১৭. শততম শতরান

১৭. শততম শতরান

এখন ডনের প্রত্যাবর্তন সম্পূর্ণ। মাঠের চারিদিকে দর্শকদের অভিনন্দন আবর্তিত হচ্ছে। ভারত থেকে অস্ট্রেলিয়ায় এই প্রথম ক্রিকেট দল আসছে, তাই কৌতূহল অন্যদের মতো ডনেরও প্রবল। দুই দেশের ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের মধ্যে খেলার ব্যাপারে স্থিরীকৃত শর্তে একটি বিষয়ে দ্বিমত হয়। ভারত চায় উইকেট অনাচ্ছাদিত থাকবে। অর্থাৎ বৃষ্টি হলে ভিজে উইকেটের সুযোগ নেবে। ডনের মতে, ভারত ভুল করেছে। ভিজে উইকেটে খেলার অভিজ্ঞতা বা দক্ষতা ভারতীয়দের থেকে অস্ট্রেলীয়দের একটু বেশিই। তা ছাড়া তাড়াতাড়ি খেলা শেষ হলে বা একপেশে জয় ঘটলে দর্শক কমে যাবে, ফলে আর্থিক লোকসান ঘটবে। ডনের এইসব যুক্তি মেনে নিয়েও অমরনাথ কিন্তু উইকেট আচ্ছাদনে রাজি হল না। তবে অমরনাথের সোজাসুজি কথাবার্তা, পরিচ্ছন্ন অমায়িক সহযোগিতামূলক আচরণ ডনকে খুশি করে। সেঅবাক হয়ে ভাবে, এমন লোককে ১৯৩৬-এর ইংল্যাণ্ড সফর থেকে কেন ভারতে ফেরত পাঠানো হয়েছিল।

১৯৪৭-৪৮ মরসুমে ডন প্রথম ম্যাচ খেলল অ্যাডিলেডে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে ভারতীয় দলের বিরুদ্ধে। প্রথম ইনিংসে ১৫৬ রান করে মাঁকড়ের বলে সরবটের হাতে ক্যাচ আউট হয়। দ্বিতীয় ইনিংসে মাঁকড়ের বলে প্রবীর সেন তাকে স্টাম্প করে ১২ রানে। ডন জীবনে ১২ বার স্টাম্পড হয়েছে, এটি একাদশতম। ডনের এই শতরান প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তার ৯৮তম। এই খেলা থেকেই তার ধারণা হয়, ভারতীয় দলের বিরুদ্ধে টেস্টে অস্ট্রেলিয়া প্রচুর রান করবে প্রধানত দুটি কারণে : ওদের প্রকৃত ফাস্ট বোলার এবং উচ্চ শ্রেণির প্রকৃত স্পিনার নেই আর ফিল্ডিংয়ে অত্যন্ত দুর্বল।

ভিক্টোরিয়ার বিরুদ্ধে ডনের ১০০, তার জীবনের ৯৯তম শতরান। এবার সিডনিতে ভারতীয়দের বিরুদ্ধে অস্ট্রেলীয় একাদশের অধিনায়করূপে ডন খেলবে। আর একটি শতরান করলেই শততম শতরানটি হবে। তখনও পর্যন্ত ১০ জন ইংরেজ ছাড়া আর কেউ এই কৃতিত্ব অর্জন করেনি। স্বভাবতই ডন ব্যগ্র এই সম্মানের একাদশতম অধিকারী হওয়ার জন্য। সিডনি মাঠেই সেশতরানটি চায়, কেননা এই মাঠকেই সেসবথেকে ভালোবাসে। এই মাঠের দর্শকদের কাছ থেকে সেবরাবরই সহানুভূতি ও স্নেহ পেয়েছে।

সিডনিতে ভারত ৩২৬ করার পর অস্ট্রেলিয়া ব্যাট শুরু করে ব্রাউন ও রজার্সকে হারাল ৩১ রানে। ডন ও কিথ মিলার ব্যাট করছে। দর্শকের ভিড় বাড়ছে। তারা দেখতে এসেছে, ডন হয়তো শততম শতরানটি করবে।

ডন ৯০-এ। আর দশটি রান দরকার। ডন একটু যেন নার্ভাস বোধ করল। একবার দ্বিতীয় রান নিতে গিয়ে প্রায় রান আউট হয়ে যাচ্ছিল।

অবশেষে ৯৯-এ। চা-পানের বিরতি এক ওভার পরেই।

অমরনাথ হঠাৎ বাউণ্ডারি থেকে কিষেণচাঁদকে ডাকল বল করার জন্য। ডন বিভ্রান্ত বোধ করল। এই লোকটি তো কখনো বল করেনি, কী ধরনের বোলার! অমরনাথ কূটচাল চেলেছে। পোক্ত ব্যাটসম্যানরাও ঠকে যেতে পারে। ডন অত্যন্ত সমীহভরে কিষেণচাঁদের প্রথম বলটি দেখে খেলল। মিড অনে দ্বিতীয় বলটি পাঠিয়েই একটি রান নিল। দর্শকরা স্বতঃস্ফূর্ত অভিনন্দনের বন্যায় মাঠ প্লাবিত করল। ডনের ১০০, মিলারের ৬৩। অস্ট্রেলিয়া ৪৭ ওভারে ১৮৮/২।

১০১ রান নিয়ে চা-এর পর ডন আরও ৭১ রান যোগ করল ৪৫ মিনিটে। অর্থাৎ প্রথম ৫০ রান ৭৮ মিনিটে, পরের ১০০ রান ৮৩ মিনিটে। তার ১৭২ রান হয় ১৭৭ মিনিটে। শততম শতরানটি এসেছে ২৯৫টি ইনিংসে।

১৯৪৭-এর ২৮ নভেম্বর ব্রিসবেনে প্রথম টেস্ট ম্যাচ শুরু হল। প্রথম দিনে ডন ১৬০ অপরাজিত। গত মরসুমের থেকে শরীর অনেক তাজা হয়ে উঠেছে। রাতে বৃষ্টি এল। পরদিন এক ঘণ্টার জন্য খেলা হয়। ডন ১৮৫ রানে হিট উইকেট হয় অমরনাথের বলে। সেব্যাট তুলে এত পিছিয়ে গেছিল ব্যাকফুট ড্রাইভ করতে যে, ব্যাট নামাবার সময় উইকেটে আঘাত করে পিছন থেকে। তৃতীয় দিনে লাঞ্চের পর খেলা শুরু হয়। অস্ট্রেলিয়া ৮ উইকেটে ৩৮২ রানে ইনিংস ঘোষণা করে দেয়। চতুর্থ দিনে খেলা হয়েছিল এক ঘণ্টার জন্য। পঞ্চম দিনে খেলা হতে পারেনি। অনাচ্ছাদিত ভিজে পিচে ভারতের ইনিংস শেষ হল ৫৮ রানে। টোসাক দুই ইনিংস বল করে ৬/২৯ ও ৫/২। দারুণ বোলিং। ভারত দ্বিতীয় ইনিংসে ৯৮ করায় অস্ট্রেলিয়া ইনিংস ও ২২৬ রানে জিতে যায়।

দ্বিতীয় টেস্ট সিডনিতে। ভারত টসে জিতে ব্যাট করতে নামার এক ঘণ্টা পরেই বৃষ্টি। খেলা আবার শুরু হলে পিচ ভারতকে সুবিধা করতে দিল না। ১৮৮ রানে ইনিংস শেষ। ফাড়কর করে ৫১। অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসের শুরুতেই চাঞ্চল্য।বিনু মাঁকড় বল করতে আসার সময় বেল ফেলে দিয়ে ব্রাউনকে আবার রান আউট করেছে। প্রথম বার করেছিল কুইন্সল্যাণ্ডের সঙ্গে খেলায়, বল করার আগেই ব্রাউন ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে গেছিল। মাঁকড়ের স্পোর্টসম্যানশিপ নিয়ে কথা উঠতে ডন জানাল, মাঁকড় কিছু অন্যায় করেনি। আইনে যা আছে সেতাই করেছে, নয়তো আইনটা আছে কী করতে? অন্যায় সুযোগ নিয়েছিল ব্রাউনই, তাই শাস্তি পেয়েছে। তা ছাড়া মাঁকড় তো আগেই একবার হুঁশিয়ারি দিয়েছিল।

বৃষ্টিভেজা পিচে ভারত চটপট অস্ট্রেলিয়ার ইনিংস ১০৭ রানে খতম করে দেয়। ডন করে ১৩ রান। অস্ট্রেলিয়াকে তাড়াতাড়ি আউট করে ভারত ভুল করেছিল। পিচ তা ছাড়া খারাপ এবং ভারতকে সেই পিচে ব্যাট করতে নামতে হল। দিনশেষে ভারত ৭ উইকেটে ৬১। এরপর আবার বৃষ্টি এবং ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়। ৩০ ঘণ্টা খেলার ১০ঘণ্টাও খেলা হল না।

মেলবোর্নে তৃতীয় টেস্ট ম্যাচ। অস্ট্রেলিয়া ৩৯৪ রানে ইনিংস শেষ করে। ডনের রান ১৩২। ভারতের ইনিংস যখন ৯ উইকেটে ২৯১ (মাঁকড় ১১৬), অমরনাথ বৃষ্টি নামতে ইনিংস ঘোষণা করে দিল। ডনের মনে পড়ল ১৯৩৬-এ ‘গাবি’ অ্যালেনের ইংল্যাণ্ড দলের সঙ্গে টেস্ট ম্যাচটির কথা। সেই একই পন্থা নিয়ে সেদুই বোলার জনসন ও ডুল্যাণ্ডকে ইনিংস শুরু করতে পাঠাল কালক্ষেপের জন্য— পিচ ভালো হয়ে ওঠার জন্য সময় নিতে। জনসন আউট হতে নামল জনস্টন এবং তারপর সিড বার্নেস। চার উইকেটে ৩২ থেকে মরিস ও ডন জুড়ি রান নিয়ে গেল ২৫৫-য়। মরিস ১০০ ও ডন ১২৭ অপরাজিত। তখন আবার বৃষ্টি নেমেছে। টেস্টের দুই ইনিংসে ডন এই প্রথম দুটি শতরান করল। চতুর্থ দিনেই খেলা শেষ হল ভারতের দ্বিতীয় ইনিংস ১২৫ রানে কাদা-পিচে শেষ হওয়ায়। অস্ট্রেলিয়া জিতল ২৩৩ রানে। পিচ আচ্ছাদিত রাখার জন্য ডনের প্রস্তাবে কর্ণপাত করলে ভারতের হয়তো এতটা হেনস্থা হত না।

অ্যাডিলেডে চতুর্থ টেস্ট ম্যাচ খেলা হয় খটখটে কড়া রোদে। টসে জিতে অস্ট্রেলিয়া রান তুলল ৬৭৪। ডন করল ২০১। এটি তার জীবনের ৩৭তম দ্বিশত। এতদিন সর্বাধিক দ্বিশত রান করার রেকর্ড ছিল ইংল্যাণ্ডের ওয়ালি হ্যামণ্ডের ৩৬টি। ভারত দুই ইনিংসে ৩৮১ ও ২৭৭ করে ইনিংস ও ১৬ রানে হেরে গেলেও বিজয় হাজারে নিজেকে বিরাট ব্যাটসম্যান হিসাবে প্রতিপন্ন করে দুই ইনিংসে ১১৬ ও ১৪৫ রান দ্বারা। প্রথম ইনিংসে ফাড়কর করে ১২৩। দ্বিতীয় ইনিংসে লিণ্ডওয়াল মারাত্মক বল করে সাতটি উইকেটে পায় ৩৮ রানে। হাজারের খেলা সম্পর্কে ডন প্রথম থেকেই শ্রদ্ধাশীল ছিল। বিশেষ করে হাজারের স্ট্রোক দেওয়ার কেতাবি ধরন, খেলার জমাটি গড়ন, ডনের মনে এমনই রেখাপাত করে যে নির্দ্বিধায় সেহাজারেকে ‘গ্রেট প্লেয়ারদের’ পর্যায়ের স্থান দেয়। এই টেস্টে ১৯ বছরের একটি ছেলে প্রথম খেলতে নামে। নিল হার্ভে। রঙ্গচারির বলে ১৩ রানে এলবিডবল্যু আউট হয়।

ইংল্যাণ্ড সফরে যাওয়ার জন্য অস্ট্রেলীয় দলগঠনের সময় এসে পড়েছে। যাবে কি যাবে না, এই নিয়ে ডন চিন্তায় পড়ল। যাওয়ার ইচ্ছা খুবই, কিন্তু ব্যক্তিগত কাজকর্ম ছেড়ে প্রায় আট মাসের জন্য ক্রিকেট নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হলে তাকে অনেক কিছুই ভাবতে হয়। যেমন, বয়স প্রায় চল্লিশে পৌঁছেছে। সফরের ধকল সহ্য করার পক্ষে বয়স একটু বেশিই। মাত্র তিন জন অস্ট্রেলীয় বেশি বয়সে ইংল্যাণ্ড সফরে অধিনায়কত্ব করেছে : ১৮৯৩-এ ব্ল্যাকহ্যাম (৪০), ১৯১২-য় সিড গ্রিগরি (৪২) ও ১৯২১-এ আর্মস্ট্রং (৪২)।

১৯২৮-এর টেস্ট দলে যাদের সঙ্গে ডন খেলেছে তারা সবাই অবসৃত। ডন জানে তার ২০ বছরের অভিজ্ঞতার দাম আছে, এটা অস্ট্রেলিয়ার কাজে লাগবে। কিন্তু ইংল্যাণ্ডে আর একটি সফরে অধিনায়কত্বের বিরাট ধকলটাও যে কেমন হবে তা সেজানে। ১৯৩৮ মরসুম শেষে নিজেকেই সেবলেছিল, ‘আর কখনো নয়।’ এখন আবার তার মনে পড়ল দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা, বক্তৃতা দেওয়া, সাক্ষাৎকার ও ফোটো তোলানোর ঝামেলা, ভিড়-জনতা, চিঠির উত্তর লেখা, খেলার কৌশল নির্ধারণের জন্য চিন্তা এবং সর্বোপরি ব্যাট হাতে মাঠে নামা।

যুদ্ধপূর্ব সাফল্য অতিক্রম করা আর তার পক্ষে সম্ভব নয়। ব্যর্থও হতে পারে। প্রাপ্তির কিছু নেই, আছে হারানোর ভয়। যে-খেলোয়াড় জানে না কখন তাকে খেলা থেকে সরে যেতে হবে, তার থেকে করুণাকর আর কেউ হতে পারে না।

ডন জানে, এখন সেখেলা ছেড়ে দিতে পারে। খবরের কাগজ থেকে প্রচুর টাকার, কয়েক বছরে তার মোট আয়ের পরিমাণ যত, প্রায় তত টাকার প্রস্তাব এসেছে সাংবাদিক হয়ে ইংল্যাণ্ডে গিয়ে এই সফর সম্পর্কে লেখার জন্য। কেন সেখেলা ছেড়ে দেবে না? স্বপক্ষে যত যুক্তি আছে সব ক-টি নিয়েই ডন ভাবল।

কিন্তু সব যুক্তি ভেসে গেল কর্তব্যবোধের কাছে। ক্রিকেট তাকে অনেক কিছু দিয়েছে, ঋণশোধ করতেই হবে। দেশেরও এখন অধিনায়ক দরকার, এখন খেলা থেকে বিদায় নেওয়া অনুচিত।

ভারতের সঙ্গে পঞ্চম টেস্ট ম্যাচ শুরুর আগের রাতে মেলবোর্নে ডন সাংবাদিক সম্মেলনে বলল, ‘ইংল্যাণ্ড সফরে যেতে রাজি। এইসঙ্গে জানাচ্ছি, ভারতের বিরুদ্ধে খেলাটিই অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে আমার শেষ প্রথম শ্রেণির ম্যাচ, ইংল্যাণ্ড সফর শেষ হলেই ক্লাব, রাজ্য এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেব।’

পঞ্চম টেস্ট ম্যাচে ব্যাট করার সময় ডন ফাইব্রোসাইটিসে আক্রান্ত হয়ে ৫৭ রানে অবসর নেয়। অস্ট্রেলিয়া ৮ উইকেটে ৫৭৫ রানে ইনিংস ঘোষণা করে (হার্ভে ১৫৩, ব্রাউন ৯৯); ভারত ৩৩১ (মাঁকড় ১১১) ও নিখুঁত পিচে ৬৭। ইনিংস ও ১৭৭ রানে জিতে অস্ট্রেলিয়া সিরিজ জিতল ৪—০ ম্যাচে। মরসুমে ডন ১২ ইনিংসে আটটি শতরান করে গড় রাখল ১২৯.৬। অষ্টম শতরানটি ইংল্যাণ্ড যাত্রার প্রাক্কালে পার্থে, পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। টেস্টে ছয় বার ব্যাট করে চারটি শতরান-সহ মোট রান ৭১২; গড় ১৭৮.৭৫। একটি সিরিজে টেস্ট ইতিহাসে এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গড়। প্রথমটিও ডনেরই, দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে (২০১.৫০)।

মরসুমে ডনকে বেশ হাসিখুশিই দেখাল। দর্শকরা দেখল, মাঠে সেসহখেলোয়াড়দের সঙ্গে হেসে কথা বলছে, অনেক সামাজিক হয়েছে এবং নির্দয়ভাবে খেলাটা যেন কমেছে। ডন নরম হয়ে এসেছে। এইটিই তার ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর বছর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *