বিসর্জন

বিসর্জন

খাদের কিনারায় বসেও লোকে দাবা খেলতে পরোয়া করে না।

–মাদাম সুজান নেকার
জার্মেইন দ্য স্তায়েলের মা

.

প্যারিস সেপ্টেম্বর ২, ১৭৯২

কেউই বুঝতে পারে নি এটা কি ধরণের দিন হবে। অ্যাম্বাসির কর্মকর্তাদের বিদায় জানানোর সময় জার্মেইন দ্য স্তয়েলও জানতো না। আজ সেপ্টেম্বরের ২ তারিখে কূটনৈতিক সুরক্ষায় ফ্রান্স ত্যাগ করবে সে। জ্যাক-লুই ডেভিড অ্যাসেম্বলির জরুরি সেশনে যোগ দেবার জন্যে তাড়াহুড়া করে জামাকাপড় পরার সময়ও জানতেন না, আজ ২রা সেপ্টেম্বর অগ্রসরমান শত্রুবাহিনী প্যারিস থেকে মাত্র ১৫০ মাইল দূরে অবস্থান করবে। প্রুশিয়ানরা হুমকি দিয়েছে তারা প্যারিস শহরটাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেবে।

মরিস তয়িরাঁ এবং তার ব্যক্তিগত সহকারী কর্তিয়াদি যখন স্টাডিরুমে চামড়ায় বাধানো বইপুস্তকগুলো নামাচ্ছিলো তখনও এটা জানতো না। আজ সেপ্টেম্বরের ২ তারিখে সে পরিকল্পনা করেছে তার মহামূল্যবান লাইব্রেরিটা ফরাসি সীমান্তের কাছাকাছি নিয়ে যাবে, কারণ খুব শীঘ্রই সে ফ্রান্স ছাড়ছে।

ডেভিডের স্টুডিওর পেছনে ফুলের বাগানে ঘুরে বেড়ানোর সময় ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়েও জানতো না। একটু আগে তারা যে চিঠিটা পেয়েছে তাতে বলা হয়েছে মন্তগুেইন সার্ভিসটা নাকি ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে পড়ে গেছে। তারা ধারণাও করতে পারে নি ফ্রান্সকে লণ্ডভণ্ড করে দেবে যে টর্নেডো তার কেন্দ্রে অবস্থান করতে যাচ্ছে তারা দুজন।

মাত্র পাঁচ ঘণ্টা আগেও কেউ জানতো না সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় দিন বেলা দুটোর সময় আতঙ্কটি ছড়িয়ে পড়বে।

সকাল : ৯টা

ডেভিডের স্টুডিওর পেছনে যে বাগানটা আছে তার মাঝখানে ছোট্ট একটা ফোয়ারার সামনে বসে আছে ভ্যালেন্টাইন। হাত দিয়ে পানি নাড়ছে সে। বিশাল একটি গোন্ডফিশ তার আঙুলে ঠোকর মারলো। সে যেখানে বসে আছে তার বুব কাছেই মন্তগেইন সার্ভিসের দুটো খুঁটি লুকিয়ে রাখা হয়েছে মাটির নীচে। এখন হয়তো ওখানে আরো কিছু অংশ যোগ দেবে।

মিরিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে চিঠিটা পড়ে শোনালো। শরৎকালের আগমনে গাছের পাতার রঙ হলুদ হয়ে উঠেছে। শীঘ্রই পাতা ঝরে পড়তে শুরু করবে।

“এই চিঠির একটাই ব্যাখ্যা হতে পারে,” কথাটা বলেই পড়ে শোনাতে শুরু করলো মিরিয়ে :

আমার প্রাণপ্রিয় সিস্টাররা,

আপনারা হয়তো জানেন কায়েন-এর অ্যাবিটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফ্রান্সের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আমাদের দাইরেক্তিস আলেক্সাদ্রিয়ে দ্য ফবোয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ফ্রান্ডার্সে তার পরিবারের কাছে চলে যাবার। অবশ্য সিস্টার মেরিশালোত্তে করদে, যাকে আপনারা হয়তো চেনেন, তিনি কায়েন-এ থেকে গেছেন ওখানে অপ্রত্যাশিত কোনো ঘটনা ঘটে গেলে সামাল দেবার জন্য।

আমাদের মধ্যে কোনো দিন দেখা-সাক্ষাৎ হয় নি, তাই আমি। আমার পরিচয় দিচ্ছি, আমি সিস্টার ক্লদ, ভূতপূর্ব কায়েন-এর কনভেন্টের একজন নান। আমি সিস্টার আলেক্সান্দ্রিয়ের ব্যক্তিগত সেক্রেটারি, কয়েক মাস আগে ফ্লাডার্সের উদ্দেশ্যে রওনা দেবার পূর্বে তিনি আমার ইপার্নির বাড়িতে এসেছিলেন। সে সময় তিনি আমাকে কিছু তথ্য দিয়ে বলেন, আমি যেনো খুব শীঘ্রই প্যারিসে গিয়ে সিস্টার ভ্যালেন্টাইনকে সশরীরে সেটা দিয়ে আসি।

আমি বর্তমানে প্যারিসের কর্দেলিয়া কোয়ার্টারে অবস্থান করছি। দয়া করে আজ দুপুর দুটো বাজে লাবায়ে মনাস্টেরির গেটে এসে দেখা করুন, কারণ আমি জানি না এই শহরে আর কতোক্ষণ থাকতে পারবো। আশা করি এই অনুরোধের গুরুত্বটা আপনি অনুধাবন করতে পারছেন।

-আপনার বোন
কায়েন-এর অ্যাবি-অদেম-এর সিস্টার ক্লদ

“উনি ইপার্টি থেকে এসেছেন,” চিঠিটা পড়া শেষ করে বললো মিরিয়ে।

“এটা ফ্রান্সের পূর্বাঞ্চলীয় একটি শহর। মার্নে নদীর তীরে অবস্থিত। উনি দাবি করছেন, আলেক্সান্দ্রিয়ে দ্য ফবোয়া ফ্লভার্সে যাবার পথে ওখানে যাত্রা বিরতি করে তার সাথে দেখা করেছেন। তুমি কি জানো ইপার্নি আর ফ্লেমিশ সীমান্তের মাঝখানে কি আছে?”

ভ্যালেন্টাইন মাথা ঝাঁকিয়ে গোল গোল চোখে মিরিয়ের দিকে তাকালো।

“লঙ্গাই আর ভারদান দূর্গ। প্রশিয়ান সেনাবাহিনীর অর্ধেক ওখানে অবস্থান করে। সম্ভবত আলেক্সান্দ্রিয়ে ফোবোয়ার কাছ থেকে যে খবরের কথা বলছেন তারচেয়ে অনেক মূল্যবান কিছু বয়ে এনেছেন আমাদের সিস্টার কুদ। সম্ভবত উনি এমন কিছু নিয়ে এসেছেন যার কারণে সিস্টিার ফবোয়া মনে করেছেন যুদ্ধরত সেনাবাহিনীর মধ্য দিয়ে ফ্লেমিশ সীমান্ত অতিক্রম করাটা অনেক বেশি বিপজ্জনক হবে।”

 “সার্ভিসের খুঁটিগুলো!” বললো ভ্যালেন্টাইন, ঝট করে উঠে দাঁড়ালো সে। “চিঠিতে বলা হয়েছে সিস্টার শালোত্তে করদে নাকি কায়েনে রয়ে গেছেন! কায়েন হয়তো উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্তের কাছে কালেকশান পয়েন্ট হয়ে থাকবে।” একটু ভেবে আবার বললো সে, কিন্তু তাই যদি হয়, তাহলে আলেক্সান্দ্রিয়ে কেন পূর্ব সীমান্ত দিয়ে ফ্রান্স ছাড়বেন?”

“আমি জানি না,” কথাটা বলে মিরিয়ে তার চুলের রিবন খুলে ফোয়ারার কাছে বসে মুখে একটু পানি ছিটিয়ে নিলো। “সিস্টার ক্লদের সাথে দেখা না করা পর্যন্ত এই চিঠির মানে কি সেটা আমরা জানবো না। কিন্তু দেখা করার জন্য উনি কর্দেলিয়া বেছে নিলেন কেন? ওটা তো এ শহরের সবচাইতে বিপজ্জনক জায়গা। তুমি তো জানোই, লাবায়ে এখন আর কোনো মোনাস্টেরি নয়, ওটাকে জেলখানা হিসেবে রূপান্তরিত করা হয়েছে।”

“আমি ওখানে একা একা যেতে মোটেও ভয় পাচ্ছি না,” বললো ভ্যালেন্টাইন। “অ্যাবিসের কাছে আমি প্রতীজ্ঞা করেছিলাম যেকোনো দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকবো। এখন সময় এসেছে নিজের কথা রাখার। তবে তুমি এখানেই থাকো, বোন। আঙ্কেল জ্যাক-লুই তার অনুপস্থিতিতে আমাদেরকে বাড়ির বাইরে যেতে বারণ করে দিয়েছেন।”

 “তাহলে আমাদেরকে খুব বুদ্ধিখাঁটিয়ে বের হতে হবে,” জবাব দিলো মিরিয়ে। কারণ তোমাকে একা একা কর্নেলিয়ায় যেতে দেবো না আমি। এটা তুমি জেনে রেখো।”

সকাল ১০টা

সুইডিশ অ্যাম্বাসির গেট দিয়ে জার্মেইন দ্য স্তায়েলের ঘোড়ার গাড়িটা বের হয়ে গেলো। গাড়ির ছাদের উপরে কতোগুলো ট্রাঙ্ক আর উইগবক্স থরে থরে বেধে রাখা হয়েছে। দু’জন কোচোয়ান আর নিজস্ব চাকর রয়েছে তার সাথে। গাড়ির ভেতরে রয়েছে জার্মেইনের কাজের মহিলা আর অসংখ্য গহনার কেস। পরে আছে অ্যাম্বাসেডরের পোশাক। প্যারিসের রাস্তা দিয়ে তার ছ’টি সাদা ধবধবে ঘোড়া ধুলো উড়িয়ে ছুটে যাচ্ছে শহরের প্রবেশদ্বারের অভিমুখে। গাড়ির দরজায় সুইডিশ রাজের রঙ্গিন ক্রেস্ট লাগানো। জানালার পর্দাগুলো নামিয়ে রাখা হয়েছে।

নিজের ভাবনায় ডুবে থাকা জার্মেইন আবদ্ধ গাড়ির ভেতরে প্রচণ্ড গরম থাকা সত্ত্বেও জানালা দিয়ে মুক্ত বাতাস নিচ্ছে না। তবে প্রবেশদ্বারের সামনে গাড়িটা আচমকা ঝাঁকি খেয়ে থেমে গেলে জার্মেইন জানালা খুলে বাইরে তাকালো।

 বাইরে কিছু বিক্ষুব্ধ মহিলা শাবল আর গাইতি নিয়ে তেড়ে আসছে তাদের দিকে। কয়েকজন জার্মেইনের দিকে সংক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকালো। তাদের ভীতিকর মুখগুলো এবড়োথেবড়ো, বেশ কয়েক পাটী দাঁত নেই। উশৃঙ্খল লোকজনের মুখ সব সময় এরকম বিশ্রি হয়ে কেন? ভাবলো জার্মেইন। জানালা দিয়ে মুখটা বের করলো সে।

“এখানে হচ্ছেটা কি?” বেশ কর্তৃত্বের সুরে বললো। “এক্ষুণি আমার গাড়ির সামনে থেকে সরে দাঁড়াও!”

“কাউকে শহর ছাড়ার অনুমতি দেয়া হয় নি!” জনসমাগমটি দ্রুত বেড়ে গেলে তাদের মধ্যে থেকে বেশ কয়েকজন সমস্বরে বললো।

“আমি সুইডিশ অ্যাম্বাসেডর!” চিৎকার করে বললো জার্মেইন। একটা গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় কাজে সুইজারল্যান্ডে যাচ্ছি! আমি আদেশ করছি, এক্ষুণি আমার পথ থেকে সরে দাঁড়াও!”

“হা! আমাদেরকে আদেশ করে!” জানালার সামনে থাকা বিক্ষুব্ধ এক মহিলা চেঁচিয়ে বললো। একদলা থুতু ছুঁড়ে মারলো সে, সঙ্গে সঙ্গে উল্লাস প্রকাশ করতে শুরু করলো সবাই।

একটা রুমালে মুখটা মুছে নিয়ে সেটা জানালার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে চিৎকার করে বললো জার্মেইন, “এই নাও তোমাদের প্রাণপ্রিয় শ্রদ্ধেয় অর্থমন্ত্রি জ্যাক নেকারের মেয়ের রুমাল। এই থুতু তোমাদের মুখে মাখো!…জানোয়ারের দল কোথাকার।” গাড়ির ভেতরে তার কাজের মহিলাদের দিকে তাকালো। তারা ভয়ে জড়োসরো হয়ে আছে। এই ঘটনার নাটের গুরু কে সেটা আমরা দেখে : নেবো।”

কিন্তু ততোক্ষণে বিক্ষুব্ধ মহিলারা গাড়ি থেকে ছ’টি ঘোড়া খুলে নিয়ে সরিয়ে ফেলেছে। আরেকটি দল গাড়িটাকে টানতে টানতে প্রবেশদ্বার থেকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অন্য কোথাও। যেনো একদল পিঁপড়ে কেকের টুকরো বয়ে চলেছে।

আতঙ্কগ্রস্ত জার্মেইন শক্ত করে দরজা ধরে রাখলো। জানালা দিয়ে চিৎকার করে অভিশাপ আর হুমকি-ধামকি দিতে লাগলো জনতাকে। কিন্তু বাইরের বিক্ষুব্ধ জনতার হৈহায় ধামাচাপা পড়ে গেলো সেটা। কিছুক্ষণ পরই রক্ষিবেষ্টিত বিশাল একটি ভবনের সামনে গাড়িটা থেমে গেলে জার্মেইন যা দেখতে পেলো তাতে করে তার রক্ত জমে বরফ হবার জোগার। তারা তাকে হোটেল দ্য ভিলে’তে নিয়ে এসেছে। প্যারিস কমিউনের হেডকোয়ার্টার এটি।

তার গাড়ির চারপাশে যে উশৃখল জনতা আছে তাদের চেয়ে প্যারিস কমিউন অনেক বেশি বিপজ্জনক। উন্মাদ একদল লোকের সমাহার। এমন কি অ্যাসেম্বলির অনেক সদস্য তাদেরকে যমের মতো ভয় পায়। প্যারিসের রাস্তাঘাট থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি তারা, অভিজাত পরিবারের লোকজনদেরকে জেলে পুরে বিচার করে, দ্রুত কার্যকর করে তাদের মৃত্যুদণ্ড যা কিনা স্বাধীনতা-মুক্তির যে ধারণা দেয়া হচ্ছে তার একেবারেই বিপরীত চিত্র। তাদের কাছে জার্মেইন দ্য স্তায়েল হলো আরেকজন অভিজাত ব্যক্তি যার গদান কেটে ফেলা উচিত। সে নিজেও এটা জানে।

গাড়ির দরজা জোর করে খুলে জার্মেইনকে টেনে হিঁচড়ে নীচে নামালো ক্রুব্ধ মহিলারা। শীতল চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে দৃঢ়ভাবে সোজা হয়ে হেঁটে গেলো সে সামনের দিকে। তার পেছনে তার চাকরেরা ভয়ে আর্তনাদ করছে, তাদেরকে লাঠিসোটা দিয়ে পেটানো হচ্ছে। দু’পাশ থেকে মহিলারা টেনে টেনে হোটেল দ্য ভিলের সিঁড়িতে নিয়ে গেলো জার্মেইনকে। আচমকা তার সামনে এসে দাঁড়ালো এক লোক। হাতের চাকুটা দিয়ে তার গাউনের বাধন কেটে দিলে সেটা খুলে পড়তে উদ্যত হলো। কোনোরকম গাউনটা শরীরের সাথে জড়িয়ে রাখলো সে। এক পুলিশ সামনে চলে এলে দম বন্ধ হয়ে গেলো জার্মেইনের। লোকটা তাকে জড়িয়ে ধরে দ্রুত অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবনের ভেতরে চলে গেলো।

সকাল : ১১টা

ডেভিড হাপাতে হাপাতে অ্যাসেম্বলিতে এসে পৌঁছালেন। বিশাল ঘরটা লোকে লোকারণ্য, চিৎকার চেঁচামেচি চলছে। মাঝখানের পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে আছেন সেক্রেটারি সাহেব। চিৎকার করে নিজের কথা পৌঁছে দিতে চাচ্ছেন সবার কাছে। লোকজনের ভীড় ঠেলে নিজের সিটের দিকে এগোনোর সময় ডেভিড বুঝতেই পারলেন না সেক্রেটারি কী বলছেন।

“আগস্টের তেইশ তারিখে লঙ্গাই দূর্গটি শত্রুবাহিনী দখল করে নিয়েছে। প্রুশিয়ান সেনাবাহিনীর কমান্ডার ব্রুন্সউইকের ডিউক এক আদেশ জারি করেছে, আমরা যেনো অতি শীঘ্রই রাজাকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে রাজপরিবারকে পূণরায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করি। তা না হলে তার সৈন্যেরা প্যারিসকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেবে!”

ঘরের হৈহল্লায় সেক্রেটারির কথা ছাপিয়ে যাচ্ছে বার বার। এরইমধ্যে তিনি চেষ্টা করে যাচ্ছেন নিজের কথা সবার কাছে পৌঁছে দেবার জন্যে।

অ্যাসেম্বলি ফ্রান্সের উপর তার ভঙ্গুর কর্তৃত্ব বহাল রেখেছে রাজাকে বন্দী করে রাখার পর থেকেই। কিন্তু ব্রুন্সউইকের আদেশমতে যোড়শ লুইকে ছেড়ে দেয়াটা আসলে ফ্রান্স আক্রমণ করার একটি অজুহাত মাত্র। ক্রমবর্ধমান ঋণগ্রস্ততা আর বাহিনী থেকে ব্যাপকহারে চলে যাওয়ার কারণে ফরাসি সেনাবাহিনী এতোটাই দূর্বল আর নাজুক যে কিছু দিন আগে ক্ষমতায় আসা নতুন। ফরাসি সরকার যেকোনো দিন পতন হয়ে যাবার মুখে দাঁড়িয়ে আছে। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো ব্যাপার হলো, অ্যাসেম্বলির ডেলিগেটরা একে অন্যেকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছে। মনে করছে সীমান্তে যে শত্রু জড়ো হয়েছে তাদের সাথে তলে তলে হাত মেলাচ্ছে অনেকেই। নিজের আসনে বসে থেকে ডেভিড ভাবছেন, এটাই হলো এই অরাজকতার আসল কারণ।

“নাগরিকগণ!” চিৎকার করে বললেন সেক্রেটারি। “আমি আপনাদেরকে ভয়ঙ্কর একটি সংবাদ দিচ্ছি। আজ সকালে ভারদানের দূর্গটাও প্রুশিয়ানদের দখলে চলে গেছে। আমাদের সবাইকে তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র-”

পুরো অ্যাসেম্বলিতে যেনো উন্মাদনা শুরু হয়ে গেলো। ভয়ার্ত ইঁদুরের মতো লোকজন এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে লাগলো উদভ্রান্ত হয়ে। শত্রুবাহিনী আর প্যারিসের মাঝখানে ভারদানের দূর্গটি তাদের সর্বশেষ শক্তঘাঁটি! হয়তো রাতের মধ্যেই প্রশিয়ান সেনাবাহিনী চলে আসবে প্যারিসে।

চুপচাপ বসে থেকে ডেভিড কথাগুলো শোনার চেষ্টা করে গেলেন। হট্টগোলের কারণে সেক্রেটারির কথা একদমই শোনা যাচ্ছে না এখন। লোকজনের ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকালেন তিনি।

পুরো অ্যাসেম্বলিটা উন্মাদগ্রস্ত লোকজনের আখড়ায় পরিণত হয়ে গেছে। উপর থেকে বিক্ষুব্ধ আর উশৃঙ্খল লোকজন মডারেটদের উপর কাগজ আর ফলমূল ফেলছে। এইসব গায়রোদিনরা ক’দিন আগেও লিবারেল হিসেবে পরিচিত ছিলো, ভয়ার্ত ফ্যাকাশে মুখে অসহায়ের মতো উপরে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে যাচ্ছে এখন। তারা পরিচিত রিপাবলিকান রয়্যালিস্ট হিসেবে, যারা তিন তিনটি জিনিসের সমর্থক : অভিজাত পরিবার, যাজকতন্ত্র এবং বুর্জোয়া। ব্রুনসউইকের আদেশের কারণে এই অ্যাসেম্বলি রুমেও তাদের জীবন বিপন্ন হয়ে উঠেছে। এটা তারাও ভালো করে জানে।

 প্রুশিয়ান সেনাবাহিনী প্যারিসে আসার আগেই রাজতন্ত্রের পুণর্বহাল যারা সমর্থন করে তারা সবাই হয়তো মারা যাবে।

এবার সেক্রেটারি পোডিয়াম থেকে নেমে যেতেই সেখানে এসে দাঁড়ালেন দাঁতোয়াঁ, যাকে সবাই অ্যাসেম্বলির সিংহ বলে ডাকে। বিশাল মাথা আর সুগঠিত শরীর তার, শৈশবে ষাড়ের সাথে লড়াই করতে গিয়ে নাকে-ঠোঁটে আঘাত পেয়েছিলেন। সেই ক্ষত এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন। নিজের ভারি দু’হাত তুলে সবাইকে শান্ত হতে বললেন তিনি।

“নাগরিকগণ! মুক্ত দেশের একজন মন্ত্রী হয়ে এ কথাটা বলতে সন্তোষ বোধ করছি যে, তাদের দেশ রক্ষা পেয়ে গেছে। কারণ সবাই সজাগ, সবাই প্রস্তুত, এই লড়াইয়ে যোগ দিতে সবাই উন্মুখ হয়ে আছে…”

শক্তিশালী এই নেতার কথা শুনে পুরো ঘরের মধ্যে আস্তে আস্তে নীরবতা নেমে আসতে শুরু করলো। দাঁতোয় তাদেরকে আগুয়ান হয়ে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে বললেন, দুর্বলদের মতো পিছুটান না দিয়ে প্যারিসে যে ঝড় ধেয়ে আসছে বুক চিতিয়ে সেটার প্রতিরোধ করতে আহ্বান জানালেন। শহরের প্রতিটি নাগরিক যেনো অস্ত্র ধারণ করে, যার যা আছে তাই নিয়ে যেনো প্রহরা দেয় প্রতিটি প্রবেশদ্বার। তার এমন জ্বলাময়ী বক্তব্য শুনে সবাই উদ্দীপ্ত হলো, উৎফুল্ল হয়ে আনন্দ ধ্বনি প্রকাশ করলো সমস্বরে।

“আমরা যে চিৎকার করছি সেটা বিপদের ভয়ে আর্তচিৎকার নয়, ফ্রান্সের শত্রুদের বিরুদ্ধে আমাদের হুঙ্কার!…আমাদেরকে দেখিয়ে দিতে হবে, আবারো দেখিয়ে দিতে হবে, সব সময় আমরা যেমনটি দেখিয়ে দিয়েছি-ফ্রান্স টিকে থাকবে…ফ্রান্স রক্ষা পাবেই!”

পুরো অ্যাসেম্বলিতে উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়লো। হাতের সামনে যা কিছু পেলো, সব শূন্যে ছুঁড়ে মেরে চিৎকার করে বলতে লাগলো সবাই : “লদেসি! লদেসি! দেখিয়ে দাও! দেখিয়ে দাও!”

এই হট্টগোলের মধ্যে ডেভিডের চোখ গ্যালারিতে বসা এক লোকের উপর নিবদ্ধ হলো। হালকা পাতলা গড়নের ধবধবে সাদা একজন মানুষ, গায়ের পোশাক একেবারে পরিপাটী, মাথার উইগে বেশ সুন্দর করে পাউডার দেয়া। হিম-শীতল সবুজ দৃষ্টির এক যুবক, সাপের মতোই চকচক করে তার চোখ দুটো।

 ডেভিড দেখলেন, এই যুবক দাঁতোয়াঁর উজ্জীবিত বক্তৃতায় মোটেও আলোড়িত হচ্ছে না, চুপচাপ বসে আছে। তাকে দেখেই ডেভিড বুঝতে পারলেন, অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া, হাজারো সমস্যায় জর্জরিত, নিজেদের মধ্যে বিবাদ আর আশেপাশের ডজনখানেক শত্রুদেশের হাত থেকে একটা জিনিসই কেবল ফ্রান্সকে রক্ষা করতে পারে আর সেটা দাঁতোয়াঁ কিংবা মারাতের জ্বালাময়ী বক্তৃতা নয়। ফ্রান্সের দরকার একজন নেতার। এমন একজন নেতা যার শক্তি নিহিত আছে স্তব্ধতার মাঝে। যে গলাবাজি করে না, কিন্তু প্রয়োজনে নিজের ক্ষমতা দেখাতে পারে। এমন একজন নেতা যার পাতলা ঠোঁটে লোভ আর সম্মানের চেয়ে ‘সততা’ শব্দটিই বেশি সুমধুর শোনায়। যে জঁ জ্যাক করে। মতাদর্শকে সন্নত রাখতে পারবে, এই মতাদর্শের উপরেই তো তাদের বিপ্লব সূচীত হয়েছে। গ্যালারিতে চুপচাপ বসে আছে যে লোকটা সে-ই হলো সেই নেতা। তার নাম ম্যাক্সিমিলিয়ে রোবসপাইয়ে।

দুপুর : ১টা

প্যারিস কমিউনের ভেতরে কাঠের একটি বেঞ্চে বসে আছে জার্মেইন দ্য স্তায়েল। প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে এখানে বসে আছে সে। তার চারপাশে ছোটো ছোটো দলে বিভক্ত হয়ে অসংখ্য লোকজন থাকলেও তারা কোনো কথা বলছে না। কিছু লোক তার পাশে বসে থাকলেও বেশিরভাগ লোক বসে আছে ঘরের মেঝেতে। পাশের একটা খোলা দরজা দিয়ে স্তায়েল দেখতে পাচ্ছে লোকজন স্ট্যাম্প মারা কাগজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে। মাঝেমধ্যেই তারা ঘরে এসে কাগজ দেখে দেখে লোকজনের নাম ধরে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে ভেতরে। যাদের নাম ধরে ডাকা হচ্ছে তাদের মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। বাকিরা তালি বাজিয়ে সাহস যোগাচ্ছে তাদেরকে।

 মাদাম স্তায়েল অবশ্য জানে দরজার ওপাশে কি হচ্ছে। প্যারিস কমিউনের সদস্যরা দ্রুত এবং তাৎক্ষণিক বিচার করছে অপরাধীদের। অপরাধ বলতে বংশগত অবস্থান এবং রাজার প্রতি আনুগত্য থাকা। অভিজাত বংশের হলে তার রক্ত প্যারিসের পথেঘাটে রঞ্জিত হবে আগামীকাল সকালে। জার্মেইন নিজের পরিচয় কোনোভাবেই লুকাতে পারবে না। সেই সুযোগ তার নেই। বেঁচে থাকার একমাত্র আশা : হয়তো বিচারকেরা গর্ভবতী কোনো মহিলাকে গিলোটিনে শিরোচ্ছেদ করবে না।

জার্মেইন যখন অপেক্ষা করছে তখন হঠাৎ করে তার পাশে বসা এক লোক কাঁদতে কাঁদতে খিচুনি দিতে লাগলো। ঘরের বাকিরা কেউ এগিয়ে এসে লোকটাকে সান্ত্বনা দিলো না বরং এমনভাবে তার দিকে তাকালো ঠিক যেভাবে নোংরা কদর্য ভিক্ষুকদের দিকে উন্নাসিক ধনীরা তাকায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে জার্মেইন উঠে দাঁড়ালো। এরকম লোকের সাথে একই বেঞ্চে বসে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাকে এখন মাথা খাটাতে হবে নিজেকে রক্ষা করার একটা উপায় বের করার জন্য।

ঠিক এ সময় তার চোখে পড়লো জনাকীর্ণ ঘরে লোকজনের ভীড় ঠেলে হাতে একগাদা কাগজ নিয়ে এক যুবক পাশের ঘরে যাচ্ছে। জার্মেইন চিনতে পারলো তাকে।

“কামিয়ে!” চিৎকার করে ডাকলো সে। “কামিয়ে দেমোলা!” যুবকটি তার। দিকে ফিরে তাকাতেই অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। কামিয়ে দেয়োল প্যারিসের একজন প্রসিদ্ধ নাগরিক। তিন বছর আগে একজন জেসুইট ছাত্র হিসেবে অধ্যয়নরত ছিলো, তো জুলাই মাসের এক উত্তপ্ত রাতে ক্যাফে ফোয়ে এসে উপস্থিত লোকজনকে বাস্তিল দূর্গ আক্রমণ করার প্রস্তাব করেছিলো সে। এখন। ফরাসি বিপ্লবের একজন নায়ক বনে গেছে কামিয়ে।

 “মাদাম দ্য স্তায়েল!” ভীড় ঠেলে তার হাতটা ধরে বললো সে। “আপনি এখানে কেন? নিশ্চয় রাষ্ট্রদ্রোহী কোনো কাজ করেন নি?” এমন মিষ্টি করে হেসে কথাটা বললো যে এই অন্ধকারাচ্ছন্ন মৃত্যুপরীতে সেটা একদমই বেমানান। জার্মেইনও চেষ্টা করলো মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলার।

 “প্যারিসের মহিলা নাগরিকেরা আমাকে ধরে এনেছে এখানে,” একটু কূটনৈতিক ভাষা ব্যবহার করে বললো সে। মনে হচ্ছে অ্যাম্বাসেডরের স্ত্রীর শহরের গেট দিয়ে বের হয়ে যাওয়াটা এখন রাষ্ট্রদ্রোহ কাজ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আমরা যখন মুক্তি আর স্বাধীনতার জন্যে কঠিন সংগ্রাম করছি তখন এটা কি পরিহাসের ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে না আপনার কাছে?”

কামিয়ের মুখ থেকে হাসি উবে গেলো। জার্মেইনের পাশে বেঞ্চে বসা লোকটার দিকে আড়চোখে তাকালো সে। তারপর জার্মেইনের হাত ধরে একটু পাশে সরিয়ে নিলো তাকে।

“আপনি বলতে চাচ্ছেন কোনো রকম পাস আর এসকর্ট ছাড়া আপনি প্যারিস ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন? হায় ঈশ্বর, এ কি করেছেন মাদাম। আপনার ভাগ্য ভালো তাৎক্ষণিক বিচারে আপনাকে গুলি করে মারা হয় নি!”

“কী যা তা বলছেন!” আৎকে উঠে বললো সে। “আমার তো কূটনৈতিক সুরক্ষা আছে। আমাকে জেলে ভরলে সেটা সুইডেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল বলে বিবেচিত হবে। আমাকে যে এখানে আটকে রাখা হয়েছে এটা শুনলেই তারা ভীষণ ক্ষেপে যাবে।” তার এই ক্ষণস্থায়ী সাহসিকতা কামিয়ের পরের কথাগুলো শুনে পুরোপুরি লোপ পেয়ে গেলো।

“এখন কি হচ্ছে সেটা কি আপনি জানেন না? আমরা এখন যুদ্ধাবস্থায় আছি, বহিশত্রুর আক্রমণের মুখোমুখি…” কথাগুলো একটু চাপাকণ্ঠে বললো যাতে আশেপাশের কেউ শুনতে না পায়। কারণ এই খবরটা এখনও জনগণ জানতে পারে নি, জানতে পারলে একটা আতঙ্ক আর ভীতি ছড়িয়ে পড়বে সর্বত্র। “ভারদানের পতন হয়েছে,” বললো সে।

স্থিরচোখে চেয়ে রইলো জার্মেইন। খুব দ্রুতই বুঝতে পারলো তার অবস্থা কতোটা সঙ্গিন এখন। ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো, “অসম্ভব! তারপর মাথা দুলিয়ে জানতে চাইলো, “প্যারিস থেকে কতো দূরে আছে…মানে তারা এখন কোথায় আছে?”

“আমার ধারণা দশ ঘণ্টারও কম সময়ে তারা প্যারিসে পৌঁছে যাবে। এরইমধ্যে একটা আদেশ জারি করা হয়েছে, শহরের প্রবেশদ্বার দিয়ে যে বা যারাই ঢোকার চেষ্টা করবে তাদেরকে যেনো গুলি করা হয়। আর এ মুহূর্তে যান দেশ ছাড়ার চেষ্টা করবে তাদেরকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে বিবেচনা করা হবে। জার্মেইনের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকালো সে।

“কামিয়ে,” জার্মেইন বললো। “আপনি কি জানেন আমি কেন সুইজারল্যান্ডে আমার পরিবারের সাথে যোগ দিতে এতোটা মরিয়া? আমি যদি আরো দেরি কবি তাহলে হয়তো আর ওখানে যেতেই পারবো না। আমি গর্ভবতী।”

কামিয়ে অবিশ্বাসের সাথে তাকালো তার দিকে, তবে জার্মেইনের সাহস আবার ফিরে এসেছে। যুবকের হাতটা নিয়ে নিজের পেটের উপর রাখলো সে। কামিয়ে বুঝতে পারলো কথাটা মিথ্যে নয়। প্রসন্ন হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটে।

 “মাদাম, ভাগ্য ভালো থাকলে আমি হয়তো আপনাকে আজরাতের মধ্যে অ্যাম্বাসিতে ফেরত পাঠাতে পারবো। প্রুশিয়ানদের সাথে লড়াই করে জেতার আগে স্বয়ং ঈশ্বরও আপনাকে শহরের গেটের বাইরে নিয়ে যেতে পারবে না। আপনার ব্যাপারটা নিয়ে আমি দাঁতোয়াঁর সাথে কথা বলবো।”

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো জার্মেইন। “জেনেভাতে যখন আমার বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হবে তখন আমি তার নাম রাখবো আপনার নামে।”

দুপুর : ২টা

ডেভিডের স্টুডিও থেকে অনেকটা পালিয়ে এসে একটা ঘোড়াগাড়ি ভাড়া করে লাবায়ে জেলখানার সামনে চলে এলো মিরিয়ে এবং ভ্যালেন্টাইন। রাস্তায় লোকেলোকারণ্য, বেশ কয়েকটি গাড়ি জেলখানার সামনে আর্টকে দেয়া হলো।

দাঙ্গাবাজ লোকগুলো হাতে দা-কুড়াল আর লাঠিসোটা নিয়ে জেলখানার গেটের কাছে থেমে থাকা ঘোড়াগাড়িগুলোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গাড়িগুলোর দরজা আর জানালার উপর আঘাত করতে শুরু করলো তারা চারপাশ থেকে। তাদের গর্জনে প্রকম্পিত হলো দু’পাশে পাথরের দেয়ালের মাঝখানে থাকা সরু পথটা। জেলখানার রক্ষীরা ঘোড়াগাড়িগুলোর ছাদে উঠে লোকজনকে দূরে সরানোর বৃথা চেষ্টা করছে।

মিরিয়ে আর ভ্যালেন্টাইনের গাড়ির ড্রাইভার ঝুঁকে জানালা দিয়ে উঁকি মারলো ভেতরে।

 “আমি আর বেশি কাছে যেতে পারবো না,” বললো তাদেরকে। “আরেকটু এগোলেই গলির মধ্যে আটকা পড়ে যাবো। তাছাড়া এইসব দাঙ্গাবাজদের চোখমুখ দেখে আমার ভালো ঠেকছে না।”

হঠাৎ করেই লোকজনের ভীড়ের মধ্যে নানের পোশাকে একজনকে দেখতে পেলো ভ্যালেন্টাইন। গাড়ির জানালা দিয়ে হাত নেড়ে তার মনোযোগ পাবার চেষ্টা করলো সে। বৃদ্ধ নান তাকে দেখতে পেয়ে হাত নাড়লেও লোকজনের ভীড় ঠেলে এগোতে পারলো না।

 “ভ্যালেন্টাইন, না!” দরজা খুলে তার বোন লাফ দিয়ে পথে নেমে গেলে মিরিয়ে চিৎকার করে বললো।

মঁসিয়ে, প্লিজ,” গাড়ি থেকে নেমে অনুনয় করে ড্রাইভারকে বললো মিরিয়ে, আপনি কি গাড়িটা একটু রাখবেন? আমার বোন খুব জলদিই ফিরে আসবে।” লোকজনের ভীড় ঠেলে ভ্যালেন্টাইনকে চলে যেতে দেখছে সে। উদভ্রান্তের মতো সিস্টার কুদের কাছে যাবার চেষ্টা করছে মেয়েটা।

“মাদেমোয়ে,” ড্রাইভার বললো, “আমি নীচে নেমে ঘোড়াগুলো হাতে টেনে গাড়িটা ঘোরাচ্ছি। এখানে ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে আছি আমরা। যেসব গাড়ি তারা থামিয়েছে সেগুলোতে বন্দী আছে।”

“আমরা একজনের সাথে দেখা করতে এসেছি,” মিরিয়ে বললো। “এক্ষুণি তাকে এখানে নিয়ে আসবো, তারপরই চলে যাবো এখান থেকে। মঁসিয়ে, আমি আপনার কাছে আবারো অনুনয় করছি, একটু অপেক্ষা করুন।”

“এইসব বন্দীদের, চারপাশে ঘিরে থাকা কয়েকটি গাড়ির দিকে চেয়ে বললো ড্রাইভার, “সবাই পাদ্রী আর যাজক, তারা রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য দেখায় নি বলে ধরে আনা হয়েছে। আমি তাদেরকে নিয়ে যেমন আশংকা করছি তেমনি আমাদের নিরাপত্তা নিয়েও শংকিত। আমি গাড়িটা ঘোরাচ্ছি, এই ফাঁকে আপনার বোনকে নিয়ে চলে আসুন। সময় নষ্ট করবেন না।”

ড্রাইভার সিট থেকে নেমে ঘোড়াগুলো ঘোরাতে শুরু করলে মিরিয়ে। লোকজনের ভীড় ঠেলে এগোনোর চেষ্টা করলো। তার বুক ধকধক করছে এখন।

চারপাশে জনসমুদ্র। লোকজনের ভীড়ের কারণে ভ্যালেন্টাইনকে দেখতে পাচ্ছে না। বহু কষ্টে সামনে এগোতে গিয়ে তার কাছে মনে হলো অসংখ্য হাত তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে অন্য দিকে। মানুষের কাঁচা মাংসের গন্ধ নাকে এসে লাগতেই ভয়ে তার গলা শুকিয়ে এলো।

হঠাৎ লোকজনের ভীড়ের ফাঁকে ভ্যালেন্টাইনকে এক ঝলক দেখতে পেলো মিরিয়ে। সিস্টার ক্লদের থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরে আছে সে। হাত বাড়িয়ে বৃদ্ধ নানকে ধরার চেষ্টা করছে। এরপরই লোকজনের ভীড়টা আরো গাঢ় হয়ে। গেলে হারিয়ে ফেললো তাকে।

“ভ্যালেন্টাইন!” চিৎকার করে ডাকলো মিরিয়ে। কিন্তু হাজার হাজার লোকের বজ্রকণ্ঠের কাছে মিইয়ে গেলো সেটা। লোকজনের ভীড় ঠেলতে ঠেলতে বন্দীদের গাড়িগুলোর সামনে নিয়ে গেলো তাকে। এইসব গাড়িতেই পাদ্রীরা আছে।

ভ্যালেন্টাইনের দিকে ছুটে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা করলো মিরিয়ে কিন্তু উন্মাতাল জনসমুদ্রের স্রোত তাকে সরিয়ে দিচ্ছে ক্রমশ। আস্তে আস্তে সে বন্দীদের গাড়ির দিকে চলে এলো। তাকে একটা গাড়ির সাথে সাঁটিয়ে দিলো জনসমুদ্র। ঠিক তখনই খুলে গেলো গাড়িটার দরজা।

 দাঙ্গাবাজ লোকগুলো বন্দীদের টেনে হিঁচড়ে বের করে আনতে শুরু করলো এবার। ভয়ার্ত এক যুবকপাদ্রীর সাথে মিরিয়ের চোখাচোখি হয়ে গেলো কিছু সময়ের জন্যে। তারপরই তাকে টেনে নিয়ে গেলো হিংস্র মানুষগুলো। এক বৃদ্ধ যাজক দরজা দিয়ে লাফিয়ে নীচে নেমে এসে হাতের লাঠিটা দিয়ে আঘাত করতে শুরু করলো দাঙ্গাকারীদের। উদভ্রান্তের মতো চিৎকার করে জেলখানার রক্ষিদের ডাকলো সাহায্যের জন্যে কিন্তু তারাও এখন হিংস্র পশু হয়ে গেছে, দাঙ্গাকারী খুনে লোকগুলোর সাথে যোগ দিয়ে পাদ্রীদের ছিন্নভিন্ন করে ফেললো মুহূর্তে। পায়ের নীচে ফেলে পিষ্ট করে ফেললো অনেককে।

একটা ঘোড়াগাড়ির চাকা ধরে মিরিয়ে দেখতে লাগলো একের পর এক পাদ্রীকে টেনে হিঁচড়ে গাড়ি থেকে বের করে হিংস্র লোকগুলো পশুর মতো হামলে পড়ছে। শাবল-গাইতি, লাঠিসোটা, যার কাছে যা আছে তা নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ছে বিচারের জন্যে আনা পাদ্রীদের উপর। সুতীব ভয়ে বার বার ভ্যালেন্টাইনের নাম ধরে ডাকতে লাগলো মিরিয়ে। কিন্তু সবই বৃথা। এক সময় জনসমুদ্রের ঢেউ তাকে ধাক্কা মেরে গাড়ির কাছ থেকে সরিয়ে জেলখানার দেয়ালের দিকে নিয়ে গেলো।

পাথরের দেয়ালের উপর আছড়ে পড়লো সে, তারপর কাকড় বিছানো পথের উপর। ভেজা আর উষ্ণ কিছু টের পেলো মিরিয়ে। মাথা তুলে চোখের সামনে থেকে চুল সরাতেই দেখতে পেলো সিস্টার ক্লদের ভোলা চোখ দুটো। লাবায়ে জেলখানার দেয়ালের নীচে পড়ে আছে সে। সারা মুখে রক্ত। মাথার স্কার্ফটা ছিন্নভিন্ন। স্পষ্ট দেখতে পেলো কপালের বাম দিকটা ফেটে চৌচিড় হয়ে আছে। চোখ দুটো শূন্যে তাকিয়ে আছে যেনো। মিরিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে প্রাণপনে চিৎকার করার চেষ্টা করলো কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। তার গলা আর্টকে এলো। তার হাতে যে ভেজা আর উষ কিছু টের পেয়েছিলো সেটা আর কিছু না। সিস্টার ক্লদের ছিঁড়ে ফেলা হাতের অংশ।

ভয়ে দূরে সরে গেলো মিরিয়ে। উদভ্রান্তের মতো হাতের রক্ত মুছে ফেললো নিজের গাউনে। ভ্যালেন্টাইন! কোথায় তার বোন? পশুর মতো কতোগুলো মানুষ তার দিকে এগিয়ে আসতেই দেয়াল ধরে হাটু মুড়ে উঠে বসলো সে, ঠিক তখনই একটা গোঙানি শুনে বুঝতে পারলো সিস্টার ক্লদ এখনও বেঁচে আছে!

সিস্টারকে জড়িয়ে ধরলো মিরিয়ে।

“ভ্যালেন্টাইন!” চিৎকার করে বললো সে। “ভ্যালেন্টাইন কোথায়? আপনি কি আমার কথা বুঝতে পারছেন? ভ্যালেন্টাইনের কি হয়েছে, বলুন?”

মৃতপ্রায় নান কোনো রকম বলতে পারলো, “ভেতরে, তার কথাটা একেবারে ফিসফিসানির মতো শোনালো। “তারা তাকে লাবায়ের ভেতরে নিয়ে গেছে।” তারপরই জ্ঞান হারালো আবার।

“হায় ঈশ্বর, আপনি কি নিশ্চিত?” মিরিয়ে বললো কিন্তু কোনো জবাব পেলো না।

উঠে দাঁড়ালো সে। রক্তপিপাসু দাঙ্গাবাজরা তার দিকেই ছুটে আসছে। চারদিকে দা, কুড়াল, শাবল, গাইতি আর নানা রকম ভয়ঙ্কর অস্ত্রের ঝনঝনানি। সেইসাথে তাদের জান্তব উল্লাস আর কিছু মানুষের বেঁচে থাকার করুণ আর্তনাদ মিলেমিশে এমন বিকট শব্দ সৃষ্টি করেছে যে মাথা ভনভন করতে শুরু করলো। লাবায়ের দরজায় জোরে জোরে আঘাত করতে গিয়ে তার হাত রক্তাক্ত হয়ে গেলো।

ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। ক্লান্ত-ভগ্ন মনে বুঝতে পারলে এখান। থেকে সরে গিয়ে ঘোড়াগাড়িটার কাছে যেতে হবে, হয়তো সেটা এখনও আশেপাশেই আছে। তারপর খুঁজে বের করতে হবে ডেভিডকে। কেবলমাত্র ডেভিডই তাদেরকে সাহায্য করতে পারবে এখন।

হঠাৎ করেই সে বরফের মতো জমে গেলো জনারণ্যের মাঝখানে। লোকজনের ভীড়ের ফাঁক গলে চোখে পড়লো একটা ভয়াবহ দৃশ্য। যে গাড়িটায় করে তারা এসেছিলো সেটা এখন দাঙ্গাবাজদের কবলে পড়ে গেছে। সেটাকে টানতে টানতে মিরিয়ে দিকেই নিয়ে আসা হচ্ছে। সেই গাড়ির ড্রাইভারের আসনে একটা বলুমের মাথায় তাদের ড্রাইভারের খণ্ডিত মস্তক। লোকটার সিলভার রঙের চুল আর রক্তাক্ত মুখমণ্ডল দেখে গা শিউড়ে উঠলো তার।

নিজের ভেতর থেকে আসা চিৎকারটা থামানোর জন্য নিজের হাতে কামড় বসিয়ে দিলো মিরিয়ে। বুঝতে পারলো ডেভিডকে আর খুঁজতে পারবে না সে। তাকে এখন লাবায়ের ভেতরে যেতে হবে। আর এখন যদি ভ্যালেন্টাইনের কাছে না যেতে পারে তাহলে এই জীবনে আর কখনই সেটা সম্ভব হবে না।

বিকেল : ৩টা

জ্যাক-লুই ডেভিড উঠে আসা বাস্পের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। পাথর বিছানো উত্তপ্ত রাস্তার উপরে মহিলারা বালতি ভরে ঠাণ্ডা পানি ঢেলে দেয়ার কারণে এই বাষ্প। তিনি প্রবেশ করলেন ক্যাফে দ্য লা রিজেন্সিতে।

ডজনখানেক লোক ভেতরে বসে পাইপ আর সিগার খাচ্ছে ফলে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন পুরো ক্লাবঘরটি। ডেভিডের চোখে এসে লাগলো সেটার আঁচ। কোনো রকম ভীড় ঠেলেঠুলে এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে। প্রতিটি টেবিলে তাস, ডমিনো আর দাবা খেলে যাচ্ছে লোকজন। ক্যাফে দ্য লা রিজেন্সি হলো ফ্রান্সের সবচাইতে পুরনো খেলাধুলার ক্লাব।

ঘরের পেছনে চলে এলেন ডেভিড। দেখতে পেলেন ম্যাক্সিমিলিয়েঁ রোবসপাইয়ে একটা টেবিলে বসে নিবিষ্টমনে দাবা খেলে যাচ্ছে। তার মধ্যে অসম্ভব শান্ত আর ধীরস্থির মনোভাব, চারদিকের হৈহল্লার কোনা কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারছে না। বাস্তবেও লোকটা বরফের মতোই শীতল। আর দাবা খেলার সময় আশেপাশের কোনো কিছুই তাকে স্পর্শ করে না।

রোবসপাইয়ের বিপরীতে যে বৃদ্ধ লোকটি বসে আছে ডেভিড তাকে চিনতে পারলেন না। পুরনো দিনের নীল কোট আর সাদা মোজা পরে আছে, বেশভূষা দেখতে একেবারে পঞ্চদশ লুইয়ের মতো। কোনো দিকে না তাকিয়েই বুড়ো লোকটা চাল দিলো। ডেভিড কাছে আসতেই মুখ তুলে তাকালো সে।

“আপনার খেলায় বিঘ্ন ঘটানোর জন্য আমি খুবই দুঃখিত,” বললেন ডেভিড। “মঁসিয়ে ম্যাক্সিমিলিয়ে রোবসপাইয়েকে আমি একটা জরুরি অনুরোধ করতে এসেছি।”

 “ঠিক আছে, কোনো সমস্যা নেই,” বললেন বুড়ো লোকটা। রোবসপাইয়ে এখনও চুপচাপ দাবাবোর্ডটি নিরীক্ষণ করে যাচ্ছে। আমার বন্ধু খেলায় হেরে গেছে। তার রাজা চেক হয়ে গেছে। তুমি খেলা থেকে ছুটি নিতে পারো ম্যাক্সিমিলিয়ে। তোমার বন্ধু ঠিক সময়েই এসে পড়েছে।”

“আমি তো এটা দেখতে পাচ্ছি না,” বললো রোবসপাইয়ে। অবশ্য দাবার ব্যাপারে আপনার চোখ আমার চেয়েও ভালো, সেটা আমি জানি।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাবাবোর্ড থেকে চোখ সরিয়ে ডেভিডের দিকে তাকালো সে। “মঁসিয়ে ফিলিদোর হলেন ইউরোপের সবচাইতে সেরা দাবা খেলোয়াড়। তার সাথে হেরে যাওয়াটাও অনেক সম্মানের ব্যাপার। এক টেবিলে বসে যে খেলছি। সেটাই তো অনেক কথা।”

 “আপনিই তাহলে সেই বিখ্যাত ফিলিদোর!” অবাক হয়ে বলেই বুড়ো লোকটার হাত ধরে ফেললেন ডেভিড। “আপনি তো বিখ্যাত সুরকার, সঁসিয়ে। আমি যখন অনেক ছোটো ছিলাম তখন আপনার লো সোলদাত ম্যাজিশিয়ান দেখেছিলাম। জীবনেও ভুলতে পারবো না সেটা। দয়া করে আমাকে আমার পরিচয়টা দিতে দিন, আমি জ্যাক-লুই ডেভিড।”

“বিখ্যাত পেইন্টার!” উঠে দাঁড়িয়ে বললেন ফিলিদোর। “ফ্রান্সের অন্য সবার মতো আমিও আপনার চিত্রকর্মের দারুণ ভক্ত। তবে বলতে বাধ্য হচ্ছি, এ দেশে আপনিই হলেন একমাত্র ব্যক্তি যে আমাকে মনে রেখেছে। যদিও এক সময় আমার সঙ্গিত কমেদি-ফ্রাসোঁয়া আর অপেরা-কমিকে নিয়মিত পরিবেশিত হতো কিন্তু বর্তমানে আমি প্রশিক্ষিত বানরের মতো দাবা খেলে দু’পয়সা রোজগার করে সংসার চালাই। রোবসপাইয়ে আমার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে দারুণ উপকার করেছে, একটা পাস জোগার করে দিয়েছে আমাকে, যাতে করে এ দেশ ছেড়ে ইংল্যান্ডে চলে যেতে পারি, ওখানে আমি দাবা খেলে ভালোই রোজগার করতে পিরবো।”

“আমিও ঠিক এরকম উপকার চাইতে এসেছি তার কাছে, রোবসপাইয়ে নিজেও চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালে বললেন ডেভিড। এই মুহূর্তে প্যারিসের রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুবই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। আর সেজন্যেই আমি এখানে ছুটে এসেছি, জানি না উনি আমার অনুরোধ রাখবেন কিন.।”

“নাগরিকেরা সব সময়ই অন্যের কাছ থেকে একটু সুবিধা পেতে চায়, শান্তকণ্ঠে বললো রোবসপাইয়ে।

“আমি আমার তত্ত্বাবধানে থাকা অল্পবয়স্কা দুটো মেয়ের জন্যে এসেছি, দৃঢ়ভাবে বললেন ডেভিড। “আমি নিশ্চিত আপনি নিজেও মনে করেন না এ মূহূর্তে অল্পবয়স্ক তরুণীদের জন্যে ফ্রান্স কোনো নিরাপদ জায়গা।”

“আপনি যদি তাদের নিয়ে এতোটাই চিন্তিত হয়ে থাকেন তাহলে,” নাক সিটকিয়ে বললো রোবসপাইয়ে, “আঁতুয়ার বিশপের মতো লোকের বাহুবন্ধনে তাদেরকে প্যারিসের পথেঘাটে ছেড়ে দিতেন না।”

“আমি একটু ভিন্নমত পোষণ করবো,” ফিলিদোর কথার মাঝখানে ঢুকে পড়লেন। “মরিস তয়িরাঁর দারুণ ভক্ত আমি। আমার অনুমাণ একদিন এই লোকটা ফ্রান্সের ইতিহাসে মহান রাষ্ট্রনায়ক হয়ে উঠবে।”

“অনুমাণ হিসেবে একটু বেশিই হয়ে গেছে,” বললো রোবসপাইয়ে। “ভাগ্য ভালো যে, আপনি লোকজনের ভাগ্য গণনা করে জীবিকা নির্বাহ করেন না। কয়েক সপ্তাহ ধরে মরিস উঁয়িরা ফ্রান্সের সরকারী কর্মকর্তাদের ঘুষ সেধে যাচ্ছে তাকে যেনো কূটনৈতিক হিসেবে ইংল্যান্ডে যাবার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। লোকটা এখন নিজের মাথা বাঁচাতে ব্যস্ত। মাই ডিয়ার ডেভিড, প্রশিয়ান সেনাবাহিনী এসে পড়ার আগে ফ্রান্সের সব অভিজাত লোকজন দেশ ছাড়তে চাইছে। আজরাতে কমিটির মিটিংয়ে আপনার ঐ দুই তরুণীর ব্যাপারে কী করা যায় সেটা নিয়ে কথা বলবো তবে এ মুহূর্তে কোনো কথা দিতে পারছি না। আপনি একটু দেরি করে ফেলেছেন।”

 ডেভিড তাকে ধন্যবাদ দিয়ে চলে যাবার সময় তার সাথে সাথে বের হলেন দাবা মাস্টার ফিলিদোর। তিনিও ক্লাব থেকে বের হতে যাচ্ছিলেন এ সময়। জনাকীর্ণ ক্লাবঘর থেকে বের হবার সময় ফিলিদোর বললেন, “আপনাকে বুঝতে হবে রোবসপাইয়ে আপনার এবং আমার থেকে একটু ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ। একজন অবিবাহিত লোক হিসেবে সন্তানের প্রতি কি রকম দায়িত্ব থাকতে হয় সেটা সে জানে না। আপানার তত্ত্বাবধানে যে মেয়ে দুটো আছে তাদের বয়স কতো, ডেভিড? কতোদিন ধরে তারা আপনার তত্ত্বাবধানে আছে?”

“দু’বছরের বেশি সময় ধরে আমার কাছে আছে,” বললেন ডেভিড। “আমার কাছে আসার আগে তারা ছিলো মন্তগ্লেইন অ্যাবির অ্যাপ্রেন্টিস নান…”

“আপনি কি বললেন, মন্তগ্লেইন?” ক্লাবের গেট দিয়ে বের হবার সময় কণ্ঠে বললেন ফিলিদোর। মাই ডিয়ার ডেভিড, একজন দাবা খেলোয়াড়ে, আমি আপনাকে জোর দিয়ে বলতে পারি মন্তগ্লেইন অ্যাবির ইতিহাস ম আমি বেশ ভালোই জানি। আপনি কি তাদের ইতিহাসটা জানেন না?”

“হ্যাঁ, জানি,” একটু বিব্রত হয়ে বললেন ডেভিড। “সবটাই গালগল্পো। মন্তগ্লেইন সার্ভিসের কোনো অস্তিত্ব নেই। আপনার মতো লোক এর গালপপ্লো বিশ্বাস করে শুনলে আমি অবাকই হবে।”

“গালগপ্পো?” রাস্তায় নামতেই ফিলিদোর ডেভিডের হাতটা ধরলেন। “বন্ধ। আমি জানি ওটার অস্তিত্ব আছে। আমি আসলে তারচেয়েও বেশি কিছু জানি। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে, আপনি সম্ভবত জন্মান নি তখন, প্রশিয়ার ফ্রেডারিকের রাজদরবারে গিয়েছিলাম। ওখানে গিয়ে এমন দুজন লোকের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম যাদের ছিলো অনুধাবন করার অসম্ভব ক্ষমতা। আমি জীবনেও সেটা ভুলবো না। একজনের কথা আপনি নিশ্চয় শুনে থাকবেন-মহান গণিতজ্ঞ লিওনহার্ড ইউলার। অন্যজন ফ্রেডারিকের বাবার সময়কার সভাসঙ্গিতকার। তবে এই বৃদ্ধলোকটি তখন একেবারে ফুরিয়ে গেছে, বলতে পারেন, তার সমস্ত প্রখরতা যেনো বয়সের ধুলোবালিতে চাপা পড়ে গেছে। সমগ্র ইউরোপ তখনও তার কথা শোনে নি। তবে রাজার সুনরোধে এক রাতে তিনি যখন আমাদের সামনে তার সঙ্গিত পরিবেশন করলেন তখন বুঝতে পারলাম এ জীবনে এরকম বিশুদ্ধ সঙ্গিত আর কখনও শুনি নি। তার নাম ইয়োহান সেবাস্তিয়ান বাব।”

“এ নাম তো শুনি নি,” ডেভিড স্বীকার করলেন, “কিন্তু ইউলার আর এই সঙ্গিতকারের সাথে লিজেন্ডারি মন্তগ্লেইন সার্ভিসের সম্পর্কটা কি?”

“বলবো আপনাকে,” হেসে বললেন ফিলিদোর। “তবে আপনি যদি আপনার ঐ দুই তরুণীর সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিন তাহলে। সম্ভবত আমরা এই রহস্যটার কূলকিণারা করতে পারবো। আপনি হয়তো জানেন না এই রহস্যটা উন্মোচন করতে গিয়ে আমি আমার সারা জীবন কাটিয়ে দিয়েছি!”

 ডেভিড তার কথায় রাজি হয়ে তাকে নিজের স্টুডিওতে নিয়ে আসার জন্যে। রওনা হলেন।

 বাতাসের কোনো গতি নেই। গাছের পাতাও নড়ছে না। প্রচণ্ড গরমের একটা দিন। মাটি তেঁতে আছে সেই প্রখর গরমে। সাইন নদীও যেনো সমস্ত উদ্দামতা হারিয়ে ধীরগতিতে বইছে। তারা তখনও জানে না বিশ ব্লক দূরে, কর্নেলিয়ার প্রাণকেন্দ্রে একদল রক্তপিপাসু দাঙ্গাবাজ লাবায়ের জেলখানার প্রধান ফটকটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। আর সেই জেলখানার ভেতরেই আছে ভ্যালেন্টাইন।

তারা দু’জন যখন পায়ে হেঁটে স্টুডিওর পথে এগিয়ে যাচ্ছে তখনই ফিলিদোর তার গল্পটা বলা শুরু করলেন…

দাবা মাস্টারের গল্প

উনিশ বছর বয়সে আমি ফ্রান্স ছেড়ে হল্যান্ডে যাত্রা করি একটা বাদ্যযন্ত্র নিয়ে, উদ্দেশ্য ওখানে এক অল্পবয়সী এডিজি পিয়ানো বাদক মেয়ের সাথে বাজাবো। কিন্তু হল্যান্ড গিয়েই শুনি মেয়েটা কয়েক সপ্তাহ আগে গুটিবসন্তে মারা গেছে। কপর্দকহীন হয়ে আমি বিদেশের মাটিতে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। আয়রোজগারের কোনো আশাও ছিলো না সেখানে। কোনো রকম খেয়েপরে বেঁচে থাকার জন্য আমি কফিহাউজগুলোতে গিয়ে দাবা খেলতে শুরু করি।

চৌদ্দ বছর বয়স থেকেই আমি বিখ্যাত দাবা মাস্টার স্যার দ্য লিগ্যালের অধীনে দাবা চর্চা শুরু করেছিলাম। উনি ছিলেন ইউরোপের সেরা খেলোয়াড়। আঠারো বছর বয়সে আমি তাকে নাইট ছাড়াই হারাতে সক্ষম হতাম। খুব দ্রুত বুঝতে পারলাম আমি যেকোনো খেলোয়াড়কেই হারিয়ে দিতে পারি। আমাকে হেগে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো ফন্টিনয় যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে। চারপাশে যখন যুদ্ধ চলছে তখন যুবরাজ ওয়ালডেকের সাথে দাবা খেলেছিলাম।

আমি সমগ্র ইংল্যান্ড ভ্রমণ করি, ওখানকার কসাইদের কফিহাউজে গিয়ে প্রায় সব সেরা দাবাড়ুদের সাথেই খেলি, তার মধ্যে স্যার অ্যাব্রাহাম জেনসেন এবং ফিলিপ স্টামাও ছিলো। তাদের সাবইকে আমি হারিয়ে দেই। সম্ভবত স্টামা একজন সিরিয়ান কিংবা মুরিশ বংশোদ্ভূত ছিলেন। দাবার উপর বেশ কয়েকটি বই লিখেছিলেন তিনি। সেইসব বইসহ লা বোদোয়া আর মারিচালের বই দুটো আমাকে দেখিয়ে বলেছিলেন, আমারও দাবার উপর বই লেখা উচিত।

 এর কয়েক বছর পরই আমার বই প্রকাশ হয়। সেটার শিরোনাম ছিলো অ্যানালাইস দু জুয়ে দে এসচেক। তাতে আমি দাবা খেলা নিয়ে একটা তত্ত্বের কথা বলি, সৈনিকেরা হলো দাবার প্রাণ। ওই বইতে আমি দেখাই সৈন্যেরা শুধুমাত্র বলি দেয়ার বস্তু নয়, তাদেরকে কৌশলগত এবং অবস্থানগতভাবে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কার্যকরীভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এই বইটা দাবা খেলার জগতে একটি বিপ্লব বয়ে আনে।

আমার কাজ জার্মান গণিতবিদ ইউলারের মনোযোগ আকৃষ্ট করে। দিদেরোর প্রকাশিত ফরাসি দিকশনেয়া’তে আমার চোখ বেধে খেলার কথা প্রকাশিত হলে তিনি ফ্রেডারিককে দিয়ে তার রজদরবারে আমাকে নিমন্ত্রণ করেন।

ফ্রেডারিক দি গ্রেটের রাজদরবারটি পটসডামে অবস্থিত, বিশাল, চোখ ধাঁধানো আর সূক্ষ্ম কারুকাজ করা এই দরবারটি ইউরোপের সেরা হিসেবে বিবেচিত। ফ্রেডারিক নিজে একজন যোদ্ধা বলে তার রাজসভায় সব সময় কিছু সৈনিক, শিল্পী আর নারী থাকতো। তিনি এদের সঙ্গ খুব পছন্দ করতেন। বলা হয়ে থাকে তিনি কাঠের শক্ত তক্তার উপরে ঘুমাতেন, পাশে রাখতেন তার প্রিয় কুকুরগুলো।

আমি যে রাতে রাজদরবারে যাই সেই রাতে লিপজিগের সভাসঙ্গিতকার বাখ তার ছেলে উইলহেমকে নিয়ে উপস্থিত হন আরেক ছেলে কার্ল ইমানুয়েল বাধে সাথে যোগ দিতে। ইমানুয়েল বাখের ছিলেন ফ্রেডারিকের রাজদরবারের সঙ্গিতকার। ফ্রেডারিক নিজে আট বার-এর একটি ক্যানন কম্পোজ করেছিলেন, সিনিয়র বাখকে তিনি অনুরোধ করেছিলেন ঐ থিমটার উপরে কিছু ইপ্রোভাইজ করার জন্য। আমাকে বলা হয়েছিলো, এই বৃদ্ধ সঙ্গিতকার জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনেক বিষয়ে আগ্রহী। তিনি জিশু এবং নিজের নামে কিছু ক্যানন রচনা করেছিলেন আর সেগুলোকে লুকিয়ে রেখেছিলেন গাণিতিক নোটেশনের হারমোনির ভেতরে। তিনি একই সাথে বেশ কয়েকটি জটিল আর বিপরীত মেলোডি একসূত্রে গেথে এমন একটা হারমোনি তৈরি করতেন যা হতো মূল মেলোডির ঠিক বিপরীত চিত্রের মতো।

ইউলার প্রস্তাব করলেন, বৃদ্ধ সঙ্গিতকার যেনো ‘দ্য ইনফিনিট’-এর স্ট্রাকচারের মধ্যে একটি ভ্যারিয়েশন আবিষ্কার করেন। এই ইনফিনিটি মানে ঈশ্বর তার সমগ্র সৃষ্টির মধ্যেই উদ্ভাসিত। রাজা এ কথাটা শুনে খুব খুশি হলেন কিন্তু তার ধারণা ছিলো বাখ এটা করবেন না। আমি নিজে একজন সঙ্গিতকার হিসেবে বলতে পারি, অন্যের সঙ্গিতের উপর বাড়তি কিছু কারুকাজ করা ছোটোখাটো কাজ নয়। একবার আমি জঁ জ্যাক রুশোর একটি থিমের উপর অপেরা কম্পোজ করেছিলাম। দার্শনিক রুশোর বয়স তখন খুব কম ছিলো। কিন্তু সঙ্গিতের মধ্যে এ ধরণের ধাঁধা লুকিয়ে রাখাটা…একেবারেই অসম্ভব একটি কাজ।

তবে আমাকে অবাক করে দিয়ে বাখ তার জামার হাতা গুটিয়ে কিবোর্ডের সামনে বসে গেলেন। ভারি শরীর, বিশাল আকৃতির নাক, শক্ত চোয়াল আর জ্বলজ্বলে চোখ ছিলো তার। ইউলার আমার কানে কানে বললেন, বৃদ্ধ বাখ। ফরমায়েশি কাজ করেন না। নির্ঘাত তিরি রাজার অনুরোধের জবাবে একটা তামাশা করবেন।

 মাথা নীচু করে ইয়োহান সেবাস্তিয়ান বাখ অপূর্ব সুন্দর আর প্রাণ হরণ করা। একটি সঙ্গিত বাজাতে শুরু করলেন। মনে হলো অন্তহীন এক পাখির গান সেটা। এক ধরণের ফিউগো ছিলো ওটা, আমি সেই রহস্যময় দুর্বোধ্যতা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ওনে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলাম তিনি কি করেছেন। সুরের প্রতিটি স্টানজা একটি হারমোনি-কি থেকে শুরু হয়ে অন্য একটি উপরের কি-তে গিয়ে শেষ হচ্ছে, আর এটা চললো রাজার নিজের থিমটা ছয়বার রিপিট হওয়া পর্যন্ত, তবে যে কি থেকে শুরু করেছিলেন সেখানে এসেই তিনি শেষ করলেন। তারপরও পালা বদলটি কোথায় ঘটলো, কিভাবে ঘটলো সেটা আমার কাছেও বোধগম্য হলো না। ওটা ছিলো জাদুর মতো একটি কাজ। অনেকটা সাধারণ ধাতুকে সোনায় বদলে ফেলার মতো একটি ব্যাপার। সঙ্গিতটির চাতুর্যপূর্ণ গঠন শুনে আমার মনে হলো এটা বিরামহীনভাবেই অসীমতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। যতোক্ষণ না সরগুলো দেবদূতেরা শুনতে পায়।

“অসাধারণ!” বাখ থামতেই রাজা বলে উঠলেন। হাতেগোনা কয়েকজন জেনারেল আর সৈনিকের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে সায় দিলেন তিনি।

“এই স্ট্রাকচারটাকে কি নামে ডাকা হয়?” জানতে চাইলাম বাখের কাছে।

“আমি এটাকে বলি ‘Ricercar,” বৃদ্ধ আমাকে বললেন। চমৎকার একটি সঙ্গিত সৃষ্টি করার পরও তার গুরুগম্ভীর অভিব্যক্তি পাল্টালো না। “ইতালিতে এটাকে বলে অম্বেষণ’। এটা সঙ্গিতের খুবই প্রাচীন একটি ফর্ম। এখন আর এ ধরণের সঙ্গিতের চল নেই।” কথাটা বলে তিনি তার ছোটো ছেলে কার্ল ফিলিপের দিকে তিক্তমুখে তাকালেন। তার এই ছেলে জনপ্রিয় ধারার সঙ্গিত রচনা করতেন।

রাজার পাণ্ডুলিপিটা তুলে নিয়ে সেটার উপরে Ricercar শব্দটি দ্রুত লিখে ফেললেন। শব্দটির প্রতিটি অক্ষরকে একেকটি লাতিন শব্দে রূপান্তর করলেন তিনি। ফলে এরকম দাঁড়ালো : রেজিস ইসু কান্তিও এত রেলিকুয়া কানোনিকা আর্তে রেজুলুতা। সাদামাটাভাবে এটার অর্থ দাঁড়ায়, রাজা কর্তৃক ইস্যু হওয়া সঙ্গিত, বাকিটা ক্যাননের শিল্পের মাধ্যমে সম্পন্ন। ক্যানন হলো এমন এক ধরণের সঙ্গিত যেখানে প্রতিটি পার্ট একটা নির্দিষ্ট হিসেবে মাপা থাকে, তবে পুরো সঙ্গিতটি ওভারল্যাপিং ফ্যাশনে। যেনো চিরকাল বহমান, এরকম একটি ভাব তৈরি করে এটি।

 এরপর বাখ মিউজিক শিটের মার্জিনে দুটো লাতিন বাক্য লিখলেন। সেগুলো অনুবাদ করার পর দাঁড়ালো এরকম :

স্বরগুলোর বিস্তৃতির সাথে সাথে রাজার সৌভাগ্যও প্রসারিত হবে।
সুরের সম্প্রসারণ হবার সাথে সাথে রাজার মহিমাও বৃদ্ধি পাবে।

ইউলার এবং আমি বৃদ্ধ সঙ্গিতকারকে তার চাতুর্যপূর্ণ কাজের জন্য প্রশংসা করলাম। এরপর আমাকে একই সাথে রাজা, ডক্টর ইউলার এবং বাখের ছেলে উইলহেমের সাথে চোখ বেধে দাবা খেলার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। যা যদিও দাবা খেলেন নি কিন্তু খেলা দেখেছিলেন বেশ মনোযোগ দিয়ে, তিনজনকেই হারিয়ে দেই আমি। খেলা শেষে ইউলার আমাকে একপাশে সরিয়ে নিয়ে যান।

“তোমার জন্য আমার কাছে একটা উপহার আছে, আমাকে বললেন তিনি। “আমি একটা নতুন নাইট টুর আবিষ্কার করেছি। এটা একটা গাণিতিক ধাঁধা। আমার বিশ্বাস দাবা খেলায় এ পর্যন্ত যতোগুলো নাইট টুর আবিষ্কৃত হয়েছে আমারটা তারমধ্যে সবচাইতে সেরা। তবে তুমি যদি কিছু মনে না করো আমি ওটার একটা কপি বৃদ্ধ বাধকে দিতে চাই আজ রাতে। তিনি গাণিতিক খেলা খুব পছন্দ করেন, এটা তাকে বেশ আনন্দ দেবে।”

আমাদের কাছ থেকে উপহারটা অদ্ভুত হাসির সাথে গ্রহণ করলেন বাব। আন্তরিকভাবেই ধন্যবাদ জানালেন তিনি। “আমি বলি কি, হের ফিলিদোর চলে। যাবার আগে আপনারা আগামীকাল সকালে আমার কটেজে চলে আসুন, বললেন তিনি। “তাহলে আপনাদের জন্যে আমি ছোট্ট একটা সারপ্রাইজ প্রস্তুত করে রাখতে পারবো।” আমরা খুব কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। কথা দিলাম অবশ্যই কাল সকালে তার ওখানে যাবো।

পরের দিন সকালে কার্ল ফিলিপের কটেজের দরজা খুলে বাখ আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। ওখানে ছোট্ট একটা পার্লারে বসলাম আমরা। তিনি আমাদের চা পান করতে দিলেন। এরপর ছোট্ট একটা পিয়ানোর সামনে বসে একেবারে অন্য রকম একটি সঙ্গিত বাজাতে শুরু করলেন তিনি। বাজানো শেষ করলে আমি এবং ইউলার একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলাম।

 “এটাই হলো আপনাদের সারপ্রাইজ!” সন্তুষ্ট ভঙ্গিতে বললেন বাখ। তার মুখের গুরুগম্ভীর অভিব্যক্তি বদলে গেলো। মনে হলো অনেক খুশি হয়েছেন। তবে বুঝতে পারলেন ইউলার এবং আমি কিছুই ধরতে পারছি না।

“শিট মিউজিকটা একটু দেখুন,” বললেন বাখ। আমরা দু’জনে উঠে পিয়ানোর সামনে চলে গেলাম। শিট মিউজিক বলতে কিছুই ওখানে নেই, আছে গতরাতে ইউলারের দেয়া নাইট টুরের সেই কপিটা। জিনিসটা বিশাল দাবাবোর্ডের একটি মানচিত্র, যার প্রতিটি বর্গে সংখ্যা লেখা। বাখ এইসব সংখ্যাগুলোর সাথে চমৎকার কিছু লাইনের সম্পর্ক তৈরি করেছেন, সেগুলো আমার কাছে ধরা পড়ে নি। তবে ইউলার একজন গণিতজ্ঞ, তার মাথা আমার চেয়ে দ্রুত কাজ করে।

“আপনি এইসব সংখ্যাগুলোকে অক্টেভ আর কর্ডে রূপান্তর করেছেন। তিনি চিৎকার করে বলে উঠলেন। “কিন্তু আমাকে দেখাতে হবে এটা আপনি কিভাবে করলেন। গণিতকে সঙ্গিতে পরিণত করা-এটা তো সাংঘাতিক জাদু!”

“কিন্তু গণিত তো সঙ্গিতই,” জবাবে বললেন বাখ। এর উল্টোটাও সত্য। আপনারা যদি বিশ্বাস করে থাকেন মিউজিক’ শব্দটি এসেছে মুসা, মিউজেস’ অথবা ‘মিউটা’ থেকে, যার অর্থ দাঁড়ায় ওরাকলের মুখ, তাহলেও ঐ একই কথা খাটে। আর যদি ভাবেন ম্যাথমেটিকস’ এসেছে ম্যাথানেইন’ কিংবা ম্যাট্রিক্স থেকে যাদের অর্থ জরায়ু অথবা সকল সৃষ্টির মাতা, তাহলেও একই কথা…”

“আপনি শব্দ নিয়েও স্টাডি করেছেন?” ইউলার বললেন।

“সৃষ্টি এবং হত্যা করার ক্ষমতা রয়েছে শব্দের,” বললেন বাখ। “যে মহান স্থপতি আমাদের এই বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন তিনি শব্দেরও জন্ম দিয়েছেন। সত্যি বলতে কি, আমরা যদি নিউ টেস্টামেন্টের সেন্ট জনের কথায় বিশ্বাস রাখি তাহলে বলতে হয়, তিনি প্রথমে শব্দই সৃষ্টি করেছেন।”

“আপনি কি বললেন? মহান স্থপতি?” ইউলারের মুখ কিছুটা ফ্যাকাশে হয়ে। গেলো।

“আমি ঈশ্বরকে স্থপতি নামে ডাকি, কারণ তিনি প্রথমে শব্দের ডিজাইন করেছেন,” জবাবে বললেন বাখ। প্রথমে ছিলো শব্দ,’ মনে আছে? কে জানে? হয়তো এটা নিছক শব্দ না। হয়তো এটা সঙ্গিত। হতে পারে ঈশ্বর তার নিজের তৈরি করা অন্তহীন এক সঙ্গিত গেয়ে চলেছেন, আর এর মাধ্যমেই এই বিশ্বজগৎ মূর্ত হয়ে উঠেছে।”

 ইউলার সূর্য নিরীক্ষণ করতে গিয়ে এক চোখের দৃষ্টি হারিয়ে ফেললেও অন্য চোখে পিটপিট করে তাকালেন পিয়ানোর উপর রাখা নাইট টুরের দিকে। দাবাবোর্ডের ডায়াগ্রামে থাকা অসংখ্য ছোটো ছোটো সংখ্যাগুলোর উপর হাত বুলিয়ে কিছুক্ষণ ভেবে গেলেন তিনি। তারপর কথা বললেন এই গণিতজ্ঞ।

 “আপনি এসব জিনিস কোথায় শিখেছেন?” সুরস্রষ্টাকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি। “আপনি যা বললেন সেটা খুবই গুপ্ত আর বিপজ্জনক একটি সিক্রেট, কেবলমাত্র ইনিশিয়েটরাই এটা জানতে পারে।”

“আমি ইনিশিয়েট হয়েছি,” শান্তকণ্ঠে বললেন বাখ। “ওহ, আমি জানি অনেক সিক্রেট সোসাইটি আছে যারা সারা জীবন ব্যয় করে যাচ্ছে এই মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচন করতে। তবে আমি সেসব সোসাইটির সদস্য নই। আমি আমার নিজের পদ্ধতিতে সত্যান্বেষণ করি।”

 এ কথা বলেই পিয়ানোর উপর থেকে ইউলারের ফর্মুলাটি হাতে তুলে নিলেন। বাখ। তারপর কালির দোয়াত থেকে একটা পালক তুলে নিয়ে সেটার উপরে কিছু শব্দ লিখে দিলেন : কোয়ারেন্দো ইনভেনিতিস। খোঁজো, তাহলেই তুমি পাবে। এবার নাইট টুরটা তুলে দিলেন আমার হাতে।

“আমি বুঝতে পারছি না,” কিছু বুঝতে না পেরে বললাম।

“হের ফিলিদোর,” বললেন বাখ, “আপনি ড. ইউলারের মতো একজন দাবা মাস্টার এবং আমার মতো একজন সঙ্গিতকার। একজন ব্যক্তির মধ্যে এরকম দুটো অতি মূল্যবান দক্ষতা রয়েছে।”

“মূল্যবান কোন দিক থেকে?” ভদ্রভাবেই জানতে চাইলাম। “আমার বলতে কোনো কার্পন্য নেই, এ সবের মধ্যে আমি আর্থিক কোনো মূল্যই খুঁজে পাই নি!” হেসে ফেললাম আমি।

“টাকার চেয়েও যে শক্তিশালী ক্ষমতাবান কিছু জিনিস এই মহাবিশ্বে কাজ করছে এই সত্যটা খুব কম সময়ই মানুষ বুঝতে পারে,” মুচকি হেসে বললেন বৃদ্ধ সঙ্গিতকার। “উদাহরণ দিয়েই বলি-আপনি কি কখনও মন্তগ্লেইন সার্ভিসের নাম শুনেছেন?”

ইউলার আৎকে উঠলে আমি চমকে তার দিকে তাকালাম।

“বুঝতেই পারছেন,” বললেন বাখ, “আমাদের বন্ধু হের ডক্টরের কাছে নামটা মোটেই অচেনা নয়। সম্ভবত এ বিষয়ে আমিও আপনাকে কিছুটা আলোকপাত করতে পারবো।”

আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বাখের অদ্ভুত গল্পটা শুনে গেলাম। এই দাবাবোর্ডটি এক সময় শার্লেমেইনের কাছে ছিলো, জনশ্রুতি আছে ওটার মধ্যে নাকি অসাধারণ এক ক্ষমতা রয়েছে। সঙ্গিতকার তার কথা শেষ করে আমাকে বললেন :

“আমি আপনাদের দু’জনকে আজ এখানে আসতে বলেছি একটা এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য। সারা জীবন ধরে আমি সঙ্গিতের চমকপ্রদ ক্ষমতা নিয়ে স্টাডি করে গেছি। এর যে নিজস্ব একটা ক্ষমতা রয়েছে সেটা খুব কম লোকেই অস্বীকার করতে পারে। একটা জংলী পশুকে শান্ত করে তুলতে পারে এটা, আবার শান্তশিষ্ট কোনো মানুষকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য রক্ত গরম করে দিতেও পারে। আমি আমার নিজের এক্সপেরিমেন্টের মধ্য দিয়ে সঙ্গিতের এই ক্ষমতার সিক্রেটটা জানার চেষ্টা করেছি। সঙ্গিতের নিজস্ব যুক্তি আছে। এটা অনেকটা গণিতের মতোই তবে কিছু দিক থেকে একটু ভিন্নতা রয়েছে। সঙ্গিত আমাদের মস্তিষ্কের সাথে সরাসরি কমিউনিকেট করে না, তবে এটা দুর্বোধ্য এক পদ্ধতিতে আমাদের চিন্তাভাবনাকে বদলে দেয়।”

“আপনি এ দিয়ে কি বোঝাতে চাচ্ছেন?” জানতে চাইলাম আমি। তবে আমি ভালো করেই জানতাম বাখ আমার ভেতরে একটা কর্ডে টোকা মেরে দিয়েছেন যা কোনোভাবেই বলে বোঝাতে পারছিলাম না। আমার কাছে মনে হলো অনেক বছর ধরেই আমি এটা জানি। আমার ভেতরে সুপ্ত থাকা কিচ সাদা চমৎকার এক সঙ্গিতের মূৰ্ছনায় জেগে উঠছে। অথবা আমি দাবা খেলছি।

“আমি বলতে চাচ্ছি,” বললেন বাখ, “এই মহাবিশ্ব অনেকটা দল গাণিতিক খেলার মতো, যা সীমাহীন বিশালত্বের একটি স্কেলের উপর চলেছে। সঙ্গিত হলো সবচাইতে বিশুদ্ধ গণিতের একটি রূপ। প্রতিটি ফর্মূলাকে সঙ্গিতে রুপান্তর করা যেতে পারে, ঠিক যেমনটি আমি করেছি ড. ইউলারের ফর্মূলাটি নিয়ে।

 ইউলারের দিকে বাখ তাকাতেই তিনি মাথা নেড়ে সায় দিলেন। যেনো তারা। দু’জন এমন একটি সিক্রেট জানেন যেটা এখনও কেউ জানে না।

“আর সঙ্গিতকেও,” বাখ বলতে লাগলেন, “গণিতে রূপান্তর করা যায়, আর সেটার ফল খুব বিস্ময়কর হয়ে থাকে। এই মহাবিশ্বের স্থপতি এভাবেই এটার ডিজাইন করেছেন। মহাবিশ্ব সৃষ্টি এবং সভ্যতা ধ্বংস করার ক্ষমতা রয়েছে। সঙ্গিতের। আমার কথা বিশ্বাস না হলে বাইবেল পড়ে দেখতে পারেন।”

ইউলার চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। “হ্যাঁ,” অবশেষে তিনি বললেন, “বাইবেলে আরো কিছু স্থপতি আছে যাদের গল্পগুলো বেশ চমকপ্রদ, তাই না?”

“বন্ধু, মুচকি হেসে আমার দিকে ফিরে বললেন বাখ, “আমি যেমনটি বলেছি, খুঁজুন, তাহলেই পেয়ে যাবেন। যে সঙ্গিতের স্থাপত্য বুঝতে পারবে সে মন্তগ্লেইন সার্ভিসের ক্ষমতাও বুঝতে পারবে। যেহেতু এ দুটো জিনিস একই।”

.

ডেভিড তার নিজের বাড়ির লোহার দরজার সামনে এসে ফিলিদোরের দিকে তাকালেন।

“কিন্তু এসবের মানে কি?” জানতে চাইলেন। “সঙ্গিত আর গণিতের সাথে মন্তগ্লেইন সার্ভিসের কি সম্পর্ক? আর এসব কিছুর সাথে স্বর্গ-মর্ত্যের ক্ষমতারই বা কি সম্পর্ক আছে বুঝতে পারছি না? আপনার কাছে যে গল্পটা শুনলাম সেটা আমার আগের ধারণাটাকেই আরো পোক্ত করলো। কিংবদন্তীর মন্তগ্লেইন সার্ভিসটা আধ্যাত্মবাদ আর বোকাদেরই শুধু আকর্ষণ করে। এরকম আজগুবি জিনিসের ব্যাপারে ড. ইউলারের মতো লোকজন জড়িত জানতে পেরে আমার কাছে মনে হচ্ছে তিনি বোধহয় খুব সহজেই ফ্যান্টাসির শিকার হতেন।”

ডেভিডের গেটের কাছে বিশাল একটি গাছের নীচে থামলেন ফিলিদোর। “এই বিষয়টা নিয়ে আমি অনেক বছর ধরেই গবেষণা করে গেছি,” চাপা কণ্ঠে বললেন দাবাড়ু এবং সঙ্গিতকার। “অবশেষে ইউলার এবং বাধের কথামতো বাইবেলও স্টাডি করেছি আমি, যদিও এরকম কোনো ধর্মপুস্তকের ব্যাপারে আমার কোনো আগ্রহ ছিলো না। আমাদের সাক্ষাতের কিছুদিন পরই বাখ মারা যান আর ইউলার চলে যান রাশিয়াতে। তিনি ওখানকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। ফলে এই দু’জন মানুষের সাথে আমার আর সাক্ষাত করার সুযোগ ঘটে নি। তাদের সাথে আমি আলোচনা করতে পারি নি বাইবেল পড়ে কি খুঁজে পেয়েছিলাম।”

“আপনি কি খুঁজে পেয়েছিলেন?” গেটের তালায় চাবি ঢোকাতে ঢোকাতে বললেন ডেভিড।

“তারা আমাকে স্থপতির ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, আমি তাই খুঁজেছিলাম। বাইবেলে দু’জন স্থপতির কথা উল্লেখ আছে। একজন হলেন এই মহাবিশ্বের স্থপতি ঈশ্বর আর অন্যজন বাবেল টাওয়ারের স্থপতি। ‘বাব-এল’ শব্দটির মানে জনতে গিয়ে আমি দেখলাম এর অর্থ ঈশ্বরের দরজা। ব্যাবিলনিয়ানরা খুব গর্বিত জাতি ছিলো। সভ্যতার সূচনালগ্নে তারাই ছিলো সবচাইতে মহান সভ্যতার প্রতিষ্ঠাতা। প্রকৃতির সাথে পাল্লা দিয়ে তারা উদ্যান বানিয়েছিলো। তারা এমন একটি টাওয়ার বানাতে চেয়েছিলো যা স্বর্গ ছুঁয়ে ফেলতে সক্ষম হবে। এমন একটি টাওয়ার যা পৌঁছে যাবে সূর্যের কাছে। আমি নিশ্চিত, বাইবেলের এই গল্পটাই বাখ এবং ইউলারকে আকর্ষণ করেছিলো।

“এর স্থপতি ছিলেন,” তারা দুজন গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে ফিলিদোর বলতে লাগলেন, “নিমরদ, যাকে কোরানে নমরুদ নামে অভিহিত করা হয়েছে, নিজের সময়ে একজন মহান স্থপতি ছিলেন। তিনি এমন একটি উঁচু টাওয়ার বানিয়েছিলেন যা ঐ সময়কার মানুষের কাছে অকল্পনীয় একটি ব্যাপার ছিলো। তবে সেটা সমাপ্ত করা যায় নি। আপনি কি জানেন কেন?”

“যতোদূর মনে পড়ে ঈশ্বর গজব নাজেল করেছিলেন,” বাড়ির ভেতরে প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে ডেভিড বললেন।

“তিনি কিভাবে এই গজবটা নাজেল করেছিলেন?” জানতে চাইলেন ফিলিদোর।

“তিনি বজ্রপাতের সাহায্যে কিংবা প্লাবন সৃষ্টি করে তা করেন নি, যেমনটি তিনি সব সময় করে থাকেন! আমি বলছি কিভাবে তিনি নিমরদের কাজটা ধ্বংস করেছিলেন। নির্মাণ শ্রমিকদের ভাষা এলোমেলো করে দিয়েছিলেন ঈশ্বর। শ্রমিকেরা সবাই একটা ভাষায়ই কথা বলতো। তিনি সেই ভাষার উপর আঘাত হানেন। শব্দ ধ্বংস করে ফেলেন!”

ঠিক এমন সময় ডেভিড দেখতে পেলেন তার বাড়ির এক চাকর তার দিকে ছুটে আসছে। “ঈশ্বর তাহলে এভাবেই একটা সভ্যতাকে ধ্বংস করে ফেললেন? মানুষের মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে? কিংবা ভাষার মধ্যে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে? যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে আমাদের ফরাসিদের এ নিয়ে কোনোদিনও চিন্তা করার কিছু থাকবে না। আমরা আমাদের ভাষার খুবই অনুরক্ত, এটাকে আমরা স্বর্ণের মতো মূল্যবান মনে করি!”

“সম্ভবত আপনার অধীনে থাকা ঐ দুই তরুণী এই রহস্যটার সমাধানে সাহায্য করতে সক্ষম হবে, যদি তারা সত্যিই মন্তগ্লেইনে থেকে থাকে তো,” জবাবে বললেন ফিলিদোর। আমি বিশ্বাস করি এটা একটা শক্তি। ভাষার যে সঙ্গিত তার শক্তি-সঙ্গিতের গণিত। ঈশ্বর যে শব্দের সাহায্যে এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন, ব্যাবিলন সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়েছিলেন এটা তারই সিক্রেট-আমি বিশ্বাস করি এই সিক্রেটটা রাখা আছে মন্তগ্লেইন সার্ভিসের ভেতরে।”

ডেভিডের চাকর তার সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো।

“পিয়েরে, কি হয়েছে?” অবাক হয়ে ডেভিড জানতে চাইলেন।

“ঐ দুই তরুণী, ভয়ার্ত চোখেমুখে বললো পিয়েরে নামের কাজের লোকটা। “তারা উধাও হয়ে গেছে, মঁসিয়ে।”

“কি?!” চিৎকার করে উঠলেন ডেভিড। “তুমি এসব কি বলছো?”

“সেই বেলা দুটোর পর থেকে তারা বাড়িতে নেই, মঁসিয়ে। সকালে তারা। একটা চিঠি পায়। বাগানে গিয়ে সেই চিঠিটা পড়ে দু’জনে। লাঞ্চের সময় তাদের খোঁজ করতে গেলে দেখি তারা নেই। আমার মনে হচ্ছে বাগানের দেয়াল টপকে চলে গেছে-এছাড়া আর কোনোভাবে যাওয়া সম্ভব নয়। এখনও তারা ফিরে আসে নি।”

বিকেল ৪টা

এমন কি লাবায়ে জেলখানার বাইরে লোকজনের উলু ধ্বণি এর ভেতর থেকে উৎসারিত কানফাটা চিৎকারকে ছাপিয়ে যেতে পারলো না। মিরিয়ে কখনই এই আওয়াজটার স্মৃতি মুছে ফেলতে পারবে না।

দরজায় আঘাত করতে থাকা লোকগুলো এখন ক্লান্ত হয়ে বন্দীদের নিয়ে আসা ঘোড়াগাড়িগুলোর ছাদে উঠে বসেছে। গাড়িগুলো নিহত যাজকদের রক্তে স্নাত। জেলখানার সামনের সরু গলিটায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ছিন্নভিন্ন মানব অঙ্গ।

প্রায় এক ঘণ্টা আগে ভেতরের বিচার কাজ শুরু হয়েছে, এখনও সেটা চলছে। কিছু শক্তিশালী লোক জেলখানার দেয়ালের উপর উঠে হাতের বলুম ছুঁড়ে মারছে ভেতরের প্রাঙ্গনে।

 এক লোক অন্য আরেক লোকের কাঁধে উঠে চিৎকার করে বললো, “নাগরিকগণ, দরজা খুলে দাও! আজকে ন্যায়বিচার করতে হবে!”

 একটা বিশাল কাঠের দরজা খুলে যেতেই লোকজন উৎফুল্ল হয়ে আনন্দ প্রকাশ করতে লাগলো। সেই ভোলা দরজা দিয়ে হুরমুর করে প্রবেশ করতে শুরু করলো তারা।

কিন্তু একদল সৈন্য জনস্রোতকে আটকে দিলো সাহসের সাথে। ঠেলেঠুলে তাদেরকে দরজার বাইরে বের করে আবার বন্ধ করে দিলো সেটা। মিরিয়ে এবং অন্যেরা ভেতরে যে তামাশার বিচার চলছে সেটা শোনার জন্যে দেয়ালের উপরে বসে থাকা লোকগুলোর জন্যে অপেক্ষা করলো।

জেলখানার গেটে আবারো আঘাত করলো মিরিয়ে, কিন্তু সবটাই বৃথা। ক্লান্ত হয়ে সে গেটের পাশেই বসে রইলো এ আশায় যে আবারো কয়েক মুহূর্তের জন্য গেটটা খোলা হলে সবার অলক্ষ্যে ঢুকে পড়তে পারবে।

অবশেষে তার আশা পূর্ণ হলো। বিকেল চারটার দিকে মিরিয়ে দেখতে পেলো গলির দিক থেকে একটা ছাদ খোলা ঘোড়াগাড়ি ছুটে আসছে, পথের উপর পড়ে থাকা ছিন্নভিন্ন মৃতদেহগুলো সাবধানে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে আসছে ঘোড়াগুলো। গাড়ির পেছনে বসে থাকা লোকটাকে দেখে বন্দীদের ঘোড়াগাড়িগুলোর ছাদে বসে থাকা কিছু মহিলা উল্লাস করতে শুরু করল উপস্থিত করলো। লোকজনও গাড়িটার দিকে ছুটে যেতে শুরু করলো উল্লাস করতে করতে। বিস্ময়ে উঠে দাঁড়ালো মিরিয়ে। এটা তো ডেভিড!

 “আঙ্কেল, আঙ্কেল!” চিৎকার করতে করতে ছুটে গেলো সে গাড়িটার দিকে, তার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়ছে। তাকে দেখতে পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে গা থামাতে বলে ছুটে এলেন ডেভিড। লোকজনের ভীড় ঠেলে জড়িয়ে ধরলেন তাকে।

“মিরিয়ে!” লোকজন তার পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে, স্বাগত জানাচ্ছে, সেগুলোর দিকে তার কোনো মনোযোগ নেই। “কি হয়েছে? ভ্যালেন্টাইন কোথায়?” তার চোখেমুখে তীব্র আতঙ্ক।

“ও জেলখানার ভেতরে আছে,” কেঁদে কেঁদে বললো মিরিয়ে। “আমরা এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে এসেছিলাম…আমি জানি না কী ঘটে গেছে, আঙ্কেল। হয়তো দেরি হয়ে গেছে।”

“আসো আসো,” মিরিয়েকে জড়িয়ে ধরে লোকজনের ভীর ঠেলে ডেভিড চলে এলেন জেলখানার গেটের কাছে। তাকে অনেকেই চিনতে পেরে পথ করে দিলো দ্রুত।

“গেট খোলো!” দেয়ালের উপরে থাকা কিছু লোক চিৎকার করে ভেতরের লোকগুলোকে বললো। “নাগরিক ডেভিড এখানে এসেছে! চিত্রশিল্পী ডেভিড!”

 কিছুক্ষণ পরই একটা বিশাল গেট খুলে গেলে ডেভিডকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে আবারো বন্ধ করে ফেলা হলো সাথে সাথে।

জেলখানার প্রাঙ্গনটি রক্তে রঞ্জিত। এক সময় যেটা মোনাস্টেরির বাগান ছিলো সেখানে এক যাজক বসে আছে, তার মাথাটা কাঠের একটি ব্লকে আঁটকে রাখা হয়েছে পেছন দিক থেকে। রক্তে লাল হওয়া ইউনিফর্ম পরা এক সৈনিক তলোয়াড় হাতে যাজকের ঘাড়ে কোপ বসালেও সেটা বিচ্ছিন্ন করতে পারলো না, ফলে গলগল করে রক্ত বের হতে লাগলো যাজকের অর্ধকর্তিত ঘাড় থেকে। সৈনিক বার কয়েক কোপ বসালো, তাতেও মৃত্যু হলো না যাজকের, ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে লোকটার ক্ষতস্থান থেকে। তার মুখ হা হয়ে থাকলেও কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না।

পুরো প্রাঙ্গণ জুড়ে লোকজন ছুটে বেড়াচ্ছে, টপকে যাচ্ছে পড়ে থাকা বীভৎস লাশ। ঠিক কতোজনকে কচুকাটা করা হয়েছে সেটা বোঝা প্রায় অসম্ভব। সুন্দর করে ছাটা ঘসের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মানুষের হাত-পা, ধর আর মুণ্ডু।

এসব দেখে মিৱিয়ে চিৎকার দিতে উদ্যত হলো। তাকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে আশ্বস্ত করলেন ডেভিড। নিজেকে শান্ত রাখো তা না হলে

আমরা ওকে খুঁজে বের করতে পারবো না।”

চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন ডেভিড। তার সামনে এক সৈনিক দাঁড়িয়ে আছে, পোশাকে রক্ত লেগে রয়েছে তার। মুখটাও রক্তাক্ত, তবে সে নিজে আহত হয় নি, এই রক্ত নিহতদের।

“এখানকার দায়িত্বে আছে কে?” বললেন ডেভিড। সৈনিক হেসে ফেললো, তারপর জেলখানার প্রবেশপথের সামনে বিশাল একটি কাঠের টেবিলে বসে থাকা কয়েকজন লোকের দিকে ইঙ্গিত করলো সে। লোকগুলোর সামনে ছোটোখাটো একটা ভীড় তৈরি হয়েছে।

মিরিয়ে আর ডেভিড টেবিলের দিকে এগোতেই দেখতে পেলো তিনজন যাজককে টেনে হিঁচড়ে সেই টেবিলের সামনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তারপর বেয়নেট দিয়ে তো মেরে তাদেরকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে বাধ্য করলো কিছু সৈনিক।

 টেবিলে বসে থাকা পাঁচজন লোক একে একে যাজকদের সাথে কথা বললো। তাদের মধ্যে একজন হাতের সামনে থাকা একটি কাগজে দ্রুত কিছু। লিখে মাথা ঝাঁকালো কেবল।

যাজকদের টেবিলের সামনে থেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হলো প্রাঙ্গনের মাঝখানে, চারদিক থেকে লোকজন হর্ষধ্বণি প্রকাশ করতে লাগলো আসন্ন মুণ্ডুপাত দেখার জন্য। যাজকদের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। তাদের চোখেমুখে মৃত্যুভয়। ভালো করেই জানে কি ঘটতে যাচ্ছে। মিরিয়েকে নিয়ে দ্রুত সেই টেবিলের সামনে চলে এলেন ডেভিড। কিন্তু বিচারকদের সামনে এখন উফুলু লোকজন জড়ো হয়ে আছে, ফলে তাদের কারণে সামনে এগোতে পারলেন না। তিনি।

দেয়ালের উপরে থাকা এক লোক বাইরের দাঙ্গাবাজদের উদ্দেশ্যে বিচারের রায় চিৎকার করে বলতেই ডেভিড টেবিলের সামনে চলে আসতে পারলেন।

“সান সালপিচের ফাদার অ্যাম্বুয়ের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হচ্ছে!” তার কথাটা মিইয়ে গেলো লোকজনের আনন্দধ্বণির মধ্যে।

 “আমি জ্যাক-লুই ডেভিড,” টেবিলের সামনে এসে একজন বিচারকের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বললেন তিনি। “আমি বিপ্লবী ট্রাইবুনালের একজন সদস্য। দাঁতোয়াঁ আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন-”

“আমরা আপনাকে ভালো করেই চিনি, জ্যাক-লুই ডেভিড,” টেবিলে বসা। অন্য এক লোক বললো। লোকটার দিকে ফিরে তাকাতেই আৎকে উঠলেন ডেভিড।

মিরিয়ে টেবিলে বসা বিচারকের দিকে তাকাতেই তার রক্ত হিম হয়ে গেলো। এ রকম মুখ কেবলমাত্র দুঃস্বপ্নেই দেখেছে সে। অ্যাবিসের সতর্কতার কথা মনে করলে এরকম একটি মুখ তার সামনে ভেসে ওঠে। আস্ত শয়তানের একটি মুখ।

 লোকটার মুখ একেবারেই ভীতিকর। তার শরীরে অসংখ্য কাটা দাগ। মাথায় একটি নোংরা কাপড়ের পট্টি বাধা, সেটা থেকে কালচে তরল ঝরে পড়ছে কপাল বেয়ে। তার চুলগুলো তৈলাক্ত। লোকটাকে দেখে শয়তানের পূর্ণজন্ম হওয়া কোনো পাপাত্মা বলেই মনে হলো মিরিয়ের কাছে।

“আহ, তুমি,” চাপা কণ্ঠে বললেন ডেভিড। “আমি ভেবেছিলাম তুমি…”

“অসুস্থ?” জবাবে বললো লোকটা। “এতোটা অসুস্থ নই যে আমার দেশের সেবা করতে পারবো না।”

মিরিয়ের কানে কানে ফিসফিস করে বললেন ডেভিড, “তুমি কিচ্ছু বোলো না। আমরা ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে আছি।”

টেবিলে বসা বিচারকের দিকে ঝুঁকে কথা বললেন ডেভিড।

“আমি দাঁতোয়াঁর ইচ্ছেয় এখানে এসেছি, এই ট্রাইবুনালে সাহায্য করার জন্য,” বললেন তিনি।

“আমাদের কোনো সাহায্য লাগবে না, নাগরিক, ঝাঁঝের সাথে বললো লোকটা। “শুধুমাত্র এখানেই বিচার হবে না। প্রতিটি জেলখানায়ই রাষ্ট্রের শত্রুদের ভরে রাখা হয়েছে। এখান থেকে কাজ শেষ করে আমরা পরেরটায় যাবো। বিচারের কাজে কোনো স্বেচ্ছাসেবকের দরকার নেই আমাদের। দাঁতোয়াঁকে গিয়ে বলবেন আমরা এখানে আছি। ভালো লোকজনের হাতেই বিচার হচ্ছে।”

“বেশ,” লোকটার পিঠ চাপড়িয়ে বললেন ডেভিড, ঠিক এই সময় আরেকটা মরণচিৎকার শোনা গেলো। “আমি জানি তুমি একজন সম্মানিত নাগরিক এবং অ্যাসেম্বলির সদস্য। কিন্তু একটা সমস্যা হয়ে গেছে। আমি নিশ্চিত তুমি আমাকে সাহায্য করতে পারবে।”

মিরিয়ের হাতটা শক্ত করে ধরলেন ডেভিড। মেয়েটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।

“আমার ভাতিজি আজ দুপুরের দিকে এই জেলখানার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো, দুর্ঘটনাবশত তাকে ভুল করে এখানে ধরে আনা হয়েছে। আমার বিশ্বাস…মানে আশা করছি তার কিছু হয় নি, কারণ মেয়েটা একেবারে সহজ সরল, রাজনীতির সাথে তার কোনো সম্পর্কই নেই। জেলখানার ভেতরে তাকে খুঁজে দেখো।”

“আপনার ভাতিজি?” ডেভিডের দিকে ঝুঁকে বললো জঘন্য লোকটা। “তাকে আর কষ্ট করে খোঁজার দরকার নেই। এখনই তাকে ট্রাইবুনালের সামনে নিয়ে আসা হবে। আমরা জানি কারা আপনার তত্ত্বাবধানে ছিলো। এই মেয়েটাও তার মধ্যে আছে।” মিরিয়ের দিকে না তাকিয়েই মাথা নেড়ে বললো লোকটা। তারা অভিজাত পরিবারের সন্তান, দ্য রেমি বংশের মেয়ে। মন্তগ্লেইন অ্যাবি থেকে তারা এসেছে। জেলখানার ভেতরে আপনার ভাতিজিকে আমরা এরইমধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি।”

“না!” ডেভিডের হাত থেকে ছুটে চিৎকার করে বললো মিরিয়ে। “ভ্যালেন্টাইন! আপনারা তার কি করেছেন?” টেবিলে বসা শয়তানটাকে শক্ত করে ধারে বললো সে। ডেভিড টেনে সরিয়ে দিলেন তাকে।

“বোশমি কোরো না,” দাঁতে দাঁত পিষে বললেন তিনি। মিরিয়ে আবারো তার হাত থেকে ছুটে গেলে জঘন্য বিচারকটি হাত তুললো। টেবিলের পেছনে জেলখানার সিঁড়ি থেকে ধাক্কা মেরে দু’জনকে ফেলে দেয়া হলে একটা হৈচৈ শুরু হয়ে গেলো। মিরিয়ে দৌড়ে গেলো সিঁড়ির দিকে। ভ্যালেন্টাইন আর তরুণ এক যাজক পড়ে আছে সেখানে। যাজক নিজের পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে ভ্যালেন্টাইনকেও উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলো। মিরিয়ে ছুটে এসে জাপটে ধরলো তার বোনকে।

“ভ্যালেন্টাইন, ভ্যালেন্টাইন,” চিৎকার করে বললো সে। ভ্যালেন্টাইনের ক্ষতবিক্ষত মুখ। ঠোঁট কাটা।

“ঐ খুঁটিগুলো,” ফিসফিস করে বললো ভ্যালেন্টাইন, প্রাঙ্গনের দিকে উদভ্রান্তের মতো তাকালো সে। “ক্লদ আমাকে বলেছেন খুঁটিগুলো কোথায়। আছে। মোট ছয়টি…”

“ওগুলো নিয়ে তুমি চিন্তা কোরো না,” বোনকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বললো মিরিয়ে। “আমাদের আঙ্কেল এখানে এসেছেন। আমরা তোমাকে মুক্ত করে নিয়ে। যাবো…”

“না!” চিৎকার করে বললো ভ্যালেন্টাইন। “তারা আমাকে হত্যা করবে, বোন। তারা ওগুলোর কথা জেনে গেছে…তোমার কি ঐ ভুতটার কথা মনে আছে! দ্য রেমি, দ্য রেমি,” বিড়বিড় করে বললো সে। উদভ্রান্তের মতো নিজের পারিবারিক পদবীটা আওড়াতে লাগলো। তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলো মিরিয়ে।

ঠিক তখনই একজন সৈনিক এসে মিরিয়েকে ধরে ফেললো। ডেভিডের দিকে বিস্ময়ে তাকালো সে। তিনি টেবিলে বসা বিচারকের দিকে ঝুঁকে প্রাণপণ বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। দু’জন লোক এসে ভ্যালেন্টাইনকে ধরলে মিরিয়ে সৈনিকের হাতে কামড় বসিয়ে দিলো। ট্রাইবুনালের সামনে দাঁড় করানো হলো ভ্যালেন্টাইনকে। দু’পাশে দু’জন সৈনিক তাকে ধরে রেখেছে। চকিতে মিরিয়ের দিকে তাকালো সে, তার মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে আছে। তারপরই হাসলো সে, তার সেই হাসি যেনো কালো মেঘের আড়ালে এক টুকরো রোদের উন্মেষ। কিছুক্ষণের জন্য শান্ত হয়ে উঠলো মিরিয়ে, বোনের হাসির জবাবে সেও হেসে ফেললো। এরপরই টেবিলের পেছন থেকে কিছু লোকের কণ্ঠ শুনতে পেলো সে। সেটা যেনো তার মনে চাবুকের মতো শপাং করে আঘাত করলো, প্রাঙ্গনের দেয়ালে প্রতিধ্বণিত হলো সেই কথাটা।

“মৃত্যু!”

সৈনিকের হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো মিরিয়ে। টেবিলের সামনে ক্রন্দনরত ডেভিডের উদ্দেশ্যে কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বললো সে। ভ্যালেন্টাইনকে ঘাসের যে লনটা আছে সেখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যে সৈনিক শক্ত করে তাকে ধরে রেখেছে তার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার আপ্রাণ চেষ্টা করলো মিরিয়ে। ঠিক তখনই, হঠাৎ করে পাশ থেকে তাকে কিছু একটা আঘাত করলে সৈনিকসহ সে মাটিতে পড়ে গেলো। ভ্যালেন্টাইনের সাথে যে তরুণ যাজক লোকটি সিঁড়িতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলো সেই লোকটা ধাক্কা মেরেছে সৈনিকটিকে। যাজক আর সৈনিকের সাথে ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেলে মিরিয়ে ছুটে গেলো টেবিলের কাছে। বিচারকের নোংরা শার্ট খামচে ধরে চিৎকার করে বললো সে :

“থামতে বলুন!”

পেছন ফিরে দেখতে পেলো মোটাসোটা দু’জন লোক ভ্যালেন্টাইনকে ঘাসের উপর ফেলে কুড়াল দিয়ে শিরোচ্ছেদ করতে উদ্যত। আর এক মুহূর্তও দেরি করা যাবে না। “তাকে মুক্ত করুন!” চিৎকার করে বললো সে।

“অবশ্যই করবো,” বললো বিচারক, “তবে তোমার বোন যে কথাটা বলে নি সেটা যদি তুমি আমাকে বলো। এবার বলো মন্তগ্লেইন সার্ভিসটা কোথায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে। তোমার বোন গ্রেফতার হবার আগে কার সাথে দেখা করে কথা বলেছে সেটা কিন্তু আমি জানি, বুঝলে…”।

“আমি যদি বলি,” ঝটপট বললো মিরিয়ে, আবারো পেছন ফিরে ভ্যালেন্টাইনের দিকে তাকালো সে, “তাহলে কি আমার বোনকে ছেড়ে দেবেন?”

“ওগুলো আমাকে পেতেই হবে!” রেগেমেগে বললো বিচারক। কঠিন-শীতল চোখে তাকালো তার দিকে। এই চোখ উন্মাদের, ভাবলো মিরিয়ে। দৃঢ়ভাবে লোকটার দিকে তাকালো সে।

“তাকে যদি ছেড়ে দেন তাহলে আমি বলবো কোথায় আছে ওগুলো।”

“বলো!” চিৎকার করে বললো বিচারক।

লোকটার মুখ থেকে বাজে গন্ধ টের পেলো মিরিয়ে, তারপরও তার দিকে ঝুঁকে এলো সে। তার পাশে থাকা ডেভিড আর্তনাদ করে উঠলেও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলো না মেয়েটি। গভীর করে দম নিয়ে ভ্যালেন্টাইনকে রক্ষা করার জন্য শান্ত কণ্ঠে বললো, “আমার আঙ্কেলের স্টুডিওর পেছনে বাগানের মাটির নীচে লুকিয়ে রাখা হয়েছে ওগুলো।”

“আহা!” চিৎকার করে বললো লোকটা। অনেকটা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। তার দু’চোখে পৈশাচিকতা। “তুমি আমার সাথে মিথ্যে বলার আম্পধা দেখাবে না। যদি মিথ্যে বলো তাহলে আমি তোমাকে পৃথিবীর শেষ প্রান্তে গিয়েও খুঁজে বের করবো। ওগুলো আমার চাই-ই চাই!”

“মঁসিয়ে, আমি কসম খেয়ে বলছি,” কেঁদে কেঁদে বললো মিরিয়ে। যা বলেছি সত্যি বলেছি।”

“তাহলে তোমাকে আমি বিশ্বাস করলাম,” বিচারক তাকে বললো। হাত তুলে ভ্যালেন্টাইনের দুই জল্লাদকে থামতে নির্দেশ দিলো সে। বিচারকের জঘন্য মুখটার দিকে তাকালো মিরিয়ে। এই মুখটা সে কখনও ভুলবে না। যতো দিন বেঁচে থাকবে এই নরপিশাচটার কথা তার মনে থাকবে।

“আপনি কে?” লোকটাকে বললো মিরিয়ে।

“আমি জনগণের সুতীব্র ক্রোধ,” ফিসফিসিয়ে বলো সে। “অভিজাতরা পতিত হবে, যাজকেরা নিপাত যাবে, নিপাত যাবে বুর্জোয়ারা। তারা আমাদের পায়ের নীচে লুটিয়ে পড়বে। তোমাদের সবার মুখের উপর আমি থুতু ফেলবো। তোমাদের জন্যে যে দুর্ভোগ আমরা ভোগ করেছি সেটা তোমাদেরও এখন পোহাতে হবে। তোমাদের স্বর্গ তোমাদের সামনে লুটিয়ে পড়বে। আমি ঐ মন্তগ্লেইন সার্ভিসটা চাই! সেটা আমার হবে! শুধু আমার! তুমি যেখানকার কথা বললে সেখানে যদি ওটা না পাই তাহলে তোমাকে আমি ঠিকই পাকড়াও করবো-এরজন্যে তোমাকে পরিণাম ভোগ করতে হবে!”

 তার বিষাক্ত কণ্ঠটা মিরিয়ের কানে বাজতে লাগলো।

“মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করো!” চিৎকার করে বললো সে, সঙ্গে সঙ্গে লোকজন উল্লাস প্রকাশ করতে শুরু করলো প্রাঙ্গনের ভেতরে। “তার শাস্তি হলো মৃত্যু!”।

 “না!” চিৎকার করে বললো মিরিয়ে। একজন সৈনিক তাকে ধরে রাখলেও সে তার হাত থেকে ছুটে গেলো। পাগলের মতো ছুটে গেলো ঘাসের লনের দিকে। দৌড়ানোর সময়ই সে দেখতে পেলো দুই জল্লাদের ধারালো কুড়াল ভ্যালেন্টাইনের মাথার উপরে শূন্যে উঠে গেছে।

অসংখ্য মৃতদেহ টপকে ছুটে গেলো মিরিয়ে। কুড়াল দুটো নীচে নেমে আসতেই এক লাফে ঝাঁপিয়ে পড়লো ভ্যালেন্টাইনের উপর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *