সর্বমঙ্গলা থেকে পূর্ণা, মাঝে সেজবউ

সর্বমঙ্গলা থেকে পূর্ণা, মাঝে সেজবউ

বাগবাজারের বাড়ি নাকি ভাগ হবে। শুনে অবধি বেদবতীর বুকের মধ্যেটা কেমন করছে। এই ভাগাভাগি, ভাইয়ে ভাইয়ে আড়াআড়ি ছাড়াছাড়ি জিনিসটাতে কেমন ব্যাখ্যাতীত একটা ভয় হয় তাঁর। একটা চালু কাঠামো আছে সেটাই যেন স্বস্তিদায়ক। অন্য কিছু, অন্যরকম হলে যেন মনে হয় নিরালম্ব শূন্যে ঝুলছেন তিনি। কে জানে সবাইকারই এমন হয় কি না। সত্যিই তো যৌথ পরিবার অনেক দিনই ভেঙে পড়েছে। যবে থেকে লোকের জমি-জিরেত যৌথ ব্যাবসা ইত্যাদির দিন গেছে তবে থেকেই এ ভাঙন। গাঁয়ের লোক উচ্চশিক্ষা উচ্চপদে চাকরির জন্য বরাবর মহানগরে নগরে সংসার পেতেছে আলাদা। কিন্তু সেটাতে তত ভয় নেই। কারণ আসল ভিতটা ভিটেমাটিটা তো আছেই। সেখানে কাকা অথবা জ্যাঠা ভূ-সম্পত্তি দেখাশোনা করেন, বাবা ধরো ডাক্তারি করেন। আছে বাস্তু। আর একটা যৌথ এস্টেট থেকে সবাইকার মোটা ভাতকাপড়ের ব্যবস্থা হয়ে যায়। এই ব্যবস্থায় সবচেয়ে উপকৃত হয় বৃদ্ধ পঙ্গু অসহায়রা। কেউ না কেউ একটু দেখাশোনা করে দেয়। বেদবতী বৃদ্ধ হয়েছেন। তাঁর দাদা-বউদিরাও বৃদ্ধ। ন’দার একটি ছেলে জড়বুদ্ধি, সব মিলে তাই তিনি এদিকটাই দেখতে পাচ্ছেন।

তাঁদের বাড়িতে, অর্থাৎ শ্বশুরবাড়িতে এ সমস্যাই ছিল না। কিরণময়ের কোনও ভাই ছিল না, সব দিদি। একটি বোনের বিয়ে বেদবতীর বিয়ের পরে হয়েছিল। তবে হ্যাঁ। পরের প্রজন্ম অর্থাৎ তাঁর নিজের সন্তানদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়েছে, ততটা মানসিক নয়— এই যা রক্ষা। বাড়ি-বিক্রির ব্যাপারে তারা সব এককাট্টা ছিল, বেদবতীর বিপক্ষে। পরিস্থিতি দেখে তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিলেন। এটাই তাঁর স্বভাব। প্রতিকূল কিছু বা নিজের অপছন্দের কিছু দেখলে তিনি গুটিয়ে যান। এক ধরনের শম্বুকবৃত্তি এটা। কর্তা যখন রাগারাগি করতেন কোনও কারণে, তিনি আস্তে আস্তে স্থানত্যাগ করতেন। কর্তা যখন গা-জোয়ারি কোনও ব্যবস্থা করতেন তাঁর অপছন্দ হত। তিনি একবার, মাত্র একবার বোঝাবার চেষ্টা করতেন, তারপর চুপ হয়ে যেতেন। সঞ্জয়ের ইচ্ছে ছিল ইঞ্জিনিয়ার হবে, উনি বললেন এত খেটেখুটে এত মাথা নিয়ে শেষ পর্যন্ত কুলি?

তিনি বুঝিয়েছিলেন— এটা ওর ইচ্ছে। যথেষ্ট বুদ্ধিমান ছেলে, তা ছাড়া ইঞ্জিনিয়ারের উপার্জন বেশি। তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে যাবে। এসব খানিকটা সঞ্জয়ই অবশ্য বুঝিয়েছিল তাঁকে। উনি নড়লেন না। কেমিস্ট্রিতে লেটার মার্কস পাচ্ছে সমানে, ওই রসায়নই ওর বিষয়। ছেলেমানুষ বুঝছে না। মুখ গোঁজ করে রসায়ন নিয়ে ভরতি হল সঞ্জয়, বরাবর খুব ভাল রেজাল্ট। কর্তা বললেন— দেখলে? বলেছিলুম না? সঞ্জয় উন্নতি ভালই করেছে। কিন্তু সুযোগ পেলেই বলে থাকে, সে সময়টা ছিল ইঞ্জিনিয়ারদের স্বর্ণযুগ। তখন যারা বি. ই. থেকে বেরিয়েছে, এখন সব দেশের ইন্ডাস্ট্রির মাথা।

ওই একই কর্তা আবার মেজছেলে সঞ্জীবের বেলায় তাকে টেকনিক্যাল স্কুলে পাঠালেন। তার নাকি মেকানিক্যাল ব্রেন, ছেলেটার সাহিত্যে ঝোঁক ছিল। তিনি কিছু করতে পারেননি। তার জন্য এখনও মেজছেলের কাছে তাঁকে কথা শুনতে হয়।

অথচ, তাঁর যে বুদ্ধি-বিবেচনা নেই, তিনি যে কিছুর বন্দোবস্ত বা মোকাবিলা করতে পারেন না, তা তো নয়। মঞ্জু ভুল করতে যাচ্ছিল। তিনি সামলালেন বুদ্ধি করে, ডিপ্লোম্যাসি চালিয়ে, মঞ্জু আজ কত সুখী। রঞ্জার বেলায় কিন্তু পারলেন না। তাঁর মনে হয়েছিল সুবীর যেন ঠিক দায়িত্বশীল নয় বা রঞ্জার প্রতি তার আগ্রহেও যেন কিছু খাদ আছে। এইটুকু আরও বুঝেছিলেন জীবনের ঝড়ঝাপটা সামলে নেবার মতো শক্তি এই মেয়ের সম্ভবত আছে। এ তাঁর মেয়ে নয়। সর্বমঙ্গলা ঠাকরুনের নাতনি। তবে কুটুমবাড়ির তত্ত্ব ফেরত দেওয়া সর্বমঙ্গলা নন। ঠাকুর মারা যাওয়ার পর অতগুলি সন্তানের শিক্ষা শেষ করা, তাদের বিয়ে, ছেলেপুলে সামলানো, কাজের লোকেদের অসুখে সেবা-শুশ্রূষা করা সর্বমঙ্গলা ঠাকরুন।

কোনও মানুষই সর্বগুণান্বিত হতে পারে না, দোষত্রুটিহীন হতে পারে না, তবু তিনি আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করেন— সর্বমঙ্গলার কর্ম ও পরিচালন ক্ষমতা, তাঁর বুদ্ধি যেন রঞ্জার মধ্যে প্রকাশ পায়। সেইসঙ্গে ছোট্ট করে খুব বিনয়ের সঙ্গে যোগ করে দেন— তাঁর অপরিসীম সহ্যশক্তিরও একটু যেন রঞ্জা পায়। তাঁর সহনশীলতার দাম দেয় না, বোঝে না তাঁর মেয়েরা। মঞ্জু যখন দিল্লি থেকে আসে! —বাবা! বাবা! কোন বাড়িতে উঠব তা-ও জানি না। আমার কোনও বাপের বাড়ি মায়ের বাড়ি নেই। সব দাদা, ভাইদের বাড়ি। কেন মা, তোমার স্বামীর তো একটা নিজস্ব বাড়ি ছিল। একটা আস্তানা তোমার আলাদা করা যেত না। যেটাকে আমরা আমাদের বাপের বাড়ি বলে ভাবতে পারতুম! দিস ইজ ভেরি ভেরি আনফেয়ার। একবারও তো বলতে পারতে মা!

বেদবতী বলেন— আলাদা আস্তানা হলে তো আলাদা দেখাশোনার লোকও চাই মঞ্জু। একটা আলাদা খরচ, আলাদা সংসার। সে কি আর আমার দ্বারা…

—কেন, ওরা সবাই কিছু-কিছু দিত, আমরাও দিতুম, তাতেই চমৎকার চলে যেত।

—শুনতে চমৎকার। তিনি বললেন— থাকতে, বাঁচতে চমৎকার নয় রে। সে তো এক উঞ্ছবৃত্তি ছাড়া কিছুই নয়। তোদের ওই বৃদ্ধাশ্রমই। একলা বৃদ্ধার বৃদ্ধাশ্রম! তফাতের মধ্যে দায়-দায়িত্ব সব বৃদ্ধার ঘাড়ে। ঘরে মরে পড়ে থাকল…

—আচ্ছা আচ্ছা। অনেক হয়েছে, এসব অলক্ষুনে কথা একদম বলবে না।

রঞ্জা এই সময়ে বলে থাকে— মা নিজেকে বৃদ্ধা বোলো না। আমার বড্ড কষ্ট হয়। তার চোখ ছলছল করে।

বেদবতী হাসেন— দেখ, আমি যে সময়কার মানুষ তখনও মেয়েদের কুড়িতেই বুড়ি প্রবাদটা চালু ছিল। তারপর সন্তানধারণ ক্ষমতা চলে গেলেই সে-মেয়ে আর মেয়ে থাকত না। বুড়ি তো বটেই! তখন সংসারে প্রাণপণে খেটে নিজের দাম ঠিক রাখতে হত।

—আহা তোমারও যেন তাই। শাশুড়ি নেই, দেওর-ভাশুর নেই।

বেদবতীর হাসিতে কী ম্লান ছায়া! কেন? কে জানে! বললেন— বড্ড বেশি দিন বাঁচা হয়ে গেল রে! এতটা দরকার ছিল না।

—হ্যাঁ, তোমার ওপর দিয়ে যা গেছে, আর যেভাবে মুখ বুজে সয়েছ, তাতে বুকটা ফেটে যাওয়ার কথা ছিল।

রঞ্জা বলে— আচ্ছা মা এই যে তোমার সর্বংসহা ধরিত্রী মূর্তি এটা শক্তি; না দুর্বলতা?

—কী জানি!

—তোমার কী মনে হয়?

—তোদের কী মনে হয়?

দুই বোন সমস্বরে বলে ওঠে— দুর্বলতা মা। স্বীকার করো না করো—এর নাম বেতসীবৃত্তি। ঝড়ের সময়ে বড় বড় গাছ পড়ে যায়, বেত নুয়ে পড়ে তাই বেঁচে যায়।

—তা তোরা কি আমায় লড়াই করতে করতে অনেক আগেই মরে যেতে বলছিস!

—না, না, তা নয়। মানুষ তো গাছ নয়! মানুষই তো ঝড়-ঝাপটার মধ্যে সোজা দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি রাখে। বেশ তুমি কী ভাবো, বলো! —রঞ্জা বলে। বেদবতীকে বেশি ভাবতে হয় না। আশি হল। জীবন কেটে গেছে জীবনের ওপর দিয়ে। তিনি যা করেছেন, তার মধ্যে যেমন তাঁর স্বভাব ছিল, তেমনি চেষ্টাও ছিল। হেসে বললেন— দুটোই। শক্তিও বটে, দুর্বলতাও।

—সেটা কেমন? —মঞ্জু যেন ঝড়।

—এই যে কারও ওপর বেশি জোর ফলাতে আমার কোনও দিনও ভাল লাগত না মঞ্জু। একবার বললুম— সে যদি তাতে আমার কথার মান দিল তো ঠিক আছে। ঘ্যানঘ্যান করতে আমার মানে লাগে। আজও।

—এটা তো আমাদের সেই বহু পরিচিত ইগো মা— রঞ্জা বলল, তোমার মান যাচ্ছে বলে তুমি একটা অন্যায় মুখ বুজে সয়ে নেবে?

—কী কী সত্যিকারের অন্যায় সয়েছি। বল?

—এই ধরো মামার বাড়িতে দিদিমার বড্ড ফেভারিটিজম ছিল, তুমি কখনও কিছু বলেছ? —মঞ্জু বলল।

রঞ্জা বলল— দিদি তুই আসল প্রসঙ্গ থেকে সরে যাচ্ছিস। ওটা প্রতিবাদ। আমরা সওয়ার কথা বলছি, নিজের বা নিজের খুব আপন কারও ওপর অন্যায়টা মুখ বুজে মেনে নেওয়ার কথা।

বেদবতী হেসে ফেললেন— রঞ্জা তোরা নিজেরাই জানিস না, আমার কাছে কী জানতে এসেছিস। তবু দুটোরই জবাব খুঁজি। দেখ তেরো বছরে বিয়ে হয়ে যে সংসার থেকে চলে এসেছি, সেখানে আমার জোর কতটা? এসো, খাও, মাখো, চলে যাও।

—কেন দিদিমা তোমার সঙ্গে পরামর্শ করতেন না?

—করতেন বই কী! কিন্তু সেটা সায় পাবার জন্য। কীরে খুকি নমস্কারিগুলো সরেস হওয়া চাই, বলে দিই? আমি বললাম— তাদের যা সাধ্য তাই দেবে মা। মা বললেন— নারে না, ফাঁকি দিতে সব মেয়ের বাপ একপায়ে খাড়া। বজ্জাতের ঝাড় তুই জানিস না।

আচ্ছা মা, যে তোমার আত্মীয় হতে যাচ্ছে তাকে গালাগাল দেওয়াটা কি ঠিক?

মা বললেন— আত্মীয় আবার কী! কুটুম! আমি রাগ করে বললুম— তা হলে আমার শ্বশুরমশাই, তোমার জামাই— এরা সব তোমার তো আপন নয়? মা কী বললেন, জানিস? —ওমা, দেখেশুনেই তো তোকে পাঁচ-বোনের কোলে এক ছেলেতে বিয়ে দিয়েছি, শাউড়ি নেই, সংসার তোর। বউ-কাঁটকি। জটিলে-কুটিলে থাকবে না। দিদিগুলো দূরে দূরে পড়েছে। শ্বশুর তোর হাতের সেদ্ধ-ভাত পেলেও বর্তে যাবে। আর জামাই? কেমন ভালমানুষ মুখখানা? আঁচলে বাঁধা থাকবে তোর। তা ছাড়া যম, জামাই, ভাগনা তিন না হয় আপনা। জামাই-ষষ্ঠীর দিন জামাইকে দেখব, ছেলে মেনে উপোস করব, কিন্তু তার ওপর ভরসা? সে আমার কন্না করবে? ধুর, তুইও যেমন!

দুই বোনে হেসে কুটিপাটি হয়ে গেল।

হাসি-টাসি শেষ হলে, রঞ্জা বলল— বাবা কতটা ভালমানুষ ছিলেন, তুমিই ভাল বলতে পারবে মা। আমরা দেখেছি বাবার কথাই সংসারে শেষ কথা। সব সময়ে সেটা খুব ভাল ব্যবস্থা হত না। বাবা অসময়ে একগাদা বন্ধু নিয়ে বাড়ি ঢুকলেন। তোমার খাওয়া-দাওয়া মাথায় উঠল। তুমি তাড়াতাড়ি রাঁধতে বসলে। রাঁধলে, পরিবেশন করলে, সবাই আহ বলে ঢেকুর তুলে উঠে গেল আড্ডা দিতে, তুমি গিয়ে শুয়ে পড়লে। খিদে পড়ে গেছে, শরীর বইছে না।

—কী জানিস— বেদবতী বললেন— তখনকার মেয়েরা নিজেদের খিদে খাওয়া এসবের কথা বলতে লজ্জা পেত, কোনও দিন তো খোঁজ নেননি। কী করে বলি বল।

—চলে না মা চলে না। তোমার যে আলসার হয়ে যায়নি সেটা আমার আর রঞ্জুর দৌলতে। —মঞ্জু ঝেঁঝে উঠল।

বেদবতী হেসে বললেন— একশোবার। মেয়েরাই মাকে দেখে। ব্যাটাছেলেদের ওসব দিকে চোখ থাকে না। চোখ থাকাটাও ওদের পক্ষে লজ্জার, লোকে বলবে স্ত্রৈণ।

মঞ্জু সগর্বে বলল, ভাগ্যিস সেসব দিন আর নেই। তোমার জামাইয়ের নজর খুব। আমার ভাল না খেয়ে উপায় নেই। যেন পাহারা দিয়ে আছে। লোকজন যখন খেতে বলি একেবারে প্ল্যান করে মা। দু দিন ধরে রান্না করি আর ফ্রিজে তুলি। গেস্টদের সঙ্গে একসঙ্গে খাই, গল্প করি, খাটুনিটা আড়ালে থাকে।

তাই তো বলি। বেদবতী বললেন— তোরা আজকালকার মেয়েরা দশভুজা! আমরা কিছুই জানতুম না। খেটে মরতুম খালি। বোকা!

—আহা, তাই যেন বলেছি— মঞ্জু অপ্রতিভ হয়ে বলল— তোমার মতো রাঁধতে আমি পারব? সাতজন্ম ঘুরে আসতে হবে। তা ছাড়া মা, আমরা আর আজকালকার মেয়ে নই, আমাদের ছেলেমেয়েরা এখন আজকালকার।

রঞ্জার মনে হচ্ছিল অনেক কথা। সে কিছু বলল না। সে-ই কি কূটনীতি চালায় না? দাদা-বউদিরা যবে থেকে নিজের-নিজের আস্তানা হয়েছে— দুম করে বদলে যায়নি। মা গৃহিণী ছিলেন, কিন্তু কর্ত্রী ছিলেন না কখনও। পিসিমারা রিমোট কনট্রোলে কি কিছুই চালাতেন না! বাবার কথায় কথায় ছিল— বড়দি এই লিখে পাঠিয়েছে, মেজদি এটা পছন্দ করবে না। ছোটপিসিমা-ই খালি গজগজ করত, —মজঃফরপুর থেকে ফরমান এসেছে, উঃ বউদি পারোও! যাই হোক, যবে থেকে শ্রীকৃষ্ণ লেনের বাড়ি বিক্রি হয়েছে, মায়ের আরও ডিমোশন হয়েছে, এখন কর্ত্রী তো নয়ই, গৃহিণীও নয়। এখন আশ্রিতা। মোটামুটি সম্মানিত আশ্রিতা। সীমাবদ্ধ। প্রাইভেট লিমিটেড। সে তো কিছু বলতে পারে না! যদি মায়ের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যায়? যদি দাদা-বউদিদের সঙ্গে তার সম্পর্কে চিড় ধরে! সে নিজেও কি কম সুবিধাবাদী নাকি?

বাগবাজার সর্বমঙ্গলার সর্বময় কর্তৃত্বে বহু দিন তার একত্ব বজায় রাখতে পেরেছিল। তার রেশ চলেছে তাঁর মৃত্যুর পরও। বছর দুই কেন, তিন তো হয়েই এল। যত মেজাজি, একচোখো, দাপুটে হোন না কেন, তাঁর আমলে কোনও অসৈরন হতে পারেনি। এইরকম ঠাকরুনের যে কী প্রয়োজন একটা পরিবারে, তা দীর্ঘদিন রোগগ্রস্ত, স্মৃতিভ্রষ্ট সর্বমঙ্গলা মারা যাওয়ার পর বোঝা যাচ্ছে। সেজবউদির মতো প্রতাপশালিনী, কিছুটা বিত্তশালিনীও বটে, কাজটা করে উঠতে পারলেন না। পরবর্তী প্রজন্ম হেলায় বলল, ওসব হিসেব-নিকেশ আপনারা পারবেন না, তার পরের প্রজন্ম অর্থাৎ তাঁর নাতনি ঈশাদের জেনারেশন আবার বলল— দিস ইজ আনথিংকেবল। এখনও আমরা এতগুলো লোক দুটো বাথরুমে চান করি। বাড়ি ফেরার কড়াক্কড়ি। ননসেন্স। তার পরের জেনারেশন আবার টিভি-তে সেঁটে গেছে, একেবারে আঠা দিয়ে। দেখছে কার্টুন, দেখতে দেখতে টুক করে এদিক ওদিক টিপে এক্কেবারে একটা শয্যা-দৃশ্যর সামনে। প্রত্যেকটি সিরিয়াল কেউ না কেউ দেখছে। তাদের সঙ্গে ছোটরাও বসে যাচ্ছে। সেখানে সব শাশুড়ি ক্রিমিন্যাল, ঘরের বউয়ের কথা বিশ্বাস না করে বাইরের অতিথির কথা বিশ্বাস করছে সবাই, সব জায়গায় মারামারি, কুটিলতা।

একদিন তিনি ছোটবউদির ঘরে বসে ছিলেন। ছোটবউদির নাতবউ নীনা হাঁ করে দেখছিল, তিনিও কীরকম জমে গেলেন। কিছুক্ষণ দেখে বললেন, হ্যাঁরে নীনা— এত কষ্ট করে আইন করে বহুবিবাহ বন্ধ হল। এসব হিন্দি সিরিয়াল যে তা-ই ফিরিয়ে আনতে প্রাণপণ চেষ্টা করছে রে! এ তো আইনবিরুদ্ধ! একজনের বউ কোমায় আছে, সে আর একজনকে বিয়ে করে ফেলল, কোমা ভেঙে গেল, এখন আইনত দ্বিতীয় বিয়েটা তো অসিদ্ধ রে! বড়বোনের স্বামী দুর্ঘটনায় বেঁচে গেছে, প্লাস্টিক সার্জারি করে কাঠামো, গলা সব বদলে এসেছে, তা কেন এল, কী করে হল তা অবশ্য জানি না, ছোটবোনটা শয়তানি করে ফাঁসিয়ে তাকে বিয়ে করল, তা লোকটা যে আসলে সেই বড়বোনের স্বামীই, সেটা সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়ে স্থির হয়ে যাবার পর তো দ্বিতীয় বিয়েটা আপনিই কেঁচে যায় রে! বাড়িসুদ্ধু লোক ওই দ্বিতীয় বিয়েটাকেই সিদ্ধ বলে ধরে নিচ্ছে কেন? প্রথম বউটা না হয় বোনের জন্যে আত্মত্যাগ করছে।

নীনা হেসে বলল— দিদান তুমি ওই টেলিফিল্‌মকে একটা উকিলের চিঠি ছেড়ে দাও।

নীনার বর বলল— এর আবার কেন আছে নাকি দিদান। বাড়াতে হবে, চার বছর, পাঁচ বছর। তখনও যদি পাবলিক খায় তো আরও এক বছর!

তিনি বলেছিলেন— তোদের পাবলিক কি অমনি বোকা? মুখ্যু?

নীনা আর তার বর সমস্বরে বলে ওঠে— এরে কয় জ্ঞান বোকা জ্ঞান মূর্খ, যেমন জ্ঞানপাপী, তেমন। জানে সবই, খেয়ে যাচ্ছে, চাটনি চেটে যাচ্ছে।

বেদবতীর কেমন ভয়-ভয় করে। সবাই যদি এই সব বে-আইন, অনাচার দেখায়, যা ঘরের মধ্যে তাকে হাটের মাঝখানে করে দেখায় তো কী হবে! শিশু বলে, বালক-বালিকা বলে কিছু আর এরা থাকতে দেবে না। সেই শিশুহীন শুধুমাত্র যুবতী পৃথিবীতে তিনি, তাঁরা কী করে বাঁচবেন! কেনই বা! অথচ প্রাণের ওপর তো কারও হাত নেই।

ছোটছেলে রঞ্জনকে বলেকয়ে আনিয়ে তিনি তার সঙ্গে বাগবাজারে চললেন। বিশাল বাড়ি। ক’পা গেলেই গঙ্গার ঘাট। সেখান থেকে ইলিশ আসত টাটকা, দড়ি দিয়ে বাঁধা সেই জোড়া ইলিশ সিঁদুর দিয়ে বরণ করছেন সর্বমঙ্গলা এ ছবি তিনি স্পষ্ট দেখতে পান। যাকে খাবে তাকে অমনি করে বরণ করা কেন? একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন। সবার মাঝে পড়ল কথা সেজবউদি বলে উঠল— শাউড়ি বউকে বরণ করে না? এ সেইরকম। সারাজীবন ধরে খাবে তার আনন্দে বরণ। সবাই হেসে উঠল। আচ্ছা, সত্যিই কি সর্বমঙ্গলা অতটা বউ-কাঁটকি ছিলেন? তাদের খাওয়া-দাওয়ার কোনও অযত্ন তো কখনও করেননি? কতকগুলো কঠোর নিয়ম ছিল। সকালবেলা উঠেই চান করে ফেলতে হবে বউ-মানুষকে। তসরের কাপড় গায়ে জড়িয়ে ঘরে গিয়ে তবে তুমি তোমার সুতিবস্ত্র পরো। মাথায় ঘোমটা থাকবে। স্নানের পর ঠাকুরঘরে ভক্তিভরে একটা পেন্নাম। তারপর এসে শাশুড়িকে পেন্নাম। সবাইকার কাজ ঠিক করা আছে। কে ময়দা মাখবে, কে চা করবে, কে কুটনো কুটবে, স—ব। বেশ একটা শৃঙ্খলা। কিন্তু হ্যাঁ, কারও অধীনে।

তাঁর মেয়ে রঞ্জা বলেছিল— মা ইলিশ হল সম্পদের প্রতীক, ‘জলের রুপোলি শস্য’— বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, তা-ই বোধহয় বরণ করা হত। হবেও বা। আরও বলত এই যে যৌথ সংসার, একজনের অধীনে জীবনযাত্রা— এ বহু প্রাচীন। কৃষিভিত্তিক সভ্যতার অভ্যেস। প্রথম যুগের আদি সভ্যতার সব মানুষ কোনও না কোনও কর্ত্রীর অধীনে কাজ করত। একজন কেউ পরিচালনা না করলে, কাজ ভাগ করে না দিলে— কমিউনিটি লিভিং চলে না। আদি সমাজের আদলে কমিউনিটি লিভিং চিন আর রাশিয়ায় চালু করার চেষ্টা হয়ে গেছে মার্কস-এর কথামতো। চলেনি। আর চলবেও না মা। ইন্ডিভিজুয়ালিজম, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য তো সভ্য মানুষের একটা প্রধান লক্ষণ, সেটা সে বড় জায়গার জন্য, ধরো তার কর্মক্ষেত্রে সরকারি কাজে বিসর্জন দিতে বাধ্য, কিন্তু নিজের নিজস্ব গণ্ডিতে এসে প্রত্যেকে তার নিজের মতো বাঁচতে চায়।

সেই কথাই একটু অন্যভাবে বলল পূর্ণাবউদি।

—দেখো দিদিভাই, ঠাকরুনের প্রত্যেক ছেলেরই নাতিপুতি হয়ে গেছে। বাড়ি তো নয়, পাড়াবিশেষ। দেশের সম্পত্তি খানিকটা বিক্রি, খানিকটা বেদখল হয়ে গেছে। সংবৎসরের চালটাও যে আসত, আজ আর আসে না গো। সবাই তাদের রোজগারের অংশ দিচ্ছে, চাইছে নিজের পছন্দের জিনিসটি। কেউ চায় মাছের ঝোল, কেউ চায় মাছের ঝাল, কেউ আবার মাছ খায়ই না, তার চাই মাংস। সবাই অখুশি। ভিন্ন হয়ে যাওয়াই তো ভাল ভাই। তোমাদের একটু কেমন কেমন লাগছে ঠিকই। স্ট্যাটাস কো— কেউ ভাঙতে চায় না। কিন্তু দেখো, ভাল হবে। তা ছাড়া এই বাড়ি তো আর থাকবে না, বিশাল মাল্টি-স্টোরি উঠবে। বড়মার সব ছেলেরই আলাদা আলাদা ফ্ল্যাট হবে। দরকারে ডাকলে সবাই জড়ো হবে। ভাবছ কেন?

এটা বেদবতী জানতেন না। এই বাড়ি ভাঙা হবে? ভাঙা হবে? বাগবাজারের দেউল-বাড়ি আর থাকবে না? ছাদে মন্দিরের চুড়োমতো একটা আছে বলে একে সবাই দেউল-বাড়ি বলত। বাগবাজার অঞ্চলে ঢুকে দেউল-বাড়ি বললে যে কেউ চিনিয়ে দিতে পারত, সেই বাড়ি ভাঙা হবে? তারপরেই তাঁর মনে হল তাঁর শ্বশুরবাড়ি? সে-ও তো বিক্রি হয়ে গেল! খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। নিজের কোনও জায়গা রইল না। তাঁর নিজস্ব জায়গার বদলে ছেলেদের সবার একটা একটা জায়গা। আক্ষরিক অর্থেই এ হল জায়গা ছেড়ে দেওয়া। ছোটদের জায়গা ছেড়ে দেওয়া। নিজে অন্তরালে চলে যাওয়া। এই খেলাই খেলা হবে এবার। কিন্তু বাগবাজারের বাড়ি যে একটা বিশেষ বাড়ি।

তিনি ঘরগুলো ঘুরে ঘুরে দেখেন। মায়ের ঘরটি এখনও তেমনই আছে। পালঙ্কে মোটা বিছানা। আয়নাঅলা বিশাল আলমারি, তিন পাল্লাঅলা ড্রেসিংটেবল। এক কোণে ঠাকুরের সিংহাসন। যখন ঠাকুরঘরে আর যেতে পারলেন না, তখন সর্বমঙ্গলা নিজের ঘরের কোণে সবচেয়ে প্রিয় ঠাকুরটিকে এনে বসিয়েছিলেন। সেই প্রিয় ঠাকুরটি হলেন জগদ্ধাত্রী। একটা ছবি। এ বাড়ির বার্ষিক জগদ্ধাত্রীপুজো বন্ধ হয়ে গেছে অনেক দিন। বাবা মারা যাবার পরই। কিন্তু মা শয়নে-জাগরণে জগদ্ধাত্রী সামনে রেখে জীবন যাপন করতেন।

—কেন মা? তুমি লক্ষ্মী নিলে না, কৃষ্ণ নিলে না, কালী নিলে না, জগদ্ধাত্রী নিতে গেলে কেন?

সর্বমঙ্গলা ঘরের হাওয়ার মধ্য থেকে স্বর হয়ে বলে উঠলেন—বুঝলি না খুকি? আমরা যে সব মহামায়ার অংশ রে! মহামায়াই পৃথিবী, প্রকৃতি, মানুষ গড়লেন। তিনিই চালাচ্ছেন, সবাই তাঁর অংশ, কিন্তু আমরা মেয়েরা বেশি করে। দেখছিস না যেমন বীর্য, তেমন রূপ, তেমন ক্ষমতা। সব পারেন। তাঁকেই ডাকি। তাঁর ওপর নির্ভর করেই থাকি। যদি তিনি সহায় হন তো সব পারব।

এই বিশ্বাসকে খোঁজেন বেদবতী। তিনি যে কেউ, বিশেষ কোনও শক্তির অংশ এ তাঁর কখনও মনে হয় না। মনে হয় প্রকৃতির খেয়ালে এসেছেন। শরীরের ঘড়ি অচল হলেই পঞ্চভূতে মিলিয়ে যাবেন। এর মধ্যের অংশটুকু যাকে জীবন বলে, তারও তেমন কোনও তাৎপর্য খুঁজে পান না বেদবতী। যে সময়ের যা— পুতুল খেলা, রান্নাবাটি, সংসারধর্ম, সন্তান জন্ম পালন। তাদের সুখদুঃখে সামান্য অংশ নেওয়া, তাদের বিয়ে-থা, অসুখ-বিসুখে সেবা, নিত্যপূজা, ব্যস। এখন আর কিছু করবার নেই। যা করে এসেছেন তা-ও সাগরপারে বসে শিশুর বালি নিয়ে খেলার বেশি কিছু নয়।

মায়ের ঘর থেকে বেড-প্যানট্যানগুলো সরে গেছে। অসুখ আর ওষুধের গন্ধের জায়গায় ধুনো গুগ্‌গুলের গন্ধ। তিনি জানেন এ কাজটা সেজবউদি করে। তিনি অনেকক্ষণ ঘরটাতে দাঁড়িয়ে আছেন দেখেই বোধহয় পূর্ণা একটা গদি-আঁটা বেতের চেয়ার নিয়ে এসেছে কোথা থেকে, সেজমাকেও ডেকে দিয়ে গেছে।

—কী গো মায়ের নাম জপ করছ? না শোক করছ? নাকি মা কত কষ্ট পেয়ে গেলেন সেই সব ভাবছ?

তিনি চুপ করে রইলেন।

—ভেবে কিছু লাভ নেই বেদো— সেজবউদি বললেন। কণ্ঠে যেন একটু মধু এসেছে।

—আসল কথা কী জানিস নতুন যুগের নতুন দেবতা, মা জগদ্ধাত্রীদের কাল গেছে।

বেদবতী শুনছেন, মন্তব্য করছেন না।

সেজবউদি বললেন, জগদ্ধাত্রী যে আদতে কিছু না, আমাদের দিয়ে সংসারের ঘানি ঘোরাবার একটা কল—এটা তো বুঝিনি। ঠাকরুনও ছাই বুঝতেন।

—বুঝলুম না।

—বুঝবি কী করে? নিজের দুঃখেশোকে বুঁদ হয়ে আছিস। চারদিকে কী হচ্ছে দেখছিস? আমরা জগদ্ধাত্রীর মতো রূপ নিয়ে সব কী করেছি? কোন কাল থেকে! পান খেয়ে; আঁচলে চাবির গোছা ফেলে, রান্নাঘর ভাঁড়ারঘর আর শোবারঘর আর আঁতুড়ঘর করে বেরিয়েছি। কী কাজে লেগেছে রূপ? আর গুণ? কে কত রাঁধতে পারল! কে অসময়ের অতিথিকে নিজের ভাগ ধরে দিল, কে কত উপোস করল। কার কত সহ্য, কোমর বেঁধে কে কত লোক খাওয়াতে পারল; তারপর কপালে সিঁদুর পরে ড্যাংডেঙিয়ে চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছরে গঙ্গাযাত্রা করল— এই তো!

—কী যে বলো! মায়ের একশোর কাছাকাছি বয়স হয়েছিল, তুমি আমি আশি পেরোলুম। এরকম…

সেজবউদি হেসে বললে, বয়স কিন্তু ওই চল্লিশেই শেষ হয়ে গেছে বেদো, ভেবে দেখো। তোর মা বেঁচেছিলেন চুষিকাঠি নিয়ে— আমি হ্যান, আমি ত্যান, আমার পুরো সংসারে কত নাম কত দাপ। পানটি থেকে চুনটি খসতে দিই না। চুষিকাঠি। তা, আমাদের সে চুষিকাঠিটিও নেই। এ ঘরের তিনটে নাতনি, দুটো নাতি, লাভ ম্যারেজ করেছে। কেটে পড়বার তাল করছে আরও কতক-চাট্টি। আমাদের কথা কেউ শোনে না। বিজয়ার সময়ে একটা করে প্রণাম সবার থেকে পাওনা ছিল। ঠাকরুন যাবার পর তাতেও শর্ট পড়েছে। বলে ধুত, প্রণাম আবার কী! পায়ে কত নোংরা, ছিঃ। হাত জোড় করে নমস্কার করে, কিংবা একটু নিচু হয়ে ‘থাক থাক’ টুকু শোনবার যা অপেক্ষা, উঠে পড়ল।

বেদবতী হেসে ফেললেন— এই নিয়ে তোমার এত দুঃখু?

—নারে এটা ভূমিকা, আসল কথাটা হল কাগজে দেখছিস না, রেপ রেপ রেপ, জগদ্ধাত্রীর অংশ যেই না বাইরে বেরিয়েছে অমনি রেপ হয়ে যাচ্ছে। চালান হয়ে যাচ্ছে। হিল্লি দিল্লিতে বেবুশ্যে হয়ে জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। আর গুণ? গুণ নিয়ে সব ঘরেও খাটছে, বাইরেও খাটছে, এত খাটতে খাটতে চেহারাটুকু যাচ্ছে, বর মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এই তো লাইফ!

সেজবউদির মুখে ‘লাইফ’টা খুব মজার শোনাল। বেদবতী মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলেন— তা তুমি কী করতে বলো!

—আমার বলাবলির কী আছে? আমার ‘আইডিয়া’ই নেই। মেয়েরা নিজেরাই দেখাচ্ছে। যার যট্টুকু রূপ আছে, দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। নাইকুন্ডুলি, বুকের ভাঁজ, পাছার মাংস, যার যা আছে দেখাচ্ছে। তাকে বলে মডেল। বেশ্যাতেও লজ্জা পাবে এমন সব রঙ্গ। তবে কী জানিস, পয়সা কামিয়ে নিচ্ছে। অগাধ! শরীর দিতে হচ্ছে না রাতভর, অথচ বাড়ি-গাড়ি। ভক্ত উমেদার। আর সত্যি জগদ্ধাত্রী হলে তো কথাই নেই। সোজ্জা হেমা মালিনী হয়ে যাও। যাই বলিস আর তাই বলিস, এরাই এই ছ্যাঁচড়া সমাজকে কলাটা ঠিকঠাক দেখাল। ঠাস ঠাস করে চড় যাকে বলে। বেশ করেছে।

—তুমি এই যুগে জন্মালে কী করতে সেজবউদি?—বেদবতী মিটিমিটি হেসে বললেন।

—আমি? আমি ব্যায়াম করা মেয়ে, রেপ করতে এলে পাঁচটা জোয়ানকে ল্যাং মেরে ফেলে দিতে পারি। আর আজকের দিনে আমার যা ছিল, তাতে করে হিন্দির হিরোইন না হোক, বাংলার তো হতুমই। কোল ভরতি কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা, বিজ্ঞাপনে বিজ্ঞাপনে গয়না পরে শাড়ি পরে পোজ দিচ্ছি। পাঁজা পাঁজা টাকা। তখন আমি তোর এই বাগবাজারের দেউলে-বাড়ির পরোয়া করতুম নাকি? যে নাতবউরা আজ ক্যাটক্যাট করে কথা শোনায়, তাদের নাগালের মধ্যেই থাকতুম না। এখানে থাকলে থিয়েটার রোড কি সল্ট লেক, বম্বেতে থাকলে বান্দ্রা কি জুহু, আর বিদেশে থাকলে ক্যালিফোর্নিয়া, আহা কী শহর, দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।

সেজবউদি কিছু দিন আগে তার বড়দার নাতনির বাড়ি আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া ঘুরে এসেছে, মোহিত একেবারে।

বেদবতী বললেন—সে দেশে তো শুনতে পাই, বুড়োবুড়িরা সব নিজে নিজে করে, লোক রাখা যায় না, গাড়ি চালিয়ে সব জায়গায় যেতে হয়। কম হ্যাপা!

গর্বের হাসি হেসে সেজবউদি বললে—দুর দুর— আমি তো হিরোইন! হিরোইনরা লোক রাখতে পারে, গাড়ি যখন নিজে চালাতে পারব, চালাব, নইলে আমার শফার কিংবা বয়-ফ্রেন্ড চালাবে!

—বয়-ফ্রেন্ড!

—হ্যাঁ, সে দেশে কুড়ি পঁচিশ বছরের ছোট জোয়ানকেও বিয়ে করা যায়। দিব্যি থাকে। লিভ-টুগেদার। যদ্দিন ইচ্ছে হল রইলে, ইচ্ছে গেল তো নেই নেই। তোর সেজদার কথা এর মধ্যে আসছে না বেদ। এ হল ‘যদি হতে পারতুম,’ সেই ‘যদির’ কথা। নে এবার তুই যত খুশি গালাগাল দে—বলে সেজবউদি শাঁখ বাজাল গাল ফুলিয়ে। তারপর চলে গেল।

বেদবতী হাঁ করে বসে রইলেন। সত্যি কথা, জগদ্ধাত্রী না হলেও সেজবউদির খুব চটকদার চেহারা ছিল। চুল তো এখনও দেখবার। রুপোর সুতোর মতো ঢেউ খেলানো, ধবধবে আলোর মতো রং। সোজা লম্বা চেহারা, চারটি ছেলেমেয়ে, সে বোঝবার জো নেই। সেজবউদির মা নানারকম জানতেন। বাচ্চা হতে প্রত্যেকবার যেত, আর যেন আরও কমবয়সি, কুমারীটি হয়ে ফিরত সেজ। মুখ চোখ আহামরি না হলেও ওই চটক। তার জন্যে কম খোঁটা শুনতে হয়েছে মায়ের কাছে। ‘বউমানুষের অত সাজগোজ! অত চোখে কাজল, গালে পাউডার কী গো! সবসময়ে যেন নেচে আছে! ঘরের আয়নাগুলো এবার লোক ডেকে ভেঙে দোব।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *