মা মেয়ে….

মা মেয়ে….

রায়চৌধুরী বলছিলেন—দেগঙ্গা নামটা কোথা থেকে এসেছে বিচার করতে গেলেই একটা ইতিহাস বেরিয়ে আসবে রঞ্জাবতী। গঙ্গার দুটি ধারা ভাগীরথী ও গঙ্গা দুদিক দিয়ে বইত—তাই দ্বিগঙ্গা। দীর্ঘতার জন্য দীর্ঘগঙ্গা, দেবরূপের জন্য দেবগঙ্গা, এতগুলো নামের মধ্যে কমন কী পেলেন বলুন তো?

—গঙ্গা, আর কী!

—অনেকে আবার বলে গঙ্গা নিমন্ত্রিত হয়ে আসছিলেন রাজার ছেলের অন্নপ্রাশনে, রাজার শত্রু পিরসাহেব তাঁর কানে তুলে দিলেন সেখানে তাঁর জন্য রাঁধা হচ্ছে নিষিদ্ধ মাংস। শুনে গঙ্গা ফিরে গেলেন।

—দেবদেবীরা খুব কানপাতলা হতেন, তাই না? রাজা কর্ণেন পশ্যতি বলে একটা কথা আছে ঠিকই। কিন্তু রাজার কানে যে কোনও কথা তুলে দিলেই তার সত্যাসত্য বিচার না করে তিনি যদি তার ওপর অ্যাকশন নেন তা হলে তো সর্বনাশ! তা এত যে গঙ্গা গঙ্গা করছেন এদিকে গঙ্গা কোথায়!

—ওপারে শ্মশান আছে দেগঙ্গার, তার পাশে একটা সরু সোঁতামতো আছে, ওইটেই গঙ্গার পদচিহ্ন। আপনাকে দেখাব এখন। কিন্তু তার চেয়েও ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল ওই গঙ্গা বা গঙ্গে। এটাই কি সেই আদি গঙ্গারিডি, পেরিপ্লাস যার বর্ণনা করেছিলেন? বিনয় ঘোষ বলছেন দেবগঙ্গা, দেগঙ্গা, দেবালয় ও অন্যান্য স্থানীয় স্মৃতি থেকে মনে হয় গ্রিকদের বর্ণিত প্রাচীন গঙ্গারিডি জাতি ও রাজ্যের সঙ্গে দেগঙ্গা আর চন্দ্রকেতুগড়ের সম্পর্ক আছে। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে পেরিপ্লাস একেই প্রাচীন বাণিজ্য নগরী গঙ্গা বলছেন। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে টলেমি বলছেন গঙ্গারিডাই। কুঞ্জগোবিন্দ গোস্বামী মশাইয়েরও এই মত।

—নিজের দ্যাশ তো তাই খুব গুণ গাইছেন।

রায়চৌধুরী হাসলেন। —আরে পুরো চত্বরটাই ধরুন দেগঙ্গা দেউলিয়া, চন্দ্রকেতুগড়, খনামিহিরের ঢিপি মিলিয়ে একটা প্রত্নভূমি। রাশি রাশি গল্প, কাহিনি লোকের মুখে মুখে ফেরে। শোনাব এখন আপনাকে। ইন ফ্যাক্ট লিখে ফেলতে হবে, কো-অর্ডিনেট করতে হবে।

প্রত্নভূমি কোনটা নয়! সারা ভারতবর্ষই এক অতি প্রাচীন ভূমি। তার মাটির স্তরে স্তরে সাজানো আছে সভ্যতার পরতের পর পরত। একবার বুডাপেস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপককে নিয়ে পাণ্ডুয়া দেখাতে গিয়েছিল। এক জায়গায় ভদ্রলোক খুব একটা ঠোক্কর খেলেন, আধলামতন ইটের টুকরো, খুঁড়ে সেটাকে তোলা হল, —একটা চিত্রিত পোড়ামাটির ট্যাবলেট। দেখে ভদ্রলোক কী মুগ্ধ, কী উত্তেজিত। — তোমাদের দেশ থেকে যখন তখন যেখান সেখান থেকে এইরকম সব আশ্চর্য জিনিস বেরোয়। আমাদের কোনও সভ্যতা নেই। যদি বা আছে তার কোনও প্রাচীনতা নেই। রহস্য ছাড়া স্বপ্ন ছাড়া অতীত ছাড়া একটা গদ্যময় দেশ।

রঞ্জা হেসে বলে— তোমরা আমাদের অতীত নিয়ে মুগ্ধ। আমরা তোমাদের বর্তমান দেখে লুব্ধ, ভবিষ্যতের কথা ভেবে উত্তেজিত বোধ করি। কারও অতীত থাকাটা কেন এত গর্বের আমি বুঝি না। লক্ষ বছর পরের মানুষ মাটি খুঁড়ে তোমাদেরই সভ্যতার চিহ্নগুলো পাবে। উত্তেজিত, প্রদীপ্ত হবে। আমাদের এই সব অতীত তখন ধুলো হয়ে গেছে। সবটাই আপেক্ষিক, সময়ের ব্যাপার। মহাকালের বিচারে সবই প্রায় সমকালীন, নয়?

যতই বলুক, আমরা তো মহাকালীন নই। আমাদের সভ্যতার প্রাচীনতা নিয়ে আমরা গর্বিত হতেই পারি। রঞ্জা অন্যমনস্ক হয়ে গেল। সেই প্রাচীন, কী বলছে? যক্ষীমূর্তি। বিপুলস্তনী, নিবিড়নিতম্বিনী, অলংকৃতা, গোলমুখ, চোখে স্নেহদৃষ্টি,— চন্দ্রকেতুগড় বা গঙ্গারিডির লোকেরা কি এই যক্ষিণী পূজা করত? মাটির পাত্র নানা আকারের, ঘট, তার নলটি ভেঙে গেছে। একটু অন্যরকম দেখতে বদনা। এই নল দিয়ে দেবদেবীর মাথায় জল ঢালা হত। দেবদেবীদের মাথা বোধহয় খুব গরম, ব্লাড-প্রেশার সব সময়ে চড়ে থাকে, তাই-ই কি জল বা তরল ঢালার ব্যবস্থা? নাকি তাঁদের জগতে স্নানঘর, হামাম নেই? সে জন্য মর্ত্য মানুষদের হাতের ভক্তিধারা জলধারার জন্যে অপেক্ষা করতে হয়!

দেবদেবী কারা! আমাদের বিশ্বাস, আমাদের নিজহাতে গড়া স্বপ্নপ্রতিমা, নিজেদের বিশ্বাসকেই আমরা স্নান করাই। আরতি করি, ভোগ নিবেদন করি। অনাদি অতীত থেকে মানুষ এই করে আসছে। আমার এ ঘর বহু যতন করে / ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে…। কী জানি সে আসবে কবে! কবে তার মনে পড়বে আমায়! নিজের ভরসা, নিজের মহত্ত্ব, নিজের ক্ষমতার সঙ্গে মানুষের এই বিরহ কতকালের।

রায়চৌধুরী বললেন— আসুন রঞ্জা। ইনি নিবারণ বিশ্বাস। ইনি একরাম আলিসাহেব, সব এসে গেছেন।

নমস্কার করল রঞ্জা— এঁরা সত্যিই নমস্য। নিবারণ বিশ্বাস স্থানীয় স্কুলের শিক্ষক, একরাম আলি মাদ্রাসার। দেগঙ্গা, দেউলিয়া ও কাছাকাছি গ্রামগুলিতে প্রচুর মুসলমান থাকেন। এঁদের দুজনের বিশেষত্ব হল— এঁদের বাপ-পিতামহ যে সংগ্রহ করে গেছেন এঁরা সাবধানে সেগুলোর সংরক্ষণ করছেন। কেউই টেকনিক্যাল লোক নন। ইতিহাসের সঙ্গেও কোনও সম্পর্ক নেই। খালি দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে এক ধরনের ইতিহাসবোধ গড়ে উঠেছে। নিবারণ নিজের একটি লেখা পুরো খাতা রঞ্জাবতী দত্তকে পড়তে দিয়েছেন। রঞ্জা পড়ছে। সে খুবই কৌতূহলের সঙ্গে নিবারণের দিকে তাকাল। খেলনাগুলো দেখুন— নিবারণ সসম্ভ্রমে বললেন।

ছোট ছোট জন্তুজানোয়ার। ভেড়ার মুন্ডু, খোকাপুতুল, মাটির গাড়ি, মৃচ্ছকটিক। সেই মাটির গাড়ি যা নিয়ে শূদ্রকের নাটক। খেলনাটা আজও স্মরণ করিয়ে দেয়। গাড়ি ছোটদের ভীষণ প্রিয়। বাচ্চাদের গাড়ি চাই। কত রকমের মোটর, এরোপ্লেন, জাহাজ, জিপ যে বাচ্চাদের উপহার দেওয়া হয় আজকাল। তাদের গাড়ি-প্রীতি কি আদি মানবের প্রথম চাকা-আবিষ্কারের সঙ্গে কোনও ভাবে জড়িত! কতরকম ভাবে গাড়িগুলোকে নিয়ে খেলে ওরা। তার নাতনি শায়রী মামার বাড়ি এলেই তার সঙ্গে সঙ্গে তার গোটা বারো গাড়ি আসবেই। চাকাগুলো মাটিতে ঘষে ঘষে শব্দ করে ছেড়ে দাও— হুস করে ছুটে যাবে, টেবিলের পায়ায় লেগে গেল। সবটাতেই আনন্দ। চাকারই যত কায়দা, যত জাদু! গাড়িটার সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সে। গাড়িটাতে আর শায়রীতে অভেদ হয়ে যাচ্ছে। সে দেখতে পাচ্ছে— আড়াই তিন থেকে পাঁচ ছ’ বছরের শায়রীকে, মাথায় অল্প কোঁকড়া চুল। অনাবিল চোখ— সুন্দর নরম ছোট ছোট হাত। কবজির কাছে একটি মোহন ভাঁজ। হাতের থাবায় ধরা একটা নীল মার্সেডিজ। নিষ্পাপ শিশু এখনও যে জানে না, বোঝে না তার জনক তার জননীকে বলে দিয়েছে সে তাকে আর ভালবাসে না। কথাটা কি কথার কথা? সাময়িক বিরক্তি প্রকাশ করতে চেয়েছে নিশীথ? অসম্ভব ক্ৰোধী, উত্তপ্ত ধরনের মানুষ, আজকাল কথা বললে, টেলিফোনের মধ্য দিয়েও একটা আঁচ টের পাওয়া যায়! চাকরিতে ফটাফট উন্নতি করছে। পরিশ্রমও করছে তার জন্যে। কিন্তু এই হঠাৎ পরিবর্তন নিশীথের কি উচ্চপদের, টাকার গরম? নিজের জামাইকে এত অপরিশীলিত ভাবতে খারাপ লাগল বড্ড। এত সাধারণ ও? হঠাৎ তার মনে হল —বেশির ভাগ মানুষই কিন্তু এইরকমই! কোনও আর্থিক উন্নতি হলে মাথার ঠিক রাখতে পারে না। বেশির ভাগ মানুষই খুব কৃত্রিম, সংস্কারবদ্ধ, কতকগুলো পূর্ব ধারণার মধ্যে ভীষণ ভাবে সীমাবদ্ধ। এই নিশীথ, নিশীথের বাবা জজসাহেব, আরও এই জাতীয় অনেক আত্মীয়-স্বজন এইরকম। ছকে-বাঁধা মানুষ। কাঠ-কাঠ কথাবার্তা। ভেতরে কিছু নেই। কনভার্সেশন করছে। কিংবা সোশ্যালাইজ করছে। আসল মানুষ কিন্তু চারপাশে অনেক দেখা যায়। এই নিবারণ বিশ্বাস, এই একরাম আলি— জজসাহেবের বৈঠকখানায় হয়তো বেমানান। কিন্তু এদের জ্ঞান, নিষ্ঠা, শিক্ষা— অনেক জজ-ব্যারিস্টারের থেকে এদের বেশি মানবিক এবং গুণী করে তুলেছে। মূল্যবোধগুলো যেন কেমন গুলিয়ে যায় তার। কে জানে এরা আবার বাড়িতে স্ত্রী, ছেলেমেয়ের সঙ্গে কীরকম ব্যবহার করে। সুবীর বা নিশীথও তো তাদের চাকরিস্থলে সুভদ্র বলেই খ্যাত।

কীরকম খাপছাড়া ভাবে সে জিজ্ঞেস করল— নিবারণবাবু আপনার ফ্যামিলি কী? একটু অবাক হয়ে তাকাল নিবারণ। লাজুক হেসে বলল বিয়ে-থা হয়ে ওঠেনি এখনও। মা আছেন, এই সব নিয়ে ভালই আছি।

একরাম আলি বললেন— আমার বিবি আমায় খুব হেল্‌প্‌ করেন দিদি। আমি তো চাকরি বাদে এই সব নিয়েই আছি। এতে কারও কোনও নালিশ নেই। সংসার তিনিই সামলান। আমি কিছু দেখি না। বোঝলেন না?

একরামের থেকে নিবারণের বয়স কম। কিন্তু চল্লিশ নিশ্চিত ভাবে পার হয়ে গেছে। তার দিকে তাকিয়ে নিবারণ হেসে বললেন— যদি এসব দেখাশোনার লোক তৈরি করতে না পারি, জাদুঘরের কিউরেটরকে ভার নিতে বলব। আপনার ভয় নেই দিদি।

রঞ্জা হাসল। যেন সে এই জন্যেই প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করেছিল। ভেতরের কোন আলোড়ন থেকে প্রশ্নটা বেরিয়ে এসেছে তা এরা ধরতে পারেনি। পারার কথাও নয়।

বিয়ের সময়ে যা যা দিয়েছিল খুব পছন্দ করে, যত্ন করে, ভালবেসে দিয়েছিল। নিশীথের বাবা-মা বললেন— যা দিয়েছেন সব অতি সুন্দর, তবে সবচেয়ে সুন্দর আপনার মেয়েটি। দেখলে চোখ, মন জুড়িয়ে যায়।

উচ্ছ্বাসটা শ্বশুরেরই বেশি ছিল। জজগিন্নি সায় দিয়েছিলেন হেসে। অত সুন্দর করে, গোলমাল, ত্রুটিহীন বিবাহ— তার পরিণতি এই?

মেয়েটা ছেলেমানুষ ছিল, ব্যাবহারিক জীবনের সম্পর্কে জ্ঞান ছিল না। সে কিন্তু বলেছিল কথাটা। আমাদের এখন এই একটিই সন্তান দাদা, খুব আদরের। আমরা কখনও বকা-ঝকাও করি না। একটু আতুপুতু করেই মানুষ বলা চলে। একটি সন্তান তো….

বুকটা হঠাৎ মুচড়ে উঠল। বিষাণ চলে যাচ্ছে। অদ্ভুত দুর্বোধ্য অসুখ। গ্যালপিং হেপাটাইটিস। কিচ্ছু করা গেল না। ছোট্ট শরীরটা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। চোখে অসহায় আর্তি। সে হাত ধরে বসে ছিল, নার্সিং হোমে বেডের পাশে। বাবা পায়চারি করছে। মেয়ে মামার বাড়ি রয়েছে। রোজ ভাইকে দেখতে এসে মুখ শুকনো আমসি হয়ে যায়। আমি আছি, আমরা আছি বারবার বলছিল সে, চোখে স্নেহ মেখে। আশ্বাস মেখে তাকিয়ে ছিল নির্নিমেষ। মায়ের চোখের আশীর্বাদ ভালবাসা ব্যাকুলতার যদি কোনও সাইকিক প্রভাব থাকে তা হলে বিষাণ ভাল হয়ে যেত। বোধহয় নেই। মায়ের সর্বস্ব দিয়েও বোধহয় সন্তানকে রক্ষা করা যায় না। বিষাণ চলে যাবার পর বাড়িটা অভিশপ্ত লাগত। ঈশা গুমরে গুমরে বেড়াত। কাঁদত কখনও লুকিয়ে, কখনও প্রকাশ্যে। বাবা-মা যে তাকে জড়িয়ে ধরবে, তাকে আশ্রয় দেবে, আশ্বস হয়ে আশীর্বাদ হয়ে সঙ্গে থাকবে, ঘিরে থাকবে —এতে আর আশ্চর্যের কী আছে? —অনন্তকাল থাকত বুকের ভেতর। না-ই করত বিয়ে। তাতেও তার কিছু মনে হত না। কিন্তু বিয়ে করলে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে, নিজে পরিণত হয়ে, সচেতনে বিয়ে করো। তা না, দু-চারটে মিষ্টি কথায় ভুলে— মেয়েটা মা-বাবার নিশ্চিত নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছেড়ে গেল? একটা মাটির পুতুলের মতো, কাদামাটির পুতুল। তাকে ওঁরা ভালবেসে যা গড়তেন তাই-ই হত। ভালবাসার অত অভাব ঘটে কেন পরিণত বয়স্ক মানুষের? কী করেছিল ওরা তিনজনে মিলে মেয়েটাকে যে দিনে দিনে মেয়েটার চোখের দৃষ্টি বদলে যেতে থাকল! ওইটুকু মেয়ে। বিষাদে মগ্ন। মাঝে মাঝে আবার সামান্য কারণে ঝেঁঝে উঠছে। কোথাও কিছু একটা বেসুর বলছে। বুঝতে পারছিলেন কিন্তু উত্তর পাচ্ছিলেন না। জিজ্ঞেস করলে ওই ঝাঁজ। ‘এত দিন তো প্রোটেকশন দিয়ে দিয়ে বড় করেছ, এখন আমাকে নিজেকে বুদ্ধি খাটিয়ে বাঁচতে দাও না!’ শাশুড়ি-শ্বশুর যত চোখ গরম করছেন ও তত মুষড়ে পড়ছে। অসহযোগ চালাচ্ছে। এ ভাবে হয় না ঈশা, এখনও কোনও কোনও ফ্যামিলি উনিশ শতকের প্রথমাংশে বাস করছে, বিশ শতকের শেষ দিকে মাথা, মগজ, কিন্তু উনিশে পা। তার ফলে এসব মানুষকে বোঝা যায় না। এদিকে যন্ত্রপাতি, কম্প্যুটার গুলে খেয়েছে। কাঁটা-চামচে খায়, বাড়ি পশ্চিমি কায়দায় সুসজ্জিত, কুঁচিয়ে পরিপাটি শাড়ি পরা মহিলা, প্যান্টশার্ট পরা বয়স্ক পুরুষ পায়ের ওপর পা তুলে চশমা পরা বুদ্ধিমান বসে আছেন, লোকের হাত দিয়ে ট্রেতে চায়ের সরঞ্জাম এল, মহিলা চা তৈরি করে দিলেন। সব ঠিকঠাক আছে। কিন্তু সেই সব মানুষই বউয়ের খাওয়ার দিকে শ্যেনদৃষ্টি ফেলে রাখেন! ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হলে কথা বন্ধ করে দেন! বরের সঙ্গে বেরিয়ে খেয়ে এলে বা দেরি করলে, খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাজার কথা শুনিয়ে দেন, ছেলেকে নয়, বউকে। এ কবেকার মনোবৃত্তি! বাড়িতে অন্য বাড়ি অন্য সংসার থেকে একটা সোঁদা মেয়ে এসেছে, নিজের মা-বাবা-পরিবেশ ছেড়ে, তার প্রতি মমতা, সৌজন্য, এগুলো তো থাকবেই। তোমরা সকলে একসঙ্গে, সে একা। তার অভ্যাস, তার ভিন্নতার সঙ্গে মানাবে তোমরা, মানাবার কাজটা শুরু করার দায়িত্ব তোমাদের হে জজসাহেব, একটা উনিশ-কুড়ি বছরের অনভিজ্ঞ কিশোরীপ্রায় মেয়ের নয়! নয়! কখনওই নয়! তোমরা যা করেছ তা শুধু কাণ্ড-জ্ঞানহীনতার পর্যায়ে পড়ে না। চূড়ান্ত হৃদয়হীনতা, অমানবিকতার স্তরে চলে গেছে সেটা। আমার কল্পনায় কিছুতেই আসছে না।

এ ভাবে হয় না ঈশা! যে উনিশ শতকের মানুষ, তার বাড়িতে উনিশ শতকীর মতোই তোমাকে থাকতে হবে। সেখানে অভিমান দেখিয়ে কোনও লাভ নেই। স্নেহ ভালবাসা প্রত্যাশা করে কোনও লাভ নেই। যা বলছে নীরবে করে যাও, প্রশ্ন কোরো না। তারপরও হাসিমুখে থাকো— কেন বলনি মা? ওই আপাত-আধুনিক বাড়িতে প্রাচীনতা বাসা বেঁধে আছে! বললে শিখিয়ে দিতে পারতাম প্রশ্নহীন বাধ্যতা দিয়ে প্রাথমিক বাধাগুলো জয় করে অবশেষে কী ভাবে এসব মানুষকে খানিকটাও অন্তত মানবিকতার দিকে আনতে হয়! সবচেয়ে মজার কথা হল— নিজেদের বউমার কাছ থেকে এঁদের দাবি, প্রত্যাশা এত বেশি, তাকে এত নিচু চোখে দেখেন সে মাংসের কিমা-কারিটা ভাল রাঁধতে পারেনি বলে! কিন্তু ওঁদেরই আত্মীয়-বাড়িতে বউয়ের সাত মাসের দামাল ছেলেকে শাশুড়ি একলা সামলান। সামান্য কিছু চাকরি করে মেয়েটি। তার কত আদর! গায়ে আঁচটি লাগতে দেন না। রবিবার যদি কিছু রাঁধে সে শাশুড়ি দেখিয়ে তো দেনই, খেতে বসে সবাই তাকে উৎসাহ দেয়— দারুণ হয়েছে, দারুণ হয়েছে বলে। ছেলেকে রেখে ছেলে-বউ সিনেমা-থিয়েটার যাচ্ছে, তাঁদের তো কোনও নালিশ নেই! আজকাল বেশির ভাগ ভদ্র, শিক্ষিত বাড়িতেই এইরকম। স্বাভাবিক। তার ভাগ্যে, ঈশার ভাগ্যে সেই একটিমাত্র অস্বাভাবিক বাড়িতেই বিয়ে হতে হল?

রাত্রি ন’টায় দরজায় বেল শুনে খুলে দিলেন সঞ্জয়। রঞ্জা দাঁড়িয়ে।

—কীরে? এত রাতে?

আঁচল দিয়ে মুখ মুছে রঞ্জা বলল চন্দ্রকেতুগড় মানে দেগঙ্গার ওদিকটায় কাজে গিয়েছিলুম। তোমাদের বাড়িটাই আগে পড়ল দাদা, খুব ক্লান্ত, বুঝলে? মা কোথায়? বউদি কোথায়?

—আয় আয়!

—বাড়িতে একটা ফোন করে দিই আগে— রঞ্জা ভেতরে ঢুকেই মোবাইল বার করল— হ্যাঁ, শোনো, আমি আজ মায়ের কাছে থেকে যাচ্ছি। না অসুখ-বিসুখ কিছু না। জাস্ট খুব ক্লান্ত। সব ঠিক আছে। ফ্রিজে। হ্যাঁ, প্লিজ, সেটাই বলছিলুম। যদি বাই চান্স ল্যান্ড লাইনে ফোন করে কেউ আমার মোবাইলটা দিয়ে দেবে। ঠিক আছে?

…বউদি বলল— কী যে করিস! হঠাৎ! সুবীর যদি কিছু মনে করে?

—কী আবার মনে করবে বউদি! সে-ও তো যাচ্ছে! লেকচার, সেমিনার, সেবার বাঁকুড়া গিয়ে ফিরতে পারল না, রাত দশটায় ফোন। আমি কি কিছু মনে করেছি!

—ওর কথা আলাদা!

—বা! বা! ওর কথা আলাদা কেন? ও সেমিনার করতে গেছে! আমিও প্রাচীন ধ্বংসস্তূপ মাড়িয়ে মাড়িয়ে সভ্যতার খোঁজে গেছি। আমারটা আরও কষ্টকর। এখানে থেকে আবার কসবায় ফিরতে হলে… আজ ভীষণ জ্যাম।

মায়ের ঘর থেকে ভেসে আসছে…

ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রম্‌ ইহা বিদ্যতে।

তৎ স্বয়ম্ যোগসংসিদ্ধঃ কালেনাত্মনি ভিন্দতি।।

শ্রদ্ধাবান লভতে জ্ঞানম্ তৎপরঃ সংযতেন্দ্রিয়ঃ।

জ্ঞানং লব্ধ পরাং শান্তিম্ অচিরেণাধিগচ্ছতি।।

চতুর্থ অধ্যায় কি? মা জ্ঞান ও শ্রদ্ধার মধ্যে বিহ্বল দাঁড়িয়ে আছেন। জ্ঞান নয়, শ্রদ্ধাও সহজ নয়, নিষ্প্রশ্ন শ্রদ্ধা! মা কি পারবেন?

—এই রাত ন’টায় এখনও মায়ের পুজো শেষ হয়নি বউদি?

বউদি একটা মুখভঙ্গি করল— আজকাল সারা দিন রাতই তো পুজোর মধ্যে আছেন। কী যে হয়েছে!

দাদা বলল— বুড়ো মানুষ, পুজো-টুজো নিয়ে থাকাই তো ভাল!

—শাড়ি-টাড়ি বার করে দিই? —বউদি জিজ্ঞেস করল!

—উঁহু। এই যে আমার ব্যাগ দেখছ, এতে সবসময়ে অন্তত দুটো চেঞ্জ রাখছি, ধুলো মাখামাখি… যা অবস্থা হয় না ওখানে।

চানঘরে যাবার আগে মায়ের ঘরে উঁকি মারল রঞ্জা। —মা, আমি এসেছি।

মা যদি আগের মতো বলতেন— এসেছ, বেশ করেছ। এখন হাতমুখ ধুয়ে কিছু খাও— তা হলে কিছু মনে হত না। কিন্তু মা বললেন—

হে চন্দ্রচূড় মদনান্তক শূলপাণে স্থাণো গিরিশ গিরিজেশ মহেশ শম্ভো।

ভূতেশ ভীতভয়সূদন মামনাথং সংসার দুঃখ গহনাৎ জগদীশ রক্ষ।

হে পার্বতীহৃদয়বল্লভ চন্দ্রমৌলে ভূতাধিপ প্রমথনাথ গিরীশজাপ

হে বামদেব ভব রুদ্র পিণাকপাণে সংসারদুঃখাৎ জদগীশ রক্ষ।।

রঞ্জা দাঁড়িয়েই রইল, দাঁড়িয়েই রইল। মায়ের স্তব শেষ হল। বইটিকে মাথায় ঠেকিয়ে নমস্কার করে ধীরে-সুস্থে তাকে তুলে রাখলেন বেদবতী, তারপর বললেন— পুজোর সময়ে আমি কথা বলি না রে! আয় এবার!

—আমি আজ থাকব মা, তোমার কাছে। দাঁড়াও চান করে আসি।

—থাকবি? তুই? আমার কাছে! মা যেন তিন সপ্তকে বললেন। খাদ থেকে চড়ায় উঠছে বিস্ময়। থাকাটা প্রথম বিস্ময়, ‘তার’ থাকাটা দ্বিতীয় বিস্ময়, ‘তাঁর’ কাছে থাকাটা তৃতীয় বিস্ময়। পুরোটা পরিষ্কার বুঝতে পারল রঞ্জা। রঞ্জা যে কবে শেষ থেকেছে এখানে তাকে ভেবে বার করতে হবে, তারপর নোটিশ ছাড়া, আর মায়ের কাছে থাকা! মা স্কলার মেয়ের কাছে নিজেকে আজকাল বড় অযোগ্য মনে করছেন। শুধু মেয়ে নয়, মেয়ে ছেলে সব্বাই। কী বিষয়ে যে ওরা কথা কয়! সেভেন হানড্রেড বি.সি. চর্যাপদ, ত্রিপিটক। মাদার বোর্ড, মাউস, গ্লোব্যালাইজেশন, গ্রিন হাউজ এফেক্ট। সেনসেক্স বেড়ে যাওয়া কমে যাওয়া… অজস্র শব্দ, অজস্র শব্দবন্ধ নাতি নাতনিরা পর্যন্ত, তাঁর কেমন দিশেহারা লাগে। তাই একদা দুর্বোধ্য গীতা-উপনিষদ-চণ্ডীও তাঁর কাছে সহজ মনে হচ্ছে। প্রাণপণে কোনও একটা চেনাজানার সূত্র আঁকড়ে ধরে থাকতে চাইছেন। নয়তো পুরো পৃথিবী ও জীবন, সংসার কাজকর্ম সব কেমন অনর্থক হয়ে যায়।

মায়ের দিকে পূর্ণ চোখে তাকিয়ে সে বলল—বাথরুম থেকে আসছি মা।

ধারাযন্ত্র থেকে জল পড়ে অজস্র ধারায় আর সে বলতে থাকে, জপ করতে থাকে— ঈশা, ঈশা, ঈশা। মা চণ্ডী, মা কমলা, মাতঙ্গী, মা মহিষাসুরমর্দিনী, বগলা, কালী, পৃথিবীর, পৃথিবীর ওপরের স্তরের যত মাতৃশক্তি আছ তোমরা তোমাদের ঈশাকে রক্ষা করো। ঈশা মাত্র অংশত আমার, কিন্তু তোমাদের অংশে যেমন বেদবতীর জন্ম, রঞ্জাবতীর জন্ম, তেমন ঈশারও জন্ম। তোমরা কী করে অপমান, অনাদর সহ্য করবে? ঈশার অপমান কি তোমাদেরও অপমান নয়? তোমরা যদি সাহায্য না করো, আমার একার কী সাধ্য! বলতে বলতে বলতে বলতে রঞ্জা ক্রমশ বাড়তে লাগল, লম্বায়, চওড়ায়। ভেতরের আত্মবিশ্বাসে। তার মুখ বদলে যেতে লাগল। শ্যামলা রং, কখনও ঘোর কালো, কখনও হলুদ বর্ণ ঘামতেল মাখা। কখনও হিমাদ্রিশুভ্র। কখনও বারিধিনীল। দেবতারা যেন তার দশ হাতে দশ প্রহরণ সরবরাহ করতে থাকলেন। চতুর্দিকে ধূপের গন্ধ, ধুনো-গুগ্‌গুলের গন্ধ। পুজোর নানা উপচারের, নৈবেদ্যের আতপ চাল ও ফলফুলুরির গন্ধ। রঞ্জা নিজেকেই নমস্কার করতে থাকে শেষ পর্যন্ত— নমো রঞ্জে, নমো রঞ্জে। রঞ্জাবত্যৈ, সর্বার্থসাধিকে। যা দেবী সর্বভূতেষু রঞ্জাবতী রূপেণ সংস্থিতা/ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমহ্‌।

দরজায় টোকা পড়ছে।

—রঞ্জু তোমার হল? কতক্ষণ চান করবে?

—যাই বউদি।

ছোট চুল সম্পূর্ণ ভিজিয়ে মাথায় তার নিজস্ব হলুদ তোয়ালে স্বর্ণমুকুটের মতো জড়িয়ে, লাল চোখ, সিক্ত, স্নাত রঞ্জা বেরিয়ে আসে।

—কী কাণ্ড! তোমার যে চোখ টকটকে লাল হয়ে গেছে।

—বড় গরম, বড় নোংরা, ধুলো, ময়লা বউদি…

বড় কষ্ট, বড় যন্ত্রণা। বড় বিবমিষা, বড় কাদা, নিষ্ঠুরতা… এগুলোকে পালটে নিয়ে বলল সে। কিন্তু এমন একটা করুণ ব্যাকুল অথচ ওজোময় ভঙ্গিতে বলল যে বউদি অবাক হয়ে রইল।

খাটো গলায় জিজ্ঞেস করল— সুবীরের সঙ্গে আবার ঝগড়া করেছ?

—সুবীর? কেন? তুমি কি পাগল হলে?

বউদির দোষ নেই। সুবীরের সঙ্গে তার সম্পর্ক বড়ই কথা কাটাকাটির। যত দিন যাচ্ছে সুবীরের ইগো এবং তাকে সব ব্যাপারে দায়ী করার প্রবণতা বাড়ছে। বুবুনের চলে যাওয়া তাদের উভয়ের জীবনে একটা প্রলয়ংকরী ঘটনা। কোনও দিন তারা ভুলতে পারবে না। কোনও দিন যন্ত্রণা থামবে না। কিন্তু কষ্টের প্রকাশ দুরকম।

—তোমারই জন্যে। সুদ্ধু তোমার জন্যে। —স্কুলে আলুকাবলি, চাট, ফুচকা খাওয়ার পয়সা না দিলেই চলছিল না? —সুবীর বলে। যেন যন্ত্রণার সমস্ত ভার, ছেলের মৃত্যুর পুরো দায় রঞ্জার ওপর চাপিয়ে দিলে তার শোক কমবে। এসব সময়ে সে ভাবে না রঞ্জা মা। ছেলেটার জন্ম দিয়েছিল বড় কষ্ট করে।

কেউ জানে না কোথা থেকে এই মারাত্মক সংক্রমণ হয়েছিল। রাশি রাশি বাচ্চা খাচ্ছে, তাদের কারও কিছু হল না, হল একমাত্র ওরই? ডাক্তার একবার বলেছিলেন— স্পট করবেন কী করে, বাচ্চারা তো কত কুপথ্যই খায়। ধুলোমাটিও খায়, নোংরা হাত না ধুয়েও খায়, এসব ভেবে লাভ নেই। আমরা চেষ্টা করেছিলাম, পারিনি, ফেলিওর।

রঞ্জা কার ওপর তার রাগ ঝাল ঝাড়বে? সে শুধু কাজে নিজেকে ডুবিয়ে দেয়। কাজ কাজ আর কাজ। মাঝে খুব সামান্য অবকাশ। ইতিহাসের ধারা, সভ্যতার মহাধারা খুঁটিয়ে লক্ষ করার কাজ। এই হাজার হাজার বছরের তুলনায় আমি, আমার জীবনই বা কতটুকু আর আমার শোকেরই বা সেখানে বুদ্‌বুদের চেয়ে বেশি কী অস্তিত্ব আছে! বুবুন ভয় নেই বাবা, আমি আসছি। আর কত দিন? দশ বছর, বড়জোর কুড়ি… কিছুই নয়। তারপর আমি ইতিহাসবেত্তা স্কলার নয়, শুধু গৃহিণী নয়, প্রিয়া নয়। শুধু মা, শুধু জননী হয়ে তোর কাছে যাব। দু হাত বাড়িয়ে কাছে আসিস। শুনেছি তো আমাদের কুড়ি বছর সেখানে সামান্য কয় পল! এই কটা দিন অপেক্ষা করে থাক, তারপর আমরা শুধু মজা শুধু হাসি শুধু খেলায় কাল কাটাব। এটাই তার সান্ত্বনা, যন্ত্রণার প্রলেপ। তারও তো পঞ্চাশ হয়ে গেছে, দুর্ভাগ্য হলে দীর্ঘতর জীবন, না হলে টুক।

জীবনকে ভালবাসার মন্ত্র জপ করে সবাই। জীবন কত সুন্দর, পৃথিবী কত সুন্দর। জীবন এতই মোহময় যে শত কষ্ট সত্ত্বেও মানুষ তাকে আঁকড়ে থাকে। রঞ্জার তেমন মনে হয় না। হ্যাঁ পৃথিবী খুব সুন্দর, জীবনকে ভাল না বেসেই বা মানুষ যাবে কোথায়। তার জন্য এত আয়োজন! ভুলে যাও সব, যা কিছু দুঃখ, দুর্দশা, অপমান জীবনে ঘটেছে কালের প্রলেপে সব বিস্মরণ হয়ে যাবে। সে ওই ধ্বংস আর বিস্মরণের সাক্ষ্য প্রতিদিনকার কাজে-কর্মে পায়, বারবার পায়। কোথায় গেল সেই দিন যখন বৃদ্ধ আর্কিমিডিস সিরাকুজের রাজার দরাজ দান-বাসনার উত্তরে বলেছিলেন— দিতে হলে শুধু সরে দাঁড়াও। সূর্য আড়াল কোরো না। আমার চিত্রগুলো ভাল দেখতে পাচ্ছি না। কোথায় গেলেন সক্রেটিস, বুদ্ধ, রৈক্ক, খ্রিস্ট, কোথায় গেলেন এই সাম্প্রতিক সূর্যপ্রতিম রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, শ্রীঅরবিন্দ। কোথায় গেল সেই সব বিশাল বিশাল সভ্যতা! সুমেরু, গ্রিক, রোম্যান, বাইজানটাইন, সিন্ধু সভ্যতা। ঝুলন্ত উদ্যান আর পিরামিডের গরিমা অস্তাচলে। হাম্মুরাব্বি, তৈমুর লং, এই সব বর্বর বীর যারা সভ্যতা কাঁপিয়ে দিয়েছিল— তারা কোথায়?

প্রায় তিন হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা মায়াসভ্যতা শেষ হয়ে গেল ঠিক দু বছরের মধ্যে, ১৫১৯-এ কর্টিজ পা রাখলেন অ্যাজটেক রাজধানী নগরে। প্রতিনিয়ত নরবলি, আর আনুষ্ঠানিক বানানো যুদ্ধের ভয়ংকর রক্তপাতে সিক্ত মায়াসভ্যতা স্প্যানিশদের হাতে আরও রক্তস্নান করে শেষনিশ্বাস ফেলল। ইজিপ্টের গর্ব ধুলোয় মিশে গেল অ্যাসিরীয় অসুর বানিপালের আক্রমণে। লুটের সোনাদানা মণিমুক্তোয় ইন্দ্রপুরীর মতো সাজপরা নিনেভ, নিমরুদের প্রাসাদ? তারাই বা আজ কোথায়? সব শক্তি, রণহুংকার, এবং এবং সব মহাবলী, মহাপুরুষ স্মৃতির অতলে চলে যাচ্ছেন। সেই সব ধ্বংসস্তূপের ওপর নতুন নতুন রক্তক্ষয়ী ক্ষমতার মুখ— হিটলার, চার্চিল, সাদ্দাম, বুশ, ওসামা-বিন-লাদেন…।

আর আমরা সাধারণ মানুষ? সংখ্যায় বেঁচে থাকি, সংখ্যায় মরে যাই। জীবনমৃত্যুর মাঝখানটুকুতে কোনও তাৎপর্যপূণ কিছু ঘটে না। কিছু যা অন্যরকম, যা বিশেষ। চলমান এই জীবনধারার শেষ পর্যন্ত কি কোনও মানে আছে? সুতরাং মরজীবনের অতীত কোনও মায়াময় ছায়া-জীবনের প্রতি বিশ্বাস রেখে যাই, সেখানে হরিপদ কেরানির সঙ্গে অসুর বানিপালের কোনও ঝগড়াও নেই, তফাতও নেই, সেখানে সেই লোকে মায়েরা ফিরে পায় তাদের শিশুসন্তানদের। শিশুরা ফিরে পায় মায়েদের। কেননা সাদ্দাম, হাম্মুরাব্বি না থাকলেও জীবন চমৎকার চলে যায়, কিন্তু মা আর সন্তান একটা অচ্ছেদ্য যুগ্ম। দুয়ে মিলে এক। না হলে জীবন স্তব্ধ।

বেদবতী বললেন—কতক্ষণ ধরে চান করলি রঞ্জা। এত তোর গরম?

—গরম নয় মা। দাহ।

—এখনও দাহ আছে? থাকবে কত দিন? তোর কত দিন বন্ধ হল?

—তা বছর পাঁচ ছয় তো হবেই।

—কারও কারও অমন হয়। গরম যেতে চায় না। আমার মনে হত মাথার ওপর কে আগুনের কড়া বসিয়ে দিয়েছে। আমাদের সময়ে কেউ গ্রাহ্য করত না। আজকাল তো অনেক ওষুধ-বিষুধ বেরিয়েছে। খেলেই তো হয়!

খাটে বসা মায়ের কোলে রঞ্জা মাথাটা গুঁজে দিল, বলল—এই আমার ওষুধ মা।

ভিজে চুলে হাত বুলোতে বুলোতে মা বললেন—অত চুল, এমন করে কেটে ফেললি? একটু মায়া হল না রে?

—কলজে দু টুকরো হয়ে গেল, কিছু করতে পারলুম না মা। তায় সামান্য চুল!

মা চুপ করে গেলেন।

ছেলে গেছে এক, মা গেলেন সেদিন, নাতি যে পরের জেনারেশন— সেও গেছে। তবে বেদবতী কেন বেঁচে আছেন? বিষাণ খোকাকে নিজের আয়ুটা দেবার প্রাণপণ চেষ্টা তিনি করেছিলেন, বাবর যেমন হুমায়ুনকে দিয়েছিলেন বলে শোনা যায়। তাঁর তেমন পুণ্যফল নেই। তাই পারেননি। এখন তিনি নিবিড় গভীর এক ছায়ার মধ্যে একাকী বাস করছেন। গহন, জনহীন প্রান্তর এক, বৃক্ষশূন্য। তবু ছায়াময়। কিছু থাকার ছায়া নয়, না থাকার, নাস্তির ছায়া। সেই ছায়ার গভীর থেকে তিনি একটি বর্ণহীন শীতল হাত বাড়িয়ে দিলেন। মেয়ের মাথার ওপর, হাতের ওপর, পিঠের ওপর। কেন তিনি এই সব ছেলেমেয়ের জন্ম দিয়েছিলেন? প্রথম পুত্র সঞ্জয় ও প্রথম কন্যা মঞ্জুলিকা ছাড়া প্রত্যেকটি অবাঞ্ছিত সন্তান। তিনি দুঃখের সঙ্গে, লজ্জার সঙ্গে স্বীকার করেন। প্রথম সন্তান সঞ্জয় এল, নতুন মাতৃত্বের স্বাদে তখন তিনি গর্বে আনন্দে একরকম হয়ে গিয়েছিলেন, ঠিক কথা। জননী? তিনি জননী? ষোলো বছরের সদ্য প্রস্ফুটিতা তরুণী, নিজেকে অপূর্ণ ভাবতে শিখেছিল। আশপাশে সকলেই বলত কিনা, তি-ন বছর বিয়ে হয়ে গেল? এখনও পোয়াতি হল না, বাঁজা নাকি? সঞ্জয় সেই স্বস্তি। সেই প্রথম নিজের ‘নারীত্ব’ জিনিসটার স্বীকৃতি। তারপর একটা শিশুর দেওয়া কুটি-কুটি আনন্দের খনি তো আছেই। পরের বছর অন্তঃসত্ত্বা হলে, প্রথমবারের কষ্টের কথা মনে করে একটু ভয়, আবার একটু লজ্জা লজ্জা করেছিল, হল আবার ছেলে—রঞ্জিত, দুই পুত্রের জননী, এয়োতি পুত্রবতী বলে তখন খুব খাতির। তৃতীয়বার গর্ভ হল দুবছর পর। রক্তশূন্যতায় ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিলেন একেবারে। মরি-বাঁচি করে জন্ম দিলেন মঞ্জুলিকার। ফুটফুটে কন্যা। আরেক রকমের আনন্দ, আদর, খাতির। কিন্তু তারপর আর চাননি। শরীর ভেঙে যাচ্ছে তবু স্বামী শুনছেন না, প্রবৃত্তির হাতে তিনি অসহায়, ক্রুদ্ধ। রঞ্জা হয়ে রঞ্জনকে দিয়ে ফুল স্টপ। এদের তিনি চূড়ান্ত অনিচ্ছায় সংসারে এনেছেন। আসার পরে কি আর খারাপ বেসেছেন? রঞ্জা তো ছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয়, সর্বক্ষণের সঙ্গী। সে কথা নয়। তাঁর যেটা বিবেকে লাগে, এদের তিনি অনিচ্ছায় জন্ম দিয়েছেন। আর পিতা-মাতার সেই প্রবৃত্তিমূলক অসহায়তার কুক্ষণে জন্ম এদের। এদের প্রতি তাঁর দায়িত্ব যেন তাই আরও বেশি। কই, কাউকে সুখী করতে পারলেন না তো! ওদের অসুখ, ওদের দুঃখ তাঁকে মর্মাহত করে। তিনি দায়ী। আর যিনি দায়ী ছিলেন, তিনি তো সুতো ছিঁড়ে পালিয়েছেন। দুঃখ, দুঃখ, অ-সুখ।

ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে।

পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবা বশিষ্যতে।।

পড়া আছে। অর্থও জানেন। কিন্তু জীবনে তো সে উপলব্ধি হল না। যা হল তা হচ্ছে:

দুঃখ হেথা দুঃখ হোথা, দুঃখ থেকে দুঃখই গজায়।

দুঃখ থেকে দুঃখ নিলে তলানিতে দুঃখই থেকে যায়।।

উপনিষদের বাণীর ঠিক বিপরীত। এসব তাঁর ডায়েরিতে আজকাল লিখে রাখেন তিনি। পছন্দসই বা ভাববার জায়গাগুলোর অনুবাদও করেন। কেউ জানে না তাঁর এই গুপ্ত খাতার কথা।

তিনি বুঝলেন রঞ্জা ফুলে ফুলে কাঁদছে। এ কি বারো বছর আগে মৃত সন্তানের শোকে? নাকি কোনও নতুন ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে!

বেদবতী বললেন—কী হয়েছে রঞ্জা, আমায় বল। বলবি বলেই তো এসেছিস!

রঞ্জা মুখ তুলল, বলল—না মা, কিছু বলতে আসিনি। শুধু তোমার কাছে থাকতে এসেছি। হঠাৎ কেমন ভীষণ মন-কেমন করে উঠল। তুমি তো জানো, এরকম করলে আমি থাকতে পারি না।

—হঠাৎ!

—হঠাৎই! একদম হঠাৎ।

বেদবতী সে কথা বিশ্বাস করলেন না। কিন্তু আর চাপাচাপিও করলেন না। ওদের সমস্যার সমাধান তিনি কি আর করতে পারবেন? খুব জটিল জীবন, সমস্যাও তাই জটিলতর। তিনি শান্ত মানুষ বলেই সবাই জানে। সর্বংসহা। মা সর্বমঙ্গলার মতো দোর্দণ্ডপ্রতাপশালিনী নয়। তাই-ই হয়তো রঞ্জা কিছু বলতে চাইছে না। নিজের সমস্যার সমাধান সে নিজেই করবে, শুধু মায়ের কাছ থেকে নীরবে সান্ত্বনা, সহায়তা, শক্তি সংগ্রহ করতে চাইছে।

ছোটবেলায়, কিশোরবেলায় হঠাৎ কোনও শীতের সন্ধেয় স্কুল বা কলেজ থেকে কেমন আনমনে ফিরত মেয়ে। একদিন গেল, দু দিন গেল, তারপর তৃতীয় দিন মায়ের কোলে মুখ গুঁজে এমনি কান্না। কী হয়েছে রঞ্জা? কাঁদছিস কেন? কেউ কিছু বলেছে?

বলে তো অনেকেই। ছেলেমানুষের হৃদয়ের কথা তো কেউ ভাবে না। বলে দিল—ওমা, সঞ্জয় নাগের বোন তুমি? ও তো দারুণ ব্রিলিয়ান্ট ছিল! কিংবা বলল মঞ্জুলিকা নাগের বোন? ও তো খুব সুন্দর ছিল! কিংবা তোর দ্বারা কিচ্ছু হবে না। এগুলো তো সাধারণ। ধরতে ছুঁতে পারা যায় না। কত দৃষ্টির ভর্ৎসনা, ঔদাসীন্য, কত আচরণের স্থূলতা আছে মানুষের! জিজ্ঞেস করলে রুদ্ধ গলায় রঞ্জা বলত—জানি না মা, মনটা কেমন কেমন করছে। কাঁদি একটু, হ্যাঁ?

তিনি সস্নেহে বলতেন—সেই ভাল। প্রাণভরে কাঁদ, কেঁদে নে। ‘কেন রে তুই যেথা সেথা পরিস প্রাণে ফাঁদ!… এবার তুই একলা বসে পরাণভরে কাঁদ! পাগলা মনটারে তুই বাঁধ।’ গানটা তাঁর বড় প্রিয়, তাঁর অকালমৃত বড়দি লীলাবতী অপরূপ গাইতে পারতেন। কী যে ভরে দিতেন তিনি গানটাতে। তাঁর সদ্যবিবাহিত জীবনের যাবতীয় বেদনা, যাবতীয় আকাঙক্ষার অপূর্ণতা সংগীতে রূপ পেত। কেঁদে আকুল হয়ে যেত লোকে সে গান শুনলে। শুধু জামাইবাবু আর শ্বশুরবাড়ির লোকেদের মন গলত না। ‘আমি বাঁধিনু তোমার তীরে তরণী আমার/ একাকী বাহিতে তারে পারি না গো আর।’ এসব গানের তীব্র গভীর আকুতি তাঁদের কাছে বিপজ্জনক ঠেকল। গানটাও তাঁর কেড়ে নেওয়া হল। লীলাবতী বাপের বাড়িতে হয়তো বছরে দুবার কি তিনবার আসবার অনুমতি পেতেন—তখন গাইতেন। তাঁর দু চোখ দিয়ে ধারা নামত।

চলে গেলেন। মৃত সন্তানের জন্ম দিয়ে লীলাবতী এই বদরসিক পৃথিবী থেকে চলে গেলেন।

বেদবতীর গলায়ও সুর ছিল। দিদির মতো নয়। কিন্তু ছিল। কিন্তু দিদির দুর্দশার উদাহরণ সামনে নিয়ে তাঁর মা-বাবা তাঁকে গানে উৎসাহ দিতে আর সাহস করেননি। যদিও কলের গানের রেকর্ড থেকে তিনি অনেক গানই গলায় তুলে নিয়েছিলেন। একা ঘরে, একা ছাতে, একা কলঘরে গাইতেন।

হঠাৎ রঞ্জা মুখ তুলল—মা, তুমি আজকাল আর গাও না?

মজা হচ্ছে, বেদবতী শ্বশুরবাড়িতে এসে দেখলেন সেখানে গানের বেশ কদর। বিশেষ করে শ্যামাসংগীত। শ্বশুর গাইতেন, স্বামী গাইতেন৷ তখন তিনিও ধরলেন—আর কতকাল রইব বসে, দুয়ার খুলে বঁধু আমার…। কেউ বেরসিকের মতো জিজ্ঞেস করল না বঁধুটি কে, যার জন্য তুমি বসে আছ?

রঞ্জা বলল—একটা গান গাও না মা, সেই যে তুমি একটা অতুলপ্রসাদ গাইতে! ভৈরবীতে বোধহয়!

বেদবতী সঙ্গে সঙ্গে বুঝলেন কোন গানের কথা রঞ্জা বলছে। গান তিনি রঞ্জাকেও শেখাতে কত চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু মেয়ে কাবাডি আর ব্যাডমিন্টন নিয়ে মত্ত। অল্প বয়সটা খেলে কাটাল, তারপর মেডেল, কাপ, শিল্ড-টিল্ড জিতে পড়াশোনায় মন দিল। গান যে অভিনিবেশ, ভালবাসা দাবি করে, রঞ্জা গানকে তা কখনওই দিল না। গানও মুখ ফিরিয়ে রইল অভিমানে। তাই সূক্ষ্ম কাজ, মোচড়, প্রাণ— এসব এল না তার হঠাৎ-গাওয়া গানে। মুড, খেয়াল শুধু। আমি মারের সাগর পাড়ি দেব গো! —কিংবা জয় হোক, জয় হোক, নব অরুণোদয় জয় হোক। এগুলো স্কুল-কলেজের অনুষ্ঠানে কোরাসে গাইতে হত বোধহয়।

তিনি বললেন—আমার কি আর গলায় সুর আছে রঞ্জা, ভাঙা গলা।

—তোমার ওই ভাঙা গলার গানই শুনব মা। গাও না!

ফিসফিস করে তিনি গাইলেন—‘একাকী বাহিতে তারে পারি না গো আর/ আমি বাঁধিনু তোমার তীরে তরণী আমার।’ কতবার কণ্ঠরোধ হয়ে গেল। দম ছুটে গেল, সুর ফসকে গেল, কথা ভুল হয়ে গেল। কিন্তু মেয়ের শান্তির জন্য এসব তিনি অগ্রাহ্য করলেন। মেয়ের জন্য মা কী না করতে পারে! এ তো কিছুই নয়। তা ছাড়া গান তো শুধু সুর নয়। শুধু কথাও নয়। সে শুনছে তার অল্প বয়সে শোনা মায়ের সেই সংগীত। নির্ভুল শুনতে পাচ্ছে। তার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে আজকের এই ভাঙা গলার সুর ফসকানো গান, যেন সারাজীবনের স্বরলিপি এতে লেখা। সেই সমস্তটা—মায়ের জীবনের সমস্ত, তার জীবনের সমস্ত, ঈশার জীবনের সমস্ত সুর-বেসুরের হিসেবনিকেশ যেন এই ভাঙা গলায় পেশ করছেন সুরের হিসেবি কোনও তবিলদার।

গান শেষ করে সামান্য হাঁপাতে লাগলেন বেদবতী। রঞ্জা মায়ের বুকে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। আশি, সামান্য বয়স! নিদারুণ পরিশ্রমের, বিরাম বিশ্রামহীন, বৈচিত্র্যহীন। রুটিনে বাঁধা আশি বছরের ভার। — তোমায় কষ্ট দিলুম মা!

—না কষ্ট কিছু না! একটু দমের অসুবিধে হয়। তা ছাড়া আমি তো চণ্ডী সুর করেই পড়ি রোজ।

বউদি এসে বলল—এবার মা-মেয়ে দুজনেই খেয়ে নাও। রঞ্জা, মা বিকেলবেলা আজকাল চা পর্যন্ত খাচ্ছেন না।

—সে কী? মা!

—কী জানি, মুখে ভাল লাগে না রে। একটু শরবত করে দেয় সীমা, বেশ তো লাগে!

—পৌনে দশটা বাজল মা আজ। —বউদি বলল।

তিনজনে খেতে বসল। দাদার হয়ে গেছে। ছেলে ইন্টারভিউ দিতে বাঙ্গালোর গেছে। বারান্দা থেকে দাদার সিগারেটের গন্ধ আসছে। বউদি উঠে গিয়ে বারান্দার দরজা বন্ধ করে দিল।

খাবার নিয়ে মা শুধুই নাড়াচাড়া করছেন। কপালে সামান্য বিরক্তির কোঁচ।

—মা তোমার খিদে নেই? ভাল লাগছে না?

বউদি বলল—মায়ের আজকাল আমার রান্না মুখে রোচে না। তুমি যদি কাল থাকো তো কিছুমিছু বেঁধে দিয়ো তো! কতরকম করে দিচ্ছি, সবই ওইরকম। বউদির গলার স্বরে নালিশ, ঝাঁজ। সামান্য কিন্তু নির্ভুল।

মা বললেন—আমি তোমায় কতবার বলছি বউমা, দোষ তোমার রান্নার নয়, আমার জিভের! কী যে মুখপোড়া জিভ হয়েছে!

—তা হলে ডাক্তার দেখালেই তো হয়! একটু দেখে—

—থাম রঞ্জা, এই বয়সে আর খাওয়ার জন্য ডাক্তারের কাছে ধরনা দিতে হবে না।

—এইগুলো তোমার অ্যাটিটিউডের ভুল মা। অরুচি ইজ অরুচি। বয়স যা-ই হোক, অরুচি যখন হয়েছে তখন ডাক্তার দেখাতে হবে, ওষুধও খেতে হবে…

রাত অনেক। বারোটা তো বেজে গেছেই। বেদবতী এপাশ-ওপাশ করছেন।

—ঘুম আসছে না, মা?

—নারে। এমনিই তো হয় আজকাল, তবু তো আজ তুই এসেছিস। কাছে রয়েছিস। কত শান্তি! ঘুম আসে না, হয়তো একবার একটু এল… তারই মধ্যে শিরদাঁড়া দিয়ে সড়সড় করে একটা ভয় ওঠানামা করে সাপের মতো। কীসের ভয়? জানি না। মরণকে তো তুঁহু মম শ্যামসমান বলে ডাকছি। এ মৃত্যুভয় নয় রঞ্জা, কী ভয়, কেন জানি না। খালি মনে হয় এই পৃথিবী একটা বিশাল আদি অন্তহীন মাঠ। তার মাঝখানে আমি একা দাঁড়িয়ে আছি। প্রাণপণে ডাকছি—কোথাও কোনও সাড়া নেই। বড্ড ভয় করে। মনে হয় কেউ কাছে থাক। যে হোক কেউ। আজ বড্ড ভয় করছিল তাই আর আমার গীতা শেষ হচ্ছিল না। তুই এলি। গীতার দেবতা আমার প্রার্থনা শুনলেন। আজকে যে আমার কী স্বস্তি। ঘুম না-ই হল। তোর একটা হাত গায়ের ওপর রাখ, সেই ছোটবেলাকার মতো।

রঞ্জা পাশ ফিরে আলতো করে মাকে জড়িয়ে ধরল। আর সঙ্গে সঙ্গে তার মনে পড়ে গেল যুবতী মাকে। এখনকার চোখ দিয়ে যুবতী মাকে দেখতে পেল সে। এমন আপাদমস্তক মাতৃত্বময় মানুষ কমই দেখেছে সে। সুন্দরী নয়। কিন্তু ভীষণ লাবণ্যময়ী। আর স্পর্শটা কী শান্তির। গরমকালে ঠান্ডা, শীতকালে উষ্ণ। পদ্মিনী নারীদের নাকি এটা একটা লক্ষণ। কত বড় বয়স পর্যন্ত এই মায়ের স্পর্শ, গন্ধ, মায়ের রূপ, গলার স্বর জীবনের সঞ্জীবনী শক্তি ছিল। কবে থেকে হৃদয় অন্য স্পর্শ খুঁজল, মায়ের রূপ, স্বর-এর স্বর্গীয় পৃথিবী থেকে সে স্বেচ্ছানির্বাসন নিল! মোটের ওপর সব মানুষেরই এমনটা হয়। কিন্তু সবার স্মৃতিতে এ ভাবে সেই সব ইন্দ্রিয়সুখ টাটকা থাকে না। তার আছে। সে সারারাত ধরে মার বার্ধক্যকুঞ্চিত ফ্যাকাশে দেহটি জড়িয়েও মসৃণ যুবতী মাতৃ স্নেহশরীরের স্পর্শ পেতে লাগল। চোখের সামনে ভাসছে শান্তিপুরি শাড়ির আঁচলের চাবির গোছা মা সশব্দে পিঠে ফেললেন। মা ডাকছেন—মঞ্জু, রঞ্জা, দাদাদের ডাক। খাওয়ার সময় হয়েছে—এ-এ। কে জানে কীসের সময়! খাওয়ারই, না অন্য অজ্ঞাত কিছুর! ঘুমের মধ্যে, ভোরের ঘুমের প্রশান্ত অতলে রঞ্জা অনুভব করল সে মাতৃনাম জপ করছে। মা মা মা মা…।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *