০২. গোকুল ত্যাগ করে

গোকুল ত্যাগ করে চলে এসেছে নন্দ আর তার আত্মীয়, পরিজন, প্রতিবেশী। বৃন্দাবনে গড়ে উঠেছে নতুন আভীরপল্লি। কংসের চেলাচামুণ্ডা ও সৈন্যদের উপদ্রবও কমেছে অনেকটা। যে-সন্দেহের বশে কংস শিশুনিধনে মেতেছিল, হয়তো সে সন্দেহ দূর হয়ে গেছে তার মন থেকে। তাই এখন অন্যান্য দুরাচারে মন দিয়েছে।

একটু বড় হয়েছে কানু। এখন সে নিজেই একা মাঝে মাঝে বাড়ির বাইরে ছুটে যায়। দেখতে পেলেই যশোমতী ছুটে গিয়ে তাকে ধরে আনে। বড় দুরন্ত ছেলে হয়েছে সে। তাকে শাসন করাও যায় না। তাকে বকুনি দিলে, এমনকী মারলেও সে কাঁদে না, ঝরঝরিয়ে হাসে কিংবা এমন মুখভঙ্গি করে যে শাসনকারীরও হাসি এসে যায়। বাড়িতে তার জন্য ক্ষীর-ননি কিছুই জমিয়ে রাখার উপায় নেই। সে তো নিজে যত খুশি খেতেই পারে, সে সম্পর্কে কোনও কার্পণ্য নেই যশোমতীর, তবু ফেলে-ছড়িয়ে নষ্ট করার দিকেই ছেলের ঝোঁক। দুপুরে যখন যশোমতী ঘুমিয়ে থাকে, তখন কানু পাড়ার এক দঙ্গল শিশুকে জড়ো করে মায়ের সব হাঁড়ি-কলসি হাতড়ায়, কোনওটা ভাঙে, ক্ষীর-ননিতে মাখামাখি করে হাত-মুখ। একদিন এমন নরম, এমন স্নেহময়ী যশোমতীও এমন রেগে গিয়েছিলেন যে কানুর দু’হাত বেঁধে রেখেছিলেন দুটো গাছের সঙ্গে। তাও ছেলে মুক্তি পাবার জন্য কান্না জোড়েনি।

নন্দ কানুকে কোনও দিন বকে না। ছেলে আর মায়ের খুনসুটি সে কৌতুকের চোখে দেখে। সে এখন অনেক নিশ্চিন্ত।

ঘোষপাড়ার মধ্যে নন্দর অবস্থা অতি সাধারণ। তার চেয়ে ক্ষমতাবান ও সঙ্গতিসম্পন্ন গোপ আরও অনেকে আছে। তবু নন্দর ধীর স্বভাব ও সহজ সততার জন্য অনেকেই তাকে মান্য করে। নন্দর খুব একটা উচ্চাকাঙক্ষাও নেই জীবনে। সেবাপরায়ণা স্ত্রী ও সুকুমার পুত্রকে নিয়ে তার যে ছোট্ট পরিবার, তাতেই সে খুব তৃপ্ত।

একদিন নন্দ গেল ব্ৰজপুরীতে বেড়াতে। প্রকাণ্ড একটা দিঘির সামনে বৃষভানু রাজার প্রাসাদ। সিংহদ্বারের দু’ পাশে দুটি মঙ্গলঘট বসানো। সে ঘট দু’টি এমন চকচক করে যে সকলে বলে সোনার। এ-রাজপ্রাসাদের দ্বারীরা প্রসন্নবদন, তারা কঠোর ভাবে কারওকে দূরে ঠেলে দেয় না।

রাজা বৃষভানু নন্দকে খুব সমাদর করলেন। তাকে এনে বসালেন একেবারে অন্দরমহলে। পুরনো বন্ধুর মতো আরম্ভ করলেন সুখ-দুঃখের গল্প। এলেন রানি কলাবতী। এই প্রাসাদে শান্তি ও পরিতৃপ্তির একটা স্নিগ্ধ গন্ধ পাওয়া যায়। অলক্ষ্মী এদিককার ছায়া মাড়াতেও ভয় পেয়েছে।

এক সময় রাধা এসে বসল বাবা-মায়ের পাশে। তাকে দেখে নন্দর চোখ জুড়িয়ে গেল। এমন মেয়ে যাদের থাকে, সেই বাপ-মায়ের কত আনন্দ। শুধু আনন্দ? দুশ্চিন্তাও থাকে না?

রাধা এখন বারো বছরের কিশোরী। আয়ত চোখ দুটির ওপর স্নিগ্ধ ছায়া ফেলেছে ঘন পল্লব। চম্পক বর্ণ আরও ফেটে পড়েছে। পিঠ ছেয়ে আছে মেঘবর্ণ চুল। মুক্তাপাঁতির মতো ঝকঝকে দাঁত।

রাধার কাছে রাজা বৃষভানু নন্দর পরিচয় দিতে যেতেই নন্দ বলল, ওকে তো আমি চিনি! একদিন বনের পথে দেখে ছিলাম। ওর টানেই তো এলাম। কী মা, আমাকে মনে নেই?

রাধা ঠিক মনে করতে পারল না।

নন্দ মনে করিয়ে দিল, সেই যে সেদিন খুব বৃষ্টি হয়েছিল, আমার সঙ্গে ছিল আমার ছেলে, খুব ছোট্ট।

তখন মনে পড়ল রাধার। ছেলেটিকে মনে আছে, কী সুন্দর চোখ! নন্দ রাধার এত প্রশংসা করতে লাগল যে লজ্জায় সে একেবারে নুয়ে পড়ল।

বেশিক্ষণ বসল না রাধা। দূর থেকে রাই, রাই বলে ডাকতে ডাকতে এল তার সখীরা। এখন মালা গাঁথার সময়। একটু পরেই সন্ধ্যারতি শুরু হবে, তার জন্য মেয়েরা মালা গাঁথবে।

রাধা উঠে যাবার পর নন্দ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আহা, এমন সোনার পুত্তলি, সে-ও কোথায় চলে যাবে!

বৃষভানু চকিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেন, কেন, এ-কথা বলছ কেন?

নন্দ বলল, রাজা, আপনার মেয়ে বয়স্থা হয়েছে, এবার তো তাকে পাত্রস্থ করতেই হবে!

বৃষভানু বললেন, তা ঠিক, ইদানীং আমি এবং রানিও এ-সম্পর্কে চিন্তা করছি। কিন্তু যোগ্য পাত্র কই?

আপনার মেয়ের যোগ্য পাত্র সত্যিই দুর্লভ। মেয়ে যেন সাক্ষাৎ লক্ষ্মী। একমাত্র স্বয়ং নারায়ণের হাতেই একে সমর্পণ করা যায়।

রানি কলাবতী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তা ভাবলে তো চলে না। কন্যারত্ন বেশি দিন পিতা-মাতার সংসারে থাকবে এটাই বিধান। আপনার কাছে কোনও সৎপাত্রের সন্ধান আছে নাকি?

আপনার মতন রাজার মেয়ের সঙ্গে…

বৃষভানু বাধা দিয়ে হেসে বললেন, আমি আর রাজা কোথায়! ছোটখাটো একটা জমিদারি আছে, লোকে আদর করে রাজা বলে।

আমাদের কাছে আপনি রাজাই।

কলাবতী বললেন, যাই বলো বাপু, আমি কিন্তু আমার মেয়ের সঙ্গে কোনও রাজপুত্রেরই বিয়ে দেব।

রাজকন্যার সঙ্গে রাজপুত্রের বিয়ে হওয়াই প্রথা। আপনারা কি কংসের কোনও ছেলের সঙ্গে শ্রীমতী রাধার বিয়ে দেওয়ার কথা ভেবেছেন?

বৃষভানু তৎক্ষণাৎ দৃঢ় স্বরে বললেন, না।

নন্দর মুখে একটা কৃতজ্ঞ ভাব ফুটে উঠল। স্বস্তির সঙ্গে সে বলল, রাজা, এ আপনারই যোগ্য উত্তর দিয়েছেন। অত্যাচারী কংসের সঙ্গে যদি আপনি বৈবাহিক সম্পর্ক পাতাতেন, তা হলে শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষ আপনাকেও সামাজিক ভাবে বর্জন করত। এখন যারা আপনাকে শুল্ক দেয় না, তারাও আপনাকে শ্রদ্ধা করে। সেই শ্রদ্ধার আসন আপনি হারাতেন!

বৃষভানু বললেন, সে প্রশ্নই ওঠে না। জেনেশুনে আমার মেয়েকে আমি কোনও রক্তলোলুপ শ্বশুরের পরিবারে পাঠাতে পারি না।

সেই জন্যই তো বলছিলাম, এই সোনার পুত্তলি কত দূরে চলে যাবে কে জানে! কাছাকাছি আর রাজ্য কিংবা রাজপুত্র কই?

কলাবতী বললেন, আর্যাবর্তে কি রাজপুত্রের অভাব?

নন্দ বলল, কংসের আত্মীয় জরাসন্ধও মহাপ্রতাপশালী রাজা। যদি তাঁর কোনও ছেলের সঙ্গে সম্বন্ধ করতে চান—

বৃষভানু আবার দৃঢ় ভাবে বললেন, না। আপনার সন্ধানে আর কোনও রাজপুত্র নেই?

আমি অনেক দিন তীর্থ ভ্রমণে যাই না, অন্য দেশের সংবাদ রাখি না।

রানি কলাবতী তাঁর স্বামীকে বললেন, তুমি নানা দিকে দূত পাঠিয়ে সন্ধান নাও। আর বেশি দিন অপেক্ষা করা চলে না।

হঠাৎ নন্দর চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে কলাবতীর উদ্দেশে বলল, রানি, আমি আপনাদের বিয়েতে ঘটকালি পূজা না করে সে জলস্পর্শ করে না…

.

রাজা ও রানি সমস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ছেলেটি কে? ছেলেটি কে?

নন্দ বলল, আমার স্ত্রী যশোমতীর সম্পর্কে ভাই হয় ছেলেটি। তার নাম আয়ান। ঘোষপাড়ার সবাই তাকে খুব ভালোবাসে।

রাজা বৃষভানু হঠাৎ উৎকট গম্ভীর হয়ে গেলেন। রানি কলাবতী মুখ ফেরালেন অন্য দিকে।

নন্দ জানত, এমনটি হবে। রাজদুহিতার সঙ্গে কি সামান্য গোয়ালার বিয়ে হয়? কিন্তু সে রকমও তো হয়েছে কখনও কখনও। মহাবল দক্ষরাজার মেয়েরও তো বিয়ে হয়েছিল শ্মশানচারী শিবের সঙ্গে। রূপে-গুণে আয়ান কোনও রাজার ছেলের চেয়ে কম কীসে? যদি ভাগ্যে থাকে সেও একদিন রাজা হবে।

কিছুক্ষণ নিঃশব্দে রাজা বৃষভানু তাকিয়ে রইলেন অলিন্দের বাইরে। তারপর একটি বড় নিশ্বাস ফেলে বললেন, দিঘির জলে আর একটুও রোদুরের আলো নেই। এবার আমার পূজাগৃহে যাবার সময় হল।

অর্থাৎ এবার নন্দকে উঠে পড়ার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। রানি কলাবতীও গাত্রোত্থান করে বললেন, আমিও যাই, এখনই নাপতেনি আসবে আলতা পরাতে।

নন্দ বুঝেও বুঝল না। বলল, একদিন আয়ানকে ডাকি তা হলে? ছেলেটিকে একবার দেখলে—

রানি তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আরও দু’-চারটি পাত্র দেখুন, হঠাৎ এক কথায় তো বিয়ে হয় না। পাঁচ জায়গায় দেখতে হয়—

রানিমা, আমি আর একটি কথা বলে যাই। মেয়েকে সৎপাত্রে দেওয়াই পিতা-মাতার দায়িত্ব। অনেক রাজপুত্রও কুলাঙ্গার হয়। আমাদের আয়ানের ঠিকুজি দেখে একজন মস্ত গণকঠাকুর একবার বলে-ছিলেন, এ-ছেলের একদিন রাজকন্যা লাভ হবে। সেটা মনে পড়ল বলেই সম্বন্ধের কথা বললাম। কে জানে, হয়তো আপনার মেয়ের সঙ্গেই ওই ছেলের নিয়তি বাঁধা আছে। নিয়তি তো কেউ খণ্ডাতে পারে না। আপনারও সুবিধে হবে, মেয়ে কাছাকাছি থাকবে, যখন ইচ্ছে তাকে দেখবেন, যখন ইচ্ছে তাকে বাড়িতে আনবেন। মেয়ের ঠিকুজিটা অন্তত একবার মেলান ওর সঙ্গে।

বৃষভানু বললেন, আচ্ছা দেখি!

রাজপুরী থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে নন্দ দেখল, মন্দিরের সিঁড়িতে বসে রাধা তখনও তার সখীদের সঙ্গে মালা গাঁথছে। আবার চক্ষু ভরে দেখল নন্দ। কী রূপ! এই মেয়ে একাই ব্ৰজ-বৃন্দাবন আলো করে রাখবে। একে কি দূরে কোথাও পাঠানো যায়?

বৃষভানু রাজার পুরী পার হয়ে আসবার পর একটি বেশ বড় মাঠ। মাঠটির মাঝখান দিয়ে রথচক্রের দাগে দাগে একটা পথ তৈরি হয়ে গেছে। একটি মাত্র বড় গাছ রয়েছে সেখানে। মাঝে মাঝে সেখানে কোনও সাধু-সন্ন্যাসী আস্তানা গাড়ে। কাছেই একটা ডোবা। অনেকে বলে ওই ডোবার জল খেলে হজম শক্তি বাড়ে। নন্দ এক আঁচলা জল খেয়ে নিল।

বাড়িতে এসে নন্দ মহা উৎসাহের সঙ্গে যশোমতীকে বলল, জানো, আজ একটা বিয়ের সম্বন্ধ করে এলাম। উঃ, কত বড় ধুমধাম যে হবে!

যশোমতী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কার সঙ্গে কার বিয়ে? তোমার কি ঘটকালির নেশা ধরল নাকি?

তোমার ভাই আয়ান, তার সঙ্গে বৃষভানু রাজার মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছি।

যশোমতী গালে হাত দিয়ে বললেন, ওমা, সেকী কথা! তোমার যেমন কাণ্ড! আগে আমাকে একটু জিজ্ঞেস করবে তো!

কেন, কেন, কী হয়েছে? আমাদের গয়লাপাড়ায় একজন রাজকন্যা আসবে, আমাদের কত বড় সৌভাগ্য!

কিন্তু আয়ান যে বিয়েই করবে না প্রতিজ্ঞা করেছে! সে বলেছে, সারা জীবন ব্রহ্মচারী হয়ে থাকবে।

নন্দ এবার হো হো করে হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, যুবাবয়সে অনেকেই প্রথম প্রথম ওই কথা বলে। বৃষভানু রাজার মেয়েকে তো দেখোনি! ঠিক যেন একটি হিরের ফুল। তাকে দেখলেই আয়ানের মাথা ঘুরে যাবে!

যশোমতী তবু চিন্তিত ভাবে বলল, না গো না! আয়ানের একেবারে ধনুর্ভঙ্গ পণ। বড় গোঁয়ার ছেলে। এর আগে কত ভালো ভালো ঘরের মেয়ের সঙ্গে তার সম্বন্ধ করা হয়েছে, কিন্তু বিয়ের কথা শুনলেই সে রেগে যায়।

নন্দ এবার একটু রেগে উঠে বলল, তোমার যেমন মেয়েছেলের বুদ্ধি! অন্য অন্য মেয়ের সঙ্গে রাধার তুলনা? রাধার সঙ্গে যদি বিয়ে হয়, তা হলে সেটা আয়ানের সাত পুরুষের ভাগ্যি! এখনও ওঁরা রাজি হবেন কি না ঠিক নেই!

যশোমতী তবু মুখে আশঙ্কা নিয়ে বলল, তা যাই বলো, শুধু শুধু তোমার কেন এর মধ্যে মাথা গলানো! আয়ান এসে আমাদের ওপর রাগারাগি করবে!

সত্যি তাই হল। দিন দু’-এক পরেই দুপুরবেলা পা দুপদুপিয়ে আয়ান এসে হাজির এ-বাড়িতে। মুখে তার গনগনে রাগ।

অন্যরা যখন গোকুল ছেড়ে বৃন্দাবনে চলে আসে, তখন আয়ান আসেনি। তার অনেক বড় বাড়ি, বিশাল বাথান, সে-সবের মায়া ত্যাগ করে চলে আসা সম্ভব নয়। তার সঙ্গে সঙ্গে দু’-চারজন তার অনুচরও সেখানেই থেকে গেছে। এখনও গোকুলে একটি গোপপল্লি রয়ে গেছে। আশেপাশের বেশ কয়েকটা গ্রামের মানুষ আয়ানকে এক ডাকে চেনে।

উঠোনে ধুলোবালি নিয়ে খেলা করছিল কানু। তাকে এক ধমক দিয়ে আয়ান বলল, এই কী করছিস! ওঠ! সারা গায়ে ধুলো মেখেছে একেবারে! তোর বাবা কোথায়? তোর বাবাকে ডাক। তুই আমাকে চিনিস? আমি তোর এক মামা হই। বাবাকে গিয়ে বল, আয়ানমামা এসেছে!

গলার আওয়াজ শুনে নন্দ আর যশোমতী এর মধ্যেই বেরিয়ে এসেছে। নন্দ কৌতুক করে বলল, আরে, আরে, বড় কুটুম যে! হঠাৎ পথ ভুলে নাকি? তোমার মতন ব্যস্ত মানুষ যে আমাদের বাড়িতে পায়ের ধুলো দিয়েছে—

আয়ান বলল, আপনার সঙ্গে একটা দরকারি কথা বলতে এসেছি!

তা তো বলবেই। আগে এসো, বসো, পান-তামাক খাও! তারপর তো কথা হবে। আগে থেকেই অত রাগ রাগ ভাব কেন?

যশোমতী ঘরের দাওয়ায় আসন পেতে দিল দু’টি। নন্দ আয়ানকে পাশে বসিয়ে বলল, তোমার শরীর-মন সব ভালো তো! পিতামাতার মঙ্গল তো? ধেনুগুলি যথেষ্ট দুগ্ধবতী আছে তো?

আয়ান সেসব কথায় না গিয়ে সরাসরি বলল, আপনি আমাকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করছেন কেন, হঠাৎ?

নন্দ অতি নিরীহ সেজে বলল, কেন, কেন, কী হয়েছে? আমি তোমাকে বিপদে ফেলব, একি হতে পারে?

তা হলে দু’দিন ধরে অনবরত বৃষভানু রাজার কাছ থেকে লোক আসছে কেন আমার কাছে? একবার এসে আমার ঠিকুজি চাইছে, একবার এসে আমাকে রাজবাড়িতে নিয়ে যেতে চাইছে, এসব কী?

তা হলে তো মনে হচ্ছে, তোমার ভাগ্যটা খুলেছে। রাজার পছন্দ হয়েছে তোমাকে। এতে রাগের কী আছে?

আমি রাজারাজড়ার সঙ্গে মেলামেশা পছন্দ করি না।

নন্দ মুচকি হেসে বলল, বাবাজীবন, রাজারাজড়াদের পছন্দ না হলেও রাজকন্যাকে তো পছন্দ হতে পারে! তুমি বৃষভানুর কন্যা রাধাকে কি দেখেছ সম্প্রতি?

আয়ান আবার রেগে উঠে বলল, আমি ঠিকই বুঝেছিলাম, এ-সব আপনারই কীর্তি। লোকমুখে শুনেছি, আপনিই কয়েক দিন আগে ব্রজপুরীতে গিয়েছিলেন। রাজার কানে কিছু মন্তর দিয়ে এসেছেন! আমাকে এর মধ্যে জড়ালেন কেন? আমি নিজের বিষয়কর্ম নিয়ে পরিবৃত আছি—

শোনো আয়ান, শ্রীমতী রাধার সঙ্গে তোমার পরিণয় হলে তোমার সংসারে আরও শ্রীবৃদ্ধি হবে!

আমি চাই না সেসব। আপনিও শুনুন, যদি সম্বন্ধ পাতাতেই আপনার সাধ যায়, তা হলে বৃন্দাবনে-গোকুলে আরও অনেক সমর্থ ছেলে আছে, তাদের কারওর কথা ভাবুন, আমাকে নিষ্কৃতি দিন। দিদি, তোমার পতিটিকে নিবৃত্ত করো না!

যশোমতী বলল, আমি বাপু কিছু বলিনি। বারণই করেছিলাম—

নন্দ বলল, বৃন্দাবন-গোকুলে তোমার মতন আর কে আছে আয়ান? তুমিই তো রূপে-গুণে সবার সেরা! তুমি ছাড়া আর কেউ তো শ্রীমতী রাধার যোগ্য হতে পারে না!

প্রশংসা শুনে একটু মুখের ভাব বদলাল আয়ানের। তবু সে বলল, আমার বিয়ে করার অসুবিধে আছে।

কীসের অসুবিধে? ব্যবস্থাপত্তর সব আমরাই করব!

সে-কথা নয়। বিবাহে আমার রুচি কিংবা বাসনা কিছুই নেই।

সে-কথা কি বললে চলে। সংসারধর্ম সকলকেই করতে হয়। এ তো আর যেমন-তেমন বিয়ে নয়, ঘর আলো করে রাজকন্যা আসবে—

আমি মহামায়ার পূজারী, সংসারধর্ম আমার না-করলেও চলে

ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখো। আর একটা কথা বলি। রাজা কংসের বিষ নজর আছে আমাদের ওপরে। এখন আবার রাজা বৃষভানুকেও চটানো ঠিক হবে না। বরং, ব্ৰজের রাজার সঙ্গে আমাদের একটা কুটুম্বিতা হলে রাজা কংসও আর আমাদের ওপর অত্যাচার করতে চাইবে না সহসা। এসব দিকও তো ভাবতে হয়, গোষ্ঠীস্বার্থের জন্য তুমি যদি…

অন্যের স্বার্থের কথা ভেবে আমাকে বিয়ে করতে হবে নাকি?

আয়ান, তোমার ওপর আমাদের অনেক ভরসা! রাজা কংস আমাদের বিরোধী। রাজা বৃষভানুকেও চটানো আমাদের পক্ষে মোটেই ঠিক হবে না!

বিষণ্ণ মুখে আয়ান বলল, অগ্রজাপতি, আপনি সত্যিই আমাকে দারুণ চিন্তায় ফেলে দিলেন!

গোয়ালঘরের কাছ থেকে একটা বাঁশির আওয়াজ ভেসে আসছিল, সেদিকে হঠাৎ খেয়াল করে আয়ান জিজ্ঞেস করল, কে বাঁশি বাজায়?

নন্দ বলল, আমাদের ছেলে কানু বাজাচ্ছে! ক’দিন ধরেই দেখছি, রাখাল ছেলেদের কাছ থেকে একটা আড়বাঁশি জোগাড় করে খুব ফুঁ ফাঁ দিচ্ছে।

সপ্রশংস ভাবে আয়ান বলল, বাঃ, এর মধ্যেই বেশ মিষ্টি সুরটা তুলেছে তো!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *