১৯. অ্যারাইজ স্যার ডোনাল্ড

১৯. অ্যারাইজ স্যার ডোনাল্ড

ডন যখন স্বদেশের পথে জাহাজে, তখনই অস্ট্রেলিয়ায় রটে যায়— ব্র্যাডম্যান রাজনীতিতে নামছে। জাহাজেই সেটেলিগ্রাম পেল, গুজবটাকি সত্যি?

অস্ট্রেলিয়ায় তখন এই গুজবটিই একমাত্র আলোচ্য ব্যাপার। কাগজে কাগজে প্রবন্ধ বেরোল, রেডিয়োতে আলোচিত হল, এমনকী অস্ট্রেলীয় পার্লামেন্টেও এই নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। যথারীতি ডনের কাছে তাড়া তাড়া চিঠি এল। কেউ বলছে, রাজনীতিতে নামো, একদিন প্রধানমন্ত্রী হবেই। কেউ লিখল, গত কুড়ি বছরে বিরাট নাম ও খ্যাতি অর্জন করেছ, রাজনীতিতে যেয়ো না। ওটা নোংরা ব্যাপার, দু-এক বছরের মধ্যেই ঘৃণিত হবে, অসম্মানের বোঝা মাথায় চাপবে।

সেই ল্যাঙ্কাশায়ার লিগের ব্যাপারটাই আবার ফিরে এল। এত যে ডামাডোল, ডন কিন্তু চুপ। যথারীতি নিজের মতামত নিজের মনেই রেখে দিল। রাজনীতিতে সেআসেনি।

ডনের জন্য মেলবোর্ন মাঠে বেনিফিট ম্যাচের আয়োজন করা হয়েছে। এক দিকের অধিনায়ক সেনিজে, অন্য দিকের হ্যাসেট। ডন ১২৩ রান করে। যখন ৯৭-এ, জনস্টনের বল হুক করে মিড-অনে বল তোলে। ম্যাককুল ছুটে এসে বলটি হাতে পেয়েও ফেলে দেয়। চেষ্টা করলে কি ক্যাচটা লুফতে পারত না ম্যাককুল? ইচ্ছা করেই কি ফেলে দিল যেহেতু এটা ডনের বেনিফিট ম্যাচ এবং ৫০ হাজার দর্শক মাঠে এসেছে ডনের কাছ থেকে একটি শতরানের প্রত্যাশী হয়ে? হয়তো। হয়তো নয়। ম্যাচটি ‘টাই’ হয়েছিল।

এরপর এল ১৯৪৯-এর পয়লা জানুয়ারি। সবিস্ময়ে পৃথিবী জানল ডন ব্র্যাডম্যান নাইটহুড পাচ্ছে। প্রথম ক্রিকেটার, শুধুমাত্র খেলার জন্যই যাকে এই সম্মান দেওয়া হচ্ছে। ডনের আগে ও পরে কয়েক জন ক্রিকেটার ‘স্যার’ খেতাব পেয়েছেন; কিন্তু অন্য কারণে, শুধুই ক্রীড়া কৃতিত্বের জন্য নয়।

বছরের শেষ দিনটিতে ডন মেলবোর্ন মাঠে এসেছিল খেলা দেখতে। বহুলোক কাছে এসে অভিনন্দন জানায়। ডন জানে কীজন্য এই অভিনন্দন। কেননা নাইটহুড দেওয়া হবে এটা তাকে জানিয়ে রাখা হয়েছে। সেঅবাক হল, অন্য লোক তা জানল কী করে। সরকারিভাবে ঘোষিত হওয়ার আগে এটা জানিয়ে দেওয়া অশোভনতা। তাই ডন মাঠে সারা দুপুর শুধু না জানার ভান করে যায়। সন্ধ্যা থেকে সেপালিয়ে রইল এক বন্ধুর বাড়িতে। রীতি মান্য করায় ডনের আনুগত্য এমনই কঠোর যে সেখানেও সেমুখ খোলেনি। ঘড়িতে রাত বারোটা বাজার পর সেবন্ধুদের খবরটি দেয়। বাড়ি ফেরার পথে ডন খবরের কাগজ কিনে দেখে, তার নাম তালিকায় রয়েছে। ভোরে টেলিফোন এল। মিটাগং-এ বাপের বাড়ি থেকে তার স্ত্রী ফোন করে জানাল, রেডিয়োয় খবরটা শুনেছে।

অ্যাডিলেডে ফিরে এসে ডন অভিনন্দনের বন্যার মুখে পড়ল। টেলিফোন, টেলিগ্রাম আর চিঠির স্রোত। এরই মধ্যে ডনের খুব ভালো লাগে অসম থেকে ৮ বছরের একটি ছেলের চিঠি। ডন অবাক হয়ে ভাবে, কত জনপ্রিয় সেহতে পেরেছে। গাঁয়ের ছেলে, কোথাও কোনো প্রভাব-প্রতিপত্তি নেই, শুধুই নিজের কৃতিত্বে হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক; তারপর এই সম্মান! বস্তুত সামান্য থেকে অসামান্য হয়ে ওঠার প্রতীকরূপে ডনকে অস্ট্রেলিয়াবাসীরা বিবেচিত করে থাকে।

ইংল্যাণ্ডের কাগজে কচকচি শুরু হয়েছিল; স্যার ডন না স্যার ডোনাল্ড, কী বলা হবে? ডনের স্ত্রী অর্থাৎ নতুন লেডি ব্র্যাডম্যান জবাব দিয়ে দেয়, ‘স্যার ডোনাল্ড’। মেলবোর্নে পার্লামেন্ট ভবনে অস্ট্রেলীয় গভর্নর জেনারেলের কাছ থেকে ডন ‘নাইটহুড’ গ্রহণ করে।

ফেব্রুয়ারিতে কিপ্যাক্স ও ওল্ডফিল্ডের জন্য আয়োজিত টেস্টিমোনিয়াল ম্যাচ ডন খেলে সিডনিতে। ৬৫ মিনিটে ৫৩ রান করে তার মাঠকে শেষ অভিবাদন জানায়। অ্যাডিলেডে ফিরে এসে আর্থার রিচার্ডসনের টেস্টিমোনিয়াল হিসাবে চিহ্নিত ভিক্টোরিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচটিতে খেলে। বিল জনস্টনের বলে ৩০ রানে বোল্ড হওয়ার পর ফিল্ড করার সময় পা মুচকে যায়। ১৯৩৮-এ ওভালে এই পা-টিই জখম হয়েছিল। জীবনের শেষ প্রথম শ্রেণির ম্যাচটির শেষের প্রহরগুলি ডন ড্রেসিং রুমে বসে কাটাতে বাধ্য হয়।

খেলার আমন্ত্রণ ডনের কাছে এসেছে কিন্তু পরিষ্কারভাবে সেপ্রত্যাখ্যান করে দেয়। বার বার অবসর নেওয়া আর খেলতে নামা, যারা এই কাজ করে, ডনের ধারণা তারা শুধুই হাস্যকর হয়ে ওঠে। এখন থেকে সেতার শেয়ার দালালি ব্যবসায়েই মন দেবে। তবে হালকা মেজাজের, অ্যাডিলেড শেয়ার দালালদের বাৎসরিক ম্যাচের মতো খেলায় তার আপত্তি নেই।

এখন থেকে ডন তার শেয়ার দালালি ব্যবসায়েই ব্যস্ত থাকল। অ্যাডিলেডে এলেই আগন্তুকদের চোখে পড়ে ট্রামওয়ে টার্মিনালের কাছে ‘ডন ব্র্যাডম্যান অ্যাণ্ড কোং’ সাইনবোর্ডটি। অন্যান্য ব্যবসায়েও ডন আগ্রহী। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টরপদেও তাকে দেখা গেল। শরীর পোক্ত রাখার জন্য সপ্তাহান্তে এখন সেগলফ খেলে। বাড়িতে বিলিয়ার্ডস টেবিল পাতল এবং কয়েক জন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে বিলিয়ার্ডস খেলে সন্ধ্যা কাটায়। ক্রিকেটে সেনির্বাচক, দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার এবং জাতীয় দলের।

শুধু একটি ব্যাপার ডনের মানসিক শান্তি হরণ করেছে— তার মেয়ে শার্লি পঙ্গু। ছেলে জন বাবার মতোই ক্রিকেটে আগ্রহী এবং স্কুলে ভালোই নাম করে ব্যাটসম্যান হিসাবে। কিন্তু ১৪ বছর বয়সে হঠাৎ সেআক্রান্ত হল পোলিওয়। কোনো সান্ত্বনাই ডনকে কেউ তখন দিতে পারেনি।

নির্বাচকের পদ ডন ছেড়ে দিল। তার কথা : ‘জনকে আমায় এখন সময় দিতেই হবে; সুতরাং দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকার মতো কাজ আমি নিতে পারব না। আমার পরিবারের, ক্রিকেটের এবং নিজের প্রতি কর্তব্য পালন করতে হলে নির্বাচকের পদটি আমার অন্য কাউকে ছেড়ে দেওয়া উচিত।’

কিন্তু এক বছরের মধ্যেই অকল্পনীয় ব্যাপার ঘটল। জন সুস্থ হয়ে উঠেছে। পরের বছরই সেক্রিকেট, সাঁতার এবং দৌড় শুরু করল। ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮-র মধ্যে স্প্রিন্ট এবং হার্ডলসে অস্ট্রেলীয় স্কুল ও কলেজের কয়েকটি নতুন রেকর্ডও করল। ১৯৫৯-এ কুড়ি বছর বয়সে জন প্রথম শতরান করে আন্তঃকলেজ ম্যাচে। তার প্রত্যাবর্তন তার বাবার থেকেও বিস্ময়কর।

ডন আবার ফিরে গেল নির্বাচকপদে। কিন্তু স্বাস্থ্য আর পুরোপুরি ফিরল না। ১৯৫৪-য় সেস্টক এক্সচেঞ্জ থেকে পদত্যাগ করে। তখন সেবলে, ‘গত তিরিশ বছর ধরে শরীর ও মনে আমার যে ধকল ও টানাপোড়েন গেছে তা একমাত্র আমার ঘনিষ্ঠরাই জানে। সহজ শান্ত জীবনযাপনের জন্য ডাক্তারের নির্দেশে অবাক হবার কিছু নেই, এটা বিস্বাদকরও মনে হচ্ছে না। স্টক এক্সচেঞ্জের কাজের দায় নামিয়ে দিতে হচ্ছে বলে আমি দুঃখিত।’ ডনের অন্যান্য বিবৃতির মতো এতেও অনেক অকথিত বস্তু রয়ে গেল।

অনেকের কাছে মনে হতে পারে ডন সব কিছুই সহজে পেয়েছে। তার খেলার প্রতিভাই তাকে যশ, সম্মান ও বিত্ত এনে দিয়েছে।

ক্রিকেটই যে তাকে জীবনের অন্যান্য দিকের পথ খুলে দিয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রত্যেকটিতে সফল হওয়ার জন্য তাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। ভুললে চলবে না, ছুতোরের ছেলেটিকে শিক্ষিত হয়ে ওঠার জন্য একা একাই বই পড়ে রুচি ও জ্ঞান আহরণ করতে হয়েছে। ‘গেঁয়ো ক্রিকেটার’ বলে একদা তাকে হেনস্থা সহ্য করতে হয়েছে। রোগ ও ভগ্নস্বাস্থ্য এবং দুঃখদায়ক পারিবারিক ঘটনার সঙ্গে তাকে লড়াই করতে হয়েছে। যখন তার চাকুরিদাতা দেউলিয়া হয়ে গেল তখন নিজের ব্যাবসা প্রচন্ড পরিশ্রমে সেগড়ে তোলে।

ডনের ক্রিকেট লক্ষ লক্ষ মানুষের আনন্দের কারণ হয়েছে বটে, কিন্তু তা শুষে নেয় তার দেহশক্তির ভান্ডার। তবু সারাজীবন ডন মাথা উঁচিয়ে চলেছে—কোনো রাখঢাক নেই, আত্মমর্যাদায় দৃপ্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *