১১. কানু আর আসেনি

১১

কানু আর আসেনি। দ্বন্দ্বযুদ্ধে কংসকে নিহত করে সে মথুরার রাজা হয়েছে। যাদবদের লুপ্ত গৌরব ফিরিয়ে আনার ভার পড়েছে তার ওপর। সে এখন সদাব্যস্ত। কত প্রার্থী, গ্রহীতা, অসহায় ব্যক্তিরা আসে তার কাছে সাহায্য চাইতে। রাজ্যে ন্যায়, শান্তি ও শৃঙ্খলা স্থাপনের কাজে সে অষ্টপ্রহর ব্যাপৃত। তা ছাড়া আরও শত্রুদমনের কাজ বাকি আছে। মহাবল জরাসন্ধের ক্রোধ থেকে মথুরাকে রক্ষা করাও কম কথা নয়। শোনা যায়, সে নাকি রাজধানী মথুরা থেকে সরিয়ে অনেক দূরে, দ্বারকায় নিয়ে গিয়ে সুদৃঢ় করতে চাইছে।

বৃন্দাবনে সে আর আসেনি। এতদিন যেমন সে তার জন্ম-পরিচয় বিস্মৃত ছিল, এখন সে যেন তার বাল্য-কৈশোরের এই অধ্যায়টিও সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছে। কত পূর্ণিমা, এসেছে, তারপর অমাবস্যা, আবার পূর্ণিমা। অমাবস্যা হয়েছে চন্দ্রাভুক, আবার চন্দ্রকিরণ ভক্ষণ করেছে আঁধার। আকাশে দেখা দিয়েছে নবীন মেঘ, মাটিতে পড়েছে নীলবর্ণ ছায়া, তখনও কানু আসেনি। কদম গাছগুলো ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে, তমাল গাছের নীচে জ্বলছে দীপ, কানু আসেনি। চোখের জলে একটি নদী বানিয়ে রাধা তার পাশে শুয়ে থেকেছে।

একবার বৃন্দা আর সুবল গিয়েছিল দূত হয়ে কানুর কাছে। কানু ফিরিয়ে দিয়েছে তাদের। রাজার অনুচর-প্রতিহারীরা এইসব গাঁয়ের লোকের সঙ্গে সহজে দেখাই করতে দিতে চায় না। কংসের কী বিশাল প্রাসাদ— তার মধ্যে যেন পথ হারিয়ে যায়। প্রতিটি ঘরের মেঝে দর্পণের মতো ঝকঝকে, বিরাট বিরাট অলিন্দ, তার মধ্যে মধ্যে রত্নখচিত মিনার। আজ কানু এই সবকিছুর অধিপতি। সে যেখানেই যায় তার সঙ্গে সঙ্গে রক্ষীরা ফেরে। তবু কানু বৃন্দা আর সুবলকে নিয়ে গিয়ে বসিয়েছে রাজপ্রাসাদের নিভৃততম ঘরে। প্রথমে কেউ কোনও কথা বলতে পারেনি। একটু পরে কানুই প্রথমে মৃদু গলায় প্রশ্ন করেছিল, ওখানে সবাই ভালো আছে?

সুবল আর বৃন্দা দু’জনেই মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, না!

ওরা দু’জনে ভেবেই পায় না কানুকে কী বলে সম্বোধন করবে! এত দিন তারা কানুর নাম ধরে যে ডেকেছে সে-কথা ভেবেই লজ্জা পায়। সে কানু তো আর নেই। সে এখন রাজা, এখানে তাকে দেখলে সবাই ভক্তি-সম্ভ্রমে সরে দাঁড়ায়, কেউ তার নামও উচ্চারণ করে না।

দুয়ারের পাশ দিয়ে রাজমাতা দেবকীকে দেখে সুবলরা অকারণেই শঙ্কিত হয়ে পড়ে। যেন তারা কানুকে চুরি করে নিয়ে যেতে এসেছে। বাইরে থেকে অমাত্যরা উঁকি দেয় মাঝে মাঝে। তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। রাজাধিরাজ কৃষ্ণের জন্য রাজকার্য অপেক্ষা করে আছে।

এক সময় সংকোচ ঝেড়ে ফেলে সুবল জিজ্ঞেস করল, ভাই কানু, তুমি কি আর একবারটিও আমাদের ওখানে যাবে না? কানু সুবলের হাত চেপে ধরে কম্পিত গলায় বলতে লাগল, ভাই সুবল, বৃন্দাবনের জন্য আমার মন কাঁদে, সেখানকার সকলের জন্য আমার মন কাঁদে, কিন্তু সে-বৃন্দাবন আর আমার জন্য নয়! আমি আর ফিরতে পারি না। আমার ফেরার পথ নেই। যদি বৃন্দাবনে যাই, আর কি তা হলে গোষ্ঠে গিয়ে ধেনু চরাতে পারব? আর কি তোদের সঙ্গে ধুলো মেখে খেলতে পারব মায়ের মতন মাটিতে? আর কি কখনও যমুনায় একা নৌকো বাইব? স্নানের ঘাটে গিয়ে সংকেতবাঁশি বাজাতে পারব রাধার জন্য? আমি রাজা, কোনও রাজার পক্ষে কি এসব মানায়? তা হলে যে শাসন দুর্বল হয়ে যাবে? আর ওই সবই যদি না করতে পারি, তা হলে বৃন্দাবনে যাব কোন সাধে? আমার বুক হু-হু করবে না? এই রাজপোশাকের পিঞ্জরে আমাকে আটকে দিয়েছে সবাই। সুবল, তোরা দেখে যা আমাকে, সবাইকে গিয়ে বলিস!

মা যশোদার জন্য আমার প্রাণ কাঁদে। কিন্তু মা দেবকীকে কাঁদিয়ে কী করে আমি যশোদার কাছে ফিরে যাই? একজন অনেক বছর কাছে পেয়েছে, আর একজন যে এক দিনও পায়নি।

আর রাধা?

সুবল, তোরা রাধাকে বলিস, আমি মন-পবন গগনে রেখেছি। এখন দশমী দুয়ারে কবাট। আমি মূল কমলে মধু পান করেছি, আমার ব্রহ্মজ্ঞান হয়েছে, তাই জ্ঞানবাণে মদনবাণ ছিন্ন না করে পারিনি। আমি অহর্নিশ যোগধ্যান করি, আমার দেহে আর বিকার নেই। তবু তোরা বলিস, সেই সুন্দরের প্রতিমাকে আমি কখনও ভুলব না!

ওরা ফিরে এসে রাধাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে। রাধা এসব কথা কিছুই কানে নেয় না। কেউ কাছে এলে সে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এখন আর সে কাঁদে না।

প্রতি পূর্ণিমার রাতে সে সাজতে বসে। কুঙ্কুম চন্দনের আলিপন দেয় শরীরে। হাতে, পায়ে, গলায় পরে নেয় ফুলের গহনা। তারপর চুপি চুপি চলে যায় যমুনা তীরে। তমাল গাছের নীচে দীপ জ্বেলে দাঁড়িয়ে থাকে। সে আসবে বলে কথা দিয়েছিল, তাই রাধাকে যে অপেক্ষায় থাকতেই হবে।

এক সময় মনে হয়, যেন দূরে কোথাও বেজে ওঠে সেই পাগল-করা বাঁশি। সেই সুর বাতাসে কাঁপে এবং রাধাকে কাঁপায়। যমুনার জল কাঁপে, তমালের পাতা কাঁপে। তারপর এক সময় মনে হয়, সেই দুরন্ত দুর্দান্ত মেঘবর্ণ ছেলেটি ছুটে ছুটে আসছে বন-পাথার পেরিয়ে! এক সময় সে রাধার বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারপর হাসিতে-কান্নায় আদরে-সোহগে মানে-অভিমানে রাত ভোর হয়ে যায়। এ রাধার একান্ত নিজস্ব কানু, এ তাকে ছেড়ে থাকবে কী করে?

মথুরায় যে রাজত্ব করছে, সে রাজত্ব নিয়েই থাকুক। সে অন্য কৃষ্ণ। সে রাধার কেউ নয়!

॥ সমাপ্ত ॥

[এই কাহিনী রচনায় শ্রীশ্রীভাগবত, শ্রীশ্রীব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, রাস পঞ্চাধ্যায়, শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন, চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি ও অন্যান্য পদকর্তাদের পদাবলী, বিভিন্ন লোক সঙ্গীত এবং দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়ের রচনাবলী থেকে প্রভূত উপকরণ গ্রহণ করা হয়েছে।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *