খোলা দরজার ইতিহাস

খোলা দরজার ইতিহাস

সন্তোষ দত্ত আমাদের মধ্যে একজন বড়ো গাল্পিক। বাইরে শ্রাবণ সন্ধ্যার ঘনায়মান মেঘজাল, মাঝে মাঝে জোনাকি পোকা জ্বলচে। মুখুজ্যে বাড়ির বৈঠকখানায় আমাদের নৈশ আড্ডা বসেছে। না, ও সব কিছু না, শুধু চা। আর আছে গরম মুড়ি, কচি শশা, নারকেল কুচি। সন্তোষদা আজ কলকাতা থেকে দু-দিন এসেছেন। পরলোকতত্ত্বের আলোচনা করেন। এ সম্বন্ধে প্রবন্ধও লিখেছেন। নামও আছে।

সন্তোষবাবু এ গ্রামের জামাই। মাঝে মাঝে আসেন কারণ শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তির তিনিই উত্তরাধিকারী। মাসে এক-দু-বার আসেন। আমাদের গ্রামের নতুন কলেজের নতুন মাস্টারমশাইরা একটা মেস করেছেন, পাঁচ-ছ-টি উচ্চশিক্ষিত যুবক মাস্টার মেস থেকে মুখুজ্যে বাড়িতে রোজ সন্ধ্যায় আড্ডা দিতে আসেন। আমিও এই দলের একজন বটে। তবে আমি মেসে থাকি না, এই গ্রামেই আমার পৈতৃক ভিটা। রামবাবু দর্শন ও ন্যায়ের অধ্যাপক। তিনি বললেন— আপনি প্রমাণ করতে পারেন পরলোক আছে?

—না।

—তবে?

—প্রমাণের ব্যাপার এ নয়, তবে আমি আপনাকে অনেক ঘটনা বলতে পারি—

—বলুন কী ঘটনা?

—তার চেয়ে—

—আপনি বিশ্বাস করেন?

—করি।

—কী করে জানলেন পরলোকের ব্যাপার?

—নক অ্যান্ড ইট উইল বি ওপেনড ইন টু ইউ।

—ও সব বড়ো অস্পষ্ট কথা—

—এর চেয়ে বড়ো সত্যি কথা খুব কম মহাপুরুষের মুখ দিয়ে বেরিয়েচে। প্রমাণ করা অত সহজ নয়, তবে এক-আধটা ঘটনা বলি শুনুন। তার চেয়েও ভালো হয়, যদি রেখাকে নিয়ে এসে একদিন আপনাদের সামনে প্রেত নামিয়ে দেখিয়ে দেওয়া যেত।

—কে রেখা?

—রেখা চক্রবর্তী। একজন বড়ো মিডিয়াম, আমাদের সাইকিক সোসাইটির। তার এই শক্তির জন্যে সোসাইটি তার মা, দুই ভাইকে পুষচে।

—রেখা চক্রবর্তীর বয়স কত?

—সতেরো-আঠারো হবে। আশ্চর্য শক্তি ওর। অনেক অবিশ্বাসী, নাস্তিক লোক রেখাকে দেখবার পর আমাদের সোসাইটির মেম্বার হয়েছে; কিন্তু এবার আমরা ওকে ছেড়ে দিচ্ছি—

—কেন?

—খোলা দরজা পেয়ে পরলোক থেকে বড্ড অবাঞ্ছিত খারাপ লোক এসে ঢুকে পড়ে।

—কোথায় ঢুকে পড়ে?

—মিডিয়ামের দেহে। রেখার শরীরটা তো হল খোল, খোলের মধ্যে ঢুকে পড়ে পরলোকবাসী বহু দুষ্ট আত্মা। ওর দেহটাকে নিয়ে তারা সবাই ছিনিমিনি খেলতে শুরু করেছে—

—অদ্ভুত ফেয়ারি টেল।

—মশাই শিক্ষিত পণ্ডিত লোক। প্রত্যক্ষ তো একটা প্রমাণ? আপনাদের ন্যায়শাস্ত্রে কী বলে? হ্যাঁ, আপ্ত অনুমানের চেয়ে প্রত্যক্ষ বড়ো প্রমাণ বই কী।

—চলুন আমার সঙ্গে। সাতষট্টি নম্বর নন্দনবাগান স্ট্রিট। রেখা ও তার মা, ভায়েরা ছোট্ট একটা ঘরে ওই ঠিকানায় থাকে। গরিব বড্ড। কিন্তু সাইকিক সোসাইটি খেতে-পরতে দিচ্ছে বলে একটি মেয়ে তার সব কিছু বিসর্জন দিতে পারে না। তার নিজের দেহটা আর তার দখলে থাকচে না— অপরে দখল করে নিচ্ছে।

—তার মানে?

—এর মানে খুব সহজ। রেখাকে তার দেহ থেকে তাড়িয়ে দিয়ে অন্য দুষ্টু আত্মা এসে সেখানে জুড়ে বসেছে।

ন্যায়ের অধ্যাপক রামবাবু এই আজগুবি কথায় নিজের মতের অকাট্যতা খুঁজে পেলেন। হেসে বললেন, এই জন্যেই তো লোক আপনাদের কথা বিশ্বাস করে না— আচ্ছা বলে যান শুনি।

সন্তোষবাবু বললেন— না, আপনাদের নিয়ে যাব নন্দনবাগানে। বললে বিশ্বাস করবেন না।

আমরা বললাম সেই ভালো।

রামবাবু বললেন— সে তো ভালোই, তবু আগে বলুন কী-কী হয়?

সন্তোষবাবু বললেন— হবে আর কী? সেদিন রেখার মা বসে আছে, রেখা গিয়ে বললে— দিদি, আমার শ্রাদ্ধটা পর্যন্ত তোমরা করলে না। আমার জন্য গয়ায় গিয়ে পিণ্ডদান করো। তোমাদের ভালো হবে। ওর মা বললে— কে তুমি?

—আমি পারুল, হেমনগরের পারুল।

—তুই তো অনেকদিন মরে গিয়েচিস পারুল?

—গিয়েচি তাই কী? রোজ তোমাদের বাড়িতে আসি, হেমনগরে যাই, সোদপুরে বড়দির শ্বশুরবাড়ি যাই। মনের গতিতে যাতায়াত আমাদের। কোনো কষ্ট নেই; কিন্তু ওপরে উঠতে পারি না। পৃথিবী যেন টেনে রেখেচে। পিণ্ডদান করলে পৃথিবীর বন্ধন কাটিয়ে চলে যাবো। আমি চলি দিদি। একটা হিন্দুস্থানি মেয়ে রেখার দেহে ঢুকবে বলে ঘুরঘুর করছিল, আমি তাকে তাড়িয়ে দিইচি।

—কে সে?

—বস্তিতে আসতো। চরিত্র ভালো ছিল না। আত্মহত্যা করেছিল কী জন্যে। এখন কষ্ট পাচ্ছে।

এখানে দার্শনিক রামবাবু প্রশ্ন করলেন, দাঁড়ান মশায়। একটা মস্ত বড়ো ফাঁক রয়ে গেল। চরিত্র ভালো ছিল না— এ কথার মানে কী? কোন স্টান্ডার্ডে পরলোকে চরিত্রের সু-কু নির্ধারিত হয়ে থাকে?— এটার উত্তর চাই।

সন্তোষ দত্ত বললেন— নিজের মনই পরলোকে নিজের বিচারক হয়। কেউ বাইরে থেকে কিছু করে না। উইল ইজ দা কি— পরলোকের একটি মস্ত বড়ো সত্য। কিন্তু এ সব তত্ত্বকথা থাক। গল্পটা বলি— রেখার মধ্যে মাঝে মাঝে দুষ্ট আত্মারা ঢুকে পড়ে। তারা হিন্দিতে, ওড়িয়াতে, বাংলাতে গাল দেয়, কারণ সব জাতির আত্মা তার মধ্যে আছে। সেদিন একটি ফিরিঙ্গি মেয়ে ওর দেহ অনেকক্ষণ অধিকার করে রাখলে। তার বাড়ি ছিল নাকি পার্ক সার্কাস। রেখা কোনোকালে ইংরিজি জানে না; অথচ গড়গড় করে ইংরিজি বলচে।

রামবাবু অবিশ্বাসের সুরে বলেন— আপনি নিজে শুনেছেন?

—নিশ্চয়, না শুনলে বলি? শুধু তাই নয়। অনর্গল ওড়িয়া বলতে শুনেচি রেখাকে। কিন্তু এ-সবের চেয়েও আশ্চর্য এবং খুব খারাপ হল পরলোক থেকে নিম্ন শ্রেণির দুষ্টু আত্মা আসাতে।

—তারা এসে কী করে?

—নানারকম উপদ্রব করে। ওর দেহটাকে নিয়ে হয়তো ধুলোয় ফেললে, হয়তো রোদে কষ্ট দিলে। একবার রেখাকে আগুনে পোড়াতে গিয়েছিল। আবার ভুবর্লোকের নিম্ন শ্রেণির প্রাণীর আবির্ভাব হয়। তাদের নাম জানি না— ইংরিজিতে যাদের বলে এলিমেন্টাল— এরা ভয়ানক হিংস্র এবং মানুষের ক্ষতি করার জন্য সবসময় উন্মুখ। তবে এরা কিছু করতে পারে না। স্থূল জগতে এদের দেহ অদৃশ্য। পৃথিবীর কোনো পদার্থ এদের স্পর্শ করার কোনো ক্ষমতা নেই।

—বেশ আজগুবি গল্প হল আজ বৃষ্টির দিন।

—আমার সঙ্গে যাবেন নন্দনবাগানে?

—যেতে পারি।

—প্রত্যক্ষ দেখুন না? দোষ কী?

—না কিছু দোষ নেই। কাল চলুন বাসে করে যাই—

.

এইভাবে শ্রীযুক্ত রামলাল চক্রবর্তী এমএ পিএইচডি দর্শনের অধ্যাপক তাঁর মরণের পথে অগ্রসর হয়েছিলেন। সংবাদপত্রে যেটা বেরিয়েছিল সেটা সর্বৈব মিথ্যা। ময়না তদন্তে আদালতের বিবরণও কাল্পনিক। রেখা চক্রবর্তী খুব ভালো চরিত্রের মেয়ে।

.

মুখুজ্যে বাড়ি ছিল বসিরহাট ট্যাঁটরায়। পূর্বোক্ত আড্ডার দিনের ঠিক ন-দিন পরে জন্মাষ্টমীর ছুটির সন্ধ্যা বেলায় রামবাবুকে নিয়ে আমরা ক-জন নন্দনবাগান স্ট্রিটে রেখাদের বাড়ি গেলাম।

রেখাদের বাড়ি এদিন যা-ঘটনা ঘটে গেল, প্রেততত্ত্ব চর্চার ইতিহাসে এরকম ঘটনা আর কোথাও ঘটেছে বলে আমার জানা নেই।

রেখাদের বাড়িটার একটু বিবরণ দেওয়া যাক— একটা পাশের দরজা দিয়ে ওদের বাড়ি ঢুকেই সামনে একটা রোয়াক। রোয়াকের সামনে দু-খানা দক্ষিণমুখী বড়ো ঘর। পেছনে একটা ছোটো ঘর। ছোটো ঘরের পেছনে ছোট্ট একটা বারান্দা। আগে এখানে বোধ হয় রান্না হত। উনুন পাতা আছে। বর্তমানে এখানে কয়েকটি ফুলের টব ও রেখার ছোটো ভাইয়ের একখানা ট্রাইসাইকেল থাকে। এই গেল বাড়ির কথা। ওই ছোট্ট ঘরের অবস্থান ও পেছনের বারান্দাটার কথা মনে রাখতে হবে ঘটনার পরবর্তী অধ্যায়ে।

সংক্ষেপে বলাই ভালো। ফেনিয়ে লাভ নেই। রেখা আমাদের চা এনে দিল। সন্তোষবাবু বললে— আজ আমাদের বন্ধু রামলাল চক্রবর্তী এখানে এসেছেন। ওঁকে একটু দেখাতে হবে।

রেখা মেয়েটি শ্যামবর্ণ, একহারা, বেশ সুশ্রী, গলার সুর বীণার ঝংকারের মতো মিষ্টি। বড়ো বড়ো চোখ; চোখের দৃষ্টি অতিনিরীহ, যেন বোবার মতো। ওর সুশ্রীতার অনেকটা ব্যাঘাত করেচে এই নির্বোধের মতো চোখের দৃষ্টির দরুন। রেখা বললে— আজ ক-দিন থেকে ভয়ানক অত্যাচার আরম্ভ করেছে একটা কেউ; মানুষ কী জানোয়ার বুঝতে পারচিনে। আজও বোধ হয় আসবে। আমার বড়ো ভয় করে।

সন্ধ্যার পর রেখার মা আমাদের নিয়ে গেলেন সেই ছোট্ট ঘরটাতে। ধুনো দেওয়া হল ঘরে, ফুল দিয়ে সাজানো হল। আমরা সবাই গিয়ে একটা টেবিলের চারপাশে বসলাম। ঘর অন্ধকার করা হল। রেখার মা বললেন— বাবা, একখানা রেকর্ড দাও—

গ্রামোফোনে একটা সানাই বাজনার রেকর্ড দেওয়া হল।

একটা ক্ষীণ সুর শোনা গেল ঘরের কোণ থেকে।

কে যেন কী বলচে। সন্তোষবাবু বললে— কে?

ক্ষীণ সুর মেয়েলি কণ্ঠের। বললে— আজ আপনারা রেখাকে সার্কেলে বসতে দেবেন না—

—কেন? আপনি কে?

—আমি রেখার পিসি নীরদবালা। আজ ওর শরীরটা তত ভালো নেই। অনেকগুলো বাজে লোক অপেক্ষা করছে ওর দেহের মধ্যে প্রবেশ করবার জন্যে।

—এখনও আছেন নাকি?

আর কোনো শব্দ শোনা গেল না।

খানিকটা সময় কেটে গেল। অন্ধকারে যেন ঘরের বাতাস ভারী হয়ে উঠেচে। রেখা চক্কত্তির কোনো সাড়াশব্দ নেই। মাঝে মাঝে ওর নাক ডাকার শব্দ ছাড়া। কিছুক্ষণ পরে নিদ্রিতা রেখার মুখ দিয়ে আবার কে একজন গম্ভীর সুরে বললে— মালতী, ও মালতী—

সন্তোষবাবু বললেন— কে আপনি? মালতী আজ এখানে আসেনি।

—আমি তার স্বামী। এলে বলবেন, তাঁর খোঁজ করেচি। আজ মিডিয়ামকে উঠিয়ে দিন। আজ বড়ো বিপদ।

—কেন?

রেখা আবার ঘুমিয়ে পড়লো, আর কোনো কথা তার মুখ দিয়ে বেরুলো না। রাত ক্রমে বেশি হল। আর কেউ আসে না। আধঘণ্টা কেটে গেল। আমরা ভাবচি আজ এই পর্যন্ত থাক। হঠাৎ পেছনের ছোট্ট ঘরটাতে একটা কী শব্দ শোনা গেল। খুব চাপা কী-একটা শব্দ। ঘরের বাতাস আবার ভারী ঠান্ডা হয়ে উঠল। প্রত্যেকবার পরলোকের কোনো মানুষ আসবার সময় ঘরের বাতাস নাকি এমন ঠান্ডা হয়। সন্তোষ দত্ত মানলে না।

এবার যে ঘটনাটি ঘটল, তা আমার দিকে থেকে বলি—

সেই অন্ধকারে অন্য লোকের কী হচ্ছে তা জানবার উপায় ছিল না আমার। আমার মনে হল মাথায় কে এক ঝুড়ি বরফ বসিয়ে দিলে এবং সেই যেন কোনো অদ্ভুত উপায়ে লম্বা হয়ে ঝুলে পড়ে আমার নাকের গর্ত বুজিয়ে দিচ্ছে ধীরে ধীরে। আমার শরীর যেন অবশ হয়ে আসছে। পেছনের ঘরটাতে একটা যেন বরফের কল বসানো হয়েছে। ঠান্ডা এবং ভারী হাওয়া আসছে ওই ঘরটা থেকেই।

যেন চাপা আর্তনাদের মতো কী একটা শোনা গেল রেখার কণ্ঠ থেকে।

আর পেছনের ঘরটাতে কী যেন একটা কল বসেছে। কোনো শব্দ নেই। কিছু দেখা যাচ্ছে না সে ঘরে; অথচ মনে হচ্ছে কাণ্ডকারখানার আয়োজন ও মালমশলা তৈরি হচ্ছে ওই ছোট্ট পেছনের ঘরে। হঠাৎ সন্তোষবাবু বলে উঠলেন— ঘরে আলো জ্বেলে দিন, আলো জ্বেলে দিন, ওই দেখুন কী—

আমি দেখলাম কী তা বলি— ঘরের দেওয়ালে একটা বিরাট কালো ছায়া। দেখতে গায়ের দাদের মতো। ঠিক যেন মানুষের গায়ের দাদ অথবা বাঁশ গাছের গায়ে বর্ষাকালে কেমন কান-চটা নাক ছত্রাক গজায় অনেকেই দেখবেন ওই কান-চটার মতো।

তবে সেটা রবারের ফুঁ দেওয়া বেলুনের মতো ক্রমবর্ধমান ভীষণ ঠান্ডা হাওয়া— হিম যেন বরফ— আমার চৈতন্য লুপ্ত হয়ে আসছে। আমি ঠিক জানি না কী হচ্ছে কোথায়। কোথায় যেন নিস্তব্ধ ঘন অরণ্যের মধ্যে মহা এক জন্তু বা দানব লোকালয়কে ধ্বংস করবার সাধনায় মগ্ন। সেটা বোবা দানব। মুখে ভাষা নেই তার। মুখ বোধ হয় নেই। দৃষ্টি হয়তো আছে নগ্ন হিংস্রতার; কিন্তু চোখ নেই। সে জিনিসটা কোনো মানুষ বা ছবিতে আঁকা দানব, ভূত-প্রেতের মতো আদৌ নয়। মোটেই নয়। সেটা একটা ক্রমবর্ধমান ব্যাঙের ছাতার মতো কিংবা গায়ের দাদের মতো বাড়চে— বাড়চে— ক্রমশ বাড়চে; চওড়া হচ্ছে, ডাইনে বায়ে সব দিকে বেড়ে সব যেন গ্রাস করে ফেলে দেবে। দাদ ছড়িয়ে পড়বে সারা ঘরের গায়ে। ঘরের মানুষের গায়ে। ঘন কৃষ্ণ বর্ণের দাদ। রবারের বেলুনের মতো ফেঁপে-ফুলে ক্রমশ বড়ো হচ্ছে অথচ ভয়ানক হিংস্র-উগ্র-ক্রুর-নির্মম বুদ্ধিহীন ধ্বংসের করাল দূত; কারও নিস্তার পাবার উপায় নেই ওর হাত থেকে—

একটা আর্ত চিৎকার শোনা গেল যেন ঘরে। আমি যেন দেখলাম পেছনের ছোটো ঘরটা সেই বিরাট কালো ব্যাঙের ছাতা বা দাদে ভরে গিয়েছে। ঘরের দেওয়াল ও দাদটা ভেদ করে ওই জিনিসটা চারিধারে ছড়িয়ে পড়বে। কালো ভীষণ ঠান্ডা কান-চটা দাদ…

আমি স্পষ্ট অনুভব করলাম, মাথা থেকে নরম সেই মোমের মতো জিনিসটা বেড়ে নেমে ঝুলে পড়ে আমার চোখ ও নাক বুজিয়ে দিচ্ছে। আমি কথা বলতে পারছিনে, নিশ্বাসও নিতে পারছিনে। কোথায় যেন ঢং-ঢং করে দশটা বাজচে। আমি শুনে চলেছি— এক— দুই— তিন— চার— পাঁচ— ছয়— সাত… তারপর আমার জ্ঞান ছিল না।

রাত তখন দশটা হবে।

.

যখন জ্ঞান হল তখনও রাত্রি। কিন্তু ঘর অন্ধকার নয়, শেষরাতের চাঁদের আলো জানালা দিয়ে এসে পড়েছে ঘরে। যে-যার চেয়ারে অসাড় হয়ে হেলে পড়ে আছে। রেখা চক্কোত্তিও অজ্ঞান হয়ে হাত-পা এলিয়ে চেয়ারে কাত হয়ে পড়ে আছে। কেবল সন্তোষ দত্ত নেই ঘরের ভিতর। আমি খানিকটা বোঝবার চেষ্টা করলাম কী ঘটেছিল, তারপর সব মনে পড়ল। সে ভীষণ দাদ কোথায়? রেখা চক্কত্তি মিডিয়ামের বাড়িতে সার্কেল বসেছিল আজ সন্ধ্যার সময়। ঘরে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার ছিল। এখন চাঁদের আলোয় খানিকটা অন্ধকার দূর হয়েচে। ঘর দেখে মনে হল এখানে যেন একটি নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড হয়ে গিয়েচে। মোটরের শব্দ উঠল বাইরে।

একটু পরে সন্তোষ দত্ত ঘরে ঢুকল। ওর সঙ্গে একজন ডাক্তার।

আর সব লোকের চৈতন্য সম্পাদন করানো হল। রামবাবুর প্রাণ অনেকক্ষণ দেহ ছেড়ে চলে গিয়েছিল। ডাক্তার পরীক্ষা করে মত দিলে শ্বাস বন্ধ হওয়ায় মৃত্যু। সারামুখ কালো হয়ে গিয়েছে। জিব বেরিয়ে পড়েছে! চোখ ঠিকরে বেরুচ্ছে! পুলিশ এল, হইহই হল। লোকজনের ভিড় হল। রামবাবুর সব পরীক্ষা করা হল, তারাও বললে নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার দরুন মৃত্যু। ফুসফুসে একটা নতুন গ্যাসের অস্তিত্ব। শব ব্যবচ্ছেদাগারে পাওয়া গেল আর্জন জাতীয় সহজ দাহ্য গ্যাস।

.

সন্তোষ দত্তকে অনেকদিন পর জিজ্ঞাসা করেছিলুম সে-রাত্রে কাণ্ডখানার মূল সূত্রটি। সন্তোষ দত্ত বললে— সে-রাত্রে একজনও বাঁচতাম না আমরা। পূর্বেকার আত্মা আমাদের সতর্ক করে দিয়েছিল। আমাদের সেটা শোনা উচিত ছিল।

আমি বললাম— দু-জন আত্মা। রেখার পিসি আর মালতীর স্বামী—

—কী হয়েছিল জানেন? কোনো দুষ্ট আত্মা আসেনি। রেখার পিসি অন্তত তাই বলে গিয়েছিল। কিন্তু আসলে ব্যাপারটা তা নয়, এসেছিল ভুবর্লোকের হিংস্র জীববিশেষ— যাদের ইংরিজিতে বলে এলিমেন্টাল। ওরা ভুবর্লোকের বাঘ-ভাল্লুক জাতীয় প্রাণী। মানুষের চেয়ে অনেক নিম্ন স্তরের অথচ ক্ষমতায় ও ক্রূর বুদ্ধিতে মানুষকে ছাড়িয়ে যায়। সেদিন কী করেছিল জানো? ওটা আমাদের সকলের শরীর থেকে স্থূল উপাদান সংগ্রহ করে এলিমেন্টাল-টা সেই ছোট্ট ঘরটাতে নিজের অদৃশ্য দেহটাকে স্থূল জাতের উপযুক্ত করে তুলেছিল। অন্ধকার ঘর ল্যাবরেটারি হিসেবে ব্যবহার করেছিল। তা তখন কী জানি? জানলে খুব সহজে তাড়াতে পারা যেত।

আমি কৌতূহলের সুরে প্রশ্ন করলাম, কীভাবে?

—খুব সহজে।

—বলুন না আপনি? নিশ্চয়ই জানেন।

মাত্র আলোটার সুইচ টিপে দিয়ে বিভীষিকাময়ী অন্ধকার রাত্রি ও রহস্যময় পরজগতের সমস্ত ভয় ও কুহেলি কেটে গিয়ে আমরা সেই মুহূর্তেই নিরাপদ হতাম। যদি আলোয় ভরিয়ে খুলে দিতে পারতাম ঘর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *