০৮. কে বাঁশি বাজায়

কে বাঁশি বাজায়, বড়ায়ি, ওই কালিন্দী নদীর কূলে? বুড়িমা, এই গোকুলের গোষ্ঠে কে অমন বাঁশি বাজায়? আজ যে আমার শরীর বড় আকুল, মন যে বড় ব্যাকুল হয়ে পড়ছে। ওই বাঁশির শব্দে আমার রান্না সব এলেমেলো হয়ে গেল। বুড়িমা, কে ওই বাঁশি বাজায় আমি জানি না, তবু কেন ইচ্ছে হচ্ছে ছুটে গিয়ে তার পায়ে আমি মাথা কুটি? সে তো চিত্তের হরিষে বাঁশি বাজাচ্ছে, কিন্তু তার কাছে আমি কোন দোষ করেছি?

বুড়িমা অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন রাধার মুখের দিকে। এক সময় বললেন, ও কী, তুই কাঁদছিস কেন মা? এমন মিষ্টি বাঁশির সুর, তা শুনে কেউ কাঁদে?

ও তো আমাকে কষ্ট দেবার জন্যই অমন সুস্বরে বাঁশি বাজাচ্ছে।

ও তো নন্দের নন্দন কানু। ক’দিন ধরেই ওকে দেখছি এদিকে। অমন বাঁশি শুনলে পিঞ্জরের শুকপাখিও উড়ে যেতে পারে!

আমি তো পাখি নই যে উড়ে যাব তার ঠাঁই। মেদিনী বিদীর্ণ হলে আমি তার মধ্যে লুকোতাম।

তোর দুঃখ আমি বুঝেছি মা।

বুড়িমা, যখন বন পোড়ে তখন জগজ্জন তা দেখতে পায়। কিন্তু আমার মন পুড়ছে যেন কুমোরের পোয়ান।

বুড়িমা হা-হা করে উঠল, ও কী, তুই জল ছাড়াই হাঁড়িতে চাল চাপাচ্ছিস কী? একটু আগে দেখলাম, তুই নিমের ঝোলে লেবু টিপে দিলি!

রাধা বলল, আমি আর পারি না! আর পারি না! আর পারি না যে!

ক’দিন ধরে রাধা নিজেকে সামলেসুমলে উঠে বসেছিল। চুল আঁচড়ে, শাড়ি বদলে সে মন দিয়েছিল সংসারধর্মে। কিন্তু আজ আবার সন্ধ্যার পর রান্নাঘরে বসে ওই খ্যাপা বাঁশির সুর শুনে তার সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। রান্নায় আর কিছুতেই মনঃসংযোগ করতে পারল না। বাঁশির সুর তাকে যেমন উতলা করে, তেমনই হঠাৎ বাঁশি থেমে গেলে সে চাতকের মতো অধীর হয়ে পড়ে।

সে বাঁশি বেজেই চলল, বেজেই চলল। ও কি বাড়ি যাবে না? ওর ক্ষুধা-তৃষ্ণা নেই? ও কি পাগল হয়েছে আজ? রাধা ঘরে থাকতে পারে না, বাইরে আসে। বাইরে থাকতে পারে না, ঘরে আসে আবার। ভাত রান্না করতে গিয়ে সে নুন ফুরিয়ে ফেলল, ডাল বেঁধে সে ফেন গালতে গেল। বুড়িমা তাকে সরিয়ে দিয়ে বলল, তুই সর দেখি, যা ঘরে গিয়ে শুয়ে থাক। রান্না করতে হবে না তোকে। আমি সব দেখছি।

রাত যখন নিশুতি, সবাই খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, রাধা তখনও জেগে। তখনও দূরে কোথাও সেই বাঁশি বেজেই চলেছে। এখন সেই বাঁশির সুর আরও তীক্ষ্ণ, আরও করুণ। এক সময় রাধার সব সংযম বন্যার তোড়ে মাটির বাঁধের মতন ভেঙে গেল।

চুপি চুপি শয্যা ছেড়ে উঠে এল রাধা। পায়ের নূপুর আর কটিভূষণ খুলে ফেলল। পরে নিল একটা নীল রঙের শাড়ি। তারপর গুরুজন, দুর্জনের ভয় কিছুই না মেনে বেরিয়ে পড়ল পথে।

রাধার সঙ্গে শত্রুতা করার জন্যই যেন সে-রাতে মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে। চাঁদ যেন আঁধার রূপ মদিরা পান করে আজ বেশি পরিমাণে স্ফূর্তি প্রবণ। চারদিকে ফটফট করছে নীল জ্যোৎস্না। রাধার শরীর ও বসন যেন মিশে গেল সেই জ্যোৎস্নায়।

চৈত্র মাসের ছোট রাত, কখন ফুরিয়ে যাবে তার ঠিক নেই। রাত্রির এখন কত প্রহর রাধা তা জানে না। তাই রাধা পথ দিয়ে দ্রুত চলতে যায়। কিন্তু চিত্ত এত অস্থির যে পথের দিকে চোখ নেই। বার বার তৃণাঙ্কুর ফোটে পায়। বেশি জোরে যেতে গিয়ে মাঝে মাঝে পদস্খলিত হয়ে পড়ে যায়, তখন মনে হয় যেন জালে-বদ্ধ হরিণী। আবার ছটফটিয়ে উঠে পড়ে। রাধার এখন শরম-ভরম বোধ নেই।

বাঁশির শব্দ অনুসরণ করে করে বনের মধ্যে ছুটতে ছুটতে রাধা এক সময় দেখতে পেল বংশীবাদককে। গাছের ডালপালা কেটে মাটিতে বিছিয়ে কানু একটু শয্যা তৈরি করেছে। তার ওপর অজস্র ফুল ছড়ানো।

.

প্রথম কিছুক্ষণ পরম্পর দৃষ্টিবদ্ধ হয়ে রইল। কেউ একটা কথাও বলল না। যেন কত দিন, কত মাস, কত বর্ষ পার হয়ে গেল। দুই চোখের মাঝখানে যেন এক সেতু। দু’জনে তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ বাতাস উঠল, গাছের শাখা দুলল, সেই শব্দে ওদের ঘোর ভাঙল। তারপর দু’জনেই ছুটে এসে যখন আলিঙ্গনাবদ্ধ হল, তখন মনে হল, মেঘের ওপর একটি বিদ্যুৎরেখা স্থির হয়ে গেছে।

একটু বাদেই আলিঙ্গনমুক্ত হয়ে রাধা ভাবল, কেন এলাম? এ যে না-ফেরার পথ!

কানু ভাবল, আমি দিনের পর দিন, রাতের পর রাত যার ধ্যান করছি, এ কি সে? এ যে তার চেয়েও বেশি। এত রূপ তো আমি চক্ষে ধারণ করতে পারিনি! ত্রিবেণী জলসঙ্গমে শতযজ্ঞ অনুষ্ঠান করে যে বহু ভাগ্য অর্জন করে, সেই তো এমন রমণীকে পাবার অধিকারী। আমি কি একে পাব? এ আমার আঙুলের ফাঁক দিয়ে অলীক হয়ে চলে যাবে না তো!

রাধা আস্তে আস্তে বলল, হে নির্দয় কানু, কেন আমাকে এমন ভাবে পাগল করলে? আমাকে কলঙ্ক সাগরে ডুবিয়ে তোমার কী লাভ?

কানু বলল, তুমি ডুববে না, আমরা দু’জনেই আনন্দ বারিধিতে ভাসব! কিন্তু তুমি কেন আমায় এত দিন দূরে সরিয়ে রেখেছ? আমি যে আর পারছিলাম না! দেখো আমার কপাল কত জ্বরতপ্ত?

কানু নিজের মাথাটা ঝুঁকিয়ে দিল, কিন্তু লজ্জাবশত রাধা তা স্পর্শ করল না। কানু তখন হাঁটু গেড়ে বসে, দেবীর সামনে ভক্তের মতন ভঙ্গিতে বলল, সুন্দরী রাধা, তুমি সরোবরময়ী। তোমার দেহের লাবণ্যই তোমার জল, কুন্তলদাম যেন তার শৈবাল, তোমার বদন একটি পদ্ম, তোমার নয়ন দুটি নীলকান্ত মণি, নাসিকা যেন স্রোতে-ভাসা তিলফুল; তোমার দুই গালে মহুয়া ফুলের আভা। তোমার হাসিতে লোধ্ররেণু…রাধা, তুমি তো এখনও একবারও হাসোনি।

রূপবর্ণনায় ও স্তুতিতে রাধার মুখ অরুণবর্ণ। সে ঈষৎ পাশ ফিরে প্রস্তরমূর্তির মতন স্থির।

কানু বলল, পায়ের কাছে একটি কীট এলেও মানুষ তার দিকে দেখে। আমি কি কীটের চেয়েও অধম? বলো, বলো, বলো—

রাধা অস্পষ্ট গলায় বলল, এই ভয়াল রাত্তিরে গৃহশাসন অগ্রাহ্য করে আমি ছুটে এসেছি, কানু, সে কি কোনও কীটাণুকীটের জন্য? কানু, তুমি আমার ইহকাল কেড়ে নিয়েছ!

কানুর মুখ উল্লাসে উদ্‌ভাসিত হয়ে গেল। অত্যন্ত বেশি আনন্দ যেন কষ্টের রূপ ধরল, সে মাথা ঝাঁকিয়ে আঃ আঃ আঃ শব্দ করতে লাগল। তারপর বলল, তুমি যখন কিঞ্চিৎমাত্রও কথা বলো, তখন তোমার দন্তরুচি ঠিক কৌমুদীর মতন বিকশিত হয়। যেন একটা আলো ফোটে, এক নিমেষে অতিশয় আঁধারও দূর হয়ে যায়! প্রতীক্ষায় প্রতীক্ষায় অধৈর্য হয়ে আমার শরীর যেন জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিল, এমন সময় তুমি এলে স্নিগ্ধ সরোবরের মতন। তোমার বাহুই যেন মৃণাল, করতল রক্তপদ্ম। তোমার স্তনদ্বয় কনক-কলস, নাভিতে ঈষৎ প্রস্ফুটিত শালুক। তোমার ত্রিবলী যেন ঘাটের স্বর্ণ-সোপান, শোভিত জঘনে স্বর্ণপাট—

রাধার মনে হল, কেন একটু চুলটা বেঁধে আসেনি, কেন নয়নে কাজল দেয়নি একটু, কেন কুঙ্কুম-চন্দনে একটু শরীর-প্রসাধন করেনি! পরক্ষণেই এ-চিন্তার জন্য লজ্জা জাগল তার মনে। কিন্তু তার অঙ্গ থরথর করে কাঁপছে। তার কুচ-যুগের ওপর সূক্ষ্ম বসনও যেন গুরুভার বোধ হচ্ছে। তার শরীর যেন তার নিজের বশে নেই আর। তার এত দিনের নারীজীবনে এমনটি দশা আর হয়নি কখনও।

কানু এবার রাধার হাত ধরে পাতার শয্যার ওপর বসাল। রাধা লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে রইল অন্য দিকে। কিন্তু মন মানে না। চোখ চকিতে ফিরে ফিরে আসে কানুর দিকে। তার শরীর যেন অয়স্কান্তমণি দিয়ে গড়া। গলায় বাঁধুলি ফুলের মালা। তার ত্বক যেন কালো রঙের দর্পণ। তার দেহের গড়ন সুঠাম-বলিষ্ঠ, একটুও রুক্ষতা নেই। সবচেয়ে বেশি পাগল করে তার মুখ। ভ্রমর-কৃষ্ণ চোখ দু’টি সদা চঞ্চল।

কানু জিজ্ঞেস করল, কেন তোমায় আর যমুনার ঘাটে দেখি না? কেন তুমি আর কদমতলায় স্নান করতেও আসো না? আমি কি এতই বিষ যে আমাকে তোমার চোখে দেখতেও ইচ্ছে করে না?

রাধা উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল। কিন্তু একটু পরেই তার অনুতাপ হল। কানুর এত ব্যগ্রতাকে সে কী করে প্রতিহত করতে পারে?

সে মুখ ফিরিয়ে উত্তর দিল, যদি বলি করে না, তবে সেটা হবে অতি বড় মিথ্যে। সেই মিথ্যেটাই তো আমি আমার মনকে বোঝাতে চাই। কিন্তু মানুষের মনই একমাত্র জায়গা, যেখানে মিথ্যের কোনও স্থান নেই।

অনেক দিন তুমি বাড়ি থেকে বেরোওনি। মাত্র তিনদিন আগে একবার তুমি সখীদের সঙ্গে বেরিয়ে ছিলে, সে-দিনও তুমি আমাকে দেখতে পাওনি। কিন্তু তার আগেই নৌকো বিহারে আমরা পরস্পরকে জেনেছি। তবু তুমি আমাকে ভিনগাঁয়ীর মতন অবহেলা করলে?

দেখেছিলাম তো সেদিন।

আমার সঙ্গে কথা বলেনি।

কানু, তুমি কি লোকসমাজে আমার কলঙ্ক প্রকট করতে চাও?

সেদিন তুমি দেখেছিলে, তোমার অবহেলায় অস্থির হয়ে আমি থাকতে পারিনি। আমি একটা পদ্মকোরকে চুম্বন রেখেছিলাম!

তাও দেখেছি।

তাতেও আমি নিবৃত্ত হইনি। আমি একটি অবনত দাড়িম্ব লতিকার সুবর্তুল ফলে হাত বুলিয়ে ছিলাম। তাতেও হয়নি! আমি তখন অশোকপল্লবে দংশন করেছিলাম, দেখেছিলে?

সেই দেখে আমি এত অস্থির হয়ে পড়েছিলাম যে মনে হয়েছিল সখীদের সমক্ষেই মূৰ্ছিতা হয়ে পড়ব! কানু, আমার শরীর কাঁপছিল, সারা গায়ে স্বেদ বইছিল, তুমি অনেক দূরে ছিলে, তবু আমি লোকসমক্ষে কলঙ্কিনী হয়েছিলাম! তাই আর এক দণ্ডও সেখানে থাকিনি। চলে এসেছিলাম বাড়িতে। সেই দিনই আবার ঠিক করেছিলাম, আর আমি বাড়ির বাইরে যাব না। পিঞ্জরেই আমার স্থান।

আজ তুমি এসেছ।

এসেছি?

রাধা, তুমি আমার কাছে এসেছ, আজ তুমি স্বয়মাগতা।

আমার চোখে ঘোর লাগছে। কানু, আমার এ কী হল? আমি নিজেই জানি না, আমি কখন এলাম, কী করে এলাম। এ স্বপ্ন নয় তো!

না, স্বপ্ন নয়। এই যে অনুভব করে দেখো আমার হাত।

হ্যাঁ কানু, এ তোমার হাত।

দাও, রাধা, সেই পদ্মকোরক, সেই দাড়িম্বের সুবর্তুল ফল, আর অশোকপল্লব।

তুমি বনের মধ্যে খুঁজে দেখো, ওই সবই আবার পাবে!

এত হাতের কাছে সব থাকতে আমি খুঁজতে যাব কেন!

রাধা তক্ষুনি কানুর হাত ছাড়িয়ে উঠে দৌড় লাগাল। কানু তিন লম্ফে গিয়ে তাকে ধরল। কিন্তু বলপ্রয়োগ করল না, কাতর ভাবে বলল, তুমি যদি দয়া না করো, তা হলে আমি তোমার পায়ে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকব—

রাধা সসংকোচে নিজের পা ঢেকে বলল, না, না, না—

কানু বলল, বুঝেছি, তোমার ও শারদ শশীর তুল্য মুখ তুমি আমাকে ছুঁতে দেবে না। তবে থাক, তোমার পায়ের নখে যে কতগুলো চাঁদ পড়ে আছে, সেগুলিতেই আমি ওষ্ঠ স্পর্শ করব—

রাধা বলল, না, কানু, আমার পায়ের নখে লেগে আছে পথের ধুলো আর কাদা!

ধুলো আর কাদাই যার প্রাপ্য, সে আর বেশি কী পাবে?

না, কানু, তোমার জন্যই তো আমার সব!

কী বললে?

আমি এতকাল ছিলাম যেন একটা পাথরের মূর্তি, তুমি এসে ছুঁয়ে দিলে বলেই তো আমি প্রাণ পেলাম। অথচ সেই আমিই কী মূঢ়া দেখো, তোমার কাছে আসতেও আমার লজ্জা? কানু, তুমিই তো আমার সব।

রাধা, তুমিই আমার জীবন, তুমিই আমার ভূষণ। এই ভবজলধিতে তুমিই আমার একমাত্র রত্ন। তুমি সযত্নে আমার হৃদয়ে থাকো।

রাধা নিজেই এবার অত্যন্ত ব্রীড়ার সঙ্গে বসে পড়ে কানুর দুই করতলের মধ্যে তার ঈষৎ স্বেদযুক্ত কম্পিত মুখখানি বন্দি হতে দিল।

সেই মুখে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে কানু বলল, আঃ! রাধার বুকের সূক্ষ্ম বসন সরিয়ে কানু সেখানে মাথা রেখে আবার বলল, আঃ! সেই স্বরে গভীর তৃপ্তি। যেন বহু কাল পরে ঘর-ছাড়া এক বালক গৃহে ফিরেছে!

…তারপর তরল তিমির যেন প্রচ্ছন্ন করে দিল চন্দ্র ও সূর্য। মেঘের মধ্যে হারিয়ে গেল তড়িৎলতা। চতুর্দিকে ছেট্‌কাতে লাগল ফুল, যেন আকাশ থেকে ঝরছে তারা। অম্বরও খসে পড়ল। পাহাড়চূড়া বিমর্দিত হল, মেদিনী দুলতে লাগল। সমীরণ উষ্ণ ও খর বেগে বইতে লাগল, পাখির চিৎকারের মতন কিছু শোনা গেল, এবং শেষে প্রলয় পয়োধি জলে সব ডুবে গেল।…

রাধার যখন ঘুম ভাঙল, তখন ভোরের আলো ফুটে উঠছে। ঝটিতি উঠে বসেই ভাবল, আমি কোথায়? চোখ রগড়ে ভালো করে দেখল, সে এক নিবিড় বন, গাছে গাছে পাখির কাকলি, পাতায় ফাঁকে ফাঁকে হিরের কুচির মতন রোদের ঝিকিমিকি। পাশে ঘুমিয়ে আছে কানু, পরিশ্রান্ত তবু প্রশান্ত তার মুখ।

রাধা ভেবেছিল, সে বুঝি শুয়ে আছে অমরাবতীতে! এক চঞ্চল মেঘ তাকে নিয়ে গিয়েছিল সেখানে। কিন্তু এ যে চেনা অরণ্য। অদূরেই তাদের বাড়ি। দিনের আলোর মধ্যে সেখানে ফিরবে কী করে?

তবু তো ফিরতেই হবে। রাধা ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল। কানুকে একবার ডাকবে ভেবেও জাগাল না। ও ঘুমোক, ওর স্বপ্ন ভাঙিয়ে লাভ কী?

রাধা প্রায় ছুটেই চলল। বন ছাড়িয়ে সে যখন পল্লিতে এসে পড়ল, তখন সেখানে অনেকেই উঠে পড়েছে। কেউ উঠোনে জল-ছড়া দিচ্ছে। কেউ চ্যাঁ-চ্যাঁ শব্দে দুধ দুইতে বসেছে গোয়ালঘরে। কেউ নিমগাছের ডাল ভাঙছে।

রাধা জানে না, তার মুখ কানুর চোখের কাজলে মাখামাখি। নিপীড়িত ফুলের রস ছোপ ছোপ হয়ে লেগে আছে তার গায়। তার বসন দোমড়ানো। অনেকেই অবাক হয়ে তাকে দেখছে আর ভাবছে, ওই যে আয়ান ঘোষের ঘরণী সুন্দরী রাধা ছুটে চলেছে। কিন্তু এই সাতসকালে সে কোথায়ই বা গিয়েছিল, কোথা থেকেই বা ফিরছে?

বাড়ির দোরগোড়ায় রাধা ধরা পড়ে গেল ননদিনীর কাছে। ননদিনীর চোখ বড় খরশান। সে রাধাকে দেখে প্রায় আঁতকে উঠে বলল, ওমা, কোথায় মরতে গিয়েছিলি!

রাধা বলল, মরতেই গিয়েছিলাম, তবু এমন কপাল, আবার বেঁচেই ফিরে আসতে হল।

দিনের পর রাত আসে, আবার দিন। এই ভাবে সময় যায়। কিন্তু রাধার কাছে দিনরাত্রি এখন সব সমান হয়ে গেছে। কখন কানুর সঙ্গে দেখা হবে, সেটাই একমাত্র চিন্তা। দেখা হয়, দুপুরে, বিকেলে বা মধ্যরাত্রে, তার কোনও ঠিক নেই। রাধা এখন আবার নিয়মিত স্নানের ঘাটে কিংবা হাটের পথে যায়। যদি দূর থেকে কানুকে এক পলকের জন্যও দেখতে পায়। কানুর পীত রঙের বসনের সামান্য আভাসও চোখে পড়ে, অমনি তার শরীর কম্পিত হয়, দৃষ্টি হয়ে যায় স্থির, কপালে দেখা দেয় পুলক-স্বেদ। শুধু দেখাতেই যখন এত আনন্দ, তখন নিভৃতে নিবিড় করে পাওয়ার আনন্দ যেন সহ্যেরও অতীত। যেন মৃত্যুর মতন। এই আনন্দ যে পায়নি, সে জানল না একই জীবনে বার বার মৃত্যুর স্বাদ কী রকম। তার চেয়ে বড় আনন্দ বার বার করে বেঁচে ওঠায়।

যখন কানুর দেখা পায় না, যখন তার বাঁশির সুরও শোনা যায় না, তখন রাধার মনে হয় পৃথিবীতে শুধু আঁধারও যেন কঠিন পদার্থ, তার একটা শক্ত দেওয়াল উঠেছে চারদিকে। রাধা সেই দেওয়াল ভেঙে বেরিয়ে যায়। এমনকী সে ছুটে যায় গোষ্ঠে, অন্য রাখালদের দিকে চেয়ে থাকে, চোখের পলক পড়ে না, তখন তার সমস্ত শরীরটাই জিজ্ঞাসু।

সখীরা বলে, রাই, তুই কি শেষে পাগলিনী হবি?

যেন পাগলিনী হতে তার বাকি আছে? কখনও সে তমাল গাছকে কানু বলে ভুল করে। কখনও স্নান করতে নেমে যমুনার নীল জলকে এমন ভাবে আদর করে কিংবা সেই জলে মুখ রেখে সে এমন মধুরসবাক্য বলে যেন সে কানুর সঙ্গেই আছে!

এদিকে কানুরও সেই একই অবস্থা। এ এমনই এক তৃষ্ণা, যা প্রতি দিনই বাড়ে এবং বেড়েই চলে। এবং যতই বাড়ুক এর আকৃতি কখনও বিরাট বা বেঢপ হয় না। এই তৃষ্ণার কোনও ক্ষয়কারী শক্তি নেই, তাই মনপ্রাণ এমন মাতিয়ে রাখে। এক বেলা দেখা না হলেই বেঁচে থাকার আর যা-কিছু সরঞ্জাম, সব তুচ্ছ হয়ে যায়। রাধা যখন কানুকে দেখতে পায় না তখন আসলে কানু দিগভ্রান্ত হয়ে অন্য কোথাও রাধাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

সখারা বলে, কানু, তুই শুধু এক জনের জন্য আমাদের সবাইকে ছাড়লি! কিন্তু আমরা তোকে ছাড়ব না।

এখন রাধার সখীরা এবং কানুর সখারাই ওদের দু’জনের জন্য দূতিয়ালি করে। নিজেরাই তৈরি করেছে নানা রকম সংকেত। খবর পৌঁছোতে আর দেরি হয় না।

সে রকম কোনও কোনও রাতে ওদের দেখা হয় অরণ্যের মধ্যে সেই নিভৃত কুঞ্জে। রাধা সেদিন চুলে ধূপের গন্ধ দিয়ে সুন্দর করে খোঁপা বাঁধে। যদিও জানে, একটু পরেই সব চুল আলুলায়িত হয়ে যাবে। প্রথমে একটা গাঢ় নীল রঙের শাড়ি পরে, তার ওপর একটা অতি সূক্ষ্ম লাল রঙের রেশমি বস্ত্র জড়িয়ে নেয়—যাতে লালের মধ্য থেকে নীলের আভা ফুটে বেরোয়। সখীরাই এই ভাবে সাজিয়ে দেয় তাকে। বনপথে ছুটে যেতে যেতে সেই বস্ত্র যে একটু পরেই ছিঁড়ে যাবে সখীরা তা জানে না! কোনও সখী তাকে শিখিয়ে দেয়, শোন রাই, আগেই গিয়ে কানুর কাছে আত্মসমর্পণ করবি নে! মেয়েদের একটু গুমর থাকা ভালো। আগে মুখ ফিরিয়ে বসে থাকবি, কানুকে দিয়ে পায়ে ধরে সাধাবি! বক্রবাক্য বলে তাকে চটিয়ে দিবি, বুঝলি? রাধা শান্ত মেয়ের মতন মাথা নেড়ে বলে, আচ্ছা!

কিন্তু যখন সে কানুর কাছে ছুটে যায়, তখন আর এসব কিছুই মনে থাকে না। কানুর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে, তুমি আমায় নাও। তুমিই আমার জীবনসর্বস্ব! অন্য মানুষের কত কী থাকে, কিন্তু আমার তো তুমি ছাড়া আর কিছু নেই!

কানু বলে, রাধা, আমি তোমার কাছ থেকে সব নিই, নিজে ধনী হব বলে! আমি তো নিঃস্ব, তোমার কাছ থেকে না নিলে আমি ধনী হব কী করে? আর ধনী না হলে তোমায় কী দেব? আমি যে তোমাকেই সব দিতে চাই!

এক সময় রাধা আর কানুর যেন একই শরীর হয়ে যায়। একই রকম ব্যথা-বেদনা-আনন্দ। রাধার স্তনে কানুর দাঁত ও নখরে যখন একটা রক্তের ফুল ফুটে ওঠে, রাধা নিজেই তার সৌন্দর্যে মোহাভিভূত হয়ে যায়। কখন রাত কেটে যায় কেউ টের পায় না।

রাধার বাড়িতে এখন ননদিনীর কঠিন প্রহরা। রাধা সম্পর্কে নানা রকম কানাঘুষা সে শুনেছে, নিজেরও সন্দেহ এখন পাকা—সব সময় তক্কে তক্কে থাকে হাতেনাতে ধরে ফেলার জন্য। কিন্তু বুড়িমা আড়াল করে রাখে রাধাকে। রাধার সখীরা এবং রাখালরা মিলেও ননদিনীর চক্ষে ধুলো দেয় বার বার।

এক মাঝরাত্রে ননদিনীর ঘুম ভেঙে গেল। কী যেন শোনার চেষ্টা করল কান পেতে। কোনও শব্দ নেই, এমনকী ঝিঁঝির ডাক বা মর্মরধ্বনি পর্যন্ত স্তব্ধ। এই স্তব্ধতাটাই যেন সন্দেহজনক। সন্ধ্যাবেলা থেকে অনেক রাত পর্যন্ত দূরে কোথায় যেন বাঁশি বাজছিল একটানা। এখন সেই বাঁশিও থেমে গেছে কেন?

ধড়মড় করে উঠে সে চলে এল রাধার ঘরে। শূন্য শয্যা। তার ওপর লম্বা হয়ে পড়েছে চাঁদের আলো, দেখে মানুষ বলে ভ্রম হয়। ননদিনী হাত দিয়ে সেই শূন্যতা স্পর্শ করে দেখল। রাধার গায়ের অলংকারগুলি কেন খুলে রাখা আছে বিছানায়? সে ‘দাদা’ ‘দাদা’ বলে চেঁচিয়ে আয়ানের ঘরের দোরে ধাক্কা মারল। নিশ্চিন্ত নিদ্রায় নিমগ্ন ছিল আয়ান। কোনও দিন এই ভাবে কেউ ডেকে তার ঘুমের ব্যাঘাত করেনি। আয়ান দরজা খুলে বাইরে আসবার পর তার বোন বলল, তোমায় বলেছিলাম না? আজ মিলিয়ে দেখো!

এর আগেই ক’দিন ধরে ননদিনী তার দাদার কাছে রাধা সম্পর্কে লাগানিভাঙানি দিতে গিয়েছিল। আয়ান বিশেষ কান দেয়নি। আজ এত রাত্রে বোনের এতখানি গরজ দেখে সে আর উড়িয়ে দিতে পারল না। প্রথমে সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখল। রাধা সত্যিই কোথাও নেই।

তখন আয়ান জিজ্ঞেস করল, সে কোথায় গেছে, তুই জানিস?

ননদিনী বলল, শুনেছি ওরা বনের মধ্যে একটা রমণকুঞ্জ বানিয়েছে! লোকে বলে, আমি তাতে বিশ্বাস করিনি।—

কোথায়? চল।

পদপাতে ভূমি কাঁপিয়ে আয়ান চলল বনের দিকে। তার এক হাতে খড়্গ। অবারিত জ্যোৎস্নায় আয়ানের দীর্ঘ শরীরের দীর্ঘতর ছায়া পড়েছে পথে। তার ছোট বোন দৌড়ে দৌড়ে এসেও তার সঙ্গে তাল রাখতে পারছে না।

খানিকটা গিয়ে আয়ান থমকে দাঁড়াল, কুঁচকে গেল ভুরু। যদি সত্যিই দেখা হয়ে যায়? যদি সত্যিই চোখের সামনে প্রমাণিত হয়ে যায় যে রাধা কলঙ্কিনী? না, না, থাক। লোকের মুখে শোনা এক কথা আর নিজের চোখে দেখা অন্য জিনিস। চোখে দেখার পর আয়ান কী করবে?

.

দাদা, থামলে কেন? আরও যে অনেকটা দূর!

বোনের কথায় আয়ান আবার চলতে শুরু করে। বোনকে সে কী বোঝাবে তা ভেবে পায় না। রাধার বিয়ের সময়কার মুখখানা তার মনে পড়ে। স্বর্ণময়ী কিশোরীর অপাপবিদ্ধা মুখ, প্রথম দিন সেই মুখ দেখে আয়ানের কষ্ট হয়েছিল। আজও বুকটা টনটন করে। ওই মেয়ের যোগ্য সমাদর কি সে করতে পেরেছে? কিছুই পারেনি।

বনের মধ্যে আলো-ছায়ার আঁকিবুকি। পায়ের চাপে শুকনো পাতা ভাঙার শব্দ হয়—হঠাৎ ভয় পেয়ে ডেকে ওঠে দুটো-একটা রাতপাখি। আয়ান আবার একবার থেমে গিয়ে বলে, আর যাব না!

বোন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, কেন দাদা, আর তো বেশি দূর নেই।

আয়ান বলল, থাক। এ শুধু মরীচিকার পেছনে ছোটা।

না, দাদা, আমি ঠিক জানি।

আয়ান বোনকে এক ধমক দিয়ে বলল, বিশ্বসুন্ধু লোক বললেও আমি রাধাকে অবিশ্বাস করি না।

যদি নিজের চোখে দেখো?

দেখব না!

আমি বলছি তুমি ঠিক দেখতে পাবে। আর একটু চলল…

দেখব না!

তার মানে? তুমি ইচ্ছে করেই দেখতে চাও না?

না, না চল—

আরও একটু দূর যাবার পর আয়ানের বোন আঙুল তুলে দেখাল, ওই যে পর পর কয়েকটা কদম্ব গাছ, ডালপালা দিয়ে বেঁধে মাঝখানটা ঘিরে রাখা হয়েছে, ঠিক যেন একটা ঘর দেখছ, আমি তবে ঠিকই শুনে ছিলাম—একটু একটু শব্দও শোনা যাচ্ছে—

আয়ান কঠোর ভাবে বলল, তুই এখানে দাঁড়া, তোকে আর একটুও যেতে হবে না!

আয়ান মন্থর পায়ে হেঁটে গেল সেই ঝোপের দিকে। বার বার মনে মনে আওড়াতে লাগল, সব যেন মিথ্যে হয়!

ঝোপের কাছে এসে পাতার ফাঁক দিয়ে দেখবার চেষ্টা করল। বেশি চেষ্টা করতে হল না, অচিরেই দেখা গেল।

একটি কদম গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক জন মানুষ। নবীন মেঘের মতন গায়ের রং। একটি পীতরঙের উত্তরীয় জড়ানো। মাথায় চুল চূড়া করে বাঁধা। তার মুখখানা ভালো দেখা যায় না, তার একটি হাত সামনে বাড়ানো। সেই হাতখানাই যেন বিশ্বের সেরা শিল্পীর গড়া। যেমন কোমল তেমনি দৃঢ়। সেই পুরুষের পায়ের কাছে বসে আছে রাধা।

রাধার মাথার চুল খোলা, আঁচল বিস্রস্ত, পুরুষের পা জড়িয়ে ধরে আছে সে ব্যাকুল মিনতির ভঙ্গিতে, মুখখানা ওপরের দিকে তোলা, কুরঙ্গিনীর মতন চোখ দু’টি সেই পুরুষের মুখে স্থির।

আয়ানের প্রথমেই মনে হল, এরকম অপরূপ দৃশ্য সে জীবনে দেখেনি। সে তো সারা জীবনটা শুধু বিষয়কৰ্ম বা পুজোআচ্চা করেই কাটাল। সে তো জানতেই পারেনি, মানুষ কখনও মানুষের দিকেও অমন করে চায়! এই রাধা তার এতদিনের চেনা, কিন্তু এখন যেন একেবারে অচেনা হয়ে গেছে।

মনে হয় ওদের দু’জনের যেন বাহ্যজ্ঞান নেই। আয়ান বা অন্য কেউ যে এসেছে কাছাকাছি, সে-দিকে কোনও হুঁশই নেই—শুধু সেই বিভোর দৃষ্টিতে পরস্পরের দিকে চেয়ে দেখা। আয়ান অপেক্ষা করল, ওদের মুখ থেকে কথা শোনবার জন্য। আশ্চর্য, মুহূর্ত পল কেটে যায়, ওরা একটাও কথা বলে না। একটু নড়ে না পর্যন্ত!

আয়ানের গা ছমছম করে উঠল। সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই অলৌকিক নয় তো? এই নিঝুম মধ্য রাত, জ্যোৎস্নাময় অরণ্য, তার মধ্যে নিথর নির্বাক দুই মূর্তি। প্রাণবন্ত যে তাতে কোনও সন্দেহ নেই; আয়ান ওদের ত্বকের চিক্বণতা পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু এমন স্পন্দনহীন, শব্দহীন হয়ে স্থির হয়ে আছে কেন? পুরুষটি কি তার হাত বাড়িয়ে অভয় দিচ্ছে রাধাকে? কিন্তু রাধার চোখে তো ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই। রয়েছে আকূতি। সব মিলিয়ে যেন এক পবিত্র সৌন্দর্য।

আয়ানের খড়্গসমেত হাত ওপরে উঠল না। রাধাকে সে ডাকতেও পারল না। পায়ে পায়ে পিছিয়ে এল। খানিকটা পরে সে উলটো দিকে ফিরে গতিবেগ বাড়াল।

তার বোন তাকে প্রায় ঘোরগ্রস্ত অবস্থায় ছুটতে দেখে ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হল? কী দেখলে দাদা?

আয়ান বলল, কিছুই দেখিনি! চল।

যত জোরে এসেছিল, তার চেয়েও বেশি গতিবেগে আয়ান ফিরে গেল বাড়িতে। সোজা গিয়ে ঢুকল তার পুজোর ঘরে। কালীমূর্তির সামনে জোড়াসনে বসল চোখ বুজে। তবু তার বন্ধ চোখ দিয়েও টপ টপ করে গড়িয়ে পড়তে লাগল জল। সারা রাত ধরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *