০৬. গঞ্জের হাট

পরদিন ভোরবেলা কানু কাউকে কিছু না বলে চলে গেল নদী পার হয়ে। হাটে গিয়ে দু’-একটা জিনিসপত্র কিনে সে একটু সাজগোজ করল। তারপর, বনের ধার ঘেঁষে, পথ যেখানে খুব নির্জন, সেখানে একটা পাথরের ওপর বসে রইল গ্যাঁট হয়ে।

হাটের মানুষরা পথ দিয়ে যায়, আর কানুকে দেখে ফিরে ফিরে। কেউ তাকে চিনতে পারে না। তার মাথায় পাগড়ি, পায়ে কাঁচা চামড়ার নাগরা, কোমরে জরির কোমরবন্ধ। ঠোঁটের ওপর বেশ পুরুষ্টু একটা নকল গোঁপ লাগিয়েছে। হাতে একটা বিরাট ধারালো বর্শা। কানুর লোহার দরজার মতন বুক, শালপ্রাংশু বাহু, ওই রকম অপরূপ বেশে তাকে দেখে একটু ভয় করে!

এই পথেরই এক প্রান্তে গঞ্জের হাট, বহুকালের পুরনো। আশেপাশের অনেক গ্রাম থেকেই মানুষজন আসে। সারাদিন ধরে কেনাবেচা হয়। গ্রামের লোকের যা দরকার, তা এখানেই মেলে। আরও খানিকটা দূরে মথুরা নগরী। সে খুব জমজমে জায়গা। সেখানকার পথঘাটও নাকি কঠিন বাঁধানো! বাড়ির গায়ে বাড়ি। কথায় কথায় সেপাই-সান্ত্রী এসে ধমকে দেয়। গাঁয়ের লোক চট করে সেখানে যেতে সাহস করে না।

যথাসময়ে ব্রজের গোপিনীরা হাটে সওদা করার জন্য এল এ-পথ দিয়ে। তাদের দেখে কানু একটু নড়েচড়ে বসল। ওরা কাছাকাছি আসতেই সে উঠে পথের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে হুংকার দিয়ে বলল, এ সুন্দরী! সুন সুন! মো নাম হৃষীকেশ। মো-কে পুছ্‌ না করে চলে যাইছিস যে?

গোপিনীরা থমকে দাঁড়াল। একজন তার চিবুকে এক আঙুল ঠেকিয়ে, ভুরু তুলে বলল, ওমা! এ আবার কে? এই যমদূতটা আবার এখানে এল কোথা থেকে?

কানু জলদগম্ভীর স্বরে বলল, মোকে চিন্‌হো না? আমি মহাদানী। মো তুম্‌হারা সকলের পসরা দেখুঁ।

এক গোপিনী মুখঝামটা দিয়ে বলল, মরণ! তোমাকে কেন আমাদের পসরা দেখাতে যাব হে?

কানু কোমরে গোঁজা একটা লাল মলাটের খেরো খাতা বার করে বলল, এই দেখো পাঞ্জি! মহাদানীকে শুল্ক দিতে হয় জানো না?

এতদিন ধরে এই পথে যাচ্ছি-আসছি, কোনও দিন তো বাপু এমন কথা শুনিনি?

আগে না শুনেছ তো এখন শোনো!

গোপিনীরা এ-ওর মুখের দিকে তাকাল। হবেও-বা নতুন নিয়ম। তা ছাড়া এড়িয়ে যাওয়া যাবেই বা কী করে? পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্রমূর্তি ধরে।

কানাই একে একে তাদের পসরা পরীক্ষা করতে লাগল। এবং উদার ভাবে এক এক জনকে ছেড়ে দিয়ে বলল যাও, তুম্‌হারা কিছু লাগবে না। যাও তোমাকে আজ ছেড়ে দিলুঁ!

সব গোপিনীই মহাদানীর কাছ থেকে ছাড় পেয়ে গেল, পেল না শুধু রাধা।

কানাই রাধার পথরোধ করে দাঁড়িয়ে কর্কশ গলায় বলল, এর কাছে তো অনেক জিনিস দেখছি। বহুত দামি দামি সওদা। আবার হাতে-পায়ে কত গহনা। চুপড়ি নামাও, তোমার সব দেখব।

অন্য গোপিনীরা একটু দূরে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। কানু তাদের দিকে ফিরে এক ধমক দিয়ে বলল, যাও! তোমাদের যেতে বলেছি না?

এস্ত পায়ে তারা চলে গেল। সভয়ে বার বার পিছন ফিরে দেখতে দেখতে।

চুপড়ি বাসনপত্র নামিয়ে রাধা আড়ষ্ট ভাবে দাঁড়িয়ে আছে।

কানু তাকে ভারিক্কি গলায় জিজ্ঞেস করল, তুমি কে? তোমার ঘর কোথায়? কোন দেশে যাবে?

রাধা ক্ষীণ ভাবে উত্তর দিল, আমার নাম রাধা, গোকুলে থাকি, গোয়ালা জাতি, গোপিনীদের সঙ্গে আমি মথুরা হাটে যাচ্ছি। তুমি এসব কথা আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন?

আমি তোমার পসরা দেখব। তুমি কোন কোন বস্তু নিয়ে হাটে যাচ্ছ, আমাকে তার বিচার দাও!

ঘি, দই, দুধ আর ঘোল—এই আমার পসরা। তুমি কোন কারণে এর বিচার চাইছ?

এর চেয়ে বিস্তর বেশি মূল্যবান পসরা তোমার আছে।

কী? আমি তো জানি না!

তুমি তা জানবে না, অন্যরাই জানবে।

তুমি কীসের কথা বলছ?

তোমার রূপ।

এ আবার কী রকম কথা?

আমি তোমার রূপের জন্য ভিখারি হতে পারি।

তুমি মশানের ধারে গিয়ে ভিক্ষে করো গে, এই বিকট মূর্তি ধরে এখানে বসে আছ কেন?

রাগলে তোমার নীল কমলের মতো চক্ষু দু’টি কোকনদের (রক্তকমল) মতন দেখায়।

পথ ছাড়ো! এসব অল্পমতি কথা আমাকে শোনাও, তোমার সাহস কী।

তা হলে আমার শুল্ক দিয়ে যাও।

কী তোমার শুল্ক?

প্রতি ভাণ্ডে ষোলো পণ মহাদান দিয়ে তবে হাটে যাও!

বিস্তর কালে বিস্তর কথা শুনেছি, কিন্তু এমন বিপরীত কথা কখনও শুনিনি! এত দিন পর মথুরার হাটে হঠাৎ ঘি-দুধের মহাদানী নিযুক্ত হল?

নেকি রাধা, তুমি দেখছি বড় আবালী! এই পাঞ্জির প্রমাণ দেখছ না? আমি রাজার কাছ থেকে এই পথ জমা নিয়েছি!

রাধা বিরক্তি ও ক্রোধ নিয়ে তাকিয়ে রইল কানুর দিকে। এত বড় এক সা-জওয়ানকে সরিয়ে সে যাবেই বা কী করে? হতাশ ভাবে বলল, এত পণ আমি দেব কোথা থেকে? আমার কাছে নেই।

কানু সহাস্যে বলল, তোমার অনেক আছে। তোমার কাছে পণের টাকা যদি না থাকে, তুমি জিনিস দিয়ে তা শোধ করো!

কোন জিনিস!

বললাম তো আগে। রূপ!

ক্রুদ্ধা ফণিনীর মতন রাধা মুখ উঁচু করে কানুর চোখে চোখ রাখল। তারপর বলল, তোমার সাহস তো কম নয়! আমাকে এখানে একা পেয়ে তুমি এমন কথা বলছ! প্রান্তরে সোনার ঘট দেখে চোরের মন সাত-পাঁচ করে। তুমি দেখছি সেই চোর!

দু’ কোমরে হাত রেখে কানু হা-হা করে হাসতে লাগল শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে। রাধার ক্রোধ সে বেশ উপভোগ করছে! কৌতুক-চঞ্চল চোখে বলল, আমাকে তুমি চোর বলছ? এর উত্তর আমি তোমাকে দিতে পারি, কিন্তু এখন দেব না!

রাধা বলল, মর্কটের হাতে নারকোল পড়লে তার সেটা খাওয়ার জন্য খুব সাধ হয়। কিন্তু ভেঙে খাওয়ার সাধ্য তার নেই। তুমি সেই রকম একটি মর্কট। কিংবা তুমি একটি শিশু, তুমি আগুনকে ফুল ভেবে তাতে হাত দিতে চাইছ।

অত কথার প্রয়োজন কী? তুমি আমার পণ দিয়ে নিজের মান রক্ষা করো!

রাধা একটা ভাণ্ডের ঢাকনা খুলে বলল, ঠিক আছে, পণের বদলে আমি দ্রব্যই দেব! আমার দই-মাখনের অংশ দিচ্ছি, তাই নিয়ে তুমি দূর হও!

রাধা তার দ্রব্যসম্ভার ভাগ করতে বসল। খানিকটা বাদেই সে আবার বলল, কিন্তু তোমাকে আমার পসরার ভাগ দিয়ে দিলে বাড়িতে গিয়ে আমি হিসেব দেব কী করে?

কানু চট করে বলল, এমন দ্রব্যও তোমার কাছে আছে, যার কোনও হিসেব দিতে হয় না।

কী?

সত্যিই দেখছি তুমি নাবালিকা! কতবার করে বলতে হবে! সেই দ্রব্যের নাম রূপ।

রাধা দর্পিতার মতন উঠে দাঁড়াল। আস্তে আস্তে বলল, সাপের মাথায় মণি জ্বলে, বলপ্রকাশ করে কে নিতে পারে?

তারপর রাধা তার হাঁড়ি-কলসি সব উলটে দিল। দুধ-দই-ঘি-মাখন সব গড়িয়ে পড়ল পথের ধুলোর ওপর। সমস্ত পসরাই নষ্ট করে দিয়ে রাধা বলল, এবার? এবার তুমি কীসের জন্য পণ চাইবে?

স্তম্ভিত কানুকে সেখানে দাঁড় করিয়ে রেখে রাধা চলে গেল দৃপ্ত পায়ে।

অনেকক্ষণ ধরে তাকে দেখল কানু। আর অনুসরণ করল না। রাধা দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলে কানু মৃদু হেসে পাশের জঙ্গলে ঢুকল। আর এক এক করে খুলে ফেলল ছদ্মবেশ। সে-সব সেখানেই পড়ে রইল।

এক কৌশলে হল না দেখে ক’দিন পরে কানু আরেক কৌশল ধরল।

সেদিন ব্রজাঙ্গনারা হাট থেকে ফিরে এসেছে খেয়ার ঘাটে। হঠাৎ তারা অবাক হয়ে দেখে, তাদের চিরপরিচিত সেই বুড়ো মাঝি সেখানে নেই। তার নৌকোও নেই। তার বদলে একটা ছোট্ট ভাঙা নৌকো নিয়ে এক কচি চেহারার মাঝি দাঁড়িয়ে আছে।

আকাশে দলা দলা মেঘ। ফিনফিনে হাওয়া দিচ্ছে। বেলা পড়ে এসেছে। এর মধ্যেই একটু ছায়া ছায়া ভাব। সকলেরই বাড়ি-ফেরার তাড়া।

নবীন মাঝির চুল চুড়ো করে বাঁধা। কপালে ফেট্টি। তাম্বুল-রাঙা ঠোঁট, চাদর দিয়ে মুখের অনেকখানি ঢাকা। গোপিনীদের দেখে সে চেঁচিয়ে উঠল, গেল-গেল-গেল-গেল, কে পারে যাবে জলদি এসো, জলদি, জলদি—

গোপিনীরা বলল, এমা! এ আবার কী মাঝির ছিরি! আমাদের সেই মাঝি গেল কোথায়?

নবীন মাঝি বলল, বড় মাঝির উদুরি হয়েছে, সে আজ আর আসবে না। যেতে হয় তো জলদি করো! আমার এক কাহন করে পণ। তা আগে থেকে কয়ে দিলাম কিন্তু!

অ্যাঁ! এই তো ভাঙা নৌকো, তার আবার এক কাহন!

ভাঙা নাও দেখেছ, কন্নধারের গুণ তো দেখোনি!

এক গোপিনী আর এক জনকে বলল, কী জানি বাপু, কেলটে ছোঁড়ার নৌকায় উঠতে আমার ভয় করছে। শেষে ডুবিয়ে মারবে কিনা কে জানে!

অন্য গোপিনী রঙ্গ করে উত্তর দিল, এর জন্য কেউ আবার ইচ্ছে করেই ডুবে না মরে! নতুন কর্ণধারের মোহন রূপটি দেখেছিস? বুড়ো মাঝি ছিল বলেই আমাদের ওনারা এতকাল ভরসা করে ছেড়ে দিয়েছে!

অন্য সখী বলল, আমি কিন্তু অত কালো রং দেখে মজি না, ছুঁলে যেন হাতে কাঁচা রং উঠে আসবে।

আরেক জন বলল, ওরে, তোরা কি গল্প করেই বেলা পার করে দিবি? বাড়ি যেতে হবে না?

কিন্তু এর নৌকোয় যে বাড়ি ফিরতে পারব, তার ভরসা কী?

এ কি সেই বুড়ো মাঝির ছেলে? আগে তো একে দেখিনি?

কী ঠোঁটকাটা বাবা! প্রথমেই বলে কিনা এক কাহন পণ! আগে ভালোয় ভালোয় পারে পৌঁছে দেবে, তবে তো পণ চাইবে!

মাঝি চেঁচিয়ে বলল, যাবে কি যাবে না, সাফ কথা বলে দাও। আমার নাও এখুনি ছাড়বে!

তখন গোপিনীরা দেখল আর উপায়ান্তর নেই, প্রাণ সংশয় করে এই টুটোফুটো নৌকোতেই যেতে হবে। কখন ঝড়বৃষ্টি নামবে তার ঠিক নেই। সবাই হুড়মুড় করে চলে এল জলের কাছে।

মাঝি আঁতকে উঠে বলল, আরে, রও রও রও, করো কী, করো কী! সবাই মিলে উঠে কি আমার নাও ডোবাবে নাকি? আমার এ ভাঙা নাও-এ একবারে একজনের বেশি যায় না!

এই বলে সে টপ করে রাধার হাত ধরে টেনে তুলে নিল নৌকোর ওপর। তারপর পায়ের ধাক্কায় নৌকো কূল-ছাড়া করল। মুখ থেকে তার সরে গেছে চাদরের ঢাকনা।

তখন তীরের গোপিনীরা সবিস্ময়ে বলল, আরে, এ সেই কানু ছোঁড়া না? দেখেছ ছোঁড়ার কাণ্ড? গাল টিপলে দুধ বেরোয়, তার এত রস?

কানু ততক্ষণে পাকা মাঝির ভঙ্গিতে মুখ দিয়ে হে-হে লহে লহে লহে লহে লহে শব্দ করে খুব জোরে জোরে বৈঠা চালাচ্ছে। রাধা অবাক হয়ে দেখছে তাকে। কানুর সুঠাম শরীর, বালকের মতন মুখ, দুষ্টুমি-ভরা চোখ।

রাধা জিজ্ঞেস করল, তুমি তো কানাই! তুমি একী করছ?

কানু বলল, তোমাকে একলা নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছি!

ছিঃ, ও-কথা বলে না। তুমি এ রকম পাগলামি করছ কেন?

আমি তো পাগলই, কিন্তু তুমিই তার জন্য দায়ী।

ওমা, সে কী কথা? আমি তোমার কী করেছি?

তুমি আমায় সর্বস্বান্ত করেছ। এখন তুমিই আবার আমায় ধনী করতে পারো।

আমি সখীদের সঙ্গে হাটের পথে যাই-আসি। কোনও দিন তো অন্য কারওর পানে তাকাইনি। তুমি কেন আমায় দোষারোপ করছ? আমি তোমায় সর্বস্বান্ত করব কেন, পাগলই বা করব কী করে?

হ্যাঁ, তুমিই আমাকে পাগল করেছ। কালীয়দহের পাড়ে, সেদিন তুমি কেন অমন করে চোখ দিয়ে হেসে ছিলে? কেন তোমার এমন ভুবন আলো-করা রূপ? তোমার যাওয়া-আসার পথের ধারে আমি কত দিন দাঁড়িয়ে থেকেছি, তুমি ভ্রূক্ষেপও করোনি! যেন আমাকে দেখতেই পাও না। আসলে কিন্তু দেখতে পেতে। একদিন তুমি যমুনার ঘাটে যাচ্ছিলে, আমাকে দেখে কেশবন্ধনের ছলে কেন বাহু তুললে? সে-তো আমাকে পাগল করার জন্যই। মুখ মোছার জন্য তুমি যে-ই তোমার বুকের রেশমি আঁচল ঘোচালে, অমনি আমি তোমার কুচভার দেখলাম। তা দেখে আমি প্রায় মূৰ্ছিত হয়ে পড়ছিলাম। নদীতে জল তোলার সময়, তুমি যেন জলের সঙ্গেই চুপি চুপি মধুরসবাক্য বলছিলে—এসব কি আমাকে পাগল করার জন্য নয়?

রাধা এস্তে বলে উঠল, না, না, তুমি ভুল বুঝেছ। তুমি প্রায়ই আমাদের পেছনে পেছনে আসতে, সেদিন তোমাকে অত কাছাকাছি দেখে আমি ভয় পেয়ে দ্রুত যেতে গেলাম, সেইজন্য আমার কেশ এলিয়ে গেল। তাই দু’হাত তুলে আমি কেশ সংযত করেছিলাম। বাতাসে আমার বুকের আঁচল খসে গিয়েছিল, দৈবাৎ সেই সময়েই তুমি তাকিয়েছ। আমাকে দেখে যদি তোমার মন বিচলিত হয়, তবে তো আমার বেঁচে থাকাই উচিত নয়। আমি কি তবে আজ থেকে স্বেচ্ছাবন্দি হয়ে থাকব?

কিন্তু সেই সময় তুমি তোমার চোখ দু’টিও তরল করেছিলে।

চোখ তরল করেছিলাম? সে তো ভয় ও লজ্জায়।

না।

.

নিশ্চয়ই! কানু, তুমি এসব কী বলছ? আমি যমুনার জলের সঙ্গে তো মধুরসপূর্ণ কথা বলতেই পারি, কিন্তু তোমার সঙ্গে তা বলব কেন? তোমার জন্য এখনও আমি ভয় পাচ্ছি। যাকে আপদে পায়, সে নিজেকে চিনতে পারে না। তুমি মতিচ্ছন্ন-হেতু পাগল হয়েছ!

তা যদি সত্যও হয়, তবু এখন আমাকে আবার সুস্থ করে তোলার উপায়ও তোমার হাতে।

কী সে উপায়?

তোমার আলিঙ্গন।

লজ্জায় রাধার কর্ণমূল ও গালে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ল। মুখখানি যেন কুঙ্কুম-মাখানো স্থলকমল। সে কানুর দিকে আর ভালো করে তাকাতে পারল না। মুখখানি পাশের দিকে ফিরিয়ে জল দর্শন করতে করতে বলল, আমাকে ওসব কথা বোলো না, বলতে নেই।

কানু বলল, তুমি স্নানের ঘাট থেকে ফিরছিলে, আমি দেখেছিলাম। সে যেন আমার দিব্যদর্শন। তোমার ভিজে চুল দিয়ে জল ঝরছে, যেন মুখশশীর ভয়ে আঁধার কাঁদছে। মুখের ওপর এসে পড়েছে চূর্ণ অলক, যেন মধুলুব্ধ ভ্রমর। কুচ যুগল যেন দু’টি সুন্দর চক্রবাক—কোন দেবতা তাদের এনে মিলিয়েছে—আর পাছে উড়ে না যায় তাই ভুজপাশে বেঁধে রেখেছে। হাত দুটো যখন একটু সরালে, তখন আবার অন্য রকম মনে হল—যেন দুটো সোনার বাটি উলটো করে বসানো। কিংবা ঠিক হল না। তোমার পয়োধরের ওপর সিক্ত বসন—ঠিক যেন মনে হয় সোনার বেলফলের ওপর হিম পড়েছে। সত্যি এ রকম মনে হয়েছিল। তোমার মনে হচ্ছে না, এসব পাগলের প্রলাপ?

রাধা এবার সর্বাঙ্গ বসনে ভালো করে ঢেকে, বাহুতে মুখ লুকিয়ে বলল, কানু, এসব কথা তুমি কোথা থেকে শিখলে? আমাকে এসব বোলো না। আমি তোমার থেকে বয়সে বড়। তা ছাড়া সম্পর্কে তোমার আত্মীয়!

কানু ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, ইস ভারী তো আত্মীয়! সাতজন্মে দেখা নেই, তার আবার আত্মীয়তা! তুমি আমাদের বাড়িতে কখনও এসেছ?

কারওর বাড়িতে যাওয়া আমার নিষেধ।

তবে? আর বয়সের কথা বলছ? সুন্দরের কোনও বয়স আছে নাকি?

আত্মীয়তা যদি না-ও মানো, তবু এ-কথা তো মানবে যে আমি পরের ঘরণী?

হঠাৎ এই কথা বলে রাধা কেঁদে ফেলল। কানু সে-কান্নার মানে বুঝতে পারল না। সে রাধার কম্পিত শরীরের দিকে চেয়ে রইল।

রাধা আবার বলল, কানু আমার এমনিতেই অনেক কষ্ট। তুমি আর আমাকে কষ্ট দিয়ো না।

কানু বলল, আমার কষ্ট তোমার চেয়ে মোটেও কম নয়। তুমি তা বোঝে না, কারণ তুমি আমার দিকে চেয়ে দেখো না! সে যাই হোক, তুমি যেখানে ঘরণী আছ, তা থাকো— কিন্তু এখানে তো এটা কারওর ঘর নয়। এখানে মাথার ওপরে আকাশ, চারদিকে কোনও দেওয়াল নেই—এখানে আমার মনে হয়, আমিই সবকিছুর অধিপতি। এখানে তুমি আমার!

রাধা বলল, তুমি চোরের মতন আমাকে চুরি করে নিতে চাও! তোমার ছেলেবেলার অনেক দুরন্তপনার কথা শুনেছি—কিন্তু তুমি যে এ রকম চোর হয়ে উঠেছ, তা জানতাম না।

কানু মিটিমিটি হেসে বলল, তুমি এর আগেও একদিন আমাকে চোর বলেছিলে—

কবে আবার বললাম?

বলেছিলে, তোমার মনে নেই। সেদিন তোমায় উত্তর দিইনি। আজ দিই? আসলে তুমিই চোর।

আমি?

নিশ্চয়ই। তুমি, শ্রীমতী রাধা, একটি মস্ত বড় চোর।

আমি কবে কী চুরি করেছি?

শুনবে? তুমি রাজকন্যা কিনা, তাই তোমার পক্ষে চুরি করা অনেক সহজ। দেখো, তুমি স্বর্ণের বর্ণ চুরি করে নিজের অঙ্গে লুকিয়ে রেখেছ। চন্দ্রের কিরণ চুরি করে রেখেছ নিজের চন্দ্রাননে। মদনের ধনুকটা চুরি করে রেখে দিয়েছ ভুরুর মাঝখানে। বনের হরিণীর কাছ থেকে তুমি হরণ করেছ তার চোখ দু’টি। পক্ক বিম্বের শোভা চুরি করে তুমি রেখেছ তোমার ওষ্ঠে। কোকিলের স্বর চুরি করে রেখেছ নিজের কণ্ঠে। সাদা বেগুনের মসৃণতা চুরি করে তুমি রেখেছ তোমার চিবুকে। কোন মরালীকে নিঃশেষ করে তৈরি হয়েছে তোমার গ্রীবা। সুমেরু পর্বতকে বঞ্চিত করে শোভিত হয়েছে তোমার কুচযুগ। সিংহের কাছ থেকে চুরি করেছ তার কোমরের খাঁজ। গজের কাছ থেকে চুরি করেছ তার গতি। কদলীকাণ্ডের গড়ন চুরি করে রেখেছ নিজের উরুতে। তম্বুরা বাদ্য হরণ করে রেখেছ তোমার নিতম্বে। পদ্মফুলের কোমলতা রেখেছ তোমার পায়ে। একসঙ্গে এতগুলো চুরি আর কে করতে পারে? এর চেয়েও বড় কথা, তুমি চুরি করেছ আমার চিত্ত। তুমি আবার আমাকে চোর বলো?

আকাশে মেঘ জমাট হয়ে এসেছে। আর রাধার খুব কাছে নৌকোর ওপর বসে আছে এক মেঘবর্ণ যুবা। রাধার বুকের মধ্যে গুড়গুড় করে উঠল। এখনই বুঝি ঝড় উঠবে, শুরু হবে প্রলয়।

নৌকো রয়েছে মাঝনদীতে। কানুর আর নৌকো বাওয়ার দিকে মন নেই।

রাধা কানুকে কী উত্তর দেবে কিছুতেই ভেবে পেল না। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর সে হঠাৎ বলে ফেলল, আমার ভয় করছে।

কানু জল থেকে বৈঠা তুলে ফেলল। বাতাসের বেগ বেড়েছে, স্রোতের ধাক্কায় দুলতে লাগল নৌকো।

কানু হাসতে হাসতে বলল, আমি তো রয়েছি, ভয় কী! তুমি শুধু আমায় একটি বার আলিঙ্গন দাও!

যেন নিজেকেই বেশি করে শোনানো দরকার, সেইজন্য রাধা জোরে জোরে তিন বার উচ্চারণ করল, না, না, না!

দু’টি আঙুল তুলে, সামান্যতর ভঙ্গি করে কানু বলল, তুমি যদি আমাকে একটুখানি, এই এতটুকুও দয়া করো—

না, না, না।

দেখো, এই যে আকাশ, বাতাস, দশ দিক—এখন আমার মনে হয় আমিই এই সবকিছুর অধীশ্বর। আমার মনে এই জোর আছে যে আমি ইচ্ছে করলেই সব কিছু পেতে পারি। সেই আমি, তোমার কাছে দয়া চাইছি। তুমি আমার হও।

তা হয় না, কানু, তোমার সঙ্গে আমি কথায় পারব না— কিন্তু তুমি আমাকে আর কষ্ট দিয়ো না!

কানুর তন্ময় ভাবটা কেটে গেল, আবার জেগে উঠল তার মধ্যে দুর্দান্তপনা। সে ইচ্ছে করে পা দিয়ে নৌকোটা দুলিয়ে দিল। তারপর কড়া গলায় বলল, শোনো রাধা, ভালোমানুষের ঝি, তোমাকে একটা কথা বলি! দেখো, শনশন করে বায়ু বইছে, আমার ফুটো নৌকো দিয়ে কলকল করে জল উঠছে, এখন যদি আমার কথা না শোনো, তা হলে নৌকো ডুবে গেলে আমি দায়ী হব না!

রাধা ব্যাকুল ভাবে বলল, না, না, এই গহীন নদীতে ডুবে গেলে আমি আর কূল পাব না।

ডুবতে তোমাকে হবেই মনে হচ্ছে।

কানু, তুমি আমাকে বাঁচাবে না?

তোমাকে বাঁচাবার জন্যই তো আমি এসেছি। কিন্তু সেজন্য আমাকে অবলম্বন করে থাকতে হবে তোমায়। আমাকে শক্ত করে ধরে না-থাকলে স্রোতে তোমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে যে।

কানু, তুমি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ! তুমিই তো আমাকে জোর করে তুলে এনেছ নৌকোয়!

আমি না-আনলে তুমি নদী পার হতে কী করে?

কিন্তু এখন মাঝনদীতে তুমিই আমাকে ডুবিয়ে দিতে চাইছ।

ডুবতে গেলে মাঝনদীতেই ডোবা ভালো।

না, কানু, আমি ডুবতে চাই না। কেন ডুবব?

ভয় নেই, ডুবলে আমরা দু’জনেই ডুবব, বাঁচলে আমরা দু’জনেই বাঁচব। তুমি আমায় ধরে থাকো।

দেখো, নদীতে কত খরস্রোত। নৌকোটা জোরে জোরে দুলছে। তোমার এই ভাঙা নৌকোয় এক্ষুনি বুঝি জল উঠবে।

নৌকো ভাঙা হোক না, আমি মাঝিগিরি জানি ভালো। তুমি ভয় পেয়ো না। আমিই তোমাকে তোমার সঠিক ধামে নিয়ে যেতে পারি।

সে যে অনেক দূর। এ-নৌকো কি তত দূর পৌঁছোবে?

তোমার সঙ্গে এত চুপড়ি-প্যাঁটরা, তাই তো নৌকো বেশি ভারী হয়ে গেছে!

কানু আবার ইচ্ছে করে জোরে নৌকোটা দুলিয়ে দিল।

রাধা সঙ্গে সঙ্গে বলল, ফেলে দিচ্ছি, আমার বাসনপত্র ফেলে দিচ্ছি জলে।

রাধা নিজে একটা দধিভাণ্ড জলে ফেলে দিতেই কানু উৎফুল্ল ভাবে অন্য হাঁড়ি-কলসিগুলোও জলে ছুড়ে ফেলতে লাগল।

কিন্তু দুষ্টু কানু তাতেও যেন ঠিক সন্তুষ্ট নয়। সে কপট দুশ্চিন্তার সঙ্গে বলল, উঁহু! এখনও যেন নাওটা ভারী ঠেকছে!

রাধা বলল, আমার যা-কিছু ছিল সবই তো ফেলে দিয়েছি!

কানু বলল, না তো! সব তো দাওনি। ওই যে তোমার গলায় রয়েছে মুক্তামালা। বাজুতে সোনার তাগা। কোমরের গোঠ, পায়ের মল। ওগুলোও কি কম ভারী নাকি? দেখো, আমি রাখাল, আমার কিছুই নেই। তোমার এত কিছু আছে বলেই তো এত জ্বালা!

রাধা গা থেকে একটি একটি করে অলংকার খুলতে খুলতে পরম মায়াভরে বলল, এগুলো সবই ফেলে দিতে হবে?

তা তো হবেই!

সব অলংকার টুপটাপ করে খসে পড়ল যমুনার জলে। তবু নৌকো টলমল করে!

কানু বলল, এখনও একটু ভারী ভারী লাগছে!

রাধা জিজ্ঞেস করল, এবার তো আমার যথাসর্বস্ব জলাঞ্জলি দিয়েছি! তবু কেন ভয় দেখাও?

না, সব তো দাওনি!

দিইনি? আর কী বাকি আছে?

লাজলজ্জা!

পরক্ষণেই নৌকো এমন ভয়ংকর ভাবে দুলে উঠল যে রাধা আর পারল না। মহা ত্রাসে সে উঠে এসে দু’ হাতে কানুকে জড়িয়ে ধরল।

কানুর চোখে, ওষ্ঠে, চিবুকে, বুকে, সারা শরীরে, এমনকী মাথার চুলে পর্যন্ত খুশি উছলে উঠল। সে বলল, আমাকে এমন ভাবে যদি ধরে থাকো, তা হলে আমি তোমাকে যে-কোনও নদী পার করে দিতে পারি।

কানুর কাঁধে গণ্ড স্থাপন করে রাধা আবেশভরে বলল, আমি প্রাণ-ভয়ে যদি তোমাকে আলিঙ্গন করি, তাতে কি কোনও পাপ হয়?

কানু বলল, কী জানি, পাপ-পুণ্যের কথা অন্য লোকে ভাবে। ওসব আমি জানি না। ওসব আমার মাথাতেই আসে না!

তারপর সহর্ষে, রাধাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, কানু পায়ের ধাক্কায় নৌকোটা উলটে দিয়ে জলে লাফিয়ে পড়ল।

মরকতমণি দিয়ে গড়া তরণীর মতন কানু ভাসতে লাগল জলে। তার বুকের ওপর রাধা যেন এক অজানা দেশের শ্বেতহংসী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *