ঈশার অসুখ

ঈশার অসুখ

এখানে সূর্যাস্ত একটু আগেই হয়। পশ্চিমের জানলার কাচে আলো ঝলকাচ্ছে। ছোটবেলায় তারা ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে সূর্যের আলো কেন্দ্রীভূত করে কাগজ পোড়াত। কোণের বাড়ি থেকে কে একটি ছেলে তার চোখ তাক করে আয়না দিয়ে সেই একই কাজ করত। পড়ার টেবিলে সরিয়ে তবে শান্তি। শায়রী ঘুমোচ্ছে। জানলার দিকে তাকিয়ে তার হঠাৎ মনে হল; ওই সূর্যাস্তের পুঞ্জীভূত তাপ কি একমাত্র তারই পশ্চিমের জানলায়? গৃহদাহ হবে না কি? উঠে পড়ে সে বৈকালিক গোছগাছ শুরু করে দিল। জামাকাপড়গুলো ছাত থেকে তুলে পরিপাটি করে পাট করে যার যার জায়গায় রেখে দেওয়া। ঝাড়ন দিয়ে একবার সব কিছু দ্রুত ঝেড়ে নেওয়া। ময়লা, ধুলো, অপরিপাটি সে দেখতে পারে না। বেডকভারের কোণ টেনে দিল সমান করে। এবার এক কাপ চা করে খাওয়া যাক। এখানে ভাল চা পাওয়া যায় না। সব অসম। দুধ চিনি চা পাতা একত্র করে ফোটায় এরা, পুরো ভারতেই প্রায় এই রীতি। চলে যায়। লিকার চলে যায়। কিন্তু মকাই বাড়ির চা যেটা মা পার্সেলে পাঠিয়েছে সেটা একটা ডিলাইট, ঠিক আছে যত দিন থাকে তত দিন চলুক। বুড়োমার মৃত্যুর খবরটা তাকে এত নাড়িয়ে দেবে সে ভাবেনি। চায়ে প্রথম চুমুকটা দিয়ে সে ভাববার চেষ্টা করল মায়ের দিদিমার কী স্মৃতি তার মনে সঞ্চিত আছে। মায়ের মামার বাড়ি প্রতি বিজয়াদশমীতে অবশ্যই যেত। বিচিত্র সব খাবার হত ওখানে। কত রকমের মিষ্টি, মিষ্টির ফুলঝুরি। খাজা, কুড়মুড়ে, খুব মিষ্টি নয়, মালপো, ভেতরটা নরম বাইরেটা কড়া, রসবড়া— রসে টুপুটুপু, এলাচ গন্ধওয়ালা চন্দ্রপুলি, এগুলো মনে করতে পারছে। অদ্ভুত একরকম শুকনো খাস্তা গজা করতেন ওঁরা। সেটা সে খুব ভালবাসত। সব মামি-দিদাই অদ্ভুত ভাল রান্না করতে পারতেন। একটা বড় ঘরে, পালঙ্কের ওপর পিঠে বালিশ ঠেস দিয়ে বসে থাকতেন বুড়োমা। সবাই এলেই নেমে আসতেন, প্রণাম হবে, চিবুক ছুঁয়ে। এটা বোধহয় তার বারো তেরো বছরের স্মৃতি। স্মৃতি খুঁড়লে আরও আগের বুড়োমাকে সে সাদা থান পরে খটখট করে ঘুরে বেড়াতে দেখে। খুব স্পষ্ট করে কেটে কেটে কথা বলতেন। ওঁকে সবাই ভয় করত কি না কে জানে, কিন্তু মানত খুব। মামি-দিদারা সবসময়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে থাকতেন। স্বামী, ভাশুর দেওরদের সঙ্গে কথা বলতেন না। যেমন

—ঈশা তোর ছোটদাদুকে জিজ্ঞেস কর তো অম্বল নেবে কি না।

ছোটদাদু বললেন—ঈশা তোর ছোড়দিদিকে বল অম্বল, আবার দই! দুটো খাব না।

এই ভাবে সাক্ষী মেনে মেনে কথা। একমাত্র সেজদিদা এসব মানতেন না। গরমকালের দুপুর। ফট করে ঘোমটা খুলে ফেললেন। বাপরে, ঘাড়ে একটু বাতাস লাগুক। বুড়োমা বললেন—আরও তো পাঁচটা বউ রয়েছে বউমা। গরমটা কি তোমার একারই? সেজদিদি বললেন— হ্যাঁ মা, সে তো আপনি জানেনই। ও রাঙাঠাকুরপো শোনো, শোনো— শুনে যাও, বলতে বলতে চলে গেলেন।

বুড়োমা বললেন— বেহায়া মেয়েমানুষ! শিখবে না, ওকে কী শেখাব? মা বলত— আরও বুড়োমাকে রাগাবার জন্যে ওইরকম করেন সেজমামি।

ও-বাড়িতেও তো এখন তাদের জেনারেশন এসে গেছে। তারা কী করে কে জানে! মায়ের মামাতো বউদি ও বোন অর্থাৎ তার মামাতো মামি ও মাসিদের সঙ্গে তার যোগাযোগ অনেক দিনই কমে গেছে। যদিও মামিদের মাথার আধ ঘোমটার কথা তার ভালই মনে আছে। সিঁদুর-টিপ, চওড়া সিঁদুর, শাঁখা, ঘোমটা। পাঁঠার মাংসের একটা সুরুয়া রাঁধেন দিদিমা, যেটা তাঁর বাপের বাড়ি থেকে শেখা। এত ভাল— যে মাইলের পর মাইল হেঁটে সেটা খেতে যাওয়া যায়। রাহুল সাংকৃত্যায়ন সে পড়েনি, কিন্তু মাতৃতান্ত্রিক সমাজের কথা যা যা লিখেছেন অদ্ভুত! আজব! মায়েতে মেয়েতে কর্তৃত্ব নিয়ে ঝগড়া! ভাবাই যায় না। মা মেয়েকে মেরেই ফেলল! কে জানে মাতৃতন্ত্রের সেই উত্তরাধিকারটাই শাশুড়িরা পেয়েছেন কি না! নিজের মা আর বরের মা! আকাশ-পাতাল তফাত। তার বন্ধু ইন্দ্রাণীর মায়ের নিজস্ব টাকাপয়সা আছে। থাকেন কানপুরে। যখনই কদমতলায় ওদের বাড়িতে আসবেন, ইন্দ্রাণী, চাকরি করা, বাচ্চার মা একটা, শাশুড়ির খাস দাসীতে পরিণত হবে। আজ মোচার ঘণ্ট করো, কাল থোড় ছেঁচকি। কুমড়ো ফুল ভাজো—ওসব ওখানে খাই না। কোনও দিন একটা উপহারও কিনে দেন না ইন্দ্রাণীকে, তার ছেলেকে, বেশি কথা কী, ফ্যাশনেবল মহিলা কলকাতা এসে বিউটি পার্লারে চলে গেলেন। একবারও খাটাখোটা বউয়ের কালিপড়া মুখখানা তাকিয়ে দেখলেন না। ‘তুমিও চলো বউমা’ —বলতেই তো পারতেন। শুধু তাই নয়। ছেলের সঙ্গে গিয়ে একখানা গাদোয়াল কিনে আনলেন নিজের জন্যে, বাড়িতে যে একটা ইয়াং মেয়ে রয়েছে, একটা বাচ্চা রয়েছে এসব কিছু না।

সে নিজে যে ভয়াবহ ঘূর্ণির মধ্যে পড়েছিল, যার থেকে এখনও বেরোনোর চেষ্টা করে যাচ্ছে, পারছে না। মাকে সে একবারও বলেনি তার এই দুর্গতির কথা। মা কষ্ট তো পাবেই ভীষণ, সেইসঙ্গে বিষণ্ণ চোখে চেয়ে বলবে—আমি তো পড়াশোনাটা শেষ করতে বলেছিলাম ঈশ, কথা শুনলি না। সেক্ষেত্রে বাইরের একটা জগৎ হতে পারত। ছোট জায়গা, অল্প মানুষ। কঠিন নিয়ম। এসবের আবর্তে পড়ে গেলে জীবনটা একটা কুয়োর জীবন হয়ে যায়।

মায়ের সেই ‘বাইরের জীবনে’ যে সে কখনও স্বচ্ছন্দ বোধ করেনি, কেমন করে বলবে মাকে কথাটা? অর্ধেক জিনিস, ভাবনা-চিন্তা অনুভূতি গোপন করে যাওয়াই তার স্বভাব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সামলাতে পারে না। মা, গড়পড়তা মায়ের মতো কোনও দিন জিজ্ঞেস করেনি—শ্বশুর-শাশুড়ি কেমন! এত বোকা মা, সবাইকেই নিজের মতো মনে করে। বাবা-মা তো! বাবা-মার মতোই হবেন! মেয়ে ছিল না, মেয়ে হল, কত আহ্লাদ! স্নেহ-ভালবাসা, আদর—এসব দিতে কোনও বাবা-মার কার্পণ্য থাকবে, মায়ের এটা কল্পনার বাইরে। কিন্তু ওই ভদ্রমহিলা তার প্রত্যেকটি কাজে খুঁত ধরে চেঁচাবেন, কঠিন চোখে তাকাবেন, যেন এক্ষুনি একটা থাপ্পড় কষিয়ে দিলেন বলে।

—না না, রান্নাঘরে তোমায় আসতে হবে না—কর্কশ গলায় বললেন। আসলে যে চাইছেন সে রান্নাঘরেই যাক—কী করে বুঝবে? সে তো অত কুটিলতার মধ্যে মানুষ হয়নি! কাজেই সে গেল না। তা ছাড়া লোক রয়েছে তো!

শ্বশুরের চা দিতে গেল, গর্জন করে উঠলেন—ওঁর চায়ে তুমি হাত দিয়েছ কেন?

হকচকিয়ে যায় সে। ভেতরে একটা রাগ উথলে ওঠে। ব্যাপার কী? ব্যাপারখানা কী রে বাবা, এরা চায় কী?

নিশীথ বলত—একটু মানিয়ে নাও, লেগে থাকো, মা ওইরকম রাগি বরাবর, কাছে কাছে থাকো—ঠিক হয়ে যাবে।

মানিয়ে যে নেব, কীসের জোরে নিশীথ? তুমিই কি তোমার স্ত্রীকে কোনও পূর্ণতা দিতে পেরেছ? বিবাহিত স্ত্রীকে ফেলে তুমি বান্ধবীদের সঙ্গে গল্প করো। হতে পারে তারা আমার চেয়ে চালাক চতুর, খবর রাখে, পাকা ঝানু সব। তুমি তো তাদের বলতে পারতে দেখো, আমার বউ কিন্তু একেবারেই সরল, সাদাসিধে, সে কখনও এত মেলামেশা করেনি। ট্রাই টু পুট হার অ্যাট ইজ। বলারও দরকার করে না। ভদ্রতার নিয়মই হল নতুন কেউ এলে তাকে সহজ করে নেওয়া। নিশীথ তুমি কেন আমাকে বিয়ে করলে? কেন আমাকে ভোলালে? যদি বা করলে কেন সর্বক্ষণ কূট দৃষ্টিতে আমার গতিবিধি নজর করছ! কে তোমাকে বারণ করেছিল ইকনমিক্স-এর ফার্স্ট ক্লাস, কর্নেল ইউনিভার্সিটির উৎপাদনকে বিয়ে করতে! আসলে তুমি-ই কনফিডেন্ট ছিলে না। এত বিদুষী তেজি মেয়ে সে কত দিন তোমার পুরুষ অহমিকা সইত! সে কত দিন তোমার মা-বাবার কর্তৃত্ব সইত? সইত না, সইত না। তুমিও যে প্রভুত্ব করাটাই পছন্দ করো। মালবিকাদির ওপর কর্তৃত্ব চলত না নিশীথ। সে তোমার থেকে অনেক বেশি উপার্জন করত। অনেক উঁচুতলায় ঘোরাফেরা করত, ইভেনচ্যুয়ালি। এবং সেখানে পৌঁছোবার জন্য তোমাকে হাড়ভাঙা ঘোড়দৌড়ে নামতে হত! স্ত্রীর থেকে কম হওয়া কোন পুরুষ সয়? টিকত না। তোমার আত্মাভিমান আর তার আত্মাভিমানে লড়াই লাগত। তোমাকে আমি যতটুকু দেখেছি, তুমি যেটা ঠিক করবে সেটাই হবে, তুমি যা ভাববে সেটাই ঠিক। তোমার সিদ্ধান্তই চরম। এ জিনিস মালবিকাদি কেন সইবে? তার কীসের দায়? প্রেম? প্রেমের দৌড় ন’বছরের বিবাহিত জীবনে, অন্যদের বিবাহ বিশ্লেষণ করে করে করে করে আমার জানা হয়ে গেছে। প্রেম বলে কিছু থাকতে পারে সেই প্লেটোর আদর্শর জগতে। কিন্তু এই নশ্বর পার্থিব জীবনে প্রেম নেই। বোঝাপড়া আছে, দয়ামায়া আছে, সয়ে নেওয়া আছে, সহযোগিতা আছে, কিন্তু প্রেম নেই। প্রেম নেই। প্রেম বলতে কী বোঝায়? সে কী বুঝত? দুজন মানুষ পরস্পরকে গভীর ভাবে চাইবে। শরীরে, মনে। পরস্পরের দিকে যখন চাইবে এমন ভালবাসা মগ্ধতা ঝরে ঝরে পড়বে তা থেকে যে মনে হবে তা একলা ধারণ করতে পারছি না। সবাইকে আলোর মতো বিলিয়ে দিই। কোনও মানুষ, যে সত্যিকারের ভালবাসা পেয়েছে বা বাসতে পেরেছে সে কখনও নীচ হবে না, ইতর হবে না, ঈর্ষাকাতর হবে না। তার স্বপ্নের পুরুষ অবশ্য ছিল পরম সুন্দর। কার মতো? কার মতো! লর্ড বায়রনের ছবি দেখে একদা সে এত মুগ্ধ হত যে বইয়ের পাতা উলটে উলটে ছবিটা খালি দেখত। তারপর যখন মনে হত—এই লোকটি চূড়ান্ত দুশ্চরিত্র, কতজনকে মর্মান্তিক কষ্ট দিয়েছে, তখন তার মন বিমুখ হয়ে যেত। রূপকথার রাজপুত্রদের চেহারা বড়ই মেয়েলি, ছবিতেই ভাল লাগে। সে কল্পনা করে নিতে পারে অর্জুনকে, কৃষ্ণকে—অপরূপ সুন্দর, কিন্তু বহুগামী। চলবে না। সৈয়দ মুজতবা আলিকে অল্প বয়সে দারুণ অ্যাট্রাকটিভ দেখতে ছিল, ওইরকম চোখা চেহারার পুরুষের যে শেষ বয়সে কী দুর্গতি হল, চেনাই যায় না! এমনই তার সৌন্দর্যের দিকে ঝোঁক, যে কোনও অসুন্দর পুরুষকে সে ভালবাসবে—ভাবতেই পারেনি। নিশীথ একজন বেশ ব্যক্তিত্ববান, স্বাস্থ্যবান, বুদ্ধিমান যুবক। তার স্বপ্নে দেখা রাজপুত্তুর নয়। তবু তার প্রাণঢালা ভালবাসা সে দিয়েছিল তাকে। দোষের মধ্যে নির্ভর করেছিল, লতা যেমন গাছকে জড়িয়ে খুশি থাকে তেমনই। দুঃখের বিষয় এ গাছ লতা-টতা পছন্দ করে না। ঝেড়ে ফেলে দিল। কোথায় প্রেমিকের কূজন? কোথায় চোখে চোখে চাওয়া? স্পর্শের বিদ্যুৎ! ফর গডস সেক হোল্ড ইয়োর টাং অ্যান্ড লেট মি লাভ। কোথায়? কিছু উত্তেজিত কথা সহবাসের সময়ে, তারপরে উলটো দিকে ফিরে ঘুমিয়ে পড়লেন। সকালে অফিস যান। রাত করে বাড়ি ফেরেন, ছুটির দিনে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে চান, কিংবা অনন্ত টি.ভি দেখে যান। এর মধ্যে প্রেমের ভূমিকা কোথায়? সে যত্ন করে চা করে এনে দিল। খাওয়ার সময়ে শাশুড়ি ছেলেবউ পাশাপাশি বসে খাওয়া পছন্দ করেন না। মুখোমুখি বসা পছন্দ করেন না, পিঠোপিঠি বসতে পারলে বোধহয় ভাল হত। হনিমুন?

হ্যাঁ—পুরীতে, যে পুরীতে সে মা বাবার সঙ্গে বার চারেক গেছে আগেই। আপত্তি করেছিল—গোয়া চলো না? খুব দেখতে ইচ্ছে করে।

—পুরী হাতের কাছে। চট করে উইকএন্ড-এর সঙ্গে দু দিন জুড়ে নিলেই হবে। গোয়া আউট অব কোয়েশ্চন। তা ছাড়া পুরী ঠিক করেছি, পুরীই যাব। যখন গোয়া ঠিক করব তখন গোয়া যাওয়া যাবে। সব কিছু প্ল্যানমাফিক।

—কখন প্ল্যান করলে গো?

—কখন? অটোমেটিক্যালি হয়ে গেছে বিয়ের আগেই।

সে বেশি যুক্তিপূর্ণ কথা, কথার পিঠে কথা বলতে পারে না। চোর পালালে তার বুদ্ধি বাড়ে। নবদম্পতি হনিমুন যাবে। পত্নীটির পছন্দ-অপছন্দেরও তো একটা ভূমিকা থাকার কথা! দুম করে এল কথাটা তারপর।

—ফর্মালিটিজ, রিচুয়ালস— এসব চটপট সেরে নেওয়াই ভাল।

ফর্ম্যালিটিজ? হনিমুন ফর্ম্যালিটি? রিচুয়াল? হায় ভগবান, এ কেমন ভুল প্রেমের হাতে সে ধরা দিল?

মা কী খুশি! নিজের হনিমুন-টুন হয়নি। মেয়ে হনিমুনে গেছে, না মা-ই তার মধ্যে দিয়ে গেছে বোঝা ভার। চাপা খুশির আলো মুখে নিয়ে— তোদের বোঝাপড়া মানে রিলেশনস ঠিকঠাক হয়েছে তো!

—আঃ মা!

—না রে, সব মা সব মেয়েকে এ-কথা জিজ্ঞেস করে। খুব ইমপর্ট্যান্ট!

মাকে সে লজ্জার মাথা খেয়ে কী করে বলবে তার জামাইয়ের সবই প্ল্যান ও মর্জিমাফিক। তার মর্জি। তারই ইচ্ছে, তারই প্ল্যান—তার বাইরে কিছু নয়। কিচ্ছু নয়।

আমার বড় অসুখ করেছে মা! বড্ড অসুখ। ভালবাসা চেয়ে না পাওয়ার ভীষণ অসুখ। ন’বছরের প্রতিটি মুহূর্ত কেটেছে কোনও অলৌকিক প্রত্যাশায়। ঘটল, এই বুঝি ঘটল। জাদুমন্ত্রে বদলে গেল সব। এখনও এখনও সেই দিবস রজনী কার আশায় আশায় থাকা। এ ভুল মানুষ, ভুল পরিবেশ, আমি নিজেও তো ভুলই। বুঝি, তবু তৃষ্ণা যায় না। চাতকের পিপাসা। স্বাতী নক্ষত্রের জলের জন্য হাঁ করে বসে রয়েছি যেন। কবে সেই একফোঁটা জাদু জল পড়বে, আমার মুক্তি হবে।

আচ্ছা, এই যে বুড়োমার মামি-দিদা, মাসি-দিদা, এমনকী দিদিমা… এঁরা পেয়েছেন? দুর, ওঁরা তো বুড়ো। যখন ওঁরা ছোট ছিলেন? দুর— ওঁদের অত সব আইডিয়াই ছিল না। বালিকা বয়সে বিয়ে হত। ধেড়ে একটা বরের সঙ্গে। বরটার সব জেগেটেগে গেছে, মেয়েটা নেহাতই খুকি। খুকি অবস্থায় সেক্স যে কী ভয়ানক বিতৃষ্ণা জাগায় তা অল্পবিস্তর সব মেয়েই জানে। যাই হোক, প্রকৃতি তো সংযোগ ঘটিয়েই দেয়। সোহাগ খুব। তারপর একটার পর একটা বাচ্চা। প্রেম করেছ কি মরেছ! তখনকার দিনে আবার ঘরের সঙ্গে বাথরুমও থাকত না। হয়তো বা একতলায়, কোণে। কী করে কী করত বাবা সব কে জানে! এক মেয়ে হওয়াতেই যা কষ্ট তার! আগে, পরে। ওঁদের কী হত? দিনের পর দিন খেতে না পেরে, হড়হড় বমি করে, তারপর দিবারাত্র বুকের দুধ খাইয়ে, রান্নাবান্না করে, সংসার দেখে, বড় ছেলেমেয়েগুলো, শ্বশুর, ভাশুর, দেওর, ননদ, নন্দাই… ওরে বাপ রে বাপ! প্রেম বাপ বাপ বলে পালাবে।

তবে কি প্রেম খুব ভঙ্গুর কিছু! রিয়্যালিটির ধাক্কা খেলেই ভেঙে যায়? শকে পুড়ে যায়? থেকে যায় ছাই—বৈচিত্র্যহীন দাম্পত্যের, সহনশীলতার, বিতৃষ্ণাকে কোনওমতে চাপাচুপি দিয়ে রাখার? এমনই তো অভিজ্ঞতা তার বহু বন্ধুর। মাত্র পাঁচ বছর বিয়ে হয়েছে সংযুক্তার, বলে—কিছু মনে করিসনি ভাই, প্রেম করে বিয়ে করেছিলম বটে, কিন্তু বরটাকে দেখলে আমার এখন গা জ্বলে যায়। আমাকে থাকতে হবে স্লিম। সুন্দর, টিপ কাজল পরে ফিটফাট। আর উনি? নোয়াপাতি ভুঁড়ি বাগিয়েছে একটা। সিগারেট খেয়ে খেয়ে আঙুলের ডগা, ঠোঁট ঝাঁজালো, দাঁত তামাটে, মুখে কড়া তামাকের গন্ধ, অনেকের নাকি খুব সেক্সি লাগে, জানি না ভাই আমার তো নিশ্বাস বন্ধ করে থাকতে হয়, তারপর এখন পাওয়া হয়ে গেছে, আর কী! লুঙ্গি পরে পা তুলে বসবে, গবগব করে খাবে, ঘোঁত ঘোঁত করে রাগবে, রোজ এই রাঁধো সেই রাঁধা, সুড়ুৎ করে যখন চা খায় না আমার ভেতরটা সিটকে যায়।

রুবি বলল—তা এত দিন মেলামেশা করলি বুঝলি না কিছু?

—কনশাসলি সব কন্ট্রোল করেছে। জ্ঞানপাপী তো!

রুবি বলল—লুঙ্গি তত ভাল। আমার বর তো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে নাক খোঁটে, দমাস করে বায়ুত্যাগ করে আমার সামনেই। বললে বলবে— তুমি তো আমার নিজের বউ। —মানে পরের বউয়ের বেলায় বায়ু সংবরণ করবেন, নিজের বউয়ের বেলা আর কোনও কেতা, সভ্যতা, নিয়ন্ত্রণের দরকার নেই। আসলে আমার আর কোনও দাম নেই। কোনও ভব্যতার চাহিদা থাকতে নেই। আর আমি? আমি যদি একটা ম্যাক্সি বা হাউজ-কোট পরে ঘুরি। কাজের সময় সুবিধে হয় তো! বলবে— এই ঢোলাটা তুমি ছাড়ো তো, বিশ্রী লাগে। মাইন্ড ইটস আ ম্যাক্সি, নট আ নাইটি। তা আমার তো আর ঐশ্বর্য রাইয়ের মতো চাঁছা-পোঁছা ফিগার নয়! হয়তো মডেলের মতো লাগে না। মডেল দেখে দেখে এদের ধারণা হয়ে গেছে বউ হবে না-রোগা না-মোটা না-বেঁটে না-লম্বা।

সংযুক্তা বলল—আর ওঁরা হবেন মোটা থলথলে ভুঁড়িদাস, ঘেমো, বেঁটে কি লম্বা কিছুতেই কোনও ছিরিছাঁদ নেই। আমরাও তো মডেল, ফিল্ম অ্যাক্টর, খেলোয়াড় দেখে দেখে বড় হয়েছি ভাই। কী দারুণ দারুণ সব চেহারা, কই বাস্তবে ওরকম হামলে পড়িনি তো, নিজেদের কালো কালো, মোটা বেঁটে বর নিয়েই তো খুশি আছি। আপত্তিটা এই গা-ছেড়ে দেওয়া ভালগারিটিতে। আমাকে সুন্দর থাকতে হবে, তুমিও থাকো, দুজনের জন্য দুরকম প্রিন্সিপল হবে কেন? পুরুষ জাতটাই ভালগার, ছিঃ!

কৃষ্ণা বলে তার এক বান্ধবী নিয়মিত স্বামীর কাছে মার খায়। ঠাস ঠাস করে চড়। ভাবা যায়? কোম্পানি এগজিকিউটিভ বর তার সফ্‌টওয়্যার প্রফেশন্যাল বউকে ঠেঙাচ্ছে? তবু ডিভোর্স হয় না। বাচ্চা আছে দুটো।

রুবি বলে—কেন যে পটাপট দুটো বাচ্চা নামাতে গেলি!

—ও কথা বলিস না। কৃষ্ণা বলল, ওরাই আমার জীবনের আসল মানে। তোরা এই যে সব স্থূলতা, বিয়ের পর টেক ফর গ্রান্টেড করে নেওয়া— এসব বললি না! এসব আমার কাছে কিছুই না। নিষ্ঠুরতা, নির্ভেজাল নিষ্ঠুরতার সামনাসামনি হতে হলে বুঝতিস বিয়ে কী জিনিস!

—কেন? তুই চাকরি করছিস, যথেষ্ট মাটি তোর পায়ের তলায়, লোকটার সঙ্গে থাকিস কী করে? ডিভোর্স নে!

—তা হয় না রে। এক তো ছেলেমেয়ে তাদের বাবাকে ভালবাসে, বাবাও ওদের জন্য করে, তাদের পিতৃহীন করি কী করে? ধর এটা আমার স্যাক্রিফাইস ওদের জন্যে। তা নয় তো অধীরের সঙ্গে আমার আর কোনও সম্পর্ক নেই। আমার মা-বাবা চলে যাবার পর বাপের বাড়ি বলতেই বা কী? কতটুকু? তোদের সমাজই বা ডিভোর্সিদের জন্যে কী অভ্যর্থনা ডালায় করে সাজিয়ে রেখেছে, বল?

—মারে কেন? মদ খেয়ে?

—উঁহু। কেমন একটা অদ্ভুত রাগ আছে। সেসব মুডে মুখখানা ভয়ংকর হয়ে যায়, সে সময়ে কিছু বলতে গেলেই উঠে এসে এক চড়।

—এ তো মেন্টাল কেস রে! কাউন্সেলিং করা! ডিজঅর্ডার একটা।

—বেড়ালের গলায় ঘন্টাটা বাঁধবে কে? বললে বলে—আমার কোনও মেন্টাল প্রবলেম নেই, আমি পাগল নই, তুমি যাও কাউন্সেলরের কাছে। আমিই নাকি ঘ্যানঘ্যান করে, ইমোশন্যাল হয়ে ওর রাগ বাড়িয়ে দিই।

সংযুক্তা বলে এই একুশ শতকে কাউন্সেলিং সম্পর্কে এই মনোভাব? এ যে একেবারে মধ্যযুগীয় রে! কিন্তু কৃষ্ণা তুই কি সত্যিই ঘ্যানঘ্যান করিস খুব? ইমোশন্যাল হয়ে পড়িস বেশি বেশি!

—দেখ ঘ্যানঘ্যান মানে ন্যাগিং প্রত্যেক স্ত্রীকে করতে হয়, স্বামী যদি একই ভুল বারবার করে, একই দায়িত্ব এড়ায়। ও শুধু চাকরি করবে, আর আমি চাকরি করব, ছেলেমেয়ের পড়াশোনা দেখব, সংসার চালাব, সামাজিকতা করব। স-ব। বাচ্চাদের স্কুলে পেরেন্টস-টিচার্স মিটিং-এ একটাতেও আজ পর্যন্ত যায়নি। অ্যানুয়াল ফাংশনে ওরা গান করবে,— বাবা যাবে না। প্রিন্সিপ্যাল, ক্লাস-টিচারের কাছে কথা শুনতে হয় আমায় এ জন্যে…

অন্যমনস্ক হয়ে যায় ঈশা। বিয়ে আছে, দাম্পত্য আছে, সহবাস আছে, ডেটিং আছে, আছে সাম্প্রতিক অতি পপুলার ভ্যালেনটাইনস ডে। খালি প্রেম নেই। কাগুজে ধারণা একটা। ভাবের ফানুস।

মৃদুল বলে তার এক সহপাঠী, এখনও যোগাযোগ রাখে। একদিন বলল—তোকে ম্যানেজ করতে পারলাম না ঈশা, ঘরে একটি যা জিনিস এসেছে না! যদি দেখতিস!

দেখাটাই তোদের সব, না! —সে ঝেঁঝে ওঠে।

না না, দেখতে ভাল। ফরসা, বড় বড় চোখ। ভাল ফিগার। কী ডিমান্ডিং, কী ডিমান্ডিং, তুই ধারণা করতে পারবি না। আমাকে দেউলে করে ছেড়ে দেবে। মার্কেটিং… মার্কেটিং হল তার একমাত্র বিনোদন।

—একদিন বসলেই পারিস। ভাল করে বুঝিয়ে বল। ইয়ে মানে ভালবেসে বল—

—সে গুড়ে বালি। বলবে দুটো চুমুর ফাটকা খেলে আমাকে মেটিরিয়্যাল জিনিস না দেবার ধান্দা, না? অতি ধড়িবাজ মেয়েছেলে…

—ছিঃ মৃদুল!

—স্যরি—নিশ্বাস ফেলে মৃদুল বলল—কিন্তু আর কিছু ভেবে পেলাম না, অ্যাডজেকটিভ হিসেবে। আমার সন্দেহ টাকাগুলো নিয়ে আলাদা অ্যাকাউন্টে রাখছে।

—কেন? তুই কিছু পকেটমানি দিস না?

—দিই বই কী! সেটাই তো সরিয়ে রাখে। একসঙ্গে বেরোবে। তখন আমার গ্যাঁট থেকে যাবে।

কতরকম প্রবলেম। নারী-পুরুষ রসায়ন আর মিলছে না, মিলছে না। পরস্পরকে চাইছে। চেয়ে, পেয়ে দেখছে এ চাইনি। ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে! কেউ বলছে ও বড্ড চুপচাপ। কেউ বলছে ও বড্ড বকবক করে, কারও নালিশ অপর পক্ষ শীতল, কারও নালিশ ও পক্ষ বড্ডই গরম, যে রূপ দেখে বিয়ে সে রূপই আর কিছু দিন পর ভাল লাগে না, যে গুণ দেখে বিয়ে সেই গুণই কিছু দিন পর গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। কেমিস্ট্রি হচ্ছে না, হচ্ছে না। এ কি প্রকৃতিরই নির্দেশ! কঠিন নির্দেশ! এত দিন তোমাদের মিলতে দিয়েছি, এখন থেকে আর দেব না—আলাদা থাকো, একা থাকো, একা ক্রমশ আরও একা হয়ে যাও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *