লাগলাম। মহিলা বলল : আহা তুমি যা বলছ তার কিছুমাত্র যদি সত্য হতো তাহলে আমি নিজেকে একজন ভাগ্যবতী বলে গণ্য করতাম। আমার মনে হয় আমার সরলতাই তাকে মুগ্ধ করে তুলছিল এবং কোনক্রমেই সে তার এই কসরতে আর হার মানতে রাজি হচ্ছিল না।

.

আমরা ইতোমধ্যে মাদাম দা’ কলোবিয়ার রোমান্স এর বাসা পরিত্যাগ করে এসেছিলাম। আমরা আমাদের যাত্রা আস্তে ধীরে চালাতে লাগলাম। আমরা বলতে : মাদাম দা লারনেজ, মারকুইস দা’ তরিগনান এবং আমি।

মারকুইস অবশ্য একেবারে অক্ষম হয়ে পড়েছিলেন, আবার তার খুঁতখুঁতে স্বভাবেরও বৃদ্ধি ঘটছিল, তবুও লোকটিকে আমার খারাপ লাগছিল না। তবে নিজে অন্য লোকের সঙ্গ তেমন পছন্দ করতেন না।

মাদাম দা নারনেজকে দেখলাম, আমার প্রতি তার আকর্ষণটি লুকিয়ে রাখার তেমন কোনও প্রয়োজন তিনি বোধ করলেন না। অবশ্য এ ব্যাপারটি সম্পর্কে আমার চাইতে তিনি আগেই অবহিত হয়েছিলেন। তাতে ভদ্রমহিলার আকর্ষণের চাইতে আমার প্রতি তার ঠাট্টার ভাবটি আমার মনের মধ্যে একটা সাহসের সঞ্চার করেছিল। আমার মনের মধ্যে যেন কী রকম একটা বিকারের সৃষ্টি হয়েছিল। আমার মনে হলো যেন ওরা আমাকে নিয়ে কী একটা খেলা খেলতে চাচ্ছে। আমার এমন অর্থহীন ধারণা আমার মাথাটাকে যেন একেবারে ঘুরিয়ে দিল। আমি বুঝতে পারছিলাম না, মাদাম দা লারনেজ কেমন করে আমার এরূপ অদ্ভুত আচরণ সহ্য করছিলেন। তিনি তো আমাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে দিতে পারতেন। কারণ তিনি তত বুদ্ধিহীনা ছিলেন না। তিনি তো বুঝতে পারছিলেন যে তার প্রতি আমার আচরণে যত না প্রশ্রয় ছিল, তার অধিক ছিল প্রত্যাখ্যান।

শেষপর্যন্ত দেখলাম মাদাম দা লারনেজ তার সহ্যশক্তি দিয়ে আমাকে সে যথার্থই কবজা করে ফেলল। আমরা সময় মতোই ভালেন্স পৌঁছাতে পেরেছিলাম। মধ্যাহ্নভোজে আমাদের কোনও অসুবিধা হলো না এবং আমাদের বুদ্ধিমত্তার কারণে আমরা সাথ সাথে জায়গাটা পরিত্যাগ না করে সারাদিনটাই আমরা ওখানে কাটিয়ে দিলাম। আমরা শহরের বাইরে সেইন্ট জেইনসে তাঁবু খাটালাম। এই সরাইখানাটাকে আমি জীবনে বিস্মৃত হব না। মাদাম দা লারনেজ যে ঘরটায় ছিলেন, সে ঘরটাও আমার স্মৃতিতে অমর হয়ে রইল। মধ্যাহ্ন আহারের পরে মাদাম দা লারনেজ আমাকে নিয়ে একটু হাঁটতে বেরুলেন। তিনি জানতেন মারকুইস এমন হাঁটা তেমন পছন্দ করবেন না। আসলে এটা ছিল তার নিজের জন্য একটু সময়ের বিলাসকে জোগাড় করা। আর এই সময়টাকে আনন্দের সঙ্গেই ব্যবহার করলেন। কারণ তিনি জানতেন হয়তো সময় আমাদের আর বেশি ছিল না। আমরা শহরটা ঘুরে বেড়ালাম। দুৰ্গটা ঘিরে একটা পরিখা ছিল, সেটিও আমাদের ভাল লাগল। আমি মাদামকে আবার আমার দুঃখের সব কাহিনী বলতে লাগলাম। আমার দুঃখের কথায় মাদাম যথার্থই সমবেদনা প্রকাশ করতে লাগলেন। মাঝে মাঝে তিনি আমার হাত তার বুকে চেপে ধরলেন। তার এই ব্যবহারেই আমি আপুত বোধ করতাম। কারণ আমি তার আচরণের গভীরে প্রবেশ করার কোনও বুদ্ধি রাখতাম না।

আসলে আমি নিজেই অভিভূত হয়ে পড়ছিলাম। আমি আগেই বলেছি, তার দেহ সৌষ্ঠবের একটা আকর্ষণ ছিল। তার ভালবাসার প্রকাশ তাকে আমার কাছে অধিকতর সুন্দর করে তুলছিল। তার আচরণ তাকে তার তারুণ্যে নিয়ে যেতে লাগল। এবং তার প্রতি আকর্ষণ এত গভীরভাবে প্রকাশ করতে লাগলেন যে সেই প্রকাশে আর যে কোনও পুরুষই আপুত না হয়ে পারত না। ফলে আমার মধ্যে একটা বিব্রতবোধ যেন সৃষ্টি হচ্ছিল আর মাঝে মাঝেই তার প্রতি আমার একটা আগ্রহ যেন বৃদ্ধি পাচ্ছিল যা আমি না পারছিলাম দমন করতে, না তা নিয়ে আরও অগ্রসর হতে। একটা ব্যাপার দেখলাম মাদামের প্রতি আমার এই আকর্ষণ ও আচরণ মারকুইস বেশ কৌতূকের সঙ্গে উপভোগ করছিলেন। এর অধিক আমাকে প্রতি নিবৃত্ত করছিল এই আকর্ষণ পাছে না আমার এমন আচরণে শেষপর্যন্ত আমি তার এক হাসির খোরাকে পরিণত হয়ে যাই। আমি যেন একটা ভাসন্ত ভেলায় পরিণত হয়ে যাচ্ছিলাম।

আসলে আমার এমন আচরণকে যেন বোধ করতে পারছিলাম না। আমি বুঝতে পারছিলাম, আমার এই আচরণের পরিণাম খুব ভাল হবে না। তবুও আমার ভাগ্য ভাল যে, মাদাম আমার প্রতি কোন দুর্ব্যবহারের বদলে আমার প্রতি যেন দয়াপরবশ হয়ে উঠছিলেন। সুখের বিষয় আমি দেখলাম আচম্বিতে মাদাম লারনেজ তার হাত দিয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরলেন এবং সাথে সাথে তিনি তার মুখকে আমার মুখের ওপর চেপে ধরলেন। এবার তার নিজের আলাপে আর কোনও সঙ্কোচ রইল না। ফলে আমারও সাহসের কোনও অভাব ঘটল না। এই মুহূর্তটা ছিল চরম মুহূর্ত। আমিও যেন তার বন্ধনে গলে যেতে লাগলাম। আমি যথার্থই পুরুষ হয়ে উঠলাম। আম চুম্বন, আমার মুখ ও জিহ্বা কোনওটাই আর বাধ মানল না। আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে আমি তাকে আঘাত করতে কসুর করলাম না। এমন সাহস আমি কেমন করে পেলাম, আমার স্মৃতির সেটিই এখন একমাত্র প্রশ্ন। এবার আমার বিজয় যে পূর্ণ হলো আর তার আঘাতে মাদাম যদি কিছুটা আহত হয়ে থাকেন তাতে যে তিনি একটুও রাগান্বিত হচ্ছিলেন না, তা বুঝতেও আমার কোন অসুবিধা হচ্ছিল না।

আমি যদি একশ’ বছরও বাঁচি তবু আমি এমন মনমোহনকারী মহিলার কথা বিস্মৃত হতে পারব না। তার স্মৃতিতেই আমার আনন্দ। আমি মনমোহিনী কথাটি বললাম। এর একটা কারণ আছে। একথা ঠিক মহিলাটি যে খুব সুন্দরী ছিল, এমন নয়। সুন্দরীও নয়। আবার যেমন বয়স্ক নয়, তেমনি দেখতে অসুন্দর নয়। তা সত্ত্বেও তার মুখের ভাবটিতে এমন কিছু ছিল না যাতে তার বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে কোনও বাধা সৃষ্টি হতো। অন্য কোনও মেয়ের তুলনায় তার মুখে কোন তারুণ্য লাবণ্য ছিল না। সে মুখে রুজ ব্যবহার করত। তাতে যে তার মুখের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেত তেমনও নয়। তথাপি তার সহজ সারল্যের একটা আকর্ষণ ছিল। আর সেই সারল্য দিয়েই সে আমাকে মুগ্ধ করেছিল। ভালবাসার প্রকাশ বাদে যে তার দিকে আমি তাকাতে পারতাম না, তা নয়। তবু তাকে ভাল না বেসে তাকে আমার পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব হতো না। এ থেকেই আমার মনে হয়, আমার প্রতি তার ভালবাসার প্রকাশ অপরের প্রতি তার প্রকাশ থেকে যেন ভিন্ন হতো। আমার প্রতি তার ভালবাসার প্রকাশ যেমন আচম্বিতে ঘটত তেমনি তার মধ্যে কোনও মালিন্যের ভাব যেমন থাকত না, তেমনি তার প্রকাশে এমন একটা আন্তরিকতা ছিল যাকে আমি প্রত্যাখ্যান করতে পারতাম না। তার অন্তরের প্রকাশে দৈহিকতার কোনও প্রাবল্য থাকত না। যে যেরূপ কোমলতার সঙ্গে আমাকে স্পর্শ করত, তাতে আমি বুঝতাম আমার প্রতি ওর দেহের দাবি যেমন ছিল তার চেয়েও অধিক ছিল আমার জন্য ওর মঙ্গল কামনা।…

সেই সময় আমরা যে এলাকাটাতে ছিলাম এবং তখনকার প্রাকৃতিক যে কোমলতা আকাশে বাতাসে ছিল তাতে অপরিসীম আনন্দ আমরা ভোগ করতাম। এমন জীবন ভোগে মারকুইসের কোনও বাধা ছিল না। তাই বলতে পারি সেই সময়টার আনন্দ আমরা পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করতে পেরেছিলাম। আমি তাদের শয়নকক্ষ পর্যন্ত যাতায়াত করতে পারতাম। যদিচ মারকুইসের একটা চাকর ছিল যাকে আমার পছন্দ হতো না। তবু আমাদের শয়ন ঘরগুলোর ব্যবস্থাপনায় আমার অবস্থান মাদাম লারেন্সের শয়ন কক্ষের পাশেই ঘটত।…

তার জন্য আমার অনুভূতিতে ভালবাসার আধিক্য প্রকাশিত না হলেও সে আমার প্রতি যে মমতার প্রকাশ ঘটাত আমার আচরণেও তার স্বীকৃতির কোন অভাব ছিল না। আমাদের উভয়ের দৈহিক আচরণেও আনন্দ এবং মিলনের কোনও অভাববোধ হতো না। প্রকৃত ভালবাসার অনুভূতি আমার জীবনে একবারই ঘটেছিল। সে অবশ্য এই মেয়েটার সঙ্গে নয়। তাছাড়া মাদাম দা লারনেজের সঙ্গে আমার যে ভালবাসা ছিল তার কথাও বলছিনে। তবু এমন পার্থক্যের কথায় আমার যে অনুভূতির প্রকাশ ঘটছে তাও অন্য কিছুর সঙ্গে অতুলনীয়। মামার সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক ছিল তাতে সর্বদাই একটা দুঃখের ভাব ছিল। তাতে আমার অন্তরে একটা বেদনার ভাব থাকত। এই দুঃখবোধটাকে অতিক্রম করা আমার পক্ষে কঠিন ছিল। মাদামের সঙ্গে আমার দৈহিক সম্পর্কের একটা অদ্ভুত বৈপরীত্য বোধ থাকত। তাকে অধিকারে আমার যতটা না আনন্দবোধ হতো, তার অধিক তাকে পরাভূত করতে পারার জন্য একটা দুঃখবোধের সৃষ্টি হতো।

মাদাম দা লারনেজের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার ওপর আবার অধিকার প্রাপ্তিতে যথার্থ একটা গর্ববোধের সৃষ্টি হতো। আমার মধ্যে একটা পৌরুষবোধ জাগ্রত হতো। তাকে ভোগ করতে আমার আনন্দের যেন সীমা থাকত না। তার ওপর যে অধিকার আমি প্রয়োগ করতাম তাতে কোনও পাপ বা দুঃখবোধ থাকত না। যা থাকত তাকে আমি কেবল বিমল আনন্দই বলতে পারি। তাকে ভোগ করতে আমার কোনও দীনতার বোধ ছিল না। এবং তার পৌনপুনিকতাতেও আমার কোনও ক্লান্তি আসত না।

আমার ঠিক মনে নেই মারকুইস আমাকে রেখে গিয়েছিল। তবে এটা ঠিক যে আমরা যখন মান্টলিমার পৌঁছি, তখন আমরা একাকী ছিলাম। আর এখানে আসার পর মাদাম দ্য লারেঞ্জ তার দাসীটিকে আমার গাড়িতে যে পাঠিয়ে দিয়েছিল সেটি আমার মনে আছে। আমি তখন গাড়ীতে একাই ছিলাম। তবে তাতে আমার কোনও অসুবিধা ঘটেনি। …

আমাকে পল্ট দা গার্ড দেখার জন্য যেতে বলা হল। তার হুকুম মত আমি তাই করলাম। আর এই উপলক্ষে আমি এই প্রথম একটা বোম সৌধ দেখার ভাগ্য পেলাম।

এই সৌধটি দেখে আমি যথার্থই মোহিত হয়েছিলাম। আমার মনে প্রশ্ন না জেগে পারেনি এই সৌধের বিরাট পাথরগুলো ওরা কেমন করে খনির মধ্য থেকে তুলে এনেছিল।

এই সৌধটির তিনটি তলা আমি অতিক্রম করে উঠেছিলাম।

আমি এই সৌধের সিঁড়িতে পা রেখে যত উঠতে লাগলাম তত যেন অবিশ্বাস্য সেই কারিগরদের সঙ্গে যেন আমার সাক্ষাৎ দর্শন ঘটতে লাগল। একটা স্থানে যথার্থই আমি একটা রোমান এমপি থিয়েটারের দর্শন লাভ করলাম।

.

[আনন্দের সঙ্গে কয়েক সপ্তাহ কাটার পর রুশো মাদাম দা লারেঞ্জের সঙ্গ পরিত্যাগ করা ঠিক করল। তার মনে হল এর অধিক কাল অতিক্রম করলে মাদাম দা লারেঞ্জের ঘোড়শী মেয়েটির মোহ থেকে সে মুক্ত হতে পারবে না।]

.

এখন এটা আমি এটা বুঝতে পারি কিছুকাল যদি কারো সঙ্গে পবিত্র জীবন যাপন করা যায় সর্বমোহ মুক্ত হয়ে, তাহলে আত্মার অবশ্যই একটা উন্নতি ঘটে। আমি সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে আমি যেন আর একটা মানুষে পরিণত হয়ে গেলাম। যেন আমার অধঃপতন থেকে একটা মুক্ত মানুষের অস্তিত্বে আমি প্রত্যাবর্তনে সক্ষম হলাম। আমি সময় মতই ফিরে এলাম। আরো কিছু দূর এগুতেই আমার চোখ আর মন তাকে অন্বেষণ করতে শুরু করল। আমি যেন তাকে পাওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠলাম। আমি উঠানের চারদিকে তাকাতে লাগলাম। অথচ কাউকে দেখতে পেলাম না। আমি যেন একটা অস্বস্তিতে ডুবে গেলাম। আমার একটা ভয় হতে লাগল, কিছু একটা ঘটেছে আমি আরও ভেতরে এগিয়ে গেলাম। দেখলাম কয়েকটি লোক খাচ্ছিল। আমার জন্য কেউ অপেক্ষা করছিল এমন কোনও আভাস পেলাম না। এই সময়ে একটি চাকরানী আমাকে দেখে বিস্মিত হয়ে উঠল। সে আমার আসাটা একেবারেই টের পায়নি। আমি তাকে পরোয়া না করে দোতলায় উঠে গেলাম।

অবশেষে আমি তাকে পেলাম যাকে আমি অন্বেষণ করে বেড়াচ্ছিলাম। আমার ভালবাসার পাত্রীকে আমি পেয়ে গেলাম। ছুটে গিয়ে তার গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। মামা এবার হেসে উঠল, কীরে বাচ্চা, তুই এতদিনে এলি? খুব তো ঘুরলি। কেমন লাগল, তুই আছিস কেমন?’ মামার এই আদর আমাকে বিস্মিত করল। আমি মামাকে একটা চিঠিও লিখেছিলাম। সে চিঠিটা কি সে পায়নি। আমি জিজ্ঞেস করাতে সে বলল : ও! চিঠি পেয়েছিলাম তো। এর চাইতে আর বেশি কিছু বলল না। আমিও কিছু বললাম না। আমি দেখলাম তরুণ একটি ছেলে মামার গা ঘেঁষে বসে আছে যে, আমি বাড়িটা ছেড়ে যাওয়ার আগে ছেলেটাকে যে না দেখেছি, তা নয়। কিন্তু এখন দেখলাম সে আগের চেয়ে বেশ জমিয়ে নিয়েছে। আমি বুঝলাম যেন এতদিনে আমি বেদখল হয়ে গেছি!

ছেলেটা কোন গ্রাম থেকে যেন এসেছিল। ও পরচুলা বানাবার কাজ করত। ওর বাবার নাম ছিল ভিনজেনরিড। লোকটা নিজেকে বলত চিলন দুর্গের রক্ষাকর্তা। ছেলেটা চলার পথে পরচুলা বানাত। ছেলেটা গ্রাম থেকে প্রথম যখন শহরে এসে মাদাম দা ওয়ারেনস এর সঙ্গে দেখা করে, তখন তিনি তাকে বেশ ভাল চোখেই দেখেছিলেন। তার স্বভাব এমনি ছিল। নিজের গ্রাম থেকে কেউ এলে মাদাম তাকে খাতিরই করতেন।

ছেলেটা যখন প্রথম এসেছিল তখন সে কাঠখোট্টা ধরনের ছিল। কিন্তু দেখতে বেশ সুন্দরও ছিল। ছেলেটা বোকা মূর্খ ছিল বটে। কিন্তু অন্যদিকে ছেলেটা বেশ ভালই ছিল। এমনি একটা ছেলে আমার জায়গা দখল করে নিল। আমি চিন্তা করে বললে বলব, ছেলেটা একেবারে খারাপ ছিল না।

আর আমার চরিত্রও এতদিনে পাঠকদের কাছে নিশ্চয়ই কিছুটা পরিচিত হিয়ে উঠেছে। ফলে আমি ব্যাপারটাকে খুব ভাল চোখে নিতে পারলাম না। পরিস্থিতিটা আমার জন্য দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কী। যে স্বপ্ন, সুখের স্বপ্ন আমি এতদিন নিজের জন্য দেখে আসছিলাম সেসবই এবার একেবারে যেন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। যে আমি আমার কৈশোর থেকে মামাকে বাদ দিয়ে আমার অস্তিত্বকে আদৌ কল্পনা করতে পারিনি, সেই আমি আজ একেবারে নিঃস্ব এবং একেবারে সঙ্গীহীন হয়ে পড়লাম। এখন যে জীবন আমি যাপন করতে শুরু করলাম সে জীবন একেবারেই আনন্দহীন হয়ে দাঁড়াল। আমি তখনো কিশোর মনে এক তরুণ। কিন্তু একটি তরুণের মনে যে আনন্দ এবং উপভোগের একটা বোধ থাকে, যার মনে একটা আশার দীপ জ্বলে সে যেন চিরদিনের জন্য আমার জীবন থেকে নিভে গেল। তখন থেকে যাকে আমি জীবিত জীবন বলে মনে করতে লাগলাম সে যেন জীবন নয়, একটা অর্ধমৃত দেহে পর্যবসিত হয়ে গেল। আমার সামনে স্বাদহীন একটা জীবন বৈ আর কিছু অবশিষ্ট রইল না। এখন দুএক সময়ে যদি-বা পেতাম, তবু একে আর আমি নিজের অস্তিত্বের কোনও প্রকাশ বলে ভাবতে পারলাম না। আমার মনে হল যাকে আমি আশা মনে করছি, এ আশা আদৌ আমার নয়।

আমি আমার বোধে এত সরল ছিলাম আবার নিজের বিশ্বাসে এত অনড় ছিলাম যে, যদি-বা নিজের মনে ক্ষণে ক্ষণে আশার আলো জ্বলে উঠত এবং যাকে আমার মামারই অস্তিত্বের কিছুটা প্রকাশ বলে বোধ হতো এবং দেখতাম মামার সেই প্রকাশের আকর্ষণে কত না মানুষ তার দিকে ছুটে যেত, তবু আমি তার মধ্যে তার সেই অস্তিত্বকে আমি খুঁজে পেতাম না। কিন্তু একবার দেখলাম সে বিনা দ্বিধায় নিজের চরিত্রকে আমার চোখের সামনে তুলে ধরে আমাকে যেন একেবারে প্রাণশূন্য করে ফেলল। তার এমন প্রকাশে আমার যদি বিন্দুমাত্র শক্তি থাকত তবে রাগের আগুনে আমি জ্বলে উঠতাম। অথচ ব্যাপারটাকে কত-না সরলভাবেই নিল, বাড়িতে কখনও তার নিকটবর্তী হলে আমাকে বকুনিতে আর শেষ রাখত না। তবু আমি রেগে জ্বলে উঠে বললাম, মামা তুমি আমাকে এমন করে বকছ কেন? তোমার প্রতি আমার এমন ভালবাসার তুমি এমন প্রতিদান দিলে, এই তুমিই না তোমার ভালবাসা দিয়ে আমাকে কতবার জীবন দিয়েছ! আর সেই তুমি আজ আমার প্রতি এমন ব্যবহার করছ! তোমার এমন প্রতিদানে আমি মরে যাব ঠিকই। কিন্তু আমার মৃত্যু তোমাকে দুঃখ ছাড়া আর কিছুই দিবে না।

আমার এমন কথাতেও সে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না। একেবারে শান্তভাবে সে বলতে লাগল : আরে বাচ্চা, এ তো কিছু না। তুইও মরবি না আর আমারও কিছু হবে না। আবার আমরা অন্তরঙ্গ হব। তোর প্রতি আমার মমতা একটুও কমবে না। এর কোনও শেষ হবে না। আমার জীবন শেষ না হওয়া পর্যন্ত এর কোনও শেষ হবে না। কী আশ্চর্য, নিরুদ্বেগে মামা এই কথাগুলো বলতে লাগল।

আমার মনে হলো মামা যেন বলছে, তুই ঘাবড়াসনে। আমাদের কোনও পরিবর্তনই ঘটেনি। আর কারোর সাথে থাকলেও আমি তোর। তার এমন কথায় আমার নিজের অস্তিত্বকেই যেন হারিয়ে ফেললাম। এমন মমতাভরা কথা। এমন কী হতে পারে? যা আমাদের মধ্যে ঘটেছে তার পরেও! সেই মুহূর্তের মতো এমন মমতা মামার কাছ থেকে যেন আর কোনওদিনই পাইনি। আমি মামার পায়ে তক্ষুনি লুটিয়ে পড়লাম। আমার চোখ দিয়ে যেন সমুদ্রের স্রোত বইল। আমি তার হাঁটু জড়িয়ে ধরলাম। আমি বললাম, মামা তুমি আমাকে ক্ষমা করো। তোমার ওপর আমি অন্যায় করেছি। তোমাকে আমার ভালবাসাতে কোনও সীমা নেই। তোমাকে আমি যেভাবে পেতে চাই, তোমাকে অপর কেউ এমনভাবে পাক, এ আমি কল্পনা করতে পারিনে। তোমার প্রতি আমার ভালবাসা কেবল বৃদ্ধি পেয়েছে, কখনও হ্রাস পায়নি। যেদিন থেকে তোমাকে আমি পেয়েছি, তারপর থেকে আমার সে ভালবাসার বিন্দুমাত্র হ্রাস ঘটেনি।

মামা তুমি আমার পূজ্য। আমি তোমাকে চিরকাল একইভাবে ভালবাসব। আমার হাজার বার মরণ ঘটুক, তবু যেন আমার হাতে তোমার কোনও অপমান না ঘটে। তোমার প্রতি আমার ভালবাসায় কোনও ঘৃণ্যতা থাকতে পারে না। এমন কথা আমি কল্পনা করতে পারিনে।

এটা সেদিন যথার্থই আমার অন্তরের কথা ছিল। এই আন্তরিকতা থেকে আমার বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি ঘটেনি। সেই মুহূর্ত থেকে আমি যেন যথার্থই আমার নিজের মায়ের একটি স্নেহের পুত্রতে পরিণত হয়ে গেলাম। যদিও একথা ঠিক যে তার মধ্যে আমার গভীর ভালবাসার প্রকাশ আর দেখিনি। তবু মামা আমাকে কখনও পরিত্যাগ করেনি। কখনও পরিত্যাগ করার কোনও প্রকাশ ঘটায়নি। তার আচরণে কোনও নৈরাশ্যের আভাস পাইনি। কিংবা কোনও কপটতার প্রকাশ কখনও দেখিনি। মেয়েরা নানা কপটতায় অবশ্যই পটু। মেয়েরা নিজেদের না দিয়েও দান করার ভান করতে পারে। বরং এমন আচরণে পুরুষের পরাজয় মান্য করা ছাড়া উপায় থাকে না।

.

[মামা সম্পর্কে রুশোর এমন দৃঢ় প্রতিজ্ঞা তার মামার মনকে অধিকতর নিস্পৃহই করে তুলল।]

.

কিন্তু আমি নিজের উপর যতই আঘাত করলাম না কেন মামা আমার প্রতি তাতে

এতটুকু নরম হলো না। মেয়েদের বোধ হয় এমনি স্বভাব। তারা যা হারায় তার জন্য যত অপেক্ষা না করে তার অধিক তারা যা পায় না তার জন্য একটা অবাধ্যতার বোধ দ্বারাই তারা আক্রান্ত হয়। একজন দার্শনিক মহিলার কথাও যদি ধরা যায়, তার অপরাধ যদি ক্ষমতার অযোগ্যও হয়, তবু অন্য বিষয়ে সে নমনীয় হলেও এমন ক্ষেত্রে সে নত হতে চায় না। সেদিন থেকে আমি মামার মধ্যে আর তার পূর্বের মমতার সাক্ষাৎ পেলাম না। এরপর থেকে সে আর তার নিজের বুকের কামনা আর আমার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়নি। তখন থেকেই আমি এটা বুঝতে পারলাম, আমার ভাগ্য ভেঙে গেছে। সেদিন থেকে তার কাছে আমি যে ঋণে ঋণী ছিলাম, আমি স্থির করলাম, আর আমি প্যারিসে থাকব না। প্যারিসকে আমার ছাড়তে হবে। পরিশেষে আমার যা কিছু দক্ষতা ছিল তা নিয়ে আমি প্যারিস পরিত্যাগ করলাম।…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *