১.৩০ গৃধ্রকূট থেকে সূর্যোদয়

৩০

অতি প্রত্যূষে গৃধ্রকূট থেকে সূর্যোদয় দেখবার জন্য চণক, জিতসোমা এবং তিষ্য তিনটি ঘোড়ায় চড়ে বেরিয়ে পড়ে। তখন নগরীর পথঘাট ঘন কুয়াশায় ঢাকা। চলাচল করে অন্ত্যজ শ্রেণীর লোকেরা গৃহমল পরিষ্কার করবার জন্য। আর দেখা যায় শ্রমণদের। কেউ শ্বেত বস্ত্রধারী, কেউ গৈরিক, কেউ অর্ধনগ্ন, কেউ-বা একেবারেই নগ্ন। প্রত্যূষ ভ্রমণে অভ্যস্ত কিছু নাগরিকও বেরোয়। কয়েকজন বৈদিক ব্রাহ্মণ আছেন, একটি গো-শকটে করে নিত্য পাটুলি গ্রামে গিয়ে গঙ্গাস্নান করেন, ফিরতে ফিরতে অপরাহ্ণ হয়ে যায়। আবার রাত কাটিয়ে পর-প্রত্যূষে গো-শকট চলে পাটুলি অভিমুখে। অর্থাৎ এঁদের সারা দিনটাই ব্যয় হয়ে যায় যাতায়াতে। জিজ্ঞেস করলে এঁরা বলেন, বহতা জল নইলে এঁরা স্নান করে পবিত্রতা ফল অনুভব করেন না। তার ওপর গঙ্গাস্নান। যা কিছু পাপ সারা জীবন জ্ঞাতে অজ্ঞাতে হয়ে যাচ্ছে সবই প্রতিদিনের গঙ্গাস্নানে ধুয়ে যাচ্ছে। অনেকেই এঁদের চেনে, উদকশুদ্ধিক ব্রাহ্মণ বলে এঁদের খ্যাতি বা অখ্যাতি আছে।

পরস্পরকে ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে না এমনই কুয়াশা। জিতসোমা অশ্বারোহিণী হবার সময়ে অধোবাস পুরুষদের মতো করে পরে নেয়। তার ঊর্ণার স্তনপট্ট দৃঢ়ভাবে বাঁধা। তার ওপর একটি স্থূল ঊর্ণার উত্তরীয় সে সুকৌশলে পিঠ এবং বুক ও পেট ঢেকে নীবিবন্ধে বেঁধে নিয়েছে। চণক ও জিতসোমা উভয়েরই শীত অভ্যাস আছে। শীতে দুজনেই উল্লসিত হয়। কিন্তু তিষ্যকুমার তক্ষশিলায় বহু বছর কাটালেও, শীতে খানিকটা পর্যুদস্ত হয়। বিশেষ করে অশ্বের ওপর। অশ্ব চলায় বেগ দিলেই দু’পাশ দিয়ে হু-হু করে হিমেল বাতাস বইতে থাকে। তিষ্য তার ঘোড়ার রাশ টেনে ধরে বলে, ‘তাম্রক, তাম্রক, ধীরে, ধীরে, আমরা রণক্ষেত্র থেকে পালাচ্ছি না। তাড়া নেই।’

চণক তার ঘোড়ার পেটে মৃদু আঘাত করে বলে, ‘চিত্তক, চিত্তক, জোরে, আরও জোরে, সূর্যোদয়ের পূর্ব মুহূর্তে উপস্থিত হওয়া চাই।’

জিতসোমা কুয়াশার অন্তরালে হাসতে থাকে, তার মুখের সামনে হিম বাতাসে বাষ্প নির্মিত হয়। সে এক হাতে ঘোড়ার রাশ টেনে ধরে আরেক হাত বাষ্প খণ্ডগুলিকে ধরতে যায়। ধরতে না পেরে আবারও হাসতে থাকে।

এইভাবে কখনও দ্রুত, কখনও ধীর লয়ে তিনজনে গৃধ্রকূটে পৌছে যায়। যেতে যেতে প্রথমেই নগরীর উত্তর দ্বার দিয়ে বেরোতে উদ্যত গো-শকটটির সঙ্গে তাদের দেখা হয়। বয়স্থ ব্রাহ্মণ তিনটি শীতে জড়সড় হয়ে কোলের ওপর পুঁটলি নিয়ে বু-বু করে কাঁপতে কাঁপতে কী সব মন্ত্র উচ্চারণ করতে থাকেন। তিষ্যকুমার হেঁকে বলে ‘কে যায়?’

—তিন ব্রাহ্মণ গঙ্গাস্নানে যায় বাপা— কুয়াশার মধ্যে ব্রাহ্মণত্রয় নিশ্চয় তাদের ভেবেছে তোরণরক্ষী কী সৈনিক। নইলে এত বিনীত উত্তর পাওয়া যেত না।

—তিষ্য দ্বিগুণ হেঁকে বলে, ‘দূরান্তের গঙ্গায় কেন? রাজগহে কি পুষ্কর্ণী নেই!’

—পাপগুলি ধুতে বাপা, পুষ্কর্ণীতে কি আর পাপ-স্খলন হয়?

—কী পাপ? তিষ্য গলা বিকৃত করে। ভীষণ শোনায় তার স্বর। ব্রাহ্মণগুলি আরও বু-বু করে কাঁপতে থাকে।

—পাপগুলি অবিলম্বে জানাও। বোহারিকের কাছে চলো। নরহত্যা না অলংকার চুরি?

একজন ব্রাহ্মণ তাড়াতাড়ি বলে, ‘ও সব কিছু নয় বাপা, তিন সত্য করছি। প্রাণিমাত্রেই অজ্ঞাতে পাপ করে ফেলে, সেইসব অনির্দিষ্ট পাপের কথা বলছি।’

তিষ্য তখন চাপা গলায় বলে, ‘যাও, গঙ্গার জলে ডুবে মরো গে যাও।’

জিতসোমা তার কাণ্ড দেখে মৃদুস্বরে হাসে। চণকের ওষ্ঠাধরও দুদিকে ছড়িয়ে যায়।

কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে উদকশুদ্ধিক ব্রাহ্মণ তিনটি বলে, ‘কী হল? যাবো তো বাপা? পথে আবার আটকাবে না তো? ও কি, নারীকণ্ঠের হাসি শুনলাম যেন!’

আরেক জন বলে, ‘দু পা গেলেই শ্মশান। নারীকণ্ঠের হাসি শোনা যাবে, এ আর বিচিত্র কী? তাড়াতাড়ি চলো! তাড়াতাড়ি চলো! ওহে শকটচালক, থামছ কেন?’

কিছুদূর চলে এসে চণক হাসিতে ফেটে পড়ে, ‘সোমা, সঙ্গীতচর্চা করছ কতদিন! হা সোমা! তোমার হাসি প্রেতিনীর হাসি বলে ভুল হয়?’

সোমা হাসতে হাসতে বলে, ‘ওই ব্রাহ্মণগুলির পরিবর্তে আমারই এখন গঙ্গায় ডুবে মরা উচিত, কী বলুন তিষ্যভদ্র?’

—আমাদেরও ওরা এতক্ষণে প্রেতই ভাবছে। দেখুন, আজ গৃহে ফিরে কোনও প্রেতনাশক ক্রিয়া-কর্মের আয়োজন করে কি না!’

সূর্য ওঠার লগ্ন থেকেই কুজ্বটিকা গলতে থাকে। ধীরে ধীরে তরল রক্তিমাভ আলোর স্রোত বইতে থাকে। তিষ্য ঈষৎ বিষন্ন গলায় বলে, ‘চণকভদ্র আমার শ্রাবস্তী যাবার দিন ঘনিয়ে এলো।’

—তুমি তো নিজেই বেছে নিলে এই ভাগ্য তিষ্য। তবে হয়ত এই-ই ভালো হল।

তিষ্য বলল, ‘মহারাজের সন্দেশ বয়ে নিয়ে যেতে আমি বিন্দুমাত্র দুঃখিত হচ্ছি না ভদ্র। বরং আমি অত্যন্ত আনন্দিত, গর্বিত যে এরূপ বিশিষ্ট কার্যের ভার আমার ওপর দেওয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে চণকভদ্র, রাজগৃহে আসার আগে আমি নাবালক ছিলাম।’

—এখন সাবালক হয়েছেন? জিতসোমা মৃদু মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল। বালার্কের রক্তাভা এখন তার গৌরবর্ণ মুখশ্রীর ওপর একটি অসামান্য সৌন্দর্যের মুহূর্ত রচনা করেছে। সে মাথাটিও উত্তরীয় প্রান্ত দিয়ে ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়েছে। কপালের ওপরে সামান্য কিছু কেশ দেখা যায়। সে নারী না অতি কিশোর বয়স্ক পুরুষ বোঝা যাচ্ছে না।

তিষ্য সোজাসুজি জিতসোমার সঙ্গে কথা বলতে লজ্জা পায়। কেমন একটা জড়তা, সঙ্কোচ। সে জানে না কেন! সে মুখ নিচু করে দুঃখিত স্বরে বলল, ‘তা-ও বলতে পারি না ভদ্রা। মহারাজের অভিনব কার্য আমাকে সাবালকত্ব দেবে আশা করছি।’

চণক বলল, ‘তিষ্য, বিনয় ভালো। কিন্তু অতি বিনয়ে কাজ কি? বিশেষত সখাদের কাছে! তুমিই এই কাজের উপযুক্ততম পাত্র। তুমি শিক্ষিত, উদার, অভিজাত, সুন্দর বাক্য ব্যবহার করতে জানো। একটিই মাত্র প্রশ্ন আছে আমার।’

—কী প্রশ্ন?

—মহারাজা যে উপায়ে রাজসংঘ করে জম্বুদ্বীপকে একত্র করতে চাইছেন, তোমার নিজের তাতে সম্মতি এবং বিশ্বাস আছে তো?

তিষ্য বলল, ‘আমার সম্মতির প্রশ্ন উঠছে কেন আর্য চণক?’

—এই জন্য উঠছে যে তুমি রাজ্য বিস্তার করতে চেয়েছিলে। বিস্তার না বলে বলা ভালো রাজ্য সৃষ্টি করতে চেয়েছিলে। অর্থাৎ সার্বভৌমত্বই তোমার প্রিয় তত্ত্ব, প্রিয় কল্পনা। কিন্তু মহারাজের প্রতিনিধিত্ব করতে যে তত্ত্ব তুমি অবলম্বন করতে যাচ্ছ, তা তোমার পুর্বের কল্পনার বিরোধী, ওই কল্পনা যদি তোমার স্বভাবানুগ হয়, তা হলে বলতে হয় রাজপ্রদত্ত এই কর্ম তোমার প্রকৃতিরও বিরোধী।

—আর্য চণক, আমি দক্ষিণে যেতে চেয়েছিলাম। দক্ষিণ তত সহসা কেউ ভেদ করতে পারবে না! অন্তত উত্তরের প্রতিযোগিতা ও আগ্রাসী লোভ থেকে আমার রাজ্য সুরক্ষিত থাকবে এবং সেই শান্তির সুযোগে আমি আদর্শ রাজ্য, আদর্শ রাজা-প্রজা সম্পর্ক, বিভিন্ন বৃত্তির মধ্যে পারস্পরিক আদানপ্রদানের ফলে পণ্য বিতরণের মসৃণ গতি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত করতে পারব, আমি এইভাবে ভেবেছিলাম। সার্বভৌমত্বের জন্যই সার্বভৌমত্বে আমার কোনও লোভ ছিল না আর্য। সার্বভৌমত্ব যে শান্তি ও শৃঙ্খলা, সুসভ্য, সুমিত জীবনধারণের সুযোগ দেয়, তারই জন্য সার্বভৌমত্ব আমার কাম্য ছিল। মহারাজ বিম্বিসার দেখিয়ে দিলেন অন্যভাবেও তা সম্ভব। রাজশক্তি যদি পরস্পরের আনুকূল্য করে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভিন্ন রাজ্য হওয়ার জন্য প্রজাদের অসুবিধাগুলি মিলিতভাবে দূর করবার চেষ্টা করে, তা হলে আমার কল্পনার রাজ্য তো আমি পেলাম। পেলাম না!

চণক সাবধানে বলল, ‘আমি জানতাম না তিষ্য, তুমি ক্ষত্রিয়, অথচ ক্ষত্রিয়ের যা স্বধর্ম সেই যুদ্ধবাসনা, বা রাজ্যবাসনা তোমার নেই। তুমি চিরকাল কারও না কারও নেতৃত্ব মেনে নিতে প্রস্তুত আমি এ কথা বুঝতে পারিনি।’

অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে জিতসোমা বলল, ‘আর্য চণক, আমি বুঝতে পারছি না আপনি তিষ্যভদ্রকে তাঁর ক্ষত্রিয়োচিত উচ্চাকাঙ্ক্ষা সংবরণের জন্য তিরস্কার করছেন, না তাঁর মহানুভবতার জন্য প্রশংসা করছেন।’

তিষ্য সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে চণকের দিকে। তার চোখ দুটি দীর্ঘ। ঘনপক্ষ্ম। তার তরঙ্গায়িত ওষ্ঠাধর এবং নাতিউচ্চ নাসাগ্রে এখন রোদ ঝলমল করছে। সে ডান হাতের পাতা দিয়ে মাঝে মাঝে রোদ আড়াল করছে। আর যাই থাক, এই মধ্যদেশীয় যুবকের মধ্যে বিন্দুমাত্রও ধূর্ততা নেই।

সে বলল, ‘তিষ্য, আমি তোমাকে তিরস্কারও করছি না, প্রশংসাও করছি না। শুধু তোমাকে ভালো করে ভেবে নিতে বলছি। তোমার বয়সে হঠাৎ কারও ব্যক্তিমায়ায় মুগ্ধ হয়ে তাঁর আদিষ্ট কর্ম করতে গিয়ে সহসা যদি আবিষ্কার করো তা তোমার প্রকৃতিবিরোধী, তখন না পারবে এগোতে, না পারবে পেছোতে। তুমি যেরূপ বিবেকী, শুধু অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষতই হবে। তা ছাড়া যথার্থ প্রত্যয় না থাকলে কাউকে তুমি স্বমতে, অর্থাৎ বিম্বিসার মতে আনতেও পারবে না। ওই তত্ত্বে তোমার প্রত্যয় চাই!’

তিষ্য অনেকক্ষণ চিন্তামগ্ন রইল, তারপর বলল, ‘আপনার কথা আমি বুঝতে পেরেছি। মহারাজের তত্ত্বের ওপর আমার শ্রদ্ধা আছে… কিন্তু…।’

—কিন্তু কী?

—এটি একটি নূতন তত্ত্ব স্বীকার করেন তো? কুরু-পাঞ্চালের ভয়ানক যুদ্ধের কথা স্মরণ করুন। শুনেছি জম্বুদ্বীপে সামান্য কয়জন ছাড়া আর যুবা বা প্রৌঢ় অবশিষ্ট ছিল না। শুধু শিশু আর নারী, বিধবা নারী। সমগ্র জম্বুদ্বীপ এই যুদ্ধে কোনও-না-কোনও পক্ষে যোগ দিয়েছিল। সেই আদর্শ থেকে আমরা কি এখনও সরে এসেছি? ওই যুদ্ধ থেকে কোনও শিক্ষাই কি লাভ করেছি? এখনও ক্ষত্রিয় মানে যোদ্ধা, ধনুর্গ্রহ, গদাচক্রধারী। সুতরাং এটি, এই মৈত্রীর তত্ত্বটি এখনও তো পরীক্ষার স্তরেই আছে। তাই নয় কি আর্য চণক?

—সত্য বলেছ। কিন্তু কোনও তত্ত্ব যিনি উদ্ভাবনা বা প্রচার করেন তিনি বা তাঁরা অন্তত তত্ত্বটি, যথার্থতায়, প্রয়োগ-যোগ্যতায় বিশ্বাস রাখেন। যেমন ধরো, শ্ৰমণ গৌতম অনাত্মবাদ, ক্ষণিকবাদ প্রচার করছেন, আমি এখুনি তর্ক করে ওঁর যুক্তিজাল শতচ্ছিদ্র করে দিতে পারি। কিন্তু ওঁর প্রত্যয় তাতে টলবে না। উনি আমাকে বলবেন অবিশ্বাসী, অনধিকারী, পৃথগ্‌জন। ওঁর মুখের বিমল আভা দেখে, প্রত্যয়ী উক্তি শুনে বহু লোকে ওঁর অনুগামী হবে। হতেই থাকবে। সে রূপ প্রত্যয় কি তোমার আছে তিষ্য এই মৈত্রী তত্ত্বে?

‘না, চণকভদ্র, নেই,’ দুঃখিত গলায় তিষ্য বলল, ‘সত্যি কথা বলতে কি স্বয়ং মহারাজ বিম্বিসারেরও সেরূপ অবিচল প্রত্যয় নেই। তবে শ্রদ্ধা আছে, তাঁরও আমরাও। শুধু শ্রদ্ধা দিয়ে কাউকে স্বমতে আনতে পারবো না, বলছেন?’

জিতসোমা এই সময়ে বলল, ‘আর্য চণক, তিষ্যভদ্রকে নিরুৎসাহ করবেন না। যে কাজ মহৎ, যে চেষ্টা মৌলিক তার প্রতি শ্রদ্ধা থাকাই যথেষ্ট। আপনি যাকে প্রত্যয় বলছেন তা একমাত্র ঐশ্বরিক অনুপ্রেরণা থেকেই আসে। যেমন সংহিতার ঋষিদের এসেছিল!

অহমেব বাত ইব প্র বামি

আরভমানা ভুবনানি বিশ্বা।

পরো দিবা পর এনা পৃথিব্যা—

এতাবতী মহিনা সং বভূব॥

ঋষি বাক্-এর এই যে বুকের মধ্যে বিশ্বভুবন ধারণ করার অনুভব, আবার আকাশ ছাড়িয়ে পৃথিবী ছাড়িয়ে বিপুল মহিমায় দাঁড়িয়ে থাকার অনুভব, এ তো ঐশী প্রেরণার দান। যে শ্রমণ গৌতমের উদাহরণ আপনি দিলেন তিনি নাকি বলে থাকেন : অগ্‌গোহম অস্মি লোকস্‌স। —সমস্ত পৃথিবীতে আমিই শ্রেষ্ঠ, এইসব প্রত্যয় উপলব্ধিজাত। বুদ্ধি দিয়ে যা ভালো বলে বুঝি তাকে শ্রদ্ধা করে মানাও তো অনেক! গৌতমের বা ঋষি বাক্‌-এর প্রত্যয় মহারাজ বিম্বিসারই বা কোথায় পাবেন, তিষ্যভদ্রই বা কেমন করে পাবেন?’

সূর্য লাফিয়ে লাফিয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে। এখন তার মিশ্রিত রক্তাভার মধ্যে হরিদ্রার বর্ণই প্রধান হয়ে উঠছে। সূর্যের তাপ কোমল কম্বলের মতো জড়িয়ে ধরছে শীতার্ত বৃক্ষ ও গুল্মগুলিকে। এবং উপবিষ্ট তিনটি মানুষের শরীর। ঈষৎ তপ্ত হয়ে উঠেছে বাতাস, বইছে উত্তর থেকে, ভারি মধুর, উষ্ণ। তিষ্যর মনে হল বাতাস নয়, ভদ্রা জিতসোমাই এভাবে বইছেন। তাঁর গভীর সহমর্মিতার উষ্ণতায় আবৃত করে দিচ্ছেন চরাচর। তিনিই দাঁড়িয়ে আছেন পৃথিবী, আকাশ সব ছাড়িয়ে, উন্নতগ্রীব বিশাল মহিমায়। স্বে মহিম্নি।

চণক একটু পরে বলল, ‘না। আমি তিষ্যকে কখনওই নিরুৎসাহ নিরুদ্যম করছি না সোমা। শুধু ওকে চিন্তা করে নিতে বলছি। এইসব কর্মের ক্ষেত্রে কয়েকটি মানসিক বিপন্নতার সম্ভাবনা থাকে; ওকে সতর্ক করে দিচ্ছি তাই।’

তিষ্য বলল, ‘সে কথা আমি বুঝতে পেরেছি ভদ্র। আপনি যেন আমারই ভেতরের সত্তার একটি দিক। দুটি দিকের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক চলছে।’

কথাগুলো সে মৃদুস্বরে বলল। কেননা সে চায় না তার চারপাশে যে শান্তির, আনন্দের আবহ প্রস্তুত হয়েছে, তার হৃদয়ের মধ্যে এখন যে আবেশ তা ক্ষুণ্ণ হোক। ব্যক্তি-মায়া কী? কুণ্ডলকেশী সেই শ্রমণার অদ্ভুত কথাবার্তায় সে আবিষ্ট হয়েছিল, শ্রমণ গৌতম, বিশেষ করে মহা মৌদ্‌গল্যায়ন যেভাবে যক্ষ-যক্ষী দুটিকে এবং পরে উন্মত্ত জনতাকে শান্ত করলেন তখনও সে মুগ্ধ হয়েছিল। চণকের প্রতি সে আকৈশোর মুগ্ধ, মহারাজ বিম্বিসারকে তাঁর স্বরূপ দেখামাত্র তাঁর অদ্ভুত পৌরুষব্যঞ্জক হাবভাব ও স্নেহকৌতুক মিশ্রিত কথা, দেখা ও শোনামাত্র তাঁর চরিত্রের গভীরতা উপলব্ধি করা মাত্র সে মুগ্ধ হয়ে পড়েছে। এই-ই কি ব্যক্তিমায়া? আর এই যে ভদ্রা জিতসোমা অধিক কিছু বলেন না। কিন্তু যখন বলেন তখন দ্যুলোক ভূলোক ভরিয়ে বলেন, এতে যে মুগ্ধতার আবেশ সৃষ্টি হয়, মনে হয় আর কেউ কোনও কথা না বলুক, পৃথিবী ঠিক এই মুহূর্তে থমকে থাকুক, এ-ও কি ব্যক্তি-মায়া? তিষ্য কি তা হলে একটার পর একটা ব্যক্তি-মায়ায় বদ্ধ হয়ে চলেছে? তার নিজের কোনও ব্যক্তি-মায়া নেই? যাতে অন্য কেউ আবিষ্ট হতে পারে? আবদ্ধ হতে পারে?

শেষোক্ত চিন্তা মনে আসতেই তিষ্যর এতক্ষণের আবেশ, স্থিরতা, ধৈর্য, আনন্দ টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গেল। তার মনে পড়ে গেল সরযূ নদীতীর। সুনীল বর্ণের বসনে সজ্জিত এক অপরূপা কিশোরী। তিট্‌ঠ, তিট্‌ঠ, তিস্‌স্‌। তার আবেশের, মুগ্ধতার কুন্দমালাটি যেন ছিড়ে-খুঁড়ে সে টুকরো টুকরো করে ফেলে দেয়। চার দিকে ছড়িয়ে যায় তার অধৈর্য, অশান্তি, যন্ত্রণা, জিতসোমা অবাক হয়ে মুখ তুলে তাকায়। দণ্ডায়মান তিষ্যর রক্তাভ, ভ্রূকুটি কুটিল মুখের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে চণক বলে, ‘কী ব্যাপার তিষ্য, আজ কি এরই মধ্যে ফিরতে চাইছ?’

বহু কষ্টে আত্মসংবৃত হয়ে তিষ্য বলে, ‘কী লাভ? ভদ্র চণক? ক’দিন পরেই চলে যাবো শ্রাবস্তী। সেখানকার কাজ সমাপ্ত হলেই বৈশালী, তারপর যাত্রা করতে হবে উজ্জয়িনী-কৌশাম্বীর উদ্দেশে। কোথায় থাকবেন আপনারা? কোথায় বা হতভাগ্য তিষ্য।’

চণক উঠে দাঁড়িয়ে তার কাঁধ স্পর্শ করে বলল, ‘তিষ্য নিজেকে হতভাগ্য বলছ কেন সখা! তুমি যেমন দূরে যাবে, আমিও তেমন যাবো, আরও দুর্গম স্থানে যেখানে স্ব-সমাজের মানুষই হয়তো পাবো না। কিন্তু তুমি ক্ষত্রিয়, দুঃখে অবসন্ন হলে, ক্ষিপ্ত হলে কি তোমার চলবে?’

তিষ্য আরক্ত মুখে বলল, ‘আমি ক্ষত্রিয় নই আর্য চণক। আমি মানুষ। কোনও বিশেষ বর্ণের আচরণের চিহ্ন আমার গায়ে লেগে নেই। লেগে থাকবে না। কেন বারবার শুনতে হবে ক্ষত্রিয়, ক্ষত্রিয়, ক্ষত্রিয়, এমন কি আপনার থেকেও? কত যুগ ধরে আমাদের পূর্বপুরুষেরা এই ক্ষত্রিয়-সংস্কার, ব্রাহ্মণ-সংস্কার ঢুকিয়ে দিয়েছেন আমাদের রক্তে? ভদ্র চণক, ওই বিদ্রোহী চণ্ডাল অনঙ্গ যেমন দাসত্বের, শূদ্ৰত্বের পূর্ব-সংস্কার ভেদ করে উঠে দাঁড়িয়ে সক্রোধ প্রশ্নে জানিয়ে দেয় সে শুধু সেবক নয়, সে মানুষ, তিষ্যও তেমন ক্ষত্রিয়-সংস্কার ভেদ করতে চায়। প্রশ্ন করতে চায় কোনটা সুবিচার কোনটা অবিচার?’

হঠাৎই সে থেমে গেল। এ কী বলছে সে? কেন বলছে? কাকেই বা বলছে?

চণক নীরবে তার দিকে তাকিয়ে। চোখে উৎকণ্ঠা। জিতসোমা মুখ নত করে একটি ক্ষুদ্র উপলখণ্ড দেখতে মনোযোগী হয়ে উঠেছে। চণক ধীরে ধীরে বলল, ‘কী তোমার সে মহাদুঃখ তিষ্য, যার জন্য নিজেকে দুর্ভাগা বলো— জানি না। কী সে গূঢ় যন্ত্রণা যা এইভাবে হঠাৎ বিস্ফোরিত হল তা-ও জানি না। কিন্তু তিষ্য, তুমি কখনও বন্ধুহীন নও। কোনও দিন নিজেকে প্রকাশ করতে ইচ্ছা হলে স্বচ্ছন্দে করবে। আর বিদ্রোহের কথা যদি বলো— চণক তোমায় বিদ্রোহীর ভূমিকায় দেখতে আনন্দিতই হবে। চলো, এবার নামি। সোমা, এসো…।’

ক্ষমা প্রার্থনার একটি বাক্যও তিষ্য উচ্চারণ করতে পারল না। চণকভদ্র ওইভাবে তার ক্রোধের কারণ নির্ণয় করবার পর সে মুখ খুলতেও সাহস পাচ্ছে না। কে জানত তার বুকে এত হাহাকার জমে ছিল? শ্রাবস্তী যাবার প্রস্তাবে এইভাবে পুরনো ক্ষত থেকে রক্তপাত হয়ে তাকে উদ্‌ভ্রান্ত করে দেবে তা কি সে ভেবেছিল? আচ্ছা, কেন শ্রাবস্তীই? তাকে তো প্রথমেই কৌশাম্বী বা উজ্জয়িনী পাঠাতে পারতেন মহারাজ। সে বলেও ছিল। কিন্তু মহারাজের দৃঢ় ধারণা সহজ কাজ থেকে কঠিন কাজের দিকে অগ্রসর হতে হয়। তাই বৈশালী পেরিয়ে তাকে শ্রাবস্তীতেই যেতে হবে। চণক এবং জিতসোমার মতো সহমর্মী ছেড়ে, মহারাজ বিম্বিসারের মতো পক্ষপুটবিস্তারী মহামহিম রাজসঙ্গ ছেড়ে শ্রাবস্তী, যা এখন নিষ্ঠুর প্রত্যাখ্যানের বাসভূমি।

প্রকৃত ব্যাপার নারী! এই নারীই যত অনর্থের মূল! জননী হয়ে দুরূহ কর্তব্যের পথ থেকে টেনে ধরে রাখে পেছনে, জায়া হয়ে পথ ভোলায়, নিত্যনৈমিত্তিকের পথে বাঁধা গরুর মতো ঘোরায়, প্রিয়া রূপে উদ্‌ভ্রান্ত করে, পৌরুষের মধ্যে এনে দেয় নারীসুলভ কম্প্ৰতা, শেষ পর্যন্ত এই নারী কী দেয়? যন্ত্রণা ও আত্মধিক্কার ছাড়া? নারীদের যে অধম মনে করা হয়, পুরুষকে বিপথগামী করবার যন্ত্র মনে করা হয়, ঠিকই! ঠিকই! যে কোনও সম্পর্কের নারী, যে কোনও বয়সের পুরুষকে হাত ধরে নিরয়লোকে নিয়ে যেতে পারে। তার গুরুপত্নী অলভা! হতে পারে তিনি খুবই অল্প বয়স্কা। কিন্তু বিবাহিতা তো! আচার্য সংকৃতির পঞ্চম পত্নী তিনি। আচার্য সংকৃতি যিনি সারা জম্বুদ্বীপে তাঁর জ্ঞান, তাঁর মুক্ত দৃষ্টির জন্য সুবিদিত। তাঁর পত্নী। গুরুপত্নী সে যে বয়সেরই হোন না কেন জননীর মতো তো! অথচ অলভা তাকে প্রলোভিত করাবার জন্য কী করতেন। উড়ুম্বর বৃক্ষের ডালে বসে পা দোলাতেন, তাঁর শুভ্র কোমল চরণপত্র তো বটেই, তার ঊর্ধ্বের অংশও অনাবৃত হত। যখন কোনও আদেশ করতেন তখন গ্রীবা বাঁকিয়ে কটাক্ষে তাকাতেন তার দিকে, নীলাভ চোখের মণিতে একই সঙ্গে তিরস্কার ও প্রশ্রয় ফুটে থাকত। দাঁত দিয়ে অধর কামড়ে থাকার একটা মধুর ভঙ্গি ছিল অলভার। একদিন, একদিনই মাত্র বলেছিলেন, ভুজঙ্গিনীর মতো যেন ফণা তুলে—তিষ্যকুমার আমি তোমার থেকে তিন চার বছরের বেশি বড় হবো না। কক্ষনো আমাকে মাতৃসম্বোধন করবে না। কেন করো? কেন? কেন? আমি কারও মা নই, হইনি এখনও, হবোও না। আমি কারও পত্নীও নই। আমি অলভা, অলভা, অলভা… বলতে বলতে দূর বনচ্ছায়ে হারিয়ে গেলেন ছুটতে ছুটতে।

ধাবমানা, বনচ্ছায়ে হারিয়ে যেতে থাকা অলভার আকৃতিটি তিষ্যর বুকের মধ্যে ফুটে উঠল যেন একটি চলমান প্রতিকৃতি। সর্পিণী! সর্পিণী! এরা সকলেই সর্পিণী! তার পর সহসাই তার বুকের মধ্যে আরও প্রতিকৃতি ফুটে উঠল। আচার্য সংকৃতির। শ্বেত শ্মশ্রু, শ্বেত কেশ, শান্ত স্বরে ঋষি অগস্ত্য মৈত্রাবরুণির দ্যাবা-পৃথিবী সূক্ত ব্যাখ্যা করছেন :

সংগচ্ছমানে যুবতী সমন্তে

স্বসারা জামী পিত্রোর্ উপস্থে।

অভিজিঘ্ৰন্তী ভুবনস্য নাভিং

দ্যাবা রক্ষতং পৃথিবী নো অভ্‌বাত্..

“তরুণবয়সী দুটি মেশামেশি সীমানা পরস্পর

মিলেছ আপন দুটি ভাইবোন কোলটিতে মা-বাবার

ভুবনের নাভি আদরেতে ঘ্রাণ করো—

হে দ্যাবা পৃথিবী মহাভয় হতে মোদের রক্ষা করো…”

তিষ্যর যে কী হয়ে গেল হঠাৎ, সে জানে না। অলভার ছুটন্ত আকৃতি যেন একটি যন্ত্রণার তীরের মতো তার বুকে বিঁধে গেল। ঘৃণা নয়, যন্ত্রণা। এ যন্ত্রণার অর্থ সে জানে না। সংগচ্ছমানে যুবতী সমন্তে…। সংগচ্ছমানে… তিষ্যর চোখ সেই বিদ্ধ তীরের যাতনায় সজল হয়ে উঠছে। তরুণবয়সী দুটি মেশামেশি… অলভা একটি খড়ের কন্দুক প্রস্তুত করেছেন। একেবারে নিটোল, অতি নিপুণভাবে প্রস্তুত। প্রেঙ্খায় দুলছেন, দুলতে দুলতে মহাবেগে উঠে যাচ্ছেন ঊর্ধ্বে। শিংশপার উচ্চ শাখাগুলি বুঝি ছুঁয়ে ফেললেন, সেই ঊর্ধ্বে থেকে কন্দুকটি ছুঁড়ে দিচ্ছেন, পায়ের আঘাতে, ধরো তিষ্যকুমার ধরো, দেখি তো তুমি কেমন কুশলী!

অহমেব বাত ইব প্র বামি… বায়ুর মতো বয়ে যাচ্ছে বিশ্বভুবনে এক সুগভীর যন্ত্রণার তরঙ্গ। সব সময়ে বোঝা যায় না। হয়ত এইভাবে বয়ে যাচ্ছে আনন্দধারাও, একইভাবে বইছে আত্মোপলব্ধির তরঙ্গধারাও। কে কখন কোন ধারাটিকে ছুঁয়ে ফেলে, তার বিশ্বভুবন মুহূর্তে পাল্টে যায়, পাল্টে যায় জীবনের অর্থ, তিষ্যকুমার এখন আনন্দধারার ঊর্ধ্বে সেই বেদনাপ্রবাহকে ছুঁয়ে ফেলেছে, সেও এখন ধাবমান, চূড়ান্ত বেগে, হারিয়ে যাচ্ছে কোন অন্ধকার অরণ্যছায়ায়, পালাচ্ছে স্বস্তি, সংকল্প এবং কেতুকাম্যতার দিক থেকে ব্যথাজর্জর কোনও উপলব্ধির ব্যাখ্যাতীত গাঢ়তায়। যেতে যেতে বলে যাচ্ছে অনম ফণা তুলে—ক্ষত্রিয় নই। কারো কেউ নই। আমি তিষ্য… তিষ্য… তিষ্য…

৩১

বর্ষার পরে শীতের প্রারম্ভকালই যাত্রার জন্য প্রশস্ত। সে যুদ্ধযাত্রাই হোক আর তীর্থযাত্রাই হোক। কে কোথায় যুদ্ধযাত্রার জন্য প্রস্তুত হল বা হল না, জানা যাচ্ছে না। ছোটখাটো সংঘর্ষ তো লেগেই আগে। প্রদ্যোৎ মহাসেনের গান্ধারপিপাসা সম্ভবত এখনও মেটেনি। তবে তার তীব্রতা আর তেমন নেই। উত্তর বাণিজ্যপথে যাতায়াতরত সার্থগুলির থেকে এই জাতীয় আভাসই যেন পাওয়া যায়। সমস্ত কিছুর মধ্যে মহারাজ পুষ্করসারীর বিপন্ন মুখটির থেকে থেকেই মনে পড়ে। ভেতরে একটা অপারগতার কাঁটা ফোটে। তাই চণক সার্থদের কাছ থেকে পাওয়া সংবাদে হৃষ্ট হয়। মহারাজ বিম্বিসার ঠিকই বলেছিলেন। চণ্ড মহাসেনের চণ্ডতা আপনা থেকেই চলে যাবে। যাই হোক তেমন কোনও রণ বা মহারণযাত্রার কথা শোনা না গেলেও আরেক ধরনের যাত্রা চলেছে। তাকে তীর্থযাত্রাও ঠিক বলা যায় না। বিভিন্ন পন্থের পরিব্রাজকেরা বিশেষত সাক্ক পুত্তীয় সমনরা ছড়িয়ে পড়ছেন দূর থেকে দূরান্তরে। এঁদের কোনও নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই। কাজেই তীর্থযাত্রা নয়। অথচ যাত্রা। নিঃসন্দেহে যাওয়া। দেশ থেকে দেশান্তরে পরিভ্রমণ করাই এঁদের কাজ। বিশেষত এই সময়ে। গৃহ নেই, ক্লান্তি নেই, চিন্তা নেই, অভিযোগ নেই। শুধু চলা। ক্ষণেক বিশ্রাম। আবার চলা। পথে পথে পথিকদের, গৃহীদের পরামর্শ দেন, সেবা দেন, উপদেশ দেন, সামান্য ভিক্ষাগ্নে ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করেন। আবার চলেন। নভোমণ্ডলে মেঘে মেঘে কাশ ফুটে আছে। শুভ্রপক্ষ হংস হংসী উড়ে যাচ্ছে উত্তর থেকে দক্ষিণ-পূর্বে। দেখতে দেখতে পা দুটি চঞ্চল হয়ে ওঠে দৈবরাত চণকের। যাবার সময় হল। এখনও যদি না বেরাতে পারে তা হলে পুরো এক বছর বিলম্ব হয়ে যাবে। সোমার সঙ্গে পরিষ্কার কোনও আলোচনা না হলেও যেন একটা অনুক্ত চুক্তি হয়ে যাচ্ছে। সে রাজগৃহে দাস-দাসী নিয়ে বসবাস করবে। চণক কয়েক মাস পরিব্রজনের পর আবার আসবে। যাওয়া-আসা চলবে। কিন্তু চণকের ভেতরটা স্বস্তিতে নেই। কাজটা কি সে ঠিক করছে? সোমা মূক হয়ে রয়েছে। চণক যা করবে সে তা মেনে নেবে। কিন্তু চণকের দায়িত্ববোধ? অবশ্যই সোমার সুরক্ষার ভার নেবেন স্বয়ং মহারাজ। কিন্তু…। মহারাজের কূটকক্ষে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, চণক। সোমা প্রশান্ত মুখে তার কটিবন্ধ এগিয়ে দিল। প্রশান্ত, কিন্তু প্রসন্ন কী? প্রসন্ন হওয়ার কথা নয়। প্রসন্ন যে নয় তা প্রাণপণে লুকোবার জন্যই এই প্রশান্তি। ভ্রূ কাঁপে না, চোখ দুটি তাদের আয়ত নীলিমায় মগ্ন। ওষ্ঠাধর যেন পটে আঁকা। শুধু নাসারন্ধ্র একটু একটু স্ফুরিত হচ্ছে।

চণক হেসে বলল—‘সোমা, আমার কি হাতের সংখ্যা অল্প? কটিবন্ধটি কি নিজে নিতে পারি না? তুমি কেন এতো কষ্ট করো?

—এই সামান্য কটিবন্ধ তুলতে আমার কষ্ট হবে? আর্য, আপনার যদি ভালো না লাগে আমি এখুনি চলে যাচ্ছি।

চলে যেতে উদ্যত সোমাকে ক্ষিপ্র হাতে থামায় চণক।

—‘সোমা!’

—বলুন!

—আমার কথার কি এই অর্থই হয়?

—আর কোনও অর্থের কথা তো আমার মনে আসছে না।

বাইরে থেকে এই সময়ে তাম্রকের হ্রেষা ধ্বনি ভেসে আসে। তিষ্যকুমার এসে গেছে। উভয়ে রাজসকাশে যাবে।

সোমা বলে—যান আর্য, আপনার সখা এসে গেছেন।

কদিন আগে গৃধ্রকূটে সহসা নিজের আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাবার পর থেকে তিষ্য চণকের গৃহের ভেতরে আর আসছে না। আর একদিনও সে সোমার মুখোমুখি হয়নি। চণক বুঝতে পারে, এ তার লজ্জা, সংকোচ। সে তিষ্যকে সময় দিতে চায়। কিন্তু সোমা বোঝে না। চণকের কাছে যদি তার সংকোচ না থাকে, তা হলে সোমার কাছেই বা তার এতো সংকোচ কেন? ভেতরে ভেতরে সে গূঢ় অভিমানে স্তিমিত থাকে। চণকের সঙ্গে তর্ক করে। চণক বলে সোমা বোঝো না কেন, নারীর কাছে পুরুষের একটা সংকোচ স্বাভাবিক কারণেই আসে! সোমা বোঝে না।

সোমা তার জীবনে, তার প্রতিবেশে নারীর কাছে পুরুষের সঙ্কোচ দেখেনি যে। সে বরং দেখেছে বণিক, রাজপুরুষ, সাধারণ গৃহী, সর্বজাতীয় পুরুষ তার কাছে অকপট। মুক্ত। শারীরিক, জৈবিক, মানসিক সব অর্থে। দর্ভসেনের মতো বর্ষীয়ান পুরুষেরা নিজেদের শিথিল, বয়ঃকুঞ্চিত শরীর প্রকাশ করতে লজ্জা পেতেন না। রাজসভার যাবতীয় গুপ্ত কথা তারই সঙ্গে অসঙ্কোচে আলোচনা করতেন। গৃহীরা সংসারের যাবতীয় অসন্তোষ খোলাখুলি বলে যেত, বণিকরা বলত তাদের লাভালাভের কথা। কবিরা, পণ্ডিতরা তার সঙ্গে, তার জননীর সঙ্গে কাব্য এমন কি শাস্ত্রালোচনা করে যে সুখ পেতেন আর কারো সঙ্গে ততটা পেতেন না, এ কথা তাঁরা নিজেরাই বলেছেন। তা হলে কেন গূঢ় আলোচনার জন্য তিষ্যকুমার ও চণককে মহারাজের কূটকক্ষে যেতে হবে? কেন আর্য চণক সব কথা তাকে বললেও কিছু যেন আবার না বলা রেখে দ্যান? তিষ্যকুমার কেন তার মনের গোপন ব্যথাগুলি তার কাছে ব্যক্ত করে না! নারী কি পুরুষের বন্ধু হতে পারে না? আর্য চণকের কাছে সে তার সংকোচ জয় করল, অথচ জিতসোমা তার সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে থাকলেও তিষ্যকুমার কেন সে হাত ধরে না? কেন এড়িয়ে যায়?

এবং তিনজনের এই নতুন মন্ত্রণার ঘটনাটি ঘটবার পর থেকে সোমা থেকে যাচ্ছে বৃত্তের বাইরে। অন্তর্বৃত্তে শুধু ওরা তিনজন। মহারাজ এর আগে প্রায়ই আসতেন। চারজনে কত কথা হত! মনে হত মহারাজের মনে সোমার প্রতি আস্থা জন্মাচ্ছে। কিন্তু কূটকক্ষে যখন ডাকলেন শুধু দুটি পুরুষকেই ডাকলেন। যদিও সোমার অভিজ্ঞতা এবং সেই সুযোগে রাজনীতি সম্পর্কিত জ্ঞান এক অর্থে চণকের থেকেও অধিক। আর্য চণক তত্ত্ব জানেন, তত্ত্ব উদ্‌ভাবন করেন। কিন্তু সোমা তার জীবনে শিশুকাল থেকে অনেক তত্ত্বের প্রয়োগ দেখেছে, শুনেছে, কোথায় কোথায় কীভাবে তত্ত্ব নিষ্ক্রিয়, নিস্ফল হয়ে যায় তাও দেখেছে। এ গৃহে সেই চিত্তপ্রসন্নকর আলোচনাচক্রগুলি আর বসছে না। মহারাজ আসেন মাঝে মাঝে। লঘু তারল্যে যেন ভেতরকার কোনও উদ্বেগ গলিয়ে নিতে চান। কোনও গুরুত্বপূর্ণ কথা হয় না। তিষ্যকুমার তো কদিন ধরে আসছেই না। অথচ এই যুবার অনভিজ্ঞ গম্ভীরতা, আবার অতি তারুণ্যের মোহান্ধতা, তার মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি এ সব অত্যন্ত ভালো লাগে জিতসোমার। সে যেন মুক্ত বাতাসের মতো চণক আর সোমার মাঝখান দিয়ে বয়ে যায়।

সোমার দিকে একবার দ্বিধাগ্রস্ত চোখে তাকায় চণক। চোখে চোখ মেলে না কিন্তু। কেন না সোমা নতচক্ষু।

—যাই সোমা, নম্র গলায় বলে চণক বেরিয়ে পড়ে।

রাজপুরীর অন্তঃপ্রাচীর পার হবার পর ঘোড়া থেকে নেমে দুজনে পদব্রজে পুরীর দিকে যেতে থাকে, তাম্রক ও চিত্তকের পাশে পাশে। অন্তঃপ্রাচীরের তোরণ থেকে কূটকক্ষ পর্যন্ত পথটি দুজনে সম্পূর্ণ নীরবে চলে। একদিকে রাজসভা, রাজার ব্যায়ামাগার, রাজকোষ, মন্ত্রণাগৃহ ইত্যাদি মিলিয়ে একটি প্রাসাদ! রাজার বাসভূমি তার বিপরীত দিকে।

পথে মাঝে মাঝেই প্রহরীরা দাঁড়িয়ে আছে। প্রধান তোরণে একবার মাত্র পরিচয়মুদ্রা দেখাতে হয়, তারপর প্রাসাদের তোরণে পৌঁছতেই রাজসচিব বর্ষকার কিম্বা সুনীত তাঁদের রাজসকাশে নিয়ে যান। মন্ত্রণাগৃহটি কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। কূটকক্ষ একেবারে ভেতরে। মহারাজ সেখানে তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন না। বস্তুত তিনি মন্ত্রণাগৃহের একেক অংশে একেক দিন বসেন। আজ বর্ষকারকে দেখতে পাওয়া গেল।

এঁকে দেখলৈ তিষ্য বিরক্ত হয়। তার ধারণা ইনি কুর, কুটিল। চণক জানে রাজ-সন্নিধানে এ প্রকার বহু কুটিল, ক্রূর মানুষ থাকে। থাকাটাই স্বাভাবিক।

বর্ষকার বললেন—আসুন, আসুন মহামান্য চণক। আসুন কুমার তিষ্য। মহারাজ অনেকক্ষণ থেকেই আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।

চণক বলল—হ্যাঁ, মহারাজ কখনও উত্তরদেশে যাননি তো, তাঁর জিজ্ঞাসা অনেক। কৌতূহলে আপাদমস্তক পূর্ণ থাকেন।

বর্ষকার কটাক্ষে একবার তার দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললেন—মহারাজ কি সাকেতেও যাননি কখনও?

তিষ্য যে সাকেতক তা রাজসচিব বর্ষকারের জানার কথা নয়। সে যে মধ্যদেশীয় এ টুকু তিনি কেন অনেকেই অনুমান করে নিতে পারে। কিন্তু সাকেতক? মহারাজ কি বলেছেন? বলবার কথা নয়। রাজ-অমাত্যরা সবাই জানে চণক মহারাজের আচার্যপুত্র। সে এখনও কোনও অমাত্য-পদ পায়নি, বা নেয়নি এ তারা স্বচক্ষেই দেখছে। সে যে গৃহ-কানন দাস-দাসী, মাসিক বৃত্তি ইত্যাদি রাজ-অনুগ্রহও পাচ্ছে এ-ও তারা জানছে। পরিবর্তে চণক মহারাজকে কী দিচ্ছে। কী দিতে পারে এ নিয়ে প্রথম দিকে কিছুটা চঞ্চল কৌতূহল প্রকাশ পেয়েছিল। এখন তা শান্ত হয়ে এসেছে। তিষ্য চণকের সখা বলেই রাজসখা, তার অন্য কোনও গুরুত্ব বা ভূমিকা নেই—এমনটাই মহারাজ জানাতে চান। অথচ আজ বর্ষকার বললেন—সাকেতক তিষ্য! ভালো, এঁরা স্বভাবে চতুর, রহস্য ভালোবাসেন না। রহস্য ভেদ করতে থাকুন। চণক এঁদের সাহায্য করবে না। সে মৃদু হেসে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তিষ্য হঠাৎ থেমে গেল। তার মুখ-চোখের ভাব কঠিন। অথচ ওষ্ঠাধরে হাসি। সে বলল—‘শুনুন মহামান্য বর্ষকার, সাকেতকরা আবার কোশলের প্রজাও তো! তা কোশলরাজ্য তো মহারাজের শ্বশুর-গৃহ। কতদিন যান না। নিমন্ত্রণ করতে এসেছি। সম্মত করাতে পারছি না। দেখুন না একটু বলে কয়ে…’

সে এক পলক বর্ষকারের মুখের দিকে তাকাল। মেঘাচ্ছন্ন সে মুখ। ক্ষণপূর্বের হাসি প্রায় অন্তর্হিত হয়েছে। চণক খানিকটা এগিয়ে গেছেন। তিষ্য দ্রুতপদে গিয়ে তাকে ধরল। চণক তিষ্যর দিকে তাকাল না, অতি মৃদু স্বরে বলল—‘তিষ্য, কাউকে উত্তেজিত করে দিয়ে তার ভেতরের সংবাদ বার করে নেওয়াই কূটনীতিকের একটা কাজ। উত্তেজক উক্তির উত্তর দেবে নির্বোধের হাসি দিয়ে। আগুন নিয়ে খেলা না করাই ভালো।’

মন্ত্রণাগৃহের দ্বারে প্রহরী বিনত নমস্কার করে সরে দাঁড়াল। ভেতরে ঢুকে তিষ্য বলল—কেন জানি না, চণকভদ্র, আত্মসংবরণ করা আমার পক্ষে ক্রমশই কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যদি আপনার মতো এমন নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারতাম নিজেকে!’ —তার কণ্ঠে হতাশার সুর।

চণক বলল—আত্মসংবরণ করতে পারছো না—এটা সত্য বলেছ তিষ্য কুমার। কিন্তু কেন জানো না, এটা সত্য বলল না। জানো, নিশ্চয় জানো। তিষ্য তুমিই তো বলেছিলে ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের ঊর্ধ্বে কর্মকে, আদর্শকে স্থান দাও তুমি, বলোনি?

মৃদু কোমল কিন্তু দৃঢ় স্বরে কথাগুলি বলল চণক। কিন্তু উত্তরের জন্য অপেক্ষা করলনা। আর একটি দ্বার এসে গেছে, এটি পার হলেই মহারাজের সঙ্গে দেখা হবে।

এসো, এসো বয়স্য। এসো তিষ্যকুমার। মহারাজের সহাস্য আহ্বান ভেসে এলো। তিনি তাঁর উচ্ছ্বাস ও অভ্যর্থনা ইচ্ছে করেই একটু সশব্দ করেন। যাতে দ্বারে দণ্ডায়মান প্রহরীদের কানে যায়। তাদের কান থেকে হয়ত কৌতূহলী অমাত্যদেরও কানে পৌঁছতে পারে এমন কোনও অনুমানে। দ্বার বন্ধ হয়ে গেলে কক্ষে যখন তিনজনই মাত্র, তখন সহসা মহারাজের মুখ থেকে হাসি অন্তর্হিত হয়। আরম্ভ হয় আলোচনা। প্রধানত মহারাজ ও তিষ্যর মধ্যে। চণক শুধু শ্রোতা। মাঝে মাঝে রাজা বা তিষ্য তার মতামত জানতে চাইলে, বা তার কিছু মনে হলে সে মুখ খোলে। নয়ত সে মস্তিষ্কের একটি অংশ দিয়ে শোনে, আর একটি অংশ দিয়ে রাজশাস্ত্রের কোনও অধ্যায় মনে মনে লেখে, এবং আরও একটি অংশ দিয়ে ভাবে, সোমার সমস্যার কথা। কী সমাধান? জিতসোমার জীবনের জটিল গ্রন্থি সে কী ভাবে মোচন করবে?

প্রকৃতপক্ষে এই আলোচনা মহারাজ এবং তিষ্যরই। এখানে চণকের বিশেষ ভূমিকা থাকার কথা নয়, নেইও। তাকে আসতে হয় তিষ্যকে আড়াল করতে। তিষ্যকুমার যে মহারাজের কোনও গুরুত্বপূর্ণ, গোপন কাজের ভার নিয়ে কোথাও যাচ্ছে, এটা মহারাজ কাউকে জানাতে চান না। সে যাবে না রাজভাণ্ডার থেকে কোনও ধন বা অশ্বাদি কোনও যানবাহন, দাস-রক্ষী ইত্যাদি নিয়ে। মহারাজ তাঁর নিজস্ব সঞ্চয়ের যে ভিন্ন কোষ আছে তার থেকেই তিষ্যর ব্যয়-ভার বহন করবেন। মহারাজের প্রতিনিধিত্ব প্রমাণ করবার জন্য তার কাছে কী কী থাকবে সেই নিয়েই এখন আলোচনা হচ্ছে প্রধানত।

চণক সহসা বলল—‘আচ্ছা মহারাজ, এতো গোপনতার পক্ষপাতী কেন আপনি?’ জিজ্ঞাসা করছে বটে, কিন্তু চণক এখন একটু অন্যমনস্ক।

বিম্বিসার গম্ভীরভাবে বললেন—‘চণক, যুদ্ধের সপক্ষেই এখানে জনমত অধিক। আমার অমাত্যরা, যুবরাজ এমন কি অন্তঃপুরিকারাও বিশাল মগধরাজ্যের স্বপ্ন দেখে।’

চণক দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল—‘আমিও দেখেছিলাম।’

তিনজনেই বহুক্ষণ নীরব রইলেন। কারণ চণকের এই উক্তি তিনজনের চিত্তে তিনপ্রকার চিন্তা ও দিবাস্বপ্ন জাগিয়ে দিয়েছে। চণক দেখছে এক মহাসমুদ্রের মতো চতুরঙ্গ সৈন্যদল, তার ওপরে জেগে আছে মগধের মুদ্রা অঙ্কিত পতাকাগুলি। এই সৈন্যদলের মধ্যে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে শ্বেতকায়, তাম্রকায়, কৃষ্ণকায় বহু প্রকার সৈনিক এবং সেনাধ্যক্ষ। বাইরের বর্ণ ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাদের সবার চিত্ত এক। প্রত্যেকে ভাবছে আমি জম্বুদ্বীপবাসী। মহারাজ বিম্বিসার, সর্বগুণান্বিত, মহাবীর, লোকপাল বিম্বিসার আমাদের সর্বসম্মত রাজা এবং নেতা। এই মহাসমুদ্রের ও দিকে আছে আরও এক সমুদ্র। উপরিশ্যেন পর্বতের ওপার থেকে আসা বিদেশীরা। তাদের নেতা মহাবীর কুরুস। দুই সমুদ্র উত্তাল হয়ে উঠল। কিন্তু ক্রমশ কুরুস সমুদ্র পেছিয়ে যাচ্ছে পেছিয়ে যাচ্ছে। তার তরঙ্গগুলি ক্রমশই সংখ্যায় অল্প হয়ে যাচ্ছে। ভেঙে যাচ্ছে। জম্বু জলধি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অবধি বিস্তৃত হয়ে গেছে। সেই ভীষণ, ভয়ঙ্কর, সগর্জন আকৃতি আর নেই, এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভরঙ্গভঙ্গে লীলা চপল সে জলধি। শান্তিঃ, শান্তিঃ শান্তিঃ। …

তিষ্য দেখছিল দুটি রুক্ষ শিলাসন। কৃষ্ণশিলা পাথরের অস্ত্র দিয়ে কেটে কেটে প্রস্তুত হয়েছে এই রাজাসন দুটি। ঘন অরণ্যের মধ্যে গুহাকৃতি একটি স্থান পরিষ্কৃত হয়েছে। পেশল বক্ষ, বিপুলকায় কালো মানুষেরা অরণ্যের বিভিন্ন অঞ্চল বৃক্ষ কেটে পরিষ্কার করে ফেলছে। সমান করে ফেলছে ভূমি। ‘মহারাজ ওইখানে কী হবে?’

—‘বস্ত্রবয়নশালা প্রজাগণ, তোমরা আর কতকাল নগ্ন, অর্ধনগ্ন থাকবে?’

—‘ওখানে কী হবে মহারাজ?’

—‘রথ নির্মাণের জন্য কর্মান্ত। দূর দূর অঞ্চলে যেতে হবে, রথ, রথচক্র এবং রথ্যা নির্মাণ না করতে পারলে এই মহা পৃথিবী যে তোমাদের আয়ত্তের বাইরেই থেকে যাবে!’

‘আর ওখানে? ওখানে কী নির্মাণ করব মহারাজ?

—অস্ত্র ও যন্ত্র নির্মাণ করবে, পাথরের এই ভল্ল এই ছুরিকায় কিছুই হবে না, এই বল্লমের মতো যন্ত্র দিয়েই বা তোমরা কতটুকু ভূমি কর্ষণ করতে পারবে?’

‘ওই বিশাল স্থানটি কী মহারাজ?’

—ওখানে গণ পাকশালা প্রস্তুত হবে। তোমরা অগ্নিপক্ক করে কী ভাবে মাংস মৎস্য খেতে হয় শিখবে। তোমাদের নারীদের ওখানে যেতে হবে, মহারানী এই বিভাগের ভার নিয়েছেন। তিনি তোমাদের রমণীদের শেখাবেন কী ভাবে কর্ষিত ভূমি থেকে উৎপন্ন শস্য সিদ্ধ করতে হয়, কী ভাবে তা চূর্ণ করতে হয়। আর কতকাল তোমরা বন্যফলের মুখাপেক্ষী, মৃগয়ার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে প্রজাগণ? আর কতকালই বা অপক্ক মাংস খাবে পশুর মতো?… মহারানি…’

পাশে বসা নারীমূর্তিটি মুখ ফেরাল। তিষ্যর অন্তরাত্মা চিৎকার করে উঠল। নারীবেশধারী একটি শূন্যতা বসে রয়েছে তার পাশে। কোনও অবয়ব নেই, মুখমণ্ডলের স্থানে ঘোর অন্ধকার। শূন্য, শূন্য, শূন্য সব…।’

বিম্বিসার দেখছিলেন এক অষ্টাদশবর্ষীয় তরুণ যুবক উপবিষ্ট রয়েছে সামনে এক জ্যোতিঃপুঞ্জের মতো আকৃতির ব্রাহ্মণ। বর্ষীয়ান, কিন্তু উন্নতদেহ। উন্নতশির, বাইরেটা যেন প্রজ্জ্বলন্ত উল্কা। ভেতরটা স্নিগ্ধ যেন চন্দনতরু। পাঠ শেষে তরুণ প্রণাম করছে, ঋষিপ্রতিম আচার্য উঠে দাঁড়াচ্ছেন সামনে প্রসারিত করে দিয়েছেন হাত, করতল দিয়ে স্পর্শ করছেন তরুণের শির—তুমি রাজ চক্রবর্তী হবে বিম্বিসার।’

—‘সত্য? সত্য বলছেন আচার্য?’ তরুণের পিতা ব্যগ্রস্বরে জিজ্ঞাসা করছেন। —‘সত্য? না আশীবাদ?’

—দেবরাতের আশীর্বাদে আর সত্যে কোনও পার্থক্য থাকে না ভদ্র ক্ষেত্রৌজা।

বিম্বিসারের সামনে এ দৃশ্যের পাত্র পরিবর্তিত হয়ে গেল। সামনে এক স্নিগ্ধ চন্দনতরু, ভেতরে প্রজ্বলন্ত উল্কাই বুঝি। করুণার সমুদ্র নয়ন দুটি। কিন্তু স্বর জলদ্‌গম্ভীর।

—জন্ম থেকে শত শত বন্ধনে বন্দী মানুষ। শত নিষেধাজ্ঞা পদে পদে। একমাত্র প্রব্রজ্যায় নিষেধ নেই। প্রব্রজ্যার পথ বন্ধ করে দেওয়া অমানবিক নিষ্ঠুরতা।

বিম্বিসার নিজেকে বলতে শুনলেন কিন্তু তা হলে এই জগৎসংসার, এই রাজ্য, এই জনযাত্রা চলবে কী করে দেব? কী ভাবে চালাব? একদিনেই তো সমগ্র পৃথিবী ভবচক্র থেকে মুক্ত হয়ে যাবে না? প্রব্রজিত ভিক্ষুদের পিণ্ডদানের জন্যও তো সমাজ চাই? কে ধারণ করবে সেই সমাজ?—এতো কথা তিনি বলেননি। তথাগতর ভাষাও সামান্য ভিন্ন ছিল। কিন্তু তবু এ সবই তাঁরা উভয়েই বলেছিলেন, একে অপরের ভাষ্য পরিপূর্ণ বুঝতে পেরেছিলেন। নীরব সব। নিস্তব্ধ। অনেকক্ষণ। তারপর সেই ব্ৰহ্মঘোষ :

…তাই হবে। সৈনিকদের থেকে প্রব্রজ্যার অনুমতি প্রত্যাহার করে নেওয়া হল।

তথাগতর কণ্ঠে এখন জল। অতল ওই চোখদুটিতেও কি বাষ্প? বিম্বিসার তথাগতকে দুঃখ দিয়েছেন। রাজার কাজই হল দুঃখ দেওয়া। দুঃখ দেওয়া, দুঃখ পাওয়া, দুঃখ পাওয়া…

দুঃখ-শূন্যতা-বিজয়ের গরিমা ও শান্তি, শূন্যতা শান্তি-দুঃখ, শান্তি-দুঃখ-শূন্যতা তিনটি চক্রের মতো ঘুরে যাচ্ছে তীব্র বেগে। একে অপরকে স্পর্শ করছে আবার দূরে চলে যাচ্ছে।

হঠাৎ বিম্বিসারের মনে পড়ল কিছু। তিনি বললেন—সখা চণক, কোথাও কি কিছু হারিয়েছ?

—কই না তো মহারাজ!

—ভেবে বলো!

—ভেবে পাচ্ছি না তো!

বিম্বিসার তাঁর পাশে রাখা স্থবিকাটি খুলে, ধীরভাবে একটি বস্তু বার করে আনলেন, ডান হাত দিয়ে খানিকটা তুলে ধরে বললেন—চিনতে পারো?

একটি সুবর্ণমণ্ডিত কঙ্কতিকা, মধ্যে মধ্যে রক্তাভ মুক্তা। কালো দাঁতগুলি কঙ্কতিকার। সব মিলিয়ে ঝকঝক করে উঠল কক্ষ। কঙ্কতিকার মধ্যে লিখিত কাত্যায়ন চণক।

চণকের দুরযাত্রী চিত্ত যেন এক লক্ষে বিশ যোজন পেরিয়ে এলো। দুই চোখে ব্যগ্র বিস্ময়।

—এ কঙ্কতিকা কোথায় পেলেন মহারাজ? কোথায়?

মৃদু মৃদু হাসছেন বিম্বিসার—‘তবে যে বলছিলে হারাওনি কিছু! দৈবরাত চণক যে স্বর্ণ-মুক্তার কাঙাল নয়, তা সবাই জানে। এই কঙ্কতিকা কোন প্রিয় উপহার? কোন সুপ্রিয় অভিজ্ঞান? বলবে আমায় সখা চণক?

—বলছি। কোথায় পেয়েছেন, কী ভাবে পেলেন শীঘ্র বলুন মহারাজ।

—একটি চোরের কাছ থেকে। শুধু চোর নয়, একটি চোরও নয়। দুটি চোর। চৌর এবং চৌরী। চৌরীটি তার কেশে পরেছিল এই কঙ্কতিকা। রাজভটদের সন্দেহ হয়, বন্য যক্ষীর মাথায় সুবর্ণ কঙ্কতিকা? ধরে স্থানীয় বোহারিকের কাছে নিয়ে যায়।

চণক উঠে দাঁড়িয়েছে—তারপর? মহারাজ তারপর?

—তারপর আর কী? কঙ্কতিকায় কাত্যায়ন চণকের নাম দেখে বোহারিক একেবারে আমার কাছে সোজা পাঠিয়ে দিলেন দ্রব্যটি।

—‘আর সেই যক্ষ-যক্ষী?’

‘চোরের শাস্তি পেয়েছে। আবার কী? চোরটির হয়ত দক্ষিণ হস্ত ছিন্ন করবার আদেশ হয়েছে। চৌরীটির…

জ্যা-মুক্ত শরের মতো দৈবরাত চণক ছুটে বেরিয়ে গেল।

মহারাজ হতবুদ্ধি হয়ে বললেন—‘কোথায় যাও?’

তিষ্যকুমার হতবুদ্ধি হয়ে বলল—‘কী হল? কী হল?’

তোরণের পর তোরণ পার হচ্ছে, শিথিলভঙ্গি দ্বারীরা ছুটন্ত পুরুষমুর্তি দেখে বিস্মিত সতর্ক হয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে..এ ওকে বলছে—রাজমিত্ত মহামান্য চণক না?

—উনি তো মহারাজের আচারিয় পুত্ত, এই তো কিছুক্ষণ আগে…

নিজের অশ্বও ছেড়ে, কোনদিকে না তাকিয়ে উন্মত্তের মতো ছুটে যাচ্ছিল চণক। চিত্তক তীব্র স্বরে হ্রেষা করে উঠল। চণক দৌড়ে গিয়ে এক লাফে উঠল তার পিঠে। —‘চল চিত্তক, চল—উত্তর তোরণ। আমক শ্মশান’—যেন চিত্তক তার ভাষা বুঝবে। উল্কাবেগে ছুটে চলেছে চণক। রাজপথে পদযাত্রীরা ছুটে সরে যাচ্ছে। রথগুলি কোনওমতো পাশ দিচ্ছে। পথকুকুরগুলি চিৎকার করে দৌড়চ্ছে। একটি মার্জার বোধহয় চিত্তকের পায়ের এক আঘাতে দূর ছিটকে পড়ল। পিষ্ট হয়ে গেল একটি কুক্কুরশাবক।

—আরও জোরে চিত্তক আরো জোরে..চণক সামনে ঝুঁকে পড়েছে।

হতবুদ্ধি মহারাজ বললেন—গুরুতর কিছু হয়েছে, তিষ্যকুমার শীঘ্র চলো। দ্বারী! আমার অশ্ব প্রস্তুত করতে বলো। যতো তাড়াতাড়ি পারো।

দিবসের তৃতীয় যামেই যেন অমানিশার ঘোর তমিস্রা নেমেছে। চণক পথ দেখতে পাচ্ছে না। শুধু দিক। উত্তর। উত্তর প্রান্ত। দু পাশ দিয়ে ছুটে পেছনে সরে যাচ্ছে বৈপুল্ল, বৈভার। গিরিগুলিও বুঝি দৌড়চ্ছে। তাদের এতদিনের স্বভাব, স্থাবরতা ত্যাগ করে কোন মহা উদ্বেগে মহা আশঙ্কায় দৌড়চ্ছে। দৌড়চ্ছে বৃক্ষগুলি। জনবহুল রাজমার্গ? তা-ও দৌড়চ্ছে।

অবশেষে আমক-শ্মশান। ঘন বৃক্ষ দিয়ে ঘেরা রাজগৃহের বধ্যভূমি। এখানে অপরাধীদের হস্ত পদ ছেদন করা হয়। পাশবিক চিৎকার করতে করতে শূলদণ্ডে বিদ্ধ হয় মানুষ। যূপবদ্ধ মস্তকের ওপর নেমে আসে ভয়ানক খড়্গ। রক্ত ছিটকে যায়, মুণ্ড ছিটকে যায়। ছুটে আসে রক্ত পিপাসু তরক্ষু, শৃগাল। ওপর থেকে ঝুপ ঝুপ করে নামে গৃঘ্রদল। গলা অবধি প্রোথিত জীবিত মুণ্ডের দিকে ধেয়ে যায় দুঃস্বপ্নের বিভীষিকার মতো পশুপাখিগুলি। কেউ চোখ খুবলে নেয়, কেউ এ কান, কেউ ও কান। জীবিত মুণ্ড শুধু মরণান্তিক আতঙ্কে, যন্ত্রণায় চিৎকার করতে থাকে। তরঙ্গুর হাসির শব্দে ডুবে যায় তার ত্রাসস্তিমিত স্বর। তারপর পা দিয়ে মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে অর্ধজীবিত দেহটিকে বার করে পশুরা। একটি মনুষ্যশরীর চেতনার শেষবিন্দু পর্যন্ত ছিন্নভিন্ন হতে থাকে। চোর, দস্যু, ভ্রূণঘাতক, হত্যাকারী, ব্যভিচারিণী, বৈদেশিক চর, রাজদ্রোহী—সবারই অম্লাধিক এই জাতীয় দণ্ড। তবে অপরাধী সহজে মেলে না। সবাই জানে অপরাধের এই ভয়াবহ পরিণাম। নগরীতে এই আমক শ্মশান প্রত্যক্ষ। নগরবাসীর অস্তিত্বের মধ্যে বিদ্ধ এক আতঙ্কবিন্দু। কিন্তু, নগরী থেকে যতই দূরে যাওয়া যাবে ততই এ স্মৃতি ক্ষীণ, ক্ষীণতর। জানা আছে কিন্তু সে এক অপ্রত্যক্ষ নৈর্ব্যক্তিক তথ্য। আছে। রাজগৃহের উত্তর তোরণের বাইরে একটি আমক শ্মশান আছে। এই পর্যন্ত। তাই নগরীর বাইরে বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে, বিভিন্ন রাজ্যের মধ্য দিয়ে চলাচলের সুদীর্ঘ পথগুলিতে, নদীগুলিতে চৌর্য আছে, দস্যুবৃত্তি আছে, ব্যভিচারও আছে। ঘাতকের দিনগুলি সবই বিফল যায় না।

চিত্তক তার আরোহীসমেত শরের মতো নিক্ষিপ্ত হল এই বধ্যভূমিতে। তখন একটি কৃষ্ণাঙ্গ তরুণের দ্বিতীয় হস্তটিও ছিটকে পড়ছে রক্তে ভেজা মাটির ওপর। পার্বত্য ঝর্ণার মতো গরম রক্ত উঠছে। রক্তকরবীর মালা পরা প্রকাণ্ড মূর্তিটি পিশাচের মতো হাসছে। —‘শাস্তি দিয়েছি, রাক্ষসকে শাস্তি দিয়েছি। রাক্ষসীকে শাস্তি দিয়েছি। এক জোড়াকে পারিনি। আরেক জোড়াকে পেরেছি। চণক লাফিয়ে নেমে খড়্গসমেত সেই ভীষণ হাত ধরল।

—থামো ঘাতক, থামো।

—থেমেছি তো। যে পর্যন্ত শাস্তি আদেশ ছিল, দিয়েছি। তারপর থেমেছি।

—উদ্দক। উদ্দক! চণক ডাকল

—দুই কাঁধ থেকে স্রোতের মতো রক্তপাত হচ্ছে। কৃষ্ণাঙ্গ তরুণটি লুটিয়ে পড়েছে। তার চোখ খোলা, কিন্তু তাতে কোনও দৃষ্টি নেই।

চণক নিজের উত্তরীয় ছিড়ে প্রাণপণে স্রোতের মুখ বাঁধতে বাঁধতে বলল—ঘাতক বৈদ্য ডাকো, বৈদ্য আনো। শীঘ্র, বিলম্ব করো না। একটি বালিকা ছিল, বালিকা…তাকে কোথায় রেখেছো?

ঘাতক রক্ত চক্ষে চেয়ে বলল—সে-ই তো প্রকৃত অপরাধিনী। তার নাক-কান কেটে ফেলে দিয়েছি।

—বলছো কী? চণক বাতাসের অভ্যন্তর চিরে আর্তনাদ করে উঠল। কোথায় সে? কোথায়? আঙুল দিয়ে দেখালো ঘাতক—ওই তো, ওই দিকে দেখতে পাচ্ছেন না?

দু-তিনটি শবদেহের ওপর থেকে কৃষ্ণবর্ণ একটি হাত এলিয়ে পড়ে আছে।

বিম্বিসার যখন তিষ্যকুমার এবং আরও রক্ষীদের নিয়ে বধ্যভূমিতে পৌঁছলেন তখন কৃষ্ণকায় সেই তরুণীর কর্ণ-নাসিকাহীন শির কোলে নিয়ে চণক উন্মাদের মতো হাহাকার করছে—রগ্‌গা, রগ্‌গা, রগ্‌গা…।

বিম্বিসার পেছন ফিরে রক্ষীদের আদেশ করলেন—জীবক বৈদ্য এবং বৈদ্য সন্নতিকে নিয়ে এসো। অবিলম্বে। বলবে রাজাদেশ। মুহূর্তকালও যেন বিলম্ব না হয়।

আরও কয়েকজন রক্ষীর দিকে ফিরে বললেন—শীতল জল আনো, পরিষ্কার বস্ত্রখণ্ড। শীঘ্র যাও।

চণকের পাশে নতজানু হয়ে বসে পড়েছেন বিম্বিসার। ভুলে গেছেন তিনি রাজা। চতুর্দিকে তাঁর ভূতিভোগী রক্ষী, প্রহরী, ঘাতক দল। তাদের সামনে তিনি এক মাত্র বুদ্ধ তথাগত ছাড়া আর কারো কাছে নত হন না। এমনকি যখন অজিত বা নির্গ্রন্থ নাতপুত্ৰ কিম্বা সঞ্জয়ের কাছেও যান সমবেত শিষ্যমণ্ডলী, শ্রোতামণ্ডলী উঠে দাঁড়ায়। উচ্চাসনে বসে থাকেন সঞ্জয় বা নাতপুত্র, কিম্বা অজিত তাঁরাও তাঁকে আশীবাদের ছলে উঠে দাঁড়ান। তিনি উপবিষ্ট হলে, তবে সবাই আবার বসেন। একমাত্র ব্যতিক্রম বুদ্ধ তথাগত। আর ব্যতিক্রম ঘটল আজ। আত্মবিস্মৃত রাজা নিজের দণ্ডমুকুটধারী ভাবমূর্তির কথা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে মাটিতে জানু ঠেকিয়ে বসে বললেন—চণক, চণক, কী হয়েছে বন্ধু? কী হল?

নিজের হাত দিয়ে তরুণীর রক্তাক্ত নাসাস্থল আবৃত করে চণক বলল— অপরাধী নয়, নয়, এই বন্য তরুণ-তরুণী, রাজা এরা দিনের পর দিন আমায় আতিথ্য দিয়েছে সখ্য দিয়েছে, রক্ষা দিয়েছে, উজ্জীবন দিয়েছে, আর আমি এই সামান্য কঙ্কতিকা উপহারের ছলে আজ তাদের এই দিলাম। এই দিলাম মহারাজ এই দিলাম। ধিক সভ্যতা, ধিক আর্যতা, ধিক রাজশাস্ত্র। ধিক, ধিক, ধিক…

সমগ্র বধ্যভূমি, রাজভূমি, ভারতভূমি সাগরমেখলা আকাশমৌলি ধরাভূমি সেই ধিক্কারে থরথর করে কাঁপতে লাগল।

৩২

বোহারিক বললেন—অনঙ্গ চণ্ডাল ধরে এনেছিল। মাথার চুলে সুবন্ন কঙ্কতিকা দিয়ে সাজ-সজ্জা করে ওই বন্যতরুণী তরুণের হাত ধরে রাজগহ নগর দেখতে এসেছিল।

বিম্বিসার বললেন—আপনি তাকে জিজ্ঞাসা করেননি, সে কোথায় এ কঙ্কতিকা পেল?

—জিজ্ঞাসা করেছিলাম। বললে এক যতি দিয়েছে। এরা সর্বশ্রেণীর সন্ন্যাসীকে যতি, জটি এই সব বলে, জানেন তো?

—ভালো কথা, সে তো আত্মপক্ষে কিছু বলেছিল। মানলেন না কেন?

মহারাজের মুখ দেখে বোহারিকের তালু শুকিয়ে গেল। তিনি বললেন—কঙ্কতিকায় মহামান্য কাত্যায়ন চণকের নাম তক্ষিত রয়েছে দেখলাম। জিজ্ঞাসা করলাম চণককে চেনে কি না। বলল—না, চেনে না। এখন দেখুন মহারাজ, একে বন্য, তারপর সুবন্নের দ্রব্য, এ দিকে বলছে যতি দিয়েছে। কী অসম্ভব কথা! সন্ন্যাসী কখনও কাউকে কিছু দেয় উপদেশ ছাড়া? যদি বা দেয় সুবন্ন দেবে? তারপর মহামান্য চণকের নামাঙ্কিত দ্রব্য। চণককে তারা চেনে না। আমি…

—আপনার একবারও মনে হল না তরুণ-তরুণী দুটির চুরির দ্রব্য অমন সর্বজনের দেখার জন্য প্রকাশ্যে পরে ঘুরে বেড়ানো অস্বাভাবিক। চোর তো চোরাই দ্রব্য গোপনই করে!

—না। উপহার অথচ উপহর্তাকে চেনে না…।

—এ-ও তো আপনার মনে হতে পারত যে কঙ্কতিকাটি হয়তো হারিয়ে গিয়ে থাকবে, সত্যই কোনও সন্ন্যাসী বা সন্ন্যাসীবেশধারী কুড়িয়ে পেয়ে তরুণীটিকে উপহার দিয়েছেন সেটি!

—মহারাজ, অপরাধ মার্জনা করবেন, প্রণয়ীরা তরুণীদের কঙ্কতিকা উপহার দিতে পারে, সন্ন্যাসীরা নয়। বন্যদের কথাবার্তা আচরণ এতোই অসঙ্গতিপূর্ণ যে…

সে কথাই বলছি বোহারিক মহোদয়, এতোই অসঙ্গতি যখন ছিল ঘটনাটিতে এবং কাত্যায়ন চণকের নামাঙ্কিত ছিল যখন দ্রব্যটি, তখন আপনি চণকভদ্রকে ডাকলেই তো পারতেন। তিনি কী উত্তর দেন, জানা আপনার প্রয়োজন ছিল না?

—মহারাজ ক্ষমা করবেন, অনঙ্গ তার দলবল নিয়ে বন্য দুটিকে বেঁধে এনেছিল। ভীষণ স্বরে বলছিল, যক্ষরা শিশুহত্যা করেছে। যক্ষরা চুরি করেছে, তাদের দণ্ড দিন। দণ্ড দাবি করছি। বোহারিক। দণ্ড না দিলে এ বার গোটা রাজগহ আমক-শ্মশান করে দিয়ে চলে যাবো। কোনও শব আর দাহ হবে না।

—ও, তাহলে অনঙ্গ চণ্ডালই বোহারিক ছিল। আপনি ছিলেন না!

—না, অর্থাৎ, সময় দিতে চাইছিল না, ঘিরে রেখেছিল বিনিশ্চয়াগার…

—ও তাহলে আপনি চণ্ডালদের ভয়ে অন্যায় হচ্ছে জেনেশুনেও অমন দণ্ড দিলেন…

—না, মহারাজ, আমার প্রত্যয় হয়েছিল বন্যরা মিথ্যা বলছে…

—আপনি বোহারিক পদের সম্পূর্ণ অযোগ্য। আসন ত্যাগ করুন। আর কোনওদিন মগধের সীমানার মধ্যে বোহারিকের কাজ করবেন না। চলে যান। এই মুহূর্তে।

—কে অনঙ্গ চণ্ডাল? কে?

রক্তকরবীর মালা পরা রক্তবসনধারী বিশালকায় অনঙ্গকে কারা পেছন থেকে ঠেলে সামনে এগিয়ে দিল। —এ, মহারাজ, এই অনঙ্গ চণ্ডাল।

—তুমি দলবল নিয়ে বোহারিকের কাজে বাধা সৃষ্টি করেছিলে?

—দলবল ছিল। বাধা তো কিছু দিইনি! উদ্ধত উত্তর।

—বন্যরা চুরি করেছিল কি না তা তো স্পষ্ট প্রমাণ হয়নি অনঙ্গ? তার আগেই তুমি দণ্ড দাবি করোনি?

—স্পষ্ট প্রমাণ হলেও তো এ রাজ্যে অপরাধীর দণ্ড হয় না মহারাজা। আমাদের বচ্চগুলিকে খেয়ে যক্ষিণী তো দিব্যি রয়েছে। সুগন্ধি যাউ খাচ্ছে নাকি আজকাল।

—তাই তুমি অন্য এক যক্ষিণীর ওপর প্রতিশোধ নিলে?

অনঙ্গ আগুন-ঝরা চোখে চেয়ে চিৎকার করে বলল—হত্যকারীর দণ্ড যে বন্ধ করেছে সেই সমন বুদ্ধকে আগে দণ্ড দাও রাজা, এই বচ্চহারা দলিদ্দদের বঞ্চনা করে সগ্‌গলাভের কথা শুনিয়েছে যে, সেই সমন মোগগল্লানকে আগে দণ্ড দাও রাজা, দণ্ড দাও, দণ্ড দাও।

সে তার দু হাতের শৃঙ্খল বিনিশ্চয়াগারের পাথরের স্তম্ভে ঠুকতে লাগল।

পেছনে অন্য চণ্ডালগুলি। হাত জোড় করে বলল—অনঙ্গ উন্মাদ হয়ে গেছে, মহারাজ, বচ্চ হারিয়ে একেবারে উন্মাদ হয়ে গেছে। মাজ্জনা চাইছি। মাজ্জনা করুন।

—উন্মাদের স্থান লোকালয়ে নয়। প্রহরী এই উন্মাদকে কারারুদ্ধ করো।

বিনিশ্চয়াগার থেকে ক্লান্ত পদে, ক্লান্ত মনে বেরিয়ে এলেন বিম্বিসার। রথে উঠলেন। রথ ছুটল। অবসন্ন রাজা অঙ্গ শিথিল করে, চোখ বুজলেন। বড় ক্লান্তি, মহা ক্লান্তি, এত ক্লান্তি কেন?

—রক্তপাত নয়। এই বন্যরা রক্তপাতে কাবু হয় না। এদের শরীর অতি কঠিন ধাতু দিয়ে নির্মিত।

—তা হলে? তাহলে তরুণটিকে বাঁচানো গেল না কেন আয়ুষ্মান জীবক? তুমি কী মনে করো?

—মান্যবর সন্নতি, আমার ধারণা তরুণটির চিত্তে একটা দারুণ আঘাত লেগেছিল। তার থেকেই হৃৎপিণ্ড বিকল হয়ে গেল। অপ্রত্যাশিত একটা আঘাত।

—চিত্তে আঘাত? শরীরের আঘাতের চেয়েও বড়?

—তাই তো মনে হচ্ছে।

বৈদ্য সন্নতির বয়স হয়েছে। কেশে ভালোই পাক ধরেছে। চিকিৎসা করে করে তাঁর হাত মন-মস্তিষ্ক সবই যেন যন্ত্রের মতো সূক্ষ্ম হয়ে গেছে। এখন এসেছে এই তরুণ যুবা জীবক! তাঁর মুখে বক্র হাসি খেলে গেল। চিত্ত! হুঁঃ! চিত্ত! রক্তপাতটা কিছু না। কিছুই না।

দেখুন মহামান্য সন্নতি মনে কিছু করবেন না, চোরেদের হস্তচ্ছেদ তো হয়েই থাকে। কেউ মারা গিয়েছে বলে শুনেছেন কী? জীবকের মুখ গম্ভীর। চোখে সামান্য কৌতুকের ঝিলিক। সে বৈদ্য সন্নতির বাঁকা হাসি লক্ষ করেছে।

সন্নতি বললেন—কিন্তু আয়ুষ্মান জীবক, সাধারণত চোরেদের দক্ষিণ হস্ত ছেদন করা হয়, তা-ও কনুই থেকে। এ ব্যক্তির দুই হাতই কেটে ফেলা হয়েছে, একে বারে বাহুমূল থেকে। ক্ষত আরও ভয়াবহ। রক্তপাতও পরিমাণে অনেক।

—কিন্তু মহারাজের আচার্যপুত্ৰ চণক তত প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সে রক্তপাত বন্ধ করবার চেষ্টা করেছিলেন! রোগী তো ঔষধপ্রয়োগের সময় দিল না। একটি বন্য যুবার শরীরের শক্তি, সহন ক্ষমতা এ গুলি তো সভ্য মানুষের থেকেও অধিক হবার কথা মহামান্য সন্নতি! এ তো হস্তচ্ছেদ নয়, যেন শিরচ্ছেদ। ওর প্রাণ কি ওই হস্তদ্বয়েই ছিল?

—পরিহাস করছো জীবক? মহামান্য সন্নতির মুখ গম্ভীর।

জীবক বলল—কী বলছেন আপনি মান্যবর? পরিহাস করবো? আয়ুর্বেদের নূতন দিক উন্মোচিত হতে যাচ্ছে আর আপনি বলছেন পরিহাস?

—কী বলতে চাইছো, পরিষ্কার করে বলো। আমি কিছুদিন হল কানে ভালো শুনি না।

জীবক মনে মনে বলল—একটু চিৎকার করে বললেই আপনার কানে কথাগুলি ঠিকই পৌঁছে যাবে। কিন্তু মনে পৌঁছবে কী? মনকে যে দ্বাররুদ্ধ কক্ষের মতো করে রেখে দিয়েছেন!

মুখে বলল—প্রাণ কোথায় থাকে কেউ জানে না, মহাবেজ্‌জ। ত্রিদোষ বিকারের ফলে দেহস্থ প্রধান প্রধান যন্ত্রের একটি যখন বিকল হয়ে যায়, তখন প্রাণ বেরিয়ে যায়। প্রধান প্রধান অঙ্গ ছেদন করলেও যায়। কিন্তু অন্যথায় যাবার কথা নয়। আমার বক্তব্য হচ্ছে—আকস্মিক আঘাত—শুধু শরীরে নয়, মনে, হৃদয়ে, মৃত্যুর কারণ হতে পারে। এই যে বন্য যুবা তার প্রণয়িণীকে নিয়ে নগর দেখতে এসেছিল, তাদের হৃদয় ছিল আনন্দে পরিপূর্ণ। শঙ্কার লেশমাত্র তাতে ছিল না। কঙ্কতিকাটি তারা এমন কারও কাছ থেকে পেয়েছিল যাকে উভয়েই সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে, ভালোবাসে। ওই কঙ্কতিকার জন্য যে তাদের শাস্তি পেতে হতে পারে, তা তারা কল্পনাও করেনি। এই আকস্মিক মানসিক আঘাত এদের মৃত্যুর প্রধান কারণ।

সন্নতি বললেন—এদের মৃত্যুর? উভয়ের কথা বলছো নাকি?

জীবক ভাবিত স্বরে বলল—বললাম, বলে ফেললাম।

সন্নতি উৎকণ্ঠিত হয়ে বললেন— চলো আয়ুষ্মান, বালিকাটিকে আরেকবার দেখে আসি।

জম্বুবনের মধ্যস্থিত গান্ধারভবন নামে কাঠের অনুপম প্রাসাদটিতে শোকময় স্তব্ধতা। প্রধান শয্যাগৃহ এখানে চারটি। জিতসোমা ও চণকের ছাড়াও দুটি স্বতন্ত্র শয্যাগৃহ আছে। জিতসোমার কক্ষটি অন্তঃপুর ঘেঁষে। বাকি তিনটি আসনশালার কাছেই। জিতসোমা সেদিন আপনকক্ষে ব্যস্ত ছিল লিখতে। তক্ষশিলার অনেক আচার্য ও ছাত্ররা মনন-প্রয়োগে অত্যন্ত কুশলী হয়। একই সঙ্গে তিন চার পাঁচ প্রকার ভাবনা চিন্তা করা তাদের কাছে কিছুই না। এইভাবে শতাবধান ব্যক্তি অর্থাৎ একই সঙ্গে একশ দিকে মন প্রয়োগ করতে পারেন এমন পণ্ডিতও সেখানে বিরল নয়। কিন্তু জিতসোমার একটিই মন, তার প্রয়োগও এক কালে দুই প্রকার হয় না। সে অনন্যমনে লিখছিল। সে শুধু অনুলিপিকার নয়। প্রকৃতপক্ষে জিতসোমা রাজশাস্ত্র পড়তে পড়তে এমনই মগ্ন হয়ে গেছে যে, তার নিজের চিন্তা, নিজের ধারণাও এই তথাকথিত অনুলিপির মধ্যে প্রবেশ করছে। সে এ কথা এখনও চণককে বলেনি। বলবে কিনা ভাবছে। চণক হয়ত তার ভাবনাগুলিকে যথাযথ মূল্যই দেবেন। কিন্তু স্বতন্ত্র করে লিখতে বলবেন, যা জিতসোমার মনোমত নয়। এই সময়ে অশ্বক্ষুরের শব্দ। যেন বহুজন একসঙ্গে তার গৃহের দিকে ধাবিত হচ্ছে। মানুষের মুখের শব্দ নেই। খালি রথের ঘর্ঘর, অশ্বের মৃদু হ্রেষা, কিন্তু এত অশ্ব রথ ও মানুষ যে, গৃহটি যেন কাঁপছে। জিতসোমা ছুটে বেরিয়ে এলো। দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েছে সে, দীর্ঘ কেশ লুটোচ্ছে, উত্তরীয়টি যেমন তেমনভাবে গায়ে জড়ানো। সে দেখল রাজরথ আসছে। দুদিক থেকে দুটি ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে নামল তিষ্যকুমার ও জীবকভদ্র। জীবকভদ্রকে সে রাজান্তঃপুরে কয়েকবারই দেখেছে। চিনতে পারল। রথ থেকে সাবধানে নেমে এলেন আর্য চণক। তার প্রসারিত দু হাতের ওপর একটি নিস্পন্দ কৃষ্ণাঙ্গ নারীশরীর। একপ্রকার নগ্নই বলতে গেলে। কটিবস্ত্রটি ছিন্নভিন্ন। প্রথমেই সোমা দেখল দুটি সুবর্তুল কৃষ্ণোজ্জ্বল স্তন, কঠিন শিলানির্মিত মনে হয়। আকাশের দিকে তাদের বৃন্ত উঁচিয়ে রয়েছে। তারপর চোখ পড়ল মুখের ওপর। রক্তের দাগ, নানাভাবে পট্টিকা লাগানো। চণক তরুণীটিকে বয়ে আনছেন অতি সাবধানে, তার চোখ মুখের ভাব কেমন অদ্ভুত! যেন তিনি কাউকে চিনতে পারছেন না। যেন তিনি এ জগতে নেই।

তাঁকে পথ করে দেবার জন্য জিতসোমা চকিতে সরে গেল, চণক প্রবেশ করলেন তার আপন শয্যাগৃহে। পেছন-পেছন আসছেন মহারাজ বিম্বিসার, বৈদ্য সন্নতি। রাজরক্ষীরা বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। চণক নিজের মৃগচর্ম আচ্ছাদিত শয্যায় শুইয়ে দিলেন তরুণীটিকে। একটু সরে দাঁড়ালেন, জীবকভদ্রর দিকে চাইলেন, জীবকভদ্র ও বৈদ্য সন্নতি দুদিক থেকে এগিয়ে এসে মেয়েটিকে পরীক্ষা করতে লাগলেন। চণক মাথার কাছে স্তব্ধ দাঁড়িয়ে। একেবারে স্তব্ধ।

জিতসোমা কিছুই বুঝতে পারছিল না। এ কে? একে তাদের গৃহেই বা আনা হল কেন? চণকের এরূপ অবস্থাই বা কেন? তরুণীটি কি তাঁর প্রণয়িনী! কে একে এভাবে আঘাত করলে? এমন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে ব্যাপারটিকে যে স্বয়ং মহারাজ বিম্বিসার এসেছেন!

এই সময়ে জীবক বলে উঠলেন— জল, গরম জল।

সোমা তাড়াতাড়ি ঘরের দ্বারের কাছে দাড়ানো এক দাসীকে গিয়ে নির্দেশ দিল। সন্নতি এতক্ষণ তরুণীটির নাড়ি ধরেছিলেন। এবার তার ডান হাতটি ধীরে ধীরে নামিয়ে রাখলেন। জীবকের দিকে চেয়ে বললেন— নাড়ি ক্ষীণা, তবে ভয়ের কিছু নেই।

জীবক বললেন— পরিষ্কার বস্ত্রখণ্ড চাই। দুটি কম্বল। রোগিণীর দেহ বড়ই শীতল।

সোমা আবার দ্বারের কাছে গেল।

জীবক বললেন— ভদ্রে আপনি কি রোগিণীকে গরম জল দিয়ে পরিষ্কৃত করে দিতে পারবেন। আমি আর আর্য সন্নতি থাকবো। নির্দেশ দেবো।

সোমা বলল—না।

চণক মুখ তুলে তাকালেন। তিষ্যকুমার কিছু বলতে গিয়ে চুপ করে গেল। মহারাজ বিম্বিসার বললেন কল্যাণি, তোমার দাসীদের নির্দেশ দাও।

জিতসোমা এবার দ্বারের কাছে গিয়ে দুটি দাসীকে ডেকে দিল। তারপর ধীরে ধীরে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

সে দেখেছে তরুণীটির নাসিকা ও কর্ণ ছিন্ন করা হয়েছে। সেখানে পট্টিকা লাগানো, কিন্তু সে দেখেছে। ব্যভিচারিণীর শাস্তি। এই কৃষ্ণাঙ্গিনী কে? দেখে মনে হয় অতি নিম্নবর্ণের। গান্ধার মদ্র এসব দেশে এই প্রকার কৃষ্ণাঙ্গ বড় একটা দেখা যায় না। বসনটি তক্ষশিলার মুনিদের মতো। বৃক্ষবল্কল। কার স্ত্রী হতে পারে এই রমণী! কার সঙ্গেই বা ব্যভিচার? আর্য চণক এরূপ বিষণ্ণ কেন? তরুণীটি কি তাঁর পত্নী? এই রমণীর অঙ্গ স্পর্শ করতে সোমার কেমন ঘৃণা হচ্ছে। আরও কী হচ্ছে সে প্রকাশ করতে পারছে না। সে নিজের কক্ষে গিয়ে দ্বার রুদ্ধ করে দিল। শয্যায় বসে পড়ল। কিছুক্ষণ পর জিতসোমা দেখল তার দুই চোখ জ্বালা করে অশ্রু ঝরছে। অশ্রু ঝরছে।

রোগিণীকে পরিষ্কৃত করে দাসীরা একটি নূতন বস্ত্র পরিয়ে দিয়েছে। উত্তরীয় দিয়ে ঢেকে দিয়েছে ঊর্ধ্বাঙ্গ। দুটি কম্বল দিয়ে তার কণ্ঠ পর্যন্ত ঢাকা। শুধু তার সুপ্রচুর কেশ এখনও পর্যন্ত কিছু করা যায়নি। ঝাঁকুনি লাগলে আবার রক্তক্ষরণ হতে পারে। ভৈষজ দিয়ে ভালভাবে বাঁধা হয়েছে ক্ষতস্থান। সারা মুখটিই পট্টিকা দিয়ে আবৃতপ্রায়।

সমস্ত কাজ সম্পূর্ণ হলে জীবক বললেন— মহামান্য সন্নতি। কত দিনে ক্ষতস্থান শুকোবে বলে আপনার মনে হয়!

সন্নতি বললেন— সম্পূর্ণ শুকোতে পক্ষকাল তো অন্তত সময় নেবেই!

আমারও তাই অনুমান। তারপর একে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখব। তারপর মহারাজ এবং চণকভদ্রর যদি অনুমতি হয়, আমি এর কৃত্রিম কর্ণ ও নাসিকা প্রস্তুত করে দেবো।

জীবক উঠে দাঁড়ালেন।

সন্নতি বললেন, কৃত্রিম কর্ণ-নাসিকা? জীবক তুমি কি পাগল হলে? শুনেছি বটে তুমি সুবন্ন সেট্‌ঠির করোটি ভেদ করে কৃমিকীট বার করে এনেছো।

জীবক বললেন— জটিল সেট্‌ঠির এক পত্নীর উদরেও শল্যচিকিৎসা করেছি মহামান্য সন্নতি। ওঁর অন্ত্রগুলি পাকিয়ে গিয়েছিল। সেগুলি বাইরে এনে গ্রন্থিমোচন করে আবার কুক্ষিতে সংস্থাপন করেছি। মহারাজের ভগন্দর তো অস্ত্র করে বাদ দিয়েছিই। এবার…

—একি জাদু না কি? জাদুবিদ্যা? বিরক্ত এবং আশ্চর্য হয়ে সন্নতি বললেন।

জীবক হাতের একটা ভঙ্গি করে বললেন— আপনি নিজে একজন ভিষক হয়ে, যদি এ প্রকারের কথা বলেন, তবে আর কী করতে পারি? চিকিৎসাবিদ্যায় জাদুর স্থান নেই মহারাজ। আপনি যদি অনুমতি দেন এই তরুণীটিকে তার পূর্বের রূপ ফিরিয়ে দেবার চেষ্টা করতে পারি।

বিস্মিত বিম্বিসার বললেন— কী ভাবে জীবক? আমায় বলবে? অসুস্থ প্রত্যঙ্গ বাদ দেওয়া এক বস্তু। কিন্তু নূতন প্রত্যঙ্গ সংযোজন করা…

জীবক বললেন— মহারাজ, আপনাদের যতটা সহজভাবে বোঝানো যায়, সেভাবে বলছি। আমার পরিকল্পনা হল দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে প্রশস্ত অশ্বথ-পত্র দিয়ে কাটা নাকের মতো একটি কৃত্রিম নাক প্রস্তুত করব, তারপর তার সমান করে গণ্ড কিংবা গ্রীবা থেকে চর্ম কেটে নেবো। তাই দিয়ে নাক গড়ে মুখে নাকের কাটা অংশের উপরে বসিয়ে পশুরোম দিয়ে সেলাই করে দিলে ধীরে ধীরে জুড়ে যাবে। নূতন নাকের ভিতরে দুটি নল প্রবেশ করিয়ে দিলে নিশ্বাস-প্রশ্বাসেরও সুবিধা হবে। নাকটি দৃঢ়ও হবে। কান দুটি হয়ত দেখতে অত ভালো হবে না। না-ই হল। কিন্তু কৃত্রিম বলে কিছুতেই বোঝা যাবে না। অনুমতিটা দিয়ে ফেলুন মহারাজ।

বিম্বিসার বললেন— বৈদ্যর আবার অনুমতির প্রয়োজন কী? প্রাণ সংশয়ের প্রশ্ন আছে না কি? — তিনি চণকের দিকে তাকালেন।

জীবক বললেন—কিছুমাত্র না। তারপর তিনি চণকের দিকে তাকিয়ে বললেন— রোগিণীর শয্যাপার্শ্বে দিবারাত্র কারুর না কারুর থাকা প্রয়োজন।

চণক মৃদুস্বরে বলল— আমি থাকবো।

সন্নতি বললেন— একটি দাসীকে নিযুক্ত করবেন। রোগী রমণী যখন… তখন নানারূপ প্রয়োজন…

চণক বলল— সেবকের কোনও লিঙ্গ নেই।

পক্ষকাল কেটে গেছে। ক্ষতস্থানও শুকিয়ে এসেছে। যদিও দুই বৈদ্যর অনুমান মিথ্যা প্রমাণ করে এখনও সম্পূর্ণ শুকোয়নি। দুদিন অন্তর অন্তর পট্টিকা পাল্টানো এবং নূতন করে ভৈষজ লেপন করা জীবক নিজেই নিষ্ঠাভাবে করে চলেছেন। কিন্তু তরুণীটি যেন এখনও আচ্ছন্ন, ভালভাবে জ্ঞান ফিরে আসছে না। জ্বর নেই। অথচ প্রলাপের প্রবণতা আছে। নিজেদের ভাষায় সে কী সব যেন বলে। চোখ মেলে। কিন্তু বোঝা যায় তার চৈতন্য নেই।

সন্নতি এর কোনও কারণ নির্ণয় করতে পারছেন না।

জীবকের নিজস্ব একটি মত আছে এ বিষয়ে, কিন্তু সে তা প্রকাশ করছে না। সে এখন অধীর হয়ে আছে নবনাসিকা ও কর্ণ প্রস্তুতের পরিকল্পনা প্রয়োগের জন্য। এখন রোগিণী অচৈতন্য-প্রায় হয়ে আছে, গ্রীবা থেকে কলা কেটে নেওয়ার কাজটা এখনই নির্বিঘ্নে হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু সে বুঝতে পারছে রোগিণী এখনও বিপন্মুক্ত নয়। বাইরের ক্ষত শুষ্কপ্রায়, কিন্তু সেই আকস্মিকতার আঘাত, তাকে এখনও বিকল করে রেখে দিয়েছে। তার বিদ্যা প্রয়োগ করলে যদি রোগিণীর মৃত্যু হয় তো চণকভদ্র তাকে ছেড়ে দেবেন না। মৃত্যু হলে হবে অন্য কারণে, কিন্তু সম্ভবত চণকভদ্র তা বুঝবেন না। জীবক তীক্ষ্ণধী মানুষ। সে অনুভব করছে দৈবরাত চণক ঠিক সরল মানুষ নয়। অধিক কথা বলেন না। এখন একেবারেই বলছেন না। এখন তিনি শান্ত। বিবিক্ত। সবার কাছ থেকে যেন নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন, চিত্তের কোন গহনে তিনি যেন গুহাহিত। কিন্তু সে চণককে শ্মশানে ঝঞ্ঝাবাততাড়িত বনস্পতির মতো আক্ষেপ করতে দেখেছে। এর ভেতরে কোনও গূঢ় ব্যাপার আছে। যত সহজে জটিল সেট্‌ঠির তৃতীয়া পত্নীর উদর দেশ চিরে অন্ত্রগুলি সে গিঁট খুলে আবার ভেতরে সংস্থাপিত করতে পেরেছিল, এই বন্য তরুণীর চিকিৎসা তত সহজ হবে না। রোগী এবং বৈদ্য উভয়ের মধ্যে শুধু রোগ থাকলে সমস্যা সহজ হয়। কিন্তু যদি থাকে অজানা আবেগ, যদি থাকে রোগীর পরিপার্শ্বে বহুমাত্রিক সব বেদনার আঘাত সংঘাত… কঠিন প্রস্তরের মতো মুখ চণকভদ্র, অপরাধীর মতো নিমীলচক্ষু রাজা, বিস্রস্তকেশা সুন্দরী গান্ধারীর চোখে কৃষ্ণবিদ্যুৎ, তাহলে? তাহলে তরুণ জীবকের কাজটা অপেক্ষাকৃত কঠিন হয়ে যায়।

উনিশ দিনের দিন জীবক এসেছে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করতে। পরিষ্কারও হয়ে গেছে। শুধু সামান্য নরম আঘাতের স্থানগুলি। তরুণীটি চোখ মেলে চাইল। চোখ দুটি স্বাভাবিক। স্বচ্ছদৃষ্টিতে সে চারদিকে চেয়ে দেখল। চোখে বিস্ময়। জীবক চোখের ইঙ্গিতে চণককে ডাকল। হাঁটু গেড়ে বসে চণক সতর্ক স্নেহের সুরে ডাকল— রগ্‌গা, রগ্‌গা…

বিহ্বল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল তরুণী, তার ঠোঁট নড়ছে। মৃদুস্বরে সে বলছে— অজ্জ আমায় ছেড়ে দে। অজ্জ তোদের পায়ে পড়ি আমাদের ছেড়ে দে।

চণক বলল —রগ্‌গা, কোনও ভয় নেই। তুমি ঘুমোও। তোমাকে সুপক্ক শূকরমাংসের সুপ খাওয়াবো। কত মধু, পায়স, উত্তম অন্ন, মোক তোমার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।

এবার তরুণীর চোখে ত্রাস ঘনিয়ে এলো, বলল— আমি অজ্জদের দাসী হবো না। তোদের পায়ে পড়ি, আমি খুড়ার কাছে যাবো। উদ্দক কোথায়? উদ্দক?

চণক শান্ত গলায় বলল— রগ্‌গা, আমরা তোমার বন্ধু। একটু ইতস্তত করে আবারও বলল— আমায় চিনতে পারছো না?

তরুণী অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। জীবক দেখল সহসা চণকভদ্র যেন কী মনে পড়েছে এমন মুখভাব করে দাঁড়িয়ে উঠলেন। ঘরের কোণে একটি পেটিকা থেকে কী সব বার করলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি যখন এদিকে ফিরলেন তখন জীবক দেখল, চণক ভদ্রর মাথায় জটা, দীর্ঘ দাঁড়ি এবং গোঁফ, কপালে বলি আঁকা। অমন সুন্দর উজ্জ্বল গাত্রবর্ণ ভস্মাচ্ছাদিত। তরুণী চোখ বুজিয়ে ছিল। সে যে এখনও অত্যন্ত অবসন্ন, তা তাকে দেখলেই বোঝা যায়, পরীক্ষা করবার প্রয়োজন হয় না। এখনও তাকে কঠিন খাদ্য খাওয়াবার সময় আসেনি। প্রায় অচৈতন্য অবস্থায় একটু একটু করে দুধ মধু ও সহপানগুলি খাওয়ানো হয়েছে মাত্র। চণকভদ্র ওই প্রকার সাজসজ্জা করে তরুণীটির শয্যার পাশে এসে বসলেন, মৃদু কোমল স্বরে ডাকলেন— রগ্‌গা, রগ্‌গা… এখন দেখো তো আমায় চিনতে পারো কি না!

কয়েকবার ডাকবার পর তার চোখ দুটি খুলে গেল। তারপর যা ঘটল তার জন্য জীবক প্রস্তুত ছিলেন না। রোগিণীর চোখ-মুখ একবার বিবর্ণ তারপরই অগ্নিবর্ণ হয়ে গেল, সে বলে উঠল ‘শঠ যতি! শঠ! শঠ! শঠ!’… শয্যা থেকে সে অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় লাফিয়ে পড়ল চণকের ঘাড় লক্ষ্য করে। দু’হাত দিয়ে চণকের গলা টিপে ধরল। চোখদুটি বন্য মার্জারের চোখের মতো জ্বলছে।

জীবক তার হাত দুটি ছাড়াবার চেষ্টা করতে লাগলেন—ধ্বস্তাধ্বস্তি এবং চিৎকারে বাড়ির ভেতর থেকে কয়েকটি দাস-দাসী ছুটে এলো। জিতসোমাকে দ্বারের কাছে দেখা গেল। সে ক্ষিপ্র পায়ে এগিয়ে এসে রোগিণীর মণিবন্ধের কাছে সামান্য আঘাত করল, হাত দুটি ছেড়ে গেল। মুক্ত হাত দিয়ে এবার রোগিণী প্রাণপণে চণকের বক্ষে আঘাত করতে লাগল—নিয়ে যা, নিয়ে যা কাঁকই। চাই না, চাই না তোদের কিচ্ছু। সব নিয়ে যা—সন্ন, দীপ, তেল, অন্ন সব নিয়ে যা… বলতে বলতে রোগিণী জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল। জীবক এবং জিতসোমা তাকে তুলে শয্যায় শুইয়ে দিলেন, ক্ষতস্থানের পট্টিকাগুলি রক্তে সামান্য ভিজে উঠেছে। উত্তেজনায় ও পরিশ্রমে অর্ধশুষ্ক ক্ষতমুখ আবার খুলে গেছে।

জীবক র্ভৎসনার সুরে বলল— এটা কী করলেন আর্য চণক?

চণক শূন্যচোখে চেয়ে বলল— এভাবেই ও আমাকে চিনত। বিশ্বাস করতো। সেবা করতো।

—করুক। আপনি বুঝতে পারেননি ও আপনাকে দেখে উত্তেজিত হবে!

—না। আমি ভেবেছিলাম ওকে আশ্বাস দেবো। সান্ত্বনা দেবো। ভেবেছিলাম ওকে অভয় দেওয়া যাবে… এ ভাবেই।

ছদ্ম জটাজুটে, ভস্মলেপনে এখন কেমন হাস্যকর অথচ করুণ দেখাচ্ছে চণককে। তার গলায় বন্য তরুণীটির হাতের চিহ্ন। রক্তাভ একটি মালার মতো। তরুণীটি যখন গলা টিপে ধরেছিল তিনি বাধা দেবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেননি। এখন জিতসোমার ইঙ্গিতে দাসীরা গরম জল ও মার্জনী বস্ত্র নিয়ে এলো। সে জটাজুট, আধখোলা কৃত্রিম গোঁফ, দাড়ি গুলি সব খুলে নিল। চণক দুহাত দিয়ে যন্ত্রচালিতের মতো মুখ ধুলেন। শীতল জলে বস্ত্রখণ্ড ভিজিয়ে ভিজিয়ে সোমা তার কণ্ঠের চারপাশ ধুয়ে ধুয়ে দিচ্ছিল। বলল— জীবক ভদ্র, কোনও ভৈষজ অবলেপ্য দেবেন না?

—প্রয়োজন হবে না, ভদ্রে

—দেখছেন না কেমন ফুলে উঠেছে! ওই তরুণীর গায়ে কী অসম্ভব শক্তি।

জীবক রোগিণীকে একটি ভৈষজ খাওয়াবার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু দাঁতে দাঁত লেগে গেছে। খাওয়াতে পারছেন না। তিনি একখণ্ড তূল ভৈষজে ভিজিয়ে নিলেন, বললেন ভদ্রে, আপনি এক এর ওষ্ঠাধরদুটি ফাঁক করে ধরবেন?

সোমা প্রাণপণ চেষ্টায় শুধু ওষ্ঠাধর নয়, দাঁতের পাটিদুটিও সামান্য ফাঁক করতে পারলো। জীবক ভৈষজ পান করালো বিন্দু বিন্দু করে। কিন্তু তরুণীর জ্ঞান ফিরল না। সেদিন গভীর রাতে তার হৃৎ-স্পন্দন থেমে গেল।

সন্নতি বললেন— রক্তপাত। রক্তপাত!

জীবক আবারও বলল—আকস্মিক মানসিক আঘাত।

সন্নতি বললেন— মন অর্থাৎ চিত্ত? এ রোগিণী বন্য মনে রেখো।

জীবক বলল— মহামান্য সন্নতি, আঘাত পাবার মতো চিত্ত এই বন্যদেরও আছে, এটিই প্রমাণ হল। এরা বন্য হতে পারে, কিন্তু পশু নয়। আপনি বৈদ্য আপনার কাছে সভ্য মানুষে বন্য মানুষে প্রভেদ কী?

সহসা বৃদ্ধ সন্নতির বদ্ধ মনের দ্বার খুলে গেল। আলো প্রবেশ করছে। অনেক অনেক আলো। তিনি সকৃতজ্ঞ, সহর্ষ দৃষ্টিতে জীবকের দিকে তাকালেন। আয়ুষ্কালের শেষ পর্বে কে আর নূতন জ্ঞানের আশা করে! তিনিও করেননি। কিন্তু জ্ঞান এলো। আয়ুষ্মান জীবকের হাত দিয়ে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার হাত দিয়ে। তিনি মুখ নিচু করে আপন মনেই বলতে লাগলেন—জীবতু, জীবতু।

জীবক কিঞ্চিৎ বিষগ্ন ছিল। তার নবনাসিকা-কর্ণ নির্মাণের একটি সুযোগ এমন বৃথা গেল! আর কি সে এমন রোগী পাবে? কর্ণ-নাসিকাচ্ছেদন ব্যভিচারিণীর শাস্তি। চোর সন্দেহে কাউকে এই শাস্তি দেওয়া যেতে পারে না। এই হতভাগিনী তরুণীর ওপর অপপ্রয়োগ হয়েছিল বোহারিকের ক্ষমতার। দ্বিতীয়ত এ তরুণী রাজসখা চণকের স্নেহভাগিনী, সুতরাং মহারাজেরও পূর্ণ সমর্থন পাওয়া গিয়েছিল এর ব্যাপারে। বৈদ্য সন্নতির আশীর্বাণী কানে যেতে সে মুখ তুলে ঈষৎ বিরক্তির সঙ্গে বলল— আর জীবতু, রোগিণীটি তো মারাই গেল।

সন্নতি বললেন— ‘মহাবেজজ জীবক তো এর মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী করেই ছিলেন। করেননি? কদিন আগে আর কদিন পরে।’

মহাবেজ্‌জ? জীবক অবাক হয়ে সন্নতির দিকে ভালো করে তাকাল। রাজগহের মহাবেজ্‌জ সন্নতি স্বয়ং। তিনি কি পরিহাস করছেন?

বৃদ্ধর চোখ দুটি বোজা। মুখে স্মিত হাসি। যেন ধ্যানে ইষ্ট দর্শন হয়েছে।

৩৩

‘শ্রীমতি! শ্রীমতি!’ দ্বারে ক্রমাগত করাঘাত করে যাচ্ছে চণক। সে লক্ষ করছে না, কাষ্ঠনির্মিত, তক্ষিত দ্বারের কপাট দুটিতে কেমন ধুলো লেগে আছে। গৃহটির আকৃতিতে অবহেলার, অমার্জনার চিহ্ন। সবে গোধূলি-লগ্ন উত্তীর্ণ হয়েছে। আকাশ এবং নগরীতে নক্ষত্রবিন্দু-দীপবিন্দু-সজ্জিত লঘু ধূম্রবর্ণের উত্তরীয়টি গায়ে জড়াতে জড়াতে সন্ধ্যা নেমে আসছে। এ সময়ে এ দ্বার তো বন্ধ থাকবার কথা নয়। কবি বোধিকুমার, নট চারুবাক, সঙ্গীতনৃত্যপ্রিয় বপ্পভদ্র এঁরা তো নিত্যদিনের আগন্তুক! শ্ৰীমতীর বিশেষ গুণগ্রাহী। এঁরা ছাড়া আরও অনেকে থাকেন। রাজগৃহের বহু যুবা-প্রৌঢ় শ্রীমতীর গান, নৃত্য, সুনক্ষত্রর মৃদঙ্গ-বাদন ভালোবাসেন।

বহুক্ষণ করাঘাতের পর দ্বার খুলল। একটি দাস মুখ বাড়াল।

—কে?

—কাত্যায়ন চণক।

—কী চান?

—কী চাই? —চণক যেন দাসটিকে ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করলেন। বাঁয়ে ফিরলেন। বিস্মিত দাসটি তাঁর পেছন পেছন আসছে।

প্রশস্ত অঙ্গন। শূন্য। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্তম্ভগুলিতে মাল্য জড়ানো নেই। দীপ জ্বলছে না। প্রশস্ত সুন্দর সভাচ্ছদ পাতা নেই। অন্তঃপুরের প্রবেশপথে পিতলের পিঞ্জরটি শূন্য। শীতের পাতা ঝরে পড়ছে চারদিকে।

শ্ৰীমতী কোথায়? রুক্ষ স্বরে পেছন ফিরে জিজ্ঞাসা করল চণক। দাসটি ভয়ে ভয়ে বলল—জানি না।

—জানো না? চন্দা। চন্দা কই? সুনক্ষত্র?

—জানি না। দেবীর সঙ্গে দেশান্তরে গেছেন সম্ভবত।

—কোথায়?

—আমি জানি না অজ্জ। আমি আর আমার পত্নী এ গৃহ রক্ষা করছি।

—একে কি রক্ষা করা বলে?—চণকের মুখ দেখে দাসটি ভয় পেল। বলল—যথাসাধ্য করি অজ্জ। কিন্তু এই মুক্ত আঙন, চার দিকে গাছ—ঝরা পাতায় ক্রমাগতই ভরে যেতে থাকে।

চণক ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো। সে কেন এখানে এসেছিলে, তার কাছে স্পষ্ট নয়। তার মনে হয়েছিল, সে শ্রান্ত। বিশ্রাম চাই। লোকজন, আলো, আলাপ-আলোচনা, সঙ্গীত-নৃত্য এ সবের কিছুই তার ভালো লাগছে না। কিন্তু এই সমস্তই অনেক সময়ে একটি অন্তরাল সৃষ্টি করে, একটি প্রকৃত অন্তঃপুর, যেখানে থাকে সন্তপ্ত হৃদয়ের জন্য একটি নিভৃত ক্রোড়। নিভৃত আশ্রয়। উদ্যত তর্জনীগুলির থেকে নিষ্কৃতিস্বরূপ দুঃস্বপ্নহীন নিদ্রার অবকাশ।

—চণক ভদ্র। এদিকে কোথায়?

চণক পদব্রজে চলেছিল। মুখ নিচু। ডাক শুনে পাশ ফিরে দেখল বপ্পকুমার।

—অনেক দিন আপনাকে দেখিনি। এদিকে… কোথায় এসেছিলেন?

চণক শুধু নির্বাক চেয়ে রইল। কী অর্থ হয় এই প্রশ্নের? পেছনে পথের বাঁক ফিরলেই তো দেখা যাবে শ্রীতীর গৃহদ্বার।

বপ্পকুমার বলল—আপনি অনেক দিন পর এলেন, না?

চণক উত্তর দিল না।

—শ্রীমতী কোথায় গেছে আমরা জানি না, বপ্পকুমার বলল, ভদ্র আমরা একদিন সন্ধ্যায় গিয়ে দেখি পিঞ্জর শূন্য। শ্রীমতী পক্ষী উড়ে গেছে। আমরা আজকাল নন্দার কাছে যাই। অত ভালো গায় না। কিন্তু চমৎকার সব গীত রচনা করে, সুর দেয়। অতিশয় চঞ্চল। একটি খঞ্জনের মতো যেন। চলুন না। নিয়ে যাই।

চণক বলল—না।

বপ্পকুমার তার পাশে পাশে চলতে লাগল। বলল—চণকভদ্র মনে যদি কিছু না করেন তো বলি, বারস্ত্রীর ওপর আসক্তি ভালো নয়। মোটে ভালো নয়। এরা কুট্টনীর কাছ থেকে নানা প্রকার সম্মোহক বিদ্যা আয়ত্ত করে, প্রধানত ধনী, সুদর্শন, কুমার পুরুষদের ওপর এদের বিদ্যা খাটায়। যাতে সারা জীবন একটু একটু করে শোষণ করতে পারে। তারপর যখন দেহে-মনে-ভাণ্ডারে নিঃস্ব হয়ে যাবে সে পুরুষ তাকে নিষ্ঠুরভাবে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তা ছাড়া বারস্ত্রী তো একটি নয় ভদ্র, নন্দা আছে, সুপূর্ণা আছে, আছেন স্বয়ং সালবতী। তিনি অবশ্য অত্যুচ্চ বৃত্তের লোক, তবে আপনার অগম্যা নন কখনও। বয়সে হয়ত, হয়ত কেন নিশ্চয় আপনার আমার থেকে অনেক বড়। কিন্তু গেলে, দেখবেন, যেন বিংশতিবর্ষীয়া যুবতীটি। স্থিরযৌবনা। এঁরা অপ্সরা-বিদ্যা জানেন তো!

তখনও চণক কিছু বলছেন না দেখে বপ্প বলল—আমি জানি আপনি অতি লাজুক, আমিই না হয় আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাই…

তার কথা শেষ হল না, চণক বলল—আমার বড় তাড়া আছে। চলি বাপ্পাকুমার…সে অতি দ্রুত পথ পার হতে লাগল। যেন বপ্প তাকে কোনমতেই ধরতে না পারে।

বপ্পকুমার অবাক হয়ে গেল। চণক নামে গান্ধার দেশের এই যুবা গোড়ার থেকেই অতি উন্নাসিক। উদীচীর লোকেরা এমনটাই হয়ে থাকে, সে শুনেছে। মাগধদের তারা অনেকেই মানুষের মধ্যে ধরে না। আবার তক্ষশিলার স্নাতক, আবার গান্ধারের রাজপুরুষ আবার এখন মগধের রাজমিত্ত। তাই-ই কি অহংকার আরও বেড়ে গেল চণকভদ্রর! বপ্পও অতি ধনবান সেট্‌ঠির পুত্ত। তার নামটা পর্যন্ত চণক ঠিকঠাক বলতে পারলেন না। অহংকার, না আত্মবিস্মরণ! শ্রীমতীর বিরহেই ওই প্রকার কৃশ, অন্যমনা নাকি! তা এতকাল কোথায় ছিলেন? শ্ৰীমতীর সভায় তারা তো নিয়মিতই যেত। চণকভদ্রকে দেখেনি তো! অথচ অনেক সময়েই দেখেছে গিজঝকুট থেকে ফিরতে। কিংবা কোনও পানগৃহে আর একটি সুদর্শন তরুণের সঙ্গে কথা বলতে। সহসা যেন চণকভদ্র তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন। তারা দুঃখিত হয়েছিল। বিশেষত কবি বোধিকুমার। বোধিকুমারের সঙ্গে বোধহয় চণকভদ্রর সখ্যটি যথেষ্ট নিবিড় হয়েছিল। প্রথম প্রথম যখন চণক আসা বন্ধ করলেন, বোধিকুমার অত্যন্ত উতলা হয়েছিল। বলত, অমন কাব্যভাবক আর হয়ত পাবো না। কবিরা ততটা মান যশের প্রার্থী নয়, যতটা প্রকৃত সহমর্মী বোদ্ধার প্রত্যাশী।

বপ্পই বুঝিয়েছিল বোধিকুমারকে, রাজমিত্ত তো আর শুধু শুধু হয় না, নিশ্চয়ই কোনও রাজকার্যে জড়িয়ে পড়েছেন।

—সে ক্ষেত্রে একটি চমৎকার, উচ্চস্তরের সাহিত্যরসিককে আমরা হারালাম। কে জানে হয়ত কবিকেও!

—কবিকে হারাবার প্রশ্ন উঠছে কেন?—বোধিকুমারকে জিজ্ঞাসা করেছিল। বোধিকুমার তাতে বলে—আমার ধারণা চণকভদ্র নিজেও একজন কবি। নিজে কবি না হলে কবিতার অন্তরে ওইভাবে প্রবেশ করার সাধ্য থাকে না। তা ছাড়া বপ্পভদ্র, যথার্থ বোদ্ধা ব্যতীত কবির অস্তিত্ব কতদিন? একটি পিক আর কতদিন শূন্য প্রান্তরে, নির্জন বৃক্ষশাখায় বসে কুহু-কুহু করে, বলো?

—কেন, আমরা? আমরা মাগধরা কি এতই অরসিক? বপ্পকুমার আহত হয়ে জিজ্ঞাসা করে।

না, না, তা নয়—বোধিকুমার যেন একটু লজ্জিত—তারপর বলেছিল, আপনারাও কাব্য শোনেন, গ্রহণ করেন, কিন্তু কিছু মনে করবেন না বপ্পভদ্র, আপনাদের কাছে সাহিত্যরস বারস্ত্রী সঙ্গের তুল্য। প্রমোদের জন্য, বিলাসের জন্য আপনারা কাব্যের কাছে আসেন। চণকের মতো রসিক আসেন প্রণয়ীর মতো, মর্মে প্রবেশ করেন।

—কেন, ভদ্র চারুবাকও তো আপনার কাব্যের অলঙ্কারাদি ব্যাখ্যা করে থাকেন, দোষ-গুণ বিশ্লেষণ করেন। তাতেও আপনার মন ওঠে না?

ঠিকই। ভদ্র চারুবাক কাব্যের বহিরঙ্গ বোঝেন। সে সম্পর্কে তাঁর সঙ্গে আলোচনায় আমি বহুবার উপকৃত হয়েছি বপ্পভদ্র। সত্য। কিন্তু প্রকৃত কাব্যভাবক কাকে বলে তা আমি চণকভদ্রর সঙ্গে আলোচনার পূর্বে জানতামই না। সমগ্র কাব্য, তার ভাষা, শব্দযুথ, ধ্বনি ব্যবহার, ছন্দ, অর্থ, খণ্ড খণ্ডভাবে নয়, সামগ্রিক দৃষ্টিতে কাব্যের যে অধরা ব্যঞ্জনা, একই সঙ্গে বহু ব্যঙ্গার্থ বহন করবার ক্ষমতা—এ একমাত্র চণকভদ্রই রাজগৃহে বুঝেছিলেন।

ওই আরেক ব্যক্তি যে না কি শ্রীমতীর বিরহে ক্লিষ্ট। বপ্পকুমার নন্দার গৃহের দিকে পা চালাল। যদি ওখানে বোধিকুমারের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, আজকের এই চণক-সংবাদ তাকে সত্বর জানাবে।

চণক কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করেছিল। বোধিকুমারের গৃহ কোথায় সে জানে। কিন্তু কখনও যায়নি। সাধারণত একটি আম্রকুঞ্জে বসে তাদের কথা হত। এখন আসন্ন সন্ধ্যার ছায়া পড়ে গেছে চতুর্দিকে। কুঞ্জ-কাননগুলিতে সেই ছায়া গাঢ়তর। নাঃ, আম্রকুঞ্জে বোধিকুমারের যাওয়ার সম্ভাবনা অল্প। সে অগত্যা বোধিকুমারের গৃহের দিকেই চলল।

পশ্চিম পল্লীতে ক্ষুদ্র গৃহটি কবির। সমগ্র রাজগৃহে কাননহীন গৃহ একটিও নেই। অন্ত্যজ ছাড়া আর কেউ দরিদ্রও নয়। গৃহগুলি যাতে সময়মতো সংস্কার হয়, কাননগুলি যাতে যথাযথ রক্ষা হয় তার জন্য অনমনীয় নির্দেশ আছে রাজার। বোধিকুমারের গৃহটি ক্ষুদ্র এবং মাটির। মাটির প্রাচীরের গায়ে খোদিত বহু প্রকার অলঙ্কার দেখতে পেল চণক। কাননটিও ক্ষুদ্র। কিন্তু অপরিসীম যত্নে কেউ তাকে রক্ষা করছে। এই শীতেও প্রত্যেকটি গাছ সবুজ। পাতাগুলি ঝকঝক করছে। একটি আম্র ও একটি হরীতকী ছাড়া বৃক্ষ বলতে তেমন কিছু নেই। সবই ছোট ছোট গুল্ম। দ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে সে ইতস্তত করছে এমন সময়ে দ্বার খুলে গেল। গায়ে মাথায় উর্ণার উত্তরীয় জড়িয়ে বেরিয়ে এলেন এক রমণী। তাঁর মুখ দেখতে পাচ্ছিল না চণক। কাননের দিকে চলে যাচ্ছিলেন তিনি, সহসা চণকের উপস্থিতি অনুভব করে ফিরে দাঁড়ালেন—কে?

চণক সামনে এসে দাঁড়াল, বলল—বোধিকুমারকে প্রয়োজন ছিল। আমি কাত্যায়ন চণক।

গৃহের ভিতরে দীপ জ্বলছে, দ্বারপথে সেই দীপের আলো। রমণী ফিরে দাঁড়ালেন, ত্বরিতে ভেতরে ঢুকে গেলেন। তাঁর চলার ভঙ্গির দিকে ইচ্ছার বিরুদ্ধেও তাকিয়ে রইল চণক। ইনি কি নৃত্যকুশলা? একটু পরেই বেরিয়ে এলো বোধিকুমার।

—আসুন আসুন চণক ভদ্র—সে অভ্যর্থনা করল, চণকের মনে হল তার মধ্যে যেন পুর্বের আগ্রহের অভাব।

সে বলল—ভেতরে যাবো না কবি, আপনার এই কাননে…

চলুন, তাই চলুন—বোধিকুমার তার উত্তরীয়টি ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে, কাননে একটি বকুলমূলে মৃৎ-বেদীর ওপর বসল। মৃৎ-বেদীর ধারগুলিও অনুপম কারুকার্যে ভরা। পরপর অনেকগুলি হাতি শুঁড় তুলে রয়েছে, বেদীর প্রান্ত যেন সেই শুঁড়গুলির ওপর ন্যস্ত। একটি প্রিয় অলংকরণ মগধবাসীদের। মঙ্গলচিহ্নও বটে। হাতি।

সন্তর্পণে বেদীতে বসতে বসতে বিনা ভূমিকায় চণক জিজ্ঞেস করল—শ্রীমতী কোথায়? জানেন?

অনেকক্ষণ নীরবতার পর বোধিকুমার ঈষৎ কর্কশ স্বরে বলল, —শ্রীমতীকে কি আপনার আবার প্রয়োজন পড়েছে?

চণক তার দীর্ঘ চোখ দুটি তুলে বোধিকুমারের দিকে তাকাল, বলল—তিরস্কার?

—আপনাকে তিরস্কার করার স্পর্ধা আমার নেই হে উদীচ্য ব্রাহ্মণ। কিন্তু আপনি একদিন সহমর্মী চক্ষু দিয়ে ওই নগরবধূকে দেখেছিলেন বলে শুনতে পাই।

—সত্য, আমি বহুদিন ব্যস্ত ছিলাম.। শ্রীমতীর সংবাদ রাখিনি। একথা সত্য—চণক দূরের দিকে তাকিয়ে বলল।

—হ্যাঁ আপনি ব্যস্ত ছিলেন আপনার নূতন প্রণয়িনীকে নিয়ে।

—কে বললে? চণক আশ্চর্য হয়ে মুখ ফেরাল।

—সবাই জানে। শ্ৰীমতী জানে! বারবধূর তার ক্রেতাদের কাছ থেকে প্রত্যাশা কিছু থাকে না। থাকতে নেই। তবু…

চণক বলল—আমি কোনদিন শ্রীমতীকে ক্রয় করিনি, সে-ও নিজেকে আমার কাছে বিক্রয় করেনি।

—এই রূপই যেন শুনেছিলাম? অবিক্রীত দেহসম্ভোগের নাম প্রণয়। প্রণয় লাভ করলে বারস্ত্রীও বড় অভিমানিনী হয়ে ওঠে চণকভদ্র। আপনি জানেন না, শ্ৰীমতী কেন অদর্শন হয়েছে? জানেন না, কোন পরিস্থিতিতে বারাঙ্গনা অদর্শন হয়?

চণক অবাক হয়ে বলল—না। জানি না তো!

বোধিকুমার ক্রোধে রক্তিম হয়ে উঠে দাঁড়াল। শ্ৰীমতীর গর্ভস্থ সন্তানের পিতৃত্ব অস্বীকার করছেন তাহলে? তা তো করবেনই। এই প্রকারই তো হয়ে থাকে পাষণ্ড গণিকাভোগীরা। আপনাকে অন্যপ্রকার ভেবেছিলাম। ভেবেছিলাম….

—ক্ষান্ত হও পুত্ত—অদূরে সেই রমণী এসে দাঁড়িয়েছেন, তাঁর হাতে দারুফলকে পানীয়-অতিথির সেবা করো।

চণক আর কিছু শুনতে পেল না। কারণ, তখন সে তক্ষশিলার সন্নিহিত অরণ্যে আচার্য দেবরাতের কুটির-প্রাঙ্গণে একটি সুকুমার শিশুকে কন্দুক হাতে খেলা করে বেড়াতে দেখছিল। পিতার কোলে বসে সেই শিশু কিছুই না বুঝে ঋক্‌সংহিতা কণ্ঠস্থ করত। ক্লান্ত হলে পিতার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ত। কোন এক সময়ে জ্যেষ্ঠা ভগ্নী কিংবা পিতার কোনও শিষ্য তাকে তুলতে এলে, পিতা বলতেন থাক্‌ থাক্‌, আহা থাক!

—কিন্তু, এতক্ষণ ওকে কোলে নিয়ে বসে আছেন, আপনার কষ্ট হবে যে! পা ধরে যাবে।

—যাক। দেখছ না কন্দুকটি হাতের মুঠোয় নিয়ে কেমন এলিয়ে রয়েছে। আহা, মাতৃহীন শিশু, থাক। তিনি সস্নেহে তার চুলগুলি যথাস্থানে বিন্যস্ত করে দিতেন। শিশু মাঝে মাঝেই আধো-ঘুমের মধ্যে পিতার স্নেহবাক্যগুলি শুনত।

চণকের প্রথম সন্তান? আচার্য দেবরাতের প্রথম পৌত্র?

সচেতন হবার পর সে শুনল—বোধিকুমার বলছে—মা তুমি জানো, তোমার কাছে শপথ করেছিলাম নিষ্ক্রয় দিয়ে শ্রীমতীকে মুক্ত করবো। এঁর জন্য তা হল না। না হোক, ভেবেছিলাম আমি না পারি, ইনিই তা পারবেন এবং করবেন।

বোধিকুমারের মা একটু এগিয়ে এসে বললেন—বচ্চ চণক, পানীয় গ্রহণ করো, আমার পুত্তের কথায় উত্তেজিত হয়ো না।

চণক ধীর স্বরে বলল—জননী, শ্রীমতী কোথায় আপনি জানেন?

—না বচ্চ, জানি না, তবে যদি কখনও সন্ধান পাওয়া যায়, আমার পুত্ত তাকে জানিয়ে দেবে। কাত্যায়ন চণক তাকে খুঁজেছিল।

বোধিকুমার কাঁদছে। অশ্রু গদগদ স্বরে কী বলছে। সহসা চণকের সমস্ত দৃশ্যটি, বিশেষত বোধিকুমারকে অসহ্য মনে হল। কাঁদছে? এই মাগধ পুরুষরা কাঁদেও না কি? চিরকালই তবে বালক থাকে বোধহয়! সে বিতৃষ্ণায় মুখ ফিরিয়ে নিল। আর একটিও কথা না বলে সে উঠে দাঁড়াল, দ্রুত কাননদ্বারের দিকে চলল।

পেছন থেকে দৃঢ় নারীকণ্ঠ শুনল—বচ্চ চণক, জননীকে অপমান করে যাচ্ছো? চণক যেন একটা আঘাত খেল। সে পেছন ফিরে মায়ের মুখোমুখি হল।

কোমলকণ্ঠে তিনি বললেন-বসো চণক।

চণক বসবার পর তিনি পানীয়র পাত্র এগিয়ে ধরলেন। বললেন—অতিশয় মৃদু এ পানীয়। যদিও মধু থেকেই প্রস্তুত, তবু উত্তেজক কিছু প্রায় নেই বললেই চলে। আমি নিজে করি। নাও। এই খজ্জও অন্তত একটি নাও। মিষ্ট নয় এগুলি। খেয়ে দেখো, ভালো লাগবে। তোমাদের মায়েরই করা। পুত্ত তুমিও নাও। বৃথা অশ্রুপাত করছো কেন? পরিস্থিতি বুঝে যা ভালো মনে হয়, বিচার করে, তাই করবে। এর মধ্যে অশ্রুর কোনও স্থান নেই। জীবন কি তোমার পরিকল্পনা মতো চলবে?

চণক একটি বর্তুলাকার খজ্জ মুখে তুলে নিয়ে কামড় দিল। ইনি ঠিকই বলেছেন। ভালো লাগছে। সুগন্ধ, মুড়মুড়ে। মুখের ভেতরটা যেন সুস্বাদে ভরে গেল।

—আরও একটি নাও বচ্চ, যদি ভালো লাগে। তার মনের কথা বুঝেই যেন বললেন বোধিকুমারের মা। দ্বিতীয় খজ্জটি তুলে মুখে দেবার পর চণকের সহসা এক প্রবল আত্মধিক্কারের বোধ এলো।

শ্রীমতী কোথায় কোন নির্বাসনে গেছে। হয়ত কষ্ট পাচ্ছে। মানসিক তো বটেই। সেই সঙ্গে দৈহিকও হয়ত। তার অর্থাগমের পথও রুদ্ধ। অথচ সে এখানে বোধিকুমারের জননীর কাছে বসে তাঁর রাঁধা খুজ্জ খেয়ে চলেছে মনের সুখে। যেখানে যাই ঘটুক পৃথিবী যেমন নির্বিকার, তার দিন-রাত্রি, বর্ষা-শীতের নিয়মে যেমন কোনও ব্যত্যয় হয় না, মানুষও তেমনি। তার ইন্দ্রিয়গুলি ক্ষুধার্ত। প্রিয়তম ব্যক্তির মৃত্যু বা অপঘাত বা অন্য কোনও দুর্দশা ঘটলেও কি ক্ষুধা-তৃষ্ণা বোধ, শৈত্য বা গরম বোধ, নিদ্রার প্রয়োজন ইত্যাদি ইত্যাদি মানুষ অস্বীকার করতে পারবে? পৃথিবীর পক্ষে এই প্রকার ব্যবহারের ন্যায় অন্যায়ের প্রশ্ন নেই, কেন না যতই ঋষিরা ভূমিসূক্তে, পৃথিবীসূক্তে তাকে জননী বলে স্তুতি করুন, প্রকৃতপক্ষে পৃথিবী জড়। কিন্তু মানুষের চিত্ত আছে। মস্তিষ্ক আছে। আবার সব মানুষই কি এক প্রকার? এই তো বোধিকুমার, চোখ দুটি এখনও অরুণাভ। মায়ের অনুরোধ সত্ত্বেও খজ্জের দিকে হাত বাড়ায়নি। এমন কি সে চণক, চণকও তো ক্ষুধা-তৃষ্ণা-নিদ্রা ভুলে ছিল যতদিন অরণ্যকুমারী রগ্‌গার সেবা করেছে। রগ্‌গা, চণকের বুকের মধ্যে তীক্ষ্ণ লৌহমুখ তীর বিঁধতে লাগল। মুখ থেকে খুজ্জ ফেলে দেওয়া অত্যন্ত অভদ্রতা হবে বুঝে সে প্রাণপণে সেগুলি গিলতে লাগল। বিষম খেলো। কাশির ধমকে তার সারা শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। বোধিকুমারের জননী কাছে এসে তার ঘাড়ে মৃদু মৃদু আঘাত করতে লাগলেন। অন্য হাতে পানপাত্র মুখের কাছে ধরে বলছেন, একটু পান করো, পান করো বচ্চ। না হলে ঠিক হবে কী করে?

সামান্য পান করবার পর কাশি প্রশমিত হলে তিনি বললেন—যখন যা করবে, চিত্ত তাতেই সমর্পণ করবে। জীবন তো বহু কর্মের, বহু চিন্তার, বহু দায়ের সমাহার হবেই। শতাবধান হবার সাধনা করে থাকো তো অন্য কথা, নইলে চিত্তকে সংযত একাগ্র করতে হবে, বচ্চ।

এই কথা বললেন বোধিকুমারের মা, একজন সামান্য মগধিনী, চণককে, কাত্যায়ন দৈবরাত চণককে, যে চণক শতাবধান না হোক, অন্তত দশাবধান তো বটেই, যে চণক তক্ষশিলার মুকুটমণি পিতার মুকুটমণি পুত্র, যার পাণ্ডিত্য ও বুদ্ধির যশ এমনই যে, গান্ধার রাজসভা ও তক্ষশিলার আচাৰ্যকুল উভয়ের মধ্যে তাকে নিয়ে রীতিমতো টানাটানি পড়ে গিয়েছিল। উপরন্তু, যে চণক এখন মগধরাজের মিত্র, রাজশাস্ত্রের রচক, যে চণক মগধরাজকে নতুন দিশা দেখাচ্ছে, যে চণক…। তখন চণক বুঝতে পারল ইনি সামান্য এক মগধিনী কখনও নন। সে মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করল—এই বেদী, গৃহের মৃৎ প্রাচীরের এই সব অপূর্ব লতায়িত হংসমিথুন, শঙ্খহাতে নারী না অপ্সরী, বংশীবাদক, এই সমস্ত সৌকর্যায়িক, এসব কে করেছেন?

—তোমার এই জননীই করেছে বচ্চ।…একটু পরে নিজের হাত দুটি কোলের ওপর মেলে ধরে তিনি ধীরে ধীরে বললেন—প্রকৃত কথা, থাকতে পারি না, হাত দুটি যেন সর্বক্ষণ কেমন করতে থাকে।

চণক অদূরে সেই মৃৎ-গৃহের দিকে অপলক চেয়ে রইল। গাছের ডালে বাঁধা একটি উল্কা জ্বলছে। তার আলোয় গৃহের অলঙ্করণ কখনও স্পষ্ট কখনও অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সে সেই দিকে অভিভূতের মতো চেয়ে রইল।

জননী বললেন—চণক, বচ্চ, আমি স্থপতি মহাগোবিন্দের কন্যা সুমেধা।

—‘মা’ বোধিকুমার যেন র্ভৎসনা করে উঠল।

জননী বললেন—আমাকে বলতে দাও পুত্ত, বলতে দাও। তুমি না বলেছিলে এই ক্যাত্যায়ন চণক তোমার বর্ষা কাব্যের মমোৰ্দ্ধার করেছেন! বচ্চ চণক, আমি পাঞ্চালীও বটে। আমার মা এক পাঞ্চালী বারমুখ্যা। আমার জন্মের সম্ভাবনার কথা শুনে পিতা মহাগোবিন্দ দেশান্তরে যাবার সময়ে মাকে একটি মহামূল্য রত্ন-অঙ্গদ দিয়ে গিয়েছিলেন, বলেছিলেন পুত্র হলে ওই রত্ন অঙ্গদসহ তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিতে, পিতৃবংশের সিপ্প শিক্ষা করবে সে পিতার তত্ত্বাবধানে, আর কন্যা হলে ওই অঙ্গদ বিক্রয় করে কন্যার ভরণপোষণ করতে। বচ্চ, আমার জননীর এবং আমার দুর্ভাগ্য যে, আমি কন্যাই হলাম। আমার এই পুত্ত আমাকে মুক্ত করেছে। যখন মাত্র দশ বছরের বালক, তখন আমরা পাঞ্চাল-রাজধানী কাম্পিল্ল ছেড়ে পালিয়ে আসি। কাম্পিল্লে থাকলে গণিকার বিট হওয়া ছাড়া আমার পুত্তের আর কোনও ভবিষ্যৎ থাকত না। আমরা বারাণসীতে গিয়ে বাস করি। পুত্তের শিক্ষা সমাপ্ত হবার পর রাজগহে ভাগ্যের সন্ধানে আসি। সামান্য অর্থ ও অলঙ্কার আনতে পেরেছিলাম, গ্রাসাচ্ছাদন চলে যায়। শিক্ষার ব্যয় তো লাগেনি! আচার্য গঙ্গাধর আমার পুত্তকে পুণ্যশিষ্য তো করে নেনই। উপরন্তু তার কবিপ্রতিভা দেখে তাকে কতভাবে সাহায্য করেছেন, বলে শেষ করা যায় না। এখন বচ্চ চণক, আশা আছে কোন না কোনদিন মগধের রাজসভা কবির প্রয়োজন বুঝবে। তখন..

বোধিকুমার মুখ তুলে বলল—ইতিমধ্যে আমার জননী পরিচয় গোপন করে ধনীদের গেহে সৈরিন্ধ্রীর কাজ করেন। রমণীদের সিপ্প শিক্ষা দেন, এমন কি উৎসব গৃহে মহানসীর কাজ পর্যন্ত নিয়ে থাকেন…।

মনে হল বোধিকুমার চণকের প্রতি তার ক্ষণপূর্বের ক্ষোভ ভুলে গেছে। সম্ভবত তার ব্যক্তিগত সঙ্কটের প্রসঙ্গে।

সে হঠাৎ বলল—আচ্ছা চণকভদ্র, এই যে সিপ্পসমূহকে বিদ্যার জগতে অন্ত্যজ করে রাখা হয়েছে, একি আপনি ন্যয়সঙ্গত বলে মনে করেন? কম্মার সিপ্প, কুম্ভকার সিপ্প এগুলির কথা বলছি না। কিন্তু ধরুন স্থাপত্য বিদ্যা, ভাস্কর্য অথবা চিত্রকলা? কাব্য উচ্চকোটির বলে স্বীকৃত। কিন্তু এই সমস্ত বিদ্যার মধ্যেও যে সৌন্দর্যের সঙ্গে দক্ষতা, প্রয়োজনের সঙ্গে সৌষম্যবোধের সমন্বয়সাধন হয়, তা কি উচ্চকোটির সিপ্প নয়?

চণক বলল— আমি এ নিয়ে এখনও চিন্তা করিনি কবি। আপনি কি এগুলিও জানেন না কি?

জননী বললেন—আমার পুত্ত অপূর্ব সব চিত্ত লিখতে পারে। পুতুল গড়তে পারে। স্থাপত্য বিষয়ে আমরা উভয়েই বহু চিন্তা ও পরিকল্পনার আলোচনা করে থাকি। আমাদের এই গৃহ হিমঋতুতে উষ্ণ থাকে, দীর্ঘ গ্রীষ্মের সময়ে থাকে সুশীতল। বর্ষার সময়ে ঢালু ছাদের যাবতীয় জল গিয়ে পড়ে একটি কূপে। গৃহের কোনও কক্ষে বা অলিন্দে জল ঢুকতে পায় না।

বোধিকুমার বলল—এখন আমরা চিন্তা করছি, সমুদয় আবর্জনা যা নালিকাপথে কাননে একত্রিত করি, তা কী করে আবার মাটির তলায় চালিত করা যায়। এইভাবে গৃহও হবে আবর্জনামুক্ত, মাটিও হবে উর্বরতর, অথচ ব্যয় এমন কিছু নয়। তবে এ ধরনের গৃহ সর্বদা সুসংস্কৃত রাখতে হয়। সংস্কারের কাজ গৃহের পুরুষরাই রমণীদের সাহায্য নিয়ে করতে পারেন। বিশেষজ্ঞর প্রয়োজন হয় না।

এবার সে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ঘুরে ঘুরে চণককে তাদের কানন, গৃহাভ্যন্তর দেখাতে লাগল। কক্ষে কক্ষে অর্ধসমাপ্ত ভিত্তিচিত্র। এখনও কাঁচা রয়েছে কিছু কিছু।

—বর্ণ কী ব্যবহার করেন? চণক কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল।

—শুভ্রবর্ণ নিই চুনম থেকে, গৈরিক মাটি থেকে, কৃষ্ণবর্ণ কজ্জল থেকে পেয়ে যাই। লাক্ষা থেকে রক্তবর্ণ, রক্তচন্দনও ব্যবহার করি। কিন্তু হরিৎ, নীল ও অন্যান্য বর্ণের জন্য রত্ন গুঁড়োলে ভালো হয়। ভেষজবর্ণে ঠিক হয় না। আমার তো সে সাধ্য নেই। তাই দেখছেন না কতকগুলি নির্দিষ্ট বর্ণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছি।

শ্রীমতীর চিত্র দেখল চণক একাধিকবার। সঙ্গীত-নৃত্য-সভা, কখনও শ্রীমতী গাইছে, কখনও নাচছে, সুনক্ষত্র বাজাচ্ছে। বহু চেনা-অচেনা মুখের মধ্যে দর্ভসেনের মুখটি সে পরিষ্কার চিনতে পারল।

—এই নৃত্যসভা তো শুধু প্রতিচ্ছবি নয়! —চণক দেখতে দেখতে বলল।

শিল্পী বলল—তা তো নয়ই। এই যে অতিগৌর, নাতিগৌর, হেমবর্ণ, চম্পকবর্ণ, তাম্রাভ, কৃষ্ণবর্ণ, সর্বপ্রকার বর্ণের মানুষ দিয়ে এই সভাটি লিখেছি তাতে বোঝানো হল না কি, সঙ্গীত আস্বাদনের ব্যাপারে বর্ণ-নির্বিশেষে সব মানুষের চিত্তই সমান উৎসুক! এখানে এই যে নৃত্যপর নারী বা বাদকদের দেখছেন, দেখুন এরা কিন্তু বস্তুপৃথিবীর নিয়ম মেনে লিখিত হয়নি। হাত, পা, চোখ সকলই কেমন লীলায়িত, যেন দেহে অস্থি বলে কিছু নেই। এ হল ভাব, নৃত্যের ভাবরসের একেবারে ভেতরকার কথা। বাদকের চারপাশে যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনিন্দ্যসুন্দর বালকগুলি নাচছে এগুলি প্রকৃতপক্ষে ধ্বনি, বিচিত্র ধ্বনি। তাই এদের শুধু গৈরিক দিয়ে লিখেছি। মুখ-চোখের মধ্যে দেখুন কেমন তদ্‌গত ভাব! এরা এ পৃথিবীর নয়। বিশুদ্ধ ধ্বনি সব। গন্ধর্বলোক থেকে এসেছে।

সাধু, বোধিকুমার, সাধু—মৃদুস্বরে বলল চণক,—আর আমাকে এগুলি না দেখিয়েই বিদায় করে দিচ্ছিলেন?

বোধিকুমার লজ্জা পেয়ে বলল—আপনাকে ভুল বুঝেছিলাম। মার্জনা করুন।

—করবো। যদি একটি সত্য কথা বলেন।

—বলুন।

—আপনি কি শ্রীমতীর প্রণয়প্রার্থী?

একটু ইতস্তত করে বোধিকুমার বলল—ছিলাম চণকভত্র। কিন্তু আপনি আসার পর সব যে অন্যরূপ হয়ে গেল! আপনি শ্ৰীমতীর সন্তানের পিতৃত্ব যখন স্বীকার করেছেন তখন বাকিটুকুও নিশ্চয়ই করবেন?

—অর্থাৎ?

—আমি রাজভাণ্ডারে নিষ্ক্রয় দিয়ে শ্রীমতীকে মুক্ত করবার জন্য ধনসঞ্চয় করছিলাম। সে কাজটা, সে যদি রাজগহে ফেরে, তো আপনাকেই করতে হবে।

একটু পরে চণক বলল—ধরুন তখন যদি আমি রাজগৃহে না থাকি! ধরুন কেন, সত্য সত্যই থাকবো না। আমার ভবিষ্যৎ আমায় কোন দেশে কোন অবস্থায় নিয়ে গিয়ে ফেলবে, আমি জানি না। …কবি…মৃদুস্বরে চণক ডাকল…আপনি কি আমার সেই অনাগত সন্তানের ভার নেবেন?

একটি রত্ন অঙ্গদ দিয়ে যান তাহলে; পুত্র হলে অঙ্গদসমেত… বোধিকুমারের কণ্ঠে বিদ্রুপের সঙ্গে ব্যথা মিশে আছে। তার কথা শেষ হল না। চণক বলল—না, অঙ্গদ নয়। কাত্যায়ন দৈবরাত এই গোত্র নাম আছে শুধু, তাই দেবো, কিন্তু…গৃহী হবার অবসর চণকের জীবনে হয়ত আসবে না। এই কথাটি শ্ৰীমতীকে বুঝিয়ে বলতে হবে।

বোধিকুমারের মুখের দীপ্তি ধীরে ধীরে নিবে গেল।

—আমি নিষ্ক্রয়ের ব্যবস্থা করে যাবো, চণক বলল।

—নিষ্ক্রয় দিয়ে মুক্তি কিনতে পারি ভদ্র চণক, প্রণয় কিনতে তো পারি না!

—প্রণয় কিনবে কেন কবি, চণক ধীরে ধীরে বলল, প্রণয় লাভ করতেও তো পারো!

চিন্তামগ্ন দৈবরাত সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে যাবার পর ধীরে ধীরে গান্ধার- ভবনে প্রবেশ করল। ঘরে ঘরে দীপ জ্বলছে। শান্ত সুন্দর। আসনশালায় তিষ্য বসে আছে। বসে আছে জিতসোমাও। তিষ্য কিছু বলছে, জিতসোমা শুনছে। এই দৃশ্যটি যেন বহু দূরের। চণকের সঙ্গে কোনও প্রত্যক্ষ সংযোগ নেই। সে প্রবেশ করতেই দুজনে নীরব হয়ে গেল। সোমার মুখে শোনার ঔৎসুক্য ছিল, অন্তর্হিত হল। সোমার এই ভাবান্তর চণক কি লক্ষ করল? দীর্ঘদিন ধরে সে অন্যমনস্ক। প্রায় সারারাত ধরে সে লেখে। ভোর হলে চিত্তকের পিঠে বেরিয়ে যায়। মধ্যাহ্নভোজনের সময়েও অনেক দিনই ফেরে না। আজ বোধিজননীর সংস্পর্শে, বোধিকুমারের শিল্পচর্চার প্রসঙ্গে চণক যেন সামান্য উজ্জীবিত। যদিও গান্ধার-ভবনে প্রবেশ করা মাত্র একটি কৃষ্ণাঙ্গী তরুণীর কর্ণ-নাসিকাহীন শব তার প্রাণশক্তি কেড়ে নেয়, তবু।

সে বলল—তিষ্য, আসছি, চলে যেও না। আজ নৈশভোজে একসঙ্গে বসবো। চণক ভেতরে যেতে তিষ্য উৎফুল্ল মুখে বলল—বলেছিলাম না ভদ্রে, একটু সময় দিন, চণকভদ্র আবার আগের মতো হয়ে উঠবেন।

সোমা কিছু বলল না। বিষণ্ণ মুখে যেমন বসে ছিল বসে রইল।

তিষ্য বলল—আপনার মুখে হাসি দেখছি না কেন ভদ্রে?

সোমা মৃদু অশ্রচ্ছন্ন কণ্ঠে বলল-বন্য কুমারীর সেবা করতে চাইনি সে কি আমার দোষ?

তিষ্য প্রথমটা আশ্চর্য হয়ে গেল, তারপর বুঝে বলল—আপনি হয়ত ঠিকই বুঝেছেন, চণকভদ্র বোধহয় ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন।

সোমা বলল—আমি কখনও করিনি। নিষাদদের দেখিনি কখনও। ওরূপ বীভৎস দৃশ্যও কখনও দেখিনি।

সে যেন কোনও বোহারিক কি বিনিশ্চয়ামাত্যর কাছে আত্মপক্ষ সমর্থন করছে। তিষ্য কী বলবে? কিছুক্ষণ পর সে বলল—এতে কোনও অপরাধ হয়নি, আর হলেও…

জিতসোমা হঠাৎ উঠে অন্তঃপুরের দিকে চলে গেল। করুণ কোমল মূর্তি। তিষ্যর হৃদয় যেন ভদ্রা জিতসোমার জন্য দ্রব হয়ে যেতে থাকে। কী রহস্য এঁর হৃদয়ে! ইনি কী প্রকার বিদুষী, কত শিল্প জানেন—এ সবই প্রতিদিন তিষ্য দেখতে পাচ্ছে। বন্য কুমারী হতভাগিনী রগ্‌গা গান্ধার-ভবনে কী যে অনভিপ্রেত জটিলতার সৃষ্টি করে গেল! দাসী তাকে পানীয় এনে দেয়। তিষ্য বুঝতে পারে জিতসোমা সংবৃত হতে অন্তঃপুরে গেছেন কিন্তু ভোলেননি তিষ্যকুমার অতিথি, একা বসে আছে। সে ধীরে ধীরে পানীয়ে চুমুক দিতে থাকে। যেতে হবে। তাকে এবার শ্রাবস্তী যেতে হবে। শ্রাবস্তীর সঙ্গেই মগধের সম্পর্ক সবচেয়ে দৃঢ়। মহারাজ পসেনদি যদি সম্মত হন তো…তার চিন্তার সূত্র ছিঁড়ে যায় দ্বারের ওপর মৃদু করাঘাতের শব্দে। দাস-দাসীরা আসার আগেই সে দ্বার খুলে দেয়। রাত হচ্ছে, এখন কে আসবে? বাইরে ঘন অন্ধকার ও শীত। সমগ্র জম্বুবন জুড়ে সহস্র সহস্র জ্যোতিরিঙ্গণ জ্বলছে নিবছে। ঘোর কৃষ্ণ বসন-পরা মানুষটি প্রবেশ করলেন। লোকপাল। তিষ্য নত হয়ে প্রণাম করল। মহারাজ, এই সময়ে?

মৃদুকণ্ঠে লোকপালবেশী বিম্বিসার বললেন—আশু প্রয়োজন। চণক কোথায়? শীঘ্র ডাকো। সোমা? সোমাই বা কোথায়? তার সঙ্গেও প্রয়োজন আছে।

তাঁর মুখ দেখে সহসাই তিষ্য উপলব্ধি করল ব্যাপার যা-ই হোক, তা অতি গুরুত্বপূর্ণ। সে ভেতরের দ্বারের কাছে গিয়ে একটি দাসীকে বলল—‘ভদ্র লোকপাল এসেছেন, সংবাদ দাও…।’

সে যথেষ্ট উচ্চগ্রামে কথাগুলি বলেছিল। বলবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জিতসোমাকে দেখা গেল। একটু পরেই চণক তার নিজের কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো।

বিম্বিসার বললেন, আসনশালার দ্বার বন্ধ করো।

চণকের উদাসীন মুখ এখন সতর্ক হয়ে উঠেছে, সে বলল—কী সংবাদ মহারাজ? আপনার কোনও বিপদ…?

আমার নয় চণক, তোমার। তোমার এবং সোমার, অসহিষ্ণু স্বরে বিম্বিসার বললেন।

আমার? সোমার? চণকের কণ্ঠে বিস্ময়। তিষ্য এবং জিতসোমা উৎকণ্ঠিত হয়ে তাকিয়ে আছে।

বিম্বিসার বললেন—আজ সকালে চম্পা থেকে দূত এসেছে। অগ্রদূত। কুমার কুনিয় আসছে। সে বলে পাঠিয়েছে তার প্রাসাদ যেন প্রস্তুত থাকে। আরও বলেছে, গতবারে যে গান্ধারদেশীয় রমণী তার প্রাসাদ সজ্জা করেছিল, সে যেন থাকে। বিশেষভাবে তার নৃত্য-গীত উপভোগ করতেই সে এবার রাজগৃহে আসছে।

জিতসোমার মুখ পাংশুবর্ণ হয়ে গেল। চণক ঈষৎ রুক্ষ স্বরে বলল—তা যে হয় না সে কথা কুমারকে বলে দিলেই তো হয়!

বিম্বিসার পদচারণা করতে করতে মুক্ত বাতায়নের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন, তাঁর পিঠ কক্ষে উপস্থিত উৎকণ্ঠিত মানুষগুলির দিকে। তিনি কি তাঁর মুখভাব গোপন করতে চাইছেন?

—কাজটা সহজ নয় চণক, তিনি বললেন, কুমার অত্যন্ত আত্মপর, ক্রোধী।… আমার সন্দেহ হয় এ অন্তঃপুরিকাদের ষড়যন্ত্র। কেউ তার কাছে জিতসোমার কথাটা তুলে দিয়েছে। হয়ত আমাকে বিব্রত করবার জন্যই।

তিনি ধীরে ধীরে চণকের মুখোমুখি হলেন, বললেন—আচার্যপুত্র, তুমি তাকে জানো না, তাই বলছো। কিন্তু তুমিই বা বিলম্ব করছো কেন?

—আর বিলম্ব হবে না মহারাজ। কালই বেরিয়ে পড়ব।

—না না, আমি তোমার যাত্রার কথা বলিনি আচার্যপুত্র, বলছি সোমাকে বিবাহ করতে বিলম্ব করছো কেন? আমি তো অনেক দিন আগেই তোমার হাতে সমর্পণ করেছি তাকে। সখা চণক, মন স্থির করতে তুমি বড় সময় নাও।

—আর সময় নেবো না মহারাজ।

—আমি তাহলে এখুনি বিবাহের আয়োজন করি!

—তা হয় না মহারাজ, সোমা যে আমার ভগ্নী!

তিষ্য চমকে উঠে দেখল তার কুসুমবর্ণ উত্তরীয়ে মুখ ঢেকে গেছে সোমার।

—সোমা তোমার..অর্থাৎ আচার্য দেবরাতের…

—মহারাজ, সোমা তক্ষশিলার প্রখ্যাত রাজনটী দেবদত্তার কন্যা, আচার্য দেবরাতের ঔরসে।

আসনশালা নিস্তব্ধ। একটিমাত্র পতঙ্গ উড়ছে। তার শব্দও যেন কানকে আঘাত করছে। চণক পতঙ্গটির দিকে তাকিয়ে বলল—আমার জননী আমার জন্মের পরেই মারা যান। পিতার হাতেই বড় হয়েছি। সমাবর্তনের পর পিতা আমাকে ডেকে বললেন—দেবী দেবদত্তার কন্যাকে বেদবিদ্যা শিক্ষা দিতে হবে। আমি আর সতীর্থ অনঘ দুজনে এই কাজের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলাম। প্রথম দিন যাত্রার পূর্বে পিতা আমাকে বললেন—বৎস যেখানে যাচ্ছো, শিল্পচারুতা ও সৌন্দর্যের খনি সেই গৃহ। বড় বিভ্রান্তিকর। কন্যাটি কিশোরী। অত্যন্ত মেধাবী এবং অত্যন্ত সুন্দরী। কিন্তু সে তোমার বৈমাতৃক ভগ্নী, মনে রেখো।

সোমার মুখ অশ্রুপ্লাবিত। অস্ফুটে আত্মবিস্মৃতের মততা সে বলল- মহারাজ, হতভাগিনী সোমাকে সে কথা বলতে কেউ মনে রাখেনি। আচার্য দেবরাতের মর্যাদা রাখতে গিয়ে সোমার কথা কেউ ভাবল না। অবশেষে যখন আর্য অনঘর প্রণয় অস্বীকার করলাম, তখন জননী বললেন—কার আশায় এ কাজ করলে সোমা? চণক? সে যে তোমার জেট্‌ঠ! আচার্য দেবরাত তোমার পিতা, তিনিই তোমায় পিতৃধন বেদবিদ্যা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।

চণক নীরক্ত মুখে সোমার দিকে তাকিয়ে বলল—তোমার না জানার কথা আমি কখনও জানতাম না সোমা, ক্ষমা করো।

কক্ষ নিস্তব্ধ। সেই পতঙ্গটিই শুধু উড়ছে। উড়ে উড়ে দীপবর্তিকার কাছে চলে যাচ্ছে। আবার ফিরে আসছে।

চণক বলল—মহারাজ আমার সব আয়োজনই প্রস্তুত, ভাবছিলাম দু- এক দিনের মধ্যেই যাত্রা করব। সোমার এই আশু বিপদের পরিপ্রেক্ষিতে এ ও ভাবছিলাম এইমাত্র, যা হয় হোক সোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবো। আমাদের দুজনের কারওই উপস্থিতবুদ্ধি অল্প নয়। যেতে যেতে যেমন বুঝবো, তেমনই ব্যবস্থা করবো। কিন্তু এখন আর তা হয় না। আমি চলে যাচ্ছি। আপনি রাজা, আপনি মিত্র, যেমন করে হোক আমার ভগ্নীকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করুন। কুমার কুনিয়র লালসার আহুতি সে হবে না। হলে আমি প্রতিশোধ নেবো। মহারাজ, কুমারের আসার পর আমি উপস্থিত থাকলে অনর্থক বিবাদ, রক্তপাত, বন্ধুত্বনাশ হবে…আমি উঠলাম।

সে অন্তঃপুরের দিকে ফিরল।

জিতসোমা তীক্ষ্ণ আর্তস্বরে বলে উঠল—জেট্‌ঠ চণক, আমায় ফেলে রেখে যাবেন না। আমায় সঙ্গে নিয়ে যান। আমি শরণাগত। শরণাগত…বলতে বলতে চণকের প্রতিক্রিয়াহীন মুখের দিকে তাকিয়ে সে স্তব্ধ, বিবর্ণ, প্রস্তর-কঠিন হয়ে যেতে থাকল।

চণক বিষন্ন স্বরে বলল—ভেবে দেখো, আর তা হয় না সোমা। মহারাজ, দেবরাতপুত্রীর আরক্ষার ভার আপনার…আর…আর… তিষ্যকুমারের, যদি সে দায় স্বীকার করতে সে কুণ্ঠিত না হয়।

বলতে বলতে সে আসনশালার দ্বার খুলে ফেলল, বলল—মহারাজ, পশ্চিমপল্লীতে বোধিকুমার নামে এক গুণী ব্যক্তি আছেন রাজ-অনুগ্রহের অপেক্ষায়। সে থামল, কী যেন বলবে বলে তিষ্যর দিকে তাকাল। চোখে চোখ মিলল। তাকাল একবার পাষাণ-মূর্তি নতমুখী জিতসোমার দিকে। তার চোখের তারা যেন গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে যাচ্ছে। ধীরে অন্তঃপুরের দ্বার খুলে সে চলে গেল। সামান্য পরে উদ্যান পথে চিত্তকের মৃদু হ্রেষা শোনা গেল। তার প্রভু পেছনের দ্বার দিয়ে বেরিয়ে গেছেন। শিশির-সিক্ত কাননভূমির ওপর দিয়ে চিত্তকের ক্ষুরের ধ্বনি দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে।

অনেকক্ষণ পরে বিম্বিসার বললেন—তিষ্যকুমার আমাদের দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমার মনে হয়, তুমি আর সোমা গান্ধর্ব বিবাহ করো। এখনই! তারপর দ্রুতগামী অশ্বে শ্রাবস্তী চলে যাও। আমার মুদ্রা তো তোমার কাছে আছেই। এই দুটি স্থবিকায় আমি পর্যাপ্ত সুবর্ণ কার্ষাপণ নিয়ে এসেছি। তিষ্য তোমার অস্ত্র-শস্ত্র, সোমা তোমার বস্ত্রালঙ্কার, পুঁথিপত্র যত শীঘ্র সম্ভব সংগ্রহ করে নাও। কী তিষ্য? সোমা?

নীরব দুটি মূর্তির দিকে চেয়ে অসহিষ্ণু বিম্বিসার বলে উঠলেন।

তিষ্য আচ্ছন্ন স্বরে বলল—আমায় একটু ভাবতে সময় দিন মহারাজ।

—বলছো কী? —বিম্বিসার দ্রুত পদচারণা করতে লাগলেন—কুনিয় যাত্রা করে গেছে। হয়ত সে কাল প্রত্যূষেই এসে উপস্থিত হবে। তিষ্য, কুনিয় যখন তার মাতার গর্ভে ছিল, তার মাতা কোসলদেবীর বড় বিচিত্র দোহদ হয়। তিনি আমার কাধের ওপর দাঁত বসিয়ে দিতেন। লক্ষণপাঠক পণ্ডিতরা বললেন—এই জাতক পিতৃরক্তপিপাসু হবে। কোসলদেবী গর্ভ নষ্ট করবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। আমি বাধা দিই। সোমা, এই আমার বংশের প্রথম পুত্র। পুত্ৰমুখ দেখে অপত্যস্নেহ কাকে বলে জানলাম। অবিমিশ্র আদর, স্নেহ দিয়েছি, দিয়েছি পিতার মতো। লক্ষণপাঠকদের কথা আমি বিশ্বাস করি না। ভগবান তথাগত এ সব বিশ্বাস করতে নিষেধ করেন। কিন্তু কুমার বড় দুর্বিনীত। তাকে উপরাজা করে দিয়েছি। কিন্তু আচার-আচরণ দেখলে মনে হবে, সে রাজাই। বড় অহঙ্কারী। যদি মনে করে কিছু চাই, না নিয়ে ক্ষান্ত হবে না কিছুতেই।

জিতসোমা এতক্ষণ নতমুখে বসেছিল। তার দেহে কোনও প্রাণের লক্ষণও যেন ছিল না। সে এবার ধীরে ধীরে উঠে দাড়াল। শান্ত স্বরে বলল—তিষ্যভদ্রকে তার গোপনীয় রাজকর্মে যেতে দিন মহারাজ। তাকে ভারাক্রান্ত করবেন না।

—আর তুমি? বিম্বিসার উৎকণ্ঠিত স্বরে বললেন

—সোমার ভাগ্যফল সোমাকেই বুঝে নিতে দিন।

—কী করবে তুমি? সোমা হঠকারিতা করো না।

তিষ্য বলল—ভদ্রে, আপনি আমার সঙ্গে শ্রাবস্তী চলুন। সেখানে গিয়ে…

সোমা বলল—আমি গান্ধারী। ভবিতব্যকে ভয় পাই না ভদ্র। আমার নিরাপত্তার জন্য এত জন উৎকণ্ঠিত হচ্ছেন দেখে আমার আত্মধিক্কার জন্মে যাচ্ছে।

সে নত হয়ে মহারাজকে অভিবাদন করে ভেতরে চলে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *