প্রারম্ভ – মোকেটের পরিচয়

প্রারম্ভ – মোকেটের পরিচয়

ছোট্ট একটা শহরে আমার জন্ম। কাছেই একটা বন আর কিছু গ্রাম। ১৮২৭ থেকে ১৮৪৭, সাহিত্য জীবনের প্রথম বিশ বছর জন্মস্থানকে উপেক্ষা করে গেছি। কেন সেটা আমি নিজেও জানি না। কীভাবে যেন শৈশব আমার কাছ থেকে প্রায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, যেন মেঘের আড়ালে হারিয়ে গেছে!

জীবনের শুরুতে আমাদের পথ দেখায় আশা, তাই ভবিষ্যতটা থাকে অনেক পরিষ্কার। তারপর একসময় যাত্রার ক্লান্তি আমাদের ধরে ফেলে। তখন সবকিছু একপাশে রেখে আমরা বসে পড়ি। ফিরে তাকাই ফেলে আসা পথের দিকে। জীবনের শেষে এসে সঙ্গী হয় বাস্তবতা। ভবিষ্যৎ তখন হয়ে পড়ে কুয়াশাচ্ছন্ন।

একসময় বুঝতে পারি, সামনে ধূসর মরুভূমি আমাদের অপেক্ষায়। তখন অবাক হয়ে পেছনের ফেলে আসা ছোট ছোট মরূদ্যানগুলোকে আবিষ্কার করি। যেগুলোকে অবহেলায় ও অলক্ষ্যে পাশ কাটিয়ে এসেছি।

সুখের খোঁজে কত তাড়া ছিল আমাদের। কিন্তু কোন পথই কাউকে কখনও কাক্ষিত সুখের কাছে পৌঁছে দিতে পারে না। কতটা অন্ধ আর অকৃতজ্ঞ ছিলাম আমরা! আবার যদি এমন কোন ছায়া সুনিবিড় জায়গায় ফিরে যেতে পারতাম, সেখানেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতাম।

শরীরের পক্ষে সম্ভব না ফিরে যাওয়া, কিন্তু স্মৃতির বেলায় সে বাধা নেই। স্মৃতি ছাড়া শরীর তারাহীন রাতের মতো, আলোহীন বাতির মতো। তাই শরীর আর স্মৃতি দুটো ভিন্ন পথে যাত্রা শুরু করে।

অজানার দিকে যখন এগিয়ে যায় শরীর, স্মৃতি তখন ঘুরে বেড়ায় ফেলে আসা সময়ে। ফেলে আসা কোন মরূদ্যানই সে বাদ দেয় না। ভ্রমণ শেষে আবার ফিরে আসে শরীরে। যা কিছু দেখেছে সেসবের গল্প শোনায়।

শুনতে শুনতে ক্লান্ত পথিকের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, মুখে ফুটে ওঠে হাসি। শৈশবে ফিরতে পারে না সে, তাই শৈশবকেই ফিরিয়ে নিয়ে আসে।

তে জীবন কি অনেকটা চক্রের মতো নয়? দোলনা থেকে আমরা যাত্রা শুরু করি। কবরের দিকে যত এগোই, ততই আবার দোলনার দিকেই কি ফিরে আসি না?

 ২

এখন আমি আপনাদের থিবল্ট, ওর নেকড়ের পাল, লর্ড ভেয, আর অ্যানলেটের গল্পটা বলব। গল্পটি আমি শুনেছি মোকেটের কাছ থেকে। মোকেট সম্বন্ধে আমি আরেকটু বিস্তারিত বলব যাতে পাঠক ওকে ভাল করে বুঝতে পারেন।

আমার তখন তিন বছর বয়স। বাবা-মায়ের সাথে লে ফস নামের একটা দুর্গে থাকি। এন আর ওইযের সীমান্তে, আহামো আর লোপোর মাঝে। আমার বোন প্যারিসে থাকত। বছরে একবার মাসখানেকের জন্য বাড়ি আসত।

আমাদের বাড়িতে আরও ছিল ট্রাফল নামে একটা কুকুর-আমি প্রায়ই ওটার পিঠে চেপে ঘুরতাম; মালি পিয়ের-আমাকে খেলার জন্য সাপ ব্যাঙ যোগাড় করে দিত; বাবার নিগ্রো ভ্যালে হিপোলাইট; অতঃপর মোকেট-বাড়ি দেখাশোনা করত; আর ছিল রাধুনী মেরি, যার ব্যাপারে নাম ছাড়া আর তেমন কিছুই অবশ্য আমার মনে নেই।

মোকেট আমাকে নেকড়ে-মানব আর ভূতের গল্প বলত যতক্ষণ না জেনারেল-আমার বাবাকে জেনারেল বলেই ডাকা হত-এসে বাধা দিতেন।

তবে এই কাহিনীর বয়ানে একমাত্র মোকেটই উঠে আসবে, সুতরাং তাকে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করা যাক।

মোকেটের বয়স বছর চল্লিশের মতো হবে। ছোটখাটো কিন্তু শক্তপোক্ত গড়নের লোক। মাথায় তেকোনা টুপি, কাঁধে ঝোলা, হাতে পিস্তল আর ঠোঁটে পাইপ।

পাইপটা সম্বন্ধে আরও কিছু কথা বলা এখানে আবশ্যক। ওটা বাহ্যিক একটা বস্তু থেকে বদলে মোকেটের শরীরের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গিয়েছিল। পাইপহীন মোকেটের কথা কেউ স্মরণ করতে পারবে কি না সন্দেহ। কখনও যদি পাইপটা ঠোঁটে না থাকত, তাহলে নির্ঘাত সেটা ওর হাতে থাকবে।

এই সর্বদা পাইপ মুখে চলার ফলে একটা সমস্যা তৈরি হলো। মোকেটের মুখের বাদিকের শ্বদন্তগুলো প্রায় বিলুপ্তির পথে চলে গেল। তাছাড়া পাইপ মুখে আর পাইপ হাতে কথা বলার মধ্যে পরিষ্কার পার্থক্য টের পাওয়া যেত।

এই ছিল মোকেটের বাহ্যিক রূপ। সামনে মোকেটের বুদ্ধিবৃত্তি এবং মানবিক গুণাবলীর কিছু নমুনা পাওয়া যাবে।

একদিন ভোরবেলা। বাবা তখনও বিছানা ছাড়েননি। মোকেট ঘরে ঢুকে পায়ের কাছে খুঁটির মতো দাঁড়িয়ে গেল।

বাবা জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার মোকেট? এত সকাল সকাল?

জেনারেল, মোকেট গম্ভীর ভাবে বলল, আমি দুঃস্বপ্নিত হচ্ছি। মোকেটের ব্যাকরণজনিত বেশ কিছু ঝামেলা ছিল। ও নিজের অজান্তেই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ, দুটো ক্রিয়াপদই একসাথে ব্যবহার করে ফেলে।

তুই দুঃস্বপ্নিত হচ্ছিস? আহারে বেচারা! মোকেটের অনুকরণে জবাব দিলেন বাবা, এ তো খুবই খারাপ কথা। তা কতদিন ধরে হচ্ছিস?

ঠিকই বলেছেন, বেচারাই বটে।

বলে মোকেট দুর্লভ একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলল। মুখ থেকে পাইপ সরিয়ে নিল সে। অতীব গুরুত্বপূর্ণ কোন ব্যাপার ঘটলেই কেবল এই কাজটা করে ও।

বাবা সহানুভূতির সুরে জানতে চাইলেন, তা কতদিন ধরে হচ্ছিস?

পুরো এক সপ্তাহ ধরে।

তা কে দেখাচ্ছে দুঃস্বপ্ন?

কে দেখাচ্ছে সেটা খুব ভালমতোই জানি। পাইপটা তখনও ওর হাতে, আর হাতটা পেছনে। তাই যতটা সম্ভব চিবিয়ে চিবিয়ে বলল মোকেট।

তার পরিচয়টা কি জানতে পারি?

আহামোর মাদার ডুরান্ড। নিশ্চয়ই চেনেন, সেই বুড়ি ডাইনিটা।

না রে, অমন কাউকে চিনি না আমি।

ওহ! আমি খুব ভালভাবে চিনি। ডাইনিদের উৎসবে ওকে ঝাড়ুতে করে উড়তে দেখেছি!

ঝাড়ুতে করে উড়তে দেখেছিস?

পরিষ্কার দেখেছি। তাছাড়া ওর বাড়িতে একটা কালো ছাগল আছে যেটাকে সে পূজা করে।

কিন্তু মহিলা কেন এসে তোকে দুঃস্বপ্ন দেখাবে?

প্রতিশোধ নিতে। একদিন মাঝরাতে ওকে শয়তানের চক্রের চারদিকে নাচতে দেখে ফেলেছিলাম।

খুবই গুরুতর অভিযোগ এনেছিস ওর বিরুদ্ধে। আমাকে যা বলেছিস, তা অন্য কাউকে বলার আগে তোর উচিত নিরেট প্রমাণ যোগাড় করা।

প্রমাণ? প্রমাণ কেন লাগবে? গ্রামের সবাই জানে যৌবনে সে নেকড়েদের নেতা থিবল্টের রক্ষিতা ছিল।

ব্যাপারটা আমাকে একটু তলিয়ে দেখতে হবে মোকেট।

আমার দেখা হয়ে গেছে। ওই বুড়ি ছুঁচোকে মাশুল দিতেই হবে!

ছুঁচো শব্দটা মালি পিয়েরের কাছ থেকে ধার করা। বাগানের সবচেয়ে বড় শত্রু ছুঁচো। তাই মালি যাকে বা যেটাকে সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করে, সেটাকেই ছুঁচো বলে গাল দেয়।

বাবা এসব কু-সংস্কারে বিশ্বাস করেন না। এমনকি মোকেটের দুঃস্বরিত হওয়াকেও গুরুত্ব দেননি। কিন্তু তিনি জানতেন এসব গুজবের ফলে অনেক দুঃখজনক এবং নির্মম ঘটনা ঘটেছে। মাদার ডুরান্ডের কথা বলার সময় মোকেট যেভাবে পিস্তলটা চেপে ধরেছিল, তাতে বাবা ভবিষ্যৎ কোন বিপর্যয় এড়ানোর জন্যই তলিয়ে দেখার কথা বলেছেন। যাতে মোকেটের মনে হয়, তিনি কথাটা গুরুত্বের সাথে নিয়েছেন।

 ৫

যা-ই হোক, মোকেট। কাউকে দায়ী করার আগে দেখা দরকার, কেউ তোর দুঃস্বপ্ন দেখা বন্ধ করতে পারে কি না? প্রশ্রয় পেয়ে মোকেট কিছুটা প্রভাবিত হয়েছে ভেবে বললেন বাবা।

কেউ পারবে না, জেনারেল, জোর গলায় ঘোষণা করল মোকেট।

কী বলিস! কেউই পারবে না?

কেউ না। অসম্ভব চেষ্টাও করেছি আমি।

কীভাবে করেছিস?

প্রথমে এক বালতি মদ খেয়ে বিছানায় গেলাম!

তা নিদানটা কে দিল? মঁসিয়ে লুকোস? মঁসিয়ে লুকোস গ্রামের নামকরা ডাক্তার।

মঁসিয়ে লুকোস? সে মন্ত্র-তন্ত্রের কী জানে? না না, সে না।

তাহলে?

লোপো-এর রাখাল।

তাই বলে এক বালতি মদ? তোর তো বেহেড মাতাল হয়ে থাকার কথা রে!

অর্ধেকটা রাখালই খেয়েছিল।

আচ্ছা। এখন বুঝতে পারছি, ব্যাটা কেন এই নিদান দিয়েছিল। তা এক বালতি মদে কাজ হলো?

নাহ্, কোন কাজ হয়নি। বরাবরের মতোই স্বপ্নে হানা দিয়ে গেছে হতভাগা বুড়িটা।

তারপর? এক বালতি মদেই তোর চেষ্টা নিশ্চয়ই শেষ হয়নি?

চোরা পশু ধরার সময় যা করি, তাই করলাম।

মোকেটের নিজস্ব কিছু শব্দের ব্যবহার আছে। ওকে দিয়ে কোনভাবেই বুনো পশু বলানো যায়নি। যখনই বাবা বুনো পশুর কথা বলত, ওর জবাব ছিল, জি, জেনারেল। চোরা পশু। বুঝতে পেরেছি।

বাবা একবার বলেই বসলেন, তুই তাহলে চোরা পশুই বলবি?

জি, জেনারেল। তবে একগুয়েমির কারণে নয়।

তাহলে কেন?

কারণ, জেনারেল, কিছু মনে করবেন না, কিন্তু আপনি একটু ভুল করছেন।

ভুল? আমি? কীভাবে?

করেছো।

বুনো পশু নয়, আপনার বলা উচিত চোরা পশু।

তা চোরা পশুটা কী?

এসব পশু শুধু রাতে বেরোয়। বিড়ালের মতো কবুতর ধরে, শিয়ালের মতো মুরগী চুরি করে, নেকড়ের মতো ভেড়া মারে। মানে-এসব পশু খুব ধূর্ত, ধোকা দিতে ওস্তাদ। সোজা কথায় চোরা পশু।

এমন যুক্তিপূর্ণ বক্তব্যের পর অবশ্য আর কিছু বলার থাকে না। বাবাও তাই চুপ মেরে গেছিলেন। আর মোকেটও জিতে গেছে ভেবে চোরাতেই আটকে রইল, বুনোতে আর ফিরল না।

চোরা পশুর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বর্ণনার মাঝপথে বাধা দিতে হলো। বাবা ও মোকেটের অবশ্য এই ব্যাখ্যার দরকার ছিল না, তাই তাদের কথা চলছিল বিনা বাধায়।

তা মোকেট, এই পশুগুলোকে ধরতে তুই কী করিস? বাবার জিজ্ঞাসা।

ফাঁত পাতি জেনারেল। ফাঁদকে সবসময়ই ফাঁত বলে মোকেট।

তুই কি বলতে চাইছিস মাদার ডুরান্ডের জন্যও তুই ফাঁদ পেতেছিস? বাবা ফাঁদই বলেছিলেন; কিন্তু কেউ ভিন্ন উচ্চারণ করলে মোকেটের সেটা পছন্দ হয় না।

মাদার ডুরান্ডের জন্য আমি আসলে ফাঁত পেতেছি।

তা ফাঁদটা কোথায় পেতেছিস? দরজার বাইরে? বোঝাই যাচ্ছে বাবা ছাড় দিতে রাজি আছেন।

আমার দরজার বাইরে? তাতে কী লাভ! প্রতিরাতে আমার ঘরে সে আসে জানি, কিন্তু কোন্ পথে আসে তা তো জানি না!

চিমনি দিয়ে?

আমার ঘরে কোন চিমনি নেই। তাছাড়া ওর উপস্থিতি টের পাওয়ার আগে ওকে দেখতে পাই না।

পরে কি দেখতে পাস?

হ্যাঁ। ঠিক যেমন এখন আপনাকে দেখছি।

কী করে সে?

বুঝতেই পারছেন, ভাল কিছু না। আমার বুকের উপর উঠে ধুপ ধাপ লাফায়!

তো তোর ফাঁদটা কোথায় পেতেছিলি?

ফাঁত, কেন, আমার পেটে!

তা কী ধরনের ফাঁত ব্যবহার করেছিস? বোধহয় বিরক্ত হয়েই ফাঁদ বলা বাদ দিলেন বাবা।

খুবই ভাল ফাঁত।

কী ছিল সেটা?

ধূসর নেকড়েটাকে ধরতে যে ফাঁতটা ব্যবহার করেছিলাম, মঁসিয়ে দিথু নেলের ভেড়াগুলোকে মারত যেটা।

ভাল হলো কোথায়? ধূসর নেকড়েটা তো তোর টোপকে খেয়ে ভেগেছিল।

জেনারেল, আপনি জানেন কেন ওটা ধরা পড়েনি।

না, জানি না।

কারণ ওটা আসলে ছিল স্যাবট কারিগর থিবস্টের কালো নেকড়ে।

ওটা থিবল্টের কালো নেকড়ে হতেই পারে না। তুই এই মাত্র নিজেই বললি মঁসিয়ে দিথু নেলের ভেড়া ধরে নিয়ে যেত একটা ধূসর নেকড়েটা!

এখন ধূসর; কিন্তু ত্রিশ বছর আগে থিবল্ট যখন বেঁচে ছিল, তখন ওটা কালোই ছিল। প্রমাণ দেখবেন? আমার চুলই দেখুন। ত্রিশ বছর আগে কালোই ছিল, কিন্তু এখন ডক্টরের মতো ধূসর হয়ে গেছে!

ডক্টর হচ্ছে একটা বিড়ালের নাম। কোটের মতো দেখতে লোমের কারণে এই নাম দেয়া হয়েছে।

থিবল্টকে নিয়ে তোর গল্পটা জানি। তোর দাবি অনুযায়ী, কালো নেকড়েটা যদি আসলেই শয়তান হয়ে থাকে, তাহলে তো রঙ পাল্টানোর কথা না।

অবশ্যই না, জেনারেল। সাদা হতে ওর একশো বছর সময় লাগে। তারপর এক মাঝরাতে ও আবার কয়লার মতো কালো হয়ে যায়!

আচ্ছা বাদ দে! একটা কথা বলি, পনেরো বছর বয়স হওয়ার আগ পর্যন্ত তুই আমার ছেলেকে এই গল্প বলবি না।

কেন, জেনারেল?

নেকড়ে সাদা হোক, কী ধূসর বা কালো; যতদিন নেকড়ের গল্প শুনে হাসার মতো বড় না হচ্ছে, ততদিন এসব উদ্ভট কথা দিয়ে ওর মাথা ভারি করার কোন দরকার নেই।

আপনার আদেশ শিরোধার্য, জেনারেল। ওনাকে আমি এসব কিছুই বলব না।

তারপর বল।

কোথায় ছিলাম, জেনারেল?

ফাঁত পেতেছিলি তোর পেটের উপর। দাবি করছিলি খুবই ভাল ফাঁত।

আসলেই ভাল ফাঁত ছিল, জেনারেল, বিশ্বাস করুন। দশ পাউন্ড ওজন হবে। দশ পাউন্ড বলছি কেন, চেনসহ পনেরো পাউন্ড হবে। চেনটা আমার কব্জিতে জড়িয়ে রেখেছিলাম।

এরপর রাতে কী হলো?

রাতে? আরও খারাপ হলো। অন্যদিন চামড়ার জুতো পরে আসত, সেদিন। আসল কাঠের জুতো পরে।

এভাবে আসে…?

প্রতিটা রাত। দেখতেই পাচ্ছেন, জেনারেল, আমি শুকিয়ে যাচ্ছি। সেকারণেই, আজ সকালে সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললাম।

কী সিদ্ধান্ত নিলি?

পিস্তল নিয়ে ওর মুখোমুখি হব!

সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত। তা কখন ঘটনাটা ঘটবে?

আজ সন্ধ্যায়, না হলে কাল অবশ্যই, জেনারেল।

ঝামেলা হয়ে গেল! তোকে ভিলার-সেইলনে পাঠাব ভাবছিলাম।

সমস্যা নেই, জেনারেল। এখনই যেতে হবে?

হ্যাঁ, এখনই।

বেশ, ভিলার-সেইলনে যাব। খুব বেশি দূরের রাস্তা নয়। বনের মধ্যে দিয়ে গেলে সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরতে পারব। যাওয়া আসা মিলে প্রায় চব্বিশ মাইল হবে। শিকারে গিয়ে এরচেয়ে বেশি রাস্তা আমরা পাড়ি দিয়েছি।

তাহলে ঠিক আছে। মঁসিয়ে কলার্ডকে একটা চিঠি লিখে তোকে দিয়ে দিচ্ছি, তুই রওনা হয়ে যা।

একটুও দেরি করব না, জেনারেল।

বাবা উঠলেন। মঁসিয়ে কলার্ডকে চিঠিতে লিখলেন:

প্রিয় কলার্ড,

একটা গাধাকে পাঠালাম। তুমি ওকে চেনো। ওর মাথায় ঢুকেছে এক বুড়ি নাকি ওকে প্রতিরাতে দুঃস্বপ্ন দেখায়। ওই ভ্যাম্পায়ারের হাত থেকে বাঁচতে বুড়িকে মারার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বদহজম সারানোর এই তরিকাটা বিচারকরা ঠিক পছন্দ করবে না। তুমি ওকে দূরে কারও কাছে পাঠাও। সে যেন ওকে আরও দূরে কারও কাছে পাঠায়। এভাবে ওকে যতদূর পাঠাতে পারো। জাহান্নাম হলেও আমার আপত্তি নেই।

অন্তত দিন-পনেরো ও যেন দৌড়ের উপরে থাকে। ততদিনে আমরাও আঁটিলি চলে যাব। গাধাটাও আহামোর বাইরে চলে যাবে। আশা করা যায় এরমধ্যে দুঃস্বপ্নের ভূতও ওকে ছেড়ে যাবে। এদিকে মোকেট আশেপাশে না থাকায় মাদার ডুরান্ডও নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারবে।

গতকালের শিকার করা একটা খরগোশ আর ছয়টা পাখি পাঠালাম।

হামাইনিকে শুভেচ্ছা আর ছোট্ট ক্যারোলিনকে আমার আদর দিও।

তোমার বন্ধু,
আলেক্স দ্যুমা

ঘণ্টাখানেকের মধ্যে মোকেট রওনা হয়ে গেল। এর তিন সপ্তাহ পর আঁটিলিতে চলে এল ও।

বাবা ওর চনমনে চেহারা দেখে জিজ্ঞেস করলেন, তো, মাদার ডুরান্ড আর কী করল?

হাসিমুখে মোকেট বলল, জেনারেল, বুড়ি ছুঁচোটার নিজের এলাকার বাইরে কোন ক্ষমতাই নেই!

মোকেটের দুঃস্বপ্ন দেখার ওই ঘটনার পর বারো বছর পেরিয়ে গেছে। আমার বয়সও পনেরো ছাড়িয়েছে। বাবা মারা গেছেন দশ বছর হলো। আগের কাজের লোকদের কেউ আর নেই। বাড়িও পাল্টেছে। ভিলারস কটেরেটে থাকি এখন আমরা। ঝর্ণার উল্টোদিকের একটা ছোট্ট বাড়িতে।

খেলাধুলার প্রতি আমার খুব উৎসাহ ছিল। প্রিন্সেস বোর্গিসের মনোগ্রাম খোদাই করা একটা একনলা বন্দুক দিয়েছিলেন বাবা আমাকে। বাবার মৃত্যুর পর অনেককিছুই বিক্রি করে দেয়া হয়। কিন্তু আমার জোরাজুরিতে বন্দুকটা শেষ পর্যন্ত আর বিক্রি করা হয়নি।

শীতকাল ছিল আমার পছন্দের সময়। পাখিগুলো খাবারের খোঁজে বেরিয়ে আসত। বাবার কিছু বন্ধুর বিশাল বাগান ছিল। সেখানে গিয়ে ইচ্ছামতো পাখি শিকারের অনুমতি ছিল আমার। শীতকাল যদি দীর্ঘায়িত হত, তাহলে আরেকটা ঘটনার সম্ভাবনা বাড়ত। যদি কোন নেকড়ের বাসা খুঁজে বের করা যেত, তবে সবাই মিলে নেকড়ে শিকারে বেরোত। মায়ের শত আপত্তি সত্ত্বেও আমি বন্দুক নিয়ে সামিল হতাম।

১৮১৭ আর ১৮১৮-এর শীত বেশ চরম আর লম্বা ছিল। একদিন বেলা চারটার দিকে মোকেট এসে হাজির। আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল। আমি ওর পিছু নিলাম।

কী হয়েছে, মোকেট?

বুঝতে পারছেন না?

নাহ।

তাহলে বুঝতে পারছেন না আহামো না গিয়ে আপনার মায়ের কাছ থেকে বারুদ কিনছি কেন? আচ্ছা, সংক্ষেপে বলি, পৌনে এক মাইলের বদলে তিন মাইল হেঁটে এসেছি, তারমানে নিশ্চয়ই কোন শিকারের প্রস্তাব আছে?

তাই নাকি মোকেট? কী শিকার? কোথায়?

নেকড়ে, মঁসিয়ে আলেক্সান্ডার।

সত্যি?

গতরাতে, মঁসিয়ে দিথু নেলের একটা ভেড়া ধরে নিয়ে গেছে। আমি বনের কাছে ওটার ছাপ খুঁজে পেয়েছি।

তারপর?

তারপর আর কী? আমি নিশ্চিত আজ রাতে ওটাকে আবার দেখা যাবে। তখন ওটার ডেরাও খুঁজে পাওয়া যাবে। ব্যস, কাল সকালে সব খতম।

দারুণ!

প্রথমে আমাদের অনুমতি নিতে হবে মাদামের কাছ থেকে।

চলো, এখনই যাই।

জানালা দিয়ে মা আমাদের লক্ষ করছিলেন। দেখেই বুঝেছেন কোন একটা ষড়যন্ত্র চলছে। আমরা ঢুকতেই তিনি বললেন, তোমাকে নিয়ে আর পারি না, মোকেট।

কেন, মাদাম?

আসতে না আসতে ওকে উসকে দিচ্ছ শিকারের জন্য।

না মাদাম, এটা ওনার রক্তেই আছে। ওনার বাবাও শিকারি ছিলেন, উনিও শিকারি; ওনার ছেলেও তা-ই হবে। আপনাকে মানিয়ে নিতে হবে।

ওর যদি ভাল-মন্দ কিছু হয়ে যায়?

জেনারেলের ছেলের কোন ক্ষতি হবে? মোকেট সাথে থাকতে? জীবন বাজি রাখতে রাজি। কখনও হবে না। কখনও না।

মা মাথা নাড়তে লাগলেন। আমি কাছে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলাম।

লক্ষ্মী, মা। যাই? অনুরোধ করলাম।

মোকেট, তুমি ওর বন্দুকে গুলি ভরে দেবে।

চিন্তা করবেন না। ঠিক মতো গুলি ভরে দেব।

সবসময় ওর সাথে থাকবে।

থাকব, একেবারে ছায়ার মতো।

আমি ওকে শুধু তোমার দায়িত্বে ছাড়ছি, মোকেট।

এবং নিরাপদে আপনার কাছে ফিরিয়ে আনব। তো, মঁসিয়ে আলেক্সান্ডার, তৈরি হয়ে নিন। মায়ের অনুমতি পাওয়া গেছে।

আজ বিকেলে তো তুমি ওকে নিতে পারবে না, মোকেট।

সকালে অনেক দেরি হয়ে যাবে, মাদাম। ভোরেই নেকড়েটার পিছু নেব।

নেকড়ে। তুমি ওকে নেকড়ে শিকারে নিতে এসেছ?

আপনি কি ভয় পাচ্ছেন যে নেকড়েটা আপনার ছেলেকে খেয়ে ফেলবে?

মোকেট! মোকেট!

আমি তো আপনাকে কথা দিলাম যে আমি দায়িত্ব নিচ্ছি!

তা ও কোথায় ঘুমোবে?

অবশ্যই মোকেটের সাথে। তুষারের মতো সাদা ভাল চাদর বিছিয়ে দেব। দুটো গরম কাপড়ও থাকবে যাতে শীত না লাগে।

মা, কিছু চিন্তা কোরো না, আমি ঠিকই থাকব। মোকেট, আমি তৈরি।

যাবার সময় মা-কে একটা চুমুও খাবি না?

একটা কেন মা, অনেকগুলো খাব। বলেই মা-কে জড়িয়ে ধরলাম।

তোকে আবার কখন দেখতে পাব?

মোকেট বলল, সন্ধ্যা হবে ফিরতে ফিরতে।

সন্ধ্যায় তুমি তো মাত্রই বললে ভোরে বেরোবে!

যদি নেকড়েটাকে মারতে না পারি, তাহলে নদীর ধারে দুয়েকটা পাখি শিকার করতে নিয়ে যাব।

আচ্ছা! তুমি আমার ছেলেটাকে ডুবিয়ে মারার ধান্ধা করছ।

ঈশ্বর জানেন, আপনি যদি জেনারেলের বিধবা না হতেন, তাহলে বলতাম…

কী? কী বলতে?

বলতাম আপনি ছেলেটাকে এখনও কোল থেকে নামাচ্ছেন না। চিন্তা করুন একবার! আপনার মতো যদি জেনারেলের মা-ও ছেলেকে কোল-ছাড়া না করতেন, তাহলে কি জেনারেল সমুদ্র পেরিয়ে অভিযানে যেতে পারতেন?

ঠিকই বলেছ, মোকেট। আমি আসলেই একটা বোকা। নিয়ে যাও, নিয়ে যাও ওকে।

মা ঘুরে চোখের জল মুছে নিলেন। মায়ের একেকটা অশ্রুবিন্দু, হৃদয়ের একেকটা হীরক খণ্ড, পৃথিবীর আর সব মণির চেয়ে দামী। ছুটে গিয়ে মা-কে জড়িয়ে ধরলাম। বললাম, তুমি না চাইলে আমি যাব না, মা।

না, না মা। মোকেট ঠিকই বলেছে। আজ হোক কাল হোক, তোকে তো দায়িত্ব নেয়া শিখতে হবে।

মা-কে আরেকটা চুমু খেয়ে মোকেটের পিছু নিলাম।

কিছুদূর গিয়ে পেছন ফিরে তাকালাম। মা রাস্তার মাঝখান পর্যন্ত চলে এসেছেন। যতক্ষণ পারা যায় আমাকে দৃষ্টির সীমানায় রাখতে চাইছেন। এবার আমার চোখ আর্দ্র হয়ে এল।

কী ব্যাপার মঁসিয়ে আলেক্সান্ডার? আপনিও কাঁদছেন!

কী যে বলো না! ঠাণ্ডায় চোখ দিয়ে পানি বেরোচ্ছে।

কিন্তু যে ঈশ্বর অশ্রু দিয়েছেন তিনি জানেন, আমার চোখের পানির কারণ ঠাণ্ডা নয়।

 ৮

মোকেটের বাড়ি পৌঁছতে অনেক রাত হয়ে গেল। খরগোশের স্টু আর অমলেট দিয়ে রাতের খাবার সেরেছি। মা-কে দেয়া কথা রেখেছে মোকেট। ভাল চাদর আর গরম কাপড় দিয়ে আমার বিছানা করে দিয়েছে।

নিন, শুয়ে পড়ুন। কাল ভোর চারটার দিকে বেরোতে হবে।

যখন তুমি বলবে, তখনই রওনা দেব।

আমি জানি আপনার ঘুম খুব গাঢ়। সকালে হয়তো পানি ঢেলে আপনার ঘুম ভাঙাতে হতে পারে।

বারবার ডাকলেও যদি তাহলে তাই কোরো। দেখা যাক।

তোমার কি ঘুমোবার তাড়া আছে?

কেন? এতরাতে আমাকে দিয়ে কী করাতে চাইছেন?

ভাবছিলাম, ছোটবেলার মতো করে যদি আমাকে গল্প শোনাতে…

আমি যদি মাঝরাত পর্যন্ত আপনাকে গল্প শোনাই, তাহলে রাত দুটোয় আমাকে কে ডেকে দেবে? আমাদের পুরুতমশাই?

তা ঠিক।

যাক, বুঝতে পেরেছেন। বিছানায় যাওয়ার পাঁচ মিনিটের মাথায় মোকেট নাক ডাকা শুরু করল। এপাশ-ওপাশ করে আমার ঘুম আসতে আসতে দুই ঘণ্টা। শিকারের আগে নিঘুম রাত তো কম যায়নি। শেষপর্যন্ত ক্লান্তির কাছে হার মানতে হলো। চারটার দিকে হঠাৎ ঠাণ্ডায় ভেঙে গেল ঘুম। মুখে হাসি নিয়ে মোকেট আমার গায়ের ওপর থেকে চাদর সরিয়ে দিয়েছে।

কী করছিলে মোকেট?

ডেরাটা খুঁজে পাওয়া গেছে।

নেকড়েটার? কে খুঁজে বের করল?

এই বুড়ো মোকেট!

চমৎকার!

কোথায় লুকিয়েছিল কল্পনাও করতে পারবেন না। তিন ওকের অঞ্চলে।

তাহলে তো আমরা ওকে বাগে পেয়ে গেছি।

আশা করি।

তিন ওকের অঞ্চল জায়গাটা জঙ্গল থেকে শ পাঁচেক পা দূরে একটা সমতল এলাকার মাঝে অবস্থিত। সেখানে অনেক গাছ আর বুনো ঝোঁপ আছে।

বনরক্ষকেরা যাবে?

মএনা, মিদে, ভেটা, লাফুইলে, সেরা সব বন্দুকবাজদের খবর দেয়া হয়েছে। মঁসিয়ে শাপোতি, আপনি আর আমি ভ্যালু থেকে, লানি থেকে মঁসিয়ে হোশদি, লে ফস থেকে মঁসিয়ে দিথু নেল, আর মাঠ রক্ষীরা কুকুরদের সামলাবে। ধরা ওকে পড়তেই হবে, এতে কোন ভুল নেই।

আমাকে ভাল একটা জায়গা বেছে দেবে, মোকেট?

আপনাকে তো বলেইছি আপনি আমার সাথে থাকবেন। তবে সব কিছুর আগে বিছানা ছাড়তে হবে।

একদম ঠিক।

আপনার অল্প বয়স বিবেচনা করে আগুনে কাঠ গুঁজে দিচ্ছি।

তোমার অশেষ দয়া। কথাটা বলার সাহস পাচ্ছিলাম না।

মোকেট কাঠ এনে আগুনে ফেলল। আমি দ্রুত তৈরি হয়ে নিলাম। আমাকে এত তাড়াতাড়ি তৈরি হতে দেখে মোকেটও অবাক হয়ে গেল।

এটা গলায় ঢেলেই রওনা হয়ে যাব আমরা, দুটো গ্লাসে হলুদ রঙের তরল ঢালল। দেখেই বুঝতে পারলাম ওটা কী।

মোকেট, তুমি তো জানো আমি ব্র্যান্ডি খাই না।

আহ, একদম বাবার মতন। তাহলে কী নেবেন?

কিছুই না।

একটা কথা আছে, খালি বাড়িতে শয়তান বাসা বাঁধে। মাদামের আদেশ অনুযায়ী আপনার বন্দুকে গুলি ভরে দিচ্ছি, ততক্ষণে পেটে কিছু দিয়ে নিন।

তাহলে এক টুকরো রুটি আর এক গ্লাস পিনিউলে নেব। পিনিউলে হচ্ছে এক প্রকারের ওয়াইন। জিনিসটা এমন জায়গায় বানানো হয়, যেখানে ওয়াইন তৈরির কাঁচামাল পাওয়া যায় না। খেতে তিনজন লোক লাগে। একজন খায় আর দুজন তাকে ধরে রাখে। আমার অবশ্য কোন অসুবিধা হয় না। খাওয়া শেষ হতে হতে দেখি মোকেটের কাজও শেষ।

কী করছ, মোকেট?

আপনার গুলিতে ক্রুশ চিহ্ন এঁকে রাখছি। আপনি তো আমার পাশেই থাকবেন। একসাথেই গুলি ছুঁড়ব। চিহ্ন থাকলে কার গুলিতে নেকড়েটা মরল বোঝা যাবে। নিশানা সোজা রাখবেন?

আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।

এই যে আপনার বন্দুক, শিকারের জন্য তৈরি। কাঁধে নিন, চলুন বেরিয়ে পড়ি।

পাঁচটার মধ্যেই শভিনি যাওয়ার রাস্তায় সবাই মিলিত হলো। ঠিক হলো-দূরত্ব বজায় রেখে তিন ওকের অঞ্চল নিঃশব্দে ঘিরে ফেলব আমরা। সবাইকে খেয়াল রাখতে বলা হলো যাতে নেকড়েটা পালিয়ে না যায়। এরমধ্যে মোকেটের হাউন্ডগুলোকে সামলে রাখা হবে।

সবাই যার যার অবস্থান নিয়ে নিল। আমার আর মোকেটের জায়গা পড়ল উত্তরের বনের দিকে।

এলাকাটা ঘিরে ফেলার পর কুকুরগুলোকে ছেড়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল সবাই। বার দুয়েক ডেকে কুকুরগুলোও ঠাণ্ডা হয়ে গেল, এক পা-ও আর এগোয় না।

কিপার বলল, মোকেট, তোমার এই নেকড়েটা মনে হচ্ছে বিশেষ ধরনের। হোকাড়ু ও টুষে তো নড়তেই চাইছে না।

মোকেট জবাব না দিয়ে চুপ করে রইল। চায় না নেকড়েটার কাছে ওর অবস্থান ফাঁস হয়ে যাক।

কিপার গাছে বাড়ি দিতে দিতে এগোল। কুকুরগুলোও সাবধানে পেছন পেছন একপা একপা করে এগোতে লাগল। ঘেউ ঘেউ না করলেও মাঝে মাঝে মৃদু গরগর করছে।

হঠাৎ কিপারের চিৎকার শোনা গেল। আরেকটু হলেই নেকড়েটার লেজ মাড়িয়ে দিয়েছিলাম। মোকেট। খেয়াল রেখো!

তখনই নেকড়েটা লাফ দিয়ে আমাদের মাঝ দিয়ে বিদ্যুতের মতো ছুটে বেরিয়ে গেল। বিশাল আকার ওটার, বয়সের কারণে সাদা হয়ে গেছে গায়ের রঙ। ঘুরেই ওটাকে লক্ষ্য করে দুটো গুলি ছুঁড়ল মোকেট। আমি দেখলাম লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গুলি দুটো বরফে নাক গুঁজেছে।

গুলি করো! গুলি করো! আমাকে তাগিদ দিল মোকেট।

তাক করে গুলি ছুঁড়লাম। নেকড়েটাকে দেখে মনে হলো কাঁধ কামড়ে ধরতে চাইছে।

লেগেছে! ছেলেটা গুলি লাগিয়েছে।

কিন্তু নেকড়েটা না থেমে মনা আর মিদে যেদিকে আছে সেদিকে ছুটে গেল।

নেকড়েটা খোলা প্রান্তরে থাকতেই ওরা প্রথম দফা গুলি ছুঁড়ল। ওটা জঙ্গলে ঢুকতে দ্বিতীয় দফা। কল্পনা করা কঠিন যে ওদের গুলি ফসকে গেছে। একটাও গুলি মিস না করে, মনাকে সতেরোটা পাখি পর পর শিকার করতে দেখেছি আমি নিজে। আর মিদেকে দেখেছি এক গাছ থেকে আরেক গাছে লাফ দিয়ে যেতে থাকা কাঠবিড়ালি পেরে ফেলতে।

জঙ্গলে নেকড়েটাকে খুঁজতে গেল কিপাররা। একটু পর ব্যর্থ হয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে ফিরে এল।

এতক্ষণে বহুদূর চলে গেছে ওটা।

পালিয়ে গেছে। তারমানে ওদিককার গাধাগুলোও মিস করেছে।

বলে কী লাভ? তুমি নিজেও তো মিস করেছ।

কোন একটা অশুভ ব্যাপার আছে এরমধ্যে। আমার মিস না হয় হলো, তাই বলে মনাও দুবার মিস করবে, এটা তো সম্ভব না।

কিন্তু তাই ঘটেছে।

মোকেট আমাকে বলল, সে যাই হোক, আপনি কিন্তু লাগিয়েছেন।

১০

তুমি… তুমি নিশ্চিত?

আমাদের জন্য ব্যাপারটা লজ্জাজনক। তবে আমার নাম মোকেট, এটা যেমন সত্যি; আপনি গুলি লাগিয়েছেন-সেটাও তেমন সত্যি।

আমার গুলি যদি লেগে থাকে, তাহলে বরফে রক্ত থাকবে। এসো মোকেট, দেখে আসি। বলেই ছুট লাগালাম।

দাঁত কিড়মিড় করে পা দাপিয়ে মোকেট বলল, আর যা-ই করুন, দয়া করে ছুটবেন না। যতক্ষণ না পুরো ঘটনাটা পরিষ্কার হচ্ছে, আমাদের সাবধানে। চলাফেরা করা উচিত।

ঠিক আছে, চুপিচুপিই সই, তবু চলো।

মোকেট নেকড়েটার পায়ের ছাপ অনুসরণ করতে শুরু করল।

ছাপ হারানোর ভয় নেই।

সেটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

হুম। কিন্তু আমি অন্য জিনিস খুঁজছি।

কী?

দুই-এক মিনিটের মধ্যেই জানতে পারবে।

অন্য শিকারিরাও এসে আমাদের সাথে যোগ দিল। কিপার পরিস্থিতিটা তাদের ব্যাখ্যা করে বোঝাল। এদিকে আমি আর মোকেট পায়ের ছাপ পর্যবেক্ষণ করছি। বরফে গম্ভীর হয়ে বসে গেছে ছাপগুলো। অবশেষে আমরা কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছলাম।

দেখেছ মোকেট, আমার গুলিটাও লাগেনি।

কীভাবে বুঝলেন?

বরফে কোন রক্তের দাগ নেই।

তাহলে বরফে আপনার গুলির চিহ্নটা খুঁজে বের করুন।

যেদিকে গুলিটা যেতে পারে সেদিকে এগোলাম। অনেকটা জায়গা জুড়ে ব্যর্থ অনুসন্ধান চালিয়ে মোকেটের কাছে ফিরে এলাম। কিপারদের এগোবার ইঙ্গিত করে ঘুরে আমাকে বলল, বুলেট?

খুঁজে পাইনি।

আমি তো তাহলে আপনার চেয়ে ভাগ্যবান। আমি খুঁজে পেয়েছি।

তুমি পেয়েছ?

আসুন আমার সাথে।

বাকি শিকারিদের সাথে আমিও মোকেটের কাছে গেলাম। মিদে আর মএনাও যোগ দিল। মোকেট ওদের দিকে তাকাল, কী খবর?

দুজনেই বলল, গুলি মিস করেছে।

প্রান্তরের গুলি মিস করতে দেখেছি। কিন্তু জঙ্গলের গুলি?

ওগুলোও লাগাতে পারেনি।

তোমরা নিশ্চিত?

দুটো গুলিই গাছের গুঁড়িতে পাওয়া গেছে।

ভেটা বলল, বিশ্বাস হতে চাইছে না।

হুম, কিন্তু একটা জিনিস দেখানোর আছে যেটা বিশ্বাস করা আরও কঠিন হবে।

দেখাও তাহলে।

ওদিকে বরফের ওপর তাকাও। কী দেখতে পাচ্ছ?

নেকড়ের পায়ের ছাপ, তো?

ডান পায়ের ছাপের দিকে খেয়াল করো, দেখতে পাচ্ছ?

একটা ছোট্ট ফুটো।

কী বুঝলে? বিস্ময়ে শিকারিরা একজন আরেকজনের দিকে তাকাল।

কী বুঝলে? আবার জিজ্ঞেস করল মোকেট।

অসম্ভব!

অসম্ভব হলেও সত্যি। আমি প্রমাণ করে দেব। বলে বরফে হাত ঢুকিয়ে দিল। একটুক্ষণ হাতড়ে একটা চ্যাপ্টা বুলেট বের করে নিয়ে এল।

এটা তো আমার গুলিটা। বললাম আমি।

চিনতে পারছেন তাহলে?

অবশ্যই, তুমিই তো চিহ্ন দিয়ে রেখেছিলে।

কী চিহ্ন দিয়েছিলাম?

ক্রুশ চিহ্ন।

সবাই দেখেছেন?

হ্যাঁ। কিন্তু এর ব্যাখ্যা কী?

আর দশটা সাধারণ গুলি ফিরিয়ে দিতে নেকড়েটার কোন সমস্যা হয়নি। কিন্তু ক্রুশ চিহ্ন আঁকা গুলি সে ফেরাতে পারেনি। আমি ওটাকে দেখেছি কাঁধ কামড়ে ধরার চেষ্টা করতে।

শিকারিদের মাঝে নীরবতা নেমে এল। আমি প্রশ্ন করলাম, কিন্তু গুলিটা যদি লেগেই থাকবে, তাহলে মরল না কেন নেকড়েটা?

কারণ গুলিটা সোনা বা রূপো দিয়ে তৈরি নয়; আর ওই দুই ধাতুর তৈরি নাহলে কোন গুলির ক্ষমতা নেই শয়তানকে বা তার অনুসারীদের মারার বা তাদের চামড়া ভেদ করার।

কেঁপে উঠে একজন কিপার বলল, মোকেট, তুমি নিশ্চয়ই ভাবছ না…

অবশ্যই তা ভাবছি। আজ আমরা স্যাবট-কারিগর, থিবল্টের নেকড়ের মুখোমুখি হয়েছিলাম।

সবাই একজন আরেকজনের দিকে তাকাতে লাগল। দু-তিন জন বুকে ক্রুশ আঁকল। বোঝা যাচ্ছে, সবাই থিবল্টের নেকড়ের গল্পটা জানে এবং মোকেটের সঙ্গে একমত। একা আমিই কিছু জানি না। অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করলাম, এই স্যাবট-কারিগর থিবল্টের নেকড়ের ঘটনাটা কী?

মোকেট একটু ইতস্তত করে জবাব দিল, জেনারেল বলেছিলেন আপনার বয়স পনেরো হওয়ার আগে যেন এই গল্পটা না বলি। আপনার বয়স তো পনেরো হয়েছে, তাই না?

আমি কিছুটা গর্বের সুরেই বললাম, আমার মোলো চলছে।

তাহলে তো হয়েই গেল, মঁসিয়ে আলেক্সান্ডার। স্যাবট-কারিগর থিবল্টের নেকড়ে হচ্ছে স্বয়ং শয়তান। কাল রাতে আপনি গল্প শুনতে চেয়েছিলেন না?

হ্যাঁ।

আমার সাথে বাড়ি চলুন। আজ আপনাকে একটা গল্পের মতো গল্প বলব।

শিকারি এবং কিপারেরা মাথা নেড়ে যে যার পথ ধরল। আমিও মোকেটের সাথে ফিরে এলাম। তারপর মোকেট আমাকে যে গল্পটা বলল, সেটাই আমি এখন আপনাদের বলব। আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে কেন আজ এত বছর পর গল্পটা আমি বলছি। আসলে এই গল্পটা আমার স্মৃতির এক মণিকোঠায় লুকিয়ে ছিল। দিন তিনেক আগে আবার খুঁজে পেয়েছি। কী আমাকে গল্পটা বলতে উৎসাহিত করল তা আমি বলতে পারি, কিন্তু ভয় হচ্ছে তা আপনাদের ভাল না-ও লাগতে পারে। আর তাছাড়া বলতে সময় লাগবে। তাই অহেতুক দেরি না করে গল্পটা শুরু করছি।

আমার গল্প শুরু করি। বলা ভাল মোকেটের গল্প, আমার ভাষায়। আটত্রিশ বছর যদি একটা ডিমের ওপর বসে থাকেন, সে-ই ডিমটা আপনি পেড়েছেন না অন্য কেউ, তাতে বোধহয় খুব বেশি কিছু যায় আসে না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *