মেয়ে-মা-স্বামী

মেয়ে-মা-স্বামী

দিনগুলো শেষ হতে চায় না। সাতটার সময়েও ফটফটে বিকেল। মেয়েকে ঘুম থেকে তুলে নীচে খেলতে পাঠায় সে। ঠিক তার মতো লাজুক, অমিশুক, গোঁয়ার হয়েছে মেয়ে। কিছুতে যাবে না। —‘ওরা আমাকে বুলি করে, বিগ বয়েজ’— এক বুলি তার।

—করুক, তুমি তার জবাব দেবে। ডোন্ট লেট দেম। শো সাম অব ইয়োর টেম্পার শাই।

সে চায় শায়রী যেন পুতুল খেলে, মেয়েদের সঙ্গে দঙ্গল বেঁধে বড় না হয়। ছেলেদের মতো হোক তা-ও চায় না। কিন্তু এখন এই আট বছর বয়সে সন্তানের কোনও লিঙ্গ থাকার কথা নয়। ঠেলে ঠেলে পাঠিয়ে শায়রী এখন ভলিবল খেলছে, ব্যাডমিন্টন খেলছে অপটু হাতে। অনিচ্ছায় খেলতে খেলতে ইচ্ছে আসবে, মেলামেশা বাড়বে, কেউ বলবে না— ‘মূর্খ বড়, সামাজিক নয়।’

নিজের ছোটবেলার কথা মনে করলে এখন তার অনুশোচনা হয়। স্কুলে খেলা হত ক্রিকেট, ফুটবল— সেগুলো তো ছেলেরাই অধিকার করে রাখত। ভলিবল, বাস্কেট বল থাকত। কিন্তু দুপুরের রোদকে সে ভয় পেত, ঘেন্না করত। তার নরম মাখনের মতো ত্বকের ওপর হলকাটা আসত যেন দৈত্যের নিশ্বাসের মতো, সে ঘেমে একেক্কার হয়ে ঢলে পড়ত। এমনকী পি.টি-র সময়েও। শীতকালে ঠিক আছে। কিন্তু গরমকালে? ওরে ব্বাবা। যেখানে ছায়া সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে সে। সারকে বলার সাহস নেই, এই ছায়া-ছায়া জায়গাটাতে করুন সার! নিজে ছায়া দেখে দেখে দাঁড়াত, বন্ধুরা মুখ টিপে হাসত। ফুলটুসি, ফুলটুসকি! এই দুর্বলতাটাও তার একটা গর্বের জায়গা ছিল যেন। সবাই বলছে— ঈশা, ও অত পারবে না। রোদ সয় না ওর। আদুরি। রং কালো হয়ে যাবে না? —ক্ষীণ একটা গর্ব। কোনও কিছু না পারলে, কোনও দুর্বলতা থাকলে অনেক মেয়েই গর্ববোধ করে। সে-ও তো তেমনই ছিল। … টেবল-টেনিসটাও তো খেললে পারিস — বাবা বলল।

—বাপ রে, যা ছোটাছুটি, দম বেরিয়ে যায় আমার।

কত্থকটা চলছিল সুন্দর। কিন্তু প্রথম পিরিয়ড হতেই সে এমন ফ্যাকাশে যন্ত্রণাকাতর দুবলা হয়ে পড়ল, যে ডাক্তার দেখিয়ে, ব্লাড টেস্ট করে হিমোগ্লোবিন কাউন্ট করাতে হল। —কম, যথেষ্ট কম। বিট গাজর খাও, ভাল লাগে না, মেটে খাও পাঁঠার। ম্যাগো! ঘেন্না করে। তা হলে ওষুধ। ট্যাবলেট। দুধে গুলে যেগুলো দেওয়া হত সেগুলো খেলে তার বমি পেত, বিশ্রী গা গুলোত। নাচটা বন্ধ হতে সে বাঁচল যেন। বড্ড ভাল নেচে ফেলছিল। ঝর্নাদি বলছিলেন লাবু সবচেয়ে ভাল, কিন্তু তার পরেই ঈশা। স্কুল ফাংশন পাড়ার ফাংশনে নেচে বড্ড নাম হয়ে যাচ্ছিল। ঝর্নাদি বলতে শুরু করেছিলেন, চেহারাটাও সুন্দর তো! অ্যাডিশনাল বেনিফিট। ঈশা কত্থকে ঝড় তুলছে আমি দেখতে পাচ্ছি। যখন ছেড়ে দিল, বাড়িতে এসেছিলেন— রঞ্জা, ঈশা নাচবে না?

মা ম্লান মুখে বলেছিল— সাত মন তেলও পুড়বে না, ঈশাও নাচবে না ঝর্নাদি। এত অ্যানিমিক! এত ব্লিডিং হচ্ছে। চিকিৎসা হচ্ছে, দেখা যাক। মুখ কালো করে চলে গেলেন ঝর্নাদি। তারপর রাস্তায় দেখা হলে দু-একটা কথা বলে এড়িয়ে যেতেন। ভাল শিক্ষক, আশ্চর্য নাচতেন, কিন্তু নিজের চেহারা একেবারেই ভাল নয় বলে কোনও দিন নাচিয়ে হিসেবে তেমন নাম করতে পারেননি। শিক্ষক হিসেবে খুব মর্যাদা ছিল। ঈশাকে নিয়ে বোধহয় অনেক আশা ছিল। আশাভঙ্গটা সহ্য করতে পারেননি।

প্রকৃতি তুমি আমাকে অক্ষম শরীর দিলে কেন? এখন তো মেদ বৃদ্ধি হয়েছে, কিন্তু তা স্বাস্থ্য নয়। এখনও ৫/৬ দিন ভীষণ ব্লিডিং হয়। পেটে যন্ত্রণা। ডাক্তার বলেছিলেন সেই প্রথম দিনগুলোতে— বাচ্চা হলে আপনি সেরে যাবে, বুঝলেন?

মা দুঃখের হাসি হেসেছিল— তেরো বছর বয়স, এখন থেকে স্বাভাবিক জীবনযাপন করবার জন্য বাচ্চা হওয়ার অপেক্ষা করতে হবে? হায় ভগবান! আপনারা চিকিৎসার এদিকটাতে একেবারেই গুরুত্ব দেন না, না ডাক্তারবাবু! আমিও কাটা ছাগলের মতো ছটফট করেছি যন্ত্রণায়, খেলাধুলো চালিয়েছি কিছু দিন। তারপর বন্ধ করে দিতে হয়েছে। আমার মেয়েও তাই, তার মেয়েরও তাই-ই হবে? পরম্পরা নাকি? এত ওষুধ-বিষুধ বার করছেন, এই ব্যথা আর অতিরিক্ত ব্লিডিং-এর ওষুধ বার করতে পারেন না! না, দরকার মনে করেন না!

ডাক্তার হেসে বলেছিলেন— আমার ওপর রাগ করে লাভ কী! আপনারা আজকালকার মেয়েরা এই ভাবে ভোগেন। আপনার মা, তাঁর মা এঁদেরও কি এরকম হত?

না হত না — মা বলেছিল— তাঁদের অন্যরকম হত। দু বছর তিন বছর অন্তর অন্তর প্রসব করতে হত। দশ মাস গর্ভে ভার ধারণ করবার যন্ত্রণা সয়ে, তারপর প্রসব-যন্ত্রণা। প্রত্যেকটা তাঁদের মৃত্যুর কাছাকাছি নিয়ে যেত। আপনি বলছেন দুটোর একটা মেয়েদের বেছে নিতেই হবে! টিউব বেবি তৈরি করে ফেললেন ডাক্তারবাবু, ক্লোনিং নিয়ে গবেষণা এগিয়ে চলেছে। সামান্য এই বাধকের ব্যথা আর প্রতিমাসে অন্তহীন ব্লিডিং-এর সমাধান বেরোল না? আশ্চর্য!

শায়রী তাই হাজার কেঁদেও দুধের হাত থেকে মুক্তি পায় না। শোবার আগে দুধ তাকে খেতেই হবে। চকোলেট দিয়ে হোক, ভ্যানিলা-গন্ধ দিয়ে হোক। মাস্ট। এসব জায়গায় সে অনড়। ফল খাও বেশি করে। প্রতিদিন চিকেন বরাদ্দ আছে। মাছ নিয়ে রোজ কান্নাকাটি। কখনও স্টু, কখনও বেক, কখনও সুইট-সাওয়ার, কতরকম করে দিচ্ছে। দেব, কিন্তু খেতে হবে।

মেয়ের বাবা চোখ গরম করে— ও খেতে চায় না। জোর করো কেন? ইটস রং। লেট হার অ্যালোন।

মেয়ে কতজ্ঞ চোখে বাবার দিকে তাকায়। সে ঘর ছেড়ে চলে যায়। পরে মায়ের রাগ বুঝে মেয়ে দু হাতে জড়িয়ে ধরে রাত্রে। শোবার সময়ে। মা— রাগ কোরো না, আমি আর অমন করব না।

মা চুপ।

—মা আমি মাছ খাব, খালি কাঁটা বেছে দিয়ো, কাঁটা মাছ খেতে পারি না। মা চুপ।

—মা আমি দুধ খাব, কিন্তু একবার।

মা চুপ।

—মা আমি জুস নয়, গোটা ফলই খাব।

এবার মা পাশ ফেরে, আলতো করে চুমু দেয় মেয়ের কপালে, নরম গলায় বলে— মনে থাকবে তো? কথা দিলে কিন্তু।

গল্পের বই। ঈশার সর্বক্ষণের সঙ্গী গল্পের বই। আড্ডা আর গল্পের বই। বাঁধাধরা পড়াশোনা করতে ইচ্ছে করে না। সেগুলো কোনওমতে শেষ করে সে গল্পের বই নিয়ে বসে। লালবাই, শুন বরনারী, তিলাঞ্জলি, সাহেব-বিবি-গোলাম, কড়ি দিয়ে কিনলাম, বিভূতিভূষণ শেষ, শরৎচন্দ্র শেষ, তারাশঙ্কর কিছু কিছু। ওদিকে উদারিং হাইটস, জেন এয়ার, টেস অব দা ডারবারভিলস, রেবেকা, মাই কাজিন র‍্যাচেল, গন উইথ দা উইন্ড …। যে নিজেকে অযোগ্য ভাবছে সেই মেয়ের বা ছেলের প্রার্থিত ভালবাসা পাওয়ার গল্প তার ভাল লাগে খুব। জেন এয়ার, রেবেকা, শুন বরনারী এইরকম গল্প। প্রতিভা বসুর গল্প খুব ভাল লাগে। সেখানেও এমন। স্বয়ং নবাব মেয়েটিকে এত ভালবাসলেন যে বাড়িতে তাঁতি-তাঁত বসিয়ে মহামূল্য অনন্য শাড়ি তৈরি করালেন, তবু সে মেয়ে নবাবের ভালবাসা গ্রহণ করে না। শেষে ঢাকার ভয়াবহ দাঙ্গার সময়ে সেই মেয়েটিকে নিজের বেগম সাজিয়ে কোনওমতে ঢাকা থেকে বার করলেন নবাব, এবং কলকাতায় প্রাণটা দিলেন। পড়ে সে হাপুস নয়নে কেঁদেছিল, ভাবত ওই ডার্সি বা নবাব, বা রচেস্টার, বা ‘রেবেকা’র নায়ক এরকমই কেউ হবে তার বর। তাকে সে প্রাণপণে ভালবাসবে, অভিমান করবে, আদর পাবে। এই স্বপ্ন দেখতে দেখতে সে বইয়ের পাতা উলটোত।

কিন্তু বইগুলো এমন মিথ্যে কথা বলে! ডার্সির পুরুষালি সৌন্দর্য ও আভিজাত্য নয় অহংকার, নবাবের প্রাণপণ ভালবাসা না শিক্ষাদীক্ষার ভিন্নতা, হিদক্লিফের মৃত্যুঞ্জয়ী প্রেম নয়, শুধু চেহারা নিয়ে নিশীথ এল তার জীবনে। প্রায় প্রথম থেকেই রেড সিগন্যাল পেতে শুরু করল সে। স্ত্রী কাঁদলে, অভিমান করলে এ বিরক্ত হয়, ওটা নেহাতই বালিকাসুলভ ন্যাকাপনা তার কাছে। বেশি কথা কী, অসুখ করলে রেগে যায়। মাথায় আধকপালে? ধুত্তোর! বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। পিরিয়ডের ব্যথা! এক দঙ্গল লোকের মাঝখানে দোকানে চিৎকার করে উঠল। সারাদিনের পর বাড়ি এল— চান করে চা খেয়ে এবার হালকা গান চালিয়ে একটু গল্প করবে নিশ্চয়, বারান্দার নির্জনতায়, সবার চোখ লুকিয়ে হাতে হাত রাখবে! কোথায় কী! টি.ভি. খুলে বসে গেল। ডিসকভারি, অ্যানিম্যাল প্ল্যানেট, হিসট্রি, এইচ.বি.ও … তারপর ঘুরে ঘুরে হিন্দি নাচা-গানা। খেতে বসতে রাত বারোটা বাজিয়ে দেবে। সেখানে শাশুড়ি ছিলেন, অবশেষে বলতেন— তুমি খেয়ে নাও ঈশা, আমরা তো খেয়েই নিই, ও বোধহয় অফিস-ক্যান্টিনে খুব খায়। যখন তোক খাবে …। তো এখানে তো একটাও বেজে যাচ্ছে। এত করার পরেও ভুরু কুঁচকে থাকে, বলে ‘কিচ্ছু তো করো না।’ কিছু করা নয়, এই সংসার গুছিয়ে টিপ-টপ রাখা, অর্ধেক সময়ে লোক থাকে না— তখন কত ভালবেসে যে যা পছন্দ করে তাই রান্না, মেয়ের সমস্ত ভার তার একার, একদম একার, নিজের ও মেয়ের অসুখ-বিসুখ করলে তাকেই সব করতে হয়, ইলেকট্রিসিটি গেল, ফোন খারাপ, মেয়ের পেট খারাপ জ্বর, নিজের জ্বর— তার জন্য ডাক্তার— এভরিথিং। দেখার, ভাবার, শেয়ার করার কেউ নেই। কেরিয়ার করছেন, উঁচু থেকে আরও উঁচুতে উঠবেন, তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর হয়ে যাবে স্ত্রী-পুত্র-সংসার। আছে— এইটুকুই সমাজের কাছে দেখানো, এবং নিরাপত্তা— অবশ্যই নিজেরও নিরাপত্তা। নিজের একটা প্রকাণ্ড স্বাবলম্বী ভাবমূর্তি তৈরি করেছে নিশীথ। এত স্বাবলম্বী যে স্ত্রী না থাকলে ক্যানটিন-রেস্তোরাঁ-টেক-অ্যাওয়ে নির্ভর, এবং স্ত্রী-থাকা, সন্তান-থাকা অবস্থাতেও আত্মীয় বন্ধু-নির্ভর। তাদের সঙ্গে সপ্তাহান্তে দেখা না হলে মেজাজ খারাপ হবে তার। কোনও মেলামেশাটারই কিন্তু কোনও জাত নেই। সেটাও চাকরিনির্ভর। খালি কর্মজগতের কথা, কোন শেয়ার উঠল, কোথায় নামল। ইউ.এস.এর সরকারি পলিসি— আউটসোর্সি-ফ্রেন্ডলি হতে যাচ্ছে কি না। ইন্ডিয়া কত সুদ কমাল। ফিনান্সিং সেক্টর স্টেট পলিসির জন্যে কীরকম ফ্লারিশ করছে। এবং শৈবালের বউ যা দেখতে, শৈবাল কী করে বিয়ে করল! অলি হংকং-এ জমিয়ে বসেছে। হংকং-এ বসে ডলারে আর্ন করবে। হাঃ হাঃ হাঃ, ওর বর এখনও সামবাজারের সসিবাবু— হাঃ হাঃ হা, রুবি-সুন্দরের মোঙ্গল বেবি হয়েছে। রাজা-অর্নার ডিভোর্স হয়ে গেল। হবারই ছিল, হুঁ! সত্যজিৎ বড় না মণি রত্নম।

সারাক্ষণই সে একঘরে হয়ে ছিল। এমন কোনও আলোচনা হচ্ছিল না যে ও অংশ নিতে পারে। এবার বলল— দুজনেরই কতকগুলো প্লাস-পয়েন্ট আছে। ব্যসস্‌। খ্যাঁক করে উঠল নিশীথ। —তুমি এ বিষয়ে কী জানো? সত্যজিতের ক্লাস আলাদা। ইউ ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড সাচ থিংস।

নিশীথের দিদি-জামাইবাবু চোখ চাওয়া-চাওয়ি করে মুচকি হাসি হাসল। নিশীথ-ঈশার সম্পর্ক ওদের কাছে জলের মতো পরিষ্কার। এবং ঈশার অপমান ওরা উপভোগ করেছে। জামাইবাবু যদি এখনও পিঠ চাপড়ানো ভঙ্গিতে বলেনও— ‘আহ্, ঈশাকে বলতে দাও না নিশীথ।’ দিদির চমৎকার লাগে ব্যাপারটা। ননদিনি না! যতই বড় হোন বয়সে। তার ওপর সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট-এ আছেন। ব্যাপারই আলাদা। সেখানে একটা গ্র্যাজুয়েট বউ, ভিতু, লাজুক, নরম দেখলেই বোঝা যায় একে বেশ করে ছেঁচা চলে। তা ছেঁচবেন না! অত আহ্লাদ আর কীসে? অত উপার্জন, অত শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, বাইরের জগতে অবাধ বিচরণ কিছুই এঁকে এঁর মৌলিক ননদিনি-স্বভাব থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি।

মার কাছে এ কথাগুলো সে বলেছিল। মা বিষণ্ণ গলায় বলেছিল— ঈশা, যত মানুষ বাড়ছে, প্রতিযোগিতা বাড়ছে, তত মূল্যবোধ পালটে যাচ্ছে। টাকা এবং পদ এগুলোই এখন মানুষের মনুষ্যত্ব ভব্যতা সহবতের পরিবর্ত হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমরা দেখেছি অতি উচ্চপদস্থ ভদ্রলোক, রিজার্ভ ব্যাংকের সম্ভবত অ্যাসিস্ট্যান্ট গভর্নর, আমাদের সম্পর্কে মামাতো দাদা হতেন, কোনও হ্যাঁকো ভ্যাঁকো ছিল না, আর কী স্নেহময় ছিলেন, তাঁর বন্ধুদের মধ্যে কেরানি থেকে প্রোফেসর শিক্ষক, বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে সরকারি অফিসার, কর্পোরেট এগজিকিউটিভ সবাই ছিল, ছিলেন লেখক শিল্পী। সবাইকার সঙ্গে তুই-তুই আর হা হা হাসি। নিজের পদ, অভিজ্ঞতা, টাকা, সম্মান কোনওটাকেই তিনি সোশ্যাল লাইফে টেনে আনতেন না। একটা রাস্তার কুকুর পুষেছিলেন, নাম দিয়েছিলেন কালাচাঁদ। তাকে নিয়ে ভোরবেলা প্রাতঃভ্রমণ, তারপর আধ ঘণ্টা তার ট্রেনিং— কালাচাঁদ উঠে দাঁড়া, কালাচাঁদ বসে পড়। সে এক মজার ব্যাপার। এই সব মানুষ চলে যেতে সব দর্জির দোকানের মানুষের দল এসেছে। পৃথিবী, জীবন, মেলামেশা সবই আনইন্টারেস্টিং হয়ে গেছে রে! উদাসীন ভাবে চল, কারও দেওয়া আঘাত গায়ে মাখবি না, কুকুর ঘেউ-ঘেউ করলে কি গায়ে মাখিস। বড়জোর একটা হ্যাট করিস, এ-ও তাই। সুযোগ পেলে হ্যাট করিস, ছোট্ট করে একটা ঢিল, ব্যস বেলুন চুপসে যাবে, কিন্তু যতক্ষণ কাজটা করার মতো ব্যক্তিত্ব আর ডিট্যাচমেন্ট তৈরি না হচ্ছে, ততক্ষণ কিন্তু ‘হ্যাট’টাও করবি না, ঢিল ছোড়া তো দূরের কথা। কত করে বলেছিলুম ঈশা কিছু একটা কর, কিছু একটা, এম.এ যদি করতে ইচ্ছে না করে, অন্য কিছু শেখ, এখন তো প্রচুর সুযোগ!

ব্যস, ঈশা চুপ। কাজের জগৎকে তার ভীষণ ভয়। একটা ছোট্ট পরিবার, সেখানেই কত কমপ্লিকেশন! তার ওপর কর্মক্ষেত্র! ওরে ব্বাপ! অত জটিলতা সামলানো তার কর্ম নয়। এই সব কথা সে নিশীথকেও প্রথম প্রথম বলত। ওরে বাবা, চাকরি সামলানো তার কর্ম নয়, ওরে বাবা অমুক ভয়ানক কমপ্লিকেটেড, তাঁকে সামলানো তার কর্ম নয়। নিশীথের আমেরিকা-ফেরত আধা সাহেব বন্ধু-বান্ধবীর দল। ওরে বাবা, ওদের অ্যাকসেন্ট বুঝতেই আমার কম্ম কাবার, তারপর ওদের কোনটা রসিকতা, কোনটা ঠোকা, কিচ্ছু বুঝতে পারি না। প্লিজ নিশীথ, তুমি একা যাও।

—একা যাওয়াটা সহবত নয়।

—যা হোক একটা কিছু বলে দিয়ো।

—দে আর নট ফুলস্‌!

গেল ঠিকই। একজন মন্তব্য করল— আই হ্যাভ নেভার সিন আ পার্সন সো সাইলেন্ট। ডাজ শি টক! এভার! ডু ইউ, ঈশা?

উত্তরে শুধু অপ্রতিভ হাসি ছাড়া তার কিছু দেবার নেই। ওদিক থেকে নিশীথ যমের মতো তাকিয়ে আছে।

বাড়ি এসে ফেটে পড়ল। —দে থিংক য়ু আর আ ডাম ডল, নাথিং মোর। দে আর ওয়ান্ডারিং হোয়াই আই হ্যাভ ম্যারেড য়ু।

একটা প্রচণ্ড ধাক্কা।

নিশীথ তুমি কি তোমার বন্ধুদের পার্টিতে নিয়ে যাবার জন্য একজন স্ত্রী খুঁজেছিলে? তো তাই করলে না কেন? যে মেয়ে সর্বত্র স্বচ্ছন্দ বোধ করবে! এরকম মেয়ে আজকাল খুব উঠেছে। আমাকে চাইলে কেন? আমাকে তো বলেছিলে ভালবেসেছ তাই বিয়ে করতে চাইছ। তুমি না এলে আমার কোনও ক্ষতি হত না নিশীথ। এসে গেছ বলে এতগুলো বছর আমার ভয়ে, খারাপ লাগায়, আশাভঙ্গে, হতাশায়, ব্যক্তিত্বহীনতায়, আত্মবিশ্বাসের অভাবে বরবাদ হয়ে গেল। সেই ভয়, ডিফিডেন্স, সেই মোহভঙ্গ তোমরা আমার মধ্যে লালন করেছ। প্রতিমুহূর্তে বুঝিয়েছ আমি কত তুচ্ছ, নগণ্য, অর্থহীন। তার ওপরে খারাপও। কেননা তোমার প্রিয়জনরা আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে আর তাদের সঙ্গে আমি মিশতে পারি না। আরও অর্থহীন হয়ে যাই।

অর্থের পেছনে ছুটি, অর্থ দাও, কোনও অর্থ দাও মনস্কাম

হাত পেতে আছি

ফিরিয়ে নিও না যা যা আছে বলে জানি।

মুষ্টিবদ্ধ হাত

দেব না দেব না, তবু দৈত্যচাপে মুঠি খুলে যায়,

ঝরে পড়ে হাসি গান, ঝরে যায় আশা অনির্দেশ

শুকনো ফুল, ভাঁট ফুল, সে-ও তো তেমন কিছু নয়

মূল্যহীন, অর্থহীন। আছি কিনা তা-ও জানি না এখন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *