খনামিহিরের ঢিপি

খনামিহিরের ঢিপি

ওকে খুলে দাও, যেতে দাও নিবারণ— হঠাৎ আর্তনাদ করে উঠলেন রোগিণী জড়িয়ে জড়িয়ে… ছি ছি ছি— অমন করে মারে! উঃ, উঃ, উঃ, রোগিণী বলছেন আর পিঠ কুঁকড়ে শিউরে উঠছেন যেন অদৃশ্য চাবুক আছড়ে পড়ছে পিঠের ওপর।

—ভুল বকত্যাছেন, তাই না ডাক্তারসাব?

হ্যাঁ মনে তো হচ্ছে। খুব খারাপ কোনও ইনফেকশন হয়েছে মন্টু, জোর টাইফয়েড বোধহয়, আমার দ্বারা হবে না। হাসপাতালে দাও। রক্ত, ইউরিন পরীক্ষা, এম আর আই করতে হতে পারে…

—হ্যাঁ, উলটি-পালটি খাইয়ে নোংরা জল খাইয়েছেন তো বেশ। সাঁতার জানেন ওস্তাদ, নইলে—। কিন্তু এখান থে’ তো হাসপাতালে পাঠাতে পারব না আজ্ঞে।

—নিমেষ ও বন্দি হবার মানুষ নয়। স্পিরিট, স্পিরিটটাকে বাঁধবে কী করে? ঢিপি ভেঙে ফেলো, ওর মধ্যে জিব আছে, — রঙ্কার জিব।

—কী কন বুঝি না ডাক্তারবাবু, জ্ঞান কচ্ছেন বোধহয়। তবে নিবারণবাবুর নাম নিলেন। খবর করুন, একরাম সাবকে খবর করুন।

চারদিকে বিস্তীর্ণ জলমরু। বিচরণ করছে বহু রকমের মাছ, জলঢোড়া, পোকা-পতঙ্গ, হালকা হাওয়ায় ভেসে আছে মাছখেকো পাখিরা। উড়ে উড়ে বসবার দাঁড় খোঁজে সাদা সাদা বক। মাছের খাবার বস্তা বস্তা ঢালা হয় মরশুমে মরশুমে, বিদ্যাধরীর নোংরা জল মেশে, তলায় শ্যাওলা, গেঁড়িগুগলি, জলজ উদ্ভিদ। পায়ে লম্বা লতার জাল আটকে গিয়েছিল। বহুক্ষণ সাঁতরে আর পারেননি ইনি। ইতি দ্যান। ডুবতে থাকেন। মন্টু মিঞার লোক সময়মতো ঝাঁপিয়ে না পড়লে হয়ে যেত আজ।

কমলা রং-এর টালির চালের আধপাকা একটি ঘর। একটি বিন্দুর মতো জলের মধ্যে টলটল করছে। মেঝেয় থকথকে কাদা। পরিষ্কার করছে মন্টু মিঞার লোক। খাটিয়ায় রোগিণী। কোথাও কোনও মেয়েলোক নেই। শাড়ি ভেসে গেছে। কী করবেন ডাক্তারবাবু! ভিজে জামাকাপড় ছাড়িয়ে এদের একটা কাঁথায় ঢেকে রেখেছেন!

বিড়বিড় করছেন— বরাহ কি কারও নাম হয় নিমেষ? ওটা মিহিরের নামের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল। লোককথা বলছে— মিহির রাজপুত্রের মৃত্যুগণনা করেছিলেন, শুয়োরের হাতে। তাই রাজা কুমারকে আর বাইরে বেরোতে দিলেন না। ছোটছেলে বুবুনের মতো, কী করবে বল সুবীর, একদিন উঁচু সিন্দুকের ওপর থেকে ঝাঁপ খেল, নীচে রুপোর খেলনা বরাহ ছিল। বুকের মোক্ষম জায়গায় বিঁধে গেল। যতই কেন তুমি মা হও, তাকে হেলথ ড্রিংক দাও, আর ফল মাছ খাওয়াও, সে চুরমুর খাবেই। মায়ের হাত থেকে না পেলে বন্ধুদের কাছ থেকে খাবে… মায়ের দোষ কী… আপনি কি কুঞ্জবাবু, কুঞ্জগোবিন্দ গোস্বামী? নমস্কার। বলি শুনুন… একই ব্যক্তি। শ্বশুর নয়। স্বামীরই নাম বরাহমিহির। লোককথায় কিছু সত্য থাকে।

দুপুর। একটু ফরসা হয়েছে আকাশ। মন্টু মিঞা এখনও ফেরেনি। ডাক্তার আবার মাথা ধুইয়ে দিলেন রোগিণীর। লাল চোখ মেলে উনি বললেন— আহ! আপনি কি ডাক্তার?

—হ্যাঁ ম্যাডাম।

—শুনুন ডাক্তার, আগে মিহিরের বাবার চিকিৎসা করুন। তিনিও গণক, ছেলের অকালমৃত্যু গণনায় পেলেন। সমুদ্রের জলে ঝুড়ি করে ভাসিয়ে দিলেন। কুন্তী তাঁর কুমারী গর্ভের সন্তানকে জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন, সেই নিয়ে কত সমালোচনা! কী করবেন তিনি! কোনও উপায় ছিল? আপনিই বলুন! কিন্তু এই মিহিরের বাবা জ্যোতিষার্ণব পুত্র বিসর্জন দিল স্রেফ পুত্রশোকের ভয়ে। লোকে গঙ্গাসাগরে ছেলে বিসর্জন দিত ছেলে পাওয়ার জন্যে? সেই এক জিনিস আয়রনিটা দেখুন।

ডাক্তার বুঝলেন— এ প্রলাপ। কিন্তু সমৃদ্ধ প্রলাপ। যাকে জ্ঞান বলছে মন্টু। কিন্তু তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না। সূত্র নেই হাতে।

—ম্যাডাম, আপনি শান্ত হোন।

—শান্তই তো, কুঞ্জবাবু। মন-প্রাণ-বোধি দিয়ে যা সত্য বলে বুঝেছি তাই বলছি। হতে পারেন খনা সিংহলি। কিন্তু তিনি বাংলার বউ। মেয়েও হতে পারেন। কিন্তু যাই হোক, বাংলার। সবার ওপরে তিনি সেই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক, দাদা, যার বিদ্যাও অবিদ্যা, গুণও অগুণ। তরুণী বধূ গুনে দেখিয়ে দিলেন শ্বশুরের গণনায় কোথায় ভুল ছিল, কেন মিহিরের মৃত্যু হল না। সেই থেকে শুরু। তারপর রাজসভায় একেবারে কেলো! কী করব ভাই, আধুনিক অপ-বাক বেরিয়ে যায় মাঝে মাঝে। রাজা গণনা করতে দিলেন। মিহিরেরটা ঠিক হল না। খনাকে ডাকা হল, তিনি সঠিক উত্তর দিলেন। বিক্রমাদিত্যর নবরত্ন হেঁটমুণ্ড। অগ্নিশর্মা স্বামী ঘরে ফিরেছেন, কোথায় খনা? এত বড় স্পর্ধা!

—মন্দিরটা দেখেছেন?

—খনামিহিরের ঢিপির কথা বলছেন মা? —ডাক্তার বললেন।

—আবার কী! মন্দির বড় পুণ্যস্থান, মন্দির বড় পাপস্থানও বটে দাদা। মন্দিরে নিয়ে গিয়ে মিহির স্ত্রীকে শপথ করালেন— আর জ্যোতির্বিদ্যা, জোতিষচর্চা করবেন না। কণ্ঠে গান নিয়ে জন্মেছে। তাকে বলছে গাইবে না, পায়ের চলায় নাচের ছন্দ, তাকে বলছে নৃত্য তো বাইজির পেশা। বিদুষী, গুণবতী কি তা ছাড়তে পারেন? পারেন না! মৃত্যুর চেয়েও কঠিন তা। জিব কেটে ফেলছেন খনা। স্বামীর হাতে সেটি ধরিয়ে দিয়ে রক্তমুখী বধূ বেরিয়ে যাচ্ছেন— এই নাও আমার গৌরব, আর তোমার গ্লানি। মাথা উঁচু। স্পিরিট নষ্ট করতে পারেনি। কিন্তু এই নীরবতা আর এই ভয় আপামর মেয়ের সাইকিতে একটা পরিবর্তন আনল। চুপিসারে। ওরে বাবা, বেঁচে-বর্তে থাকতে চাও তো চুপ করে থাকো। শিখবে বই কী! শুক্তো, ছ্যাঁচড়া, ধোপার খাতা, ছেলেকে অ আ ক খ। ইচ্ছা-অনিচ্ছা তোরঙ্গে তুলে রাখো। সতী-উমা-করুণা-মলিনারা এই ভাবে বুকভরা মধু বাংলার বধূ হয়ে জন্মাল মরল। খুব নাম হল। কিন্তু দাদা এ তো শেষ নয়, মিহির একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গেছে হঠাৎ। বলছে পালটাও, ঘরের বাইরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করো, নাচ, গান, বিদ্যা সব আয়ত্ত করো, কিন্তু অবশ্যই স্বামী যতটুকু চাইবে, ততটুকু। রামচন্দ্রের গণ্ডি এবার। রূপ-গুণ-চরিত্র-ব্যক্তিত্ব নিয়ে এমন হও যাতে তোমাকে নিয়ে গর্ব করা চলে। খালি আমার থেকে এক বিঘত খাটো থেকো। কুমোরটুলিতে অর্ডার গেছে ডাক্তার।

নিস্তেজ হয়ে পড়েছে রোগিণী। মুখের দুপাশে গাঁজলা। জিবটাই খালি নড়ে। যেন মানুষটি মৃত। শুধু জিবটুকুই বেঁচে আছে।

ডাক্তার ইঞ্জেকশন দিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *