খনার বচন

খনার বচন

সে এসেছিল স্ত্রীর সীমাহীন স্পর্ধায় ফুঁসতে ফুঁসতে। সে গালি দিয়েই যাবে। দিয়েই যাবে। তার স্ত্রী কেঁদেই যাবে, কেঁদেই যাবে। সে বেঁধে মারবে, তার স্ত্রী মার খেয়েই যাবে, খেয়েই যাবে। বুক শূন্য করে দেয় এমন রূঢ়তা, গুঁড়িয়ে ভেঙে দেয় প্রাণ— এমন অপমান। চিরকাল করে এসেছে, আবহমান পুং সাইকি তাকে দিয়ে এমনই করায়। এই ফর্মুলা যে অগ্রাহ্য করে, তার কী শাস্তি? কী শাস্তি তাকে যারা মদত দেয় তাদের? কম কষ্ট করে স্ত্রীর ঠিকানা বার করতে হয়েছে তাকে? বিশ্বসুদ্ধ লোক জেনে গেল। মালবিকা তাকে কম ধাতানি দেয়নি। মা-বাবা জেনে স্তম্ভিত। কসবায় বারবার ফোন করেও সাড়া পায়নি সে। কী করে পাবে? তখন তো সব নার্সিংহোমে, কে কখন আসছে, যাচ্ছে কোনও ঠিক নেই। অবশেষে দিল্লি এবং সেই সি-ই-ও মেসো। গম্ভীর গলা। মানুষ যত পদস্থ হবে তত গম্ভীর হবে তার গলা— হোয়াট হ্যাভ য়ু ডান টু হার? শি ইজ ব্রোকেন, ব্রোকেন ইন টু পিসেস। দিস ইজ ডিসগাস্টিং, আনপার্ডনেবল।

কী হল? ব্রেক-ডাউন? যাক, অন্ততপক্ষে বেঁচে আছে। এখানে এসে বিছানায় শোয়া রোগা, কালো, স্তিমিত শাশুড়িকে সে খেয়ালই করেনি। তার অর্জুনের চোখ— চাঁদমারি খুঁজে নিয়েছিল ঠিক। ঈশা। রোগা, ফ্যাকাশে, কিন্তু শান্ত ধীর, সে যে কোনও দিন উথাল-পাথাল কেঁদেছে, বড্ড ভয় পেয়েছে, বিদ্রোহ করেছে কোনও কিছুরই চিহ্ন তার মুখে নেই। তাকে দেখেও ঈশার কোনও ভাবান্তর হল না। সেই বরং ভেতরে কোথাও একটা শান্তি, আশ্বাস টের পেল। যাক ঈশা আছে।

মঞ্জুলিকাও আছেন, খর চোখে তাকালেন। তবু এই মানুষটাকে সে চেনে। বসে আছেন মেয়ের হাতটি নিজের কোলের ওপর নিয়ে। চোখ খোলা। কিন্তু দৃষ্টি অন্য কোথাও—

হে চন্দ্রচূড় মদনান্তক শূলপাণে
স্থানো গিরিশ গিরিজেশ মহেশ শম্ভো
ভূতেশ ভীত ভয়সূদন…

তিনি অখণ্ড জপ করে চলেছেন। সুবীর? তিনিও কেমন দুর্বোধ্য, গ্লাসে ওষুধ মাপলেন, ঈশার হাতে দিলেন।

সবাই চুপ। রোগশয্যা ঘিরে। কে ও? নিশীথ অধৈর্য হয়ে যাচ্ছিল। মঞ্জুলিকা বললেন— খাও নিশীথ।

তিনি কোথায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন। কখন টেবিল টেনে তার সামনে রেখেছেন, প্রচুর খাবার-দাবার।

নিশীথ কিছু ছুঁল না। স্বাভাবিক গলায় বলল— ও কি আমার সঙ্গে যাবে? ঈশা নিরুত্তর। কিছুক্ষণ পর মঞ্জুলিকাই বললেন— ঈশার মতো ভিতু, ঘরকুনো মেয়ে যখন এ ভাবে বেরিয়ে আসে, তখন ব্যাপারটা আর খুব সহজ থাকে না নিশীথ। ও যাবে কি না ও-ই জানে। আমি এইটুকু বলতে পারি আদর-যত্ন-মর্যাদার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তবে ওকে নিয়ে যাবে তুমি।

তার শাশুড়ির বিচরণক্ষেত্র যেখানে, সেখানে নিশীথের যাওয়া-আসা নেই। উনি হিস্ট্রি চ্যানেল। অলস চোখ ফেলে মাঝে মাঝে দেখে নেওয়া। তাঁকে সে পাত্তা দেয় না। কিন্তু মঞ্জুলিকা বিখ্যাত কর্পোরেট হাউসের এক্স সি ই ও-র স্ত্রী। তাঁকে খাতির করতেই হয়।

—আমি অত কমপ্লিকেশন বুঝি না মাসি, ইয়েস অর নো!— অসোয়াস্তি হচ্ছে। নিজের অনম্যতাটাকেই যে সে নিজের আইডেনটিটি বলে জানে!

হঠাৎ ঈশা ফিরে তাকাল। —অত অবাক হচ্ছ কেন? বার করেই তো দিয়েছিলে?

—রাগের মাথায় মানুষ অনেক কিছু বলে সেটা বোঝো না, এটাই তোমার মূর্খতা।

ঈশা ঠান্ডা গলায় বলল— তুমি, তোমরা তো ওয়েস্টার্ন ভ্যালুজ-এ বিশ্বাস করো। মানুষকে অপমান করলে যে অন্তত দুঃখ প্রকাশটা করতে হয়, সেটা জানো না, এটা তোমাদের মূর্খতা। স্ত্রীকে লোকচক্ষে হেয় করতে নেই, জানো না এটাও। তোমার ডিগ্রি তো কর্নেলের। ওরা কিন্তু এ জিনিস করে না। এতে নিজেরও অপমান। বোঝে।

অনেকক্ষণ চুপ করে রইল নিশীথ। সে আশা করছিল এঁরা তাকে আর ঈশাকে একলা হতে দেবেন যেমন লোকে দম্পতিকে দেয়। আর তখন সে তার সর্ব যুক্তি অগ্রাহ্যকারী কুশকাঠিন্য দিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করে ফেলবে তাকে। কিন্তু এখন সে বুঝছে এটা আর ডুয়েলের পর্যায়ে নেই। মহাযুদ্ধের জায়গায় চলে গেছে। গোলটেবিল বৈঠক থেকে কি ভিন্ন ভিন্ন পক্ষের প্রতিনিধিদের বাদ দেওয়া যায়!

অবশেষে জমাট অনভ্যাস ও অনন্যতা জয় করে সে আপসের গলায় বলল— ঠিক আছে। আই অ্যাম স্যরি। রিয়্যালি। স্বীকার করছি তুমি যেমন আমাকে নিরাশ করেছ, আমিও তেমনই তোমাকে…স্যরি। শায়রীর কথা ভাবো, মা-বাবা, সমাজ, আমার পজিশন…।

—ভাবছি। কিন্তু তোমাকেও ভাবতে হবে। আমি, আমার মা-বাবা, সমাজ, আমার পজিশন।

কোনও কসম এখনও খায় না নিশীথ। তার অহং-এ লাগে। সে বলে— স্বীকার করছি আমার রাগটা বেশি। কিন্তু তুমিও কম জেদি নও। সব সময়ে আমার দিকে আঙুল ওঠালে চলবে না…।

জলজ্যান্ত কংক্রিট জঙ্গলের মধ্য থেকে এক প্রাচীন ভাঙা মন্দির মাথা তোলে। তার মেঝেতে সাড়ে তেইশ ফুট গভীর কূপ। সাঁইত্রিশটি স্তরে ক্রমশ সংকীর্ণ হতে হতে নেমেছে কূপ যেখানে মাঙ্গলিক শঙ্খ-পদ্ম চিহ্ন, আর স্তব্ধ এক জিব। এখানেই প্রোথিত হয় সুবৃহৎ সুদৃঢ় স্তম্ভ। তার ওপর ভর করে থাকবে গোটা মন্দিরের স্থাপত্যনির্মাণ। উঠে আসে অশরীর জিব। কষ্টে নড়ছে, কিন্তু বলছে।

—এগুলো মগজের তৈরি কাঁদ নিশীথ— এই তর্ক। পরস্পর দোষারোপ। স্টপ আর্গুইং অ্যান্ড স্টার্ট ফিলিং। ইভল্যুশন মানুষকে দুটো ক্ষমতা দিয়েছে যা অন্য কাউকে সেভাবে দেয়নি— একটা মগজ, অন্যটা সংবেদন। সংবেদন ছাড়া মগজের কোনও… মানে নেই। সংবেদন থেকেই… সম্পর্ক,… ভালবাসা,…মূল্যবোধ, একে অপরকে ওপরে উঠতে, গভীরে আরও গভীরে যেতে সাহায্য করা। যদি না পারো তো জীবনটা জলে গেল।

তুই চুপ কর রঞ্জা— হাঁপাচ্ছিস।

এতক্ষণে নিশীথ নিজের ভেতর থেকে বেরিয়েছে। —মা? কী হয়েছে মার?

কেউ জবাব দিল না।

—বাবা, সে এবার সুবীরকে জিজ্ঞেস করে— মায়ের কী হয়েছে?

—সে অনেক কথা। ভেড়ি অঞ্চলে বৃষ্টিতে বানেতে— অনেক কষ্টে উদ্ধার করা গেছে—মেনিনজাইটিস— জানি না পা দুটো আর চলবে কি না।

—এত সিরিয়াস ব্যাপার, কই আমি তো কিছু জানি না…

ঈশা আস্তে বলল— বুঝতেই পারছ, আমি এখুনি ফিরতে পারছি না।

—শায়রীর স্কুল!

—আই’ল টেক কেয়ার অব ইট— ঈশা দাঁড়ি টেনে দিল।

রঞ্জা শুকনো হাসলেন। বললেন— ইয়েট অ্যানাদার লিজ, নিশীথ। আবার জীবন। বুঝলে কিছু? ইয়েট অ্যানাদার চান্স। যদি নতুন ভাবে ভাবতে না পারি, তা হলে কেন? কেন বলো?

প্রশ্নটা ঘরের বাতাসে চক্কর খেতে লাগল। হালকা করে বলা। কিন্তু প্রচণ্ড চাপ তার।

—দেখো, সে থেমে থেমে আবারও বলে যেন কথাগুলোকে বুকের গভীর থেকে টেনে বার করছে। টাকাকড়ি… প্রতিষ্ঠা,…সংসার সুখ…এসবই ভোগ করার জন্যই তো! কিন্তু ভোগের কতকগুলো সিক্রেট আছে। কিছু কিছু বাদ দিয়ে নিতে জানতে হয়। কী আর কতটা! ধরো প্রিয়জন না প্রোমোশন? পরিধির আবছা মানুষগুলো না কেন্দ্রের ঘনিষ্ঠ ক’জন! ঠিক ভাবে ব্যালান্স করে বাদ না দিতে পারলে ভোগ হয় না, হযবরল হয়। তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ

বেদবতী উদ্‌বিগ্ন দৃষ্টিতে চাইলেন মেয়ের দিকে। ঈশা বলল— মা, চুপ করো না। এসব বলে কী লাভ?

—লাভটা এখনও বুঝতে পারছিস না, না? —রঞ্জাবতী বিস্ময়ে পরিশ্রমে চুপ করে গেলেন। একটু পরে যেন অভিমান ভরা গলায় বললেন— ‘সারাজীবনের সারাৎসার, নিজের পুত্র-কন্যাকে বলব না? নিশীথ, অন্যের প্রাপ্তি দেখে নিজের চাওয়ার লিস্টি করাটা আহাম্মকি, বাবা। নকলনবিশি করবে কেন? ওর তিনটে গাড়ি বলে আমারও তিনটে, ওর বউ পঞ্চাশ হাজার রোজগার করে, আমার বউ কেন করবে না, ওর ছেলে ব্রিলিয়ান্ট, আমারটিকেও হতে হবে, নইলে সপাং— এ একেবারে লোলুপতা, হিংসা, হিংস্রতা। মা গৃধঃ কস্য স্বিদ্ধনম্‌। মা মা গৃধঃ। মানুষী সম্ভাবনার অনন্ত পথ খুলে রাখতে হলে, অনন্ত অমানুষী বাঁধনও খুলে দিতে হয়।

তাঁর দম ফুরিয়ে গেছে। কষ্টে পাশ ফিরলেন, মেয়ের সাহায্যে। চোখ বুজলেন। বড় ক্লান্ত। যখন ঝাঁজির দামে খাবি খাচ্ছিলেন, যখন প্রলাপ বকছিলেন, যখন ডাক্তারের হাতুড়ির ঠোকায় পায়ের নার্ভ সাড়া দিচ্ছিল না, সমস্ত সময়টা আসলে তিনি এক মন্দিরের গর্ভে দাঁড়িয়ে এক জ্যান্ত জিব খুঁজছিলেন। কী সেই পরম প্রথম, বলো খনা, কীসের জন্য তুমি থেকে এই আমি আমরা… আবহমানের এই দুর্গতি!

যখন মৃত্যুর সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিলেন তখন সে বলল। তিনি এদের বললেন। যদি না শোনে, না বোঝে তা হলে আবার তমিস্রাপাত হবে, অন্ধকারে রক্ত ঝরাতে ঝরাতে সে নেমে যাবে বহু শতাব্দী প্রাচীন সেই কূপের তলায়, মঙ্গলচিহ্নগুলির পাশে— আর এক মাঙ্গলিক— কিন্তু ছিন্ন। এবং নির্বাক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *