৫. কাশীতে সত্যসেবী আশ্রমের শাখা

কাশীতে সত্যসেবী আশ্রমের শাখা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময়, ঠাকুরের নির্দেশে বেশ কিছুদিন কাশীতে গিয়ে ছিলেন উত্তরণ। সান্ধ্য প্রার্থনার শেষে কাশীর রাস্তায় বেরিয়ে পড়তেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এদিক-ওদিক হেঁটে বেড়াতেন, এক-একদিন এক-একটা ঘাটে গিয়ে বসতেন। মণিকর্ণিকা ঘাটে অনেক-অনেক চিতা জ্বলতে দেখার পাশাপাশি, অদ্ভুত একটি লোকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। রামলাল শ্রীবাস্তব নামের সেই লোকটি, স্বজনেরা চিতায় চড়ানোর আগে মৃতদেহের ছবি তুলে রাখত। কালো কাপড়ে অর্ধেক ঢাকা ওর ওই পুরনো ক্যামেরায় জীবনের ছবি ছিল না কোনও, সবই মৃত্যুর ছবি। শেষ ছবি না তুলিয়ে কোনও দল শবদেহ সৎকার করার দিকে এগিয়ে গেলে রামলাল এবং তার খুদে অ্যাসিস্ট্যান্ট চিৎকার করে ডাকত তাদের।

“তোমার খারাপ লাগে না, দিনরাত এই মরে যাওয়া লোকেদের ছবি তুলতে?” উত্তরণ একদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন রামলালকে।

“এটাই তো আমার রুজি-রুটি।” রামলাল জবাব দিয়েছিল।

“হোক রুজি-রুটি। অস্বস্তি হয় না?”

“অস্বস্তি হবে কেন? মৃত্যু মানে তো মুক্তি, হর দর্দ সে ছুটকারা!”

রামলালের ওই কথাটা মাথায় নিয়েই তারপর বেশ কিছুদিন কাশীর রাস্তায় হেঁটেছিলেন উত্তরণ। একদিন হাঁটতে-হাঁটতে শহরের সীমানা ছাড়িয়ে বিরাট থামের উপর দাঁড়িয়ে থাকা সেই মস্ত দোতলা ব্রিজটার সামনে এসে থমকেছিলেন। মনে হয়েছিল, জীবন যেন শহর আর মৃত্যু তার চাইতে অনেক উঁচুতে দাঁড়িয়ে থাকা ওই ব্রিজটা। অলঙ্ঘনীয়।

কাশীর আশ্রমের দায়িত্বে ছিলেন সন্ন্যাসী নির্মলানন্দ, সবাই যাঁকে দিলীপদা বলে ডাকত। উত্তরণকে কাছে ডেকে এক-একদিন রাতে গল্প করতেন দিলীপদা। উত্তরণের কথা শুনে একদিন বললেন, “কাশীর নাম বারাণসী কেন বলো তো? বরুণা আর অসী নদীদুটো এখানেই গঙ্গায় এসে মেশে বলে ওই দুটো নদীর নামে কাশীর নাম।”

“নদীদুটো কোথায়?”

“ওদের আর দেখতে পাওয়া যায় না। ওরা গঙ্গায় মিশে গিয়েছে। কিন্তু ওদের নামটা শহরের নামের সঙ্গে মিশে অক্ষয় হয়ে আছে। আমরা সবাই ওই নদীগুলোর মতোই। একটা মহানদীতে মিশে যাব। কিন্তু আমাদের নামটা কোথাও থাকবে কি?”

উত্তরণ কোনও জবাব দিতে পারেননি। নিজের প্রশ্নের উত্তরও পাননি পুরোপুরি। কেবল রাতে ঘুমোনোর সময় মনে হত, শুধু ওই ব্রিজটার মতোই নয়, কাশী বিশ্বনাথের গলির মাঝখানে দাঁড়ানো ষাঁড়টার পিঠের কুঁজটার মতো মৃত্যু উঁচু হয়ে আছে চারপাশের সবকিছুর থেকে।

পার্ট-টু’র শেষ পরীক্ষাটা দিয়ে আশ্রমে ফেরার সময় যখন গেটের বাইরে অসংখ্য লোককে আছাড়িপিছাড়ি খেয়ে কাঁদতে দেখলেন, উত্তরণ তখনই টের পেয়ে গেলেন ভিতরে কী সর্বনাশ হয়েছে। আর কী আশ্চর্য, সেই মুহূর্তে ওঁর রাগ হল ব্রহ্মচারী ঠাকুরের উপরে। আগের দিন সন্ধ্যায় যখন দরজার বাইরে থেকে প্রণাম করলেন, তখন একবার কেন ভিতরে ডেকে ঠাকুর সতর্ক করে দিলেন না যে চব্বিশ ঘণ্টার ভিতরেই এই আশ্রমের সঙ্গে জড়িত সবার মাথায় বাজ ভেঙে পড়বে? অসুস্থ ছিলেন ঠিকই, কিন্তু মহাপুরুষের অসুস্থতা কি সাধারণ মানুষের অসুস্থতার মতোই? যার থেকে পরিত্রাণের রাস্তা নেই?

“ঠাকুরের দেহটা কষ্ট পাচ্ছিল। তাই ঠাকুর তাকে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিলেন।” অনিলদা কাঁদতে-কাঁদতে বলে উঠলেন।

‘হর দর্দ সে ছুটকারা’! উত্তরণের মাথার মধ্যে বেজে উঠল রামলালের কথাটা।

“ঠাকুরের শরীরকেও যন্ত্রণা পেতে হয়?” অস্ফুটে বলে উঠলেন উত্তরণ।

“শরীর ধারণ করলেই যন্ত্রণা পেতে হবে।” জিশু খ্রিস্ট যন্ত্রণা পাননি? বুদ্ধ কিংবা রামকৃষ্ণ পরমহংস পাননি?” অনিলদা উত্তরণের কথাটা শুনতে পেয়ে বলে উঠলেন।

উত্তরণ সেই প্রথম অনুভব করলেন, “অনিবার্যের কোনও প্রতিকার নাই’, ঠাকুরের এই কথাটার মানে। একই সঙ্গে, ‘অনিবার্য’ শব্দটিকেও নতুন করে চিনলেন।

ঠাকুরকে সমাধিস্থ করা হল আশ্রমের ভিতরেই। শিষ্য-ভক্তদের ঐকান্তিক আগ্রহে সেই সমাধিস্থল ঘিরে গড়ে উঠতে শুরু করল সমাধিমন্দির। উত্তরণ সবটার ভিতরে ছিলেন বলেই হয়তো বা কাঁদতে পারছিলেন না। কাঁদলেন সেদিন, যেদিন রেজ়াল্ট বেরোল আর দেখার আগেই শুনলেন যে রেকর্ড ব্রেক করা নম্বর পেয়ে তিনি প্রথম হয়েছেন ইউনিভার্সিটিতে।

“জানেন বিজয়দা, এইটথ পেপারের পরীক্ষা দেওয়ার দিন চোখ বন্ধ করলেই আমি দেখতে পাচ্ছিলাম ঠাকুরের পা আমার মাথার উপর।”

“নরলীলা সংবরণ করলেও তাঁর পা যে সবসময় তোমার মাথার উপরেই থাকবে, সেটাই তোমায় জানাচ্ছিলেন ঠাকুর।”

“আমার পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি দেহরক্ষা করেননি, পাছে আমার রেজ়াল্ট খারাপ হয়…” উত্তরণ কেঁদে ফেললেন।

“রেজ়াল্ট তো শুধু তোমার নয় উত্তরণ। রেজ়াল্ট যে গুরুদেবেরও। তুমি ফার্স্ট হওয়া মানে, গুরুদেবেরও ফার্স্ট হওয়া। এইটা বোঝো তো? তোমার ভিতর দিয়ে ঠাকুরও যে প্রচারিত হবেন, প্রসারিত হবেন সারা পৃথিবীতে। আমি আর ক’দিনের জন্য।” বিজয়দা হাসলেন।

উত্তরণ বুঝতে পারলেন না, ব্রহ্মচারী ঠাকুর স্থূলদেহ ত্যাগ করার পর, ঠাকুরের প্রতিনিধি হিসেবে যিনি সদ্য আশ্রমের সভাপতির আসনে বসেছেন, সেই বিজয়দা কেন এইরকম কথা বলছেন।

উত্তরণকে চুপ দেখে বিজয়দা বললেন, “তোমার মনে প্রশ্ন জাগছে বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি তো আমার কথা বলছি না, বলছি ঠাকুরের ইচ্ছার কথা, যা আজ নয় কাল তোমাকে জানতেই হবে।”

“আজই বলুন।”

“বলছি। ঠাকুরের ইচ্ছা যতটুকু বুঝতে পেরেছি তাতে… আগামী দিনে তুমি তাঁর নাম ছড়িয়ে দেবে ভক্ত-শিষ্যদের মধ্যে।”

“আমি? আমার কী যোগ্যতা?”

“যোগ্যতা-অযোগ্যতার বিচার কি তুমি করবে?”

“আমি তা বলিনি বিজয়দা। কিন্তু ছোট থেকে আমি তো এই আশ্রমেই বড় হয়েছি। আমি তো শুনেছি, আপনি কীভাবে মঙ্গলঘটের চাল সংগ্রহ করে আশ্রমে ফেরার পথে রাস্তায় পড়ে গিয়ে ভয়ংকর আহত হয়েছিলেন। কিন্তু সেই পা-ভাঙা অবস্থাতে হাসপাতালে যাওয়ার পথেও চালের বস্তা নিজের কাছছাড়া করেননি।”

“ওসব পুরনো কথা, বাদ দাও।”

“কেন বাদ দেব? শুরুদেবের মুখেই তো শোনা। অনিলদা সকালে মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়েও দুপুর পর্যন্ত মাসিক পত্রিকার ফাইনাল প্রুফ দেখে, পাতা ছেড়ে তারপর বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার এমন কোন আত্মত্যাগ আছে ঠাকুর বা আশ্রমের জন্য যে আমি ঠাকুরের নাম ছড়াতে পারি?”

“নিজেকে অনেক বড় করে দেখছ বুবাই। তুমি কী পারো বা পারো না সেটা তুমি ঠিক করবে না, ঠিক করবেন ঠাকুর। আর ঠাকুরের নাম ছড়ানো মানে ‘বিজয়’ বা ‘উত্তরণ’ এর মতো কোনও নামের প্রচার নয়, ঠাকুরের প্রদত্ত নাম দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে দেওয়া। মনে রেখো, নাম এবং নামী অভেদ। নামই ঠাকুর, ঠাকুরই নাম। নাম করতে পারা মানেই ঠাকুরের সঙ্গে থাকা। এবার এই সত্যটা হচ্ছে জুঁইফুলের মতো খানিকটা সাদা ভাত। সেই ভাত তুমি কলাপাতায় দাও, মাটির পাত্রে দাও, কিংবা সোনার থালায় দাও, ভাতের রং পালটাবে, না, স্বাদ পালটাবে?”

উত্তরণ আর কোনও কথা না বলে বিজয়দাকে একটা প্রণাম করে নিজের ঘরে ফিরে এলেন। ঠাকুরের যে প্রতিকৃতি ওঁর ঘরের দেওয়ালে ছিল, তার সামনে গিয়ে চুপ করে দাঁড়ালেন।

এম এ-তে ভর্তি হওয়ার পরপরই নতুন তৈরি হওয়া সমাধিমন্দিরে পুজোর দায়িত্ব পেলেন উত্তরণ। প্রবীণ সন্ন্যাসী বিশুদ্ধানন্দজি অসুস্থ, ভোরবেলা উঠতে পারেন না, বিজয়দা তাই খানিকটা কুণ্ঠার সঙ্গেই জিজ্ঞেস করেছিলেন যে উত্তরণ ভোরের পুজোটা করে দিতে পারবেন কি না।

“আপনি আদেশ করলে নিশ্চয়ই পারব।”

“না, তোমাকে তো রাত জেগে পড়াশোনা করতে হয়…”

“তাতে কী? আমি কি সেই ক্লাস নাইনে পড়ার সময় থেকে রাধাগোবিন্দ মন্দিরে অভয়ানন্দজির সঙ্গে পুজোয় বসিনি?”

“বসেছ, কিন্তু ঠাকুর নিজেই তোমাকে সেই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন, তুমি বি এ-ক্লাসে ভর্তি হওয়ার পর তোমার উপর চাপ পড়ে যাবে বলে। তাই ভাবছি…”

“আপনারা একটু বেশিই ভাবেন আমায় নিয়ে। আমি বলছি, কোনও চাপ পড়বে না, আমায় দয়া করে সমাধিমন্দিরের নিত্যপূজার ভার দিন।”

বিজয়দা হেসে ফেললেন, “চাইছ যখন, করো।”

পরদিন থেকে ভোরে উঠে সমাধিমন্দিরে পুজো করতে বসতেন উত্তরণ। আর গুরু-মহারাজের পুজো করতে পারার আনন্দ সারাদিন ঘিরে রাখত ওঁকে। কিন্তু পৃথিবীতে আনন্দের ভাগ কিছু কম বলেই হয়তো এম এ সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস শুরু হওয়ার সময়ই চিকেন পক্স হল উত্তরণের। পক্স থেকে সেরে ওঠার পর শরীর এত দুর্বল হয়ে গেল যে রোজ ইউনিভার্সিটি আসা-যাওয়াই সমস্যা হয়ে দাঁড়াল।

“তুই এভাবে ক্লাস করতে পারবি না। তোকে কাছাকাছি কোথাও হস্টেল কিংবা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতে হবে।” দীপ্ত একদিন ফিরতি পথে বলল।

“গ্র্যাজুয়েশনের তিন আর এম এ-র এক, এই চার বছর তো এইভাবেই ক্লাস করলাম।”

“এখন আর পারবি না। তোর শরীর দেবে না। তুই গাড়িতে বসে কথা বলতে-বলতে ঘুমিয়ে পড়িস বিকেলে। তা হলে কীভাবে ট্রেনের ওই ভিড় সামলে ফিরবি, কোনওদিন আমি না এলে?”

উত্তরণ লজ্জা পেয়ে গেলেন, ঘুমের কথা শুনে। মনে হল, দীপ্তর উপর তিনি অহেতুক চাপ সৃষ্টি করছেন। একদিন দীপ্তকে একরকম ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে একটা ট্রামে উঠে পড়লেন। ধর্মতলায় নেমে মেট্রোয় চেপে টালিগঞ্জ। সেখান থেকে বাসে যখন উঠেছেন গড়িয়া পেরিয়ে নামবেন বলে, উত্তরণের মনে হল শরীরটা আর বশে নেই। হাওয়া এসে ছুঁয়ে দিলেই উলটে যাবেন।

পরদিন শনিবার ছিল, তার পরদিন রবিবার। উত্তরণ দুপুরে ঘুমিয়ে পড়লেন, আর ঘুমের ভিতর বেশ একটা স্বপ্নও দেখছিলেন যখন রতনদা এসে তুলে দিয়ে বলল যে ওঁর এক বন্ধু প্রেসিডেন্ট মহারাজের সঙ্গে দেখা করতে চাইছে। উত্তরণ কথাটা শুনেই বাইরে বেরিয়ে দেখলেন, দীপ্ত দাঁড়িয়ে আছে নাটমন্দিরে।

উত্তরণ ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন দেখে দীপ্তই বলল, “তোর আশ্রমে চলে এলাম বলে রাগ করলি?”

“আশ্রম গুরুদেবের। সেখানে যার ইচ্ছে সে-ই আসতে পারে।” উত্তরণ বললেন।

“আমি কিন্তু একটা কাজে এসেছি। তোদের প্রেসিডেন্ট মহারাজের সঙ্গে একবার দেখা করব।”

“কিন্তু কেন?”

“সেটা মহারাজকেই বলব।”

নাছোড়বান্দা দীপ্তকে বিজয়দার ঘরে নিয়েই যেতে হল। বিজয়দাকে প্রণাম করে একটা-দুটো সাধারণ কথার পর দীপ্ত হঠাৎ বলে উঠল, “উত্তরণ যদি এম এ-তেওঁ ফার্স্ট হয়, সেটা আপনাদের আশ্রমের পক্ষেও একটা বিরাট গৌরবের ব্যাপার হবে, তাই না?”

বিজয়দা কিছু না বলে তাকালেন দীপ্তর দিকে।

দীপ্ত সপাটে বলল, “এত দূর থেকে ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে উত্তরণের পক্ষে দারুণ কিছু করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে এখন যখন ওর শরীরটাও ভাল যাচ্ছে না। আপনি যদি অনুমতি দেন তবে আমি উত্তরণের জন্য ইউনিভার্সিটির কাছাকাছি একটা জায়গা দেখে দিতে পারি।”

“হস্টেলে কি ও থাকতে পারবে?” বিজয়দা সামান্য দ্বিধার সঙ্গে বললেন।

“আমি ওকে বাড়ি দেখে দেব। একটা বাড়ির আলাদা ঘরে ও নিজের মতো থাকবে। ওকে আমার বাড়িতেও নিয়ে যাচ্ছি না, কারণ সেটা হয়তো ওর ইগোতে লাগবে।”

‘ইগো’ শব্দটা বিজয়দা কী বুঝলেন কে জানে। বললেন, “সন্ন্যাসীর তো কোনও অহংকার থাকার কথা নয়। সে গাছের তলায়ও শুয়ে থাকতে পারে। বুবাই যেখানে জপ-ধ্যান করতে পারবে, নিজের মতো থাকতে পারবে, সেরকম একটা জায়গায় যদি ওর ব্যবস্থা করে দিতে পারো, আমার আপত্তি নেই।”

উত্তরণ এই এতক্ষণে বলে উঠলেন, “আমি যাব না।”

“তুমি আশ্রম ছেড়ে যাচ্ছ না। আশ্রমের কাজে তোমাকে বাইরে পাঠানো হচ্ছে।”

“ঠিক বলেছেন মহারাজ। তুই ফার্স্ট হয়ে আবার আশ্রমে ফিরে আসবি। তাতে তো আশ্রমেরই লাভ।”

দীপ্ত এমনভাবে প্লিড করল যে কথাটায় শিলমোহর পড়ে গেল।

কিন্তু বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়ে দীপ্তর ঠিক করা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার সময়, উত্তরণের বুক ভেঙে যাচ্ছিল। যাওয়ার আগে বিজয়দা কাছে ডেকে জড়িয়ে ধরলেন। উত্তরণ হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন বিজয়দার বুকে মাথা রেখে।

“এই একটা বছর, সন্ন্যাসীরা যেমন হিমালয়ে যান, তেমন তুমিও তপস্যা করতে যাচ্ছ। এটা ঠাকুরেরই ইচ্ছে ধরে নাও। তোমাকে প্রথম হতে হবে, তাই—না?”

“কিন্তু আমি প্রথম না হলেই বা কী বিজয়দা?”

“তুমি তোমার জন্য প্রথম হচ্ছ না। তোমাকে ঠাকুরের জন্য প্রথম হতে হবে। ঠাকুরের যে প্রিয় শিষ্য, সে কি কখনও কোথাও দ্বিতীয় হতে পারে?”

উত্তরণ থমকে গেলেন বিজয়দার কথা শুনে। তারপর বিজয়দাকে প্রণাম করে বেরিয়ে পড়লেন।

উত্তর কলকাতায় গৌরীবাড়ির কাছে উত্তরণের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল দীপ্ত। পুরনো একটা বাড়ির দোতলায় একটা বড় ঘর, একটা ছোট ঘর, অ্যাটাচড বাথরুম, রান্নার জায়গা, ছোট্ট বারান্দা মিলিয়ে উত্তরণের থাকার জায়গাটাকে একটা ছিমছাম ফ্ল্যাট বলাই সমীচীন। জায়গাটায় বেশ একটা বনেদি কলকাতার সুবাস ঘুরে বেড়াত। শিয়ালদা কাছে, কলেজ স্ট্রিটও দূরে নয়। যাতায়াতের সময় থেকে এক ধাক্কায় প্রায় চার ঘণ্টা বেঁচে যাওয়ায় পড়াশোনার জন্য বাড়তি অনেকটা সময় পেয়ে গেলেন উত্তরণ। তবু বিকেলবেলা ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে আশ্রমের জন্য মন কেমন করত ওঁর। সান্ধ্য প্রার্থনার আওয়াজ শোনার জন্য ছটফট করে উঠত ভিতরটা। তখন, ঠাকুরঘর বানিয়েছিলেন যে ছোট ঘরটাকে, সেখানে জপে বসতেন উত্তরণ। অনেক-অনেকক্ষণ জপের শেষে শান্ত হয়ে যেত মাথাটা। উঠে ভাতে-ভাত বসাতেন স্টোভে।

একতলায় যে ছেলেগুলো থাকত, তারা কোনওদিন হাতিবাগান, কখনও এসপ্ল্যানেডের কোনও হল থেকে সিনেমা দেখে ফিরত প্রায় মাঝরাতে। ওদের হুল্লোড়ের শব্দে প্রথম-প্রথম একটু অসুবিধে হত উত্তরণের। পরে মনে হত, জীবনকে তিনি যেভাবে দেখেন, জীবন তো শুধু সেরকমই নয়। এক-এক জায়গায় এক-একরকম তার প্রকাশ। দেখতে হবে, শুনতে হবে, নিজের বিশ্বাসে অটলও থাকতে হবে।

নীচের ছেলেগুলোর কাছে নানা সময়ে আসা মেয়েদের হাসি আর চিৎকার দোতলায় উঠে আসত। উত্তরণ যখনই বাইরে থেকে ফিরতেন বা বাইরে যেতেন, তখনই মেয়েগুলো নানারকম আওয়াজ দিত ওঁর উদ্দেশ্যে। ওদের উৎসাহে ছেলেগুলোও চেগে উঠত, নয়তো অন্য সময় ওরা একদমই বিরক্ত করত না।

কলেজে ঢোকার পরপরই যে ঠাট্টা-তামাশার মুখোমুখি হতে হয়েছিল, গ্র্যাজুয়েশনে প্রথম হয়ে তার আওতার বাইরে চলে এসেছিলেন উত্তরণ। ছেঁড়া জিনস আর গাঁজার ছিলিমের বিপ্রতীপে একটা অন্যরকম আদর্শই হয়ে উঠেছিলেন, বলা যায়। ধুতি-পাঞ্জাবি পরা একটা বাইশ-তেইশের ছেলের সঙ্গে অধ্যাপকরাও সম্ভ্রমের সঙ্গে কথা বলতেন।

দীপ্তর দেখে দেওয়া বাড়িতে এসে আবার সেই পুরনো দিনগুলোকে যেন ফিরে পেলেন উত্তরণ। ওই টিটকিরি, ওঁকে দেখলেই আজেবাজে অশ্লীল কথার চালাচালি… উত্তরণের বোধ হত, তিনি বোধহয় কিম্ভুত কেউ।

“তোকে নিয়ে ওদের প্রবলেম একটাই। সেটা কি তুই বুঝতে পারিস?” দীপ্ত একদিন উত্তরণের ঘরে এসে বলল।

“কী করে বুঝব?”

“ব্যাপারটা আর কিছুই নয়, তুই যে মেয়েগুলোকে পাত্তা দিস না, সেটাই ওদের রাগের কারণ। সেই রাগ থেকেই ওরা ছেলেগুলোকে তাতায়।”

“কিন্তু আমি কে এমন যে…”

“যে-ই হোস। ওদের বাজে লাগে। ওদের দেখে যে সিটি দেবে তাকে নিয়ে ওদের কোনও সমস্যা নেই, কিন্তু একবার ফিরেও যে লোকটা দেখবে না, তাকে নিয়ে…”

“এখানে যে এইসবের সম্মুখীন হতে হবে, আমার জানা ছিল না।” উত্তরণ বলে উঠলেন।

“আমিই কি জানতাম নাকি? আমাদের ফ্যামিলিরই বাড়ি এটা, আমার এক কাকার ভাগে পড়েছে। সে বিদেশে থাকে বলে কেয়ারটেকারের হাতে দায়িত্ব। আর তার ফলেই, যা হওয়ার তা হয়েছে। নীচের তলায় একটা মেস বানিয়ে দিয়েছে, অথচ যে কোনওদিন সন্ধ্যার পরে এলে মনে হবে, বৃন্দাবনের লীলাক্ষেত্রে প্রবেশ করলাম।”

“বৃন্দাবনের লীলাক্ষেত্র সত্যিই কেমন ছিল, জানা আছে?”

দীপ্ত হেসে উঠল, “উপমাটা তোর ভাল লাগল না, তাই না? বেশ আমি বদলে দিচ্ছি। পার্ক স্ট্রিটের ক্যাবারে বানিয়ে রেখেছে জায়গাটাকে। এবার ঠিক আছে?”

উত্তরণ কোনও উত্তর না দিয়ে দীর সামনে থেকে সরে গেলেন।

দীপ্ত সেদিন কিছু না বললেও পরে একদিন এসে জিজ্ঞেস করল, “জীবনে সবসময় কি এত সংযত, এতখানি সতর্ক হয়ে চলা যায়? লাইফে তো মাঝে-সাঝে একটু ক্যাজ়ুয়ালও হবে লোকজন, তাই না?”

“অসতর্ক কথা বললে কিংবা অনর্থক আলাপে জড়ালে সাধনা বাধাপ্রাপ্ত হয়। জপের সময় মন অশান্ত হয়ে ওঠে। জপ তো শুধু আঙুলের উপর দিয়ে আঙুল চালানো নয়।”

“শরীরের উপর দিয়ে শরীর চালানোও কিন্তু প্রেম নয়। সেখানেও ভালবাসা লাগে।” দীপ্ত আলটপকা বলে উঠল, একটা সিগারেট ধরিয়ে।

রাত্রে ও চলে যাওয়ার পরও কথাটা ভুলতে পারেননি উত্তরণ। মনেও রাখতে চাননি তাই বলে। পরদিন জপ করতে বসে কথাটা মাথায় এলে, উত্তরণ কথাটাকে চলে যেতে দিলেন। একাগ্র হয়ে ভাবার চেষ্টা করলেন, আঙুলের মধ্যে মনকে সঞ্চারিত করা যায় কীভাবে। কেমন করে মনের বিদ্যুৎ আঙুলের মধ্যে দিয়ে শরীরে প্রবেশ করতে পারে। ওই বিদ্যুতটাই তো ঠাকুর। যাঁর অদর্শনেও দর্শন।

পবিত্রতার এমন একটা আলাদা গন্ধ আছে যে তার মধ্যে থাকতে-থাকতে অন্য কিছু মনকে আর টানে না। উত্তরণের অনেকদিন ধরে ইচ্ছে জেগেছিল, যেখানে আছেন সেই ঘরটায় একটা দিন গুরুদেবের নামগান হোক। উত্তরণের অনুরোধেই আশ্রমের তপন, রতন, স্বামী পরমানন্দ আর ষষ্ঠী এক রোববার বিকেলে এসেছিল ওঁর ঘরে। খোল-করতাল নিয়ে উত্তরণের ঘরের চেয়ারে বসানো ঠাকুরের প্রতিকৃতির সামনে সারা সন্ধ্যা নামগান করে ঠাকুরকে নিবেদন করা ভোগই প্রসাদ হিসেবে গ্রহণ করেছিল সবাই মিলে।

সেদিন রাতে উত্তরণের মনে হয়েছিল, এতদিন একটা মেসের ঘরে তিনি ছিলেন। কিন্তু আজকে এই চারজন আসায় ওঁর আস্তানাটাও আশ্রমেরই একটা অংশ হয়ে উঠল।

সুগন্ধ তো সেই মাটিতেই, যে মাটিতে গোলাপ ফুটে আবার ঝরে পড়ে। নইলে মাটির নিজের কী এমন ক্ষমতা যে সুগন্ধ ছড়াবে?

ভূমিকম্প হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তেও কি মাটিতে পা রেখে বোঝা যায় যে পরের মুহূর্তে ভূমিকম্প হবে? জীবনের দুর্ঘটনাগুলোও সেভাবেই আসে। কিংবা কে জানে হয়তো তারও প্রস্তুতি থাকে কোথাও। উত্তরণের কী দরকার ছিল পূজা সম্বন্ধে কোনও মন্তব্য করার দীপ্তর কাছে? সেরকম স্বভাব তো ওঁর নয়। এইসব ব্যাপার নিয়ে ভাবাও ওঁর কাজের মধ্যে পড়ে না। তবু দীপ্ত ওঁর এতটা বন্ধু, উত্তরণের জন্য এত কিছু করে, সেই জায়গা থেকেই হয়তো দীপ্তর বান্ধবী পূজার প্রতি একটা স্নেহ কাজ করত উত্তরণের।

পূজাকে এই ঘরেও বারদুয়েক নিয়ে এসেছিল দীপ্ত। উত্তরণ প্রাথমিক আড়ষ্টতা কাটিয়ে কথা বললেও ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে নামেননি কিছুতেই। তাই নিয়ে দীপ্ত আর পূজা ওঁর সামনেই হেসে গড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু উত্তরণ নিজেকে পরিবর্তন করতে পারেননি বা চাননি। বন্ধু যতই কাছের হোক, বন্ধুর বান্ধবীর সঙ্গে একটা দূরত্ব রাখা প্রয়োজন, ওঁর মন বলেছিল।

কিন্তু সেই পূজাকেই ট্যাক্সির ভিতরে অন্য পুরুষের বুকে মাথা রেখে হাসতে দেখে উত্তরণের স্বাভাবিক বৈরাগ্য ধাক্কা খেল। কয়েক মুহূর্তের জন্য ওঁর পা দুটো যেন গেঁথে গেল মাটিতে। পূজার কাঁধে হাত দিয়ে ছেলেটি পূজার মুখটা নিজের কাছে টেনে আনছিল। তখনই পূজার চোখ পড়ল উত্তরণের উপর। পড়ামাত্র ওর মুখটাও কি ফ্যাকাশে রক্তশূন্য হয়ে যায়নি? ওই দৃশ্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় উত্তরণ খেয়াল করেননি।

দু’দিন পরে দীপ্তই ইউনিভার্সিটিতে উত্তরণকে ধরল। একটু অস্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করল, “তুই পূজাকে কার সঙ্গে দেখেছিস? কী অবস্থায় দেখেছিস?”

উত্তরণ এটা নিয়ে কথা বলতে চাইছিলেন না। রুচিতে আটকাচ্ছিল।

দীপ্ত বলে উঠল, “পূজাই আমাকে বলেছে যে তুই দাঁড়িয়ে গিয়েছিলি ওদের ওই অবস্থায় দেখে। ইউ ওয়্যার এনজয়িং দ্য সিন। শোন, ইফ শি ইজ় আ ব্যাড গার্ল, আই উইল ডিল উইথ হার, বাট পুরো সত্যিটা আমার জানা দরকার।”

গায়ে কে যেন চাবুক মারল। উত্তরণ এনজয় করছিলেন দৃশ্যটা?

“তোর মতো তো সবাই সন্ন্যাসী হবে না, তাই বলব অতটা শকড না হয়ে, যা দেখেছিস, বলে ফেল।”

“সন্ন্যাসী হোক বা না হোক, একজনের সঙ্গে সম্পর্ক থাকাকালীন আর-একজনের গলা জড়িয়ে বসে থাকাটা কোনও কাজের কথা নয়।” উত্তরণ বোধহয় জীবনে প্রথমবার এইভাবে কথা বললেন।

“আই সি। শোন, যে ছেলেটার সঙ্গে পূজাকে দেখেছিস সে একটা নোবডি। আমাদের রিলেশন আমাদের জায়গা থেকে ঠিকই আছে, তুই অকারণে মেজাজ গরম করিস না।”

দীপ্ত কথাগুলো বলে চলে গেল। কিন্তু উত্তরণ বুঝতে পারলেন যে কোথাও যেন একটু তাল কাটল। তা হলে কি এটা সত্যি যে যেখানে কামিনী এসে দাঁড়ায় সেখানেই দুই ভাই কিংবা দু’জন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মধ্যেও বিরোধ লাগে!

মানুষ কি ঘটনার মধ্যে নিজেই জড়ায়, নাকি নিয়তি তাকে জড়িয়ে দেয়? সেদিন ওই মুহূর্তে সিগন্যালের লাল আলো জ্বলে না উঠলে পূজাকে ওভাবে দেখার প্রশ্নই উঠত না। কিন্তু দেখার পরও উত্তরণ কোনও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি কোথাও। তা হলে দীপ্ত এসে ওঁকে ওইসব বলে গেল কেন? হ্যাঁ, দৃশ্যটা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু অপ্রত্যাশিত কোনও কিছুর সামনে সেটুকু হওয়ারও কি অধিকার নেই মানুষের?

“অধিকারবোধ থেকেই প্রবলেমগুলো হয়, কিন্তু একটু পজ়েসিভ না হলে প্রেমও তো হয় না।” তিন-চার দিন পর দীপ্তই আবার উত্তরণের ঘরে এসে বলল।

উত্তরণ চুপ করে রইলেন।

দীপ্ত আগের দিনের মতো উত্তেজিত ছিল না। শান্ত গলায় বলল, “পূজা চমকে গিয়েছিল তোকে ওখানে দেখে। তারপর ভেবেছিল যে তুই আর পাঁচটা ছেলের মতো আমাকে ব্যাপারটা বলবি। তুই আলাদা মানুষ, এই বিশ্বাসটুকু রাখতে পারলে আমার কাছে পূজাকে মুখ খুলতেই হত না আর আমিও কিছু জানতাম না। আমাদের সম্পর্কটাও টিকে যেত।”

“মানে?” উত্তরণ প্রশ্নটা করে বসলেন।

“মানে একটাই। ইটস ওভার। পূজা যদি রং চড়িয়ে কথা না বলত, পার্টলি তোকে দায়ী করে বাঁচতে না চাইত, তা হলে বুঝতাম যে কোথাও একটু সততা আছে ওর মধ্যে। কিন্তু এখন আমার কাছে জলের মতো পরিষ্কার যে ও একটা মিথ্যুক। কিংবা তার থেকেও বেশি। শি ইজ় আ বিচ।”

উত্তরণ শিউরে উঠলেন, “যার প্রতি ভালবাসা, তাকে এতটা অশ্রদ্ধা করা উচিত?”

“ভালবাসলেই তো ঘেন্নাটা বেশি করে জন্মায়। শ্রীদেবী কার বুকে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে আছে তাতে তো আমার কিছু যায়-আসে না, তাই—না? কিন্তু যাকে ভালবেসেছি তার বিশ্বাসঘাতকতাটা বুকে লাগে।”

“হয়তো বিশ্বাসঘাতকতা নয়। হয়তো…”

“রিলেশনশিপে থাকা একটা ছেলে আর-একটা মেয়ের মধ্যে একজন যখন তৃতীয় কারওর সঙ্গে জড়ায়, তখন তাকে বিশ্বাসঘাতকতাই বলে। সাধু-সন্ত মানুষ তুই, এই ব্যাপারগুলো বুঝবি না। অবশ্য না বোঝাটা আশীর্বাদ। আমি যেদিন থেকে বুঝতে পেরেছি, সেদিন থেকে আমার অতীত-ভবিষ্যৎ একদম কালো হয়ে গিয়েছে। পিচ ব্ল্যাক।”

“বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে ব্যাপারটা থেকে।”

“সেটা আমিও জানি। একটা ফালতু মেয়ের কথা ভেবে জীবন নষ্ট করার কোনও মানে হয় না। কিন্তু এখানে থাকলে আমি পূজাকে ভুলতে পারব না। তাই দু’মাসের জন্য দিল্লি যাচ্ছি। ব্যবসার কিছু কাজও আছে ওখানে। জানি পড়াশোনার ক্ষতি হবে অনেকটাই, হয়তো এ বছর ড্রপ দিতেও হতে পারে। তবু নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ। হয়তো এতটা খারাপ লাগবে না সবকিছু।” দীপ্ত এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল উত্তরণকে।

তারপর পিছনে না তাকিয়ে বেরিয়ে গেল।

পুরো কালো হয়ে গেলে একরকম, কিন্তু চোখের সামনে যখন ধীরে ধীরে কালো হচ্ছে, তখন কী করতে পারে মানুষ? উত্তরণ কী করতে পারলেন যখন আসন থেকে হ্যাঁচকা টানে ওঁকে তুলে এনে সিঁড়ি দিয়ে নামাতে লাগল পুলিশের দুটো কনস্টেবল? ওরা লাথি মেরে ঘরে কেন ঢুকল, সেটা ভেবেই বিস্মিত হয়ে ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন উত্তরণ। ওরা ওঁকে হেঁচড়ে তুলে নিতে একেবারে বোবা হয়ে গেলেন।

নামানোর সময় দু’জনের একজন বলল, “পাঁচশো টাকা দিলে এখনও ছেড়ে দিতে পারি। নইলে কিন্তু একতলার হারামিগুলোর সঙ্গে এক লক-আপে ভরে দেব।” কেন ওঁকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, টাকাই বা কেন দিতে হবে, এরকম হাজারও প্রশ্ন ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়তে লাগল উত্তরণের মাথায়। কিন্তু কথা বেরোল না মুখ দিয়ে।

উত্তরণের কাছ থেকে কোনও সাড়া, বা বলা ভাল টাকা না পেয়ে একতলার কয়েকটা ছেলে আর তাদের কাছে আসা কয়েকটা মেয়ের সঙ্গে ওঁকে একই ভ্যানে তুলে দেওয়া হল। আশেপাশের বাড়ির বেশ কিছু বাসিন্দা নিজেদের গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, কী হচ্ছে দেখতে। তাঁদের সামনে দিয়েই পুলিশের ভ্যানটা থানার দিকে এগিয়ে গেল।

থানার মেজবাবু সবাইকে জেরা করতে-করতে উত্তরণের সামনে এসে একটু থমকে গেলেন। ধুতি-ফতুয়া পরা ছেলেটাকে একটু অন্যরকম মনে হল বলেই হয়তো জানতে চাইলেন উত্তরণের পরিচয়।

উত্তরণ অনেক কষ্টে এটুকুই বললেন যে তিনি ইউনিভার্সিটিতে পড়েন। ফাইনাল ইয়ার। কিন্তু কিছুতেই বলে উঠতে পারলেন না, ফার্স্ট হয়েছিলেন গ্র্যাজুয়েশনে।

“ওই বাড়িটার একতলায় যে ছেলেগুলো থাকত, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন মেয়েদের ঘরে ডেকে এনে ন্যাংটো করে তাদের সঙ্গে জাপটাজাপটি করে ক্যামেরায় ছবি তুলত। সেই ফিল্ম ক্যাসেট করে বিক্রি করত। মানে, পর্নোগ্রাফিক র্যাকেট চালাত রীতিমতো। বুঝতে পেরেছেন?”

উপর থেকে একটা হাতুড়ি যেন উত্তরণের মাথায় এসে পড়ল। ‘পর্নোগ্রাফি’ শব্দটা অনেক আগে তিনি শুনেছেন। কিন্তু ড্রেনের জল দূর থেকে দেখা একরকম। সেটা যদি গায়ে এসে পড়ে?

“আমি এসবের কিছুই জানি না, বিশ্বাস করুন। আমি আশ্রমে থাকতাম, মানে এখনও থাকি। যাতায়াতের সুবিধার জন্য এখানে এসে উঠেছি কয়েকদিন…” উত্তরণের গলা দিয়ে দলা-পাকানো শব্দগুলো উঠে এল।

“আমার স্ত্রী হসপিটালাইজ়ড। কাল বা পরশু ওর একটা ক্রিটিক্যাল অপারেশন হবে। আমাকে এখান থেকেই এখন একবার হাসপাতালে যেতে হবে। কাল সকালে এসে আপনার কেসটা দেখব। আপনি যে ফেঁসে গিয়েছেন সেটা বুঝতে পারছি, কিন্তু পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা, জানেন তো? আপাতত রাতটা এখানেই বসে থাকুন। কাল সকালে এসে দেখছি কী করা যায়।”

“এই মালটাও হারামি স্যার। ‘লক-আপ’এ ভরে দিন।” সেই কনস্টেবলটা বলে উঠল।

“তুমি বেশি কথা বোলো না মজুমদার। এই ভদ্রলোক বাইরেই চেয়ারে বসে থাকবেন। তারপর ওঁকে কোর্টে চালান করব না গাড়ি ডেকে বাড়ি পাঠাব, সেটা কাল সকালে আমি বড়বাবুর সঙ্গে কথা বলে ঠিক করব।” মেজোবাবু ঝাঁঝিয়ে উঠলেন।

কিন্তু মেজোবাবু বেরিয়ে যাওয়ার মিনিটদশেকের মধ্যে ওই মজুমদার উত্তরণের ফতুয়া ধরে টান মেরে লক-আপ’এ ভরে দিতে-দিতে বলল, “টাকা দেবে না, আবার সতী সাজবে। মর শালা!”

উত্তরণ ওই আধো-অন্ধকার ঘরটায় ঢুকেই টের পেলেন, অসহ্য দুর্গন্ধ। পেচ্ছাপ-পায়খানার সঙ্গে পাপ মিশলে বোধহয় এমনই গন্ধ বেরোয়।

“খুব খারাপ লাগছে ব্রাদার। আমাদের সঙ্গে তুমিও জড়িয়ে গেলে।” লক-আপ-এ বসে থাকা একটা ছেলে বলে উঠল।

“জড়িয়েই যখন গিয়েছ তখন একটু বন্ধুত্ব করে নিয়ো আমাদের সঙ্গে। নইলে সময় কাটবে কী করে?”

“এখন কবে জামিন পাব, আদৌ পাব কি না, কোনও ঠিক তো নেই।” আর-একটা ছেলে বলে উঠল।

উত্তরণ ওদের কথার কোনও জবাব না দিয়ে বসে রইলেন। ওঁর মনে পড়তে লাগল, মায়ের মৃত্যুর পর শ্মশানে বসে থাকার রাত্রিটার কথা। অনেক মৃতদেহ এসেছিল সেদিন, মায়ের পালা আসতে-আসতে ভোর হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সেই রাত্রিটার মধ্যে কোথাও একটা পবিত্রতা ছিল। মা নিজের শরীর ছেড়ে দিয়ে মিশে যাচ্ছে আকাশে, বাতাসে, জলে… সেই ভাবনাটার মধ্যে পরিত্রাণ ছিল কোথাও। এখন যেখানে বসে আছেন সেটা যেন একটা রৌরব নরক। কীভাবে মুক্তি মিলবে এখান থেকে?

শেষ রাতের দিকে ঘুমে জড়িয়ে গিয়েছিল চোখটা। সকাল হতেই লক-আপের দরজাটা খুলে একটা লোক চিৎকার করল, “এই ধুতি-ফতুয়া, বাইরে আসুন।”

উত্তরণ তাকিয়ে দেখলেন, লোকটা গতকাল রাতের সেই কনস্টেবল নয়। ওই তিনটে ছেলে পরস্পরকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে ছিল। উত্তরণ ওদের দিকে একবার তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। লক-আপ থেকে বেরিয়ে যে ঘরটায় গিয়ে ঢুকলেন সেটা থানার ওসি-র ঘর। সেখানে তখন ওসি ছাড়াও মেজোবাবু এবং কাল রাতের সেই কনস্টেবল উপস্থিত। এ ছাড়াও অন্য দু’জন ছিলেন সেই ঘরে। দুই সন্ন্যাসী। বিজয়দা এবং অনিলদা।

“আমি খুব দুঃখিত আপনাকে গতকাল রাতে লক-আপ-এ থাকতে হয়েছে বলে। চিন্তা করবেন না, আপনি এক্ষুনি ছাড়া পেয়ে যাবেন। স্যার জানামাত্রই ইনিশিয়েটিভ নিয়েছেন। ওই মজুমদার হারামজাদা টাকার জন্য এরকম করে। ওকে ক্লোজ় করা হয়েছে।” মেজোবাবু বললেন।

ঘরের কোণে দাঁড়ানো মজুমদার নিচু গলায় কী একটা বলে উঠল।

থানার ওসি চেঁচিয়ে উঠলেন, “চুপ শালা শুয়োর।” তারপরই বিজয়দা আর অনিলদাকে বললেন, “সরি মহারাজ। আমাদের প্রফেশনের ভাষা, বোঝেনই তো!” আপনারা আধঘণ্টা বসুন, তার ভিতরেই যেটুকু যা ফরম্যালিটি আছে…”

অনিলদা ওসিকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “আমরা কিন্তু জামিন জাতীয় কিছু চাইছিই না। আপনাকে প্রথমেই বলেছিলাম যে উত্তরণ ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট, তাই ওর নামে থানায় কোনও রেকর্ড থাক, এটা একেবারেই কাম্য নয়।”

“আমাদেরও তো কিছু বাধ্যবাধকতা থাকে।” মেজোবাবু বললেন।

“কিন্তু আপনারাই তো বললেন যে ব্যাপারটার মধ্যে ওকে ভুলবশত জড়ানো হয়েছে?” বিজয়দা বলে উঠলেন।

“একদমই ভুল করে। আসলে এমনই নোংরা কেস যে কিছু অ্যাকশন নিতেই হত। লোকাল প্রেশারও ছিল। কিন্তু তাই বলে যে এটার সঙ্গে বিন্দুমাত্র জড়িত নয়, তার নাম এই কেসে থাকবে না।” ওসি বললেন।

“কিন্তু কাল রাতে উত্তরণ মুখার্জির নাম যে লেখা হয়ে গেল…”

মেজোবাবুকে থামিয়ে দিয়ে ওসি বলে উঠলেন, “তুমি বাদ দাও তো। হোয়াইট ইঙ্ক দিয়ে মুছে অন্য একটা বানানো নাম বসিয়ে দেওয়া যাবে ওখানে। কোনও চিন্তা করবেন না মহারাজ। স্যার আমায় বলে দিয়েছেন, আপনাদের যাতে কোনও অসুবিধে না হয় তা দেখতে।”

মিনিট পনেরোর মধ্যে থানার বাইরে বেরিয়ে এসে একটা ট্যাক্সিতে উঠলেন বিজয়দা, অনিলদা এবং উত্তরণ। ওসির কথায় থানার লোকই ধরে দিয়েছিল ট্যাক্সিটা। অনিলদা বলা সত্ত্বেও উত্তরণ ওঁদের পাশে না বসে সামনে গিয়ে বসলেন। ওঁর মনে হচ্ছিল সারা শরীরে যেন পাঁক লেগে আছে।

ট্যাক্সিটা চলতে শুরু করলে বিজয়দা বললেন, “ভুল আমার, তোমার নয়। আমার আশ্রমের সম্পদকে আমি যদি বাইরে রাখি, তা চুরি হয়ে যেতে পারে। তার গায়ে কাদা লাগতে পারে। তোমাকে এখানে পাঠানো আমার উচিত হয়নি। তোমার সেই বন্ধুর কথা শুনে.”

অনিলদা বিজয়দার কথার মধ্যেই বলে উঠলেন, “থাক ওইসব বিশ্লেষণ। উজ্জ্বলকে আশ্রমে ফিরে একটা ফোন করে দিতে হবে, ও সাহায্য না করলে সমস্যা বাড়ত।

“হ্যাঁ, আমার তরফ থেকে ওকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ো।” বিজয়দা বললেন।

“ও কৃতজ্ঞতা চায় না, আশীর্বাদ চায়।” অনিলদা বললেন।

“আশীর্বাদ করার ক্ষমতা কি আমাদের আছে অনিল? কাজ হয় কিছু আমাদের আশীর্বাদে?”

বিজয়দার প্রশ্নের উত্তরে অনিলদা কিছু বলার আগেই উত্তরণ জিজ্ঞেস করলেন, “আপনারা ট্যাক্সিতে এলেন কেন? আশ্রমের গাড়ির কী হল?”

“কিছুই হয়নি। কিন্তু তোমার সঙ্গে যা হয়েছে তা আশ্রমের অন্য কারওর কান অবধি পৌঁছক, আমরা চাইনি।” বিজয়দা বললেন।

“আপনারা জানলেন কী করে?”

“গুরুদেব জানিয়েছেন।” বিজয়দা বললেন।

উত্তরণ উত্তরে কিছু না বলতে পেরে চুপ করে রইলেন।

ট্যাক্সিটা যখন প্রায় আশ্রমের কাছে চলে এসেছে, বিজয়দা জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি আজ সকালে জপ করেছিলে বুবাই?”

এই এতক্ষণে কান্নাটা বুক থেকে গলায় উঠে এল উত্তরণের।

পক্স সেরে গেলে মুখের দাগও মিলিয়ে যায় এক সময়ে, কিন্তু ওই একরাত্রি হাজতবাসের ক্ষত এমন ফালাফালা করে গিয়েছিল উত্তরণের অন্তরকে যে আশ্রমে ফিরে এলেও সেই আগের স্বস্তি আর শান্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। প্রতি মুহূর্তে মনে হত, যতটা পবিত্রতা থাকলে আশ্রমের সমস্ত কাজ করা যায়, ততখানি পবিত্রতা বোধহয় ওঁর মধ্যে আজ আর নেই। তাই পুজোর কাজ কিংবা ঠাকুরের সমাধি সাজানোর চাইতে আশ্রমের পায়খানা-বাথরুম পরিষ্কার করা বা উঠোন ঝাঁট দেওয়ার কাজে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন।

কয়েকদিন পরে বিজয়দা এক সন্ধ্যায় উত্তরণকে ঘরে ডেকে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে বললেন, “একটা কথা তোমায় জানানো দরকার। হয়তো পরে বললেও হত, কিন্তু কবে কী হয়, তাই বলে রাখাই ভাল। এই শরীরটার ক্যানসার ধরা পড়েছে।”

উত্তরণ চমকে তাকালেন, আর সেই অবস্থাতেও খেয়াল করলেন, বিজয়দা ‘আমার’ না বলে এই শরীরটার বললেন।

উত্তরণ চুপ করে আছেন দেখে বিজয়দা বললেন, “আমি এটা নিয়ে বেশি হইচই চাই না। তাতে আশ্রমের কাজ ব্যাহত হবে। কিন্তু আমার যেটা জানা দরকার তা হল, তুমি নিজে কতটা প্রস্তুত হতে পেরেছ বলে তোমার মনে হয়?”

“কী ব্যাপারে?”

“তোমার কি স্মৃতিবিভ্রম হয়েছে নাকি? তোমায় আমি জানাইনি, ঠাকুরের ইচ্ছা কী? তিনি কোন কাজের জন্য তোমায় নির্বাচন করে গিয়েছেন?” বিজয়দা যেন খানিকটা বিরক্ত।

“আমি ভিতর থেকে সাড়া পাই না।”

“সাড়া পাও না মানে?”

“মানে আমার সঙ্গে যা ঘটেছে, তারপর…”

“তুমি নিজের সঙ্গে ঘটা একটা খারাপ ঘটনা নিয়েই বুঁদ হয়ে আছ। অথচ আগামী দিনে এই আশ্রমের গুরুদায়িত্ব তোমার উপরেই। গুরুদেবের ভাবধারার প্রচার, প্রসার কীভাবে হবে তা নিয়ে ভাবতে হবে তো তোমায়। তোমার এম এ পরীক্ষার আর ক’দিন বাকি?”

“চার-পাঁচ মাস মতো।”

“তারপর?”

“ভাবছিলাম পিএইচ ডি-টা করব। ঠাকুরের বাণীর আলোকে ‘শ্রীমদ্ভাগবত গীতা’র উপর কাজ করার কথা ভেবেছি।”

“তার থেকে জরুরি কাজ এখন আমাদের সামনে বুবাই। ভুবনেশ্বরের শাখা আশ্রমের নাটমন্দির অসম্পূর্ণ হয়ে পড়ে আছে। আমাদের টাকা নেই যে এই মুহূর্তে তা সম্পন্ন করি। ঠাকুরের নামে যে দাতব্য চিকিৎসালয়গুলো চলে, প্রতিদিন সেখানে বেশি-বেশি মানুষ আসছেন। কিন্তু আমরা সেই অনুযায়ী ওষুধ কিংবা ডাক্তারের জোগান দিতে পারছি না। এসবের জন্য আরও অর্থের জোগান চাই, প্রভাবশালী মানুষদের সাহায্য চাই। সবথেকে আগে যেটা চাই তা হল, আরও নতুন-নতুন শিষ্য-ভক্ত। সবাই সম্মিলিত হয়ে ঠাকুরের কাজে ব্রতী হলে, সত্যসেবী আশ্রমের কাজ আরও ব্যাপ্তি পাবে। আমার যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে, আমি বুঝতে পারছি। তাই বলছি, তোমাকে ঈশ্বর সাধকোচিত চেহারা এবং শক্তি দিয়ে পাঠিয়েছেন। পড়াশোনা তো অনেক হল, এবার ঠাকুরের জন্য তোমাকে জীবন উৎসর্গ করতে হবে।”

বিজয়দার কথার উত্তরে কিছু বলতে পারলেন না উত্তরণ। ওঁর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে লাইব্রেরিতে গিয়ে বসলেন। চোখের সামনে রাধাকৃষ্ণন-এর ‘দ্য প্রিন্সিপ্যাল উপনিষদ’স বইটা মেলে ধরলেন, কিন্তু পাতাগুলো উলটে যেতে থাকল হাওয়ায়। অক্ষরগুলো চোখে ধাক্কা খেয়ে ফিরে যেতে লাগল পৃষ্ঠায়। একটি ব্যাখ্যাও মাথার ভিতর পর্যন্ত পৌঁছতে পারল না।

বইয়ে মাথা রেখে চোখ বুজে ফেলেছিলেন ক্লান্ত উত্তরণ। অনিলদা এসে পিঠে হাত রাখতেই চমকে উঠলেন।

অনিলদা বললেন, “সেদিন বিজয়দা কেন তোমায়, জপ করেছ কি না জিজ্ঞেস করেছিলেন জানো?”

“না।” উত্তরণ অস্ফুটে বললেন।

“বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী একবার তাঁর প্রিয় শিষ্য কুলদানন্দ ব্রহ্মচারীকে বলেছিলেন, ‘কুলদা, তুই জপে ফাঁকি দিচ্ছিস।’ কুলদানন্দ অবাক হয়ে গিয়ে জানিয়েছিলেন যে তিনি তো সারাক্ষণই জপ করেন। উত্তরে বিজয়কৃষ্ণ পালটা প্রশ্ন করেন, ‘পায়খানা-বাথরুমে যখন যাস তখন জপ করিস?’ উত্তর না দিতে পেরে কুলদানন্দ যখন চুপ তখন বিজয়কৃষ্ণ বলেন ‘কেন করিস না রে? ওখানে আমি নেই?’”

“তাই বলে ওই লক-আপে…”

অনিলদা উত্তরণকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “হ্যাঁ লক-আপে। শুধু লক-আপে নয়, স্টেশনে, রাস্তায়, ফুটপাথে, ঠাকুর সর্বত্র উপস্থিত। তুমি যে রাতটা হাজতে ছিলে, সেই রাতটা আমরা কেউ তোমার সঙ্গে থাকতে পারিনি। কিন্তু গুরুদেব সারাক্ষণ ছিলেন। তোমার ভিতরেই জেগে ছিলেন।”

“এমনটা হল কেন আমার সঙ্গে?”

“তুমি তো একবারও ভাবছ না আরও কী-কী হতে পারত তোমার সঙ্গে! তোমায় কোর্টে তোলা হতে পারত। সাত দিনের পুলিশ কাস্টডি হতে পারত। জেলও হয়ে যেতে পারত বছরখানেকের। ঠাকুর চেয়েছিলেন বলেই একজন বড় পুলিশ অফিসারের মুখ থেকে আমরা খবর পেলাম। ছুটে যেতে পারলাম তোমায় ছাড়িয়ে আনতে।

“কে সেই অফিসার? ‘উজ্জ্বল’ বলে যাঁর কথা বলছিলেন সেদিন, তিনিই? আমার তো তাঁকে একটা ধন্যবাদ জানানো দরকার।”

“তিনি ধন্যবাদের আশায় কাজ করেননি বুবাই। তাই তাঁর সঙ্গে তোমার কথা না বললেও চলবে। আর বাকি সবাই তো মাধ্যম মাত্র। তোমায় রক্ষা করেছেন, ঠাকুর স্বয়ং।”

“তা হলে এখন আমি…”

উত্তরণকে আবারও থামিয়ে দিয়ে অনিলদা বললেন, “আগে যেমন ছিলে, ঠিক তেমনই থাকবে। থাকবে কী, তেমনই আছ। মনে রেখো ঠাকুরের সন্তানকে ঠাকুর কাদায় পড়তে দেন না, নিজের কোলেই রাখেন।”

অনিলদার কথায় সামনের ধোঁয়াটা কেটে গেলেও ভিতরের গুমোট কাটল না। উত্তরণ আশ্রমে থেকেই ইউনিভার্সিটি যাতায়াত করা শুরু করলেন! মধ্যে একদিন ষষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে ওই ফ্ল্যাট থেকে নিজের বইপত্র আর ঠাকুরের প্রতিকৃতি নিয়ে এলেন কেবল। ফ্ল্যাটের ভিতর সব গোছাতে সময় লাগল হয়তো দশমিনিট কিন্তু উত্তরণের মনে হচ্ছিল দশ ঘণ্টা। যতক্ষণ ওখানে ছিলেন, প্রতিটা পল যেন চাবুক মারছিল, আত্মায়।

কলেজ স্ট্রিটের রাস্তায় দিনদশেকের মাথায় রজত বলে একটি ছেলে ওঁকে জিজ্ঞেস করল, “কী একটা ঝামেলা হয়েছে শুনলাম?”

উত্তরণ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন কোনও উত্তর না দিয়ে। ছেলেটা সামনে থেকে সরে গেল একসময়। তারপর যে ক’দিন ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছেন, উত্তরণের অবচেতনে কেউ একটা বলে উঠেছে, এই বুঝি আবার কেউ এসে জানতে চাইল, কোন গন্ডগোলে হাজতে থাকতে হয়েছিল।

শাস্তির ভয়টাই শাস্তি। আতঙ্কের জন্য অপেক্ষাই সবচেয়ে বড় আতঙ্ক। উত্তরণ সেই যন্ত্রণা ভিতরে বয়েই এম এ পরীক্ষা দিলেন আর দেওয়ার পরপরই বিজয়দার আদেশে ভুবনেশ্বরে গেলেন। ভৌগোলিক দূরত্ব যে মানুষকে শান্তিও দিতে পারে, ভুবনেশ্বর না এলে তা বুঝতেন না উত্তরণ। শাখা আশ্রমের যাবতীয় কাজের মধ্যে ডুবে গিয়ে ওঁর আর মনেও পড়ত না, ইউনিভার্সিটি কিংবা পিএইচ ডি-র কথা। ভুলে যাচ্ছিলেন সেই এক রাতের ভয়াবহতার স্মৃতিও!

জগন্নাথদেবকে দর্শন করবেন বলে পুরী গেলেন একদিন উত্তরণ। যে দিন পুজো দিলেন সে দিন সন্ধ্যায় সমুদ্রের তটে বসে ওঁর কেবলই মনে পড়ছিল মন্দিরের পাণ্ডা মধুসুদন মহাপাত্রের বলা কথাগুলো। ঠাকুরের তিরোধানের দিন মধুসূদন নাকি বিগ্রহে বিলীন হয়ে যেতে দেখেছিলেন গুরুদেবকে। কিন্তু উত্তরণ তো ছোটবেলা থেকে ঠাকুরের কাছেই শুনেছেন যে, ‘চমৎকার’ কোনও সাধকের বিষয় নয়। ওটা ম্যাজিশিয়ানের কাজ। তা হলে?

রাত বাড়তে উত্তরণ নিজের মনেই উত্তরটা পেলেন, রবীন্দ্রনাথের একটা লাইনে। ‘ফুরায় যা তা ফুরায় শুধু চোখে’। মন যাকে প্রবল ভাবে চাইছে চোখ বন্ধ করে তাঁকে দেখতে পাওয়াই প্রেম কিংবা ভক্তি। সেটা ছাড়া শুধু জ্ঞানের আলোয় পৃথিবী চলত না। প্রিয়তমকে যদি শিল্পে দেখতে পান শিল্পী, ভক্ত তাকে বিগ্রহে দেখতে পাবেন না কেন?

প্রশ্নটা মাথায় নিয়ে পরদিন সকালে ভুবনেশ্বরে ফিরে উত্তরণ শুনলেন, ওঁর সঙ্গে কথা বলবেন বলে ফোন করেছিলেন অনিলদা। শাখা আশ্রমের ল্যান্ডলাইন থেকে কলকাতায় ফোন করে উত্তরণ জানলেন যে এম এ-র রেজ়াল্ট বেরিয়েছে। খবরটা শুনে বিন্দুমাত্র আগ্রহ বা উৎকণ্ঠা জন্ম নিল ভিতরে। ঠাকুরের কাজে যিনি ব্রতী, তাঁর আবার আলাদা করে কোন পরীক্ষা? কীসের রেজ়াল্ট? কেবল মনে হল, এত দ্রুত আড়াই-তিন মাস সময় কেটে গেল?

আনরিজ়ার্ভড কমপার্টমেন্টে চেপে হাওড়া স্টেশনে নেমে উত্তরণ একবার ভাবলেন আশ্রমে ফিরে যাবেন। পরক্ষণেই মনে হল, তা হলে আবার কাল আসতে হবে। পড়াশোনার সঙ্গে সম্পর্ক যখন চুকিয়েই দেবেন ভেবেছেন, তখন আবার একদিন নষ্ট করে লাভ? তাই কলেজ স্ট্রিটের বাসেই উঠলেন শেষে।

ডিপার্টমেন্টের মুখেই দেখা হয়ে গেল অনিন্দ্য সেনের সঙ্গে। উত্তরণের পিঠ চাপড়ে স্যার বলে উঠলেন, “কনগ্রাচুলেশনস, ফার্স্ট বয়।”

ইউনিভার্সিটির পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়ার খবর পেয়ে সাধারণত খুব আনন্দ পাওয়ার কথা। কেন তবে প্রবল একটা নিরাসক্তি গ্রাস করল উত্তরণকে? কেন মনে হল লাস্ট হলেও তেমন কিছু ফারাক হত না?

অনিন্দ্য সেন জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় বেপাত্তা হয়ে গিয়েছিলে বলো তো? কী নিয়ে পিএইচ ডি করবে কিছু ঠিক করলে?”

“আমি পিএইচ ডি করব না।”

“পাগলের মতো কথা বলছ কেন?”

“না স্যার, সজ্ঞানেই বলছি। আমি অন্য কাজ করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”

“তোমার ওই আশ্রম?”

উত্তরণ চুপ করে রইলেন।

স্যার বললেন, “করো না যত খুশি নামগান। বি এ, এম এ-র মতো রোজ ক্লাসে তো আর আসতে হবে না। লাইব্রেরি আর ইউনিভার্সিটির সময়টুকু বাদ দিয়ে গলায় খোল ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়বে।”

উত্তরণ হেসে ফেললেন, “গলায় খোল ঝুলিয়ে ঘোরা ছাড়াও আশ্রমিকের অনেক কাজ থাকে। আপনাকে বোঝাতে পারব না হয়তো।”

“আমি বুঝতে চাইও না, ইউনিভার্সিটির চল্লিশ বছরের রেকর্ড ভেঙে দেওয়া ছেলেটা কেন পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে গায়ে ভস্ম মেখে ধ্যান করবে! কাল একটা মাধ্যমিক ফেল বা পাস গ্র্যাজুয়েট ছেলে হিমালয় চলে যেতে পারে সাধু হতে। কিন্তু তুমি অ্যাকাডেমিকস ছেড়ে দিলে ভবিষ্যতের কত ছাত্রছাত্রী বঞ্চিত হবে ভেবে দেখেছ?”

“সেসব ভাবার অধিকার আমার নেই স্যার।

অনিন্দ্য সেন উত্তরণের দু’টো কাঁধ ধরে ঝাঁকাতে শুরু করলেন, “কেন নেই? তুমি কি ক্রীতদাস?”

“না। আমি নির্বাচিত।”

“নির্বাচন কে করেছেন?”

“আমার ঠাকুর, স্যার।”

“তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, তিনি সত্যিই যদি তোমার মঙ্গল চেয়ে থাকেন, তা হলে পড়াশোনার জগৎ থেকে তোমায় ছিনিয়ে নেবেন না অন্তত। যাও তাঁকে আজই জিজ্ঞেস করো, তিনি কী চান। যা উত্তর পাবে, আমাকে বলবে।”

স্যারের কাছ থেকে সরে এসে উত্তরণ ভাবলেন, কেন তিনি বলতে পারলেন না যে তাঁর ঠাকুর এখন আর স্থূলদেহে নেই ! প্রশ্ন করামাত্র আর উত্তর পাওয়া যায় না তাঁর থেকে। তাঁর উত্তর বুঝে নিতে হয়।

কিন্তু সত্যিই যদি জিজ্ঞেস করতেন, কী হত ঠাকুরের উত্তর? ঠাকুর তো উত্তরণকে মন দিয়ে পড়াশোনা করতে বলেছিলেন। একবারও তো বলেননি এম এ-র পর পড়া ছেড়ে দিতে। তা হলে বিজয়দা যা চাইছেন আর ঠাকুর যা চেয়েছিলেন, দুইয়ের মধ্যে কোথাও কি কোনও…

ইউনিভার্সিটির গেট পেরিয়ে উদভ্রান্তের মতো রাস্তা ধরে হাঁটছিলেন উত্তরণ। মাথার ভিতরে একটা অনিঃশেষ কাটাকুটির খেলা চলছিল। ধ্যান না গবেষণা, ব্ৰত না বিস্তার?

হঠাৎ একটা হ্যাঁচকা টানে কক্ষচ্যুত হয়ে যেন অন্য কোনও পৃথিবীতে আছড়ে পড়লেন উত্তরণ। প্রবল শব্দে একটা বাস পেরিয়ে গেল পাশ দিয়ে। চেতন-অবচেতনের মাঝখানে আবিষ্কার করলেন একটি মেয়ে জড়িয়ে ধরে আছে ওঁকে।

প্রাথমিক ঘোরটা কেটে যেতে যতক্ষণ… উত্তরণ কাঁপতে শুরু করলেন থরথর করে।

অনসূয়া নিজের আলিঙ্গন থেকে ওঁকে মুক্তি দিয়ে বলল, “মারবেন? নিজে মরে গিয়ে আমাদের সবাইকে মারবেন?”

সেদিন রাতে বারবার ওই কুড়ি বা তিরিশ সেকেন্ডের অভিঘাত কাঁপিয়ে দিচ্ছিল উত্তরণকে। মনে হচ্ছিল, অনসুয়া ওঁকে জড়িয়ে ধরল কেন? আবার মনে হচ্ছিল, যদি অনসূয়া জড়িয়ে না ধরত, তা হলে কী হত? অপঘাতে মৃত্যু হলে তো নরকে যেতে হয় বলে শুনেছেন। অন্যদিকে, ‘নারী নরকের দ্বার’, শুনেছেন তা-ও। কিন্তু নরকে যাওয়া থেকে যে বাঁচায়, সে নিজেই কীভাবে নরকের দরজা হয়?

পরদিন ভোরে গুরুপূজা করতে-করতে মন শান্ত হয়ে এল অনেকটা। সত্যসেবী আশ্রমের ভিতরে কিংবা বাইরের ধর্মসভায় উত্তরণ কতবার ব্রহ্মচারী ঠাকুরকে বলতে শুনেছেন, “মেয়েদের নিষ্ঠা, বিশ্বাস, উদ্যম ও ঐকান্তিকতার প্রয়োজন আছে আমার। মেয়েরাই সংসারের মেরুদণ্ড। প্রতিটি সংসারকে আদর্শ সংসারে পরিণত করার গুরুদায়িত্ব তাদের উপরেই ন্যস্ত। তারাই নিজ-নিজ সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে, পুরুষরা ভুল পথে চললে তাদের ঠিক পথে নিয়ে আসে৷” কই, মেয়েদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই সর্বনাশ হয়ে যাবে, এমন কথা কখনও তো বলেননি ঠাকুর!

ঠাকুর না বললেও মানুষ বলে। আর মানুষের জিভে লাগাম দেবে, কার সাধ্য? বিজয়দার সেবাইত সন্তুর ডাক পেয়ে বিজয়দার ঘরে যেতেই উত্তরণ বুঝতে পারলেন সেই কথা।

গুরুদেবের পুরনো শিষ্যদের অন্যতম কমলাক্ষ গুহ উত্তরণকে দেখেই গলা তুললেন, “আপনি ওকেই জিজ্ঞেস করুন না, কাল সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের রাস্তা ধরে একটা মেয়ের হাতে হাত ঢুকিয়ে হাঁটছিল কি না?”

উত্তরণের মাথায় কেউ যেন বন্দুক ঠেকিয়ে ট্রিগারটা টেনে দিল। সত্যিই তো, অনসূয়ার ওঁকে বাসের মুখ থেকে ছিনিয়ে আনাতেই শেষ হয়ে যায়নি ব্যাপারটা। মেয়েটা তারপর উত্তরণের হাত ধরে হেঁটেছিল বেশ কিছুক্ষণ। উত্তরণ তখন এমন মানসিক অবস্থায় ছিলেন যে ওকে বারণ করার কথাও মনে আসেনি। স্থিতি ফিরে আসার পরও ওই আলিঙ্গনের ব্যাপারটাই মাথায় ঘুরছিল, আলাদা করে হাত ধরে হাঁটার কথাটা ভুলেই গিয়েছিলেন।

“ঠাকুর না চাইলে আমি তখন ওখান দিয়ে যাব কেন? ঠাকুরই নিশ্চয়ই চাইছিলেন যে ওই সব কীর্তিকলাপ আমার চোখে পড়ুক আর আমার মাধ্যমে আপনিও জানুন, কীরকম অপদার্থকে আপনি আশ্রমের নতুন সন্ন্যাসী করবেন বলে ঠিক করেছেন!” কমলাক্ষ গুহ বলে উঠলেন।

উত্তরণ শুনতে-শুনতে ভাবছিলেন, কমলাক্ষ গুহ যে ওখান দিয়ে যাচ্ছিলেন, সেটা যদি ঠাকুরের ইচ্ছে হয়ে থাকে, তা হলে অনসূয়া এসে যে ওঁকে বাঁচাল, সেটা কার ইচ্ছে ছিল?

“কমলাক্ষদা যা বলছেন তা কি সত্যি?” কেমন একটা ধরা গলায় জিজ্ঞেস করে উঠলেন বিজয়দা।

“একটা বাসের মুখে পড়তে যাচ্ছিলাম কাল। ওই মেয়েটিই আমাকে বাঁচায়। তারপর ঠিক কী হয়েছিল…”

“কী হয়েছিল, সেটা তো আমিই বলে দিলাম। তুমি সেই রাধিকাকে জড়িয়ে ধরে বৃন্দাবনের পথে হাঁটতে শুরু করলে। আরও কিছু করেছ কি না জানি না অবশ্য। ছ্যাঃ। বিজয়দা, এইসব ব্যভিচারীদের কিন্তু আশ্রমে আমরা মেনে নেব না, আগেই বলে দিচ্ছি?” উত্তরণকে থামিয়ে দিয়ে বললেন কমলাক্ষ গুহ।

বিজয়দা একটা হাত তুলে থামতে বললেন কমলাক্ষকে। তারপর উত্তরণের চোখে চোখ রেখে বললেন, “তুমি কি সংসার ধর্মের কথা ভাবছ? অধঃপতনের রাস্তায় একটা পা পড়েছে বলে মার্বেলের গুলির মতো শেষ ধাপ পর্যন্ত নামতে হবে? তুমি জানো না ঠাকুরের ইচ্ছা কী? ঠাকুর তো চাননি, তুমি অধ্যাপনা কিংবা অন্য কোনও চাকরি করো, বিয়ে-থা করে সন্তান মানুষ করো। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর নাম তুমি পৌঁছে দেবে সারা পৃথিবীতে। সে কথা ভুলে গিয়েছ?”।

“ভুলিনি। এই পৃথিবীর যেখানেই থাকি…”

“যেখানেই থাকি মানে কী? তুমি কি স্যুট-প্যান্ট পরে বিদেশ যাওয়ার পরিকল্পনা করছ?”

“আপনি ভুল বুঝছেন বিজয়দা।”

“বোঝার তুমি কী বাকি রেখেছ বুবাই? যেদিন দুর্ঘটনা ঘটেছিল, সেদিন আমি খবর পাওয়ামাত্র অনিলকেনিয়ে ছুটে গিয়েছিলাম। কিন্তু কাল যে দৃশ্য কমলাক্ষদা দেখেছেন স্বচক্ষে, তাতে তুমি জড়িত নও, আমি কীভাবে দাবি করব?”

“হাতে দই, পাতে দই, তবু বলে, কই, কই? ওর সেই মুখ আছে যে নিজেকে নির্দোষ দাবি করবে?” কমলাক্ষ গুহ বললেন।

আশ্চর্য, এত অপমানের মধ্যেও উত্তরণ নিজেকে ঘেন্না করার মতো কিছু পেলেন না। ওঁর বারবার মনে হচ্ছিল, সেদিন লক-আপ থেকে ছাড়াতে যেমন অনিলদা আর বিজয়দাকে থানায় পাঠিয়েছিলেন ঠাকুর, কাল ওই ছুটন্ত বাসের মুখ থেকে রক্ষা করতে অনসূয়াকেও ঠাকুরই পাঠিয়েছিলেন। তারপর কিছুক্ষণের জন্য যদি বিহুলতা এসে গ্রাস করে থাকে উত্তরণকে, তার দায় কি ওঁরই?

বিজয়দার মনের ভিতর তখন অন্য তোলপাড় চলছিল নিশ্চয়ই। নইলে হঠাৎ করে উঠে দাঁড়িয়ে, তাঁর ঘরের দেওয়ালে ঠাকুরের যে প্রতিকৃতি আছে তার দিকে তাকিয়ে কেন বললেন, “ঠাকুর, আমি পারলাম না! আপনি যে দায়িত্ব আমাকে দিয়েছিলেন, আমি তা পালন করতে পারলাম না।” বলেই উত্তরণকে অবাক করে ঠাকুরের ছবিতে মাথা ঠুকতে লাগলেন।

“মহারাজ আপনি থামুন। কী করছেন?” বলতে-বলতে উত্তরণ উঠে গিয়ে বিজয়দার হাতটা ধরলেন।

বিজয়দা এক ঝটকায় নিজের হাতটা সরিয়ে নিয়ে বললেন, “আমায় ছুঁয়ো না তুমি। আমার জ্বালা করছে।”

বিজয়দার সেবাইত সন্তু ছুটে এসে ধরে না ফেললে হয়তো মাটিতেই পড়ে যেতেন তিনি, একটা অঘটন ঘটে যেত তখনই। কিন্তু চৌকিতে বসে পড়ার পরও তাঁর মুখ-চোখ রক্তবর্ণ হয়ে রইল রাগে। যেন পলকে বিস্ফোরণ ঘটবে।

বিজয়দা গ্লাস থেকে নয়, একটা ঘটি থেকে আলগা করে জল খেতেন। বরাবর। সন্তু নিজে থেকেই ঘটিটা তাঁর দিকে এগিয়ে দিতে সেটা উঁচু করে এক ঢোঁক জল খেলেন বিজয়দা। দ্বিতীয় ঢোঁকটা খাওয়ার সময়ই হাত থেকে ঘটিটা পড়ে গেল। গায়ের গেরুয়া গেঞ্জি, চৌকির উপর পাতা চাদর — সব ভিজে গিয়েছে, ঘটিটা গড়াতে গড়াতে থেমে গিয়েছে সামনের মেঝেয়, সেই অবস্থায় বিজয়দা বললেন, “মনে রেখো বুবাই, ‘শিব রুষ্ট হলে গুরু রক্ষা করে তারে, গুরু রুষ্ট হলে কেহ রক্ষিতে না পারে। তুমি গুরুদেবের সঙ্গে কথার খেলাপ কোরো না।”

“এটা কথার খেলাপ? আগামী জগদ্ধাত্রী পুজোয় আপনি যাকে সন্ন্যাস দেবেন বলে ঘোষণা করে দিয়েছেন, সে যখন একটি মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হাঁটে, সেটা কথার খেলাপ নয়, ঘোরতর অপরাধ। সেই অপরাধ আপনি মেনে নিতে পারেন, আমি মানব না। সামনের ট্রাস্টি মিটিংয়ে…”

কমলাক্ষ গুহকে থামিয়ে দিয়ে বিজয়দা চিৎকার করে উঠলেন, “কী চান আপনি? আমি খুন করব বুবাইকে? সে ক্ষমতা যদি থাকত আমার, তা হলে এখনই ওর প্রাণটা নিয়ে আপনাকে শান্তি দিতাম। কিন্তু গুরুদেব যে আমায় বিশেষভাবে বলে গিয়েছিলেন এই ছেলেটাকে পাখির মায়ের মতো আগলে রাখতে।”

“আগলে হয়তো রেখেছেন, কিন্তু সন্ন্যাসী কিংবা ব্রহ্মচারী হওয়ার উপযুক্ত করে তৈরি যে করতে পারেননি, তার সাক্ষী তো আমি।” কমলাক্ষ গুহ বললেন।

“তার দোষ তো বিজয়দার নয়, আমার। আমি সেই অপরাধের শাস্তিস্বরূপ আজই যদি আশ্রম ছেড়ে চলে যাই, আপনি বিজয়দাকে নিষ্কৃতি দেবেন?” উত্তরণ স্বভাববিরুদ্ধ ঢঙে গলা তুললেন।

“এখানে নিষ্কৃতি দেওয়ার কথা উঠছে না, আশ্রমের পরিবেশ পবিত্র রাখার কথা হচ্ছে।”

“আমি চলে গেলেই তো পরিবেশ পবিত্র হয়ে যাবে। তা হলে আর সমস্যা কোথায়?”

“সমস্যা তো আমি তৈরি করিনি, দুধ-কলা খাওয়া যেসব কালসাপ এখানে আছে, সমস্যা তারাই।” কমলাক্ষ উঠে দাঁড়ালেন।

বিজয়দা দু’টো হাত দিয়ে মাথা চেপে বসেছিলেন, হাতদু’টো সরিয়ে বলে উঠলেন, “চলে যাও বুবাই, তুমি নিজের মুখে যা বলেছ, তাই করো। এখানে থেকে এত কথা শুনতে হবে না তোমায়।”

দুপুরে যখন নিজের সামান্য জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়েছেন উত্তরণ, তখন হন্তদন্ত হয়ে ওঁর ঘরে ঢুকলেন অনিলদা। ঢুকেই জড়িয়ে ধরলেন উত্তরণকে।

সেই স্পর্শের মধ্যে একটা কিছু ছিল, উত্তরণ কেঁদে ফেললেন।

অনিলদা ওঁকে শান্ত হওয়ার সময় দিয়ে বললেন, “এক সপ্তাহ কাশী কিংবা নবদ্বীপের শাখা আশ্রমে গিয়ে ঘুরে এসো। হাওয়া ঠান্ডা হয়ে যাবে ততদিনে।”

“কিন্তু আমার ভিতরের আগুনটা তো জ্বলতেই থাকবে অনিলদা।”

“লোকের কথায় অত পাত্তা দিলে চলে না। ‘লোককে পোক মনে করতে হয়’ সময়-সময়। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, ওই লোকটার অত জাতক্রোধ কেন তোমার উপর?”

“এভাবে বলছেন কেন? উনি তো ঠাকুরের পুরনো শিষ্য।”

“তাতে কী? এই আধ্যাত্মিক জগতে যদি থাকো, তা হলে দেখবে যে এমন অনেকে ভক্ত সেজে আছে যারা আদতে খুব নিচু মানসিকতার। তোমার মনে প্রশ্ন জাগবে, এইসব লোক মঠ-মিশনের ভিতরমহলে ঢুকল কী করে? একটু তলিয়ে ভাবলে বুঝবে, এই লোকগুলো বাইরে থাকলে সমাজ-সংসারের আরও বড় ক্ষতি হয়ে যেত। মহাপুরুষরা তাই এদের নিজেদের কাছে ধরে রাখেন। শিব যেমন বিষ ধারণ করেছিলেন গলায়। ব্রহ্মচারী ঠাকুরও তেমন কতবার যে নীলকণ্ঠ হয়েছেন।”

“আগেরবার ঠাকুরের জন্মোৎসবের সময় আমি যখন সমাধিমন্দিরে ছিলাম, তখন উনি এসে আলাদা করে তিন-চারটে প্রসাদী মিষ্টির প্যাকেট চেয়েছিলেন।”

“তুমি দাওনি?”

“আমি বলেছিলাম যে দিতে হলে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অজস্র শিষ্য-ভক্তের সবাইকেই দিতে হবে। উনি একটু আড়াল করে ওঁর হাতে তুলে দিতে বলেছিলেন। সেটা মানা সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে। কিন্তু অনিলদা, আমার মনে হয় না যে উনি সেই রাগে এই কাণ্ডটা ঘটিয়েছেন। হয়তো সত্যিই একটি মেয়ের হাত ধরে আমাকে হাঁটতে দেখে খারাপ লেগেছিল ভদ্রলোকের।”

“আচ্ছা বুবাই, বুদ্ধদেব যখন সাধনায় বসে প্রায় মারা যাচ্ছিলেন, তখন তাঁর হাতে পায়েস তুলে দিয়েছিলেন সুজাতা। আমরা যদি সেই সময়টায় চলে যাই, পায়েসের বাটি দেওয়া কিংবা নেওয়ার সময় সুজাতার হাত কি বুদ্ধের হাতে লাগেনি? কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছিল তাতে?”

“কিন্তু আমি তো কোনও সাধনায় বসিনি। বাসে কাটা পড়তে-পড়তে না পড়ে, আমার বোধবুদ্ধি তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল।”

“তোমার জায়গায় আমি থাকলে, আমারও যেত।”

“কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই আমার মতো কারওর হাত ধরে হাঁটতেন না রাস্তা দিয়ে।”

“কে বলতে পারে বুবাই? বিশ্বামিত্র কি আমার চেয়ে কম ক্ষমতাসম্পন্ন ঋষি ছিলেন? তাঁর ধ্যানভঙ্গ হয়নি?”

“আমার সব গুলিয়ে যাচ্ছে।”

“তাই তো বললাম, কয়েকটা দিন ঘুরে এসো।”

“কয়েকদিনের মধ্যেই আবার আমাকে আশ্রমে দেখা গেলে, বিজয়দাকে এত কটুকাটব্যের মুখোমুখি হতে হবে যে মহারাজের শরীর আরও খারাপ করবে।”

“দ্যাখো, প্রেসিডেন্ট মহারাজের ভাগ্যে যদি কটু কথা থাকে, তা হলে তুমি না থাকলেও শুনতে হবে। যেমন তোমার ভাগ্যে যদি আশ্রমের বাইরে যাওয়া থাকে, তা হলে আমি আটকাতে পারব না। আমি শুধু বলব, হঠকারী কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ো না।”

“নিচ্ছি না। শুধু ঠাকুরের ওই কথাটা, নিজের ক্ষতিতে ভয় পেয়ো না, দেখো যেন আশ্রমের ক্ষতি না হয়, এটা মেনে চলার চেষ্টা করছি।”

“তোমার সত্যিই মনে হচ্ছে যে তুমি থাকলে, আশ্রমের ক্ষতি হবে? মনে হলে, তোমাকে আটকাব না। কিন্তু এই ভাবনাটা সাময়িক, আমার মন বলছে। তোমার মন যখন বলবে, তখন ফিরে এসো।”

“ফিরতে চাইলেই ফিরতে পারব?”

অনিলদা হেসে উঠলেন, “কেন পারবে না? তবে আগে বলো, যাবে কোথায়?”

আশ্রম থেকে বেরিয়ে উত্তরণের মনে হল, যেখানেই যান ওঁকে আগে একবার অনসূয়ার কাছে যেতে হবে। জিজ্ঞেস করতে হবে, গতকাল একসঙ্গে হেঁটে যাওয়ার সময় উত্তরণ কি এমন কিছু করেছেন, যা অন্যায়? কমলাক্ষবাবুর কাছে যা গর্হিত, অনসূয়ার কাছে সেটাই হয়তো উচিত। পৃথিবী এক-একটা চশমার ভিতর দিয়ে এক-একরকম। তবু আশ্রমিকের একটা লক্ষণরেখা তো থাকেই। আর কাল সেই লক্ষণরেখা অতিক্রম করেছিলেন উত্তরণ। কিন্তু সেটা কি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে?

প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়ার জন্য অনসূয়ার কাছে যাওয়া জরুরি। কিন্তু কোথায় ওর বাড়ি? কালই একবার আবছা শুনেছিলেন উত্তরণ, বরানগরের কোন একটা পাড়ায়। কিন্তু কী সেই রাস্তার নাম, গলির কত নম্বর বাড়িতে ওরা থাকে, কিছু না জেনে কোথায় গিয়ে খুঁজবেন?

শিয়ালদায় নেমে উত্তরণের মনে হল, খোঁজার তেমন দরকারও নেই। কালকের কাজটার পরিণামে যখন আশ্রম ছেড়ে বেরিয়েই আসতে হয়েছে, তখন কাজটা কেন, কী ভেবে করেছিলেন, তা জানা, না জানা সমান।

অজস্র থেমে থাকা ট্রেনের ভিতর দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে উত্তরণ টের পেলেন, তিনি নিজেও একটা থেমে থাকা ট্রেন। কোথাও যাওয়ার নেই, ফেরার নেই কোথাও। তিনি ঠিকানা হারিয়ে ফেলেছেন। আর ঠিকানা যে হারিয়ে ফেলেছে, সে-ই স্বাধীন।

ব্যাগের ভিতরে একটা চাদর ছিল, সেটা বিছিয়ে স্টেশনেই শুয়ে পড়লেন উত্তরণ। কিছুক্ষণ পরে ঘুমিয়ে পড়লেন, দৈবী করুণাতেই হয়তো-বা। হঠাৎ কে যেন ধাক্কা দিয়ে তুলে দিল। উত্তরণ চোখ মেলে দেখলেন, রাত তখনও ভোর হয়নি।

“দেতা হ্যায়। বাবু দেতা হ্যায়। আধবুড়ো যে লোকটা বলল, সে-ই নির্ঘাত ওঁকে ঠেলে তুলে দিয়েছিল।

উত্তরণ দেখলেন, এক অবাঙালি ভদ্রলোক মিষ্টি আর কচুরি খাওয়াচ্ছেন। স্টেশনের ভিখিরিদের। সেই সকালের পর থেকে আর কিছু খাওয়া হয়নি বলেই বোধহয় ভিখিরিদের মধ্যে বসে হাত পেতে নেওয়া সেই কচুরি আর মিষ্টি যখন মুখে গেল, অদ্ভুত ভাল লাগল। খুব তৃপ্তি করে খেলেন উত্তরণ। তারপর স্টেশনের কল থেকে জল খেয়ে আবার ফিরে এলেন যেখানে চাদরটা পেতেছিলেন, ঠিক সেখানে। শুতেই, ঘুম আবার এসে হাত বুলিয়ে দিল চোখে।

লাইব্রেরির যে বইগুলো কাছে ছিল, আশ্রম থেকে বেরোনোর সময় সেগুলো সঙ্গে করে এনেছিলেন উত্তরণ। স্টেশনে ক’দিন থাকতে হবে তার ঠিক নেই ভেবে ইউনিভার্সিটিতে বইগুলো ফেরত দিতে গেলেন। ফেরার সময় অনসূয়ার সঙ্গে দেখা হতেই যখন ও জিজ্ঞেস করল যে তক্ষুনি আশ্রমে ফিরতে হবে কি না, উত্তরণ কিছুতেই মিথ্যে বলতে পারলেন না।

“আশ্রমে আর ফিরতে হবে না মানে?” অনসূয়া উত্তরণের কথা বুঝতে পেরেই জিজ্ঞেস করল।

উত্তরণ চুপ করে রইলেন।

“চুপ করে থাকবেন না, বলুন! কোথায় যাবেন এখান থেকে?”

“শিয়ালদা স্টেশনে।”

“আপনি কি ওখানেই আছেন নাকি?”

“কাল রাতটা ছিলাম।”

উত্তরণকে অবাক করে অনসূয়া কেঁদে ফেলল, “আমার জন্যই এটা ঘটল, তাই না?”

“তা কেন হতে যাবে? আমি এমনিই…”

অনসূয়া উত্তরণকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “যারা জীবনে একটিও মিথ্যে বলেনি, তারা মিথ্যে বলতে গেলেই ধরা পড়ে যায়, আপনি জানেন না? আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি, আমার সঙ্গে আপনাকে রাস্তায় কেউ দেখতে পেয়েছে আর তার ফলেই আপনাকে আশ্রম থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছে। কী, তাই তো?”

“তুমি কি অন্তর্যামী?” উত্তেজনায় উত্তরণ আর “আপনি” বলতে পারলেন না অনসূয়াকে।

“আমি আদৌ কী বা কে, আপনি জানার চেষ্টা করেছেন কোনওদিন? করেননি যখন, তখন বাদ দিন। শুধু বলুন, আমি যদি আপনার সঙ্গে আশ্রমে গিয়ে বলি যে দোষ আমার, আপনার নয়, তা হলে কি ওরা আপনাকে ফিরিয়ে নেবে?”

“আমাকে কেউ তাড়িয়ে দেয়নি। আমি নিজেই বেরিয়ে এসেছি।”

“কেন?”

“আশ্রমিকদের যে নিষ্ঠা, যে সংযম বজায় রাখতে হয়, তা রাখতে পারিনি বলে।”

“তার দায় তো আপনার নয়, আমার। আমিই আপনার হাত ধরেছিলাম হাঁটার সময়।”

“কিন্তু তুমি তো আমায় বাঁচিয়েছ কাল।”

“ঠিক বলেছেন। আমিই বাঁচিয়েছি। আর বাঁচিয়েছি যখন, তখন আপনার জীবনের উপর আমার একটা অধিকার জন্মায়। সেই অধিকার থেকেই বলছি, আপনাকে আমার বাড়িতে থাকতে হবে। শিয়ালদা স্টেশনে আপনাকে আমি শুয়ে থাকতে দিতে পারি না।”

“আমি তোমার বাড়িতে গিয়ে থাকতে পারব না। তুমি বরং…”

“বরং?”

উত্তরণ বাক্যটা সম্পূর্ণ করতে পারলেন না। অনসূয়াকে কাছাকাছি একটা ঘর খুঁজে দেওয়ার কথা বলতে গিয়ে ওঁর আচমকা মনে হল, সেই ঘরটার উপর বা নীচেও যদি পর্নোগ্রাফিক র‍্যাকেট চলে?

উত্তরণকে থেমে যেতে দেখে অনসূয়া ব্যস্ত গলায় বলে উঠল, “আপনার সব ইফস অ্যান্ড বার্টস নিয়ে পরে ভাবলেও চলবে। আপাতত চলুন আমার সঙ্গে।”

উত্তরণের দোটানার সুযোগে অনসূয়া উত্তরণকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেল। বরানগরের রামকৃষ্ণ মিশনের কাছেই ওদের বাড়ি। অনসূয়ার মা নেই, দাদা ইঞ্জিনিয়ার এবং চাকরিসূত্রে জার্মানিতে থাকে। বাড়িতে লোক বলতে অনসূয়া আর ওর বাবা জয়ন্তবাবু।

“আমার মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হওয়ার চার দিন আগে মা মারা যায়। আমি তিন দিনের কাজ সেরে পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলাম। কীভাবে যে পাশ করেছিলাম, জানি না। তারপর থেকে এভাবেই চলছে।” বলল অনসূয়া।

“আমি যতদিন কলেজে মাস্টারি করেছি, ততদিন ও ভোর সাড়ে পাঁচটায় উঠত, এখন রিটায়ার করে যাওয়ার পর, ছ’টায় ওঠে বোধহয়।” অনসূয়ার বাবা জয়ন্ত বসু বললেন।

“না, না। সাতটায় উঠি এখন।” অনসূয়া হাসতে-হাসতে বলে উঠল।

উত্তরণ কোনও কথা না বলে তাকালেন অনসূয়ার দিকে। কত সহজে সব দায়িত্ব মাথায় তুলে নিয়েছে মেয়েটা। কিন্তু ওকে দেখে একবারও বোঝার উপায় নেই যে অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা পেরিয়ে এসেছে। মেয়ে জাতটাই হয়তো এমন যে মাথায় সিন্দবাদের বোঝা নিয়েও হাসতে পারে। কিন্তু মেয়েদের সম্বন্ধে কিছু বলার এক্তিয়ার তো উত্তরণের নেই। মেয়েদের ব্যাপারে তিনি জানেন কী?

“আপনার জন্য দোতলায় দাদার ঘরটাই ভাল হবে। দক্ষিণের জানলা দিয়ে রোদ, হাওয়া দুই-ই আসবে।” অনসূয়া বলল।

“কিন্তু আমি তোমাদের বাড়িতে থাকব কোন অধিকারে?” উত্তরণ কেমন একটা গলায় বলে উঠলেন।

“মানুষের বাড়িতে থাকতে মানুষের অধিকার লাগে না তো?” অনসূয়ার বাবা বলে উঠলেন। তারপর বললেন, “তাও যদি অসুবিধে বোধ করো তা হলে অনসূয়ার শিক্ষক হিসেবে থাকবে।”

উত্তরণ একবার তাকালেন অনসূয়ার দিকে। কিছু বললেন না।

অনসূয়া এক মিনিট চুপ থেকে বলল, “আপনি আমাদের বাড়িতেই থেকে গেলে, ভীষণ খুশি হব আমি আর বাবা দু’জনেই। কিন্তু আপনাকে জোর তো করতে পারি না। তাই আপনি না চাইলে…”

জয়ন্ত অনসূয়াকে থামিয়ে বলে উঠলেন, “ওর না চাওয়ার কথা উঠছে কোত্থেকে?”

অনসূয়া হেসে ফেলল, “সেসব নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে। আপাতত আপনি স্নান করে আসুন। সকাল থেকে কিছু খেয়েছেন?”

উত্তরণ মাথা নাড়লেন।

“খিদে-তেষ্টা পায় না আপনার? নাকি যোগবলে জয় করেছেন সেটা?”

উত্তরণ হাসলেন এতক্ষণে, “খুব খিদে পেয়েছে।”

“শিগগির স্নান করে আসুন। আমি ততক্ষণে… কিন্তু আপনি আমার হাতের রান্না খাবেন তো?” অনসূয়ার গলাটা কেমন ভেঙে গেল।

“খাবে না কেন?” অনসূয়ার বাবা খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

“আসলে আমরা কায়স্থ তো। তাই জিজ্ঞেস করছি।” অনসূয়া গলাটা একটু নামিয়ে বলল।

উত্তরণ সামান্য চুপ করে থেকে বললেন, “আমার ঠাকুরকে জানলে তুমি এ প্রশ্ন করতে না। ঠাকুরের এক প্রিয় শিষ্য শান্তিদা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ঠাকুর তাঁকে দেখতে হাসপাতালে গেলে শান্তিদা বলেছিলেন যে হাসপাতালে যারা খেতে দেয় তাদের কী জাত তিনি জানেন না। কথাটা শুনে ঠাকুর আচারনিষ্ঠ শান্তিদার মাথায় হাত বোলাতে-বোলাতে বলেছিলেন, “তোমাকে সকালে যে খেতে দেয় সে রাম। আর তোমাকে বিকালে যে খেতে দেয় সে কৃষ্ণ।”

অনসূয়ার মুখে হাসি ফুটল কথাটা শুনে।

শীতসকালের রোদের মতো সেই হাসিটার দিকে তাকিয়ে উত্তরণ বললেন, “তবে আমি কিন্তু নিরামিষ খাই।”

অনসূয়া মাথা নাড়ল শুনে। কিছু বলল না।

শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে উত্তরণ টের পেলেন, নিজের ইচ্ছায় কিছুই করছেন না। একটা অন্ধ নিয়তি ওঁকে ঠেলতে-ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছে এদিক থেকে ওদিক। সেই নিয়তির উপর ঠাকুরের নিয়ন্ত্রণ আছে নিশ্চয়ই! তা নইলে আজও তো শিয়ালদা স্টেশনেই ওঁর বসে থাকার কথা। তার বদলে অনসূয়ার বাড়িতে…

অনসূয়ার বেড়ে দেওয়া ভাত খেতে-খেতে উত্তরণের মনে হল, রামও নয়, কৃষ্ণও নয়। এই মেয়েটি সাক্ষাৎ জগদ্ধাত্রী। নয়তো মায়ের পর কোনও মেয়ে তো কোনওদিন ভাত বেড়ে দেয়নি। জল এসে গেল উত্তরণের চোখে। কান্না সংবরণ করে তিনি খেলেন তৃপ্তি করে। তারপর দুপুরে ঘুমোলেন বেশ কিছুক্ষণ।

সন্ধেবেলা জপের শেষে যখন খানিকটা দিশেহারা হয়ে উত্তরণ ভাবছেন, এরপর কী করবেন, কোথায় যাবেন, অনসূয়া এসে দাঁড়াল সামনে।

“আমার একটা কথা আপনি রাখুন। আপাতত এখানেই থাকুন। আমি কথা দিচ্ছি, কোনও অসুবিধে হবে না। কেউ আপনার জীবন কিংবা সাধনায় ব্যাঘাত ঘটাবে না।”

“তোমরা কি ঘরভাড়া নেবে আমার থেকে?” কথাটা বলেই উত্তরণ বুঝলেন, ভুল করেছেন।

অনসূয়ার মুখটা ম্লান হয়ে গেল। ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে ও একবার তাকাল উত্তরণের দিকে, কিছু বলল না।

সেই না-বলা কথার ব্যথা অনেকক্ষণ ভেসে রইল ঘরটায়। উত্তরণ মনে-মনে অস্থির হয়ে উঠলেন। হাঁটতে বেরোবেন বলে দরজার কাছে এসেছেন, অনসূয়া সামনে এসে দাঁড়াল আবার।

“আপনি কি চলে যাচ্ছেন?” জিজ্ঞেস করল অনসূয়া।

“জানি না।” উত্তরণ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন।

রাস্তায় বেরিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে-হাঁটতে উত্তরণের মনে পড়ে যাচ্ছিল ব্রহ্মচারী ঠাকুরের কথা। ঠাকুর বলতেন, “কল্পনায় সৃষ্ট আর দৃষ্ট বিনাশশীল এবং চক্রাকারে ঘূর্ণমান অতি চঞ্চল এই জগৎ, অলীক এক বিভ্রম স্থান। এখানে এক ব্রহ্মই নানা রূপে প্রকাশিত হন। তাঁর ভিন্ন-ভিন্ন রূপ নেই। ভিন্ন বলে যা মনে হয়, তা নেহাতই মায়া বা স্বপ্ন।” তা হলে এই অনসূয়ার মধ্যে দিয়ে কি সেই একই ব্ৰহ্ম নিজের লীলা প্রকাশ করছেন না?

নিশ্চয়ই করছেন। নিশ্চয়ই ঠাকুরই ওঁকে দেখে রাখার জন্য এই সময়ে এই মেয়েটিকে পাঠিয়েছেন। ভাবতে-ভাবতে উত্তরণ ফিরে এলেন অনসূয়ার বাড়িতে। রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর অনসূয়া যখন ওঁর সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে শুরু করল, উত্তরণ সরে যেতে পারলেন না।

“আপনিই আমার ঈশ্বর, বিশ্বাস করুন। আমি আপনাকে কোনওভাবে বিরক্ত করব না কোনওদিন, কিন্তু আপনি প্লিজ় এই বাড়িতেই থেকে যান। আপনি রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে বেড়াবেন, স্টেশনে শুয়ে থাকবেন, বেখেয়ালে বাসের নীচে চাপা পড়তে যাবেন, এ আমি সহ্য করতে পারব না।”

অনসূয়া চলে যাওয়ার পরও উত্তরণের মাথার মধ্যে ওর বলা কথাগুলো বাজতে থাকল।

সেদিন রাতে উত্তরণ একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলেন। দেখলেন যে কোনও সমুদ্রের পাড়ে তিনি আর অনসূয়া দাঁড়িয়ে আছেন এবং মস্ত একটা ঢেউ সমুদ্রের মাঝখান থেকে উঠে তাঁদের দিকে এগিয়ে আসছে। সেই ঢেউটার ভিতর একটা পদ্ম। সেই পদ্মে গুরুদেব স্থিত হয়ে আছেন। স্বপ্নের ভিতরে ঢেউটা ভাঙল না, কিছুতেই ভাঙল না। ভোরে ঘুম ভাঙতেই উত্তরণের মনে হল, যে পৃথিবীতে ছেলেরাই মেয়েদের পিছনে ছুটে বেড়াচ্ছে অহরহ, সেখানে একটা মেয়ে ওঁকে এত ভালবাসছে, এ-ও কি ঠাকুরের ইচ্ছে ছাড়া সম্ভব?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *