পঞ্চম পুস্তক

পঞ্চম পুস্তক

[এই পর্যায়ে দেখা যায় আঁ আঁকে তথা রুশো আবার প্রিয় মামার সঙ্গে বাস করতে শুরু করেছে। ওর বাসের ঘরটা ছিল কিছুটা অন্ধকারময় আর বিষণ্ণ। মামার আলাপে বোঝা গেল তার নিজের চাকরটিও তার আর একটি প্রেমিক।]

কিন্তু আমার মনটা একটু খারাপই লাগল যে, মামার সঙ্গে আমি ছাড়া এত ঘনিষ্ঠতায় আর কেউ থাকবে। এই নয় যে, আমি কোনওদিন তার সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠতা কামনা করেছি। তবু অপর কেউ আমার চাইতে তার ঘনিষ্ঠ এমনটাও আমার সহ্য হচ্ছিল না। কী করব। এমন ভাবা ছাড়া আমার উপায় ছিল না। এই লোকটার প্রতি আমার একটা বিতৃষ্ণা জেগেছিল, একথা ঠিক। তবু তা সত্ত্বেও এই লোকটাকেও আমি ভালবাসতে লাগলাম। কারণ আমি আবার যাতে খুশি হই, তাতেই আমি খুশি হব। কাজেই এ লোকটিকে যখন মামা ভালবাসে তখন আমিও লোকটিকে ভালবাসব। লোকটাকে দেখলাম, একদিকে সে যেমন মাদামকে ভালবাসছে, তেমনি আমাকেও ভালবাসছে। আমার উপর তার নিজের কোনও মাতব্বরি না ফলিয়ে, সে বরং তার স্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তা দিয়ে আমাকেই ওর দিকে আকৃষ্ট করে তুলল। এই লোকটি যা অপছন্দ করে আমি নিজে তেমন কিছু করতাম না। আর সেও তাকে খারাপ ভাবত যাকে আমিও খারাপ মনে করতাম। ফলে আমাদের সবারই পারস্পরিক সম্পর্কটি যথার্থই মধুর হয়ে উঠল। আমরা পরস্পর এমন একাত্মতায় বাস করতে লাগলাম যে মৃত্যু বাদে অপর কিছুতে আমাদের মধ্যকার এমন অবিচ্ছিন্নতার কখনও ইতি ঘটতে পারে। আমার এই মাদামের এ গুণটি আমাকে বিমোহিত করত যে, এই লোকটিকে যারা যারা ভালবাসত তারাও পরস্পরকে ভাল না বেসে থাকতে পারত না। ঈর্ষাই বলি, বা প্রতিদ্বন্দিতাই বলি সবকিছু তার অমৃত আচরণের কাছে নত না হয়ে পারত না। যথার্থই তাই। আমি কোনওদিন দেখিনি আমরা যারা তার ঘনিষ্ঠতায় থাকতাম তারা নিজেরা কেউ কারোর প্রতি ঈর্ষা বোধ করেছি। আমি আমার পাঠকদের বলব তারা যেন ব্যাপারটা ভেবে দেখেন। তারা কেউ যদি এমন মহৎ মহিলার ঘনিষ্ঠতা লাভ করেন তবে তারা যেন সকলেই তাকে এমন করেই ভালবাসে।

১৭৪১ এর কথা বলছি। চাখেরিতে পৌঁছার পর প্যারি থেকে চলে আসার পরে আমার জীবনে আট কিংবা নয় বছরের একটা নতুন পর্যায়ের যেন সূচনা ঘটল। এই পর্যায়টি যথার্থই আমার জীবনের একটা সুখের পর্যায় ছিল। এমন একটি নিরুদ্বেগ সুখের জীবনেরই আমার দরকার ছিল, যেন আমি আমার চরিত্রে অস্থিরতার বদলে একটা ধৈর্যকে আয়ত্ত করতে পারি। এর পূর্বে এরকম জীবন আর কখনও আমি লাভ করিনি। এই পর্যায়টিকে আমি আমার জীবনের একটি মূল্যবান পর্যায় বলেই গণ্য করি। এতদিন আমার শিক্ষায় এবং অভিজ্ঞতায় যে একটা অস্থিরতা বিরাজ করছিল, সে অস্থিরতার স্থানে যেন একটা স্থিরতার সূচনা ঘটতে লাগল। তার ফলে পরবর্তীকালে আমার জীবনে ঝড়-ঝঞ্ঝা যাই ঘটুক না কেন আমার এই স্থিরতা থেকে আমি আর কখনও বিচ্যুত হইনি।…..

এবার একটু রঙের কথা বলি। জ্যামিতিক চিত্রের রঙগুলো যেন আমার মনের মধ্যে একটা অঙ্কনের আকর্ষণ সৃষ্টি করে তুলল। এবার আমি কতগুলো রঙ সংগ্রহ করলাম। আর সেই রঙ দিয়ে প্রাকৃতিক নানা রকমের দৃশ্য অঙ্কন করার চেষ্টা করলাম। ফুল আর প্রকৃতির দৃশ্য। আসলে ছবি আঁকার আমার কোনও দক্ষতা ছিল না। আমি যত না আঁকতাম, রঙই যেন আমাকে তার বেশি আঁকত। রঙ আমাকে পেয়ে বসল। সারাটা মাস আমি রঙের মধ্যে বসে থাকতাম। এই কাজে আমি যত মগ্ন হতে লাগলাম, তত যেন এই পাগলামি আমাকে রঙের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে লাগল। এটা আমার স্বভাবে পরিণত হয়ে পড়ল। যাতে যত আকৃষ্ট হই, তার থেকে যেন তত আমি ‘বিকৃষ্ট হয়ে পড়ি। কোনও একটা কিছু শুরু করলাম তো তাতে এত ডুবে গেলাম, সেটাই যেন আমাকে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে লাগল। বয়স যে আমার এমন চরিত্রকে তেমন পাল্টাতে পেরেছে, তা নয়। আজ এই কথা যখন লিখছি তখনও আমার যেন মনে হচ্ছে কী অর্থহীনভাবেই না জীবনটা কাটিয়ে দিচ্ছি। অপরের ব্যাপারে নিশ্চয়ই এমন হয় না। তারা যত বড় হয় তত তাদের কৈশোরকে পার হয়ে তারা এগুতে থাকে, আর আমি যেন সেই কৈশোরেই আটকে থাকছি।

.

যে সময়ের কথা বলছি, তখন আর একটা ব্যাপার ঘটেছিল। ব্যাপারটার প্রতি আমার নিজের আকর্ষণও সৃষ্টি হয়েছিল। আমাদের সে গৃহে আনে বলে একটি কাজের লোক ছিল। আমি রোজ দেখতাম সে তার মাথায় এক বোঝ লতাপাতা নিয়ে আসত। আর তাতে সে বেশ মজা পেত। আমাদের মামা তথা মাদাম ওয়ারেনস-এরও এই লতাপাতার প্রতি এক আকর্ষণ ছিল। এদিয়ে নানা প্রকার ঔষধি তৈরি করা যায়। তাই বলে মাদাম যে এই লতাপাতা দিয়ে কোনও ঔষধাদি বানাতেন তা আমার মনে হয় না। কিন্তু যে লোকটি এইসব বনলতার বোঝা মাথায় করে আনত, তার দিকে চাইতে আমি তার চোখে একটা আনন্দের ভাব দেখতে পেতাম। আমি ওর সঙ্গে একবার বাইরে গেলেই এই লতাপাতায় আমি মোহাবিষ্ট না হয়ে পারতাম না। আর তাই যদি আমি করতাম, আর আমি যদি ব্যাপারটায় লেগে থাকতাম তাহলে এতদিনে আমি একটা বিখ্যাত উদ্ভিদতত্ত্ববিদে পরিণত হয়ে যেতাম। কারণ এই লতাগুলোর প্রতি আকর্ষণের মতো আকর্ষণ আমি প্রকৃতির আর কিছুতে যেন বোধ করিনি। আর তখন থেকে আমি যে জীবন যাপন করছি তাকে বলতে পারি উদ্ভিদের জীবনতত্ত্ব অন্বেষণেরই এক জীবন। অথচ উদ্ভিদ তত্ত্বের আমি কিছুই জানতাম না। বরং এগুলোর সঙ্গে আমার যত পরিচয় ঘটেছে তত যেন ওদের জন্য আমার বিতৃষ্ণার বৃদ্ধি ঘটেছে। মামারও বিশেষ কোনও গুল্মের প্রতি যে আকর্ষণ ছিল তেমন নয়। তারও আকর্ষণ ছিল সাধারণ লতাপাতার প্রতি। তা দিয়ে তিনি কোনও ওষুধপত্র তৈরি করতেন তেমনও নয়। এইভাবে নানা লতাপাতা দেখতে দেখতে : উদ্ভিদ, রসায়ন, বায়বীয় তত্ত্ব নানা দিকেই আমার চোখ গেল বটে; কিন্তু এর কোনও কিছুতেই আমি বিজ্ঞ হয়ে উঠলাম না। সব মিলিয়ে ‘ওষুধ বলে একটা ব্যাপার যেন আমার পরিচিত একটা ব্যাপার হয়ে উঠল।

কিন্তু কালক্রমে দেখলাম একটা একেবারে ভিন্ন জগতে কেমন করে যেন আমি ঢুকে গেলাম। আমি সঙ্গীতের কথা বলছি। কেমন করে যেন সঙ্গীতের জগতে আমি ঢুকে গেলাম। মনে হচ্ছে এ ব্যাপারটা আমার একটা জন্মগত ব্যাপার ছিল। সেই শিশুকাল থেকে আমি যেন সঙ্গীতের এক শিষ্যে পরিণত হয়ে গিয়েছিলাম। আর এই একটা মাত্র বিষয় যা আমার মনে কোনও বিতৃষ্ণা সৃষ্টি করেনি। অথচ একে আয়ত্ত করতে আমার কত না কষ্ট করতে হয়েছে। আর সঙ্গীতের শিক্ষায় আমি অগ্রসরও হতে পেরেছি, খুব ধীরে। একথা ঠিক সঙ্গীতের চর্চা বলা চলে সারাজীবনই আমি করেছি। তথাপি কোনও একটি গানের শুরুতে আমি আদৌ ভয় ব্যতীত কোনও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে পারিনি। এই পর্যায়ে ব্যাপারটাতে আমি যে টিকে ছিলাম, তার বড় কারণ মাদাম নিজেও গান গাইতেন। আর আমি তার সাথে গান গাইতাম। অন্যান্য ব্যাপারে আমাদের মতামতে যে কোনও মিল ছিল এমন নয়। কিন্তু এই সঙ্গীত ছিল আমাদের দু’জনার মধ্যে যথার্থই একটি ঐক্যসূত্র। আমাদের উভয়ের মধ্যকার এই সূত্রটির ব্যবহারে আমার কোনও কার্পণ্য ছিল না। আমার এ ব্যাপারে মামার কোনও আপত্তি ছিল না। এমন অনেক সময় হয়েছে যে, একটা চুলার পাশে আমরা দুজনে বসে আছি। আমি বললাম, মামা এসো না, আমরা দু’জনে ব্যাপারটা তৈরি করি। হ্যাঁ, তা আমরা পারি বটে। তবে খারাপ যদি কিছু হয় তবে দোষ দেব তোর আর তার সবটাই আমি তোকে খাইয়ে ছাড়ব! এমন আলাপের মাঝখানে আমি তাকে পিয়ানোর কাছে নিয়ে এলাম। আর দু’জনেই আমাদের আসল ব্যাপারটা ভুলে গেলাম। যা বানাবার আশায় চেষ্টা করছিলাম তা ইতোমধ্যে পুড়ে প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। মামা তাতে রাগ করলেন না। কড়াইয়ের সব পাউডার তিনি আমার মুখে লেপে দিলেন। সবটাতেই আমরা দু’জনেই খুব মজা পেয়েছিলাম।

.

[রুশোর কৃতিত্ব বাড়ছিল। এখন থেকে রুশোর সঙ্গীতের মাসিক আসর বসতে শুরু করল। এবং এর আগে যে কাজে নিযুক্ত ছিল, তা বাদ দিয়ে সে সঙ্গীতেই মগ্ন হয়ে গেল। সে দস্তুরমতো সঙ্গীতের শিক্ষক হয়ে উঠল। এবং এর মাধ্যমে সে অভিজাত মহলেও ঢোকার একটা সুযোগ পেল। অবশ্য রুশোর দৃষ্টি ছিল তার ছাত্রীকুলের সঙ্গীতে দক্ষতার দিকে, তার অধিক দৃষ্টি ছিল তাদের দৈহিক সৌন্দর্যের দিকে।]

.

আমার ছাত্রীকুলের মধ্যে কিছু ছিল আর্থিক অবস্থায় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। এদের একটি ছিল, যার কারণে পরোক্ষভাবে হলেও আমার চরিত্রে কিছু পরিবর্তন সংঘটিত হতে শুরু করল। এ কাহিনীটি আমার বলা দরকার। কারণ, আমি কোনও কিছু না লুকাতে বদ্ধপরিকর। মেয়েটি ছিল একটি দোকানীর মেয়ে। নাম ছিল মাদামসেল লার্ড। তার দেহটি ছিল একটি গ্রীক মূর্তির একটি সুসম্পূর্ণ প্রতিকৃতি। আমি বলব আমার জীবনে আমি যত মেয়ে দেখেছি তার মধ্যে এটি ছিল সুন্দরতম। এর জীবন বা আত্মার কথা আমি বলছিনে। দেহ এবং আত্মাবাদে যদি নিছক কোনও সৌন্দর্য থাকতে পারে, তবে সে ছিল তেমনি একটি নিছক সৌন্দর্য। তার চরিত্রের একটা নিস্পৃহতা, একটি উত্তাপহীনতা ছিল প্রায় অবিশ্বাস্য। তাকে সুখি করা কিংবা উত্যক্ত করা– এ দুটোই ছিল আমার ক্ষমতার বাইরে। আর আমার মনে এমন কোনও লোক যদি থাকত যে তার ওপর কোনও আক্রমণের উদ্যোগ নিত, তবে তাতেও ওর কোনও বিরাগ ঘটত না। সে ওকে বাধা দিত না। বাধা দিত না আগ্রহের অভাব থেকে নয়। এ ব্যাপারে ওর নিছক নির্বিকারহীনতা থেকেই ও কোনও বাধার উদ্রেক করত না। ওর ওপর ওর মায়ের একটা সতর্ক দৃষ্টি ছিল। কোনও ঝুঁকির মধ্যে সে যেতে চাইত না। তার ফলে ওর মা ওর কাছ থেকে ক্ষণিকের জন্যও দূরে থাকত না। ওর মা ওকে সঙ্গীত শেখাবার জন্য এক যুবককে শিক্ষক হিসাবে নিযুক্তও করেছিল। নানাভাবে ওর মেয়েটাকেও সঙ্গীতে রপ্ত করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তাতে কোনও ফল হয়নি। ব্যাপারটার অপরদিকটা দাঁড়াল এমন যে সঙ্গীতের শিক্ষক একদিকে যেমন ছাত্রীটিকে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করত, মেয়েটির মার প্রতি তার প্রণয়ের দৃষ্টি নিবদ্ধ হতো। তার মা তখন মেয়েটার শিক্ষকের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করত। অবশ্য মাও তাতে কোনও সফলতা লাভ করতে পারেনি। মেয়ের মার উদ্দামতা কম ছিল না। অথচ এই উদ্দমতাটি মেয়ের মধ্যে থাকলে তার অধিকতর লাভ হতো। মেয়েটার প্রাণ ছিল, সৌন্দর্য ছিল। অবশ্য ওর অঙ্গ সৌষ্ঠবটি তেমন ভাল ছিল না। মুখমণ্ডলে বসন্তেরও কিছু দাগ ছিল। চোখ দুটি ক্ষুদ্রাকারে হলেও তাতে আগুনের ছটা ছিল। ওর চোখের রঙ ছিল লাল এবং প্রায় সময়ই চোখ দুটি যেন ফোলা ছিল।

আমি রোজ সকালে ওকে সঙ্গীতের পাঠ দিতে যেতাম। গিয়ে দেখতাম আমার কফি এবং ক্রিম তৈরি করা আছে। মা-টি আমার ওষ্ঠ চুম্বনে দ্বিধা করত না। এমন সমাদরটিকে আমি মায়ের বদলে মেয়ের ওষ্ঠেই লেপন করতে চাইতাম। অন্তত এর বদলে এই নিস্পৃহ মেয়েটার প্রতিক্রিয়া নিয়ে তা দেখবার ইচ্ছায়। ব্যাপারটা এমন সরলভাবে ঘটত যে লার্ড উপস্থিত থাকলেও এমন চুম্বন এবং সমাদরের কোনও ব্যতিক্রম ঘটত না। তাই বলব, ভদ্রলোকটি বেশ দ্রই ছিল। মেয়ের উত্তম পিতাই সে ছিল। মা যে পিতাকে কোনও দিক দিয়ে বঞ্চিত করত, এমন কথা বলা যায় না। আসলে মেয়েটির বাবাকে কোনও প্রকারে বঞ্চিত করার প্রয়োজন তার মার হতো না। …

আমার প্রতি মাদাম লার্ডের প্রীতির নজর এত অধিক ছিল যে তার প্রতি আমার নজর দেয়ার কোনও উপায় ছিল না। আমার প্রতি তার এমন নজর আমাকে অবশ্যই মোহিত করত। এসব কথা আমি মামার কাছে বলতাম। এর মধ্যে গোপনীয়তার কিছু ছিল বলে আমি মনে করতাম না। এর মধ্যে রহস্যের যদি কিছু থাকতও তবু তাকে আমি তা না বলে পারতাম না। কারণ আমার কাছ থেকে আমার কিছু গোপন থাকবে, এমন আমি ভাবতেই পারতাম না। ঈশ্বরের কাছে আমার যা কিছু সব যেমন প্রকাশিত ছিল, মামার কাছেও তাই। কিন্তু ব্যাপারটাকে আমি যতটা নিষ্পাপ মনে করতাম, তিনি তেমনটা মনে করতেন না। আমি যাকে বন্ধুত্ব বলে মনে করতাম, তিনি তাতে প্রেম নিবেদন বলে গণ্য করতেন। মাদাম লার্ড আমাকে একটা মূর্খ বলে পরিত্যাগ করছেন না দেখে, মামা আমাকে তার কবল থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করতে বিন্দুমাত্র কসুর করতেন না। কারণ তিনি মনে করতেন একটা খারাপ মেয়েলোকের খপ্পর থেকে একটু সুকুমার প্রিয়কে তার রক্ষা করার চেষ্টা করা অবশ্যই কর্তব্য। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আরও হচ্ছিল বলেই মাদাম মনে করতেন। অবশ্য সেই ষড়যন্ত্র থেকে আমি উদ্ধার পেয়েছিলাম। তবু মাদাম মনে করতেন ভাগ্যে তিনি টের পেয়েছিলেন আর চেষ্টা করেছিলেন তাই সুপাত্র আমাকে তিনি সেই ডাইনীর হাত থেকে আমাকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

আমার একটি ছাত্রের মায়ের নাম ছিল কাউন্টেস দা মেনথন। এ ভদ্রমহিলার বুদ্ধির কমতি ছিল না। ঈর্ষার ক্ষেত্রে তার কমতি ছিল না। এমন খবর রটেছিল যে সে তান্ত্রেমন্টের গৃহে নিদারুণ সব বিবাদের সৃষ্টি করেছিল, যার একটির পরিণাম মারাত্মকই ঘটেছিল। মাদাম অবশ্য এই মেয়েলোকটির চরিত্রকে ভাল করেই জানতেন। মাদাম দা মেনথন মামার বিরুদ্ধে নানা প্রকার অভিযোগ করেছিল। মামা তার সব কু-ইচ্ছাকেই ধরে ফেলেছিল। তার কু-ইচ্ছার একটাও সফল হতে পারেনি। একটা দৃষ্টান্ত হিসেবে একটা হাসির ঘটনার কথা বলি। তখন তারা গ্রামে ছিল। সাথে তাদের বেশ কয়েকজন প্রতিবেশী ছিল। এদের মধ্যে একজন ছিল। প্রণয় প্রার্থী। মাদাম দা মেনথন একদিন এই ভদ্রলোকদের একজনকে বলল : মাদাম দা ওয়ারেনস আসলে একটা ভণ্ড। তার কোনও রুচিবোধ নেই। পোশাক পরিধান করা কাকে বলে, তা সে জানেই না। তার বক্ষমণ্ডলকে সে চাষারে মেয়েলোকের মতো আবৃত করে রাখে। এ ব্যাপারে এই কাউন্টেস দা মেনথন তেমন সুবিধা করতে পারল না। কারণ লোকটি জবাবে বলল, “এমন বক্ষই তো আমার পছন্দ। আসলে ঘৃণার একটা বৈশিষ্ট্য এই যে ঘৃণাই ঘৃণিতের জন্য বিশ্বাসের সঞ্চার করে। মাদাম দা মেনথন এই সত্যটার সদ্ব্যবহারের চেষ্টা করল। এবং একদিন মামা যখন এই মেয়েলোকটার সঙ্গে তাস খেলছিল, তখন মেয়েলোকটা পেছনে সরে গিয়ে মামার তাসের রঙ চুরি করে দেখে নিল। এবং মামার চেয়ারটাকে এমন একটা ধাক্কা দিল যে মামা প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। কিন্তু ওই শয়তানের চেষ্টা সফল হওয়ার বদলে ব্যর্থ হয়ে গেল। যে ভদ্রলোকের ওপর মেয়ে লোকটা নজর রাখছিল, সে কিন্তু ব্যাপারটা ধরে ফেলল। ফল হলো উল্টো।

আসলে মাদাম দা মেনথনের প্রতি আমার যে কোনও সুদৃষ্টি ছিল, এমন নয়। তবু আমার ওপর ওর একটা নজর ছিল। সে অবশ্য আমার চেহারার জন্য নয়। কারণ, চেহারা বোঝার বুদ্ধি ওটার ছিল না। আসলে ব্যাপারটা ছিল আমার বুদ্ধির খেলা। এতে হয়তো মেয়েলোকটি কিছু মজেছিল। বুদ্ধির প্রতি মেয়েলোকটির একটি আকর্ষণ ছিল, এটা আমার বলতে হয়। রঙ্গ বা ব্যাঙ্গের প্রতি ওর একটা আকর্ষণ ছিল। তাছাড়া যদি কেউ ওকে উত্ত্যক্ত করত তবে তাকে নিয়ে গান বাধতে ও দস্তুরমতে ওস্তাদ ছিল। ও যদি আমার সঙ্গীতের দক্ষতার দিকটাকে বুঝতে পারত তাহলে ওর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ভিন্নতরও হতে পারত। এবং ও হয়তো আমাকে ওর বাকি জীবনের শৃঙ্খলে বন্দি করে ফেলতে যথার্থই সক্ষম হতো।

কিন্তু আসলে এমন কিছু ঘটেনি। মাদাম দা মেনথন আমাকে কয়েকবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আমাকে দিয়ে কথা বলাবারও চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তার সে চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে। তাতে কেবল আমার মূর্খতাই প্রকাশ পেয়েছে। ব্যাপারটাতে আমি নিজেই সচেতন ছিলাম। এতে আমার দুঃখবোধও ছিল। ব্যাপারটাতে আমার বন্ধু ভেনচারের প্রতি যথার্থই কৃতজ্ঞ ছিলাম। সে আমাকে যথার্থই ব্যাপারটার অপ্রিয়তা থেকে বাঁচাতে চেষ্টা করেছে। আমি তার কন্যার সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে যে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলাম, সে দায়িত্ব আমি পরিত্যাগ করিনি। এর অধিক কোনও দায়িত্ব আমার ছিল না। আমার জীবন শান্তিতেই কাটছিল….

সে যাই হোক। আমার মনোভাবটি ছিল, আমি যে ধ্বংসের পথে যাচ্ছিলাম, সে পথ থেকে আমাকে উদ্ধার করতেই হবে। আর সেজন্য সে উপায় গ্রহণ করল তা একটি স্ত্রীলোকের পক্ষে আদৌ এমন অবস্থায় স্বাভাবিক ছিল না। আমি দেখলাম ব্যাপারটাকে সে যথার্থই গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছে। এবং তার আচরণ এবং তার প্রকাশ অন্য সময়ের চেয়ে যেন অধিকতর নীতিপূর্ণ ছিল। তার আচরণে আগে যে হালকা মেজাজ ছিল, এখন সে জায়গায় গাম্ভীর্যই অধিকতর স্পষ্ট হয়ে উঠল। এমনটি আগে ছিল না। এবার তার আচরণে হয়তো কাঠিন্য তত ছিল না। কিন্তু আমার কাছে এমন পরিচয়ও পূর্বে ছিল না। আমি নিজেকে নিজে জিজ্ঞেস করেও এর কোনও কারণ খুঁজে পেলাম না। সে নিশ্চয়ই আমার কাছ থেকে একটা জিজ্ঞাসার অপেক্ষায় ছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম। দেখলাম পরের দিন কাছের ছোট বাগানটিতে সে আমাকে ভ্রমণের আহবান জানাল। পরের দিন আমি তার কাছে হাজির হলাম। আমি দেখলাম কেউ যেন আমাদের কোনও রকমে বিব্রত করতে না পারে সে ব্যবস্থাও সে গ্রহণ করেছিল। এবং অন্য কোনও স্ত্রীলোক এমন অবস্থায় যে ভাব দেখাত নাআমার প্রতি সে সেই ভাবটিই দেখাল। সেজন্য সে নানা কৌশল নিল। আমাকে আকর্ষণের নানা উপায় উদ্ভাবন করল। তার ব্যবহারে যে ভদ্রতা ছিল না তা নয়। এবং তার এ ভদ্রতায় আমি কিছুটা মোহিতও হয়েছিলাম। কিন্তু তার আচরণ দ্র হলেও, অন্য কোনও সময়ে তার প্রতি যে মনোযোগ আমি দিতাম, এবার সে মনোযোগ দিতে আমি মোটেই আগ্রহবোধ করলাম না। প্রেমের যে প্রস্তুতি পর্ব সে গ্রহণ করেছিল আমি তাতে আদৌ প্রীত হলাম না। তার কথার সময়ে আমার চোখে উত্তেজনার বদলে তন্দ্রার ভাবই প্রধান হয়ে দেখা দিল। সে আমার প্রতি যা কিছু করছিল তার দিকে দৃষ্টি দেবার বদলে তার আসল কী উদ্দেশ্য সেদিকেই আমি নজর রাখছিলাম। তার আচরণের প্রতি আমি ক্রমেই আকর্ষণহীন হয়ে পড়লাম। সে কী বাক্য ব্যবহার করছিল তার প্রতিও আমার আগ্রহ বা আকর্ষণ রইল না।

সঙ্গীত শিক্ষকদের অনেকেই তার শিষ্যদের মধ্যে বিকৃত রু চি সৃষ্টি করার চেষ্টা করে থাকে। ব্যাপারটার বিষয়ে আমার ‘এমিলিতে’ আমি আলোচনা করেছি। একজন যুবক কী করে? সে যদি আকর্ষণীয় কিছু পায় তবে সে তাকেই দৃষ্টির অগ্রবিন্দুতে নিয়ে আসতে চেষ্টা করে। এখন, শিষ্যকে যদি এই বিন্দুটিতে আটকে রাখতে চায়, তবে শিক্ষকের উচিত হবে না কেবল সেই বিন্দুটিকেই কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা। কিন্তু মামা এই দিকটিকে তত খেয়াল রাখেননি। আমি নিজে কোনও বিন্দু চাইনি। আমার দৃষ্টি ছিল যদৃচ্ছা পরিভ্রমণ। যাই-ই ভাল লাগত তাকেই আমি ভালবাসতাম। আমার ভালবাসার তুন তাতেই আমি গেঁথে ফেলার চেষ্টা করতাম।

.

আমার মনে হচ্ছে, যে আটটা দিনের আমি বর্ণনা দিচ্ছি সে আটটা দিন আমার কাছে বোধ হয়েছিল অষ্ট শতাব্দী বলে। আমার ইচ্ছা হচ্ছিল যেন এই সময়টা যথার্থই আটটা শতাব্দী ব্যাপীই বিস্তারিত হয়।

সে সময়টার বর্ণনাদান আমার ক্ষমতার অতীত মনে হচ্ছে। দু’এক সময়ে মনে হয়েছে যেন এই স্বপ্নের শেষ আমার জীবনে আদৌ না আসে। তখনকার আমার সুস্বাস্থ্য, তার প্রদাহ, আমার রক্তের উত্তাপ আমাকে উন্মাতাল করে তুলত। আমার সেই সময়কার যৌন উগ্রতার কথা চিন্তা করলে, পুরুষোচিত আচরণের কথা ভাবলে বুঝতে পারিনে কেমন করে কোনও দুর্ঘটনা ব্যতিরেকে সেই সময়টা আমি পেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম। এখন আমার নিজেরই বিশ্বাস হয় না, কেমন করে একটা মেয়ের প্রতি আমার যৌন আকর্ষণকে ঘটনাহীন বাদে আমি অতিক্রম করতে পেরেছিলাম। অথচ একথা ঠিক যে, কোনও মেয়েমানুষকে আমি এতদিন স্পর্শ করিনি। অথচ মেয়েটার প্রতি আমার আগ্রহ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ছাড়া হ্রাসপ্রাপ্ত হয়নি। মেয়েটাকে না দেখতে পেলে আমার ভাল লাগত না। ওর চিন্তা বাদে যেন আমি থাকতেই পারতাম না। আমার হৃদয় কেবল যে ওর বিনয়-নম্রতাতেই পূর্ণ ছিল তা নয়। ওর প্রতি আমার মন যৌন আকর্ষণেও পূর্ণ ছিল। তার শরীরের গঠন : মোটকথা যে কোনও আচরণে ওর প্রতি সবার আকর্ষণ বৃদ্ধিই পাচ্ছিল।

পাঠক এমন মনে করবেন না যে, মেয়েটার বয়স আমার চাইতে দশ কিংবা বার বছর বেশি ছিল বলে তাকে আমার চেয়ে বৃদ্ধ বলে মনে হতো। ওকে দেখার পর পাঁচ-ছ’বছর কেটে যাবার পরও তার প্রতি আমার আকর্ষণ বিন্দুমাত্র কমেনি, যেন তার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নিঃ আমার চোখে তো নয়ই। আমার চোখে ও সবসময়ই সুন্দর বলে বোধ হতো। সে সময়টাতে আর সবাই-ই তাকে সুন্দর বলে মনে করত। ওর শরীরটা কেবল একটু শক্ত হয়ে উঠছিল। অপর সবদিকে ওর কোনও পরিবর্তন ঘটেনিঃ সেই একই রঙ, সেই একই বক্ষমণ্ডল, গঠনের একই প্রকৃতি, সেই সুন্দর চুল, এমনকি কণ্ঠস্বরেরও কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। তারুণ্যের সেই রৌপ্যবৎ কণ্ঠস্বর। ওর সেই কণ্ঠস্বর আমাকে এমনি মোহিত করেছিল যে আজও একটি তরুণীর কণ্ঠে ওর কণ্ঠের আভাস না পেয়ে আমি পারিনে। আমার ভয় হচ্ছিল ওর প্রতি আমার আকর্ষণ শেষপর্যন্ত অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে এবং আমি আমার ওপর আমার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। এমন হতো যে আরও অধিক বয়সে, কোনও একটু আদর-আহ্লাদের স্পর্শতেই আমি বিবশ হয়ে পড়তাম। আমার রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পেত এবং আমার শরীর উত্তপ্ত হয়ে উঠত আর তাই আমি আজও বুঝতে পারছিনে তারুণ্যের সেই প্রভাতে, দেহগত আকর্ষণ আমার এমন নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছিল। বলতে হয় একদিকে যেমন আকর্ষণ তেমনি অপরদিকে একটা ভয়ও যেন আমাকে গ্রাস করে ফেলেছিল। মাঝে মাঝে মনে হতো যে তৃপ্তির জন্য আমার অস্থিরতা তা থেকে মুক্তির কি আর কোনও পথ নেই। ভাবতে আশ্চর্য লাগে আমি যেমন কামোদ্দীপ্ত ছিলাম, আমার দেহের রক্ত যেমন টগবগ করে ফুটত, আমার সেই বয়সের স্বাস্থ্য, মেয়েদের প্রতি আমার কামনার তীব্রতা, তথাপি কোনও দৈহিক মিলন না ঘটা : এমন করে ভাবা প্রায় অসম্ভব হলেও বাস্তবে ব্যাপারটা তো তাই ঘটেছিল। এর তো কোনও অন্যথা হয়নি। কেবল তাই নয়। তথাপি তার প্রতি আমার আকর্ষণ হ্রাস পায়নি। বরং প্রতিদিনই তার প্রতি আমার আকর্ষণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ওকে না দেখলে আমার ভাল লাগত না। এক মুহূর্তও আমার চিন্তার বাইরে থাকত না। তাই বুঝতে পারিনে সেই বয়সে প্রথম ভোগের তৃপ্তির জন্য আমার কামনার তীব্রতা এত কম কেমন করে ঘটেছিল। সেই চরম মুহূর্তটির চিন্তায় আমার যতনা আনন্দের সৃষ্টি হতো তার চাইতে অধিক ভীতির উদ্রেক কেন হতো? ত্বকচ্ছেদের যে কল্পনা আমাকে উদ্বেলিত করে ভোলা স্বাভাবিক ছিল, তার কল্পনা আমার মনের মধ্যে কেন একটা ঘৃণার ভাবের সৃষ্টি করত? একথা আমি বিশ্বাস করি ব্যাপারটার চিন্তায় যদি আমার মধ্যে ঘৃণার ভাব সৃষ্টি না হতো, যদি একটা শালীনতার ভাব আমার কল্পনাতে আসত তাহলে ব্যাপারটাকে আমি আনন্দের সঙ্গেই উপভোগ করতে পারতাম। কিন্তু ওর প্রতি আমার আকর্ষণে কেমন যেন একটা পবিত্রতার ভাব জড়িয়ে ছিল যার ফলে সেই ভাবের কোনও প্রকার লঙ্ঘনের কথা আমি কল্পনা করতে পারতাম না।

আমি বুঝতে পারছি আমার পাঠক ইতোমধ্যেই আমার ওপর বিষম বিতৃষ্ণ হয়ে উঠেছে এবং তারা মনে করছে আমার এমন পরস্পর বিরোধী ভাবের মূলে রয়েছে অপর কোনও লোকের সঙ্গে মেয়েটার দৈহিক সম্পর্কের ঘটনা। আর তার ফলেই মেয়েটা একদিকে যেমন আমার মনে আকর্ষণের সৃষ্টি করেছে, তেমনি অপরদিকে মেয়েটা আমার মনে একটা বিষম বিতৃষ্ণার সৃষ্টি করেছিল। পাঠক এমন মনে করলে ভুল করবেন। অন্যের প্রতি ওর আকর্ষণের এই বিভাগ আমার জন্য অবশ্যই বেদনাদায়ক হয়েছিল, তথাপি একথা আমি বলব না যে ওর এমন আচরণ ওর প্রতি আমার আকর্ষণকে কোনওক্রমে হ্রাস করে দিয়েছিল। আমি সত্যের দিব্যি দিয়ে বলতে পারি, বরং ওর প্রতি আমার কামনা যখন সব চাইতে কম ছিল, ওর প্রতি আমার আকর্ষণ তখনই সবচাইতে বেশি ছিল। আমি জানি ওর প্রতি আমার আর্মণ যখন সবচাইতে কম হতো, আমি ওর মাধুর্যের জন্য আমার আকর্ষণ সবচাইতে বেশি হতো। এটা আমি দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করি, দৈহিক কোনও আকর্ষণ-বিকর্ষণের সঙ্গে ওর সম্পর্কে আমার এমন ভাবের কোনও কার্য-কারণ যুক্ত ছিল। আমি বিশ্বাস করি ওর সঙ্গে আমার এমন সম্পর্কের পরিণামে যে বিপদ আমার ঘটতে পারত, তার আতঙ্কই আমাকে ওর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলত। এবং তাতেই আমি রক্ষা পেয়েছি এবং সে কারণেই এই মেয়েটার অন্য মেয়ের আচরণ থেকে পৃথক করে তুলেছিল। ব্যাপারটা পরবর্তী সময়ে পরিষ্কার হবে। সমস্ত ব্যাপারটায় ওর প্রতি আমার যেমন একটা করুণার সৃষ্টি হয়েছিল, তেমনি আমার প্রতিও আমার একটা করুণার উদ্রেক হয়েছিল। আমার ইচ্ছা হতে আমি তাকে বলি না, মামা, ওটার আমার প্রয়োজন নেই। ওটা বাদেই আমার তৃপ্তি আমি সাধন করতে সক্ষম হবো। কিন্তু তেমন বলার সাহসও আমার হয়নি। কারণ এটা কোনও বলার ব্যাপার নয়। তাছাড়া একে আমি ঠিকও মনে করিনি। আসলে আমি জানতাম একটি মাত্র মহিলাই আমাকে অপর মহিলা থেকে রক্ষা করতে সক্ষম। এবং একমাত্র সেই-ই মাত্র অপর সব প্রলোভন থেকে আমাকে বাঁচাতে পারত। আমি তাই যেমন তাকে লাভ করতে না চাওয়াতে আনন্দ লাভ করেছি, তেমনি সে অপর মেয়েলোকের আকর্ষণ থেকে আমাকে রক্ষা করে আমার মনে অধিকতর আনন্দের সৃষ্টি করেছে। আর তাই এই পর্যায়ে যে কোনও দুর্ভাগ্য যখন তার থেকে আমার বিচ্ছিন্নতার কারণ হতো, তাতে আমার আনন্দ বৈ বেদনার কোনও সৃষ্টি হতো না। আমাদের উভয়ের এমন দীর্ঘ অন্তরঙ্গতা তার কাছ থেকে আমাকে বিচ্ছিন্ন করার পরিবর্তে, তার প্রতি আমার অন্তরঙ্গতাকে বৃদ্ধি করে দিত। এটা যেমন সত্য, তেমনি এ ঘটনা আমাদের উভয়ের সম্পর্কে একটা ভিন্ন মাত্রাও এনে দিত। যে মাত্রার সোহাগ এবং অন্তরঙ্গতা পূর্বেকার অন্তরঙ্গতার চাইতে অধিক বৈ অল্প হতো না। এতে দেহজ আকর্ষণ আমার হ্রাসই পেত। আমি এতদিন মামা বলে সম্বোধন করেছি, তার একটি পুত্রবৎ নৈকট্য ভোগ করেছি। ফলে আমি নিজেকে তার সন্তান বলেই গণ্য করেছি। আমার বিশ্বাস এ কারণেই তার প্রতি পুত্রের ক্ষমতা বৈ আর কোনও সম্পর্কের কথা ভাবতে পারিনি। ফলে তাকে দৈহিকভাবে পাওয়ার কোনও আগ্রহ আমার মধ্যে জন্মেনি। অথচ সে আমার এত প্রিয় ছিল। আমি বরং তার প্রতি আমার পূর্বের অনুভূতির কথা ভাবলে দেখি বর্তমানের চাইতে সেই ছোটকালেই তার প্রতি আমার দৈহিক আগ্রহ অধিক ছিল। এ্যানেসিতে তো আমি তার জন্য প্রায় পাগল হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু চ্যাম্বেরিতে সে ভাবটা আমার ছিল না। তবে আমি তাকে তখনও গভীরভাবে ভালবাসতাম। কিন্তু সে ভালবাসারও ভাবটি ছিল আমি তার আগ্রহেই তাকে ভালবাসছি আমার নিজের আগ্রহে নয়। বলা চলে আমি তার কাছে শান্তি পেতাম, প্রেম নয়। সে আমার কাছে ভগ্নী বলে বোধ হততা, প্রেমিকা নয়, মায়ের চেয়ে অধিক বলে আমি তাকে ভাবতাম, বন্ধুর অধিক, এমনকি ঘরের কত্রী। কিন্তু তাই বলে আমার প্রেমিকা নয়। মোটকথা তাকে আমি যথার্থই ভালবাসতাম, কিন্তু তাকে ভোগ করার জন্য নয়। আমার ভালবাসার আধিক্যে ভোগের কোনও ভাব ছিল না। সেই পর্যায়ের কথা ভাবতে গেলে এমনি আমার মনে হয়। আমার মনে এই ধারণাগুলোই স্পষ্ট হয়ে আছে।

তারপর যে দিনকে প্রত্যাশার চাইতে ভয় করেছি অধিক, সেই দিনের আগমন ঘটল। আমি যা কিছুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, সবকিছুই আমি তৈরি রেখেছিলাম। আর এবার যেন যথার্থই আমি প্রত্যাশার পূরণ পেলাম। এই প্রথম আমি জীবনে একজন মেয়ের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ দেখলাম। তেমন একজন মহিলাকে পেলাম যাকে আমি প্রাণভরে ভালবাসি। কিন্তু আমি এ ঘটনায় সুখী হলাম? না, তেমন আমি বলতে পারিনে। হ্যাঁ, আমি আনন্দ পেলাম বটে, তবু যেন আজও একটা বিষাদভাব আমার আনন্দকে যেন বিষাক্ত করে তুলল। আমার মনে হলো আমার মায়ের সঙ্গে যৌনমিলনে মিলিত হয়েছি। এমনি পাপবোধ আমাকে পেয়ে বসল। দুতিনবার আমি তাকে আমার বুকে পিষ্ট করলাম। তার বুকে আমার মুখ ঘঁষে আমার চোখের জলে তার বুক ভাসিয়ে দিলাম। অথচ তার দিক থেকে যেমন কোনও বিষাদ বোধ করল না, তেমনি কোনও উত্তেজনাও নয়। সে আমাকে বুকে নিয়ে প্রশান্ত এবং মমতাময় এবং শান্ত হয়ে রইল। ফলে তার শরীরে কোনও উত্তেজনা বোধ যেমন এল না, কোনও কামের সান্ত্বনার কোনও আগ্রহ যেমন তার আচরণে প্রকাশ পেল, তেমনি তার ব্যবহারে কোনও তৃপ্তি বোধেরও প্রকাশ ঘটল না। আবার আমার প্রতি তার কোনও ঘৃণাবোধেরও সৃষ্টি হলো না।

আমি আবার বলছি। আমার কোনও অপরাধ ছিল না। যা কিছু ঘটেছে সবই তারই কারণে ঘটেছে। তার কামনার কোনও প্রকাশে নয়। তিনি বংশগতভাবে একজন অভিজাত রমণী ছিলেন। তার হৃদয় নির্মল ছিল। তিনি ভদ্রতা কাকে বলে তা জানতেন। তার ইচ্ছায় কোনও সুলতা ছিল না। তার ইচ্ছা ছিল। তার চরিত্রের মধ্যেই একটা ভদ্রতার প্রকাশ ছিল। মনে হতো তিনি যেন তার হৃদয়ের চাইতে তার যুক্তির দ্বারা অধিক পরিচালিত হতেন। নীতিতে তার যে ভুল হতো না, তা নয়। কিন্তু তার অন্তরের মূল অনুভূতিতে তার সংশোধন ঘটে যেত। অবশ্য তার নিজের দর্শন সম্পর্কে তার একটা গর্ববোধ ছিল। ফলে তার অন্তরের প্রতি আর দর্শনের গৌরব এ দু’য়ের সবসময় মিলন ঘটত না।

এম দা ট্রাভেল, যিনি তার প্রথম প্রেমিক ছিল, সে তাকে দর্শন পড়াত। আর দর্শনের যে নীতিতে সে তাকে শিক্ষিত করে তুলেছিল, সেগুলো তার প্রয়োজন ছিল। কারণ এগুলো দিয়েই সে যাদের চাইত তাদের সে প্রলুব্ধ করতে পারত।

এম দা ট্রাভেল ছিল তার প্রথম প্রেমিক। এই প্রেমিকই তাকে দর্শন শিক্ষা দিত। আর তার সে দর্শন থেকে সেগুলোই তাকে শিক্ষা দিত যা তার কাজে লাগত। কিন্তু সে যখন দেখল মেয়েটা তার স্বামীভক্ত এবং তার স্বামী যা বলে তাই সে পালন করে এবং তার সঙ্গে কোনও ফস্টিনস্টিতে সে সাড়া দিতে উৎসুক নয় তখন সে তাকে নানা কুতর্কে জড়িয়ে বশ করার চেষ্টা করল এবং এর দ্বারা সে তাকে বুঝতে পারল যে, তার স্বামীর প্রতি যে আনুগত্য দেখাচ্ছে এগুলো অর্থহীন। এগুলো যা সে করছে তা কেবল বাচ্চাদের মানায়, তাকে নয়। দৈহিক সঙ্গম তেমন কোনও খারাপ জিনিস নয়। এবং দাম্পত্য অন্তরঙ্গতার কোনও মূল্য নেই। সব মেয়েলোক একই রকম। সে কেবল তাই করে তার স্বামী তাকে যা করতে বলে, এর অধিক কিছু নয়। আর তাই তার সঙ্গেও যদি তেমন কিছু করে তাতে তার দাম্পত্য আনুগত্যের কোনও ক্ষতি হবে না। মোটকথা সে মেয়েটাকে এমনি করে বশ করে ফেলল। মেয়েটার সঙ্গে তার এমন আচরণে সে কোনও অপরাধ বা পাপ বোধ করল না। তার স্বামীর দিক থেকে বলা যায়, তার স্ত্রীর এমন আচরণে সে ঈর্ষার জ্বালায় জ্বলেছে, এর অধিক কিছু আর করতে পারেনি। পরবর্তী যে পাদ্রী তার শিক্ষক হয়েছিল সেও ওই একই রূপ আচরণ করেছে। ফলে মেয়েটার মধ্যে যে নিস্পৃহতা আদিতে ছিল এবং যা তাকে এরকম বদমাশের হাত থেকে রক্ষা করতে পারত, সেই নিস্পতাই তাকে বদমাশটার জালের মধ্যে আরও টেনে নিল। মেয়েটা আদৌ এটা বুঝতে পারেনি যে, যে আচরণে সে নিজে নিস্পৃহ অপর কেউ তার দ্বারা কেমন করে উত্তেজিত হতে পারে।

মেয়েটার এই ভিত্তিহীন নীতিগুলোকে সে আদৌ ব্যবহার না করে ছাড়েনি। তবে এর অনেকগুলোকে সে অপব্যবহারই করেছে এবং তাতে অপরের যা লাভ হয়েছে তার চেয়ে তার নিজের ক্ষতি হয়েছে বেশি। তার একটা বিশ্বাস ছিল কোনও মেয়েলোক ধরা দিলে কোনও পুরুষ তাকে না ধরে পারে না। তার প্রেমিকদের জন্য তার ভালবাসাকে সে বন্ধুত্ব বলে মনে করত। তবু সে ভালবাসার কমনীয়তার গভীরতা এত ছিল যে সেগুলোকে যথাসাধ্য অন্তরঙ্গতার সঙ্গে তাদের সে ব্যবহার করতে চাইত। আমার কাছে যা আশ্চর্য মনে হতো সে হচ্ছে এই যে, মেয়েটার নমনীয়তা যথার্থই বিস্ময়কর ছিল। ফলে যে কেউ ওর অন্তরঙ্গতায় আসত। সে ওকে ভাল না বেসে পারত না। আর একটা ব্যাপারেও লক্ষযোগ্য ছিল যে, কারোর সঙ্গে অন্তরঙ্গ হলে, মেয়েটা তাকে বাদে অপর কাউকে কাছে ঘেঁষতে দিত না। অথচ যারা ওর ঘনিষ্ঠতার কামনা করত তারা হেলাফেলার লোক ছিল না। কিন্তু এমন কেউ ওর প্রতিষ্ঠাতা লাভে সক্ষম হতো না। কিন্তু ও নিজে ছিল অনিরুদ্ধ। একবার কারোর প্রতি নজর পড়লে তাকে সে দখল না করে ছাড়ত না। এমন যদি হতো যে এমন কারোর ওপর নজর পড়েছে, যে ওর যোগ্য নয়, তার কারণ ওর কোনও অবাঞ্ছিত কামনা নয়, বরং তার মূলে থাকত একই অনন্য ধৈর্য, সহনশীলতা এবং মমতাময় অনুভূতি। আসলে ও নিজের অনুভূতির উপযুক্ত মূল্য ও নিজেই জানত না।

আমি বলব কারোর ব্যাপারে ও যদি প্রাপ্তির মধ্যে পড়েও থাকে, তবে সেগুলো বাদ দিয়ে তার অপর আচরণগুলোর অনন্যতার জন্য ওকে ধন্যবাদ দেয়া ছাড়া আমার উপায় থাকত না। ওর দুর্বলতা যাই থাক, তার কোনওটাতে ওর দেহজ কোনও কামনার প্রকাশ ঘটতে দেখা যেত না। এমনি ছিল ওর মনের মমতা। একই লোক যদি ওকে মানসিকভাবে আঘাত করত, সেই লোকই আবার ওকে পুরস্কৃত না করেও পারত না। ওর কোনও ভ্রান্তিকেও আমার মনে হতো প্রশংসার ব্যাপার। ওর ভুলের কারণে অবাঞ্ছিত যে কিছু করত না তা নয়, কিন্তু তার এরূপ কোনও কাজকে আমি ইচ্ছাকৃত বলে মনে করতে পারতাম না। মিথ্যে বলার ওর কোনও অভ্যাস ছিল না। ওর কোনও দ্বিচারণের স্বভাব ছিল না। ওর মধ্যে প্রতিশোধ স্পৃহা আমি দেখিনি। আমি আর কীভাবে ওর পক্ষে সুপারিশ করতে পারি। আমি বরং বলব ওর প্রতি সক্রেটিসেরও যদি দৃষ্টি পড়ত, তবে তার এই মাদাম দ্য ওয়ারেনসকে ভাল না বেসে উপায় থাকত না। সে তাকে সম্মানের সঙ্গেই ভালবাসত।…

.

আমি জানিনে, ক্লদ আনে আমাদের এমন অন্তরঙ্গতার ব্যাপার জানতেন কী-না। আমার মনে হয় তিনি জানতেন। কারণ তিনি তীক্ষ্ণ বুদ্ধির মানুষ ছিলেন। আবার সুবিবেচকও ছিলেন। তিনি কখনও এমন কিছু বলতেন না, যা তিনি বলার কথা ভাবেননি। আবার এও ঠিক যে তিনি যা ভাবতেন তা সব বলতেন না। আমাদের ব্যাপারটা তিনি জানতেন তার বিন্দুমাত্র আভাস আমাকে না দিয়ে তার আচরণে তিনি বুঝিয়ে দিতেন যে, তিনি সব জানেন। তার এমন আচরণের পেছনে কোনও হীনতা ছিল না। এর কারণ নিশ্চয়ই এই ছিল যে, তিনি তার প্রিয়তমার আচরণকে স্বীকার করার পরে তার বিরোধিতা করার কথা ভাবতে পারতেন না। যদিও তিনি তার স্ত্রীর চেয়ে অধিক বয়সের ছিলেন না, তবু মনে হতো তিনি আমাদের দুজনকে তারই দু’টি শিশু বলে গণ্য করতেন। দুটি শিশুকে প্রশ্রয় দিতে তার যেন বাঁধত না। আর তাকে শ্রদ্ধা করতেও আমাদের কোনও দ্বিধা হতো না। তার প্রশ্রয় পাওয়ার জন্যও আমাদের মনে একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল। আমি নিজের দিক থেকে বলতে পারি তার স্বামীর প্রতি তার অবিশ্বস্ততার পরিচয় পাওয়ার পূর্বে আমিও বুঝতে পারিনি, সে তার স্বামীকে কত গভীরভাবে ভালবাসে। মাদাম জানত, সে আমার জীবনে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসসম, তথাপি সে তার স্বামীকে কত গভীরভাবে ভালবাসে তা আমাকে দেখাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করত না। তার এমন আচরণের ইচ্ছাও ছিল যেন আমি তার স্বামীকে তার মতোই গভীরভাবে ভালবাসি। এবং তাই সে আমার প্রতি সখ্যের তত মূল্য দিত না, যত সে তার স্বামীর প্রতি তার ভালবাসাকে গণ্য করত। আর তাই আমার ক্ষেত্রে তার সখ্য আর তার স্বামীর ক্ষেত্রে ছিল তার ভালবাসা। এ কথাটা আমি বুঝতাম। কারণ আমি তাকে সখ্যই মাত্র দিতে পারতাম, ভালবাসা নয়। আমি স্মরণ করছি কতবার মাদাম আমাকে আলিঙ্গন করেছে, তার চোখের জলে আমার বুককে ভাসিয়ে আবার একই সঙ্গে আমাকে বুঝিয়েছে, আমি এবং তার স্বামী দু’জনকেই তার জীবনে বাঁচার জন্য সমানভাবেই আবশ্যক। আমার এ কাহিনীকে আমার পাঠকবৃন্দ ঈর্ষাহীনভাবে পাঠ করতে পারবে না। তার এরূপ অস্বাভাবিক মনোভাবে কোনও কৃত্রিমতা ছিল না।

এটা তার অন্তরের অমলীন বিশ্বাসই ছিল। এটাই মাদামের সঙ্গে আমার সম্পর্ক। আমি যথার্থই মনে করি এমন সম্পর্ক অসাধারণই হয়। এবং এমন সম্পর্কের দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত দুর্লভ। আমাদের দুজনের এমনি ছিল, প্রেম, প্রীতি ভালবাসা। আমাদের দুজনের প্রীতির এই ছিল বিশ্ব, এর বাইরে কিছু নয়। সমস্ত জগৎকে বাদ দিয়ে আমাদের তিনের এই মিলনের অচ্ছেদ্যতা এমনি দৃঢ় ছিল যে, আমাদের ভোজনের টেবিলে আমাদের কোনও একজন যদি থাকত অনুপস্থিত, কিংবা অপর কেউ যদি এসে উপস্থিত হতো তবে আমাদের এমন সঙ্গোপন একেবারে ছত্রচ্ছন্ন হয়ে যেত। আমরা তিনজনে আমাদের আচরণে এমন অবাধ হতাম তার কারণ ছিল আমাদের পরস্পরের প্রতি এক গভীর বিশ্বাস। আর তাছাড়া আমাদের সহবাসের এমন জীবনে যে কখনও কোনও ক্লান্তি আসত না, তার কারণ আমাদের মনে কখনও কোনও শূন্যতা ঘটত না। একটা কিংবা অন্য একটা কাজে আমরা তিনজনই ব্যস্ত থাকতাম। মামা সব সময়ে কোনও না কোনও বিষয়ের পরিকল্পনা করতেন এবং সবসময়ই কর্মব্যস্ত থাকতেন। ফলে আমরা দুজনের কেউই কর্মহীন থাকতে পারতাম না। তাছাড়া সব সময়ই আমাদের কোনও না কোনও কাজ থাকত। ফলে কোনও সময়ই আমাদের সময়ের শূন্যতা ঘটত না। আমি তো মনে করি কর্মহীনতা হচ্ছে আমাদের সমাজের এবং একাকিত্বের অন্যতম কারণ। এছাড়া অন্যকিছু মনের মধ্যে এমন শূন্যতার সৃষ্টি করে না। গান, গল্প, ঝগড়াঝাটি : কোনওকিছুই কর্মহীনতার মতো মানসিক শূন্যতা সৃষ্টি করে না। যাদের কোনও কাজ থাকে না তারাই শব্দহীনভাবে একটা ঘরে যেন আবদ্ধ থাকে আর সে কারণেই মানুষ অর্থহীন চিৎকার, গালাগালি আর বকবকুনিতে লিপ্ত হয়। মানুষ যখন সর্বক্ষণ কর্মে ব্যস্ত থাকে তখন একজন মানুষ অপর একজনের সঙ্গে কাজের প্রয়োজনে কাজের কথাই বলে। কর্মহীনরা সর্বক্ষণ শব্দ তৈরির রোগে ভোগে : কিচিরমিচির শব্দ করে। অর্থহীন শব্দের উচ্চারণ করে। আমি বরং আরও বলব, কর্মহীনরা সবচাইতে ক্লান্তিতে ভোগে। মানুষের পারস্পরিক সঙ্গ কর্মের মধ্যেই মাত্র সুখের হয়ে উঠতে পারে। আসলে মানুষের কেবল যে সর্বদা কর্মরত থাকা আবশ্যক তাই নয়, তার এমন কর্মের প্রয়োজন যে কর্মের জন্য তার চিন্তার প্রয়োজন। মেয়েরা সেলাই কর্মে নাকি দক্ষ! আমি তো মনে করি এমন কর্মের মতো অর্থহীন কর্ম আর কিছু হতে পারে না। একজন সেলাইরত মেয়েকে তুমি কখনও সহজে তোমার দিকে আকৃষ্ট করে তুলতে পারবে না। হাত গুটিয়ে বসে থাকা আর সেলাইতে ব্ৰত থাকা একই ব্যাপার। সেলাই শিল্পের কথা আমি বলছিনে। সেলাই শিল্পের মানুষকে নিঃশব্দতার ব্যাপার নিয়েও কর্মের চিন্তা করতে হয়…

আমি যখন মতিয়েরে ছিলাম, আমি তখন প্রতিবেশী কারোর বাড়িতে যেতাম তাদের ফিতা বানিয়ে দিতে।

আমাকে যদি আবার পেছনের জগতে ফিরে যেতে হয় তবে আমি অবশ্য আমার জামার পকেটে একটা বাটি আর বল পুরে রাখব যেন আমার শব্দ করার প্রয়োজন হলে ও দুটোকে টুংটাং করে আমি বাজাতে পারি। আমার মতো সব মানুষেরই হাতে সবসময়ে একটি বাটি আর কাঠি থাকত, তবে তাদের মন এমন বিদ্বেষপূর্ণ হতে পারত না। সবাই এই নীতিটি অনুসরণ করলে যথার্থই মানুষের মধ্যে সখ্য অধিকতর আনন্দময় হয়ে উঠত। মোটকথা, আমার এমন কথায় যে কেউ হাসতে পারে। তবু আমি বলব, মানুষের জগতে এখন যে নীতিহীনতা চলছে, তার সংশোধনের একটিই মাত্র পথ রয়েছে : বাটি আর কাঠির একটি বল।

.

[ক্লিদ আনে মারা গেল এবং রুশো তার জিনিসপত্র ভরতি আলমারিটা পেয়ে খুব খুশি হলো। এই অবস্থায় মাদাম দ্য ওয়ারেনস তার আর্থিক সমস্যা সমাধানে অধিকতরভাবে অক্ষম হয়ে পড়লেন। রুশো নিজের জীবিকার জন্য বাদ্যযন্ত্র হারমনি বানানো শিখতে শুরু করল। তার জন্য সে বেসানকন গেল। কিন্তু রাষ্ট্রের সীমানায় পুলিশ তার জিনিসপত্রের বাক্স বাজেয়াপ্ত করল এবং সে চেম্বারীতে ফিরে এল। এই পর্যায়ে রুশো তার কাহিনীতে দু’জন ব্যক্তির বর্ণনা দিচ্ছে : গকেনকোর্ট এবং দা কনজি।]

.

আমার ভেতরে ইতোমধ্যে সাহিত্য এবং দর্শনের যে বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল তা বেশ মাথাচাড়া দিতে শুরু করল। কেবল দরকার হলো এদের একটু উৎসাহ দান, তাদের পূর্ণ বিকাশের জন্য। এবং তার অভাবও ঘটল না। এক মশিয়ে দা কনজির দেখলাম এদিকে মানে সঙ্গীতে বেশ একটু দক্ষতা আছে। এটিকে আমি কাজে লাগাতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমার শেখার সময়টা সঙ্গীতের গৎ শোনানো ব্যতীত বাকি সবকিছুতেই ব্যয় হতে লাগল। আমরা এক সঙ্গেই প্রাতরাশ করতাম। আমরা দুজনে মিলে কথা বলতাম নানা বিষয়ে। নতুন পত্র-পত্রিকা বই পাঠ করতে শুরু করলাম। কিন্তু সঙ্গীতের ধারে কাছেও যেতাম না। এই সময়ে দেখলাম প্রশিয়ার যুবরাজের নিকট লিখিত ভলটেয়ারের পত্রাবলি বেশ আলোচিত হচ্ছে। আমরা দু’জনে মাঝে মাঝে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করতে শুরু করলাম। এ দু’ব্যক্তিই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। যুবরাজ তখন মাত্র সিংহাসনে আরোহণ করেছেন। এদের একজন শিগগিরই তার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার নিশ্চিত ধারণা প্রকাশ করতে লাগলেন। অপরজন তথা ভলটেয়ারের ভাগ্যে আজকের মতোই যেমন প্রশংসা তেমনি দুর্নাম জুটতে দেরি হলো না। আমরা দুজনেই এই বেচারির দুর্ভাগ্যের জন্য দুঃখবোধ করতে লাগলাম। অবশ্য আমরা এটাও বুঝলাম যে এটার মধ্যেও কিছু আছে। কারণ যাদের মধ্যে কিছু থাকে তাদেরই বিরুদ্ধে দুর্নাম রটে। যুবরাজের ভাগ্যে তার কিশোরকালে তেমন সুখ জোটেনি। আর ভলটেয়ারের সারা জীবনে সুখ বলে কিছু ছিল না। কিন্তু আমরা দুজনেই এই দু’জনের সব বিষয়েই উৎসাহিত বোধ করতে লাগলাম। ভলটেয়ারের কোনও রচনাই আমাদের নজর এড়াল না। ভলটেয়ারের এই পাঠে আমিও কিছু লিখতে উদ্বুদ্ধ বোধ করতে লাগলাম। এর লেখার ক্ষমতার যে বৈচিত্র্য তা আমাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করল। এর কিছুকাল পরে তার দার্শনিক পত্রাবলি প্রকাশিত হলো। এটা যে তার সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা তা আমি বলিনে। তবু তার এই রচনা সেদিন আমাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল। আমি তা পাঠ করতে শুরু করলাম। এবং সে সময় থেকে ভলটেয়ারের কাছ থেকে আমি আর দূরে যেতে পারলাম না।

কিন্তু ভলটেয়ারে পুরো নিবদ্ধ হওয়ার সময় তখনও আমার আসেনি। তবু তাতে চোখ বোলানোর ক্ষমতা আমার জন্মেছিল। এই দক্ষতার কিছুটা আমি মাদাম ওয়ারেনস-এর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতার সময়ে জন্মেছিল। অবশ্য তখনও ভলটেয়ারকে পুরো অনুধাবনের ক্ষমতা আসেনি। তার জমিদারিতে শত শত মানুষের জমায়েত ঘটত। তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্বার্থ উদ্ধারের আশাতেই আসত। তারা মাদামকে নানাভাবে প্ররোচণার চেষ্টা করত। মাদাম ওয়ারেনস-এর এমন দুর্দশা দেখে আমি কষ্ট পেতাম। এই সময়ে মাদাম আমাকে তার ব্যক্তিগত সহকারিতে নিযুক্ত করেছিলেন। আমার এই দায়িত্বের ভিত্তিতে আমি মাদামের সব বিষয়ের দিকে খেয়াল রাখতে শুরু করলাম। আমি দেখলাম মাদামের বিষয় সম্পত্তির অবস্থা দিনে দিনে অধিকতর খারাপ হয়ে পড়ছে। সংকট ভয়ানকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাকে কঠোর হওয়ার জন্য শতবার চেষ্টা করতে লাগলাম। আমি বকলাম, তার হাত ধরে অনুরোধ করতে লাগলাম, কিন্তু কিছুতেই ফল হলো না। আমি তার পায়ে পড়লাম। বললাম, মামা, খরচপাতি কমান। আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে তাকে বললাম, আমরা ভয়ানক সঙ্কটে পড়েছি। আমি বললাম, আমি আপনার পাশে থাকব। যে কষ্ট আমার করা দরকার সেই কষ্ট আমি করব। বললাম : আমাদের খরচ বাড়ালে আমরা নিষ্কৃতি পাব না। আমার এমন আচরণে তার পার্শ্বচররা আমার উপর বিরূপ হয়ে উঠল। তার এই বৃদ্ধ বয়সে তার এমনভাবে সম্পদের ব্যয় করা উচিত নয়। আমার আন্তরিকতায় যেন মুগ্ধ হলেন এবং আমার কথামতো আমাকে প্রতিশ্রুতি দিলেন। কিন্তু যেই মুহূর্তে তার কিছু দুর্বত্তের আগমন ঘটল অমনি তিনি তার সব প্রতিশ্রুতি যেন ভুলে গেলেন। দুর্ঘটনার হাজার প্রমাণ আমি দেখাতে লাগলাম। তবু কোনও কাজ হলো না। এই অবস্থায় আমার চোখ বন্ধ করে থাকা ছাড়া আর কী উপায় থাকতে পারে। যে গৃহকে আমি রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছিলাম, সে গৃহ পরিত্যাগ করা ছাড়া আমার আর কী উপায় ছিল? আমি মামার আবাস পরিত্যাগ করে নিয়ন, জেনেভা ছেড়ে লিয়নসে গেলাম যেন মাদামের ক্রমবর্ধমান দুরবস্থাকে আমার দেখতে না হয়। আমি প্রতিজ্ঞা করে বলতে পারি অপ্রয়োজনীয় যে কোনও সংখ্যক কর্মচারী ছাঁটাই করতে আমি রাজি হতাম। কিন্তু এ তো কেবল আমার ব্যক্তিগত কৃতার ব্যাপার ছিল না। আমি যতই কৃতার আশ্রয় নিলাম, দেখলাম তার সবই ওইসব নচ্ছারদের হাতে গিয়ে জমা হচ্ছে। তার এমন উদারতাকে আঘাত দিয়ে কথাও বললাম।… অবশেষে আসন্ন হত্যাকাণ্ডে নিহত হওয়ার কুকুর প্রায় আমি আমার দ্রব্যাদির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র টুকরাগুলোকে নিয়ে মামার সেই গৃহ পরিত্যাগ করলাম।

এই অবস্থাতে আমার প্রায় দু’বছর কিংবা তিন বছর কাটল। আমি এ কাজ থেকে ও কাজে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাত লাগালাম। এখান থেকে ওখানে গেলাম। সাহিত্যের পাঠ শুরু করলাম। তার আলোচনাতেও যোগ দিলাম। অর্থ বুঝি আর না বুঝি তার শব্দ নিয়ে কারিগরি করা শুরু করলাম। জেনেভার পথে একবার আমি বার কয়েক আমার পুরাতন সুহৃদ মশিয়ে সাইমনের কাছেও গেলাম। তিনি নানা ধরনের সাহিত্য জগতে খবর দিয়ে আমার সাহিত্যের আগ্রহকে উদ্দীপিত করে তুললেন। চ্যামবেরিতে আমি প্রায়ই জ্যাকোবিন পন্থী একজন জ্যাকোবিন পদার্থবিদের কাছেও যেতাম। অত্যন্ত ভদ্র মেজাজের একজন ভিক্ষু ছিলেন তিনি। আজ তার নাম ভুলে গেছি। তিনি আমাকে নিয়ে নানা প্রকার পরীক্ষার চেষ্টা করতেন। তাতে আমারও আমোদ লাগত। তার নির্দেশে আমি একরকম রাসায়নিক কালি বানাতে সক্ষম হলাম। এক প্রকার চুন, জল আর অরপিনেন্ট মিশিয়ে একটা তরল পদার্থ বানালাম। একটা বোতলে ভরে মুখ বন্ধ করে ওটাকে ঝাঁকুনি দিতে বোতলটা বাষ্পের চাপে ফেটে গেল। আমি দ্রুত আটকানো বোতলটার মুখ খুলতে গেলাম। কিন্তু তার মুখ খোলার আগেই বোতলটা দরাম করে একটা বোমার শব্দে ফেটে গেল। আমার চোখে মুখে সেই বোতলের চুন আর অরপিনেন্ট এত পরিমাণ লেগেছিল যে, আমি প্রায় মারা যাচ্ছিলাম। এর ফলে আমি প্রায় ছয় সপ্তাহ কিছু দেখতেই পাইনি। সেখানেই আমার বিজ্ঞানের কিছুমাত্র না জেনে বিজ্ঞান নিয়ে আমার খেলার শেষ।

বিজ্ঞানের পরীক্ষাটা আমার স্বাস্থ্যের নিদারুণ ক্ষতি করেছিল। আমার শরীর ইতিপূর্বেই বেশ খারাপ যাচ্ছিল। অথচ আমার দৈহিক কাঠামো তো ভালই ছিল। আমি কোনও কিছুই বেসামাল চর্চাও করিনি। তথাপি গায়ে-পায়ে আমি বেশ শুকিয়ে যেতে লাগলাম। আমার শরীরের গঠন বেশ শক্তই ছিল। আমার বুকের পাটাও বড় ছিল। তা সত্ত্বেও আমার শ্বাসকষ্ট হতে লাগল। একটা দমবন্ধ ভাব এল, বুকের ধরফরানি বাড়ল এবং রক্তবমি হলো। মাঝে মাঝে জ্বর হতে লাগল। এই জ্বরের উপসর্গ থেকে আমি আজ পর্যন্ত মুক্ত হতে পারিনি। এই সময়টা নিয়ে ভাবতে আমার খারাপ লাগে। আমার সেই সুকুমার বয়সে শরীরে আমার কেমন করে এই অবস্থা হলো, তা আমি ভাবতে পারিনে। আমি কোনও খারাপ কাজ করিনি। শরীরের ভেতরে কোনও আঘাতও লাগেনি, স্বাস্থ্য নষ্ট করার কোনও কাজও আমি করিনি। তথাপি এই সময়টাতে আমার দুর্ভোগই ঘটেছিল।

অনেক সময় এমন বলা হয় যে, তলোয়ারের খাপটাও তলোয়ারের ভেতরটাকে নষ্ট করে দিতে পারে। আমার ইতিহাসও তাই বলছে। আমি এক আবেগসর্বস্ব মানুষ। এই আবেগ নিয়েই আমি জীবনধারণ করেছি। আর এই সব আবেগই আমাকে শেষ করেছে। যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, যে আবেগের কথা বলছি, কী সে আবেগ– তাহলে বলব না, কোনও মহৎ বা বৃহৎ আবেগ নয়। তবু আমার মনে হতো এ যেন হেলেন উদ্ধারের এক আবেগ কিংবা বিশ্বের সিংহাসন হারাবার আশঙ্কার এক আবেগ।

মেয়ে ব্যাপার বলে একটা ব্যাপার তো ছিলই। একটিকে পেলে আমার ইন্দ্রিয়াদি শান্তই থাকত। কিন্তু তাতে আমার শান্তি আসত না। ইন্দ্রিয়ভভাগের মধ্যেও ভালবাসার আকর্ষণ আমাকে কুড়ে কুড়ে খেত। আমার তো কোমলমতি এক মা ছিল, একজন প্রিয় বন্ধু ছিল, তারপরও আমার একটি প্রণয়ীর প্রয়োজন ছিল, আমার ভালবাসার পাত্রী। কেউ এমন না থাকলেও আমি তার কথা চিন্তা করতাম। আমি মনে করতাম সে আমার হাতের কাছে, হৃদয়ের কাছে আছে আর আমি তাকে হাজার রকমে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যেন দেখছি। হোক এ আত্মভ্রম, তবু এ থেকে আমার নিষ্কৃতি ছিল না। আমার কাছে যদি মামা থাকত, তবে আমি তাকে মনে করতাম সে আমার বাহুবন্ধনে আবদ্ধ আছে। আমি যেন তাকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করছি। এটা ঘটনা না হলেও এই চিন্তাকে আমি ঘটনা বলে মনে করতাম এবং তাতেই আমার সকল উত্তেজনার প্রশমন ঘটত। স্নেহে-মমতায় আমার কান্না পেত, কিন্তু তাতে আমার এমন প্রশান্তি ঘটত না। আমি জানি না অপর কারোর মনে এমন ঘটে কী না। আমি কখনও যদি এমন প্রেমের সাক্ষাৎ পেতাম তাহলে তেমন ভালবাসার তীব্রতাকে আমার এই কৃশ দেহ বহন করতে পারত কী না তা আমি বলতে পারিনে। সেই ভালবাসার তীব্রতায় বাঁচার চাইতে তৎক্ষণাৎ মরে যেতেই আমি ভালবাসতাম।

এভাবে আমি মাদাম ওয়ারেনস, মানে মামার যন্ত্রণায় আমি মরে যাচ্ছিলাম। আমার সামনে কী লক্ষ্য তাও আমি জানতাম না। আর সেজন্যই এই অবস্থা আমাকে যেন শেষ করে ফেলছিল। আমার অস্থিরতার শেষ ছিল না। মামার ঘর-সংসারের অবস্থা দেখে আমি হতাশ হয়ে পড়ছিলাম। এমন অবস্থায় তার আচরণ তার জন্য আরও আত্মঘাতী হয়ে পড়ছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম কিছুদিনের মধ্যেই মামা একেবারে শেষ হয়ে যাবে। আমার নির্দয় এমন কল্পনা সবসময়ই সত্য হয়ে দাঁড়াত। মামার ক্ষেত্রে এর পরিণতির যে আর কোনও ব্যতিক্রম হবে না তা আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার নিজের দুর্গতি আর অনটনেরও শেষ ছিল না। এর ফলে যে মামাকে আমি জীবন দিয়ে ভালবেসেছি তার কাছ থেকে যে আমার বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে হবে তার নিশ্চয়তাকেও আমি বুঝতে পারছিলাম। আমার জীবন দিয়ে যাকে ভালবেসেছিলাম তাকে বাদ দিয়ে যে আমি বাঁচব না তাও আমি বুঝতে পারছিলাম। তাকে বাদ দিয়ে আমার জীবনে আনন্দের সন্ধান কোথায় কী করে পাব? এভাবে আমার আত্মার অস্থিরতার শেষ ছিল না। একদিকে আমার জীবনের কামনা, অপরদিকে এক অসীম শূন্যতা আর ভীতি আমাকে দিগ্ভ্রান্ত করে ফেলছিল।

সঙ্গীত ছিল আমার জীবনের আর এক আকর্ষণ। সে অবশ্য এত তীব্র ছিল না। তবু সে সঙ্গীতে যেভাবে ডুবে গেলাম তাও আমার অস্তিত্বকে কম ক্ষত-বিক্ষত করল না।… কত সঙ্গীত যে আমি রাতের পর রাত রচনা করতে লাগলাম আবার তার নকল করতেও আমার শ্রম কম ব্যয় হলো না।… ক্লিভল্যান্ডকে আমি গোগ্রাসে গিলেছি। আমার নিজের রচনাকে বাদ দিয়ে এইভাবে ভিন্নতর জিনিসের পেছনে আমি নিজেকে ক্ষয় করেছি।

চাম্বেরিতে এম বাগারেত নামে একটি লোক পেয়েছিলাম। এ লোক রাশিয়ার সম্রাট পিটারের দরবারে নিযুক্ত হয়েছিল। এ ব্যাটা যেমন একটা বদমাশ ছিল, তেমনি একটা মূর্খও ছিল। জীবনে এরূপ তোক আমি খুব কমই দেখেছি। এই লোকটা কোনও একটা মামলার ব্যাপারে চাম্বেরিতে এসেছিল। আমি যা আশঙ্কা করেছিলাম, তাই ঘটল। মাদামের ওপর তার দৃষ্টি পড়ল। আকর্ষণীয় কোনওকিছু মামাকে প্রদানের বিনিময়ে তার যা কিছু ক্রাউন অবশিষ্ট ছিল তাও একটার পর একটা সরিয়ে তাকে নিঃশেষ করে ফেলল। আমি লোকটাকে যে পছন্দ করতাম না, তা সে বুঝত। আমার সারল্যের সুযোগ নিয়ে লোকটা আমাকে পটাবার জন্য কোনও গর্হিত কাজ থেকেই নিবৃত থাকল না। একবার সে আমাকে দাবা খেলা শেখাবার প্রস্তাব দিল। ও নিজে যে দাবা তেমন জানত তা নয়। আমার নিজের খুব ইচ্ছা না থাকলেও আমিও দু’একবার চেষ্টা করলাম। আমি দাবার চাল কিছু শিখেছিলাম। কিন্তু তেমন দক্ষতার সঙ্গে নয়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই আমি বেশ দক্ষ হয়ে উঠলাম। এবং প্রথম খেলার পরের খেলাতে আমি তাকে আমার নৌকার চালে মাত করে দিলাম। এতেই আমি পাগল হয়ে গেলাম। তখন থেকে আমি দাবায় মত্ত হয়ে উঠলাম। আমি দাবার একটা বোর্ড কিনে ফেললাম এবং দাবা খেলার একখানি বইও! আমি নিজের ঘর বন্ধ করে নিজেই নিজের সঙ্গে চাল, পাল্টা চালের খেলা খেলতে লাগলাম। এরপর বিরামহীনভাবে আমার এই দাবার পাগলামি চলতে লাগল। এই অবিশ্বাস্য কাণ্ডের পরে একেবারে শীর্ণকায় হয়ে আমি একদিন একটা ক্যাফেতে গেলাম। এটাও ছিল দাবা খেলার ক্যাফে। আমি আবার শুরু করলাম : সেই বারগারেতের সঙ্গেই। কিন্তু লোকটা একটার পর একটা খেলায় আমাকে মাত করতে লাগল। আমিও ক্ষেপে গিয়ে এমন পাগলামি করতে লাগলাম যে আমার মাথা ঘুরতে লাগল। সমস্ত চাল আমার মাথার মধ্যে একটার সঙ্গে একটা মিশে গিয়ে আমাকে দিশেহারা করে ফেলল। তবু আমি ছাড়লাম না। এর ফল দাঁড়াল এই যে আমার শরীর আগের চাইতেও কাহিল হয়ে পড়ল। তারপর আমি যতই দাবার চর্চা করলাম না কেন দাবা খেলায় আমি আর বিন্দুমাত্র উন্নতি করতে সক্ষম হলাম না। আমার চেষ্টাতেও কিছু হলো না। এমনি ছিল আমার দাবার মুখতার একগুয়েমি। শেষপর্যন্ত দাবার ঘর থেকে যখন আমি বেরিয়ে এলাম তখন আমি একটা কঙ্কাল বৈ আর কিছু ছিলাম না। আমি যদি এভাবে আরও চালাতাম তাহলে আমি যে একেবারে শেষ হয়ে যেতাম তাতে কোনও সন্দেহ ছিল না। আমার সেই কিশোর বয়সে এমন পাগলামিতে আমার শেষ হয়ে যাওয়া ছাড়া আর উপায় ছিল না।

আমার স্বাস্থ্যের এমন অধোগতি আমার মন-মেজাজকেও খারাপ করে তুলল। আমার কল্পনার তেজ এবং আগ্রহের হ্রাস ঘটতে লাগল। আর শরীরের দুর্বলতার কারণে আমার আচরণে যেন উচ্ছ্বাসেরও অভাব ঘটল, এখন কেবল ঘরে আবদ্ধ হয়ে থাকতে লাগলাম। আগে ঘুরে বেড়াবার যে আগ্রহ ছিল তাও যেন উবে গেল। ঘরে বসে বসে মানসিক ক্লান্তির চাইতেও মানসিক বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়তে লাগলাম। আবেগের স্থানে যেন মৃগী রোগের শিকারে পরিণত হতে লাগলাম। যেটা ছিল জড়তা, তা একটা অবসাদে পর্যবসিত হতে লাগল। মনে হতে লাগল জীবনটা ভোগ করার আশাই যেন ফুরিয়ে যাচ্ছে। আমার মমতাময়ী মাদামকে ফেলে যাওয়ার দীর্ঘশ্বাসে আমার বুক ভরে উঠল। যে দুরবস্থায় সে পতিত হচ্ছিল, তাকে এমন অসহায় ফেলে যাওয়াতে দুঃখ আর বিষাদ ছাড়া আর কোনও অনুভূতি ছিল বলে আমার মনে হলো না। এমন মানসিক অবস্থায় আমি রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়লাম। আর এমন অবস্থায় মাদাম আমাকে পূর্বের চাইতে অধিক আন্তরিকতার সঙ্গে আমার শুশ্রূষা করতে লাগলেন, যেন আমি তার কাছে একটি দুর্বল শিশুতে পরিণত হয়ে গেলাম। কোনও মা-ই তার শিশুকে এর অধিক মমতা দিয়ে শুশ্রূষা করতে পারত বলে আমি মনে করতে পারলাম না। এতে অবশ্য তারও একটু ভাল হলো। মাদাম আগে নানা পরিকল্পনায় ব্যস্ত থাকতেন। এখন আর তেমন নানা কল্পনায় উদব্যস্ত রইলেন না। এতে তাকে ঘিরে ছিল যে দুর্বত্তবৃন্দ তারাও ভেগে পড়তে লাগল। এমন সময়ে মৃত্যু এলে আমি তাকে স্বাগত জানাতাম। আমার তখন মৃত্যুকে সুন্দর মনে হতো। জীবনের ভাল বেশি ভোগ যদি আমি নাও করে থাকি। জীবনের মন্দের ভাগ্যও আমার তেমন ঘটেনি। মানুষের অন্যায় আর অসততাকে পরিত্যাগ করে যেতে আমার তখন কোনও কষ্ট হতো না। মানুষের কৃত অন্যায় আর অমানুষিকতাই মানুষের মৃত্যুকে অধিকভাবে বিষাক্ত করে তোলে। আমার মৃত্যুকে তখন মনে হতো খারাপের চাইতে ভাল। এমন ভাল মৃত্যুকে তখন আমি মৃত্যু বলেই মনে করতাম। হায়! তখন যদি আমি আমার এমন মমতাময়ীর কোলে যথার্থই মরে যেতে পারতাম। তার অনিবার্য দুরবস্থা এবং দুর্ভাগ্যের জন্য যদি আমি বিষণ্ণতায় আপুত না হতাম, তাহলে তখন আমি তার বুকে ঘুমিয়ে পড়ার মতোই আমি শান্তিতে নিদ্রায় ঢলে পড়তে পারতাম। কিন্তু তার দুরবস্থার আশঙ্কা তার জন্য আমার মনের বিষণ্ণতাকে দৃঢ়তার জন্য একটা মায়া এবং মমতায় আমাকে ভরে তুলত। আমি একদিন বললাম, মা মণি, আমি তোমার হাতের পুতুল। আমার সমর্থ অস্তিত্ব তোমার অস্তিত্বে নিহিত। মা মণি, আমার অস্তিত্বকে তুমি আনন্দিত করে তোল। আমার অবস্থা আরও খারাপ হলে, দু’এক রাত আমি নিজেকে কোনও রকমে টেনে টেনে মাদামের কক্ষে ঢুকেছিলাম, তার কী করা উচিত সে কথা বলতে। আমি ভেবেছিলাম, তার ভালর জন্য তাকে আমার একথা বলা দরকার। কিন্তু আমার আচরণে আমার মুখের কথার চাইতে তার প্রতি আমার সোহাগ আর ভালবাসার প্রকাশ ঘটল অধিক। তার শয্যায় আমি উঠে বসেছিলাম। কিন্তু তার জন্য আমার চোখে জল ছাড়া আর কিছু তো ছিল না। আমারও মনে হলো আমার চোখের জলই হচ্ছে তাকে আমার দেয়। তার হাত দুটিকে আমার হাতের মধ্যে তুলে নিলাম। আমার মনে হলো তার হাত দুটি ধরতেই আমি যেন আমার অস্তিত্বে শক্তি পেলাম। আমাদের দুজনের কথায় কথায় আমাদের রাত কেটে গেল। পরে আমি যখন তাকে শুইয়ে রেখে তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলাম, তখন আমি যেন তার কক্ষে প্রবেশের সময়ের চাইতে অধিক শক্তি বোধ করতে লাগলাম। তিনি আমার সব দাবি মেনে নিলেন। আমাকে প্রতিশ্রুতি দিলেন তিনি আমার কথা শুনবেন। তার এমন কথায় আমার মন শান্ত হলো। আনন্দে যেন ভরে গেল। তার গায়ে হাত রেখে আমি যখন তার কাছ থেকে চলে এসে ঘুমাতে গেলাম তখন আমার অন্তর যথার্থই শান্তিতে পূর্ণ ছিল। আমার নিজের অস্তিত্বকে সেই শান্তির হাতেই যেন আমি অর্পণ করে দিলাম।

জীবনকে ঘৃণা করার কারণের আমার অন্ত ছিল না। যে ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্যদিয়ে আমাকে এগুতে হয়েছে, আর যার আঘাতে আমার অস্তিত্ব প্রায় ভেঙে পড়ছিল, যখন আমার জীবনকে আমার কাছে একটা ভার বৈ আর কিছু মনে হচ্ছিল না তখন ঈশ্বরের কাছে আমার মনের এই কামনা ছিল, যে মৃত্যুতে আমার অস্তিত্বের শেষ হবে, সে মৃত্যু যেন সেদিনের মৃত্যুর চাইতে অধিকতর নির্মম না হয়।

কিন্তু মাতৃসম আমার সেই মামার বিরামহীন যত্ন এবং তার অবিশ্বাস্য পরিশ্রমে তিনি আমাকে সেদিন রক্ষা করেছিলেন। এবং একথা একান্ত সত্য যে তিনি ব্যতীত অপর কেউ এ কাজ করতে পারতেন না। চিকিৎসকের ওষুধাদিতে আমার সামান্য বিশ্বাস। আমি বিশ্বাস করি আমার বিশ্বস্ত বন্ধুর ভালবাসাকে। যে সমস্ত বিষয়ে আমাদের সুখ নিহিত তার শক্তি অপর যে কোনও কিছুর চাইতে বেশি। জীবনে আনন্দবোধ বলে যদি কিছু থাকে তবে তা আমাদের এই দুজনের পরস্পরকে পুনরায় লাভ করার আনন্দ বৈ আর কিছু নয়। আমাদের পারস্পরিক নিবিড়তার অধিকতর বৃদ্ধির কোনও উপায় ছিল না। কিন্তু আমাদের এই পুনর্মিলনের গভীরতা যেরূপ এবার প্রাপ্ত হলো তার কোনও ব্যাখ্যা দান আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তার মহৎ সারল্যই তার একমাত্র ব্যাখ্যা। এবার আমার অস্তিত্ব একান্তই তার হয়ে দাঁড়াল। আমি এবার একান্ত তার একটি সন্তানে পরিণত হলাম। তিনি যদি যথার্থই আমার জননী হতেন তাহলে তার সঙ্গে আমার এই জীবনের সম্পর্ক তার চাইতেও অধিক হয়ে দাঁড়াল।

এ জীবনের সূচনাতে আমরা দুজনে অবিচ্ছিন্ন হয়ে দাঁড়ালাম। আমরা একে অপরের অংশ, এমনও আমরা ভাবতে পারতাম না আমাদের দুজনের অস্তিত্ব একটা অভিন্ন অস্তিত্ব হয়ে দাঁড়াল। আমাদের অনুভূতি এমন ছিল যেন আমরা একে অপরের জন্য যে কেবল অনিবার্য হয়ে দাঁড়ালাম তাই নয়– আমরা একটা অভিন্ন সত্তায় যেন পরিণত হয়ে গেলাম। আমরা কোনও কিছুকে আমাদের অস্তিত্ব থেকে ভিন্ন বলে আর ভাবতে পারলাম না। আমাদের দুজনের সুখ এবং আনন্দ অভিন্ন হয়ে উঠল। একের কামনাই অপরের কামনা, একের আনন্দই অপরের আনন্দ হয়ে দাঁড়াল। আমাদের উভয়ের কামনা উভয়েরই পরস্পরকে প্রাপ্তির কামনা হয়ে দাঁড়াল। এমন সম্পর্কের কোনও তুলনা বা প্রকাশ আর কিছুতেই যেন সম্ভব নয়। আমি নিজেও দু’জন মানুষের মধ্যে এমন সম্পর্কের অস্তিত্বকে যেন কল্পনা করতে পারছিলাম না। যে ভালবাসার কথা আমি বলছি সে ভালবাসা কোনও ইন্দ্রিয়গত ভালবাসা নয়। ইন্দ্রিয়গত ভালবাসার চাইতেও এ অধিকতর ভালবাসা। এর অস্তিত্ব কোনও ইন্দ্রিয় বা ইন্দ্রিয়ের জন্য যৌন কামনা, কোনও এক বয়সের প্রতি অপরের আকর্ষণ বা ভালবাসা নয়। এর সব কিছু নিয়েই এবং এর সবকিছুকে অতিক্রম করেই যেন আমাদের এই ভালবাসা ছিল। দুই অস্তিত্বকে একটি মাত্র অস্তিত্ব হতে যা কিছু প্রয়োজন তার সবকিছুতেই যেন আমরা পরিণত হয়ে গেলাম। এবং দুজনেই একেবারে অস্তিত্বহীন হওয়া বাদে আমাদের কেউ কারোর অস্তিত্বকে কল্পনা করতে পারতাম না।

আমার এখন মনের প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে আমাদের এই সুখকর সঙ্কট না তার জন্য, না আমার জন্য, সুখে পরিণত হলো না। কেমন করে হলো। কেমন করে এমন হয়? তার কিংবা আমার দু’জনেরই কারোর জন্যই এই সম্পর্ক পরিণামে সুখের আকর হয়ে উঠলো না। কিন্তু কাকে এ জন্য দায়ী করব। আমার তো কোনও অপরাধ ছিল। আমার তো কোনও ত্রুটি ছিল না। আমার সান্ত্বনা এই যে, একথা আমার মিথ্যা নয়। তবে কী দোষ তার। তাও আমি বলতে পারিনে। তারও তো কোনও ইচ্ছাকৃত অপরাধ ছিল। এটা আমার ভবিতব্যেরই ব্যাপার। পরিবর্তন বা পরিশোধনের অতীত আমার যে স্বভাব; সে আবার তার অস্তিত্বকে অপরিহার্য করে তুলল। সে আবার আমাকে কজা করে ফেলল। তবে ঘটনাটা যে হঠাৎ ঘটেছিল, এমন নয়। ভাগ্য ভাল; হঠাৎ নয়। দুটো ঘটনার মধ্যে যেন কিছু কালের একটা বিরতি ছিল। এর একটা প্রয়োজন ছিল। বড় রকমের প্রয়োজন। এটা আমার দোষে ঘটেছে, এমন নয়। আমি আমার নিজের কোনও বিচ্যুতি এমন পরিণতির জন্য খুঁজে পাচ্ছিনে।

.

[রুশোর বিবৃতি এরূপ যে, সে মাদামকে নাকি বলেছিল : মামা, এসো আমরা দুজনে এক দেশে কোথাও ঘর বাঁধি।]

.

আমার কথায় ‘মামা’ রাজি হতেন। এমন মমতাময়ী তিনি আমার প্রতি ছিলেন। তাই যদি বাস্তবে ঘটত তাহলে আমাদের মৃত্যু পর্যন্ত দু’জনে এক অভিন্ন অস্তিত্বে অপার আনন্দে জীবনকে ভোগ করতে পারতাম যতক্ষণ না মৃত্যু এসে আমাদের দু’জনকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলত। মৃত্যু পর্যন্ত তাহলে আমাদের জীবনে এক অপার সুখ নেমে আসত। কিন্তু সে ভাগ্য আমাদের হলো না। আমার ভাগ্যে মর্মান্তিক দুঃখ-দুর্দশা নেমে এল। নানা অভাব অনটন তার জীবনে ঘটতে লাগল। একদিন যার প্রাচুর্যের অভাব ছিল না পরিণামে এর কিছুই তার ভাগ্যে জুটল না। বিনা দুঃখে সব তাকে ছাড়তে হলো। আমার দুর্ভাগ্যের অভাব ঘটল না। শেষপর্যন্ত একদিন আমি মামাকে পরিত্যাগের নোটিশ দেয়ার মতোই কথা বললাম। তাকে যারা ঘিরে ছিল তারা সবাই সে কথা শুনল। আর তারা যেন সততা আর সত্যের খাতিরে জগৎকে আমাদের মধ্যকার সম্পর্কের ঘটনা জানিয়ে দিল। এজন্য তাদের যে কোনও চক্র তৈরি করতে হলো বা নিজেদের মধ্যে ষড়যন্ত্র, তেমন কিছু নয়। কারণ আমাদের দুজনের মধ্যে গোপনীয়তার তো কিছু ছিল না।

একটা দুর্ভাগ্যজনক আশঙ্কা তাকে পিছু টানল। যে বাড়িতে সে ছিল তা তখন আর বাসযোগ্য কিছু ছিল না। কিন্তু সে বাড়ি ছেড়ে দেবার নোটিশ দিলে বাড়ির মালিক ক্ষুব্ধ হতে পারে, এই আশঙ্কায় মামা পিছিয়ে গেলেন।

মামা বললেন, বাছা, তোমার প্রস্তাবটি মনোহর। তোমার প্রস্তাবটির আকর্ষণকে আমি বুঝি। আমার আকর্ষণও কম নয়। কিন্তু ধর আমরা এই আবাস ছেড়ে বনবাসে চলে গেলাম। তাতে এ বন্দিত্ব থেকে আমি মুক্তি পাব, একথা সত্য। কিন্তু এই দুর্গ থেকে যদি আমি মুক্তি পাই, আমার জৈবিক জীবনের কী অবস্থা ঘটবে। কোথায় পাব আমাদের দুজনের আহারাদি : জীবনের জন্য যার প্রয়োজন রয়েছে। বনের মধ্যে তা না পেয়ে আমাদের তো আবার এই শহরেই ফিরে আসতে হবে। তাই এমন আশঙ্কাকে সামনে নিয়ে আমাদের দুজনেরই এক সঙ্গে এ আবাস পরিত্যাগ করা উচিত নয়। বার্ষিক যে ভাড়া আমাকে দিতে হয়, আমি বরং বাড়ির মালিককে তা অগ্রিম দিয়ে দিই। যদি ফিরে আসি তখন সে আমাকে এই গৃহে থাকতে দেবে। চল, আমরা দুজনে দূরে কোথাও চলে যাই : সেখানে আমরা শান্তিতে থাকতে পারব। শহরের বাইরে। তবু যেন প্রয়োজন হলে একটু ফিরেও আসতে পারি।

আমরা দুজনে তাই করেছিলাম। চারদিকে একটু তাকিয়ে শহর থেকে দূরে লা’ চারমেটিসে এসে বাস করতে আরম্ভ করলাম। এটা চাষেরির কাছেই একটা জমিদারির মতো ছিল। এর মালিক ছিল মশিয়ে দা বোনজি। চাম্বেরি থেকে তেমন দূরে নয়। কিন্তু এত শান্ত এবং নিরিবিলি, মনে হতো যেন বনের অনেক গভীরে। জায়গাটির দুপাশে দুটি উঁচু পাহাড় ছিল : দু’টি পাহাড়ের মাঝখানে ক্ষুদ্র একটি উপত্যকা ছিল। উত্তর দক্ষিণে দ্বীপ। উপত্যকাটির মধ্য দিয়ে একটি জলপ্রপাত ও গাছ-গাছালি আর নুড়ি পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে যেত। এই উপত্যকারই ওপর দিকে, মাঝপথে, কয়েকটি ছড়ানো ছিটানো ঘরও ছিল। সব মিলিয়ে যে একটু নিরিবিলি জীবনকে পছন্দ করে তার জন্য অবশ্যই আদর্শ। ঘর কয়টিকে দেখে আমরা এর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ঘরটিকে নিজেদের জন্য বেছে নিলাম। এই ঘরটির মালিক ছিল ওখানকার সেনাবাহিনীর এক অফিসার।

তার নাম ছিল নয়রেত।

ঘরটি দস্তুরমতো বাসযোগ্য ছিল। সামনে একটি আঙ্গুর বাগান ছিল। তার ওপরে একটি ঝুল বারান্দার মতো ছিল। নিচের দিকেও একটি বাগান ছিল। নানা ফলের বৃক্ষপূর্ণ। একটি ফোয়ারাও ছিল। পাহাড়ের আর একটু ওপরে পশুচারণের ভূমিও ছিল।

মোটকথা আমরা যার কল্পনা করেছিলাম, তার সবই ছিল। সময়ের দিনক্ষণ যা এখন স্মরণ করতে পারি, তাতে সয়মটা ছিল ১৭৩৬৮ সালের গ্রীষ্মকাল। প্রথম রাতে আমরা যখন ঘরটিতে শুতে গেলাম, তখন আমাদের আনন্দের সীমা ছিল না। আমি আমার মামাকে আদরে সোহাগে আলিঙ্গন করে আমার হৃদয়ের আনন্দ প্রকাশ করে বললাম : আহ! কি সুন্দর মামা, তাই না? যথার্থই আমার বিমল হৃদয়ের শেষ ছিল না। মামা : এই হচ্ছে আমাদের আনন্দ, সুখ আর পবিত্রতার প্রিয় স্থান! এটি যদি আমার কল্পনার স্বর্গ না হয়, তাহলে আর কোথাও আমরা তাকে অন্বেষণ করে বের করতে পারব না।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *