১৪. ইংল্যাণ্ডে তৃতীয় বার

১৪. ইংল্যাণ্ডে তৃতীয় বার

ডন যখন অস্ট্রেলীয় দল নিয়ে ১৯৩৮-এ ইংল্যাণ্ডে এল তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালোছায়া ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ছে। জাহাজে আসার সময় নেপলস বন্দরে তারা গুনল ৩৬টি ডেস্ট্রয়ার, ৮টি ক্রুজার ও ৭২টি সাবমেরিন। ডকের ধারে কুচকাওয়াজে ব্যস্ত নাবিকরা। লণ্ডনে পার্কে ও খেলার মাঠে বিমান আক্রমণ আশ্রয়স্থল তৈরি হচ্ছে, ট্রেঞ্চ খোঁড়া হয়েছে।

তাই বলে খেলার মাঠে দর্শকের কমতি হল না। অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটারদের খেলা দেখতে মাঠ ঠিকই ভরে গেল। বলা বাহুল্য, প্রধান আকর্ষণ ডন। ইংল্যাণ্ডে তখন সেঅসম্ভব খ্যাতিমান। ‘হুজ হু’ পরিচিতি গ্রন্থে ডনের জন্য তখন ২১ লাইন বরাদ্দ অর্থাৎ হিটলারের থেকে আট লাইন কম, স্ট্যালিনের থেকে সতেরো লাইন বেশি। ডনের পায়ে পায়ে তখন ছেলের পাল ঘোরে। রাস্তায় লোকজন দাঁড়িয়ে গিয়ে তাকায়। হোটেলে অনেকেই দেখা করতে আসে পুরোনো বন্ধুর ভান করে।

জাহাজে ডন ফ্লু-তে আক্রান্ত হয়ে বেশিরভাগ সময় বিছানাতেই কাটায়। তার উপর এক দুর্ঘটনা, দলের সবথেকে ছোটো সিডনি বার্নেস পিছল ডেকে পড়ে গিয়ে কবজির হাড় ভাঙে জিব্রাল্টারে। জুনের শেষে দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচ শেষ হওয়ার পর বার্নেস সফরে প্রথম ব্যাট করে। জাহাজে অসুস্থ হয়ে বিছানায় কাটালেও ডন মানসিক বিশ্রাম নেয়নি। কাগজ-পেনসিল নিয়ে বোলিং প্ল্যান ছকেছে, ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের স্কোর আর কীভাবে তারা আউট হয়েছে তাই নিয়ে বিশ্লেষণ করেছে, বিভিন্ন ধরনের উইকেটে ও বিভিন্ন ধরনের বোলারের বিরুদ্ধে তাদের দক্ষতা সম্পর্কিত রিপোর্টও গভীর মনোযোগে পড়েছে। জাহাজে সামাজিকতা রক্ষার জন্য মেলামেশার থেকেও তার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল এই কাজগুলি করা।

ডন ইংল্যাণ্ডে খেলতে ভালোবাসে। অস্ট্রেলিয়ার থেকে ইংলিশ উইকেট মন্থর। তার ব্যাটিং প্রধানত পিছিয়ে গিয়ে খেলার ওপরই ভিত্তি করে, ফলে মন্থর উইকেট তার স্টাইলেরই উপযোগী। ইংল্যাণ্ডের মৃদু কোমল আলোয় বল দেখতেও তার সুবিধা হয়।

যথারীতি সফরের প্রথম খেলা উরস্টারে। প্রথম দুটি সফরের মতো ডন এবারও সফর শুরু করল দ্বিশত রান দিয়ে। ২৯০ মিনিটে ২৫৮ রান, তাতে ৩৩টি চার। উরস্টারশায়ারের বিরুদ্ধে প্রথম দুটি সফরে করেছিল ২৩৬ ও ২০৬। এই ত্রি-সাফল্যের জন্য সেখানকার এক চিনামাটির দ্রব্যনির্মাতা বিশেষ এক ফুলদানি তৈরি করে ডনকে উপহার দেয়। সেটির একদিকে আঁকা আছে উরস্টার মাঠের ছবি— দর্শকরা, নদীতীরের গাছের সারি, অনবদ্য উরস্টার ক্যাথিড্রাল এবং উইকেটে ব্যাটিংরত ডন ব্র্যাডম্যান। অন্য দিকে উৎকীর্ণ আছে প্রশংসাবাক্য।

সফর শুরু করে ২৭ মে পর্যন্ত ডন সাতটি ম্যাচে এক ইনিংস করে খেলে সাত ইনিংসে করে ১,০২১ রান। মরসুমের শুরু থেকে মে মাসের ৩১ তারিখের মধ্যে হাজার রান এখন পর্যন্ত সাত জন পূর্ণ করতে পেরেছে। কিন্তু ডনের মতো দু-বার (১৯৩০ ও ১৯৩৮) কেউ পারেনি। অন্য ছয় জন হলেন— গ্রেস (১৮৯৫), টম হেওয়ার্ড (১৯০০), ওয়ালি হ্যামণ্ড (১৯২৭), চার্লি হ্যালোজ (১৯২৮), বিল এডরিচ (১৯৩৮) ও গ্লেন টার্নার (১৯৭৩)। এঁদের মধ্যে গ্রেস, হ্যামণ্ড ও হ্যালোজ ছাড়া বাকি সবাই এপ্রিল থেকে ব্যাটিং শুরু করেন। গ্রেস সবথেকে দ্রুত, ২২ দিনে হাজার রান করেন।

ডনের ১৯৩৮-এর স্কোর : ২৫৮, ৫৮, ১৩৭, ২৭৮, ২, ১৪৩ ও ১৪৫ = ১,০২১ রান। ডনের হাজার রান পূর্ণ হয় হ্যামশায়ারের সঙ্গে খেলায়। ১৯৩০-এর মতো এবারও বৃষ্টি সম্ভাবনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাকে এই সাফল্য অর্জন করতে হয়েছে। পরের ম্যাচ মিডলসেক্সের সঙ্গে। তাদের বিল এডরিচের এখন পর্যন্ত ৯৮১ রান ১৩ ইনিংস খেলে। প্রথমে অস্ট্রেলিয়া তারপর মিডলসেক্স ব্যাট করে এবং এডরিচ ৯ রান করে আউট হয়। আর মাত্র দশটি রান যদি দ্বিতীয় ইনিংসে পায় তাহলে সেঅসাধারণ সম্মান অর্জন করবে।

কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংস খেলার সুযোগ মিডলসেক্স পাবে কি! নির্দয় কঠিন চরিত্ররূপে অভিহিত ডন ওকে সুযোগ দেবার জন্য অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংস ঘোষণা করে দিল মাসের শেষ দিনে ৩১ মে। দর্শকরা প্রথমে ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। তারা চেঁচামেচি করে ডনের আদ্যশ্রাদ্ধ শুরু করে দেয়। তারপর যখন বুঝল ডন কেন ইনিংস ঘোষণা করেছে, তখন আবার চিৎকার ডনকে সাধুবাদ জানিয়ে। এডরিচের প্রতিটি স্ট্রোকে তারা উল্লাসে ফেটে পড়তে লাগল। শেষ পর্যন্ত সেঅপরাজিত রইল ২০ রানে। অর্থাৎ ৩১ মে এডরিচের ১,০১০ রান।

এই খেলাতেই ডনের পিঠে আবার যন্ত্রণা শুরু হয়। ডাক্তারের উপদেশে প্রথম টেস্ট ম্যাচ পর্যন্ত সেবিশ্রাম নেয়। অবশ্য তখন সেজানত না এই যন্ত্রণাটাই তার খেলোয়াড় জীবনকে সংক্ষেপিত করবে। তবে প্রথম টেস্ট পর্যন্ত বিশ্রাম নেওয়াটা ভালোই হয়েছিল, কেননা তার সহনশক্তি ও মনোনিবেশ ক্ষমতা আবার যাচাই হয় এই টেস্ট ম্যাচে।

নটিংহামে নিখুঁত ব্যাটিং উইকেটে হ্যামণ্ড টসে জেতে। মাত্র এক রানের জন্য চার্লি বার্নেট রেকর্ড বইয়ে তিন অস্ট্রেলীয়— ট্রাম্পার, ম্যাকার্টনি ও ব্র্যাডম্যানের পাশে নিজেকে রাখতে পারেনি। টেস্ট ম্যাচের প্রথম দিনে লাঞ্চের আগে বার্নেট ৯৯ রানে অপরাজিত থাকে। অস্ট্রেলীয়রা তাকে কিছুতেই শতরান পূর্ণের জন্য একটি রান করতে দেয়নি।লাঞ্চের পর অবশ্য বার্নেট ১২৬ রান করে আউট হয়। হাটন ও কম্পটনের এটি ছিল অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলা। এরা দুজনেই শতরান করে যথাক্রমে ১০০ ও ১০২ এবং তারপরও এডি পেন্টার ২১৬ রানে অপরাজিত থাকে। ইংল্যাণ্ড ইনিংস হ্যামণ্ড ৮ উইকেটে ৬৫৮ রানে ঘোষণা করে দেয়।

অস্ট্রেলিয়া জবাব দিল ৪১১ রান করে। ২৪৭ রানে পিছিয়ে অর্থাৎ ফলো অন এড়ানো গেল না। ডন করেছিল ৫১ কিন্তু স্ট্যানলি ম্যাককেবের ২৩২, ডনের মতে স্তম্ভিতকারী ইনিংস, এমন অসাধারণ ব্যাটিং আর কখনো দেখা যায়নি। অস্ট্রেলিয়া ছয় জনকে হারিয়ে ১৯৪, ম্যাককেবকে খেলতে হয়েছিল উইকেট-কিপার বেন বার্নেট ও তিন বোলার ওরিলি, ম্যাককরমিক ও ফ্লিটউড স্মিথকে জুড়ি নিয়ে। যতক্ষণ সেউইকেটে ছিল অস্ট্রেলিয়ার ওঠে ৩০০ রান, তার মধ্যে ২৩০ মিনিটে তার নিজেরই ২৩২। তাতে ৩৪টি চার ও ১টি ছয় অর্থাৎ ১৪২ রান এসেছিল ৩৫টি স্ট্রোক থেকে। খেলা দেখতে দেখতে ডন আর পারছিল না মাঠের দিকে তাকাতে। অকল্পনীয় অসম্ভব ব্যাটিংয়ের মহিমায় তার দু-চোখ জলে ভরে গেছল। নেভিল কার্ডাস তাঁর অনুপম গদ্যে ডনের মতো একই কথা বলেছেন :

হৃদয় আলোড়নকারী ক্রিকেট। তার ব্যাটের নিখুঁত স্পর্শ নান্দনিক বোধকে নাড়া দেয়। ম্যাককেব ইংলিশ আক্রমণকে ধ্বংস করে আভিজাত্যিক বিনয় সহকারে, সুরুচি দ্বারা।

ডগলাস রাইটের তিন ওভারে ম্যাককেব নেয় ৪৪ রান এবং শেষদিকে ৭২ রান করে ২৮ মিনিটে, শেষ উইকেটে যোগ করে ৭৭ রান। তবু ফলো অন এড়ানো গেল না। জয়ের জন্য নয়, ম্যাচ বঁাচানোর জন্য এবার ডনকে খেলতে হবে। উইকেটে ক্ষয় ধরেছে, বোলারদেরই প্রাধান্য এখন। ম্যাচের শেষ পর্যন্ত ডন ব্যাট করল অসাধারণ সংযমে, প্রকৃতি-বিরুদ্ধ রক্ষণাত্মক মেজাজে নিখুঁত টেকনিকে, শুধু দলের মর্যাদা রক্ষার জন্য। তাকে যোগ্য সাহচর্য দেয় বিল ব্রাউন ১৩৩ রান করে। এমন ডনকে লোকে আগে কখনো দেখেনি। সারাদিন ব্যাট করে ১৪৪ রানে অপরাজিত। পিঠের ব্যথাটাও আবার চাগিয়ে উঠেছে। পিচ থেকে ধুলোর কণা চোখে গিয়ে চোখ করকর করছে। কিন্তু ম্যাচ তাকে বঁাচাতেই হবে। অত্যন্ত বিরক্তিকর ইনিংস সেখেলল, যে-খেলা দর্শকরা দ্রুত মন থেকে তাড়িয়ে দিতে পারলে হাঁফ ছাড়বে। কিন্তু ডনের কাছে এই ইনিংস তার সেরাগুলির অন্যতম, বীরত্ব ব্যঞ্জনায় শ্রেষ্ঠত্বের থেকে কোনোমতেই ন্যূন নয়। অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংসে ৬ উইকেটে ৪২৭ রান করার পর খেলা শেষ হয়।

লর্ডসে দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচও অমীমাংসিত রয়ে যায়। দ্বিতীয় ইনিংসে ডন ১০২ রানে অপরাজিত থাকে ১৪০ মিনিট ব্যাট করে। এই শতরান পর পর পাঁচটি টেস্ট ম্যাচে তার পঞ্চম শতরান। তা ছাড়া তখন ইঙ্গ-অস্ট্রেলীয় দুই দেশের মধ্যে টেস্ট খেলায় জ্যাক হবসের ৩,৬৩৬ মোট রানের রেকর্ডটিও ডন অতিক্রম করে। এই টেস্টে হ্যামণ্ড ২৪০ করে এবং অস্ট্রেলিয়ার ৪২২ রানের প্রথম ইনিংসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ব্যাট করে বিল ব্রাউন ২০৬ রানে অপরাজিত থেকে যায়। দ্বিতীয় ইনিংসে ইংল্যাণ্ডের অর্ধেক ব্যাটসম্যান ৭৬ রানে ফিরে আসার পর তরুণ কম্পটন অসাধারণভাবে ৭৬ রান না করলে হয়তো অস্ট্রেলিয়া জেতার সুযোগ পেত। ইংল্যাণ্ড করে ৮ উইকেটে ২৪২। প্রসঙ্গত বলে রাখি, লর্ডস প্যাভিলিয়নে বসেই ডন প্রথম টেলিভিশন সেট চোখে দেখে। দেখেছিল উইম্বলডন টেনিস। টিভি-র তখন শৈশবকাল।

তৃতীয় টেস্ট ম্যাচটি শুরুই হল না। মাঠে একটা বলও পড়ল না। দুই অধিনায়ক টস করারও দরকার বোধ করল না। কারণ বৃষ্টি, অবিশ্রান্ত অঝোরে দিনের পর দিন বৃষ্টি। তৃতীয় টেস্টম্যাচের স্থান? অবশ্যই ম্যাঞ্চেস্টার ছাড়া আর কোথায়ই-বা হবে!

লিডসে চতুর্থ টেস্ট ম্যাচ। ডনের মতে, আধুনিক কালে অন্যতম সেরা টেস্ট ম্যাচ। ভালো পিচে ইংল্যাণ্ডের প্রথম ইনিংস শেষ হল ২২৩ রানে। আকাশে ঘন মেঘ জমে উঠছে। বৃষ্টি আসবে। আসবেই। এইবার অধিনায়ক ডনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়। আলো কম বটে কিন্তু উইকেটের অবস্থা ভালো, বৃষ্টির পর আলো ভালো হবে বটে কিন্তু উইকেট খারাপ হবে—তাহলে কোন অবস্থায় ব্যাটিং শ্রেয়? ডন ঠিক করল প্রথম অবস্থাটিরই সুযোগ নেওয়া ভালো। ব্যাটসম্যানদের প্রতি তার নির্দেশ : ‘আর যাই করো, আলো কম হওয়ার জন্য আবেদন কোরো না।’

রীতিমতো অন্ধকারেই অস্ট্রেলিয়া ব্যাট করেছিল। মাঠের মাঝ থেকে ওরা দেখতে পাচ্ছিল গ্যালারিতে দেশলাই জ্বালানো আগুনের শিখা। প্রেসবক্সে এক সাংবাদিক তো রেগে বলেছিল, ‘অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যানরা যদি আপিল না করে তো আমিই করব। আমি নিজের লেখাই দেখতে পাচ্ছি না।’

অন্ধকারে ডন প্রায় তিন ঘণ্টা ব্যাট করে ১০৩ রান করে। এক সাংবাদিক লিখল, ‘পিকাডিলিতে মোমবাতির আলোয়ও ডন শতরান করবে।’ পর পর ছয়টি টেস্টে হল ছয়টি শতরান। পরের টেস্ট ওভালে ডন ব্যাট করেনি এবং তারপরই আবার সেপর পর দুটি টেস্টে দুটি শতরান করে (১৯৪৬-৪৭ অস্ট্রেলিয়া)। লিডসে অস্ট্রেলিয়া ১৯ রানে এগিয়ে ২৪২ রানে ইনিংস শেষ করে। ইংল্যাণ্ডের দ্বিতীয় ইনিংস ১২৩ রানে শেষ হওয়ার পরই আবার আকাশে ঝঞ্ঝামেঘ দেখা দিল। ঝড়-বৃষ্টি এখনি শুরু হবে। ডন নির্দেশ দিল, পেটাও, রান তাড়া করো। ১০৫ রান সংগ্রহের জন্য ব্যাটসম্যানরা তাই শুরু করল। রান উঠছে উইকেটও পড়ছে। খেলা ধীরে ধীরে উত্তেজনায় কাঁপতে শুরু করল। প্রকৃতির সঙ্গে রেষারেষি করে ইংলিশ প্রতিরোধ ভেঙে জয় সম্ভব হবে কি হবে না। দুটি টেস্ট অমীমাংসিত, একটি পরিত্যক্ত, আর একটির খেলা বাকি, সুতরাং এই টেস্টের বিজয়ীর ‘রাবার’ হারাবার ভয় অন্তত থাকবে না। লিডসে জিতলে অস্ট্রেলিয়ার কাছেই ‘অ্যাশেজ’ থাকবে।

অস্ট্রেলিয়া জিতল পাঁচ উইকেটে ১০৭ রান তুলে। ম্যাচে ওরিলি পায় ১০ উইকেট ১২২ রানে। ডন করে ১৬ রান। শেষদিকে উত্তেজনা এমন পর্যায়ে পৌঁছোয় যে সেআর খেলার দিকে তাকাতেই পারছিল না। ডেসিং রুমে বসে কিছু-একটা কাজে ব্যস্ত থাকার জন্য গাদা গাদা রুটি আর জ্যাম চিবোতে শুরু করে আর বাইরে থেকে একজন রিলে করে তাকে বলে যায় খেলার কী অবস্থা। এত নার্ভাস সেজীবনে হয়নি।

কিন্তু ওভালে ‘টাইমলেস’ শেষ টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল অকল্পনীয়, টেস্ট ইতিহাসের বিরাটতম পরাজয়—ইনিংস ও ৫৭৯ রানে। এমন বিপুল ইনিংস হার এখনও কোনো দেশের বরাতে জোটেনি।

এই ওভাল টেস্ট, হাটনের টেস্ট। ২২ বছরের ইয়র্কশায়ার ওপেনিং ব্যাটসম্যান ১৩ ঘণ্টা ২০ মিনিট (তখনকার উইকেটে থাকার রেকর্ড) ব্যাট করে বিশ্ব টেস্ট রেকর্ড স্থাপন করে ৩৬৪ রানের। আগের রেকর্ড ছিল ডনেরই ৩৩৪। বিশ্ব টেস্ট রেকর্ড হল সর্বোচ্চ ইনিংস রানের ও ইংল্যাণ্ড ৭ উইকেটে ৯০৩। (৫৮ বছর পর শ্রীলঙ্কা এই রেকর্ড ভাঙে ভারতের বিরুদ্ধে ৬ উইকেটে ৯৫২ রান করে।) পার্টনারশিপে ইংল্যাণ্ডের রেকর্ড হল—দ্বিতীয় উইকেটে হাটন-লেল্যাণ্ড ৩৮২ রান; ষষ্ঠ উইকেটে হাটন-হার্ডস্টাফ ২১৫ রান। তার নিখুঁত ইনিংসে হাটন শুধু ৪০ রানের মাথায় ফ্লিটউড স্মিথের বলে স্টাম্পিং সুযোগ দিয়েছিল। টেস্ট ইতিহাসের সবথেকে দামি সুযোগ!

হাটন যখন ৩৩৪ রানের দিকে এগোচ্ছে তখন ডন সিলি মিড-অফে এসে দাঁড়ায়। অনবদ্য কাট করে হাটন ৩৩১ থেকে ৩৩৫-এ পৌঁছোতেই ডন সর্বপ্রথম হাত বাড়িয়ে দেয় অভিনন্দন জানাতে। ৩০ হাজার দর্শক গেয়ে ওঠে ‘ফর হি ইজ এ জলি গুড ফেলো’। এই টেস্টে ইংল্যাণ্ড দলে ইয়র্কশায়ারের পাঁচ জন মিলে ৬১২ রান করে ও ১০টি উইকেট পায়। তাদের উইকেটকিপার উড তিনটি ক্যাচ ধরে ও ৫৩ রান করে।

খেলার তৃতীয় দিন লাঞ্চের পর ক্লান্ত বোলারদের রেহাই দেবার জন্য ডন নিজে বল করতে এল। ১৯৩০-এর পর ইংল্যাণ্ডের মাঠে এই তার প্রথম বল-করা। দ্বিতীয় বলটি করার সময় বোলারদের পায়ে তৈরি গর্তে তার পা ঘুরে গিয়ে পায়ের গোছের একটা হাড় সামান্য ভাঙল। তাকে তুলে নিয়ে যেতে হল মাঠ থেকে। তৃতীয় দিন চা পানের পর হ্যামণ্ড যখন শুনল ডন ব্যাট করতে পারবে না তখনই নিশ্চিন্ত হয়ে ইনিংস ঘোষণা করে। হ্যামণ্ড জানত, এই সহজ ব্যাটিং উইকেটে ডনের প্রতিভাকে দমিয়ে রাখার সাধ্য তার বোলারদের নেই। নশো রানের মোকাবিলা করতে ডন যে কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠবে কেউ তা জানে না।

এই টেস্টে ডন ব্যাট ধরেনি। পায়ের পেশি জখম করে ফিঙ্গলটনও মাঠ থেকে ফিরে এসেছে। মনমরা অস্ট্রেলিয়ার দল ভেঙে পড়ল ২০১ এবং ১২৩ রানে। সিরিজের ফল ১ : ১। ডন সফরের বাকিটুকুতে আর খেলতে পারেনি। তার হাঁটা বারণ, এমনকী বিলিয়ার্ডস খেলা পর্যন্ত। মিডলসেক্সের ও ইংল্যাণ্ডের বিখ্যাত বোলার ওয়াল্টার রবিন্সের বারনহামের বাড়িতে সেবিশ্রাম নেয় তাস খেলে, পিয়ানো বাজিয়ে আর চিঠির উত্তর দিয়ে। দেশের বাইরে ডনের এই প্রথম সফর অধিনায়কের দায়িত্ব নিয়ে। দায়িত্বের চাপটা যে কী প্রচন্ড তা সেভালোভাবেই বুঝেছে। প্রায়শই তার মনে হত, ভবিষ্যতে এইরকম আর একটা সফরে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব নিতে আর সেপারবে না। দেশে ফিরে বড়োজোর আর একটা টেস্ট সিরিজ, তারপরই অবসর।

কিন্তু দশ বছর পর অস্ট্রেলিয়াকে সবথেকে মর্যাদাপূর্ণ, অজেয় সফরের নেতৃত্ব দেবার জন্য ডন আবার ইংল্যাণ্ডে ফিরে এসেছিল।

ডন ১৯৩৮ ইংল্যাণ্ড সফরে ২৬ ইনিংস খেলে সংগ্রহ করে ২,৪২৯ রান। আজ পর্যন্ত কোনো বিদেশি দলের কেউ ইংল্যাণ্ডের মাঠ থেকে এত রান বা ১৩টি শতরান (তাতে তিনটি দ্বিশত) তুলতে পারেনি। ডনের গড় হয় ১১৫.৬৬ রান। ইংল্যাণ্ডে একটি মরসুমে ১৫টির বেশি ইনিংস খেলেছে এমন কোনো ব্যাটসম্যান এখনও পর্যন্ত এই গড় স্পর্শ করতে পারেনি। এই মরসুমে ইংল্যাণ্ডে সবথেকে বেশি মোট রান করে হ্যামণ্ড, ৪২ ইনিংসে ৩,০১১ রান; ৭৫.২৭ গড়। ১৯৩৮-এ ডন ইংল্যাণ্ডে ১৩টি শতরান করে ১৯টি ম্যাচে। দশ বছর পর ফিরে এসে ১৯৩৮-এর মোট রান থেকে সেমাত্র একটি রান ও দুটি শতরান কম করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *