১১. ‘ব্র্যাডম্যান মৃত’

১১. ‘ব্র্যাডম্যান মৃত’

ডন ১৯৩৩-৩৪ মরশুমে প্রায় মারা গিয়েছিল।

মরশুম শুরুতেই সেদেখল পিঠে একটি ব্যথা চাগিয়ে উঠছে। একটা ইনিংস ব্যাট করলে আগের থেকে অনেক বেশি ক্লান্ত লাগে। তার মানে ক্লান্তি নামার আগেই তাড়াহুড়ো করে তাকে রান তোলার কাজ সারতে হচ্ছে। যত রান করা দরকার ততটুকু হয়ে গেলেই ইচ্ছে করে ক্যাচ তুলে বা উইকেট ছেড়ে দিয়ে সেচলে আসত। অপ্রয়োজনেও ব্যাট করে যাওয়া বা মনোনিবেশ করে থাকা আর তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না।

ডনের বিচারবোধ অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। সেবুঝতে পারত ঠিক কত রান তাকে করতে হবে ম্যাচ জেতার জন্য। কিন্তু এইভাবে তার পক্ষে বেশিদিন খেলে যাওয়া সম্ভব নয়। আগের মরসুমের বডিলাইনের ঝঞ্ঝাট সেপোহাতে পেরেছিল যেহেতু স্ত্রী তার চিঠিপত্র লেখালেখি এবং খবরের কাগজের ও বেতারের প্রবন্ধগুলির কাঠামো তৈরিতে সাহায্য করেছিল। বেশিরভাগ ক্রিকেটারই যা করে, অর্থাৎ অন্যে তাদের প্রবন্ধগুলি লিখে দেয় আর তারা শুধু নিজের নামটুকু সেই লেখার উপরে বসিয়ে দেন, ডন কিন্তু এই অশরীরী লেখকদের লেখাকে কখনোই নিজের নামে চালায়নি। নিজের লেখা সেনিজেই লিখত।

অ্যাডিলেডে সেবিশেষজ্ঞদের দিয়ে স্বাস্থ্যপরীক্ষা করাল। তারা বলল, অত্যধিক চিন্তা ও পরিশ্রমে তার শরীর ভেঙে পড়ছে; দেহে ও মনে সেনি:শেষ হয়ে আসছে; তার উচিত সুযোগ পেলেই বিশ্রাম নেওয়া আর সহজ ও হালকাভাবে সব কিছুকে গ্রহণ করা।

ডন তাই করার চেষ্টা করল। একটা বড়ো রকমের সিদ্ধান্ত সেতখন নিল। এই সময় সারাদিনে তার প্রতিটি মুহূর্তই ভরে ছিল ক্রিকেটে। ক্রিকেট খেলা, ক্রিকেট নিয়ে কাগজে লেখা, ক্রিকেট সম্পর্কে বেতারে বলা, ক্রিকেটের সরঞ্জামগুলি খেলে দেখিয়ে-শুনিয়ে তা বিক্রি করা। তখন ক্রিকেটই তার পেশা এবং নেশা। জীবনটা যেন ক্রমশ সংকীর্ণ একঘেয়ে এবং একপেশে হয়ে যাচ্ছে। হাঁফ ছাড়া যাচ্ছে না, বৈচিত্র্য আনা সম্ভব হচ্ছে না। সেঠিক করল, তার এমন একটা কাজ চাই যার সঙ্গে ক্রিকেটের কোনো সম্পর্ক থাকবে না। ক্রিকেটকে সেরুটি সংগ্রহের হাতিয়ার না করে শুধুই খেলার ব্যাপার করে রাখবে ঠিক করল। এইভাবে তাহলে আবার সেক্রিকেটের মধ্যে আনন্দ খুঁজে পাবে।

যে ক্রিকেট সরঞ্জাম প্রতিষ্ঠানে সেচাকরি করত সেটা ছেড়ে দিল, ক্রিকেট বিষয়ে বক্তৃতা দেবার প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করল। চাকরি নিল অ্যাডিলেডে ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের একজন সদস্যের শেয়ার দালালির অফিসে। খুব-একটা অবাক হবার মতো ব্যাপার এটা নয়। স্কুলে অঙ্কে দারুণ মাথা ছিল ডনের। আর একবগ্গা মাথামোটা খেলোয়াড়দের মতো তার মাথাটা মোটেই বুদ্ধিহীন ছিল না।

বিচারবোধসম্পন্ন বহু বিখ্যাত লেখক ডন সম্পর্কে বলেছেন, সেযে-কাজই বেছে নিক-না তাতে সেসফলই হবেই যেহেতু সফল হবার জন্য তার সংকল্প, একমুখীনতা এবং কাজের প্রতি মনোনিবেশ অত্যন্ত প্রবল এবং প্রগাঢ়। এবার থেকে ডন তার ব্যাবসায়িক জীবন ও ক্রিকেট জীবনকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা করে রাখার চেষ্টা করে যেতে লাগল। অফিসে লেনদেনের কথা ছাড়া ক্রিকেট নিয়ে একটি কথাও বলত না, শুনতেও চাইত না। টেলিফোন ডিরেক্টরি থেকে বাড়ির ফোন নম্বরটা সেবাদ দিয়ে দিল যাতে বাড়িতে তাকে কেউ ব্যাঘাত না করে। আর সুযোগ পেলেই সেবিশ্রাম নিত।

১৯৩৪-এ এল ডনের দ্বিতীয় ইংল্যাণ্ড সফর। ডনকে অস্ট্রেলীয় দলের সহ-অধিনায়ক করা হল। সেবুঝতে পারল তাকে ভবিষ্যৎ অধিনায়করূপে চিহ্নিত করা হয়েছে।

অস্ট্রেলীয় দল ইংল্যাণ্ডে পৌঁছোল। তারা ওয়েম্বলিতে এফএ কাপ ফাইনাল দেখল, প্রধানমন্ত্রী র্যামসি ম্যাকডোনাল্ডের ভোজের আমন্ত্রণ রক্ষা করল। কিন্তু ডন তার শরীর সম্পর্কে বিশেষ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিল না, অধিনায়ক বিল উডফুলকে সেজানাল, প্রথম ম্যাচে তাকে যেন বাদ দেওয়া হয়। উডফুল তাকে বলল, এটা করা ঠিক হবে না, কেননা ইতিমধ্যে চারদিকে গুজব রটেছে যে, ডনের শরীর ভেঙে গেছে, না খেললে গুজবটা সত্য প্রমাণিত হবে। দলের মনোবলও যথেষ্ট ধাক্কা খাবে। তা ছাড়া দর্শকও কমে যাবে, তাতে আয়ও কমে যাবে।

সুতরাং ডন খেলল। দ্রুত ২০৬ করল। এবং শুরুতেই এতটা শক্তিক্ষয়ের ফলে শ্রান্তি তাকে এমনভাবে চেপে ধরল যে, সেই মে মাসের শেষাশেষি একটি পঞ্চাশ রানের ইনিংস ছাড়া আর কিছু সেকরতে পারল না। এর মধ্যে আবার স্কোরবুকে দুটি শূন্যও তার নামের পাশে যুক্ত হয়েছে।

এরপরই এল লর্ডসে মিডলসেক্সের বিরুদ্ধে, আকর্ষণীয়তার দিক থেকে তার জীবনের একটি অদ্বিতীয় ইনিংস—অন্তত ডন নিজে তাই মনে করে। আগের ম্যাচে হাম্পশায়ারের বিরুদ্ধে শূন্য করেছে। সুতরাং মনে মনে ডন নিজের সম্পর্কে যথেষ্ট নড়বড়ে ছিল। অনবরত শ্রান্তি এবং যন্ত্রণার তাড়া খেয়ে সেমনমরা হয়ে পড়েছিল।

মিডলসেক্স ২৫৮ রানে ইনিংস শেষ করে। অস্ট্রেলিয়া উডফুল ও পন্সফোর্ডকে হারাল শূন্য রানে। এইবার ডনকে অস্ট্রেলিয়ার দরকার, ভীষণভাবে দরকার। ম্যাচ জেতার মতো রান তাকে করতে হবে, করতেই হবে। এবং সেকরল।

প্রথম মিনিট পাঁচেক ডনের অনিশ্চিতভাবে কাটল। বরাবরই দেখা গেছে এইরকমই তার হয়। ফাস্ট বোলার জিম স্মিথের একটা আউট সুইঙ্গারের বাতাসও ডনের স্টাম্পে ছোঁয়া দিল। অস্ট্রেলীয়রা তো তাই দেখে শিউরে উঠল। এরপরই ডন নিজমূর্তি ধারণ করে। প্রতিটি স্ট্রোকে আশ্চর্য নিখুঁত সময় বিচার, প্রতিটি স্ট্রোকে ওস্তাদের স্পর্শ। জিম স্মিথের ফাস্টবল, ওয়াল্ডার রবিন্সের স্লো বল, ইয়ান পিবলসের গুগলি, প্রহারে প্রহারে জর্জরিত হল। ক্রিজ থেকে বেরিয়ে এসে ড্রাইভ, পিছিয়ে গিয়ে পুল। যেখানে খুশি সেবল পাঠাল। লোকে যা দেখতে মাঠে আসে তাই দেখা গেল : ব্র্যাডম্যান তার স্বমহিমায়।

দিনের শেষ বলটিতে এক রান নিয়ে ডন ঠিক ১০০ রানে পৌঁছোয়, সময় লাগে ৭৫ মিনিট। তার কয়েকটি শতরানের থেকে সময়টা একটু বেশিই লাগল। এতে আছে ১৯টি চার। পরদিন সে১৬০ রানে আউট হয়। এজন্য মোট সময় লাগে ১২০ মিনিট। লর্ডসে প্যাভিলিয়নের সামনে জ্যাক হিউম ঝাঁপিয়ে পড়ে অসাধারণ ক্যাচ নিয়ে তাকে আউট করে।

বেচারা ডন। এই খেলার পর আবার শ্রান্তি তাকে চেপে ধরল। নটিংহামে প্রথম টেস্টে সেকরল ২৯ ও ২৫। এই টেস্টে এক জনও শতরান করেনি। অস্ট্রেলিয়ার চিপারফিল্ড জীবনের প্রথম টেস্ট খেলায় ৯৯ রানে আউট হয়। ইংল্যাণ্ড দলে নবাগত ফাস্ট বোলার স্কুলশিক্ষক কেনেথ ফার্নেস দুই ইনিংসে পাঁচটি করে উইকেট পায়। খেলা শেষের ১০ মিনিট আগে ওরিলির বলে মিচেল এলবিডব্লু আউট হওয়ায় অস্ট্রেলিয়া ২৩৮ রানে জেতে।

ইংল্যাণ্ডে তখন খেলার মাঠ দড়ি দিয়ে ঘেরা থাকত। খেলার শেষদিকে দর্শকরা উত্তেজনাবশে এগিয়ে আসায় দড়ি ঝুলে পড়েছিল, দেখাও যাচ্ছিল না। খেলা শেষ হতেই খেলোয়াড়রা ছুটে ড্রেসিং রুমের দিকে যাচ্ছিল, তখন পায়ে দড়ি আটকে ডন পড়ে যায়, তার ওপর আর একজন এসে পড়ে এবং ঊরুতে আঘাত পায়। পরের ম্যাচে সেরানার নিয়ে ব্যাট করে এবং তার পরের ম্যাচে খেলতে পারেনি।

লর্ডসে দ্বিতীয় টেস্টে অস্ট্রেলিয়া হারল ইনিংস ও ৩৮ রানে। ডনের রান ৩৬ ও ১৩। ইংল্যাণ্ড ৪৪০ রান করার পরই বৃষ্টি এবং ভিজে পিচে হেডলি ভেরিটির মারাত্মক স্পিন অস্ট্রেলিয়াকে অসহায় করে দেয়। ম্যাচে ভেরিটি ১৫টি উইকেট পায়, দ্বিতীয় ইনিংসে ৮-৪৩। প্রথম ইনিংসে খেলতে নেমেই ফার্নেসের বলে ডন পর পর তিন বলে তিনটি ৪ ও একটি ২ নেয় প্রথম ওভারেই। গিয়ারির বলে ৪। গিয়ারির বদলে ভেরিটি আসতেই তিন বলে আবার তিনটি ৪। ভেরিটির হাতেই ক্যাচ তুলে দিয়ে সেফিরে যায়। কার্ডাস লিখলেন :

ব্র্যাডম্যানের এই ৩৬ রান লিডসে তার ৩৩৪ রানের থেকেও অনেক বেশি মহীয়ান। প্রতিটি স্ট্রোকের পিছনে ছিল প্রেরণা, ছিল সৌন্দর্য যা পৌরুষের চূড়ায় পৌঁছোনো জীবন থেকেই বিচ্ছুরিত হয়।

১৯৩০-এ ডন মে মাসের মধ্যেই হাজার রান সম্পূর্ণ করেছিল। ১৯৩৪-এর জুন মাসের শেষে তার রান দাঁড়াল মাত্র ৭৬০। লর্ডসের ব্যাটিং ছাড়া বলার মতো রান আর সেকরেনি। সাধারণ লোক জানে না ডন কী অসুবিধার মধ্যে পড়েছে। নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে ডন কখনো আলোচনা করত না।

জুলাই এল এবং স্বাস্থ্য তাকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখল। ম্যাঞ্চেস্টারে তৃতীয় টেস্ট ম্যাচ এসে পড়ল। কিপ্যাক্স অসুস্থ, খেলল না। ডন ও চিপারফিল্ডের গলায় ব্যথা। প্রথমে সন্দেহ হয়েছিল বুঝি ডিপথেরিয়া। সেই অবস্থাতেই ডন খেলে এবং ৩০ রান করে। ম্যাচের মীমাংসা হয়নি।

এরপর ওরা এল লিডসে। ডনের প্রিয় মাঠ। এখানে স্মৃতি হয়ে আছে তার সেরা ইনিংসগুলির কয়েকটি। মাঠটিকে দেখেই বোধ হয় ডন তাজা বোধ করেছিল। ইয়র্কশায়ারের সঙ্গে খেলা। অস্ট্রেলিয়ার এক উইকেটে ১৬ রান, ডন উইকেটে এসে যোগ দিল উডফুলের সঙ্গে। কয়েক মিনিট যথারীতি সেব্যাটে লাগাম পরিয়ে রাখল। তারপরই খসে গেল লাগাম। টগবগ করে উঠল স্কোরবোর্ড—২৫ মিনিটে ৫০, ১০০ মিনিটে ১০০ রান। পরের ১৫ মিনিটে আরও ৪০ রান। ১১৫ মিনিটে নেওয়া তার ১৪০ রানে দুটি ৬, বাইশটি ৪। বোলারদের মধ্যে অবশ্যই ভেরিটিও ছিল। কোনো বোলারের কাছে অপদস্থ হলে ডন শোধ না নিয়ে ছাড়ত না।

লিডসেই চতুর্থ টেস্ট ম্যাচ। ডন তখন অপ্রতিরোধ্য মেজাজে এসে গেছে।

প্রথম ব্যাট করে ইংল্যাণ্ড চমৎকার উইকেটে ২০০ রানে আউট হয়ে যায়। দিনের শেষদিকে অস্ট্রেলিয়া ৩৭ রানে হারায় ব্রাউনকে। নৈশ প্রহরীরূপে উইকেটকিপার ওল্ডফিল্ড আসে এবং দু-রান পরেই আউট হয়ে ফিরে যায়। উডফুল নামে এবং বাওয়েস সঙ্গে সঙ্গেই তাকে বোল্ড করে। অস্ট্রেলিয়ার তিন উইকেটে ৩৯ রান। এর পরের উইকেট পড়ে পরদিনের খেলা শেষের দশ মিনিট আগে যখন ভেরিটির বল হুক করতে গিয়ে পন্সফোর্ডের পায়ে লেগে বেল পড়ে যায়। তখন তার রান ১৮১।

আর ব্র্যাডম্যান? দ্বিতীয় দিন শেষে ২৭১ অপরাজিত। তৃতীয় দিনে বোল্ড হয় বাওয়েসের বলে, তখন তার রান ৩০৪। সময় লেগেছে ৪২০ মিনিট। তাতে আছে দুটি ৬, তেতাল্লিশটি ৪।

সাধারণ লোক ধরে নিল ডন আবার তার নিজের খেলা ফিরে পেয়েছে। কিন্তু ডনের সতীর্থরাই জানে কী অসম্ভব কষ্ট তাকে করতে হল। দীর্ঘ ইনিংস খেলার ধকল শুধুই মনের জোরে সহ্য করারও একটা সীমা আছে। ড্রেসিং রুমে দলের অন্যান্য খেলোয়াড়রা পোশাক খুলিয়ে ডনকে বাচ্চা ছেলের মতো কোলে করে মালিশের টেবলে শুইয়ে দেয়। নড়াচড়ার ক্ষমতা তার আর ছিল না। একটা বড়ো ইনিংস খেলা মজবুত লোকের পক্ষেও যে কী পরিশ্রমের ব্যাপার— যে খেলেনি তার পক্ষে বোঝা সহজ নয়। ১৯৩৮-এ ৩৬৪ রানের টেস্ট রেকর্ড করার পর লেন হাটন বলেছিল আবার যে কোনোদিন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলতে পারব, মনে হচ্ছিল না।

ডন অবশ্য ফিল্ড করতে নামে। কিন্তু আবার বিপত্তি বঁাধায় ঊরুতে পেশিতন্তু ছিঁড়ে ফেলে। মাঠ থেকে নার্সিং হোম তাকে যেতে হয়। তার ফলে তিন সপ্তাহ তার খেলা বন্ধ থাকে। ওভালে পঞ্চম টেস্টের আগে ডন একটিও প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেনি। এই সময়টায় সেইংল্যাণ্ডপ্রবাসী এক ধনী অস্ট্রেলীয় ডাক্তারের গ্রামের বাড়িতে কাটায়—জনতা, ক্রিকেটার, খবরের কাগজের লোকেদের থেকে দূরে নি:সঙ্গ শান্ত প্রাকৃতিক পরিবেশে, পাখি আর কাঠবিড়ালিদের ব্যস্ততার মধ্যে।

অস্ট্রেলিয়া থেকে উদবিগ্ন টেলিগ্রাম পাঠাল ডনের স্ত্রী জেসি। কাগজে স্বামীর শরীরের খবর পড়ে ব্যস্ত হয়ে লিখেছে—ইংল্যাণ্ডে আসবে কি না। ডন টেলিগ্রামে জানাল, ওসব কিছু না। ব্যস্ত হতে হবে না।

তারপর পঞ্চম টেস্ট ম্যাচ। অস্ট্রেলিয়া জিতল ৫৬২ রানে। ইংল্যাণ্ড ভুল করল ৪৭ বছরের ফ্র্যাঙ্ক উলিকে দলভুক্ত করে। ওরিলির বল খেলার মতো অভিজ্ঞতা তার ছিল না। উইকেট-কিপার লেসলি এমস খেলার মাঝে কোমরের ব্যথায় আক্রান্ত হয়। উলি তার জায়গা নেয় (বাই রান হয়েছিল ৩৭টি)। বাওয়েসও খেলার মধ্যে অসুখে পড়ে।

পন্সফোর্ড ২৬৬, ব্র্যাডম্যান ২৪৪। দ্বিতীয় উইকেট পার্টনারশিপে ওরা ৪৫১ রান তুলে বিশ্বরেকর্ড করে। ৬২ বছর পর এটি ভাঙে শ্রীলঙ্কার জয়সূর্য ও মহানামা ভারতের বিরুদ্ধে ৫৭৬ রান যোগ করে।

অস্ট্রেলিয়া ‘রাবার’ জিতল। ডন এরপর আরও দুটি শতরান করল। ফোকস্টোনে ইংল্যাণ্ড একাদশের বিরুদ্ধে ১০৫ মিনিটে অপরাজিত ১৪৯। ফ্রিম্যানের ছয় বলের একটি ওভারে তিনটি ৬ ও তিনটি ৪ নিয়ে সে৩০ রান তোলে। তারপর স্কারবরোয় লেভিসন গাওয়ারের বোলারদের (ফার্নেস, বাওয়েস, নিকলস ও ভেরিটি) বিরুদ্ধে ১৩২ রান। ব্রাউন ৩ রান করে আউট হওয়ার পর ডন খেলতে নেমে লাঞ্চের আগেই ফিরে আসে ১৩২ রান নিয়ে। সফরে তার মোট রান ২,০২০। গড় ৮৪.১৬।

দু-সপ্তাহ পরই সারা অস্ট্রেলিয়া স্তব্ধ প্রস্তরবৎ হয়ে শুনল, ডন মারা গেছে।

গুজবটা যদিও গুজবই কিন্তু ডন তখন গুরুতর অসুস্থ। দেশে ফেরার জন্য অস্ট্রেলীয় দল লণ্ডনে তোড়জোড়ে ব্যস্ত। তখন এক বিকেলে ডন পেটে অসহ্য যন্ত্রণা বোধ করে। ডাক্তার এলেন। পরীক্ষা করে থমথমে হয়ে গেল মুখ! পরদিন সকালেও এলেন এবং ডনকে জানালেন যন্ত্রণার কারণ অ্যাপেন্ডিসাইটিস! এখুনি ব্যবস্থা নিতে হবে।

ব্যবস্থা মানে অপারেশন। তার আগে আর একজন বড়ো ডাক্তারকে দেখানো হল। তিনিও একমত, এটা থাণ্ডারস্টর্ম অ্যাপেন্ডিসাইটিস। এখুনি অপারেশন দরকার। তাই করা হল। তা ছাড়া পাকস্থলীর আবরণ ঝিল্লির প্রদাহেও ডন ভুগছিল।

জীবন-মৃত্যুর আলো-আঁধারিতে ডনকে কিছু সময় কাটাতে হয়েছে। সারা অস্ট্রেলিয়ায় গির্জায় গির্জায় যখন ডনের জন্য প্রার্থনা হচ্ছে তখন তার স্ত্রী অ্যাডিলেড থেকে পার্থ রওনা হয়েছে ইংল্যাণ্ডগামী জাহাজ ধরার জন্য। ১৩ হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে ৩১ দিন পর জেসি লণ্ডন পৌঁছোয়।

লণ্ডনে ডনের ভক্তরা হাসপাতালে বার বার ফোন করে জানাচ্ছে, দরকার হলে তারা রক্ত দিতে রাজি।

শত শত টেলিগ্রাম আসছে, এমনকী ইংল্যাণ্ডের রাজা-রানিও পাঠিয়েছেন। প্রচুর চিঠি আসছে নানান চিকিৎসা পদ্ধতি বাতলে। ডনের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয় শুধু জ্যাক হবস ও ‘প্লাম’ ওয়ার্নারকে। তাঁরা গল্প করেন ক্রিকেটের।

ডন কিন্তু খুব ঘাবড়ায়নি। সেবিকা থার্মোমিটারে তার তাপ নিলে, ডন ঠাট্টা করত, ‘স্কোর কত হল, আজ একশো পেরিয়েছি কি?’ সেবিকার মুখ দেখে সেবুঝতে পারত অনুমানটা সঠিক করতে পেরেছে কি না।

জেসি যেদিন লণ্ডন পৌঁছোয়, তার আগের দিন ডন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পায়। নট আউট রয়ে গেল ডন, কিন্তু এ যাত্রা আউট হতে হতে বেঁচে গেল। চোখ দুটো গোলমাল শুরু করেছে তাই পড়াশুনোর জন্য তাকে চশমা পরতে হল কিছু দিন। দেশে ফেরার আগে ডন ও জেসি লম্বা ছুটি কাটাল স্কটল্যাণ্ড ও দক্ষিণ ফ্রান্সে। ওরা যখন অস্ট্রেলিয়ায় ফিরল তখন সেখানে ক্রিকেট মরসুম। কিন্তু ডাক্তারের হুকুমে তার ক্রিকেট খেলা একদমই বারণ। দেশের বাড়ি বাওরালে গিয়ে সেক্রিকেট মরসুমটা কাটাল প্রাকৃতিক পরিবেশে।

তিন মাস সেকোনোরকম খেলায় নামেনি শুধুমাত্র একটু-আধটু গলফ খেলা ছাড়া। গলফকে হালকা পরিশ্রমের খেলা হিসাবেই ধরা হয়। কিন্তু ডনের এমনই স্বভাব যখন যা ধরবে, গভীর মনোনিবেশে তা করবেই। একটা ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে ফেলল!

১৯৩৫-এ ডন সিডনি থেকে অ্যাডিলেডে এসে শেয়ার দালালির নতুন কাজে যোগ দিল আর আবার শুরু করল ক্রিকেট খেলা, তার নতুন রাজ্য সাউথ অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *