২.২০ একশ এক জন গণরাজা

২০

একশ এক জন গণরাজা সংস্থাগারে মগধদূতের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। অভূতপূর্ব সাফল্য।

সেনাপতি অভয় বললেন: কিন্তু একটা কথা আপনারা স্মরণে রাখবেন পাঞ্চাল নিজেকে মগধের প্রতিনিধি বলছেন না, বলছেন বিম্বিসার-প্রতিনিধি।

—দুটির মধ্যে কোনও পার্থক্য আছে নাকি?

—সে-কথা পাঞ্চালই বলুন।

সাবধানতার সঙ্গে শব্দ নির্বাচন করতে হয় পাঞ্চালকে।

—তত্ত্বটি মহারাজের নিজস্ব ভাবনা-প্রকৃত। সমপর্যায়ের ব্যক্তিদের কাছেই তিনি প্রথম প্রচার করতে চান। আপনারা সম্মত হলে তবেই রাজ্যেরও নীতি বলে স্বীকৃত হবে।

—আর সম্মত না হলে! মগধরাজ কি যুদ্ধ করবেন?

সেনাপতি অভয় লোকটি অতি চতুর।

পাঞ্চাল বলেন—আমার কাজ মৈত্রী নীতির কথা, রাজসংঘের কল্পনার কথা আপনাদের জানানো। এর অধিক বলবার অধিকার আমার নেই। তবে একটা কথা জানিয়ে রাখা ভালো— মগধরাজ দুর্বল বা রণভীরু এমন ভাববেন না। অন্যরা হোক তা-ও তিনি চাইছেন না। একের বিপদে বহুর বিপদ। সুতরাং সংঘবদ্ধ হওয়া ভালো—এই-ই তাঁর ধারণা।

—সংঘনায়ক কে হবেন? রাজা ছেটক জিজ্ঞাসা করলেন। সবাই উৎসুক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এই প্রশ্নটিকেই ভয় করছিলেন পাঞ্চাল। মাথার মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে গেল, হেসে বললেন : আপনারা? আপনারা বৈশালীর গণরাজারা এই প্রশ্ন করছেন?

ছেটক স্মিতমুখে বললেন : ঠিকই। ভগবান বুদ্ধও আমাদের কর্মপদ্ধতির ভূয়সী শংসা করে থাকেন। আমরা সবাই সমমর্যাদার অধিকারী, মহল্লকদের পরামর্শ গ্রহণ করি। শলাকার দ্বারা নির্বাচনের পদ্ধতি বার করেছি… প্রশাসনের ব্যাপারে শেষ কথা আমরাই বলতে পারি।

সেনাপতি অভয় তবু ছাড়েন না।

—মগধরাজ তাহলে আর সাম্রাজ্য চাইছেন না? সৈন্যদল ভেঙে দিচ্ছেন?

—রাজসংঘ গড়ে উঠলে কারোই আর সাম্রাজ্যের প্রশ্ন থাকছে না— মহামান্য সেনাপতি। কিন্তু সৈন্যদল ভেঙে দেবেন কেন?

—বসিয়ে বসিয়ে ভৃতি দেবেন নাকি?

—নিশ্চয়! তাদের প্রশিক্ষা, অস্ত্রনির্মাণ এ সমস্তই অব্যাহত থাকবে। জম্বুদ্বীপের বহিঃশত্রুর প্রসঙ্গটি আপনারা বিস্মৃত হয়ে যাচ্ছেন।

সংস্থাগার থেকে প্রত্যাবর্তন করতে করতে পাঞ্চাল বুঝলেন এঁরা, এই গণরাজারা অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে এই মৈত্রী-প্রস্তাবের ভেতর থেকে নিজেদের জন্য কোনও বিশেষ সুযোগ বার করে নিতে চাইছেন। এঁরা চাইছেন, মগধরাজ অস্ত্র ত্যাগ করুন, সৈন্যদল ভেঙে দিন। নেতৃত্ব বৈশালীর হাতে অর্পণ করুন।

সেনাপতি সীহর কাছে পত্র দিয়ে বন্ধুল পাঠিয়েছেন তাকে। রাষ্ট্রীয় অতিথিশালায় না রেখে সীহ তাকে রেখেছেন নিজের গৃহে। রথে উঠতে উঠতে সীহ জিজ্ঞাসা করলেন, কী ভাবছেন পাঞ্চাল?

—ভাবছি গান্ধার সীমান্তের কথা।

হেসে উঠলেন সহ—কোথায় বেসালি আর কোথায় গান্ধার।

—যতটা দূর ভাবছেন, ততটা নয় সেনাপতি। কুভা নদী পার হতে পারলেই…

—কুভা? যমুনা, সদানীরা, সিন্ধু এগুলির কথা বলুন…বিস্মিত সীহ বললেন।

—পারস্য থেকে এ-দেশে আসতে তো সর্বাগ্রে কুভা-ই পড়বে সেনাপতি! তারপরে অবশ্য সিন্ধু, সদানীরা, যমুনা, গঙ্গা সবই সহজে পার হওয়া যাবে। যে সময়টা আমরা কে সংঘনায়ক হবেন বা কোনও রাজ্যের সৈন্যদল থাকবে কি থাকবে না এই নিয়ে বিতর্ক করব, সেই সময়ের মধ্যেই এ-নদীগুলি পার হওয়া যাবে।

শুনতে শুনতে সীহর চোখ দুটি বিস্ফারিত হয়ে উঠছিল। বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর তিনি বললেন—সত্যি, আমরা ক্ষুদ্র স্বার্থ নিয়ে বড়ই ব্যস্ত থাকি, নয়!

—ইতিবৃত্ত মনে করুন সেনাপতি। যারা যেখানে পরাজিত হয়েছে, এই কারণেই হয়েছে। এই ক্ষুদ্র স্বার্থ।

—মগধরাজ মহানুভব—আপন মনেই বললেন সীহ, বললেন, রত্নখনি নিয়ে আমরা এত ক্ষুদ্রতা করছি তার পরেও তিনি মৈত্রীর কথা ভাবেন। সত্য পাঞ্চাল, অন্যদের কথা বলতে পারি না, কিন্তু আমি লজ্জিত বোধ করছি।

তিষ্য কোনও রত্নখনির বিষয়ে জানে না। সে সতর্ক কানে শুধু শুনল। মন্তব্য করল না।

—এমন মহানুভব শুধু তথাগত বুদ্ধকেই দেখেছি।

মহারাজ বিম্বিসারের সঙ্গে তথাগত বুদ্ধর তুলনায় তিষ্য চমৎকৃত হয়। কিন্তু সীহ এখন উচ্ছ্বাসের ঘোরে আছেন।

—আমি পূর্বে জিন নাতপুত্তের অনুগামী ছিলাম। ভগবান বুদ্ধের উপাসক হওয়ার পর তিনি আমাকে প্রথম কী কথা বললেন জানেন?

—কী?

—বললেন নাতপুত্তকে আগের মতো অর্চনা করতে আমি যেন বিস্মৃত না হই। তাঁর যেন কোনও ক্ষোভ বা কষ্টের কারণ না জন্মায়।

সেই রাত্রে সীহর গৃহের বিলাস-শয্যায় সহসা আবার তিষ্যকুমারের শয্যাকণ্টকী হল। নিদ্রার মধ্যে অতর্কিতে গুপ্ত শত্রুর মতো এক অনির্দেশ্য উৎকণ্ঠা তার শরীর-মন অধিকার করে নিচ্ছে। এত তীব্র যে, তার প্রথম নিদ্রা ভেঙে মনে হয়েছিল কোনও ব্যাধির আক্রমণ হয়েছে বুঝি বা।

—আমি কি হলাহল পান করেছি? বিস্মিত তিষ্য নিজেকেই নিজে জিজ্ঞাসা করতে থাকে। কী সুতীব্র আক্ষেপ! কোনও খরস্রোতা নদীর তীরে তাকে দাঁড় করিয়ে রেখে কেউ বুঝি চলে গেছে। কেউ নেই, কিছু নেই, কাষ্ঠপুত্তলিকার মতো চালিত হচ্ছে সে এক অবস্থান থেকে অন্য অবস্থানে। বিপুল অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হল। কিন্তু অভিজ্ঞতাগুলিও সব সারিবদ্ধ কাষ্ঠমূর্তির মতো সত্তার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। কোনটিই তার ভেতরে এসে তার রক্ত, মাংস, মজ্জার সঙ্গে মিশল না। হঠাৎ তার মনে হল, সে তার মৃত্যুদৃশ্য দেখছে।

‘পাঞ্চাল তিষ্যর দেহাবসান হয়েছে-এ-এ’ কোথাও কেউ ঘোষণা করছে। ‘এই মাত্র মারা গেলেন।’

‘পাঞ্চাল তিষ্য? কে তিনি?’

‘তিষ্যকুমার নামে এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী যুবাকে চিনতাম। কিন্তু পাঞ্চাল?’

‘ও অবশ্যই। সেই তিষ্যই! ভাল, তিনি সৎকৃত হয়েছেন তো?’

শয্যা থেকে উঠে পড়ে তিষ্য। সুপরিসর কক্ষটিতে ঘুরে বেড়াতে থাকে। কখনও বাতায়নের কাছে থামে। তমসাবৃত কাননের দিকে চেয়ে থাকে। আবার আকাশের দিকে মুখ তোলে। জ্যোৎস্নায় তার মুখটি পাণ্ডুর দেখায়। মুষ্টিবদ্ধ হাত দুটি কখনও পেছনে রাখে। কখনও খুলে বাতায়নের বাইরে মেলে দেয়।

—পাঞ্চাল!

—কে? তিষ্য বেগে ঘুরে দাঁড়ায়।

—আমি সীহ।

—আপনি! এত রাতে!

তিষ্য জানে না লিচ্ছবিরা অতিথিবৎসল হলেও অতি সতর্ক। মগধের কোনও রাজপ্রতিনিধিকে কখনও তারা চোখের আড়ালে রাখবে না।

—আপনার নিদ্রা আসেনি!

—এসেছিল, হঠাৎ ভেঙে গেছে।

—অপরাধ মার্জনা করবেন পাঞ্চাল, আমি এখুনি সুন্দরী নটী পাঠিয়ে দিচ্ছি।

—না— পাঞ্চালের চক্ষু দুটি বাঘের মতো জ্বলে।

মৃদু প্রদীপের আলোয় সীহ সেদিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন।

এখন মধ্যরাত। সমস্ত পৃথিবীর সুখী ও নির্বোধেরা গাঢ় নিদ্রায় নিদ্রিত। তিষ্য আর সীহর মাঝখানে নিশীথিনীর আড়াল।

পাঞ্চালের কণ্ঠ ভেসে আসে—এ-কথা কি সত্য সেনাপতি?

—কী সত্য পাঞ্চাল?

—পুরুষের তাবৎ যন্ত্রণার নিরাময় নারীশরীরে?

—এ-কথা কখন বললাম?

—আমাকে বিনিদ্র দেখে রমণী পাঠিয়ে দেবার কথা বলেননি?

—বলেছি পাঞ্চাল! যা সহজ, সুপ্রচল—তাই ভেবেছি। মার্জনা করুন। আপনি স্বতন্ত্র।

—মার্জনার প্রশ্ন নেই সেনাপতি। কিন্তু আপনি অভিজ্ঞ ব্যক্তি। বয়োজ্যেষ্ঠ। বলতে পারেন, কী সে যাতনা যা আমাকে থেকে থেকে বৃশ্চিকের মতো দংশায়।

সত্যিই, অতিথিকক্ষের আলো-অন্ধকারে পাঞ্চালকে এক নীল বর্ণের পুরুষ বলে ভ্রম হয়। দংশনের বিষে নীল।

সীহ বললেন—পাঞ্চাল, যতদূর শুনেছি আপনি তো আমার চেয়েও অধিক আমার চেয়েও ঘনিষ্ঠভাবে তাঁকে দেখেছেন। মনে হয়নি, আপনার এ-যাতনা তিনি দূর করতে পারেন!

—কার কথা বলছেন?

—সেই আদিত্যবর্ণ পরমপ্রাজ্ঞ অমিতাভ তথাগত।

—তিনি যে মৃত্যু এবং নিবৃত্তির কথা বলেন,

—কিন্তু তিনি অমৃতের কথাও তো বলেন! নির্বাণ অমৃত ছাড়া কী? আর নিবৃত্তির কথায় তো আপনার ভয় পাওয়ার কিছু নাই, আপনি সংযমী পুরুষ।

—না, না, এ নির্বাণ, এ-নিবৃত্তি আমার নয়।

তখন নিশ্বাস ফেলে সীহ বললেন, আসুন পাঞ্চাল, বেশবাস করে নিন, দেখি আপনার বৃশ্চিকের দংষ্ট্রা নির্বিষ করতে পারি কি না।

—কোথাও যেতে হবে, সেনাপতি?

—ব্যক্তিগত সংকটের কথা যে মুহূর্তে আমাকে জানিয়েছেন, সে মুহূর্ত থেকে আমি আপনার সুহৃৎ। আমাকে সেনাপতি বলে আর সম্বোধন করবেন না পাঞ্চাল। হ্যাঁ যেতে হবে। চিত্ত এবং চিত্তবৈকল্যের ব্যাপারে যাঁকে সবচেয়ে প্রাজ্ঞ বলে মানি তাঁর কাছে নিয়ে যাই। আমাকে বিশ্বাস করুন।

স্ফটিকের পাত্রের মধ্যে একটি আলোকশিখা জ্বলছে। দূর থেকে দেখা যায়। সম্ভবত একটু উচ্চ ভূমির ওপর গৃহটি। শ্বেতমর্মরের সেই অপরূপ স্থাপত্য জ্যোৎস্নাপিণ্ডের মতো অন্ধকারেও দৃশ্যমান। দীর্ঘ কয়েকটি অঙ্গন পেরিয়ে একটি সুবিশাল কক্ষ। পাথরের স্তম্ভগুলিতে ওপরে পদ্ম, নিচে সিংহ, হস্তী। কোথায় আলো জ্বলছে দেখা যায় না। ভোরের মতো আলোয় কক্ষটি ভরে রয়েছে। মৃদু একটা সৌরভ। সীহ তাকে বসিয়ে রেখে আসছি বলে চলে গেছেন। এতো রাতে নিশ্চয় গৃহকর্তাকে নিদ্রা থেকে তুলতে সময় লাগবে।

কক্ষটিতে প্রতিকৃতি রয়েছে অনেকগুলি। মহাবল, শক্তিসুন্দর পুরুষ সব। দেখতে দেখতে একটির সম্মুখে থেমে যায় তিষ্য—মহারাজ সেনিয় না? একেবারে উদ্ভিন্নযৌবন। কী অসামান্য প্রতিভাদীপ্ত মুখশ্রী! তিষ্যর বক্ষের ভেতর থেকে কী যেন একটা উঠে আসতে চায়। চক্ষু বাষ্পাচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। এ-দুর্বলতা তাকে সাজে না, সাজে না! সে ঘুরে দাঁড়ায়। সুন্দর-সুন্দর মূর্তিও রয়েছে কক্ষটিতে। সত্যি কথা বলতে কি কত যে শিল্পসম্ভার, আর কী অদ্ভুত সুন্দর তাদের বিন্যাস সে কথা মুখে বলা যায় না। নারীমূর্তিগুলি নৃত্যভঙ্গিমায়। শ্বেত পাথরের, কৃষ্ণ মৃত্তিকার, কত প্রকার আভা যুক্ত বস্তু, সে কি কাংস্য না অন্য কিছু বোঝা যায় না সব সময়ে। তিষ্য মূর্তিগুলি অলস চোখে দেখতে থাকে। এক একটি মূর্তি যেন জীবন্ত। দেখতে দেখতে সুন্দরতম মূর্তিটির সামনে সে দাঁড়িয়ে যায়। এর চোখদুটি অলৌকিক করে এঁকেছেন শিল্পী। ঈষৎ দেখা যাচ্ছে কদলী পুষ্পের মতো একটি দুটি দাঁত। হাত দুটি অঞ্জলিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে মূর্তি। মুগ্ধ তিষ্য বিস্মিত হয়ে বলে, কোন শিল্পী তোমাকে গড়েছেন জানি না। কিন্তু তিনি মহাশিল্পী।

অঞ্জলিবদ্ধ হাতদুটি কপালের কাছে ওঠাল মূর্তি। মৃদু নিক্কণ শোনা গেল। তিষ্যকে বিস্ময়ে অভিভূত করে মুর্তি বলল—যিনি আপনাকে গড়েছেন, তিনিই।

—আপনি…আপনি…

—আমি অম্বপালি।

পাঞ্চাল তিষ্যর পরিণত যৌবনের শরীর থেকে যেন মন্ত্রবলে বেরিয়ে এল একটি অনভিজ্ঞ, প্রণয়োন্মুখ, বহু আশার আশী এক কিশোর। সে কোন চিরকালের নদীপ্রান্তে দাঁড়িয়ে এক সদ্যকিশোরীকে বলল—আমায় ফিরিও না। ফিরিয়েছ বলে আমি পূর্ণ হতে পারছি না, প্রত্যয়ী হতে পারছি না।

—ফেরাইনি তো! আমি যে তোমাকে বারবার ডেকেছি। দুই সজল চোখে বিদ্যুৎ বর্ষণ করে কম্পিত ওষ্ঠাধরে বলে উঠলেন অলভা—আমাকে এই অফলা যৌবনের কারাগার থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাও।

যাতনায় নীল হয়ে মুখ ফেরাল তিষ্য।

অমনি কক্ষ পার হয়ে চলে যেতে যেতে স্ফুরিতাধরে কেউ বলে উঠল—চাই না। কিছু চাই না। নিজ কর্তব্যে যাও, ডেকো না আমাকে, বলল—কোমলে ও কঠিনে, প্রণয়ে এবং দুর্বিনয়ে।

—অম্বপালি! আপনি অম্বপালি! বিস্ময়, শ্রদ্ধা, আনন্দ, সমর্পণ সব সব কিছু যেন তার কণ্ঠে।

—হয়ত অম্বপালি। হয়ত নয়। হয়ত বা অন্য কেউ যাকে চিত্তের মধ্যে মূক করে রেখেছেন হে পাঞ্চাল। —করুণ হাসিতে যেন গলতে থাকে মুখশ্রীর মণ্ডন।

তিষ্য দেখল তার দু’ নয়ন থেকে তৈলধারার মতো অশ্রুবর্ষণ হচ্ছে। এক বারিধিই বুঝি জমে ছিল তার বুকের ভেতর।

বারিবিধৌত সেই মুখটিকে তাঁর দু’হাতের অঞ্জলিতে নিয়ে চুম্বন করলেন অম্বপালি। কোথাও দ্বার খোলবার শব্দ হল। আকাশ স্বয়ং নত হয়ে পড়েছে তার ভোরবেলাকার কুসুমবর্ণ মেঘরাজি, তার দ্বিপ্রহরের কাংসোজ্জ্বল রোদ, তার ত্রিযামা যামিনীর অগণ্য নক্ষত্রশোভিত আলো-অন্ধকার নিয়ে। পদ্মগন্ধের লহরী বহে যায়। বহে যায়।

অম্বপালি গান ধরলেন মৃদুস্বরে। কোন অন্তরাল থেকে বীণা বেজে উঠল।

সীহ যখন তিষ্যকে নিতে এলেন তখন সদ্যই অংশুমালী দিগন্ত পার হয়েছেন। স্ফটিকের মতো ঝকঝক করছে শিশিরমণ্ডনা বৈশালী। সখী রম্ভা এসে জানাল—তিস্‌স ভদ্দ গভীর নিদ্রায় অভিভূত আছেন। অম্বা তাঁকে জাগাতে নিষেধ করেছেন।

সীহ ফিরে গেলেন। মধ্যাহ্নভোজনের পূর্বে আবার তাঁর উৎকণ্ঠিত রথ এসে দাঁড়ায়। রম্ভা জানায় ভদ্দ তিস্‌স এখনও নিদ্রিত।

—কোনও বিশেষ সুরা…ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করেন সীহ।

—কই না তো! কোনও সুরাই তো নয়!

গোধূলিবেলায় তিষ্য জেগে ওঠে। প্রথমে সে বুঝতেই পারেনি সময় অপরাহ্ণ। সে ভেবেছিল প্রত্যূষ হচ্ছে। ঘরটির চারদিকে বাতায়ন। মুক্ত বাতায়নপথে চোখ ভরে দেখা যায় বৈশালীর অপরাহ্ণশ্রী। দুটি যুবতী ঘরে ঢুকে তাকে স্নানের আহ্বান জানাল।

—স্নানগৃহটি শুধু দেখিয়ে দিন। কারো সাহায্য লাগবে না। বলল তিষ্য। সসম্ভ্রমে কলসে সুরভিত কবোষ্ণ জল রেখে, মার্জনী বস্ত্র, তৈল, অঙ্গরাগ, সুগন্ধি সব সাজিয়ে রেখে চলে গেল তারা।

এক প্রস্থ নববস্ত্র, তার অলঙ্কারগুলি ফলকের ওপর রাখা। স্নানের পর বাইরে এসে দেখে যুবতী দুটি দাঁড়িয়ে আছে। বলল, আসুন ভদ্দ।

—কোথায় যেতে হবে? আমি এবার…

—সায়মাশ খেতে হবে না? অম্বার গৃহ থেকে এমনি যাবেন? আর কয়েক প্রহর হলেই তো পুরো একটি দিবস নিদ্রা হয়ে যেত। ক্ষুধাবোধ হচ্ছে না?

—একটি দিন কেটে গেছে?

—প্রায়।

—তবে কি এখন প্রত্যূষ নয়?

—এখন বৈকাল ভদ্দ।

পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসে দু’জনে।

সত্যই সে অত্যন্ত ক্ষুধার্ত। এত ক্ষুধা যেন তক্ষশিলার সেই ব্রহ্মচর্যের দিনগুলিতেও কখনও অনুভব করেনি সে। একটি স্বপ্ন দেখেছিল সে গতরাত্রে। স্বপ্নটি তার চিত্তের সমস্ত অন্ধকার সংগ্রহ করে নিয়ে মিলিয়ে গেছে।

অপর দিকের বস্ত্রাবরণী সরিয়ে এক রমণী প্রবেশ করেন। শুভ্র সামান্য বসন। অলঙ্কারের কোনও বাহুল্য নেই। মুক্তকেশী। কে ইনি? এঁর উপস্থিতির ছটায় কক্ষটি যেন বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে।

—এখন ভাল বোধ করছেন তো? মৃদু স্বরে জিজ্ঞাসা করে তিনি বসলেন একটি পীঠে।

—আমার কি কিছু হয়েছিল?

—না, তেমন কিছু নয়। গীত শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লেন। গভীর নিদ্রা। সুষুপ্তি বলতে পারেন। যে নিদ্রায় কোনও দুঃস্বপ্ন থাকে না।

—দেবী অম্বপালি বোধহয় আমাকে ঘুম পাড়াতেই ওই গীত গেয়েছিলেন…তিষ্য বলে, একটি ফলকে আহার্য এল।

তিষ্য বলল আমি ক্ষুধার্ত। অনুমতি করুন।

—নিশ্চয়, আপনি উদর পুরে খান।

তিষ্য শুনল—খেতেই তো বললাম যুবক…বলছেন এক শুভ্রবসনা কুণ্ডলকেশী শ্রমণা।

একজন যুবতী এসে বলল—অম্বা, সেনাপতি এসেছেন।

—তাঁকে প্রতীক্ষাগৃহে আপ্যায়ন কর সুলসা। আমার নমস্কার জানাও, জানাও মহামান্য পাঞ্চাল প্রায় প্রস্তুত, এখনি যাচ্ছেন।

—যাবার আগে দেবী অম্বপালীর কাছে একবার বিদায় নেব। কোথায় তিনি?

—এই তো আমি। আমিই সে।

—তা হলে কাল রাতে যাঁকে…স্তম্ভিত তিষ্য কথা শেষ করতে পারে না।

—আমাকেই তো দেখেছিলেন পাঞ্চাল।

লজ্জা সংকোচ ভুলে সে এই প্রগাঢ়যৌবনা, তপ্তকাঞ্চনবর্ণা, তন্বী, লাবণ্যকোমল, প্রজ্ঞাভাস্বর মানবীরত্নর দিকে তাকিয়ে রইল।

—বিশ্বাস হচ্ছে না? কেমন এক প্রকার হাসলেন রমণী,—আমি সর্ব কল্যাণী নারী। ছলনা করি না। কিন্তু মানুষ আমার মধ্যে তার মনোলোকের কল্পমূর্তি দেখে। সত্য মানুষটিকে দিবালোক ছাড়া দেখতে পায় না। দিবালোকেও পায় কি? তা পাঞ্চাল আপনি কি স্বপ্নের ঘোরেই থাকতে চান, না দিবালোকের স্পষ্টতায় ফিরতে চান।

—আমি কি স্বপ্নের ঘোরেই ছিলাম এতদিন?

—এমন স্বপ্ন দেখা চোখ আমি বহুদিন দেখিনি।

—বুঝলাম না দেবি।

কী বুঝলেন না?

—কিছুই না।

—একটু প্রতীক্ষা করুন, ধৈর্য ধরুন, দেখবেন, অনেক কিছুই বুঝতে পারছেন। প্রকৃত কথা নিজের চিত্তকে বোঝা।

—তাহলে আমি আপনার কাছে আবার আসব। অনুমতি দিন…

—কাল রাত্রেই আমি আমার শেষ অতিথি গ্রহণ করেছি ভদ্র।

গভীর সজল সেই চোখ দুটির দিকে চেয়ে তিষ্য মাথা নিচু করে বলল—অতিথির মতো আসতে চাই না। আচার্যের কাছে শিক্ষার্থী যেমন আসে, তেমনি আসব দেবি।

জম্বুদ্বীপের এই শ্রেষ্ঠ নারী ভগবান বুদ্ধের চোখেও ধন্দ লাগিয়ে দিয়েছিলেন। বৈশালীতে তাঁর আমন্ত্রণসভায় তথাগত বারবার তাঁকে দেখছিলেন—কী আশ্চর্য এই অম্বপালি। কত সামান্য বেশ, কোনও প্রসাধন নেই, অলঙ্কার ন্যুনতম, তবু কী মহিমা! তুষিত স্বর্গের দেবীরাও বুঝি এই মানবীর কাছে পরাজিত হবে।

প্রকৃতপক্ষে সর্বার্থসুন্দরী এই নারীকে দেখলে পুরুষ এত বিভ্রান্ত হত যে কেউই তাঁকে সঠিক চিনতে পারত না। স্পষ্ট দেখতেই পেত না। তিনি নিতুই নব নব রূপে পুরুষের প্রাণের দুয়ারে গিয়ে আঘাত দিতেন।

২১

ঊষাকাল। মুক্তাভার মতো একটি আস্বচ্ছ দ্যুতিতে দ্যুতিমতী ধরণী। শেষবারের মতো গৃধ্রকূটের পাশ দিয়ে নগর-প্রাকারের দিকে চলে যাচ্ছেন চণক। চলেছেন একটা ঘোরের মধ্যে। পরিচিত পথগুলি অপরিচিত লাগছে। সব যেন অসত্য, ভ্রান্ত, মায়া। নিদ্রিত রাজগৃহ। রাজগৃহ, তুমি জানলে না এক যুগেরও অধিক কাল তোমার জন্য, শুধু তোমার জন্য। হে গৃধ্রকুট, আমার চিন্তার চারণভূমি, বিদায় দাও। হে বৈপুল্ল, বৈভার গিরিমালা, কালশিলা, শীতবন, আম্রবন, বেণুবন, লট্‌ঠিবন কাত্যায়ন চণক যে পথে এসেছিল সেই পথেই ফিরে যায়।

প্রাকার-তোরণের কাছে বিদায় নিচ্ছেন চন্দ্রকেতু। স্থবিকা দিচ্ছেন কাত্যায়নের হাতে।

—কী এ?

—পাথেয় হে কাত্যায়ন।

—প্রয়োজন হবে না।

—মান্যবর, এ স্থবিকা না নিয়ে যাবেন না, মহারাজের আদেশ।

তোরণ পার হচ্ছেন চণক। —এই পর্যন্ত মগধরাজের আদেশ মানি। তারপর আর না।

মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। চিত্তক তার আরোহীকে নিয়ে ছুটছে। উষা ক্রমে স্ফুট হচ্ছে। স্থবিকা হাতে বিমূঢ় থেমে আছেন চন্দ্রকেতু। কী বলবেন বিম্বিসার নামে সেই দীর্ণ বিভক্ত মানুষটিকে যিনি তরবারির ওপর ভর দিয়ে কূটকক্ষের অভ্যন্তরে একা দাঁড়িয়ে আছেন?

ক্রমে মহাবন, সেই মহা-অরণ্য মানুষের বহু পূর্ব থেকে যা অধিকার করে আছে জম্বুদ্বীপের উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম। মাঝে মাঝে তাকে কেটে পরিষ্কার করে কোনও জন নিজেদের বাসভূমি প্রস্তুত করেছে, মাথা তুলেছে জনপদ। সভ্যতা, বাণিজ্য, কৃষি, নগরায়ণ, সংস্কৃতি, মনন, রাজনীতি। কিন্তু সে কতটুকু!

চিত্তককে বনের প্রবেশপথে একটি আমলকী গাছের সঙ্গে শিথিল বাঁধনে বাঁধলেন তিনি। একটু শক্তি প্রয়োগ করলেই সে বাঁধন ছিঁড়ে মুক্ত হতে পারবে। সঙ্গে সঙ্গে উদগত তৃণদলের মধ্যে মুখ নামাল চিত্তক। কত সুখী এই মনুষ্যেতর প্রাণীরা! কত অল্প প্রয়োজন! অল্পতর সান্ত্বনা! চণক মহাবনে প্রবেশ করলেন। যতই যান, বনভূমির আঁচল তাঁকে ঢেকে দিতে থাকে। অনেক চেষ্টায় তিনি সেই কুটিরটিতে আসেন, একদা যা আটবিকরা তাঁর জন্য বেঁধে দিয়েছিল। কুটির নয়, কুটিরের অকিঞ্চিৎকর অবশেষ এখন। চালের একটি খণ্ড বটবৃক্ষের মাথায় দুলছে। খুঁটিগুলি অদৃশ্য। বনভূমির থেকে এক হাত প্রমাণ উঁচু ছিল। সেই উচ্চতার কিছু এখনও টিকে আছে। সেই সরোবর অদূরে, যা দেখে তিনি একদিন বাসস্থান নির্বাচন করেছিলেন। আরও এগিয়ে যান যেখানে একটি জনগোষ্ঠী বাস করে বলে তিনি জানতেন। কোনও চিহ্ন নেই কারও। তৃণে তৃণে গুল্মে গুল্মে ঢেকে গেছে মানুষের চরণচিহ্ন। খসখস শব্দ তুলে চকিত শশক পালিয়ে গেল। ওরাও অমনি করেই পালিয়ে গেছে। ভয়ে। হয়ত শুধু ভয়ে নয়। অজানা আতঙ্ক, কল্পনার অতীত কৃতঘ্নতা হয়ত তাদের ঘৃণাও জাগিয়েছে। হয়ত কেন, নিশ্চয়ই। অথচ তিনি তাদের সেই ক্রোধ, আতঙ্ক, ঘৃণার নিরসন করবার চেষ্টা না করে, তাদেরই বাসভূমি অধিকার করে করে মগধরাজ্যের সীমানা বাড়াতে গিয়েছিলেন। কী মূঢ়তা, কী সীমাহীন মূঢ়তা! আরও বন পার হতে থাকেন তিনি। তৃষ্ণা পেলে পান করেন কোনও পল্বলের জল, ক্ষুধাবোধ তাঁকে ছেড়ে গেছে, তবু যখন জঠরের কথা স্মরণ হয় তখন ফল পাওয়া গেলে খান। না পাওয়া গেলে জল আরও জল। চলতে চলতে তিনি বুঝতে পারেন এই অরণ্যই তাঁর নিয়তি ছিল। নইলে উচ্চভূমি, তুষারাবৃত পর্বতের সানু, উজ্জ্বল বারিহীন দিনরাত্রি এবং স্বর্ণ বর্ণের মানুষ দেখে যার অভ্যাস সে কেন এই অরণ্য, এই বৃষ্টি, এই কৃষ্ণদেশকে এত ভালোবাসবে! চলতে চলতে অস্পষ্টভাবে তাঁর আরও মনে হয় তিনি প্রকৃতপক্ষে একটি প্রবাহ যা অরণ্য ভেদ করে কৃষ্ণ ভারতের অভিমুখে ছুটে চলেছে, রক্তের ভেতরের কোন অজানা তৃষ্ণায়, তৃষ্ণা মেটাবারও তৃষ্ণায়। সম্ভবত তাঁকে চালিত করছে এক অমোঘ শক্তি যা জম্বুদ্বীপের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের একটি সূচক বলে তাঁকে চিহ্নিত করেছে। তাঁর এবং এই দেশের ভবিতব্য হয়ত বা এক ও অভিন্ন। পরম্পরাক্রমে রাজশাস্ত্রের যে চর্চা তাঁরা করে আসছেন তারই বলে হয়ত স্বদেশের ভাগ্যে ভাগ্য মেলাবার এই দুরূহ পুরস্কার তাঁর। কোনও সত্য-সাম্রাজ্য স্থাপনের গুপ্ত মন্ত্র উদ্ভাসিত হচ্ছে তাঁর কাছে আজ, শান্তরস তপোভূমির আশ্রয়ে নয়, অনার্য-অধ্যুষিত এই আদিমানবী অরণ্যানীর গুণ্ঠনের তলায়।

ক্রমশই চণক ঢুকে যেতে লাগলেন আরও গভীরে, গহনে, গম্ভীরে। চতুর্দিকে বনস্পতিসকল আকাশ বিদ্ধ করে নিঃশব্দ কোলাহল করতে থাকল। দেখো হে মানব, মৃত্তিকায় প্রোথিত চরণ, তবু উর্ধ্বে উঠি। যত দূর চক্ষু যায় তত দূর, আরও দূর। সূর্যশিখার সন্ধানে ক্রমাগত নভস্তল বিঁধে চলি। শাখাপ্রশাখাগুলিকে প্রচারিত করে দিই শূন্যমণ্ডলে। বিমুক্ত, অনপেক্ষ, আদিম তবু নবীন, সকল শীতবসন্ত বুকে নিয়ে চিরস্থির তবু চিরপ্রচল।

স্পর্ধিত এই বনবাণী শুনতে শুনতে হর্ষে, রোমাঞ্চে, আক্ষেপে, আক্রোশে, পিপাসায়, অন্বেষায়, ত্রাসে, বিস্ময়ে, দুঃখে, মোহে এক সময়ে তাঁর বাস্তবের জ্ঞান হারিয়ে গেল। সময়ের হৃৎস্পন্দন শোনা যায় না। সময় চলেছে তাঁরই সঙ্গে একীভূত হয়ে, তাঁরই অনুভূমিক বক্ররৈখিক ভঙ্গিতে। এক অনাদ্যন্ত ব্রাহ্মমুহূর্ত ক্রমাগত চলে চলেও তিনি পার হতে পারছেন না এই বোধ তাঁকে আক্রান্ত করল। মস্তিষ্ক হারিয়ে ফেলল তার অনবদ্য ভাবনা-প্রতিভা, স্মৃতি, তার প্রখর আত্মজ্ঞান ও সাধন-সংকল্প, স্বাতন্ত্র্য।

ঘন গুল্ম, লতাপাতা, কোমল বৃক্ষকাণ্ড, শাখাপ্রশাখা দু হাতে সরাতে সরাতে কঠিন শাল-শাল্মলী-অশ্বথ-ন্যগ্রোধ-অর্জুন-সপ্তপর্ণী কাণ্ডে দু হাতে আঘাত করতে করতে চিৎকার করে চণক ডাকতে লাগলেন—রগ্‌গা, রগ্‌গা, রগ্‌গা, রগ্‌গা, রগ্‌গা… গম্ভীর নাদের সেই ডাক ক্রমশ ভাঙতে লাগল— কর্কশ, করুণ, শক্তিহীন, ক্রমশ তা ঝিল্লির ডাকের মতো নিরন্তর এক অরণ্যধ্বনি হয়ে গেল। তিনি নিয়ন্ত্রণহীন, সংজ্ঞাহীন পড়ে গেলেন সেই মহাবনের গহন গভীর বক্ষের কোমলতম কজ্জলিত মৃত্তিকায়। অবিকল যেন একটি দীর্ঘ শালবৃক্ষ, সমূল উৎপাটিত। দীর্ঘ হাত দুটি সামনে ছড়িয়ে রইল, বজ্রমুষ্টি খুলে গেল ক্রমশ? তিনি কি প্রথমে কিছু ধরতে চেয়েছিলেন? দুর্মূল্য কোনও কিছু? তার পর সেই বস্তুর ওপর আস্থা হারিয়ে, মায়া হারিয়ে তাকে মুঠি খুলে ফেলে দিয়েছেন! পা দুটি মহাশালের নিষ্পত্র শাখা, কেটে রাখা হয়েছে, দক্ষ বর্ধকিরা অদূরভবিষ্যতে কাজে লাগবে বুঝি বা। তাঁর সুগঠিত নাসা ডুবে গেছে ঝরাপাতার স্তূপে। ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে সমস্ত মুখমণ্ডলটিই। সম্ভবত তাঁর অন্তরাত্মা লুকোতে চাইছে। কিংবা আশ্রয় চাইছে ধরিত্রীর গভীরে। আশাহীন কোনও মহাসংকটে পরাজিত মহাবীরেরা বীরাঙ্গনারা এইভাবেই আশ্রয় চান ধরিত্রীর কাছে।

উপকথালোক ছেড়ে উড়ে আসে ত্রিকালদর্শী বৃদ্ধ ভূশণ্ডী কাক, ক্রমাগত ডানা ভাসিয়ে ভাসিয়ে আসতে থাকে ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী। আসে শুক-সারী, অমিতায়ু উলুক।

—কে ধায়? কে যায়?

—এক প্রেমী পুরুষ। আর ধায় না, যায় না, এখন শয়ান। এখন শব।

কাকে স্নেহ করেছিল?

—স্বজাতিকে, স্বদেশকে, যাকে পৃথিবী বলে জেনেছিল।

—আর কাকেও?

—আর সেই পৃথিবীকে ধারণ ভরণ করতে পারেন এমন একজনকে।

—আর কাকেও?

—বড় জটিল এই স্নেহ স্নেহান্তরের কথা…আর কারও অসুখও তাই এত জটিল নয়।

—আরোগ্য হবে না?

—সময়ান্ত হলে হবে, নইলে নয়।

—এমন কেন হয়? এ অসুখে কেউ কষ্ট পায়, কেউ পায় না…

—সময়কে হারাতে চায় যারা তাদেরই বোধহয় এ অসুখ করে…

—অসুখও তবে এক প্রকার সুখ?…সুখ…সুখ…সুখ এবং ঠিক সেই সময়ে, পরিপূর্ণ সভাগৃহে, বামে বর্ষকার, দক্ষিণে সুনীথ সার্থক সচিবদ্বয়, অবিদূরে চন্দ্রকেতু বিনিশ্চয়কার, অহিপারক নগর শ্রেষ্ঠী, দুই পাশে কুমার অভয় বীরপুরুষ যিনি অবন্তীর আক্রমণ প্রতিহত করেছিলেন এবং হল্ল ও বেহল্ল ছেল্লনাদেবীর পুত্রদ্বয়, আরও বহু অমাত্য, দ্বারপাশে ধনুর্গ্রহ দ্বারী, পিছনে চামরধারিণীরা, ঝলসে উঠল বর্শা কুনিয়র হাতে।

এত অবাক যেন অমাত্যরা আর কখনও হননি। ঠিক এমনটি তাঁরা কেউই ভাবেননি। কুমারের স্বপক্ষীয়রা না, বিপক্ষীয়রাও না। মন্ত্র এখনও গুপ্ত। প্রকৃত বিপদ শ্রমণ গৌতমের, তিনিই মহারাজকে ক্রমশ নিষ্ক্রিয় করে দিচ্ছেন। কিন্তু প্রকাশ্য সভায় মহারাজকে ঘিরে এমন ঘটনা ঘটতে পারে কারওই কল্পনায় ছিল না। বর্ষকার সুনীথ কুমারের আনুগত্য স্বীকার করেছেন। অহিপারক তাঁকে অর্থসাহায্য করবেন কথা দিয়েছেন। কিন্তু তা ইতিকর্তব্য স্থির হবার পর। চন্দ্রকেতু এবং তাঁর অনুগত অমাত্যরা তরোয়ালের কোষে হাত রাখলেন। অভয় স্থিরবুদ্ধি মানুষ। পাছে কেউ মনে করে তিনি সিংহাসনের উত্তরাধিকার চাইছেন তাই নিজেকে সতর্কভাবে সঙ্কুচিত রাখেন। আজ তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। হল্ল বেহল্লর চোখে মহাভয়। ভয় বিস্ময় অনুপস্থিত শুধু রাজার চোখে। সামান্য কৌতুক সেখানে এবং ক্লান্তি।

মহিষী কোশলকুমারী কদিন উপর্যুপরি দুঃস্বপ্ন দেখে ঘর্মাক্ত হয়ে জেগে উঠছেন। প্রতিদিন প্রত্যূষে তিনি তাঁর প্রার্থনা নিবেদন করেন।

—কদিন বিশ্রাম করুন মহারাজ, অন্তঃপুর থেকে বেরোবেন না।

—কেন?

—স্বপ্ন দেখলাম গিজ্ঝকুটের গিজ্ঝমুণ্ডটা পড়ে যাচ্ছে, আপনার শির চূর্ণ করে দিল।

—স্বপ্ন দেখলাম জল, ভীষণ তরঙ্গ এক ছুটে আসছে। আপনাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।

—মহারাজ যাবেন না, স্বপ্ন দেখলাম দক্ষিণবনে দাবানল লেগেছে। আপনি একটি বৃক্ষ, পুড়ে যাচ্ছে…

—দেবি, তথাগত বলেছেন, দুঃস্বপ্ন শরীর মনের বিকারমাত্র।

—যাবেন না মহারাজ, বন্ধ থাক সভা—ছুটে এসেছেন ছেল্লনা।

—কেন?

—কেমন ভালো লাগছে না। কুমার কদিন কেমন অস্থির, চঞ্চল…

—যখন দীর্ঘদিন ধরে তাকে তপ্ত করেছিলে মনে হয়নি এমন দিন আসবে?

অশ্রুমুখী ছেল্লনা, ভয়ার্ত কোশলকুমারীকে পেছনে ফেলে অন্তঃপুরের দ্বার পেরিয়েছিলেন তিনি।

—একমাত্র কাপুরুষেরাই অবরোধের বিবরে মুখ লুকোয় দেবি, বিম্বিসার তো কাপুরুষ বলে সাম্রাজ্য-বিস্তার বন্ধ রাখেনি!

তিষ্যকুমারের শেষ পত্রটির কথা স্মরণ করলেন তিনি। সে তার যথাসাধ্য যত্ন করেছে। প্রত্যেক রাজা, কোশলের তো নিশ্চয়ই, কুরুর, পঞ্চালের, কৌশাম্বীর, উজ্জয়িনীর, বৈশালীর গণরাজারা সবাই তাঁর সঙ্গে মৈত্রী স্বীকার করেছেন। কিন্তু রাজসংঘের ব্যাপারটি কেউই ভালো করে বোঝেননি।

—বোঝেননি? না বুঝতে চাননি? ব্যক্তি বিম্বিসারের তাঁরা সবাই সুহৃৎ। সুহৃৎ? রাজা সেনিয় বিম্বিসার হাসেন। রাজনীতির নিরুক্ত-কারিকায় সুহৃৎ কথাটি বড় আপেক্ষিক। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থে, ব্যক্তিগত, কুলগত, গোষ্ঠীগত স্বার্থে একজন আর একজনের সুহৃৎ হয়। বৃহৎ রাজনৈতিক স্বার্থও আছে। কিন্তু বৃহৎ হলেও তা তো স্বার্থই! নিঃস্বার্থ বন্ধুতা কোনও রাজা কারও কাছ থেকে চাইতে পারেন না। চাওয়া ভ্রম। সে ভ্রমের মূল্য তাঁকে হৃৎ-পিণ্ড ছিঁড়ে দিতে হয়েছে। ব্যক্তি বিম্বিসার? ব্যক্তি বিম্বিসার কে? তাকে কেউ দেখতে পায়? দর্পণ? দর্পণও দেখে কি? সেই ব্যক্তি বিম্বিসারকে জম্বুদ্বীপের রাজকুল আশ্বাস দিয়েছেন নাকি? তিষ্য বলছে! তিষ্য আরও বলছে…রাজসংঘের তত্ত্ব বোধগম্য হতে আর একটু সময় লাগবে। সময়? তিনি হাসেন? সময় আছে নাকি? তিনি তো দেখছেন, সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। সময় আর থাকছে না। তিনি তাঁর রক্তের মধ্যে সময়ের সেই অবলোপ অনুভব করছেন যে!

হে তথাগত, এই জীবন ততটুকুই পারবে যতটুকু ব্যক্তির কর্ম নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। হে তথাগত, এই জীবন বহু আকাঙ্ক্ষার যোগফল, তুমি বলেছ। জীবনের শেষে মৃত্যু। দুর্বার। কেমনভাবে সে আসবে সে-ই স্থির করে। হে তথাগত…

ডান হাতটি তুললেন মহারাজ। আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে নয়। যেন বরাভয় দিচ্ছেন। অদ্ভুত! হত্যা করতে যাচ্ছে ঘাতক, তাকে অভয় দিচ্ছেন নাকি? মহাপাপ, মহাপাপ থেকে মহাভয়। অনন্ত নরক। জীবনে এবং জীবনান্তে। তাই অভয়!

—পিতাকে হত্যা করতে চাও? কেন?—একেবারে নিরুদ্বেগ প্রশ্ন, যেন অস্ত্র তোলেনি, কন্দুক তুলেছে কোনও বালক।

—আর কতকাল এই সিংহাসনে বসে আমার পথরোধ করে থাকবেন? আর কতকাল? কত আয়ু আপনার?

সভা শ্বাসরুদ্ধ করে শুনছে। সুনীথ, অহিপারক মুখ নত করেছেন, লজ্জায়, দুঃখে। কোনও নীতি নয়। লোভ, বর্বর লোভের কথাই শেষ পর্যন্ত বলল কুমার? বর্ষকার চেয়ে আছেন দূরের প্রাচীরের দিকে। কী ভাবছেন, বোঝা যায় না। সম্ভবত কী করে এই লোভকে বীর্যে পরিণত করা যায়, সেই কথা ভাবছেন উপায়কুশল মহাসচিব। চন্দ্রকেতুর মুঠির তরোয়াল কোষমুক্ত।

বিম্বিসার উঠে দাঁড়ালেন। কৌতুকের চিহ্ন মুছে গেছে মুখ থেকে।

—বসো। এ আসন ছেড়ে দিলাম। পিতৃরক্ত পাত করা কুশল কর্ম নয়।

সভা ত্যাগ করে চলে গেলেন তিনি। উত্তরীয়টি লুটোতে লুটোতে অবশেষে খসে পড়ে গেল। রাজসভা এবং অন্তঃপুরের মধ্যবর্তী পথে ছিন্ন পতাকার মতো পড়ে রইল।

যত দূর দেখা যায় দেখলেন সভাসদরা। সিংহকটি এখনও, প্রশস্ত পিঠ, পেশল কাঁধ। বীরপুরুষের আকৃতি। বীর কিন্তু অনিচ্ছু। নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।

পরিপূর্ণ সভার অনুচ্চারিত ধিক্কারের মধ্যে ভ্রূকুটি ভীষণ মুখে অজাতশত্রু সিংহাসনে বসলেন।

পুষ্পলাবীর গবাক্ষপথে জিতসোমা দেখল পথ যেন জনহীন। দু চারজন যা চলাফেরা করছে অত্যন্ত সন্তর্পণে, যেন প্রয়োজন সমাধা হয়ে গেলেই আপন বিবরে মুখ লুকোবে। সংবাদ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। কুমার কুনিয় নাকি রাজসভায় সর্বসমক্ষে মহারাজকে হত্যা করতে গিয়েছিল এবং মহারাজ রাজদণ্ড সেই পাপীর হাতে তুলে দিয়ে, রাজমুকুট সেই পাপীর মাথায় পরিয়ে সভাত্যাগ করেছেন।

—এ কী করলেন মহারাজ? তাঁর অনুগত রক্ষী, অমাত্য এরাও তো কিছু অল্প ছিল না! এতেই কি তিনি বাঁচতে পারবেন? শুধু জীবনের প্রতিই এত মায়া!

সহচরী বৃন্দা বলল—পুত্রের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধ করবেন? পিতা-পুত্র পরস্পরের রক্তপাত করছে সেটাই কি ভালো? শুনেছি অমাত্যরা সব মাথা নত করে বসেছিলেন, কেউ একটি কথাও বলেননি, কী বুঝবেন এতে রাজা?

ব্যর্থ ক্রোধে কক্ষের চারপাশে ঘোরে জিতসোমা। নিজেকে এত অযোগ্য মনে হয়! ওই সভায় উপস্থিত থাকার অধিকার সে কোনও মতেই অর্জন করতে পারেনি। মহারাজ তাকে ভৃতকভোগী অমাত্যের পদ দিলেন শেষ পর্যন্ত, কিন্তু তা গুপ্ত রইল। এই গোপনতায় তার সম্মত হওয়া উচিত ছিল কি। কুনিয়-দেবদত্তর দলকে দমন করার যে পরিকল্পনা সে করেছিল তা-ও মহারাজের সঙ্গে আলোচনা করার সময় পাওয়া গেল না। এই থের দেবদত্ত নিজেকে প্রকৃত বুদ্ধ বলে প্রচার করছেন। তাইতে মহারাজ বিরক্ত, ক্রুদ্ধ। সোমা তাঁকে বার বার বলছে রাজগৃহ তো কোনও শ্রমণ কোনও সন্ন্যাসীকেই ফেরায় না! কূটনীতির অঙ্গরূপে মহারাজ থের দেবদত্তকেও উপহার পাঠান না! গয়াশিরে তাঁকে একটি সুন্দর বিহার করে দিন! নিরাপদ দূরত্বও থাকবে, আবার বুদ্ধদ্বেষী এই স্থবির প্রশমিতও হবেন। দেবদত্ত রাজগৃহ থেকে দূরে এবং তুষ্ট থাকলে কুমারের সাহস দম্ভ আস্ফালন সবই অল্প হয়ে যাবে, কারণ অলৌকিক শক্তির ওপর কুমারের বিশ্বাস বালকের মতো। কিন্তু মহারাজ এত কূটনীতিজ্ঞ হয়েও এইটুকু করতে চাইলেন না। বুদ্ধদ্বেষী কাউকে তিনি কোনও ছলেই সইবেন না। …হয়ত মহারাজ মনে করেন, অকপট, অচঞ্চল থাকলে তথাগতই তাঁর অলৌকিক শক্তিবলে তাঁকে সাহায্য করতে পারবেন। কিন্তু এ বিশ্বাস কি ঠিক? তা হলে যে মুহূর্তে কুনিয়র হাত পিতৃবধে উদ্যত হয়েছিল, সে মুহূর্তে সে হাত কেন খসে পড়ল না? নাকি মহারাজ ওই সন্ন্যাসীকে আপন প্রাণের চেয়েও ভালোবাসেন?

জিতসোমা রক্ষীপ্রধানকে ডেকে পাঠায়। সে কিছু বলবার আগেই রক্ষীপ্রধান বলে—সেনাপতির কাছ হতে আদেশ এসেছে দেবি, আমরা কিছুক্ষণের জন্য যাচ্ছি।

—কেন ডেকেছেন?

—তা তো জানি না।

—অনুমানও করতে পারো না?

—অতিশয় গোপন কথা দেবি, সম্ভবত সেনাপতি আমাদের যতজনকে পারেন একত্র করতে চাইছেন।

—যাও।

রক্ষীদের বিদায় দিয়ে জিতসোমা প্রসাধনকক্ষে যায়। দীর্ঘ কেশ কাঁধ পর্যন্ত কেটে ফেলে। বক্ষে চর্মের বর্ম বাঁধে। পায়ে উপানৎ। পিঠে তূণ, কটিতে ছুরিকা। মাথায় করোটিকা শিরস্ত্রাণ। হাতে, জানুতে লাগিয়ে নেয় স্থূল চর্মের পট্টিকা, তাণ্ডব-নৃত্যের নটী সে, পুরুষসুলভ চলনের ছন্দ আয়ত্ত করতে তার বিলম্ব হয় না। সে অপেক্ষা করে। তার অনুগত রক্ষীদের অপেক্ষা।

এক দিন যায়, দু দিন যায়, তৃতীয় দিনও যায় যায়। রক্ষীরা আসে না। আসে কুমার। সংবাদ পেয়ে জিতসোমা বর্ম, শিরস্ত্রাণ, অস্ত্র, উপানৎ সব নামিয়ে রাখে। শুধু বসনের মধ্যে থাকে তীক্ষ্ণধার ছুরিকা।

আসনশালায় ভ্রূকুঞ্চিত মুখে কুমার কুনিয়, সঙ্গে রক্ষীরা। এবং এক শ্রমণ।

—ঘোষণা শুনতে পেয়েছ?

—পেয়েছি। এক দুর্বৃত্ত পিতার হাত থেকে রাজদণ্ড ছিনিয়ে নিয়েছে।

—সাবধান…সাবধান সোমা…কুনিয় চিৎকার করে উঠে দাঁড়ায়।

—মিথ্যা বলেছি?

—কুমার বীরোচিত কর্ম করেছে—পাশে এসে দাঁড়ালেন দীর্ঘদেহী শ্ৰমণ।

—বীর? —সোমা যত না ক্রুদ্ধ তার চেয়েও বুঝি বিস্মিত।

—কাপুরুষের হাতে রাজদণ্ড থাকা না থাকা সমান নারী। যে সন্ন্যাসীর নির্দেশে রাজ্য চালায় তার ওপর কে আস্থা রাখবে?

এই তা হলে সেই স্থবির দেবদত্ত!

বৌদ্ধ ধর্মসংঘের ভেতরে ইনি রাষ্ট্রীয় রাজনীতির কীট ঢুকিয়ে দিলেন তা হলে! এ কি কোনও সনাতন ঐতিহ্য? না কোনও ইতিহাসের আরম্ভ হল এভাবে? নির্বাসনা প্রব্রাজকরা তা হলে রাজনীতিতে এত বড় শক্তি? কারণ? কারণ কী? অশন-বসন নয়, বিলাস নয়, নারীও নয়, প্রভুত্ব। আর সব বাসনা যখন যায়, তখন সব বাসনার শক্তি একত্রিত হয় প্রভুত্বের বাসনায়। জিতসোমার মাথার ভেতরে রাজশাস্ত্রের কয়েকটি শূন্য পাতা উল্টে যাচ্ছে। সে লিখছে: সাবধান! রাজপুরোহিত শুধু ধর্মকার্যে রাজাকে সহায়তা করেন না। তিনি এবং যে কোনও পন্থের প্রব্রাজকদের সঙ্গে রাষ্ট্রনীতির সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকে। সাধারণ সূত্র—ক্ষমতার লোভ। প্রয়োগের ক্ষেত্র—প্রজাসাধারণ। উভয়েরই অস্ত্র—ভয়। রাজা ধনমানপ্রাণের ভয় সব সময়ে জাগিয়ে রাখেন রাজদণ্ড সামনে রেখে। আর সন্ন্যাসীর পলাশদণ্ড? অভিশাপের ভয়, নরকের ভয়, তির্যগ্ বা হীনযোনিতে জন্মের ভয়। হে রাজন, ভবিষ্যৎ যুগের রাজাসকল, আপনারা যদি সত্য সত্যই প্রজাপালক, লোকসেবক হন, হতে চান, তা হলে যে প্রব্রাজক, পুরোহিত, বৈরাগী আপনার ঘনিষ্ঠ হতে চাইবে তাকে গূঢ়, কূট, স্বার্থসন্ধানী জেনে দূরে রাখবেন। রাজা ও সন্ন্যাসী একত্র হলে তা কোনও অর্থেই রাজ্যের পক্ষে শুভ নয়। রাজার পক্ষেও তা শেষ পর্যন্ত অশুভ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন মহারাজ বিম্বিসারের ক্ষেত্রে হল।

—কথা বলছ না কেন জিতসোমা? এ কি! কেশ কেটে ফেলেছ কেন?

—এ তো কেশমাত্র, কারও মাথা তো আর নয়!

—কী বললে? রাজা কুনিয়র মাথা নিতে চাও?

রুষ্ট চোখ অন্য দিকে ফিরিয়ে নেয় জিতসোমা।

হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে হাসে কুনিয়, বলে—যাই হোক মহামান্য কাত্যায়নও তো এই কথাই বলেন, সে একটি পুঁথি বার করে, —পড়তে থাকে: যে রাজ্য নিজেকে বিতত করে না, প্রতিবেশী রাজ্যের অন্যায় সয়ে যায় সে রাজ্যের আয়ু শেষ হয়ে আসে।…মহামান্য চণক আমাদের সঙ্গে সহমত।

চমকে ওঠে জিতসোমা, কিছু বলে না।

দেবদত্ত বলেন—তক্ষশিলার স্নাতক। রাজশাস্ত্রের রচয়িতা তিনি। বহুদূর পর্যন্ত দেখতে পাবেন, বুঝতে পারবেন—এ আর অধিক কী?

কুনিয় তির্যক চোখে চেয়ে বলল—তিনি যে শ্রমণ গৌতমকে সবার সামনে স্পর্ধা জানালেন, তিরস্কার করলেন, তাঁর প্রভাব যে রাজার পক্ষে, রাজ্যের পক্ষে ক্ষতিকর এ কথা স্পষ্ট জানালেন—তাইতেই তো আমরা আরও ত্বরা করলাম। যে কোনও উত্থানের পেছনে তাত্ত্বিকের সমর্থন থাকা প্রয়োজন। তক্ষশিলক না হতে পারি। পণ্ডিতদের মেনে চলি।

—এ পুঁথি কোথায় পেলেন? ছিন্ন কেন?

—গান্ধার ভবনে! আর কোথায় পাবো? পাতাগুলি কক্ষের মধ্যে ইতস্তত বিচরণ করছিল।

—সে কী? তিনি কোথায়?

—আমরা সন্ধান করছি। মনে শঙ্কা রেখো না সোমা। দৈবরাত চণককে আমরা মাথায় করে রাখব। আর তোমাকে?…

কুমার কুনিয় এখন রাজা অজাতশত্রু, তার কথা শেষ করল না। প্রকৃতপক্ষে সে সোমাকে কোনও নির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দিতে পারছে না। অন্তঃপুরে তার মহিষী পদুমাবতী অত্যন্ত চতুর, ক্ষমতাবতী, অভিমানিনী হয়ে উঠেছে। সদ্যবিবাহিতা সুন্দরী তরুণী, কুনিয়র তার প্রতি আকর্ষণও কিছু অল্প নয়। অথচ সোমা এক অমূল্য সম্পদ, পিতার সঙ্গে সংগ্রাম করে পাওয়া। সোমাকে হারাতে হলে…হারাতে হলে…কুমার ক্ষিপ্তের মতো ঘাড় ফেরায়। না। না।

রাত্রি দ্বিপ্রহর। শ্মশানের স্তব্ধতা চারদিকে। কিন্তু রাজগৃহের ঘরে ঘরে শিশু, রোগী ও অতিবৃদ্ধ ছাড়া নিদ্রা যায়নি কেউ। যুবরাজ অজাতশত্রু রাজা হয়েছেন এ ঘোষণা চলেছে সারাদিন, রাতের প্রথম প্রহর পর্যন্ত। এখন সে ঘোষণাও বুঝি ক্লান্ত। যারা এতদিন রাজাকে দোষারোপ করছিল, তারা বিষণ্ণ হয়ে ঘরের মধ্যে বসে। হট্টে, আপণে ক্রয়-বিক্রয় তেমন হয়নি। বিম্বিসার সমালোচিত হলেও লোকপ্রিয় ছিলেন, প্রজাদের ক্ষতি কখনও করেননি। পিতাকে সিংহাসনচ্যুত করে যে সিংহাসনে বসে, তার হাতে নিরাপত্তা থাকবে কিনা এই প্রশ্নে ভারাক্রান্ত সবার মন। কিন্তু রাজপরিবারের ব্যাপার, অমাত্যরাই কিছু বলছেন না, সাধারণে কী বলবে!

মহাশ্রেষ্ঠী যোতীয় জটিল শ্ৰেষ্ঠীকে বললেন—বুঝলে কিছু?

জটিল সতর্ক কণ্ঠে বললেন—আমাদের ধনমানপ্রাণ?

—নিরাপদ ছিল, এখন বিপন্ন।

—বলছেন?

—বলছি—স্থূল ভ্রূযুগের মধ্যে অসংখ্য কুঞ্চন, যোতীয় চোখ দুটিও কুঞ্চিত করে যেন অদূরকালের অভিসন্ধি বোঝবার জন্য সামনে চেয়ে রইলেন।

—রাজ্যের হয়ত ভালোই হবে। মহারাজ তো ইদানীং…

—বাক্য শেষ করো জটিল। মহারাজ তো ইদানীং কী? সুবিচার করছিলেন না? না, তোমার সঞ্চিত ধনের কলসগুলি চেয়ে পাঠিয়েছিলেন! কোনটি?

—কোনওটিই নয় মহাসেট্‌ঠি, রাজোচিত উদ্যম-উদ্যোগের কিছু অভাব দেখা দিয়েছিল। এই মাত্র।

—তোমারও পুত্র আছে জটিল। ভেবে দেখো…

রাজসভাতেও অমাত্যরা গম্ভীর মুখে বসে থাকেন, গ্রামণীরা ব্যাপার শুনে শুষ্কমুখে ফিরে চলে যান। রাজগৃহ-শ্রেষ্ঠী অহিপারক দিনের পর দিন অনুপস্থিত থাকেন, তাঁর নাকি কঠিন অসুখ। অন্তঃপুর থেকে সংবাদ আসে রানিরা অজাতশত্রুর সাক্ষাৎ-প্রার্থী। থের দেবদত্ত বলেন—সাবধান মহারাজ, আপনার পিতা ছিলেন লোকপ্রিয়। তাঁকে চক্ষের সামনে রেখে রাজত্ব করা দুষ্কর হবে। আরও সাবধান, আপনার মাতারা আপনাকে দ্রব করতে চেষ্টা করবেন।

সেনানীগ্রামে উপঢৌকন যায়—সেনারা নতুন রাজার অভিষেক উপলক্ষে উৎসব করো। নৃত্য-গীত, ভোজ, যত প্রকার আমোদ-প্রমোদ জানা আছে, সব। ব্যয় বহন করবেন রাজা। রাজ্যময় উৎসবের ঘোষণা হতে থাকে। অন্ত্যজ-পল্লীতে নতুন বস্ত্র, গন্ধানুলেপন, উৎকৃষ্ট তণ্ডুল বিতরিত হয়। দান যায় শাক্যপুত্রীয় ছাড়া অন্য শ্রমণসংঘগুলিতে। রাজা অজাতশত্রু অন্তঃপুরে আসেন ভয়ানক অপরিচিত মুখ নিয়ে, সঙ্গে নতুন রক্ষী সব। অঙ্গদেশ থেকে এসেছে। আদেশ হয়—

—কারারুদ্ধ থাকবেন রাজপিতা, এখন থেকে।

আর্তনাদ করে ওঠেন রানিরা।

বিম্বিসার বলেন—আর কী চাও?

—রাজদ্রোহ প্রচার করছেন অন্তঃপুরে বসে!

—প্রমাণ?

—আপনাকে দেখাতে শোনাতে বাধ্য নই।

অস্ত্র ঝনঝন করতে করতে চলে গেল অজাতশত্ৰু।

ছেল্লনা সকাতরে বললেন—মহারাজ! কিছু করুন!

—আর কিছু হয় না—বিম্বিসার বললেন— এ-ই আমার কর্মফল। তোমারও কর্মফল রাজ্ঞী। হল্ল-বেহল্লকে অবিলম্বে সেচনকের পিঠে মাতুলালয়ে পাঠাও।

—হল্ল-বেহল্ল নিয়ে গেছে আমার মঙ্গলহস্তী, আঠার লহর রত্নহার। এ সব রাজার সম্পদ। —অজাতশত্রু ক্রোধে আগুন হয়ে কারাগারে প্রবেশ করে—কেন দিয়েছেন?

—এক পুত্রকে সমগ্র রাজ্য দিলাম। আর দুই পুত্রকে মাত্র একটি হস্তী ও একটি রত্নহার। অন্যায় হল?

—ওই হস্তী রাজার বাহন। ওই হার কণ্ঠে নিয়ে রাজা সিংহাসনে বসেন।

ভদ্রাবতী আছে, নালাগিরি আছে, বাহনের অভাব কী? রত্নহারেরও অভাব নেই কোষাগারে। ক্রোধে গর্জন করে অজাতশত্রু।

ক্ষীণভাবে মনে পড়ে রাজার, এই পুত্র তাঁর প্রথম বৈধ পুত্র। একে দিনে দিনে বেড়ে উঠতে দেখেছেন মাতৃগর্ভে। ভূমিষ্ঠ হবার পর সে কী উৎসব সমস্ত রাজ্যে। কুনিয়কে অদেয় সেদিন তাঁর কিছুই ছিল না। সারা বাল্য এই পুত্রের কেটেছে তাঁর প্রশ্রয়ে, সচিবরা বলেছিল তক্ষশিলায় পাঠাতে। অত দূরে বলে তিনি বারাণসী থেকে আচার্য আনান। স্বতন্ত্র প্রাসাদে আচার্য এবং শস্ত্রাচার্যদের কাছে শিক্ষা কুনিয়র। কোশলদেবীর এতে আপত্তি ছিল। তিনি ঐতিহ্যশালী কোশল রাজবংশের কন্যা, তক্ষশিলার শিক্ষা না হলে সত্যিকার রাজবংশের উপযুক্ত হবে না পুত্র, এইজাতীয় মনোভাব তাঁর ছিল। কিন্তু কুনিয় নিজেও যেতে চাইল না। তিনিও মেনে নিলেন। ফলে, প্রকৃত ব্রহ্মচর্য পালনই করতে হয়নি কুমারকে। আরও অতিরিক্ত স্নেহ ছিল তার দেহগত ত্রুটির জন্য।

—হল্ল-বেহল্লকে ফিরে আসতে আদেশ করুন। হস্তী এবং হার নিয়ে।

—তারা পালিয়েছে প্রাণের ভয়ে কুনিয়। অভয় দিলে নিশ্চয়ই আসবে।

আর উপহার দিয়ে ফিরিয়ে নেবার আগে বিম্বিসারের মৃত্যুও ভালো।

—তবে তাই হোক। দন্তে দন্ত ঘর্ষণ করে উচ্চারণ করে সে।

অজাতশত্রু আদেশ দিয়ে গেল বন্দীর আহার বন্ধ। কেউ যেতে পারবে না তাঁকে দেখতে, একমাত্র কোশলদেবী ছাড়া।

কদিনের মধ্যেই বৃদ্ধ হয়ে যান বিম্বিসার! অন্ধ কারাকক্ষে একটিমাত্র ছিদ্র। সেই ছিদ্রপথে গৃধ্রুকুট দেখা যায়, আলোকিত সেই বিন্দুটির দিকে চেয়ে চেয়ে রাজ্যচ্যুত মগধরাজ ভাবেন—কে আমি? সত্যই বা কী? ষোড়শ বর্ষের যে কিশোরকে তার পিতা রাজমুকুট পরিয়ে দিয়েছিলেন, যে যুবক শত্রুরাজ্যের শত বিপদ অগ্রাহ্য করে এক অনন্যার প্রণয়াহ্বানে সাড়া দিয়েছিল, যে পরিণতযৌবন বীরপুরুষ এক অলোকসামান্য শ্রমণকে আত্মনিবেদন করেছিল, সে কি সত্য? না এই ক্ষুৎপিপাসা-কাতর ভগ্নহৃদয় বৃদ্ধ সত্য? দুটি আমিই কি এক ব্যক্তি হতে পারে? কোন্ কর্মফল দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন আকৃতির, ভিন্ন ভাগ্যের মানুষকে যুক্ত করছে? মঙ্গলহস্তীর পিঠে সেইসব দুঃসাহসী অভিযান…শতসহস্র প্রজার জয়ধ্বনি, সপারিষদ সেই সব তীর্থগমন!

ক্রমশ হতবল হতে থাকে শরীর। অবসন্ন মন। চৈতন্য আবিল। বৃদ্ধ আর ভালো করে দেখতে পান না। চিন্তাগুলি বিবর্ণ চিত্র গড়ে। গড়ে আর ভেঙে যায়। শত চেষ্টা করেও সেগুলি সমঞ্জস ও সুস্থির রাখতে পারেন না। কে আমি? এই চেতনা যাকে আমি বলে জানে সে কে? কয়েক দিন আগেও তো সে ছিল না? হায় তথাগত! বলেছিলে বটে প্রতিটি ক্ষণ স্বতন্ত্র; নিরবচ্ছিন্ন ধারে ক্ষণ পরম্পরা আসে তাই মনে হয় এক। প্রকৃতপক্ষে এক নয়। বালক বিম্বিসার, যে জলের মুকুরে মুখ দেখত, বান্ধবী সুমনাকে যখন তখন প্রহার করত ও প্রহার খেত, যে বিম্বিসার পিতার পরাজয়ের শোধ নিতে অঙ্গরাজ ব্ৰহ্মদত্তকে হারিয়ে নির্মূল করে দেয়, যে বিম্বিসার মহাসমারোহে শ্রাবস্তীর রাজকুমারীর পাণিগ্রহণ করল সমবেত জয়কারের মধ্য দিয়ে, এক শ্ৰমণ যুবকের অলোকসামান্য প্রতিভাচ্ছটায় মুগ্ধ হয়ে যে তাঁকে রাজন্যপদ, সেনাপতিপদ সব দিতে চাইল, দেশনা শুনছে, মহারানি ক্ষেমার সঙ্গে রহস্যালাপে মত্ত, চণক…দৈবরাত চণকের সঙ্গে সেই আশ্চর্য মিলনে মিলিত বিম্বিসার, ভোজনগৃহের কেন্দ্রে আমরণ বন্ধুত্বের অঙ্গীকার…হায় চণক…হায়, এগুলি ভিন্ন ভিন্ন বিম্বিসার, নানা বিম্বিসারের এক মালা এ। একটির কর্ম অন্যটিকে সৃষ্টি করে যাচ্ছে ক্রমাগত…তৈলধারের মতো। এগুলিকে স্বতন্ত্র বলে পরিষ্কার চিনতে পারছেন তিনি আজ। কার্যকারণ সম্পর্কে বিম্বিসারগুলি গ্রথিত।

ভগবন, ভগবন পিপাসায় বুক ফেটে যায়। করুণা করো করুণা করো। তোমার সেই অলৌকিক করুণাধারে স্নাত করাও এই বিম্বিসারের জীবন, যা ধ্বস্ত, ব্যর্থ হতে চলেছে। এ কি ঘোর অন্যায়? ঘোরতর পাপ! আত্মজ হয়ে স্নেহশীল পিতাকে কারারুদ্ধ করে? অনাহারে হত্যা করে? জননীর দেহ অনুসন্ধান করায়! কোন্ কর্মফলে এই ব্যর্থ পিতা, ব্যর্থ রাজা সৃষ্টি হল? হে ভগবন!

গবাক্ষের দিকে মুখ তুলে চান বন্দী। আশ্চর্য! তথাগত আবির্ভূত হয়েছেন! পসেনদিকে সহস্র বুদ্ধ দেখিয়েছিলেন, আজ বিম্বিসারের ডাকে তমসের মধ্যে জ্যোতিঃস্বরূপ হয়ে আবির্ভূত হয়েছেন। চোখ ভরে, প্রাণ ভরে সেই অতীন্দ্রিয় দৃশ্য দেখতে থাকেন বিম্বিসার। মহাশূন্যের পটে ভগবান তথাগত বুদ্ধ। দেখতে দেখতে দেখতে দেখতে অবশেষে বিম্বিসার নামের একদা প্রতাপশালী প্রজারঞ্জক অধুনা আত্মপরিচয়হারা, দীনাতিদীন বন্দী সহসা বুঝতে পারেন, এ কোনও অলৌকিক আবির্ভাব নয়। এখন কারার বাইরে পৃথিবীতে প্রত্যূষ এসেছে। তথাগত দেশান্তরে ছিলেন, এসে নিদারুণ সংবাদ শুনেছেন, রাজগৃহের বিস্ফোরক বাতাবরণে নিষ্ঠুর রাজনীতির কাছে উপরোধ করে বিম্বিসারকে মুক্ত করবার সাধ্য তাঁর নেই। তিনি শুনেছেন গৃধ্রকূটশীর্ষ থেকে এই কারাকক্ষ দেখা যেতে পারে। তাই সূর্যোদয়ের লগ্ন থেকে দাঁড়িয়ে আছেন সেখানে। তিনি যত সহজে ভগবানকে দেখতে পাচ্ছেন, ভগবান তত সহজে তাঁকে দেখতে পাচ্ছেন না। আদৌ পাবেন কি না সন্দেহ। কিন্তু তিনি চেষ্টা করছেন। বৃদ্ধ তথাগত, বৃদ্ধ বন্দী বিম্বিসারকে দেখবার চেষ্টা করছেন। সকরুণ, কাতর নয়ন। অশ্রুবিন্দুগুলি বুঝি চোখের প্রান্তে থমকে আছে। হাত দুটি কি অঞ্জলিবদ্ধ! সম্ভবত পরমপুরুষ উপনিষদোক্ত ঈশের কথা যিনি কখনও বলেন না, আজ পরমতর কোনও শক্তির কাছে তাঁর শ্রেষ্ঠ সুহৃৎ বিম্বিসারের জন্য প্রার্থনা করছেন। এবং সেই মুহূর্তে বিম্বিসার এ-ও বুঝতে পারেন, কী সেই কর্ম যার এই ফল। তথাগত, তথাগতরূপ সম্মোহই সেই কর্ম, এই রুদ্ধ কারা তারই ফল। শুধু তথাগত কেন, বিশ্বনিয়ামক কোনও মহাশক্তি পর্যন্ত তার ব্যত্যয় ঘটাতে পারে না।

তথাগতরটিত কর্মতত্ত্বের এবম্বিধ মর্মান্তিক উদ্‌ভাসই মহারাজ বিম্বিসারের জীবনের শেষ প্রাপ্তি।

২২

বাইরে অনেকগুলি পেঁচা একসঙ্গে যেন আর্তর করে উঠল। কাঁ কাঁ ক্রাঁরর্‌র্ ক্রাঁরর্‌র্। তারপরেই কাকেদের তুমুল কোলাহল। কারা ধ্বংস হচ্ছে বোঝা যায় না। কিছুক্ষণ আগে প্রাসাদের দিক থেকে উপর্যুপরি ভেরীর আরাব শোনা গেছে। সামান্য একটু তন্দ্রা এসেছিল, ভেরীর অস্বাভাবিকতাতেই সম্ভবত সে লঘু তন্দ্রা ছুটে গেল। রাতের পর রাত নিদ্রা আসে না জিতসোমার। পুষ্পলাবীর গর্ভে সে বহুদিন হল বন্দিনী। কত দিন সে আর গুনে গুনে পারে না। রাজপ্রাসাদ, রাজগৃহ নগরীর অভিজাতকুল, মগধের রাজনীতি সব, সব কিছুই যেন গান্ধার নটীকে ভুলে গেছে। জিতসোমার দেহ ক্ষীণ, চোখের চারপাশে অনিদ্রার কালি। রাজগৃহ কেমন যেন ছিল? তার পাহাড়, পাহাড়িয়া পথ, কাননগুলি? সব যেন দূর জন্মের স্মৃতি। জিতসোমা বাইরে যেতে পারে না। তার কাননে, প্রাসাদের প্রবেশপথগুলিতে পাহারা দিচ্ছে অজ্ঞাতকুল সব রক্ষী। কক্ষ থেকে কক্ষে ভ্রমণ করা ছাড়া তার আর কোনও উপায় রাখেনি এরা। প্রথম যেদিন বাইরে যাবার চেষ্টা করেছিল, তিনজন ভীষণদর্শন অস্ত্রধারী সঙ্গে সঙ্গে চলতে লাগল। সোমা দেখল তার রথ নেই। মন্দুরা শূন্য। কয়েক পা যাবার পর সে ফিরে এসেছিল।

তার দাসী ধ্রুবা প্রথম প্রথম হট্টে যেত। শাক, পর্ণ, মাংস, মৎস্য, ঘৃত.. তণ্ডুল… প্রয়োজন কি একটা? ধ্রুবা এসব ছাড়াও আনত সংবাদ।

এদিক ওদিক চেয়ে মৃদুকণ্ঠে বলত—শুনেছেন দেবি, মহারাজ নাকি এখন কারাগারে।

—সে কি? সিংহাসন ত্যাগ করার পরেও?

—তাই তো শুনছি? কুমারের সঙ্গে কী রত্নহার নিয়ে কলহ…

—আজ বড় মর্মান্তিক কথা শুনে এলাম।

—কী!

–কুমার নাকি মহারাজকে অনাহারে রেখেছে। কাউকে তাঁর কাছে যেতে পর্যন্ত দেয় না। এক মহারানি ছাড়া। তা মহারানি নাকি কবরীর মধ্যে, পাদুকার মধ্যে লুকিয়ে ভোজ্য নিয়ে যেতেন। ধরা পড়ে গেছেন। অকথ্য লাঞ্ছনা হয়েছে তাঁর। ভাবতে পারেন! রাজমহিষী, রাজার মা!… শুনছি কুমার নাকি মায়ের বিরুদ্ধে অস্ত্রও তুলেছিল। জীবক কোমারভচ্চ আর ওই অমাচ্চ বস্‌সকার মিলে থামান।

—প্রজারা, বড় বড় গৃহপতিরা কেউ কিছু বলছেন না?

—প্রজারা ভয়ে স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। এতটুকু বিরুদ্ধাচরণ করলেই ভীষণ দণ্ড হয়ে যাচ্ছে। অমাচ্চ মহানাগকে হত্যা করেছে। সেট্‌ঠি পুন্নক পালিয়ে যাচ্ছিলেন, গঙ্গাবক্ষ থেকে তাঁকে ধরে এনেছে। ওই দেবদত্ত থের নাকি মহা ইদ্ধিমান। হাতে বালুমুঠি ধরে মন্তর পড়লে তা মুষলমুঠি হয়ে যায়।

কিন্তু এই সব সংবাদের প্রবেশ এখন থেমে গেছে। রক্ষীরা একদিন স্থবিকায় করে প্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলি নামিয়ে রাখল একে একে। শাক, পর্ণ, মৎস্য, মাংস, ঘৃত, তণ্ডুল…। অপাঙ্গে একবার চাইল, সে কী দৃষ্টি! ভালো। কী চায় এই কুমার! বুদ্ধপূজা করার অপরাধে একটি বালিকা নটীকে পর্যন্ত না কি হত্যা করেছে রাজপুরীতে। শ্রীমতী। চন্দ্রকেতু কারাগারে, মহানাগ নিহত। আরও বহু বিম্বিসার ভক্ত, বুদ্ধপন্থী রাজপুরুষ হয় কারাদণ্ড ভোগ করছেন, নয় মৃত্যুদণ্ড। ওই অমাত্যদের সঙ্গে তার যোগাযোগের কথা কি এতদিনেও প্রকাশ পায়নি? তাকেও হত্যা করুক না। হত্যা করো। সোমাকে হত্যা করো কুমার। শৃঙ্খলিত করতেও অন্তত এসো! সোমা কোনদিন তোমার প্রতি সুমুখ হবে না। সে ভক্তি করেছিল তোমার পিতাকে।

কুট্ট কুট্ট কুট্ট কুট্ট… কোথায় যেন কাষ্ঠকুট্ট পাখি শব্দ করছে। একটু পরেই অদূর অরণ্য থেকে ভেসে আসে কৃষ্ণসার পুরুষের হ্বাক হ্বাক হ্বাক। আবার কাষ্ঠকুট্টর কুট্ট কুট্ট কুট্ট…

এত রাতে কাষ্ঠকুট্ট? সহসা সতর্ক হয়ে উঠল জিতসোমা। উত্তরীয়টি ভালো করে মাথায় জড়িয়ে, ডান হাতে ছোট ছুরিকা নিয়ে সে প্রস্তুত হয়। এ অন্য কোনও নিশাচর। শব্দটি লক্ষ্য করে সে বাতায়নের দিকে এগিয়ে যায়। নিঃশব্দে খুলে ফেলে কপাটদুটি।

এক অঞ্জলি ম্লান চন্দ্রালোক।

—ভদ্রে! —মৃদু বৃষ্টিপাতের মতো কণ্ঠস্বর। বহু বর্ষার ওপার থেকে কণ্ঠটি ভেসে আসে। বহু মেদুর বর্ষা, বহু বিফল বসন্ত, বহু নীলবর্ণ শীত, পীতবর্ণ গ্রীষ্ম। এই কণ্ঠ আর শুনতে পাওয়া যাবে আশা ছিল না। শুনলে হৃদয় এমন করবে জানা ছিল না।

ছায়াশরীর ভেতরে প্রবেশ করে।

—আজ রাত্রির প্রথম যামে মহারাজ… প্রয়াত হলেন।

উদ্গত ক্রন্দনধ্বনি অন্ধকার গ্রাস করে নেয়। দুজনে অতি নিকটে। মাঝে একটি আলিঙ্গন থমকে আছে।

—আপনি কি জানেন দৈবরাত নির্বাসিত?

—সে কী? কেন?

জিতসোমার পায়ের তলায় পৃথিবী প্রকম্পিত হচ্ছে।

সম্ভবত গৌতম বুদ্ধর বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য। সম্ভবত কেন তাই-ই।

—কত দিন?

—অনেক দিন। তার পরেই কুমারের এই দ্রোহ…মহারাজের পাশে দুঃসময়ে তিনি রইলেন না। অঙ্গীকার ছিল উভয়ের মধ্যে, মহারাজ মানলেন না…নিয়তি…। ভদ্রে কেউ জানে না তিনি কোথায় গেছেন। কারাগারে অমাত্য চন্দ্রকেতুর কাছে শুনলাম… মহারাজের দেওয়া স্বর্ণ, বাহন, বসন, অস্ত্র সমস্তই প্রত্যাখ্যান করে চলে গেছেন।

নিমেষগুলি নিঃশব্দে পার হতে থাকে। বিশুষ্ক, অশ্রুহীন।

—ভদ্রে, আজ নগরী অরাজক, আপনার রক্ষীরা প্রাসাদের দিকে চলে গেছে। কুমার সম্ভবত গণ-উত্থান আশঙ্কা করছেন। আসুন, আমরা রাজগৃহ ছেড়ে চলে যাই।

পাঞ্চালের বাহু গান্ধার নটী বিম্বিসার-অমাত্য জিতসোমাকে ঘিরে ধরে।

নীলকৃষ্ণ বনরেখার ওপর গৈরিক পথটি বাঁক নিতে নিতে চলেছে। বিসর্পিল রেখায় চলেছে সার্থ। বারাণসী বণিকদের তীর্থ। এমন পণ্য নেই যা বারাণসীতে পাওয়া যায় না। এমন সার্থ নেই যারা বারাণসীতে বাণিজ্যার্থে আসে না। প্রাচী থেকে বহু বছর স্থলবাণিজ্য করে সার্থ মধ্যদেশে স্বগৃহে ফিরছে। বারাণসী হয়ে শ্রাবস্তী যাবে। রৌরূক থেকে কৌশাম্বী হয়ে আবার আসছে আরও একটি দল। এরা যাবে চম্পা, দক্ষিণগিরি, আলবী। বারাণসী হয়ে এসেছে। উভয় দলের দেখা হয়েছে উরুবেলা গ্রামের কাছে। দুটি দলেই রয়েছে শ্বেতবসনধারী নিয়ামক, লোহিত বেশ পরা রক্ষীরা। তাদের হাতে লগুড়, ধনুর্বাণ, তীক্ষ্ণ ধার ছুরিকা। বণিকদের অধিকাংশই কুসুমবর্ণের উত্তরীয় ও পাটল অধোবাস পরেছে। দীর্ঘ পথ পার হবার সময়ে ধূলির ভয়ে তারা এই বর্ণগুলিই নির্বাচন করে। সিন্ধু-সৌবীর থেকে আগত দলটির সঙ্গে অশ্বতর ও গর্দভ ছাড়াও রয়েছে কতকগুলি উট। মরুদেশ থেকে সংগ্রহ করে আনা হয়েছে। এই মরুবাহন উষ্ট্রদেবদের বিশেষ মর্যাদাসহকারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যানরূপে এদের অসীম গুণগুলির প্রচার হবে অঙ্গদেশে। এঁদের প্রধান পণ্য রত্ন। বারাণসীর হাটে সবই প্রায় বিকিয়ে গেছে। সম্ভ্রান্ত রুচিমান ধনপতিরা, মণিকাররা কিনেছেন।

অঙ্গদেশের সার্থ নিয়ে চলেছে তামা, লোহা, বসন, কিলিঞ্জক, সুরা। সার্থবাহ নন্দিয় রয়েছেন এই দলের পুচ্ছের দিকে। তাঁর বাহন একটি অশ্বতর। অশ্বতরই ভালো, তা যদি বলেন। অশ্ব থেকে একবার তিনি পড়ে গিয়েছিলেন। গুরুতর কিছু হয়নি। কিন্তু শিক্ষা হয়ে গেছে। জীবনটি দুর্মূল্য বস্তু। বহু ভাগ্যবিপর্যয়, আবার সৌভাগ্য, দৈব করুণা, মানুষী সহায়তা ইত্যাদি মিলিয়ে এখন একটি পরিতোষজনক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অত সহজে দুম বলতে অশ্বের পিঠ থেকে পড়ে গেলে হয়! অপর দলটির কাছ থেকে তিনি দুটি উট কিনেছেন, সেগুলিকে এর পরে পশ্চিমে বাণিজ্যযাত্রা করার সময়ে ব্যবহার করবেন ভেবেছেন। কিন্তু নিজে ওগুলির ওপর কখনই চড়বেন না। বালুকাময় মরুকান্তারে নাকি চড়তেই হয়।

নন্দিয় অপর দলটির সার্থবাহর কাছ থেকে অনেক রত্ন এবং উপরত্ন কিনেছেন। বৈদুর্য, সিতমণি, বিদ্রুম, অকীক, স্ফটিক, নামহীন বহু বর্ণের উপরত্নই অধিক। নন্দিয়র ইচ্ছা বারাণসীতে মণিকারপল্লী থেকে এই রত্নগুলি দিয়ে পত্নী ময়ূরীর জন্য একটি ঘনমট্‌ঠক নির্মাণ করাবেন। এই অলঙ্কার পরেন বিসাখাভদ্দা, ময়ূরীর সখী। অত মূল্যবান অলঙ্কার নন্দিয় এ-জন্মে আর নির্মাণ করাতে পারলেন না। রত্নগুলির স্থানে উপরত্ন দিলে হয়ে যেতে পারে। বড় সুন্দর অলঙ্কারটি। নিজের জন্যও একটি রত্নহার গড়াবেন নন্দিয়। সকলের অলক্ষ্যে পেটিকা থেকে একটি মুকুর বার করে, কেশগুলি আঁচড়িয়ে নেন সার্থবাহ। মুখটি তো এখনও ভালোই আছে। তেমন বয়সের রেখা তো কই…!

পেছন থেকে একটি তরুণ অপর একটি তরুণকে বলল— খুল্লতাতর মাথাটি গেছে। কোসল যত এগিয়ে আসছে দর্পণে মুখ দেখা ততই বেড়ে যাচ্ছে।

কথাটি কানে যায় নন্দিয়র। খুল্লতাত? কোন পিতার সম্পর্কে তোমাদের খুল্লতাত হই বাপা! যাক জেট্‌ঠতাত যে বলোনি এই যথেষ্ট। সার্থবহ নন্দিয় মুকুর তুলে রেখে ঈষৎ কর্কশ কণ্ঠে চেঁচান— বাপা হে, একটু পা চালিয়ে বনের দিক থেকে অনেক সময়ে তরক্ষু কি দ্বীপী ঘাড় কামড়ে ধরে নিয়ে যায়।

শিবির পড়ে দুই পক্ষেরই। একটি ছোটখাটো গ্রামই হয়ে যায় যেন। ব্যস্ত সবাই। পশুগুলিকে বাঁধা, জল, ঘাস, খড় দেওয়া। শিবিরের ভেতর বাহির পরিষ্কার করা। শকটগুলিকে মাঝখানে রাখা, রাতে সমস্ত অঞ্চলটি ঘিরে অগ্নিকুণ্ড হবে তার জন্য কাঠকুটো সংগ্রহ করা, মাটি কাটা। দুই দলের বণিকরা, নিয়ামকদ্বয়, বসে বসে বিশ্রাম নেন।

ক্রমে অগ্নি জ্বলে। পাক হয়। মুক্ত আকাশের তলায় অন্ন সিদ্ধ হবার সুগন্ধ ওঠে। ভিন্ন ভিন্ন বণিকদল স্বতন্ত্র পাকশাল খুলেছে।

—তোমাদের কী ভাই?

—মাংসভক্ত। তোমাদের?

—কুল্মষ হচ্ছে ভালো মুদগ ও শ্যামাক ধানের তণ্ডুল দিয়ে। বর্তক পাখি আছে কতগুলি, পুড়িয়ে নেবো।

—বতিঙ্গণ নাই? বর্তক-পোড়ার সঙ্গে লাগবে ভালো।

—আছে। সার্থবাহর আদেশ নাই। কাল হবে।

অদূরে একটি সরোবর। তার তীর দিয়ে দিয়ে চলে যান দুই শ্রমণ। সম্ভবত জলপান করে উঠেছেন। ছায়ার মতো দেখা যায় দুজনকে।

—ভো সমন!

কথা কানে যায় না শ্ৰমণদের।

—ভো ভো সমন!

দুজনে থেমে গেছেন।

—সাক্কপুত্তীয় যেন মনে হয়! কোথা হতে আসা?

হাত ঘুরিয়ে দিক-নির্দেশ করে শ্রমণরা আবার চলবার উপক্রম করেন।

—অরে! যান কই? রাজগহ হতে আসেন নাকি?

মাথা নাড়েন শ্রমণরা।

—রাজগহে তো ভারি গোল?

মাথা নাড়েন শ্রমণরা।

—নতুন রাজা সাক্কপুত্তীয়দের ওপর অত্যাচার করছেন নাকি?

আবার মাথা নাড়ছেন শ্রমণদ্বয়।

—কী ডাইনে-বামে মুণ্ড নাড়েন সমন তখন হতে? স্বর নাই? ভাষা নাই? আমি এক সময়ে তীত্থিক ছিলাম, সমন-টমনের নাড়ি-নক্ষত্তর জানি। অত মান আমার কাছে পাবেন না, তা বলে দিচ্ছি। যাবেন কোথায়?

একটু ইতস্তত করে একজন বললেন—সাবত্থি।

—পাটুলির দিকের দ্বারগুলি বন্ধ করে দিয়েছে, না? বড় গোল। তা সাবত্থি তো আমরাও যাবো, বারাণসী, সাকেত হয়ে। বসুন না! আমাদের গো-শকটে আপনাদের নিমন্ত্রণ রইল। যতদিন না সাবত্থি পৌঁছাই। এতে দোষ নাই সমন।

সার্থবাহ নন্দিয় দুই শ্রমণকে পাশে বসান। আবার সার্থবাহকে জিজ্ঞাসা করেন— তা উদয়ভদ্দ, রোরুক ছাড়া আর কোথাও গিয়েছিলেন নাকি?

—ভরুকচ্ছে গিয়েছিলাম ভদ্দ। সমুদ্দুর দেখা হল। সে কী অকূল জলরাশি! নীল-হরিৎ বর্ণ। মহা বিস্ময়ের ব্যাপার সে। আবার শুনতে পাই ওই বারিধির ওপারেও নাকি ভূমি আছে।

—থাকুক—নন্দিয় বললেন—তা কখনই পৃথ্বী নয়। প্রেতলোক-টোক হতে পারে। কী বলেন সমন!

শ্ৰমণ দুজন বসে আছেন বাক্যহীন।

—মগধের নতুন রাজা কিন্তু সেট্‌ঠিদের ওপর শক্তি দেখাতে যাচ্ছেন, কাজটা ভালো করছেন না। কী বলেন!

মাথা নেড়ে সম্মতি জানান শ্ৰমণরা।

—সেট্‌ঠি-জেট্‌ঠক যোতীয় মহোদয়ের ঘটনাটি শুনেছেন নাকি ভদ্দ উদয়!

উদয় শোনেন নি। মহা উৎসাহে ঘটনাটি সবিস্তারে বলতে লাগলেন নন্দিয়।

—সেনাদল নিয়ে রাজা অজাতশত্রু তো গেছেন যোতীয়র প্রাসাদে। উদ্দেশ্য সম্পদ সব অধিকার করা। যোতীয়র সম্পদ অতুল, জানেন তো? সারা জম্বুদ্বীপ ওঁর নাম জানে, মান দেয়।

উদয় বললেন— আমরা অঙ্গদেশে মেণ্ডক মহোদয়কে মানতাম। এখন উনি প্রয়াত। ওঁর পুত্র ধনঞ্জয়ও মহাসেট্‌ঠি। তিনি অবশ্য…

—ওঁর কথা আপনি কী বলবেন? নন্দিয় বিজ্ঞ ভঙ্গিতে হাসতে লাগলেন। উনি তো আমাদের সাবত্থির মিগারমাতা বিসাখার পিতা। মিগারমাতার সখী আবার আমার পত্নী। এই সমনরা সাবত্থিতে গিয়ে যদি মিগারমাতু প্রাসাদে ওঠেন, কিছুর অভাব হবে না। নিশ্চিন্তে ধম্মকথা কইতে পারবেন।

—যোতীয় সেট্‌ঠির ঘটনাটি বলবেন না? —সার্থবাহ উদয়ই শুধু নয় আরও অনেকে নন্দিয়র কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে আসে কাহিনীর লোভে। নন্দিয় বলতে থাকেন।

—রাজা সসৈন্য যোতীয়র প্রাসাদের প্রধান দ্বার দিয়ে ঢুকে দেখেন অপরদিকে একটি বস্ত্রাবরণ। তার পেছনে সশস্ত্র রক্ষীদল অপেক্ষা করছে। রাজা তো দ্বিধায় পড়ে গেছেন। অরক্ষিত গেহ লুঠ করা এক, আর রক্ষীদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়া আরেক। রাজাকে কি তা শোভা পায়? ফিরে যাচ্ছেন। পথে সেট্‌ঠি মহোদয়ের সঙ্গে দেখা। রাজাকে দেখে রথ থামিয়েছেন যোতীয়। দেখেছেন তো মহাসেট্‌ঠিকে সমন? এঁরা না দেখে থাকতে পারেন। শুভ্র কেশ, ভ্রূগুলি সুদ্ধ পেকে গেছে। বৃদ্ধ মানুষ। কিন্তু বলিষ্ঠ। রাজা বললেন বাহা। ভালো সেট্‌ঠি তো আপনি। সাক্ষাৎ করতে গেলাম আপনার সঙ্গে আর যোদ্ধা দিয়ে দ্বার আটক রাখলেন?

বৃদ্ধ বললেন— সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন? না গেহ লুঠ করতে গিয়েছিলেন কুমার?

—যদি তাই যাই। কী করবেন?

—ভালো। এই দেখুন আমার দশ আঙুলে দশটি অঙ্গুরী। এই বজ্ৰমণি, এই মুক্তা, এই মরকত, পদ্মরাগ, নীলকান্তমণি এ সকল প্রত্যেকটি দুর্মূল্য। অপ্রাপ্য বললেই হয়। লক্ষ লক্ষ সুবর্ণমুদ্রা পাবেন বিক্রয় করলে। নিন তো দেখি কেমন নিতে পারেন!—

তা শত টানাটানিতেও অঙ্গুরী খুলল না। শেষে ঘর্মাক্ত হয়ে থামলেন রাজা। তখন সেট্‌ঠি বললেন—পাতুন হাত, উত্তান করুন দেখি হাত দুটি।

সেই হাতের ওপর অঙ্গুরীগুলি ঝেড়ে ফেলে দিলেন। বললেন— শুনে রাখুন কুমার। বলপ্রয়োগ করে শুধু যোতীয় কেন কোনও সেট্‌ঠির কাছ হতেই কিছু পাবেন না। আর, আমার কুটিরে যোদ্ধও নাই, রক্ষীও নাই। স্ফটিকের প্রাচীর আছে, তাইতে নিজেদের প্রতিবিম্ব দেখে ভয় পেয়েছেন। যান, গেহে যান। স্নেহদুর্বল পিতার ওপর অত্যাচার করে পার পেতে পারেন, সেট্‌ঠিদের কাছে পাবেন না…

বলতে বলতে নন্দিয় বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দুটি ডাইনে-বামে নাড়তে লাগলেন।

—বুঝলেন তো সবাই? সেট্‌ঠিরা অর্থ না দিলে রাজ্য আর রাজ্য থাকবে না খজ্জ হয়ে যাবে। আমাদের ঘরে যা আছে, রাজার ঘরে তা নাই।

অগ্নিকুণ্ড হতে সামান্য দূরে বসে আছেন শ্ৰমণ দুজন। নন্দিয়র কাহিনী শুনে সবাই ভারি আহ্লাদিত। তারা আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে আসে। সন্ধ্যার গাঢ় বাতাসে মাংসর উপাদেয় সুবাস। সার্থবাহরা কাহিনী, সংবাদ বলাবলি করছেন।

—সিন্ধু নদীর জল ছাঁকলে নাকি সোনা পাওয়া যায়?— নন্দিয়র দলের এক তরুণ বণিক প্রশ্ন করল।

উদয় বললেন— তা যায়। তরে সিন্ধুনীরে এখন ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র পোত নিয়ে পার্সরা ঘুরে বেড়ায়। স্বর্ণ যা পাবার তারাই পায়।

—পার্স? তারা কারা?

উদয় সাড়ম্বরে বর্ণনা করেন—কুভা নদীর অপর পার হতে এসেছে সব। দলে দলে। কপিশা নাকি তাদের করায়ত্ত। পাকা সোনার মতো গাত্রবর্ণ। নাসাগুলি বিষম তীক্ষ্ণ। তক্ষশিলায় শুনতে পেলাম কুভা আর সিন্ধুর মধ্যবর্তী দেশগুলি এই পার্সদের রাজা দরায়ভুস জিতে নিয়েছেন। সিন্ধুর এপারে গান্ধারের সৈন্যদল সর্বদা পাহারা দিচ্ছে।

একজন শ্ৰমণ অর্ধস্ফুট একটি শব্দ করেন। নন্দিয় ফিরে তাকালেন। শ্ৰমণ অতিশয় গৌরবর্ণ। দীর্ঘ চক্ষুদুটি। গাঢ় অক্ষিপল্লব। কেশগুলি অল্প বড় হয়েছে। অতিশয় শোভাময়। অপর শ্রমণ তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করলেন—যুদ্ধ হবে নাকি?

—পার্সগুলি স্বর্ণলোভী বুঝলেন শ্রমণ, উদয় বললেন, তক্ষশিলা অবধি আসেনি। সিন্ধুর ওপারেই ঘোরে। রাজা দরায়ভুস স্বর্ণ নেবার জন্য দূত পাঠান। স্বর্ণ পেলেই হল। সিন্ধুটি তো সেঁচে ফেলছে একেবারে। নদীতটে বালুর সঙ্গে স্বর্ণ মিশ্রিত আছে। নদীর জলেও সোনা বইছে।

দরায়ভুস নামটি অনেকেরই হাসির উদ্রেক করে।

—দরায়ভুস, দরায়ভুস। ভুস, ভাউস নানাপ্রকার হাস্যমিশ্রিত গুঞ্জন ওঠে।

আশ্চর্যের কথা কী জানেন? উদয় বললেন—এই পার্সরা অসুরভক্ত। পার্সগুলি ‘স’ উচ্চারণ করতে পারে না বোধ হয়। অসুরকে বলে আহুর। সিন্ধুকে বলে হিদুস্‌। সোমকে বলে হোম। আমাদের বৈদিকদের মতো আগুন জ্বেলে যজন-হবনও করে থাকে।

সকলেই অতিশয় আশ্চর্য হয়ে গেল।

গৌরবর্ণ শ্রমণ মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন: যুদ্ধ ছাড়াই কি পার্সরা গান্ধার জয় করে নিল?

—ওই যে বললাম, রাজা দরায়ভুস স্বর্ণ চায়। যুদ্ধ ছাড়াই যদি প্রতি বৎসর স্বর্ণ পেয়ে যায়, যুদ্ধের কী প্রয়োজন শ্রমণ। তবে যুদ্ধ যদি করত ওগুলিকে বাধা দেবার কেউ থাকত না। গান্ধাররাজ পুক্কুসাতি তো শুনলাম, ভগবান বুদ্ধকে দেখবার আশায় এদিকেই এসেছিলেন, দুর্ঘটনায় মারা যান। তাঁর পুত্র রাজা স্বর্জিতের তেমন কোনও ক্ষমতা নাই। প্রকৃত ক্ষমতা অমাত্যদের। গর্বসেন না দ্রবসেন! মহা ধুরন্ধর ব্যক্তি। তবে তিনিও তো বৃদ্ধ! সত্য বলতে কি জম্বুদ্বীপের সর্বত্রই কেমন একটা শূন্যতা দেখা দিয়েছে। তেমন কোনও রাজা দেখি না যিনি চক্রবর্তী হতে পারেন। মহারাজ বিম্বিসারকে দিয়ে আমাদের বড় আশা ছিল।

নন্দিয় শ্রমণ দুজনের দিকে তাকিয়ে বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়তে লাগলেন। আগুনের প্রভায় শ্ৰমণদের মুখগুলি বড়ই বিষণ্ণ দেখায়।

নন্দিয়র সহবণিক একজন বললেন—কেন? আমাদের কোসলরাজ?

নন্দিয় বললেন—সত্য কথা বলব?

—বলুন না ভদ্দ। ভয় কী?

—ভয়? ভয় নন্দিয় কাউকে করে না। আপনারাই বলুন না কোসলরাজের প্রকৃত বল কী? কে? বন্ধুল মল্ল। নয় কী? তার পুত্রগুলিই বা কী? সব পিতার মতো বীরপুরুষ। তা এগারজনকেই কি নিহত হতে হয়?

একজন শ্রমণ ভয়ানক চমকে উঠলেন।

—কী বললেন সার্থবাহ?

—দেখুন সমন, আমি পাঁচ বৎসর পরে দেশে ফিরছি। কিন্তু দেশের সঙ্গে যোগাযোগ আমি সর্বদাই রেখে যাই। কজঙ্গলের দিকে রয়েছি সে সময়টা। সাবত্থি হতে একদল নাতপুত্তীয় এলেন, ওঁরা লাঢ়দেশে যাচ্ছেন, ওঁরাই আলোচনা করছিলেন বন্ধুল ও তার পুত্ররা সব প্রত্যন্ত দস্যুদের হাতে নিহত হয়েছেন। সেই দারুণ শোকসংবাদ বুকে নিয়েই বন্ধুলপত্নী মল্লিকা নাকি বুদ্ধ ও সংঘের সেবা করেছেন। ভোজ শেষ হবামাত্র জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েন।

শ্ৰমণটি হঠাৎ দু হাতে মুখ ঢাকলেন, তার বক্ষ ফুলে ফুলে উঠছে। গাঢ় সন্ধ্যার তিমিরেও তার শোক ঢাকতে পারছে না।

—চিনতেন নাকি মল্লকে?

সার্থবাহ নন্দিয় তার এ প্রশ্নের উত্তর পেলেন না।

কিছুক্ষণ পর নন্দিয় বললেন—সমন, মনে কিছু করবেন না, আমিও এক সময়ে ভগবান বুদ্ধের দেশনায় মুগ্ধ হয়ে পব্‌বজিত হতে চেয়েছিলাম। আজও তাঁকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু চতুর্দিকে এই যে তার বড় বড় উপাসকদের শোচনীয় গতি হচ্ছে এর অর্থ কী? ভগবান কি বৃদ্ধ হয়েছেন বলে তাঁর ক্ষমতাগুলি ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে? যিনি অঙ্গুলিমালের মতো নিষ্ঠুর নরহন্তাকে বশ করলেন, তিনি কি মগধের এই পিতৃঘাতী রাজকুমারটিকে কোনক্রমেই শান্ত করতে পারতেন না?

শোকার্ত শ্রমণ এই সময়ে উঠে চলে গেলেন। অগ্নির প্রভা থেকে দূরে। বনরেখা যেখানে আকাশের প্রান্তে লুটিয়ে রয়েছে সেইখানে তাঁকে পেছন ফিরে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল।

সার্থবাহ নন্দিয় অপর শ্রমণকে লক্ষ্য করে বললেন—সত্য বলুন তো! উনি পঞ্চাল তিস্‌স না!

শ্ৰমণটি সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন।

—প্রথম হতেই আমার ওঁকে পরিচিত মনে হচ্ছিল। কেশগুলি এখন খুদ্দ খুদ্দ… সমন হয়েছেন… তাই কেমন…। উনি তো বন্ধুলের দক্ষিণ হাত স্বরূপ ছিলেন। পুত্রদের থেকেও অধিক বোধ হয়। যখনই কোনও ক্রীড়া কি প্রতিযোগিতার আয়োজন হবে, উনি থাকবেন বন্ধুলের পাশে। আহা! কী আঘাতই না ওঁর লাগল! মুহ্যমান হয়ে গেছেন একেবারে! হলেনই বা পব্‌বজিত। পিয়জনের শোক লাগবে না তাই বলে! একটু পরে নন্দিয় আক্ষেপের সুরে বললেন—সব বীরপুরুষই যদি সমন হয়ে যান…

সার্থবাহ উদয় বললেন— আপনি কিন্তু মধ্যদেশের নয় সমন।

এই শ্রমণটি বড় অল্পভাষী, মাথাটি নাড়লেন শুধু। একটু পরে তিনিও উঠে গেলেন বনভূমির দিকে। … গান্ধার পার্সকবলিত হয়ে গেল তা হলে! সমুদ্র তরঙ্গের মতো সৈন্যদল আসে নি! তবু পরাজিত হয়েছে! এত হতবল! কী-ই বা করবে? দ্বীপের মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য, যে যার অস্তিত্বসংকট নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু গান্ধার শত্রুর গর্ভে গেল, আর যিনি এই পরিণাম দ্রষ্টার চোখ দিয়ে দেখেছিলেন, তিনি কোথায় রইলেন! জানতেও পারলেন না! অনঘ, সুভদ্র, চণক, এঁদের তক্ষশিলার লোকে বলত ‘ত্রয়ী’ ‘ত্রিবেদ’, দেশের সংকট, বিদ্যার সংকট, সমাজের সংকট নিয়ে এঁরাই চিন্তা করতেন, সেসব চিন্তার কথা আলোচনা করতেন। কোথায় রইলেন তাঁরা গান্ধারের এই দুঃসময়ে?

কিন্তু, দুঃসময় কি একা গান্ধারেরই? সমগ্র জম্বুদ্বীপই কি বিপন্ন নয়? যিনি এই বিপদের মর্ম যথার্থ বুঝতেন সেই মহাবীর রাজা আরেক দিক দিয়ে এত দুর্বল যে তাঁকে কারারুদ্ধ করা গেল, অনাহারে মেরে ফেলাও গেল। শার্দুলের পরিণাম যদি মার্জারের মতো হয়, তা হলে তো তথাগতকে লোকে দোষ দেবেই। সঙ্গত কারণেই দেবে।

সার্থবাহ উদয় এবং অঙ্গদেশগামী বণিকদের সঙ্গে বিদায় অভিবাদন বিনিময় করে শ্রাবস্তীর দল আবার পথ চলে। সকাল এবং সন্ধ্যা যায়। সন্ধ্যা এবং সকাল। বারাণসী যতই এগিয়ে আসে ঘোর কলরোল শোনা যায়। এরা পরস্পরের মুখের দিকে চায়। বারাণসীতে এরা এই প্রথম তো আসছে না! স্থানটি হট্টগোলের সত্য। কিন্তু তাই বলে এত কোলাহল?

নিয়ামক রক্ষীদের অস্ত্র বার করতে বলল। বোঝা যাচ্ছে না ঠিক। কিন্তু ভয়ানক কোনও দস্যুদল হতে পারে।

নন্দিয় বললেন—না। নগরীর এত কাছে দস্যু যদি আসেও, আসবে নিঃশব্দে। এভাবে নয়।

পথ আরেকটি বাঁক নিতেই ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেল। সমুদ্রের মতো সৈন্যদল আসছে। হা হা শব্দ করতে করতে, তূর্যধ্বনি করে, শল্য ধনুর্বাণ মুষল আস্ফালন করতে করতে। পদাতিক, অশ্বারোহী, গজবাহী, রথারোহী সেনাদল।

নিয়ামক চিৎকার করে বলল— পথ ছেড়ে দাও হে। ত্বরা করো, ত্বরা করো, প্রান্তরে, বনে যে যেখানে পারো নেমে যাও…

উভয় দিকে নেমে যেতে থাকে বণিকদল। শুধু দুই শ্রমণ ছুটে গিয়ে মাঝে দাঁড়ান হাত তুলে। নিয়ামকের হাত থেকে ভেরীটি তুলে নিয়েছেন শ্রমণ।

সেনাদলের ঘোষকের সঙ্গে উত্তর-প্রত্যুত্তর হচ্ছে।

—কোথকার সেনা-আ-আ-?

—কাশী কোসলের-র-র।

—কোথায় যায়?

—মগধ আক্রমণ করতে-এ-এ-

—কেন-ও-ও-ও-?

—মহারাজ পসেনদি ভগ্নী কোসলদেবী ও ভগ্নীপতি মহারাজ বিম্বিসারের হত্যার প্রতিশোধ নিতে চলেছেন। কাশীগ্রামটি কোসলদেবীর বিবাহের যৌতুক ছিল-অ-অ। আমাদের রাজকুমারী, মগধের মহারানি বিষপান করে আত্মঘাতী হয়েছেন-ন। মগধের পিতৃমাতৃ ঘাতক কুমার কি এখনও কাশীগ্রামের রাজস্ব ভোগ করবে না কি-ই-ই? কোসলরাজ তা করতে দেবেন না-আ-আ।

—সৈনাপত্য করছেন কে-এ-এ?

—কোসলকুমার ও দীঘ মল্ল-অ-অ।

রক্ত কাষার দেহ থেকে খুলে দূরে নিক্ষেপ করলেন শ্রমণদ্বয়। সংঘাটির তলা থেকে প্রকাশিত হল বর্ম-অস্ত্রধারী যোদ্ধৃশরীর। পাঞ্চাল ভেরী মুখে তুলে চিৎকার করে বললেন— ভো সেনাধ্যক্ষ দীঘকারায়ণ, ভো ভো কুমার বিরূঢ়ব আমি পাঞ্চাল তিষ্য বলছি-ই-ই। আমাদের অশ্বরথাদি রণসামগ্রী দিতে আজ্ঞা হোক। আমরা যুদ্ধে যাবো-ও-ও।

২৩

বনের মধ্যে রাতগুলি দিন শুষে নিয়ে পুষ্ট হতে থাকে। প্রসূত হতে থাকে অচেনা শব্দ, অজানা গন্ধ, বহু অদৃষ্টপূর্ব আলো যাদের প্রভায় দেখা যায় অদ্ভুত অদ্ভুত দৃশ্যও। তাদের ভৌতিক, অলৌকিক মনে হতে থাকে। একমাত্র নানা জাতীয় মৃগরা, শশকরা, সরীসৃপরা জানে এগুলি অলৌকিক নয়। কেউ নাক ডুবিয়ে ঘ্রাণ নেয়, কেউ সতর্ক করে কান দুটি, দ্রুত তরঙ্গে পালায়। এইখানে মাটিতে মাটি, তৃণেতে তৃণ, গুল্মেতে গুল্ম হয়ে শুয়ে থাকে নিঃসংজ্ঞ দেহটি। গাত্রবর্ণ হারিয়ে ফেলে তার কাঞ্চন আভা। কেশগুলি হয়ে যায় পিঙ্গল, জটাবদ্ধ। শীর্ণ অতি শীর্ণ দেহ। পিঠের ওপর কয়েক স্তর মাটি জমে যায়। তার ওপর খেলা করে গোধিকা, শল্লকী, বৃক্ষমার্জার। শিশুরঙ্কু কেশগুলি তৃণ ভেবে চিবার, তারপর বিস্বাদ মনে হওয়ায় ফেলে দিয়ে লম্ফ দিয়ে দিয়ে দূরে চলে যায়। নকুলযুবা রক্তচক্ষু মেলে দ্রুত ছুটে আসে, অস্থির হয়ে ঘোরে, সামনের পা দিয়ে মাটি খোঁড়ে, মুদিত চোখ দুটি খুবলে নেবে কি না ভাবে, আবার অস্থিরভাবে ছুটে চলে যায়। বানরেরাও শাখা থেকে ঝুপঝাপ নেমে পড়ে, মহা কৌতূহলে। আবার ওপরের শাখায় উঠে যায়, দোল খায়। বহু দূর থেকে ধ্বনি প্রতিধ্বনিময় নাদ শোনা যায় ধিমি ধিমি দ্রিমি দ্রিম দ্রিমি দ্রিম দ্রিম্ দ্রিম্—। লঘু পায়ে দেহটি মাড়িয়ে ছুটে চলে যায় কজন! চমকে থামে। পায়ের আঙুল দিয়ে মাটি খোঁচায়।

—তলে ই তো বাহাসিন্দড়ি লয়?— এ ওর মুখের দিকে তাকায়।

—কী? কী? কী তবে?

কটিদেশের পাতার মালা দুলিয়ে মানুষগুলি উপুড় হয়ে পড়ে। দেখতে দেখতে চোখগুলি গোল হয়ে যায়। অভীষ্ট বস্তু বুঝি পেয়ে গেছে তারা। একজন কী ইঙ্গিত করে। আরেক জন ছুটে চলে যায়।

—বেগাবেগি যা, বেগাবেগি যা… পেছন থেকে নির্দেশ আসে।

ক্রমে একটি পুরো দল চলে আসে। টাঙ্গি দিয়ে বৃক্ষশাখা কেটে কেটে একটি চারকোনা খাটুলি প্রস্তুত হয়। তারপর সংজ্ঞাহীন মৃত্তিকাময় দেহটি বাহিত হয়ে চলে যায় দূরে… বহু দূরে।

এ দিকে বহধ্বম্ জহধ্বম্ শব্দ করে গিজ্ঝকূট থেকে গড়িয়ে পড়ে পাথরের খণ্ড। বৃদ্ধ হলে হবে কী! গৌতম বিড়ালের সতর্কতায় সরে যান। তাঁর শ্রবণেন্দ্রিয় অতি সজাগ। ধীর চারিকায় ছিলেন তিনি। অদূরে ছিলেন উপস্থায়ক আনন্দ। চারিকার সময়ে তিনি মগ্ন থাকেন নানা চিন্তায়। কেউ বলতে পারে না তা কী! তা কি ব্রহ্মবিহার! নাকি দেশ কাল-পাত্র-সমাজ বিহার! যদি ধ্যানেই মগ্ন থাকবেন তো এতো সতর্ক হন কী করে?

কিন্তু সতর্কতায়ও পুরো ফল হয়নি। একটি পাথরের খণ্ড গুল্ফ ঘেষে চলে গেছে। রক্তধারা বয়ে যাচ্ছে, অস্থি ভেঙেছে কিনা বোঝা যায় না। কিন্তু গুল্‌ফের পাশটি থেঁৎলে গেছে। উঠতে পারছেন না ভগবান।

—কী হল? কী হল জেট্‌ঠ?

ভগবান স্মিতমুখে আনন্দর দিকে চান। বিপন্নতম মুহূর্তগুলিতে আনন্দ ভুলে যান তিনি শ্রমণ। তথাগত বুদ্ধর উপস্থায়ক। শুধু মনে থাকে ইনি জেট্‌ঠ। মাতা গোতমীর কোলে সিদ্ধার্থ ও নন্দ, কিন্তু কিশোর সিদ্ধার্থের সকল কাজের কাজি বালক আনন্দ, শাক্য অমৃতোদনের ছেলে।

আনন্দ বসে পড়েছেন। দ্রুত হাতে ছিঁড়ে নিচ্ছেন ঘাস। চেপে ধরেছেন ক্ষতস্থানের ওপরে।

পথ দিয়ে আসছিলেন দুজন নাগরক। ঊর্ধ্বে মুখ তুলে দেখলেন কিছু মানুষের আকৃতি। গিজ্ঝকূটের পাথর ও গুল্মের মধ্য দিয়ে পালাচ্ছে। আনন্দ ব্যাকুল স্বরে বললেন—আয়ুষ্মন, মহাবেজ্জকে একবার সংবাদ দেবেন! ভগবান দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন।

—তা দিচ্ছি সমন, তবে আপনারা সাবধান হন, এটি দৈব বা আকস্মিক দুর্ঘটনা নয়।

ইঙ্গিতপূর্ণ চোখে গিরিশিরের দিকে তাকায় নাগরকদ্বয়।

উদ্বিগ্ন আনন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে তথাগত বললেন—সম্মা সতি, হে আনন্দ, সম্মা সতি।

—সেদিন ধনুর প্রহারের হাত থেকে বেঁচে গেলেন বহু ভাগ্যে, আজ নামল গিরিশৃঙ্গ, এর পরে কী? চলুন ভগবন আমরা রাজগৃহ ছেড়ে চলে যাই। আনন্দ আকুল হয়ে বললেন।

—হে আনন্দ, পৃথিবীর একটি ক্ষুদ্রতম অংশেরও নাম করো যা মৃত্যুস্পৃষ্ট নয়।

আনন্দ সজল চোখে নির্বাক হয়ে রয়েছেন। তথাগতর যুক্তিজালের সঙ্গে তিনি পরিচিত। সমগ্র জীবন, সমস্ত পৃথিবী এবং মহাকালের প্রেক্ষিতে তার সব বিচার।

—বলতে পারছো না! তবে কোথায় পালাবে? ভয়ানক, ভয়ানক থেকে ভয়ানকতর, ভয়ানকতম মৃত্যুও অপেক্ষা করে থাকতে পারে তোমার আমার জন্য। যে বাসনামুক্ত হয়েছে, যে চতুর্ আর্যসত্য জানে—সে ভয় ভৈরবের হাত থেকেও মুক্ত।

নাগরকরা এগিয়ে আসে।

—ধনুর প্রহার থেকে বেঁচে যাবার কথা কী যেন বলছিলেন সমন!

আনন্দ বললেন— এই তো পাঁচ ছ’দিন পূর্বে প্রত্যূষে আজকের মতোই ধীর চারিকায় আছেন ভগবান। গিজঝকুটের পাশ দিয়ে পথ। পাঁচটি ধনুর্গ্রহ এসে তাঁকে প্রণাম করল। এরা কজঙ্গলের অধিবাসী, ভাগ্যান্বেষণে রাজগহে এসেছে। এদের নাকি বলা হয়েছে, এই পথের পাশে গুপ্তভাবে থাকতে। প্রথম এ পথ দিয়ে যে আসবে তাকেই হত্যা করতে হবে। ভগবানকে আসতে দেখে ঘাতকরা আশ্চর্য হয়ে যায়। স্বভাবতই শ্রদ্ধাবনত হয়ে তার শরণ নেয়। গৃহে ফিরছে এরা, আরও পাঁচটি ধনুর্গ্রহ বেরিয়ে আসে। দ্বিতীয় দলের একজন প্রথম দলের একজনকে চেনে। তারপর প্রকাশ পায় দ্বিতীয় দলকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে প্রথম দলকে হত্যা করবার। বুঝলেন তো? ভগবানকে হত্যা করার কোনও সাক্ষী থাকবে না। ব্যবস্থাটি উত্তমই হয়েছিল। কিন্তু পণ্ড হল।

নাগরকরা উচ্চকণ্ঠে এই ষড়যন্ত্রকে ধিক্কার দিতে দিতে চলে গেল। তাদের বুঝতে বিলম্ব হয়নি এর পেছনে কারা আছে।

মহারাজ বিম্বিসারের হত্যা আপামর রাজগহবাসীকে রাজনীতি সচেতন করে দিয়ে গেছে। পূর্বে শুধু অভিজাতরাই দণ্ড ও বার্তা নিয়ে মাথা ঘামাতেন। এখন যে কোনও গৃহস্থ জানে, একজন স্বৈরাচারীর আয়ত্তের মধ্যে বাস করার কী ভয়ানক বিপদ। তথাগত বুদ্ধর ওপর তারা অনেকেই বিরক্ত ছিল, এখন তার দ্বিগুণ বিরক্ত দেবদত্তর ওপরে। হত্যা, গুপ্তঘাতের যেন বান ডেকেছে নগরে। মহারাজ বিম্বিসার নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তিনি কি এভাবে প্রজাসাধারণের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছেন কখনও? ক্রমশ তাদের ভয় চলে যাচ্ছে। আর কিছুকাল দেবদত্তকে সহ্য করতে হলে তারা বিদ্রোহ করবে, টেনে নামাবে ওই পিতৃঘাতী রাজাকে। অমাত্যগুলি তাকে ঘিরে আছেন, এটাই কথা। কেন? ওঁদের পক্ষপাত কোথায় এবং কেন বুঝতে না পারলে তারা এখনও কিছু করতে সাহস করছে না। কিন্তু রাজগহে অসন্তোষ এখন ধূমায়মান।

নাগরক দুজন চোখের আড়ালে গেলে তথাগত বললেন—আনন্দ তুমি ভালোই বাক্যবাগীশ।

আনন্দ বললেন—আপনিই তো বলে থাকেন মৌনতা অবলম্বন করলেই মুনি হয় না। মৌনতার অর্থ অনেক সময়ে প্রতীতির অভাব, বা কিছু জানাতে কৃপণতা। আমি ওই ঘটনাটি নিশ্চিতরূপে জানি, জানাতেও আমার কার্পণ্য নেই। আপনার অক্রোধের উপদেশের কথা স্মরণে রেখেই এ কথা বলছি।

তথাগত বললেন— তথাগতর উপস্থায়ক না হয়ে তুমি কোনও বোহারিকের উপস্থায়ক হলে ভালো করতে।

আনন্দর মুখটি শুকিয়ে গেল কিন্তু তিনি মুখ নত করে জ্যেষ্ঠের কথা মেনেও নিলেন না। বললেন— কোসাম্বিতে ভিক্ষুরা কলহ করেছিল বলে আপনি সে স্থান ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন। তা এখানেও কি একজন কলহ করে সংঘভেদ করছেন না? আর মগধের রাজকুমার? তিনি যা করলেন তা কি ক্ষমার যোগ্য?

—আনন্দ, ভিক্ষুরা আমার আপনজন। তাদের ছেড়ে আমি চলে যাই তাদের চেতনা জাগাতে, আমার এবং তাদের মধ্যে যে সূত্র রয়েছে, সেই সূত্র ধরে টান দিতে। কিন্তু পৃথগ্‌জন অধ্যুষিত এই ভূমি এমনই মরু যা তথাগতকে পার হতেই হবে। সংঘকেও। এমন কি আনন্দকেও। আর তাতেই মরু হয়ে যাবে ফুল্লকানন।

জীবক রথে করে এসে পৌঁছলেন, তাঁর রথে— চর্মপেটিকায় শুশ্রূষার সব আয়োজন। দুহাতে আহত তথাগতকে তুলে নিলেন তিনি।

তথাগত স্মিতমুখে বললেন— হে জীবক, তুমি তো শুধু মহাবেজ্জই নও! মহাবলীও দেখছি।

জীবক হেসে প্রত্যুত্তর দিলেন— তা যদি বলেন ভন্তে, আপনাকে দশবল লোকে শুধু শুধু বলে না। আপনার দশ বলের একটি বল অন্তত দৈহিক বল। সম্যক আহার, সম্যক বিহারে শরীরটি রেখেছেন চমৎকার!

—আর সম্যক সমাধি? তার কথা তো কই বললে না জীবক! ধ্যানটি ঠিক মতো অভ্যাস করছো তো?

—যতদূর পারি ভন্তে! তবে বোঝেনই তো জীবকের ধ্যানের একমাত্র বিষয় হল ব্যাধি। বিচিত্র, দুরন্ত সব ব্যাধি— জীবক হাসিমুখে তথাগতর ক্ষত পরিষ্কার করে ভেষজ লাগিয়ে পট্টিকা বেঁধে দিলেন। না, অস্থি ভাঙেনি।

নালাগিরির ঘটনার পর রাজগৃহের মনোজগতে আমূল পরিবর্তন হয়ে গেল। ঘটনাটি ঘটে এইরূপ: নালাগিরি এমনিতেই দুর্দান্তস্বভাব হাতি। মহারাজ বিম্বিসার ছাড়া আর কাউকে সে পিঠে নিতে চাইত না। তাকে সুরাপান করিয়ে উন্মত্ত অবস্থায় পথে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ঠিক যে সময়ে বুদ্ধ ভিক্ষার্থে বার হয়েছেন। সঙ্গে অল্প কজন ভিক্ষু। হাতির সামনে পড়ে গেছে শিশু কোলে এক রমণী। আনন্দ ছুটে আসছেন— রক্ষা করতে হবে ওই শিশুটিকে, তার মাতাকে, তথাগতকে। উপস্থায়ক আজ প্রাণ দিয়েই ছাড়বেন। সহসা তথাগত স্বয়ং একটি যুবক মল্লর মতো দ্রুত, অতিদ্রুত চারণে সবাইকে পার হয়ে প্রায় মুখোমুখি দাঁড়ালেন হাতিটির। কী যেন বলছেন হাতিটিকে। শুঁড় তুলে হাতি বাতাসে গন্ধ নিতে থাকে—এ সেই তাঁর গন্ধবাহী বাতাস না, যার অদর্শনে সে ক্ষিপ্ত হয়েছিল! রক্ত গৈরিকের ছটা, প্রসন্ন সুন্দর মূর্তি— এঁর চারিদিকের ব্যক্তিত্ব-বলয়ে তার প্রভু বিম্বিসারের গায়ের ঘ্রাণ! হাতির শোকানলে শান্তি বারি ঝরছে। সে জানু মুড়ে বসে পড়ল।

কাতারে কাতারে লোক জমে গিয়েছিল সেদিন জীবকাম্রবন থেকে বৈভারের পথে। চতুর্দিকে জয়ধ্বনি উঠতে থাকে গৌতম বুদ্ধর নামে। এতদিন পরে মহারাজ বিম্বিসারের একটি স্বপ্ন পূর্ণ হল বুঝি বা। রাজগৃহের মানুষ তাদের পূর্ব অভিযোগ ভুলে গৌতমের চরণে লুটিয়ে পড়ল। প্রাসাদে বসে প্রমাদ গুণলেন অজাতশত্রু। গয়াশিরে পালালেন দেবদত্ত, কোকালিক, মোরগতিষ্য, খণ্ডদেবপুত্র ও সাগরদত্ত। সংঘভেদী বিশ্বাসঘাতক পাঁচ শ্রমণ।

কার্তিকোৎসবের উৎসব মুখরিত দীপোজ্জ্বল সন্ধ্যা। পূর্ণিমার চাঁদ থেকে যেন কুন্দকুসুমের প্রপাত নেমেছে। রাজা অজাতশত্রু উৎসবে অংশ নিতে পারছেন না। সভাসদদের ডেকেছেন। এসেছেন বর্ষকার সুনীথ, চন্দ্রকেতু-জীবক, কুমার অভয়, এসেছেন নগরশ্রেষ্ঠী অহিপারক। বেশ-বাস করেছেন রাজা, জ্যোৎস্নায় ঝকঝক করছে মুকুটের হীরক, কিন্তু প্রাসাদ অঙ্গনেই বসে আছেন, কখনও বসে, কখনও বা দাঁড়িয়ে উঠছেন। অতি অস্থির। মাধ্বী পরিবেশিত হয়েছে। সোনার পাত্রে স্বাদু, দুর্মূল্য আসব। পাত্র হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন জীবক, চন্দ্রকেতু।

গণ-উত্থানের ভয়ে তুমি আজ রূপ পরিবর্তন করছে, তাই না কুমার? বহিঃশত্রু তো আছেই। কোশলরাজ একবার পরাজিত হয়েছেন, আবারও হবেন কী? সেনাপতি মহানাগ নেই। হত হয়েছেন মহাবীর কুরুবিন্দ। শোনা যাচ্ছে অবন্তীর সৈন্যও বেরিয়ে পড়েছে। প্রদ্যোত মহাসেন নাকি বিম্বিসার হত্যায় জ্বলন্ত অয়সের মতো তপ্ত হয়ে রয়েছেন। তিনি এবার বৈশালীর সঙ্গে মিলবেন। সঙ্গে আসছে তার দুর্দান্ত নিষাদ সেনা। … তাই আজ সভাসদ্‌দের ডেকে পানভোজন করতে চাইছো! এই অভয়কুমারকে নিজ প্রাসাদে বন্দী রেখেছিলে, চন্দ্রকেতুকে পাঠিয়েছিলে কারাগারে, অহিপারক, বর্ষকার, সুনীথ কারো কথার মান দাওনি! এই সচিবরা তাই অন্য অমাত্যদের কাছে অপরাধী হয়ে আছেন। চোখে চোখ রাখতে পারেন না কারো। নিঃশব্দ ধিক্কার চতুর্দিকে— ধিক বস্‌সকার, ধিক ধিক সুনীথ তোমাদের না মহারাজ বিম্বিসার সবচেয়ে উচ্চপদে বসিয়েছিলেন! বিশাল মগধসাম্রাজ্যের সর্বার্থক হওয়ার আশা পরিপূরিত হয়নি বলে কুমারের লোভে ইন্ধন জুগিয়ে রাজার প্রাণ নিলে? রানির প্রাণ নিলে? ধিক ধিক, শত ধিক্…

সহসা কুমার দু হাত ঊর্ধ্বে তুলে অব্যক্ত আর্তনাদ করে উঠল—পিতা! পিতা!

অদূরে ধাত্রী এসে দাঁড়িয়েছে কুনিয়র শিশুপুত্র উদায়ীকে কোলে নিয়ে, শিশু পিতার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে দু হাত।

—কুমার দু হাতে নিজের বক্ষে আঘাত করতে থাকে।

ধাত্রী সভয়ে শিশুটিকে নিয়ে পালায়। অন্তঃপুরের পথ থেকে শিশুটির কান্না ভেসে আসে। ক্রমশই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর।

মুখ নত করে বসে থাকেন সবাই। একটি সান্ত্বনার বাক্যও উচ্চারণ করতে পারেন না।

—জীবকভদ্র। জীবকভদ্র!— কুমার এমন করে ডাকছেন যেন কেউ তাকে ছুরিকাবিদ্ধ করেছে।

—বলুন কুমার— রাজা হতে পারেন অজাতশত্রু। এঁরা কেউ তাঁকে কুমার ছাড়া বলেন না।

—বলুন, কার কাছে, কোথায় গেলে শান্তি পাবো! দিনে রাতে সর্বত্র পিতার মুখ দেখি… মাতার মুখ… সইতে পারি না।

অক্কোধেন জিনে কোধং অসাধুং সাধুনা জিনে…

জীবকের হৃদয়ের মধ্যে ধ্বনিত হতে লাগল। কিন্তু সেই মহাবাণী ছাপিয়ে তাঁকে অধিকার করতে লাগল পবিত্র ক্রোধ।

খেলা, না? এই সব রাজা-হওয়া, রাজা-হত্যা করা! অমাত্য নির্বাচন, যুদ্ধ! হে রাজনীতিকগণ— ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণ, খেলা পেয়েছ, না? লক্ষ কোটি মানুষের জীবন নিয়ে চিরকাল ধরে খেলা করে চলেছ? জানলে না জীবনের রহস্য। জানতে চাও না। পারবে? মহাপ্রাণ ছেড়ে এক বিন্দু প্রাণও সৃষ্টি করতে পারবে? বিকলাঙ্গ, বিকৃতমস্তিষ্ক প্রাণ? তাও পারবে না। আয়ুর্বেদ বলছে—পারবে না। জীবক জানে— পারবে না। ব্যাধির দুঃখ, অঙ্গহানির দুঃখ, মহাদুঃখ জীবজগতে, জীবক প্রাণপণে তার সারা জীবনের সাধনায় সে দুঃখ এই মগধেই বা কতটুকু দূর করতে পেরেছে? পারেনি, কিছুই পারেনি। আরও অনেকগুলি জীবন পেলে, আরও ফলবান মস্তিষ্ক, যুগাতিশায়ী প্রতিভা পেলে আরও পারতো। কিন্তু জীবক জানে, সুস্থ সবল সুন্দর জীবনের কী অপরিসীম মূল্য। সেই জীবনগুলি শিশু যেমন করে পতঙ্গের পাখ ছেঁড়ে তেমনি করে ছিঁড়েছ, ভেঙেছ, সর্বনাশ ছড়িয়ে দিয়েছ দু হাতে; তোমার শান্তির অধিকার কী?

ক্রোধে অগ্নিপিণ্ডের মতো লোহিতবর্ণ হয়ে স্থির বসে রইলেন কোমারভচ্চ।

সেট্‌ঠিবর, বলুন, আপনি অন্তত কিছু বলুন!

গলাটি অনাবশ্যক ঝেড়ে কেশে অহিপারক বললেন— রাজগহের পাহাড়ে, কন্দরে তো কত বড় বড় তীর্থঙ্কর বাস করছেন, গিয়েই দেখুন না!

—না, না, এমন কেউ কি নেই যাঁর করুণা অলৌকিক, আকৃতি বচন এমনই সৌম্য মধুর যে দেখলেই হৃদয় শান্ত হয়!

উপস্থিত সকলেই বুঝতে পারেন কুমার কার কথা বলছেন, কিন্তু কিছু দিন আগেও যাঁর নাম পর্যন্ত মুখে আনা নিষিদ্ধ ছিল, যাঁকে আরাধনা করার অপরাধে যত্র তত্র হত্যা হয়েছে, হত্যা হয়েছে এমন কি সুকুমারী নারী পর্যন্ত, কিশোরী নটী শ্রীমতীর হত্যার স্মৃতি কি অত সহজে মুছবে? কে তাঁর নাম মুখে আনবে?

জীবকের দিকে ভিক্ষুকের মতো চেয়ে রয়েছে কুমার।

জীবক ভাবলেশহীন গম্ভীর কণ্ঠে বললেন— আপনি কি তথাগত বুদ্ধর কথা বলছেন? তিনি এখন আমারই অম্ববনে অবস্থান করছেন। যান, যাবেন তো যান। এমন কোনও ক্ষমা নেই যা তাঁর অদেয়।

জীবক উঠে দাঁড়ালেন।

—কোথায় যান মহাবেজ্জ? আপনি সঙ্গে যাবেন না?

ভয়, ভয়ভৈরব অধিকার করেছে পিতৃঘাতককে।

অম্ববন। ঝিল্লির ডাকটি পর্যন্ত শোনা যায় না। কার্তিকী পৌর্ণমাসীর জ্যোৎস্নায় গাছের পাতাগুলি পর্যন্ত স্বতন্ত্রভাবে চেনা যায়। সঙ্গে সভাসদরা! কুমার সভয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল— জীবক ভদ্র, এ কী? ছল করে এখানে এনে হত্যা করাবেন নাকি?

-—এর অর্থ?— জীবক ক্রুদ্ধ মুখে দাঁড়িয়ে পড়লেন— আপনিই তো আসতে চাইলেন? আপনি পাবেন শান্তি? সান্ত্বনা? মহারৌরব নরকের আগুন আপনার নিজের ভেতরেই জ্বলছে।

—মহাবেজ্জ। মৃদুকণ্ঠে ডাকলেন অহিপারক। সতর্ক করা প্রয়োজন জীবককে।

কিন্তু কুমার যেন কিছুই শোনেননি। বললেন— এই সব বৃক্ষের পেছনে অস্ত্রধারী ঘাতক আছে। আমি জালে পড়ে গেছি। গুপ্তহত্যা… স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি শল্যগুলি শাখা-প্রশাখা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে… দূর হতে বিঁধবে…

অমাত্য চন্দ্রকেতু আর সহ্য করতে পারলেন না, এগিয়ে গেলেন। পেছন পেছন চলে গেলেন জীবক ও অহিপারক। প্রাণান্তক ভয়ে অজাতশত্রু অসি কোষমুক্ত করে সামনের বৃক্ষতল পেরোলেন। অমনি অন্ধকার সরে গেল। আলো, আলো। আলোর সমুদ্রে ভাসছে রাজগৃহ। ধনী, দরিদ্র, ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, গৃহপতি, দাস, নর, নারী, বালক বালিকা, নটী, গৃহিণী সবাই। সমগ্র রাজগৃহে প্রচার হয়ে গেছে তথাগতবুদ্ধ এক দেবমানব। রাজগৃহের অনেক ভাগ্যে তিনি এখানে অবস্থান করছেন। তার ঋদ্ধি বিফল করে দিয়েছে সমস্ত বিরুদ্ধ ষড়যন্ত্র। এই আনন্দসন্ধ্যায় তাই রাজগৃহ তার ভ্রম শুধরে নিতে জীবকাম্রবনে এসে বসেছে। শুভ্র বসন সব, উত্তরীয়গুলি বাতাসে অল্প অল্প উড়ছে, মানবসমুদ্রে যেন হিল্লোল উঠছে। ঋজু, শুভ্র মূর্তি। বসে আছেন মণ্ডলমালে। দুই ভ্রূর মাঝখানে একগুচ্ছ শুভ্র রোম।

তিনি বলছেন—এক অদ্ভুত জগৎ অদ্ভুত সমাজের কথা। সেখানে হিংসা, ঈর্ষা, দ্বেষ, কলহ নেই। সৎ কর্ম, সৎ সঙ্কল্প, সৎ চিন্তার মধ্য দিয়ে জীবনকাল কাটিয়ে পৌঁছও এক অনির্বাণ প্রশান্তিতে— যার নাম নির্বাণ।

নির্বাণ কী? কেমন? তা ভাষার অতীত, বর্ণনার অতীত। কেমন সে কথা ভেবে অনর্থক কালক্ষেপ করে কাজ নেই। কেউ কি কখনও গঙ্গার বালুরাশি কিংবা সমুদ্রের জল গুণে, পরিমাপ করে শেষ করতে পেরেছে? প্রয়োজনই বা কী?

—ভগবন, জগৎ শাশ্বত কি অশাশ্বত?

—দেহ ও আত্মা এক না পৃথক?

—ভগবন, নির্বাণ প্রাপ্ত অর্হন কি বিদ্যমান থাকেন?

—হে রাজগহবাসী, আমি কি একবারও তোমাদের বলেছি এসো এসো। তোমরা তথাগতর শরণ নাও, তাহলেই আমি তোমাদের এ সকল প্রশ্নের উত্তর দেবো। এমন বচন দিয়েছি কী?

—না ভগবন, তা আপনি দেননি।

—তা হলে এ সকল প্রহেলিকা থাক। হে নাগরকগণ, যদি কোনও ব্যক্তির শরীরে বিষাক্ত বাণ প্রবেশ করে, এবং সেই ব্যক্তির আত্মীয়রা মহাবেজ্জ জীবককে ডেকে আনে তাহলে কি জীবক যন্ত্রণাকাতর রোগীকে প্রশ্ন করবেন এই বাণ কে মেরেছে? সে গৌরবর্ণ না কৃষ্ণ বর্ণ? সে ব্রাহ্মণ না ক্ষত্রিয়, না শূদ্র? ধনুকের জ্যাটি কিসের? জিজ্ঞাসা করবেন, না শল্য চিকিৎসা করে রোগীকে আরোগ্য করবেন!

—আরোগ্য করবেন ভগবন—

—জগৎ শাশ্বত বা অশাশ্বত, আত্মা আছে কিনা, মৃত্যুর পর কী ঘটবে এ সকল উত্তর-প্রত্যুত্তরে শুধু কালক্ষেপই হবে, জরা, মরণ, পরিদেব, শোক এগুলির থেকে মুক্তি হবে না। তথাগত যেসব বিষয়ে চর্চা করেননি সেগুলি চর্চার অযোগ্য জানবে। অস্ত্র ব্যতীত, হিংসা ব্যতীত এক সুন্দর জীবন গঠনের চেষ্টায় নিয়োজিত হও।

অজাতশত্রু সেই মহতী সভায়, জ্যোৎস্নালোকে তথাগতর বেদিকার সামনে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাতের ভঙ্গিতে পড়ে গেলেন।

বড় সংশয়ী মানুষ বর্ষকার। বললেন— কুমারের চাতুর্য বুঝলে, সুনীথ?

—বলুন মহামাচ্চ, আপনার ব্যাখ্যাশুনি।

—গণ- অভ্যুত্থানের ভয় পাচ্ছেন তো, তাই গণের সামনেই তথাগতর শরণ নিলেন।

তথাগত এখন রাজগহের মাথার মুকুট। কুমার পাপী কিন্তু অনুতপ্ত, ওঁর শরণাগত।

উনি ক্ষমা করলে, রাজগহ ক্ষমা না করে করে কী?

—এতোটুকুও সত্য কি নেই কুমারের আচরণে?

—আছে সুনীথ, ভয়ের সত্য, ইদ্ধিতে বদ্ধমূল বিশ্বাসের সত্য, আর সহজাত কুটবুদ্ধির সত্য। ভয় নাই। কুমার অস্ত্রত্যাগ করবে না, মগধসাম্রাজ্য আমরা পাবোই। আজ, নয় কাল।

—তোমরা কে?— কণ্ঠ ক্ষীণ, দৃষ্টিতে আলো নেই, স্মৃতি আহত, যেন বহুদূর থেকে বললেন তিনি।

কোমরে পাতার মালা, গলায় কুঁচ ফলের হার, খালি গা, মানুষগুলি বলল– হড় গো, মোরা হড়। ই যে বির দেখিস কেঁদ, বয়ড়া, গাব, শ্যাওড়া, সাল, পিয়াল গাছে গাছ বির, ই বির মোদের।

এরা এই বনের মানুষ? নিজেদের এরা হর বলে কী?

—আমি কোথায়?

—মোদের মজাঙে আছিস। ভাবিস নাই। তু মোদের মেইয়্যার নাম লিছিস। তুরে ঠারে লিব। বুঢ়ামবুঢ়া বুঢ়ামবুঢ়ি বলিছে।

ধিমি ধিমি ধিমি ধিমি বাদ্য বাজে। তাঁর ঘোর লাগে। এরা কি তাঁকে কোনও সুরা পান করিয়েছে? জিভে কেমন একটা মাদক মধু মধু স্বাদ! বলকারক কোনও তৈল দিয়ে তার সারা শরীর মাজছে এরা। শরীরের অসাড়ভাব কেটে যাচ্ছে ক্রমশ। কার নাম নিয়েছেন তিনি? কার নাম? তিনি বুঝতে পারেন না কেন এরা তাঁকে সেবা করছে।

তিনি ঘোরে থাকেন। মজাঙে রক্ষিত আগুন থেকে তাঁর হাতে পায়ে সেঁক দিতে দিতে বাঁশের চোঙা থেকে মধুক-মদ পান করে তারা। গল্প করে অনেক চাঁদ আগে তাদের বন্ধু ভিন্ন এক কিল্লির পাঢ়ায় এক যতি এসেছিলেন। পূজা ঠিকমতো না হওয়ায় একদিন তিনি রাগ করে অদৃশ্য হয়ে যান। আর তারপরে তাঁর মন্তরের টানে তাদের বীরতমা মেয়েটি আর বীরতম ছেলেটি কোথায় চলে যায়। যতি দেখলেই তাই সব কিল্লির হড়রা তাকে তুষ্ট করবার প্রাণপণ প্রয়াস পায়। কে বলতে পারে কার মধ্যে কী শক্তি আছে!

ঘুমঘোরের মধ্যে গল্প কথা ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় তাঁর চেতনা। তিনি অস্পষ্ট স্বপ্নে নিজেকে হাতড়ে ফেরেন। তিনি কে? কোথায় ছিলেন? তিনি কি কোনও যতি? এরা কি পত্ৰশবর? কারা হারিয়ে গেছে? তিনি কি তাদের চিনতেন।

২৪

মগধ-কোশলের যুদ্ধে ভিক্ষুসংঘ বড়ই জড়িয়ে পড়ে। কোশলের পক্ষে থাকে এবং থাকে সক্রিয়ভাবে। বুদ্ধ তখন জেতবনেই। ভিক্ষুদের সক্রিয় সহযোগের কথা তিনি প্রথম থেকেই জানতেন কিনা নিশ্চয় করে বলা যায় না। ধনুর্গ্রহ তিষ্য নামে এক স্থবির আরেক স্থবির উপ্তর সঙ্গে একই পরিবেণে থাকতেন! ধনুর্গ্রহ তিষ্য প্রব্রজ্যা নেবার আগে তক্ষশিলার শস্ত্রশিক্ষক ছিলেন। তাঁর সেই সময়ে রাতে নিদ্রা হত না পসেনদির মূর্খামিতে। অবশেষে উপ্তর পরামর্শে তিনি তাঁর শিষ্য পাঞ্চালকে ডেকে পাঠান।

—আমাকে নিমন্ত্রণ করছ না কেন তিষ্য?

—সে কী? এখনি করছি। কালই আসুন আচার্যদেব।

—যাবো যাবো অবশ্যই যাবো, কিন্তু আমি শ্ৰমণ, আমাকে সেইভাবে ডাকো আয়ুষ্মন।

—ভন্তে, আমার অপরাধ হয়ে গেছে।

পরদিন নিমন্ত্রণে এসে তিষ্যপত্নী সোমার হাতের পায়স চেটেপুটে খেতে খেতে স্থবির বললেন—উপাসককে ভোজনান্তে উপদেশ দেওয়ার নিয়ম, জানো নিশ্চয় তিষ্য! সুতরাং আরম্ভ করি। বলি বৎসে সোমা, তুমি এমন বিদুষী হয়ে পতিকে যুদ্ধে যেতে দিচ্ছ না এ বড়ই পরিতাপের বিষয়।

সোমা বলল—সে কি ভন্তে, এমন মিথ্যা আরোপ আমার ওপর?

—তবে তিষ্য সৈনাপত্য করছে না কেন? কে বাধা দিচ্ছে?

তিষ্য বলল—দীঘ মল্ল রয়েছেন। কুমার রয়েছেন। মগধ থেকে পালিয়ে আসবার সময়ে যুদ্ধ করেছি। মহারাজ তো স্বয়ং নেতৃত্ব দিচ্ছেন এখন।

কুমারের গূঢ় বিরাগ ও দ্বেষ যে তাঁকে এই যুদ্ধ থেকে শেষ পর্যন্ত সরিয়ে রাখল, এ কথা পাঞ্চাল পত্নী ছাড়া কারো কাছে প্রকাশ করেনি।

—ওটি তো একটি আস্ত গর্দভ!

—স্বর মৃদু করুন ভন্তে! আমি জানি উনি তাই। কিন্তু ওঁর গর্দভত্বের কোন্ দিকটির প্রতি আপনি এখন নির্দেশ করছেন?

—দীঘ মল্ল ও রাজকুমার বিরূঢ়ক যদি ওঁর সঙ্গে রণক্ষেত্রেই থাকে, তাহলে যুদ্ধে জয় হওয়া সম্ভব? অচিরেই মহারাজ বন্দীও হবেন। মল্লই ধরিয়ে দেবে।

—সে কী!

—বন্ধুলের কারণে দীঘ কারায়ণের হৃদয়ে প্রতিহিংসার অনল জ্বলছে না? আর বিরূঢ়ক ভগবানের মধ্যস্থতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে সত্য। কিন্তু দাসীপুত্র বলে বিতাড়িত হবার অপমান সে কোনদিন ভুলবে?

—তা সত্য। কিন্তু প্রতিহিংসা? বন্ধুলের কারণে? ঠিক বুঝলাম না ভন্তে!

—তুমি তিষ্য আরও একটি গর্দভ।

—মাঝে মাঝে মনে হয় বটে। কিন্তু আপাতত এ বিশেষণটি কেন উপহার দিলেন ভন্তে?

—বন্ধুল আর তার দশ পুত্র মহাবীর। এগারটি মহাবীর প্রত্যন্ত দস্যুর হাতে নিহত হল এই শিশু-ভোলানো উপকথা তুমি ছাড়া আর কেউই বিশ্বাস করে না তিষ্য।

—তা হলে? —নিশ্বাস রুদ্ধ করে তিষ্য বলে।

—পসেনদি নিজে ওদের হত্যা করিয়েছেন।

তিষ্য কাঁপতে থাকে। শরীরে স্বেদ। দেহ কঠিন হয়ে যায়।

সোমা বৃথাই বলে, আত্মসংবরণ করো, ধৈর্য ধরো হে পাঞ্চাল।

স্থবির বললেন—বন্ধুল বড় পরিহাসপ্রিয় মানুষ ছিলেন। কখনও সখনও হয়ত পরিহাস করেই বলে থাকবেন তাঁদের এগারজনের মিলিত শক্তিতে অনায়াসেই পসেনদিকে রাজ্যচ্যুত করা যায়…পসেনদি যে তাঁর ছাত্রজীবনের সখা এ কথা তো বন্ধুল কখনওই ভুলতেন না—তা এই প্রকার কথাবার্তা হতে হয়ত অনড্‌বান রাজাটির মনে সংশয় জমে থাকবে! মল্লর বিরুদ্ধে মন্ত্রণা দেবার লোকও তো অমাত্যদের মধ্যে কিছু অল্প নয়। তুমি তো জানো সবই…কী হল তিষ্য, কথা বলো? এমন বাক্যহারা হলে প্রতিহিংসা নেবে কী করে?

—আপনি বুদ্ধপন্থী হয়ে প্রতিহিংসার কথা বলছেন?—তিষ্য অনেক কষ্টে সংবৃত হয়ে বলে।

—আয়ুষ্মন, বন্ধুল যেমন পসেনদির সতীর্থ ছিলেন তেমনি আমারও ছিলেন যে! আর সদ্ধর্ম যেমন প্রাণিহিংসা, হিংসার পরিবর্তে হিংসা নিষেধ করে, তেমনি অসৎকে পরিত্যাগ করার কথাও তো বলে। আমি এবং স্থবির সারিপুত্ত এমন কত উপদেশের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা করে আনন্দ পাই। তবে প্রতিহিংসার অর্থ যে হত্যাই, তা আমি একবারও বলিনি তিষ্য। দেবদত্তর কেমন শাস্তিটা হল? নিজের শিষ্যদের পদাঘাতে মুখে রক্ত উঠল, তারপর ভগবানের কাছে আসবার পথে ভূকম্পে মারা গেল …তবে অসতের শাস্তিবিধান করতে হলে কাকে ছেড়ে কাকেই বা রুখবে? এই যে একেকটি রাজবংশ হয়ে যাচ্ছে, মনে করছে পরম্পরায় পৃথিবী ভোগ করবে, এতেই হয়ে যাচ্ছে সর্বনাশ!

—আমাকে কী করতে বলেন ভন্তে!

—যুদ্ধে যাও, কাশী হতে গয়ায় প্রবেশ করতে দু’ পাশে গিরি আছে, ওইখানে শকট ব্যূহ রচনা করে অজাতশত্রুকে টিপে মারো।

ধনুর্গ্রহ তিষ্য চলে গেলেন। যাবার সময়ে পেছন ফিরে একবার মৃদুস্বরে বললেন—আমার নামটি আবার যেন তথাগতের কানে না যায়। তুমি যা—

—গর্দভ! তিষ্য বলল।

কার্যকালে কিন্তু দেখা গেল তথাগত ব্যাপারটি শুধু জানেনই না, প্রসন্ন মুখে তিনি ধনুর্গ্রহ তিষ্যর গুণগান করছেন।

যাই হোক, পাঞ্চালের পরামর্শে শকট ব্যূহ রচনা করে পসেনদি জয় লাভ করলেন। কিন্তু অজাতশত্রুর শাস্তি? হল কই! দু’-তিনদিন ধরে বন্দী ‘মগধরাজকে অনর্গল তিরস্কার করে কন্যা বজিরার সঙ্গে তার বিবাহ দিলেন পসেনদি। এবং যে-কাশীগ্রাম নিয়ে বিরোধ সেটাই তাকে প্রত্যর্পণ করলেন।

কিশোরী বজিরার কান্না, আহত সৈনিক ও দাসদের আর্তনাদ, মৃত সৈনিকদের স্ত্রী-পুত্রদের হাহাকার ও বিবাহ উৎসবের বিবিধ হট্টরোল শুনতে শুনতে ক্রমশ বিষণ্ণ, উদাস হয়ে যেতে থাকেন পাঞ্চাল। ওই তো রাজা পসেনদি বার্ধক্য-কুঞ্চিত মুখে হা-হা করে তাঁর বিখ্যাত হাসি হাসছেন। মদিরার স্ফটিক পাত্র তুলে দিচ্ছেন তারই হাতে যে নাকি তাঁর ভগ্নী ও ভগ্নীপতির নিষ্ঠুর ঘাতক! কই? শোক, ক্রোধ এসবের কোনও চিহ্ন তো নেই! তা হলে যুদ্ধ কেন হল? সহস্র সৈন্য নিহত হয়েছে। শত শত আহত। উভয় পক্ষেই। রাজায় রাজায় এ এক গোপন খেলা তবে পরস্পরের সিংহাসন সুরক্ষিত করার জন্য?

বিবাহ-সভা ত্যাগ করে চলে যান পাঞ্চাল।

—কোথায় যান পাঞ্চাল!

কুমার বিরূঢ়ক আসছে পেছন পেছন।

—আপনি কোথায় যান?

ক্রুদ্ধ মুখে গর্জন করে কুমার বলে—ভগ্নীর কান্না আর শুনতে পারছি না পাঞ্চাল। একটা নৃশংস ঘাতক, বিকলাঙ্গ—এই কি বজিরার উপযুক্ত পতি? আমাদের ভাই-ভগ্নীর কোনও মূল্য নেই পিতার কাছে?

বড় বড় নিশ্বাস পড়ে কুমারের।

তিষ্য বলেন—এ এক প্রকার কান্না। কুমার, আরো কান্না আছে। শুনবেন তো আসুন।

শুশ্রূষাশালায় আহত সৈনিকদের মধ্যে প্রবেশ করলেন তিনি কুমারকে নিয়ে। বৈদ্যরা পট্টিকা লাগাচ্ছেন, ঔষধ দিচ্ছেন, হাত, পা, আঙুল বিবিধ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে বাদ দিতে হচ্ছে। অমানুষিক চিৎকার, আর্তনাদে শুশ্রূষাশিবির যেন সপ্তম নরক।

অশ্বারোহী দলের এক সৈন্যের দুটি পা-ই গেছে, ক্ষতস্থান পচে ভীষণ আকার ধারণ করেছে। সে জান্তব আর্তনাদ করছে আর বলছে—নিপাত যাক, নিপাত যাক মগধ, কোশল নিপাত যাক…ধ্বংস হয়ে যাক যে যেখানে আছে।

—কী হবে আমাদের পুত্র-কন্যা-পত্নীর? কেউ কেউ বলছে।

—আমার বৃদ্ধ পিতা-মাতার? কে দেখবে? —রব উঠছে চারদিকে।

পাঞ্চাল বলেন—শান্ত হও, শান্ত হও সৈনিক, আমি দেখব, কথা দিচ্ছি, এই কোশলকুমার দেখবেন।

আরও বৈদ্য আসেন। শল্যবিদ আসেন। সেবক আসে। মৃত্যুর হাহাকার…তারই মধ্যে যাদের আঘাত অত গুরুতর নয়, যাদের চিকিৎসায় উপকার হচ্ছে তারা জয়ধ্বনি করে তিষ্যকুমারের, রাজকুমারের। ক্রমশ বৈদ্যদের কাছে গিয়ে প্রতিটি রোগীর সংবাদ নিতে থাকে বিরূঢ়ক।

—এই-ই করণীয় কুমার—ধীরে ধীরে বলেন পাঞ্চাল—স্বাভাবিক করুণার বশে যদি না-ও করেন, অন্তত প্রজাদের হৃদয়ে প্রবেশ করবার জন্যও করুন।

শ্রাবস্তীতে ফিরে মগধ যুদ্ধে হতাহত সৈনিকদের পরিবারগুলির জন্য ব্যবস্থা নেন পাঞ্চাল। সেনাপতি দীঘমল্লর পরেই এখন তাঁর স্থান। কিন্তু রাজার দেওয়া বৃত্তির অধিকাংশই ব্যয় করেন দানে। পত্নী জিতসোমার সঙ্গে থাকেন সাধারণ গৃহস্থের মতো।

চণকের সন্ধানে দিকে দিকে লোক যায়। কেউ কোনও সংবাদ আনতে পারে না। দর্ভসেনের মৃত্যুর পর গান্ধারের সবার্থক হয়েছেন তাঁর পরমমিত্র অনঘ আঙ্গিরস—এমন সংবাদ আসে। প্রায় নিশ্চিত হওয়া যায় তখন যে চণক সেখানে নেই।

শ্রাবস্তীর রাজনীতির আকাশে সবার অলক্ষ্যে মেঘ ঘনায়। কাল, জুহ্ন, উগ্র, শ্রীভদ্র—ব্রাহ্মণ অমাত্যরা কেউ বৃদ্ধ রাজার ওপর আস্থা রাখেন না। সারাটা জীবন তিনি একবার বুদ্ধ একবার বেদ এইভাবে দুই তরীতে পা দিয়ে চললেন; তাঁদের অসন্তোষ আজকাল পরিষ্কার বোঝা যায়। দীঘকারায়ণের সঙ্গে প্রায়ই তাঁরা নানা পরামর্শ করেন, যদিও সে মল্ল বলে তাকেও তেমন বিশ্বাস করেন না। প্রায়ই এই অমাত্যদের গৃহ থেকে নিমন্ত্রণ আসে তিষ্যর কাছে।

এমনই এক নিমন্ত্রণে যেতে অমাত্য শ্রীভদ্র একদিন বললেন—মহামান্য পাঞ্চাল, আপনি তো কোশলেরই সন্তান…

পাঞ্চাল বুঝতে পারেন না শ্রীভদ্র কী বলতে চান।

শ্রীভদ্র বলেন, কোশলের গর্ব আপনি। প্রজাসাধারণকে যেরূপ অল্প সময়ের মধ্যে জয় করে ফেলেছেন তাতে করে মনে হয় কোশলের এখনও কিছু আশা আছে। আপনি কি সেই ঘটনাটি জানেন?

—কোন ঘটনা?

—ওই, রাজা রাজকুমার এরা মনোমত না হওয়ায় অমাত্যরা তাদের সিংহাসন থেকে টেনে নামায়, জনগণ সমর্থন করে, একজন সত্যিকার গুণী মানুষকে তখন রাজা করা হয়!

—এমন ঘটনা আগে প্রায়ই ঘটত—তিষ্য সতর্কভাবে বলেন।

—আবার ঘটবে, ভবিষ্যতে প্রচুর ঘটবে, বর্তমানেও ঘটা উচিত। এইভাবে চললে কোশলের আয়ু আর অধিক দিন নয়। মগধের গর্ভে চলে যাব আমরা।

তিষ্য মনে মনে হাসতে হাসতে ফেরেন। শ্রীভদ্র জানেন না, একদা এই তিষ্য মগধেরই আধিপত্য বিস্তার করার জন্য প্রাণপণে করেছেন। সে কথা জিতসোমাকে জানাতে সে বলে—সাম্রাজ্য হবেই পাঞ্চাল, দৈবরাত যে-চক্রবর্তীক্ষেত্রের কথা বলে গিয়েছিলেন এই মধ্যদেশ, প্রাচী-ঘেঁষা মধ্যদেশই সেই ক্ষেত্র। অজাতশত্রু এবং তাঁর দুই দুর্ধর্ষ সচিব বর্ষকার ও সুনীথ থাকতে মগধের সাম্রাজ্য হওয়ায় কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমি অমাত্য ছিলাম, আমি জানি পাটুলিতে গঙ্গা ও হিরণ্যবাহর সঙ্গমস্থলে দুর্গ গড়া আরম্ভ হয়ে গেছে। অতি দক্ষ দ্রাবিড় কম্মাররা এসেছে, মহাশিলাকণ্টগ বলে এক ধরনের নতুন অস্ত্র নির্মাণ করাচ্ছে অজাতশত্রু। বড় বড় শিলাখণ্ড বহু দূর পর্যন্ত ছুড়তে পারবে এই অস্ত্র। গবেষণা চলছে রথমুষল নিয়ে। রথের চারপাশে মুষল থাকবে। এই দ্রুতগামী রথ শত্রুসৈন্যের মধ্য দিয়ে চললে বহু লোক নিমেষেই হতাহত হবে।

তিষ্য আশ্চর্য হয়ে বললেন—সত্যিই তো! নতুন অস্ত্র হলে তবেই তো পুরনো অস্ত্রধারীদের ওপর জয়লাভ করার আশা থাকে! এ কার কল্পনা সোমা?

—কুমারেরই।

—কুমার তো তা হলে সামান্য নয়?

—আমি কি একবারও বলেছি সামান্য? প্রকৃত কথা উদ্ভাবনী-প্রতিভার সঙ্গে শুভবুদ্ধি আছে কিনা। হে পাঞ্চাল, শুভবুদ্ধি বিবর্জিত কুমারের প্রতিভা তাই ভয়ের কারণ। তবে এখন শুনছি তথাগতর সঙ্গে সন্ধি হয়ে গেছে…আশা করতে পারি তার কিছু ভালো ফল হবেই! —সোমা হাসল।

অন্যমনস্কভাবে তিষ্য বললেন—তা হলে দৈবরাত ঠিক মানুষটিকে চিহ্নিত করতে পারেননি! পিতা নয়? পুত্র?

জিতসোমা বিষণ্ণ দু চোখ তুলে বলল—দৈবরাত ভুল করেননি পাঞ্চাল। কাল, স্বয়ং কাল এই ভুল করেছে।

শ্রাবস্তী থেকে কপিলবস্তু। কপিলবস্তু থেকে শ্রাবস্তী ঘন ঘন যাতায়াত করছেন বুদ্ধ। মগধের সঙ্গে সন্ধির পর নিশ্চিন্ত পসেনদিও তাই করছেন। রানি মল্লিকার মৃত্যুর পর এক স্থানে স্থির থাকতে পারেন না তিনি। বুদ্ধর প্রতি আকর্ষণ আরও বেড়েছে। সমান অনুপাতে বেড়েছে অমাত্যদের বিরাগ।

অবশেষে একদিন প্রবাসী পসেনদির রাজছত্র, মুকুট ইত্যাদি রাজচিহ্ন চুরি করে নিয়ে দীঘকারায়ণ ঘোড়া ছুটিয়ে আসেন। তাঁর পেছনে কোশলসৈন্যের একটি দল। বিরূঢ়কের রাজ্যাভিষেক হয়। অমাত্যরা কেউ আপত্তি করেন না। কিন্তু আড়ালে পাঞ্চালের কাছে এঁরা নানা প্রকার অভিযোগ জানাতে থাকেন। বয়োবৃদ্ধ অমাত্যদের নানাভাবে অপদস্থ করছেন বিরূঢ়ক।

—অমাচ্চ হয়েছেন কিসের জন্য? ভৃতি, প্রাসাদ, লোকজন, বহু স্ত্রী, সম্পদ ভোগ করবার জন্য? রাজাকে সুপরামর্শ দেওয়া আপনাদের কাজ নয়? যখন পট্টমহিষী এবং তাঁর কুমার প্রাসাদ থেকে বহিষ্কৃত হলেন সামান্য দাসদাসীর মতো, তখন কোথায় ছিলেন? সুন্দরী শূদ্রা দাসীর অঙ্কে শয়ন করেছিলেন বোধহয়!

কিংবা

—মগধের রাজাকে হাতে পেয়ে ছেড়ে দিলেন আপনাদের মহারাজ? এর মধ্যে দণ্ডনীতির কোনও ভুল নেই? হিংস্র শার্দুলকে হাতে পেয়ে ছেড়ে কেউ দেয় মহামূর্খ ছাড়া? তারপর আবার সেই শত্রুর ঘরে কন্যা পাঠানো! জেনে রাখবেন অমাচ্চ মহোদয়রা, পাশকের গুটি এখন ওই বিকলাঙ্গ রাজার হাতে। আমরা কোনওদিন ওর সাম্রাজ্য বিস্তারের বিরোধিতা করতে পারব না, কন্যা দিয়েছি বলে। নিষেধ করতে পারেননি?

—শোনেন তিষ্যও। ঠিকই বলেছে বিরূঢ়ক। বয়স অধিক নয়, কিন্তু বুঝেছে সঠিক। শুধু যদি প্রতিহিংসা প্রবৃত্তি আর অকারণ রূঢ়তাকে জয় করতে পারত।

পসেনদি মারা গেলেন রাজগৃহের উত্তর দ্বারের বাইরে এক রথকারের কুটিরে। রাত্রে এসে পোঁছেছিলেন। রাজগৃহের দ্বার রাত্রে খোলে না। অজাতশত্রুর কাছে শেষ আশ্রয় নিতে এসেছিলেন, না সাহায্য প্রার্থনা করতে এসেছিলেন বোঝা গেল না। তার আগেই হৃৎস্পন্দ বন্ধ হয়ে গেল।

অমাত্যদের গোপন প্রার্থনা তিষ্য রাজা হোক। ক্ষণে ক্ষণে নানা ছলে নানা বেশে চর আসছে তার কাছে। যে কোনও সুযোগে তাঁরাই বসাবেন তিষ্যকে সিংহাসনে। বহু শ্ৰেষ্ঠী, সাধারণজন পাঞ্চাল তিষ্যকে চায়। পাঞ্চাল ভাবেন—হায় ঈশ, একদিন রাজাই হতে চেয়েছিলাম, কী অফুরন্ত শক্তি। উৎসাহ, কল্পনা ছিল, গড়তে চেয়েছিলাম আমার সব দিয়ে একটি আদর্শ রাজ্য। বোধহয় একটি রানীর অভাবে তা হল না। —ভাবতে ভাবতে তিষ্য আপনমনেই হাসেন—আর এখন? রানী প্রস্তুত, রাজ্য প্রস্তুত, সিংহাসন ডাকছে, কিন্তু তিষ্যই প্রস্তুত নয়। মহাবীর পাঞ্চাল কি শেষে চৌর্যবৃত্তি ধরবেন? না, কখনও না। মন্দ উপায়ে কখনও শুভফলে পৌঁছনো যায় না।

পরদিন কোশলের রাজসভা পাঞ্চালের তীব্র প্রতিবাদ শুনল। রাজা বিরূঢ়ক ঘোষণা করেছিলেন, কপিলবস্তুর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করবেন।

—কেন? পাঞ্চাল তিষ্য উঠে দাঁড়িয়েছেন—কেন জিজ্ঞাসা করতে পারি মহারাজ! শাক্যরা কোশলের অধীন, নিয়মিত রাজস্ব দেয়। আমাদেরই মনোমত ব্যক্তিকে গণজ্যেষ্ঠক করে, কী ছলে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন?

—তারা কোশলের রাজবংশকে, রাজকুমারকে অপমান করেছে। এর চেয়ে বড় কারণ আর কী হতে পারে? বিরূঢ়ক ক্রুদ্ধ।

—কিন্তু কোশলের রাজবংশ তো আর কোশল নয় মহারাজ।

—অর্থ?

—কোশলের রাজবংশ একটি ধনশালী কুল। একদা কুলের প্রমুখের হাতে এ রাজ্যের শাসনভার ন্যস্ত হয়েছিল। কথা ছিল সচিবরা, মহামাত্ররা মিলে সিদ্ধান্ত নেবেন, রাজা একা কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। আমি একজন মহামাত্র, সেই পদাধিকারে আপনাকে নিষেধ করছি—মিথ্যা লোকক্ষয় করবেন না। মাতুলদের কুলের সঙ্গে আপনার যে মান-অভিমান তা ব্যক্তিগত। সে কারণে আপনি সমগ্র কোশলকে বিপন্ন করতে পারেন না। এই সেদিন মগধের সঙ্গে যুদ্ধ উপলক্ষ্যে কোশল রক্তস্নান করে উঠেছে, আবারও যুদ্ধ হলে তা কোশলের কাল হবে।

জুহ্ন, কাল, শ্রীভদ্র—তিন অমাত্য উঠে দাঁড়িয়ে বললেন—মহামাত্র পাঞ্চাল ঠিকই বলেছেন মহারাজ।

সিংহাসন ছেড়ে রাগে গরগর করতে করতে সভা ত্যাগ করে চলে গেল বিরূঢ়ক।

কদিন পরই কোশলসৈন্য কপিলবস্তুর দিকে যাত্রা করল। কুমার স্বয়ং পরিচালনা করছেন। দীঘকারায়ণ রাজধানী রক্ষা করতে লাগলেন। আর কাউকেই নতুন রাজা বিশ্বাস করেন না।

পাঞ্চাল নিজের গৃহে ফিরে জিতসোমার কক্ষে প্রবেশ করলেন। পুঁথিতে সম্ভবত ছায়া পড়েছিল, জিতসোমা মুখ তুলে তাকালেন। মগধ হতে আসবার পর থেকে জিতসোমার শীর্ণতা কাটেনি। চোখদুটি অস্বাভাবিক বড় এবং কালো দেখায়। রজতসূত্র দেখা দিচ্ছে মাথায়। এখনও চণকের সন্ধান চলছে। দেশে দেশে সার্থ যায়। ক্রমেই তাদের সংখ্যা, সম্পদ বেড়ে যাচ্ছে। তাদের দেওয়া হয় সন্ধানের ভার। সংবাদ মেলে না।

তিষ্য জানু মুড়ে বসে পড়েন, তারপর প্রিয়ার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়েন।

—কী হল, মহামাত্র কি ক্লান্ত?

—সম্ভবত তিষ্য আর মহামাত্র নেই প্রিয়ে।

—কেন? —সোমা লেখনী রেখে দেন।

ক দিন আগেকার সভার বিবরণ, আজ যুদ্ধযাত্রার বিবরণ দেন তিষ্য। তারপর বলেন—বৃথাই রাজশাস্ত্র লিখছ সোমা, তোমার স্বর্গরাজ্য স্থাপনের কল্পনা কোনওদিন সফল হবে না।

—স্বর্গরাজ্য তো নয় পাঞ্চাল! সুখ-দুঃখ পাপ-পুণ্যের অভিঘাতময় এই মর্ত্যের উত্তরাধিকারকেই বিবেক ও নিয়মের শাসনে সংযত করে যেতে চাই।

—কিন্তু স্বভাবের মধ্যে হিংসাকে উচ্ছিন্ন না করলে, বাসনাকে বন্দী করতে না পারলে কি মানুষ কোনদিন সুখ পাবে?

—হায় পাঞ্চাল, তুমি যে তথাগতর মতো কথা বলছ? হিংসাকে কোনদিন উচ্ছিন্ন করা যাবে কি? কামনাকেও বিনষ্ট করা যাবে না। সব মানুষ একই সময়ে সর্বতোভাবে সুখীও হবে না।

—তা হলে? তিষ্য স্মিত মুখে জিজ্ঞাসা করেন।

—তোমার কি মনে হয় না এগুলি জীবনেরই স্বভাব? ওই কামনা! বাসনাজাত ক্রোধ লোভ, দম্ভ, ঈর্ষা—এইসব! যতই এদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে ততই দ্বিগুণ বলের সঙ্গে এরা তোমাকে আক্রমণ করবে। এমন কি তুমি দেখোনি? শোনোনি?

—তা হলে উপায়?

—ক্রোধকে ক্ষাত্ৰতেজ, লোভকে বাণিজ্য বিস্তার, দম্ভকে মর্যাদাবোধ, ঈর্ষাকে উৎকৃষ্ট থেকে উৎকৃষ্টতর হওয়ার প্রয়াসে পরিণত করা যায় না কী?

—আর বাসনা?

—বিত্তবাসনার কথা তো বললামই পাঞ্চাল, শক্তিবাসনার থেকে উদ্ভূত হোক বিরাট বিরাট কর্মকাণ্ড, মহান সব মানুষ—আর দেহবাসনার রূপান্তর তো সবচেয়ে সুন্দর হবে! এই যে পাঞ্চাল সারা জীবন ধরে বিশাখার জন্য অস্থির বাসনাকে সোমার জন্য স্থির প্রেমে পরিণত করলেন, এ কী তবে? দুঃখময় পৃথিবীতে এই অমৃতের জন্যই কি লক্ষবার ফিরে আসতে ইচ্ছা হবে না?

ক্লান্ত চোখদুটির মধ্যে দীপ জ্বলছে। পাঞ্চাল তাকিয়েই থাকেন। অপরূপ এক আহ্লাদে ভরে যেতে থাকে—শরীর, মন, অস্তিত্ব, পৃথিবী। কিছু তা হলে পেরেছেন তিষ্য? কেউ তা হলে শেষপর্যন্ত তাঁকে গ্রহণ করল! তিনিও পারলেন দিতে এবং নিতে? জীবনের স্বাদ কী গভীর! কী মধুর। মন কী যে বিষাদে পরিপ্লুত। নারীরাই—বিশাখা এবং অলভা, ভদ্রা এবং অম্বপালী, অবশেষে সোমা জিতসোমা তাঁর অর্ন্তজীবনকে গড়ল। একটু একটু করে পূর্ণতা দিল। তিনি সোমার মুখাটি নামিয়ে এনে থিরবিজুরির মতো একটি দীর্ঘ চুম্বনে বহুক্ষণ স্থির-অস্থির রইলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *