১০. খাওয়া-পরার চিন্তা চলে গেলে

১০

খাওয়া-পরার চিন্তা চলে গেলে মানুষের মাথার প্রায় সব ভারই নেমে যাওয়ার কথা। কিন্তু উত্তরণ যে সন্ন্যাসী হওয়ার ব্রত নিজের অন্তরে লালন করেছেন এতদিন, আজ সেই ব্রতচ্যুত হয়ে বাঁচবেন কী করে! উত্তরটা নিজের অজান্তে অনসূয়ার বাবা-ই একদিন দিয়ে দিলেন ওঁকে। বললেন যে, যখন বাইরের সমস্যাগুলো পাহাড়প্রমাণ হয়ে ওঠে, তখন বইগুলোকে আঁকড়ে ধরা ছাড়া একজন স্কলারের আর কিছুই করার থাকে না।

উত্তরণ অন্ধের যষ্টির মতো আঁকড়ে ধরলেন জয়ন্তবাবুর বলা কথাটাকে। দিন নেই রাত নেই, নিজেকে ডুবিয়ে দিলেন পড়াশোনায়।

“আপনাকে বাইরে বেরোতেও হবে না। যে বই যখন দরকার আমাকে বলে দেবেন, আমি লাইব্রেরি থেকে তুলে নিয়ে আসব।”

শুধু বই তুলে আনাই নয়, দুষ্প্রাপ্য যেসব বই ইস্যু করা হয় না, শুধু পড়তে দেওয়া হয়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইব্রেরিতে বসে সেগুলো কপি করে আনত অনসূয়া।

সেই সময়টা দেশ বদলাচ্ছে, দুনিয়ার দেখাদেখি বিশ্বায়ন কেবল কড়াই নাড়ছে না, ভারতের ঘরের ভিতর ঢুকে এসেছে। কিন্তু অনসূয়ার একমুখী জীবন যেন তিন হাজার বছর আগেকার কোনও তপোবন থেকে উঠে এসে, উত্তরণকে কেন্দ্রে রেখেই পাক খেয়ে চলেছে।

উত্তরণ মাঝে কয়েকদিন নিজেই ন্যাশনাল লাইব্রেরি যাচ্ছিলেন। তাতে খানিকটা ক্ষুন্ন হয়ে অনসূয়া ওঁকে জিজ্ঞেস করে, “আমি কি ঠিকমতো কপি করতে পারছি না?”

“তুমি কেন এত কিছু করছ নিজের পড়াশোনার ক্ষতি করে? আমার খুব খারাপ লাগে।” উত্তরণ উত্তরে বললেন।

“আপনি কেন আপনার ঠাকুরের কাজ করেন?”

“কাজ কিছুই করতে পারিনি, কিন্তু তার আগে বলি, তুলনাটা ভুল হল। ঠাকুর তো আমার ঈশ্বর।”

“আর আপনি আমার। আগেই তো বলেছি।” অনসূয়া হেসে ওঠে।

উত্তরণ বুঝতে পারেন এই মেয়ের সঙ্গে তর্ক করে কোনও লাভ নেই। এ যা মনে করবে তা করবেই। তার চেয়ে ঈশ্বরই যখন এতটা সুবন্দোবস্ত করে দিয়েছেন তখন তার সদ্ব্যবহার করবেন না কেন?

সকালে উঠে পুজোয় বসতেন উত্তরণ। অনসূয়া ওদের ঠাকুরঘরে ওঁর জন্য আলাদা একটা জায়গা তৈরি করে দিয়েছিল। নিজে সত্যসেবী আশ্রমে গিয়ে উত্তরণের জন্য ঠাকুরের বড় একটা ল্যামিনেট করা ছবি কিনে এনেছিল।

ঠাকুরের সেই প্রতিকৃতির সামনে বসে ধ্যান-জপ করতে-করতে উত্তরণের চোখ থেকে গড়িয়ে নামত জল। কীভাবে তিন বছরের উপরে একদিনও আশ্রমে না গিয়ে বেঁচে আছেন, এই প্রশ্নটাতেই তোলপাড় হয়ে যেত হৃদয়। ওঁর রিসার্চ গাইড অনিন্দ্য সেন নিজে নাস্তিক হয়েও খানিকটা বুঝতেন উত্তরণের মনোবেদনা। ঈশ্বর যে কেবলমাত্র অস্তিত্ব নন, তিনি যে শুভ বোধের ভিতরেও বিরাজমান, এই ধারণার দিকে উত্তরণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন তিনি, ওঁর বর্তমান অবস্থার কথা জেনে। তাতে যে উত্তরণ খুব কিছু শান্তি পেতেন তা নয়, তবু স্যারের সহৃদয়তা ছুঁয়ে যেত ওঁকে। মাসে অন্তত দু’বার যখন রানাঘাটে আশ্রমের বোর্ডিং স্কুলে থাকা ভাইকে দেখতে যেতেন, ভাইকে নিয়ে ঘুরতে বেরোতেন, ওকে খাওয়াতেন কোনও একটা হোটেলে, কিনে দিতেন যা তোক কিছু, তখন মনের মধ্যে ভিড় করে আসত পুরনো কথা। হয়তো ওঁর মনের অবস্থার কথা খেয়াল করেই বোর্ডিংয়ের দায়িত্বে থাকা স্বামী অজয়ানন্দ, উত্তরণ বর্তমানে কোথায় আছেন, কী করছেন, সেসব জিজ্ঞেস করতেন না একেবারেই। উত্তরণ প্রতি বার ভাবতেন যে স্বামীজি নিশ্চয়ই বলবেন, ‘আশ্রমের সবাই তোমার জন্য খুব কষ্টে আছে, তুমি আশ্রমে ফিরে যাও, বিজয়দা তোমাকে যেতে বলেছেন।’ কিন্তু অজয়ানন্দ কখনওই এরকম কিছু বলতেন না। একরাশ গ্লানি আর মনখারাপ নিয়ে ট্রেনে শিয়ালদা ফিরতে-ফিরতে উত্তরণের মনে হত, তিনি কক্ষ থেকে ছিটকে গিয়েছেন। এতটাই ছিটকে গিয়েছেন যে আর ফিরে আসা সম্ভব হবে না।

সম্ভব-অসম্ভবের হিসেব মানুষ একরকমভাবে করে আর ভাগ্য অন্যভাবে। একটা বাড়িতে দিনের পর দিন থাকলে সামান্য কিছু দায়িত্ব তো পালন করতেই হয়। সেই জায়গা থেকেই উত্তরণ হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন জয়ন্তবাবুকে। অনসূয়ার ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা ছিল সেদিন। ডাক্তার দেখিয়ে বেরোনোর পথেই ওঁর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় বিজয়দার সেবাইত সন্তুর।

একটু মোটা হয়েছে সন্তু। দাড়ি রেখেছে। প্রথমটায় উত্তরণ চিনতে পারেননি ওকে। সন্তুই এগিয়ে এসে বলল, “তুমি এখনও ধুতি-পাঞ্জাবিই পরো?”

মুহূর্তে অনেক বছরের কুয়াশা কেটে গেল। উত্তরণ হাত বাড়িয়ে সন্তুর হাতটা ধরে বললেন, “তুমি এখানে?”

“মহারাজ তো খুব অসুস্থ। মনে হয় না আর ধরে রাখা যাবে। এই হাসপাতালেই আছেন।

আশ্রম থেকে বেরিয়ে আসার বছরখানেকের মাথায় একবার বিজয়দার অসুস্থতার খবর পেয়েছিলেন উত্তরণ। বোধহয় ভাইয়ের বোর্ডিংয়ে গিয়েই। কিন্তু এখন কী এমন হল যে সন্তুর মনে হচ্ছে বিজয়দা আর বাঁচবেনই না? ক্যানসার কি তার শেষ থাবা বসিয়ে দিয়েছে?

“আমি যাই। একটু পরে আবার ভিড় হয়ে যাবে।”

“সন্তু, আমাকে একবারটি নিয়ে যাবে বিজয়দার কাছে?”

“যাবে তুমি? এসো। আমার কাছে দুটো কার্ড আছে।” সন্তু সহজভাবেই বলল।

অনসূয়ার বাবাকে কিছু বলতেই হল না। উনি উত্তরণের কাঁধে হাত রেখে নিজেই জানালেন যে একটু অপেক্ষা করতে ওঁর কোনও অসুবিধে হবে না।

উত্তরণ সন্তুর হাতটা ধরে এগিয়ে গেলেন তিনশো এগারো নম্বর বেডের দিকে।

“মহারাজকে সবাই কেবিনে ভর্তি হওয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু উনি কিছুতেই আশ্রমের বেশি টাকা খরচ হতে দেবেন না। কী অদ্ভুত লোক বলো তো। অবশ্য প্রথমে তো প্রাইভেট হাসপাতালেই আসতে চাইছিলেন না।”

উত্তরণ শুনছিলেন আর ওঁর বুকের পাঁজর মোচড়াচ্ছিল। একইরকম রয়ে গেলেন বিজয়দা। সেই মঙ্গলঘট কালেকশনের যৌবন থেকে জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছেও। ঠাকুরের প্রত্যেকটি শিষ্যের কাছে এটাই তো কাম্য যে, সে ধরে থাকবে ঠাকুরকে। বিজয়দা পেরেছেন, সম্পূর্ণ পেরেছেন।

সন্তুর সঙ্গে যে কেবিনটায় ঢুকলেন উত্তরণ তাতে আরও তিনজন পেশেন্টের সঙ্গে বিজয়দাও শুয়ে আছেন। লোহার খাটটার সামনে উত্তরণ গিয়ে দাঁড়ানোর কিছুক্ষণ পরেই বিজয়দা চোখ মেলে চাইলেন। স্মৃতির একটা সাইক্লোন উত্তরণকে উড়িয়ে নিয়ে গেল, হাসপাতালের ওই কেবিন থেকে দূর অতীতে, যেখানে সুজির হালুয়া হাতে বিজয়দা ডাকছেন “বুবাই খাবে এসো।” নিজেকে সামলে নিয়ে উত্তরণ সামনে তাকিয়ে দেখলেন, বিজয়দার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। বিজয়দা হাতটা বাড়িয়ে উত্তরণের হাত ছুঁলেন একবার। বিড়বিড় করে কী যেন বললেন।

উত্তরণ তেমন কিছু শুনতে পেলেন না, কেবল ‘গুরুদেব’ শব্দটা ছাড়া। মনে হল, গুরুদেব যেন হাসপাতালের ঘরে, ওঁর আর বিজয়দার মধ্যে সুক্ষদেহে বিচরণ করছেন। না-বোঝা কথার ভিতরে জেগে রয়েছে ঠাকুরের বাণী, ঠাকুরের আশীর্বাদ।

“আপনি সুস্থ হয়ে উঠবেন বিজয়দা। আমি আপনাকে প্রণাম করে আসব।”

বিজয়দা কোনও উত্তর দেওয়ার আগেই ঘরে অন্য লোক ঢুকে পড়ল। উত্তরণ নিজের কথা অসমাপ্ত রেখেই বেরিয়ে এলেন।

পরদিন বিকেলে আবারও একবার বিজয়দাকে দেখার আশায় দুপুর-দুপুর বেরিয়ে পড়েছিলেন উত্তরণ। কিন্তু হাসপাতালের গেটের সামনেই পরিচিত-অপরিচিত কয়েকজনকে বলতে শুনলেন যে বিজয়দা আর নেই। ঘণ্টাখানেক আগেই তাঁর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয়েছে আশ্রমের দিকে।

খবরটা শুনে উত্তরণের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিল। তিনি গড়িয়ার একটা বাসে উঠে বসলেন। গড়িয়া থেকে অটোয় উঠে আশ্রমের সামনে নামলেন। কেমন যেন পা কাঁপতে লাগল আশ্রমে ঢোকার আগে। যে আশ্রম তাঁর নিশ্বাস নেওয়ার বাতাস, আজ সেখানে প্রবেশ করার মুহূর্তে এত কীসের দ্বিধা? আসলে পাকাপাকিভাবে আশ্রমে যেদিন থাকতে এসেছিলেন, সেদিন বিজয়দাই হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গিয়েছিলেন ওঁকে। আর আজ বিজয়দার মরদেহ শায়িত আছে আশ্রমের চাতালে। আচ্ছা, পুনর্জন্ম বলে কি সত্যিই কিছু আছে? সেখানে কি ভালবাসার মানুষদের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় আবার? নাকি যে শাস্ত্রে যা-ই লেখা থাক, মানুষের এই একটাই জীবন, একবারই বেঁচে থাকা? সেরকমটা হলে বিজয়দার সঙ্গে কখনওই কোথাও আর দেখা হবে না উত্তরণের। কিন্তু যদি পুনর্জন্ম থেকেও থাকে, তা হলেও বিজয়দা কি আর জন্মাবেন? তাঁর তো মুক্তি পেয়ে যাওয়ার কথা, তিনি যে শুদ্ধাত্মা।

ভিড়ের ভিতর থেকে কে যেন একটা হাত ধরে টান দিল। উত্তরণ চমকে দেখলেন, রঘু। নিজেকে ছাপিয়ে একটা কান্না উঠে এল উত্তরণের। রঘুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন তাই। কাঁদতে-কাঁদতেই মনে হচ্ছিল, বিজয়দা যা বলেছিলেন, তা যে হয়নি তাতে একরকম ভালই হয়েছে। কী ওঁর তেজ কিংবা শক্তি? কী এমন অবদান যে আশ্রমের শীর্ষস্থানে বসবেন? কিন্তু তাই বলে উত্তরণ কি আশ্রমের কেউ নন? বিজয়দা নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন যে তাকে যেন সমাধিস্থ না করে দাহ করা হয়। সেই নির্দেশ মেনে আশ্রম থেকে অসংখ্য মানুষের পদযাত্রা যখন শ্মশানের দিকে এগোচ্ছে, তার মধ্যে মিশে গিয়ে উত্তরণ টের পেলেন যে আশ্রমের একজন ছিলেন, আছেন, থাকবেনও।

শ্মশানে নামগানের পর বিজয়দাকে যখন চন্দনকাঠের চিতায় শুইয়ে দেওয়া হল, তখন মুখাগ্নিক অনিলদাকে ছুঁয়ে থাকল সব আশ্রমিকরা, কিন্তু উত্তরণকে কেউ ডাকল না। ওঁর খুব ইচ্ছে করছিল পিছনের কাউকে ছুঁয়ে থাকতে, দ্বিধার জেরে পারলেন না। উত্তরণ যেন কালাপানি পার করা সেই মানুষটা, যে আর ঘরের একজন হতে পারবে না। বিজয়দার মরদেহ ছাই হয়ে যাওয়ার পর সবাই যখন কলসি করে জল ঢালতে লাগল চিতায়, উত্তরণের বড় সাধ হল এক কলসি জল তিনিও ঢালেন। ওঁর হাতের জলেও দাহ জুড়িয়ে যাক আশ্রমের প্রেসিডেন্ট মহারাজের, উত্তরণের আপনের চেয়েও আপন বিজয়দার।

কিন্তু চার বছর অনেকটা সময়। কাশী থেকে আসা এক অবাঙালি সন্ন্যাসী এখন আশ্রমের গুরুত্বপূর্ণ পদে। উত্তরণ কলসি হাতে এগিয়ে যেতেই তিনি হাত তুলে বাধা দিয়ে জানালেন যে বিজয়দার চিতায় জল ঢালার অধিকার কেবল আশ্রমের সন্ন্যাসী এবং ব্রহ্মচারীদের। কোনও বাইরের লোকের নয়। কথাটা শুনে আশ্রমেরই দু’-চারজন একটু চমকে উঠলেও কোনও প্রতিবাদ এল না কারওর থেকে।

উত্তরণ ছিটকে সরে এলেন চিতার সামনে থেকে। তারপর প্রায় ছুটে শ্মশান থেকে বেরিয়ে এলেন। মাথার মধ্যে বোমার মতো ফাটতে লাগল ওই শব্দটা, বাইরের লোক। সত্যিই তো, উত্তরণ বাইরের লোক। যাকে কোনও মেয়ে কখনও জড়িয়ে ধরেছে, সে কী করে সন্ন্যাসীদের সঙ্গে এক পঙক্তিতে দাঁড়িয়ে জল ঢালতে পারে আশ্রম সভাপতির নির্বাপিত চিতায়? কেউ না দেখুক, গুরুদেব তো দেখেছেন সবটা। তিনি কী করে অনুমতি দিতেন উত্তরণকে? দেননি। ঠিক করেছেন। এই যে এখন বুকের ভিতরটা জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে, সেটাও নিশ্চয়ই ব্রহ্মচারী ঠাকুর চাইছেন বলে। তবে কি সত্যি-সত্যি গুরুর সঙ্গে প্রতারণা করেছেন উত্তরণ? এমন পাপ করেছেন যার প্রায়শ্চিত্ত হয় না?

সন্ন্যাসীর তো শ্ৰাদ্ধ হয় না, তিনি তাঁর নিজের শ্রাদ্ধ নিজেই করে যান। তবু তাঁর স্মরণে ভাণ্ডারা হয়। সেখানে কত মঠ-মিশনের কত সন্ন্যাসী এসে মন্ত্রোচ্চারণ করে প্রসাদ গ্রহণ করেন। বিজয়দার ভাণ্ডারায় অনাহূতের মতো গিয়ে সেইসব মন্ত্রোচ্চারণের ভিতর নিজের জীবনের হারিয়ে যাওয়া মন্ত্রটা খুঁজতে শুরু করলেন উত্তরণ। কিন্তু পেলেন না। কেবল উপলব্ধি করলেন, পরশপাথর হারিয়ে ফেলা সহজ, ফিরে পাওয়া ভীষণ কঠিন।

আশ্রমের নতুন সভাপতি স্বামী বিরজানন্দ, উত্তরণের অনিলদা, ওঁকে কাছে ডেকে বললেন, “কোনও সংকোচ কোরো না।”

কেন অনিলদাকে বলতে হল ওই কথা? নিজের বাড়িতে কি কেউ সংকোচ করে? আসলে এই বাড়িতে আর উত্তরণের ঠাঁই নেই, সে কথাই হয়তো ঠাকুর অনিলদার মাধ্যমে শুনিয়ে দিলেন ওঁকে।

ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই। কিন্তু এই সত্যসেবী আশ্রমে যদি ঠাঁই না থাকে, তা হলে এই কলকাতা শহরে, এই বাংলায়, এই ভারতবর্ষেও তিনি থাকতে পারবেন না। কক্ষ থেকে ছিটকেই যখন গিয়েছেন, তখন অনেক দূরে চলে যেতে হবে। যাতে কারওর আর মনে না পড়ে যে তিনি কখনও এখানে ছিলেন। একশো কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চালাতে গিয়ে দিল্লিতে অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায় দীপ্ত। পড়াশোনা শেষ না করে ওর ওই দুম করে কলকাতা ছেড়ে দিল্লি চলে যাওয়ার পিছনে উত্তরণও তো কিছুটা দায়ী। পূজার ঘটনাটা যদি না চোখে পড়ত ওঁর? হয়তো ঝামেলা পাকত না, দিল্লি যেত না দীপ্ত। আচ্ছা, খুব স্পিডে আসা কোনও গাড়ি উত্তরণকে একটা ধাক্কা মেরে দীপ্তর কাছেই পৌঁছে দিতে পারে না? বারবার নিশ্চয়ই অনসূয়া ওঁকে বাঁচানোর জন্য পাশে থাকবে না।

পিএইচ ডি-র থিসিস জমা করেই পোস্ট-ডক্টরাল কাজের জন্য আমেরিকার বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে চিঠি লিখতে শুরু করলেন উত্তরণ। উত্তরও আসতে শুরু করল দ্রুতই।

অনসূয়া একদিন ওঁর ঘরে এসে বলল, “ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে, শিকাগোর ইলিনয়, আটলান্টার এমরি আপনাকে ডাকছে। আপনি কোথায় যাবেন?”

“সত্যসেবী আশ্রম। গড়িয়া।” অন্যমনস্ক হয়ে জবাব দিলেন উত্তরণ।

“কিন্তু সেখানে কর্তৃপক্ষ কি আর আপনাকে রাখতে চায়?”

“জানি না।”

“জানেন। স্বীকার করতে লজ্জা কিংবা ভয় পান। আর ওদিকে বিরাট একটা পৃথিবী দু’হাত বাড়িয়ে ডাকছে আপনাকে। অতীতে যা ছিল তা অতীতে থাক, মনে যা আছে তা মনে। আপনাকে সামনের দিকে তাকাতে হবে।”

“আমি এখান থেকে চলে গেলে খারাপ লাগবে না তোমার?”

“লাগবে তো। ভয়ংকর খারাপ লাগবে। আমি ডাইরেক্ট পিএইচ ডি না করে এম ফিল-এ কেন ভর্তি হয়েছিলাম জানেন? যাতে দু’-তিন বছর পর আপনার আন্ডারেই পিএইচ ডি করতে পারি।”

“তা হলে?”

“তা হলে কিছু নয়। আপনাকে যেতে হবে। আমার খারাপ লাগবে বলে, আপনার ভাল হওয়াটা আটকে রাখব, সেরকম মেয়ে মনে হয় আমাকে? এতদিন তো দেখছেন?”

“না, মনে হয় না। আর কী যে মনে হয়, সেটা এক্ষুনি বুঝিয়ে বলতেও পারব না। কিন্তু তুমি শিয়োর, আমেরিকায় গেলে ভাল হবে আমার?”

অনসূয়া কোনও জবাব না দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মিনিটপাঁচেক পরে যখন ফিরে এল, তখন ওর হাতে একটা ম্যাগাজ়িন। ম্যাগাজ়িনটা খুলে তার দুটো পাতা উত্তরণের দিকে মেলে ধরল অনসূয়া।

“কীসের ছবি এটা?” উত্তরণ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

“দেখুন ভাল করে।”

উত্তরণ দেখলেন, অজস্র লোহার শিক ছবিটায়। কিন্তু শিকগুলোর দিকে একদৃষ্টিতে তাকালে একটা মুখের অবয়ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

অনসূয়া বলল, “দক্ষিণ আফ্রিকার একটা ছোট্ট শহরে নেলসন ম্যান্ডেলার জন্য বানানো হয়েছে এটা। কয়েক বছর আগে। এই ভাস্কর্যটার নাম, রিলিজ়। আমি আপনাকে এটা দেখাচ্ছি কারণ গত চার বছরের বেশি সময় আপনাকে কাছ থেকে দেখে আমার মনে হয়েছে, আপনিও এরকম একটা লোহার শিকের আড়ালে আটকে আছেন। আপনার এই ধর্ম, এই সন্ন্যাস, এই জপ-তপ আপনাকে বোধহয় আনন্দের বদলে কষ্টই দিয়েছে। একটা প্রতিভার সামনে অনেকগুলো লোহার শিক দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, নেলসন ম্যান্ডেলার সামনে শাসকরা যেমন দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। আপনাকে এই শিকগুলো উপড়তে হবে। শিকাগো থেকে নিউ ইয়র্ক নিজের মেধাকে ছড়িয়ে দিতে হবে। কারণ নিজেকে বেঁধে রেখে আপনি, নিজের প্রতি তো বটেই, ঈশ্বরের প্রতিও চরম অবিচার করছেন।”

“তুমি কী বলছ তুমি জানো?”

“হ্যাঁ জানি। আর একই সঙ্গে জানি যে নিজের স্বার্থে কিছুই বলছি না। সেক্ষেত্রে বলতাম, আমায় বিয়ে করুন।”

“হোয়াট?”

“কেন, আপনি বোঝেন না যে আমি ভালবাসি আপনাকে? প্রতিটা মুহূর্ত আপনার চিন্তাই আমার ভিতরে পাক খায়? এই পৃথিবীতে আমার চেয়ে বেশি আপনার জন্য কেউ ফিল করে না, আপনি অনুভব করতে পারেন। না?” অনসূয়ার গলাটা ভেঙে গেল বলতে-বলতে। ও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

অনসূয়া ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরে উত্তরণ চুপ করে বসে রইলেন। চোখটা বন্ধ করে ফেললেন এক সময়। ধ্যানে গুরুদেবকে স্মরণ করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ওই লোহার শিকগুলো জ্যান্ত হয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। মনে হল, ওঁর পরিধি, ওঁর স্মৃতি, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, সবকিছু থেকে বেরিয়ে একটা নতুন পৃথিবীতে নিজেকে প্রতিস্থাপিত করতে হবে। উত্তরণ গুরুদেবের দেওয়া বীজমন্ত্র জপ করছিলেন। হঠাৎই কী মনে হল, ঠাকুরের নাম উচ্চারণ করতে গেলেন একবার। ওঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘রিলিজ়’!

১১

একটা সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকতে গেলে কী প্রয়োজন? অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, ইত্যাদি-ইত্যাদি। কিন্তু শুধু সেটুকুতে সন্তুষ্ট থাকে কতজন? যার এক আছে সে চায় দুই, যার দুই আছে সে চায় চার, যার চার সে আট। মানুষ নিয়ত নিজের সামনে নিজের জন্য একটা টার্গেট ঝোলায়। একটা ফিনিশিং লাইন এঁকে প্রাণপণ চেষ্টায় সেখানে পৌঁছনোর চেষ্টা করে। যে পাড়ার দলে খেলছে, সে চায় দেশের হয়ে খেলতে। যে ছোট চাকরি করছে, সে বড় চাকরি করতে। যে বিঘেতে চার মন ফসল ফলাচ্ছে, সে চায় ছ’মন ফলাতে। এই যে আরও, আরও, পাওয়ার চেষ্টা, এই চেষ্টা থেকে একজন সন্ন্যাসীও কি সম্পূর্ণ মুক্ত? তিনিও তো চান সাধনার আরও উঁচু স্তরে পৌছঁতে। কিন্তু সেই সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছনোর পরও সন্ন্যাসীকে আবার নেমে আসতে হয় লোকালয়ে। লোকশিক্ষার জন্য। রামকৃষ্ণদেব থেকে ব্রহ্মচারী ঠাকুর পর্যন্ত তারই প্রমাণ। প্লেনটা যখন চক্কর কাটছিল নিউ ইয়র্কের মাটি ছোঁওয়ার আগে, উত্তরণের মাথায় তখন এই সমস্ত ভাবনা ঘুরছিল। এর আগে দিল্লি কিংবা ফ্রাঙ্কফুর্টে একের পর এক এয়ারপোের্ট পার হওয়া, প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় উত্তরণের মনে হচ্ছিল গুরুদেব যেন ওঁকে হাত ধরে পার করে দিচ্ছেন। আসলে উত্তরণ তো একটা ঘটনাস্রোতে গা ভাসিয়েছেন মাত্র। আর সেই ঘটনাস্রোত যে গুরুদেবেরই তৈরি করা নয়, কে বলবে?

নিউ ইয়র্কে নেমে, ইমিগ্রেশনের আগে, প্রসাধনে ব্যস্ত এক যুবতীর আয়নায় নিজের প্রতিকৃতি দেখে চমকে গেলেন উত্তরণ। সাদা শার্ট, সাদা প্যান্ট। এ কার চেহারা! এই মানুষটি তো চেনা নয়। মনে পড়ছিল আমেরিকা যাওয়ার আগে অনসূয়া নিয়ে গিয়েছিল বড় একটি দোকানে। সেখানে সমস্ত কিছু পাওয়া যায়। এঁর জন্য কালো প্যান্ট পছন্দ করেছিল অনসূয়া। কিন্তু গুরুদেব কালো পছন্দ করতেন না, বিজয়দার কাছে শুনেছিলেন উত্তরণ। উত্তরণ সরিয়ে দিয়েছিলেন সেই প্যান্ট। বদলে একটা সাদা প্যান্ট বেছে নিয়েছিলেন। স্কুলজীবনের হাফ-প্যান্টের পর প্রথম প্যান্ট-শার্ট পরে দোকানের ট্রায়াল-রুমে নিজেকে একটা কিম্ভুতকিমাকার প্রাণী বলে মনে হচ্ছিল উত্তরণের। কিন্তু যে দেশে পা রাখতে যাচ্ছেন, তার নিয়ম অনুযায়ীই তো চলতে হবে।

নিউ ইয়র্ক যখন ওঁর আমেরিকায় প্রবেশ ‘বৈধ’ ঘোষণা করল পাসপোর্টে একটি ছাপ্পা মেরে, মনে হল অদেখা পৃথিবী উন্মুক্ত হয়ে গেল ওঁর সামনে। পরবর্তী গন্তব্যের দিকে এগিয়ে গেলেন উত্তরণ।

আটলান্টা এয়ারপোর্ট সম্ভবত আমেরিকার সবথেকে বড় এয়ারপোর্ট। পথ আর ফুরোয় না। উত্তরণ টার্মিনালের ট্রেনে উঠে নির্দেশ মতো নামলেন, চার-পাঁচটা স্টপ পরে। লাগেজ কালেক্ট করে অবশেষে যখন বেরোলেন তখন আকাশজোড়া মেঘ থেকে অল্পস্বল্প বৃষ্টি হচ্ছে। একটা শাটল ট্যাক্সিতে যখন ইউনিভার্সিটির হস্টেলে পৌঁছলেন তখন বৃষ্টির তেজ বেড়েছে। রিসেপশনে লরা বলে একটি মেয়ে একটা প্লাস্টিকের কার্ড দিল। ওঁর ঘরের চাবি। লিফটে উঠে এসে বারবার সেই চাবি দরজার হাতলের সঙ্গে লাগিয়েও দরজা খুলতে পারলেন না উত্তরণ। নেমে এলেন নীচে। লরাকে সাহায্যের জন্য বললেন।

লরা শুধু বলল, “ইউ ক্যান ডু ইট। গো অ্যান্ড ট্রাই।”

উত্তরণ সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-উঠতে অনুভব করলেন, এটাই এদেশের মন্ত্র। এখানে কেউ কাউকে সাহায্য করার জন্য হাত বাড়িয়ে নেই। নিজের সমস্যা নিজেকে সমাধান করতে হবে।

উত্তরণ সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-উঠতে অনুভব করলেন, এটাই এদেশের মন্ত্র। এখানে কেউ কাউকে সাহায্য করার জন্য হাত বাড়িয়ে নেই। নিজের সমস্যা নিজেকে সমাধান করতে হবে।

নিজের চেষ্টাতেই উত্তরণ দরজা খুলতে পারলেন এক সময়। ভিতরে ঢুকে আলো জ্বালালেন। একটা ছিমছাম ঘর, একটা বিছানা, একটা পড়ার টেবিল, একটা চেয়ার, অন্য পাশে আরও একটা টেবিল। সেটা বোধহয় খাওয়ার জন্য। তার পাশেই ফ্রিজ আর মাইক্রোওয়েভ আভেন।

উত্তরণ সবটা একবার দেখে জুতো ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। তারপর দু’-তিন ঘণ্টার জন্য কোনও ভয়ান ছিল না। ঘুমটা ভাঙতে দেখলেন ঘড়িতে রাত্রি এগারোটা বাজে। উঠে পড়লেন উত্তরণ। চারদিকে তাকিয়ে ঘরটা কীরকম ফাঁকা-ফাঁকা বোধ হতে লাগল। তৎক্ষণাৎ ব্যাগ থেকে ঠাকুরের ল্যামিনেট করা ছবিটা বার করে পড়ার টেবিলের উপরে রাখলেন। রেখেই মনে হল, ঘরটা একটা চেহারা পেয়েছে। চোখে পড়ল, মাইক্রোওয়েভের উপর একটা ব্রাউন পেপারের ঠোঙা। এটা কি আগেও ছিল? কই, ঘরে ঢুকে তো খেয়াল করেননি। উত্তরণ ঠোঙাটার সামনে এগিয়ে গেলেন। ঠোঙাটার ভিতরে দু’টো আপেল, একটা কলা, একটা মাফিন। গুরুদেবই কি তবে রেখে গেলেন, শিষ্য অভুক্ত থাকবে বলে? উত্তরণ ঠোঙা থেকে বার করে আপেলে দাঁত বসালেন।

এই সেই আপেল, যা খাওয়ার জন্য ইভ আদমকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। এই আপেল থেকেই পৃথিবীর বিস্তার। একই সঙ্গে সমস্ত জ্ঞানের, আবার সমস্ত পাপের আকর। সেই আপেলে কামড় দিয়ে উত্তরণের মনে হল, জ্ঞানের থেকে পাপ, কে আলাদা করবে? কিন্তু যে জ্ঞান আহরণ করতে আমেরিকা এসেছেন, সেই জ্ঞানের প্রতি পদে যদি পাপের ছোঁয়া থাকে? উত্তরণ ঠাকুরের ছবির দিকে তাকালেন।

পরদিন সকালে ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে উত্তরণ দেখা করলেন ড. ফ্রেজ়ারের সঙ্গে। ফ্রেজ়ারের তত্ত্বাবধানেই উত্তরণের পোস্ট-ডক্টরাল কাজ করার কথা। ডক্টরেটের ক্ষেত্রে যেমন গাইড, পোস্ট-ডক্টরালের ক্ষেত্রে যাঁরা পথনির্দেশ করেন, তাঁদের বলে হোস্ট। তবে এক্ষেত্রে কাজ প্রায় পুরোটাই নিজেকে করতে হয়। নির্দেশ প্রায়শই হয়ে দাঁড়ায় ইশারামাত্র।

উত্তরণের সঙ্গে অবশ্য অনেক কথাই বলছিলেন ফ্রেজ়ার। ইংরেজির সঙ্গে ভাঙা-ভাঙা সংস্কৃত মিশিয়ে। ফ্রেজ়ার বহুবার ভারতবর্ষে গিয়েছেন। দর্শনের অধ্যাপনা করতে গিয়ে সংস্কৃত শেখা জরুরি মনে হয়েছিল, তাই সংস্কৃতও শিখেছেন বেশ খানিকটা। হরিদ্বারে একটা বাড়িও আছে সাহেবের, মাঝে-সাঝে গিয়ে থাকার জন্য। কথা বলতে-বলতে ফ্রেজ়ার হঠাৎ ভারতের গুরুবাদ নিয়ে কথা তুললেন। কোন গুরুর ক’জন অবৈধ সঙ্গিনী, কার বিছানার তলায় কয়েক কোটি টাকা পাওয়া গিয়েছে, কার সিন্দুকে এক কেজি সোনা, কে রাত্রিবেলা সুন্দরীদের ডেকে পাঠান নিজের ঘরে, এসব নিয়ে বলতে আরম্ভ করলেন।

উত্তরণ শুনতে-শুনতে ভাবছিলেন, সত্যিকারের গুরু কাকে বলে ফ্রেজ়ার জানেন না। আসল সন্ন্যাসী ফ্রেজ়ার কখনও দেখেননি। উত্তরণ দেখেছেন। উত্তরণ তাঁর আশ্রয়ে বড় হয়েছেন। গুরুদেব একবার উনুনে ভাত বসিয়ে ধ্যান করছিলেন কোনও পাহাড়ি এলাকায়। ধ্যানের একাগ্রতা ভাতের গন্ধে টলে যাচ্ছিল বলে, উঠে গিয়ে হাঁড়িসুন্ধু উনুন থেকে তুলে নীচের নদীতে ছুড়ে ফেলে দেন। ব্যস, জীবনে আর কখনও অন্ন মুখে তোলেননি। সাবুর উপর ভর করে কাটিয়ে দিয়েছেন ইহজীবনের শেষ প্রহর পর্যন্ত। ঠাকুরের মূল্যবান জিনিসপত্র যে কাঠের বাক্সে থাকত, সেখান থেকে তাঁর দেহত্যাগের পর কেবল একটা রুদ্রাক্ষ আর একটা শালগ্রাম শিলা পাওয়া গিয়েছিল। না, জীবন্ত, জ্বলন্ত সত্যের মতো সন্ন্যাসীর সংস্পর্শে আসেননি ফ্রেজ়ার, বোঝাই যাচ্ছে।

সম্পূর্ণ বা অল্প ধারণা থাকলেও কোনও বিষয় নিয়ে কথা বলতে মানুষের আটকায় না। ফ্রেজ়ার তাই এমনভাবে কথা বলে যাচ্ছিলেন যেন ভারতের গুরুদের তিনি হাতের তালুর মতো চেনেন। নিজের জায়গা থেকে ঠিকই বলছিলেন হয়তো। যে ‘গুরু’ নামধারী ভণ্ডগুলো সাদা চামড়ার শিষ্যা পেলেই শুয়ে পড়তে চায় কিংবা তৃতীয় শ্রেণির অলৌকিক কাণ্ডকারখানা দেখিয়ে ভক্তদের পয়সা হাতাতে চায়, ফ্রেজ়ারদের সঙ্গে সেই লোকগুলোর মোলাকাতই তো হয় বেশি।

উত্তরণ ‘হ্যাঁ, হুঁ’-তে কথার উত্তর দিচ্ছিলেন। প্রথম দিনই ফ্রেজ়ারের সঙ্গে তর্কে প্রবৃত্ত হতে ওঁর মন চাইছিল না।

সত্যসেবী আশ্রমেই থাকতেন শতদ্রুদা। রসায়নের অসাধারণ ছাত্র। আশ্রম থেকে বেরিয়ে গিয়ে বড় চাকরি নিয়েছিলেন, সংসারও করেছিলেন। কিন্তু স্ত্রী বাঁচেননি বেশিদিন। উত্তরণ আমেরিকা যাচ্ছেন শুনে শতদ্রুদা বলেছিলেন, “আশ্রমের ভিতরে থাকলেই শুধু গুরুসেবা হয়, বাইরে থাকলে হয় না, এমনটা নয়। গুরুদেবের সেই কথাটা ভুলে যেয়ো না, যেখানে উনি বলছেন, ‘আমি বিশ্বরূপ ভগবানের পূজা করি। তোমরা আমাকে এই একটিমাত্র শরীরে সীমাবদ্ধ ভাবিয়ো না। আমি তোমাদের ভিতরেও আছি।”

উত্তরণের মনে হল, এই যে তিনি ফ্রেজ়ারের সামনে বসে আছেন, ওঁর হৃদয়ে থাকা ঠাকুরও সেখানেই আছেন। ওঁর প্রতিটা কথার ভিতর দিয়ে ওঁর গুরুরও পরিচয় ফুটে উঠছে।

উত্তরণ নিজের কাজের ব্যাপারে সামান্য বললেন ফ্রেজ়ারকে।

ফ্রেজ়ার শুনলেন। উত্তরে খুব একটা কিছু বললেন না। কিন্তু দশ দিনের মধ্যেই উত্তরণের কাজের ধরন সাহেবের মনে সম্ভবত একটা ভাললাগা জাগাল। ফ্রেজ়ার একদিন রাত্রে উত্তরণকে নেমন্তন্ন করলেন নিজের বাড়িতে।

সাহেবের বাড়িতে গিয়ে উত্তরণ দেখলেন, মার্থা বলে ফ্রেজ়ারের এক ছাত্রী আর রবার্ট বলে এক ছাত্র আপ্যায়নের দায়িত্বে। মার্থা উত্তরণেরই বয়সি হবে। রবার্ট আর-একটু ছোট, বাইশ কিংবা তেইশ। মার্থা সিঙ্গল পেরেন্ট বলে ওর ছোট্ট মেয়েটাকেও নিয়ে এসেছে, আর রবার্ট এখনও অবিবাহিত। কিন্তু যাকে দেখে সত্যি করে অবাক হলেন উত্তরণ, সে ফ্রেজ়ারের স্ত্রী পলা।

“এ আমার তিন নম্বর স্ত্রী।” ফ্রেজ়ার নিজেই পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় বললেন।

কী অবলীলায় একটা সাতান্ন বছরের লোক একটা সাতাশ-আটাশ বছরের মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে পারে এই দেশে! সারা দেশটা যেন একটা ঘূর্তির জলে ডুব দিয়ে মাথা তুলছে, আবার ডুব দিচ্ছে, উত্তরণ ভাবছিলেন।

ভারতে যাতায়াত আছে বলে ফ্রেজ়ার উত্তরণের জন্য নিরামিষ রান্নাই করিয়েছিলেন। শুধু একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন তাঁর স্কলার ‘ফিশ-ইটিং ভেজিটেরিয়ান’ কি না। অনসূয়া ওঁকে মাছ ধরাতে পারেনি অনেক চেষ্টাতেও, তাই মাথা নেড়ে ‘না’-ই বললেন উত্তরণ। ফ্রেজ়ার সঙ্গে-সঙ্গে উত্তরণকে নিরামিষ পদগুলো দেখিয়ে দিলেন। রুমালি রুটি, একটু কাঁচা-কাঁচা রাজমার ডাল আর পনিরের তরকারি। তার পাশেই বিফ, পর্ক সমস্ত কিছু ছিল। সেগুলোর ছোঁয়া নিরামিষেও লাগছিল কিনা সেই কথাটা উত্তরণের একবার মনে হল। কিন্তু তেমন কিছু রেখাপাত করল না। অতলান্তিকের জল পেটে পড়ার ফল হয়তো। উত্তরণ প্লেটে খাবার তুলে নিলেন ইচ্ছেমতো৷

খাওয়ার পরে উত্তরণ ওয়াইন খাবেন না জেনে একটা মকটেলের গ্লাস হাতে ধরিয়ে প্রফেসর ফ্রেজ়ার জিজ্ঞেস করলেন, “ভারতীয় মতে ভক্ত কে?”

উত্তরণ জবাব দিলেন, “যার আপন-পর ভেদ নেই, যিনি ইন্দ্রিয়কে জয় করেছেন, যিনি সংসারে ঈশ্বরের চরণ ছাড়া আর সবকিছুকে মূল্যহীন বলে মনে করেন, তিনিই ভক্ত।”

একটু চুপ করে থেকে ফ্রেজ়ার হো-হো করে হেসে উঠলেন। হাসতে-হাসতেই বললেন, “তা হলে সংসারে যিনি নিজেকে ঈশ্বর ভেবেছেন, যখন যাঁকে ভালবাসতে ইচ্ছে করেছে ভালবেসেছেন, যিনি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, বাচ্চার সঙ্গে বাচ্চা হয়ে, বৃদ্ধের সঙ্গে বৃদ্ধ হয়ে মিশেছেন, যিনি জীবনের কোনও আকাঙ্ক্ষাকেই নিজের সাধ্যমতো অপূর্ণ থাকতে দেননি, তিনি ভক্ত নন?”

উত্তরণ কোনও জবাব দিলেন না।

ফ্রেজ়ার বলে চললেন, “তোমার কি মনে হয় যে তাঁর উপর ভগবানের অভিশাপ পড়বে? যদি তা-ই হত, তবে তো ভগবান তাঁকে শাস্তি দিতেন। উলটে ভগবান তাঁকে সবকিছু দিলেন কেন? যারা সারাক্ষণ ভয় পেয়ে সবকিছু থেকে দূরে সরে রইল, তারাই ঈশ্বরের থেকে সব কিছু পাবে? যারা ভোগ করল তারা পাবে না? কোনও যুক্তি আছে? শুনে রাখো, খাওয়ার সময় প্রতিটা গ্রাসেই শরীরের পুষ্টি হয় আর ক্ষুধার নিবৃত্তি হয়। বেঁচে থাকার প্রতিটা মুহূর্ত দিয়ে, মানুষের প্রত্যেকটা আকশনের মধ্যে দিয়েই ভগবৎ স্বরূপের উপলব্ধি ঘটে। ভোগের মধ্যে দিয়েই তো বৈরাগ্য আসে, ভোগ ছাড়া বৈরাগ্য আসবে কোত্থেকে?”

উত্তেজিত হয়ে নিজের সাহেবি উচ্চারণে ফ্রেজ়ার একটা-দু’টো সংস্কৃত শ্লোক বলতে লাগলেন। খানিকটা চার্বাক ঘেঁষা সেই শ্লোকগুলো।

উত্তরণ শুনলেন চুপ করে। শুনে গেলেন।

পরের সপ্তাহে ফ্রেজ়ার উত্তরণকে একটা সেমিনার অ্যাটেন্ড করতে সান ফ্রানসিসকো পাঠালেন। সেখানে গিয়ে ফ্রেজ়ারের বলা কথাগুলো অন্য একটা সুরে বেজে উঠল। উত্তরণ পরিচিত হলেন অনন্যসুন্দর একটা শহরের সঙ্গে, যেখানে একদিকের রাস্তা উঁচু হয়ে পাহাড়ের দিকে চলে গিয়েছে, আর-একদিকের রাস্তা পাহাড় থেকে নিচু হয়ে সমুদ্রে এসে মিশেছে। সমুদ্রের ধারে মস্ত বড় বাজার, সেখানে ফিশারম্যানস হোয়ার্ফ-এ মাছ ভেজে বিক্রি করছে চিনে আর কোরীয়রা। রাস্তার মোড়ে-মোড়ে ব্যাঞ্জো আর গিটার বাজিয়ে গান গাইছে গায়কেরা, যারা মূলত কৃষ্ণাঙ্গ। অজস্র মানুষের অসংখ্য প্রাণ সারাদিন ফানুসের মতো হাওয়ায় উড়ে বেড়াচ্ছে। যেন কোথাও কোনও দুঃখ নেই, দুঃখী নেই।

শহরটায় ঘুরতে-ঘুরতে উত্তরণের মনে হল, জীবনের এই উচ্ছাসের দিকটাও মিথ্যে নয়। উত্তরণ দেখলেন একটা বিরাট বড় যুদ্ধজাহাজ প্রশান্ত মহাসাগরের তটেই দাঁড় করানো। মানুষের জীবনযজ্ঞের মধ্যে মৃত্যুলীলার আয়োজন যে সদা বর্তমান, সেটাই যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে জাহাজটা। সান ফ্রানসিসকোর ইতিহাস যে মিউজ়িয়মে ধরা আছে সেই মিউজ়িয়মটা ঘুরে দেখলেন উত্তরণ। তারপর একা-একা হেঁটে গেলেন তটরেখা ধরে। দেখলেন, সমুদ্রের জল এসে ধাক্কা মারছে পাথরে। উত্তরণ সেই পাথরে পা রেখে সমুদ্রের মুখোমুখি বসলেন। তর্পণ করলেন বাবার আর মায়ের। তারপর ব্রহ্মচারী ঠাকুরকে অঞ্জলি দিলেন। ঠাকুর তো অবিনশ্বর। তাঁর তো তর্পণ হয় না।

১২

যখন আটলান্টায় ফিরে এলেন, তখন উত্তরণের অন্দরে অনেক তোলপাড় ঘটে গিয়েছে। ‘গীতা’র দশম অধ্যায় নিয়ে কাজ করছিলেন উত্তরণ, যেখানে ভগবান বলছেন যে তিনি রাজর্ষিদের মধ্যে মনু, দৈত্যদের মধ্যে প্রহ্লাদ, হাতিদের মধ্যে ঐরাবত, ধাতুর মধ্যে সোনা, সরোবরের মধ্যে সমুদ্র, পুরোহিতদের মধ্যে বশিষ্ঠ, সেনাপতিদের মধ্যে কার্তিক, আরও কত কিছুর মধ্যে কত কী। উত্তরণের মনে হচ্ছিল, আমেরিকা দেশটা সংশ্লিষ্ট সব নাগরিকদের মধ্যে কেবলই আনন্দ হয়ে বিভিন্ন শাখায় বিভিন্ন রাস্তা ধরে ছুটছে। সেই আনন্দে পূর্ণতা আছে কি নেই কেউ জানে না, কিন্তু সেই আনন্দকে শুধুমাত্র ভোগ বলে নস্যাৎ করা বোকামি।

ফ্রেজ়ার একদিন কথায়-কথায় বলেছিলেন যে সবাই যদি সন্ন্যাসী হয়ে যেত, তা হলে পৃথিবী পঞ্চাশ বছর পরই থেমে যেত।

উত্তরণ অবাক হয়ে তাকাতে ফ্রেজ়ার হেসেছিলেন, “নতুন জন্ম ছাড়া পৃথিবী চলত কী করে? যৌনতার মতো বড় শক্তিকে বাদ দিয়ে পৃথিবীর চলার অন্য কোনও রাস্তা আছে?”

উত্তরণ প্রশ্নটার সামনে থমকে গিয়েছিলেন। সত্যিই তো, নতুন জন্ম ছাড়া সন্ন্যাসী-ব্রহ্মচারীরাই বা আসতেন কোত্থেকে? আর এই নতুন জন্ম তো শুধু শারীরিক নয়। ভয়হীনতার জন্মটাও জন্ম। রবি ঠাকুরের সেই গানটা মনে পড়ছিল, ‘ভয় হতে তব অভয় মাঝে নূতন জন্ম দাও হে’। উত্তরণ অল্পদিনেই টের পেয়েছিলেন যে এই দেশটা কাউকে খুব বেশি ভয়ে বাঁচতে দেয় না। এখানে কোনও স্কুলে আমেরিকার রাষ্ট্রপতির স্ত্রী গিয়ে কোনও বাচ্চার কাঁধে হাত দিলে সেই বাচ্চাটা বলে উঠতে পারে, ‘ও তুমি এসেছ? আমি ভাবছিলাম বোধহয় কোনও ফিল্মস্টার আসবে।’ ইউনিভার্সিটির নোবেল প্রাইজ় পাওয়া প্রফেসরকে সেই ইউনিভার্সিটির বাথরুম যে পরিষ্কার করে সে-ও সন্ধে ছ’টার পর নাম ধরে ‘হাই’ বলতে পারে আর যাকে বলা হচ্ছে সেই প্রফেসরও ‘হ্যালো’ বলেই উত্তর দেয়।

এম এ পরীক্ষার আগে-আগে একবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লার্ক হরিমাধববাবুর মেয়ের বিয়েতে গিয়েছিলেন উত্তরণ। হরিমাধববাবু ওঁকে খুব পছন্দ করতেন বলে নেমন্তন্ন ফেরাতে পারেননি। কিন্তু বিয়েতে গিয়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখেছিলেন। ডিন আসতেই একেবারে পায়ের কাছে পড়ে গেলেন হরিমাধববাবু। মনে হচ্ছিল শরীরের হাড়-পাঁজরা গুঁড়িয়ে দিয়ে নিজেকে ধন্য করবেন। কিছু বলতে পারেননি, বলার উপায় ছিল না বলে, কিন্তু উত্তরণের খারাপ লেগেছিল।

সেই খারাপ লাগার স্মৃতি থেকেই উত্তরণ প্রতিনিয়ত অনুভব করতেন যে আমেরিকা নিজের দোষ-গুণ নিয়েই মানুষের অভ্যন্তরীণ ক্রীতদাসত্ব থেকে মানুষকে অনেকাংশে মুক্তি দেয়। অন্যের দেশে না হলেও, নিজের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে। আর হয়তো সেই সীমার ভিতরের অসীমকে চেনানোর জন্যই ফ্রেজ়ার এদিক-ওদিক সেমিনারে পাঠাতেন উত্তরণকে। যত না বলতে, তার চেয়ে বেশি শুনতে। উত্তরণেরও খুব ভাল লাগত, বাসে-ট্রেনে চেপে আমেরিকার মহল্লা, শহর, মানুষ চিনতে চিনতে যেতে। সেই ভাললাগা ভিতরে নিয়েই ইউনিভার্সিটিতে সারাদিন হাড়ভাঙা খাটনির পরেও, ফ্রেজ়ারের কথায় এক ঘণ্টার নোটিসে মেমফিস যেতে রাজি হয়ে গেলেন উত্তরণ।

আটলান্টা থেকে মেমফিস কম-বেশি চার ঘণ্টার পথ। তার উপর বাসটা প্রায় তিন ঘণ্টা লেট। আমেরিকাতেও যে এমনটা হয়, জানতেন না উত্তরণ। যখন বাসে উঠলেন, শরীর ভেঙে আসছে ঘুমে। কিন্তু পাশে বসা মেয়েটি সেই সময় পৃথিবীতে সদ্য আসা মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে খেলছে। কিছুটা কৌতুহল, কিছুটা বিতৃষ্ণায় যন্ত্রটির দিকে তাকালেন উত্তরণ। দেশে থাকতে একে দেখেননি, এখানে এসে দেখছেন। এ কি যন্ত্র, নাকি সারাক্ষণ মানুষকে বেঁধে রাখার এক কৌশল? কোথাও কেউ কারওর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে খুব বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না। সংযুক্ত থাকতে হবে, রেডারের মধ্যে থাকতে হবে। মেয়েটা মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে রেখেছিল, পাশে বসা উত্তরণের চোখে আলো এসে পড়ছিল। উত্তরণ দু’-তিনবার খুব নম্রভাবে মেয়েটিকে অনুরোধ করলেন, যদি হাত দিয়ে একটু আড়াল করা যায় আলোটা। ওঁর একটু ঘুমের প্রয়োজন, তাও জানালেন। কিন্তু মেয়েটা পাত্তাই দিল না। খারাপ লাগল উত্তরণের। এরা কি শ্বেতাঙ্গ বলে অন্য কাউকে মানুষ মনে করে না?

বাসটা এক ঘণ্টা পরে থামল, অক্সফোর্ড বলে একটা জায়গায়। এদের এখানকার বাস এক ঘণ্টা-দেড় ঘণ্টা পরপর থামে। যে কোনও গ্যাস স্টেশনে টয়লেট থেকে শুরু করে ছোটখাটো ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, সবই থাকে। বাস থেকে নেমে, ওয়াশরুম হয়ে উত্তরণ যখন আবার বাসে উঠছেন, বাসের ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, “ইজ় এভরিথিং অলরাইট?”

দশবারের মধ্যে ন’বার উত্তরণ এই প্রশ্নটার উত্তরে ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলে চলে আসতেন। কিন্তু ভয়ংকর ক্লান্ত ছিলেন বলেই হয়তো তিনি ওই মেয়েটি, তার হাতের মোবাইল এবং নিজের অসুবিধের কথা বলে ফেললেন।

বাসের ড্রাইভার ওঁর কথার কোনও উত্তর না দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে মেয়েটির কাছে গিয়ে কথা বলতে শুরু করল। আধ মিনিটেরও কম সময়ে উত্তরণকে লক্ষ করে ড্রাইভার বলে উঠল, “আর অসুবিধে হবে না। আসলে মেয়েটা বোবা আর কালা তো, তাই আপনার কথা বুঝতে পারেনি।”

উত্তরণের পিঠে যেন সপাং করে একটা চাবুক পড়ল। জীবনে এই প্রথম নালিশ করলেন আর এমন একজনের বিরুদ্ধে করলেন যে সেই নালিশটাই ঘুরে এসে ওঁকে মারল। আশ্চর্যের বিষয়, মানুষ মানুষের সম্বন্ধে এইরকম কত ধারণা নিয়ে থাকে, আর যতক্ষণ না আঘাত পায়, সেই ধারণা বদলায়ও না। উত্তরণ যদি নালিশ না করতেন, তা হলে কি বুঝতে পারতেন যে মেয়েটা আসলে কী! বরং ওই ভ্রান্তিটাই মনে-মনে বহন করতেন যে মেয়েটা যারপরনাই উদ্ধত। সেদিক থেকে সত্যিটা জানতে পেরে ভালই তো হয়েছে। কিন্তু তাও উত্তরণ এত গ্লানি বোধ করছিলেন কেন?

কেন চোখ জলে ভরে গেল যখন বারবার ওঁর হাতদুটো ধরে ক্ষমা চাইছিল সেই সতেরো-আঠেরোর মেয়েটা। আর তাতেও অপরাধের স্খলন হয়নি ভেবে যখন ওঁকে জড়িয়ে ধরল মেয়েটা, উত্তরণের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল কেন এক লহমার জন্য?

সেই দমবন্ধ অবস্থাতেই ব্রহ্মচারী ঠাকুরের কথা ভাবছিলেন উত্তরণ। ঠাকুর বলতেন, ‘পুণ্যঞ্চ পরোপকারে, পাপঞ্চ পরপীড়নে।’ পরের উপকারেই যত পুণ্য আর পরকে পীড়ন করার মধ্যেই সব পাপ। আচ্ছা, অপমান কি পীড়ন নয়? তা হলে কি মেয়েটিকে অপমান করছেন উত্তরণ, তাকে জড়িয়ে না ধরে? বাস অ্যাক্সিডেন্টের হাত থেকে বাঁচানোর পর অনসূয়া যখন ওঁকে জড়িয়ে ধরেছিল রাস্তার মধ্যে, তখন উত্তরণ নিজের বোধে ছিলেন না। সেদিন ওই ঘটনাটা না ঘটলে পরের কোনও কিছুই ঘটে না আর উত্তরণের আমেরিকায় আসাও হয় না। তাতে ব্রহ্মচারী ঠাকুর আদৌ রুষ্ট হয়েছিলেন কিনা উত্তরণ জানেন না। কিন্তু আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলের এক শহর থেকে অন্য শহরে যাওয়ার পথে, চলন্ত বাসের মধ্যে উত্তরণ যখন নিজের কাঠ হয়ে যাওয়া হাতদুটোকে সচল করে জড়িয়ে ধরলেন ওই বোবা-কালা মেয়েটাকে, ওঁর মনে হল ঠাকুর অলক্ষ্যে তৃপ্তির হাসি হাসছেন। নইলে আকাশের চাঁদটা অত ঝলমল করছে কেন?

১৩

মানুষের কতরকম চেহারা, কত ছদ্মবেশ, কত আয়না। তবু তার মধ্যে কিছু মানুষ থাকে যারা পাঁচ মিনিটেই অন্যকে আপন করে নিতে পারে, আত্মীয় বানিয়ে ফেলতে পারে। আটলান্টার সঞ্জয় পাল সেরকমই একজন। হো-হো করে হাসা, জোরে-জোরে কথা বলা ভদ্রলোকের স্বভাব। আর নেশা হল, নতুন কোনও বাঙালি শহরে এসেছে জানতে পারলেই তাকে আটলান্টা ঘুরিয়ে দেখানো এবং আটলান্টার বাঙালি সমাজে পরিচিত করে দেওয়া।

উত্তরণের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। উত্তরণ সবকিছু থেকেই একটু সরে থাকতে চাইতেন। কিন্তু সঞ্জয়দা কাউকে খুব বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। বিশেষ করে যাদের একবার মনে ধরে যেত, তাদের তো নয়ই।

উত্তরণের ইউনিভার্সিটিরই বায়োলজির প্রফেসর রুদ্রশিবের সুত্রে সঞ্জয়দার সঙ্গে আলাপ উত্তরণের। রুদ্রশিব কবিতা লিখত। সেই সূত্রে অনেকের সঙ্গে পরিচয় ছিল। উত্তরণকে প্রায় জোর করেই সে নিয়ে গিয়েছিল একটা অনুষ্ঠানে। সেখানেই সঞ্জয়দার চোখে পড়ে যান উত্তরণ।

লোকটা এই গান গাইছিল তো ওই একটু গিটারটা টেনে নিয়ে দু’বার তারে হাত বুলিয়ে নিচ্ছিল। আসলে যেটা করছিল, সেটা হল, সবার খাওয়া-দাওয়ার তদারকি। আর সেটা করতে গিয়েই হয়তো চোখে পড়ে থাকবে যে উত্তরণ দাঁতে কুটোটি না কেটে বসে আছেন।

“ঝট করে এই মাংসটা টেস্ট করে বলো তো, সঞ্জয় শেফ কেমন বেঁধেছে।” উত্তরণের সামনে এক বাটি মাংস হাতে দাঁড়িয়ে গেলেন ভদ্রলোক।

উত্তরণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সরে যেতে গেলেন, কিন্তু সঞ্জয়দা নাছোড়বান্দা। পারলে চামচে করে তুলে খাইয়ে দেন উত্তরণকে।

রুদ্রশিব উত্তরণের আচার-আচরণ বেশ খানিকটা জানত। ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পেরে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে কিছু বলল সঞ্জয়দাকে। কিন্তু সঞ্জয়দার অভিধানে কোনও ফিসফিসানির জায়গা ছিল না। সবই লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার।

“আশ্রমিক? কোন আশ্রমে থাকে? আমেরিকার ওই ফ্রি-সেক্স আশ্রমগুলোতে?” বেশ জোরেই জিজ্ঞেস করলেন সঞ্জয়দা।

“আরে ধ্যাত! দেশে আশ্রমে থাকত। এখানে এসেও সেই নিয়মকানুনগুলো মেনে চলে।” রুদ্রশিব বিরক্ত গলায় বলল।

“আরে ইন্ডিয়াতে প্রেমাশ্রমে থাকত না বৃদ্ধাশ্রমে থাকত, তাই দিয়ে আমেরিকায় কী? আমরা যে যার পূর্বাশ্রম দেশের ফুটপাতে, নর্দমায়, কিচেনে, বাথরুমে ফেলে এসেছি। ফেলে এসে, এখানে যে যার মতো বেঁচেবর্তে আছি। পাপ করছি, পাপের বেতন পাচ্ছি, হিসেব বরাবর হয়ে যাচ্ছে।”

“ক’পেগ টেনেছ অলরেডি?” রুদ্রশিব জানতে চাইল।

“যতগুলোই টানি, মাংসের টেস্টটা যা হয়েছে না, তোমার বড়-বড় হোটেলের রাঁধুনিরা ফেল করে যাবে। তোমার সন্নিসি বন্ধু তো খেল না, তুমি খেয়ে বলো।” সঞ্জয়দা হেসে উঠলেন।

ওই হাসিটাই লোকটার ট্রেডমার্ক। ওটা দিয়েই শেষমেশ মানুষের মন জিতে নিত লোকটা। উত্তরণ প্রথমে যেটাকে অবজ্ঞা ভেবেছিলেন, কিছুদিন যেতেই বুঝলেন, সেটা সঞ্জয় পালের সারল্য। আর সেই সারল্যের সামনে গলবে না, এমন পাষাণ-হৃদয় কমই আছে।

“সন্ন্যাসী হতে গেলে কিন্তু একটু পাহুর-দিল হতে হয়।” সঞ্জয়দা হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললেন।

উলটোদিকের সোফায় বসে কফি খাচ্ছিলেন উত্তরণ। কিছু না বলে একবার তাকালেন বক্তার দিকে। ভাবতে লাগলেন, প্রথমদিন যে লোকটাকে দেখে অস্বস্তি হচ্ছিল, সেই লোকটা দুবার ফোন করে আর-একবার আচমকা উত্তরণের ঘরে গিয়ে এমনই মজিয়ে দিল যে, উত্তরণ সটান নেমন্তন্ন রক্ষা করতে ওঁর বাড়িতে চলে এলেন, যা আমেরিকায় আসা ইস্তক আর কারও ক্ষেত্রেই করেননি।

উত্তরণকে কফি দিয়ে গিয়েছিলেন যে ভদ্রমহিলা তিনি ফিরে এলেন একটা ভর্তি প্লেট হাতে।

“নাও, আমার বাগানের কুমড়োফুলের বড়া খাও। এতে কোনও আশ্রম কিংবা ধর্মের কোনও আপত্তি থাকতে পারে না।” বলেই আবারও হেসে উঠলেন সঞ্জয়দা।

উত্তরণ একটু থমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আমেরিকায় কুমড়োফুল?”

“আমেরিকায় কী নেই বলো তো? একজন বড় রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ছিলেন জানো, এক-দুবার উত্তর আমেরিকার বঙ্গ সম্মেলনেও এসেছেন। রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে বলতে উঠলেই, গলা কাঁপিয়ে বলতেন, ‘রবীন্দ্রনাথে কী নাই!’ আমিও নিউ ইয়র্কের মুড়ি, শিকাগোর জিলিপি আর আমাদের আটলান্টার শিঙাড়া খেতে-খেতে বলি, আমেরিকায় কী নাই? অবশ্য বিশ বছর আগে যখন এসেছিলাম তখন কিছুই মিলত না। আজ মেলে সবকিছু।

ভাল লাগলে মানুষের প্রতিরক্ষা কাজ করে না। সঞ্জয়দার প্রতি ভাললাগা তৈরি হয়ে গেল বলেই ছোটবেলার কথা, আশ্রমে আসার কথা, ব্রহ্মচারী ঠাকুরের কৃপার কথা বলতে শুরু করেছিলেন উত্তরণ।

সঞ্জয়দা উত্তরণের হস্টেলের ঘরে চুপচাপ শুনছিলেন। আজ বললেন, “আমি বস এসব ব্যাপারে বিশেষ কিছুই জানি না। কিন্তু একটা কথা তোমায় বলি, ওই তোমাদের বেদে না উপনিষদে ভগবান বলেছেন না, ‘আমি এক, আমি বহু হব’? তবে তো ভগবান ক্রিয়েশন বাড়ানোর কথাই বলছেন। এবার সেক্স ছাড়া ক্রিয়েশন বাড়বে কী করে? তোমাদের মতো ব্রাইট যুবকেরা যদি সন্ন্যাসী হয়ে থাকে, তা হলে ভবিষ্যতের পৃথিবী তো লুম্পেন আর ক্রিমিন্যালে ভরে যাবে। সেটা কিন্তু কোনও কাজের কথা নয়।”

ফ্রেজ়ারের কথাগুলোই উত্তরণ একটু অন্যভাবে বলতে শুনছিলেন সঞ্জয়দাকে। নাকি, ফ্রেজ়ার কিংবা সঞ্জয় পাল নির্বিশেষে এই কথাগুলো আমেরিকার? যারা দেশটার সঙ্গে সম্পর্কে আসবে, সবাইকেই শুনতে হবে!

“আরে ও প্রথম দিন এসেছে, ওকে এত বিরক্ত করছ কেন? ওকে ওর মতো থাকতে দাও না। কতই বা বয়স ওর? যদি টানার হয়, সংসারই টেনে নেবে। ওকে কিছু করতে হবে না।” উত্তরণের প্লেটে আরও দুটো বড়া দিতে এসে ভদ্রমহিলা বললেন।

সঞ্জয়দা খুশি হয়ে উঠলেন কথাটা শুনে। “দারুণ বলেছ কমলিকা। সংসারই আমাদের টেনে নেয়, আমাদের সংসারকে টানতে হয় না। আচ্ছা উত্তরণ, কমলিকা যে যৌবনে সুন্দরী ছিল, সেটা ওকে এখন দেখলেও বোঝা যায়, তাই না?”

“এবার আপনি আমাকে বিব্রত করছেন সঞ্জয়দা। আমি ঠিক এভাবে কাউকে দেখতে অভ্যস্ত নই।”

“উফফ এই ছেলেটাকে নিয়ে আমি মরে যাব! আরে একটা মহিলার রূপ নিয়ে একটু নিরপেক্ষ মতামত আশা করতে পারব না তোমার থেকে? তুমি কী?”

“আবার তুমি জ্বালাতন করা শুরু করলে ছেলেটাকে? ও আর আসবেই না তোমার বাড়িতে! এখনই হয়তো ভাবছে কখন পালাব?” কমলিকা ঝাঁঝিয়ে উঠলেন।

“না বউদি, তেমনটা ভাবিনি আমি। সঞ্জয়দা একটু মজা করে কথা বলেন, জানি সেটা।”

উত্তরণের কথাটার পরপরই পিনপতনের নিস্তব্ধতা নেমে এল সারা ঘরে। কিছুক্ষণ পরে কমলিকা বললেন, “আমি কারওর বউ নই, তাই কারওর বউদি হওয়ারও যোগ্যতা আমার নেই। তুমি আমাকে ‘কমলিকাদি’ বলে ডেকো উত্তরণ। জাস্ট ‘কমলিকা’ও বলতে পারো।”

উত্তরণ ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে, একবার কমলিকা আর একবার সঞ্জয়দার মুখের দিকে তাকালেন।

সঞ্জয়দা নিঃশব্দে দুটো চুমুক দিয়ে বললেন, “ভাল মানুষ নই গো মোরা, ভাল মানুষ নই। কমলিকা আমার স্ত্রী নয় উত্তরণ। তাই বলে রক্ষিতাও নয়।”

“কী বলছেন, কিছু বুঝতে পারছি না।”

“বুঝবে, এখানকার বাঙালিদের সঙ্গে তোমার খুব একটা মেলামেশা নেই, তাই। থাকলে আগেই বুঝতে। অবশ্য আমার বাড়িতে তুমি এসেছ, খাওয়া-দাওয়া করেছি আমরা একসঙ্গে, এটা চাউর হলে, লোকজন নিজের দায়িত্বে তোমাকে এসে জানিয়ে যাবে যে আমি কতটা খারাপ, আমার বউ থাকতেও একটা বাঙালি রক্ষিতা আছে, আমেরিকার আইনকে কলা দেখিয়ে তাকে আমি নিকটাত্মীয়া হিসেবে নিজের বাড়িতেই রেখে দিয়েছি, ইত্যাদি-ইত্যাদি।

“এসব শুনে আমার কী লাভ? শুনতে যাবই বা কেন?” উত্তরণ উঠে দাঁড়ালেন।

“তুমি তো বিরাট ব্যবসায়ী হে! যা শুনে লাভ হয়, শুধু তা-ই শোনো! কিন্তু সংসারে মানুষ তো নিজের দুঃখ-কষ্টের কথাই অন্যকে বলতে চায়। তাই শুনে লাভ না হলেও, মানুষ শোনে মানুষের কথা। সেটাই সভ্যতা, সেটুকুই মানবিকতা। তুমি বোসে। এখনই যাওয়ার কোনও সিন নেই।”

“সঞ্জয়, ও যেতে চাইলে যাক। হয়তো ওর অস্বস্তি হচ্ছে এই পাপের পরিবেশে থাকতে।”

“চাইলেও এখান থেকে পুণ্যের পরিবেশে ও যাবেটা কী করে? সাধু মহারাজ তো এখনও গাড়ি চালাতেই শেখেননি। শেখা থাকলে পরে আমার একটা গাড়ি দিয়ে দিতাম। এখন সেই আমাকেই তো পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে। বসুক অতএব…”

“কিন্তু তুমি ড্রিঙ্ক করে…”

“‘ছাড়ো তো ড্রিঙ্ক। এর তিনগুণ মদ খেয়ে তোমায় নিয়ে ফিরিনি? তখন আবার রাস্তায় নিশ্বাস পরীক্ষা হচ্ছিল। যে লোকটা চেক করছিল সে গাধাট-ই বলতে হবে, নয়তো আমাকে যেতে দিল কেন? কিংবা কে জানে, ব্যাটাচ্ছলে নিজেও খেয়ে ছিল হয়তো। তাই এক গন্ধে অন্য গন্ধ চাপা পড়ে গিয়েছে। জীবনে তো সেটাই হয়, তাই— না?”

“তোমার নেশা হয়ে গিয়েছে সঞ্জয়। তুমি আধ ঘণ্টা ঘুমিয়ে এসো। আমি কথা বলছি উত্তরণের সঙ্গে।”

“সে তুমি বলতেই পারো। কিন্তু ঘুমোলে নেশা কেটে যায়, কে বলল তোমায়? তুমি চলে যাওয়ার পর তো কত ঘুমিয়েছি, কেটেছে?”

“কেটে যাওয়া উচিত ছিল। তুমি চেষ্টা করোনি ঠিকমতো।”

“করেছিলাম গো করেছিলাম। আর চেষ্টার আছেটা কী, প্রথম এখানে আসার পর থেকে যে মুখে রক্ত-ওঠা পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে যেতাম, তাতে বাপের নামই মনে থাকত না, অন্য কিছু তো দূর অস্ত্! তার মধ্যেই ভেরোনিকার সঙ্গে পরিচয়। কমলিকা, তুমি তো জানো ভেরোনিকার কথা, জানো না? সে কী মেয়ে ছিল রে ভাই উত্তরণ, পুরো আগুনের গোলা। রেস্তরাঁয় বাসন মাজলে কী হবে, এক-একটা বুক পুরো পৃথিবীর সাইজ়ের! আর ফ্যাটফেটে ফরসা ছিল না বলে আরও ভাল লাগত আমার। ট্যুরিস্টরা যেমন নতুন স্পটের টানে ভেসে যায়, আমি ওই গোলার্ধের টানে ভেসে গেলাম। তার কাছে কোথায় তোমার গীতা-পুরাণ। শুধু ঘি আর আগুন, আগুন আর ঘি!”

কমলিকাদি কড়া গলায় বললেন, “আবার এসব গল্প শুরু করলে?”

“আরে আমাকে যখন চিনছে, তখন পুরোটাই তো চিনবে। তা ছাড়া মেক্সিকান মেয়েদের সেক্স অ্যাপিল প্রচণ্ড। কাল যদি উত্তরণের জীবনে একটা মেক্সিকান মেয়ে আসে, তা হলে ও কতটা ব্রহ্মচর্য বজায় রাখতে পারবে, আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ভেরোনিকা একটা জার্মানের সঙ্গে ভেগে না গেলে, আমি ওই মেক্সিকানই বিয়ে করতাম, ইতালিয়ানের চক্করে পড়তাম না।”

“তুমি কি না চাইতেই চক্করে পড়ে যাও?” কমলিকাদি ব্যঙ্গের গলায় বললেন।

সঞ্জয়দা বোধহয় শ্লেষটা ধরতে পারলেন না। তিনি বলে চললেন, “ইতালিয়ান মেয়েরা একটু নরম-সরম, সংসারী গোছের হয় তো! আর সারা আমাকে যেভাবে আঁকড়ে ধরেছিল, কাটিয়ে বেরোতে পারিনি। চাইওনি হয়তো।

উত্তরণ শুনতে-শুনতে একটা ধাঁধার মধ্যে পড়ে যাচ্ছিলেন।

সঞ্জয়দা যেন সেটা বুঝতে পেরেই বলে উঠলেন, “আমি বলব তুমি এখন কী ভাবছ? ভাবছ যে সঞ্জয় পালের মেক্সিকান বান্ধবী ছিল, ইতালিয়ান বউ আছে, তা হলে এই ভদ্রমহিলা কে? আরে, কমলিকা গুপ্ত আমার প্রেমিকা, মাই ফার্স্ট লাভ।” বলতে-বলতে হাতে ধরা গ্লাসটা শেষ করে দিয়ে বললেন, “তোমার সত্যিই চলবে না?”

উত্তরণ ঘাড় নাড়লেন।

সঞ্জয়দা আবার প্রসঙ্গে ফিরে গিয়ে বললেন, “কফিই খাও তবে। বাট ভেবো না যে আমি নেশা করে বলছি। সম্পূর্ণ সজ্ঞানে বলছি, প্রেম কী, সেই বোধ, কমলিকার মধ্যে দিয়েই এসেছিল জীবনে। ও আমার প্রথম প্রেমিকা।”

“প্রেমিকা না ছাই। আমি তোমার বাড়ির ঝি।”

“কমলিকা, আমি বহুবার তোমাকে এভাবে কথা বলতে বারণ করেছি। তুমি আমার দেবী, মাই গডেস। কার এত হিম্মত যে ঝি মনে করবে তোমাকে?”

“হিম্মতের দরকার নেই। এমনিই সবাই মনে করে। দু’দিন পরে এই উত্তরণও করবে দেখে নিয়ো।”

“না, মনে করবে না। উত্তরণ সেরকম ছেলে নয়। আর কেউ করলেও, আই কেয়ার আ ফিগ। কারণ আমি জানি যে তুমি এই বাড়িতে ঝি হিসেবে আসসানি। সঞ্জয় পালের বাড়িতে তোমার পজিশন কখনও ঝি-এর হতে পারে না।”

“সে তোমার বউ তিন মাসের জন্য ফ্রান্সে ছেলের কাছে গিয়েছে বলে আমি রানি সেজে আছি। যেদিন সারা ফিরবে তার পরদিনই…”

“কী হবে পরদিন? তোমার সঙ্গে সাংঘাতিক দুর্ব্যবহার শুরু করবে? করেছে আজ পর্যন্ত?”

“করেনি কারণ ইউরোপিয়ান ভাবধারায়, মানুষকে ঝি হিসেবে ভাবাটা বাঙালিদের মতো মজ্জাগত নয়। তবু আমি আমার পজ়িশনটা কখনও ভুলতে পারি না। ভোলা উচিত নয়। একটাই শুধু আক্ষেপ যে, নিজেরই ভুলে, যে বাড়ির মালকিন হতে পারতাম সেখানে ঝি হয়ে আছি।”

ব্যাপারটা একেবারেই পরিষ্কার না হলেও উত্তরণ জিজ্ঞেস করে পরিষ্কার করে নিতে চাননি। প্রথমত সাংসারিক ব্যাপারে ওঁর তেমন কোনও আগ্রহ ছিল না। তার চেয়েও যেটা গুরুত্বপূর্ণ, তা হল বিতর্কিত ব্যাপারে প্রশ্ন করে সঞ্জয়দা কিংবা ওই সদ্য পরিচিতা ভদ্রমহিলা, কাউকেই বিব্রত করতে মন করেনি।

সেদিন রাতে না খেয়ে আসতে দেননি কমলিকাদি। কিন্তু কোথাও একটা তাল কেটে গিয়েছিল বলে খাওয়ার টেবিল থেকে আনন্দ উধাও হয়ে গিয়েছিল। সঞ্জয়দা ঝিম হয়ে শুয়েছিলেন সোফায়। গাড়ি করে উত্তরণকে ফেরত দিয়ে আসার সময়ও তেমন কোনও কথা বলেননি। শুধু উত্তরণ নেমে যাওয়ার সময় তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন।

সেই দৃষ্টিতে এমন কিছু ছিল যা উত্তরণকে চুপ করে থাকতে দেয়নি। উত্তরণ প্রায় বাধ্য হয়েছিলেন জিজ্ঞেস করতে, “কিছু বলবেন সঞ্জয়দা?”

“তুমি যেখানে থাকো সেটাকে ‘হাউস হোটেল’ বলে, তাই না?”

“হ্যাঁ। জানি না কেন, হস্টেল’ শব্দটা ব্যবহার করে না এরা।”

সঞ্জয়দা বললেন, “ভালই করে। অন্য শব্দটার ব্যাপ্তি অনেক বেশি।”

দু’সপ্তাহ পরে উত্তরণ আবার যেদিন সঞ্জয়দার অনুরোধ ফেলতে না পেরে ওই বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলেন, সেদিন সঞ্জয়দা হাসতে হাসতে বললেন, “দেখলে তো আবার আমার ‘হাউস হোটেলে’ আসতে হল তোমায়? ভাবছ, এটা বাড়ি বাড়ি হলে তো নিজের মনের মানুষকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিয়েই রাখতে পারতাম। প্রেমিক-প্রেমিকারা হোটেলে গেলেও লুকিয়ে-লুকিয়ে থাকে, জানো তো?”

“প্রেমিক-প্রেমিকারা হোটেলে অন্তত একসঙ্গেই থাকে, একটাই ঘরে। এখানে তো সেই স্বাধীনতাও নেই আমাদের। তবু তার জন্য এই বাড়িটা ‘হোটেল’ হয়ে যায় না। এটা বাড়িই। সঞ্জয় আর সারার বাড়ি। আর ওদের ছেলে শুভায়ুর বাড়ি। সারা সামনের সপ্তাহে ফিরে আসবে, সঞ্জয়কে আবার দূরত্ব রেখে মিশতে হবে আমার সঙ্গে, তাই সেন্টিমেন্টাল হয়ে গিয়ে এইসব শোনাচ্ছে তোমাকে।”

“না, আমি আসলে সত্যিটা বলতে চাইছি উত্তরণকে। নয়তো অন্য কেউ যখন আমার আর তোমার নামে নর্দমা উপুড় করবে, খারাপ লাগবে ওর।”

নর্দমাকে যে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইছে, নর্দমা তাকেও কীভাবে যেন ছুঁয়ে যায়। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতাতেই দেখেছেন উত্তরণ। তাই জোর দিয়ে বলতে পারলেন না যে নর্দমার পরোয়া করেন না তিনি।

সঞ্জয়দার শেষ কথাগুলো শুনে কমলিকাদি রেগে গেলেন, “নর্দমা ওগরালেই নর্দমাটা সত্যি হয়ে যায় নাকি? শোনো উত্তরণ, তুমি পরে যেখান থেকে যা-ই শোনো না কেন, সত্যিটা হল, সঞ্জয়ের কোনও দোষ নেই। সঞ্জয়দের পাড়ায় আমাদের মামাবাড়ি ছিল। সেখানেই প্রথম আমাকে দেখে ও মাঝে-মাঝে গিয়ে থাকতাম তো ওখানে। ওর তরফ থেকে ব্যাপারটা লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইটই হয়েছিল।”

“আর আপনার তরফ থেকে?” উত্তরণ তো রোবট নন, তাই জিজ্ঞেস করে বসলেন।

“আমি জানি না। একটা ভাললাগা নিশ্চয়ই তৈরি হয়েছিল, কিন্তু সেটা তীব্রতায় সঞ্জয়ের প্যাশনের ধারেকাছে আসত না। আমাদের গাড়ির পিছন-পিছন সাইকেল নিয়ে ফলো করতে গিয়ে ও একবার লরির তলায় চলে যাচ্ছিল।”

“গেলে ভালই হত, কি বলো?”

“বাজে বোকো না তো। অবশ্য বাজে বকাই তোমার স্বভাব। তখনও বকতে। কিন্তু বকলে কী হবে, আমি বুঝতে পারতাম যে এই ছেলেটা আমাকে ভালবাসে। পাগলের মতো ভালবাসে।”

“উত্তরণকে বলো, তুমি কেন ভালবাসোনি?”

“সঞ্জয় স্ট্রাগলিং পরিবারের ছেলে ছিল বলে আমি ভরসা রাখতে পারিনি ওর উপর। আসলে জীবনের লাক্সারিগুলো চেয়েছিলাম। তাই বাড়ি ঠিক করে দেওয়া ইঞ্জিনিয়ারকে বিয়ে করেছিলাম। সেই লোকটা যখন আমাকে বেল্ট খুলে মারত, তার রক্ষিতা এসে যখন আমার মুখের উপর আঙুল তুলত, তখন বুঝতে পেরেছিলাম কত বড় ভুল করেছি। স্লিপিং পিল খেয়ে সুইসাইড করার চেষ্টা করেছিলাম। পারিনি। বেঁচে ফিরে এসেছিলাম, একরাশ লজ্জা মাথায় নিয়ে। তার কিছুদিন পরই সেই ইঞ্জিনিয়ার আর তার রক্ষিতা ঘাটশিলায় ছুটি কাটাতে গিয়ে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। কিন্তু আমার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা এমনই ছিল যে আমার স্বামীর সম্পত্তির এক কণাও আমি পাইনি।”

“মামলা করেননি?”

“ওদের প্রচুর কানেকশন ছিল, ক্ষমতার সব কেন্দ্রে। লড়েও বিশেষ কিছু করতে পারতাম না। তবু লড়া যেত। কিন্তু যে আমাকে ভালবাসেনি কোনওদিন, তার কিছু নিতেই ঘেন্না করছিল প্রথমত। জীবনের প্রয়োজনে তাও হয়তো চাইতাম, কিন্তু যা ন্যায্যত আমার, তাও যে পাব, সেই বিশ্বাসটাই হারিয়ে ফেলেছিলাম তখন। হারার আগেই হেরে বসে থাকতাম প্রতিটা জুয়ায়। শুধু যে কোনও উপায়ে জীবনটা কাটিয়ে দিতে চাইছিলাম, এটা-ওটা করে। করেওছি। কতরকমের চাকরি যে ধরেছি আর ছেড়েছি, বিশ্বাস করতে পারবে না।”

“দেখতে সুন্দর ছিল বলে, বেশিদিন টিকতে পারত না কোথাও। হায়নারা ঝাঁপিয়ে পড়ত।”

“এই ‘দেখতে সুন্দর’ কথাটা কি সবসময় পাস্ট টেনসেই বলতে হবে সঞ্জয়?” হেসে উঠলেন কমলিকাদি। তারপর উত্তরণের দিকে তাকিয়ে বললেন, “সঞ্জয়ের সঙ্গে এগারো বছর পরে কোথায় আবার আমার দেখা হল, বলতে পারো?”

“কোথায়?”

“সঞ্জয় ফুল-টাইম কাজের লোক চেয়ে কলকাতার একটা খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। একশোর কাছাকাছি মহিলা এসেছিল বিজ্ঞাপনে সাড়া দিয়ে। আমেরিকায় যেতে পারবে, সেই আশায়।”

“সেই ইন্টারভিউতেই সঞ্জয়দা আবার আপনাকে দেখেন?” উত্তরণ খানিকটা চমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

কমলিকাদি কোনও জবাব দেওয়ার আগেই সঞ্জয়দা বলে উঠলেন, “সারা সেই সময় ভীষণ অসুস্থ বলে আমি ইন্ডিয়ায় গিয়ে ওই ভুলভাল বিজ্ঞাপনটা দিয়ে ফেলেছিলাম। তাই বলে কমলিকাকে কাজের লোক হিসেবে আমেরিকায় নিয়ে আসিনি। ভগীরথ যেভাবে গঙ্গাকে মাথায় করে নিয়ে এসেছিল, সেভাবে নিয়ে এসেছি আমার প্রথম প্রেমকে।”

“প্রেম কই? যা আছে সব ধ্বংসস্তূপ।” কমলিকাদি বিষগ্ন গলায় বলে উঠলেন।

উত্তরণের কেমন মনে হল যে কমলিকাদিও নেশা করেছেন। হাতে গ্লাস দেখতে পাওয়া যাক বা না যাক।

“যদি ধবংসস্তূপ হয়ে গিয়ে থাকে, তা হলে সে তোমার একার নয়। আমাদের দু’জনেরই যৌবনের ধ্বংসপ। আমার যৌবন তোমার সঙ্গেই শেষ হয়ে গিয়েছিল।” সঞ্জয়দা নিজের জন্য ড্রিঙ্ক বানাতে-বানাতে বললেন।

“তোমার যৌবন কখনওই শেষ হয়নি। তোমার জীবনে তারপরে অনেক মহিলা এসেছে। তোমার সন্তান হয়েছে, সংসার হয়েছে। সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছে একা আমার। আর সেটাই ঠিক হয়েছে, কারণ আমি তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। লোভের দিকে পা বাড়িয়েছিলাম। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু, কে না জানে।” বলতে-বলতে কমলিকাদি দেওয়ালে মাথা ঠুকতে আরম্ভ করলেন।

সঞ্জয়দা গ্লাসটা নামিয়ে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে পিছন থেকে গিয়ে কমলিকাদিকে জড়িয়ে ধরলেন।

উত্তরণ সোফায় স্ট্যাচুর মতো বসে রইলেন। মনে হল এখান থেকে গিয়ে বেরিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু কীভাবে বেরোবেন এখনই?

উত্তরণ আছেন না নেই পরোয়া না করে সঞ্জয়দা বলে যেতে থাকলেন, “সারা এখানে থাক বা না থাক, এই বাড়িতে তোমার জায়গা সবসময় আছে, ছিল, থাকবে।”

“আর সমাজের কুৎসা?”

“কোন সমাজ? কিছু নিন্দুকের? কে পাত্তা দেয়? ওরা যখন নেমন্তন্নের লিস্ট করে, তখন বিধবা আর বিপত্নীকদের বাদ দেয়। আমি নিজে দেখেছি। আসলে ওরা ভাবে যে এরা ফ্রি র‍্যাডিক্যাল। কার না কার সঙ্গে জড়িয়ে যাবে। তাই সবসময় জোড়ায়-জোড়ায় চায় সবকিছু। আচ্ছা, মানুষ কি পায়রা?” বলতে-বলতে উত্তরণকে একটা হাত দেখিয়ে সঞ্জয়দা কমলিকাদিকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেলেন।

উত্তরণের খুব খারাপ লাগল। ওঁকে ইশারায় অপেক্ষা করতে বলে কোথায় গেলেন সঞ্জয়দা আর কমলিকাদি? এভাবে চলে যাওয়ার মানে কি? উত্তরণ এখন থাকেনই বা কী করে, চলেই বা যান কীভাবে?

ভাবতে-ভাবতে প্রায় ঘণ্টাখানেক চুপ করে বসে রইলেন উত্তরণ। তারপর সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আলতো ধাক্কা দিতে শুরু করলেন প্রত্যেকটা দরজায়। কিন্তু দিয়েও কোনও সাড়া না পাওয়ায় প্রথম দরজাটার পাল্লাদুটো ধরে ঠেলা দিলেন। জনশূন্য ঘরটায় কেবল একটা মৃদু আলো জ্বলতে দেখলেন। এবার দ্বিতীয় দরজাটায় ঠেলা মারতেই ভিতরে যা দেখলেন তাতে একটা আগ্নেয়গিরি ঝলসে উঠল ওঁর দু’চোখের মাঝখানে। কাঁপতে-কাঁপতে নীচে নেমে এলেন উত্তরণ। দরজা খুলে বেরিয়ে যাওয়ার আগে পিছন ফিরে তাকালেন না একবারও।

বাইরে তখন নিকষ কালো রাত্রি। কনকনে বাতাস।

১৪

“তোমার কিংবা আমার বাবা-মা, অথবা পৃথিবীর সব বাবা-মা’ই একদিন ওই অবস্থায় ছিল বলেই আমরা এই পৃথিবীতে এসেছি, তাই না উত্তরণ?” সঞ্জয়দা সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়লেন লম্বা করে।

সেদিন রাত্রে যা ঘটেছে তারপরে উত্তরণের কথা বলতেই ইচ্ছে করছিল না সঞ্জয় পালের সঙ্গে। তাই বলে মানুষটাকে তাড়িয়েও দিতে পারেননি দরজার মুখ থেকে, ভিতরে এনে বসিয়েছেন। কিন্তু সেদিন সেই ঠান্ডার মধ্যে আটলান্টার রাস্তায় বেরিয়ে যেতে হয়েছিল যাঁর জন্য, তাঁকে দেখে উৎফুল্লও হতে পারছিলেন না উত্তরণ।

“কোথায় ছিলে সেদিন রাতে? কীভাবে বাড়ি ফিরলে?” সঞ্জয়দা উত্তরণের ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করলেন।

“পথে-পথে ঘুরছিলাম। আরও কিছুক্ষণ ঘুরলে হয়তো মরেই যেতাম। সামনে একটা পাব পেয়ে সেখানে গিয়ে বসেছিলাম। রাতটা ওখানেই কাটল।”

“উত্তরণ মুখার্জি শেষে পাবে গিয়ে বসল?”

“কী করব, আমার বসার জন্য সিংহাসন তো কেউ সাজিয়ে রাখেনি রাস্তার কোথাও। আর ওই ঠান্ডার মধ্যে, বাইরে আর আধ ঘণ্টা থাকলে…”

“ডবল নিউমোনিয়া হয়ে মরে যেতে, তাই তো?” সঞ্জয়দা উত্তরণকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন।

“কী বলতে চাইছেন?”

“কিচ্ছু না। শুধু চাইছি তুমি ভাবো, কেন তোমার ক্যাটেগরির একটা ছেলেকে পাবে ঢুকতে হল?”

“কী করব, উপায় ছিল না।”

“আমিও সেটাই বলতে চাইছি, উপায় থাকে না। যদি আটলান্টা না হয়ে মিনিয়াপোলিস বা বস্টন হত, তুমি পাঁচ মিনিটও রাস্তায় টিকতে পারতে না। আমাকে আর কমলিকাকে ওই অবস্থায় দেখার পরও আবার আমার বাড়িতেই হয়তো ফিরে এসে কড়া নাড়তে।”

“কখনও নয়। ওই অশালীনতা দেখার পর, কিছুতেই আর…”

“কীসের অশালীনতা? দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ পরস্পরের কাছাকাছি আসবে, এর মধ্যে অশালীনতা কোথায়? অশালীনতা বা অসভ্যতা যদি কিছু হয়ে থাকে সেদিন রাত্রে, সেটা তুমি করেছ।”

“অসভ্যতা করেছি? আমি?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। তুমি। কোন আক্কেলে তুমি আমাদের ঘরে ঢুকে পড়েছিলে?”

“আমি অন্তত ছ’বার দরজায় নক করেছি। কেবল ওই ঘরের নয়, প্রত্যেকটা ঘরের। কিন্তু কোনও সাড়া পাইনি।”

“সাড়া পাওনি তো নীচে নেমে বসে থাকতে, বা ঘুমিয়ে পড়তে পারতে। দুম করে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢোকার কী ছিল?”

“আশ্চর্য! আমি বাড়ি ফিরতাম না?”

“কেন, কোন প্রিন্সেস ডায়ানা তোমার জন্য অপেক্ষা করছিল? একটা রাত আমার বাড়িতে থেকে গেলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত?”

“আমায় মাফ করবেন, আমি আপনার সঙ্গে ঝগড়া করতে পারব না।”

সঞ্জয়দা কথা বলতে-বলতে হঠাৎ কেঁদে ফেললেন, “ঝগড়া আমিও করতে আসিনি রে ভাই। আমার ভিতরটা যদি তোমাকে দেখাতে পারতাম। সেখানে আলাস্কার থেকেও বেশি ঠান্ডা। সেই শীতে আত্মা জমে বরফ হয়ে যায়। তার থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যই, সেই রাতে…”

“আমি আপনাদের বিব্রত করব বলে ঘরে ঢুকে পড়িনি সঞ্জয়দা। ঢোকার পরেও প্রাথমিক আঘাতটুকু কাটিয়ে উঠতে যতক্ষণ লাগে, তার থেকে বেশি এক সেকেন্ডও…”

“আমি জানি। সংসার সম্পর্কে জ্ঞান নেই বলেই তুমি বুঝতে পারোনি, পুরুষ আর নারী একসঙ্গে কোনও নিভৃত জায়গায় গেলে, কীসের জন্য যায়! সেই বোধ থাকলে তুমি আমাদের খুঁজতে না, অপেক্ষা করতে আমাদের জন্য।”

“জানি না। তবে এটুকু বুঝতে পারছি, আপনাদের বাড়ি যাওয়াই ভুল হয়ে গিয়েছিল আমার।”

“ভুল নয়, কিচ্ছু ভুল নয়। মানুষ মানুষের সঙ্গে না মিশলে বাঁচবে কী করে? ওরকম হয়, হয়ে যায়। মন থেকে মুছে ফেলতে হয়। আমার স্ত্রী সারা ইউরোপ থেকে ফিরে এসেছে। ওর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়ার জন্য একটা উইকএন্ডে তোমায় আবার নিয়ে যাব…”

“মাফ করবেন, আমার পক্ষে আর ওই বাড়িতে যাওয়া সম্ভব নয়।”

“সম্ভব নয় কেন? ওখানে তুমি একজন বিবাহিত পুরুষকে অন্য একজন নারীর সঙ্গে নগ্ন হয়ে শুয়ে থাকতে দেখেছ, তাই?”

সঞ্জয়দার চাঁচাছোলা প্রশ্নগুলো আবার সেই মুহূর্তে নিয়ে যাচ্ছিল যেখানে উত্তরণ, সুতোহীন দুই নারী-পুরুষকে, ক্রিয়াশীল নয়, ঘুমন্ত অবস্থায় দেখেছিলেন। কিন্তু সেই ঘুমের গায়ে এমন একটা আশ্লেষ লেগে ছিল, যা ব্রহ্মচর্য পালন করে আসা উত্তরণকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। এমন একটা পর্ণগ্রাসের ছায়া লেগে ছিল ওই ঘরের হালকা নীল আলোয়, যা পৃথিবীর সব জ্যোৎস্নাকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে ফেলে দিতে পারে।

সিঁড়ি দিয়ে প্রায় ছুটে নেমে এসে যখন দরজা খুলে বেরিয়েছিলেন উত্তরণ, ওঁর মনে পড়ে গিয়েছিল একবার অনসূয়াকে, স্নান করছে এমন অবস্থায় দেখার কথা। তখন উত্তরণের, ওই বাড়িতে বসবাসের প্রায় এক বছর হয়ে গিয়েছে। সারা সকাল কার্ল পপারের একটা বই ঘেঁটে ক্লান্ত উত্তরণ ছাদে উঠেছিলেন টবের গাছগুলোয় একটু জল দেবেন বলে। প্রথমে খেয়ালও করেননি, কিন্তু শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখেন ছাদের যে অংশটায় শেড দেওয়া, সেখানে বসে ছাদের কলটা খুলে, বালতি থেকে মগে করে জল তুলে গায়ে ঢালছে অনসূয়া। উত্তরণের উপস্থিতি টের পেয়ে একটুও বিব্রত না হয়ে অনসূয়া বলেছিল যে বাড়ির জলের লাইন খারাপ হয়ে যাওয়ায়, পাম্প চালালে জল উপরে ট্যাঙ্কে উঠছে কিন্তু ট্যাঙ্ক থেকে নীচে নামছে না। তাই লাইন মেরামতির আগে, ছাদে উঠে স্নান করা ছাড়া গতি নেই।

কথাটা শুনেই উত্তরণ জানতে চেয়েছিলেন, “লাইন খারাপ তো বুঝলাম। কিন্তু একতলার চৌবাচ্চায় আমার স্নানের জল কোত্থেকে এল?”

“আমিই ছাদ থেকে বালতি করে নিয়ে গিয়ে ভরে রেখেছি।” স্নান করতে-করতেই জবাব দিয়েছিল অনসূয়া।

অনসূয়ার উত্তরটা শুনে উত্তরণের চোখ ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল। আর, কে জানে কেন, খুব রাগ হয়েছিল মেয়েটার উপর। মাথার ভিতর দপদপানো রাগ আর চোখ থেকে নামা জল খুব সাংঘাতিক জুটি, অন্য সবকিছুকে মুছে দেয় স্লেট থেকে। উত্তরণের মাথা থেকে তাই মুছে গিয়েছিল, অনসূয়া শাড়ি গায়ে জড়িয়ে জল ঢালছিল, নাকি নাইটি পরে। রাতের ওই পাবে বসেও ওঁর মনে পড়েনি সে কথা। কিন্তু সেই গরমের দুপুরে বরানগরের ছাদে ওঁদের কথোপকথনের সঙ্গে ‘সারা’ নামের এক ইতালিয় মহিলার অনুপস্থিতিতে সঞ্জয় আর কমলিকার পরস্পরকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকার কোনও তুলনা হয় না।

“মকটেল খেলে, পাবে গিয়ে?” সঞ্জয়দা জানতে চাইলেন।

উত্তরণ কোনও উত্তর দিলেন না।

“আচ্ছা তোমার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যখন রুক্মিণীদেবীকে বাদ দিয়ে সত্যভামার সঙ্গে শুতেন, তখন কি শোওয়ার আগে তোমার মতো সন্নিসির অনুমতি নিতেন?”

উত্তরণের বলার খুব ইচ্ছে হল, “বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণচরিত্র’ পড়ে দেখবেন, সেখানে বঙ্কিম বলেছেন যে কৃষ্ণের একটিই স্ত্রী, বাকিটা রটনা।” কিন্তু মুখ খুললেন না।

তখনই, হয়তো খানিকটা মরিয়া হয়েই, বাবা-মায়ের প্রেম এবং প্রত্যেকটি মানুষের পৃথিবীতে আসার পিছনের অমোঘ কারণের কথা উত্তরণকে মনে করাতে চাইলেন সঞ্জয়দা। কিন্তু তার একবার ছিঁড়ে গেলে সহজে আর লাগানো যায় না। লাগলেও আগের সেই সুর তাতে আর বাজে না।

উত্তরণের কাছে উত্তর না পেয়ে এক সময় চলেই গেলেন সঞ্জয়দা। ছ’মাসের মধ্যে একটা ধ্রুপদী সংগীতের অনুষ্ঠানে এবং একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে দেখা হলেও, কথা হয়নি তেমন। দ্বিতীয় দফায় যে ভদ্রমহিলা সঞ্জয়দার সঙ্গে ছিলেন, তিনিই বোধহয় তাঁর বৈধ স্ত্রী। তাঁর সামনে বলেই হয়তো আড়ষ্ট ছিলেন সঞ্জয়দা। কিন্তু সেই গানের আসরে তো একাই ছিলেন, তখনও সেভাবে কথা বললেন কই! উত্তরণ কারণগুলো খোঁজার চেষ্টা করে আর নিজেকে যন্ত্রণা দেননি। পিছনের রাস্তার দিকে না তাকানোই তো ভাল।

সামনের রাস্তাতেই পিছনের চিহ্ন পড়ে থাকে। সেদিন ভাইয়ের পার্ট ওয়ান পরীক্ষায় পাশ করার কথা শুনে ভাল ছিল মনটা। ইচ্ছে করছিল আগের মতো ওকে নিয়ে ঘুরতে যান, খাওয়ান কোনও দুর্দান্ত হোটেলে, এখন তো ছেলেটা কলকাতায় থাকে। উত্তরণের মতো সে নয় একেবারেই, তবু পড়াশোনা করে মোটামুটি একটা জায়গায় পৌঁছতে পারবে ছেলেটা, উত্তরণ বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন। ঠাকুরের কৃপা ব্যর্থ হবে না কখনওই, ভাবতে-ভাবতে এগোতে গিয়ে উত্তরণ দেখেন, সঞ্জয়দা দাঁড়িয়ে আছেন ওঁর অ্যাপার্টমেন্টের সামনেই।

উত্তরণকে দেখতে পেয়েই সঞ্জয়দা ওঁর হাতদুটো জড়িয়ে ধরে বললেন, “একটা প্রার্থনা নিয়ে এসেছি, ‘না’ বলতে পারবে না কিন্তু।”

উত্তরণ ভদ্রলোকের চোখের আর্তির দিকে তাকিয়ে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিতে পারলেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *