২৫. অপমান নেওয়া যায় না

২৫

রক্তাক্ত হলে সহ্য করা যায়। কিন্তু অপমান নেওয়া যায় না একটা বয়সের পর।

নিউ ইয়র্কে একটা সেমিনারে গিয়েছিলেন উত্তরণ। মন্ত্রকে যথারীতি প্রফেশনাল কেয়ারে রেখে। এ-ও তেমন একটা সেমিনার, যেখানে না গিয়ে উপায় ছিল না। কিন্তু এসেও যে ভিতরে খচখচ করছিল। বিকেলের দিকে উত্তরণের পূর্বপরিচিত প্রফেসর হাওয়ার্ড এসেছিলেন হোটেলে। এটা-ওটার ফাঁকে বললেন যে, উত্তরণের ভিতর যত বড় দার্শনিক হওয়ার পোটেনশিয়াল ছিল, উত্তরণ ততটা হচ্ছেন না, সুবিচার করছেন না নিজের প্রতিভার প্রতি।

হাওয়ার্ড চলে যাওয়ার পর উত্তরণ কথাগুলো নিয়ে ভাবছিলেন। হাওয়ার্ড কি জানেন, কথা বলতে পারে না অথচ কাঁদতে পারে, এমন একটা মেয়ের বাবা হওয়ার চ্যালেঞ্জ? আচ্ছা, ব্রহ্মচারী ঠাকুরও কি এমন অনেক সন্তানের বাবা নন, যারা কাঁদতে পারে, কিন্তু নিজেদের কথা বুঝিয়ে বলতে পারে না? তাদের সবার কান্না শুনবেন বলেই কি হিমালয়ে সাধনা বাদ দিয়ে সমতলে নেমে এসেছিলেন ঠাকুর? মা যেমন নিজের হাজার কাজ ফেলে সন্তানের তৃষ্ণা মেটাতে ছুটে যান?

মনটা অস্থির হয়ে ছিল বলে একটু হাঁটতে বেরোলেন উত্তরণ। ওঁর হোটেলটা টাইমস স্কোয়্যারের একদম কাছেই। এই সে-ই জায়গা, যেখানে আলো কখনও ম্লান হয় না। সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল সরণি, যেখানে সারা পৃথিবী নিজের মুখ দেখাতে চাইছে। হাঁটতে-হাঁটতে খানিকটা এগিয়ে এসেছিলেন উত্তরণ, সামনে একজন বাদামবিক্রেতা দেখে একটু দাঁড়ালেন।

লোকটা একদৃষ্টে উত্তরণের দিকে তাকিয়ে থেকে বাংলায় বলল, “মেয়ে লাগবে স্যার? ঘণ্টায় মাত্র চল্লিশ ডলার।”

উত্তরণ হতচকিত হয়ে গিয়ে বাংলাতেই বললেন, “বাদাম লাগবে।”

“সঙ্গে মেয়েও নিন না স্যার। মেক্সিকান, আমেরিকান, চাইনিজ় সব পাবেন। ঘণ্টায় তিরিশ ডলারে করে দেব। কোন হোটেল?”

উত্তরণ লোকটার সামনে থেকে সরে গেলেন দ্রুত পায়ে। লোকটা প্রথমে পিছু ডাকল, তারপর খিস্তি দিল, বাংলাতেই।

উত্তরণের কান জ্বালা করে উঠল।

কান একদম পুড়ে গেল যখন সেমিনার চলাকালীনই মার্ক স্যালট্রিনেরি উত্তরণকে আলাদা করে ডেকে বললেন, “হ্যাভ ইউ বিহেভড ইমপ্রপারলি উইথ এনি ওম্যান? আপনি আমাদের রেসপেকটেড গেস্ট, তাই আলাদা করে জিজ্ঞেস করে নিচ্ছি। ইউ নো হাউ টাফ দ্য ল’জ় আর নাও।”

“হোয়াট আর ইউ সেয়িং?”

“আপনার নামে একটা কমপ্লেন জমা পড়েছে মিস্টার মুখার্জি। আমরা কী করব বলুন?”

“কে নালিশ করল আমার নামে?”

“বৈদেহী শর্মা। ইয়োর এক্স-স্টুডেন্ট।”

“কিন্তু বৈদেহী তো নিজেই এগিয়ে এসে হাগ করল আমাকে। আমি জাস্ট রেসপন্ড করেছি। যেমন এদেশের রীতি। ইমপ্রপার কিছুই ছিল না সেখানে।” উত্তরণ একটা বজ্রাঘাতের পরও সোজা দাঁড়িয়ে থেকে বললেন।

“জানি না। নালিশ এলে আমাদের চুপ করে থাকার নিয়ম নেই। কিন্তু আমরা সত্যিই চাই না, এই ব্যাপারটা নিয়ে কেয়স হোক। সেক্ষেত্রে সেমিনারটা পুরো ঘেঁটে যাবে। প্লাস আপনার রেপুটেশন নিয়েও আমরা চিন্তিত।”

উত্তরণ হেসে উঠলেন, “আমার রেপুটেশন নিয়ে ভাববেন না। সম্ভব হলে, আপনি বৈদেহীকে ডাকুন একবার। আপনার সামনেই দু’মিনিট কথা বুলি মেয়েটার সঙ্গে। তারপর যা আপনাদের ইচ্ছা, করবেন।”

মার্ক বেরিয়ে যেতেই উত্তরণের মনে হল, আজই সেই দিন যেদিন তিনি বিষ খেলেও কেউ বাঁচাতে আসবে না, আর আসবে না বলেই তিনি মুক্ত। দেশটা আমেরিকা… মন্ত্রকে সরকার দেখে দেবে, বাপ-মা না দেখলেও। কিন্তু অপরাধ না করে এত বড় শাস্তি ভোগ করা সম্ভব নয়। নাকি অপরাধ মনে না করলেও, অপরাধ করেছেন তিনি? ঠাকুর যাঁকে সন্ন্যাসী দেখতে চেয়েছিলেন, তাঁর পক্ষে কোনও মেয়েকে জড়িয়ে ধরাই অপরাধ। মেয়েটি নিজের থেকে এগিয়ে এলেও অপরাধ। কেন বৈদেহীকে ঠেলে সরিয়ে দিলেন তিনি? অবচেতনে স্পর্শ চাইছিলেন কোনও প্রখর যুবতীর? তাই আলিঙ্গন করেছিলেন?

মার্ক একাই ফিরে এসেছিলেন কিছুক্ষণ পরে। জানিয়েছিলেন যে বৈদেহী নিজের নালিশ ফিরিয়ে নিয়েছে। তাই ব্যাপারটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করাই ভাল।

উত্তরণের মন মানেনি। ওই অপমান মুখ বুজে মেনে নেওয়ার অবস্থায় ছিলেন না বলেই মার্ককে অনুরোধ করলেন, যেভাবেই হোক, বৈদেহীকে একবার ওঁর সামনে এনে দাঁড় করাতে।

কিন্তু মার্ক আবারও একাই ফিরে এসে বললেন, ব্যাপারটা নিয়ে বাদ-প্রতিবাদের আর কোনও অর্থই হয় না। বৈদেহী যখন জলঘোলা করতে চাইছে না, তখন উত্তরণ কেন খুঁচিয়ে ঘা করছেন?

“কিন্তু ও নালিশটা করেছিল কেন?”

“আমি কী করে বলব? শি জাস্ট সেড দ্যাট শি ওয়াজ় নট ইউজ়ড টু হোয়াট ইউ ডিড।” মার্ক খানিকটা বিরক্ত গলায় বললেন।

আমি যা করেছি তার সঙ্গে ও পরিচিত ছিল না? আলিঙ্গন যে করে, সে তো আলিঙ্গনের মধ্যেই থাকে। কীভাবে ইমপ্রপার সেটা? কোথায় ইমপ্রপার? নিজেকে জিজ্ঞেস করছিলেন উত্তরণ, জীবনে প্রথমবার মদে চুমুক দিতে দিতে।

আটলান্টায় সেই রাতেই আসল অভদ্র কাজটা করেছিলেন। দু’জন ইচ্ছুক নর-নারীর ঘরে ঢুকে গিয়ে। জাগতিক সবকিছু সম্বন্ধে নির্বোধ ছিলেন বলে বুঝতে পারেননি। তারই দণ্ড ভোগ করলেন আজ।

সেদিন ঠান্ডার মধ্যে পাবে বসে থাকলেও মদ মুখে তোলেননি। জোরও করেনি কেউ। আজ স্বেচ্ছায় হুইস্কি পান করলেন। কেন করলেন, তা উত্তরণ জানেন না। কিন্তু না করে উপায় ছিল না। একটা জ্বালাকে দূর করতে আর-একটা জ্বালা তো দরকার!

হোক অপরাধ, আরও অপরাধ হোক। পৃথিবীর যত নাস্তিক, যত অবিশ্বাসী সবাই কি অপরাধী? তাদের তো কোথাও কৈফিয়ত দিতে হয় না। উত্তরণের একার মনের মধ্যে কেন সবসময় ঘড়ির কাঁটার মতো একজন ঈশ্বরকে জাগিয়ে রাখতে হবে, আর আচারে-ব্যবহারে তাঁর সমকক্ষ হওয়ার অবাস্তব চেষ্টা করে যেতে হবে আজীবন? কেন একজন নাস্তিকের সীমাহীন স্বাধীনতা উত্তরণ ভোগ করতে পারবেন না ইহজীবনে? কী এত দায় নিজেকে প্রমাণ করার? কী লাভ প্রমাণ করে? কোন পুরস্কার অপেক্ষা করছে?

জীবনভর যা মেনে চলেছেন তার একেবারে বিপরীত একটা চিন্তাস্রোত সুনামির মতো আছড়ে পড়ছিল উত্তরণের সত্তায়। শরীরের ভিতরে বৃশ্চিকদংশনের মতো মদের চলাচল অনুভব করতে-করতে উত্তরণ বারে বসেই চেঁচিয়ে উঠলেন, “অন্ধ ভক্ত হওয়ার চাইতে চোখ-খোলা বিদ্রোহী হওয়া অনেক ভাল। স্যাটান না থাকলে, কোথায় তোমার প্যারাডাইস ভগবান? এসব কথা বলা যদি আমার অপরাধ হয়, তা হলে অপরাধীই হতে চাই আমি। অনেক দূরে সরে যেতে চাই এই ধর্ম আর জপ-তপের দুনিয়া থেকে। এত দূরে চলে যেতে চাই যাতে ঠাকুরের কেউ বলে চিহ্নিত না হই আর, আমার গায়ের নোংরার দাগ যেন ঠাকুরের আসন অবধি না পৌঁছয়।”

“অপরাধী তো আপনি নন, আমি। আমায় ক্ষমা করবেন না?” ইউনিভার্সিটির সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় বৈদেহীকে নিজের পাশে আবিষ্কার করলেন উত্তরণ একদিন।

“মিথ্যে অভিযোগ করা যতটা সহজ, ক্ষমা চাওয়াও বোধহয় ততখানিই, তাই না?”

“আমি জানি আপনি এখন আমায় ঘেন্না করেন। আমার একটা কথাও বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে না আপনার। কিন্তু সেদিন ওই সময়ে আপনার নামে নালিশ না করলে রুচির আমাকে মেরে ফেলত।” বৈদেহী ধরা গলায় বলল।

“কে মেরে ফেলত?”

“আমার এক্স-বয়ফ্রেন্ড স্যার। ও আমায় সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়েছে, মেরেছে। আমি ওর খপ্পর থেকে বেরোতে পারিনি। সেদিন যখন আমি আপনাকে জড়িয়ে ধরেছি, রুচির সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। ওকে দেখে আমি মুখটা কাঁদো-কাঁদো করে ফেলতে বাধ্য হয়েছিলাম। আর মার খাওয়ার ভয়ে ওকে বলেছিলাম যে আপনিই এগিয়ে এসে হাগ করেছেন আমায়। ও-ই আপনার নামে নালিশ করেছিল স্যার, আমি নয়। আমি পরে ওকে অনেক বুঝিয়ে কমপ্লেন উইথড্র করিয়ে নিই, আমার রিসার্চের বাহানা দিয়ে।”

“তুমি যে এখন আমার কাছে এসেছ… ও তো আবার নালিশ করে দিতে পারে আমার নামে? রেপ কিংবা মলেস্টেশন চার্জ দিয়ে দিল হয়তো। বিশ্বাস কী?”

“রুচির হ্যাজ় বিন অ্যারেস্টেড স্যার। হি উইল নট ডিসটার্ব আস এনি মোর, রেস্ট অ্যাশিওরড। দ্য ড্রাগ পেডলার ইজ় বিহাইন্ড দ্য বারস নাও।”

“তুমি একজন ড্রাগ পেডলারের বান্ধবী?”

“আমি জানতাম না স্যার। কিছু জানতাম না। বিলিভ মি।”

“আমার বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাস কোনওটাই করার দরকার নেই বৈদেহী। আমি যদিনা-ও পারি, ঈশ্বর ক্ষমা করুন তোমাকে। তুমি আসতে পারো এখন।”

বৈদেহী সেদিনের মতো ফিরে গেলেও, এক সপ্তাহ পরে ফিরে এল আবার। এবার উত্তরণের বাড়িতে।

বাইরে বেরিয়ে বৈদেহীকে দেখে রেগে গেলেন উত্তরণ, “এখানে কেন এসেছ তুমি?”

“আমার ফিরে যাওয়ার জায়গা নেই স্যার। আইদার আপনি আমায় আশ্রয় দেবেন, নয়তো সুইসাইড করতে হবে আমায়।”

“তুমি নিজের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ বৈদেহী। প্লিজ় গো অ্যাওয়ে ফ্রম হিয়ার।”

“আপনি তাড়িয়ে দিলে আমি আর কোনওদিন আপনাকে বিরক্ত করব না। কিন্তু আমাকে আপনি ফিরিয়ে দেবেন? বিশ্বাস করুন, আমি থাকার জায়গা হয়তো অন্যত্রও পাব। তবু আপনার কাছে আশ্রয় চাইছি, কারণ আমি শুধু শ্রদ্ধা করি না আপনাকে, ভালবাসি।”

“জাস্ট স্টপ দিস ননসেন্স।”

“নো আই ওন্ট। বিকজ় আই লাভ ইউ। অ্যান্ড দ্যাট টু ফ্রম মাই স্টুডেন্ট ডেজ়। ইউ ওয়্যার দ্য রিজ়ন হোয়াই আই লাভড ফিলোসফি। আমি জানি না, আপনি কেন আমার চোখ দেখে বুঝতে পারেননি।”

“আমি বুঝতে চাই না। আমি বোঝার অবস্থায় নেই।”

“কেন স্যার? জাস্ট বিকজ় ইয়োর এক্স-ওয়াইফ হ্যাজ় ডিভোর্সড ইউ, লাইফ ক্যানট স্টপ। লেটস স্টার্ট আফ্রেশ।”

“আমি একটা কাজে আছি, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। তুমি প্লিজ় এখান থেকে চলে যাও।”

“দেরি হয়ে গিয়েছে বলেই তো আর দেরি করাতে চাইছি না। নতুন করে জীবন শুরু করুন আমার সঙ্গে। আমাকে তাড়িয়ে দেবেন না। ফর হেভেনস সেক।”

উত্তরণের হঠাৎ সত্যসেবী আশ্রমের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। একটা চোর ভজন-কুটিরে এসে ঠাকুরের পায়ে মাথা রেখে কাঁদতে শুরু করেছে। পিছন-পিছন তিনটে লোক এসে চোরটাকে তাদের হাতে তুলে দিতে বলতেই ঠাকুর বললেন, “আশ্রয় যে চাইছে, তাকে তো আমি তোমাদের হাতে তুলে দিতে পারি না।”

‘যে আশ্রয় চায়, তাকে আশ্রয় দিতে হয়।’ ব্রহ্মচারী ঠাকুরের কথাগুলো মাথার ভিতর বেজে উঠতেই উত্তরণ অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন।

বৈদেহী বোধহয় এটারই অপেক্ষায় ছিল। এগিয়ে এল তাই।

২৬

“সূর্যই আলো। সেই আলোতেই আমরা হাঁটি, চলি, কাজ করি। যখন সূর্য ডুবে যায় তখন চন্দ্র আলো দেয়। যখন চাঁদও ডুবে যায়, তখন আলো মানে আগুন। আর আগুন নিভে গেলে বাক্য আমাদের আলো, কারণ তার আওয়াজ শুনে আমরা এগিয়ে যেতে পারি। যখন সূর্য-চন্দ্র ডুবে গিয়েছে, আগুন নিভে গিয়েছে, কথাও বলছে না কেউ, তখন আত্মাই আলো। সে-ই পথ দেখায়…”

জনক রাজার প্রশ্নের উত্তরে যাজ্ঞবল্ক্য ঋষির উত্তরগুলো ব্যাখ্যা করছিলেন উত্তরণ। ক্লাসের শেষে নিজের চেম্বারে ফিরে এসে ভাবছিলেন, বৃহদারণ্যক উপনিষদের যুগে যা সত্যি ছিল, আজ কি তা মিথ্যে? মিথ্যে না হয়ে উপায় কী? আজ শরীরের প্রবল প্রতাপে আত্মার অস্তিত্ব কোথায়? কে বাঁচিয়ে রাখতে পারে আত্মাকে?

“তুমি নিজেই কি পেরেছ?” গল্পটা শুনতে-শুনতে স্কাইপে জিজ্ঞেস করল অনসূয়া।

“জানি না, পেরেছি কি না। তবে তুমি যা ভাবছ, তা-ও সত্যি নয়। বৈদেহীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক শারীরিক নয়। বা বলতে পারি, তোমার সঙ্গে যে মাত্রায় শারীরিক ছিল, সেই মাত্রায় নয়।” উত্তরণ চোখ সরিয়ে নিলেন ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে।

“তার মানে ইন্টারকোর্স ছাড়া সব হয়?” হেসে উঠল অনসূয়া।

সেই হাসির শব্দ তিরের মতো বিঁধতে শুরু করল উত্তরণকে। শরীরের প্রতিটা অঙ্গে তীক্ষ্ণ, তীব্র ক্ষত তৈরি করতে লাগল, যেখান থেকে রক্ত না বেরোলেও কান্না বেরোয়।

“তোমার মনে আছে উত্তরণ, তিরিশ-চল্লিশটা বাড়ি দেখার পর, এই বাড়িটা পছন্দ করেছিলাম? তখন এটা সদ্য জমির উপর মাথা তুলছে। বাড়িটার পজ়িশন যে খুব কিছু ভাল লেগেছিল, তা নয়। কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছিলাম, সেকেন্ড-হ্যান্ড বাড়িতে তুমি কমফর্টেবল ফিল করবে না কখনওই। তোমার মনে হবে, এই বাড়ির আগের বাসিন্দারা বাড়িটাতে কেমন জীবন কাটিয়ে গিয়েছে…”

“ঠিকই ভেবেছিলে তুমি।”

“শুধু ভেবেই বসে থাকিনি। কোন মর্টগেজ কোম্পানির থেকে কম সুদে, সুবিধাজনক শর্তে লোন পাওয়া যাবে, তাই নিয়ে মারামারি করেছি দিনের পর দিন। তুমি যখন জপে বসে থাকতে, আমি তখন সার্চ করতাম, কীভাবে অ্যাপ্লাই করলে তাড়াতাড়ি লোন স্যাংশন হবে। শুধু কি লোন? ঘর কত বড়, বাথরুম ক’টা, বেসমেন্ট ফিনিশড কি না, কলোনিয়াল না কেপ নাকি ভিক্টোরিয়ান, কোন স্টাইলের বাড়ি হবে… রিয়েল এস্টেট এজেন্টের সঙ্গে যাবতীয় কথাবার্তা আমিই তো বলতাম।”

“কে অস্বীকার করেছে? যে পঞ্চাশটা বাড়ি দেখেছ এটা ঠিক করার আগে, খুব বেশি হলে, তার পাঁচটা দেখার সময় আমি তোমার সঙ্গে ছিলাম। তুমি না থাকলে আমেরিকায় আমার বাড়ি হত না।”

“তোমার বাড়ি, তাই না উত্তরণ? একা তোমার? যেখানে তুমি একটা অন্য মেয়ের সঙ্গে লিভ-টুগেদার করো আর অবলীলায় বলে দাও যে ইন্টারকোর্স ছাড়া সব হয়েছে। ওটাই বা বাকি রেখেছ কেন? আগুনের খাপরার মতো একটা বস্তুকে স্যাটিসফাই করতে পারো না বলে?”

উত্তরণ ফোনটা কেটে দেবেন ভেবেও কাটতে পারলেন না। শুধু জিজ্ঞেস করবেন ভাবলেন, মাঝখানে যে লোকটা থাকে, তার করণীয় কী? বৈদেহীর কথাগুলো এঁর মাথায় ঘুরছিল তখন।

“প্রত্যেকটা মানুষ একটা ঘর। সেই ঘরের একটা নির্দিষ্ট চাবি থাকে। আপনার ঘরের চাবিটা আপনার এক্স-ওয়াইফ সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছেন। আপনি তাই ঠান্ডায় বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে একটা চান্স দিন না স্যার, নতুন চাবি বানিয়ে দিই আপনার।”

না, উত্তরণ সাড়া দিতে পারেননি বৈদেহীর ডাকে। সঙ্গম হয়নি এক ছাদের নীচে বসবাস করা দুই নর-নারীর। কিন্তু বৈদেহী ওঁকে জড়িয়ে ধরলে, চুমু খেলে, সবসময় ধাক্কা দিয়ে সরিয়েও দিতে পারেননি মেয়েটাকে। সেটা কি পাপ, নাকি দুর্বলতা? যদি দ্বিতীয়টা হয়, অনসূয়াকে বোঝাবেন কী করে?

“আমি তো তোমাকে এই বাড়ি থেকে চলে যেতে বলিনি অনসূয়া। তুমি নিজের ইচ্ছায় গিয়েছ। এমনকী নিজের মেয়েকে পর্যন্ত সঙ্গে রাখতে চাওনি।”

“হ্যাঁ, চাইনি। কারণ আমার কাছে তোমার অস্তিত্ব যতটা প্রবল, তোমার কাছে আমার অস্তিত্ব ততটা নয়। মন্ত্র তোমার কাছে একটা বাচ্চার মতোই মানুষ হতে পারবে বলে মনে হয়েছিল, আমার কাছে ও তো তোমার প্রতিভূ হিসেবে জেগে থাকত প্রতিটা মুহূর্ত। সারাক্ষণ আমায় মনে পড়াত যে তুমি নেই, আমার কাছে নেই। আমি পাগল হয়ে যেতাম। কিন্তু আমি তো বাঁচব বলে পালিয়েছিলাম গো।” অনসূয়ার গলা বুজে এল।

“তুমি তো নতুন করে বাঁচছই। তোমার রঞ্জিত তোমাকে ছন্দে, কবিতায় নতুন করে বাঁচাচ্ছে প্রতিনিয়ত। যে সুখ আমি তোমায় দিতে পারিনি, সেই সুখ ও তোমায়…”

“ভুল জাননা, ভুল। রঞ্জিতের সঙ্গে আমি আর নেই।”

“মানে? ওকেও ডিভোর্স করে দিয়েছ?”

“বিয়েই হয়নি আমাদের। আসলে রঞ্জিত আমার শরীর আর পয়সাকে যতটা চেয়েছিল, আমাকে ততটা চায়নি। আদৌ চেয়েছে কি না, তাও জানি না।”

“কিন্তু ও তো কবি?”

“কবিরা কি মঙ্গলগ্রহ থেকে আসে নাকি? তারা একটা পুরস্কারের জন্য এমন অনেক কাজ করে ফেলতে পারে, যা সাধারণ মানুষ ভাবতেও পারে না। শুধু রঞ্জিত নয়, ওর অন্যান্য কবি-বন্ধুদেরও খানিকটা দেখলাম তো আমি। নিজেদের সুবিধার জন্য কেউ-কেউ খুনও করে ফেলতে পারে বোধহয়। আর তা ছাড়া অনেকের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে না থাকলে কবিতা লেখা যায় নাকি?”

“তুমি একটু বেশিই নেগেটিভ বলছ।”

“একদম না। রঞ্জিতকে যখন আমি প্রায় হাতেনাতে ধরে ফেলেছিলাম একবার, ও বলেছিল যে শিকলে বেঁধে রাখলে ওর সৃষ্টিশীলতা ধ্বংস হয়ে যাবে।”

“তা হলে এখন তুমি…”

“ভয় পেয়ো না উত্তরণ। আমি তোমার কাছে ফিরতে চাইব না। বরং আমি চাইব তুমি দারুণভাবে বাঁচো।”

“হ্যাঁ, দারুণভাবেই বাঁচছি।” উত্তরণ হাসি চাপলেন।

“আবার সন্তানের বাবা হও। বারবার তো মন্ত্রর মতো কেউ জন্মাবে না।”

বুকে যেন একটা বুলেট ঢুকে গেল। উত্তরণ তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, “একশোবার বাবা হলে, আমি একসোবার মন্ত্রেরই বাবা হতে চাইব।”

“একটা শোভন, সুন্দর, জীবনের অধিকার সবার আছে। কষ্ট পেতে-পেতে কষ্ট ফুরিয়ে যায়। তোমার জীবনের কষ্ট শেষ হয়ে এসেছে বলে আমার মনে হয়। তুমি এবার আনন্দে বাঁচবে। ঐশ্বরিক ঘেরাটোপে আর বন্দি থাকবে না।”

“আমার মধ্যে ঐশ্বরিক কিছু কোনওদিনই বোধহয় ছিল না অনসূয়া। আমি হাজতে রাত কাটিয়েছি, স্ত্রী ছেড়ে চলে যাওয়ার পর অন্য মেয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছি, কোন ঐশ্বরিক বিভা তুমি আমার মধ্যে দেখেছিলে, তুমিই জাননা। আমার এখন মনে হয়, আমি ভগবানের আবর্জনা। আই অ্যাম জাস্ট গড়স গারবেজ। নাথিং এলস। আমি সারা জীবন ভগবানকেই ভালবেসেছি। মানুষের মধ্যে থেকেও, আমার প্রেম-অপ্রেম সমস্তটা নিয়ে ভগবানের কাছে পৌছঁতে চেয়েছি। কিন্তু কোথায় আছেন সেই ভগবান? সেই প্র্যাকটিক্যাল গড, যিনি বিপদে সাড়া দেন? তাঁকে আমি কোথায় খুঁজে পাই অনসূয়া?” কান্নায় ভেঙে পড়লেন উত্তরণ।

“তোমাকে স্কাইপে কল করতে বলে অন্যায়ই করলাম হয়তো। কী করব, তোমার জীবনে নতুন কারও আসার খবর শুনে নিজেকে স্থির রাখতে পারিনি।” বলতে-বলতে অনসূয়াও কেঁদে উঠল।

দুটো কান্নার ভার বইতে না পেরেই হয়তো যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেল দুটো মহাদেশের।

২৭

মেরিল্যান্ডের যেখানে উত্তরণ বাড়ি কিনেছিলেন, সেই সিলভার স্প্রিং বেশ পশ এরিয়া। মূলত হোয়াইট আমেরিকানদেরই বাস এখানে। গুজরাতি ও তামিলদের দৌলতে কিছু উচ্চ-প্রতিষ্ঠিত ভারতীয়ও বসবাস করে। বাঙালি অল্পই, তাই এই মহল্লায় দুর্গাপুজো হয় না। আমেরিকায় বারুইপুর থেকে বেহালা, বর্ধমান থেকে দুর্গাপুরের দুরত্বে যারা থাকে, তারাও প্রতিবেশী। সেরকমই একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ওয়াশিংটনের মেট্রোয়। সন্দীপন গুহ বলে সেই ভদ্রলোক নিজের বাড়িতে দুর্গাপুজো করেন। একবার অন্তত পুজোয় আসার সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়েছিলেন উত্তরণকে।

বিদেশ-বিভুঁইয়ে মায়ের পুজোর খবর পেয়েও যাবেন না? উত্তরণ তাই বেশ খানিকটা গাড়ি চালিয়ে দুপুর-দুপুর গিয়ে পৌঁছলেন ব্র্যাম্বেলটন বলে একটা ছবির মতো মহল্লায়, সন্দীপন গুহর বাড়িতে। এই জায়গাটা মেরিল্যান্ডের লাগোয়া স্টেট ভার্জিনিয়ায় পড়ে, কিন্তু মায়ের পুজোয় আবার ভৌগোলিক সীমারেখা কীসের?

প্রতিমার সামনে বসে খুব পবিত্র লাগছিল উত্তরণের। কিন্তু মনটা তেতো হয়ে গেল যখন বিকেল না হতেই অঞ্জন পালিত বলে একজন বাড়ির পিছনের একটা ঘরে বারোয়ারি মদ্যপানের আসরে যোগ দেওয়ার জন্য ডাকতে এল উত্তরণকে। আর আসল কথা বলার আগে খানিকটা অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলে নিল যে উত্তরণের নামের সঙ্গে সে পরিচিত।

“পুজোর সন্ধ্যাতেও মদ্যপান?” বিস্ময় আর বিরক্তি মিশিয়েই জিজ্ঞেস করলেন উত্তরণ।

“পুজোয় মদ খাবে না লোকে? আরে এসব অং-বং-চং মানেই তো একটা সোশ্যাল গ্যাদারিং, তাই না? সেখানে ফুর্তি-ফার্তা না হলে চলে?” লোকটা দেঁতো হাসি হাসল উত্তরণের দিকে তাকিয়ে।

“সে করতে চাইলে, এমনিই করুন। পুজোর নামে গ্যাদারিং করতে-করতে পুজোটা না শেষে বরবাদ হয়ে যায়।”

অঞ্জন থমকে গেল এক মুহূর্তের জন্য। তারপর উত্তরণের দিকে তাকিয়ে বলল, “স্যার দেখছি কনজ়ারভেটিভ। আমি তো ভেবেছিলাম আমরা গর্ব করি যাকে নিয়ে সেই লোকটা লিবারাল। তা ছাড়া দু’-দুটো বিয়ে করেছেন… বেঙ্গলি, আবার নন-বেঙ্গলিও…”

উত্তরণ সরে গেলেন লোকটার সামনে থেকে। নাম-কা-ওয়াস্তে প্রসাদ নিয়ে ফেরার পথে ভাবছিলেন, কে ওঁর প্রতিটা আনন্দের ভিয়েন এভাবে ধ্বংস করে দেয়? কোন নিয়তি সে? কোথায় থাকে?

অথচ কী সুন্দরভাবে শুরু হয়েছিল দিনটা।

গত রাতে চমৎকার একটা স্বপ্ন দেখেছিলেন উত্তরণ। সেই স্বপ্নের রেশ নিয়ে ভোরবেলা উঠে মনে হয়েছিল, আমেরিকা হোক বা ভারত, দেবীপক্ষে সর্বত্রই দেবীর আরাধনা হওয়া দরকার। আর মন্ত্র তো কেবল ওঁর মেয়ে নয়, সে যে দেবীর অংশ! পৃথিবীর সব মেয়ের মতোই, দেবাংশী।

স্নান সেরে জপের পর, উত্তরণ মন্ত্রকে স্নান করে আসতে বললেন। কথা বলতে না পারলেও সবই বুঝত মেয়েটা। আর স্বভাবটাও ভারী ভাল, ওর স্পেশাল স্কুলের শিক্ষিকারা উত্তরণের কাছে বারংবার প্রশংসা করতেন ওঁর মেয়ের। গর্বে বুক ভরে উঠত উত্তরণের।

সেদিনও মেয়েকে পাশে বসিয়ে গর্ব হচ্ছিল বাবা হিসেবে। মন্ত্রকে ইশারায় ব্রহ্মচারী ঠাকুরের প্রতিকৃতির দিকে তাকাতে বললেন উত্তরণ।

মন্ত্র তাকাল।

বৈদেহী কোনও একটা কাজে বাইরে গিয়েছিল বলে, নিচ্ছিদ্র শান্তিতে ভরে ছিল ঘরটা। অনসূয়াই এত সুন্দর একটা ঠাকুরঘরের প্রভিশন রেখেছিল বাড়ির প্ল্যানে, তাই অনসূয়ার প্রতিও কৃতজ্ঞ হয়ে উঠলেন উত্তরণ। কৃতজ্ঞতা জন্মাল সারা বিশ্বপ্রকৃতির প্রতি। মানুষ হয়ে জন্মেছেন বলে, ঠাকুরের শিষ্য হতে পেরেছেন বলে, মন্ত্রর বাবা হয়েছেন বলেও। বাইরে কতগুলো পাখি কিচিরমিচির করছিল। ওরাও বোধহয় বিশ্ববিধাতাকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছিল।

উত্তরণ সামনের বাগানে কিছু ফুলগাছ লাগিয়েছিলেন, অনসূয়াও লাগিয়ে গিয়েছিল কয়েকটা। সেই গাছগুলোর ফুলেই নিত্যপূজা করতেন। আজ পুজোর শেষে মন্ত্রর হাতে ফুল তুলে দিয়ে ঠাকুরের পায়ে দিতে বললেন।

বাবার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করল মেয়ে।

উত্তরণ এবার মেয়ের মাথাটা হাত দিয়ে কাছে টেনে, ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে গেলেন। তারপর ঠাকুরের যে বীজমন্ত্র একদিন পৃথিবীর প্রথম শ্লোকের মতো জন্ম নিয়েছিল ওঁর কানে, যে মন্ত্র সারা পৃথিবীতে উত্তরণকেই ছড়াতে হবে বলে বলেছিলেন বিজয়দা, সেই মন্ত্র পৃথিবীর আর-একজনের কানে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন।

হয়তো পাপের ভিতর দিয়ে গিয়েছেন উত্তরণ, ঠাকুরের ইচ্ছা এবং বাক্য লঙ্ঘন করেছেন জ্ঞানত বা অজ্ঞানত, তবু ঠাকুর উত্তরণের কণ্ঠ, ওষ্ঠ, জিভ দিয়েই ওই মহাপরাক্রমী মন্ত্র উচ্চারণ করালেন। এতদিন যাকে নিঃশব্দে উচ্চারণ করেছেন, আজ তা-ই সশব্দে বললেন। একবার-দু’বার-তিনবার বললেন। মন্ত্রের কানে ‘মন্ত্র’ প্রবেশ করল।

মেয়ে অবাক হয়ে তাকাল বাবার দিকে।

দ্রুতবেগে গাড়ি চালিয়ে ফিরতে-ফিরতে উত্তরণ ভাবছিলেন, কেন যেতে গেলেন ওই নেমন্তন্নে? আজকের এত পবিত্র একটা দিনের গায়ে কেন কলুষ লাগতে দিলেন? বাড়িতেই তো থাকতে পারতেন, মেয়েকে কাছে বসিয়ে জপ করে যেতে পারতেন দুপুর পেরিয়ে সন্ধ্যা অবধি।

চাবি খুলে ঘরে ঢুকে উত্তরণ দেখলেন, ধোঁয়ায় ধোঁয়া। তিন-চারটে বিয়ারের বোতল গড়াচ্ছে মেঝেয়। ফিরে এসেছে স্বৈরিণী, আর ফিরেই নরক করে তুলেছে বাড়িটাকে।

“বৈদেহী?” চিৎকার করে উঠলেন উত্তরণ।

হট প্যান্ট পরা বৈদেহী ওঁর সামনে এসে দাঁড়াল।

“আমি তোমায় বলেছি না যে এই বাড়িতে এরকম উদ্ধৃঙ্খলভাবে থাকা যাবে না!”

“আর ইউ ট্রাইং টু প্ৰিচ সামথিং প্রফেসর?”

“নো। আমি শুধু বলছি যে এখানে থাকতে গেলে, কিছু ডিসিপ্লিন মেনে চলতে হবে।”

“আদারওয়াইজ় কী করবে?”

“সিম্পলি বার করে দেব।” উত্তরণ ধৈর্য হারালেন।

“ওসব লেকচার অন্যকে দিয়ো, নট মি। আমায় তাড়ানোর চেষ্টা করলে, তোমার নিজের বাস উঠে যাবে এই বাড়ি থেকে।”

“ভালই তো। আমি মাসে-মাসে লোন শোধ করার ঝক্কি থেকে বেঁচে যাব। তুমি যখন থাকবে, তখন ধারটা তুমিই শোধ কোরো।”

“প্যাঁচ কোষো না আমার সাথে। আমি তোমার এক্স-ওয়াইফ নই যে সুড়সুড় করে বেরিয়ে যাব। আই উইল গো অ্যান্ড কমপ্লেন এগেনস্ট ইউ।”

“সেই যেমন করেছিলে?”

“ইয়াপ। তবে এবার আর উইথড্র করব না। তখন আমাকে সেক্সুয়ালি এক্সপ্লয়েট করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে তুমি জেল খাটবে। আর আমি আরামে…”

“তুমি খামোকা পড়াশোনা করতে এসেছিলে কেন? অভিনয় করতেও তো পারতে?”

“আই ওয়াজ় আ ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। ইউ নো দ্যাট।”

“আমি যা জানি তা হল, তোমার ফ্যামিলি টাকা খরচ করে পড়তে পাঠিয়েছিল তোমায়। তুমি একজন স্পনসর্ড স্টুডেন্ট ছিলে।”

“বাট স্টিল ইউ প্যাম্পার্ড মি।”

“তুমি আমার দেশের মেয়ে বলে …”

“ঝুট মত বোলো। অন্যদের মতো তুমিও হেলে গিয়েছিলে আমায় দেখে।”

“তুমি মরতে এলে কেন, আমার কাছে?”

“বিকজ় ইউ আর দ্য লিস্ট হার্মফুল অফ দেম… আর আমার নিজেকে লুকিয়ে রাখাও দরকার!” হেসে উঠল বৈদেহী।

বৈদেহী প্রলাপ বকছে ভেবে উত্তরণ সরে গেলেন ওর সামনে থাকে। মেয়ের ঘরে ঢুকলেন। দেখলেন মন্ত্র নির্জীব হয়ে শুয়ে আছে মেঝেয় আর ওর কপালের কাছটায় অনেকটা কেটে গিয়েছে। রক্ত চুইয়ে পড়ছে সেখান থেকে।

উত্তরণ ঘর থেকে বেরিয়ে এসে উন্মত্তের মতো চিৎকার করে উঠলেন বৈদেহীর নাম ধরে।

বৈদেহী পালটা চেঁচিয়ে উঠল, “কী মেয়ে হয়েছে তোমার! মানুষকে টলারেট করতে পারে না। আমাকে ঘর থেকে বার করে দিতে চাইছিল, তখন আমিও একটা ধাক্কা দিয়েছি। জাস্ট গিভ হার সাম ফার্স্ট-এড। শি উইল বি অলরাইট।”

উত্তরণ মন্ত্রর কাছে ফিরে গিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন। জীবনে এই প্রথম শারীরিক হিংসার প্রয়োজন বোধ করছিলেন। আর একই সঙ্গে নিজের প্রতি অসম্ভব ধিক্কারে নুয়ে পড়ছিল সারা শরীর। মনে হচ্ছিল, ওঁর তো চাতকের মতো শুধুমাত্র বৃষ্টির জলের অপেক্ষায় থাকা উচিত ছিল। অথচ নর্দমার জলকেও চিনতে না পেরে তৃষ্ণা মেটাতে গিয়েছিলেন। কেন ওই মেয়েটাকে অ্যালাও করলেন বাড়িতে! কেন?

অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে উত্তরণ বললেন, “আমি আমার মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি। ফিরে এসে তোমাকে যেন আর এখানে না দেখি।”

“আমাকে না দেখতে চাইলে, তুমি নিজেকেও এখানে দেখবে না। বিকজ় আই নো হোয়াট টু ডু।” বৈদেহী ঘরের মধ্যেই থুতু ছেটাল।

উত্তরণ ওর দিকে একটা আগুনে দৃষ্টি হেনে, বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। সিট-বেল্ট বাঁধা মেয়েটাকে পাশে বসিয়ে ড্রাইভ করতে-করতে ভাবছিলেন, এই মেয়েটাই তো ঈশ্বরী। আহত-অসুস্থ অবস্থাতেও বাবার দিকে তাকিয়ে হাসছে। কিন্তু এই ঈশ্বরকে বিস্ময় হিসেবে গ্রহণ করলে, বিস্ময় যখন কেটে যাবে, ঈশ্বরও তামাদি হয়ে যাবেন।

ভুবনেশ্বর আশ্রমের স্বামী মাধবানন্দ বলতেন, ঈশ্বরকে নেওয়া উচিত চরম শূন্যতাকে ভরিয়ে রাখার শক্তি হিসেবে। তিনি না থাকলে এই শূন্যতা জ্যান্ত কামড়ে খেত আমাদের সবাইকে। কথাটাকে ধ্রুব সত্য মনে হল উত্তরণের। সেই মুহূর্তে।

হাসপাতালের পার্কিং লটে গাড়ি দাঁড় করিয়ে উত্তরণ সর্বশক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন নিজের মেয়েকে। তারপর মন্ত্রকে গাড়ি থেকে কোলে করে নামিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, “মাই ডটার নিডস হেলপ। ইমিডিয়েটলি।”

২৮

ঠাকুর যে কোথায় কাকে দাঁড় করিয়ে রাখেন, মানুষ জানতে পারে না। নইলে পনেরো বছরের উপর যার সঙ্গে কোনও যোগাযোগই নেই, সেই সোমনাথ ওই হাসপাতালে থাকবে কেন, সেই রাত্রেই?

ভার্জিনিয়ায় থাকা ভাইয়ের বউয়ের লেবার পেন ওঠায় হাসপাতালে এসেছিল সোমনাথ। কিন্তু পরের চার দিন, ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী, তাদের সদ্যোজাত সন্তানকে এককম বিস্মৃত হয়ে, উত্তরণের সঙ্গেই লেগে রইল লোকটা।

“তুই আমাকে ভুলে গেলেও, আমরা কেউ ভুলতে পারিনি তোকে। তুই রত্ন ছিলি আমাদের ব্যাচের। কোহিনূর ডায়মন্ড। কেজি ম্যাডাম বলতেন। আর কোহিনুর কি দেশে থাকে?

এত আন্তরিকভাবে কথাগুলো বলত সোমনাথ, নিজের জীবনের সব দোষ-ত্রুটির কথা এমন সরলতায় স্বীকার করত যে ওকে দূরে ঠেলা যেত না। ‘তুমি’ করে ডাকা যেত না ‘তুই’এর উত্তরে।

কিন্তু আমেরিকার নিয়মকানুন, বিশেষ করে বাচ্চা প্রতিপালনের ক্ষেত্রে, সরল নয়। যথেষ্ট জটিল এবং কঠিন। বাচ্চা খাট থেকে পড়ে যাওয়ার কারণে কিংবা মা বাচ্চাকে একটা চড় মেরে বসায় কত শিশুকে যে মা-বাবার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে গিয়ে ফস্টার কেয়ারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।

“এই সিপিএস, চাইল্ড প্রোটেকশনের নাম করে ছাগলের মতো একটা সিস্টেম চালু করে রেখেছে দেশজুড়ে। গার্জিয়ানকে টাইট দিয়ে বাচ্চার ভাল করা যায়?” সোমনাথ বলত।

কিন্তু সোমনাথের বলায় কী আসে-যায়? কী আসে-যায় উত্তরণের আবেদন-নিবেদনে? মন্ত্র সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরও তাই চার মাস মেয়েকে ফেরত পেলেন না উত্তরণ। বারচারেক জেরার সম্মুখীন হতে হল ওঁকে। আর প্রতিবারই সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিলেন উত্তরণ, বৈদেহী সম্পর্কে একটিও কথা না বলে।

মহানুভবতা থেকে যে উত্তরণ এমন করলেন, তা নয়। হাসপাতাল থেকে ফেরার পরে যখন অপরিসীম ঘৃণা চেপে ঘটনাটা ব্যক্ত করছেন, বৈদেহী ভয় পেয়ে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মাথা ঠুকছিল। জেরার ভয়ে কান্না, জেলে যাওয়ার ভয়ে কান্না। সেই কান্না শুনতে-শুনতে উত্তরণ বুঝতে পারছিলেন, অভিনয়ের অংশ বাদ দিয়েও মেয়েটার ভয়ের মধ্যে যতটুকু সত্যি আছে, আমেরিকার আইনরক্ষকদের মোচরে সেটা এলে, কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরোবে আর অধিকতর ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে হবে উত্তরণকেই।

বৈদেহীর আসল নাম শালিনী শর্মা। কানপুরে মস্ত বাড়ি ওদের। বাবা বড় ব্যবসায়ী। কিন্তু পড়াশোনায় মোটামুটি ভাল মেয়েটিকে বাড়ি থেকে একরকম জোর করেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় এক রাজনীতিবিদের ছেলের সঙ্গে। সেই ছেলেটি মদ্যপ অবস্থায় জিন্দা জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দিত, প্রায় রোজ। রিভলভার বার করে বউয়ের মুখে, বুকে, গলায় বোলাত। সেই রিভলভারে আবার চুমু খেত নিজে। ওইসব খেলা দেখাতে গিয়েই একদিন নিজের রিভলভারের গুলি ছেলেটার গলায় গিয়ে লাগে। সেফটি ক্যাচ খোলা ছিল সেটা খেয়াল করেনি, তাই অন্যকে নিয়ে তামাশা করতে গিয়ে নিজের মৃত্যু ডেকে এনেছিল গুন্ডাটা।

“এই গল্পটাও যে সেই বয়ফ্রেন্ড রুচিরের গল্পের মতো বানানো নয়, কী করে বুঝব?”

“ছেলেটার নাম রুচিরই ছিল স্যার।” বৈদেহী একটা হলুদ হয়ে আসা হিন্দি খবরের কাগজ এগিয়ে দেয় উত্তরণের দিকে।

“কিন্তু তুমি খুন করোনি, তা তো কোথাও লেখা নেই। অবশ্য আমি হিন্দি খুব ভাল বুঝি, তাও নয়।” উত্তরণ সামান্য চোখ বুলিয়ে কাগজটা ফিরিয়ে দেওয়ার সময় বললেন।

“ধরে নিন, আমিই খুন করেছি। কিন্তু আত্মরক্ষার্থে খুন কি অন্যায়? ছেলেটার নামেই তো তিন-তিনটে খুনের মামলা ছিল।”

“এমন ছেলের সঙ্গে তোমার বিয়ে দিল কেন তোমার বাড়ির লোক?”

“ইউপি-এমপি-রাজস্থানের ব্যাপার আপনারা ঠিক বুঝবেন না। ওখানে পলিটিশিয়ানদের মুখের উপর ‘না’ বলা যায় না সবসময়। ওই ছেলেটা মারা যাওয়ার পর, আমার বাবা প্রায় এক কোটি টাকা খরচ করেছে…”

“তোমাকে আমেরিকায় পাঠাতে?”

“শুধু আমাকে পাঠাতেই নয়। অনেককে নিষ্ক্রিয় করতেও।”

“এখন কী চাইছ তুমি?”

“জাস্ট টু স্টে ইন দিস কানট্রি! আমি দেশে ফিরলেই রুচিরের রিলেটিভরা আমাকে মার্ডার করিয়ে দেবে। ফ্যামিলি প্রাইডের জন্য। অবশ্য এখানেও ওদের একজন আমাকে ফলো করছিল। সেটা টের পেয়েই আপনার কাছে গিয়েছিলাম।”

সামান্য তালগোল পাকিয়ে গেল উত্তরণের। গুছিয়ে নিয়ে বললেন, “আমার নামে নালিশটা তা হলে ভুয়ো? সম্পূর্ণ পূর্বপরিকল্পিত?”

“আই অ্যাম রিয়েলি সরি ফর দ্যাট। তবে একটা ধাক্কা না দিলে, আপনার জীবনে এন্ট্রিও তো নেওয়া যেত না। কিন্তু বিলিভ মি, শুধু শেল্টারের জন্য আপনার কাছে যাইনি। আই হ্যাড সামথিং ফর ইউ, হিয়ার।” বৈদেহী নিজের বুকের বাঁদিকে হাত রাখল।

নাটকই মনে হল উত্তরণের। কিন্তু নাটকও কি সময়ে কাঁদায় না মানুষকে?

“আপনি চাইলে আমার ঘাড়ে দোষ চাপাতে পারেন। কিন্তু ওরা আমার অ্যাফিডেভিটের কাগজপত্র ধরে টান মারলেই আমি জলে পড়ে যাব। তখন এই দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে, নয়তো জেলে পচতে হবে।” বৈদেহীর গলা চোক করে এল।

“তোমাকে কিচ্ছু ছাড়তে হবে না। জেলেও যেতে হবে না। মন্ত্রকে যতক্ষণ ফিরে না পাচ্ছি, তুমি এই বাড়িতে থাকতে পারো।”

“আর ফিরে পাওয়ার পর?”

“বাড়িটা থাকবে। যতদিন লোন শোধ দিয়ে যেতে পারব, তোমাকে কেউ তুলে দেবে না।”

“কান্ট উই স্টে টুগেদার?”

“না। কারণ আমি আর এখানে থাকছি না।”

“ইউ আর লিভিং ইউএস?” বৈদেহী হতবাক হয়ে তাকাল উত্তরণের দিকে। বৈদেহীকে উত্তরে যা বলেননি, রাতদিন নিজেকেই তা বলতে শুরু করেছিলেন উত্তরণ। যে আমেরিকায় এসে সব হারিয়েছেন, কেন পড়ে থাকবেন সেখানে? এখানে এসে উত্তরণ হারিয়েছেন সন্ন্যাস, হারিয়েছেন সংসার, হারিয়েছেন স্বপ্নও। আর এই পুরো সময়টার মধ্যে যখনই যে ক’দিনের জন্য দেশে এসেছেন, দেখেছেন যে ওঁর ‘মানুষ’ পরিচয়টাও হারিয়ে গিয়েছে আমেরিকায় থাকেন বলে। দেশের লোক ওঁর কাছ থেকে আশা করেছে আমেরিকার সাবান, শ্যাম্পু, ঘড়ি, কসমেটিকস, চকোলেট। যে জ্ঞানের মাধ্যমে উত্তরণ মানুষের কাছে পৌঁছতেন, সেই জ্ঞান গুরুত্বহীন হয়ে গিয়েছে। মানুষ তাকিয়ে থেকেছে একটা ডলার উগরোনো মেশিন কখন বমি করবে, তার অপেক্ষায়। আর তাই, আবারও ওঁকে ফিরে এসে চড়ে বসতে হয়েছে প্রাণহীন অর্থোপার্জনের নাগরদোলায়।

মন্ত্রকে এই চক্রের মধ্যে তিনি থাকতে দেবেন কেন? মন্ত্রর এমন একটা জায়গায় থাকা দরকার যেখানে কখনও-সখনও ঘণ্টাধ্বনি কিংবা আজান অথবা সংকীর্তনের সুর ওর কানে ঢুকতে পারে। এখানে কোথাও ঈশ্বরকে নিজের মধ্যে মিশিয়ে নেওয়ার বা নিজেকে ঈশ্বরের মধ্যে বিলীন করার তাগিদ নেই। এই যান্ত্রিকতায় কে থাকে?

ভারতের সরস্বতীই তো বৌদ্ধ সংস্কৃতির সূত্রে চিনে মঞ্জুশ্রী নামে পূজা পান। জাপানে তিনিই বেঞ্জাইতেন। নদী, সংগীত, কবিতা — যা কিছু বহমান তারই দেবী সরস্বতী। তা হলে সরস্বতীর চরণ ছুঁয়ে যিনি জীবন কাটাতে চান, তিনিই বা এক জায়গায় আটকে থাকবেন কেন? নায়াগ্রা জলপ্রপাত থেকে কলোরাডোর গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন, মালিবু থেকে মেইন, আমেরিকার সবকিছুর পরিচয় পাওয়া হয়ে গিয়েছে, এবার নতুন তৃণভূমির লক্ষ্যে বেরিয়ে পড়তে হবে।

অধিকাংশ প্রাচীন সভ্যতায় জ্ঞানের দেবতা মাত্রেই নারী। মিশরীয় সভ্যতায় নেইথ আর সেশাত, সুমেরীয় সভ্যতায় নিসাবা, রোমান সভ্যতায় প্রভিদেন্তিয়া আর মিনার্ভা, গ্রিকদের অ্যাথিনা, প্রাচীন পারস্যের আনহিতা… উত্তরণের জীবনে মন্ত্রই বা জ্ঞানের দেবী হবে না কেন? কথা না বলেও, নিজের দুটো চোখ দিয়েই বাবাকে ও এগিয়ে দেবে জ্ঞানচর্চার এ প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে।

তবে সবকিছুর আগে দেশে ফিরে একবার অন্তত মন্ত্রকে ঠাকুরের মুখোমুখি নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাতে হবে। তারপর উত্তরণের জীবন যেদিকে বাঁক নেয় নেবে…

মন্ত্রকে ফেরত পাওয়া আর ওকে নিয়ে দমদমে নামার মধ্যে মাত্র সাত দিন-আট রাত্রি অতিবাহিত হল। হয়তো আরও একটু সময় নিতেন উত্তরণ, কিন্তু সোমনাথ ওঁর আসার পরিকল্পনার কথা জেনে নিজের বইপ্রকাশের অনুষ্ঠানে ওঁকেই প্রধান অতিথি হিসেবে ঘোষণা করে বসল। ব্যাপারটা অপছন্দ হলেও মুখ ফুটে কিছু বললেন না উত্তরণ। যে করে, সে তো কিছু চাইবেও। পুরো জীবনটা তো আর নিজের ইচ্ছায় বাঁচা যায় না। বাঁচা উচিত নয়।

এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে উত্তরণের মনে হল, এত-এত মানুষ মরছে কি শুধু মরবে বলেই? জীবনের একমাত্র ভূমিকা কি মৃত্যুতে শেষ হয়ে যাওয়া? এমনও তো হতে পারে, সেটাই শুরু?।

২৯

প্লেনে বসে ‘উইল টু বিলিভ’ নামে একটা বই পড়ছিলেন উত্তরণ। সবাই একটা বিশ্বাস করার ইচ্ছে নিয়েই এগিয়ে যায়। কিন্তু বিশ্বাস করবে কাকে? অন্ধ যখন রাস্তায় হাঁটে, তার লাঠি লাগে। বধির যখন কিছু শুনতে চায়, তার শক্তিশালী মেশিন লাগে। সেই শক্তি পাওয়া যায় কোথায়? কোন ঈশ্বরের মধ্যে? নাস্তিকদের কথা মতো, সবটাই যদি পরিকল্পনাহীন, ঘটনা-পরম্পরার উপর নির্ভরশীল হয়, তা হলে সেই ঘটনাবলির ভিতর শক্তি সঞ্চয়ের ব্যবস্থাও থাকতে হবে। কোথাও থেকে রিচার্জড না হয়ে তো মানুষ বাঁচতে পারে না।

প্রাথমিকভাবে মানুষের মানুষকে দরকার। যে লোকটা মানুষকে মানুষ হিসেবে পাশে পায় না, সে-ই আরও বেশি করে আশা করে যে ঈশ্বর মানুষের চেহারায় আবির্ভূত হবেন। ঈশ্বরকে মানুষের চেহারায় চায় বলেই হয়তো মূর্তির থেকে গুরু জরুরি হয়ে ওঠেন মানুষের জীবনে। যখন স্কুলদেহে ছিলেন, তখন ব্রহ্মচারী ঠাকুরকেই ঈশ্বর ভাবতেন উত্তরণ। কিন্তু যখন স্থূলদেহে নেই, তখনও তো ঠাকুরই ওঁর ঈশ্বর। থাকা আর না-থাকার মধ্যে তফাত কী ভাবে?

কলকাতায় পা দিয়ে খুব ইচ্ছে হল, মন্ত্রকে নিজের হোটেলে নিয়ে যান, কাছে রাখেন। কিন্তু উত্তরণ আগামী কয়েকদিন চরকিপাকে ঘুরবেন, হোটেলে কে দেখভাল করবে, কথা বলতে না-পারা একটি মেয়ের? ভগবান না করুন, আবার যদি কোনও দুর্ঘটনা ঘটে? জন্মসূত্রে আমেরিকান সিটিজেন মন্ত্রর জন্য ওঁকে জবাবদিহি করতে হবে আমেরিকান সর্বেশ্বরদের কাছে। খুশি না হলে হয়তো আবারও চার মাস বা ছ’মাসের জন্য মন্ত্রকে কেড়ে নেবে ওরা। আর প্রত্যেকটা মুহূর্ত অকল্পনীয় উৎকণ্ঠা আর আতঙ্কে কাটাতে হবে উত্তরণকে। যদি না দেয়, আর কখনও ফেরত না দেয়? তার চেয়ে সোমনাথের ঠিক করে দেওয়া চাইল্ড-কেয়ারেই থাক মেয়েটা। প্রফেশনালদের কাছে রাখার নিশ্চিন্তি অনেক। আবেগের জোয়ারে সেই নিরাপত্তা পাওয়া যায় না।

উত্তরণ যখন বৈদেহীকে জানিয়েছিলেন যে আর ও বাড়িতে থাকছেন না, তখন বৈদেহী ভেবে নিয়েছিল যে দেশটাই ছেড়ে চলে যাচ্ছেন উত্তরণ। তেমনটা ভেবেই হয়তো মন্ত্র ফিরে আসার আগেই আমেরিকার দক্ষিণতম প্রান্তে টেক্সাসের সান অ্যান্টনিয়ো-তে চলে গেল মেয়েটা। কার কাছে, কোথায় গেল, উত্তরণ জানার চেষ্টা করেননি। মেয়েটা ওঁকে মুক্তি দিয়ে যাচ্ছে… এটাই বেশি স্বস্তির কারণ হয়েছিল। পাশাপাশি একটা কৃতজ্ঞতাও জন্ম নিয়েছিল বৈদেহীর প্রতি। মন্ত্র যে সময়টা ফস্টার-কেয়ারে, সেই সময় একদিনের জন্যেও বৈদেহী বিরক্ত করেনি উত্তরণকে। কোনওরকম চেষ্টা করেনি কাছে আসার বা ছুঁয়ে দেখার। বরং নিজেকে পুরো পালটে ফেলে বাড়িটায় একটা ছায়ার মতো থেকেছে। যাকে দেখা গেলেও, যার শব্দ শোনা যায় না।

বৈদেহী চলে যাওয়ার পর তাই একটু শূন্যতাও যেন অনুভব করেছিলেন উত্তরণ। ‘মনের ভিতর কত মনের খেলা। আজ যে পুতুল কাল সে মাটির ঢেলা/ লালন আমার সাঁই, আমি তার চেলা’। বহুদিন আগে ট্রেনে শোনা ভিখিরির গানই সত্যি হয়ে উঠেছিল তখন।

মনে-মনে উত্তরণও আমেরিকা ছাড়তেই চাইছেন তখন। কিন্তু ছেড়ে চলে আসার আগেই, ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভেনিয়া, ‘ইউ-পেন’ নামেই যার খ্যাতি গোটা বিশ্বে, ডাক পাঠাল ওঁকে। সেই ডাক ফিরিয়ে দেবেন উত্তরণ? নাকি আইভি লিগের অংশ হওয়ার যে গৌরব ওঁর প্রাপ্য, তাকে গ্রহণ করবেন? প্রশ্ন ঘাই মারতে থাকল, উত্তরের খোঁজে।

আমেরিকার স্বাধীনতা এবং সংবিধানের ঘোষণা এই ফিলাডেলফিয়ার লিবার্টি বেল ইন্ডিপেন্ডেন্স হলেই হয়েছিল। উত্তরণের সত্যিকারের স্বাধীনতাও কি এই শহর থেকে শুরু হবে? কত আর্ট মিউজ়িয়ম, পাবলিক গার্ডেন, কত ওপেন এয়ার মার্কেট ফিলাডেলফিয়ায়। সিম্ফনি অর্কেস্ট্রা আর খাওয়া-দাওয়ার জন্য এর সুনাম দুনিয়াজোড়া। যে আমন্ত্রণ উত্তরণ পেয়েছেন, তার জন্য তিন জন্ম হা-পিত্যেশ করে থাকে লোকে। মেলের শেষ লাইনে ছিল, ‘উই ইনভাইট ইউ টু দ্য সিটি অফ ব্রাদারলি লাভ।’ দেশে তো ভাইকে হারিয়ে ফেলেছেন উত্তরণ। বিদেশে যদি পান ক্ষতি কী?

পটোম্যাক নদীর পাশ দিয়ে যখন এয়ারপোর্টের দিকে যাচ্ছিলেন উত্তরণ মন্ত্রকে নিয়ে, তখনও সূর্য ওঠেনি ভাল করে। ওঁর মনে হচ্ছিল, অন্ধকারেই আমেরিকা ছেড়ে চলে যাবেন, নতুন সূর্যোদয় ভারত কিংবা জাপানে হবে। সেখানকার দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ও তো চাইছে উত্তরণকে। কিন্তু ইউ-পেনের আমন্ত্রণ নতুন পরিকল্পনা আর পুরনো বিতৃষ্ণা ঘেঁটে দিয়ে আবারও আঁকতে শুরু করেছিল ভবিষ্যতের ছবিটা। আরও একবার আমেরিকাতেই কি শুরু করবেন জীবন? সেটাই কি ঠাকুরের ইচ্ছা? ভাবতে-ভাবতে ওয়াশিংটন ডিসি থেকে প্লেনে উঠেছিলেন মন্ত্রকে নিয়ে। দমদমে নামার পর জার্নি শেষ হলেও, ভাবনা শেষ হয়নি। কী করবেন? কী করণীয়?

কলকাতায় পা রাখার দ্বিতীয় দিনে এত মানসিক আর শারীরিক শ্রম হল, এতবার অতীত থেকে বর্তমানে আর বর্তমান থেকে অতীতে যেতে হল, মনে-মনে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন উত্তরণ। সেই ক্লান্তিতে একটু তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়লেন। স্বপ্নে দেখলেন এক মহাপ্রলয়। আকাশ কাজল-কালো। ঘন বিদ্যুতের চমকে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। সমুদ্র নিজের ঢেউয়ে-ঢেউয়ে পৃথিবীকে গ্রাস করে নিচ্ছে। আর সেই ভয়ংকর বিপর্যয়ের মধ্যে উত্তরণ দাঁড়িয়ে আছেন একা। চতুর্দিকে হিংস্র সব জলজন্তু। যে কোনও মুহূর্তে আক্রমণ করতে পারে তারা। কিন্তু সেই অন্ধকারের মধ্যে একটি শিশু আপন আলোয় উদ্ভাসিত। সেই শিশুর মুখের আভায় ধীরে-ধীরে ফর্সা হয়ে যাচ্ছে সারা পৃথিবী। উত্তরণ স্বপ্নের মধ্যে দেখলেন, শিশুটি হাঁ করল। তার মুখের ভিতরে প্রলয় পূর্ববর্তী পৃথিবীর পুরোটা। আর আলজিভের কাছে সত্যসেবী আশ্রমের প্রবেশদ্বার।

শিশুটি উত্তরণের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল। পরিষ্কার বাংলায় জিজ্ঞেস করল, “আসবে না?”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *