প্রথম খণ্ড – প্রথম পুস্তক [১৭১২-১৭১৯]

প্রথম খণ্ড – প্রথম পুস্তক [১৭১২-১৭১৯]

আমি আজ একটি কর্ম সম্পাদনে হাত দিয়েছি যার কোনও পূর্বগামী নাই এবং কোনো অনুগামী কখনো হবে না। আমার সমকালের সহযাত্রীদের সম্মুখে আমি একটি মানুষকে অনাবৃত করতে চাই : তার স্বভাবের সর্বপ্রকার সত্যতায়। এই মানুষটিকে আমি চিনি। মানুষটিকে আমি আদ্যোপান্ত জানি। সেই মানুষটি আমি নিজে। যার নাম রুশো।

আর কেউ তাকে জানে না। কেবল আমি তাকে জানি। আমার আত্মাকে আমি জানি এবং মানুষকে আমি দেখেছি। আমার অস্তিত্ব, যাদেরকেই আমি দেখে থাকিনে কেন, তাদের কারোর সদৃশ নয়। হ্যাঁ, আমি জোর দিয়েই বলব, যাদের আমি দেখেছি আমি তাদের কারোর মতো নই। কারোর মতো করে আমাকে সৃষ্টি করা হয়নি। আমি তাদের কারোর চাইতে উত্তম না হতে পারি, অন্তত আমি তাদের চাইতে ভিন্ন।

প্রকৃতি যে ছাঁচে আমাকে তৈরি করেছে, সেই ছাঁচটি আমাকে তৈরি করার পরে ভেঙে ফেলে সে কোনও অন্যায় করেছে কিংবা করেনি, তা পাঠকরা নির্ধারণ করতে পারবেন আমাকে পাঠ করার পরেই মাত্র। পূর্বে নয়।

হ্যাঁ, বিচারের দিনের কথা আমি জানি। আমি বলি শেষ বিচারের নিনাদ বেজে উঠুক। বিচারপতি আসন গ্রহণ করুন। আমি আমার দক্ষিণ হস্তে এই পুস্তকখানি তথা আমার আত্মকথাকে ধারণ করে বিচারককে নির্দ্বিধায় বলব : এই দেখ আমার কর্মকাণ্ড। আমার চিন্তারাজি তোমার সমুখে উন্মোচিত। তোমার সম্মুখে এই হচ্ছে আমার অস্তিত্ব। আমার উত্তম এবং অধম : সবকিছুকে আমি সর্বাধিক সংকোচহীনতার সঙ্গে প্রকাশ করেছি। অধম কিছুকে আমি কোনও প্রকারেই গোপন করিনি এবং আমার চরিত্রের বাইরের কোনও উত্তমকেও আমার চরিত্রে অন্তর্ভুক্ত করিনি। দু’এক সময়ে কোনও ঘটনার গায়ে যদি প্রলেপ কিছু দিয়ে থাকি তবে তার কারণ আমার স্মৃতির দুর্বলতা। যা সত্য হতে পারত তাকে হয়তো আমি সত্য বলে প্রকাশ করেছি। কিন্তু যাকে মিথ্যা বলে জেনেছি তাকে কখনো আমি সত্য বলে দাবি করিনি।

আমি যা ছিলাম তাকে আমি উন্মোচিত করেছি : একটা ক্ষুদ্র, ঘৃণ্য, মন্দ নয়, ভাল একটা প্রাণী যার অন্তরের উচ্চতা কম ছিল না। হৃদয় তার মহৎ ছিল। অন্তদৃষ্টি সম্পন্ন বিচারপতি, তুমি তো জানো তোমার দৃষ্টিকে আমি লুক্কায়িত করিনি। আমার অন্তরের অন্তঃস্থলকে আমি আবরণহীন করেছি। বিচারপতি, তুমি আহ্বান করো আমার সমকালের সংখ্যাহীন সহগামীকে। তারা শ্রবণ করুক আমার আত্মঘোষণাকে। আমার পদার্থহীনতাকে তারা করুণা করুক এবং আমার অসম্পূর্ণতাকে তারা ধিকৃত করুক। এবং তার পরে তাদের প্রত্যেকে তাদের সমগ্র অস্তিত্বকে আমার সংকোচহীনতা দিয়ে প্রকাশিত করুক। তারা তাদের অন্তরের গুপ্ত গহ্বরকে তোমার সামনে অনাবৃত করুক, যেমন আমি করেছি এবং তার পরে সে বলুক, এই অধম-আমার চাইতে সে উত্তম।

আমি ১৭১২ সালে জেনেভাতে জন্মগ্রহণ করেছি। জেনেভার নাগরিক আইজাক রুশো এবং সুসেন বারনার্ডের পুত্র আমি। আমার পিতা তার পূর্ব-পুরুষদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার হিসেবে লাভ করেছিলেন সামান্যই সম্পদ। তাদের পনেরটি সন্তানের মধ্যে তাদের সম্পদের বিতরণ শেষে অবশিষ্ট ছিল সামান্যই। আমার পিতার জীবনধারণের একমাত্র উপায় ছিল একজন ঘড়ি নির্মাতা হিসেবে তার উপার্জন। অবশ্য এ কথা সত্য যে, ঘড়ি নির্মাণে তার দক্ষতা ছিল অপর সকলের চোখে প্রশংসার বিষয়। সে দিক থেকে একজন প্রটেসট্যান্ট ধর্মযাজকের কন্যা হিসেবে আমার জননীর অবস্থা কিছুটা উত্তম ছিল। আমার জননী বুদ্ধিমতী ছিলেন এবং সুন্দরী ছিলেন। আমার পিতা যে তাকে বিয়ে করতে পেরেছিলেন, এটা তার ভাগ্যের কথা। আমি বলব, পরস্পরের জন্য তাদের আকর্ষণ ছিল জন্মগত। তাদের কৈশোরকে স্মরণ করে বলতে পারি তারা যখন মাত্র আট বছর বয়সের কিশোর কিশোরী, তখন তারা দুজনে পরস্পরের হাত ধরে ভ্রমণে বেরুতেন। দশ বছর বয়সে তারা দুজনে হয়ে ওঠেন অবিচ্ছেদ্য যুগল।

পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি এবং দুটি আত্মার মিলন তাদের উভয়ের মধ্যে একটা শক্তিবোধের সৃষ্টি করে। তাদের মিলনের পথে বাধা তাদের মিলনের আকর্ষণকে অধিকতর শক্তিশালী করে তোলে। আমার পিতা তার আরাধ্যকে লাভ করতে ব্যর্থ হয়ে বেদনায় ভেঙে পড়েন। আমার জননী এমন অবস্থায় বিদেশ ভ্রমণে গিয়ে তাকে ভুলে থাকার চেষ্টা করতে বলেন। আমার পিতা জননীর এই পরামর্শ গ্রহণ করলেও তার প্রেমিকাকে ভুলে থাকতে অক্ষম হন এবং অচিরে তিনি অধিকতর প্রেমের আবেগে তাড়িত হয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। পিতা প্রত্যাবর্তন করে তার প্রতি তার প্রেমাস্পদকে অনুগত দেখে তার প্রতি অধিকতর আকর্ষণ বোধ করেন এবং পরিণামে তারা পরস্পরের প্রতি জীবনভর আনুগত্যের শপথে গিয়ে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন।

আমার মায়ের অপর এক ভাইয়ের নাম ছিল গেব্রিয়েল বারনার্ড। তিনি আমার পিতার এক ভগ্নীর প্রেমে পড়েন এবং তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব করেন। আমার পিতা তার এ প্রস্তাবে সম্মতি দেন কেবল এই শর্তে যে, আমার পিতার ভগ্নীর এক ভাই আমার জননীর এক বোনকে বিয়ে করতে সম্মত হবেন। তাদের পরস্পরের প্রতি ভালবাসা পারিবারিক এই বন্ধনকে সহজ করে তোলে এবং এই দুটি বিয়ে একই দিনে সম্পাদিত হয়। এমনিভাবে আমার পিতৃব্য আমার মাসির স্বামীতে পরিণত হন এবং তাদের সন্তানরা আমার সঙ্গে দুটি সূত্রেই আত্মীয়তে পরিণত হন। বছর শেষে তাদের উভয়েরই সন্তান জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তারা আবার বিবাহ বিচ্ছেদে আলাদা হয়ে যান।

আমার পিতৃব্য বারনার্ড পেশায় ছিলেন একজন ইঞ্জিনিয়ার। তিনি সম্রাটের সরকারে চাকরি গ্রহণ করে হাঙ্গেরীতে রাজকুমার ইউজেনীর অধীনে নিযুক্ত হন। বেলগ্রেডের অবরোধের ক্ষেত্রে আমার পিতৃব্য একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। আমার পিতা আমার একটি অনুজের জন্মদান করে কনসট্যান্টিনোপল-এর উদ্দেশে যাত্রা করেন। সেখানে তিনি তুরস্কের সুলতানের অধীনে একজন ঘড়ি নির্মাতার চাকরিতে নিযুক্ত হন।

আমার পিতার অবর্তমানে আমার জননীর বুদ্ধি এবং সৌন্দর্য তার চারপাশে একাধিক অনুরাগীকে আকৃষ্ট করে তোলে। এদের মধ্যে জেনেভায় অবস্থানরত ফরাসি প্রেসিডেন্ট মশিয়ে দ্যা লা ক্লোজার আমার জননীকে লাভ করার জন্য অদম্য হয়ে ওঠেন। আমার জননীর জন্য এই ভদ্রলোকের প্রেমের গভীরতাকে আমার স্বীকার করতে হয়। কারণ এর ত্রিশ বছর পরেও তিনি যখন আমার জননীর কথা স্মরণ করেছেন তখন তার জন্য যথার্থ আবেগে তাকে আমি আপুত হতে দেখেছি। এসব প্রেমিককুলকে প্রতিরোধে আমার জননীর পবিত্র বুদ্ধিমত্তা এবং সাহস আমি আজও স্মরণ না করে পারিনে। এই ঘটনা আমার পিতার জন্য তার ভালবাসার গভীরতাকে প্রমাণিত করে। আমার জননী অবশেষে এই সঙ্কটের কারণে আমার পিতাকে অবিলম্বে জেনেভায় প্রত্যাবর্তন করার তাগিদ দেন। আমার পিতা তার সেই পরামর্শে বিদেশে তার সব কিছুকে পরিত্যাগ করে আমার জননীর কাছে প্রত্যাবর্তন করেন। তার এই প্রত্যাবর্তনেই আমার জন্ম ঘটে। আমি বলি পিতার প্রত্যাবর্তনে দুঃখভরা এক সন্তানের জন্ম। পিতার প্রত্যাবর্তনের দশ মাস অন্তে একটি দুর্বল শিশুর জন্ম এবং তার জননীর মৃত্যু ঘটে। আর আমি তাই বলি : আমার জীবনের শত দুর্ভাগ্যের প্রথম দুর্ভাগ্যটি ছিল আমার জন্ম।

আমার বাবা কেমন করে তার এই শোককে ধারণ করেছিলেন, তা আমি জানিনে। এ কথা তিনি কোনওদিন আমাকে বলেননি। কিন্তু আমি জানি, এ শোক তার জন্য দুঃসহ হয়েছিল। তিনি আমার মধ্যে যেন তার স্ত্রীকে খুঁজে পেয়েছিলেন। কিন্তু একথাও তিনি ভুলেননি যে, আমিই তার স্ত্রীকে হত্যা করেছি। যখনি তিনি আমাকে কোলে তুলে নিয়েছেন, আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছেন তখনি আমি বুঝতে পেরেছি। আমাকে তার আদরের মধ্যে তার মনের একটা তিক্ত স্মৃতিকে তিনি ধারণ করে চলেছেন। কিন্তু তার এমন অনুভূতির সঙ্গে আমার প্রতি তার আদর আরও গভীরভাবে আমি বোধ করেছি। আমার বাবা হঠাৎ বলতেন : জ্যাকি, এসো আমরা তোমার মায়ের কথা বলি। আমি জবাবে বলতাম, বাবা, তাহলে তুমি যে কেঁদে ফেলবে, আমার যে কান্না পাবে। এবং সত্যিই এই কথায় আমাদের দুজনের চোখেই জল জমে উঠত। বাবা তখন বলতেন : জ্যাকি, তুই তোর মাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দে। পারিসনে? তোর মার শূন্যতাকে তুই ভরে দে। তোকে যদি আমি কেবল আমার পুত্র বলে, ভাবতাম, তাহলে কি তোকে আমি এমন করে আদর করতে পারতাম!

আমার মাকে হারাবার চল্লিশ বছর পরে আমার বাবা যখন মারা গেলেন তখন তার মাথা তার দ্বিতীয় স্ত্রীর কোলেই ছিল। তবু একথা সত্য, তার সেই মৃত্যুর মুহূর্তেও আমার মায়ের নামটিই তার ওষ্ঠাধরে মৃদু শব্দে উচ্চারিত হচ্ছিল। তার বুকের গভীরে ছিল আমার মায়ের ছবি।

আমার অস্তিত্বের এমনি ছিল শেকড়। আমার জনক জননী। ঈশ্বর তাদের যত সম্পদে ভূষিত করেছিলেন তার মধ্য থেকে তারা আমাকে দান করে গিয়েছেন সে হচ্ছে একটি মমতাভরা মন। এই মমতার মধ্যে তারা তাদের সুখ এবং আনন্দ লাভ করেছেন। আর আমি লাভ করেছি আমার সকল দুর্ভাগ্যকে।

জন্মকালে আমার বেঁচে থাকারই আশা ছিল না। মৃতপ্রায় এক শিশু জন্মেছিল আমার হতভাগ্য জননীর কোলে। জন্মতেই আমি লাভ করেছি অসন্তোষের বীজ। আমার অস্তিত্বের এই বীজই সময়ের স্রোতকে শক্তিমান করে তুলেছে। আমায় যদিও বা সে মুহূর্তের জন্য স্বস্তি দিয়েছে তো পরের মুহূর্তেই সে আমাকে তীব্রতরভাবে দগ্ধ করেছে। আমার বাবার এক মমতাময়ী বোন আমাকে এমন যত্নে লালন করল যে তার সেই যত্নের কারণেই আমার জীবন রক্ষা পেল। আমি বেঁচে রইলাম।

আর আজ যখন আমি এই স্মৃতির কথা লিখছি তখনও তিনি বেঁচে আছেন। এখন তার বয়স আশিতে পৌঁছেছে। তার এখনকার যত্নের পাত্র হচ্ছে তার অসুস্থ স্বামী, যার বয়স তার চেয়ে বেশ কম এবং যে অত্যধিক মদ্যপানে নিজেকে প্রায় নিঃশেষ করে এনেছে।

আমার ইচ্ছা হচ্ছে আমার স্নেহময়ী মাতৃসম পিসীমাকে সম্বোধন করে বলি : পিসী, একদিন যদিও আমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তোমাকে অভিযুক্ত করেছি, আজ আমি আমার সমস্ত অভিযোগ থেকে তোমাকে মার্জনা করে দিচ্ছি, আমার সকল কৃতজ্ঞতাসহ। আমার কেবল দুঃখ এবং অনুতাপ এই যে, আমার জীবনের সূচনায় যে মমতায় আমাকে সিক্ত করে দিয়েছিলে, তোমার জীবনের সায়াহ্নে তার কোনও প্রতিদান দিয়েই আমি তোমার ঋণ থেকে মুক্ত হতে পারছিনে। আমার শৈশবে যে সেবিকা আমাকে আন্তরিকভাবে সেবা করেছিলেন তিনি আজো সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচে আছেন। তার নাম জ্যাকুলিন। আমার আজ এই আনন্দ, যিনি একদিন একটি শিশুর চোখের পাতা উন্মুক্ত করেছিলেন তিনি তার সেই হাত দিয়ে আমার মৃত্যুতে আমার চোখের পল্লবকে তিনি মুদিত করে দিতে সক্ষম হবেন।

নিশ্চয়ই চিন্তার আগে আমার অনুভূতি এসেছিল। আমি বলতে পারি এক্ষেত্রে অপর কারোর চাইতে আমার ক্ষমতা অধিক ছিল।

পাঁচ-ছ’বছরের আগে আমার ধারণা হয়নি, কী আমি করছি বা না করছি। আমি জানিনে কেমন করে আমি পড়তে শিখলাম। একেবারে গোড়ার দিকে আমার মনের ওপর আমার পাঠের স্মৃতি কিছুটা ভেসে ওঠে। তখন থেকেই আমার চেতনার সঞ্চার।

আমার মা তার প্রেমময় জীবনের কিছু কথা রেখে গিয়েছিলেন। এবার পিতা-পুত্র আমরা দুজন নিত্য রাতে খাবার শেষে তার সেই স্মৃতি পড়তে শুরু করলাম। প্রথমটাতে এটার শুরু হয়েছিল এভাবে, যেন বাবা আমাকে পাঠ শেখাচ্ছেন। তার জন্য আমার কাছে মজার মজার গল্প বলতেন। কিন্তু ক্রমান্বয়ে আমরা দুজনেই ব্যাপারটাতে এত মজা পেতে লাগলাম যে, সারারাতই আমাদের কেটে যেত। আমরা কেউ থামতে পারতাম না। একবার আমি পড়তাম। তারপরে বাবা। তারপরে আবার আমি। মায়ের পুরো লেখাটা শেষ হওয়ার আগে আমরা থামতেই পারতাম না। অনেক সময় রাত শেষ হয়ে যেত। ভোরের পাখি ডেকে উঠত। বাবা যেন লজ্জা পেতেন, ‘দেখছিস ভোর হয়ে গেছে, আয় এবার আমরা থামি।’ আসলে তার চাইতে আমিই বেশি ছেলে মানুষ!

মোট কথা এভাবে আমি কেবল যে পড়তে শিখলাম, তাই নয়। আমার পাঠে কোনও আড়ষ্টতা থাকত না। তার চেয়েও অধিক। ঐ বয়সে আমার যা বোঝার কথা নয়- তাও যেন আমি বুঝতে পারছিলাম। অদ্ভুত এক আবেগ।

যা পড়ছি তার ভেতরটা যে আমি বুঝতাম, তা হয়তো নয়। তথাপি বাস্তব জীবনের অনুভূতিটা যেন আমাকে আপুত করত। চিন্তা দিয়ে হয়তো আমি কিছুই বুঝতাম না। কিন্তু প্রত্যেকটি ঘটনার অনুভূতি আমাকে আচ্ছন্ন করত। একটার পর একটা অনুভূতি যে আমার যুক্তির বোধকে আলোকিত করত এমন নয়। যুক্তির ক্ষমতা তখনও আমার মধ্যে আসেনি। কিন্তু এগুলো আমার মনের ওপর একটা ছাপ ফেলতে লাগল। এর মধ্য দিয়ে জীবনের যেন এক আবেগপূর্ণ চিত্র জন্ম নিতে লাগল। এই আবেগ থেকে জীবনে আর আমার মুক্তি ঘটেনি।

.

[১৭১৯-১৭২৩]

বলতে পারি এমন আবেগের যেন শেষ হলো ১৭১৯-এর গরমকালে। এতদিনে আমার মায়ের বই-এর রাজ্য শেষ হয়ে গিয়েছিল। এবার শুরু করলাম আমরা মায়ের বাবার কাছ থেকে পাওয়া বই-এর জগত এবং তার দিয়ে যাওয়া বই-এর রাজ্যে নানা গুরুত্বপূর্ণ বই-এর কোনও অভাব ছিল না। অবশ্য এটি অসম্ভব ছিল না। কারণ বই-এর এই সম্ভারটি সংগ্রহ করেছিলেন ঊর্ধ্বতন এক রাজকর্মচারী। তিনি কেবল একজন কর্মচারী ছিলেন না। তিনি যথার্থই একজন শিক্ষিত মানুষ ছিলেন। তার বুদ্ধি এবং অনুধাবন ক্ষমতা ছিল যথার্থই উঁচু দরের।

তার এই সংগ্রহের মধ্যে ছিল ‘গির্জা এবং সাম্রাজ্যের ইতিহাস’। এর রচনাকারী ছিলেন লা সুর। ছিল বুসেতের রচিত সমগ্ৰ সভ্যতার এক ইতিহাস। ছিল প্লুতার্কের রচিত ‘বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের জীবনী।’ ছিল ননী রচিত ভেনিসের ইতিহাস। ওভিডের মেটামরফোসিস। লা ব্রুয়ারের বিশ্ব। তারই ‘মৃতের সংলাপ’ নামে এক গ্রন্থ এবং মলিয়েরের কয়েকটি খণ্ড। এসব গ্রন্থ বাবার ঘরে এনে স্তূপ করা হলো। আর বাবা যখন কাজ করতেন আমি তখন তাকে শুনিয়ে এই বই-এর রাজ্য থেকে এ বই, সে বই পাঠ করে শোনাতাম। এর মধ্য দিয়েই আমার মধ্যে যেন আমার বয়সের অধিক একটা বোধের জন্ম হতে লাগল। এর মধ্যে প্লুতার্কের প্রতি আমার একটা বিশেষ আকর্ষণ সৃষ্টি হলো। প্রতার্ক থেকে পাঠের পরে পাঠ আমাকে যেন আমার এতদিনের স্বপ্নের জগৎ থেকে বাস্তব জগতে বার করে আনল। ফলে এবার আমার জীবনের নায়ক হয়ে উঠতে লাগল এগোসিলাস, ব্রুটাস, অ্যারিসটাইডিস, অরনডেটিস আর আরটামেলিস এবং জুবা। এরাই হয়ে উঠল আমার আরাধ্য। এ এক আশ্চর্যকাহিনী। আমার পিতার সঙ্গে এই সব গ্রন্থের পাঠের ওপর সংঘটিত সংলাপ আমার মধ্যে একটা গণতান্ত্রিক বোধের সৃষ্টি করে তুলল। যেন আমার মধ্যে একটা দুরারোধ্য ব্যক্তিত্বের জন্ম হলো যার কাছে দাস এবং দাসত্বের চিন্তা একেবারে অচিন্তনীয় হয়ে উঠল। আর তাই দাসতুবোধক কোনও ভাবনা আমার জীবনে আমি কখনও কল্পনা করতে পারিনি। আমি যেন প্রত্যক্ষ করলাম নিজের পদচারণাকে রোম আর এথেন্সের মহামতিদের মধ্যে। এমন বোধে আমার কোনও অসুবিধা হয়নি। কারণ আমি ছিলাম একটা স্বাধীন প্রজাতন্ত্রে জন্মলাভ করা মানুষ। আমার বাবা ছিলেন এমন এক দেশপ্রেমিক যার দেশপ্রেম ছিল তার গর্বের বিষয়। আমার পিতা আমার এক আরাধ্য পুরুষ হয়ে দাঁড়ালেন। আমি কল্পনা করলাম যেন আমি সেকালের একজন গ্রীক কিংবা রোমান। অতীত ইতিহাসের কুশীলবদের জীবনী পাঠ করতে করতে আমার নিজের অস্তিত্বকে বিস্মৃত হয়ে সেই বিস্ময়কর চরিত্রসমূহের মধ্যে আমি লীন হয়ে যেতাম। এই সব চরিত্র পাঠ করতে করতে আমার পাঠের ক্ষমতার বৃদ্ধিতে আমি নিজেই বিস্মিত হতে লাগলাম। অনেকের জীবন কাহিনীতে মাঝে মাঝে আমার চোখের পাতা ভিজে উঠত। আর কণ্ঠের ‘ আওয়াজ একটা যেন দৃঢ়তা পেত। একদিন স্কাভোলার ইতিহাস পাঠ করতে করতে আমি যখন তার জীবন নিয়ে অভিনয় শুরু করলাম তখন সেখানে যারা উপস্থিত ছিলেন তারা যেন আতঙ্কিত হয়ে উঠলেন। আমি তখন আমার কল্পিত চরিত্রের দৃঢ় হস্তের ধ্বংস ক্রিয়া প্রদর্শনে ব্যস্ত ছিলাম।

আমার একটা ভাই ছিল। আমার চাইতে সাতবছরের বড়। ও আমার বাবার কাজে সাহায্য করত। তার কাছ থেকে কাজের শিক্ষা নিত। কিন্তু আমার ওপর পিতার স্নেহের আধিক্য আমার ভাইয়ের প্রতি কিছুটা অবহেলা যে সৃষ্টি করত না তা নয়। বাবার এই দিকটি আমার পছন্দ হতো না। তার প্রতি অবহেলা তার শিক্ষার দিকটাকে ক্ষগ্রিস্ত করেছিল। ফলে বয়সের আগেই সে ভালর চাইতে মন্দ হয়ে উঠল। তার তত্ত্বাবধানকারী শিক্ষককে পরিবর্তন করা হলো। কিন্তু তাতে কোনও লাভ হলো না। বাড়ি থেকে যেমন সে পালিয়েছিল, এই শিক্ষকের কাছ থেকেও সে পালাতে লাগল। ফলে ওর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎই ঘটত না। ও যেন আমার কাছে অপরিচিতই রয়ে গেল। কিন্তু ওর জন্য আমার ভালবাসার শেষ ছিল না। ও নিজে ভবঘুরে হলেও, আমার জন্যও ওর ভালবাসার অন্ত ছিল না।

আমার মনে আছে, একদিন বাবা যখন রেগেমেগে ওকে বেদম বকুনি দিচ্ছিল আমি তখন ওদের দুজনের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার ভাইকে আমি জড়িয়ে ধরেছিলাম। ফলে বাবার দেয়া মারগুলি ওর গায়ে না লেগে আমার গায়ে পড়ছিল। তবু আমি ওকে ছাড়ছিলাম না। ফলে শেষ পর্যন্ত বাবা ওকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো। আমার নিজের কান্না ও চিৎকারে বাবা যেন ভয় পাচ্ছিল। কিন্তু তারপরে আমার সেই ভাইটি কোথায় যে চলে গেল, আর আমরা খুঁজে পেলাম না। কিছুদিন পরে আমরা শুনেছিলাম যে সে জার্মানিতে চলে গেছে। কিন্তু ওর কাছ থেকে কোনওদিন আমরা একটি পত্রও পাইনি। আর তাই আমি বলতে পারি : আমার বাবার একমাত্র পুত্র আমি।

আমার ভাইয়ের অনাদরের স্মৃতি আমার বুকে বাজে। কিন্তু আমার কোনও অনাদর ঘটেনি। বরং আমি বলি, আমার কৈশোরে একজন রাজপুত্রের অধিক যত্ন লাভ করেছিলাম। চারপাশের সকলেই আমাকে ভালবাসত। আমাকে কেউ খারাপ বলত না।

আমার পিতার কাছ থেকে চলে আসার আগে রাস্তায় সাধারণ ছেলেদের সঙ্গে ছুটে বেড়ানো আমার জন্য একেবারে নিষিদ্ধ ছিল। আমার ওপরে অন্য কোনও ছেলের অনাচার কখনও ঘটেনি। আসলে যাদের আমরা দুষ্টস্বভাবের ছেলে বলি তারা স্বভাবগতভাবে যে দুষ্ট এমন নয়। তাদের চরিত্র যদি নষ্ট হয়ে গিয়ে থাকে সে তাদের স্বভাবের জন্য নয়, সে তাদের শিক্ষার জন্য।

অবশ্য আমারও যে বয়সের দোষ ছিল না, তা নয়। আমি যে কিছুটা বাকওয়াজ ছিলাম একথা সত্য। খাবার বেলায় লোভী আর মিথ্যায় ওস্তাদ। অন্যের গাছের ফল বা কোনও খাদ্য যে চুরি করিনি, তা নয়। কিন্তু কারোর কোনও ক্ষতি করেছি এমন আমার মনে পড়ে না। বোবা পশুকে আমি কখনও আঘাত করিনি।

তবে আমাদের পাশের বাড়ির এক মেমসাহেবের একটা সসপ্যানের মধ্যে যে আমি পেশাব করে দিয়েছিলাম, এ কথা সত্য। মাদাম ক্লটের সসপ্যান। সে তখন গির্জায় গিয়েছিল। সেটা আমার জন্য একটা সুযোগ ছিল। ঘটনাটা এখনও স্মৃতিতে এলে আমি না হেসে পারিনে। তবে ভদ্রমহিলার আর কোনও দোষ না থাকলেও সে যে একজন ভয়ানক রকমের ছিচকাঁদুনে ছিল এতে কোনও সন্দেহ নেই। আমার কিশোরকালের গুণাবলীর এমন তালিকাটিতে কোনও মিথ্যা নাই।

আসলে খারাপ হওয়ার আমার উপায় ছিল না। আমার চারদিকে আমি উত্তম ছাড়া অধম লোকের সাক্ষাৎ পাইনি। আমি বলি তারা সবাই ছিল পৃথিবীর মহত্তম মানুষ। আমার পিতা, আমার মাসি, পিসি বা মাসি, আমার দাই-মা, আমার আত্মীয়-স্বজন, আমার বন্ধু-বান্ধব, আমার পাড়া-প্রতিবেশী এবং আমার চারপাশের সবাই। না, তারা যে আমার হুকুমদার ছিল তা নয়। কিন্তু তারা সকলে আমাকে ভালবাসত। আমিও তাদের ভালবাসতাম। কোনও আঘাতের জন্য কেউ আমাকে উত্তেজিত করেছে, এমন কথা আমি বলতে পারিনে।

এই স্মৃতির কথা যখন আমি বলছি, তখন আমি বৃদ্ধ। আজ আমার উদ্বেগ-অস্থিরতার শেষ নাই। কিন্তু সেই আত্মীয়-স্বজনের কণ্ঠ যখন আমার স্মৃতিতে ভেসে ওঠে তখন আজকের এই বৃদ্ধ আবেগাপ্লুত কান্নায় ভেঙে পড়ে। অপরের কাছে অবিশ্বাস্য হলেও এ সত্য।

সেই সেদিনের আমার প্রিয় কাকীমার গীত একটি গানের দু’একটি শব্দ বা সুর যে আমার স্মৃতিতে আটকে আছে তার এই আকর্ষণ আমার কাছেও অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়।

মাদাম লামবার সিয়েরের কথা বললে বলতে হয়, তিনি আমাদের সবাইকে যেমন স্নেহ করতেন তেমনি আমাদের ওপর তার কর্তৃত্বও কম ছিল না। সে কর্তৃত্ব প্রয়োজনে দৈহিক নির্যাতনেও প্রকাশ পেত। তার হুমকিধামকির পরিধি ছাড়িয়ে ক্রমান্বয়ে বাস্তবে রূপ নিতে লাগল। কিন্তু আমার ওপর তার নির্যাতনের একটা প্রতিক্রিয়া এই হলো যে, তার অত্যাচার আমার কাছে উপাদেয় বলে মনে হতে লাগল। প্রত্যেকটি মারের পরে আমি তার পরের মারটির প্রত্যাশায় অপেক্ষা করে থাকতাম। যে কাজ করলে মার খেতে হবে, আমি যেন সেই কাজ করতে অধিক আকৃষ্ট বোধ করতাম। তার কারণ তার হাতের মারের মধ্যে আমার দেহের মধ্যে যেন এক কৈশোরসুলভ যৌন অনুভূতির সৃষ্টি হতো। ফলে তার হাতে মার খাওয়ার চিন্তায় আমার মনে ভয়ের চাইতে মার খাওয়ার ইচ্ছা বৃদ্ধি পেত। যে কাজে মার খাওয়ার আশঙ্কা সে কাজ থেকে নিবৃত্ত হওয়ার বদলে সেই কাজ করার আকর্ষণ সৃষ্টি হতো।

আমার জীবনের প্রবেশকালে এগুলোই ছিল আমার মনের আবেগ। এগুলোর প্রকাশই আমার চরিত্রের মধ্যে যেমন গর্বোদ্ধত ভাব, তেমনি আমার একটা কোমলতাকেও সৃষ্টি করেছিল। আমার চরিত্রে তাই যেমন তৈরি হয়েছিল একটা নারীসুলভ কমনীয়তা, তেমনি আবার সৃষ্টি হয়েছিল একটা দুর্বিনীত ঔদ্ধত্যও। ফলে এই দুই বিপরীত আবেগের মধ্যে আমি সারাজীবন দোল খেয়েছি। কখনো কাদার মতো নরম, আবার সাহসের পরাকাষ্ঠা। তাই আমার চরিত্রে যেমন সঙ্গতিহীনতারও প্রাবল্য আছে তেমনি আছে সংযমের, আবার আনন্দভোগের আকাক্ষা। আবার বিচক্ষণতার প্রকাশও যে ঘটত না তাও নয়।

আমাদের পরিবারের ছোটদের জন্য এই মাদামসেল লামবারসিয়েরের মায়ের ভালবাসা ও স্নেহ যেমন ছিল, তেমনি প্রয়োজনে তিনি আমাদের দণ্ড দিতেও কসুর করতেন না। কোনও কোনও সময়ে হয়তো তিনি ধমক দিয়েই ক্ষান্ত হতেন। কিন্তু গোড়ার দিকে তার ধমক তেমন মিষ্ট ছিল না। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটার একটা মজার দিক ছিল। আমি যত মাদামের হাতে মার খেতাম তত তার হাতের মারের জন্য আমার লোভ যেন বৃদ্ধি পেত। তিনি আমাকে যত মারতেন আমি যেন তাকে ততো বেশি ভালবাসতে লাগলাম। যে কাজ করলে তার হাতের মার খেতে হবে না তা না করার চাইতে, তা পুনরায় করার প্রতি আমার আকর্ষণ বাড়তে লাগল। আসলে এর পেছনে যেন একটা যৌনতা বোধের ব্যাপার ছিল। কারণ বাড়ির অপর কেউ আমাকে মারলে এমন আনন্দ পেতাম না, যে আনন্দ মাদাম আমাকে মারলে পেতাম। আমার ওপর তার নির্যাতনকে আমি মনে করতাম ভালবাসা। ফলে, মাদাম এতদিন যাকে অপরাধ মনে করতেন, আমি বেপরোয়া হয়ে সে অপরাধগুলোই করতে লাগলাম। কয়েকদিন পরে দেখলাম, মাদাম যেন ব্যাপারটা কিছুটা টের পেয়েছেন। তিনি বুঝতে পারছেন, তার মারে কোনও ফল হচ্ছে না। উল্টো তার হাতের ব্যথাই বাড়ছে।

এতদিন আমি ছোটদের সাথে রাতের বেলাতেও মাদামের ঘরে ঘুমাতাম। একবার তার বিছানাতেও শুয়েছিলাম।

কিন্তু এর দু’দিন পরে হুকুম হলো, তোরা আর এক ঘরে শুবি, আমার ঘরে নয়। এই হুকুমের পর থেকে আমার প্রতি মাদামের ব্যবহারের আর একটা দিকও আমার নজরে এল। এবার তিনি আমাকে বালকের বদলে ‘বয়স্ক’ পুরুষ বলেই যেন বোধ করতে লাগলেন। ব্যাপারটা আমার কাছে মন্দ বোধ হলো না। এটা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, তবু সত্য যে, আমার বয়স তখন আট আর মাদামের বয়স চব্বিশ। আর এই অদ্ভুত সম্পর্ক আমার নিজের রুচি, আমার যৌনবোধ সবকিছুর ওপরই আমার সারা জীবনের জন্য যেন একটা পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। তবে এটা ঠিক যে আমার অনুভূতি একবার জাগ্রত হলেও আমার কিশোর বয়সের অধিক কোনও আচরণ আমি মাদাম লামবার সিয়েবের সঙ্গে সম্পন্ন করার চেষ্টা করিনি। কিন্তু একথাও ঠিক যে সেই সময় থেকে বহুদিন পর্যন্ত কোনও তরুণীর দৃষ্টিতে আমার দেহ বেশ তপ্ত হয়ে উঠত। এর একটা জ্বালাও আমি আমার শরীরের ভেতর বোধ করতাম। অনেকদিন যাবৎই এই ব্যাপারটা আমার মধ্যে ঘটছিল। তখন থেকে যে কোনও তরুণীই আমাকে আকৃষ্ট করত। তারা দৈহিকভাবে আমার নিকটে না থাকলেও কল্পনায় তাকে নিয়ে আমার ইচ্ছামতো ব্যবহার করতে আমার বাঁধত না। যাদের দেখতাম তাদের প্রত্যেককেই আমি একজন মাদাম লামবারসিয়ার বলে কল্পনা করতাম।

এরপর আমার বয়স বৃদ্ধি পেতে লাগল। আমি বয়ঃপ্রাপ্ত হলাম। তবু আমার বাল্য ব্যবহারে কোনও পরিবর্তন ঘটল না। এ এক ধরনের বিকারে পরিণত হলো, তবে আমি দৈহিকভাবে কোনও অনৈতিক আচরণে লিপ্ত হয়েছি এমন কিছু আমি মনে করতে পারছিনে। বাইরে থেকে দেখলে আমার আচরণে কোনও অভদ্রতা প্রকাশ পেত না। আমার তিন মাসি-পিসি তাদের আচার আচরণ দস্তুর মতো আদর্শ স্বরূপ ছিলেন। সেকালে তাদের মতো আদর্শ প্রশংসার পাত্রী খুব দেখা যেত না। মেয়েদের ব্যাপারে আমার পিতার ব্যবহারও ছিল আদর্শ। মেয়েদের মধ্যে কাউকে ভালবাসলেও অপরদের সামনে তিনি এমন কোনও শব্দ উচ্চারণ করতেন না যে শব্দ তার দম্ভকে লজ্জার রঙে রঞ্জিত করে তুলত এবং আমাদের পরিবারে ছোটদের আচরণ যেভাবে ভদ্র এবং প্রশংসনীয় করার চেষ্টা করা হতো তেমনটা অন্য পরিবারে দেখা যেত না। এ ব্যাপারে মাদাম লামবারসিয়েরও খুবই সতর্ক ছিলেন। একবার এমনও ঘটেছিল যে বাড়ির একটি উত্তম ভৃত্যকে তিনি বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলেন। কেবল এই অপরাধে যে সে আমাদের সামনে একটা অসভ্য শব্দ উচ্চারণ করেছিল। আমি নিজে যৌবনে পা দেয়ার পূর্বে যৌনমিলন সম্পর্কে আমার কোনও ধারণাই তৈরি হয়নি। এই ব্যাপারটা আমার কাছে অদ্ভুত বলেই বোধ হতো। সাধারণ পতিতা আমার মনে সারা জীবনই একটা বিরাগবোধের সৃষ্টি করেছে। নষ্ট চরিত্র বা লোচ্চামি বলে যে আচরণ অভিহিত হয় তাকে সব সময়ে আমি ঘৃণ্য বলে মনে করছি। যাকে আমরা লাম্পট্য বলি তার ওপরও ঘৃণা ছাড়া অপর কোনও বোধ আমার মনে সৃষ্ট হয়নি। এই ঘৃণার সঙ্গে জড়িত হয়ে আছে আমার একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। একবার আমি একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময়ে দু’পাশের দেয়ালের মধ্যে কতগুলো গর্ত দেখতে পেয়েছিলাম। পাশের লোকজন এ গর্তগুলোকে পুরুষের যৌনক্রিয়ার গর্ত বলে অভিহিত করেছিল। তাতে আমার মনের ঘৃণা তীব্রতর হয়ে উঠেছিল। আর তাই এমন কর্মের প্রতি কখনও কোনওদিনই আকর্ষণ বোধ করিনি। এই সমস্ত কথা চিন্তা করলে আমার চোখের সামনে কুকুর-কুকুরীর যৌন সঙ্গমের দৃশ্য ভেসে উঠত। আর তাতে আমার ঘৃণাবোধই সৃষ্টি হতো, কোনও আকর্ষণ নয়।

যৌন উত্তেজনার যে অভিজ্ঞতা আমার কৈশোরেই ঘটেছিল তার একটা ফল এই হয়েছিল যে আমার শরীরে যৌন-উত্তেজনার উদ্রেকের কোনও আধিক্য ঘটেনি। আমার এই অভিজ্ঞতার কারণে আমার দেহে যৌনদাহ জাগ্রত হলেও আমি আমার কল্পনাকে একটা প্রশান্তিতে নিয়ে আসতে সক্ষম হতাম। এবং চরম কোনও দৈহিক অবস্থাতে যাওয়া থেকে আমি নিজেকে নিবৃত্ত করতে পারতাম।

আমার সেই বয়ঃসন্ধিতে যৌন-উত্তেজনার উদ্ভব যা ঘটেছিল তা আমাকে মারাত্মক কোনও লজ্জাকর পরিস্থিতিতে নিয়ে যেতে পারেনি। এর কারণ মাদাম লামবারসিয়েরের আচরণ। তিনি আমার সঙ্গে তার দৈহিক সম্পর্ককে কোনও উদ্দামতাতে কখনও নেন নি। তার ফলে আমার বয়ঃবৃদ্ধিতে আমি যখন পুরুষে পরিণত হলাম তখনো যা আমাকে দুঃখজনক ঘটনাতে নিয়ে যেতে পারত আমি তা থেকে রক্ষা পেয়েছিলাম। আমার কৈশোরের সেই অনুভূতি থেকে আমি কখনও মুক্ত হইনি। একদিকে আমার মধ্যে যৌন-অনুভূতির জন্য প্রবল উন্মাদনা এলেও যৌনক্ষুধা আমাকে অস্থির করেনি। মেয়েদের ব্যাপারে আমার মধ্যে একটা সঙ্কোচের ভাব থাকত। ফলে দেহের মিলনের চরম কোনও অবস্থার কথা যেমন আমি পুরুষ হিসেবে কল্পনা করতে পারতাম না তেমনি কোনও মেয়েও আমার মধ্যে তেমন কোনও বোধ বা কল্পনা জাগ্রত করতে পারত না। ফলে আমার জীবনে আর্তি থাকলেও, যাদেরকে সর্বাধিক ভালবেসেছি তাদের জন্য কামনা বোধ করলেও যাকে যৌন সংলাপ বলে তেমন কোনও প্রকাশ মেয়েদের সঙ্গে আমার আলাপে ঘটেনি। আবার যৌন চিন্তা প্রকাশে আমার স্বভাবসুলভ সংকোচ ছিল, ফলে যৌন সম্পর্ক বিষয়ে আমার চিন্তা কোনও মেয়ের প্রতি আর্তিকে ভদ্র আচরণের বাইরে আমাকে কখনও নিয়ে যেতে পারেনি। পরস্পরের দৈহিক সম্পর্ক এবং নৈকট্যের যে অনুভূতি আমার মধ্যে ছিল তা প্রকাশ করে বললে এই বলতে হয় যে, কোনও যৌনমিলনের চাইতে আমার প্রেমাস্পদের আদেশ, নির্দেশ বা আঘাতের মধ্যেই যেন সেই যৌন তৃপ্তি পেতাম– যে- তৃপ্তি আর দশজন দৈহিক সঙ্গমের মধ্যে পেয়ে থাকে। আমাকে মেয়েরা বলত সলজ্জ এক প্রেমিক। মেয়েদের কোনও আচরণে আমি উত্তপ্ত হতে থাকলেও তাতে তার প্রতি আমার সলজ্জতাই বৃদ্ধি পেত। এর ফলে এমন প্রেমে চরমতা যেমন সহজলভ্য হতো না, তেমনি পারস্পরিক এমন সম্পর্ক কোনও দুর্ঘটনারও সৃষ্ট করত না। এর ফলে খুব কম ক্ষেত্রেই আমি কোনও মেয়েকে দৈহিকভাবে পীড়ন করেছি। তথাপি এমন মিলনে কোনও যৌন আনন্দ থেকে আমি বঞ্চিত হয়েছি, এমনও আমি মনে করিনে। আমার এমন সম্পর্কেও একটা আনন্দ থাকত। কল্পনাতেই আমার কামনার পূর্তি ঘটত। ফলে আমি বলতে পারি মেয়েদের সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্কই নৈতিক অবনতির উৎস হয়নি। এর জন্য আমার সঙ্কোচ এবং সাহসের অভাবকেই আমি মূল বলে বিবেচনা করি। এক্ষেত্রে কিছু পরিমাণ সাহসের ব্যাপার থাকলে আমি নির্ঘাত মর্মান্তিক যৌন আচরণে নিক্ষিপ্ত হতে পারতাম।এ পর্যন্ত আমি যা প্রকাশ করেছি তাতে আমার এই আত্মাদঘাটনের গুহার সবচাইতে ঘৃণ্য পর্যায়কে অতিক্রম করেছি একথা আমি বলতে পারি। কোনও অপরাধের কথা বলার চাইতে, কারোর নিজের চরিত্রের লজ্জাকর এবং হাস্যকর ব্যাপারে আত্মোদঘাটন অনেক বেশি কঠিন ব্যাপার।

যা আমি বলেছি, তারপরে যা আমি বলব তাতে আমার কোনও আত্মবিশ্বাসের অভাব ঘটবে না। এর পরে আমার গোপন কিছু থাকবে না। তবু যা আমি প্রকাশ করেছি তাতেও আমার নিজের মন:কষ্ট যে কম হয়নি, তা এ ঘটনা থেকে বুঝা যায় যে, যা বলেছি তা আর আমার কোনও প্রিয়জনকে বলার উৎসাহ বোধ করিনি। যা আমি সাহস করে করিনি, তা আমার অন্তরঙ্গ অপর কোনও মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ নৈকট্যেও মুখ ফুটে পাওয়ার দাবি করিনি। আমার জীবনে, আমার বয়সী একটি মেয়ে ব্যতীত অপর কারোর সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটেনি। আর তখনও মিলনের প্রস্তাবটি আমি করিনি, প্রস্তাবটি করেছিল ওই মেয়েটি নিজেই।

আজ যখন এভাবে আমার অন্তরের গভীরে গিয়ে কথা বলছি তখন সেই কৈশোরের আমার আচরণে কিছু অসঙ্গতির কথা আমি স্মরণ না করে পারছিনে। অসঙ্গতি এখানে যে একটি ঘটনা যেখানে তার অসঙ্গতি সত্ত্বেও আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে ভাসছে এবং সেই দূরের স্মৃতিকে সূত্রবদ্ধ করে রেখেছে, অপর কোনও একই প্রকারের অসঙ্গতি এখনও আমার মনে ঘৃণা এবং লজ্জার উদ্রেক করছে। যেমন এটা আমি বুঝতে পারিনে একই প্রকারের দুটো ঘটনা আমার চরিত্রে দুই রকমের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল কেমন করে। প্রতিক্রিয়ার একদিকে উত্তেজনা আবার অপরদিকে একটা স্নিগ্ধবোধের সৃষ্টি প্রকট রকম দুটো ঘটনার মধ্য দিয়ে। একদিনের কথা বলি। রান্না ঘরের পাশের ঘরে বসে আমি আমার পড়া শিখছিলাম। একটি চাকর মাদাম লামবারসিয়েরের চুল আঁচড়াবার চিরুনিটা শুকাবার জন্য চুলার কাছে রেখেছিল। মাদাম যখন তার চিরুনি নেবার জন্য রান্নাঘরে এলেন তখন দেখলেন যে তার চিরুনির বেশ কটা কাঁটা গরমে একেবারে পুড়ে গেছে।

প্রশ্নটা দাঁড়াল, কার দোষে এমনটা ঘটল। এটা তো সত্য যে আমি ছাড়া আর কেউ এ সময়ে রান্না ঘরে ঢোকেনি। গিন্নী যখন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি বললাম, আমি চিরুনি ধরিনি। কিন্তু সাহেব আর গিন্নী দুজনেই আমাকে ধমকাতে লাগলেন। আমাকে তারা হুমকি দিলেন শাস্তি দেয়ার। আমি বেপরোয়াভাবে কেবল অস্বীকার করে চললাম। অথচ ঘটনার সাক্ষ্য-প্রমাণ সবই আমার বিরুদ্ধে যাচ্ছিল। সেদিন পর্যন্ত জীবনে আমি আর কখনও এত জোরে মিথ্যে কথা বলিনি। কর্তা-গিন্নীর কাছে ব্যাপারটা মারাত্মক হয়ে দাঁড়াল। আমার শয়তানি, আমার বেপরোয়াভাব দেখে মনিব আমার ওপর ক্রমান্বয়ে কঠিন হয়ে উঠলেন। কিন্তু এবার দেখলাম মাদাম লামবারসিয়ের নিজের হাতে দণ্ড দিলেন না। তিনি আমার এ কর্মের কথা আমার কাকা বারনার্ড-এর কাছে লিখে পাঠালেন। কাকা বারনার্ড এসে পড়লেন। তবে এবার দেখলাম আমি একা নই, আমার আর এক গরিব ফুফাতো বোনের বিরুদ্ধে আর একটা অপরাধের নালিশ হলো। আর স্থির হলো, আমাদের দুজনকেই দণ্ড দেয়া হবে। সে এক সাংঘাতিক ব্যাপার। অপরাধের মধ্যেই যদি তার প্রতিবিধানের চিন্তা করতেন এবং চিরদিনের জন্য আমার এই দণ্ডকে স্মরণীয় করে রাখতে চাইতেন তবে তাদের এমন ব্যবস্থার চাইতে আর উত্তম কিছু হতে পারত না। এবং যথার্থই বহুদিন এই ঘটনাটাকে আমি বিস্মৃত হতে পারিনি।

তাদের চেষ্টার কোনও বিরাম ঘটল না। তবু আমার কাছ থেকে কোনও স্বীকৃতি আদায় তারা করতে পারল না। বারংবার আমাকে তাদের কাছে হাজির করা হলো। আমাকে মেরে প্রায় লাশ করে ফেলল। তবু আমি একটুও নড়লাম না। ভাবটা আমার এমন দাঁড়াল যে আমি মরব তবু বিন্দুমাত্র নড়ব না। আর শেষ পর্যন্ত ওদের জবরদস্তি একটা ছোট ছেলের জেদের কাছে হার মানতে বাধ্য হলো। শেষ পর্যন্ত এমন নিষ্ঠুর পীড়ন থেকে দৈহিকভাবে বিধ্বস্ত হলেও মানসিকভাবে আমি বিজয়ী হয়ে বেরিয়ে এলাম।

ওই ঘটনার পরে প্রায় পঞ্চাশ বছর পার হয়েছে। এখন আর সেই অপরাধে কেউ আমাকে দণ্ড দেবে, এমন সম্ভাবনাও ছিল না। তাই আমি ঈশ্বরের কাছে আজও বলব, আমার কোনও অপরাধ ছিল না। জমিদার পত্নীর সেই চিরুনিকে আমি আদৌ ছুঁইনি। শুধু তাই নয়। রান্নাঘরের আগুনের কাছে আমি সেদিন যাইনি। চিরুনিটাকে ধরারও কোনও কল্পনা আমি সেদিন করিনি। তবু ঘটনাটা কেমন করে ঘটেছিল এটা আমাকে জিজ্ঞেস করে কোনও লাভ নেই। এই ঘটনার সঙ্গে আমার যথার্থই কোনও সম্পর্ক ছিল না। আমার নিজেরও প্রশ্ন, কেমন করে যে ঘটনাটা ঘটেছিল?

আজ কেবল মজা লাগছে এই কথাটা ভেবে যে সেদিন সেই ছেলেটা ছিল একটা পিচ্চি বৈ আর কিছু নয়। দিনাদিনের সব কাজেই ছেলেটা ছিল অনুগত। অথচ আবেগে যেন পিচ্চিটা ছিল ভর্তি আর গর্বে উদ্ধত। আমি কেবল বিস্ময়ের সঙ্গে চিন্তা করি সেই ছেলেটার কথা যে, যাদের সে এতদিন ভালবেসেছে, যাদের কোনও কথার সে অবাধ্য হয়নি সে তাদের কাছ থেকেই পেল অবর্ণনীয় এমন দণ্ড! এই আমার জীবনের প্রথম স্মরণীয় ঘটনা। সেই ঘটনার স্মৃতিতে আজ আর কোনও ভয় বা লজ্জা নয়। আমার মনে এতদিনকার লালিত চিন্তাভাবনাগুলো যেন ওলট-পালট হয়ে গেল। আমার কেবল বিস্ময় আর প্রশ্ন, সেদিনকার সেই বাচ্চার মনের এই অনুভূতিকে আমি আজ কী নামে অভিহিত করব; আমার সেদিনকার সেই চিন্তার জটকে আজও কোনওভাবে যেন শৃঙ্খলাবদ্ধ করে আনতে পারছিনে। কী ছিল আমার অপরাধ? কী আমি করতে পারতাম। যা আমি করিনি তাকে স্বীকার করব? এটা কেমন করে করি? কেমন করে করতাম। তাই আজো বুঝতে পারছিনে সেদিনকার সেই নির্মম আঘাতের ঘায়ে যখন আমি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হচ্ছিলাম তখন যা আমি করেছি, তার অন্য যা কিছু আমি করতে পারতাম, যা আমি বলেছি, তার থেকে ভিন্নতর আর কিছু আমি কী বলতে পারতাম।

আমার চেতনারও তখন এমন বৃদ্ধি ঘটেনি, আমি বুঝব যে আমার বিরুদ্ধের প্রমাণটা কত অকাট্য। আমার বিপরীতে কাউকে চিন্তা করার কোনও ক্ষমতাই ছিল না আমার। আমার নিজের অবস্থান থেকে আমি এতটুকু নড়লাম না। আমি গায়ে পিঠে নিদারুণ ব্যথা পাচ্ছিলাম এ কথা ঠিক। এই বেদনাবোধ ছাড়া অপর কোনও অনুভূতি আমার স্মরণে জাগছে না। কেবল, যে অপরাধ আমি করিনি তার জন্য পীড়নের এই ঘটনা ছাড়া আর কিছুই আমার স্মরণে নেই। শারীরিক বেদনা অবশ্যই ছিল ভয়ানক রকমের। তবু সেটাকে কোনও বিশেষ অনুভূতি বলে অপর কিছুকে আমি আখ্যায়িত করতে পারছিনে। যেন সেই পীড়নের মধ্যে আমার সকল বোধশক্তি লোপ পেয়ে গিয়েছিল। বোধের কথা বললে বলতে পারি আমার দেহ মনে যেন একটা অন্ধ ক্রোধ আর অসহায়তার বোধই ছিল। অপর কিছু নয়।

সে রাতে আমার সঙ্গে আমার পিসতুতো ভাই ছিল। বয়সে আমরা সমান ছিলাম। তাকেও অপরাধী ভাবা হয়েছিল। অথচ সেও কিছু করেনি। চিরুনি সে পোড়ায়নি। কিন্তু তার ওপর যে অত্যাচার হয়েছিল সেও আমারই মতো। আমার ভাইও মারের চোটে কান্নাকাটি করা ছাড়া আর কিছু করতে পারেনি। আর কোনও কথা বলতে পারেনি। ওর দশাও হয়েছিল আমার মতো। যে কাজ ও করেনি, সে কাজ ও করেছে এমন বলার কথা ও চিন্তা করতে পারেনি। এমন বললে আমাদের অপরাধের গুরুত্ব বাড়া বৈ কি কম হতো, আমাদের ওপর পীড়ন কি কম হতো? এ এক আশ্চর্য অবস্থা। না পারি বলতে, না পারি সইতে।

রাতে বিছানাতে আমরা দুজন শুতে গিয়ে দু’জনকে জড়িয়ে ধরে কেবল ফুঁপিয়ে কাঁদলাম। দম আমাদের বন্ধ হয়ে আসছিল! আমাদের মনে রাগের প্রকাশ ঘটছিল কেবল গালাগালিতে। তার প্রকাশও ছিল সীমাবদ্ধ। হারামজাদা খুনি, হারামি খুনি এমন শব্দ বারংবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলা ছাড়া আর কিছু আমরা বলতে পারছিলাম না।

এই কথাগুলো আজ যখন লিখছি তখনও আমার মনে হচ্ছে যেন আমার শরীর গরম হয়ে উঠছে, আমার ধমনীর রক্ত চলাচল প্রবল এবং দ্রুত হয়ে উঠছে। সেই মুহূর্তের আমার এই মানসিক অবস্থা আমি কোনওদিন বিস্মৃত হব– এ কথা আমি ভাবতে পারছিনে। আমি যদি লক্ষ বছরও বাঁচি তবু আমি সেদিনের কথা বিস্মৃত হতে পারব না। আমার জীবনের সেই প্রথম নির্যাতন এবং অন্যায়ের সেই ঘটনা আমার অন্তরাত্মার ওপর এমন এক গভীর দাগ কেটে দিয়েছিল যে নির্যাতনের এমন ঘটনা যদি আমি সংঘটিত হতে দেখি, সে ঘটনা আমার ওপর না হয়ে অপর কারোর উপরেও যদি হয় তাহলেও সে ঘটনা আমার মনের মধ্যে, আমার নিজের অবিচ্ছিন্ন সেই দিনের সেই ঘটনার সব আবেগকে আমার মধ্যে জাগরিত করে তুলবে। আর তাই কোনও অন্যায়ের দৃশ্যকে আমি অবিচলিতভাবে দেখতে পারিনে। আমার সঙ্গে এমন ঘটনার আদৌ যদি কোনও সম্পর্ক না থাকে তথাপি আমার মনের এই উত্তেজনা আমি নিরোধ করতে পারিনে। তাই কোনও স্বৈরাচারীর কোনও নির্যাতন কিংবা কোনও ধর্মযাজকের অপকাণ্ডের কথা যখন শুনি তখন মনে হয় যেন আমি ছুটে গিয়ে ওই পাষণ্ডের বুকে আমার হাতের ছুরিটা বসিয়ে দিই, তাতে যদি আমার শতবার মৃত্যু ঘটে তা ঘটুক। এমন অনেক সময়ে ঘটেছে যে কোনও একটা পশু, সে কুকুর, বেড়াল যাই হোক না কেন সে আর একটাকে কেবল ওর গায়ের জোরে লাফিয়ে পড়ে আক্রমণ করেছে তাহলে আমি তার গায়ের জোরের শেষ দেখার জন্য আক্রমণকারীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছি। অবশ্যই এটা আমার আবেগের প্রকাশ। আর এর উৎস অনুসন্ধান করলে নিষ্পাপ আমার ওপর সেই আদি অত্যাচারের কাছে যাওয়া ছাড়া কোনও উপায় থাকে না।

যে ঘটনার কথা আমি ওপরে বর্ণনা করলাম, অতীতের দিকে তাকিয়ে আমি বলব, আমার শৈশবের প্রশান্তি এই ঘটনার সঙ্গেই শেষ হয়ে যায়। সেদিন থেকে আমি পরিপূর্ণভাবে সুখের উপভোগ কাকে বলে তা আমি ভুলে গেছি। আজও যদি সেদিনের কথা আমার মনে পড়ে তখন যন্ত্রণা ছাড়া আর কোনও ভাল লাগার কথা আমি মনে করতে পারিনে। বসিতে আমরা আরো কয়েকমাস ছিলাম। সেখানে কেউ যে আমাদের জ্বালাতন করেছে তা নয়। তবু আপাতভাবে সেই শান্ত অবস্থাও আমার মনে শৈশবের শান্তি আর ফিরিয়ে আনতে পারেনি। নৈকট্য, আন্তরিকতা, বিশ্বাস যা একদিন আমার ছিল, তা আমার জীবন থেকে উধাও হয়ে গেল। যাদের একদিন আদর্শ মনে করেছি, দেবতুল্য ভেবেছি তাদের আর আমি তেমন করে ভাবতে পারলাম না। আমরা কিশোররা তখন থেকে কোনও অন্যায়ে প্রবৃত্ত হলে তাতে যত লজ্জা বা সঙ্কোচ বোধ করতাম তার অধিক ধরা পড়লে যে নির্মম নির্যাতন হতে পারে তার স্মৃতিই আমার অস্তিত্বকে ঘিরে থাকতে লাগল। তখন থেকে সৎ কার্য বা সততা কাকে বলে তা যেন আমি ভুলে গেলাম। এখন আর অবাধ্য হতে বা মিথ্যা বলতে বাজত না। অপরাধ করার চাইতে অপরাধকালে ধরা পড়ার ভয়টাই বড় হয়ে দাঁড়াল। ফলে ঐ বয়সের যা কিছু নষ্টামি আমাদের চরিত্রকে আবিষ্ট করে ফেলতে লাগল। আমাদের আনন্দের আকাশ যেন একটা অন্ধকার মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। এমনকি যে জন্মভূমির জন্য আমি একদিন দেশপ্রেম বোধ করতাম সে আবেগও আমার মন থেকে যেন অন্তর্হিত হয়ে গেল। আমার নিজের দেশকেই মনে হলো যে, জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন এক রাজ্য। আনন্দহীন এক রাষ্ট্র। একদিন যার দিকে তাকালে তার সৌন্দর্যে বিমোহিত বোধ করতাম যেন সে আজ বিশুষ্ক এক ভূমিতে পরিণত হয়ে গেল। একদিন যে বাগানের পরিচর্যায় আনন্দ পেতাম সে বাগান, তার ছোট্ট সুন্দর পুস্পচারা সব যেন পরিত্যক্ত বোধ হলো। বাগানের মাটিতে আচর কাটা বা কোথাও রোপিত বীজের উদ্ভিন্ন কাণ্ডের আভাসে আনন্দে চিৎকার করে ওঠা, সবই যেন আমরা বিস্মৃত হয়ে গেলাম। আমাদের জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে উঠতে লাগলাম : বাকিরাও যেন আমাদের প্রতি বিতৃষ্ণ হতে লাগল। মাদাম লামবারসিয়েরের কাছ থেকে আমাদের পিতৃব্য আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললেন। তার মনে হলো, এখানে যা হবার তা যথেষ্ট হয়েছে। আর দরকার নেই। এ বিচ্ছেদে তার মনে কোনও রাগ বিদ্বেষের সঞ্চার হলো না।

.

বসি থেকে চলে আসার পরে ত্রিশ বছর পার হয়েছে। কিন্তু তার জন্য মনে কোনও আফসোসের আভাস পাচ্ছিনে। যে ঘটনায় একদিন আনন্দ বোধ করেছি তারও কোনও স্মৃতিও মনের মধ্যে জাগছে না।

কিন্তু এখন একটা মজার ব্যাপারও বোধ করছি, যা এতদিন করিনি। আজ আমার বয়স হয়েছে। বলা চলে প্রায় বার্ধক্যের কাছে এসে পৌঁছেছি। আজ যেন আমার ঘটনার স্মৃতি বা আবেগ বিস্মৃত হলেও সেই এক কিশোরকালে এতদিনকার বিস্মৃত ঘটনা আবার স্মৃতির এ-কোণে ও-কোণে ভেসে উঠছে। তখন তাতে একটা আনন্দবোধেরও যেন সৃষ্টি হয়। আমার মনে হচ্ছে যে সে আনন্দের ভেলা আমার হাতের পাশ দিয়ে পিছনে যাচ্ছে আমি তাকে ধরতে হাত বাড়াচ্ছি। সে দিনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনাও এখন যেন আনন্দের আকর হয়ে ভেসে উঠছে। সেকালের ঘটনা, তারপরে কতদিন কেটে গেছে, আজ আবার মাথার মধ্যে ভেসে উঠছে তাতেই আমার আনন্দ। সেই সময়কার সকল মানুষ, তুচ্ছ ঘটনা, স্থান সময় সব যেন ম্যাজিকের মতো চোখের সামনে আবার এসে হাজির হচ্ছে। আমি যেন দেখতে পাচ্ছি মাদাম লামবারসিয়েরের ওই চাকর বা সেই চাকর, এই চাকরানি বা সেই চাকরানি আমার চারপাশে আবার ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই এখন যেন একটা হাঁস আমার পড়ার ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। একটা মাছির জ্বালায় আমি পড়তে পারছিনে। ঘরের কোন জিনিসটা কোনখানে তাও যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছে। মাদাম লামবারসিয়েরের পড়ার ঘরটা হাতের ডান পাশে। একটা ছবি আঁকা তামার প্লেট আছে। তার মধ্যে পোপদের চেহারা ভেসে উঠছে। একটা ব্যারোমিটার পড়ে আছে। একটা বড় পঞ্জিকাও দেখতে পাচ্ছি দেয়ালে ঝুলানো আছে। একটা আঙ্গুরের লতা জানালাটাকে ঢেকে ফেলেছে। আমি জানি আজকের কোনও পাঠক আমার এই টুকিটাকির বিবরণে মোটেই মোহিত হবে না। কিন্তু আমি যে আমার মনকে থামাতে পারছি না। কী যেন বাধ্য করছে আমার কৈশোরের সেই ছবিগুলিকে আবার দেখতে। আজ সেদিনের সেই স্মৃতি আমার মনকে শিহরিত করে তুলছে। কতো যে স্মৃতি। এর সবগুলো বলতে গেলে না সময়তে কুলাবে, না পাঠকরা তা গ্রাহ্য করবে। কিন্তু একটা ঘটনা আর একটু বিস্তারিতভাবে না বলে আমি থামতে পারছিনে। অন্তত পাঁচমিনিট আমাকে সময় দিন। …

ঠিক আছে, যা বলেছি, আর থাক।

মোট কথা আমার কৈশোরের সবচাইতে মূল্যবান সময়কে আমি নানা দুষ্টামি নষ্টামিতে নষ্ট করেছি।

এর পরে যার অধীনে আমাকে রাখা হলো সে এক কঠিন মানুষ। তার নাম মঁসিয়ে ডুকোমান। সে এক কৃতী মানুষ বটে। এক মাসের মধ্যে সে আমার কৈশোরের সমস্ত আনন্দ-আহ্লাদকে শেষ করে আমাকে দস্তুরমতো একটা খাঁটি চাকরে পরিণত করে ফেলল। আমি যা একটু ল্যাটিন শিখেছিলাম তাকে সে যখন তখন ঠ্যাঙ্গানির চোটে একেবারে ধুয়েমুছে শেষ করে দিল। রোম বা রোমান শব্দটাকেও আমি ভুলে গেলাম।

পৃথিবীতে বা ইতিহাসে রোমান বলে যে কিছু ছিল তাও আমি ভুলে গেলাম। তারপরে একবার যখন আমি আমার বাবার কাছে গেলাম তখন তিনি যেন আমার মধ্যে শৈশবের আদরের তার পুত্রটিকে অন্বেষণ করেও আর খুঁজে পেলেন না। মেয়েদের মহলে আমি আর সেকালের সেই রোমাঞ্চকর তরুণটি রইলাম না। আমি নিজেকে এমন একটা মান্যবর বলে ভাবতে লাগলাম যে ল্যামবারসিয়েরের যে পরিবারে আমি একদিন আশ্রয় পেয়েছিলাম তাদের প্রতি কোনও সৌজন্যবোধ থেকে তাদের সাথে একবার দেখাঁটি পর্যন্ত করতে গেলাম না। কোনওদিন আর তাদের সাথে আমার কোনও সাক্ষাৎই ঘটল না। ছোটকালের আমুদে একটি কিশোরের জায়গাতে এবার জন্ম হলো সমস্ত রুচিহীন একটা অপদার্থের। পেছনের কথা যেন আমি সব বিস্মৃত হয়ে গেলাম। অথচ কিশোরকালে আমার শিক্ষা-দীক্ষা তো কিছু কম হয়েছিল না। আমার ক্ষমতার এটাও একটা দৃষ্টান্ত বটে যে, একদিন যেমন ভালবাসার পাত্র ছিলাম এখন ঘৃণার বস্তু হয়ে দাঁড়ালাম। অর্থাৎ খারাপ হওয়ার ক্ষমতা আমার ছিল। ছিল নষ্ট হয়ে যাওয়ার ক্ষমতা। আর তাতে তেমন সময়ও লাগল না। বেশ দ্রুততার সাথেই আমার পতন ঘটতে লাগল।

আমার বাড়ির কর্তার অত্যাচার শেষ পর্যন্ত যে কাজকে আমি ভাল বাসতাম সেই কাজকে আমার কাছে অসহ্য করে তুলল। আমার নিজের চরিত্রে এমন সব পাপাচার ঢুকতে লাগল যেগুলোকে আমি নিজেই একদিন ঘৃণা করতাম। এখন আর মিথ্যাচারে আমার কিছু যায় আসে না এমন অবস্থা হয়ে দাঁড়াল। কাজের বদলে আলসেমি আর চৌর্যবৃত্তি আমার স্বভাবের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়াল। আমার চরিত্রের এই পরিবর্তনের স্মৃতিতে আমি আজ পিতৃস্নেহ, প্রিয়জনের ওপর নির্ভরতা আর ঘৃণ্য দাসত্বের মধ্যকার পার্থক্যের শিক্ষাকে আমার বোধের অঙ্গীভূত করে দিল। যে কিশোর এক সময় নম্র আর বিনীত ছিল, আজ সে দস্তুরমতো দুর্বিনীত হয়ে উঠল। যার চরিত্রে একদিন অবাধ্যতার চাইতে ঘৃণ্য আর কিছু ছিল না। কিন্তু একদিন যে দুর্লভ স্বাধীনতা আমি ভোগ করেছিলাম, সে স্বাধীনতার বোধ ক্রমান্বয়ে আমি হারিয়ে ফেলতে লাগলাম এবং পরিশেষে তার আর কোনও চিহ্ন আমার চরিত্রে অবশিষ্ট রইল না। আমার বাবার সঙ্গেও কোনও অশিষ্ট আচরণে আর আমার কোনও সঙ্কোচের বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট রইল না। মিস্টার ল্যামবার সিয়েরের সঙ্গেও উদ্ধত হয়ে উঠলাম। আর সেদিন থেকে আগের আমি আর আমি থাকলাম না। যে বাড়িতে একদিন আমি মুখ ফুটে কথা বলতে সাহস করতাম না। যা আমি পেতে পারি না তাকে আমি চাওয়ার সাহস করতাম না। সে বাড়িতে এখন আহারের সময় কোনও ভদ্রতাই আমি মানলাম না। কার খাওয়া হলো আর না হলে তার পরোয়া না করে খাওয়ার মাঝখানে টেবিল ছেড়ে উঠে পড়তাম। এই কথাগুলো স্মৃতিতে এলে কারোর বুঝতে অসুবিধে হবে না পতনের কোন্ গহ্বরের দিকে আমি উন্মাদ হয়ে ছুটছিলাম। একদিন যেখানে কাজের এবং বাধ্যতার শেকলে আমি অনুক্ষণ বাঁধা ছিলাম সেখানে এখন অপর যে কারোর স্বাধীনতার দৃশ্য আমার দাসত্বের বোঝাকে দুর্বহ করে তুলতে লাগল। আর এখন যে ঝামেলার কারণের আদি-অন্ত আমি জানি, তার বিন্দুমাত্র আমি আর ফাঁস করার ইচ্ছা পোষণ করলাম না। তখন থেকে আগে আমার মধ্যে যে আনন্দ-উচ্ছ্বাস ছিল তার উধাও ঘটল। আগে কোনও বিচ্যুতির ক্ষেত্রে আমার নম্র আচরণ যেখানে আমার জন্য অন্যের মনে মমতার সৃষ্টি করত এবং আমার আচরণকেও তারা ক্ষমা করে দিত, তার সবকিছুই আমার ভাগ্য থেকে উধাও হয়ে গেল। একটা ঘটনার কথা মনে হলে আমার আজও হাসি পায়। এক রাতে কোনও কিছু না খেয়েই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পরে ক্ষুধার জ্বালায় টিকতে না পেরে ঘুমন্ত বাড়িটার রান্নাঘরে যা কিছু অবশিষ্ট ছিল তার প্রত্যেকটাকে শুঁকে শুঁকে আমি তাদের স্বাদ আস্বাদন করতে লাগলাম। একটা রোস্টের গন্ধ আমাকে এত আকৃষ্ট করল যে সেটাকে একটু চেখে দেখার লোভ আমি কিছুতেই সামলাতে পারলাম না। আমার ছ্যাচরামির ঘটনা বাড়ির সকলকে এমনভাবে উল্লসিত করেছিল যে এরপর তারা আমাকে রাতের বেলা না খাইয়ে উপোস করে রাখতে মজা পেতে লাগল। বাড়ির কর্তাও ঘটনার কথা জানতে পারলে মজা পেতেন। কিন্তু আমি সাহস করে তাকে কোনও কথাই বলতে পারিনি।

এ থেকে ব্যাপারটা এই দাঁড়াল যে, এরপর থেকে কোনও ঘটনা গোপন করতে আমার আর বাধত না। মিথ্যা বলায় আমি বেপরোয়া হয়ে উঠলাম, কোনও কিছু চুরি করতে কোনও সংকোচ ঘটল না। এসবই এবার আমার দ্বিতীয় চরিত্র হয়ে উঠল। এর এক অর্থ এই যে, কোনও কিছু পেতে চাইলে তা না পাওয়ার ব্যাপার যে কোনও কিশোরকে ক্রমান্বয়ে খারাপ করে তোলে। দন্ড কাল দন্ডিতকে আদৌ কখনও উত্তম করে তোলে না। এ অভিজ্ঞতা থেকে আমি বুঝি আমাদের বাড়িঘরের চাকরবাকর দাসদাসী কেন এমন দন্ডের ফলে ক্রমান্বয়ে খারাপ হয়ে ওঠে। তাদের চোখের সামনে অন্যরা ইচ্ছামতো খাবে, কিন্তু তারা পাবে না–এ ঘটনা তাদের খারাপ হবার পথেই নেবে। এর বদলে ওরা যদি দেখে ওরা বাড়ির অপরের সমান, কারোর চাইতে দীন নয়, তাহলে আমি মনে করি ওরা ভাল ছাড়া আদৌ খারাপ হতে পারে না। এই অভিজ্ঞতা থেকে এই বোধ আমার লাভ বৈ লোকসান নয়। ভাল দ্বারাই তুমি মন্দকে ভাল করতে পার, মন্দ দ্বারা নয়।

আসলে ব্যাপারটা যথার্থই এমন যে, দন্ডদাতার উদ্দেশ্য যতোই মহৎ হোক না কেন, দন্ড একের পর এক দন্ডিতকে খারাপ থেকে অধিকতর খারাপের দিকেই নিয়ে যায়। আমার যিনি মনিব ছিলেন, প্রায় এক বছর পর্যন্ত, তার অজ্ঞাতে আমি কোনও খাবার পর্যন্ত চুরি করার কথা ভাবতেও পারিনি। আমার প্রথম চুরির ব্যাপারটা যতো-না আমার জন্য তার চাইতে অধিক আমার এক বন্ধুর জন্য ছিল। কিন্তু ওই যে শুরু হলো, ঘটনাটা যতই সামান্য হোক না কেন, ওতেই যেন বাঁধটা ভেঙে গেল।

ব্যাপারটাতে আমি যদি ধরা পড়তাম তাহলে যে পিটুনিটা আমি খেতাম তার কথা আমি কল্পনা করতে পারছিনে। আমার স্যাঙ্গাত তো আমাকে ধরিয়ে দিতই, আমি যতোই ওর কথা ফাঁস করতাম না কেন, ওই আমাকে অধিকতর ফাঁসিয়ে দিত। মনিব আমার কথা একটুও বিশ্বাস করত না।

কাজেই সত্যটা হচ্ছে, জনগণের ব্যাপারটা এমন যে, আসল অপরাধী যদি বলবান হয়, সে নিজেকে বাঁচিয়ে নেয়, আর দোষী হয় নির্দোষ।

যাই হোক অভিজ্ঞতাটি থেকে এটাই আমি শিখলাম যে, চুরি করাটাকে আমি যত সাংঘাতিক ভেবেছিলাম, আসলে সেটা ততো সাংঘাতিক কিছু নয়। ফলে বেশ কিছুদিনের মধ্যেই আমি পাক্কা চোর হয়ে উঠলাম। এবার কোনও কিছুকে লোভনীয় মনে হলে সেটি থেকে আমি কিছুতেই হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারতাম না। খাবার দাবার আমি যে খুব কম পেতাম, এমন নয়। কিন্তু আমার অসহ্য লাগত এই দেখে যে ব্যাটা আমার চাইতে বেশি খাচ্ছে। বেহুদা খাচ্ছে। খাওয়ার টেবিলে যখন লোভনীয় সব পদ আসতে আরম্ভ করত তখন টেবিল থেকে ছোটদের সরিয়ে দেয়া মারাত্মক হতো। এর ফলে ছোটরা লোভী হয়। এবং সেই লোভই তাকে চুরি করতে উদ্বুদ্ধ করে। কিছুদিনের মধ্যে আমি দুটোতেই বেশ পাকা হয়ে উঠলাম। এবং দেখলাম যে আমি বেশ ওস্তাদেই পরিণত হয়ে উঠেছি। মাঝে-মাঝে ধরা যে পড়তাম না এমন নয়। তাতেও আমার কলাকৌশলের অভিজ্ঞতার বৃদ্ধিই ঘটে চলল।

এসব কথা মনে হলে আজ আমার যেমন কাঁপুনি ধরে, তেমনি আবার হাসিও পায়। একবার হলো কী, ভঁড়ার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলাম কী সুন্দর কয়েকটা আপেল দড়িতে ঝোলানো। আমি সেগুলো আনার জন্য মাচার ওপর উঠে দেখলাম তখনও আমার হাত আপেলগুলো পর্যন্ত যাচ্ছে না। আমি একটা কাঠি যোগাড় করলাম। তাতেও হলো না। আর একটা আনলাম। জোড়া দিলাম। সেটা দিয়ে টান দিতে সেগুলো আমার হাতে এল না, নিচে পড়ে গেল। যদিও একটা ধরতে পারলাম সেটা এত বড় যে সেটাকে জানালার ফাঁক দিয়ে আর বার করতে পারছিলাম না। একটা ছুরি যোগাড় করলাম। তা দিয়ে আপেলটাকে টুকরো করার চেষ্টা করলাম। নিজে নিজের টাল সামলাতে পারছিলাম না। কয়েকটা টুকরা তৈরিও করেছিলাম। কিন্তু টুকরোগুলো তৈরি করতে-না-করতে, সেগুলো নিচে পড়ে যাচ্ছিল।

সহৃদয় পাঠক, এবার আমার মনের অবস্থাটা একটু বুঝুন।

তবু আমি দমলাম না। কিন্তু এর মধ্যে বেশ সময় পার হয়ে গেছিল। ধরা পড়ার আশঙ্কা করছিলাম। সেদিন আর এগুলাম না। পরের দিনের অপেক্ষায় রইলাম। বাড়ির কাজকর্ম অবাধে চালালাম, যেন কিছুই কোথাও ঘটেনি। পরের দিন আবার শুরু করলাম। ভাবলাম, কিছুই তো কেউ জানে না। কিছুই তো ঘটেনি। আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে ভাঁড়ারের মেঝেতে কয়েকটা চাক্ষুষ সাক্ষীকে আমি গতকালই রেখে এসেছি!

পরের দিন সুযোগ পেয়ে আবার আরম্ভ করলাম। একটা টুল যোগাড় করে তার ওপর উঠলাম। গতকালের কাঠিকে জোড়া লাগালাম, আর একটু লম্বা করলাম এবার লক্ষ্যবস্তুকে প্রায় ধরে ফেলেছিলাম। … কিন্তু আমার ভাগ্য খারাপ। জন্তুটা ঘুমিয়ে ছিল না। ভাঁড়ারের দুয়োর খুলে গেল। মনিবের মাথা দেখা গেল। সে তার দুই হাত এক করে আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল এবং তারপরে উচ্চারণ করল : সাহস বটে! তাই তো বলি, আমার হাতের কলম পড়ে যাওয়ার কারণটা কী? …

ফল কী দাঁড়াল? ফল দাঁড়াল, আমি প্রতিবোজ মার খেতে লাগলাম, আর প্রতিরোজ চুরি করতে লাগলাম। এ বন্দোবস্তটি মন্দ লাগল না। মনিব মারতে থাকল। আমি মারের বদলা নিতে লাগলাম চুরি করে। তাতে মারটা আমার মনের গায়ে তত লাগল না। কাজেই মারের দিকে আর পেছন ফিরে তাকাবার দরকার হলো না। সামনের দিকে তাকাতে লাগলাম। নিজের মনে বললাম : আমিও দেখে নেব। প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞা। আমি খারাপ গুন্ডা বলে যদি তুমি মারতে পার, তবে আমারও খারাপ আর গুন্ডা হওয়ার অধিকার আছে। আর তাই চুরি আর মার এক সঙ্গেই চলতে লাগল। একটার বিনিময়ে আর একটা; আমারটা আমি করলে, সেও তারটা করতে পারে। মনের এই ভাবটি আমার ভাল লাগল। আগের চাইতে মুক্ত মনে আমি চুরি করতে লাগলাম। একান্তে নিজেকেই জিজ্ঞেস করলাম। পরিণামে কী হবে?

: পরিণামে আর কী হবে? আমি মার খাব। মার খাওয়ার জন্যেই আমার জন্ম।

.

আমি বুঝি, আমার রাগ খুব বেশি। আর সেই রাগ একবার উঠলে আমার কোনও খেই থাকে না। তখন আর মান, সম্মান, ভয়, ভীতি, ভালমন্দ কিছুরই আর খেয়াল থাকে না। আমার মধ্যে একটা হিংসা আছে, অবাধ্যতা আর বেপরোয়া ভাব আছে। তখন আর কোনও সঙ্কোচ আমাকে পিছন ফিরতে দেয় না। কোনও ভয় আমাকে ভীত করতে পারে না। আমার মনের রাগের লক্ষ্যই হচ্ছে একমাত্র লক্ষ্য। তখন বিশ্বের আর কিছুকেই আমি পরোয়া করিনে। আবার এককথাও ঠিক যে, এমন ভাবটা আমার বেশিক্ষণ থাকে না। হয়ত মুহূর্ত মাত্র। পরের মুহূর্তে আমি আর সে আমি নই। মন যখন শান্ত হয় তখন আমার মতো শান্ত কিশোর আর কেউ হতে পারে না। তখন সব কিছুতেই আমার সংকোচ। সব কিছুতেই আমার ভয়। একটা উড়ন্ত মাছির গুঞ্জনও আমাকে ভীত করে তোলে। তখন না ভেবে আর কথা বলতে পারিনে। সংকোচ আমাকে পরাভূত করে ফেলে। কোনও মানুষের সামনে আমার মাথা তুলে দাঁড়াতে ভয় হয়। যদি কোনও কাজ করতে হয়, সে কাজ আমি কেমন করে করব তা ভেবে পাইনে। কেউ যদি আমার দিকে তাকায় তাহলে আমি কেঁচোর মতো হয়ে যাই। আবেগে অশান্ত আমার পক্ষে কোনও কিছুই অসম্ভব বলে বোধ হয় না। তখন আবার প্রকাশে শব্দের কোনও ঘাটতি পড়ে না। কিন্তু মানুষ যেটাকে স্বাভাবিক অবস্থা বলে সেখানে একেবারেই অসহায়। এবং তখন একটা কথা বলাও আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।

আমি বুঝি না, এমন স্বভাব থেকে আমি কেমন করে মুক্ত হব। কিসের বিনিময়ে। আমি বুঝি, আমার কামনা ইচ্ছে যেন বিশুদ্ধ আনন্দের কামনা। অথচ টাকা পয়সা, অর্থ সব অনর্থের মূল। এ সব আমার আনন্দকে বিষাক্ত করে ফেলে। যেমন অপরের সঙ্গে খেতে আমার ভাল লাগে। আবার খারাপ লাগে। আমি চাই শুধু একজনই আমার প্রিয় পাত্র হবে। আর কেউ নয়। ফলে উত্তম সংসর্গও যেমন সইতে পারি, তেমন মদ্যপানের আড়াও আমি পছন্দ করতে পারিনে। তাও আমার সহ্য হয়। আর তাই পানাহারও আমাকে তৃপ্ত করতে পারে না। কোনও নারীর চিন্তা যদি আমার রক্তে ঢেউ তোলে তখনও আমার কামনা হয় বিমূর্ত আদরের, সোহাগের। যে মেয়ে মানুষকে টাকা দিয়ে কেনা যায়, আমার কাছে তার কিসের আকর্ষণ? তখন আমার ভয় ধরে এমন মেয়ে মানুষ নিয়ে আমি কী করব? কেবল মেয়ে মানুষের কথা নয়। সব লাভ আর আনন্দের ক্ষেত্রেই আমার এই বোধ। যেন এমন আনন্দ আমি চাই যার কোনও বিনিময় মূল্য নাই। যার জন্য আমাকে কিছুই ব্যয় করতে হবে না। না কোনও অর্থ, না কোনও কষ্ট। আমার আনন্দ কেবল তাকে নিয়ে, তার জন্য যে হচ্ছে সেই আদি মানুষটি যে জানে আনন্দ কেমন করে ভোগ করতে হয়। সেই একটি অনন্য মানুষই যেন আমার কামনার পাত্র।

অর্থকে অপর সকলে যেভাবে দেখে আমি কোনও কালে তাকে সেভাবে দেখতে পারিনে। কোনও সময়েই তাকে এমনভাবে লোভনীয় বলে বোধ হয়নি। অর্থ হিসেবে কিসের মূল্য বহন করে? অর্থ হিসেবে অর্থ তো অর্থহীন। যে অর্থকে বিনিময় করে আনন্দ পেতে হবে, অর্থ হিসেবে সে অর্থের কী মূল্য। তার মানে অর্থ ত্যাগে অর্থের মূল্য! একটার জন্য দরাদরি করতে হবে, একটার জন্য অর্থকে আমার প্রদান করতে হবে, যে-অর্থকে আমি মূল্যবান মনে করি, এমনকি যার বিনিময়ে আমি লাভবান হই না, অনেক সময়ে প্রতারিত হই, সে অর্থের মূল্য আমার কাছে কী? আমি চাই টাকার দ্বারা যেন আমি মূল্যবান কিছু লাভ করি। কিন্তু যা আমি লাভ করি, একটা ডিমই হোক, বা একটি ফল : সেটা যখন হয় পচা বা বিস্বাদ তখন আমি কী লাভ করলাম। কোন মূল্যবান উত্তম? যদি একটা মেয়েও হয়। তবু টাকার বিনিময়ে আমি ফল পাই আর দেখি সে একটা নষ্ট মেয়ে তখন আমি কী করব? হ্যাঁ, উত্তম মদ্য আমি ভালবাসি। কিন্তু কোথায় পাব আমি সেই উত্তম মদ্য? কোন মদের দোকানে? যে চেষ্টাই আমি করিনে কেন, আমি প্রতারিত হতে বাধ্য। আমার উত্তমের জন্য তো কেউ পসরা খুলে বসে নেই। কোনও কিছু উত্তম পেতে চাইলেও তার জন্য কত উদ্বেগ, কত পরিশ্রম, কত বিব্রতকর অবস্থা আমার সাহায্যকারী সঙ্গীর দরকার হবে, আমার প্রয়োজনের অর্থ উদ্ধারকারী ব্যক্তির প্রয়োজন হবে। আমাকে অর্ডার দিতে হবে, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করতে হবে, আশঙ্কা আর আতঙ্কে রাত কাটাতে হবে। সময়ের ক্ষণ গুনতে হবে এবং শেষ কালে নিজেকে প্রতারিত দেখতে হবে। আহা! এই হচ্ছে অর্থ! এই হচ্ছে আমার সম্পদ। এক পেয়ালা মদের জন্য আমার ইচ্ছার চাইতেও এমন অর্থের জন্য আমার কামনা কী ভয়ঙ্কর।

এমন হয়েছে যে, জীবনে অসংখ্যবার আমি কোনও উত্তমকে অর্থের বিনিময়ে লাভ করতে চেয়েছি। দোকানে, বাজারে বন্দরে বেরিয়েছি, মনোহারী দোকান বা মিষ্টি দ্রব্যের বিপণীতে : আমি দেখলাম বিক্রির আসনে একটি মেয়ে উপবিষ্ট হয়ে আছে আর আমার মনে হচ্ছে মেয়েটা আমার মতো ক্ষুদ্রাবয়ব একটি ক্রেতাকে দেখে ওরা পরস্পর মুখ টেপাটেপি করছে! হাসছে। বাঁকা চোখে তাকাচ্ছে। ফলের দোকানে যাই; সেখানেও তো এই অবস্থা। আপেলের গন্ধ আমাকে টানে। অথচ পাশের দুটো ছেলে আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকায়। ওই যে লোকটা দোকানে বসে আছে : হায়রে, ওই লোকটা আমাকে চেনে। ওপাশে দেখি একটা মেয়ে এদিকেই আসছে। এটা কি আমাদের বাড়ির সেই মেয়েটা? আমার দৃষ্টিশক্তির ক্ষীণতা আমার চোখের সামনে নানা মরীচিৎকার সৃষ্টি করে। আমার পাশে আমি যাকেই দেখি তাকেই মনে হয়, সে আমাকে চেনে! তাই রাস্তায় বেরুলেই আমি ভয়ার্ত হতে থাকি। সম্মুখের বাধা আমাকে বিধ্বস্ত করে ফেলে। একদিকে সঙ্কোচ আর এক দিকে আমার কামনার লোভ : এ দুয়ের মধ্যে আমার দোলাচলের শেষ থাকে না। এর পরিণামে আমাকে শূন্য হাতে এবং শূন্য মনে আবার ঘরে ফিরে আসতে হয়। এক নিরেট সূর্যের মতো : যার পেটে কামনার ক্ষুধা, পকেটে যার অর্থ অথচ কোনও কিছুকে হাত পেতে নিতে যার বিন্দুমাত্র সাহস নেই, সে ভীত ভয়ার্ত। সে কাপুরুষ। কিন্তু আমার টাকা তো আমার পকেটে অচল হয়ে থাকেনি। আবার বুদ্ধিমান সাঙ্গপাঙ্গরা কীভাবে তাকে হস্তগত করেছে এবং মহানন্দে তাকে ব্যবহার করেছে। তার বিস্তারিত বিবরণে গিয়ে কি লাভ আছে? কী লাভ আবার সেই হাজার বিব্রতকর অবস্থার কথা বলায় : আমার সঙ্কোচ, আমার লজ্জা, আমার এগুনো আর পেছানোর কথার বর্ণনায়?

এ কাহিনীর যদি কোনও পাঠক থাকে তবে তাকে আমার সাথে থাকতে হবে। তাকে আমার অস্তিত্বে অস্তিত্ব ধারণ করতে হবে তবেই সে আমাকে মুহূর্তের পর মুহূর্ত দিয়ে উপলব্ধি করতে পারবে আমার চরিত্রকে, আমার অস্তিত্বের অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যকে। তাকে আমার কিছু বলতে হবে না।

এমন যদি কেউ যথার্থই থাকে তবে তার পক্ষে এই বালকটির মধ্যে একদিকে অর্থের কামনা এবং অপরদিকে অর্থের প্রতি তার অবিশ্বাস্য বিরাগের বৈসাদৃশ্যকে বুঝতে পারা সম্ভব হবে। এ যেন এমন একটি আসবাব, গৃহের সামান্য আসবাব যার জন্য যেমন আমি কামনার কোনও অর্থ খুঁজে পাইনে, তেমনি তাকে অর্জন করে তাকে ব্যবহারেরও কোনও উপায় খুঁজে বার করতে পারিনে! আবার যদি একটি পছন্দমতো কিছু কখনো পেয়ে যাই তবে তাকে উল্টাতে-পাল্টাতেই আমার সব অর্থ নিমেষে নিঃশেষ হয়ে যায়। এর বাইরে কেউ আমার চরিত্রে কোনও আড়ম্বরের জন্য কার্পণ্যের সেই বৈশিষ্ট্যকে দেখতে পাবে না যা একজন অর্থবান লোভর মধ্যে দেখা যায় বলে আমরা মনে করি। আবার আমার যদি কিছু ভাল লাগে তবে আমি তাকে কোনও প্রদর্শনের বস্তু না করে নিজের মনেই আনন্দের সঙ্গে আমি ভোগ করি। হ্যাঁ, অর্থের ব্যাপারে এটাই আমার সংশোধনের অযোগ্য বোধ। টাকাকে মূল্যবান করার বোধই আমার জন্মায় না। আর তাই জীবনভর আমি না পারলাম টাকা অর্জন করতে, না পারলাম তাকে ব্যবহার করতে। অপরে যেমন করে। এমন যদি কোনওদিন হতো যে আমার হাতে হঠাৎ অনেক টাকা এসে পড়েছে, তবে তা রক্ষার জন্য যত্নবান হওয়ার চেয়ে তাকে খরচ করার উদারতায় আমি মুহূর্তের মধ্যে আবার নিঃস্বই হয়ে যেতাম। অবশ্য অর্থহীনের দুর্দশা আমাকে উদার হওয়ার সে সুযোগ কখনো দিল না। এতেই যা আমার দুঃখ!

স্বাধীনতা, অবাধ স্বাধীনতা আমার পূজ্য। অপরের নির্ভরতা, অপরের অধীনতাকে আমি ঘৃণা করি। হ্যাঁ, টাকার এই মূল্য আমি বুঝি। যতক্ষণ আমার কিছু টাকা আছে, ততক্ষণ আমার কিছু স্বাধীনতা আছে। একটা অনন্য নির্ভরতা আছে কিন্তু সেই স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য পরিশ্রম করার কথা আমি কখনো কল্পনা করতে পারিনি। অর্থ কিংবা স্বাধীনতার জন্য পরিশ্রমের কথা আমি কখনো ভাবতে পারিনি। আবার অর্থহীন হওয়ার চিন্তাও আমি সহ্য করতে পারিনে। এটা অবশ্যই এক দুর্বোধ্য চরিত্র। আমার কাছেও। হ্যাঁ, তত্ত্বগতভাবে একটি লোকের হয়ত যে টাকা থাকে, সে টাকা অবশ্যই তার স্বাধীনতার একটা মাধ্যম। কিন্তু একথাও স্মরণীয় যে, যে-টাকার পেছনে আমরা ছুটি সে-টাকা আমাদের দাসত্বেরও এক মাধ্যম। টাকার দাসত্ব। তাই যা আমার আছে তাকে অবশ্যই আমি রক্ষা করতে চাইব; তার অধিক কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নয়।

একে যদি আমি একটা অনাগ্রহ বা নিস্পৃহতা বলি, তবে তার কারণ অবশ্যই কোনও কিছু সাধন করার জন্য আমার আলস্য। পাওয়ার আনন্দ তাকে লাভ করার পরিশ্রমের চাইতে অবশ্যই কম, বেশি নয়। সেভাবে আমার খরচের আধিক্যের মূলেও এক আলস্য। খরচ করার সুযোগ যখন আসে তখন তাকে বুদ্ধিমানের মতো খরচ করতেও তো পরিশ্রমের প্রয়োজন পড়ে : চিন্তার, উদ্বেগের, আকাক্ষার। আমার কাছে বস্তু অবশ্যই বড়। যে বস্তু আমি ধরতে পারি, স্পর্শ করতে পারি, সে বস্তু অর্থহীন অর্থের চাইতে আমার কাছে অবশ্যই মূল্যবান। কারণ টাকা এবং টাকা দিয়ে আমি যা অর্জন করি : এই দুয়ের মধ্যে একটা ব্যবধান আছে। কিন্তু যে দুটি বস্তু আমি ব্যবহার করি তার মধ্যে কোনও ব্যবধান নাই। কোনও বস্তু যদি আমি পেতে চাই তবে সে বস্তু অবশ্যই আমাকে আকৃষ্ট করে। কিন্তু তাকে পাওয়ার জন্য যদি আমার কোনও মাধ্যমের কথা চিন্তা করতে হয়, তবে বস্তুর প্রতি আমার কোনও আকর্ষণ আর বজায় থাকে না। আর এজন্যই আমি চুরি করেছি। বস্তু আমাকে আকৃষ্ট করেছে। এখনো এটা ওটা যা আমাকে আকৃষ্ট করে তাকে আমি চুরি করি। চুরি করার জন্য চিন্তা করিনে। হাতের কাছে পেলেই ধরে ফেলি। এ জন্য কাউকে অনুরোধ, উপরোধ করার কথা ভাবতে পারিনে। তবু যখন শিশু ছিলাম, বা যখন বয়স্ক হয়েছি, তখনো কারোর একটা ফার্দিংও আমি পরিশ্রম করে হরণ করিনি। না, এমন ঘটনার কথা আমার স্মৃতিতে আনতে পারিনে।

কেবল একটা ঘটনার কথা আমার মনে পড়ে। সে প্রায় পনের বছর আগের কথা যখন ‘সাত লিডার দশ সো’কে আমি যথার্থই চুরি করেছিলাম। ঘটনাটা বলার দাবি রাখে। কারণ ঘটনাটির মধ্যে এমন মূর্খতা এবং নির্লজ্জতার প্রকাশ ঘটেছে যার কথা আমার নিজের চরিত্র ছাড়া অপর কারোর মধ্যে আমি কল্পনা করতে পারিনে।

ঘটনাটা ঘটেছিল প্যারিসে। আমি সেদিন সকালে মঁসিয়ে দ্য ফ্রাংকুটল-এর সঙ্গে ‘প্যালেস-রয়াল’ বা রাজপ্রাসাদের সামনে প্রায় পাঁচটায় ভ্রমণে বেরিয়েছিলাম। তিনি তার পকেট ঘড়িটা বার করে ঘড়িটা দেখে বললেন। চল আমরা অপেরাতে যাই। তার কথায় আমি রাজী হয়ে গেলাম। আমরা গেলাম। তিনি কাউন্টার থেকে দুটো টিকেট কিনে আমাকে একটা দিয়ে আর একটা নিয়ে সামনে এগুলেন। আমি তার পেছনে ছিলাম। তিনি ভেতরে ঢুকলেন। আমি ঢুকতে গিয়ে দেখি দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। আমি দেখলাম আরো দর্শক দাঁড়িয়ে গেছে। আমি ভাবলাম ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়লেই পারি। মশিয়ে ফ্রাংকুয়েলও ভাববেন, আমি ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেছি। আমি ভিড় থেকে বেরিয়ে গিয়ে আমার চেক এবং টাকা বার করে ঢুকে পড়লাম। আমি এটা বুঝিনি যে আমি যখন ঢুকব তখন দেখব যে সব দর্শকই ইতোমধ্যে নিজ নিজ আসনে বসে পড়েছে। এবং মশিয়ে ফ্রাংকোয়েল ও আমাকে আর বার করতে পারবেন না। ঘটনাটার কথা বললাম এ জন্য যে, এমন ঘটনা আমার চরিত্রে আর ঘটেনি আর এর অর্থ হচ্ছে এই, মানুষের জীবনে এমন ডেলিরিয়াম বা বিকারের মুহূর্তও আসতে পারে যখন তার কার্যকলাপের কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেয়ে যায়। এমন অবস্থায় কৃত কোনও কাজকে স্বাভাবিক বলে গণ্য করা

উচিত নয়। আসলে সেদিন ওই টাকা চুরি করার আমার আদৌ কোনও ইচ্ছা ছিল না। আমি কেবল টাকাটার ব্যবহারকেই অর্জন করতে চেয়েছিলাম। টাকাটাকে নয়। একে যেমন চুরি বলা যায় না, তেমনি এর নির্লজ্জতারও অবধি ছিল না। এ ছিল আমার জীবনের শিক্ষানবিসি। এই পর্যায়ে নিষ্পাপ সাহসিকতার বাহাদুরি থেকে অপদার্থতার কোন গভীরে আমি ডুবে গিয়েছিলাম তার পথ পরিক্রমের সব কিছুর বিস্তারিত দিতে গেলে এ কাহিনী আর শেষ হবে না। তবে এও বলতে হয় যে, আমার অস্তিত্বের কারণে যে অপকর্মগুলোর সম্পাদন, তার জন্য আমার মধ্যে কোনও মানসিক আকর্ষণ তৈরি হয়নি। আমার সাঙ্গপাঙ্গদের আমি ক্লান্তি বোধ করেছি এবং খবরদারির আধিক্য যখন সহ্যের অতীত হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন সবকিছুতেই আমার ক্লান্তির শেষ থাকেনি। এ থেকে একটা জিনিসের লাভ হলো। বই পড়ার প্রতি আমার আগ্রহ আবার সঞ্চারিত হলো। যে আগ্রহকে বিগত পর্যায়ে হারিয়ে ফেলেছিলাম তাকে যেন আমি আবার ফিরে পেলাম। কিন্তু বই পড়ার এই আগ্রহ পূরণের জন্য যখন আমাকে কাজে ফাঁকি দিতে হতো তখন এটাও মনিবের কাছে বড় রকমের অপরাধ বলে বিবেচিত হতে লাগল আর তার ফলে আমার শাস্তিভোগও বেড়ে যেতে লাগল। কিন্তু এর ফলে আবার লাভও একটা হলো। পাঠের বিরুদ্ধে বাঁধা যত বাড়ল, পড়ার জন্য আমার আগ্রহ তত দুর্দমনীয় হয়ে উঠতে লাগল। আমি প্রায় বই পড়ার পাগলে পরিণত হলাম। লা ট্রাইবু’ বলে বই ধার দেয়ার একটা ব্যবস্থা ছিল। সেখান থেকে সাহিত্যের নানা বইই আমি পাঠের জন্য সংগ্রহ করতাম। এই সংগ্রহের কোনও ভাল মন্দ ছিল না। বই পেলেই হলো। ভাল মন্দ সবই আমার কাছে সমান ছিল। আমি সবই গোগ্রাসে গিলতাম। কাজের সময়ে কাজের টেবিলে পড়তাম, পানির চৌবাচ্চায় বসেও পড়তাম। কোথায় ঘন্টা পার হতো আমি বুঝতে পারতাম না। পড়তে পড়তে আমার মাথায় ঝিম ধরে যেত। আমি বই পড়া কিছুতে ছাড়তে পারতাম না। আমার মনিব আমার ওপর নজর রাখতে লাগল। আমি তার নজরে ধরা পড়তে লাগলাম। মনিব আমাকে বেদম পেটাতে শুরু করল। আমার হাত থেকে বই ছিনিয়ে নিতে লাগল। আমার এমন কত বই যে টেনেছে, ছিঁড়েছে, পুড়িয়েছে এবং জানালার বাইরে ছুঁড়ে ফেলেছে তার কোনও ইয়ত্তা ছিল না। লা ট্রাইবুর কত খণ্ড যে এভাবে খণ্ডিত হয়েছে তারও কোনও ঠিক নেই। শেষ পর্যন্ত ওই লা ট্রাইবুকে আমার দেয়ার মতো কোনও ফ্রাংক আদৌ অবশিষ্ট রইল না, তখন আমি তার মালিক মহিলাটিকে আমার শার্ট, নেকটাই কাপড় চোপড় তো দিলামই। সবশেষে আমার পকেট খরচ হিসেবে যে তিন শ’ থাকতো তাও প্রত্যেক রোববার তার জন্য নিয়ে যেতে লাগলাম।

এর পরিণামটা মোটেই ভাল হলো না। এই বই-এর জন্য ঝগড়াঝাটি, এমন কি হাতাহাতি–কিছুই বাকি রইল না। এবং ভালমন্দ নির্বিচারে বই পড়া আমার স্বভাবকে বিকৃত করে তুলল। আমি যেন একটা নীতিগৰ্হিত জীবে পর্যবসিত হলাম। এই পর্যায়ে নীরস বই অনেক পড়েছি, কিন্তু যাকে আমরা অশ্লীল বলি, অশ্লীল উত্তেজনাকর বই আমি পড়িনি। এর একটা কারণ হয়ত এই লা ট্রাইব্যু-এর মালিকান ভদ্রমহিলা এসব বই সম্পর্কে এমন রহস্যজনকভাবে ভাবভঙ্গি করতেন যে তাতে এসব বই-এর প্রতি আকর্ষণের বদলে আমার মনে একটা বিতৃষ্ণাই সৃষ্টি হতো। ইতোমধ্যে আমার বয়সও ত্রিশ পেরিয়ে গিয়েছিল। এর পরে ছাড়া আগে আমি এরকম বিপজ্জনক বই-এর দিকে দৃকপাত করিনি।

সে যাইই হোক বছরখানেকের মধ্যেই লা ট্রাইবুর ক্ষুদ্রাকারের গ্রন্থাগার আমি শেষ করে ফেললাম। ফলে আমার জীবিকার কাজে যখন একটু সময় পেতাম তখন সেই সময়টুকু আমি কীভাবে কাটাব তাই ভেবে পেলাম না। একটা কথা বলা যায়, গোগ্রাসে বই গেলার অভ্যাস আমাকে আমার চরিত্র একেবারে বিকৃত হওয়ার হাত থেকে আমাকে বাঁচিয়েছিল। ভাল বই, চিনতাম না। তাকে পর করতেও আমি সক্ষম ছিলাম না। কিন্তু সুনির্বাচিত না হলেও সাধারণ বইও অনেক সময় আমার মধ্যে উত্তম ভাব ও চিন্তার উদ্রেক করত। আমার আকর্ষণের বস্তু যে ছিল না তা নয়। তবে তার সবই ছিল আমার আয়ত্তের বাইরে। আমি বুঝতে পারলাম আমার উত্তেজিত ক্ষুধার্ত ইন্দ্রিয়গুলো তার খাদ্য কামনা করছে। কিন্তু যা দিয়ে সেই কামনাকে শান্ত করা যায় তা ছিল তখনও আমার কল্পনারও বাইরে। সেগুলো এত ঊর্ধ্বের এবং বাইরের ছিল যে আমার মনে হতে লাগল যেন ওগুলো ভোগ করার মতো যৌন ক্ষমতাই আমার নেই।

এমন অদ্ভুত উত্তেজনা এবং অস্বস্তির অবস্থাতে হঠাৎ আমার হাতে এমন একটা কাজ জুটে গেল যে কাজ আমাকে যেন আমার অস্তিত্বের কাছ থেকেই রক্ষা করল। এবং তাতে আমার যৌন উত্তেজনার কিছুটা প্রশমন ঘটল। আমার পাঠের জগৎ ছোট্ট ছিল না। তার অনেক কাহিনীকেই আমি মনের চিত্রপটে চিত্রায়িত করতে, তাকে যেমন ইচ্ছা তেমন ভোগ করতে আমার কোনও বাধা হতো না। আর তাতেই যেন আমার বেশ পরিমাণ উত্তেজনার প্রশমন ঘটত। এমন প্রশমনে আমি যেন কিছুটা শান্তিও লাভ করতাম এবং আমার যে বাস্তব অবস্থায় আমি নিজেকে অতৃপ্ত বোধ করতাম, তাকে বিস্মৃত হতেও আমাকে সাহায্য করত। কল্পনার চরিত্রের সাথে আমার এই সঙ্গলিপ্সা আবার অচিরে একটা গর্হিত মানসিক অবস্থার সৃষ্টি করল। যার ফলে পরিবেশের ওপর আমার ঘৃণা এবং বিতৃষ্ণার বৃদ্ধি ঘটতে ঘটতে আমি যেন আমার নিজেরই এক দুঃসহ অস্তিত্বে নিক্ষিপ্ত হয়ে পড়লাম। এ অবস্থাটাও ক্রমান্বয়ে অসহনীয় হয়ে দাঁড়াল। আমার কল্পনার কোনও চরিত্রকে বাস্তবে লাভ না করতে পেরে আমার অস্তিত্ব ক্রমান্বয়ে যেন এক কাল্পনিক জগৎকেই সৃষ্টি করতে উন্মুখ হয়ে উঠল।

এমন অবস্থায় আমি মোল বছরে পা দিলাম। আমার সে এক নিদারুণ অবস্থা : অস্থিরতায় ভরা এক অস্তিতু, নিজেকে নিয়েই নিজে অতৃপ্ত। চারপাশের সবকিছুতেই আমার বিতৃষ্ণা। আমার এই বয়ঃসন্ধিক্ষণের কোনও তৃপ্তিই কোথাও খুঁজে পেলাম না। কী আমি চাই তাও আমি জানতাম না। আর সেই অজ্ঞাত বস্তুর অপ্রাপ্তিতে আমি যেন মরে যাচ্ছিলাম। আমার চোখে অশ্রু এলো; কারণহীন কান্না : দীর্ঘশ্বাস : সূত্রহীন দীর্ঘশ্বাস। মোট কথা একদিকে আমার কিশোর অস্তিত্বের জন্য আমার মমতা : অপরদিকে চারপাশে এমন কিছু না পাওয়া যা দিয়ে আমি তৃপ্ত হতে পারি। রোববারগুলোতে আমার কিশোর সাঙ্গপাঙ্গরা আমাকে নিয়ে যেত ওদের জানা আমোদ-ফুর্তিতে যোগ দেয়ার জন্য। ওদের সঙ্গও আমাকে আনন্দ বা তৃপ্তি দিত না। আর আমার যদি সাধ্য থাকত তবে আমি ওদের ঘেরাও থেকে পালিয়ে যেতাম। কিন্তু তাও আমি পারিনি। ওদের সঙ্গ আমাকে উত্তেজিত করত, যে উত্তেজনাকে না পারতাম আমি ভোগ করতে, না পারতাম তা থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করতে। আমার সর্বক্ষণের অস্তিত্বের এই ছিল অবস্থা। শহর থেকে দল নিয়ে বেরুলে, আমি দলের সাথে নয়, দল ছেড়ে সামনে চলে যেতাম। দু’বার আমি ধরা পড়ে গেলাম। কেমন করে ফিরব তার চিন্তা করিনি। দলের কেউ তা স্মরণ করিয়েও দেয়নি। ফলে আস্তানায় ফিরে দেখি, দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। পরের দিন যা হবার তাই হলো। দ্বিতীয়বার আমাকে বলা হলো, আর করবি তত মজা দেখিয়ে দেব। এবার আমি ভয় পেলাম এবং ঠিক করলাম, আর যাবো না। কিন্তু বৃথাই সে চিন্তা। তিনবারের পরই ধরা পড়লাম। আসলে যে দারোয়ান দরজা বন্ধ করত, আমার ওপর ওর নজর ছিল। আর তাই আমার ফেরার আধঘণ্টা আগেই ও গেট বন্ধ করে দিত। একবার দুই স্যাঙ্গাত নিয়ে ফিরে আসছিলাম। আধা মাইল দূর থেকেই গেট বন্ধের আওয়াজ শুনলাম। আমি দৌড় লাগালাম। দূরে গেটের ঘণ্টার আওয়াজ শুনলাম। উধ্বশ্বাসে ছুটলাম। শরীর আমার ঘামে ভিজে গেল। আমার হৃঙ্কম্প হচ্ছিল। দূর থেকে আমি সৈনিকদের শিবিরে ফেরার দৃশ্য দেখছিলাম। আমি আরও জোরে ছুটলাম। রুদ্ধকণ্ঠে আমি চিৎকারের চেষ্টা করলাম। কিন্তু সবই ব্যর্থ হলো। আমার দেরি হয়ে গিয়েছিল। বিশ পা দূর থেকেই দেখলাম গেটের কপাট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বিউগল বাজছিল। দরজা বন্ধ হচ্ছিল। আর কি চরম ভাগ্য আমার জন্য অপেক্ষা করছিল তার চিন্তায় আমি উদভ্রান্ত হয়ে পড়ছিলাম।…

.

[ভীত, ক্লান্ত রুশো চরম দন্ডের ভয়ে দুর্গের দরজার বাইরে থেকে পলায়নের সিদ্ধান্ত নিল।]

.

পাঠকদের বরং একটু বলি : যদি সেদিন কোনও ভাল মানুষের হাতে আমি পড়তাম তাহলে আমার অস্তিতুটি কী হতে পারত–একজন দিন মজুরও যদি আমি হতে পারতাম, তাহলে তার শান্ত পরিবেশে হয়ত আমার রুচির তত বিকার ঘটত না। আমার মনের এবং কল্পনার তেমন জোর ছিল না যাতে যে কোনও খারাপ পরিস্থিতিকে আমি আনন্দজনক করে তুলতে পারতাম। এ থেকে আমি এই বলতে পারি, এমন একটি উদ্বেগমুক্ত জীবন যদি আমি পেতাম তাহলে আমার নিজের মনমতো একটি ঘর আমি তৈরি করতে পারতাম, খ্রিস্টান ধর্মের এক বিশ্বাসী সন্তু হওয়াও আমার পক্ষে কঠিন ছিল না। তখন আমার একটি সংসার হতো। সন্তান সন্ততি হতো। একজন আদর্শ পিতায়ও আমি পরিণত হতে পারতাম। পরিণামে শান্তভাবেই আমি প্রস্থান করতে পারতাম এবং শান্তভাবে আমি বিস্মৃত হয়ে যেতেও পারতাম। হয়ত তখনও কেউ থাকত যার হৃদয় থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরুত : ও মরে গেল! তাতে আমার কোনও দুঃখ থাকত না। একটি মমতাময় সংসারের কোলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার ভাগ্য।

না, সে ভাগ্য আমার হয়নি। আর হয়নি বলেই আমাকে বিবৃত করতে হবে আমার জীবনের সব দুর্ভাগ্যকে। আমার পাঠকদের কাছে একটা দুর্ভাগার কাহিনীই আমি বিবৃত করতে পারি। কারণ এর কোনও উপায়ান্তর নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *