মশলা-ভূত

মশলা-ভূত

বড়োবাজারের মশলা-পোস্তায় দুপুরের বাজার সবে আরম্ভ হয়েছে। হাজারি বিশ্বাস প্রকাণ্ড ভুঁড়িটি নিয়ে দিব্যি আরামে তার মশলার দোকানে বসে আছে। বাজার একটু মন্দা। অনেক দোকানেই বেচা-কেনা একেবারেই নেই বললেই চলে, তবে বিদেশি খদ্দেরের ভিড় একটু বেশি। হাজারির দোকানে লোকজন অপেক্ষাকৃত কম। ডান হাতে তালপাতার পাখার বাতাসে টানতে টানতে হাজারি ঘুমের ঘোরে মাঝে মাঝে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ছিল, এমন সময় হঠাৎ কার পরিচিত গলার স্বর শুনে সে চমকে উঠল।

—বলি ও বিশ্বেস— বিশ্বেসমশাই! বার-দুই হাঁক ছেড়ে যতীন ভদ্র তার ডান হাতের লাঠিটি একটি কোণে রেখে দিয়ে সম্মুখের খালি টুলটার ওপর ধপাস করে বসল।

যতীন হাজারি বিশ্বাসের সমবয়স্ক; অনেক দিনের বন্ধু। ভাগলক্ষ্মী এতকাল তার ওপর অপ্রসন্ন ছিল। হালে সে হাজারির পরামর্শে মশলার বাজারে দালালি আরম্ভ করেছে। দু-পয়সা পাচ্ছেও সে। যতীনের মোটা গলার কড়া আওয়াজ পেয়ে হাজারি খুব আগ্রহান্বিত হয়ে উঠে বসল। হাজারি বিলক্ষণ জানত যে যতীন যখনই আসে কোনো একটা দাঁও বিষয়ে পাকাপাকি খবর না-নিয়ে আসে না। তাই সে যতীনকে খুবই খাতির করে।

যতীন বললে— দেখো, শুধু দোকানদার হয়ে খদ্দেরের আশায় রাস্তার দিকে হাঁ করে বসে থাকলে তাতে আর টাকা আসে না, ঘুমই আসে। পাঁচটা খবরাখবর রাখতে হয়, বুঝলে?

হাজারি বললে— এসো এসো, যতীন। ভালো আছ? অনেকদিন দেখিনি। কিছু খবর আছে নাকি?

—সেই খবর দিতেই তো আসা। অনেক হদিশ জানতে হয়, মাথা ঠুকলেই টাকা করা যায় না— অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবে টাকা, বুঝলে? এখন কী দেবে বলো। জানোই তো যতীন ভদ্র বকে একটু বেশি, কিন্তু খবর যা জানে তা একদম পাকা। যাক, এখন আসল কথা তোমায় যা বলি, মন দিয়ে শোনো।

যতীন অতঃপর হাজারিকে কাছে বসিয়ে চুপি চুপি তার কথাটি বলে গেল। যতীনের কথায় টাকার গন্ধ পেয়ে হাজারি কান খাড়া করে এমনই একাগ্রভাবে শুনে যেতে লাগল যে, সত্যনারায়ণের পাঁচালিও লোকে অতটা মন দিয়ে শোনে না।

ব্যাপারটা এই—

গ্রেহাম ট্রেডিং কোম্পানির একটা মস্ত মালজাহাজ এস এস রেঙ্গুন ডাচ ইস্ট ইন্ডিজের কোনো এক বন্দর থেকে প্রচুর মাল নিয়ে কলকাতায় আসছিল। যতরকম মাল বোঝাই ছিল, তারমধ্যে মশলার বস্তাই সবচেয়ে বেশি। লঙ্কা, হলুদ, জিরে, তেজপাতা প্রভৃতি কত রকমের মশলা। প্রতিটি বস্তা ওজনে আড়াই মণের কম নয়। এরকম শত শত বস্তার গাদায় জাহাজখানা আগাগোড়া ঠাসা। সেই মালজাহাজখানি গঙ্গার ভেতর ঢুকতেই ঘন-কুয়াশার মধ্যে শেষরাত্রির ভাটার মুখে গঙ্গার চোরাবালির চড়ায় ধাক্কা খেয়ে ডুবে যায়। জাহাজ যখন সবে ডায়মন্ডহারবার পেরিয়ে গঙ্গায় এসেছে, তখন এই ব্যাপার। সারেঙ শত চেষ্টা করেও কিছুতেই সামাল দিতে পারলে না। জাহাজডুবির সঙ্গে কতক লোকও জলে ডুবে মারা যায়। জাহাজের কতক মাল নষ্ট হয়ে যায় আর বাদবাকি মাল সব গঙ্গার জলে ভাসতে থাকে। মশলার বস্তাগুলি প্রায় ডোবেনি— বিশেষ ক্ষতিও হয়নি। দূর থেকে ওই মশলা-বস্তার গাদাগুলোকে ভেসে যেতে দেখে পোর্ট-কমিশনারের লোকেরা সে সব তুলে পাড়ে টেনে নেয়। কাল সকাল সাড়ে আটটার সময় নিলাম ডেকে বস্তিবন্দি মশলাগুলো বিক্রি করা হবে।

ধড়িবাজ হাজারি বিশ্বাস যতীনের কথাবার্তা শুনে চট করে সব বুঝে নিলে। কত লোককে চরিয়ে কত পাকা ধানে মই দিয়ে সে আজ এত টাকার মালিক। কথাবার্তা তখনই সব ঠিক হয়ে গেল। যাবার সময় যতীন আবার হাজারিকে বেশ করে মনে করিয়ে দিয়ে বললে— দেখো ভায়া! টাকা যদি পিটতে চাও তবে এ সুযোগ কিছুতেই ছাড়া নয়। জলের দামে মাল বিকিয়ে যাচ্ছে। কাল সকাল সাড়ে আটটায় নিলেম। আমি সাতটার সময়েই তোমার সঙ্গে দেখা করব।

পরদিন হাজারি যতীনকে নিয়ে যথাসময়ে খিদিরপুরের দিকে রওনা হয়ে গেল। নিলামের জায়গায় পৌঁছুতে আর বেশি দেরি নেই, দূর থেকে কলরব শোনা যাচ্ছে। যতীন আগে আগে চলেছে, হাজারি পেছনে পেছনে ছুটছে। এতবড়ো সস্তার কিস্তিটা ফস্কে না যায়! হাজারি যতীনকে বরাবর নিলামের কাছে বস্তাগুলো গুনতি করতে পাঠিয়ে দিয়েই নিজে সটান এক দৌড়ে সাহেবের কাছে গিয়ে মস্ত বড়ো এক সেলাম করলে। সাহেবের সঙ্গে দু-মিনিট ফিস ফিস করে কী কথাবার্তা বলে হাজারি ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এসে নিলামের ডাক বন্ধ করে দিলে।

যতীন বললে— কী খবর ভায়া, সুবিধে করতে পেরেছো তো?

হাজারি খুব ব্যস্ত-সমস্তভাবে বললে— পরে বলব। কাজ হাসিল। এখন কত বস্তা গুনলে বলো দেখি?

—এক-শো বস্তা গোনা হয়ে গেছে।

বাস্তবিক, উঁচু-উঁচু গাদা করা মশলার বস্তাগুলোর দিকে চেয়ে হাজারির চোখ জুড়িয়ে গেল। সে যেদিকেই তাকায়, দেখে যে অগুনতি বস্তা সারবন্দি থামের মতো রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। উঃ এমন দাঁও জীবনে কারও ভাগ্যে একবার বই দু-বার আসে না! এখন মশলা-পোস্তায় কোনোরকমে তার গুদামে হাজারি এগুলো চালান দিতে পারলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।

আর দেরি নয়, হাজারি যতীনকে তাড়া দিয়ে ডেকে বলে— ওহে ভায়া, শুভ কাজে আর বিলম্ব কেন? এখন লরি ডেকে তাড়াতাড়ি মাল বোঝাই করে পোস্তায় চালান দিয়ে দাও। আমি ততক্ষণ এগিয়ে যাই।

একবারে সমস্ত মাল লরিতে ধরল না। দ্বিতীয় খেপ বস্তা চাপিয়ে যতীন যখন পোস্তায় ফিরে গেল তখনও বিকেল আছে। সে এসে দেখে, সবই অব্যবস্থা। রাশিকৃত বস্তার গাদা হাজারির দোকানের সামনে ফুটপাতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। মাত্র তিনটি লোক এতগুলো মাল তোলবার জন্যে লাগানো হয়েছে। চতুর্দিকে লোকের মহা ভিড়, হইহই ব্যাপার। এদিকে পুলিশ তাড়া দিচ্ছে— জলদি মাল হঠাও! হাজারি কেবল চেঁচাচ্ছে। সে যেন কিছুই গোছগাছ করে উঠতে পারছে না।

কাণ্ডকারখানা দেখে যতীন নিজেই কোমর বেঁধে লেগে গেল। প্রাণান্ত পরিশ্রমের পর সন্ধ্যার পূর্বেই সব মাল তোলা হয়ে গেল। বস্তাগুলি পাশাপাশি সাজিয়ে দেখা গেল, ঘরে আর কুলোয় না। তখন বস্তার ওপর বস্তা চাপিয়ে দিয়ে কড়িকাঠ পর্যন্ত মাল ঠাসা হল। গম্বুজের মতো এক-একটা ফুলো ফুলো বস্তা, আর বস্তাগুলো উঁচুও কী কম? এইভাবে বস্তা ভরাট করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যতীন আর হাজারি যখন বাড়ি ফিরল তখন রাত দশটা। সে-রাত্রে গুদামে তালা লাগিয়ে দিয়ে প্রতিদিনের মতো হাজারির চাকর বাইরে শুয়ে রইল।

শেষরাত্রে মশলার গুদামে কী-একটা শব্দ শুনতে পেয়ে আশেপাশের দোকানদারের ঘুম ভেঙে গেল। তারা চোরের আশঙ্কা করে চাকরটাকে ডেকে তুললে। চাকরটা শশব্যস্ত হয়ে আলো জ্বেলে বেশ পরখ করে এদিক-ওদিক দেখতে লাগল। কিন্তু চোর ঘরে ঢুকল কী করে? গুদামের দরজার তালা বন্ধ, স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। খানিক বাদে আবার দুম-দুম শব্দ। সকলে কান খাড়া করে রইল। বেশ মনে হল এবারকার শব্দটা যেন হাজারির মশলার গুদামের ভেতর থেকেই আসছে। অথচ ঘরের দোর-জানলা বন্ধ, বাইরে থেকে মোটা তালা দেওয়া। কী আশ্চর্য, চোর ভেতরে যাবেই-বা কী করে? আর চোর-টোর যদি না এল তবে শব্দই বা করে কে? মাঝে মাঝে মনে হতে লাগল, ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবার জন্যে কারা যেন ভেতর দরজায় ধাক্কা মারছে। শেষরাতের বাকি সময়টা এইভাবেই শব্দ শুনে কেটে গেল। আরও আশ্চর্য, ভোর হবার সঙ্গেসঙ্গে গুদামঘর থেকে শব্দও আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। সে রাত্রি এই পর্যন্ত।

পরদিন সকালে মশলাপট্টির দোকানদারদের মুখে মুখে রাষ্ট্র হয়ে গেল যে, হাজারির দোকানে বিষম কাণ্ড, ভীষণ চুরি! আসলে সত্যি যা নয় তার দশগুণ বাড়িয়ে দিয়ে মিথ্যে রটতে লাগল। ক্রমে কথাটা হাজারির কানে উঠল। হাজারি বিশ্বাস খবর পাওয়ামাত্র দৌড়ে এসে তালা খুলে গুদামে ঢুকে দেখে যে বস্তাগুলো ঠিকই আছে, একটি মালও বেহাত হয়নি। কী ব্যাপার? তখন সে ভাবলে, কিছু নয়; তার মশলা-বস্তাগুলো দেখে যাদের চোখ টাটিয়েছিল; এ নিশ্চয়ই সেই বদমাইশদের মিথ্যে কারসাজি। তারাই মজা দেখবার জন্যে চুরির গুজব রটিয়েছে। কিন্তু হরে চাকরটাও যে বললে, ভীষণ শব্দ শোনা যাচ্ছিল? এই শব্দ রহস্যটার হাজারি কিছুতেই কিনারা করতে পারলে না। চোর যদি এসেই থাকবে, তবে কিছু নিলেও না, উপরন্তু শব্দ করে জানান দিয়ে চলে গেল— এ কী ব্যাপার? তবে কি তাকে ভয় দেখাবার জন্যেই রাত্রি বেলা দুর্বৃত্তেরা এইসব আয়োজন করেছে? সাত-পাঁচ ভেবে হাজারি সেদিনকার মতো কথাটা চেপে গেল। ভাবলে, আজ রাতে আর বাড়ি না-গিয়ে নিজেই দোকান পাহারা দেবে। করলেও তাই।

রাত্রে ঘুমোবার আগে হাজারি আজ বেশ করে চাকরটাকে নিয়ে গুদামের উপর থেকে আরম্ভ করে নীচু পর্যন্ত আঁতিপাঁতি প্রত্যেকটি বস্তার গাদা দেখতে লাগল। তারপর ভেতর থেকে জানলাটা খুলে রেখে ঘরে তালা লাগিয়ে দিলে। তবে, আজ আর একটা নয়, হবসের চার লিভারের দুটো মস্ত ভারী তালা। হাজারি চাকরটাকে নিয়ে ঘরের সামনে শুয়ে নানা কথাবার্তার পর যখন ঘুমিয়ে পড়ল তখন রাতদুপুর।

শেষরাত্রের দিকে কী-একটা শব্দ হতেই হাজারির ঘুম ভেঙে গেল। হরে চাকরটা আগেই একটা শব্দ শুনতে পেয়েছিল। গত রাত্রের ব্যাপারও তার বেশ মনে আছে। তাই সে নিজে আর কোনো কথা না-বলে চুপ করেই পড়ে ছিল। কিন্তু খানিক বাদেই ও আবার কীসের শব্দ?— ধপাস-ধপাস-ধুপ-দুম-দুম-দাম? ঘরের ভেতর বস্তায়-বস্তায় কী বিষম ধস্তাধস্তি! যেন দৈত্য-দানবে লড়াই বেধেছে! হরে আর হাজারি তখন ধড়ফড় করে এক লাফে বিছানা ছেড়ে আলো জ্বালিয়ে দেখতে লাগল তালা ঠিক আছে কি না। তালাদুটো ঠিকই আছে। হাজারি জানলার ফাঁকে চোখ তাকিয়ে দেখতে পেলে— দুটো প্রকাণ্ড বস্তা ঘরের ভেতর থেকে দরজায় ঢু মারছে। ভয়ে হাজারির চোখদুটো ডাগর হয়ে উঠল। বস্তা জীবন্ত হয়ে উঠল নাকি? না, সে চোখে ভুল দেখছে? নাকি, অনিদ্রায় আর দুর্ভাবনায় তার মাথার ঠিক নেই? হাজারি ভয়ে ভয়ে খানিকটা চোখ বুজে রইল।

হাজারি চোখ যখন খুললে তখন ভোরের আলো জানলার গরাদ দিয়ে ঘরে স্পষ্ট দেখা দিয়েছে। সঙ্গেসঙ্গে শব্দ-টব্দও সব থেমে গিয়েছে। হরে অমনি বলে উঠল— বাবু সেদিনও দেখেছি, ভোর হতেই শব্দ থেমে যায়। হাজারি আর দ্বিরুক্তি না-করে তালা খুলে ঘরে ঢুকে দেখলে, কোথাও কিছু নেই, মালপত্র ঠিকই অছে, তবে কালকের থেকে আজ তফাত এই যে, বস্তাগুলো যেটি যে জায়গায় দাঁড় করানো ছিল, সেটি ঠিক সেখানে নেই। প্রত্যেক বস্তাটিই যেন সরে সরে তফাত হয়ে গেছে। একটা বস্তা আর-একটার ঘাড়ে কাত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে পেছন দিকের কতকগুলো বস্তা হান্ডুল-বান্ডুল অবস্থায় পড়ে রয়েছে। হাজারি মহা ভাবনায় পড়ে গেল। চোরই যদি হয় তবে শব্দের সৃষ্টি কেন? আর, চোর ঢোকেই বা কোথা থেকে? আর বেরিয়েই-বা যায় কেমন করে? অসম্ভব! তবে কি জাহাজডুবির লোকগুলো ডুবে মরে ভূত হয়ে মশলা-বস্তায় যে-যার ঢুকে বসে আছে?

লাটের মাল কিনে অবধি দু-রাত্রি তো এইভাবে কাটল। আজ তৃতীয় রাত্রি। হাজারির রোখ অসম্ভব বেড়ে গেছে। সে মরিয়া হয়ে দু-জন লোক নিয়ে সারারাত্রি গুদামের বাইরে জেগে বসে রইল। হাতের কাছে যাকেই সে পাবে, কিছুতেই আজ আর তাকে আস্ত রাখবে না। তার এই অভীষ্ট সিদ্ধির করার জন্যে দিনমানেই সে খুব ঘুমিয়ে নিয়েছে— পাছে রাত্রে ঘুমিয়ে পড়ে। ঢং ঢং ঢং ঢং— পাশের ঘরের ঘড়িতে চারটে বেজে গেল। হাজারির চোখের পাতা নড়ে না, সে ঠায় জেগে আছে। কোথাও কিছু নেই, কিন্তু হঠাৎ এ কী কাণ্ড! শত-শত লোক একত্র খুব দম নিয়ে নিশ্বাস টেনে ছেড়ে দিলে যেমন একটা ঝড়ের মতো সাঁই-সাঁই করে শব্দ হয়, অবিকল তেমনি একটা শব্দ শোনা গেল।

হাজারি আলো জ্বালিয়ে দিয়েই এক লাফে দাঁড়িয়ে উঠল। দরজার গোড়ায় যে-দুটো লোক শুয়ে ছিল, হাজারি চট করে তাদের জাগিয়ে দিয়ে বললে— তোরা শিগগির ঘরের পেছনটায় দৌড়ে গিয়ে দেখ দেখি, চোরেরা সেখানে কোনো সিঁধ কেটেছে নাকি! হাজারি গুদামের তালা খুলে ফেললে।

কীসের সিঁধ, আর কোথায়-বা চোর! বস্তাগুলো যে সব হাই ছেড়ে সারবন্দি দাঁড়াতে লাগল! হরে চাকরটা ভয়ের সুরে বললে— বাবু এদিকে চেয়ে দেখুন! হাজারি দুই চোখ বিষ্ফোরিত করে বললে— অ্যাঁ, বলে কী? আমার মশলার বস্তারা নাচছে? চাকর দু-জন এ দৃশ্য দেখেই তখন ভয়ে দে-চম্পট!

তখন এক অদ্ভুত কাণ্ড!

বস্তাগুলি সব একটির পর একটি ঠক-ঠক করে ঠিকরে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। সৈন্ধব লবণের প্রকাণ্ড জাঁদরেল-গোছের বস্তাটা তো সর্বাগ্রে বেরিয়ে পড়েই সটান গঙ্গার দিকে দে-ছুট। অন্য বস্তাগুলো সব সারি দিয়ে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ধিনিক ধিনিক করে খানিকটা নেচে নিয়ে তারপর সামনে লাফিয়ে মার্চ করে স্ট্রান্ড রোডের ট্রামের রাস্তা ছাড়িয়ে চলতে লাগল। নিলামে কেনা বস্তাগুলো দলের অগ্রণী হয়ে চলেছে, পেছনে পেছনে চলেছে সারবন্দি গুদামের অন্য অন্য বস্তা। এইভাবে হাজারির মশলার গুদাম উজাড় হয়ে গেল।

শেষরাত্রি। আকাশে ভাসা-ভাসা মেঘ। গঙ্গার জলে মেটে জ্যোৎস্না। হাজারি বিশ্বাস একা দাঁড়িয়ে। এ কী সত্যি, না স্বপ্ন! নির্বাক হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে সে ফ্যাল-ফ্যাল করে চেয়ে দেখছে। লোক ডেকে চেঁচিয়ে উঠবে, সে-শক্তিও তার লুপ্ত। সারবন্দি মশলার বস্তাগুলো গঙ্গার ধারে পৌঁছল এবং গঙ্গার উঁচু বাঁধানো পোস্তার ওপর থেকে ধপাস-ধপাস করে নীচে গঙ্গার জলে দিল ডুব। এইভাবে পরপর সমস্ত বস্তা একে একে গঙ্গার জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল। এবারেও আগে ডুবল নিলামের বস্তাগুলো— তারপর গুদামের অন্য অন্য বস্তা।

এক রাত্রির মধ্যে হাজারি বিলক্ষণ নিঃস্ব হয়ে গেল।

এই ঘটনা শোনার পর হাজারির প্রতিবেশী দোকানদারেরা সকলেই বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে এক বাক্যে বললে— হুঁ হুঁ, এ আমরা অনেক আগেই জানতুম! ভরা অমাবস্যায় জাহাজডুবি, আর সেই লাটের মাল কিনলে কিপটে হাজারি বিশ্বেস! ভাগ্যিস বুদ্ধি করে আমরা ঘেঁষিনি! এ মাল কিনলে আমাদেরও কী রক্ষা থাকত!

বৈশাখ ১৩৫১, তালনবমী

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *