২০. প্রেমের প্রতি বিশ্বস্ত

বিংশ অধ্যায় – প্রেমের প্রতি বিশ্বস্ত

কাউন্টেসের সাথে দেখা করে বেরোনোর পর, সত্যিকার অর্থে যাওয়ার কোন জায়গা খুঁজে পেল না থিবল্ট। ঘর পুড়ে গেছে, কোন বন্ধুও নেই। কেইনের মতো পৃথিবীর বুকে সে-ও এখন উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়াবে। শেষ আশ্রয় হিসেবে তাই বনের দিকেই ফিরে গেল। দিনের শেষভাগে বনের কাছে নিঃসঙ্গ একটা বাড়ি চোখে পড়ল থিবল্টের। অর্থের বিনিময়ে একটা রুটি খেতে চাইল সেখানে। বাড়ির কর্তা তখন ঘরে ছিল না। কত্রী রুটি দিলেও টাকা নিতে অস্বীকৃতি জানাল। ওর বেশভূষা মহিলাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে। যাই হোক, চলার মতো খাবার পেয়ে বনে ঢুকে পড়ল ও। রাতে বিশ্রাম নেয়ার জন্য পছন্দসই একটা জায়গা খুঁজতে লাগল। হঠাত্র ঢালের নিচে চকচকে কিছু একটা চোখে পড়ল ওর। একটা মৃতদেহের কাঁধের বেল্টে লাগানো রূপোর ব্যাজ। মৃতদেহ না বলে কংকাল বলাই ভাল। লাশটার আশপাশ দেখে মনে হয়। মাত্র গতরাতেই ওখানে ফেলা হয়েছে ওটা, কিন্তু শরীরে কোন মাংস অবশিষ্ট নেই!

নিশ্চয়ই আমার নেকড়েদের কাজ। দেখা যাচ্ছে আমার অনুমতি পেয়ে ওরা ভালই ভোজ সেরেছে!

মৃতদেহটা কার জানার কৌতূহল হলো। ব্যাজে নাম লেখা আছে। খাবার যোগ্য নয় বলে নেকড়েরা ওটা ছুঁয়েও দেখেনি।

ব্যাজটা তুলে দেখল থিবল্ট। জে. বি. লেস্টক! কোঁত দু মন-গুবের লোক।

চমৎকার! হেসে উঠল ও, অবশেষে একজন পাওয়া গেল যে কিনা খুন করে পার পায়নি!

কিন্তু একটা কথা মনে হতেই ভুরু কুঁচকে গেল থিবল্টের। হাসি থামিয়ে নিচু গলায় নিজেকে প্রশ্ন করল ও, তাহলে কি লোকে যেমন বলে, ঈশ্বরের বিচার বলে আসলেই কিছু আছে?

লেস্টক সম্ভবত মনিবের কোন আদেশ পালন করতে মন-গুবে থেকে লোপো যাচ্ছিল। পথে নেকড়ের আক্রমণের শিকার হয় সে। যে ছুরির আঘাতে ব্যারন রাউল নিহত হয়েছে ওই একই ছুরি দিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছিল শিকারি। বলা বাহুল্য-সফল হয়নি। একটু দূরেই ছুরিটা খুঁজে পেল থিবল্ট।

থিবল্ট সবকিছুর ব্যাপারে খুব নির্লিপ্ত বোধ করে এখন। লেস্টকের মৃত্যুতে না পেল আনন্দ, না কোন দুঃখ। শুধু এটাই মনে হলো যে কাউন্টেসের কাজটা আরেকটু সহজ হয়ে গেল এতে। এখন শুধু তার স্বামীই বাকি আছে। দিনটা পার করার জন্য একটা পাথরের ছায়া খুঁজে নিল থিবল্ট। দুপুরের দিকে শুনল লর্ড ভেযের শিঙার আওয়াজ। লোকটা আবার শিকারে বেরিয়েছে। তবে থিবল্টের দিনটা নিরুপদ্রবেই কাটল।

রাত নটা বাজতে মন-গুবের দুর্গে হাজির হলো ও। একই জায়গায় অপেক্ষা করছে লিযেট। তবে আজ ওকে শঙ্কিত এবং উৎকণ্ঠিত বলে মনে হলো। আগের মতো মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে গেল থিবল্ট। কিন্তু ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল মেয়েটা।

আমাকে ছোঁবে না, নয়তো আমি চেঁচাব!

আচ্ছা! তা সুন্দরী, আগের দিন ব্যারন রাউলের সাথে তো এমন আচরণ করোনি।

হয়তো না, কিন্তু তারপর অনেক জল গড়িয়ে গেছে।

আরও জল গড়াবে, উৎসাহ ফুটল থিবল্টের কণ্ঠে।

হয়তো, শোকাভিভূত গলায় বলল মেয়েটা। তারপর সামনে এগোতে শুরু করে বলল, আসতে চাইলে আমার পেছন পেছন আসো।

আড়াল দিয়ে যাওয়ার কোন চেষ্টাই করল না মেয়েটা।

আজ তোমাকে খুব সাহসী মনে হচ্ছে। কেউ যদি আমাদের দেখে ফেলে…

ভয় নেই, দেখার মতো চোখ সবগুলোই আজ বন্ধ!

কথার অর্থ না বুঝলেও বলার সুরটা শিউরে তুলল ওকে।

ওপরে দরজা খোলার জন্য হাত রাখতে লিযেটকে থামাল থিবল্ট। বাড়িটার নিস্তব্ধতা ওর মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। মনে হচ্ছে কারও অভিশাপ পড়েছে জায়গাটার ওপরে।

কোথায় যাচ্ছি আমরা?

তুমি জানো আমরা কোথায় যাচ্ছি।

কাউন্টেসের ঘরে?

হ্যাঁ, কাউন্টেসের ঘরে।

উনি আমার জন্য অপেক্ষা করছেন?

হ্যাঁ, তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন। ভেতরে যাও। দরজা খুলে দিল লিযেট। তারপর থিবল্ট ভেতরে ঢুকলে দরজা বন্ধ করে বাইরে অপেক্ষা করতে লাগল।

ঘরটা একইরকম আছে। আগের মতোই আলোকিত, সুগন্ধি ভেসে বেড়াচ্ছে। কাউন্টেসকে খুঁজল ও। আশা করল ড্রেসিং রুমের দরজায় এসে দাঁড়াবেন, কিন্তু দরজাটা বন্ধই থাকল। ঘড়ির টিক টিক আর ওর বুকের ধুক ধুক ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। একটা অপরিচিত ভয়ের অনুভূতি ওর ভেতরে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। ভাল করে চারপাশে আরেকবার লক্ষ করতেই চমকে উঠল থিবল্ট-বিছানায় শুয়ে আছে কাউন্টেস! চুলে সেই হীরার পিন লাগানো, গলায় সেই মুক্তোর হারটাও আছে। সে রাতের একই পোশাক তার পরনে। থিবল্ট এগিয়ে গেল, কিন্তু কাউন্টেস নড়ল না।

ঝুঁকে প্রশ্ন করল থিবল্ট, ঘুমাচ্ছেন, কাউন্টেস?

উত্তর নেই! থিবল্টের ঘাড়ের চুল দাঁড়িয়ে গেল। কপালে ঘাম জমল। কাউন্টেস ঘুমাচ্ছে, কিন্তু সেই ঘুম কি এই দুনিয়ার না অনন্তকালের?

কাঁপা কাঁপা হাতে বাতিদান থেকে আলো এনে কাউন্টেসের ঘুমন্ত মুখের ওপর ধরল ও। ফ্যাকাসে মুখ, কপালে শিরার রেখা দেখা যাচ্ছে, আর ঠোঁটটা এখনও লাল। এক ফোঁটা মোম গলে পড়ল ঘুমন্ত মুখের ওপর। কিন্তু ঘুম ভাঙল না মাদামের।

আহ! কী হচ্ছে এসব! মোমবাতিটা নামিয়ে রাখল থিবল্ট। কাঁপা হাতে ওটা আর ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। কাউন্টেসের দুহাতের মুঠিতে কিছু ধরা আছে মনে হলো ওর। অনেক চেষ্টার পর খুলতে পারল মুঠি দুটো। এক হাতে রয়েছে একটা ছোট বোতল আরেক হাতে এক টুকরো কাগজ। তাতে লেখা-প্রেমের প্রতি বিশ্বস্ত! হ্যাঁ, আমৃত্যু স্থিরচিত্ত এবং বিশ্বস্ত। কারণ কাউন্টেস আর বেঁচে নেই!

থিবল্টের সমস্ত কল্পনা একে একে হারিয়ে যাচ্ছে, যেমন করে রাতের স্বপ্ন ভোরে মিলিয়ে যায়।

কপালের ঘাম মুছল থিবল্ট। দরজা খুলে করিডোরে বেরিয়ে এল। লিযেট হাঁটু গেড়ে প্রার্থনা করছে।

কাউন্টেস তাহলে মারা গেছেন?

কাউন্ট, কাউন্টেস দুজনেই।

ব্যারন রাউলের আঘাতের ফলে?

না, কাউন্টেসের ছুরির আঘাতে।

এই পরিস্থিতিতে জোর করে হাসতে গিয়ে মুখ কুঁচকে ফেলল থিবল্ট, তুমি যে গল্পের ইঙ্গিত দিচ্ছ, তা আমার কাছে নতুন।

লিযেট তখন পুরো ঘটনাটা বলল। সরল, কিন্তু হৃদয়বিদারক সে কাহিনী।

প্রায় সারাদিন নিজের ঘরেই ছিল কাউন্টেস। গ্রাম থেকে ভেসে আসছিল ঘণ্টাধ্বনি। ব্যারনের লাশ ভোপাফোতে নেয়া হচ্ছে পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করার জন্য। চারটার দিকে ঘণ্টা বন্ধ হলে কাউন্টেস জামার নিচে ড্যাগার লুকিয়ে নিয়ে স্বামীর ঘরের দিকে যায়। কাউন্টের দরজায় দাঁড়ানো পরিচারক খুব খুশি হয় তাকে দেখে। ডাক্তার বলে গেছেন, কাউন্ট এখন বিপদমুক্ত।

মাদাম নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন-এটা আনন্দের খবর।

আনন্দের খবর তো বটেই। বলে স্বামীর ঘরে ঢুকে পড়ে কাউন্টেস। পাঁচমিনিট পরে আবার বেরিয়ে আসে। কাউন্ট ঘুমোচ্ছেন। উনি না ডাকলে ভেতরে যেও না।

মাথা ঝুঁকিয়ে সায় জানায় পরিচারক। তারপর বসে কখন মনিবের ডাক আসে তার অপেক্ষা করতে লাগল।

কাউন্টেস ফিরে গেল নিজের ঘরে। পরিচারিকাকে ডেকে বলল, লিযেট, আমার পোশাক বদলে দাও। ওর সাথে শেষ দেখার সময় যে পোশাক পরে ছিলাম সেগুলো দাও।

হুবহু সেই একই পোশাক পরল কাউন্টেস। তারপর একটা কাগজে কিছু লিখে ডান হাতের মুঠোয় নিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়।

মাদাম, কিছু খাবেন না?

বাঁ হাতের মুঠি খুলে একটা ছোট একটা বোতল দেখাল কাউন্টেস।

খাব, লিযেট, এই বোতলে যা আছে সেটা।

সে কী! আর কিছু খাবেন না?

এটাই যথেষ্ট, লিযেট। এটা খাওয়ার পর আমার আর কোন কিছুর প্রয়োজন পড়বে না। বোতলটা খুলে মুখে উপুড় করে দিল সে। তারপর বলল, লিযেট, গতকাল রাস্তায় যে লোকটার সাথে দেখা হয়েছিল, সে সাড়ে নটার সময় আবার আসবে। তুমি গিয়ে তাকে এখানে নিয়ে এসো। আমি চাই না কেউ বলুক আমি কথা দিয়ে কথা রাখি না। এমনকি সেটা আমার মৃত্যুর পরে হলেও।

থিবল্টের কিছু বলার ছিল না। কাউন্টেস তার কথা রেখেছে। পার্থক্য কাউন্টেস একাই তার প্রতিশোধ নিয়ে ফেলেছে। কাউন্টের পরিচারকের একসময় অস্বস্তি লাগতে শুরু করে। আস্তে করে ঘরের ভেতর উঁকি দেয় সে। এবং দেখে বুকে ছুরি নিয়ে নিথর অবস্থায় পড়ে আছে কাউন্টের মৃত দেহ! আর্ত চিৎকার করে ওঠে সে। তারপর দৌড়ে-মাদামকে জানাতে এসে আবিষ্কার করে যে মাদামও মারা গেছে।

মালিক-মালকিনের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে দুর্গে। মৃত্যু-দেবতা হানা দিয়েছেন, এই ভয়ে চাকর-বাকর সবাই পালিয়ে যায়। শুধু পরিচারিকা লিযেট তার মালকিনের শেষ নির্দেশ পালন করতে রয়ে গেছে।

এখানে থিবল্টের আর কিছু করার নেই। লিযেটকে কাউন্টেসের কাছে রেখে প্রাসাদের বাইরে বেরিয়ে এল ও। আকাশটা অন্ধকার হয়ে আছে। জানুয়ারি মাস না হলে বলা যেত এটা ঝড়ের পূর্বাভাস। রাস্তায় আলো খুব অল্প। এক-দুবার থেমে দাঁড়াল থিবল্ট। ওর মনে হলো যেন পথের দুপাশে মাটিতে পড়ে থাকা গাছের শাখা ভাঙার শব্দ ভেসে আসছে মাঝে মাঝে।

ভাঙা দেয়ালের কাছে আসা মাত্র থিবল্ট শুনতে পেল, এই সেই লোক! তারপরই চারপাশ থেকে চারজন পুলিশ ওকে চেপে ধরল।

লিজেটের ব্যাপারে ঈর্ষান্বিত হয়ে রাতে টহল দিচ্ছিল খামোজি। তখনই এক অদ্ভুত লোককে ঢুকে আবার বেরিয়ে আসতে দেখে সে। পুলিশকে সেটা জানিয়েও আসে। সাম্প্রতিক নানান দুর্ঘটনার পর একথা শুনে চারজন পুলিশকে পাঠানো হয় সন্দেহজনক কোন লোককে দেখলে ধরে আনার জন্য। খামোজির সংকেত পাওয়া মাত্রই তারা চারজনে মিলে থিবল্টের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

নিরস্ত্র থিবল্টের প্রতিরোধ কোন কাজে আসল না। পুলিশরা ওকে চিনে ফেলেছে। মাটিতে পেড়ে বেঁধে ফেলা হলো ওকে। গত কিছুদিনের ঘটনাবলিতে থিবল্ট অনেক দুর্নাম কামিয়ে ফেলেছে। ওর আশেপাশে প্রচুর দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটেছে। অবশ্য নিজের অশুভ ক্ষমতার বলে চাইলেই পুলিশদেরকে মেরে ফেলতে পারে থিবল্ট। কিন্তু ও অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল। একটা ইচ্ছাও যদি

অবশিষ্ট থাকে, বেঁধে মাটিতে ফেলে রাখলেও, মানুষের বিচার এড়ানো ওর জন্য কোন সমস্যা না।

দড়ি দিয়ে হাত-পা বেঁধে ওকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল পুলিশেরা। জাদুকর হয়েও কেন থিবল্ট ওদের হাতে ধরা পড়ল তা নিয়ে ব্যঙ্গ করতে লাগল। হাসাহাসি আর বিদ্রূপ চলছে সমানে। থিবল্টের জবাব ছিল একটা প্রচলিত প্রবাদ, শেষ হাসিই সার্থক হাসি। জবাবে পুলিশেরা বলল ওদের ধারণা শেষ হাসিটাও ওরাই হাসবে।

পিউযো পেরিয়ে বনে প্রবেশ করল ওদের দলটা। কালো মেঘ অনেক নিচে নেমে এসেছে। মনে হচ্ছে গাছগুলো কালো চাদর মাথায় দিয়েছে। চার-পা সামনে কী আছে দেখা যায় না। তবে থিবল্ট ঠিকই দেখতে পাচ্ছে যে আশেপাশে অনেকগুলো আলোর বিন্দু ঘোরাফেরা করছে। ক্রমেই কাছে এগিয়ে আসছে সেই বিন্দুগুলো। একসময় শুকনো পাতায় ছন্দময় পদচারণার শব্দ ভেসে আসতে লাগল। পুলিশদের ঘোড়াগুলো অস্থির হয়ে বাতাসে নাক টানছে। ঘোড়াগুলোকে কাঁপতে দেখে পুলিশদের হাসি বন্ধ হয়ে গেল। এবার থিবল্টের হাসার পালা।

হাসছ কেন? জিজ্ঞেস করল একজন।

তোমাদের হাসি বন্ধ হয়ে গেছে দেখে হাসছি।

থিবল্টের কণ্ঠ শুনে আলোর বিন্দুগুলো আরও কাছে চলে এল। পায়ের শব্দ আরও পরিষ্কার শোনা যেতে লাগল। গা শিউরে ওঠার মতো কিছু শব্দ কানে এল ওদের-চোয়াল খোলা আর বন্ধ হবার শব্দ, দাঁতে দাঁত ঘষা খাবার শব্দ।

তো, বন্ধুরা, মানুষের মাংসের স্বাদ তো তোমরা পেয়েছ, এবং তোমাদের ভালও লেগেছে! আলোর বিন্দুগুলোর উদ্দেশে বলল থিবল্ট।

জবাবে আধা-কুকুর আধা-হায়নার মতো মৃদু গরগর ধ্বনি শোনা গেল।

বুঝতে পেরেছি। শিকারির স্বাদ পাওয়ার পর এবার পুলিশের স্বাদ পেতে আপত্তি নেই তোমাদের।

পুলিশেরা এরইমধ্যে ভয়ে কাঁপতে শুরু করেছে। অ্যাই! কার সাথে কথা বলছ তুমি?

যারা আমার ডাকের জবাব দিতে পারে, বলেই নেকড়ের মতো করে ডাক ছাড়ল থিবল্ট। জবাবে বিশটা বা তারও বেশি ডাক শোনা গেল। কিছু খুব কাছে, কিছু খানিকটা দূরে।

এগুলো কি শ্বাপদ? আমাদের পিছু নিয়েছে? এই অকর্মণ্যটা মনে হচ্ছে পশুগুলোর ভাষা বোঝে?

কী মনে হয়! তোমরা রাতের বেলা বনের মধ্যে দিয়ে নেকড়েদের নেতা থিবল্টকে বন্দী করে নিয়ে যাচ্ছ। আর জিজ্ঞেস করছ তোমাদের পিছু নেয়া আলো আর ডাক কীসের? চেঁচাল থিবল্ট, বন্ধুরা শুনেছ? এই ভদ্রলোকেরা জিজ্ঞেস করছে তোমরা কারা? জবাব দাও, একসাথে, যাতে ওদের মনে আর কোন সন্দেহ না থাকে।

নেকড়েরা বাধ্যগতের মতো দীর্ঘ একটা ডাক ছাড়ল। সেই ভয়াবহ শব্দ শুনে ঘোড়াগুলো চঞ্চল হয়ে উঠল। দুয়েকটা পিছিয়েও গেল। পুলিশেরা ভীত সন্ত্রস্ত প্রাণীগুলোকে শান্ত করার প্রয়াস পেল।

এটা তো কিছুই না, অপেক্ষা করো। যখন একেকটা ঘোড়ার পেছনে লাগবে দুটো করে নেকড়ে, আরও, একটা ঘোড়ার গলা কামড়ে ঝুলে থাকবে তখন দেখো।

নেকড়েরা ঘোড়ার পায়ের নিচে চলে এল। থিবল্টের গায়ে গা ঘষতে লাগল ওরা। একটা পেছনের পায়ে দাঁড়িয়ে থিবল্টের বুকে থাবা রাখল। যেন অনুমতি চাইছে।

ধীরে বস, ধীরে। অনেক সময় আছে। স্বার্থপর হয় না। সবাইকে আসতে দাও।

ঘোড়াগুলোকে আর বশে রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে।

একটা চুক্তিতে আসি চলল, থিবল্ট বলল। তোমরা আমাকে ছেড়ে দাও, তাহলে আজ রাতে নিজের বিছানায় ঘুমাতে পারবে।

আমরা যদি খুব ধীরে আগাই, তাহলে সমস্যা হবে না, বলল এক পুলিশ।

আরেকজনের বুট কামড়ে ধরল এক নেকড়ে। সে তলোয়ার বের করে জানোয়ারটার শরীরে ঢুকিয়ে দিল। যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে পড়ে গেল ওটা।

খুব বোকার মতো কাজ করলে। নেকড়েদের নিজেদের মাংস খেতে কোন আপত্তি নেই। একবার রক্তের স্বাদ পেয়ে গেলে, এমনকি আমিও ওদের ঠেকাতে পারব না।

নেকড়েরা ওদের আহত সঙ্গীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এই সুযোগে পুলিশের দল থিবল্টকে নিয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেল। থিবল্ট যা ধারণা করেছিল তা ই হলো। আহত নেকড়েটাকে খেয়ে নেকড়েগুলো ঝড়ের মতো ওদের পিছু ধাওয়া করল।

ঘোড়াগুলো দৌড়ানো শুরু করার পর আর গতি কমাতে রাজি হলো না। সওয়ারিরা যতই চেষ্টা করুক, ভয়ে পূর্ণ গতিতে ছুটছে ঘোড়া। থিবল্টের দড়ি ধরে রাখা পুলিশটাও দড়ি ছেড়ে দিয়ে দুহাতে ঘোড়া সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পুরো নেকড়ের পাল ঝাঁপিয়ে পড়েছে ঘোড়াগুলোর ওপর। নেকড়ের দাঁত শরীরে ফোঁটার সাথে সাথে ঘোড়াগুলো দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে শুরু করল।

থিবল্ট চিৎকার করে নেকড়েগুলোকে উৎসাহ দিচ্ছে। তবে তা না করলেও চলত। একেকটা ঘোড়ার পেছনে পাঁচ-সাতটা করে নেকড়ে জুটে গেছে।

দাঁড়িয়ে পড়ল থিবল্ট। ঘোড়া আর নেকড়েরা একেক দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষের আতঙ্কিত চিৎকার, ঘোড়ার যন্ত্রণাকাতর আর্তনাদ, নেকড়ের ডাক ক্রমেই ফিকে হয়ে আসছে।

থিবল্ট আরও একবার মুক্ত, এবং যথারীতি একা। তবে ওর হাত এখনও বাঁধা। দাঁত দিয়ে বাঁধন কাটার চেষ্টা করল ও, গায়ের শক্তিতে টেনে ছেঁড়ার চেষ্টা করল, কিন্তু দড়ি খুলল না। লাভের মধ্যে দড়ি কেটে বসে যেতে লাগল। চামড়ায়। কোনভাবেই খুলতে না পেরে আকাশের দিকে হাত তুলে ও বলল, কালো নেকড়ে! আমার হাতের বাঁধন খুলে দাও। তুমি তো জানো আমি আরও অনিষ্ট করার জন্যই এই বাঁধন খুলতে চাইছি।

সাথে সাথেই ওর হাত বেঁধে রাখা দড়ি খুলে মাটিতে পড়ে গেল।

একবিংশ অধ্যায় – মেধাবী শয়তান

থিবল্ট ওর ঘরের অবস্থা দেখতে গেল। ছাইয়ের ভগ্নস্তূপ পড়ে আছে। ওর নেকড়েগুলো ধ্বংসস্তূপকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের ভঙ্গীতে তীব্র ক্রোধ প্রকাশ পাচ্ছে। ওরা যেন বুঝতে পারছে, কালো নেকড়ের কল্যাণে নেতা হিসেবে যাকে পেয়েছে, এই পোড়াস্থূপের কারণে সে এখন ভুক্তভোগীতে পরিণত হয়েছে। থিবল্ট ওদের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল। ডেকে উঠে আর অঙ্গভঙ্গি করে থিবন্টকে বলার চেষ্টা করল, প্রতিশোধ নিতে ওকে সাহায্য করবে ওরা।

কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল থিবল্ট। তাকিয়ে থাকল পোড়া ঘরটার দিকে। অসুখী সব চিন্তারা এসে ভিড় করছে ওর মনে। তবে একবারও এটা ভাবল না, এগুলো ওর ঈর্ষাকাতর উচ্চাকাঙ্ক্ষারই ফলাফল। যা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। ওর ভেতর কোন দুঃখবোধ কাজ করল না। বরং এখন সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে যারা ওর ক্ষতি করেছে, তাদের জবাব দিতে পারবে ও।

নেকড়েরা ডাকছে। থিবল্ট বলল, হ্যাঁ বন্ধুরা, তোমাদের ডোক আমার অন্তরের কান্নার জবাব দিচ্ছে। মানুষ আমাদেরকে ঘৃণা করে। ওদের কাছ থেকে আমরা দয়া বা করুণা আশা করতে পারি না। ওরা আমাদের শত্রু। ওদেরও আমরা কোনরকম দয়া বা করুণা দেখাব না। চলো, দুর্গে যাই। যে ধ্বংস ওরা এখানে নিয়ে এসেছে, আমরা সেটাকে আবার ওখানে ফিরিয়ে দিয়ে আসি।

বেরিয়ে পড়ল থিবল্ট, নেকড়েদের নেতা এখন দস্যুদলের নেতার মতো অনুসারীদের নিয়ে ধ্বংসের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে।

হরিণ বা অন্য কোন প্রাণী নয়, ওদের লক্ষ্য এখন ভেযের প্রাসাদ-দুর্গ। থিবল্টের প্রধান শত্রু ব্যারনের আস্তাবল ভর্তি ঘোড়া আছে, আছে গরু, ভেড়া। পরদিন সকালে, দুটো ঘোড়া, চারটা গরু আর দশটা ভেড়ার মৃতদেহ পাওয়া গেল।

ব্যারন কিছুটা সন্দিহান হয়ে পড়ল। এটা কি নেকড়েদের আক্রমণ? পশুর আক্রমণ হলেও, কোথায় যেন চিন্তার ছাপ লক্ষ করা যায়। চিহ্ন দেখে বোঝা যাচ্ছে আক্রমণকারী পশুগুলো নেকড়ে। পরের রাতে আস্তাবলে পাহারা বসাল ব্যারন। কিন্তু সে রাতে বনের অন্যপ্রান্তে ব্যস্ত রইল থিবল্ট। এবার সুসি আর ভিভিয়ারের আস্তাবল আর পার্ক আক্রান্ত হলো। তারপরের রাতে বুলোনা আর ইভ নামক আরও দুটো এলাকা। কাজটা একবার শুরু করার পর আর থামার কোন উপায় নেই। বেপরোয়া নিষ্ঠার সাথে এগিয়ে যেতে হবে। থিবল্ট এখন পুরোটা সময় নেকড়েদের সাথেই থাকে। ওদের সাথেই ঘুমায়। ওদের রক্তের তৃষ্ণা চাঙ্গা রাখে।

বনে কাজ করতে যাওয়া কাঠুরে, পাতা-কুড়ানি এবং আরও অনেকে নেকড়ের মুখোমুখি হয়েছে। কেউ বেঁচে গেছে নিজের সাহস আর বুদ্ধির জোরে আর কেউ বা মরেছে। মানুষের নেতৃত্ব পেয়ে নেকড়েরা সুসংবদ্ধ এবং সুশৃঙ্খল একটা দলে পরিণত হয়েছে। যারা সাধারণ হিংস্র পশুর চেয়ে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর।

চারদিকে আতংক ছড়িয়ে পড়ল। অস্ত্র ছাড়া কেউ শহর বা গ্রামের বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিল। কারও কাজ শেষ হয়ে গেলে বাকিদের অপেক্ষা করে সে, একা বন পাড়ি দিয়ে ফেরার চেষ্টা করে না। সয়সনের বিশপ গণপ্রার্থনার আয়োজন করলেন। নেকড়েদের অত্যাচার থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য ঈশ্বরের কাছে করুন আবেদন জানালেন তিনি। প্রচুর বরফ পরার কারণে নেকড়েরা আরও বেশি হিংস্র হয়ে পড়েছে। তবে এমন খবরও আসতে লাগল যে নেকড়েদের সাথে একজন মানুষও আছে। যার উপস্থিতির কারণে নেকড়েরা আরও বেশি অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়েছে। নেকড়েদের মতোই কাঁচা মাংস খায় সেই লোক! রক্ত দিয়ে তৃষ্ণা মেটায়। লোকে এমনও বলতে লাগল যে সেই মানুষটা হচ্ছে থিবল্ট!

বিশপ জুতোর কারিগরকে চার্চের আশ্রয় থেকে বহিষ্কারের ঘোষণা করলেন। চার্চের বহিষ্কারাদেশের কারণে থিবল্টের মাথায় বাজ পড়বে-এমন ভরসা লর্ড ভ্যে অবশ্য করে না। শিকারে বেরোতে পারলে হয়তো কিছু করা যাবে। নেকড়েদের দমন করাটা তার অন্যতম প্রধান কাজ। আর সেই নেকড়েদের হাতেই তার গরু-ঘোড়া মারা পড়ায় যারপরনাই ক্ষিপ্ত ব্যারন।

লর্ড ভেয অবশ্য কিছুটা খুশিও, কারণ নেকড়েদের এই উপদ্রব বন্ধ করতে পারলে বিশাল সম্মান পাবে সে। শিকারে প্রবল আগ্রহ তার সাফল্যের সম্ভাবনাকেই শক্তিশালী করল। আবারও দলবল নিয়ে শিকারে বেরোল সে। দিন। রাত লেগে রইল নেকড়েদের পেছনে। স্যাডল থেকে বলতে গেলে নামাই বন্ধ করে দিল। হাউডগুলোকে নিয়ে যতক্ষণ সম্ভব ছুটে বেড়াতে লাগল সে। সঙ্গে থাকে লেভিলি আর এনগুভা। বিয়ের পর এনগুভার পদোন্নতি হয়েছে। কিন্তু এত ঘুরেও কোন লাভ হলো না। একটা-দুটা দলছুট বা বাচ্চা নেকড়ের দেখা পেলেও, আসল ধাড়ী নেকড়েগুলোর টিকির নাগালও পাওয়া যাচ্ছে না। থিবল্টের কারণে যোগ্য প্রতিপক্ষের সম্মুখীন হয়েছে শিকারিল।

লর্ড ভেয যেমন সবসময় তার কুকুরের সাথেই থাকছে, থিবল্টও তেমনি অবস্থান করছে নেকড়েদের সাথে। একরাতের আক্রমণের পর একটা নেকড়ের পিছু নিল ব্যারন। সেই নেকড়েটাকে সাহায্য করার জন্য পুরো পালকে সতর্ক রাখল থিবল্ট। নেকডেটা থিবল্টের নির্দেশমত সবরকম ভাবে ফাঁকি দিতে লাগল ব্যারনের দলকে। ওটার শক্তিতে যখন আর কুলাচ্ছে না তখন পালের অন্য নেকড়েগুলোও যোগ দিল। ব্যারনের কুকুরগুলো বুঝে উঠতে পারল না, কোন্ নেকড়েকে ওরা তাড়া করছে। ব্যারন নিজেও মাঝে মাঝে ভুল করতে লাগল।

সেদিনের ব্যর্থতার পর মাঝে মাঝে নেকড়েরাই শিকারিদের পিছু নিতে শুরু করল। কোন হাউন্ড পিছিয়ে পড়লে বা দলছুট হয়ে গেলে সাথে সাথে নেকড়েরা ওটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। একবার এনগুভা পিছিয়ে পড়েছিল। নেহায়েত ঘোড়াটার কল্যাণে সে যাত্রা ওর জীবন বাঁচল।

ব্যারনের হাউন্ডের দল পাতলা হয়ে এল। নিরন্তর ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার কারণে ওগুলো ক্লান্ত হয়ে পড়তে শুরু করল। সেরা হাউন্ডগুলোর অধিকাংশই মারা পড়ল নেকেড়েদের সুনিয়ন্ত্রিত আক্রমণে।

বাধ্য হয় অন্য রাস্তা ধরল ব্যারন। আশেপাশে সক্ষম যত লোক ছিল, সবাইকে জড়ো করল সে। এত লোক সমাগম হলো যে তারা যেখান দিয়ে যায়, একটা খরগোশও লুকিয়ে থাকতে পারে না।

কিন্তু বিল্ট আগে থেকেই লক্ষ রাখতে লাগল ওরা কোনদিক দিয়ে যাবে। ওরা যেদিক দিয়ে যেত, থিবল্ট ওর পাল নিয়ে তার উল্টোদিকে চলে যেত।

থিবল্ট সাফল্যের সাথে ওর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে লাগল। ব্যারন বা তার লোকজন কেউ একটা নেকড়েকেও খুঁজে পেল না। যদি কোন কারণে থিবল্ট আবিষ্কার করত-ব্যারনের পথ বুঝতে ওর ভুল হয়েছে, তাহলে সতর্কতার স্বার্থে রাতের আঁধারে সবার চোখ এড়িয়ে নেকড়ের পাল নিয়ে অন্য বনে চলে যেত ও। মাসের পর মাস এভাবে চলতে লাগল।

ব্যারন আর থিবল্ট দুজনেই নিষ্ঠার সাথে নিজেদের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছিল। কিন্তু ব্যারনের অতিপ্রাকৃতিক কোন ক্ষমতা না থাকায় প্রতিপক্ষকে কাবু করা তার জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ল। তবে লর্ড ভভয যেমন অশান্তিতে আছে, তেমনি নেকড়েদের নেতাও শান্তিতে নেই। যা করছে, তার জন্য নিজেকে দায়ী ভাবে না ও। দায়ী ভাবে তাদেরকে, যাদের জন্য ও বাধ্য হয়েছে এসব করতে। মাঝে মাঝে আনলেট এসে হানা দেয় ওর মানসপটে। অ্যানলেট যেন ওর সুখী জীবনের প্রতীক চিহ্ন! চাইলেই মেয়েটা ওর হতে পারত। ওর মনে হয় অ্যানলেটকে ও এখন আরও বেশি ভালবাসে, এতটা ভাল আর কাউকে বাসা ওর পক্ষে সম্ভব না। কখনও কখনও হারানো সুখের জন্য ওর প্রাণ কেঁদে ওঠে।

জরুরী কাজ পড়ায় একদিনের জন্য শিকারে ক্ষান্ত দিয়ে অন্য দিকে যেতে হলো ব্যারনকে। নেকড়েদের একটু শান্তিতে থাকার সুযোগ মিলল।

গ্রীষ্মের এক সুন্দর সন্ধ্যা। অনেকদিন পর নেকড়েদের সঙ্গ ছেড়ে হাঁটতে বেরোল থিবল্ট। মনে পড়তে লাগল সেই সময়ের কথা যখন কোন সমস্যা বা দুশ্চিন্তা ছিল না। এমনই সময় হঠাৎ একটা আর্ত-চিৎকার কানে এল ওর। ভয়ার্ত কণ্ঠে সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছে কে যেন! অন্যসময় হয়তো পাত্তা দিত না, কিন্তু অ্যানলেটের চিন্তায় ওর মনটা তখন নরম হয়ে আছে। এদিকেই মেয়েটার সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল ওর।

শব্দ লক্ষ্য করে দৌড় দিল থিবল্ট। বিশাল এক নেকড়ের আক্রমণ থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে একটা মেয়ে। থিবল্ট বলতে পারবে না কেন, কিন্তু দৃশ্যটা ওকে নাড়া দিল। দৌড়ে গিয়ে ধাক্কা মেরে পশুটাকে সরিয়ে দিল ও। পাজাকোলা করে তুলে নিল অজ্ঞান-প্রায় মেয়েটাকে, তারপর একপাশে এনে সাবধানে নামিয়ে রাখল ঘাসের ওপর। মেয়েটার মুখের ওপর চাঁদের এক ঝলক আলো এসে পড়তে আবিষ্কার করল থিবল্ট-মেয়েটা আর কেউ নয়, অ্যানলেট!

কাছেই বইছে পানির ধারা, সেখানেই প্রথমবার ওর লাল চুলটা দেখেছিল মেয়েটা। আঁজলা ভরে পানি নিয়ে এসে অ্যানলেটের চোখে-মুখে ছিটিয়ে দিল থিবল্ট।

চোখ খুলেই আতংকে চিৎকার দিয়ে পালানোর চেষ্টা করল মেয়েটা। কিন্তু ওকে ধরে ফেলল থিবল্ট, কী হয়েছে? এমনভাবে বলল, যেন এখনও আগের সেই স্যাবট-কারিগর থিবল্টই আছে ও, তুমি আমাকে চিনতে পারছ না, অ্যানলেট?

কেঁদে উঠে বলল অ্যানলেট, হ্যাঁ, পারছি, থিবল্ট, আর পারছি বলেই ভয় পাচ্ছি।

হাঁটুর ওপর বসে হাত জোড় করল মেয়েটা। আমাকে মেরো না, থিবস্ট! কাঁদতে লাগল ও। দয়া করো! আমাকে মেরো না! আমার বুড়ি দাদী বড় কষ্টে পড়ে যাবে। থিবল্ট, মেরো না আমাকে!

আজকের আগ পর্যন্ত থিবল্টের ধারণা ছিল না মানুষ ওকে কী চোখে দেখে। যে মেয়েটা একদা ওকে ভালবেসেছিল, যাকে ও নিজে এখনও ভালবাসে, তার চোখে ভয় দেখে ও আতঙ্কিত হয়ে পড়ল নিজের ব্যাপারে।

আমি তোমাকে মারব, অ্যানলেট? আমি! মাত্রই না তোমাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচালাম? ওহ! কতটা ঘৃণা আমাকে করলে তোমার মাথায় এমন একটা চিন্তা আসতে পারে।

আমি তোমাকে ঘৃণা করি না থিবল্ট। কিন্তু তোমার সম্বন্ধে যা শুনি, তাতে তোমাকে ভয় পাই।

তাই? নিশ্চয়ই জঘন্য সব কথা শোন তুমি আমার নামে! কিন্তু কেউ কি বলে না, কেন থিবল্ট এই অন্যায়গুলো করছে?

স্বর্গীয় নীল চোখজোড়া থিবল্টের দিকে তুলে ধরল অ্যানলেট। আমি তোমাকে বুঝতে পারছি না, থিবল্ট।

বুঝতে পারছ না আমি তোমাকে ভালবাসতাম? তোমাকে পূজা করতাম আমি। তোমাকে হারানোর পর আমার সব এলোমেলো হয়ে গেছে।

যদি আমাকে ভালইবাসতে, তবে বিয়ে করতে কী বাধা ছিল?

অশুভ আত্মা!

আমিও তোমাকে ভালবাসতাম থিবল্ট। তোমার অপেক্ষা অনেক কষ্ট দিয়েছে আমাকে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল থিবল্ট, আমাকে ভালবাসতে?

মৃদু স্বরে, নরম চোখে মেয়েটা উত্তর দিল, হ্যাঁ।

কিন্তু এখন সেসব অতীত মাত্র। এখন আর তুমি আমাকে ভালবাসো না।

আমি তোমাকে ভালবাসি না, কারণ তোমাকে ভালবাসাটা এখন অন্যায়। কিন্তু প্রথম ভালবাসাকে কেউ চাইলেও ভুলতে পারে না, থিবল্ট।

অ্যানলেট! কাঁপতে শুরু করল থিবল্ট। কী বলছ বুঝে বলল, মেয়ে!

বোঝাবুঝির কী আছে, যা সত্যি তাই বলছি, সরল মেয়েটা মাথা নাড়ল।

তুমি যেদিন আমাকে বলেছিলে তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও, আমি তোমাকে নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করেছিলাম। চাবুক পেটা থেকে তোমাকে বাঁচিয়েছি, তারপরও কী করে ভাবব তুমি আমাকে মিথ্যে বলবে? আমি কিন্তু তোমাকে খুঁজতে যাইনি! তুমিই আমার সাথে আবার দেখা করতে এসেছিলে। বলেছিলে ভালবাসার কথা। তুমিই প্রতিজ্ঞার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলো তোমার আংটিটাকে ভয় পাওয়ার পেছনেও আমার কোন দোষ নেই। তোমার হাতের জন্যও যথেষ্ট বড় ছিল ওটা। অথচ কী ভয়ংকর! আমার কোন আঙুলেই ঢুকল না অভিশপ্ত জিনিসটা!

তুমি কি চাও আমি আংটিটা আমি খুলে ফেলি? ছুঁড়ে ফেলে দেই? বলে আঙুল থেকে ওটা বের করার চেষ্টা শুরু করল থিবল্ট। কিন্তু বিধিবাম! অ্যানলেটের আঙুলে পরানোর সময় যেমন ছোট হয়ে গিয়েছিল, তেমন এখনও তেমনি ছোট হয়ে গেছে আংটিটা। শত চেষ্টাতেও ওটা খুলতে পারল না থিবল্ট।

আংটিটা ভোলা কোনভাবেই সম্ভব না! কানো নেকড়ে আর ওর মাঝের চুক্তিপত্র ওটা। হতাশ হয়ে হাত ছেড়ে দিল থিবল্ট।

অ্যানলেট বলতে লাগল, সেদিন আমি পালিয়ে গিয়েছিলাম। জানি সেটা আমার ঠিক হয়নি। তাছাড়া… চোখ তুলে থিবল্টের চুলের দিকে তাকাল ও। থিবল্টের মাথায় কোন টুপি নেই। চাঁদের আলোয় অ্যানলেট দেখল এখন আর একটা নয়, মাথার অর্ধেক চুল ওর শয়তানের রঙে রাঙানো।

আঁতকে উঠে পিছিয়ে গেল মেয়েটা। বলল, থিবল্ট। আমাদের শেষ দেখা হবার পর কী ঘটেছে?

মুখ নিচু করে দুহাতে মাথা চেপে ধরল থিবল্ট। অ্যানলেট! কোন মানুষ, এমনকি কোন পাদ্রীকেও আমি বলতে পারব না ঠিক কী ঘটেছে আমার জীবনে। শুধু এটুকুই বলব, আমি অসুখী, আমার প্রতি করুণা করো।

আনলেট এগিয়ে গিয়ে ওর হাত ধরল।

তুমি তখন আমাকে ভালবাসতে? ভালবাসতে আমাকে? নিষ্পাপ মিষ্টি কণ্ঠে মেয়েটা বলে চলল, আমার কী করার ছিল, থিবল্ট? আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম। দরজায় টোকা পরলেও ভাবতাম, তুমি এসেছ দাদীকে বলতে, দাদী, আমি অ্যানলেটকে ভালবাসি, অ্যানলেটও আমাকে ভালবাসে। ওকে স্ত্রী হিসেবে আমার হাতে তুলে দেবেন? তারপর যখন দরজা খুলে দেখতাম তুমি নও-অন্য কেউ, ঘরের কোনায় লুকিয়ে কাঁদতাম আমি।

আর এখন?

তোমার কাছে অবাক লাগতে পারে, কিন্তু তোমার নামে লোকে যত ভয়ংকর গল্পই বলুক, আমার কখনও ভয় লাগত না। আমার কখনও মনে হয়নি তুমি আমার ক্ষতি করতে পারো। নির্ভয়ে বনে ঘুরে বেড়াতাম আমি। আজও তেমনি বেড়াচ্ছিলাম, তখনই ওই নেকড়েটা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল! তুমি না বাঁচালে এতক্ষণে ওটা আমাকে মেরেই ফেলত।

কিন্তু তুমি তোমার পুরানো বাড়িতে কেন? স্বামীর সাথে থাকো না?

কিছুদিন ভেয়ে ছিলাম। কিন্তু ওখানে আমার দাদীর জায়গা হয়নি। আমার স্বামীকে বললাম, আমাকে আমার দাদীর কথা প্রথমে ভাবতে হবে। তাই দাদীর কাছে যাচিছ। তোমার যখন ইচ্ছা আমাকে এসে দেখে যেও।

সে রাজি হলো?

রাজি হতে চাইছিল না। তখন বললাম দাদীর বয়স সত্তর বছর। আর হয়তো দুতিন বছর বাঁচবেন। ঈশ্বর চান তো আরও কিছুদিন বেশি বাঁচতে পারেন। তবে সে সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। দুতিন বছর হয়তো সমস্যা হবে, কিন্তু আমাদের পুরো জীবন সামনে পরে আছে। তখন রাজি হয়েছে সে।

থিবল্টের মাথায় শুধু এই চিন্তাই খেলা করছে-ওর প্রতি অ্যানলেটের ভালবাসা মরেনি!

তুমি আমাকে ভালবাসতে? আবারও তো ভালবাসতে পারো?

অসম্ভব, থিবল্ট! আমি যে এখন অন্য কারও।

অ্যানলেট! অ্যানলেট! শুধু একবার বলো তুমি আমাকে ভালবাসো?

না থিবল্ট, যদি বাসতামও, তোমার কাছে কখনও-ই সেটা প্রকাশ করতাম না।

কেন? তুমি আমার ক্ষমতা জানো না। আমার হয়তো আর একটা বা দুটা ইচ্ছা অবশিষ্ট আছে। তোমার সাহায্য পেলে আমি তোমাকে রাণীর মতো ধনী করে দিতে পারি। এই দেশ, ফ্রান্স, ইউরোপ ছেড়ে চলে যেতে পারি আমরা। পৃথিবীতে আরও অনেক বড় বড় দেশ আছে যার নামও তুমি জানো না আমেরিকা, ইন্ডিয়া। পুরো স্বর্গ, অ্যানলেট! নীল আকাশ, বিশাল গাছ, নানা বর্ণের পাখি। অ্যানলেট, শুধু বলো তুমি আমার সাথে আসবে। কেউ জানবে না আমরা একসাথে কোথায় চলে গেছি। কেউ জানবে না আমরা একজন আরেকজনকে ভালবাসি। এমনকি আমরা যে বেঁচে আছি, তাও কেউ বুঝতে পারবে না।

তোমার সাথে চলে যাব? অ্যানলেট যেন বুঝতে পারছে না থিবল্ট কী বলছে। তুমি কী ভুলে গেছ, আমি আর তোমার নই? আমার বিয়ে হয়ে গেছে?

তাতে কী যায় আসে! যদি তুমি আমাকে ভালবাসো, আমরা ঠিক সুখী হব!

থিবল্ট! এসব কী বলছ তুমি?

শোনো অ্যানলেট, এপারের জীবন আর ওপারের জীবনের দিব্যি দিয়ে বলছি। তুমি কি চাও না আমার শরীর এবং আত্মা দুটোই বাঁচুক? যদি চাও তাহলে না কোরো না। দয়া করো, চলো আমার সাথে। এখান থেকে দূরে কোথাও চলে যাই। যদি ধনী হয়ে থাকতে না চাও, আবার যেখানে স্যাবট কারিগর হিসেবে কাজ করে খেতে পারব সেখানেই চলে যাব আমরা। আমার পরিচয় হবে গরীব, কিন্তু কাজ নিয়ে সুখী থিবল্ট। যার ঘরে আছে অ্যানলেটের মতো চমৎকার স্ত্রী।

আমি তো তোমার স্ত্রী হতেই চেয়েছিলাম। তুমিই তো আমার হৃদয় পুড়িয়ে দিয়েছ।

আমার সব পাপ ভুলে যাও, অ্যানলেট ভয়ঙ্কর শাস্তি আমি পেয়েছি।

থিবল্ট, তুমি যেটা করতে চাওনি, অন্য কেউ সেটা করেছে। অসহায় মেয়েটাকে গ্রহণ করেছে। অন্ধ বৃদ্ধার দায়িত্ব নিয়েছে। আমাকে নাম দিয়েছে আর দাদীর অন্ন সংস্থান করেছে। আমার ভালবাসা ছাড়া অন্যকিছু চায়নি সে। আমার প্রতিশ্রুতি ছাড়া কোন যৌতুকও দাবি করেনি। তুমি কি আমাকে ভালর বিনিময়ে অনিষ্ট করতে বলছ? তুমি কি বলতে চাইছ আমি তাকে ছেড়ে আসব, যে ভালবাসার প্রমাণ দিয়েছে, এমন কারো জন্য জন্য যে কোন প্রমাণ দিতে পারেনি?

তুমি যখন ওকে ভালবাসো না, আমাকেই বাসো, তখন তাতে কী যায় আসে?

আমার মুখে কথা বসিয়ো না, থিবল্ট। আমি বলেছি তোমার সাথে আমার সম্পর্কটা আমি ভুলে যাইনি, কিন্তু কখনও-ই বলিনি আমার স্বামীকে আমি ভালবাসি না। আমি তোমাকে সুখী দেখতে চাই। আমি চাই তুমি খারাপ কাজ ছেড়ে দাও। পাপের প্রায়শ্চিত্ত করো। আর সব শেষে আমি চাই ঈশ্বর তোমাকে দয়া করুন। যে অশুভ আত্মার কথা তুমি বললে, তার হাত থেকে যেন মুক্তি পাও। আমি তোমার জন্য দিনরাত প্রার্থনা করব। কিন্তু প্রার্থনা করার জন্য আমার নিজেকে শুদ্ধ রাখতে হবে। যে কণ্ঠ দয়া ভিক্ষা করবে, ঈশ্বরের কানে সে কষ্ঠ পৌঁছুতে হলে সেই তাকে নিষ্পাপ হতে হবে। আর ঈশ্বরের বেদীতে যে প্রতিজ্ঞা করেছি, কোন কিছুর বিনিময়েই আমি তা ভাঙতে পারব না, থিবল্ট।

অ্যানলেটের এই পরিষ্কার সিদ্ধান্ত থিবন্টকে ক্ষুব্ধ করে তুলল।

তুমি কি জানো না এই সুরে আমার সাথে কথা বলাটা বোকামি হয়ে যাচ্ছে?

বোকামি হবে কেন?

এখন রাত, আর আমরা এখানে একা। এই সময়ে কেউ স্বপ্নেও এখানে আসার সাহস পাবে না। এখানে আমার যতটা ক্ষমতা আছে, স্বয়ং রাজারও তার রাজ্যে ততটা ক্ষমতা নেই।

মানে?

প্রার্থনার কথা বলছ, আমাকে পাল্টাতে বলছ। আমাকে শাসাচ্ছ?

তোমাকে শাসাব কেন?

যেটা বোঝাতে চাইছি, অ্যানলেটের কথা পাশ কাটিয়ে গেল থিবল্ট। তুমি যা বলেছ-তাতে তোমার প্রতি আমার ভালবাসা যত না বেড়েছে, তোমার স্বামীর প্রতি আমার ঘৃণা বেড়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। ভেড়ার জন্য নেকড়েকে ক্ষেপানো বোকামি, যখন নেকড়ের ক্ষমতা ভেড়ার চেয়ে বেশিই হয়।

আমি তোমাকে বলেছি, থিবল্ট, তোমার সাথে দেখা হওয়া নিয়ে আমার ভেতর কোন ভয় কাজ করেনি। অন্যদের বলা কথা মাথায় ছিল বলে হঠাৎ মুহূর্তের জন্য আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু এখন তুমি চাইলেও আমাকে ভয় পাওয়াতে পারবে না।

এভাবে কথা বোলো না অ্যানলেট, তুমি চিন্তাও করতে পারবে না শয়তান আমার কানে কী মন্ত্র পড়ছে আর আমাকে কী পরিমাণ পরিশ্রম করতে হচ্ছে সেটা অগ্রাহ্য করার জন্য।

তুমি চাইলে আমাকে মেরে ফেলতে পারো। কিন্তু কাপুরুষের মতো তুমি যা বলছ তা আমি করব না। তুমি আমাকে মেরে ফেললেও আমি আমার স্বামীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকব, মরার সময়েও তার জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করব।

তোমার স্বামীর নামও উচ্চারণ কোরো না, অ্যানলেট। ওর কথা মনে করতে বাধ্য কোরো না আমাকে। নাহলে ওর ক্ষতি করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারব না।

আমাকে তুমি যত খুশি শাসাতে পারো, থিবল্ট, কারণ আমি তোমার সামনে আছি। কিন্তু ও তোমার থেকে অনেক দূরে আছে। এখান থেকে ওর কিছুই করতে পারবে না তুমি।

কে বলেছে তোমাকে? যে ক্ষমতা আমার আছে, তা ঠেকানো আমার পক্ষে কঠিন। কাছে-দূরে সব জায়গায় আমি ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারি।

তাতে আমি হয়তো বিধবা হব। কিন্তু তোমার কি ধারণা? যার কারণে আমি স্বামী হারিয়েছি, তার হাত ধরব?

হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল থিবল্ট, অ্যানলেট, নতুন করে আরও কোন অপরাধ করার হাত থেকে আমাকে বাঁচাও দয়া করে।

তোমার অপরাধের জন্য তুমিই দায়ী, থিবল্ট, আমি নই। আমি তোমাকে আমার জীবন দিতে পারি, কিন্তু সম্মান নয়।

গর্জে উঠল থিবল্ট, ঘৃণা যখন অন্তরে প্রবেশ করে, ভালবাসা তখন পালিয়ে যায়। নিজের খেয়াল রেখ, অ্যানলেট। স্বামীর খেয়াল রেখ। আমার ভেতরে শয়তান আছে। সে আমার মুখ দিয়েই কথা বলে। তোমার কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত ভালবাসা যখন পেলাম না, প্রতিশোধ নেয়া থেকে নিজেকে চাইলেও বিরত রাখতে পারব না আমি। এখনও সময় আছে। এই হাত ধরো। অভিশাপ থেকে, ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচো। নয়তো এটা জেনো, আমি নই, তুমিই তোমার স্বামীর মৃত্যুর কারণ হবে!

কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করল থিবল্ট, তারপর অ্যানলেটকে নিরুত্তর থাকতে দেখে বলল, তুমি আমাকে থামালে না অ্যানলেট? তবে তাই হোক! আমাদের তিনজনের ওপরই অভিশাপ নামুক। তুমি, আমি আর সে। আমি চাই তোমার স্বামী মারা যাক, এবং সে মারা যাবে!

তীব্র একটা আর্ত-চিৎকার করে উঠল অ্যানলেট। তবে পরক্ষণেই সামলে নিল নিজেকে। থিবল্ট যা-ই দাবি করুক না কেন, এতদূর থেকে ওর দেয়া অভিশাপ ফলে যাবে এটা অসম্ভব মনে হলো মেয়েটার কাছে। না, না, তুমি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ। বলল ও, আমার প্রার্থনা ওকে সব রকমের বিপদ থেকে বাঁচাবে।

যাও তাহলে, দেখো ঈশ্বর তোমার প্রার্থনার কী জবাব দেয়। একটা কথা, যদি তোমার স্বামীকে জীবিত দেখতে চাও, তাড়াতাড়ি করো। নয়তো শুধু মৃতদেহটাই দেখতে পাবে।

শেষ কথাগুলো যে সুরে বলা হলো, তাতে আনলেটকে একটা আতংক আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল। থিবল্টের ইশারা করা দিকে ছুট লাগাল ও। একসময় রাতের অন্ধকারে, দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে গেল মেয়েটা। উচ্চ-নিনাদে কেঁদে উঠল থিবল্ট, আমার আত্মা এখন সত্যিই অভিশপ্ত হয়ে গেল!

দ্বাবিংশ অধ্যায় – থিবল্টের শেষ ইচ্ছা।

প্রাণপণে ছুটে চলেছে অ্যানলেট। দম ফুরিয়ে গেলে থামছে। নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছে-থিবল্টের অভিশাপ আসলে শুধুই একজন ঈর্ষাকাতর মানুষের প্রলাপ মাত্র। কথাগুলো বাতাসে ছড়িয়ে গেছে, এর কোন ক্ষমতা নেই। দম ফিরে পাওয়ার সাথে সাথে আবার ছুট দিচ্ছে সে। স্বামীকে আবার না দেখা পর্যন্ত ও শান্তি পাবে না। বন-জঙ্গল পেরিয়ে ছুটে চলেছে ও। নেকড়ের ভয়ও ওকে থামাতে পারছে না। একটাই ভয় কাজ করছে এখন ওর মনে, স্বামীর মৃতদেহ দেখার ভয়। লম্বা পথ দৌড়ে অবশেষে গ্রামের কাছে পৌঁছল অ্যানলেট। চাঁদের রূপালি আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। অন্ধকার থেকে সেই আলোয় বেরিয়ে আসতেই আড়াল থেকে একজন মানুষ বেরিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল ওকে। হাসতে হাসতে বলল, এই রাতের বেলা এত জোরে দৌড়ে কোথায় যাচ্ছ, মাদাম? অ্যানলেট ওর স্বামীকে চিনতে পারল।

এটিয়েন! স্বামীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল ও। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ! তোমাকে আবার দেখতে পেয়ে আমি যে কী খুশি হয়েছি। তুমি ঠিক আছ তো?

কী ভেবেছিলে, বিবল্ট আর ওর নেকড়েরা আমাকে রাতের খাবার বানিয়েছে।

থিবল্টের কথা বোলো না। চলো, আশেপাশে মানুষজন আছে এমন কোথাও চলো।

হেসে উঠল তরুণ শিকারি। তুমি তো আমার দুর্নাম করিয়ে ছাড়বে! স্বামীরা দেখি কোন কাজেই আসে না। এমনকি স্ত্রীর সাহস জোগানোর জন্যও স্বামীর কোন দরকার নেই!

ঠিকই বলেছ, এটিয়েন। বনের ভেতর দিয়ে একা দৌড়ে আসার সাহস পেয়েছি। আর এখন যে তুমি সাথে আছ তাতে নিশ্চিন্ত বোধ করা উচিত। কিন্তু তারপরও কেন যেন প্রচণ্ড ভয় হচ্ছে আমার।

কী হয়েছে, বলল তো? স্ত্রীকে চুমু খেল এনগুভা।

নেকড়ের আক্রমণ থেকে শুরু করে থিবল্টের সাথে আলাপচারিতা, সব খুলে বলল আনলেট। মন দিয়ে শুনল এনভা, তারপর বলল, চলো, তোমাকে  দাদীর কাছে নিরাপদে রেখে আসি। লর্ড ভেষকে জানাতে হবে থিবল্ট কোথায় আস্তানা গেড়েছে।

না, তাহলে তোমাকে বনের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। কোথায় কোন্ বিপদ ওঁৎ পেতে আছে কে জানে।

অন্য রাস্তা ধরব আমি। ক্ৰয়োল দিয়ে ঘুরে গেলে বন এড়াতে পারব।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে-মাথা ঝাঁকাল অ্যানলেট। প্রতিবাদ করে কোন লাভ হবে না। এনগুভা পিছু হটবে না। তার চেয়ে বরং ঘরে পৌঁছে আবার অনুরোধ করার জন্য শক্তি সঞ্চয় করা যাক।

তরুণ শিকারি তার কর্তব্যটুকুই শুধু করতে চায়। অ্যানলেটের সাথে থিবল্টের যেখানে দেখা হয়েছে, নিশ্চয়ই তার কাছাকাছিই আছে নেকড়ে নেতা। পরদিন লোক-লস্কর নিয়ে যেদিকে যাবার পরিকল্পনা করছে ব্যারন, সেটা অনেক দূরে। এটিয়েন তাই তাড়াতাড়ি তার মনিবকে খবরটা পৌঁছে দিতে চায়। খুব বেশি রাত আর বাকি নেই, সব ব্যবস্থা করতে সময় লাগবে।

অনেকক্ষণ চুপ করে ছিল অ্যানলেট। অবশেষে মনে মনে কথা গুছিয়ে নিয়ে এনগুভাকে বোঝাবার চেষ্টা করল ও। নেকড়ে-মানব হলেও ওর কোন ক্ষতি করেনি থিবল্ট। বরং নেকড়ের কবল থেকে জীবন বাঁচিয়েছে। কোনরকম ক্ষমতা ওর ওপর প্রয়োগও করেনি। অ্যানলেটকে স্বামীর কাছে আসতে দিয়েছে। এখন থিবল্টের অবস্থানের কথা ওর ঘোর শত্রু লর্ড ভেযের কাছে বলে দেয়া বিশ্বাসঘাতকতার সামিল। অমনটা করা হলে থিবল্ট ঠিকই টের পেয়ে যাবে। এবং এরপর ও আর কাউকে কখনও দয়া না-ও দেখাতে পারে। থিবল্টের হয়ে অনুরোধ করল অ্যানলেট। বিয়ের সময় এনভাকে থিবল্টের কথা সবই জানিয়েছিল ও। অ্যানলেটকে এনগুভা বিশ্বাসও করে। কিন্তু তারপরও সে একটা ঈর্ষার খোঁচা ঠিকই অনুভব করল। সেই প্রথম দিন থিবল্টকে গাছের ওপর আবিষ্কার করার পর থেকেই দুজনের মধ্যে একটা রেষারেষি আছে। অ্যানলেটের কথা মন দিয়ে শুনলেও নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকল সে। দুজনের মাঝে কে ঠিক-তা নিয়ে তর্ক করতে করতে পথ চলছিল ওরা। থিবল্টের আক্রমণের অত্যাচারে গ্রামে বেড়া দেয়া হয়েছে, গড়ে তোলা হয়েছে টহল বাহিনী। নিজেদের কথায় মগ্ন হয়ে থাকার ফলে এনগুভা এবং অ্যানলেট কেউই পাহারাদারের প্রশ্ন, কে যায়? শুনতে পায়নি। কোন জবাব না পেয়ে পাহারাদার অন্ধকারে ভুলভাল কল্পনা করে ফেলল। বন্দুক তাক করে গুলি করতে উদ্যত হলো সে। এনগুভার চোখে ব্যাপারটা ধরা পড়ল। বন্ধু! বলে চিৎকার করে অ্যানলেটকে আড়াল করে জড়িয়ে ধরল সে। তারপর আর একটা শব্দ না করে কাটা কলা গাছের মতো পড়ে গেল মাটিতে। হৃদপিণ্ড ফুটো হয়ে গেছে ওর।

গুলির শব্দ শুনে সবাই ছুটে এসে এনভাকে মৃত আবিষ্কার করল। ওর লাশের পাশেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে অ্যানলেট। ধরাধরি করে ওকে ওর দাদীর কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। কিছুক্ষণ বাদে জ্ঞান ফিরলেও মানসিক স্থিরতা ফিরল না মেয়েটার। পাগলের মতো আচরণ শুরু করল ও। স্বামীর মৃত্যুর জন্য দায়ী করল নিজেকে। অপ্রকৃতস্থ ভাবে স্বামীর আত্মার জন্য শান্তি কামনা করল ও। থিবকে উদ্দেশ্য করেও অনেক অনুরোধ করল। আশপাশে যারা ছিল, ওর করুণ আকুতি শুনতে শুনতে চোখে পানি এসে গেল তাদের।

ধীরে ধীরে ঘটনার বর্ণনা পাওয়া গেল অ্যানলেটের কাছ থেকে। সবাই জেনে গেল, অলৌকিক শক্তি বলে নেকড়ে-মানব এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। তার অভিশাপেই এই দুর্ভাগ্যটা নেমে এসেছে বেচারা এনগুভার উপর। আদপে এটা একটা হত্যাকাণ্ড! থিবল্টের বিরুদ্ধে জনরোষ তাই আরও বেড়ে গেল।

এদিকে কিছুতেই শোক কাটিয়ে উঠতে পারছে না অ্যানলেট। স্বাস্থ্য ক্রমেই ভেঙে পড়ছে ওর। ডাক্তার-বৈদ্য দেখিয়েও কোন লাভ হয়নি-সব চিকিৎসাই বিফল হয়েছে। সবাই ধরেই নিল অ্যানলেটও শীঘ্রই স্বামীর পথ ধরবে। একমাত্র ওর দাদীর কণ্ঠই ওকে কিছুটা শান্ত করতে পারে। অন্ধ বৃদ্ধা কথা বললেই শুধু ওর দৃষ্টি নরম হয়ে যায়। চোখে জমা হয় অশ্রু। তার হাত কপালে পড়লেই ওর মুখে বিষণ্ণ একটা হাসি ফোটে।

এক রাতে অ্যানলেটের অবস্থার প্রচণ্ড অবনতি হয়েছে। লর্ড ভেযের পাঠানো দুজন মহিলা ওর দেখাশোনা করছে। সম্ভবত কোন দুঃস্বপ্ন দেখে মেয়েটা মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে। এমনি সময় হাট করে খুলে গেল ঘরের দরজা। যেন আগুনের শিখায় মোড়ানো একটা মানুষ এসে ঢুকল ভেতরে। বিছানায় উঠে মৃত্যুপথযাত্রী মেয়েটার কপালে চুমু খেয়ে আবার বেরিয়ে গেল সে। এত দ্রুত ঘটনাটা ঘটল যে ভুল দেখেছে না ঠিক দেখেছে সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগল উপস্থিত ব্যক্তিদের। অদৃশ্য কোন কিছুকে উদ্দেশ্য করে অ্যানলেট বলে উঠল, ওকে নিয়ে যাও! ওকে নিয়ে যাও! কিন্তু ততক্ষণে প্রত্যক্ষদর্শী দুজন থিবল্টকে চিনতে পেরেছে। অ্যানলেটের অবস্থার কথা শুনে আর চুপ থাকতে পারেনি থিবল্ট। ধরা পড়ার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ছুটে এসেছিল হতভাগ্য মেয়েটাকে দেখতে।

অ্যানলেটের ঘরের দুই মহিলা দেখিয়ে দিল কোন্ দরজা দিয়ে থিবস্ট বেরিয়ে গেছে। তখন লোকজন জড়ো হয়ে ওকে তাড়া করল। তাড়া খেয়ে জঙ্গলের গভীরে পালিয়ে যাবার লক্ষ্যে ছুটতে শুরু করল থিবল্ট।

থিবল্টের আকস্মিক আগমনের ধাক্কায় অ্যানলেটের অবস্থার আরও অবনতি ঘটল। রাত পোহানোর আগেই পাদ্রী ডেকে আনা হলো মুমূর্ষ মেয়েটার জন্য। আর হয়তো কয়েক ঘণ্টা টিকবে ও! মাঝরাতের দিকে পাদ্রী এসে পৌঁছাল। চার্চের লোকেরা ক্রুশ আর ছেলেরা হোলি ওয়াটার বয়ে নিয়ে এল। পাদ্রী গিয়ে বসল ওর মাথার কাছে। তখন কোন এক অদৃশ্য ক্ষমতাবলে অনেকটা শক্তি ফিরে পেল অ্যানলেট। পাদ্রীর সাথে লম্বা সময় ধরে নিচু গলায় কথা বলল মেয়েটা। ওর নিজের আর প্রার্থনার দরকার নেই। কিন্তু তাহলে কার জন্য প্রার্থনা করল ও? সেটা শুধু পাদ্রী, অ্যানলেট আর ঈশ্বরই জানেন।

ত্রাবিংশ অধ্যায় – বর্ষপূর্তি

পেছনের তাড়া করা মানুষদের থেকে নিরাপদ দূরত্বে আসার পর গতি কমিয়ে দিল থিবল্ট। এখানে বনটা শান্ত। মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে, ধাতস্থ হবার জন্য একটা জায়গা বেছে নিয়ে বসে পড়ল ও। আশেপাশে কিছু কালো পাথর ছড়িয়ে আছে। আগুনে পুড়ে কালো হয়ে গেছে ওগুলো। তাহলে কি ভাগ্যের ফেরে ওর পুড়ে যাওয়া কুটিরটার কাছে চলে এসেছে বিল্ট?

কুটিরের সেই শান্তির জীবনের সাথে বর্তমান ভয়ংকর জীবনের তুলনা করে তিক্ততায় ছেয়ে গেল ওর মন। চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পায়ের কাছের কয়লার ওপর পড়ল। দূরে গির্জাগুলোতে একে একে মাঝরাতের ঘণ্টাধ্বনি বাজতে শুরু করেছে।

ঠিক সেই সময়েই মৃত্যুপথযাত্রী অ্যানলেটের প্রার্থনা শুনছে পাদ্রী।

এদিকে নিজের সাথেই কথা বলছে থিবল্ট, দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষ ছিলাম আমি। ভাগ্যে ঈশ্বর যা রেখেছেন, তার বাইরে কিছু চাইতে গিয়েছিলাম। সেদিন সেদিনটা ছিল অভিশপ্ত এক দিন! কালো নেকড়ে যেদিন আমাকে অন্যের ক্ষতি করার ক্ষমতা দিল, সেটাও একটা অভিশপ্ত দিন ছিল। ওই ক্ষমতা দিয়ে যা করেছি, তাতে জীবনের সব সুখই ধ্বংস হয়ে গেছে আমার।

পেছনে উচ্চস্বরের একটা হাসি শুনে ফিরে তাকাল বিল্ট। কালো নেকড়েটা নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে! জ্বলন্ত চোখ দুটো ছাড়া বাকি শরীরটা অন্ধকারে ভাল দেখা যাচ্ছে না। থিবল্টের সামনে এসে বসে পড়ল ওটা।

তারপর! মাস্টার থিবল্ট কি অসন্তুষ্ট? মাস্টার থিবন্টকে খুশি করা তো খুব কঠিন দেখা যাচ্ছে।

অসন্তুষ্ট না হবার উপায় কি রেখেছ? তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে ব্যর্থ চাওয়া আর অনিঃশেষ মর্মপীড়া ছাড়া কিছুই পাইনি। ধন-সম্পদ চেয়েছিলাম। সেসব তো পেলামই না, উল্টো যা-ও বা ছিল, তা-ও হারালাম। একটা ঘর ছিল, যে ঘরে শান্তিতে ঘুমাতে পারতাম। যে ঘর আমাকে রোদ-ঝড় থেকে বাঁচাত। এমনকি সেই ঘরটাও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সম্মান চেয়েছিলাম। আর এখন? নিম্নবিত্ত মানুষগুলো পর্যন্ত আমাকে মারার জন্য খুঁজছে। ভালবাসা চেয়েছিলাম। একটা মাত্র মেয়ে যে আমাকে ভালবেসেছিল, আমিও যাকে ভালবেসেছিলাম, সে-ও অন্যের স্ত্রী হয়ে গেল। মৃত্যুর মুখে এসে ও এখন আমাকে অভিশাপ দিচ্ছে। তোমার দেয়া বিশাল ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও, ওর জন্য আমি কিছুই করতে পারছি না!

শুধু নিজেকে ভালবাসা বন্ধ করো, থিবল্ট।

আমাকে নিয়ে মজা করছ, করো!

তোমাকে নিয়ে মজা করছি না। আমার সাথে পরিচয়ের আগে কি তুমি অন্যের সম্পদের দিকে ঈর্ষার চোখে তাকাওনি?

একটা হরিণের দিকে তাকিয়েছি। অমন শত শত হরিণ বনে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

তুমি কি ভেবেছিলে, একটা হরিণে তোমার চাওয়া শেষ হয়ে যেত? দিনের শেষে রাত আসে আর রাতের শেষে দিন। ঠিক তেমনি, একটা চাওয়া থেকে জন্ম হয় আরেকটা চাওয়ার। হরিণ চেয়েছ, এরপর হরিণটা পরিবেশনের জন্য দামী রূপোর পাত্র চাইতে। সেখান থেকেই জন্ম হত একটা খানসামার চাহিদার। যে তোমাকে খাবার পরিবেশন করবে। উচ্চাকাক্ষা আকাশের মতো, সীমাহীন! মনে হয় দিগন্তরেখার ওপারে এর শেষ আছে, কিন্তু আসলে পুরো পৃথিবীটাকেই ঘিরে আছে এই চাহিদার খেলা। মাদাম পুলের মিলের জন্য তুমি অ্যানলেটকে ত্যাগ করেছিলে। মিলটা পেলে তারপর তুমি মাদাম ম্যাগলোয়ার বাড়িটা চাইতে। কিন্তু মন-গুবের দুর্গ-প্রাসাদ দেখার পর ওই বাড়ির প্রতি তোমার আর কোন আকর্ষণ থাকত না।

তোমার-আমার প্রভু, স্বর্গচ্যুত দেবদূতের সাথে ঈর্ষাকাতরতায় তুমি একই পথের পথিক। পার্থক্য এই যে তুমি ফলটা ভোগ করার মতো বুদ্ধিমান ছিলে না। আর তাই সৎ জীবন যাপন করাটাই তোমার জন্য ভাল হত।

ঠিকই বলেছ, যে ক্ষতি চায় তারই ক্ষতি হয়। আচ্ছা যদি মন থেকে চাই, তাহলে কি আবার আমি সৎ মানুষ হতে পারব না?

জবাবে নেকড়েটা একটা ব্যঙ্গের হাসি হাসল।

শয়তান শুধু মাত্র একটা চুল ধরে টেনে মানুষকে নরকে নিয়ে যেতে পারে। তোমার কয়টা চুলের মালিক এখন সে, বলতে পারো?

না।

সেটা অবশ্য আমিও বলতে পারব না। তবে কটা অবশিষ্ট আছে তা বলতে পারব। তোমার নিজের আর মাত্র একটা চুল বাকি আছে।

কোন মানুষ যখন একটা বাদে আর সব চুলই শয়তানের কাছে হারিয়েছে, তখন সেই অবশিষ্ট চুলটার কল্যাণে ঈশ্বর কি তাকে বাঁচাতে পারে না?

চেষ্টা করে দেখতে পারো।

তোমার সাথে দরাদরি করার সময় আমার ধারণা ছিল না চুক্তিটা এই ধরনের হবে।

আরে বোকা, যখন তোমার চুল আমাকে দিয়েছ, সেটা কি চুক্তি ছিল না? ব্যাপটিজম আবিষ্কার করার পর থেকে আমরা সমস্যায় পড়ে গিয়েছিলাম কীভাবে তোমাদের ধরব তাই ভেবে। সেজন্য কাউকে কোন সুবিধা দিতে গেলে বিনিময়ে শরীরের কিছু একটা চাই আমরা। যাতে সে জায়গাটা ধরতে পারি। তুমি তোমার চুল আমাদের দিয়েছ। আর নিজেই দেখেছ, সেই চুল তুমি চাইলেও উঠিয়ে ফেলতে পারবে না। এই পোড়া ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দরাদরি শেষ হওয়ার পর থেকেই তুমি আমাদের সম্পত্তি হয়ে গেছ। প্রতারণা আর নৃশংসতার বীজ তোমার মনেই ছিল!

ক্ষিপ্ত বিবল্ট মাটিতে পা ঠুকে বলল, তাই বলে এই দুনিয়ার কোন সুখ ভোগ না করেই ওই দুনিয়া হারালাম আমি?

এই দুনিয়ার সুখ ভোগ করার সময় এখনও আছে, থিবস্ট।

কীভাবে?

ভাগ্যক্রমে যে রাস্তা তুমি ধরেছ তার ফল পেতে চাইলে সংশয়ে না থেকে পুরোপুরি আমাদের একজন হয়ে যাও।

সেটা কীভাবে করব?

আমার জায়গাটা নাও তুমি।

তারপর কী হবে?

তুমি আমার ক্ষমতা পাবে। তাহলে আর তোমার কিছু চাওয়ার থাকবে না।

যদি তোমার ক্ষমতা এতই হয়ে থাকে, যত খুশি সম্পদ তুমি পেতে পারো, যা খুশি করতে পারো, তাহলে এই ক্ষমতা ছাড়বে কেন?

ওটা নিয়ে মাথা ঘামিও না। আমার প্রভু আমাকে পুরস্কৃত করবেন।

তোমার জায়গা নেয়ার মানে কি তোমার চেহারাও নিতে হবে?

রাতে নিতে হবে, দিনে তুমি মানুষের বেশেই থাকবে।

রাত অনেক লম্বা। শিকারির গুলিতে মারা পড়তে পারি আমি, অথবা ধরা পড়তে পারি ফাঁদে। তাহলে ধন-সম্পদ, সম্মান আর সুখের সাথে সাথে প্রাণটাও হারাব।

সেই ভয় কোরো না। লোহা, সীসা বা ইস্পাত এই চামড়া ভেদ করতে পারবে না। এই চামড়া গায়ে থাকলে শুধু যে কেউ তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না তা-ই নয়, তুমি হয়ে যাবে অমর! আর সব নেকড়ে-মানবদের মতো, বছরে শুধু একদিনের জন্য তোমাকে পুরোপুরি নেকড়ে হিসেবে কাটাতে হবে। শুধু ওই চব্বিশ ঘণ্টা আর সব প্রাণীর মতো বিপদের আশংকা থাকবে তোমার। একবছর আগে তোমার সাথে যখন প্রথম দেখা হয়, তখন আমার ওই সময়টাই চলছিল।

এখন বুঝলাম, কেন লর্ড ব্যারনের কুকুরগুলোকে ভয় পাচ্ছিলে তুমি।

মানুষের সাথে চুক্তিতে আসার সময় পুরো সত্যটা বলতে আমরা বাধ্য। এরপর মানুষই সিদ্ধান্ত নেবে সে চুক্তি করবে কি না।

খুব তো ক্ষমতার কথা বলছ। বলল, এই ক্ষমতাটা দিয়ে আমি কী করতে পারব?

পরাক্রমশালী রাজারাও এই ক্ষমতার সামনে দাঁড়াতে পারবে না। কারণ তাদের ক্ষমতা মনুষ্য সীমা দিয়ে বাঁধা।

ধনী হতে পারব?

এত সম্পদ পাবে, যে সম্পদের ওপর বিতৃষ্ণা এসে যাবে তোমার। সম্পদ বলতে মানুষ শুধু সোনা-রূপাই সংগ্রহ করতে পারে। কিন্তু শুধু ইচ্ছা শক্তি দিয়ে তুমি মানুষের কল্পনাতীত সম্পদের মালিক হতে পারবে।

আমার শত্রুদের ওপর প্রতিশোধ নিতে পারব?

যে কোন অশুভ ব্যাপারে তোমার ক্ষমতা হবে সীমাহীন।

যদি আমি কোন মেয়েকে ভালবাসি, তবু তাকে হারানোর সম্ভাবনা থাকবে?

মানুষের ওপর প্রভাব খাটাতে পারবে তুমি। সুতরাং ওদের নিয়ে যা খুশি তাই করতে পারবে।

আমার ইচ্ছার বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা ওদের থাকবে না?

কোন অবস্থাতেই না-এক মাত্র মৃত্যু ছাড়া! মৃত্যু সবচেয়ে ক্ষমতাশালী।

তিনশো পঁয়ষট্টি দিনের মধ্যে মাত্র একদিন আমার মৃত্যুভয় থাকবে?

মাত্র একদিন। বাকি দিনগুলোতে, আগুন, পানি, লোহা, ইস্পাত কিছুই তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না।

এবং তুমি আমাকে কোনরকম কথার ফাঁদে ফেলছ না।

নেকড়ে হিসেবে দিব্যি করে বলছি, তোমাকে কোনরকম ফাঁদে ফেলছি না আমি!

বেশ, তাহলে তাই হোক। চব্বিশ ঘণ্টার জন্য নেকড়ে আর বাকি দিনগুলোয় সম্রাট। কী করতে হবে? আমি তৈরি।

একটা পাতা নিয়ে দাঁত দিয়ে তিন ভাগ করো। তারপর যতদূর পারো ছুঁড়ে ফেলল ওটা।

থিবল্ট তাই করল।

রাতটা ছিল শান্ত। কিন্তু পাতার টুকরোগুলো বাতাসে ভাসিয়ে দেয়া মাত্র বজ্রের গর্জন শোনা গেল। একটা ঘূর্ণিবায়ু ওগুলো ভাসিয়ে নিয়ে গেল।

ভাই, থিবল্ট, এখন আমার জায়গা নাও। আর শুভকামনা রইল! চব্বিশ ঘণ্টার জন্য নেকড়ে হতে হবে তোমাকে। এই যাত্রাটা পার করতে পারলে দেখবে-আমি যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছি সবই সত্যি। শয়তান যেন তোমাকে ব্যারনের কুকুরের হাত থেকে বাঁচায়। প্রভুর কাছে আমি তোমার জন্য বিশেষভাবে প্রার্থনা করব। শয়তানের দিব্যি! তোমার ব্যাপারে আমি সত্যিই আগ্রহী বন্ধু।

ধীরে ধীরে নেকড়েটা লম্বা হয়ে একটা মানুষের আকৃতি নিল। তারপর থিবল্টের উদ্দেশে একবার হাত নেড়ে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেল বনের মাঝে।

থিবল্টের মনে হলো কিছুক্ষণের জন্য ও কোনরকম চিন্তা-ভাবনা বা নড়াচড়া করার ক্ষমতা হারিয়েছে। তারপর আবিষ্কার করল ওর শরীরের আকৃতি বদলে গেছে। একটু আগে যে নেকড়ের সাথে কথা বলছিল, সেই নেকড়ের প্রতিচ্ছবিতে পরিণত হয়েছে ও। মাথায় একটা কালো চুল অবশিষ্ট ছিল ওর। আর এখন কালো নেকড়ের চেহারায়, মাথার একটা মাত্র চুল সাদা হয়ে আছে।

এই অচিন্তনীয় পরিস্থিতিতে নিজেকে সামলে নিতে নিতেই অদূরে কুকুরের চিৎকার শুনতে পেল থিবল্ট। ডাক শুনে মনে হলো কোন ব্লাডহাউন্ড হবে। কাছেই ঝোঁপ থেকে ভেসে এল নড়াচড়ার আওয়াজ। ব্যারন আর তার কুকুরের কথা মনে পড়তেই কেঁপে উঠল ও। দৌড়াতে শুরু করল। খুশি হলো এটা আবিষ্কার করে যে ওর শক্তি আর ক্ষিপ্রতা অনেকগুণ বেড়ে গেছে।

শিকারির উদ্দেশে লর্ড ভেকে বলতে শুনল থিবল্ট, তুমি কোন কাজেরই। কুকুরগুলোকে ঠিকমতো বেঁধে আসোনি। ডাকাডাকি করছে। নেকড়েটা যে পালিয়ে গেল। ওটাকে কি আর পাব?

স্বীকার করছি আমার ভুল হয়ে গেছে, মাই লর্ড। গতকালই নেকড়েটাকে এদিক দিয়ে যেতে দেখেছি। ভাবিনি আজ আবার এদিকেই থাকবে ওটা।

তুমি নিশ্চিত এটাই বারবার আমাদের হাত থেকে পালিয়ে গেছে?

গত বছর ম্যাকোট যখন ডুবে গেল, তখন এই নেকড়েটাকেই আমরা তাড়া করছিলাম।

কুকুরগুলোকে ওটার পেছনে লেলিয়ে দেয়া উচিত।

আপনি শুধু হুকুম দিন। রাত শেষ হতে আর দুঘণ্টা বাকি আছে।

যদি একদিন সময় পায়, লেভিলি, তাহলে বহুদূরে চলে যাবে ওটা।

অন্তত ত্রিশ মাইল। মাথা নাড়তে নাড়তে সায় দিল লেভিলি।

এই অভিশপ্ত নেকড়েটাকে কিছুতেই মাথা থেকে নামাতে পারছি না। ওর চামড়াটা আমার চাই-ই-চাই! এই চিন্তায় চিন্তায় কোনদিন না পাগল হয়ে যাই আমি!

তাহলে আর দেরি না করে হুকুম দিন, কুকুরগুলোকে ছেড়ে দেই।

ঠিক বলেছ, লেভিলি। নিয়ে এসো হাউন্ডগুলোকে।

দশ মিনিটের মধ্যে ঘোড়া ছুটিয়ে গিয়ে কুকুরগুলোকে নিয়ে এল লেভিলি। যদিও লর্ড ভেযের কাছে মনে হলো একহাজার বছর সময় লেগেছে।

ধীরে, ধীরে, লেভিলিকে বলল ব্যারন, এরা নতুন। আগেরগুলোর মতো কড়া প্রশিক্ষণ পাওয়া নয়। বেশি উত্তেজিত হয়ে গেলে কোন কাজে আসবে না। আগে এগুলোর গা গরম করাও।

ছাড়া পাওয়ার পর প্রথমে একটা দুটো করে কুকুর গন্ধ শুঁকে আগানোর চেষ্টা করল। তারপর বাকিগুলোও একে একে যোগ দিল সঙ্গে। বেশ কিছুক্ষণ পর পর ডাকতে লাগল ওগুলো। নেকড়েটা যে পথে গেছে সে পথ আবিষ্কার করার পর বেড়ে গেল ডাকাডাকি।

ভাল সূচনা মানেই অর্ধেক কাজ শেষ! ব্যারনের কণ্ঠে উল্লাস প্রকাশ পেল। লেভিলি, খেয়াল রেখো। আর তোমরা, বাকিদের দিকে ফিরে বলল সে, অনেকবার মার খেয়েছি, আর না। যদি তোমাদের কারও ভুলে সুযোগটা নষ্ট হয়, নেকড়ের বদলে তাকেই কুকুরের ভোগে লাগাব।

উদ্দীপনামূলক বাণী শেষ করে ঘোড়া ছোটাল ব্যারন। হাউন্ডগুলোর কাছাকাছি পৌঁছানোর ইচ্ছা। ওদের ডাকের শব্দ দূর থেকেও শোনা যাচ্ছে।

চতুর্বিংশ অধ্যায় – নেকড়ে-মানব শিকার

ব্লাডহাউন্ডের ডাক শুনেই দৌড় শুরু করায় অনেকদূর এগিয়ে যেতে পেরেছে। থিবল্ট। বেশ কিছুক্ষণ আর কোন আওয়াজ পায়নি, তাই দৌড়ের গতি কমিয়ে দিল ও। তারপর হঠাৎ করেই দূরাগত বজ্রের আওয়াজের মতো ধ্বনি তুলে একসাথে ভেসে আসতে লাগল সবগুলো হাউন্ডের ডাক। এবার কিছুটা উদ্বিগ্ন বোধ করল ও। শত্রুর সাথে দূরত্ব বাড়ানোর জন্য দৌড়ের গতি আবার বাড়িয়ে দিল। বেশ খানিকক্ষণ একটানা ছুটে অবশেষে মন-টেগুতে এসে থামল থিবল্ট। মাথা কাত করে শোনার চেষ্টা করল, নেকড়েতে রূপান্তরিত হওয়ায় ওর শ্রবণশক্তি অনেক বেড়ে গেছে। বুঝতে পারল হাউন্ডগুলো এখনও বেশ দূরে আছে।

পাহাড় থেকে নেমে এল থিবল্ট। ঝাঁপিয়ে পড়ল নদীতে। সাঁতরে গিয়ে উঠল কম্পিয়েইনার তীরে, তারপর ঢুকে পড়ল বনের গভীরে। টানা তিন ঘণ্টা দৌড়েও ওর নেকড়ে পাগুলো ক্লান্ত হয়নি। তবে বনটা অপরিচিত বলে তেমন একটা ভরসা পাচ্ছে না।

আরও মাইলখানেক দৌড়াল থিবল্ট। নদী পেরিয়ে, ঘুরপথে ছুটে আর পিছিয়ে এসে কুকুরগুলোকে ফাঁকি দিতে পেরেছে আশা করা যায়। পিয়েরফে আর মন-গুবের ভোলা প্রান্তর পেরিয়ে শমুতার বনে গিয়ে ঢুকল ও। আরও কিছুদূর ঘুরে একসময় লঙোফোর বনে পৌঁছাল। কিন্তু উ দু পন্ডেউ-এর শেষ মাথায় এসেই হঠাৎ বিশটা কুকুরের একটা দলের মুখোমুখি পড়ে গেল ও। এরইমধ্যে প্রতিবেশীদের সবার কাছে কালো নেকড়েকে তাড়া করার খবর পাঠিয়েছে ব্যারন। তাই মঁসিয়ে দু মন্টবুটোনের শিকারিরা বেরিয়েছে রেকি করতে। নেকড়ে দেখা মাত্র ওরা কুকুরগুলোকে ছেড়ে দিল। শুরু হলো নেকড়ে আর কুকুরের মধ্যে তীব্র বেগে ধাওয়া। ঘোড়া নিয়ে ওদের সঙ্গে তাল মেলাতে অভিজ্ঞ ঘোড়সওয়ারদেরও বেগ পেতে হচ্ছে। বন-প্রান্তর সব পেরিয়ে ধাওয়া চলতে লাগল।

বিদ্যুতের বেগে ধাওয়া চলছে। পেছনে সৃষ্টি হচ্ছে বিশাল ধুলোর মেঘ। শোনা যাচ্ছে শিঙার শব্দ আর চিৎকারের প্রতিধ্বনি। পাহাড়-উপত্যকা, জল কাদা, উঁচু পাথর, সব পেরিয়ে ছুটছে থিবল্ট। ঘোড়া আর কুকুরগুলোরও যেন হিপোগ্রিফের মতো ডানা গজিয়েছে। এদিকে পেছনে ব্যারনও তার দল নিয়ে এসে হাজির। চেঁচিয়ে উৎসাহ দিচ্ছে কুকুরের পালকে। তবে কালো নেকড়ে এখনও অক্লান্ত ভাবে একই গতিতে দৌড়ে যাচ্ছে। নতুন একপাল কুকুর পেছনে লাগায় একটু দমে গেছে বটে থিবল্ট। কিন্তু এই গতিতে দৌড়ানোর মধ্যেও মানবিক চিন্তা-ভাবনার ক্ষমতা থাকাটা ওর কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। যদিও এই যাত্রা নিরাপদে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব কি না জানে না, হয়তো ও মরবে, তবে তার আগে যত কষ্ট আর যন্ত্রণা ওকে সহ্য করতে হয়েছে, তার প্রতিশোধ নিতে হবে। সুখের যত প্রতিশ্রুতি ও পেয়েছে, তা ভোগ করতে হবে। এই অবস্থার মধ্যেও অ্যানলেটের কথা ওর মাথায় এল। অবশ্যই অ্যানলেটের ভালবাসাও ওকে ফিরে পেতে হবে। এখনই হয়তো থিবল্ট আতঙ্কিত, পর মুহূর্তেই আবার রাগান্বিত হয়ে পড়ছে। মাঝেমাঝেই নিজের বর্তমান আকৃতির কথা ভুলে যাচ্ছে। ও। তখন মনে হচ্ছে ঘুরে মুখোমুখি হয় কুকুরগুলোর। রাগে পাগল হওয়ার পরক্ষণেই আবার মৃত্যুভয় জেগে ওঠে। যখন দৌড়ায়, মনে হয় যেন হরিণের পায়ে ছুটছে। যখন লাফায়, মনে হয় ঈগলের মতো পাখা আছে ওর। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। সম্ভাব্য হন্তারকদের তাড়া করার শব্দ দূর হয় না। এই মনে হচ্ছে পেছনে ফেলে এসেছে ওদের, পর মুহূর্তে টের পাচ্ছে যে আরও জোর উদ্যমে কাছে চলে আসছে ধাওয়াকারীর দল। ওর বাঁচার ইচ্ছা মরেনি। শক্তি এখনও শেষ হয়নি। কিন্তু আবার কোন নতুন দলের মুখোমুখি হলে আর উপায় থাকবে না। মরিয়া হয়ে কুকুরগুলোর সাথে দূরত্ব বাড়ানোর জন্য একটা দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল থিবল্ট। ঠিক করল ওর চেনা বনে, ওর ডেরায় ফিরে যাবে। পরিচিত জমিতে কুকুরগুলোকে ফাঁকি দিতে পারবে ও। এই ভেবে আরও একবার দিক পরিবর্তন করল। পিউযো, ভিভিয়ে পেরিয়ে কম্পিয়েইনার বনে ঢুকে পড়ল আবার। তারপর লাগের বন হয়ে অবশেষে ভিলারস-কটেরেটের বনে ফিরে এল কালো নেকড়ে রূপী থিবল্ট। ওর বিশ্বাস এবারে লর্ড ভেযের পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে পারবে। কোন সন্দেহ নেই কয়েক জায়গায় সে তার কুকুরদের বসিয়ে রেখেছে সে, কিন্তু ও যে এই দিকে ফিরে আসতে পারে এমন চিন্তা ব্যারনের মাথায় আসার কথা না।

নিজের এলাকায় ফিরে মুক্তভাবে নিঃশ্বাস নিল থিবল্ট। ও এখন দাঁড়িয়ে আছে উক নদীর ধারে। ওপার থেকে নদীর ওপর খাড়া পাহাড়ের ঝুলে থাকা একটা পাথরের ওপর লাফ দিল। তারপর সেখান থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল নিচের নদীতে। সাঁতরে আবার এপাশে এসে নদীর ওপর পাহাড়ের গায়ে একটা গর্তে আশ্রয় নিল নেকড়ে রূপী থিবল্ট। গর্তের মুখটা পানির স্তরের নিচে। গর্তের ভেতরের দিকে চলে গেল ও। অন্তত তিন মাইল পেছনে ফেলে এসেছে কুকুরের পালকে। মিনিট দশেক পর ডাক ছাড়তে ছাড়তে এসে পৌঁছল কুকুরগুলো। উত্তেজনায় হয় খেয়াল করল না সামনে নদী, অথবা ভেবেছিল ওরাও লাফিয়ে ওপাশের পাথরের মাথায় পৌঁছাতে পারবে। কিন্তু কালো নেকড়ের মতো অত জোরে লাফ দেয়া ওদের সাধ্যের বাইরে। ব্যর্থ হয়ে একে একে পানিতে পড়তে লাগল কুকুরগুলো। ছিটকে ওঠা পানি এসে লাগছে থিবল্টের গায়ে। কুকুরগুলো দুর্ভাগা, তার উপর নেকড়ে রূপী থিবল্টের মতো অতটা শক্তিও অবশিষ্ট ছিল না ওদের। নদীর স্রোতের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারল না ওরা। ঘোড়সওয়ার যতক্ষণে এসে হাজির হলো, ততক্ষণে একে একে সব কুকুরই নদীর স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। ব্যারনের শাপ-শাপান্ত শুনতে পেল ও। ব্যারন আর তার শিকারিরা তখন নদীর ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল। এই সুযোগে বেরিয়ে এল থিবল্ট। কখনও আঁতরে, কখনও পাথর থেকে পাথরে লাফিয়ে নদীর উৎসের দিকে এগোল। অবশেষে যথেষ্ট দূরত্ব আদায় করা গেছে নিশ্চিত হয়ে একটা গ্রামে ঢুকে পড়ল থিবল্ট। কিছুক্ষণ উদ্দেশ্য বিহীন ভাবে দৌড়ে বেড়াল। তারপর পোসিয়ামন গ্রামের কথা মনে পড়ল ও। ওখানে অ্যানলেট আছে। সেদিকে ছুটতে শুরু করল থিবল্ট। সন্ধ্যা ছটা বেজে গেছে। প্রায় পনেরো ঘণ্টা ধরে ধাওয়া চলেছে। না হলেও পঞ্চাশ লীগ১৯ রাস্তা পাড়ি দিয়েছে শিকারি ও শিকার সবাই। সূর্য পাটে বসেছে। সাদা, গোলাপী এবং গোধূলির আরও নানা রঙের শোভা পশ্চিম আকাশে। নানা ফুলের গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে। ফড়িং উড়ে বেড়াচ্ছে, গান গাইছে পাখি। প্রকৃতির এই শান্ত সৌন্দৰ্য্য থিবল্টের ওপর এক অদ্ভুত প্রভাব ফেলল। চারপাশে প্রকৃতি কত সুন্দর, অথচ মানসিক অস্থিরতা ওর ভেতরটাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। প্রথম চুক্তির মতো দ্বিতীয় চুক্তিতেও ও ধোঁকা খায়নি তো?

একটা পায়ে চলা পথ দিয়ে এগোতে এগোতে মনে পড়ল, এই পথ দিয়েই প্রথম দিন ও অ্যানলেটকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল। আবার অ্যানলেটের ভালবাসা পাবার আশায় ওর মন সজীব হয়ে উঠেছে।

গির্জার ঘণ্টাধ্বনি ভেসে এল থিবল্টের কানে। কালো নেকড়ের মনে পড়ে গেল ওকে তাড়া করে আসা মানুষের কথা। কোন একটা খালি বাড়িতে আশ্রয় নেয়ার আশায় মাঠের ওপর দিয়ে গ্রামের দিকে দৌড়াল ও। কবরখানার দেয়ালের পাশ দিয়ে যাবার সময় একই রাস্তা দিয়ে আসতে থাকা কিছু লোকের কণ্ঠ শুনতে পেল। মানুষের চোখ এড়ানোর আর কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে লাফিয়ে দেয়াল পেরোল থিবল্ট। ঢুকে পড়ল কবরখানার ভেতরে। গির্জাটা করবখানার লাগোয়া। দেখাশোনার লোক নেই। লম্বা লম্বা ঘাস জন্মেছে। আরও আছে অযত্নে বেড়ে ওঠা ঝোঁপ-ঝাড়। তেমনি একটা ঘন ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল থিবল্ট। ভেতরে থেকে বাইরে চোখ রাখতে অসুবিধা হবে না। একটা সদ্য খোঁড়া কবর দেখা যাচ্ছে। পাদ্রীর প্রার্থনার আওয়াজও ভেসে আসছে কানে। গির্জার আশেপাশে ঠিক স্বস্তি পাচ্ছে না ও। কেটে পড়া দরকার-এতক্ষণে রাস্তা পরিষ্কার হয়ে গিয়ে থাকবে বলে আশা করল থিবল্ট।

সবে আড়াল থেকে নাকটা বের করেছে, এমন সময় কবরস্থানের দরজা খুলে গেল। বাধ্য হয়ে আবার লুকিয়ে পড়ল বিল্ট। সাদা পোশাক পরা একটা ছেলে প্রথমে হোলি-ওয়াটার নিয়ে বেরোল। তারপর রূপোর কুশ হাতে একটা লোক এবং সব শেষে পাদ্রীকে দেখা গেল। সবার মুখে মৃতের মঙ্গল কামনা করে করা প্রার্থনা শোনা যাচ্ছে।

চারজন লোক একটা কফিন বয়ে নিয়ে এল। কফিনটা ফুল-লতা-পাতা আঁকা কাপড়ে ঢাকা। যা ঘটছে সবই খুব সাধারণ ঘটনা, তবুও কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে থিবল্টের। সামান্য নড়াচড়াও ওর উপস্থিতি ফাঁস করে দিতে পারে। তাই মূর্তির মতো স্থির হয়ে, উদ্বেগের সাথে কী হয় দেখতে লাগল ও। কফিনটা নামিয়ে রাখা হলো। রীতি অনুযায়ী, কোন তরুণ বা তরুণী যদি খুব অল্প বয়সে মারা যায়, তার কফিন শুধু একটা কাপড়ে ঢেকে কবরের পাশে রাখা হয়। যাতে তার কাছের মানুষেরা শেষ বিদায় জানাতে পারে। এরপর কফিনের ডালা আটকে দিলেই সব শেষ। এক বৃদ্ধাকে ধরে ধরে আনা হলো। দৃশ্যতই মহিলা অন্ধ। মৃতের কপালে একটা চুমু দিতে চাইল সে। কফিনের ওপর থেকে কাপড় সরানো হলো। কফিনে শুয়ে আছে অ্যানলেট! থিবল্টের যন্ত্রণাকাতর মূদ গর গর ধ্বনি উপস্থিত মানুষের কান্নার সাথে মিশে গেল। মৃত অ্যানলেটকে জীবিতকালের চেয়েও সুন্দর লাগছে। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থিবল্টের হদয় ভেঙে যাচ্ছে। আর কেউ নয়, মেয়েটাকে ও-ই খুন করেছে। সত্যিকারের দুকুল ছাপানো কষ্ট অনুভব করল থিবল্ট। অনেক অনেক দিন পর নিজের কথা ভাবতে ভুলে গেল ও। ভাবল শুধু মেয়েটারই কথা। যে ওর জীবন থেকে চিরদিনের মতো হারিয়ে গেছে। এমনকি কালো নেকড়ের দেয়া ক্ষমতাও ওকে ফেরত আনতে পারবে না।

কফিনে পেরেক ঠোকার শব্দ শোনা গেল। থিবল্ট টের পেল, কবরে মাটি আর পাথর ফেলা হচ্ছে। ওর একমাত্র ভালবাসার মানুষের ওপর চাপা পড়ছে মাটি আর পাথর! তার নরম শরীরে আঘাত লাগছে! কদিন আগেও কতই না সজীব আর প্রাণবন্ত ছিল মেয়েটা। গতরাতেও প্রাণ ছিল ওর শরীরে। থিবল্ট ছুটে যেতে চাইল আনলেটকে আনতে। জীবিত অ্যানলেট হয়তো ওর ছিল না। কিন্তু মৃত্যুর পর সে অন্য কারও হতে পারবে না।

মানুষের শোক ওর পশুর অনুভূতিকে ঠেলে উপরে উঠে এল। কালো চামড়ার নিচে শরীরটা কেঁপে উঠল থিবল্টের। হিংস্র লাল চোখ দিয়ে গড়াতে লাগল অশ্রু। অসুখী একটা মানুষ কেঁদে উঠল, ঈশ্বর! আমাকে নাও। যাকে আমি খুন করেছি, তার জীবন ফিরে পাওয়ার জন্য আমি খুশি মনে আমার নিজের জীবন দিয়ে দেব!

তারপরই গলা ছেড়ে ডেকে উঠল থিবল্ট। আর সেই অমানুষিক ডাক কানে যেতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল উপস্থিত লোকজন। দ্রুত ফাঁকা হয়ে গেল কবরস্থান। আর ঠিক সেই মুহূর্তে অন্য দলের হাউন্ডগুলোও, যেগুলো নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সলীল সমাধির শিকার হয়নি, কবরের দেয়াল টপকে এসে হাজির হলো। আর ওগুলোর পেছনে ঘর্মাক্ত ব্যারনও স্পরের ঘায়ে রক্তাক্ত ঘোড়ায় চড়ে হাজিরএগিয়ে এসে ঝোঁপটা ঘিরে দাঁড়াল কুকুরের পাল। ঘোড়া থেকে নেমে শিকারি ছুরি হাতে নিয়ে দৌড়ে এল ব্যারন। দেখল, কুকুরগুলো একটা নেকড়ের চামড়া নিয়ে কামড়া-কামড়ি করছে, কিন্তু সেই খোলসের ভেতরে শরীরটার কোন অস্তিত্ব নেই!

কোন সন্দেহ নেই, এটাই সেই নেকড়ে-মানব, যেটাকে ওরা সারাদিন তাড়া করেছে। চামড়াটায় একটাই সাদা চুল, বাকি সব কুচকুচে কালো।

কিন্তু নেকড়ে-মানবের শরীরটা তাহলে কোথায় গেল? সেই উত্তর কেউ জানে না। এরপর বিবল্টকে আর কখনও দেখা যায়নি। তবে লোকের বিশ্বাস, প্রাক্তন স্যাবট-কারিগর আর নেকড়ে-মানব একই ব্যক্তি।

কবরস্থানে উপস্থিত একজন জানাল সে শুনেছে কেউ একজন বলছে, ঈশ্বর! আমাকে নাও! যাকে আমি খুন করেছি, তার জীবন ফিরে পাওয়ার জন্য আমি খুশি মনে আমার নিজের জীবন দিয়ে দেব। যেহেতু নেকড়ে-মানবের শরীরটাও পাওয়া যায়নি, তাই পাদ্রী ঘোষণা করল, এই নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের কারণে থিবল্ট মুক্তি পেয়েছে।

এরপর থেকে ফরাসী বিপ্লবের আগ পর্যন্ত একটা রীতি চালু ছিল। পোসিয়ামন থেকে মাইল দেড়েক দূরে একটা মঠ আছে। প্রতিবছর অ্যানলেটের মৃত্যু-দিবসে সেখান থেকে একজন ধর্মযাজক আসত। মেয়েটার কবরের পাশে বসে প্রার্থনা করত সে।

এই হচ্ছে কালো নেকড়ের ইতিহাস। যেটা আমাকে বলেছে আমার বাবার সহকারী মোকেট।

-সমাপ্ত-

নির্ঘণ্ট

১। ভ্যালেঃ পোশাক-আশাকের দায়িত্বে থাকা পুরুষ ভৃত্য।

২। স্যাবটঃ কাঠের জুতো।

৩। পোর্টকুলিসঃ দুর্গের প্রবেশদ্বারে ও অধঃকরণের উপযোগী লোহার গরাদ বিশেষ।

৪। নমরুদঃ নমরুদ শব্দের অর্থ খোদদ্রোহী। বাইবেল অনুযায়ী সে ছিল সিনারের রাজা যে কিনা ঈশ্বরকে শিকার করতে চেয়েছিল।

৫। এক বিশেষ ইহুদীঃ উইলিয়াম শেকস্পিয়ারের দ্য মার্চেন্ট অফ ভেনিস নাটকের শাইলক চরিত্রটি দ্রষ্টব্য।

৬। কেইনঃ বাইবেল মতে অ্যাডামের প্রথম যমজ সন্তানদের একজন, যে তার যমজ ভাই অ্যাবলকে হত্যা করে মানব-জাতির প্রথম খুনিতে পরিণত হয়।

৭। বেইলিফঃ আইন সংরক্ষণ বিষয়ক সরকারি কর্মকর্তা।

৮। বালশাজার-এর ভোজঃ বাইবেলে বর্ণিত রাজা বালশাজার। এক বিশাল ভোজ।

৯। বিলজেবাবঃ নরকের ভয়ঙ্কর শক্তিশালী এক দানব। অথবা মতান্তরে শয়তানের অন্যতম একটি নাম।

১০। মেনেলাউসঃ হোমার-এর মহাকাব্য ইলিয়াড দ্রষ্টব্য। মেনেলাউস ছিলেন হেলেনের স্বামী, যার কাছ থেকে প্যারিস হেলেনকে চুরি করেন। এর ফলশ্রুতিতেই গ্রীক ও ট্রয়ের মাঝে যুদ্ধ শুরু হয়।

১১। ডক্টর ফাউস্টঃ ইয়োহান গিয়র্গ ফাউস্ট নামক পনেরো শতকের একজন আলকেমিস্ট, জ্যোতিষী, রেনেসাঁ যুগীও মঞ্চ-জাদুকর। পরে তিনি লোককথার কিংবদন্তিতে পরিণত হন। ডক্টর ফাউস্টের কাহিনী দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে একাধিক নাটক লেখা হয়েছে, যার মাঝে ইংরেজ ক্রিস্টোফার মারলো এবং জার্মান ইয়োহান উলফগ্যাঙ ফন গোয়েথে-এর কাজগুলো সর্বাধিক স্বীকৃত। গল্প অনুযায়ী ফাউস্ট শয়তানের কাছে নিজের আত্মা বিক্রি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে আর ক্ষতি ছাড়া ভাল হয়নি।

১২। মেফিস্টোফিলিসঃ জার্মান লোককথার দানব বিশেষ। প্রথমে ফাউস্টের কাহিনীতে বর্ণিত এবং পরে অন্যান্য অনেক সাহিত্য-কর্মেই এর দেখা পাওয়া যায়।

১৩। ভ্যালেন্টিনঃ ডক্টর ফাউস্টকে নিয়ে লেখা নাটকের অন্যতম চরিত্র।

১৪। মার্গারেটঃ ডক্টর ফাউস্টকে নিয়ে লেখা নাটকের অন্যতম চরিত্র।

১৫। ট্রয়ের হেলেনঃ হোমারের মহাকাব্য ইলিয়াডের বর্ণনা মতে হেলেন অফ ট্রয় ছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারী। ট্রয় নগরীর রাজপুত্র প্যারিসের সঙ্গে তিনি পালিয়ে যাবার ফলেই গ্রীস ও ট্রয়ের মাঝে যুদ্ধ বাঁধে এবং দীর্ঘ দশ বছর প্রতিরোধের পর গ্রীকদের কূটকৌশলের কাছে পরাজিত হয়ে ট্রয়ের পতন ঘটে।

১৬। নার্সিসাসঃ গ্রীক পুরাণের শিকারি চরিত্র যে জলে আপন প্রতিবিম্ব দেখে নিজের প্রেমে পড়ে গিয়েছিল।

১৭। ব্যাপটিজমঃ খ্রিষ্টানদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে একজন ব্যক্তিকে আরেকজন খ্রিষ্টান ব্যক্তির দ্বারা পবিত্র পানিতে নিমজ্জিত করে এবং বের করে আনার মাধ্যমে খ্রিষ্টীয় ধর্ম-সংঘের সদস্য করে নেওয়া হয়।

১৮। হিপোগ্রিফঃ পুরাণে বর্ণিত অর্ধ-ঈগল অর্ধ-ঘোড়া।

১৯। লীগঃ দূরত্বের পরিমাপ বিশেষ। তিন মাইলে এক লীগ হয়ে থাকে।  

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *