০৪. কৈশোর ছাড়িয়ে কানু

কৈশোর ছাড়িয়ে কানু এখন সদ্য যৌবনে পা দিয়েছে। অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে সে এখন ছটফটিয়ে মরে। ব্রজ-বৃন্দাবনের সব মানুষ এখন দুর্দান্ত-দুঃসাহসী হিসেবে কানুকে এক ডাকে চেনে। অনেকেই তাকে ভয় পায়।

সবচেয়ে বেশি ভয় মা যশোমতীর। একসময় কানুর বিপদের কথা ভেবে যশোমতী ভয় পেত কংসের সৈন্য কিংবা দৈত্য-দানোর। এখন তার ভয়, কানু নিজেই কবে কোথায় কোন গণ্ডগোল বাধিয়ে বসে।

রাখাল দলের সকলেই তার বশ্যতা পুরোপুরি মেনে নিয়েছে। কানু এখন তাদের একচ্ছত্র অধিপতি। একমাত্র বলরামই কোনও দিন কানুর সঙ্গে শক্তি পরীক্ষায় নামেনি, বরং ছোটভাই হিসেবে তাকে সস্নেহ প্রশ্রয় দেয়, কানুর যে-কোনও কাজে সে নিঃশব্দে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে।

শুধু রাখালি করে তাদের আর আশ মেটে না। তারা এখন নৌকো বায়, ওপারের হাটে গিয়ে উপদ্রব করে। শোনা যায়, তারা হাটের দোকানি-পসারিদের কাছ থেকে নানান ছুতোয় সওদাপত্তর কেড়েকুড়ে নেয় মাঝে মাঝে। আলটপকা কোনও বিদেশি পথিককে নাজেহাল করে ঠেলা দিয়ে। ক্রমেই কানুর অহমিকা বাড়ছে।

.

এক অপরাহ্ণে কানু সদলবলে ফিরছে গোষ্ঠ থেকে, এমন সময় দেখল আভীরপল্লির বাইরে, প্রান্তরের মধ্যে একটি বেশ বড় পূজার আয়োজন চলেছে। বয়স্ক পুরুষ ও নারীরা সেখানে সমবেত, সকলেরই পরনে পট্টবস্ত্র। বড় বড় কাঠের বারকোশে সাজানো রয়েছে ফলমূল। আর কত রকম ক্ষীর-ছানা-নবনীর মিষ্টান্ন। নরম মাটিতে সার দিয়ে দিয়ে ধূপকাঠি পোঁতা। সেগুলিকে ঘিরে গোল করে সাজানো অসংখ্য মাটির প্রদীপ। এত আয়োজনেও সবকিছু সম্পূর্ণ হয়নি, এখনও অনেকে বাড়ি থেকে নিয়ে আসছে পূজার সম্ভার।

পুরুষেরা একটু দূরে সারিবদ্ধ ভাবে হাঁটুগেড়ে বসা। সকলেরই যুক্তকর। তাদের মাঝখানে বেশি করে চোখে পড়ে আয়ান গোপকে। তার সুঠাম বলশালী শরীর, উন্নত মস্তক। ডান বাহুতে বাঁধা একটা সোনার তাগা। তার মুখখানি থমথমে গম্ভীর। ইদানীং আয়ান কারওর সঙ্গে মেশে না। ক্কচিৎ তাকে জনসমাগমে দেখা যায়। তার কোনও প্রিয় সুহৃদ নেই, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গেও সে প্রায় সম্পর্ক ছেদ করেছে। আয়ানের এই পরিবর্তনের মর্ম কেউ বুঝতে পারে না। শুধু পুজো-আচ্চার ব্যাপারেই তার উৎসাহ এখনও কমেনি।

রাখালেরা সবাই একধারে দাঁড়াল। কৌতুক দেখার ভঙ্গিতে কানু কোমরে হাত দিয়ে রয়েছে। ফিসফিস করে সে সুদামকে জিজ্ঞেস করল, হঠাৎ এ সব কী হচ্ছে রে?

পূজা-স্থানের মাঝখানে একটা লাঠি পোঁতা। সেই দিকে ইঙ্গিত করে সুদাম বলল, ওই যে দেখছিস না, ওটার নাম ইন্দ্রাযষ্ঠি। আজ ইন্দ্রের পুজো হবে।

কেন?

পর পর দু’বছর যে খরা গেল! ইন্দ্রের পুজো না করলে আর বৃষ্টি হবে না!

কানু এমন জোরে হা হা করে হাসল যে অনেকেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল তার দিকে। অনেক ভুরু কুঁচকে গেল।

বন্ধুরা কানুর গা টিপে বলল, এই চুপ, চুপ। অত জোরে হাসিস না। পুজোর জায়গায় হাসতে নেই!

কানু বলল, এমন মজার কথায় হাসব না? পুজো করলে আবার বৃষ্টি হয় নাকি? বৃষ্টি তো হয় মেঘ থেকে। আকাশে একফোঁটা মেঘ নেই, বৃষ্টি হবে কী করে?

ইন্দ্র সদয় হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে!

কচু আর ঘেঁচু হবে।

এই চুপ, চুপ!

একসময় ইন্দ্রের পূজা ছিল গোপপল্লিতে প্রতিবার্ষিক। ইদানীং একটু আলগা পড়ে গিয়েছিল। পর পর দু’ বছর অতিশয় খরা হবার ফলে আবার সকলের টনক নড়েছে। সকলেই অপরাধী হয়ে ভেবেছে যে পূজায় অমনোযোগের জন্যই ইন্দ্ৰ ক্রুদ্ধ হয়েছেন। ইন্দ্রের দয়া না হলে আকাশে সজল মেঘ আসে না। তাই এবার পূজায় ধুমধাম একটু বেশি।

একটুক্ষণ থেমে রইল কানু। তারপর আবার বলল, কত ভালো ভালো খাবার দেখেছিস, দেখেই আমার খিদে পেয়ে যাচ্ছে!

ছিঃ, ও তো দেবতার জিনিস। ওর সম্বন্ধে লোভ করতে নেই!

দেবতা কি নিজে এসে এসব খাবেন নাকি? দেবতা কি একা এত খাবার খেতে পারে? আমার এদিকে পেট চুঁইচুঁই করছে যে।

প্রবীণ পুরুষরা ইতিমধ্যে অনেকেই চক্ষু বুজে মন্ত্র-পাঠ শুরু করেছে। তাদের বিঘ্ন ঘটছে কানুর কথাবার্তায়।

নন্দ ঘোষ দূর থেকে কানুকে দেখতে পেয়ে উঠে এল। ঈষৎ ভর্ৎসনার সুরে বলল, কানু, এখানে গোলমাল কোরো না। মাটিতে বসে পড়ো তোমরা সবাই। হাতজোড় করে মন্ত্র বলো!

কানু উদ্ধত ভাবে বলল, বাবা, এসব পুজোটুজো করে কী হয়!

নন্দ বলল, ওসব আবার কী কথা? ইন্দ্রের পুজো করা আমাদের বংশের নিয়ম। ইন্দ্রদেব সদয় হলে পৃথিবীতে সুবৃষ্টি হবে, তাতে ভূমি উর্বরা হবে। ভালো ফসল না হলে মানুষ সুখে-শান্তিতে বাঁচবে কী করে? চুপ করে বোসো!

কানু তবু বসল না। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, এসব মন্ত্রটন্ত্র শুনে কি ইন্দ্রদেবতা নিজে আসবেন এখানে?

নিজে আসবেন কেন? তিনি বৃষ্টি পাঠাবেন!

তা হলে এত খাবারদাবার কার জন্য? বৃষ্টিতে সব নষ্ট হয়ে যাবে যে!

নন্দ তর্কবাগীশ নয়। অন্যরা যাতে তার ছেলের ওপর বিরক্ত না হয়, সেইজন্যই সে কানুকে শান্ত করতে এসেছে। কথা ঘুরিয়ে নিয়ে, তার ওপর পিতার ব্যক্তিত্ব আরোপ করার চেষ্টা করে বলল, এসব দেবতার ভোগ! বৃষ্টি পাঠাবার আগে ইন্দ্র নিজে এসে এই ভোগ গ্রহণ করে আমাদের কৃতকৃতার্থ করবেন!

কতক্ষণের মধ্যে? কত পল? কত দণ্ড?

আঃ চুপ করে বসো না! এত কথা কেন?

কানু মানল না। কিছুক্ষণ মাত্র সে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করল। মন্ত্রের গুঞ্জন চলেছে তো চলেছেই। তার কানে একঘেয়ে লাগছে। আকাশের কোনও প্রান্তে মেঘের দেখা নেই। কিছুক্ষণ তার একটু কৌতূহল ছিল। সত্যিই আকাশ থেকে ইন্দ্রদেবতা নেমে এসে এইসব খাবার খেয়ে যাবেন কিনা দেখার জন্য সে আকাশের দিকে তাকিয়েছিল। এখন তাকাতে তাকাতে ঘাড় আর চোখ ব্যথা হয়ে গেছে। আর কিছুই ভালো লাগছে না! দেবতাটেবতা আসবে তো…।

কানুর সত্যিই খিদে পেয়েছে খুব। উঠতি বয়সের খিদে সব সময় দাউ দাউ করে জ্বলে, সামনে খাবার দেখলে আরও বেড়ে যায়। যশোমতীও এখানে রয়েছেন, এখন বাড়ি গেলেও তাকে কেউ খাবার দেবে না।

এক সময় সে পূজাস্থলের মধ্যে লাফ দিয়ে পড়ল। চেঁচিয়ে বলল, মিথ্যে কথা! কোনও দিন কোনও দেবতা এসে এসব খাবার ছুঁয়ে দেখবে না! রাখালসেনা! তোমরা এসো, এই খাবার ভাগ করে নাও!

নিজেই সে দেবতার প্রসাদ আগে মুখে পুরে দিল।

রাখালসেনারা তার কথায় অবাধ্য হতে পারে না। তারাও হইহই করে ঢুকে পড়ল মাঝখানে। সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিল। ফুল-বেলপাতা মাড়িয়ে, কাঠের বারকোশগুলো উলটে পায়েস-পিষ্টক ক্ষীর-নবনী সব লুটেপুটে চেটেপুটে সাফ করে দিল।

আয়ান পা দিয়ে ভূমি আছড়ে উঠে দাঁড়াল। তার গনগনে মুখ দেখলে মনে হয়, এক্ষুনি সে এই ধৃষ্ট বালকদের টুঁটি চেপে ধরবে। কিন্তু সে জিতক্রোধ, অস্থির হাত দু’টি বুকের ওপর আড়াআড়ি করে রাখল, তারপর সে নন্দ ঘোষের সামনে এসে বলল, অগ্রজাপতি, আপনাকেই এর দায়ভাগ নিতে হবে।

আয়ান আর দাঁড়াল না। বিপর্যস্ত পূজাস্থল ছেড়ে তৎক্ষণাৎ সে চলে গেল।

সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত নন্দ আর যশোমতীর চোখে ঘুম নেই! স্বামী-স্ত্রী মুখোমুখি গালে হাত দিয়ে বসা। মাথার মধ্যে কুরে কুরে খাচ্ছে চিন্তার পোকা। জ্ঞাতি বন্ধুদের কাছে কী করে মুখ দেখাবে তারা!

কানুর সঙ্গে তারপর আর কথা হয়নি। বিকেল থেকেই পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল সে। একটু বেশি রাত্রে চুপি চুপি বাড়িতে ঢুকে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়েছে। ঘুমিয়েছে, না মটকা মেরে আছে, তাই বা কে জানে! নন্দ কয়েক বার চেষ্টা করেছে ছেলেকে ডেকে তুলে একটু শাসন করতে। বাধা দিয়েছে যশোমতী। স্বামীর হাত চেপে ধরে মিনতি করে বলেছে, ওগো না, তাতে যদি আমাদের সর্বনাশ হয়ে যায়? কটু কথা বললে যদি একেবারেই বাড়ি ছেড়ে চলে যায় সে। তখন যে দশ দিক আঁধার হয়ে যাবে, পৃথিবী শূন্য হয়ে যাবে! কেঁদে কেঁদে তখন অন্ধ হয়ে যাব না?

নন্দ সে-কথা অস্বীকার করতে পারেনি। জেদি ছেলে, এমনিতে মারলে বকলে কাঁদে না, কিন্তু যদি অপমান বাজে, তা হলে হয়তো নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে! কিন্তু ওর দুরন্তপনা যেমন দিন দিন বাড়ছে, তাতে একটা কিছু তো করতেই হবে!

এখন কানুর ঘুমন্ত মুখ দেখলে কে ওর ওপর রাগ করতে পারে? ওই মুখে যেন বিশ্বের মাধুর্যরস মাখানো। কে বিশ্বাস করবে যে ওই কোঁকড়া কোঁকড়া চুলভরা মাথাটার মধ্যেই এমন দুষ্টবুদ্ধি! নিমীলিত চোখ দু’টির মধ্যেও কত রূপ। ঠোঁট দু’খানি ঘুমের মধ্যে হাসি হাসি, এমনই থাকে সব সময়।

ঘুমের ঘোরে কানু পাশ ফিরল। তার মাথাটা সরে গেল উপাধান থেকে। যশোমতী তাড়াতাড়ি আবার মাথাটা তুলে দিতে গেল। নন্দ কপট ভর্ৎসনায় বলল, যাক, অত আদর দিতে হবে না! এত আদর দিয়ে দিয়েই তো ছেলের মাথাটি খেয়েছ।

এই সময় একটা ভয়ংকর শব্দ হল। চমকে উঠল নন্দ। যশোমতী স্বামীর জানু আঁকড়ে ধরে একই সঙ্গে হেসে কেঁদে বলল, ওগো, মেঘ ডাকছে।

দু’জনেই ছুটে এল বাইরে। চড়াৎ করে আর একবার বিদ্যুৎ চমকাল। সন্দেহ কী, কানুর গায়ের রঙের মতন মেঘে ছেয়ে গেছে সারা আকাশ।

নন্দ্য-যশোমতীর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল আনন্দাশ্রু। দেবতা সদয় হয়েছেন। দেবতারা কক্ষনও ছোট ছেলেদের দোষ ধরেন না। ওরা যে এখনও অবুঝ!

ওরা দু’জন ঘরের দাওয়ায় বসে রইল আকাশের পানে মুখ তুলে। হাত দু’টি প্রার্থনার ভঙ্গিতে উঁচু করা। খানিকক্ষণ পরে যখন বৃষ্টি নামল, তখনই ঘুম নেমে এল ওদের চোখে। বহু দিন পর ওরা পরম শান্তিতে ঘুমোল।

এর কয়েক দিন পর কানু আর-একটা সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড করল!

দু’-তিন দিন ধরে বলরামের অসুখ। বলরাম খুবই গুরুভোজী বলে প্রায়ই তার পেটের পীড়া হয়। ক’দিন সে আর গোষ্ঠে যায়নি। সে না থাকলে অনেক খেলা জমে না।

সেদিন সকালবেলা রাখাল ছেলেরা কানুকে ডাকতে এসেছে, কানু বলল, না রে ভাই, আজ আর আমি যাব না। আজ আমি বলাইদাদার কাছে থাকব।

ছেলেরা অনেক কাকুতিমিনতি, অনেক অনুনয়বিনয় করল, কানু টলল না। তা দেখে খুব খুশি হল যশোমতী। ছেলের তা হলে একটু ভব্যিজ্ঞান হয়েছে। যে-বলাইদাদা তাকে অত ভালোবাসে, তার অসুখের সময় কি কানুর খেলতে যাওয়া ভালো দেখায়!

একা অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে রোহিণী বিপন্না বোধ করবেন বলে যশোমতী রোজই সেখানে যায় বলাইয়ের শুশ্রূষা করার জন্য। সেদিন কানুকে সঙ্গে নিয়ে গেল।

পীড়িত অবস্থাতেও বলরাম শয্যায় শুয়ে শুয়ে এক বৃহৎ ভাণ্ড ভরতি দুধ-চিঁড়ে-কলা সাপটাচ্ছে। কানুকে দেখে সে যথার্থ খুশি হল। তাড়াতাড়ি উঠে বসে বলল, মা, কানুকেও আমার মতন খাবার দাও।

রোহিণী ইতিমধ্যে আরও কৃশ হয়েছেন। মাথার চুলে আরও জট পড়েছে। চোখ দু’টি আরও জ্বলজ্বলে। তাকে দেখলেই যশোমতীর একটু একটু ভয় করে।

ছেলের অসুখের জন্য রোহিণী একটুও চিন্তিত নন। তিনি কানুকেই দেখতে লাগলেন ভালো করে। তাকে কাছে ডেকে মস্তকের ঘ্রাণ নিলেন, তার চিবুকে, বাহুতে নিজের হাত বুলোলেন। বললেন, বাঃ এ তো বেশ বড় হয়ে গেছে, রীতিমতন শক্ত সমর্থ পুরুষমানুষ।

কানু লজ্জা পেয়ে চুপ করে রইল। বলরাম বলল, জানো মা, যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় কানুর সঙ্গে এখন কেউ পারে না! রোহিণী বললেন, শুধু খেলায় কেন, আসল যুদ্ধেও কানুর সঙ্গে কেউ পারবে না। ওকে অনেক বড় যুদ্ধ করতে হবে! তাই না কানু?

যশোমতীকে নিয়ে ঘরের বাইরে এসে রোহিণী কিছুক্ষণ স্থির ভাবে দূরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, বোন যশোদা, এবার তৈরি হও, কানু আর তোমার কাছে বেশি দিন থাকবে না।

এ কী অলুক্ষুনে কথা! শুনলেই বুক কাঁপে। যশোমতীর মুখ রক্তহীন হয়ে গেল। খুব অস্ফুট ভাবে বলল, এ-কথা কেন বলছ, দিদি?

রোহিণী যশোমতীর দিকে মুখ ঘুরিয়ে বুঝি আরও কোনও কঠোর কথা বলতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ থেমে গেলেন। যেন তাঁর মায়া হল। কণ্ঠস্বর নরম করে বললেন, এসব ছেলে বেশি দিন ঘরে থাকে না!

যশোমতী বলল, কানু আমাকে ছেড়ে কোনও দিন কোথাও যাবে না। সে সে রকম ছেলেই নয়!

রোহিণী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আগে থেকে মন শক্ত করে রাখাই ভালো। নইলে পরে বেশি কষ্ট পেতে হয়!

যশোমতীর আর থাকতে ভালো লাগল না সেখানে। রোহিণীকে আজকাল সে অপছন্দ করতে শুরু করেছে। খানিকটা পরেই সে কানুকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এল।

কিন্তু দিনেরবেলা একা একা বাড়িতে কানুর মন টিকবে কেন? সে বলল, মা, এখন তা হলে গোষ্ঠে যাই?

যশোমতীর ডান চোখের পাতা কাঁপছে। কী যেন এক অজানা আশঙ্কা তাকে ঘিরে আছে আজ। সে বলল, থাক না, আজ আর না গেলি! আজ তুই আমার কাছে থাক, কানু!

কানু বলল, যাই না, একবার ঘুরে আসি! এই তো যাব আর আসব!

লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে গেল সে। আভীরপল্লির পাশ দিয়ে, আখের খেত পেরিয়ে, বনপথ ধরে সে পৌঁছে গেল যমুনার তীরে গোষ্ঠভূমিতে। সেখানে গিয়ে সে চমকে গেল।

রাখালেরা কেউ মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছে, কেউ গাছের গুঁড়িতে ঠেসান দিয়ে বসে আছে, কারওর মুখে কথাটি নেই। কেউ বড় বড় শ্বাস ফেলছে, কারওর চোখে জল।

এ কী হয়েছে? এ কী হল?

একজন বলল, হায় কানু, তুই ছিলি না। আজ আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে!

কী হয়েছে? কীসের সর্বনাশ!

আমাদের শ্যামলী আর নেই!

গোষ্ঠের পালের মধ্যে শ্যামলী গাভীটি সবচেয়ে সুলক্ষণা। তার নরম গা থেকে যেন তেল গড়িয়ে পড়ে, তার দীঘল চোখ দু’টি যেন দীঘির জলে ভরা। সুবলের বড় প্রিয় ধেনু।

অন্য দিন কানুর বাঁশির সুর শুনে গোরুগুলি সব এক জায়গায় থাকে। আজ কানু নেই, আজ খেলা জমেনি, আজ রাখালদের গোচারণেও মন ছিল না। গোরুগুলি ছিটকে গেছে এদিক-ওদিক। হতভাগিনী শ্যামলীর এমনই কুগ্রহ হল আজ, এত বড় যমুনা নদী থাকতেও সে কিনা চলে গেল কালীয়দহের দিকে। সুবল শেষ মুহূর্তে টের পেয়ে ছুটে গিয়েছিল পিছু পিছু, তবু আটকাতে পারল না। জলে মুখ দেবার সঙ্গে সঙ্গে শ্যামলীকে টেনে নিয়ে গেল সেই অজগর সাপটা!

কানু বিস্ফারিত চোখে বলল, অত বড় ধেনুটাকে সাপে নিয়ে গেল?

মধুমঙ্গল বলল, তুই জানিস না কানু সেই মহা অজগর কী প্রকাণ্ড! তার দেহটা বটগাছের গুঁড়ির মতন, তার দাঁতগুলো কোদালের মতন, তার চোখ দুটো মশালের মতন, তার ফণাটা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন। সেটা তো শুধু সাপ নয়, নিশ্চয়ই কোনও ছদ্মবেশী দৈত্য! তুই শুনিসনি, দৈত্যরা জলের মধ্যে লুকিয়ে থাকতে পারে!

কালীয়দহের সাপটার কথা কিছুদিন ধরেই শোনা যাচ্ছে। দহের জল নাকি বিষ হয়ে গেছে। কেউ ওর ধারে কাছে যায় না। বনের পশুপাখিরাও ওই জল পান করে না, আর শ্যামলীই কিনা মরতে গেল?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে কানু জিজ্ঞেস করল, সুবল কোথায়?

রাখালরা উত্তর দিল সেই তো হয়েছে আর এক বিপদ। সুবল সেই কালীয়দহের পারে বসে অবিরল চক্ষের জল ফেলছে। শ্যামলী যে ছিল তার প্রাণের পুত্তলি! সুবলকে ফিরিয়ে আনার অনেক চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু সে কিছুতেই আসবে না। অন্য রাখালরা ভয়ে সেখানে থাকতে পারেনি।

গায়ের উত্তরীয়টা খুলে কোমরে জড়িয়ে শক্ত করে বেঁধে কানু শান্ত ভাবে বলল, আজ আমি ওই সাপটাকে মারব।

কানু সত্যি সত্যি কালীয়দহের দিকে এগোচ্ছে দেখে সব রাখালরা ঘিরে ধরল তাকে। সবাই সমস্বরে বলল, এ রকম পাগলামি করিস নে কানু! এ তো সাপ নয়, এ তো দৈত্য! মানুষে কখনও পারে এর সঙ্গে!

কানু বলল, ছাড়, আমি যাবই!

অংশুমান বলল, তোকে আমরা কিছুতেই ছাড়তে পারি না। এ তো শুধু গায়ের জোরের ব্যাপার নয়, একটু বিষের ছোঁয়াতেই যে মানুষ শেষ হয়ে যায়।

কানু বলল, আমি এক সাধুর কাছে শুনেছি, জলজ সাপের দাঁতে বিষ থাকে না।

সুদাম বলল, তা হলে দাঁড়া। আমরা ঘোষপল্লির বয়স্কদেরও খবর দিই, সবাই মিলে একসঙ্গে যদি—

ঝটকা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কানু বলল, আমি রাজা না? কোনও বিপদ-আপদ হলে আমাকেই আগে যেতে হবে।

কানু তিরের মতো ছুটছে। তার ছিপছিপে শরীরটা বাতাস কেটে সাঁ করে বেরিয়ে যায়। অন্য রাখালরা বুঝল তাকে এখন আটকাতে যাওয়া বৃথা। কানু কালীয়দহের কাছে পৌঁছে দেখল, সুবল হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে। দহের জল নিস্তরঙ্গ, সেখানকার বাতাসও কেমন যেন থমথমে।

কানু এসে সুবলের ঘাড় ধরে হেঁচড়ে টেনে আনল অনেকখানি। ধমক দিয়ে বলল, জলের এত কাছে বসে আছিস কেন! সুবল ঝরঝরিয়ে কেঁদে বলল, কানু, আমার শ্যামলী নেই, আমি আর বাড়ি যাব না! কানু ধমক দিয়ে বলল, আগে তাকে আটকাতে পারিসনি কেন? এখন কেঁদে কী হবে? এখন প্রতিশোধ নিতে হবে। আমি প্রতিশোধ নিচ্ছি, তুই দেখ।

তারপর তার বাঁশিটা সুবলের হাতে জমা দিয়ে সে তার কাপড়ে মল্লসাঁট বাঁধল। জলের কিনার ঘেঁষে রয়েছে একটা বড় কদম গাছ, কানু তরতর করে উঠে গেল সেই গাছে। একেবারে মগডালে উঠে সেখান থেকে লাফ মেরে গিয়ে পড়ল দহের মাঝখানে।

.

এদিকে ভয়-তাড়িত রাখালরা ছুটে গেছে আভীরপল্লিতে। সেখানে খ্যাপার মতন তারা আকণ্ঠ চিৎকার করতে লাগল ওগো, সর্বনাশ হয়েছে! কে কোথাও আছ, শিগগির এসো! কানু কালীয়দহে ঝাঁপ দিয়েছে!

যে-সমস্ত পুরুষরা গ্রামান্তরে যায়নি, তারা সবাই এল ঘরের বাইরে। নারীরাও বেরিয়ে এল। সকলে মিলে ছুটল দহের দিকে। কালীয়দহের চার পাশ একেবারে ভিড়ে ভেঙে পড়ল। হাট থেকে ফিরছিল গোপিনীরা, তারাও চিৎকার শুনে ছুটে এল।

বেশ কিছুক্ষণ দহের জল একেবারে শান্ত। কানু কোথায় তলিয়ে গেছে। তার আর চিহ্ন নেই। সকলে হাহাকার শুরু করেছে। কানুর মা যশোমতী এখনও খবর পায়নি, সে যাতে এদিকে না আসে তাই দু’-একজন ছুটে গেল তাকে সামলাতে।

এক সময় প্রবল জলোচ্ছাসের সঙ্গে সঙ্গে দহের ঠিক মাঝ অংশে ছিটকে ওপরে উঠে এল কানু। তারপর দেখা গেল সেই অজগরের মাথা। তীক্ষ্ণ দংষ্ট্রা মেলে সেটা গ্রাস করতে এল কানুকে, কানু ডুব দিয়ে উলটো দিকে এসে দু’হাতে চেপে ধরল তার ফণা। প্রচণ্ড লড়াইয়ে সমস্ত দহের জল উন্মত্ত হয়ে উঠল।

গোয়ালারা যে-যা পেরেছে লাঠি, বল্লম, রামদা এনেছে সঙ্গে, কিন্তু এখন কানু আর অজগরটা এমন অঙ্গাঙ্গী হয়ে আছে যে দূর থেকে কোনও সাহায্য করার উপায় নেই। তারা দর্শক হয়েই রইল।

প্রায় আড়াই দণ্ড ধরে চলল সেই যুদ্ধ। তারপর কালীয়দহের কালো জলে দেখা গেল সরু সরু রক্তের রেখা। কানুরই গায়ের রক্ত। সাপটা তার শরীর ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে। সাপের গায়ে রক্ত থাকে না। কানু শেষ বারের মতন মুচড়ে দিয়েছে অজগরটার ফণা।

রক্তাক্ত শরীর নিয়ে কানু উঠে এল ওপরে। কে তাকে আগে ছোঁবে, কে তাকে আগে শুশ্রূষা করবে, তাই নিয়ে পড়ে গেল কাড়াকাড়ি। আজ কানুর সমস্ত দোষ মুছে গেছে। আজ সে বৃন্দাবনের সকলেরই চোখের মণি।

এতখানি বীরত্ব এই অঞ্চলে কেউ কখনও দেখায়নি। কানু আজ দেখিয়ে দিয়েছে, যে-কোনও ভয়কেই জয় করা যায়।

সেই ভিড়ের মধ্যে কানু বিশেষ করে দেখল একটি নারীকে। তার রূপ আর সকলকে ছাপিয়ে, এই পৃথিবী ছাপিয়ে যেন আকাশ ছুঁয়েছে। পিঠের ওপর ঢাল হয়ে আছে এক রাশ চুল। ভ্রমর কালো চোখের ওপরে বড় বড় পল্লব। তার গ্রীবা যেন নদীর একটি তরঙ্গ।

সেই রমণী তার কাছে আসেনি। তবু দূর থেকে তার দৃষ্টিতে যেন ঝরে পড়ছে মুগ্ধতার আলো। শুধু সেই এক জনের দৃষ্টিতেই কানুর সর্বাঙ্গ জুড়িয়ে গেল।

কানুর মনে হল, সে যে জীবন তুচ্ছ করে ওই সাপটার সঙ্গে লড়তে গিয়েছিল, তা ওই এক জনের দৃষ্টির জন্যই সার্থক হয়ে গেল। অতখানি সুধা মানুষের দৃষ্টিতে থাকে? কানু সেই রমণীকে আরও কাছ থেকে দেখতে চাইল, শুনতে চাইল তার মুখের একটি কথা। কিন্তু পারল না। ভিড়ের মধ্যে যেন সমুদ্রের ঢেউ এসে লেগেছে। রাখাল বালকরা জোর করে কানুকে কাঁধে তুলে নাচতে নাচতে নিয়ে বেরিয়ে গেল। কানু ঘাড় ঘুরিয়েও আর দেখতে পেল না সেই নারীকে।

কানু তাকে চিনতে পারল না। অনেক দিন দেখেনি তো। সেই রমণীর নাম রাধা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *