০৩. প্রথম দ্বিশত রান

৩. প্রথম দ্বিশত রান

সতেরো বছর বয়সেই ডন সর্বকনিষ্ঠ নিয়মিত খেলোয়াড় বাওরাল টিমের। ক্রিকেটের বড়ো রানের যুগ আসন্ন হয়ে পড়ল। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বাওরালের মানুষ বিস্ময়ে ও গর্বে ‘আমাদের ডন-এর’ ব্যাটিং কীর্তির কথা বলতে শুরু করে। এই কীর্তির প্রথমটি প্রতিবেশী উইঙ্গেলোর বিরুদ্ধে একদিনে ২৩৪ নট আউট। শেষ ৫০ রানে আছে চারটি ছয় ও ছয়টি চার। ডন এত রান করে—বিল ওরিলি নামে উইঙ্গেলো দলের একজন লেগব্রেক বোলার চমৎকার বল করা সত্ত্বেও। ডনের সঙ্গে বিলের বহু সংঘর্ষের প্রথমটি ঘটে এই খেলায়।

এই খেলাগুলি হত পর পর দুই শনিবার, প্রথম দিন এক দলের, পরের দিনে অন্য দলের মাঠে। ডন ২৩৪ নট আউট থাকে বাওরালের মাঠে। পরের শনিবার উইঙ্গেলোয় খেলা। সারা বাওরাল সেখানে হাজির ডনের ব্যাটিং দেখতে। তারা দেখল, প্রথম ওভারেই ওরিলির একটা দ্রুত লেগব্রেক বল ছত্রাকার করে দিল ডনের উইকেট। কয়েক বছর পর এই দুজন একসঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে টেস্ট খেলে এবং ডনের ব্যাটিং, ওরিলির বোলিং ম্যাচ জেতার এক ভয়ংকর জুড়ি হয়ে ওঠে। ওরিলি ২৭ টেস্টে ১৪৪ উইকেট পায়, তার মধ্যে ইংল্যাণ্ডের ব্যাটসম্যান ১০২ জন। ডন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করেছে, জীবনে ওরিলির থেকে বড়ো কোনো বোলারের বিরুদ্ধে সেখেলেনি।

এরপর মরশুমের সবথেকে বড়ো খেলা এল সেই মস ভেল-এর সঙ্গে, যার বিরুদ্ধে ডন ১৩ বছর বয়সে খেলেছিল। ম্যাচের নিয়ম, খেলাটির মীমাংসা হতেই হবে; সেজন্য যত সময় লাগে তো লাগুক। খেলা প্রতি শনিবার চার ঘণ্টা করে। ডনের জন্য ম্যাচটি শেষ হতে সময় লাগে পাঁচটি শনিবার।

প্রথম শনিবারে ডন বাওরালের ইনিংস ওপেন করে ৮০ রানে অপরাজিত থাকে। পরের শনিবারে ২৭৯ নট আউট, বাওরালের এক উইকেটে ৪৭৫। তৃতীয় শনিবারে ডন বাউণ্ডারির কিনারে ক্যাচ আউট হয় ঠিক ৩০০ রানে। বাওরালের হয় ৯ উইকেটে ৬৭২ রান। ডনের মামা হোয়াটম্যান করেন ২২৭, দুজনে সাড়ে তিন ঘণ্টায় তোলে ৩২৩ রান। ডনের দাদা ভিক্টর করে এক রান। বাওরাল জেতে ইনিংস ও ৩৩৮ রানে। ডন ৩৯ রানে চারটি উইকেটও পেয়েছিল।

ডনের মা বলেছিলেন, ডন শতরান করতে পারলে একটি ব্যাট দেবেন। তিনশো রান করার জন্য চেয়ে বসল তিনটি ব্যাট। অবশেষে অনেক যুক্তিতর্কের পর ডনকে একটি ব্যাটই দেওয়া স্থির হয়। ডন অবশ্য তাতেই খুশি হল। জীবনে এই প্রথম তার নতুন সত্যিকারের ব্যাট পাওয়া। যে-প্রতিষ্ঠানের ব্যাট ডন পছন্দ করে কেনে, পরে তারাই ডনের সইয়ের ছাপ দেওয়া ব্যাট বাজারে বিক্রি করত।

পাঁচ সপ্তাহ ধরে খেলা হওয়ায় এই ম্যাচটার খবর ‘সিডনি সান’ পত্রিকায় মজা করে বেরিয়েছিল। সেইসঙ্গে ডনের নামও বাওরালের বাইরে পৌঁছোয়। একটা কার্টুনে দেখানো হয়, বাচ্চা ডন এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত উইকেটের ওপর খরগোশের মতো দৌড়োচ্ছে; তার পরের ছবিতে সেপূর্ণবয়স্ক লোক; তার পরের ছবিতে সেবৃদ্ধ, বেতো রুগির মতো নুয়ে পড়েছে, দাড়ি ঠেকে গেছে মাটিতে এবং শেষ ছবিতে বাওরালের দুজন স্বর্গে সন্ত পিটারকে জিজ্ঞাসা করছে— ম্যাচটা শেষ করতে হবে, মস ভেল ক্রিকেট মাঠটা কোথায় বলতে পারেন?

এই কার্টুনটা নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্য ক্রিকেট দলের নির্বাচকদের মনে গেঁথে যায়। মস ভেলও ডনের এই ইনিংসের কথা ভোলেনি। কয়েক বছর পর ডন যখন বাওরাল ছেড়ে সিডনিতে এসে বাস করছে এবং রাজ্য দলের হয়ে খেলছে, তখন একজন ক্রিকেটার মস ভেলে এসে সেখানকার একজনকে কথাপ্রসঙ্গে বলে— ‘ব্র্যাডম্যান চলে যাওয়ায় আপনারা নিশ্চয়ই দুঃখিত হয়েছেন!’

‘দুঃখিত?’ মস ভেলের লোকটি কটমটিয়ে তাকাল। ‘দুঃখিত? চলে গেছে, বঁাচা গেছে। ও শেষ বার যখন এখানে খেলে, টানা চারটে শনিবার আমাকে ফিল্ড করতে হয়েছে। আমাদের বরাত ভালো তাই ও আউট হয়।’ (ম্যাচটার দৈর্ঘ্য যতদিন গেছে পল্লবিত হতে হতে বেড়ে গেছে।)

এই মরশুমে ডনের মোট রান হয় ১,৩১৮, গড় ১০১; উইকেট পায় ৫১, গড় ৭.৮ রানে। ক্যাচ ধরে ২৬টি। এই চমকপ্রদ সংখ্যাগুলি নিউ সাউথ ওয়েলস নির্বাচকদের চোখ এড়াতে পারেনি। বড়ো কয়েক জন ব্যাটসম্যান তখন অবসর নেওয়ায় তাঁরা নতুন প্রতিভার সন্ধান করছিলেন। ডনকে তাঁরা ১৯২৬-এর অক্টোবরে চিঠি দিলেন (ডনের ঠিকানা তারা জানত না, চিঠি আসে বাওয়াল দলের অধিনায়কের ঠিকানায়)। সিডনিতে এসে নেট প্র্যাকটিসে যোগ দেওয়ার জন্য। যাতায়াত ও থাকাখরচ তাঁদেরই।

ডন সিডনিতে এল বাবাকে সঙ্গে নিয়ে। আগে ঘাসের উইকেটে কখনো খেলেনি, তার ওপর নেটের ধারে দাঁড়িয়ে তার ছেলেবেলার হিরোরা, তবু আঠারো বছরের ডন একেবারে ব্যর্থ হল না। তার অমার্জিত টেকনিক ও ফুটওয়ার্ক সত্ত্বেও নির্বাচকরা তার মধ্যে সম্ভাবনা খুঁজে পেলেন। ছেলেটির ব্যাটিং মোটামুটি নির্ভুল, হুক ও ড্রাইভ করে খুব জোরে, ফুটওয়ার্ক বিদ্যুৎগতির। ওঁরা বুঝলেন, ছেলেটির যা কিছু ত্রুটি তা ঠিকমতো কোচিং না পাওয়ার এবং কংক্রিট উইকেটে খেলার জন্য। ওঁরা ডনকে সিডনির কোনো ক্লাবে এসে খেলতে বললেন। ডন প্রথমে যে-ক্লাবের কাছে গেল, তারা রাজি হল না ওকে নিতে। সেন্ট জর্জেস ক্লাব রাজি হল। ডন ট্রায়াল ম্যাচে খেলে ৩৭ ও ৬২ রান করে দু-বারই অপরাজিত থাকলেও রাজ্য নির্বাচকদের চোখে পড়ল না। কিন্তু কানট্রি উইক দলে স্থান পেল। কানট্রি উইক হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার সপ্তাহব্যাপী ক্রিকেট উৎসব। এতে বিভিন্ন জেলা ক্রিকেট দল খেলে। টেনিসেও এইরকম কানট্রি উইক উৎসব হয়। ডন টেনিসেও তার জেলা দলে স্থান পায়।

মুশকিলে পড়ল ডন। ক্রিকেট না টেনিস, কোনটায় খেলবে। ডন যার কাছে চাকরি করে, সেই পার্সি ওয়েস্টব্রুক বললেন, ‘খেলার জন্য এক সপ্তাহ ছুটি দিতে পারি, দু-সপ্তাহ নয়। এবার তুমিই ঠিক করো।’

ডন বেছে নিল ক্রিকেটকেই। কানট্রি উইকের পর সেনিউ সাউথ ওয়েলস দ্বিতীয় দলে খেলার সুযোগ পেয়ে ৪৩ এবং ৮ রান করে ভিক্টোরিয়ার বিরুদ্ধে। ওরিলি এই খেলায় ডনের দলে ছিল। প্রতি শনিবার সেন্ট জর্জেসের হয়ে ডন এখন নিয়মিত খেলে, মায়ের দেওয়া সেই ব্যাটটি নিয়েই। প্রতি শনিবার তাকে ভোর পাঁচটায় উঠে ছ-টার ট্রেন ধরতে হয়। বাওরাল থেকে সিডনি ৮০ মাইল পথ ট্রেনে কাটিয়ে খেলতে নামে, বাওরালে ফেরে মাঝরাতে। ক্লান্তিকর ব্যাপার সন্দেহ নেই। এই মরশুমে তার রান হল ২,২৮৯, গড় ৪৮।

বাওরালের হয়ে ডন আর একটি ম্যাচ খেলেছিল এবং হতভাগ্য মস ভেলের বিরুদ্ধেই। এবার ডন করে ৩২০ রান, ৬টি ছয় ও ৪৩টি চার মেরেছিল। এ পর্যন্ত ডনের সর্বোচ্চ রান। এরপরই স্থানীয় ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন আইন করে, স্থানীয় প্রতিযোগিতায় প্রথম গ্রেডের খেলোয়াড়রা আর খেলতে পারবে না। ব্র্যাডম্যানের ঝুড়ি ঝুড়ি রান বহন করে মস ভেল ক্লান্ত হয়ে গেছে। এবার শীঘ্রই ক্লান্ত হবার পালা আসছে ইংল্যাণ্ডের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *