০৭. হেঁটে আসতে লাগল রাধা

সন্ধ্যা হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। ধুলোভরা গ্রাম্য পথ ভিজিয়ে দিচ্ছে জ্যোৎস্না। চার দিক সুনসান। তার মধ্যে ভিজে শাড়ি-পরা, মাথায় ভিজে চুল নিয়ে হেঁটে আসতে লাগল রাধা। একা। তার পায়ের শব্দও শোনা যায় না।

গোকুলের পথ দিয়ে এই সময় কোনও নারী একা যায় না। রাধার নিজের কাছে নিজেকেই অপরিচিত মনে হয়। রাত্রির পথ তো সে কখনও চোখে দেখেনি। কোনও কোনও বাড়ি থেকে চেনা নারীকণ্ঠ শুনে তার আরও বিস্ময় জাগে। দু-একজন সখী আগেই ফিরে গেল কী করে? রাধা জানে না, বুড়ো মাঝি একটু পরেই তার নৌকো নিয়ে হাজির হয়েছিল ওপারে। সে বেচারির নৌকোর দড়ি খুলে কে যেন মাঝনদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল। অতি কষ্টে সেই নৌকো উদ্ধার করে এসে পৌঁছোতে তার দেরি হয়।

চিন্তামগ্ন ভাবে রাধা এসে দাঁড়াল বাড়ির সামনে। চার দিকে কাঠের প্রাচীর-ঘেরা বাড়ি। ভেতরে প্রশস্ত চত্বর, সেখানে তখনও কাজ চলছে। পাঁচ-সাতটা বড় উনুনে ঘি জ্বাল দেওয়া চলছে, তার তদা‌রকি করছে স্বয়ং আয়ান ঘোষ।

রাধা যখন বাড়ির মধ্যে ঢুকল, কাঠের দরজায় ক্যাঁচকোঁচ শব্দ হতেই আয়ান চোখ তুলে তাকাল। রাধার দিকে সে নির্নিমেষে তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত, কিন্তু একটি কথাও বলল না। অবনতমুখী রাধা পায়ে পায়ে চলে গেল ভেতরে।

এক ঘর থেকে তার ননদিনী বেরিয়ে এসে চমকে উঠে বলল, ওমা! এতক্ষণ কোথায় ছিলি, বউ?

রাধা উত্তর দিল না।

ননদিনী তার পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে বলল, একী, সারা গা ভেজা, মাথা-ভরতি জল—এই সন্ধেবেলা কোথায় ডুব দিতে গিয়েছিলি?

রাধা ব্যথাময় দু’টি চোখ তুলল। যদি কোনওক্রমে নিষ্কৃতি পাওয়া যেত। যদি কিছু সময়ের জন্যও তাকে একলা থাকতে দিত এইসময়।

রাধার একটা হাত ধরে ননদিনী আবার আঁতকে উঠল। হাতের সোনার কঙ্কণ কোথায়? গলার হার কই? পায়ের মলও তো নেই। দেখি কোমর দেখি! এটাও তো নেই। কোথায় গেল সব? তোকে ডাকাতে ধরেছিল নাকি?

আচ্ছন্ন গলায় রাধা বলল, হ্যাঁ, ডাকাত!

অ্যাঁ? কে? কোথায়? বল বল, এক্ষুনি দাদাকে ডাকছি। দেখি, কোন ডাকাতের সাহস আছে আয়ান ঘোষের ঘরণীর গায়ে হাত দেয়।

না, না, ডাকাত নয়, ডাকাত নয়!

তবে কে? চোর!

হ্যাঁ, চোর, না, তঞ্চক। না তাও নয়।

তবে কে?

ঝড়। খুব ঝড় উঠেছিল তো!

কখন ঝড় উঠল? আজ তো ঝড় ওঠেনি। ঝড়ে বুঝি গায়ের গয়না খুলে নিয়ে যায়!

না। ঝড়ও নয়। বলছি! আগে কাপড় বদলে নিই!

রাধার সঙ্গে সঙ্গে ননদিনীও এসে ঢুকল তার ঘরে। দড়িতে মেলা শুকনো জামাকাপড় সেই আগে তুলে নিল নিজের হাতে। রাধার কৈফিয়ত না-শুনে দেবে না। তারপর বলল, আগে ঠিক করে বল কী হয়েছে? কোনও ভয় নেই। আমি দাদাকে বলব না—

রাধা বলল, একটা নীল কমল…

অ্যাঁ?

নৌকোয় করে আসছিলাম, একসময় দেখি যে জলে একটা নীলকমল ভাসছে। কী সুন্দর তার রূপ, এমন আর আগে দেখিনি। হাত বাড়িয়ে যেই সেটা ধরতে যাই, অমনি সেটা সরে যায়। একটু যেই বেশি ঝুঁকেছি, অমনি আমার গলা থেকে হারটা খসে গেল। সেটা তোলার জন্য জলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম—

কী সর্বনেশে কথা! তারপর?

তখন দেখি, সেই পদ্মের মৃণালে একটা সাপ জড়ানো। ভয় পেয়ে সেটা ছেড়ে দিলাম। তারপর সোনার হারের সঙ্গে আমিও ডুবতে লাগলাম। ডুবতে ডুবতে চলে গেলাম একেবারে নীচে, সেখানে দেখি জোড়াসন করে এক কিশোর বসে আছে। সে দেবতা না দানব, আমি জানি না। তাকে দেখে ভয় করে, আবার ভয়ও করে না। আমাকে দেখে সে অদ্ভুত ভাবে হেসে বলল, তোমাকে আমি মারতেও পারি, বাঁচাতেও পারি। আমি হাত জোড় করে বললাম, আমাকে বাঁচিয়ে দিন। সে বলল, তা হলে তোমার যথাসর্বস্ব আমাকে দাও! তাই দিলাম! একে একে আমার সব অলংকার খুলে…

আর কিছু দিসনি তো?

আমার আর কী আছে? দেখো না, আমার সর্ব অঙ্গে রিক্ততা ছাড়া এখন আর কি কিছু আছে?

বড় বাঁচা বেঁচে গেছিস তো আজ। শুনেছি জলের তলায় অনেক রকম অপদেবতা থাকে…তাকে দেখতে কেমন?

ঠিক যেন নতুন বর্ষার এক টুকরো মেঘ।

জলের মধ্যে মেঘ? তা হলে তুই দেখলি কী করে?

ভয় পেয়ে যখন চোখ বুজেছিলাম, তখন আরও ভালো করে দেখতে পাচ্ছিলাম।

ওমা, একী সাঙ্ঘাতিক কথা! শুনে আমারই যে বুক কাঁপছে, বউ! যাক বেঁচে গেছিস, এই ঢের। গয়নাগাঁটি গেছে যাক, তোর গয়নার অভাব কী?

এই রোমহর্ষক ঘটনার বিষয়ে ননদিনী আরও বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা চালাল। তারপর রাধাকে পোশাক বদলাবার জন্য একা রেখে বেরিয়ে গেল বাইরে।

তখন রাধা দরজায় আগল দিয়ে কাঁদতে বসল। তাকে এখন অনেক কান্না কাঁদতে হবে। দুঃখের কান্না, সুখের কান্না। এরপর রাধা আর সহজে বাড়ির বাইরে বেরোতে চায় না। শরীর খারাপের অজুহাত দেয়। একা একা গবাক্ষের ধারে বসে থাকে। কেউ তার অন্তরের ব্যথা বোঝে না। কেউ তাকে ডাকলেও তার কানে আসে না। তার আহারে রুচি নেই। সাজসজ্জায় মন নেই। একটা গেরুয়া গেরুয়া শাড়িতে তাকে যোগিনীর মতন দেখায়। কখনও সে বেণীবন্ধন খুলে নিজের চুলের দিকে তাকিয়ে থাকে, কখনও তার চোখ চলে যায় আকাশের মেঘের পানে, আর অমনি দীর্ঘশ্বাস পড়ে। তাদের পোষা ভবন-শিখী দু’টি যখন খেলা করে, তখন রাধার দৃষ্টি স্থির হয়ে থাকে শুধু তাদের কণ্ঠের ওপর। ময়ূরকণ্ঠী রং দেখলেই বুঝি তার বুক কাঁপে।

.

এ-বাড়িতে একটা খুব বুড়ি স্ত্রীলোক থাকে। তার সঙ্গে কার যে কী সম্পর্ক তা বলা দুষ্কর। সবাই তাকে বুড়িমা বলে ডাকে। মানুষটি বড় স্নেহপ্রবণা। বিয়ের পর থেকেই রাধা তার কাছে অনেক সুখ-দুঃখের কথা বলে।

সেই বুড়ি একদিন এসে বলল, ওলো নাতনি, তোর কী হয়েছে বল তো?

রাধা উত্তর দিতে পারে না। তার নয়নে জল, কষ্ঠে বাষ্প এসে যায়।

বুড়ি রাধার গা ছুঁয়ে বলল, ক’দিন ধরেই দেখছি, তুই ভালো করে খাস না, আমার কাছে চুল বাঁধতেও আসিস না! এই কদিনেই কী ছিরি হয়েছে দেখ তো! আগে তুই ছিলি একটা সোনার ফুল, এখন হয়েছিস দড়ি! কেন এমন করছিস, মা!

রাধা বুড়িমাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ফেলে।

বুড়ি পরম স্নেহে তার পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। আস্তে আস্তে বলে, তুই কি আমাকেও কাঁদাবি! জানিস না, আমি চোখের জল সইতে পারি না। তোর কী হয়েছে, আমাকে বল না!

বুড়িমা, আমার মরণ হয় না!

যুবতী মেয়ের তো দু’রকম মরণ আছে। তার মধ্যে এই মরণ তো খুব সুখের। দেখি, দেখি, মুখটা তোল দেখি তুই কোন মরণে মরেছিস?

রাধা আরও বেশি করে মুখ লুকোয়।

বুড়িমা জোর করে রাধাকে স্নানে পাঠায়। রাধা কিছুই খেতে চায় না, বুড়িমা জোর করে তার মুখে অন্ন তুলে দেয়। একদৃষ্টে চেয়ে থাকে রাধার মুখের দিকে। তার চোখ দিয়ে ঝরে পড়ে বহুকালের পুরনো স্নেহ। এক সময় বুড়িমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাধাকে বলে, নাতনি, তোর দুঃখ আমি বুঝি। বৃষ্টি ছাড়া যেমন চাতকের তৃষ্ণা আর কেউ মেটাতে পারবে না, তেমনি তোর দুঃখও বুঝি একজনই ঘোচাতে পারে। সে কে? সে কোথায়?

একদিন বৃন্দা আর ললিতা এল এ-বাড়িতে বেড়াতে। রাধার শুকনো মুখ, স্থির দৃষ্টি আর রাঙা বাস দেখে তারাও খুব চকিত হয়ে গেল।

দুই সখী রাধার দু’ পাশে বসে ব্যাকুল হয়ে অনেক প্রশ্ন করতে লাগল। রাধা সহজে মুখ খুলতে চায় না।

তখন ললিতা একটু রেগে গিয়ে বলল, তোকে আর হাটের পথে দেখি না, খেয়াঘাটে দেখি না,—কোথাও দেখি না। তুই কি আর আমাদের সঙ্গে দেখা করবিই না ঠিক করেছিস?

রাধা বলল, না, আমি আর কোথাও যাব না। আমি আর কোনও দিন হাটে যাব না, খেয়া পারে যাব না! আমার ভয় করে!

কীসের ভয়?

মানুষের চোখের ভয়, মানুষের কথার ভয়!

তা হলে তুই অন্তত স্নানের ঘাটেও আয়! আমরা কত দিন কদমতলায় তোর জন্য দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করি।

রাধা কেঁপে উঠে বলল, না, না আমি কদমতলাতেও আর যাব না কোনও দিন।

ললিতা বলল, ভয়ে যেন তোর মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে! কেন কদমতলায় কি বাঘ এসেছে নাকি?

বৃন্দা বলল, হুঁ, কদমতলায় প্রায়ই একটা কালো রঙের বাঘ এসে বসে থাকে দেখছি আজকাল!

ললিতা বলল, খেয়াঘাটে সেই বাঘটাই আবার নতুন নেয়ে সেজে আসে!

বৃন্দা বলল, সেই তো আবার হাটের পথে দানী সেজে বসে। অবশ্য আমাদের সে কিছু বলে না। শুধু এক শিকারের দিকেই তার লোভ।

রাধা বলল, থাক থাক সে-কথা থাক!

বৃন্দা বলল, রাই, তুই মরেছিস বুঝি?

ললিতা বলল, না, না, রাই কিছু করেনি, সেই ছোঁড়াটাই তো জ্বালায়! সেদিন থেকে দেখছি, ছোঁড়াটা এসে জোর করে রাইয়ের ভার বইতে চায়। রোদ লেগে রাইয়ের সোনার অঙ্গ পুড়ে যাবে বলে মাথার ওপর সে এসে ছাতা ধরে, মুখে তাম্বুল গুঁজে দেয়, সেদিন থেকেই বুঝেছি, ছোঁড়া একেবার মজেছে। আমাদের তো কেউ কোনও দিন এমন করেনি! তোকেই শুধু সে কেন এত জ্বালায়?

বৃন্দা তাকে ধমক দিয়ে বলল, তুই থাম ললিতা, তুই কী বুঝিস? এক হাতে কখনও তালি বাজে না। রাইয়ের অবস্থা দেখছিস না! কানুর কথা তোলামাত্র ওর চোখের তারা ঘন ঘন কাঁপছে! দীর্ঘশ্বাস পড়ল ক’বার! দেখ না, ওর গায়ের তাপ কতখানি বেড়েছে। যেন ওর দেহপিঞ্জরটা এখানে পড়ে আছে, প্রাণপাখি চলে গেছে অন্য কাকে খুঁজতে।

ললিতা বলল, সই, আমাদের রাধাকে অমন করে বকিসনি। রাই কোনও দিন আন-পানে তাকায়নি, কোনও দিন একবারও মুখ তুলে কথা বলেনি। কুলের মান রাখতে রাখতেই ও তো এতদিন কাটাল।

বৃন্দা বলল, সে যাই বলিস, এবার কিন্তু রাই মরেছে! যেদিন সেই কালো ছোঁড়া নৌকোয় তুলে নিয়ে গেল সইকে, সেদিনই বুঝেছি সই এবার ডুবল।

ললিতা বলল, বালাই ষাট, আমাদের সই ডুববে কেন? আমরা তাকে বাঁচাব।

বৃন্দা হেসে ফেলে বলল, ললিতে, তুই তো সে-ডোবার স্বাদ জানিস না, তুই কী বুঝবি? সে-ডোবা থেকে কেউ বাঁচতে চায় না!

রাধাকে নীরব দেখে বৃন্দা এবার ফিসফিস করে বলল, সই, তোকে একটা কথা বলি! সে-ছেলেটাও কম যন্ত্রণা পাচ্ছে না। ক’দিন ধরে দেখছি, যেন একেবারে পাগল হয়ে গেছে। মাথার চুলে চুড়ো বাঁধে না, অন্য রাখালদের সঙ্গে ধেনু চরাতে যায় না। সকাল নেই, রাত নেই, মাঠেঘাটে গড়াগড়ি খায়, কখনও একমনে বাঁশি বাজাতে বাজাতে দণ্ড প্রহর পার করে দেয়। আমাদের দেখলেই সে ছুটে আসে, মুখের দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে থাকে যেন আমরা কিছু বলব। বুঝি, সে তোর কথাই শুনতে চায়। আহা, বড় কষ্ট হয় আজকাল ছেলেটাকে দেখলে।

মাটিতে নখ দিয়ে দাগ কাটতে কাটতে রাধা বলল, আমার পিতৃকুল, শ্বশুরকুল—দু’য়েরই সুনাম আছে। এতদিন আমি সেই দুকূল নির্মল রেখেছি, আমার কষ্টের কথা কাউকে বলিনি। এখন আমি কী করি বল তো? আমি নিজেকে কত কঠিন করে রেখেছি তাই বাইরে যাই না! অথচ ঘরকে মনে হয় অরণ্য। চন্দনও আমার উত্তপ্ত বোধ হয়। এখন আমি কী করি তোরা বলে দে?

বৃন্দা বলল, এ বড় কঠিন প্রশ্ন! কানাইকে আমরাও যেন নতুন করে দেখছি। আগে ওকে ভাবতুম উটকো ছোঁড়া। হঠাৎ কী রকম যেন বদলে গেল? ওই নবজলধর কান্তি, কপাট বুক, করিশুণ্ডের মতন হাত, গলায় গুঞ্জা ফুলের মালা—এমন পুরুষ আর কে কবে দেখেছে? ওর ওই দৃষ্টির বিদ্যুৎ তোকে ছুঁয়েছে, তোর বুঝি আর উপায় নেই!

রাধা বলল, আমি মনে-প্রাণে চাই, ওর সঙ্গে যেন আর আমার দেখা না হয়! যদি দেখা হয়, তবুও যেন প্রণয় অনেক দূরে থাকে। আর যদি প্রণয়ই হয়, তবে সখী তোদের বলি, আমার মতন আর কারওর যেন বিচ্ছেদ না হয়! এর কী অসহ্য জ্বালা, তোদের বোঝাতে পারব না। আর যদি বিচ্ছেদই হয় তবে যেন আর দেহ ধরতে হয় না। এর চেয়ে মরণ অনেক অনেক সুখের। সখি, আমাকে এমন কোনও ওষুধ দিতে পারিস যাতে আমার যৌবন জীর্ণ হয়ে যায়?

বৃন্দা বলল, এই মেরেছে! আমরা এলাম তোকে বকুনি দিতে, তার বদলে তুই-ই যে আমাদের কঠিন প্যাঁচে ফেলতে চাইছিস! না বাবা, উঠি! চল ললিতা।

ললিতা সরল বিস্ময়ে বলল, এ কেমন প্রণয় যাতে মানুষ মরতে চায়?

যার জন্য এই প্রণয়, তাকেই যদি না-পাওয়া যায়, তা হলে বাঁচতে কার ভালো লাগে?

কেন তাকে পাওয়া যাবে না? কানু ছোঁড়া তো মুখিয়ে আছে!

বৃন্দা আবার ললিতাকে ধমক দিয়ে বলল, তুই থাম তো, তোর আর বুদ্ধিসুদ্ধি হল না। রাধা পরের ঘরের বউ, তার প্রণয় যে শরীরের রোগ-ব্যাধির মতন লোকের চোখে পড়ে যাবে! সে যে দারুণ জ্বালা। সেই জ্বালার কাছে প্রণয়ের মতন কোমল কুসুমটি কি বাঁচে?

দুয়ারের কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে বৃন্দা দেখল, রাধা মূৰ্ছিতার মতন দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে বসে আছে। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর প্রবোধ দেবার সুরে বলল, সখি, যৌবনকে বিড়ম্বিত করিসনি। কাল থেকে আবার হাটের পথে আয়। আবার আমরা একসঙ্গে গান গাইব, যমুনায় জলকেলি করব, ফুলবাড়িতে চয়ন করতে যাব। কানু যদি কাছাকাছি থাকে তো থাক না। চোখের দেখায় তো দোষ নেই। শুধু একবার চোখের দেখাতেও তো অনেক সুখ!

চোখ বন্ধ রেখে রাধা শান্ত অথচ দৃঢ় স্বরে বলল, না। আমি যাব না। আমি আর কোনও দিন যাব না!

বৃন্দা আর ললিতা বেরিয়ে গিয়ে বনপথ ধরল। তাদের অনেকটা দূরে যেতে হবে। দু’জনেই গম্ভীর। রাধা তাদের প্রাণের সই। রাধার কষ্ট দেখে তাদেরও কষ্টের অবধি নেই। আজকাল রাধা সঙ্গে থাকে না বলে তাদের পথ দীর্ঘ মনে হয়। কথায় কথায় আর কৌতুক উচ্ছল হয়ে ওঠে না।

যমুনার ধারে ধারে সরু পথ। হঠাৎ এক জায়গায় একটা গাছের ডাল থেকে কানু লাফিয়ে পড়ল তাদের সামনে। ব্যাকুল ভাবে জিজ্ঞেস করল, ললিতা, বৃন্দা, তোমরা রাধাকে দেখতে গিয়েছিলে? সে কেমন আছে?

গোপিনী দু’জন প্রথমটা চমকে উঠেছিল। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বৃন্দা বলল, সে ভালো আছে। কিন্তু আমার সখীর খোঁজে তোমার কাজ কী!

কানু বলল, তার কাছে আমার একটা মূল্যবান জিনিস জমা আছে, তাই খোঁজ নিচ্ছিলাম?

রাধা আবার তোমার কী জিনিস নিয়েছে?

একটা মুক্তাফল, নদীর ধারে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম, তাই আমি ওর হাতে—

ললিতা বলল, বুঝেছি! এসব হচ্ছে ঠ্যাকারের কথা! আমাদের সখীর আর কাজ নেই, সে ওর জিনিস নিতে গেছে! সে রাজনন্দিনী, সে কিনা বাঁদরের হাত থেকে মুক্তো নিতে যাবে?

কানু তবু বলল, কেন, তোমরা ওর বুকের কাছে সেই মুক্তাফল দুলতে দেখোনি!

না দেখিনি! আমরা দেখলাম, সে নিজের জ্বালায় জ্বলছে। চন্দন তার কাছে বিষতুল্য। পবন যেন হুতাশন। সে চাঁদকে সূর্য মনে করছে। কানু, আমাদের সখী এখন জীবন্ত-মরা, তুমি তাকে আর দগ্ধ কোরো না।

বৃন্দা-ললিতা আবার হাঁটতে শুরু করতেই কানু তাদের পেছন পেছন এসে অনুনয়বিনয় করতে লাগল, বলো, বলো, রাধার কথা আর একটু বলো—

এক সময় বৃন্দা পেছন ফিরে মুখঝামটা দিয়ে বলল, আ মরণ! আমাদের বুঝি তাড়া নেই, আমাদের বুঝি কলঙ্কের ভয় নেই? সে তো মরতে বসেছে, কালাচাঁদ, তুমিও মরো!

কানু তাদের বারণ মানে না। ভিখারির মতন অনুনয়বিনয় করতে করতে অনেকক্ষণ ওদের পেছন পেছন যায়।

সন্ধ্যার সমস্ত কাজকর্ম সেরে তারপর আয়ান পুজোর ঘরে ঢোকে। সেখানে সে প্রত্যেক দিনই অনেকক্ষণ থাকে। কালীর পুজো সেরে বেরোতে বেরোতে তার মধ্যরাত্রি পেরিয়ে যায়। রাধা তখন নিজের খাটে ঘুমিয়ে থাকে। আয়ান এসে একবার স্ত্রীর শয্যার পাশে দাঁড়ায়।

রাধার চুলগুলি খোলা, ওষ্ঠে একটা পাণ্ডু রেখা, ঘুমন্ত অবস্থাতেও তার কপালটা একটু কুঁচকে গেছে, সেখানে দুঃখের ছায়া। ক্ষীণ চাঁদের আলো এসে পড়েছে তার বরতনুতে। রাধার সূক্ষ্ম নেত বস্ত্রের আঁচল মিশে গেছে সেই জ্যোৎস্নায়।

ডান হাত বাড়িয়ে আয়ান একবার আলতো ভাবে স্ত্রীর ললাট স্পর্শ করল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে এ-ঘর ছেড়ে চলে গেল অন্য ঘরে নিজের শয্যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *