০৪. প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট

৪. প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট

ডন নিউ সাউথ ওয়েলস দলে আসার সুযোগ পেল ১৯২৭ সালের বড়োদিনের ঠিক আগে, যখন জ্যাক গ্রেগরি ও লাভ অবসর নিলেন। অ্যাডিলেডে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খেলা। ডন নতুন ছেলে, সুতরাং দলে সেদ্বাদশ ব্যক্তি। নিজের রাজ্যের বাইরে ডন এই প্রথম খেলতে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে আরচি জ্যাকসনের হাঁটুতে ফোড়া হওয়ায় ডন তার জায়গায় দলে এসে গেল। বয়স তখন ১৯। তখনও সে‘বাওরাল বয়’ নামে পরিচিত এবং ক্রিকেটের উপর মহলে একদমই নবাগত। এবার সেঅস্ট্রেলিয়ার ধুরন্ধর ক্রিকেটারদের সামনে পড়ল।

প্রথম খেলার প্রথম ইনিংসেই ডন অ্যাডিলেডে করল ১১৮। বোলারদের মধ্যে ছিল বিশ্বখ্যাত লেগব্রেক-গুগলি বোলার ক্ল্যারি (ক্ল্যারেন্স-এর সংক্ষেপ) গ্রিমেট। সহজ কথা নয়, কেননা গ্রিমেট একদমই রান দিতে চায় না। ওর বলে একটা রান হলেও বিরক্ত হয়ে ওঠে।

ডন ১১৮ রান করে হোটেলে ফিরে সান্ধ্য পত্রিকায় দেখল সেই দিনই ভিক্টোরিয়ার বিল পন্সফোর্ড কুইন্সল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে ৪৩৭ রান করে সর্বোচ্চ রানের বিশ্বরেকর্ড করেছে। ডনের আবির্ভাবের আগে পন্সফোর্ডই ছিল অস্ট্রেলিয়ার সবথেকে বড়ো রান সংগ্রাহক আর এই ৪৩৭ রানটাই বিশ্বরেকর্ড হয়ে থেকেছিল যতদিন-না ডন সেটা অতিক্রম করে। পন্সফোর্ডের সঙ্গে ডন অবশ্য পরে অনেকগুলি বড়ো রানের পার্টনারশিপে খেলেছে।

কিন্তু ডন যে এখনও অনেক কাঁচা, সেটা বোঝা গেল দ্বিতীয় ইনিংসে। নিউ সাউথ ওয়েলসের ১৫০ রানের মধ্যে ডন ৩৩ করে বোল্ড হয় গ্রিমেটের বলে। কিন্তু টারনিং উইকেটে উচ্চ পর্যায়ের লেগব্রেক বল যে কী জিনিস, এই প্রথম সেসেটা বুঝতে পারে। গ্রিমেট ৫৭ রানে ৫ উইকেট পায়। এই অ্যাডিলেড মাঠেই ডন তার জীবনের প্রথম ও শেষ (মার্চ, ১৯৪৯) প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলে।

অ্যাডিলেড থেকে ভিক্টোরিয়া। ডন এবার ব্যর্থ। মাত্র ৩১ ও ৫ রান করল। আর ফিল্ড করল পন্সফোর্ডের ২০২ ও ৩৮ এবং বিল উডফুলের ৯৯ ও ১৯১ নট আউট রান করা দেখতে দেখতে। এরপর সিডনিতে ফিরে এল কুইন্সল্যাণ্ডের সঙ্গে খেলতে। রান করল আরও শোচনীয়, প্রথম বলেই বোল্ড আউট গুফ নামে এক স্পিনারের বলে।

ডন যখন খেলতে নামে তখন ব্যাট করছে অ্যালান কিপ্যাক্স। ডন দেখল কিপ্যাক্স কী অনায়াসে সেই বলটা মিড অনে ঠেলে একটা রান নিল। পরের বলের আগেই ডন ভাবল, আমিও ওইভাবে রান নেব। ডন ঠিক কিপ্যাক্সের নকল করে ব্যাট চালাল। বলটা স্পিন না নিয়ে জোরে এসে ব্যাটের তলা দিয়ে গলে মিডল স্ট্যাম্পে লাগল। এই গোল্লা করা থেকে ডন সারা জীবনের জন্য এই শিক্ষাই পায়—বল হওয়ার আগে কখনোই মনস্থির করবে না—কীভাবে খেলবে। কিপ্যাক্স অনেকক্ষণ ধরে উইকেটে থেকে (৩১৫ নট আউট) সব কিছুর সঙ্গে রপ্ত হয়ে যেভাবে ব্যাট চালাচ্ছিল ডন খেলতে নেমেই তাই করতে গিয়ে আউট হয়।

অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটে ‘বাওরাল বয়’ যে নতুন আশা জাগিয়েছে, সেকি তবে মরীচিকা? উচ্চ পর্যায়ের ক্রিকেটার হওয়ার যোগ্যতা কি ওর নেই? ১৯২৭-২৮ ক্রিকেট মরশুমে তার মনের মধ্যে কী ঘটেছিল সেকথা ডন কখনো আমাদের জানায়নি। তার পরিবারের বাইরের কোনো লোকের কাছে সেতার মনের জানালা কদাচ খুলেছে। দুঃখে-সুখে, জয়ে-পরাজয়ে ডন তার সারা খেলার জীবনে অচঞ্চল থেকেছে। মুখ ফুটে একটি কথাও বলেনি।

অনেকেই বলেছে, ‘বাওরাল বয়’ তার গ্রাম্য চালচলনের, শহুরেপনা না জানার জন্য দলের অন্যান্য খেলোয়াড়দের কাছে খুবই হেনস্থা হত। তারা ওকে নিজেদের একজন বলে মনে করত না। তারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করত ওকে নিয়ে। হয়তো এইজন্যই পরবর্তীকালে ডন দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করত না। এমনকী টেস্ট সফরেও সেনিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকত, পার্টি এবং আমোদ-উৎসব এড়িয়ে চলত। যেজন্য তাকে অসামাজিক অভিযোগও শুনতে হয়।

হয়তো তাই। কিন্তু ডন তার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে প্রথম মরশুমেই অনেক কিছু শিখে নেয়। খেলার পর নিজের ভুলত্রুটি বিশ্লেষণ করে তা শোধরানোর জন্য চিন্তা করার যে অভ্যাস, এই সময় রপ্ত করে সারা খেলার জীবনে ডন তা বজায় রেখে যায়।

যখনই ডন ব্যর্থ হয়েছে, সাফল্যের জন্য তার আকাঙ্ক্ষা ততই তীব্র হয়েছে, রোখ বেড়েছে এবং মনোনিবেশ আরও কঠিন রূপ নিয়েছে। এই মরশুমের কঠিন প্রতিবন্ধকতা হয়তো দরকার ছিল আকাঁড়া ধাতুটিকে পিটিয়ে অস্ট্রেলিয়ার শ্রেষ্ঠ ক্রিকেট হাতিয়ারে পরিণত করার জন্য।

সৌভাগ্যের বিষয় অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের কর্তারা ব্যাপারটা বুঝেছিলেন। ডনের প্রথম মরশুমে যদিও ধাঁধানোর মতো স্কোর হয়নি (দশ ইনিংসে ৪১৬ রান, গড় ৪৬.২২, দুটি শতরান) তবু তারা ১৯ বছরের ছেলেটির মধ্যে আশা করার মতো জিনিস খুঁজে পান এবং পরের মরশুমে ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে খেলার জন্য অস্ট্রেলীয় দলের সম্ভাব্যদের তালিকায় ডন ব্র্যাডম্যান নামটির নীচে দাগ দিয়ে রাখেন।

অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটের অবস্থা তখন ভালো নয়। রীতিমতো দুর্দিন উপস্থিত হয়েছে একসঙ্গে কয়েক জন নামি খেলোয়াড় অবসর নেওয়ায়। চ্যাপম্যান যে-দল নিয়ে অভিযানে আসছে তাতে আছে বাঘা বাঘা খেলোয়াড়রা— হ্যামণ্ড, হবস, সাটক্লিফ, হেনড্রেন, টেট প্রভৃতিরা।

অস্ট্রেলিয়ার ভয় বেদম পিটুনি খাওয়ার। মনে ক্ষীণ আশা, ডন হয়তো ভেলকি দেখালেও দেখাতে পারে।

ডন বুঝেছে যদি বড়ো ক্রিকেটার হতে হয়, টেস্ট খেলার স্বপ্ন সার্থক করতে হয়, তাহলে বাওরাল থেকে সিডনি যাতায়াত করে খেললে চলবে না। সিডনিতে গিয়ে বাস করতে হবে এবং ঘাসের উইকেটে নিয়মিত খেলতে হবে। ভাগ্য সহায় হল। ডন যার কাছে চাকরি করত সেই সম্পত্তি কেনাবেচার দালাল ঠিক করলেন সিডনিতে অফিস খুলবেন। ডনের প্রয়োজনের কথা ভেবে তিনি ওকে সিডনি অফিসে চাকরি দিলেন। ডন কালক্ষেপ না করে বাওরাল ছেড়ে সিডনিতে চলে এল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *