টান

টান

ভূত আছে কি নেই এ তর্ক বহুদিনের। ভগবানের অস্তিত্ব নিয়েও এ ধরনের তর্ক আদিম যুগ থেকে চলে আসছে। দুটো তর্কেরই আজও কোনোরকম নিষ্পত্তি হয়নি, আর হবে কিনা তাও বলা যায় না।

বিজ্ঞানের যুগে তোমরা হয়তো এসব মানতে চাইবে না এবং এটাই স্বাভাবিক।

অণুবীক্ষণ আর দূরবীক্ষণ যন্ত্র নিয়ে যা দেখা যায় না, তার অস্তিত্বই নেই— এই তোমাদের হচ্ছে মত।

ভূতের কথা তোমাদের মতো এতদিন আমিও বিশ্বাস করতাম না। অনেক জায়গায় ভূত দেখার আমন্ত্রণও পেয়েছি। পোড়ো বাড়িতে রাত কাটিয়েছি, ঘোর অমাবস্যায় শ্মশানে ঘোরাফেরা করেছি— কিছু কিছু চামচিকে আর শেয়াল ছাড়া আর কিছু নজরে পড়েনি।

ভূত সম্বন্ধে ঘোরতর অবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলাম, এমন সময় এই ব্যাপারটা ঘটল, যা আজকে তোমাদের কাছে বলতে বসেছি।

ঠিক আমাদের পাশের বস্তিতে থাকে সমর রায়। ছেলেটি দেখতে যেমন সুন্দর, লেখাপড়াতেও তেমনই উৎসাহী। বি. এ. পরীক্ষা দেবার আগে মাঝে মাঝে আমার কাছে পড়তে আসত। সেই সময়ে তার বিদ্যাবুদ্ধির পরখ করার সুযোগ মিলেছিল। তা ছাড়া একেবারে পাশের বস্তিতে থাকত, কাজেই খুব ছোট্টবেলা থেকেই তাকে দেখেছি।

ইদানীং অনেক দিন সমরের সঙ্গে দেখা আর হয়নি। আমরা শুনেছিলাম পরীক্ষার পর বাইরে কোথায় বেড়াতে গেছে।

এক সন্ধ্যায় ঘরে বসে একটা বই পড়ছি। বাইরে ঝড়ের আভাস। জানলা, দরজার পর্দাগুলো দমকা বাতাসে উড়ছে; দু-এক ফোঁটা বৃষ্টি যেন গায়ে এসে পড়ল, কিন্তু বইটা এত ভালো লাগছিল যে, উঠে জানলাগুলো বন্ধ করতেও ইচ্ছে করছিল না।

এমন সময় হঠাৎ সশব্দে দরজাটা খুলে গেল। ভাবলাম ঝড়। চোখ ফিরিয়েই কিন্তু অবাক হলাম। সমর এসে দাঁড়িয়েছে উশকোখুশকো চুল, পাংশু মুখ।

‘কী সমর, কবে ফিরলে?’ বইটা মুড়ে প্রশ্ন করলাম।

সমর কৌচে আমার পাশে এসে বলল, ‘এই একটু আগে। জামাকাপড় ছেড়েই আপনার কাছে চলে এসেছি। আপনাদের খবর ভালো তো?’

বললাম, ‘হ্যাঁ ভালো, কিন্তু কি ব্যাপার? জরুরি কোনো কথা আছে নাকি?’

ওর হাবভাব দেখে আমার মনে হল সমরের বোধ হয় জরুরি কোনো কথা বলার আছে।

‘আপনার সময় হবে কখন? আপনার সঙ্গে আমার কথা ছিল একটু।’

হাসলাম। বললাম, ‘অফুরন্ত সময়। বলো কী তোমার কথা আছে বলার?’

‘মৃত্যুর পরে মানুষ শেষ হয়ে যায় না, মাস্টারমশাই। ভূত বলুন, আত্মা বলুন, তারা আছে। মাঝে মাঝে তারা দেখা দেয় শুনেছি। আচ্ছা, এটা কি ঠিক?’

এ প্রশ্ন হাজার বার হাজার জায়গায় শুনেছি। বুঝলাম কোনো কারণে সমর খুব উত্তেজিত হয়েছে। অনেকেরই রজ্জুতে সর্পভ্রম হয়। অন্ধকারে গাছপালা দেখে ভূত-প্রেত কল্পনা করে, কিংবা বদমাশ লোকের প্রতারণায় ভুলে মনে করে অশরীরী কিছু-একটা দেখেছে। সোজাসুজি উত্তর না-দিয়ে বললাম, ‘কী বলতে চাইছ সেটাই তুমি সহজ করে বলো।’

সমর কোঁচার খুঁট দিয়ে মুখ আর কপাল মুছে নিল। তারপর একটু দম নিয়ে আবার বলতে আরম্ভ করল—

‘লখনউতে আমার এক পিসি আছে জানেন বোধ হয়?’

‘হ্যাঁ, তোমার কাছেই শুনেছি। তিনি কোনো এক স্কুলের শিক্ষিকা তাই না?’

সমর ঘাড় নাড়ল, ‘পিসি বৈদ্যনাথ শিক্ষাসদনে পড়ান। তিনি অনেকদিন ধরে তাঁর কাছে আমাকে যেতে লিখেছেন, কিন্তু একটার-পর-একটা ঝঞ্ঝাটের পর ভাবলাম, এখন তো প্রচুর অবসর, এইবার ঘুরে আসা যাক কিছুদিন। তাই মাস খানেক আগে দেরাদুন এক্সপ্রেসে রওনা হয়ে গেলাম লখনউ।’

‘তোমার বাবার কাছে শুনেছি।’ আমি কৌচের ওপর পা দুটো তুলে ভালো করে বসলাম।

‘আপনি শুনলে হাসবেন, এই জীবনে আমার প্রথম রেলযাত্রা। কাজেই কৌতূহলের অন্ত ছিল না। প্রত্যেক স্টেশনে ট্রেন থামলেই আমিও নেমে প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করতে আরম্ভ করি। গার্ডের হুইসেলের সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসে কামরায় উঠি। কিন্তু একটা স্টেশনে বিপদ ঘটল।’

আমি সোজা হয়ে বসলাম। বললাম, ‘কি— ট্রেন ছেড়ে দিলে তো? তুমি আর সেই ট্রেনে উঠতে পারোনি নিশ্চয়ই!’

সমর আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর না-দিয়ে বলতে লাগল, ‘এক স্টেশনে নেমে এদিক-ওদিক বেড়াচ্ছি, হঠাৎ দেখলাম— একটি বছর আট-নয়েকের মেয়ে, বেশ ফুটফুটে চেহারা, কোঁকড়ানো চুল, পরনে নীল রঙের একটা ফ্রক। আমাকে হাত নেড়ে ডাকছে।

প্রথমে ভাবলাম, আমারই ভুল হয়েছে। মেয়েটি বোধ হয় অন্য কাউকে ডাকছে। এদিক-ওদিক চেয়ে দেখলাম, না অন্য কেউ তো ধারে-কাছে নেই। মেয়েটিকে বাঙালি বলেই মনে হল আমার। প্ল্যাটফর্মের ওপর বেশিরভাগই অন্য জাতের মানুষজনের জটলা। মেয়েটির সঙ্গে চোখাচোখি হতেই আবার সে হাতছানি দিয়ে ডাকল।

ভাবলাম বিদেশে মেয়েটি নিশ্চয় কোনো বিপদে পড়েছে। আমাকে স্বজাতি দেখে সাহায্য চাইছে।

মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেলাম। মেয়েটি দাঁড়িয়ে ছিল, আমি এগোতেই সে চলতে শুরু করল স্টেশনের বিশ্রাম কামরার দিকে। বুঝতে পারলাম, সম্ভবত এই বিশ্রাম কামরায় ওদের কোনো আত্মীয় বা আত্মীয়া বিপদে পড়েছেন কিংবা হঠাৎ অসুস্থ হয়েছেন। কিন্তু না, বিশ্রামকক্ষের সামনে একটু দাঁড়িয়েই ঘাড় ফিরিয়ে আমাকে দেখে আবার হাত নেড়ে ডেকেই আবার এগিয়ে গেল।

ওধারে বকুল গাছ। অজস্র বকুল ঝরে পড়েছে পথের ওপর। পাশে স্টেশনের সীমানায় রেলিং, মেয়েটি সেখানে দাঁড়াল।

আমি জোরে জোরে হেঁটে মেয়েটির কাছে এগিয়ে গেলাম। আর ঠিক সেইসময়—’

আমি আর উৎকণ্ঠা চেপে রাখতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হল?’

‘হুইসিল দিয়ে ট্রেন ছেড়ে দিল, এদিকে চেয়ে দেখি মেয়েটি উধাও! এক নিমেষে যেন মুছে গেল। আমি ট্রেনের দিকে ছুটলাম, কিন্তু ধরতে পারলাম না। দুরন্ত গতিতে ট্রেন যেন আমার চেষ্টাকে উপহাস করতে করতে বেরিয়ে গেল।’

এতক্ষণ পর আমি হাসলাম। ‘এই তোমার ভৌতিক গল্প। মেয়েটি তোমায় বোকা বানিয়ে সরে পড়েছে। বয়স কম হলে হবে কী, মেয়েটি বেশ ওস্তাদ মনে হচ্ছে।’

সমর আমার হাসিতে যোগ দিল না, গম্ভীর গলায় বলল, ‘আমার কাহিনি এখানে শেষ হয়নি মাস্টারমশাই।’

আমি একটু অপ্রস্তুত হলাম, বললাম, ‘বেশ বলে যাও।’

‘আমি স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে দেখা করে ট্রেন ফেল করার কথা বললাম। তিনি পরের স্টেশনে ফোন করে দিলেন, যাতে তারা আমার বিছানা আর সুটকেশটা নামিয়ে রাখতে পারে। এর পরের ট্রেন রাত সাড়ে ন-টায়।

হাতে অঢেল সময়। সমস্ত বিশ্রাম কক্ষগুলো তন্নতন্ন করে খুঁজলাম। কয়েক জন দেহাতী যাত্রী বসে আছে। মেয়েটি কোথাও নেই। স্টেশনের বাইরে এসে কয়েকটা টাঙ্গাওয়ালাকে মেয়েটির কথা জিজ্ঞেস করলাম। তারা কেউ কিছু বলতে পারল না।

আশ্চর্য লাগল চোখের সামনে থেকে মেয়েটি কী করে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল! এমন সুন্দর দিনের আলোয় সে সরে যেতে পারে!

আশ্চর্য হবার আমার আরও বাকি ছিল। রাত সাড়ে সাতটা নাগাদ সারা স্টেশনে হইচই। সবাই খুব ব্যস্ত। গিয়ে খবর নিয়েই চমকে উঠলাম। দেরাদুন এক্সপ্রেসের সঙ্গে এক মালগাড়ির ভীষণ ধাক্কা লেগেছে। অনেক লোক আহত হয়েছে, মারা গেছে বেশ কয়েক জন।

আপাতত সব গাড়ি বন্ধ। দু-একটি রিলিফ ট্রেন সাহায্য নিয়ে ছোটাছুটি করছে। স্টেশন মাস্টারের কামরায় খুব ভিড়। অনেকেই আত্মীয়স্বজনের খবর নেবার জন্য ব্যাকুল। ভিড় কমতে খবর পেলাম, দেরাদুন এক্সপ্রেসের সামনের চারখানা বগি একেবারে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে। সামনের তিন নম্বর বগিতে আমার থাকার কথা। সেই মুহূর্তে নতুন করে আবার মেয়েটির কথা মনে এল। মেয়েটি যদি হাতছানি দিয়ে আমাকে ডেকে না-নিয়ে যেত তাহলে আমার কী অবস্থা হত ভেবেই শিউরে উঠলাম।

সেই রাতেই দুটো টেলিগ্রাম করলাম। একটা কলকাতার বাড়িতে, আর একটা লখনউতে, পিসির কাছে। লিখে দিলাম যে ভাগ্যক্রমে দুর্ঘটনার হাত থেকে আমি বেঁচে গেছি। পথে এক স্টেশনে আমি নেমে পড়েছিলাম।

লাইন ঠিক হতে দিন কয়েক লাগল। আবার একদিন লখনউ রওনা হলাম, পিসিকে খবর দিয়ে।

সারারাত সেই মেয়েটির কথা ভাবলাম। বিধাতার আশীর্বাদের মতো সেই মেয়েটি যেন আমার প্রাণরক্ষা করতেই এসেছিল। কাজ শেষ করে বোধ হয় মিলিয়ে গেল।

পরের দিন এগারোটা নাগাদ লখনউ পৌঁছোলাম। স্টেশনে পিসি এসেছিলেন। খুব ছোটোবেলায়— তাঁকে দেখেছিলাম, তবু চিনতে অসুবিধে হল না। পিসির চেহারা প্রায় একইরকম রয়েছে।

প্রণাম করতেই বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ”খবরের কাগজে ট্রেন দুর্ঘটনার খবর পেয়ে আমার যা অবস্থা হয়েছিল। কেবল মনে হচ্ছিল এর জন্যে আমিই দায়ী। আমি বার বার তোকে আসতে লিখেছিলাম। তারপর তোর টেলিগ্রামটা পেয়ে ধড়ে প্রাণ এল। কী ব্যাপার বল তো?”

সব ব্যাপারটা বললে পিসি হয়তো বিশ্বাস করতেন না। বিশেষ করে তিনি যখন বিজ্ঞান পড়ান। কাজেই মেয়েটির ব্যাপারটা বেমালুম চেপে গিয়ে বললাম, চা খেতে একটা স্টেশনে নেমেছিলাম, ট্রেন ছেড়ে দিল। ছুটে গিয়েও ট্রেন ধরতে পারলাম না।

পিসি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, ”ভগবান বাঁচিয়েছেন তোকে, জন্ম জন্ম যেন তোর চা খাওয়ার নেশাটি থাকে।”

দু-জনে টাঙ্গায় উঠলাম। প্রায় আধঘণ্টার ওপর চলার পর একটি বাড়ির সামনে টাঙ্গা থামল। পিসির নির্দেশে।

পিসি নেমে চিৎকার করলেন, ”সুন্দর, সুন্দর!”

একটি ছোকরা নেমে এল, আমার সুটকেশ আর বিছানা নিয়ে আবার ওপরে উঠে গেল। পিসির পিছন পিছন আমিও ওপরে উঠলাম।

মাঝারি সাইজের একটা ঘরের দিকে আঙুল দেখিয়ে পিসি বললেন, ”এই ঘরটা তোর। যা, জামাকাপড় ছেড়ে নে। আমি জলখাবারের বন্দোবস্ত করি।”

শরীর খুবই ক্লান্ত ছিল। ঘরের মধ্যে ঢুকে একটা চেয়ারের ওপর নিজেকে ছেড়ে দিলাম।

এক কোণে একটা টেবিল, তার ওপর বাতিদান। একটা আলনা, ছোটো একটা খাট। দেয়ালে গোটা তিনেক ছবি। সামনের ছবিটার দিকে চাইতেই সমস্ত শরীর বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো কেঁপে উঠল। উঠে দাঁড়িয়ে পড়লাম। মনে হল ভয়ের কালো ছায়া আমাকে আবৃত করার চেষ্টা করছে।

তাড়াতাড়ি বাইরে এসে ডাকলাম, ”পিসি, পিসি…!”

পিসি বোধ হয় নীচের রান্নাঘরে ছিলেন। কোনো সাড়া পেলুম না, কিন্তু পিসিকে আমার একান্ত দরকার। আমি তাড়াতাড়ি সিঁড়ির মাঝ বরাবর নেমে আবার ডাকলাম, ”পিসি ও পিসি!”

ততক্ষণে আমার ডাক পিসির কানে পৌঁছোল।

হন্তদন্ত হয়ে পিসি সিঁড়ির কাছে এসে বললেন, ”কীরে, কী হয়েছে তোর?”

”একটু এঘরে এসো তো!”

আমি ছুটে ওপরের ঘরে এসে দাঁড়ালাম। হাঁপাতে হাঁপাতে পিসিও এলেন একটু পরে।

”কী হল রে তোর? শরীর খারাপ হয়নি তো? এত ঘামছিস কেন?”

জামার আস্তিন দিয়ে কপালের ঘামের বিন্দু মুছে বললাম, ”না, শরীর আমার ঠিক আছে। কিন্তু এ ছবিটা কার?”

হাত দিয়ে সামনের ফোটোটা দেখালাম।

পিসি বললেন, ”ওটা টুনুর ফোটো। আমার মেয়ে টুনু।”

”তোমার মেয়ে?”

”হ্যাঁ, তাকে দুই দেখিসনি। তোর জন্মাবার আগে টুনু মারা গেছে টাইফয়েডে। বোধ হয় বছর আটেক হয়েছিল বয়স।”

শেষদিকে পিসির কণ্ঠস্বর একটু গাঢ় হয়ে এল।

”কিন্তু—” ঠোঁটটা কামড়ে থেমে গেলাম।

”কিন্তু কীরে, কী বলবি বল?” পিসি বললেন।

”তুমি কি বিশ্বাস করবে পিসি? বিশ্বাস করবার কথা নয়!”

”কথাটা বল তবে তো বুঝব, বিশ্বাস করবার কথা কিনা!” পিসি আমার ভাবভঙ্গি দেখে রীতিমতো বিস্মিত হলেন।

”টুনুদির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে পিসি।”

আমার কথা শেষ হবার আগে পিসি ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়লেন। ভাবলেন, নির্ঘাৎ ছেলেটির মাথা খারাপ হয়েছে।

একটু একটু করে সব বললাম। যখন শেষ করলাম, পিসির চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়ছে। পিসি বিজ্ঞান পড়ান, কিন্তু একটি কথারও প্রতিবাদ করলেন না, কিছু অবিশ্বাস করলেন না, শুধু বললেন, ”টুনুই তোর প্রাণ বাঁচিয়ে দিয়েছে!” ‘

এবার সমর আমার দিকে ঘুরে বসল।

‘বলুন মাস্টারমশাই, কী করে এটা সম্ভব? মারা যাবার পরও কি আত্মার স্নেহ, দয়া, মায়ার টান থাকে? নিজের আত্মীয়দের বাঁচাবার জন্যে তারা কি মানুষের দেহ ধরে আবার ফিরে আসতে পারে মর্তলোকে?’

বাইরে ঝড়ের সঙ্গে প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আম গাছের একটা ডাল জানালার পাল্লায় মাথা ঠেকছে অনবরত। জলের ঝাপটায় ঘরের অনেকখানি ভিজে গিয়েছে।

সেইদিকে চেয়ে চুপ করে বসে রইলাম। কী উত্তর দেব সমরের প্রশ্নের?

চিরদিনের জন্যে হারিয়ে যাওয়া মানুষ নিজের লোককে বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্যে মায়া-মমতার টানে আবার কি পৃথিবীতে ফিরে আসে? তাও কি সম্ভব?…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

টান

টান

টান

গল্প নয়, সত্য ঘটনা।

যাঁর মুখে আমার এ-গল্প শোনা, তাঁদের পরিবারবর্গ কর্ম উপলক্ষ্যে পূর্ব-আফ্রিকার নাইরোবি শহরে অনেক দিন থেকে বাস করছিলেন। ও-দেশের নানাগল্প আমি বন্ধুটির মুখে সেদিন বসে বসে শুনছিলাম।

সকাল বেলা, পাহাড়ি পথে একা বেড়াতে বার হয়েছি, একখানা জিপ-গাড়ি দেখি স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসছে, আমার বন্ধু প্রণববাবু গাড়িটি চালাচ্ছেন। অনেক দিন দেখিনি প্রণববাবুকে, তিনি কবে এখানে এসেছেন তাও জানি না।

আমাদের এদিকের বাজারে মালিয়া মোহান্তির বড়ো গোলদারি দোকান। তার কাছে জিগ্যেস করে জানলুম, প্রণববাবু আজ দু-মাস ধরে ‘হোমসডেল’ কুঠিতে বাস করছেন।

মিনিট পঁয়ত্রিশ পরে (কারণ আমাকে পায়ে হেঁটে এই পথটা যেতে হল তো) প্রণববাবু ও আমি দু-জনে বসে গল্প করছিলাম ও চা পান করছিলাম। অনেক দিন পরে আমাদের দেখাসাক্ষাৎ এবং দু-জনেই খুব খুশি হয়েছিলাম এইরকম হঠাৎ দেখা হওয়ায়।

প্রণববাবু বললেন— এখানে খেয়ে যাবেন।

—বাড়িতে বলে আসিনি, স্নান হয়নি—

—সব ব্যবস্থা হয়ে যাচ্ছে। তাহলে থাকবেন তো? একটা খুব ভালো গল্প বলব খেয়ে-দেয়ে ওই বুড়ো হরতুকিতলার ছায়ায় বসে, কেমন? ও লাখপতিয়া, এখানে এসো— এই বাবুর বাড়ি গিয়ে খবর দিয়ে আসতে হবে।

—এখানে কতদিন আর থাকবেন?

—বুধবারে চলে যাব। আজ দেখা হওয়াতে বড়ো ভালো হল। কতদিন দেখা হবে না আবার— কে জানে!

—অথচ আমরা কলকাতাতেই থাকি, ঠিকানা না জানাতেই—

—মাংস খান তো?

—খুব।

—নিষিদ্ধ পক্ষীর?

—খুব।

মধ্যাহ্নভোজন খুব ভালোই হল।

এরপর আমরা সেই হরতুকিতলায় গিয়ে বসি। সামনে পশ্চিম দিকে নদীর ওপারে শৈলশ্রেণি, ঝির-ঝির বাতাস বইছে নদীর দিক থেকে। একদল সাদা বক পাহাড়শ্রেণিকে পেছনে ফেলে মেঘের তলা দিয়ে উড়ে আসছে এদিকে।

প্রণববাবু বললেন— আপনি আমার জীবনের কথা কিছু কিছু সকাল বেলা শুনেছেন। আজ একটি অসাধারণ ঘটনার কথা বলব। এ আমার নিজের চোখে দেখা বলেই আপনার কাছে বলবার ইচ্ছেটা বড়ো প্রবল হয়েছে।

আপনি জানেন, আমার বাবা ও কাকা উগান্ডা রেলপথ তৈরির সময় থেকে ওদেশে ছিলেন। আমার এক কাকা বেলজিয়ান কঙ্গোতে কমলালেবুর আবাদ করেন। আমার বাবার অনেক আগে থেকে তিনি আছেন সে দেশে। তাঁর চার-পাঁচটি ছেলে বিগ গেম হান্টার। লোহার মতো শরীর, অনর্গল সোহালি ভাষা বলতে পারে সে দেশের নেটিভদের মতোই। এসব কথা গল্পের মতো শোনাচ্ছে না কি? কিন্তু ঘর-বলা লোকের কাছে হয়তো এ সব যতই গল্প বলে মনে হোক, আমরা জানি বাংলাদেশের লোক কত দূরে দূরে ছড়িয়ে আছে। পৈতৃক বাসভূমি বলাগড়ের কাছে সিমুলিয়া। দশ বছর বয়সে আমি প্রথম নাইরোবি যাই। ভিক্টোরিয়া নায়ানজা হ্রদের তীরবর্তী কামপালা নামক ছোটো শহরে সীতানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলে একজন ভদ্রলোক স্কুল-মাস্টারি করতেন সে সময়। আমাদের পরিবারের সঙ্গে তাঁর খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। সে সময়ে তিনি বিবাহ করেননি, ছুটি-ছাটাতে নাইরোবিতে আমাদের বাসায় এসে বসতেন। তিনি দিন কতক আমায় ইংরেজি পড়াবার ভারও নিয়েছিলেন।

সে-সময়ে ওদেশে জিনিসপত্র খুব সস্তা ছিল। মাংস, দুধ, মাখন, কপি যথেষ্ট পাওয়া যেত। সমগ্র নাইরোবিতে তিন-ঘর বাঙালি পরিবার ছিল। সকলেই উগান্ডা রেলপথের কর্মচারী। আর একজন ছিল খ্রিস্টান, ধর্মপ্রচার করবার কাজে কী এক মিশন কর্তৃক প্রেরিত, মাঝে মাঝে নাইরোবিতে থাকত, মাঝে মাঝে দূর পল্লি অঞ্চলে চলে যেত।

আমি পনেরো বৎসর একাদিক্রমে নাইরোবিতে ছিলাম বাবা-মার সঙ্গে। ওখানকার জীবন খুব ভালোই কেটেছিল। জীবনযাত্রা ছিল সম্পূর্ণ নিরুদবেগ। জিনিসপত্র ছিল সস্তা, কত নতুন স্বপ্ন তখন দেখেছি অল্পবয়সে। একবার আমার খুড়তুতো ভাই অতুল এসে বেলজিয়ান কঙ্গোর জীবনের এক অপূর্ব ছবি আমার চোখের সামনে ধরলে, সেই আমার তরুণ বয়সে। বাবাকে বললাম, কাকার কমলালেবুর আবাদে গিয়ে কাজ করব, হাতি-সিংহ শিকার করব, গল্পের বইয়ের নায়কের মতো দুর্দান্ত অ্যাডভেঞ্চারপূর্ণ মুক্ত জীবনানন্দ আস্বাদ করব।

আমি বললাম— তখন আপনার বয়স কত?

—সতেরো বছর।

—লেখাপড়া?

—কামপালার সেই মাস্টার সীতানাথ বাঁড়ুজ্যে ইংরেজি পড়াতেন আর স্টেশনমাস্টার ডসন সাহেবের মেমের কাছে অঙ্ক কষতাম। আমায় বড়ো ভালোবাসতেন ডসন সাহেবের স্ত্রী। তাঁর এক ছেলে ছিল প্রায় আমার বয়সি। একটা এয়ারগান নিয়ে তার সঙ্গে খেলা করতাম। শিকারের ঝোঁক ছিল আমাদের দু-জনেরই। নাইরোবির বাইরে তখন বিস্তীর্ণ প্রান্তরে কণ্টক ও সিমোসা গাছের বনে জেব্রা, সিংহ, জিরাফ, উটপাখির দল বিচরণ করত; এখনও করে। আমরা কতবার এইসব অঞ্চলে যেতাম বন্য জন্তু শিকারের জন্যে। একবার একদল সিংহের সামনে পড়েছিলাম, তারমধ্যে এক গর্ভবতী সিংহী ছিল। সে আমাদের প্রায় চোখের সামনে একটা ঝোপের আড়ালে তিন-চারটে শাবক প্রসব করেছিল। সুতরাং লেখাপড়া সেখানে তেমন হয়নি।

—আপনি ডাক্তার হয়েছিলেন কোথায় পড়াশুনো করে?

—সে অনেক পরে। কলকাতায় ডাক্তারি পড়ি।

—কত বছর বয়সে কলকাতায় আসেন?

—পঁচিশ বছর বয়সে।

—অত বছর বয়সে ডাক্তারি পড়লেন? পাশ করেছিলেন?

—হোমিয়োপ্যাথিক কলেজে পড়ি, মাত্র তিন বছরের কোর্স ছিল তখন। তাতেই যথেষ্ট রোজগার করেছি বা এখনও করছি।

—ভাগ্যটা ভালো আপনার।

—আমি প্রথম প্র্যাকটিস করি ডার এস সালামে, তারপর মোসাম্বায়। ওখান থেকে বম্বে। বম্বে থেকে কলকাতায় এলাম। পয়সা যা কিছু বেশি রোজগার করি, সবই ডার এস সালামে। ইচ্ছে ছিল আবার সেখানে যাই, কিন্তু সেখানে আর সুবিধে হবে না। ম্যালান গভর্নমেন্টের আওতায় ও উৎসাহে যে-অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে ভারতবাসীদের আর সেখানে হয়তো সুবিধে হবে না। ওরাই বেশি ডাকত।

—কারা?

—আফ্রিকানরা। ওদের মধ্যে অনেকে ভারতীয় মেয়ে বিয়ে করেছিল সে সময়। অনেক মেয়ে ভারতীয় স্বামী গ্রহণ করেছিল। আস্তে আস্তে উভয় সমাজে এ-প্রথাটা চালু হচ্ছিল।

—এইবার আসল গল্পটা বলুন।

—বেলা গিয়েছে। বাকিটুকু অতিঅল্প, কিন্তু ভারি অদ্ভুত। শুনলেই তো ফুরিয়ে যাবে। তার চেয়ে চলুন চা-খাওয়া সেরে নেওয়া যাক।

চা খাওয়া হল। ও-বেলাও যাতে আমি থাকি, সেজন্য প্রণববাবু ও তাঁর স্ত্রী পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। এবেলা নাকি ভালো করে খাওয়ানো হল না, আমার খাওয়ার নাকি খুবই কষ্ট হল।

সন্ধ্যার পর আধ-জ্যোৎস্না আধ-অন্ধকারের মধ্যে প্রণববাবু আবার গল্প শুরু করলেন সেই হরতুকিতলায় বসে।

—এইবার যে-কথাটা বলব, সেটা ভালো করে বুঝতে হলে আমার মামার বাড়ির ইতিহাস আপনার কিছু জানা দরকার। আমার দাদামশাই গোবিন্দ ঘোষাল সিপাই বিদ্রোহের সময় ফয়জাবাদ মিলিটারি অ্যাকাউন্টেন্টের কাজ করতেন। তাঁর দুই বিবাহ, আমার দিদিমাকে তিনি বিবাহ করেন যখন, তখন তাঁর বড়ো ছেলের বয়েস ত্রিশ বছর। আমার মা তাঁর শেষ বয়সের সন্তান; কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, আমার সে দিদিমা সধবা অবস্থায় দেহত্যাগ করেন। আমার মাকে মানুষ করে বামা বলে এক পুরোনো ঝি, আমার মামার বাড়ির। আমার দাদামশাই তখন চাকরি থেকে অবসর নিয়ে হুগলি জেলায় নিজের গ্রামে এসে বসেছেন।

বামা মাকে ঠিক নিজের সন্তানের মতো মানুষ করেছিল। বাইরে কোথাও গেলে সন্ধ্যার পর পিছু পিছু যেত মার বড়ো বয়সেও।

বামা কোথাও যেত না। নিজের দেশ বর্ধমান জেলার যে ক্ষুদ্র গ্রামটিতে তাঁর পৈতৃক ভিটে, মার ভার নেওয়ার পর থেকে সে কখনো আর গ্রামে পদার্পণ করেনি।

আমার মা যখন বিয়ের কনে সেজে আমাদের বাড়ি এসেছিলেন, বামা তখন মার সঙ্গে এ-বাড়ি চলে আসে এবং মাঝে মাঝে দেশে চলে গেলেও প্রায়ই তার এই জামাই-বাড়ি এসেই থাকত।

মা বলতেন— এখানেই থাকো না কেন বামা?

সে বলত— না খেঁদি (ডাক নাম), জামাই-বাড়ি কি থাকতে আছে? লজ্জার কথা!

সে কিন্তু মাকে ছেড়ে বেশিদিন থাকতে পারত না; কিছুদিন পর পর প্রায়ই আসত। আসবার সময়, মা যা খেতে ভালোবাসতেন ছেলেবেলায়— নারকেল নাড়ু, চিঁড়ে, কলা এইসব জোগাড় করে নিয়ে আসত। শুধু হাতে কখনো আসেনি।

বামা কিন্তু মারা যায় আমার মামার বাড়িতেই, হঠাৎ কী একটা অসুখ হয়ে। মার সঙ্গে দেখা হয়নি। মার সেজন্য খুব দুঃখ হয়েছিল। আমাদের কাছে পর্যন্ত বামার নাম করতেন আর চোখের জল ফেলতেন।

আমি বললাম— আপনি বামাকে দেখেছিলেন?

—না, আমার দাদা দেখেছিলেন, তখন দাদার ছ-সাত বছর বয়েস।

—তারপর?

—তারপর কর্ম উপলক্ষ্যে বাবা-মা উগান্ডা চলে গেলেন এবং সে দেশেই বাস করতে লাগলেন। আমরাও গেলাম ক্রমে সে দেশে। বাবার চাকরির উন্নতি হল। আমার এক বোনের বিয়ে হল মোম্বাসায়, সেখানে হুগলি জেলার বন্দিপুরের রামতারণ চক্রবর্তী শিপিং কোম্পানির অফিসে চাকরি করতেন, তাঁর বড়ো ছেলে শিবনাথ আমার ভগ্নীপতি।

পরের বৎসর আমার মা মারা গেলেন।

আমার বোনের বিয়ের আগে থেকেই তিনি হৃদরোগে কষ্ট পাচ্ছিলেন, একদিন সন্ধ্যার পর আমাদের সঙ্গে গল্প করতে করতে বললেন শরীরটা কেমন করছে।

তারপর ঘরের মধ্যে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন, ডাক্তার আসবার আগেই মারা গেলেন।

এইবার আসল কথাটা এসে গিয়েছে।

মা তো মারা গেলেন সন্ধ্যার সময়। অনেক রাতে লোকজন জোগাড় হল। যে-কটি বাঙালি পরিবার নাইরোবিতে সে সময় থাকত, তাদের সকলের বাড়ি থেকেই মেয়েরা ও পুরুষেরা এলেন সে-রাত্রে আমাদের বাড়ি খবর পেয়ে। রাত এগারোটার পর আমরা শ্মশানে মৃতদেহ নিয়ে গেলাম।

নাইরোবির বাইরে শহর থেকে প্রায় এক ক্রোশ দূরে অপেক্ষাকৃত নীচু জায়গায় নদীর ধারে শ্মশান। স্থানটা বড়ো নির্জন ও ঘাসের জঙ্গলে ভরা। রাত্রে এ-সব স্থানে সিংহের ভয় ছিল খুব বেশি। সিংহের উপদ্রবে রাতে কেউ বড়ো একটা মড়া নিয়ে যেতে সাহস করত নাকো শ্মশানে। আমাদের সঙ্গে অনেক লোক ছিল। আলো জ্বেলে ও বন্দুক নিয়ে আমাদের দল মৃতদেহ শ্মশানে নিয়ে গেল।

মৃতদেহ চিতায় চড়ানো হয়েছে, দাদা মুখাগ্নি করলেন, আমরা সবাই অদূরে বসে আছি। এমন সময় আমার ছোটো ভাই দেবু আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললে— ওই দেখ, ও কে দাদা?

আমি চেয়ে দেখলাম, শ্মশানের দক্ষিণ দিকে একটা গাছতলায় একজন ভারতীয়া বৃদ্ধা মহিলা চুপ করে বসে একদৃষ্টে চিতার দিকে চেয়ে আছে। পরনে তার আধময়লা থান-কাপড়।

বাবা সেদিকে চেয়ে বলে উঠলেন— সর্বনাশ! ও যে বামা ঝি!

দাদা বললেন— হ্যাঁ বাবা, বামাদিদিমার মতো দেখতে বটে!

বাবা বললেন— তোর মনে আছে?

—একটু-একটু মনে পড়ে বাবা।

আমরা সবাই অবাক হয়ে সেদিকে চেয়ে রইলাম। সত্যি, এই গভীর রাতে এই দুর্গম শ্বাপদসঙ্কুল শ্মশানভূমিতে কোনো বাঙালি মেয়ের আসবার কথা কেউ কল্পনা করতে পারে না। আমরা কেউ তাকে চিনিও না। কেবল চেনেন বাবা এবং সামান্য কিছু চেনে দাদা। তাদের সাক্ষ্য সেখানে সেদিন গভীর এক তত্ত্বের অবতারণা করলে— কোথায়-বা চিতা, কার-বা মৃতদেহ, মৃত্যুই-বা কার?

বৃক্ষতলে উপবিষ্ট নারীমূর্তি কিন্তু আমাদের দিকে লক্ষ করেনি। সে সম্পূর্ণ নিস্পৃহ, উদাসীনভাবে একদৃষ্টে জ্বলন্ত চিতার দিকে চেয়ে বসে ছিল। এখনও সে ছবি দেখছি চোখের সামনে। চিরকাল আঁকা থাকবে সে-ছবি আমার মনের পটে।

হুগলি জেলার এক অখ্যাত গ্রাম থেকে মৃত্যুঞ্জয়ী স্নেহের টানে আজ বিশ বছর পরে বামা ঝি চলে এল পূর্ব-আফ্রিকার নাইরোবির শ্মশানভূমিতে।

বেশিক্ষণ আমরা দেখতে পাইনি। সবসুদ্ধ বোধ হয় মিনিট পাঁচ-ছয় হবে বামা ঝি-কে আমরা দেখতে পেয়েছিলুম সবাই মিলে। তার পরেই মিলিয়ে গেল সে মূর্তি।

আমরা বেশি কিছু কথা বলিনি এর পর। দাহকার্য শেষ করতে সকাল হয়ে গেল। নদীতে স্নান করে আমরা বাড়ি ফিরে এলুম, তখন বেলা সাতটা-সাড়ে সাতটা। ওই নদীতীরেই আমার মার দশপিণ্ড দেওয়া হয় এর দশদিন পরে এবং মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন রেল অফিসের অবিনাশ গাঙ্গুলি, নাইরোবির বাঙালিদের মোটামুটি বিয়ে, পৈতে, ষষ্ঠীপুজো তিনিই করতেন। তাঁর নামই ছিল আমাদের মধ্যে ‘পুরুত-কাকা’।

নদীর ওপারে শৈলশ্রেণি সন্ধ্যার অন্ধকারে ঢেকে গেল।

চৈত্র ১৩৫৬, আনন্দবাজার দোল সংখ্যা

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *